Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ১৬



রামন ইফেক্ট কী?

১৯২০ থেকে ১৯২৮ সালে রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের আগপর্যন্ত আলোর ধর্ম নিয়ে পৃথিবীব্যাপী অনেকেই গবেষণা করছিলেন। ইংল্যান্ডে লর্ড র‍্যালে, প্যারিসে জাঁ ক্যাবানিস, নিউইয়র্কে রবার্ট উড, এবং মস্কোর ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্সে গ্রিগরি ল্যান্ডসবার্গ এবং লিওনিদ ম্যান্ডেলেস্ট্যাম আলোর বিক্ষেপণ বা স্ক্যাটারিং, ও বিচ্ছুরণের ধর্ম নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। আর কলকাতায় বসে জোরোসোরে কাজ করছিলেন প্রফেসর রামন।
            লর্ড র‍্যালে ইলাস্টিক স্ক্যাটারিং (elastic scattering) এর ধর্ম ব্যাখ্যা করেছিলেন। যদি কোন আলোর কণা (ফোটন) কোন বস্তুকণার সাথে ধাক্কা খেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করে এবং যদি সেই পরিবর্তিত ফোটনের শক্তি আগের ফোটনের শক্তির সমান থাকে, তাহলে সেই স্ক্যাটারিং-কে ইলাস্টিক স্ক্যাটারিং বলা হবে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলোর তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ও শক্তির সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।[1] কম্পাঙ্ক ও শক্তির সম্পর্ক সমানুপাতিক। তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে শক্তিও তত বেশি হবে। আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কের মধ্যে সম্পর্ক বিপরীতানুপাতিক। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি হবে, কম্পাঙ্ক তত কম হবে, আবার কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হবে। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট-মাপের কোন বস্তুকণার সাথে যদি আলোর ধাক্কা লাগে সেক্ষেত্রে যে ইলাস্টিক স্ক্যাটারিং হয় তার নাম র‍্যালে-স্ক্যাটারিং। এধরনের বিক্ষেপণে মোট শক্তির পরিমাণের কোন তারতম্য হয় না। অর্থাৎ বিক্ষেপণ হবার আগে আলোর যে শক্তি ছিল, বিক্ষিপ্ত হবার পরেও সেই একই পরিমাণ শক্তি থাকবে। ফলে তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কিংবা কম্পাঙ্কের কোন পরিবর্তন হবে না।
            রামন যে স্ক্যাটারিং পর্যবেক্ষণ করেন (যা পরে রামন-স্ক্যাটারিং হিসেবে আমরা জানি) তা হলো ইনইলাস্টিক স্ক্যাটারিং (inelaastic scattering)। ইনইলাস্টিক স্ক্যাটারিং-এ ফোটনের শক্তির পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন পরিমাণে খুবই কম হলেও পদার্থবিজ্ঞানের পরিমাপে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।




কোন পদার্থের কণার সাথে যখন আলোর কণা বা ফোটনের ধাক্কা লাগে তখন সেই ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন দুভাবে হতে পারে। ধাক্কার পরে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়েও যেতে পারে, আবার কমেও যেতে পারে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো শক্তি কমে যাওয়া, আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যাওয়ার অর্থ হলো শক্তি বেড়ে যাওয়া। এই কমা-বাড়ার পরিমাণটা খুবই ছোট। ফলে আলোর বেশিরভাগ কণার শক্তির কোন পরিবর্তন হয় না, খুব সামান্য অংশেরই পরিবর্তন হয়। এই খুব সামান্য পরিবর্তনটা রামন আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন বলেই এই ঘটনাকে রামন-ইফেক্ট বলা হয়। কঠিন, তরল, বায়বীয় যে কোন অবস্থার পদার্থের মধ্যে আলো প্রবেশ করলে এই ব্যাপারটা ঘটে। এবং কোন্‌ পদার্থে কী পরিমাণে শক্তির পরিবর্তন হবে তা নির্দিষ্ট। অর্থাৎ হাইড্রোজেনে যে পরিবর্তন হবে, নাইট্রোজেনে পরিবর্তন হবে তার চেয়ে ভিন্ন, বাতাসে হবে একরকম, পানিতে হবে আরেকরকম - ইত্যাদি। তার মানে রামন-ইফেক্ট কাজে লাগিয়ে পদার্থের রাসায়নিক পরিচয় শনাক্ত করা যায়।
            বিক্ষেপণের ফলে শক্তির বাড়া-কমার ব্যাপারটা আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক। দু-ধরনের রামন-ইফেক্ট হতে পারে।
            (১) বস্তুর ভেতর দিয়ে আলো যাবার সময় বস্তুকণা আলোর ফোটনের কিছু শক্তি শোষণ করে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে যে ফোটন বেরিয়ে আসবে তার শক্তি হবে যে ফোটন ঢুকেছিল তার চেয়ে কম। অর্থাৎ তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে আগের তুলনায় বেশি। এরকম ঘটনা ঘটলে তাকে বলা হয় স্টোক্‌স রামন-স্ক্যাটারিং। ১৮৫২ সালে বিজ্ঞানী জর্জ স্টোক্‌স এরকম ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। জর্জ স্টোক্‌সকে সম্মান জানিয়ে এরকম ঘটনার নাম দেয়া হয়েছে স্টোক্‌স-রামন স্ক্যাটারিং।
            (২) স্টোক্‌স-রামন ইফেক্টে যা ঘটে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। আলো কোন মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যাবার সময় সেই মাধ্যম থেকে কিছু শক্তি শোষণ করে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। তখন যে ফোটন বের হবে তার শক্তি, যে ফোটন ঢুকেছিল তার শক্তির চেয়ে বেশি হবে। অর্থাৎ তার তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য কম হবে। এরকম ঘটনাকে বলে বিপরীত স্টোক্‌স বা অ্যান্টি-স্টোক্‌স রামন স্ক্যাটারিং।
            রামন-ইফেক্টের ফলে আলোর যে পরিবর্তিত বর্ণালী দেখা যায় তাকে রামন-স্পেক্‌ট্রা (Raman Spectra) আর যে পরিবর্তিত রেখা দেখা যায় তাকে রামন-রেখা বা রামন-লাইন (Raman Line) বলা হয়।



রামন-রেখা

পর্যায় সারণির মৌলিক পদার্থগুলোর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা দিয়ে যেমন পদার্থটি কী তা চেনা যায়, যেমন ছয়টি প্রোটন থাকলে কার্বন, আটটি থাকলে অক্সিজেন ইত্যাদি, সেরকম রামন-স্পেকট্রামও পদার্থের মধ্যে নির্দিষ্ট। এক পদার্থের রামন-স্পেকট্রাম অন্য পদার্থের রামন স্পেক্‌ট্রামের চেয়ে ভিন্ন। ফলে রামন-স্পেকট্রামকে বলা চলে পদার্থের সুনির্দিষ্ট পরিচয়-পত্র। বর্তমানে রামন-স্পেকট্রোস্কোপ হলো রাসায়নিক পদার্থের উপাদান বিশ্লেষণের একটি প্রধান নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
            বর্তমানে উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে অ্যলোর অতি সূক্ষ্ম পরিবর্তনও রেকর্ড করা যায়। কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে নিখুঁতভাবে ডাটা বিশ্লেষণ করা যায়। অথচ সেই সময়ে রামন অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে খুবই সহজ কিছু যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। রামন পরবর্তীতে অনেকবার উল্লেখ করেছেন যে মাত্র দুইশ রুপির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তিনি নোবেল পুরষ্কার নিয়ে এসেছেন।


           
রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বিক্ষিপ্ত আলো চিহ্নিত করা। বিক্ষিপ্ত আলোর তীব্রতা এত কম যে কোনভাবেই সেই আলো ধরা যাচ্ছিল না। সূর্যের আলো তরল পদার্থে প্রবেশ করানোর জন্য তিনি শুরুতে যন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত আয়না ব্যবহার করেছিলেন। এই আয়নাটি সূর্যের আলো যেদিক থেকে আসে সেদিকে ঘুরে যায়, ফলে দিনের বেলার পুরোসময়েই সূর্যের আলো পাওয়া যায়। ঘন্টার পর ঘন্টা এই কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু রামন বুঝতে পারেন যে সূর্যের আলোর যেটুকু পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে আসে সেগুলোর তীব্রতা এই পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি ভাবলেন দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে সূর্যের আরো কাছ থেকে আলো নিয়ে আসা যায়, যেগুলোর তীব্রতা স্বাভাবিক আলোর চেয়ে বেশি হবে।
            ১৯২৭ সালে তিনি সাত ইঞ্চি ব্যাসের রিফ্রাক্টিং-টেলিস্কোপ ব্যবহার করতে শুরু করলেন। টেলিস্কোপের লেন্সের সাথে একটি কম ফোকাস দূরত্বের লেন্স জুড়ে দিলেন রামন। তাতে সূর্যের আলো কেন্দ্রিভূত হয়ে সরু এবং তীব্র-আলোকরশ্মিতে পরিণত হলো। সেই তীব্র আলোকরশ্মি ব্যবহার করা হলো আলোর উৎস হিসেবে। ১৯২৮ সালের শুরুতে মার্কারি-আর্ক ল্যাম্প ব্যবহার করে আরো তীব্র আলোকরশ্মি তৈরি করেন রামন। সেটাতে তিনি কোবাল্ট-গ্লাস ফিল্টার ব্যবহার করেন। মাঝে মাঝে তরল-ফিল্টারও ব্যবহার করেছেন। মিশ্র-বর্ণের আলোকে এক বর্ণের আলোতে পরিণত করার জন্য এসব অপ্টিক্যাল-ফিল্টার ব্যাবহার করা হয়।
           



একটা বেগুনি ফিল্টার ব্যবহার করে বেগুনি বর্ণের আলো তরলের ওপর ফেলা হলো। সেই আলোর কিছুটতরলে বিক্ষিপ্ত হলো, কিছুটা শোষিত হলো এবং কিছুটা তরলের ভেতর দিয়ে চলে গেলো। রামন-ইফেক্ট দেখার জন্য দরকার বিক্ষিপ্ত আলো। আপতিত আলোর সাথে সমকোণে আরেকটি বেগুনি ফিল্টার রাখা হলো। সেদিকে চোখ রেখে বিক্ষিপ্ত আলোর রেখা পাওয়া গেলো। এভাবে বিক্ষিপ্ত আলো হচ্ছে ইলাস্টিক স্ক্যাটারিং বা র‍্যালে স্ক্যাটারিং। বেগুনি আলো ঢুকলো তরলে, বেগুনি আলো বের হলো। অর্থাৎ শক্তির কোন পরিবর্তন হলো না। যদি আলোর শক্তির পরিবর্তন ঘটে তবে আলোর বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তরল পদার্থ যদি আলো থেকে কিছু শক্তি শোষণ করে ফেলে তাহলে দেখা যাবে স্টোক্‌স-রামন রেখা। এই রেখার রঙ বদলে যাবে। আলোর যেসব রঙ আমরা দেখি তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে বেগুনি। এখন বেগুনির শক্তি চলে গেলে - কী পরিমাণ শক্তি চলে গেছে তার উপর নির্ভর করে আলোর বর্ণ নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা কিংবা লাল যেকোনটাই হতে পারে। এই রঙের রামন-রেখা খালিচোখে দেখা যায়। কিন্তু এর বাইরেও আরো অনেক রঙ হতে পারে, যেমন অবলোহিত রেখা। সেগুলো আমরা খালিচোখে দেখতে পাবো না।  
            আবার যদি আপতিত আলো যে তরলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সেই তরলের কাছ থেকে শক্তি শোষণ করে তাহলে দেখা যাবে অ্যান্টি-স্টোক্‌স-রামন রেখা। অর্থাৎ বেগুনি রঙের আলোর শক্তি বেড়ে সেই আলো অতিবেগুনি হয়ে যাবে। এই অতিবেগুনি রশ্মি আমাদের চোখে পড়লে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
            রামন-ইফেক্ট দেখার জন্য রামন দ্বিতীয় বেগুনি ফিল্টারটা বদলে যেই সবুজ ফিল্টার দিয়েছেন, সেখানে সবুজ রামন-রেখা দেখা গেলো। এই রেখাটি স্টোক্‌স-রামন স্ক্যাটারিং-এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে।
            রামন শুরুতে এই রেখাগুলো খালিচোখেই দেখেছেন অন্ধকার ঘরে। মানুষের চোখ অনেক সূক্ষ্ম আলোর রেখা দেখতে পায়। খালি চোখে দেখে নিশ্চিত হবার পর রামন বর্ণালী-বীক্ষণ যন্ত্র বা স্পেক্ট্রোমিটার ব্যবহার করেছেন। সেই সময়ের বেবি কোয়ার্টজ স্পেকট্রোগ্রাফের ক্ষমতা খুব বেশি ছিল না। রামন ফটোগ্রাফিক প্লেটে এই রামন-রেখার ছবি তুলেছিলেন। যেহেতু এই বিক্ষিপ্ত আলোর শক্তি খুবই কম তাদের ফটোতুলতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় লাগতো। অনেক সময় প্রায় তিন-চারদিন ধরে আলো প্রবেশ করানোর পর রামন-রেখার ছবি পাওয়া যেতো।
            সেই সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে অবাক হতে হয়। বর্তমানে আলোর উৎস হিসেবে শক্তিশালী মনোক্রমিক বা এক বর্ণের লেসার রশ্মি ব্যবহার করা হয়। অপ্টিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে সেই লেসার রশ্মি পদার্থের ভেতর প্রবেশ করানো হয়। সেখানে আলোর যে বিক্ষেপণ হয় সেই আলো অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে গিয়ে ঢোকে আধুনিক ইলেকট্রনিক স্পেকট্রোগ্রাফের ভেতর। তার সাথে লাগানো থাকে খুবই সংবেদী চার্জ কাপল্‌ড ডিভাইস যা একেবারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আলোর কণাও ধরে ফেলতে পারে। সেই তথ্যকে কম্পিউটারে প্রবেশ করানো হয়। কম্পিউটারের সফ্‌টঅয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব তথ্য দিয়ে দেয়। 


আধুনিক রামন-ইফেক্ট মাপার যন্ত্রপাতি


রামন-ইফেক্ট আবিষ্কৃত হবার পর প্রচন্ড উত্তেজনা ও ব্যস্ততা অ্যাসোসিয়েশানের সবখানে। মার্চের আট তারিখে নেচার জার্নালে পাঠানো হলো আরেকটি পেপার,
রামন ইফেক্ট সংক্রান্ত নোট। কিন্তু একজন রেফারি তা প্রকাশযোগ্য নয় বলে পেপার প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু নেচার জার্নালের এডিটর দেখলেন এটা একটা সত্যিকারের যুগান্তকারী আবিষ্কার। ২১ এপ্রিল নেচারে প্রকাশিত হলো রামন ইফেক্ট আবিষ্কারের কথা।[2]

           
রামন আরো বেশ কিছু স্পেকট্রা-লাইন সংগ্রহ করলেন ধারাবাহিক পরীক্ষণের মাধ্যমে। ১৬ মার্চ তিনি ব্যাঙ্গালোরে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে তাঁর আবিষ্কারের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পরের সপ্তাহে ২২ মার্চ তারিখে তিনি নেচার সাময়িকীতে আরেকটি প্রবন্ধ পাঠালেন কম্পটন ইফেক্ট ও রামন-ইফেক্টের তুলনামূলক আলোচনা করে। পেপারটি
[3] নেচারে প্রকাশিত হয় ৫ মে।
            অ্যাসোসিয়েশান থেকে রামনের উদ্যোগে যে বুলেটিন প্রকাশিত হচ্ছিল তা পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান-সাময়িকীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। রামনের সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে 'ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স'। রামন ব্যাঙ্গালোরে যে প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেছিলেন তা ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্সে প্রকাশিত হলো ৩১ মার্চ।[4]
            রামন এই প্রবন্ধটির কপি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুই হাজার বিজ্ঞানী ও গবেষকের কাছে পোস্ট করে দিলেন। সেই সময় ইন্টারনেট ছিল না, অনলাইন পোস্টিং-এর কোন উপায় ছিল না। ভারতীয় জার্নাল ইওরোপ আমেরিকার বিজ্ঞানীরা পড়েন কি না তা রামন জানেন না। তাই ছাপানো পেপার ডাকযোগে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।  
            সারাপৃথিবীর বিজ্ঞানীরা জেনে গেলেন রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের খবর। পৃথিবীর প্রধান বিজ্ঞানীরা রামনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। আমেরিকার খ্যাতিমান আলোক-বিজ্ঞানী রবার্ট উড নেচার সাময়িকীতে লিখলেন, "রামনের এই চমৎকার আবিষ্কার আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ।"[5]
            রামন-ইফেক্ট আলোক তরঙ্গের অজানা পথ খুলে দিয়েছে। শক্তির স্তর এবং অণু ও পরমাণুর গঠন বুঝতে অনেক সহায়তা করেছে রামন-ইফেক্ট। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখায় রামন-ইফেক্ট কাজে লাগছে। জীববিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও অনেক শাখায় রামন-ইফেক্ট কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। লেজার রশ্মি আবিষ্কৃত হবার পর রামন-স্পেকট্রোস্কোপি এখন একটা অপরিহার্য বৈজ্ঞানিক শাখায় পরিণত হয়েছে।
            রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের সাথে সাথে ইওরোপ আমেরিকায় রামনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। রামনের জন্য বৈজ্ঞানিক পুরষ্কার আসতে শুরু করলো। ১৯২৮ সালেই ইতালিয়ান সোসাইটি অব সায়েন্স রামনকে মাত্তেউচ্চি (Matteucci) মেডেল প্রদান করে।
            রামনের ছেলে রাজার বয়স তখন আট বছর। রাজা জন্মাবার পর রামন আবার ব্রহ্মচারী হয়ে ছিলেন এই আট বছর। তিনি বাড়িতে থাকেন নামমাত্র। ভোর পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকেন হয় অ্যাসোসিয়েশানে, নয় ইউনিভার্সিটিতে। ঘরে কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানেন না তিনি। জানার দরকারও মনে করেন না। কারণ লোকম সবকিছু সামলাচ্ছেন।
            রামন-ইফেক্ট আবিষ্কার এবং তার পরবর্তী বিশ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখে খুশির জোয়ারে ভাসছেন রামন। তিনি জানেন নোবেল পুরষ্কার এখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। কিন্তু কখন সময় হবে তার জন্য বসে থাকলে চলবে না। বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। মনের আনন্দে লোকমের সাথেও তিনি আটবছর পর আবার ঘনিষ্ঠ হলেন। লোকম দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হলেন।



[1] শক্তি = প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক x কম্পাঙ্ক (E = hf)
[2] Raman, C.V., A change of wave-length in light-scattering, Nature, 1928, Vol.121, p619
[3] Raman, C.V.; Krishnan, K.S., The optical analogue of the Compton effect, Nature, 1928, Vol.121, p711
[4] Raman, C.V., A new radiation, Indian Journal of Physics, 1928, Vol.2, p387-398
[5] R. W. Wood, Nature, 1928, 122, p.349

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts