Saturday 19 October 2019

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ১১



সূর্যের ভবিষ্যৎ

কত বয়স হলো সূর্যের? এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা সূর্যের ভবিষ্যৎ জানার জন্য দরকারি। দেখো এখানে আমরা সূর্যের যে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলবো তা বৈজ্ঞানিক হিসাবের ব্যাপার। তোমরা যেন আবার হাতের রেখায় ভবিষ্যৎ আছে বা জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎ-বাণীতে বিশ্বাস করো না। কারণ ওসব হলো ফন্দি-ফিকির করে মানুষকে ধোকা দেয়া। যাই হোক, চলো আমরা সূর্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু কথা বলি।
            আমরা জানি সূর্য একটি সাধারণ জি-টাইপের নক্ষত্র। এর শক্তিক্ষয়ের পরিমাণ ও অন্যান্য তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন সূর্যের বর্তমান বয়স প্রায় ৪৭০ কোটি বছর। সূর্যের কেন্দ্রে প্রতি সেকেন্ডে ৭০ কোটি টন হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হচ্ছে। তা থেকে  ৫০ লক্ষ টন বিশুদ্ধ শক্তি উৎপন্ন হয় প্রতি সেকেন্ডে। তার মানে প্রতি সেকেন্ডে সূর্যের ভর কমে যাচ্ছে। এই হারে চলতে থাকলে আর পাঁচশো কোটি বছর পরে সূর্যের জ্বালানি হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যাবে।
            আগামী ৫০০ কোটি বছর পর সূর্যের হাইড্রোজেনের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। কেন্দ্রে হাইড্রোজেন কমতে থাকলে কেন্দ্রের চাপ বেড়ে যাবে। সূর্যের স্বাভাবিক চাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চাপের প্রায় ৩৪০০০ কোটি গুণ। এই চাপ আরো বেড়ে গেলে কেন্দ্রের তাপমাত্রা এক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেড়ে প্রায় দশ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যাবে। তখন হাইড্রোজেনের বদলে হিলিয়াম ব্যবহার করতে হবে জ্বালানি হিসেবে। হিলিয়াম ব্যবহারের ফলে সূর্য আরো উজ্জ্বল হবে। ফলে সূর্য এত বেশি সম্প্রসারিত হবে যে এটা বুধ শুক্রকে গিলে ফেলবে আর পৃথিবী বাষ্প হয়ে যাবে। (পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে এখনই মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ ৫০০ কোটি বছর অনেক লম্বা সময়)।
            হলুদ থেকে সূর্যের রঙ হয়ে যাবে কমলা লাল। সূর্য তখন একটা লাল দৈত্যে (red giant) পরিণত হবে। এখানে দৈত্য শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে আকারে বড় বোঝানোর জন্য। তোমরা যেন আবার ভেবে বসো না যে সুর্য একটা রূপকথার দৈত্য হয়ে তোমাদের খেতে আসবে।
            সুর্য বড় হতে হতে বর্তমান আয়তনের চেয়ে ত্রিশ গুণ পর্যন্ত বড় হয়ে যেতে পারে। লাল দৈত্য নক্ষত্র (red giant star) হিসেবে সূর্য কয়েক কোটি বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে।
            এই সময় অত্যধিক তাপের কারণে হিলিয়ামগুলো সব ফিউজ হয়ে আরো ভারী পরমাণুতে পরিণত হবে। সবগুলো হিলিয়াম শেষ হতে প্রায় এক কোটি বছর লাগবে। সমস্ত হিলিয়াম শেষ হয়ে যাবার পর কেন্দ্রে যেহেতু আর কোন শক্তি উৎপন্ন হবে না, সূর্য আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে থাকবে। বাইরের আস্তরণগুলো আসতে আসতে মহাশূন্যে খসে পড়তে থাকবে। ভেতরের সাদা কেন্দ্রটা রয়ে যাবে শ্বেত বামন (white dwarf) হিসেবে।

চিত্র: সূর্যের ভবিষ্যৎ পরিণতি

শ্বেত বামন হলো জ্বলন্ত পিন্ড যা শুধুমাত্র গরম বলেই উজ্জ্বল দেখায়, কিন্তু ভেতর থেকে কোন শক্তি উৎপন্ন হয় না। এরা মৃত নক্ষত্র। ১৯১৫ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওয়াল্টার অ্যাডামস সর্বপ্রথম একটা শ্বেত-বামন আবিষ্কার করেন। তিনি তার নাম দেন সাইরিয়াস-বি (sirius B)। তিনি হিসেব করে দেখিয়েছেন এই শ্বেত বামনের আকার পৃথিবীর সমান হলেও এর ভর প্রায় সূর্যের ভরের সমান।
            আমাদের সূর্য শ্বেত বামনে পরিণত হবার পর আস্তে আস্তে অনেক বছর পরে ঠান্ডা হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন এটা বড় কালো কয়লার পিন্ডে পরিণত হয়ে মহাশূন্যে ভাসতে থাকবে। এগুলোকে কালো বামনও বলা হয়। আগের পৃষ্ঠার ছবিতে সূর্যের ভবিষ্যৎ পরিণতি দেখানো হয়েছে।


নতুন সুর্য
সূর্য যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তার ধ্বংসাবশেষগুলো একটা নতুন নেবুলার জন্ম দেবে। সেই নেবুলা থেকে আবার আস্তে আস্তে কোটি কোটি বছর ধরে তৈরি হবে আরেকটি নতুন সূর্য।




তথ্যসূত্র
1.   John N. Bahcall, How the Sun Shines, Beam Line Winter 2011.
2.   Isaac Asimov, The Sun, Collins Publishers Australia 1988.
3.   Carmel Reilly, Sky Watching The Sun, Macmillan Library 2011
4.   Wonders of the Sun, Student Guide, NEED National Energy Education Development Project, 2012 (www.NEED.org).
5.   How the Sun Shines, Nobel e-Museum, http://www.nobel.se/, June 2000.
6.   The Sun, UV, and You: A Guide to SunWise Behavior, United States Environmental Protection Agency, 2006 (www.epa.gov/sunwise).
7.   Ginger Butcher, Mysteries of the Sun, National Aeronautics and Space Administration (NASA), 2013. 
8.   Peter Riley, Light and Colour, Franklin Watts, London, 1998.
9.   Hugh D. Young, Roger A. Freedman, University Physics with Modern Physics, 13th Edition, Addison-Wesley, Boston, 2012.

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ১০


পৃথিবীর ওপর সূর্যের প্রভাব

মানুষ সূর্যকে দেখছে অনেক অনেক বছর থেকে; উদ্ভব হওয়ার পর থেকেই। তবে টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর মানুষ সূর্যের বাইরের স্তরের কিছুটা ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছে। ১৬১৩ সালে সর্বপ্রথম টেলিস্কোপ ব্যবহার করে সূর্য পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে সরাসরি সূর্যের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে তাকানো বিপজ্জনক। আধুনিক টেলিস্কোপগুলোতে প্রয়োজনীয় ফিল্টার লাগানো থাকে যার মধ্য দিয়ে সূর্যকে নিরাপদে দেখা সম্ভব।

আমাদের সূর্য সঠিক সূর্য
 আমাদের সূর্য পৃথিবীর জন্য সঠিক সূর্য। খুব বড়ও নয়, খুব ছোটও নয়। নক্ষত্র যত বড় হয় তার আয়ুও তত কম হয়। বড় নক্ষত্রে হাইড্রোজেন বেশি থাকে, বেশি হাইড্রোজেন বেশি ফিউশান ঘটায়। ফলে বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু বড় দ্রুত সেই শক্তি উৎপন্ন করতে হয়। কারণ বড় নক্ষত্রের বেশি শক্তির দরকার হয় নিজের মাধ্যাকর্ষণ বলকে ঠেকিয়ে রাখতে। নইলে নিজে নিজে সংকুচিত হয়ে যাবে। অত্যন্ত বড় আকারের সূর্য খুব বেশি হল দশ কোটি বছর বাঁচতে পারে। তারপর সব শক্তি শেষ হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তত কম সময়ে জীবনের উদ্ভব হতে পারে না। অন্যদিকে খুব ছোট আকারের নক্ষত্র প্রায় বিশ হাজার কোটি বছর বাঁচতে পারে। কিন্তু তাদের শক্তি উৎপন্ন হয় খুবই কম। কম শক্তি উৎপন্ন হবার কারণে জীবনের উদ্ভবের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দিতে পারে না ছোট আকারের নক্ষত্রগুলো। তাই আমাদের সূর্যই পৃথিবীর জন্য যথোপযুক্ত।

সূর্যের আলোর রঙ বদলায়
 পৃথিবী থেকে সূর্যকে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রঙের দেখায়। সকালে সূর্যোদয় ও সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সময় টকটকে লাল বা কমলা রঙের দেখায়। তার একটু পরে কমলা থেকে হলুদ তারপর দুপুর আসতে আসতে তপ্ত সাদা। আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে সূর্যের আলোর মিথষ্ক্রিয়ার ফলে এরকম হয়।



চিত্র: সূর্যের আলোর রঙ বদল


দিনের আকাশ নীল, রাতের আকাশ কালো
 দিনের বেলা আমাদের আকাশ নীল দেখায়। কারণ সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসার সময় ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলো বাতাসের ধূলিকণার গায়ে লেগে বিক্ষিপ্ত হয়। তাই আকাশ নীল দেখায়। রাতের বেলায় আকাশে সূর্যের আলোর অনুপস্থিতিতে আকাশ কালো দেখায়। কারণ কোন আলো বিক্ষিপ্ত হবার সুযোগ পায় না।


চিত্র: দিনের আকাশ নীল


চিত্র: রাতের আকাশ কালো


পৃথিবীর দিন রাত, পৃথিবীর জলবায়ু
 পৃথিবীর শক্তির যোগানদাতা সুর্য। সূর্যের আকর্ষণেই পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে না। সূর্যের মহাকর্ষ বল পৃথিবীকে কক্ষপথে ধরে রাখে। পৃথিবীর দিন রাত মাস বছর সবই সূর্যকেন্দ্রিক। সূর্য না থাকলে কী হতো? পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে মহাশূন্যে মিলিয়ে যেতো। দিনরাত নিয়মিত হতো না। কারণ কার চারপাশে ঘুরবে সে? তাছাড়া অন্য গ্রহের সাথে তার সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনাও ছিল প্রচুর।

চিত্র: পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর গড়ে ২৪ ঘন্টায় একবার ঘুরে, তাই দিন-রাত্রি হয়।


পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য উপযোগী আবহাওয়া তৈরি করে দিয়েছে সূর্য। সূর্য পৃথিবীকে আলো ও তাপ দেয়। এই তাপ-শক্তির পরিমাণ পৃথিবীর সব জায়গায় সমান নয়। কোন জায়গায় গরম বেশি হলে সেই জায়গার বাতাস গরম হয়ে হালকা হয়ে যায় এবং উপরের দিকে উঠে যায়। সেই বাতাসের জায়গা দখল করতে আসে ঠান্ডা জায়গার ঠান্ডা বাতাস। ফলে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। এই বায়ুপ্রবাহ পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখে। পৃথিবীর পানি সূর্যের তাপে গরম হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়। ফলে মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়। পৃথিবীর আবহাওয়া যে প্রাণধারণ ও প্রাণের বিবর্তনের উপযুক্ত ক্ষেত্র তা সূর্যের দান।


চিত্র: পৃথিবীর জলবায়ু


পৃথিবীর ঋতু পরিবর্তন হয় সূর্যের প্রভাবে। সূর্যের সাথে পৃথিবীর অবস্থান ও সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে ঋতুপরিবর্তন ঘটে। যে সব দেশ পৃথিবীর পেট বরাবর অবস্থিত তাদের ওপর সূর্যের আলো ও তাপ পড়ার কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে সেই সব দেশের আবহাওয়া সারা বছরই প্রায় একই রকম থাকে। মালয়েশিয়া সিংগাপুর ইত্যাদি দেশে সারা বছরই গ্রীষ্মকাল।


চিত্র: সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণন ও পৃথিবীর ওপর সূর্যের তাপ ও আলোর প্রভাবে পৃথিবীর ঋতু পরিবর্তন।

সূর্যগ্রহণ
 পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ। এই চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। কেউ কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ পৃথিবী এবং সুর্যের মাঝখানে এসে পড়ে। তখন চাঁদের ছায়া পৃথিবীর উপর পড়ে। ফলে পৃথিবীর যেদিকে এই ঘটনা ঘটে সেই অঞ্চল থেকে সূর্যকে দেখা যায় না। যখন পুরো চাঁদের ছায়ার কারণে সূর্যকে একেবারেই দেখা যায় না তখন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছে বলা হয়। প্রায় ছয় সাত মিনিট থাকতে পারে এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।


চিত্র: সূর্যগ্রহণ




পৃথিবীর শক্তিদাতা সূর্য
 সূর্য পৃথিবীকে শক্তি দেয়। সূর্যের আলো ও তাপ থেকে গাছপালা খাদ্য তৈরি করে। উদ্ভিদ মাটি থেকে মূলের সাহায্যে যে খাদ্য-উপাদান শোষণ করে তা উদ্ভিদের পাতার ক্লোরোফিল ও সূর্যের আলোর মিথষ্ক্রিয়ায় উদ্ভিদের খাদ্যে পরিণত হয়। এভাবে উদ্ভিদ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। অপরদিকে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। সূর্যের আলো না থাকলে প্রাণ ধারণের এই জরুরি ব্যাপারটাই ঘটতে পারতো না।
  
চিত্র: সূর্যালোক থেকে উদ্ভিদের খাদ্যগ্রহণ


সৌরশক্তি বা সোলার এনার্জি
 পৃথিবীতে এখন জ্বালানি ছাড়া এক মুহূর্তও চলা সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের বেশিরভাগ কাজকর্মই বাধাগ্রস্ত হয়। জ্বালানি হিসেবে সৌরশক্তিকে কাজে লাগানো শুরু হয়েছে অনেক বছর আগে থেকেই। মহাশূন্যে এখন অসংখ্য কৃত্রিম উপগ্রহ ভাসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মহাশূন্য অভিযান চালানোর জন্য মহাকাশে ভাসমান স্টেশন তৈরি করেছে। আমাদের মোবাইল ফোন, ক্যাবল টেলিভিশন সবকিছুর জন্যই আমাদের স্যাটেলাইটের সাহায্য নিতে হয়। এই স্যাটেলাইটগুলোর জ্বলানি আমরা সৌরশক্তি কাজে লাগিয়েই পাচ্ছি। নিচের ছবিতে দেখো - বিখ্যাত হাবল টেলিস্কোপ চালানোর জন্য শক্তি তৈরি হচ্ছে সোলার প্যানেল থেকে। সোলার প্যানেল সূর্যের আলোকে ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে।


চিত্র: হাবল টেলিস্কোপ

চিত্র: বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকান্ড সোলার প্যানেল


বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন সোলার প্যানেলের সাহায্যে সৌরশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সৌরশক্তি ব্যবহার করে গাড়ি চালানো যাচ্ছে। অনেক দেশে বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করে নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেরাই তৈরি করে ব্যবহার করছে।


উপকারি বন্ধু সূর্য
 সূর্য যে আমাদের উপকারি বন্ধু তা তো দেখতেই পাচ্ছো। শীতকালে সূর্যের দেখা না পেলে আমাদের যে কত কষ্ট হয় তা তো তোমরা জানো। শৈত্যপ্রবাহে মানুষ কষ্ট পায় সূর্য কুয়াশায় ঢেকে গেলে। নিচের ছবিতে সূর্যের কিছু উপকারের কথা, যা একটু আগেও আলোচনা করেছি, আবার দেয়া হলো। কারণ উপকারির উপকারের কথা বার বার বলতে হয়।



চিত্র: উপকারি বন্ধু সূর্য

___________
PART 11

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ৯



সূর্যের আবহাওয়া

সূর্যের আবহাওয়া পৃথিবীর আবহাওয়ার চেয়ে ভিন্ন। বাতাস নেই, ঘনত্ব অনেক কম এবং অনেক বেশি উত্তপ্ত। সূর্যের আবহাওয়ামন্ডলের দুটো অংশ। ক্রোমোস্ফিয়ার এবং কোরোনা বা কিরীট। কোরোনা মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত। সূর্যের গঠন আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ক্রোমোস্ফিয়ার এবং কোরোনা সম্পর্কে জেনেছি।  


সূর্যের পিঠে ফুটন্ত আগুন
সূর্যের উপরিতল কখনোই মসৃণ সমতল নয়। সারাক্ষণই উত্তপ্ত গ্যাসের ঢেউ উঠানামা করছে। দেখতে এগুলোকে টগবগে ফুটন্ত আগুনের দানার মত লাগে। পৃথিবী থেকে আগুনের দানাগুলোকে দেখতে ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু ওগুলোর এক একটার আকার প্রায় এক হাজার কিলোমিটার। এত বড় দানাগুলো খুব বেশিক্ষণ থাকে না। আট মিনিটেই তা শেষ হয়ে যায়। তারপর আরেকটি তৈরি হয়। যে কোন সময় সূর্যের পৃষ্ঠে প্রায় চল্লিশ লাখ আগুনের দানা ফুটতে থাকে। বিশেষ টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে দেখা যাবে সূর্যের উপরিতল ঘন কমলা হলুদ রঙের ফুটন্ত কড়াইয়ের মত সেখানে মাঝে মাঝে কিছু কালো দাগ এসে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এই কালো দাগগুলোকে সৌরকলঙ্ক বা সোলার স্পট বলা হয়।


সৌরকলঙ্ক
 সূর্যের ফটোস্ফিয়ার বা আলোকমন্ডলে কিছু কালো দাগ দেখা যায়। এগুলোকে সৌরকলঙ্ক বলা হয়। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের দরুণ এই সোলার স্পট তৈরি হয়। চৌম্বকক্ষেত্র মাঝে মাঝে প্লাজমার প্রবাহে বাধা দেয়। কিছু সময়ের জন্য তাপমাত্রার প্রবাহ কোন কোন স্থানে ধীর হয়ে পড়ে। ফলে ঐ স্থান পার্শ্ববর্তী স্থানের চেয়ে কিছুটা ঠান্ডা থাকে। তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে ঠান্ডা জায়গাটুকুকে কালো দেখায়।



চিত্র: সৌরকলঙ্ক

কালো জায়গাগুলোতে চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রাবল্য অত্যন্ত বেশি। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রায় দশ হাজার গুণ বেশি। আর সুর্যের অন্য অংশের যে চৌম্বক প্রাবল্য তার প্রায় তিন হাজার গুণ বেশি।


 চিত্র সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র। ১৯৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তোলা হয় এ ছবি। কালো অংশ হলো ধনাত্মক চৌম্বক ক্ষেত্র আর সাদা অংশ হলো ঋণাত্মক চৌম্বকক্ষেত্র।


এই সৌর কলঙ্কের আকার এক হাজার কিলোমিটার থেকে শুরু করে এক লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এগুলো এক ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে সূর্যের গায়ে। ১৫১৩ সালে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম এই সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষণ করেন। নিজের তৈরি দূরবীণ দিয়েই তিনি তা দেখেছিলেন।
            সৌরকলঙ্ক সব সময় জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। তাদের তাপমাত্রা প্রায় পাঁচ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। আলোকমন্ডলের গড় তাপমাত্রা এগারো হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে হিসেবে সৌরকলঙ্কের তাপমাত্রা প্রায় ছয় হাজার ডিগ্রি কম। এগুলো আকারে পৃথিবীর চেয়েও বড় হতে পারে। কিন্তু এগুলো যে চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে হয় তা জানা ছিল না ১৯০৮ সাল পর্যন্ত। বিজ্ঞানী জর্জ হেইল এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন।



চিত্র: সৌরকলঙ্কের চার পাশে সূর্যের উপরিতল এরকম এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়। প্রচুর শক্তির উত্থান ও নির্গমনের ফলে এরকম হয়।


প্রতি ১১ বছর পরপর সৌরকলঙ্ক দেখা যায়। ২০০১ সালের পর ২০১২ সালে আবার দেখা গেছে তাদের। কেন ১১ বছর পর পর এটা হয় তার কারণ এখনো ঠিকমতো জানা যায়নি। সৌরকলঙ্ক একেক বছর একেক রকমের হতে পারে। কোন বছর ১০০টাও হতে পারে, কোন বছর ১০টারও কম হতে পারে। যখন বেশি কলঙ্ক হয় তখন পৃথিবীর তাপমাত্রাও কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। গড়ে প্রতি ১১ বছরে সৌরকলঙ্ক খুব বেড়ে যায়। আবার আস্তে আস্তে খুব কমে যায়।
            যখন সৌরকলঙ্ক ঘটে তখন সূর্যের উজ্জ্বলতা অনেক বেড়ে যায়। কারণ চৌম্বক প্রাবল্যের আধিক্যের কারণে যে তাপমাত্রা কমে যায় তাকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য আরো অনেক উজ্জ্বল রশ্মি সৌরকলঙ্ককে ঘিরে রাখে।


সৌরঝড়
 সূর্যের আবহাওয়া মোটেও শান্ত নয়। সৌরঝড় ওঠে সূর্যপৃষ্ঠে। পৃথিবীর ঝড়ের মতো নয় এই ঝড়। সৌরঝড় তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রবাহের ফলে সৃষ্টি হয়। ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে বিশাল বিশাল গ্যাসের ঢেউ উঠে উপচে পড়ে কোরোনা অবধি। সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে যখন সৌরকলঙ্ক দেখা যায় তখন এই ঢেউগুলো দেখা যায়। কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে একেকটি ঢেউ। কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকতে পারে এই ঢেউ।



চিত্র: সৌরঝড়

সৌরঝড়ের সময় মাঝে মাঝে বড় বড় গ্যাসের স্তম্ভ তীরের ন্যায় বেরিয়ে আসে সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ার বা বর্ণমণ্ডল থেকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ বিশাল পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে আগুনের বন্যার মতো। এই শক্তিগুলোকে ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা থাকলে একটা নির্গমনের শক্তিতেই আমাদের পৃথিবীর দশ লক্ষ বছর চলে যেতো।


চিত্র: সৌরঝড়

নিচের ছবিতে সূর্যের জ্বলে ওঠা শিখা (ফ্লেয়ার) দেখা যাচ্ছে। নাসার স্কাইল্যাব স্পেস স্টেশন থেকে এই ছবি তোলা হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর।



চিত্র: সৌরশিখা


এরকম সৌরশিখা খুব কমই রেকর্ড করা হয়েছে। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে এই শিখার সৃষ্টি। সূর্যপৃষ্ঠে এই শিখার বিস্তার প্রায় ছয় লক্ষ কিলোমিটার।
            নিচের ছবিটা সূর্যের একটা অত্যাশ্চর্য ছবি। সূর্যের বাইরের আবহাওয়ামন্ডলের ১৫ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গ্যাসের এই ছবি রেকর্ড করা হয় ১৯৯৬ সালের ১৩ মার্চ এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপের সাহায্যে। টেলিস্কোপটি ছিল সোলার ও হেলিওস্ফেরিক অবজারভেটরি (SOHO) স্পেসক্রাফ্‌টে। অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের অনেক খুঁটিনাটি দেখা গেছে এই ছবিতে যা আগে কখনো দেখা সম্ভব হয়নি।



চিত্র: সূর্যের আবহাওয়ামণ্ডল


পরের পৃষ্ঠার ছবিটি দেখো। সূর্যের এক্স-রে ইমেজটি নেয়া হয়েছে ১৯৯৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। উজ্জ্বল অংশটুকু থেকে অতিরিক্ত এক্স-রে বের হচ্ছে।

চিত্র: সূর্যের এক্স-রে ছবি


সূর্যের আবহাওয়ার প্রভাব পৃথিবীর ওপরও এসে পড়তে পারে। সৌরঝড় উঠলে মহাশূন্যে তার প্রভাব পড়ে। আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলেও তার প্রভাব দেখা যায়। পৃথিবীর ঘন আবহাওয়ামণ্ডল সৌরঝড়ের প্রভাব থেকে আমাদের রক্ষা করে। তবে ঐ সময় পৃথিবীর টেলিকমিউনিকেশানে ব্যাপক বাধা পড়ে। মহাশূন্যে স্থাপিত যোগাযোগের উপগ্রহগুলোর কাজে বাধা পড়ে সৌরঝড়ের কারণে।


সূর্যের ঘূর্ণন

সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো ঘুরে। কিন্তু সূর্য নিজে স্থির নয়। সে নিজেও নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে। প্রায় এক মাস সময় লাগে তার নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরে আসতে। যেহেতু থলথলে গ্যাস দিয়ে তৈরি তাই সূর্যের সব অংশ সমান বেগে ঘুরতে পারে না। কোন অংশ আস্তে, আবার কোন অংশ দ্রুত ঘুরে। মধ্যবর্তী স্থান একবার ঘুরে আসতে ২৫ দিনের মতো লাগে। বাইরের দিকে ক্রমশ সময় বেশি লাগে। একেবারে বাইরে উপরে ও নিচের গ্যাসসহ ঘুরতে ৩৫ দিনের মতো সময় লাগে। নিচের ছবিতে সূর্যের নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরে আসতে কত সময় লাগে তার একটা চিত্র দেয়া হলো।



চিত্র: সূর্যের ঘূর্ণন


নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে ঘুরতে সূর্য আবার ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ের চারপাশেও ঘুরে। মিল্কিওয়ের চারপাশে সূর্য সেকেন্ডে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। (ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব এক সেকেন্ডে অতিক্রম করে)। এই গতিতে ঘুরলেও সূর্যের প্রায় ২২ কোটি বছর লেগে যায় মিল্কিওয়ের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে। (হিসেব করে দেখতে পারো মিল্কিওয়ের আকার কত বড়।) মিল্কিওয়ের মহাকর্ষ বল সূর্যকে তার কক্ষপথে ধরে রাখে। সূর্য মিল্কিওয়ের অরিয়ন বাহুতে অবস্থিত যা মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে প্রায় অর্ধেক দূরত্বে অবস্থিত।

__________________

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ৮



সূর্যের আলো

আমাদের পৃথিবীতে যে আলো সূর্য থেকে এসে পৌঁছায় তা কিন্তু তৈরি হয়েছে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে। সুর্যের কেন্দ্রে যে আলো উৎপন্ন হয় তা সেখান থেকে বেরোতে এত সময় নেয়। তার কারণ কী? মনে করো তুমি কোন একটা কনসার্টে গিয়ে একেবারে স্টেজের কাছে বসেছো যেখানে প্রচন্ড ভিড়। এই ভিড় ঠেলে তুমি যদি স্টেডিয়ামের বাইরে যেতে চাও অনেক বেশি সময় তোমার লাগবে। তুমি তো ভীড়ের মধ্যে দৌড়ে আসতে পারবে না। কারণ দৌড়োতে চাইলেও দেখবে ভিড়ের ঠেলায় আবার সামনে থেকে পেছন দিকে ফিরে যাচ্ছো। আলোর কণা ফোটনগুলোও সেই একই রকম সমস্যায় পড়ে সূর্যের কেন্দ্র থেকে বের হতে গিয়ে। প্রচুর পারমাণবিক মিথষ্ক্রিয়া করতে করতে কেন্দ্র থেকে আলোকমণ্ডল পার হতে লেগে যায় লক্ষ বছর।
            তবে আলো একবার সূর্যের আলোকমন্ডলে পৌঁছাতে পারলে বাধাহীনভাবে আলোর বেগে চলে যায় যা সেকেন্ডে তিরিশ কোটি মিটার বা তিন লক্ষ কিলোমিটার। সূর্যের বাইরের স্তর থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় প্রায় আট মিনিট ২৬ সেকেন্ড। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকে আলোর বেগ দিয়ে ভাগ করে তোমরা এই সময় হিসেব করে নিতে পারো।

সূর্যের আলোর অনেক রঙ। আমরা সূর্যের আলোর যে অংশটা খালি চোখে দেখতে পাই তাকে আলোর বর্ণালী বলা হয়। ১৬৬৬ সালে স্যার আইজাক নিউটন প্রিজমের সাহায্যে সূর্যের আলো থেকে সাতটি রঙ আলাদা করেছিলেন সর্বপ্রথম। বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল; এই সাতটি রঙ নিয়ে সূর্যের দৃশ্যমান আলোর বর্ণালী।  
            দৃশ্যমান আলোর মধ্যে বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম এবং তার শক্তি সবচেয়ে বেশি। আবার লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি এবং শক্তি সবচেয়ে কম। তোমরা জানো তরঙ্গের শক্তি ও তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক পরস্পর বিপরীতানুপাতিক। অর্থাৎ একটির মান বাড়লে অন্যটির মান কমে যায়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর কম্পাঙ্কও একে অপরের বিপ্রতীপ। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হলে কম্পাঙ্ক কম হয় এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলে কম্পাঙ্ক বেশি হয়। যে তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বেশি তাদের শক্তিও বেশি। পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে এর কারণ ব্যাখ্যা করা যায়।
            সূর্য থেকে যে শক্তি বেরিয়ে আসে তা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ আকারে আসে। এই তরঙ্গের বর্ণালীর খুব ছোট একটা অংশ আমরা দেখতে পাই। দৃশ্যমান আলোর বাইরে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের বিশাল বিস্তৃতির কোন অংশই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।
            বেগুনি আলোর চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর শক্তি অনেক বেশি। এই রশ্মিগুলোকে আমরা অতিবেগুনি রশ্মি বলে জানি। আমাদের শরীরে অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ করলে খুবই ক্ষতি হয়। এগুলো এক ধরনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। অতিরিক্ত অতিবেহুনি রশ্মি শরীরের ত্বকে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
            দৃশ্যমান আলোর কম্পাঙ্কের চেয়ে বেশি কম্পাঙ্কের তরঙ্গ এত বেশি শক্তিশালী যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এদের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। এক্স-রে, গামা-রে ইত্যাদি খুবই উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ। চিকিৎসায় যে এক্স-রে ও গামা-রে ব্যবহার করা হয় তা যন্ত্র থেকে উৎপন্ন করা হয়। সূর্য থেকে যে এক্স-রে ও গামা-রে বের হয়ে পৃথিবীর দিকে আসে তাদের বেশিরভাগই পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডল শোষণ করে নেয়। নইলে পৃথিবীতে আমাদের বাস করা বিপজ্জনক হয়ে উঠতো।
            বেতার তরঙ্গ দৃশ্যমান আলোর চেয়ে অনেক কম শক্তিশালী এবং এদের কম্পাঙ্কও অনেক কম। তাই এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বড়। বেতার তরঙ্গ জ্যোতির্বিদ্যায় খুব কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ দৃশ্যমান আলো যেখানে মেঘ বা ধূলিকণা ভেদ করে যেতে পারে না সেখানে বেতার তরঙ্গ সহজেই সবকিছু ভেদ করে চলে যেতে পারে। রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদি মাধ্যমে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। 



উপরের ছবিতে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বিভিন্ন অংশের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক দেয়া হলো।

______________

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ৭



সূর্যের শক্তির উৎস

আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য যা একটি প্রকান্ড আকারের গ্যাসপিন্ড। এই পিন্ড থেকে অনবরত শক্তি নির্গত হচ্ছে। সূর্য জ্বলছে কীভাবে বা সূর্য থেকে কীভাবে আলো ও তাপ পাই, সূর্য নিজে এত শক্তি কোত্থেকে পায় তা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শুরু সেই অনেক কাল আগে থেকে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য এবং পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান যখন বাড়তে শুরু করেছে, সূর্যের শক্তির উৎস সম্পর্কেও বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও প্রমাণ দেয়া শুরু হয়েছে।
            নিউক্লিয়ার ফিউশান (nuclear fusion) প্রক্রিয়ায় সূর্যের শক্তি উৎপন্ন হয়। সূর্যকে একটি হাইড্রোজেন বোমার সাথে তুলনা করা যায়। ১৯০৪ সালে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড সর্বপ্রথম ধারণা দেন যে সূর্যের শক্তি আসে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ থেকে। তার মাত্র কয়েক বছর আগে ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী হেনরি বেকোয়ারেল পদার্থের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছেন।
            সূর্যসহ সব নক্ষত্র নিজের শক্তি নিজে তৈরি করে। নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমেই এই শক্তি উৎপন্ন হয়। নিউক্লিয়ার ফিউশনে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু যোগ হয়ে একটা হিলিয়াম পরমাণুর সৃষ্টি হয় এবং কিছু শক্তির সৃষ্টি হয়। এরকম কোটি কোটি হাইড্রোজেন পরমাণু একই সঙ্গে হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হয় বলে একই সাথে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় সূর্যে। এই শক্তিগুলোই বিকিরণের মাধ্যমে সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। যা আমাদের পৃথিবীতেও এসে পৌঁছায়। প্রতি সেকেন্ডে সূর্য থেকে যে শক্তি নির্গত হয় তা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে তা দিয়ে পৃথিবী এক হাজার বছর চলতে পারবে।
              
সুর্যের চার ভাগের তিন ভাগ হলো হাইড্রোজেন। তিন ধাপে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় সূর্যের শক্তি উৎপন্ন হয়। পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো নিচে দেয়া হলো।



চিত্র: সূর্যের শক্তি উৎপাদনের প্রথম ধাপ

প্রথম ধাপ: দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস (প্রোটন) (1H) মিশে গিয়ে একটি ডিউটেরিয়াম (2H) নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এই মিথষ্ক্রিয়ার ফলে একটি নিউট্রিনো এবং একটি পজিট্রন (পজিটিভ ইলেকট্রন) বের হয়ে আসে।  পজিট্রনটি সাথে সাথে একটি ইলেকট্রনের সাথে মিশে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। (এই মিথষ্ক্রিয়াকে এনাইহিলেশান বলে)। ইলেকট্রন-পজিট্রন মিশে গিয়ে পদার্থ শক্তিতে পরিণত হয়। দুটো গামা ফোটন আকারে শক্তি বেরিয়ে আসে এখান থেকে। ফোটনকে আলোর কণা হিসেবে ধরা হয়।

দ্বিতীয় ধাপ: ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াস (2H) আরেকটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের (1H) সাথে মিশে হালকা হিলিয়াম (3He) তৈরি করে। গামা রশ্মি হিসেবে শক্তি নির্গত হয়। 

চিত্র: সূর্যের শক্তি উৎপাদনের দ্বিতীয় ধাপ


তৃতীয় ধাপ: সবশেষে দুটো হালকা হিলিয়াম (3He) নিউক্লিয়াসের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। ফলে একটা ভারী হিলিয়াম (4He) পাওয়া যায় এবং আর দুটো প্রোটন বা হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস তৈরি হয়।


চিত্র: সূর্যের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার তৃতীয় ধাপ


এই দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস (প্রোটন) আবার প্রথম ধাপ থেকে তৃতীয় ধাপ সম্পন্ন করে আবারো দুটো প্রোটন নির্গত করে। এভাবে পর্যায়ক্রমিক বিক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। প্রতিবার বিক্রিয়ায় সূর্যের 0.7% ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
            প্রতি সেকেন্ডে সূর্য ৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করে। ফিউশন পদ্ধতিতে প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিলিয়ন টন অন্যান্য বস্তু শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তার মানে প্রতি বছর ১৫৭,৬৮০,০০০,০০০,০০০ মেট্রিক টন বস্তু শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। প্রতি সেকেন্ডে ১০২৭ ওয়াট শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তির এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বা ১০১৮ ওয়াট (এক লক্ষ কোটি মেগাওয়াট) আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। এই শক্তিতে বাংলাদেশের কতদিন চলবে হিসেব করে দেখো। বাংলাদেশে দৈনিক কত মেগাওয়াট বিদ্যুত-শক্তি লাগে জেনে নিয়ে সহজেই এই হিসেবটি তোমরা করতে পারো।


সূর্যের রাসায়নিক উপাদান

সূর্যে যে সমস্ত মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে তাদের পরিমাণ ও শতকরা হিসাবের একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো।

মৌল
ভরের শতকরা হার
(%)
মোট পরিমাণের শতকরা হার (%)
হাইড্রোজেন
73.46
92.1
হিলিয়াম
28.85
7.8
অক্সিজেন
0.77



0.1
কার্বন
0.29
লোহা
0.16
নিয়ন
0.12
নাইট্রোজেন
0.09
সিলিকন
0.07
ম্যাগনেসিয়াম
0.05



সূর্যের দরকারি মান

নিচের সারণিতে সূর্যের কিছু দরকারি মান দেয়া হলো। (সূর্যমামা বলেছেন এগুলো মুখস্থ করার কোন দরকার নেই। যখনই যে মান লাগবে বই খুলে সারণি থেকে দেখে নিলেই হবে। সত্যিকারের বিজ্ঞান শিখতে গেলে বড় বড় সংখ্যা বা ধ্রুবকের মান মুখস্থ করার দরকার পড়ে না। তবে মানগুলোর তাৎপর্য বুঝতে হবে।)

বৈশিষ্ট্য
বৈজ্ঞানিক মান
প্রচলিত মান
পৃথিবী থেকে দূরত্ব
149.6 x 106 km
প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার
ব্যাস
1,392,530 km
প্রায় চৌদ্দ লক্ষ কিলোমিটার
আয়তন
1.41 x 1018 m3
পৃথিবীর আয়তনের প্রায় তের লক্ষ গুণ
ভর
1.9891 x 1030 kg
প্রায় ২০০ কোটি কোটি কোটি কোটি কিলোগ্রাম
পুরো সূর্য থেকে বিকিরণ
3.83 x 1023 kW
৩৮৩ কোটি কোটি কোটি কিলোওয়াট
ফটোস্ফিয়ার থেকে বিকিরণ
6.29 x 104 kW/m2
প্রতি বর্গমিটারে ৬৩ মেগাওয়াট
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বিকিরণ এসে পৌঁছায়
1368 W/m2
প্রতি বর্গমিটারে ১৩৬৮ ওয়াট

________________

Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts