Showing posts with label মঙ্গল গ্রহ. Show all posts
Showing posts with label মঙ্গল গ্রহ. Show all posts

Monday, 15 November 2021

মঙ্গলে অধ্যবসায়


২০২০ সালে পৃথিবী্র মানুষ যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে জর্জরিত, স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবন যেখানে থমকে গিয়েছিল, সেই কঠিন সময়েও নাসার বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করে গেছেন মঙ্গল গ্রহের সাম্প্রতিক মিশন মার্স-২০২০ সফল করার লক্ষ্যে। তাঁদের পরিশ্রম বিফলে যায়নি। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই ফ্লোরিডার কেইপ ক্যানাভেরাল থেকে যথাসময়েই উৎক্ষিপ্ত হয় রকেট অ্যাটলাস ভি-৫৪১। এই রকেট পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে পৌঁছে দেয় বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট মার্স-২০২০। পৃথিবী থেকে  বের হয়ে সাড়ে ছয় মাস ধরে মহাকাশে ৪৭১ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ির আকারের বৈজ্ঞানিক রোবট পারসিভারেন্স – যাকে বাংলায় বলা যায় অধ্যবসায়। মহাকাশ গবেষণায় এই মঙ্গল অভিযান – অন্যান্য সবগুলি অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি উন্নত, এবং অনেক বেশি চমকপ্রদ। মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম একটি হেলিকপ্টার উড়বে – পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহের ভূমির উপর দিয়ে। মার্স-২০২০ মিশনে রোভার পারসিভারেন্সের সাথে গেছে একটি ছোট্ট হেলিকপ্টার – ইঞ্জেনুইটি। 

মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ হাজার বছরের পুরনো হলেও, তার প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে বৈজ্ঞানিক আগ্রহ এই শতাব্দীতে বেড়ে যাবার প্রধান কারণ – মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলি যেভাবে লাগামহীন অতিরঞ্জন করতে পারে, বিজ্ঞান তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সেরকম কিছুই করতে পারে না। তাই এইচ জি ওয়েল্‌স এর ‘দি ওয়র অব দি ওয়ার্ল্ডস’-এ মঙ্গল গ্রহের প্রাণিরা এসে পৃথিবী দখল করে নেবার কল্পনার মধ্যে শিহরণ থাকলেও তার কোন বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু কল্পকাহিনিগুলির প্রভাবে সাধারণ মানুষের আগ্রহ জন্মে পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য গ্রহগুলি সম্পর্কে। প্রথমে খালি চোখে, তারপর দূরবীণের সাহায্যে এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর থেকে একের পর এক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু জেনেছেন মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে। ১৯৬০ থেকে শুরু করে মার্স-২০২০ মিশনের আগপর্যন্ত ৪৮টি বৈজ্ঞানিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য জানার লক্ষ্যে। তার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল ১৭টি, আমেরিকার ছিল ২২টি। শুরুটা সোভিয়েত ইউনিয়নের থাকলেও ক্রমে ক্রমে সাফল্যের দিক থেকে আমেরিকার মঙ্গল মিশনগুলি অনেক বেশি এগিয়ে যায়। ১৯৬৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা যে ২২টি মঙ্গল অভিযান পরিচালনা করে তাদের মধ্যে ১৭টি মিশন সফল হয়। মঙ্গল গ্রহের ভূমি থেকে প্রথম ছবি আমরা পাই সেই ১৯৬৫ সালে ম্যারিনার-৪ স্যাটেলাইট থেকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মহাকাশের অভিযানগুলিও দ্রুত আধুনিক হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে পাঠানো মার্স গ্লোবার সার্ভেয়ার মঙ্গল গ্রহের পুরোটাই জরিপ করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা পেয়ে যান মঙ্গল গ্রহের ভূমির সম্পূর্ণ মানচিত্র। এর পরবর্তী বছরগুলিতে মঙ্গলের পিঠে নামানো হয় একের পর এক স্বয়ংক্রিয় রোবট এবং রোভার বা যান্ত্রিক গাড়ি। ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাইকিং-১ ও ভাইকিং-২ ছিল মঙ্গলের বুকে প্রথম ও দ্বিতীয় রোবট। ১৯৯৬ সালে নাসার পাঠানো সোজার্নার ছিল মঙ্গলের বুকে প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোভার। তারপর ২০০৩ সালে স্পিরিট ও অপরচুনিটি, এরপর ২০১২ সালে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে তখনপর্যন্ত সবচেয়ে আধুনিক রোভার কিওরিসিটি। কিওরিসিটি রোভার এখনো কাজ করছে মঙ্গলে। 

নাসার পাঠানো সাম্প্রতিক রোভার পারসিভারেন্স হলো মঙ্গলের বুকে তাদের পঞ্চম রোভার। প্রায় ২৪০ কোটি ডলার বা বিশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মার্স-২০২০ মিশন পরিচালনা করার উদ্দেশ্য কী? মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে অনেক তথ্য তো বিজ্ঞানীরা আগের মিশনগুলি থেকে জেনে গেছে। মঙ্গলের চারপাশে এখনো ঘুরছে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট – যেগুলি নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত ও ছবি পাঠাচ্ছে। রোভার কিওরিসিটি এখনো সক্রিয়ভাবে মঙ্গলের ভূমি থেকে তথ্য পাঠাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আরেকটি রোভার পাঠানোর দরকার কী ছিল? বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে অনবরত চালিয়ে যেতে হয়। পৃথিবী থেকে ২২ কোটি কিলোমিটার দূরের একটি গ্রহের সবকিছু পৃথিবীতে বসে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হলে ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হয় বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম। এপর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে তাতে আমরা নিশ্চিন্তভাবে জানি এই গ্রহের আয়তন পৃথিবীর অর্ধেক। মঙ্গলের ভূমি শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে কয়েক শ কোটি বছর আগে। এর মোট ভূমির ক্ষেত্রফল পৃথিবীর স্থলভাগের ক্ষেত্রফলের প্রায় সমান। মঙ্গলের ভর পৃথিবীর ভরের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ, মঙ্গলের অভিকর্ষজ ত্বরণের মান পৃথিবীর অভিকর্ষজ মানের তিন ভাগের এক ভাগের চেয়ে সামান্য বেশি। মঙ্গলের দিন পৃথিবীর দিনের চেয়ে প্রায় ৪০ মিনিট লম্বা, কিন্তু মঙ্গলের এক বছর হয় পৃথিবীর ৬৮৭ দিনে। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব খুব কম, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ঘনত্বের মাত্র একশ ভাগের এক ভাগ। মঙ্গল খুব ঠান্ডা একটি গ্রহ। দিনের বেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর রাতের ঠান্ডায় তাপমাত্রা মাইনাস ১২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। 

প্রত্যেকটি অভিযান থেকে পাওয়া তথ্য ও উপাত্ত একই কথা বলে এ ব্যাপারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিন্ত হতে পারেননি কিছু কিছু ব্যাপারে। যেমন, শুরুতে পৃথিবীর সমান বয়সী এই গ্রহের উপাদান এবং পরিবেশের মধ্যে মিল ছিল। সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে বাঁচানোর জন্য উভয় গ্রহেই চৌম্বকক্ষেত্র ছিল। উভয় গ্রহেই পানি এবং অন্যান্য অনুকুল পরিবেশ থাকলেও পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। তবে মঙ্গলেও কি ঘটেছিল? যদি ঘটে থাকে, তাহলে সেই প্রাণের উপাদানের ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কেন? মঙ্গলে শুকিয়ে যাওয়া নদী ও পানির প্রবাহের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। শুধুমাত্র পানি থাকলেই যে জৈবপ্রাণ থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু প্রাণের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় এমন রাসায়নিক উপাদানগুলি তো খুঁজে পাবার চেষ্টা করতে হবে। এর আগের রোভার কিওরিসিটি তো সেই কাজ করেছে। কিন্তু ফলাফলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ কিওরিসিটি রোভার মঙ্গলের যে উপাদান সংগ্রহ করেছে তা সেখানেই বিশ্লেষণ করে তথ্য ও উপাত্ত পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। এই উপাদানগুলিকে যদি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসা সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীর আরো আধুনিক পরীক্ষাগারে সেগুলিকে পরীক্ষা করে হয়তো আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। এটা করার জন্যই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর প্রকল্প মার্স-২০২০ চালানো হচ্ছে মঙ্গলে। পারসিভারেন্স রোভার মঙ্গলের উপদান তো পরীক্ষা করবেই, সাথে আরো অনেক উপাদান সংগ্রহ করে তা একটি নির্দিষ্ট জায়গায়  সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করবে। পরে অন্য কোন মিশন মঙ্গল থেকে সেই নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে। 

মার্স-২০২ মিশনটি সবচেয়ে উচ্চক্ষমতার এবং উচ্চাভিলাসী প্রকল্প। এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য প্রধানত চারটি: (১) প্রাচীন অণুজীবের সন্ধান করবে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কি না প্রমাণ করবে, (২) মঙ্গলের ভূতত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করবে, (৩) মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পর্যবেক্ষণ করবে, এবং (৪) ভবিষ্যতে মঙ্গলে মানুষের যাওয়ার পথ সুগম করবে। 

এই উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়ন করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছেন। ২০১২ থেকে এই মিশনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নাসার জেট প্রপালসান ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছে আধুনিক মঙ্গলযান পারসিভারেন্স রোভার। এই রোভার – গাড়ির আকারের একটি অত্যন্ত আধুনিক রোবট যা মঙ্গলের বুকে একটি স্বয়ংক্রিয় গবেষক ও গবেষণাগারের কাজ করবে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কাজগুলি করার জন্য প্রচন্ড অধ্যবসায়ের দরকার হয়। রোভারের কাজের সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয়েছে পারসিভারেন্স। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে নাসা তাদের বিভিন্ন মিশনের নাম দেয়ার জন্য স্কুল ছাত্রছাত্রীদেরকে আহ্বান করে। আটাশ হাজার নাম পাঠায় আমেরিকার বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা। সেখান থেকে আন্তর্জাতিকভাবে অনলাইনে ভোটের মাধ্যমে  ভার্জিনিয়ার লেক ব্রাডক স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র আলেকজান্ডার মাথিরের পাঠানো নাম ‘পারসিভারেন্স’ নির্বাচিত হয় মার্স-২০২০ মিশনের রোভারের নাম। 

স্বয়ংক্রিয় রোবট রোভার – পারসিভারেন্স এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি সফলভাবে সম্পন্ন করা যায়। পারসিভারেন্স রোভারটি ৩ মিটার লম্বা, ২.৭ মিটার চওড়া, এবং ২.২ মিটার উঁচু। পৃথিবীতে এর ওজন ১,০২৫ কেজি। এর সাথে সংযুক্ত আছে ২ মিটার লম্বা রোবটিক হাত যা প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুরতে পারে, ছবি তুলতে পারে, পাথর খুড়তে পারে, নমুনা সংগ্রহসহ অন্যান্য দরকারি সব কাজ করতে পারে। এই হাতের ওজন ৪৫ কেজি। মঙ্গলের অভিকর্ষ ত্বরণ যেহেতু পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের শতকরা ৩৮ ভাগ, মঙ্গলে রোভারের ওজন দাঁড়াবে প্রায় ৩৯০ কেজি। চলার জন্য রোভারটিতে লাগানো আছে ছয়টি ধাতব চাকা। শক্ত কিন্তু হালকা অ্যালিমিনিয়ামের তৈরি চাকাগুলি মঙ্গলের মরুভূমিতে চলার উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলি ধুলোবালির উপর দিয়ে যেমন যেতে পারবে, তেমনি পাথরের উপর দিয়েও চলতে পারবে। পাথর আর বালির ঘর্ষণে এই চাকার খুব একটা ক্ষতি হবে না। 

পারসিভারেন্স রোভার খুবই আধুনিক রোবট। এই রোবট ক্যামেরার সাহায্যে দেখতে পারে, মাইক্রোফোনের সাহায্যে শুনতে পারে, আর কম্পিউটারের সাহায্যে ভাবতে পারে। বেশ কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে। দুটি শক্তিশালী কম্পিউটার তার মস্তিষ্কের কাজ করে। দুটো কম্পিউটারই একই রকমের, দুটোই একই কাজ করে, তবে এক সাথে করে না। একটা যখন কাজ করে, তখন অন্যটা ব্যাক-আপ হিসেবে কাজ করে। রোভারে লাগানো ক্যামেরার মাধ্যমে যে ছবি তোলা হয়, তা বিশ্লেষণ করে রোভারটির কম্পিউটার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সামনে কী আছে, এবং কীভাবে তা অতিক্রম করতে হবে। যেমন মঙ্গলে নামার সময় ভূমি থেকে কত দূরে আছে তা হিসেব করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এই রোভার। নামার পরে কম্পিউটার নতুন একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে যা দিয়ে মঙ্গলের ভূমিতে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে নিজে নিজে। 

ছোটবড় সব মিলিয়ে ২৩টি ক্যামেরা ফিট করা আছে পারসিভারেন্সের গায়ে। এর মধ্যে ৯টি ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যামেরা, ৭টি ইডিএল অর্থাৎ এন্ট্রি-ডিসেন্ট-ল্যান্ডিং ক্যামেরা, এবং ৭টি সায়েন্স ক্যামেরা। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যামেরার সবগুলিই ২০ মেগাপিক্সেল রেজ্যুলেশনসম্পন্ন শক্তিশালী ক্যামেরা – যার মধ্যে ২টি নেভিগেশান ক্যামেরা লাগানো আছে রোভারের মাথায়। রোভারের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয় এদের দ্বারা। ৬টি হ্যাজক্যাম বা হ্যাজার্ড এভয়ডেন্স ক্যামেরার চারটি সামনে আর ২টি পেছনে লাগানো আছে। চলাচলের সময় পাথর বা অন্যকিছু সামনে বা পেছনে পড়লে তা এড়িয়ে চলায় সাহায্য করবে এই ক্যামেরাগুলি। 

মঙ্গলে নিরাপদে অবতরণ করা সবচেয়ে কঠিন এবং জটিল কাজ। পারসিভারেন্স অবতরণ করানো হয়েছে সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে। এই কাজে সাহায্য করেছে ৭টি ইডিএল ক্যামেরা। এর মধ্যে তিনটি ক্যামেরা প্যারাশুট আপলুক ক্যামেরা – যেগুলি নামার সময় প্যারাশুট নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে। ভূমির দিকে নেমে আসার সময় সামনে পেছনে এবং পাশে লাগানো ক্যামেরার সাহায্যে সঠিক অবতরণ সম্ভব হয়েছে। 

সাতটি সায়েন্স ক্যামেরার প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা কাজ আছে এবং তাদের গঠন এবং অবস্থানও সেরকম। রোভারের ডান দিকে এবং বাম দিকের মাথায় লাগানো আছে ২টি ২ মেগাপিক্সেল রেজ্যুলেশনসম্পন্ন মাস্টক্যাম-জেড বা জেডক্যাম। রোভারের মাথায় মাঝামাঝি জায়গায় লাগানো আছে ৪ মেগাপিক্সেলের সুপারক্যাম রিমোট মাইক্রো-ইমেজার বা আর-এম-আই। রোভারের রোবটিক হাতের মাথায় লাগানো আছে ২টি গোয়েন্দা ক্যামেরার সেট- শার্লক হোমসের নাম অনুসারে যাদের নাম দেয়া হয়েছে শার্লক। অবশ্য শার্লক (SHERLOC) -এর লম্বা বৈজ্ঞানিক নাম Scanning Habitable Environments with Raman & Luminescence for Organics & Chemicals. শার্লক থাকলে ওয়াটসনের নামও থাকতে হয়। শার্লক ক্যামেরার একটির নাম ওয়াটসন। ওয়াটসন (WATSON) এর লম্বা বৈজ্ঞানিক নাম Wide Angle Topographic Sensor for Operations and eNgineering. 

মঙ্গল গ্রহের শব্দ শোনা এবং ধারণ করার জন্য পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো হয়েছে দুটো মাইক্রোফোন। একটি মাইক্রোফোন রোভার নামার সময় মঙ্গলের শব্দ ধারণ করে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে এবং রোভার কাজ করার সময় কী ধরনের শব্দ হয় তা সংগ্রহ করবে। অন্য মাইক্রোফোনটি লাগানো আছে সায়েন্স ক্যামেরার সাথে। এটি লেজার দিয়ে পাথর ভাঙার সময় শব্দ ধারণ করবে। 

পৃথিবী থেকে ২২ কোটি কিলোমিটার দূরে সমস্ত জটিল যন্ত্রপাতিসহ অক্ষত অবস্থায় পারসিভারেন্স এবং হেলিকপ্টার ইঞ্জেনুইটিকে মঙ্গলের বুকে নিরাপদে নামাতে পারা মানেই  মিশনের প্রধান ধাপ সম্পন্ন হওয়া। পৃথিবী থেকে সোজা পথে মঙ্গলে পৌঁছে যাবার কোন উপায় নেই। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ, মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ, সূর্যের সাথে আকর্ষণ ইত্যাদি সব হিসেব করে মার্স-২০২০ এর গতিপথ নির্ধারণ করতে হয়েছে। ২০৩ দিন ধরে মহাকাশ ভ্রমণ করে ৪৭ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গলে পৌঁছেছে পারসিভারেন্স। শেষের ৪৫ দিন ধরে তার গতিপথ ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ করে তাকে নিতে হয়েছে মঙ্গলের সীমানায়। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সময় প্রচন্ড গতিশীল স্যাটেলাইটের সাথে বাতাসের ঘর্ষণের ফলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। সেই তাপ থেকে বাচানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইঞ্জেনুইটিসহ পারসিভারেন্স গুটানো অবস্থায় রাখা ছিল বেশ কয়েকটি স্তরের নিরাপদ ধাতব আস্তরণবিশিষ্ট বিশেষ ধরনের ক্যাপসুলের ভেতর। এই ক্যাপসুল বিশেষ ধাতুর সংকর দিয়ে তৈরি যা প্রচন্ড তাপেও গলে না এবং অত্যন্ত ঘাতসহ। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে প্রবেশের ১০ মিনিট আগে স্যাটেলাইটের যে অংশটি পারসিভারেন্সের ক্যাপসুলকে মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে সেই ক্রুজ স্টেজ আলাদা হয়ে মহাকাশে ভাসতে থাকে। ক্যাপসুল ঘন্টায় ১৫০০ কিলোমিটারের অধিক বেগে মঙ্গলের সীমানায় ঢুকে বায়ুমন্ডলের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি কমাবার ব্যবস্থা আছে ক্যাপসুলের নিচের তাপনিরোধক অংশ বা হিট শিল্ডে। চার মিনিটের মাথায় মঙ্গলের ভূমির ৯ থেকে ১৩ কিলোমিটার উপরে ক্যাপসুলের উপরের অংশে লাগানো প্যারাসুট খুলে যায়। এই ফলে ক্যাপসুলের গতি কমে আসে ঘন্টায় ৫৭৬ কিলোমিটারে। ভূমির ৭ থেকে ১১ কিলোমিটার উপরে থাকতে ক্যাপসুলের নিচের অংশ খুলে পড়ে যায়। তখন পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো ইডিএল ক্যামেরা এবং রাডার তরঙ্গ চালু হয়ে যায়। গতি আরো কমতে থাকে। রাডারের মাধ্যমে প্যারাসুটে লাগানো ক্যাপসুলের অংশসহ পারসিভারেন্স মঙ্গলের বুকে যেখানে নামার কথা সেই জায়টাটি খুঁজে বের করে। ভূমি থেকে চার কিলোমিটার উচ্চতায় প্যারাসুটসহ ক্যাপসুলের উপরের অংশ আলাদা হয়ে যায়। ইঞ্জেনুইটিসহ গুটানো পারসিভারেন্স তখন ভূমির দিকে নামতে থাকে। পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো থাকে স্কাই ক্রেইন। স্কাই ক্রেইন হলো অনেকটা বাস্তবের ক্রেইনের মতো যেটায় লাগানো থাকে নাইলনের শক্ত সুতা। এই সুতার সাহায্যে পারসিভারেন্স রোভারকে আস্তে আস্তে ভূমিতে নামিয়ে দেয় স্কাই ক্রেইন। স্কাই ক্রেইন ভেসে থাকার জন্য চারটি থ্রাস্টার ব্যবহার করা যায় যা প্রচন্ড বেগে নিচের দিকে ধোঁয়া বের করে, ফলে বিপরীতমুখি বলের প্রভাবে ভূমি থেকে প্রায় ২৫ ফুট উঁচুতে ক্রেইনটি ভাসতে থাকে। সেকেন্ডে ৭৫ সেন্টিমিটার গতিতে খুব আস্তে আস্তে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করার সময় পারসিভারেন্স রোভার তার ছয় চাকার উপর দাঁড়িয়ে যায়। তখন স্কাই ক্রেইন আলাদা হয়ে থ্রাস্টারের বিপরীত বেগে উড়ে চলে যায় অন্যদিকে। সেটার আর কোন কার্যকারিতা থাকে না। 

মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে ঢুকার পর থেকে ভূমিতে অবতরণ করা পর্যন্ত প্রায় সাত মিনিট সময় লাগে। এই সাত মিনিট সময়ের উপর নির্ভর করে পুরো মিশনের সাফল্য। কোন গন্ডগোল হলেই কিন্তু মিশন ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। নামার সময় কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে তা এড়িয়ে চলার ক্ষমতা ছিল রোভার পারসিভারেন্সের। এই রোভারটি এমন এক জায়গায় নেমেছে যেখান থেকে মার্স-২০২০ মিশনের মূল উদ্দেশ্য পূরণ করা সহজ হবে। পুরনো একটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বদ্বীপে নেমেছে এটা – যেখানে আছে ঢালু জায়গা, বালিয়াড়ি, আর বড় বড় পাথর। জায়গার নাম জেজিরো ক্রেটার যেটা মঙ্গল গ্রহের উত্তর গোলার্ধের একটা ৪৫ কিলোমিটার বিস্তৃত শুকিয়ে যাওয়া অববাহিকা। ৩৫০ কোটি বছর আগে এখানে নদী বয়ে যেতো। সেই নদী শুকিয়ে পলি জমে একটি বদ্বীপ তৈরি করেছে এখানে। পারসিভারেন্সের বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এখানে জৈবযৌগের কিছু উপাদান এবং প্রাণধারণের আরো কিছু চিহ্ন এখনো অবশিষ্ট আছে। 

মঙ্গলে ঠিকমতো নামতে পারলো কি না সেই তথ্য পৃথিবীতে নাসার নিয়ন্ত্রণকক্ষে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে মঙ্গলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান মার্স রেকনিসেন্স অরবিটার বা এম-আর-ও’র মাধ্যমে। মঙ্গলে নামার সময় পারসিভারেন্সের কম্পিউটার ডাটা পাঠিয়ে দিয়েছে এম-আর-ও’র নেটওয়ার্কে। সেখান থেকে পৃথিবীর ডিপ-স্পেস-নেটওয়ার্ক অ্যান্টেনায়। মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ডাটা আসতে প্রায় ১১ মিনিট ২২ সেকেন্ড সময় লাগে। ডাটা আসে আলোর গতিতে বেতারতরঙ্গের মাধ্যমে। 

মঙ্গলে নেমেই কাজ শুরু করে দিয়েছে পারসিভারেন্স। কাজ করার জন্য যে বৈদ্যুতিক শক্তি লাগে সেই শক্তির জোগান দেয়ার জন্য পারসিভারেন্সে আছে মাল্টি-মিশন রেডিও-আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর বা এম-এম-আর-টি-জি। এটা মূলত নিউক্লিয়ার ব্যাটারি। প্রায় ৫ কেজি তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম অক্সাইডের বিকিরণ থেকে দুটো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি চার্জ করা হচ্ছে অবিরাম। এই ব্যাটারি দুটির ওজন প্রায় ২৭ কিলোগ্রাম। প্রতিটি ব্যাটারির ক্ষমতা ৪৩ অ্যাম্পিয়ার-ঘন্টা। জ্বালানি ইউনিটটি লাগানো আছে রোভারের কেন্দ্রে। পুরো ইউনিটের ওজন প্রায় ৪৫ কেজি। কমপক্ষে ১৪ বছর অনবরত বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ করতে পারবে এই ইউনিট। ফলে রোভারকে সৌরশক্তির উপর নির্ভর করতে হবে না। মঙ্গলে প্রচন্ড ধুলিঝড় হয়, সেই ঝড়ে সৌরপ্যানেল ঢেকে যায়। তাই সৌরশক্তির উপর নির্ভর করা যায় না। 

পারসিভারেন্স মঙ্গলে নেমেই সংযুক্ত ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তুলে পাঠাতে শুরু করেছে। অবতরণ করার সময় শব্দ ধারণ করেও পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী – মঙ্গলে অবতরণের সময় থেকে পারসিভারেন্সের কার্যদিবস শুরু। মঙ্গলের দিনকে বলা হয় সোল। পারসিভারেন্স মঙ্গলের বুকে কমপক্ষে মঙ্গলের এক বছর বা পৃথিবীর ৬৮৭ দিন ধরে কাজ করবে, এবং কমপক্ষে ৩০টি নমুনা সংগ্রহ করে তার বিশ্লেষণ করে ডাটা পাঠাবে এবং নমুনাগুলি নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করে  সেখানে রেখে দেবে। পারসিভারেন্স নিয়ন্ত্রণ করবেন যেসব বিজ্ঞানীরা, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে তাদের ঘড়ি চলবে মঙ্গলের সময়ের সাথে মিলিয়ে। অর্থাৎ তাঁদের সময় আর পারসিভারেন্সের সময় হবে একই। (আগামী ৬৮৭ দিনে হবে তাদের এক বছর)। প্রথম ৯০ সোল ধরে বিজ্ঞানীরা পারসিভারেন্সের কার্যক্রম এবং যন্ত্রপাতির দিকে ক্রমাগত লক্ষ্য রাখবেন। প্রথম ৩০ সোলের মধ্যে পারসিভারেন্সের অ্যান্টেনা চালু হবে। নির্দিষ্ট পথে ৫ মিটার আসা-যাওয়া করবে। রোভারের কম্পিউটারের সফ্‌টওয়ার আপডেট করা হবে। সবকিছু ঠিকমতো কাজ করছে কি না পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হবার পর মূল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং ডাটা সংগ্রহ শুরু হবে। এরপর হেলিকপ্টার এঞ্জেনুইটিকে পারসিভারেন্সের গা থেকে খুলে হেলিপ্যাডে রাখা হবে এবং হেলিকপ্টারের কাজ শুরু হবে। 

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম পৃথিবীর কোন হেলিকপ্টার পৃথিবীর বাইরে অন্যকোন গ্রহের বায়ুমন্ডলে উড়বে। অবশ্য এই হেলিকপ্টারের আকার খুবই ছোট। মাত্র ১৮০০ গ্রাম ওজন তার, অনেকটা ড্রোনের মতো। মঙ্গলে এর ওজন হবে মাত্র ৬৮০ গ্রাম। 

এটা উড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে এধরনের হেলিকপ্টার উড়ানো যায় কি না। যদি যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এরকম আরো অনেক পাঠানো হবে ভিন্ন ভিন্ন কাজে। পারসিভারেন্স রোভারের পেটে এই হেলিকপ্টার লাগানো আছে। হেলিকপ্টারের জন্য একটি তিন মিটার দৈর্ঘ্য ও তিন  মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট হেলিপ্যাড গুটানো অবস্থায় আছে হেলিকপ্টারের সাথে। পারসিভারেন্স নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমতল জায়গায় গিয়ে এই হেলিপ্যাড বিছানোর ব্যবস্থা করবে। তারপর তার উপর হেলিকপ্টারটি রাখবে। হেলিকপ্টারের গায়ে দুটি ক্যামেরা লাগানো আছে। মঙ্গলের প্রচন্ড ঠান্ডায় হেলিকপ্টার নিজেকে গরম রাখার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করতে পারে কি না দেখা হবে প্রথম কাজ। তারপর হেলিকপ্টারের গায়ে লাগানো সোলার প্যানেল থেকে শক্তি উৎপন্ন করবে। যে কম্পিউটারের মাধ্যমে হেলিকপ্টার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সেটা ঠিকমতো ডাটা আদানপ্রদান করতে পারে কি না পরীক্ষা করা হবে। পাখা ঠিকমতো কাজ করে কি না সব দেখার পর নিজে নিজে উড়তে পারে কি না এবং হেলিপ্যাডে নামতে পারে কি না দেখা হবে। 

পারসিভারেন্স রোভার প্রধানত সাত ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করবে মঙ্গলের বুকে। প্রথমেই আসে পারসিভারেন্সের প্রধান বৈজ্ঞানিক চোখ – মাস্টক্যাম-জেড। এটার জুমিং পাওয়ার এতই বেশি যে প্রায় একশ মিটার দূর থেকে এটা ছোট্ট মাছিকেও পরিষ্কার দেখতে পায়। ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে ঘুরে এটা রঙিন ছবি এবং ভিডিও তুলতে পারে। মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনেক বেশি কার্যকর হবে এর সাহায্যে। 

পারসিভারেন্সের মাথায় এবং শরীরে লাগানো আছে কয়েকটি সেন্সর যেগুলিকে বলা হচ্ছে মার্স এনভায়রনমেন্টাল ডায়নামিক্স এনালাইজার বা মেডা। মঙ্গলের আবহাওয়ার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করবে এসব সেন্সর। আকাশের দিকে তাক করা স্কাইক্যাম পর্যবেক্ষণ করবে মঙ্গলের মেঘ। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক্সের কার্যক্ষমতায় কোন পরিবর্তন ঘটে কি না তা দেখা হবে এই পদ্ধতিতে। 

সম্পূর্ন নতুন ধরনের একটি পরীক্ষা করা হবে মঙ্গলে – যার নাম মক্সি (MOXIE – Mars Oxygen In-Situ Resource Utilization Experiment)। এই যন্ত্র ব্যবস্থা মঙ্গলের বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে অক্সিজেন তৈরি করবে। যদিও বর্তমানে পারসিভারেন্সের মক্সি প্রতিঘন্টায় মাত্র ১০ গ্রাম অক্সিজেন তৈরি করতে পারবে, এটা সফল হলে ভবিষ্যতে এভাবে আরো বড় মাত্রায় অক্সিজেন তৈরি করে রকেটের জ্বালানির সমস্যা মেটানো যাবে। নভোচারীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজেও লাগবে। 

এরপর আছে পিক্সল (PIXL – Planetary Instrument for X-ray Lithochemistry) – এটা পাথর ও অন্যান্য অংশ থেকে রাসায়নিক উপাদান জরিপ করবে। কী কী আছে দেখবে। বিজ্ঞানীরা এসব আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন মঙ্গলে প্রাণের উপাদান আছে কি না। এর আগে এরকম বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা যায়নি। পারসিভারেন্সের পিক্সল ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ২০টির বেশি রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করতে পারে একেবারে বালুকণার মতো ছোট জায়গা থেকেও। 

এরপর আছে রিমফ্যাক্স (RIMFAX – Radar Imager for Mars’ Subsurface Experiment) -  রাডার তরঙ্গ ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ ভূতাত্ত্বিক জরিপ করবে এই যন্ত্র। ভূমির উপাদানে যদি পানির কোন উপাদান থাকে তা শনাক্ত করতে পারবে এই যন্ত্র। 

পারসিভারেন্সের রোবটিক বাহুতে লাগানো আছে ক্যামেরা শারলক। শারলক হোমস এর মতো এই যন্ত্রের নাম শারলক (SHERLOC – Scanning Habitable Environments with Raman & Luminescence for Organics & Chemicals)। এর সাহায্যে পাথর বা যে কোন নমুনার উপর অতিবেগুনি লেজার প্রয়োগ করা হবে। রামন ইফেক্টের ফলে প্রতিফলিত লেজারের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে জানা যাবে সেই নমুনায় কী কী রাসায়নিক উপাদান আছে। শারলকের ক্যামেরা ওয়াটসন মাইক্রোস্কোপিক ছবি তুলবে। ফলে মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক গঠন বুঝার জন্য অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। 

এরপর আছে শক্তিশালী লেজার প্রয়োগ করার যন্ত্র সুপারক্যাম। সুপারক্যাম লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে পাথর ও রেগোলিথ ভেঙে বাষ্প করে ফেলবে। লেজার প্রয়োগে খুব ছোট জায়গায় তাপমাত্রা প্রায় ১০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে সেই বস্তুর সেই জায়গা বাষ্পিভূত হয়ে যাবে। তারপর সেই বাষ্প থেকে তাদের রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে পারবে। সুপারক্যাম ৭ মিটার দূর থেকে কোন বস্তুর রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে পারবে। এর সাথে একটি মাইক্রোফোন লাগানো আছে। লেজার প্রয়োগের ফলে বস্তু থেকে কী শব্দ উৎপন্ন হয়, সেই শব্দের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেও অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। 

মঙ্গলের ভূতত্ত্ব এবং জলবায়ু সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে পারসিভারেন্স। মঙ্গলের চারপাশে যে দুটি অরবিটার ঘুরছে – সেগুলি জেজিরো ক্রেটারের ৩২২ কিলোমিটার উপর থেকে ছবি তুলছে অনবরত। কিন্তু প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পেতে হলে আরো কাছ থেকে ছবি দরকার। পারসিভারেন্স সেই প্রয়োজন মেটাবে। আগের অভিযানগুলিতে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল তা পূরণ করবে এই পারসিভারেন্স। 

এপর্যন্ত চাঁদ ছাড়া অন্য সব জায়গায় যেসব অভিযান চালানো হয়েছে তার সবগুলিই একমুখী। অর্থাৎ শুধু যাওয়া, কোনটাই ফিরে আসা নয়। এবার পারসিভারেন্সের ডাটা থেকে আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে গিয়ে আবার ফিরে আসার মতো অভিযান চালানোর  পদক্ষেপ নেয়া হবে ভবিষ্যতে। এর আগে কিউরিসিটি রোভার মঙ্গলের মাটিতে গর্ত করে তার উপাদান বিশ্লেষণ করেছে। এবার পারসিভারেন্স রোবটিক বাহুতে লাগানো যন্ত্রের মাধ্যমে পাথর কাটবে ছোট ছোট চকের আকারে। তারপর সেগুলি রাখবে নমুনা টিউবে। টিউবগুলি রোভার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাবে। পরে সেগুলি পৃথিবীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে ভবিষ্যতের কোন অভিযানের সময়। পৃথিবীতে নিয়ে আসার পর সেই নমুনাগুলি পরীক্ষা করা হবে পৃথিবীর ল্যাবে। 

ভবিষ্যতে পৃথিবী থেকে চাঁদে আবার যাবে মানুষ। মংগলে যাবার ব্যবস্থাও হবে। পারসিভারেন্স  থেকে প্রাপ্ত তথ্য, উপাত্ত এবং যান্ত্রিক অভিজ্ঞতা সেই সুযোগ তৈরি করে দেবে। ল্যান্ডিং সিস্টেম – টেরেইন-রিলেটিভ ন্যাভিগেশানের মাধ্যমে পারসিভারেন্স জেজিরো ক্রেটারে নামতে পেরেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামতে পারবে বিভিন্ন রোভার বিভিন্ন গ্রহে কিংবা উপগ্রহে। এই পদ্ধতিতে ভবিষ্যতে কিছুটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে, কিছুটা রোবটের মাধ্যমে চাঁদে নামতে পারবে মানুষ।

পারসিভারেন্স নিজে নিজে চলতে পারবে মঙ্গলের পিঠে। পৃথিবী থেকে অনেক কম নিয়ন্ত্রণেই পারসিভারেন্স চলতে পারবে। উন্নত সেন্সর, কম্পিউটার আর এলগোরিদমের মাধ্যমে অনেক বেশি বিজ্ঞান জানা যাবে। পারসিভারেন্সের কম্পিউটারের জন্য যে এলগোরিদম লেখা হয়েছে তা সফলভাবে কাজ করলে ভবিষ্যতে আরো অনেকভাবে কাজে লাগানো যাবে এগুলি। এরকম রোভারের মাধ্যমে চাঁদে, মঙ্গলে এবং অন্যান্য গ্রহেও কাজ চালানো যাবে ভবিষ্যতে।

মার্স-২০২০ মিশনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য নাসা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বোর্ডিং পাস দিয়েছিল। প্রায় ১ কোটির বেশি মানুষ মঙ্গলের রোভারে যাওয়ার জন্য নাম সই করেছিলেন। তাদের সবার নাম সেখানে নিয়ে গেছে পারসিভারেন্স তিনটি সিলিকন চিপের মাধ্যমে। পারসিভারেন্সের গায়ে একটা প্লেটে মোর্স কোডে লেখা আছে explore as one’। 

করোনার সময় মঙ্গলে পারসিভারেন্স পাঠানো সহজ কথা ছিল না। সারাপৃথিবীর ডাক্তার নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীরা পারসিভারেন্স মঙ্গলে পাঠাতে পেরেছেন। ডাক্তারদের সম্মানে পারসিভারেন্সের সাথে মঙ্গল গ্রহে একটি আলাদা স্মারকপত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে সারাপৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবা, ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। মঙ্গলের সাম্প্রতিক অভিযান সম্পূর্ণ সফল হবে – আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতার উপর এই আস্থা রাখা যায়। 

তথ্যসূত্র: www.mars.nasa.gov, মঙ্গলে অভিযান – প্রদীপ দেব, প্রথমা, ২০২০, 

_____________
বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত

Tuesday, 3 August 2021

মঙ্গল গ্রহের পানি

 



স্যাটেলাইট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর মানুষ বিশ্বাস করে আসছে যে আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলে প্রাণ আছে। কল্পবিজ্ঞানে তো অনেক রকমের লোমহর্ষক বিবরণ আছে মঙ্গল গ্রহের প্রাণিদের সম্পর্কে। এইচ জি ওয়েলসের 'ওয়ার অব দি ওয়ার্ল্ডস'-এ পৃথিবীর মানুষ কতভাবেই না নিগৃহিত হয়েছে মঙ্গলের প্রাণিদের কাছে। তারা পৃথিবীতে এসে লন্ডভন্ড করতে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থাপনা, পৃথিবীর মানুষদের ধরে ধরে তাদের রক্ত শোষণ করে - ইত্যাদি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও যখন বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে মঙ্গলের ভূমিতে প্রচুর খালের মত জায়গা দেখতে পেলেন, তাঁরা মত দিলেন যে এগুলো সব মঙ্গলের খাল। প্রাকৃতিক ভাবে পানির প্রবাহে নদীর সৃষ্টি হয়। কিন্তু খাল হলো পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বা সুবিধামত ব্যবহারের জন্য নিজেদের প্রয়োজনে কৃত্রিমভাবে খনন করা। সে হিসেবে বিজ্ঞানীদের অনেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলেন যে মঙ্গল গ্রহে প্রাণি আছে এবং তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পৃথিবীর মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। এই ধারণাটা পৃথিবীর মানুষের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মঙ্গল গ্রহকে ঘিরে প্রকাশিত হতে থাকে নানারকম মনগড়া প্রতিবেদন। ১৯১১ সালের ২৭ আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন প্রকাশ করলো, "মঙ্গল গ্রহের প্রাণিরা দুই বছরের মধ্যে দুটি বিশাল আকৃতির খাল খনন করে ফেলেছে। আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলের প্রাণিরা প্রকৌশল ও কারিগরি দক্ষতায় মানুষের চেয়েও অনেক বেশি অগ্রসর।" মঙ্গল গ্রহের ইঞ্জিনিয়ারদের তুলনায় আমাদের গ্রহের ইঞ্জিনিয়াররা যে কতটা অকাজের তা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিল সাংবাদিকরা। কোন ধরনের ফ্যাক্টচেক বা তথ্য যাচাই করার কোন উপায় তখন ছিল না।

১৯৬৪ সালে যখন আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দ্বিতীয় মঙ্গল মিশন ম্যারিনার-৪ মঙ্গল গ্রহের চারপাশে ঘুরে সর্বপ্রথম মঙ্গলের ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়, তখন মঙ্গলের ব্যাপারে মানুষের উচ্চ ধারণা মিথ্যা হয়ে যায়। দেখা যায় মঙ্গলে কোন খালের অস্তিত্বই নেই। পৃথিবী থেকে দেখে যেগুলোকে খাল বলে ধারণা করা হয়েছিল সেগুলো আসলে লম্বা লম্বা শুকনো ভূমি - যাতে কোন পানি নেই। তবুও সহজে আশা ছাড়ে না পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি হাতে আসার পর ১৯৬০ থেকে শুরু করে এপর্যন্ত মোট ৪৮টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে মঙ্গলের উদ্দেশ্যেতার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৭টি, আমেরিকা ২২টি, রাশিয়া ২টি, ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন ৪টি, জাপান ১টি, চীন ১টি এবং ভারত ১টি মিশন পরিচালনা করেছে।  ৪৮টি মিশনের মধ্যে মাত্র ২০টি মিশন সফল হয়েছে। মিশনে সাফল্যের হার শতকরা ৪০ ভাগের কাছাকাছি হলেও বিজ্ঞানীরা দমে যাননি।  আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরো অনেক মিশন পরিচালনা করা হবে মঙ্গল গ্রহে পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর উদ্দেশ্যে২০৩৫ সালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে আমেরিকা। এই সবগুলো অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হলো একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা - মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব কি না নাসার অনেকগুলো সফল মিশন থেকে মঙ্গল গ্রহের বর্তমান পরিবেশ সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে - তাতে বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমান অবস্থায় মঙ্গল গ্রহে প্রাণ থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এই 'প্রাণ' বলতে আমরা বুঝছি পৃথিবীর প্রাণ-রাসায়নিক ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা প্রাণ। পৃথিবীর প্রাণের মূল ভিত্তি তরল পানি। পৃথিবীতে তরল পানির অস্তিত্ব যেখানে আছে - সেখানেই প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা মঙ্গলেও যদি পানির অস্তিত্ব থাকে - তাহলে প্রাণের অস্তিত্বও থাকবে।  মঙ্গল মিশনগুলো মঙ্গল গ্রহের সবদিক থেকে হাজার হাজার ছবি তুলে পাঠিয়েছে। সাথে পাওয়া গেছে অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত। সেগুলো বিশ্লেষণ করে মঙ্গল গ্রহে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে কি না সে ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ধারণা পেয়েছেন। মঙ্গলের বায়ুচাপ মাত্র ৬.১ মিলিবার। পৃথিবীর গড় বায়ুচাপ ১০১৩.২৫ মিলিবার। পৃথিবীর গড় বায়ুচাপকে আমরা হিসেবের সুবিধার্থে ১ atm বা ১ অ্যাটমোস্ফেরিক প্রেসার একক ধরে থাকি। সে হিসেবে মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ হলো পৃথিবীর বায়ুচাপের এক হাজার ভাগের ছয় ভাগ (6.0 x 10-3) মাত্র। মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় পানি বরফ হয়ে যায়। সেখানে শূন্য ডিগ্রিরও ৬৩ ডিগ্রি নিচে কোন তরল পানি থাকতে পারে না। তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের পরিবর্তনের সাথে পানির যে তিন অবস্থা - তরল, কঠিন, বায়বীয় - তার পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীর এক বায়ুমন্ডলীয় চাপে শূন্য ডিগ্রি থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি তরল আকারে থাকে, ১০০ ডিগ্রির উপরে গেলে পানি বাষ্পে বা বায়বীয় অবস্থায় চলে যায়, আর শূন্য ডিগ্রির নিচে গেলে পানি বরফ বা কঠিন অবস্থায় চলে যায়। বায়ুর চাপ কমতে থাকলে পানির স্ফুটনাংকও কমতে থাকে। বায়ুর চাপ কমতে কমতে ৬.১ মিলিবার বা 6.0 x 10-3 atm এর কাছাকাছি এলে ০.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি একই সাথে কঠিন, তরল কিংবা বায়বীয় অবস্থায় থাকতে পারে। এই অবস্থাকে পানির ট্রিপল পয়েন্ট বলা হয়। মঙ্গল গ্রহের বায়ুচাপ পানির ট্রিপল পয়েন্টের বায়ুচাপের সমান। কিন্তু তাপমাত্রায় শূন্য ডিগ্রির অনেক নিচে হওয়াতে মঙ্গলে তরল পানি থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কিন্তু মঙ্গলের তাপমাত্রা দিনের বেলায় বিষুবীয় অঞ্চলে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। তার মানে সেই অঞ্চলে খুব সামান্য পরিমাণে তরল পানি থাকলেও থাকতে পারে। সেই আশায় মঙ্গলে পানির সন্ধান করে চলেছে সবগুলো আধুনিক মঙ্গল মিশন।



তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের সাথে পানির অবস্থার পরিবর্তন


 মঙ্গল গ্রহের ভূমিতে অসংখ্য নদী নালা হ্রদের চিহ্ন রয়েছে যা কালের আবর্তনে শুকিয়ে গেছে। ভূমির এসব গঠন তরল পানি-প্রবাহের প্রমাণ বহন করছে। মঙ্গল গ্রহের ভূমির উপরিস্তরে এখন কোন তরল পানি নেই। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মঙ্গলের ধূলি বা রেগোলিথের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচুর বরফ জমে আছে। রেগোলিথের মাঝে মাঝে এই রন্ধ্র বা ছিদ্রগুলো তৈরি হয়েছে জমাট কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা ড্রাই আইস থেকে। শীতকালে ড্রাই আইসের উপর সামান্য ধূলি পড়লে তা আটকে যায় সেখানে। শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তখন অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত ধূলো বা রেগোলিথের আস্তরণ ভূমিতে রয়ে যায়। এভাবে বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে চলতে এক মিটারেরও বেশি পুরু রেগোলিথের স্তর জমা হয়েছে ভূমির উপর। এই ছিদ্রগুলোর মধ্যে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের জলীয়বাষ্প জমে বরফ হয়ে থাকার সম্ভাবনা আছে। মার্স ওডিসি মিশনের ছবি ও ডাটা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মঙ্গলের ভূমির উপরিস্তরের কাছাকাছি প্রচুর জমাট বরফ আছে। নাসার মঙ্গল মিশন ওডিসি গামা রে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে এই পানি শনাক্ত করেছে। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র থেকে শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি মঙ্গলের ভূমিতে আসে। ভূমির রাসায়নিক উপাদানের সাথে মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়ায় ভূমি থেকে গামা রশ্মি ও নিউট্রন কণা নির্গত হয়। কী ধরনের মৌলের সাথে মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়া ঘটছে তার উপর নির্ভর করে নিউট্রন কণাগুলোর নির্গমনের গতি। নিউট্রন কণাগুলো কত বেগে নির্গত হচ্ছে তা শনাক্ত করা হয় মার্স ওডিসি স্যাটেলাইটের গামা রে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে। দেখা গেছে মঙ্গলের ভূমির মাত্র এক মিটার নিচেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি। এই হাইড্রোজেন প্রচুর পানির উপস্থিতির প্রমাণ। ঠিক কী পরিমাণ পানি মঙ্গলের ভূমির নিচে আছে তা সঠিকভাবে বলা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে আনুমানিক হিসেবে দেখা গেছে পৃথিবীর মহাসাগরগুলোতে একশ মিটার গভীরতা পর্যন্ত যতটুকু পানি ধরবে তার চেয়ে কম হবে না মঙ্গলের পানির পরিমাণ।

মঙ্গলের পানি কি পৃথিবীর পানির মত সুপেয়? মার্স এক্সপ্লোরেশান রোভার ও মার্স এক্সপ্রেস অরবিটার মঙ্গলের ভূমিতে প্রচুর রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করেছে যেগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন লবণ, সালফেট, ক্লোরেট ইত্যাদি। ভূমির স্তরের ঠিক নিচে যে জমাট পানি আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সে পানিতে লবণ ও সালফেট মিশে থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। ফলে মঙ্গলের পানি হবে লবণাক্ত। সাধারণ পানি শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় বরফে পরিণত হয়। কিন্তু লবণাক্ত পানি বরফে পরিণত হতে তাপমাত্রা আরো অনেক কম হতে হয়। -২১ ডিগ্রি তাপমাত্রায় লবণাক্ত পানি জমাট বেঁধে যায়। মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই তাপমাত্রায় লবণাক্ত পানি জমাট বেঁধে বরফ হয়ে আছে মঙ্গলের ভূস্তরের ঠিক নিচে।

২০২০ সালের ৩০ জুলাই  উৎক্ষেপণ করা হয়েছে মঙ্গল মিশনের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক মিশন- মার্স ২০২০ মিশন। ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এই মিশন মঙ্গলে পৌঁছে দিয়েছে আধুনিক রোভার - 'পারসিভারেন্স'। এই স্বয়ংক্রিয় রোভার মঙ্গলের মাটিতে পানি ও প্রাণের অস্তিত্ব পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করেছে। আশা করা যাচ্ছে ২০৩৫ সালের মধ্যে মঙ্গলের মাটিতে পা রাখবে পৃথিবীর মানুষ। 

______________

বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত




Wednesday, 20 January 2021

লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ১২

 



সপ্তম অধ্যায়

মঙ্গলে বসতি

 

স্পেস-এক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন আগামী কয়েক দশকের মধ্যে তিনি মঙ্গল গ্রহে গিয়ে বাস করবেন। শুধু তাই নয়, তিনি পৃথিবী থেকে অন্য যারা মঙ্গল গ্রহে গিয়ে বাস করতে ইচ্ছুক, তাদেরকেও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন।  তার জন্য আপাতত খরচ ধরা হচ্ছে জনপ্রতি পাঁচ লক্ষ ডলার বা চার কোটি টাকা। নিসন্দেহে এটা একটি উচ্চাভিলাসী প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবার পথে এখনো অনেক বাস্তব বাধা আছে। যদি ধরেও নেয়া যায় যে মঙ্গলে যাওয়ার জন্য মঙ্গল-যান তৈরি সম্পন্ন হয়েছে, এবং মানুষ মঙ্গলে পৌঁছে গেছে, কিন্তু মঙ্গলে যাওয়ার পর প্রথম বাধা হলো মঙ্গল গ্রহের বর্তমান পরিবেশ। মঙ্গল গ্রহের বর্তমান বায়ুচাপ মাত্র ৬০০ প্যাসকেল, আর গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গল গ্রহের বায়ুচাপ আর্মস্ট্রং লিমিটের অনেক নিচে। আর্মস্ট্রং লিমিট হলো বায়ুচাপের সেই সীমা - যার কম হলে মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পানি ফুটতে শুরু করে। পৃথিবীতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮ কিলোমিটার উপরে বায়ুর চাপ ৬.৩ কিলো-প্যাসকেল। এই চাপে পানি ফুটতে শুরু করে। মঙ্গলের বায়ুচাপ আর্মস্ট্রং লিমিটের দশ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম। সেই চাপে কোন মানুষ যদি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ছাড়া মঙ্গলে যায় - তার শরীরের সমস্ত জলীয় অংশ মুহূর্তেই বাষ্প হয়ে যাবে।

          অনেকেই বলছেন মঙ্গল গ্রহে বাস করার জন্য প্রয়োজনীয় কলোনি গড়ে তোলা হবে। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে যদি মানুষ কলোনি গড়ে তুলতে চায় তাহলে মঙ্গল গ্রহই তুলনামূলকভাবে উপযুক্ত গ্রহ। কারণ পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য আর মঙ্গলের দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান। পৃথিবী ও মঙ্গলের অক্ষের নতিও প্রায় একই ধরনের। ফলে পৃথিবীর মতো মঙ্গলেও ঋতু পরিবর্তন হয়। মঙ্গলের বুকে অনেক সমতল জায়গা আছে যেখানে ঘরবাড়ি তৈরি করা যাবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে - নিয়ে যেতে কী পরিমাণ সময় ও খরচ লাগবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

          সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পরিবেশ। মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর প্রাণির জন্য উপযুক্ত নয়। বায়ুমন্ডলের ৯৫% কার্বন-ডাই-অক্সাইড, গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের শতকরা মাত্র ৩৮ ভাগ, সর্বোপরি পানির উৎস সম্পর্কে এখনো কোন নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় এ শতাব্দীর মধ্যেই মানুষ মঙ্গলে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করবে বলাটা খুব বেশি যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অনেকে প্রস্তাব করছেন মঙ্গলে আগে রোবট পাঠানো হবে। তারা ঘরবাড়ি তৈরি করবে, তারপর আস্তে আস্তে মানুষ যাবে।

পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব মাত্র ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এই দূরত্বে পৃথিবী থেকে চার লিটার পানি চাঁদে পাঠাতে খরচ হবে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা। পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের ১৪২ গুণ বেশি। সে হিসেবে মঙ্গলে যদি পৃথিবী থেকে নিয়মিত খাবার ও পানীয় পাঠাতে হয়, তাহলে যে পরিমাণ খরচ হবে তা অকল্পনীয়। যদি মানুষকে মঙ্গলে কলোনি তৈরি করতে হয়, তাহলে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে খাদ্য ও পানীয়ের সমস্যার সমাধান কীভাবে করবে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য অনেকেই এখন মহাকাশ-বাগান বা অ্যাস্ট্রো-গার্ডেনিং এর কথা বলছেন।

          মানুষ মঙ্গলে যাবার সময় সাথে করে নিয়ে যাবে প্রচুর বীজ ও উদ্ভিদ। উদ্ভিদ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করবে আর অক্সিজেন ত্যাগ করবে। মানুষের বর্জ্য গাছের সার হিসেবে দেয়া যাবে। মঙ্গলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ বাতাসে টিকতে পারে এরকম উদ্ভিদের চাষ করতে হবে। তার জন্য দরকার হবে মঙ্গলে প্রচুর গ্রিন হাউজ গড়ে তোলা। পৃথিবীতে যে গ্রিন হাউজ সমস্যার সৃষ্টি করছে, মঙ্গলে সেই গ্রিন হাউজ হতে পারে খুবই দরকারি একটি উপায়।

 

চিত্র: মঙ্গলে গ্রিন হাউজের কল্পিত চিত্র

 

মঙ্গল গ্রহে জমাট পানি আছে নিশ্চিত। এই পানিকে গলানোর জন্য মঙ্গলের তাপমাত্রা বাড়াতে হবে। পুরো মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা এক সাথে বাড়ানো সম্ভব নয়। মানুষকে নিজেরা থাকার জন্য মঙ্গল গ্রহের ঘরের ভেতর পৃথিবীর পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে। যেমন আমরা প্লেনে ভ্রমণ করার সময় আকাশে বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, অক্সিজেন লেভেল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে রাখি, সেভাবেই করতে হবে। পৃথিবীর বাইরে ছোট্ট একটা এলাকাতে পৃথিবীর পরিবেশ তৈরি করাকে বলা হয় প্যারা-টেরাফর্মিং (paraterraforming)। এরকম প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষ মঙ্গলের সামগ্রিক পরিবেশ বদলে পৃথিবীর মতো করে ফেলার একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেবে। এটাকে বলা হয় টেরাফর্মিং (terraforming) বা পৃথিবীকরণ। লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যেতে পারে মঙ্গলের পরিবেশ বদলাতে।

           

চিত্র: মঙ্গলের পৃথিবীকরণের কল্পিত চিত্র

 

মঙ্গলের পরিবেশ বদলে পৃথিবীর মত করতে তিনটি প্রধান পরিবর্তন ঘটাতে হবে - ১) জলবায়ুর পরিবর্তন, ২) তাপমাত্রা বৃদ্ধি - যেন তরল পানির প্রবাহ ঘটে, ৩) জলবায়ু সুরক্ষা - যে অক্সিজেন তৈরি হবে তা যেন হারিয়ে না যায়। এগুলো করার জন্য নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি নেই। জীবনের বিকাশ ঘটলে এগুলো জীবনচক্রের মধ্যেই আস্তে আস্তে গড়ে উঠবে।

          শুরুতেই বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে হবে, এবং তার সাথে গ্রহটির সামগ্রিক তাপমাত্রা বাড়াতে হবে। মঙ্গলের মাটি থেকে গ্রিন-হাউজ গ্যাস পারফ্লুরোকার্বন নিসরণ করে বাতাসে ছেড়ে দিতে হবে। মাটিতে অনেক জমাট কার্বন-ডাই-অক্সাইড আছে। ভূস্তরের তাপমাত্রা বাড়লে সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসে পরিণত হবে। সেগুলো বাতাসের সাথে মিশে বায়ুচাপ বাড়তে শুরু করবে। বায়ুচাপ বাড়লে তরল পানির প্রবাহ পাওয়া যাবে। তখন মঙ্গলের লাল পাথরে আটকে পড়া মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসবে বেশি পরিমাণে। তারপর শুরু হবে ব্যাকটেরিয়া ও শ্যাওলার চাষ যেগুলো প্রচন্ড বৈরি পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। গাঢ় রঙের উদ্ভিদ ও শৈবালের চাষ করলে মঙ্গলের ভূমিস্তরের রঙ গাঢ় হবে এবং সূর্য থেকে অনেক বেশি তাপ শোষণ করবে। ফলে ভূস্তরের তাপমাত্রা বাড়বে। এভাবে হাজার বছর পরে হয়তো মঙ্গলে উদ্ভিদ জন্মানো শুরু হবে। তাতে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করবে।

          এসব পরিকল্পনা অনেক লক্ষ বছর পরে কী হতে পারে তার পরিকল্পনা। কিন্তু আর দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যেই যখন মানুষ মঙ্গল গ্রহে পা রাখবে - আমাদের অনেক চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটবে। যে কোন নতুন আবিষ্কার পুরনো অনেক ধারণা বদলে দেয়।

          ২০১০ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০৩৫ সালের মধ্যে আমেরিকা মঙ্গল গ্রহে নভোচারী পাঠাবে এবং তাদের আবার সুস্থ শরীরে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। সে লক্ষ্যে কাজ করছে নাসা এবং আরো অনেক মহাকাশ সংস্থা। মঙ্গল গ্রহে এপর্যন্ত অনেকগুলো মিশন সাফল্যের সাথে পরিচালিত হয়েছে। মঙ্গল গ্রহের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট। মঙ্গলের বুকে নেমে পরীক্ষা চালাচ্ছে যান্ত্রিক রোবট - রোভার। রোবট দিয়ে আমরা যে কাজ করিয়ে নিতে পারছি - সেখানে মানুষ পাঠানোর কী দরকার? দরকার হলো - যে যান্ত্রিক রোবটকে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পাঠানো হয় - তা যতই স্বয়ংক্রিয় হোক না কেন, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হয় পৃথিবীর কন্ট্রোল রুম থেকে। এক টন ওজনের রোভার মঙ্গলের বুকে এক কিলোমিটার যেতে যে সময় নেয়, তার অনেক কম সময়েই একজন নভোচারী তা করে ফেলতে পারে। মঙ্গলের ক্রেটারের দেয়াল বেয়ে একটি রোভারের নামতে বা উঠতে বছর লেগে যায়, সেখানে একজন মানুষ তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই করে ফেলতে পারে। মঙ্গলে যদি নভোচারী পাঠানো যায়, তাহলে তারা খুব সহজেই নমুনা সংগ্রহ করে নিজেদের মহাকাশযানে ফিরে এসে ল্যাবরেটরি টেস্ট করে পৃথিবীতে ফলাফল পাঠিয়ে দিতে পারে। তারপর আবার নমুনা সংগ্রহ করতে পারে। মঙ্গলকে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি জানা যাবে, যদি মঙ্গলে মানুষ পাঠানো যায়। মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর বাধা অনেক। প্রথম বাধা হলো দূরত্ব। পৃথিবী এবং মঙ্গল নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পরস্পর সবচেয়ে কাছের যে দূরত্বে আসতে পারে - সে দূরত্ব ৫ কোটি ৪৭ লক্ষ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে রকেটে চড়ে সেই দূরত্বে যেতে সময় লাগবে ৫ থেকে ১০ মাস। ফিরে আসতে লাগবে আবার ৫ থেকে ১০ মাস। মঙ্গলে গিয়ে কিছুদিন কাজ করতে হবে। নভোচারীদের জন্য শুধুমাত্র খাবার ও পানীয় নিতে হবে প্রায় দুই বছরের। কী পরিমাণ ওজন হবে এগুলোর? নভোযানের ভর যত বাড়বে, তার জ্বালানিও লাগবে তত বেশি। তাছাড়া আছে মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। মঙ্গল গ্রহে নভোচারীদের যাওয়ার সময় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়ে যেতে হবে।

          মঙ্গলে যাওয়া-আসার পুরো সময়টাতে নভোচারীদের থাকতে হবে অনেকটা ওজনহীন অবস্থায়। মহাকাশে মহাকর্ষ বল শূন্য নয়। কিন্তু পৃথিবী থেকে আমরা যতই দূরে যাবো আমাদের মহাকর্ষ বলের মান ততই কমতে থাকবে। আমরা নিজেদের ওজনহীন বলে মনে করবো। দিনের পর দিন এরকম ওজনহীন অবস্থায় থাকার ফলে শারীরিক ও মানসিক অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরজন্য দরকার অনেকদিনের ট্রেনিং। নভোচারীদের সে ট্রেনিং থাকে। তবে মঙ্গলের মত এত দীর্ঘ মহাকাশভ্রমণের ট্রেনিং এখনোপর্যন্ত কোন নভোচারীর নেই, সাধারণ মানুষের থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।

          মহাকাশবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মঙ্গল গ্রহে যাবার পথ আরো সুগম হয়ে উঠবে। এই শতাব্দীতে না হলেও ভবিষ্যত শতাব্দীতে হয়তো গড়ে উঠবে মঙ্গলে মানুষের বসতি।

 

তথ্যসূত্র 

1.    Clare Gibson, the Solar System, King Books, UK, 2012

2.    Giles Sparrow, Planets and Moons, Hinkler Books, Australia, 2006.

3.    Colin Ronan, The Universe Explained, Ken Fin Books, Australia, 1997.

4.   David A Rothery, Planets a very short introduction, Oxford University Press, Great Britain, 2010.

5.    Chris Cooper, Pam Spence, Carole Stott, Stars + Planets an illustrated guide, Star Fire, London, 2007.

6.    Gerard Cheshire, The Solar System and Beyond, Evans, London, 2006.

7.    Steve Parker, Solar System, Ticktock Media Ltd, Great Britain, 2006.Clare

8.    Heather Couper and Nigel Henbest, Encyclopedia of Space, DK Publishing, UK, 2003.

9.    Robin Kerrod & Carole Stott, Hubble the Mirror on the Universe, Third Edition, David and Charles, London, 2008.

10.  Patrick Moore, Mission to the Planets, Cassell, New York 1995.

11. Linda T. Elkins-Tanton, Mars, Chelsea House Publishers, New York, 2006.

12. Eric Burgess, To The Red Planet, Columbia University Press, New York, 1978.

13.  NSSDC Master Catalog, http://nssdc.gsfc.nasa.gov/nmc/

14.  Oliver De Goursac, Visions of Mars, Harry N. Abrams, Inc., Publishers., 2004.

15.  National Space Science Data Center,

       http://nssdc.gsfc.nasa.gov/

16.  Solar System Log by Andrew Wilson, published 1987 by Jane's Publishing Co. Ltd.

17. Mars Science Fiction to Colonization, Lighting Guides, Berkeley, California, 2015.

18.  Louisa Preston, Goldilocks and the Water Bears, the Serach for Life in the Universe, Louisa Preston, Bloomsbury Sigma, 2016.

19. Donald Rapp, Human Missions to Mars, Springer, Uk, 2008.

20. William K Hartmann, Mars The Mysterious Landscapes of the Red Planet, New York, 2003.

21.  Rod Pyle, Destination Mars New Explorations of the Red Planet, Prometheus Books, New York, 2012.

22.  Andrew Chaikin, A Passion for Mars, HNA Inc., 2008.

23.  To Mars and Beyond Search for the Origins of Life, National Museum of Australia, Canberra, 2001.

24.  Alfred S McEwen, Francis Rocard, Xavier Barral, This is Mars, Aperture, New York, 2013.

25.  Marc Kaufman, Mars Up Close Inside the Curiosity Mission, National Geographic, USA, 2014.

26.  Peter Bond, Space Recognition Guide, Collins, UK, 2008.

 ______


লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ১১

 


ষষ্ঠ অধ্যায়

মঙ্গলে প্রাণ 

মঙ্গল গ্রহে সবগুলো অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হলো একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা - মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব কি না নাসার অনেকগুলো সফল মিশন থেকে মঙ্গল গ্রহের বর্তমান পরিবেশ সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে - তাতে বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমান অবস্থায় মঙ্গল গ্রহে স্বাভাবিক-প্রাণ থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এই 'স্বাভাবিক-প্রাণ' বলতে আমরা বুঝছি পৃথিবীর প্রাণ-রাসায়নিক ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা প্রাণ। পৃথিবীর প্রাণের মূল ভিত্তি তরল পানি। পৃথিবীতে তরল পানির অস্তিত্ব যেখানে আছে - সেখানেই প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা মঙ্গলেও যদি পানির অস্তিত্ব থাকে - তাহলে প্রাণের অস্তিত্বও থাকতে পারেবিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পানির অস্তিত্বের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র পানির আভাস থাকলেই যে প্রাণের উদ্ভব ঘটবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।

মঙ্গল মিশনগুলো মঙ্গল গ্রহের সবদিক থেকে হাজার হাজার ছবি তুলে পাঠিয়েছে। সাথে পাওয়া গেছে অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত। সেগুলো বিশ্লেষণ করে মঙ্গল গ্রহে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে কি না সে ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

          মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ধারণা পেয়েছেন। মঙ্গলের বায়ুচাপ মাত্র ৬.১ মিলিবার। পৃথিবীর গড় বায়ুচাপ ১০১৩.২৫ মিলিবার। পৃথিবীর গড় বায়ুচাপকে আমরা হিসেবের সুবিধার্থে ১ atm বা ১ অ্যাটমোস্ফেরিক প্রেসার একক ধরে থাকি। সে হিসেবে মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ হলো পৃথিবীর বায়ুচাপের এক হাজার ভাগের ছয় ভাগ (6.0 x 10-3) মাত্র। মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় পানি বরফ হয়ে যায়। সেখানে শূন্য ডিগ্রিরও ৬৩ ডিগ্রি নিচে কোন তরল পানি থাকতে পারে না। তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের পরিবর্তনের সাথে পানির যে তিন অবস্থা - তরল, কঠিন, বায়বীয় - তার পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীর এক বায়ুমন্ডলীয় চাপে শূন্য ডিগ্রি থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি তরল আকারে থাকে, ১০০ ডিগ্রির উপরে গেলে পানি বাষ্পে বা বায়বীয় অবস্থায় চলে যায়, আর শূন্য ডিগ্রির নিচে গেলে পানি বরফ বা কঠিন অবস্থায় চলে যায়।

বায়ুর চাপ কমতে থাকলে পানির স্ফুটনাংকও কমতে থাকে। বায়ুর চাপ কমতে কমতে ৬.১ মিলিবার বা 6.0 x 10-3 atm এর কাছাকাছি এলে ০.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি একই সাথে কঠিন, তরল কিংবা বায়বীয় অবস্থায় থাকতে পারে। এই অবস্থাকে পানির ট্রিপল পয়েন্ট বলা হয়। মঙ্গল গ্রহের বায়ুচাপ পানির ট্রিপল পয়েন্টের বায়ুচাপের সমান। কিন্তু তাপমাত্রায় শূন্য ডিগ্রির অনেক নিচে হওয়াতে মঙ্গলে তরল পানি থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কিন্তু মঙ্গলের তাপমাত্রা দিনের বেলায় বিষুবীয় অঞ্চলে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। তার মানে সেই অঞ্চলে খুব সামান্য পরিমাণে তরল পানি থাকলেও থাকতে পারে। সেই আশায় মঙ্গলে পানির সন্ধান করে চলেছে সবগুলো আধুনিক মঙ্গল মিশন।

মঙ্গল গ্রহের ভূমিতে অসংখ্য নদী নালা হ্রদের চিহ্ন রয়েছে যা কালের আবর্তনে শুকিয়ে গেছে। ভূমির এসব গঠন তরল পানি-প্রবাহের প্রমাণ বহন করছে। মঙ্গল গ্রহের ভূমির উপরিস্তরে এখন কোন তরল পানি নেই। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মঙ্গলের ধূলি বা রেগোলিথের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচুর বরফ জমে আছে। রেগোলিথের মাঝে মাঝে এই রন্ধ্র বা ছিদ্রগুলো তৈরি হয়েছে জমাট কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা ড্রাই আইস থেকে। শীতকালে ড্রাই আইসের উপর সামান্য ধূলি পড়লে তা আটকে যায় সেখানে। শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তখন অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত ধূলো বা রেগোলিথের আস্তরণ ভূমিতে রয়ে যায়। এভাবে বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে চলতে এক মিটারেরও বেশি পুরু রেগোলিথের স্তর জমা হয়েছে ভূমির উপর। এই ছিদ্রগুলোর মধ্যে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের জলীয়বাষ্প জমে বরফ হয়ে থাকার সম্ভাবনা আছে।

 

চিত্র: তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের সাথে পানির অবস্থার পরিবর্তন

 

মার্স ওডিসি মিশনের ছবি ও ডাটা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মঙ্গলের ভূমির উপরিস্তরের কাছাকাছি প্রচুর জমাট বরফ আছে। নাসার মঙ্গল মিশন ওডিসি গামা রে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে এই পানি শনাক্ত করেছে। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র থেকে শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি মঙ্গলের ভূমিতে আসে। ভূমির রাসায়নিক উপাদানের সাথে মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়ায় ভূমি থেকে গামা রশ্মি ও নিউট্রন কণা নির্গত হয়। কী ধরনের মৌলের সাথে মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়া ঘটছে তার উপর নির্ভর করে নিউট্রন কণাগুলোর নির্গমনের গতি। নিউট্রন কণাগুলো কত বেগে নির্গত হচ্ছে তা শনাক্ত করা হয় মার্স ওডিসি স্যাটেলাইটের গামা রে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে। দেখা গেছে মঙ্গলের ভূমির মাত্র এক মিটার নিচেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি। এই হাইড্রোজেন প্রচুর পানির উপস্থিতির প্রমাণ। ঠিক কী পরিমাণ পানি মঙ্গলের ভূমির নিচে আছে তা সঠিকভাবে বলা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে আনুমানিক হিসেবে দেখা গেছে পৃথিবীর মহাসাগরগুলোতে একশ মিটার গভীরতা পর্যন্ত যতটুকু পানি ধরবে তার চেয়ে কম হবে না মঙ্গলের পানির পরিমাণ।

 

চিত্র: ২০১৫ সালে নাসা ঘোষণা করেছে যে মঙ্গলে তরল পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। গার্নি ক্রেটারের পাড় থেকে যে সরল রেখাগুলো নিচের দিকে নেমে গেছে সেগুলোর একেকটার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ মিটার। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে এগুলো সব মঙ্গলের লবণাক্ত পানির ধারা।

         

মঙ্গল গ্রহে প্রাণ থাকার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা খুব বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীতে পাওয়া মঙ্গলের উল্কাপিন্ড পরীক্ষা করে। ১৯৮৪ সালে অ্যান্টার্কটিকার অ্যালেন হিল্‌স-এ পাওয়া যায় উল্কাপিন্ড এ-এল-এইচ-৮৪০০১। আইসোটোপিক ডেটিং পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে এই উল্কাপিন্ডের বয়স প্রায় ৪০০ কোটি বছর। এই পাথরটি মঙ্গল গ্রহের অংশ। প্রায় দেড় কোটি বছর আগে এটা মঙ্গল গ্রহ থেকে ছিটকে পড়েছিল। তারপর মহাকাশে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ বছর আগে। ১৯৮৪ সালে এই পাথরটি আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে এই পাথরে মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ আছে। এই দাবির ভিত্তিতে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে। তারপর থেকে এপর্যন্ত কয়েক শ' গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে শুধুমাত্র এই উল্কাপিন্ডের উপর ভিত্তি করে মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সপক্ষে।

          এই পাথরটিতে পাওয়া গেছে সিলিকেট ছাড়াও আরো অনেক ধরনের খনিজ কার্বনেট, যাদের মধ্যে আছে ক্যালসাইট, ম্যাগনেসাইট, অ্যানকেরাইট, ও সাইডেরাইট। সাইডেরাইটের মধ্যে আছে ম্যাগনেটাইট ও পাইরোটাইটের কৃস্টাল। দেখা গেছে পাথরের সিলিকেটগুলোর বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। কিন্তু কার্বনেটগুলোর বয়স ৩৯০ থেকে ৪১০ কোটি বছরের মধ্যে। তার মানে মঙ্গল গ্রহ তৈরি হবার সময় যে সিলিকেট ছিল তার উপর কার্বনেট এসেছে আরো ৫০ কোটি বছর পর। খনিজ কার্বনেট তৈরি হয় পানি থেকে। সুতরাং মঙ্গলে কার্বনেট থাকার অর্থ হচ্ছে সেখানে সেই সময় পানি ছিল। ১ কেজি ৯৩১ গ্রাম ভরের পাথরটির মাত্র ১% অর্থাৎ মাত্র ১৯ গ্রাম হলো খনিজ কার্বনেট। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হয়ে উঠেন মঙ্গলে প্রাণ থাকার ব্যাপারে।

          মঙ্গলে প্রাণ থাকার ব্যাপারে বড় প্রমাণ হলো এই উল্কাপিন্ডের একটি অংশে অণুজীবের ফসিল পাওয়া যায়। সূক্ষ্ম নলাকৃতি এসব ফসিল ন্যানো-ব্যাকটেরিয়ার বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এখনো নিশ্চিন্তভাবে প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে মঙ্গল গ্রহে এধরনের ফসিল আরো পাওয়া যাবে - যা মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।

কার্বনেট মিনারেলের মধ্যে সামান্য পরিমাণে ম্যাগনেটাইট পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা মঙ্গলের ব্যাকটেরিয়াগুলো এই ম্যাগনেটাইট তৈরি করেছে। পৃথিবীতে এক শ্রেণির ব্যাকটেরিয়া নিজেদের শরীরে মাইক্রোস্কোপিক ক্রিস্টাল তৈরি করে, পৃথিবীর চুম্বকত্ব কাজে লাগিয়ে সমুদ্রের গভীরে দিক নির্ণয় করার জন্য। তাই এই ক্রিস্টালগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ম্যাগনেটাইট। মঙ্গলের পাথরে পাওয়া ম্যাগনেটাইট ক্রিস্টালগুলোর গঠনের সাথে পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ম্যাগনেটাইটের ক্রিস্টালের গঠনের মিল নেই। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে এই ক্রিস্টালের গঠনের সাথে পৃথিবীর ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্ট ম্যাগনেটাইটের ক্রিস্টালের গঠনের মিল আছে। সেসূত্রে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন যে এগুলো মঙ্গলের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে দুটো সিদ্ধান্তে আসা যায়। এক - মঙ্গলে অণুজীব ছিল, দুই - মঙ্গলের চুম্বকত্ব ছিল।

 

চিত্র: এ-এল-এইচ-৮৪০০১ উল্কাপিন্ডে অণুজীবের ফসিল

 

মঙ্গলে এখন কোন চুম্বকত্ব অবশিষ্ট নেই। কোন কোন পাথরে সামান্য চুম্বকত্বের আভাস পাওয়া গেছে, যেখান থেকে প্রমাণিত হয় যে মঙ্গলে এক সময় চুম্বকত্ব ছিল। কিন্তু ঠিক কখন এবং কী কারণে মঙ্গলের চুম্বকত্ব নষ্ট হয়ে গেছে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।

          কোন কোন বিজ্ঞানী যুক্তি দিচ্ছেন যে যে প্রচন্ড সংঘর্ষের ফলে মঙ্গল গ্রহের এই পাথরটি ছিটকে বেরিয়ে গেছে - সেই সংঘর্ষের ফলে প্রাণের কোন অস্তিত্বের প্রমাণ টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু মহাকাশ হলো প্রচন্ড ঠান্ডা। এই উল্কাখন্ডগুলো যতদিন মহাকাশে ভ্রমণ করে - একটা বিশাল প্রাকৃতিক ডিপ-ফ্রিজের মধ্যে থাকে। সুতরাং জীবনের কোন চিহ্ন যদি সেখানে থাকে তা মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে আসার ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে না। মঙ্গলের পাথরে কার্বনেটের চিহ্ন - মঙ্গলে জীবনের চিহ্নই নির্দেশ করে।

          মঙ্গল গ্রহের যে পরিবেশ তাতে কোন জীব বা অণুজীব বেঁচে থাকতে পারে কি না - সে প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীতে কিছু অণুজীব আছে যারা অত্যন্ত প্রতিকুল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। কিছু ব্যাকটেরিয়া - যাদের নাম দেয়া হয়েছে কেমোলিথোওঅটোট্রোফস - নিজের শরীর থেকে শক্তি নিয়েই পাথরের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। এরা কোন ধরনের সূর্যালোক ছাড়া শুধুমাত্র ১% অক্সিজেন লেভেলেও বেঁচে থাকতে পারে। এরা মিথেন, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা কিংবা আর্সেনিক থেকেও তাদের দরকারি শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। এদের অনেকে খনিজ সালফার খেয়ে সালফিউরিক এসিড তৈরি করে নিজের শরীরে। সাগরের কয়েক কিলোমিটার নিচে পাথরের খাঁজে খাঁজে বাস করছে এসব ব্যাকটেরিয়া। তীব্র এসিডিক পানিতেও বেঁচে থাকতে পারে অনেক ব্যাকটেরিয়া। একধরনের অণুজীব - ফেরোপ্লাজমা - তীব্র এসিডের  (pH = 0) মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে। পৃথিবীতে আরো অণুজীব আছে, যেমন এক্সট্রিমোফিলস, - যারা প্রচন্ড ঠান্ডা কিংবা প্রচন্ড গরমেও বেঁচে থাকে। বিজ্ঞানীরা যুক্তি দিচ্ছেন পৃথিবীতেই যদি এরকম অণুজীব থাকতে পারে - তাহলে মঙ্গলের অণুজীবরাও পারবে। মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না সে প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দেয়ার জন্য মঙ্গলে আরো অনেক অভিযান চালানো দরকার। বিশেষ করে নভোচারীরা যদি মঙ্গলে সশরীরে গিয়ে পরীক্ষা চালাতে পারেন, তাহলে মঙ্গলে জীবনের জীবাশ্ম পাওয়া যেতেও পারে।

লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ১০

 



পঞ্চম অধ্যায়

মঙ্গলের চাঁদ

 

মঙ্গল গ্রহের চারপাশে ঘুরছে তার দুটো উপগ্রহ - ফোবোস ও ডিমোস। মঙ্গলের এই উপগ্রহ দুটোর আকৃতি আমাদের চাঁদের মত জ্যামিতিক গোলাকার নয়, অনেকটা বড় সাইজের আলুর মত। আর আকারেও আমাদের চাঁদের তুলনায় অত্যন্ত ছোট। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আসফ হল ১৮৭৭ সালের আগস্ট মাসে মঙ্গলের এই উপগ্রহদুটো আবিষ্কার করেছিলেন। রোমান পৌরাণিক কাহিনির যুদ্ধের দেবতা মার্সের ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া দুটোর নাম ছিল ফোবোস ও ডিমোস। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে ফোবোস হলো অ্যারিস (মার্স)  ও আফ্রোদিতি (ভেনাস)'র ছেলে। আসফ হল মঙ্গলের এই উপগ্রহদুটোর নাম রাখলেন ফোবোস ও ডিমোস - আতঙ্ক ও ভয়। উপগ্রহদুটো মঙ্গলের বিষুব রেখা বরাবর প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরছে। দুটো উপগ্রহই অনুজ্জ্বল পদার্থ দিয়ে তৈরি, তাই এরা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। এদের গঠন ও উপাদান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এরা আসলে উপগ্রহ নয় - এরা হয়তো অন্য কোন গ্রহের বিচ্ছিন্ন অংশ, যারা মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ বলের টানে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু ওরকম হলে তারা এমন বৃত্তাকার কক্ষপথে এত কাছ থেকে ঘুরতো না। পৃথিবীর চাঁদ পৃথিবী তৈরি হবার সময়েই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলের চাঁদদুটো মঙ্গলের সাথে তৈরি হয়নি। হতে পারে এগুলো মঙ্গলেরই ছিটকে পড়া অংশ থেকে তৈরি হয়েছে। কোন একটা মহাজাগতিক সংঘর্ষে মঙ্গলের দুটো অংশ ছিটকে পড়েছিল। সেই অংশদুটোই মঙ্গলের মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্রে আটকে পড়ে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে উপগ্রহের মতো।

          উপগ্রহদুটোর মধ্যে ফোবোসের আয়তন ডিমোসের চেয়ে বড়। মঙ্গলের ভূমি থেকে ফোবোসের দূরত্ব ৫,৯৮১ কিলোমিটার। ফোবোসের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ, অর্থাৎ মঙ্গলের কেন্দ্র থেকে ফোবোসের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব, ৯৩৭৮ কিলোমিটার। ৭ ঘন্টা ৩৯ মিনিটে মঙ্গলের চারপাশে একবার ঘুরে আসে ফোবোস। মঙ্গলের ভূমি থেকে বিষুবরেখা বরাবর তাকালে দেখা যায় ফোবোস মঙ্গলের পশ্চিম দিকে উঠে আর ৪ ঘন্টা ২০ মিনিট পর পূর্ব দিকে অস্ত যায়। তারপর ১১ ঘন্টা পর আবার উদয় হয়।

          ফোবোসের আকৃতি এবড়ো-খেবড়ো। এর গড় ব্যাস মাত্র ২২.২ কিলোমিটার এবং ক্ষেত্রফল ৬,১০০ বর্গ কিলোমিটার। এর উজ্জ্বলতা খুব কম, কারণ সূর্যের আলোর মাত্র ৭.১% প্রতিফলিত হয় এর গা থেকে। পৃথিবীর চাঁদ যেমন আলো দেয়, মঙ্গলের চাঁদ সেরকম আলো দেয় না। ফোবোসের ঘনত্ব এত কম যে এটাকে কঠিন পাথুরে উপগ্রহ বলা চলে না। ধারণা করা হচ্ছে ফোবোস গঠিত হয়েছে খুবই হালকা ধুলোর মত পদার্থ দিয়ে। এর  উপরিতলের ধুলোর আস্তরণের পুরুত্ব হতে পারে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু এর মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ প্রায় নগণ্য। এত কম মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে এত ধুলো কীভাবে ধরে রাখছে এটা এখনো রহস্যময়।

          ফোবোসের গায়ে ৯ কিলোমিটার চওড়া বিশাল এক ক্রেটার। এই ক্রেটারের নাম স্টিকনি। ধারণা করা হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের উপর গ্রহাণুর আঘাতের ফলে মঙ্গল গ্রহ থেকে ছিটকে আসা বড় কোন পাথরের টুকরোর আঘাতে এই ক্রেটারের সৃষ্টি হয়েছে।

          ফোবোস মঙ্গলের ভূমির এত কাছে থেকে চারপাশে ঘুরছে যে, ঘুরতে ঘুরতে এটা মঙ্গলের আরো কাছে চলে আসছে। আগামী ৮০ লক্ষ বছরের মধ্যে ফোবোস মঙ্গলের ভূমির মাত্র ৭,১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসবে। এই দূরত্ব হলো ফোবোসের রোশ লিমিট (Roche Limit)। ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুয়ার্ড রোশ ১৮৪৮ সালে হিসেব করে দেখিয়েছিলেন কোন গ্রহের উপগ্রহ যদি একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের চেয়ে গ্রহটির কাছে চলে আসে, তখন গ্রহটির মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে উপগ্রহটি ভেঙে যায়। তারপর সেই ভাঙা টুকরোগুলো গ্রহটির চারপাশে একটি বৃত্ত তৈরি করে ঘুরতে থাকে। ফোবোসও ভেঙে গিয়ে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে থাকবে।

 

চিত্র: ফোবোসের ক্রেটার - স্টিকনি

         

ফোবোসের তুলনায় অনেক ছোট উপগ্রহ ডিমোস। মঙ্গল থেকে ২৩,৪৫৯ কিলোমিটার দূরে থেকে ৩০ ঘন্টা ১৮ মিনিটে মঙ্গলের চারপাশে একবার ঘুরে আসে ডিমোস। ফোবোস যেমন ক্রমশ মঙ্গলের কাছে চলে আসছে, ডিমোস আস্তে আস্তে মঙ্গল থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। মঙ্গলের বিষুব রেখা থেকে দেখলে ডিমোস মঙ্গলের আকাশে পূর্ব দিকে উঠে, আর ৬০ ঘন্টা পর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়।

          ডিমোসের আকৃতিও এবড়ো-খেবড়ো। এর আকার ১৫ কিমি x ১২.২ কিমি x ১০.৪ কিমি, মোট ক্ষেত্রফল মাত্র ১৪০০ বর্গ কিলোমিটার। ডিমোসের গায়েও ক্রেটারের চিহ্ন আছে, তবে ফোবোসের মত অত বড় নয়। ডিমোসের ক্রেটারগুলোর ব্যাস ২.৫ কিলোমিটারের কম।

 

সারণি: ফোবোস ও ডিমোসের ভৌত উপাত্ত

উপাত্ত

ফোবোস

ডিমোস

কক্ষপথের ব্যাসার্ধ

৯,৩৭৮ কিমি

২৩,৪৫৯ কিমি

কক্ষপথে একবার ঘুরতে সময় লাগে

৭ ঘন্টা ৩৯ মিনিট

৩০ ঘন্টা ১৮ মিনিট

কক্ষপথের নতি

.০৮ ডিগ্রি

.৭৯ ডিগ্রি

কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা

.০১৫১

.০০০৫

গড় আকার

২৬.৮ কিমি x ২২.৪ কিমি x ১৮.৪ কিমি

১৫ কিমি x ১২.২ কিমি x ১০.৪ কিমি

ভর

১০৬ কোটি কোটি কিলোগ্রাম

২৪ কোটি কোটি কিলোগ্রাম

গড় ঘনত্ব

১৯০০ কেজি/ঘন মিটার

.৯ গ্রাম/সিসি

১৭৫০ কেজি/ঘন মিটার

.৭৫ গ্রাম/সিসি

ক্ষেত্রফল

৬,১০০ বর্গ কিমি

১,৪০০ বর্গ কিমি

 

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts