পূরবীর শেষ বসন্ত কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “সময় রয়েছে বাকি; সময়েরে দিতে ফাঁকি, ভাবনা রেখো না মনে কোনো।“ কিন্তু কবি যতই নিশ্চিন্ত আশ্বাসের বাণী দিন, ভাবনা রয়ে যায়। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় হলো – সময়। এখানে এখন ক্ষুদ্রতম সময়েরেও ফাঁকি দেয়া দিনে দিনে অসম্ভব হয়ে উঠছে। ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইতে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং দেখিয়েছেন মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক বিবর্তন আর সময়ের ইতিহাস সমতুল। সময় এবং স্থানের পারস্পরিক জটিল সম্পর্কের ভেতর থেকে আইনস্টাইন বের করে এনেছেন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব – যা বদলে দিয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। সময় সম্পর্কে আমরা যতই জানছি – ততই জটিল হয়ে যাচ্ছে সময়ের সংজ্ঞা, সময়ের সমীকরণ।
সময়ের ধারণা কীভাবে ধরা দেয় আমাদের মনে? আমরা আমাদের পারিপার্শ্বিক ঘটনার পরিবর্তনের সাথে তুলনা করে সময় বোঝার চেষ্টা করি। যেমন হৃৎপিন্ডের একটি স্পন্দনের সময় – মোটামুটি এক সেকেন্ড ধরা যায়। দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনায় আমরা অনেক সময় বলে থাকি এক নিমেষেই ঘটে গেল সব। বাংলায় এই নিমেষ হলো চোখের পলক ফেলতে যতটুকু সময় লাগে। চোখের পলক ফেলতে গড়ে একশ থেকে দেড়শ মিলিসেকেন্ড সময় লাগে, অর্থাৎ ধরা যায় এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময় লাগে। নিমেষের হিসেবে ধরলেও এক সেকেন্ড অনেক লম্বা সময়।
কোনো একটি ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ সময় লাগে তা স্বাভাবিক নিয়মে হিসেব করতে হলে আমাদের ঘটনাটা ঘটতে দেখা চাই। আবার যেকোনো কিছু সরাসরি দেখার জন্য আমাদের আলোর দরকার। কিন্তু আলো থাকলে এবং আমাদের চোখের সামনে ঘটনা ঘটলেই কি আমরা দেখতে পাই সবকিছু? না, পাই না। কারণ আমাদের চোখের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের চোখের স্বাভাবিক রেজ্যুলেশান বা সূক্ষ্মদর্শনের ক্ষমতা মাত্র একশ মাইক্রোমিটার। অর্থাৎ কোন বস্তু যদি এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগের চেয়ে ছোট হয়, স্বাভাবিক চোখে আমরা তা দেখতে পাবো না।
আবার দেখার জন্য যে আলো লাগে – সেই আলোর তরঙ্গের খুব সামান্য অংশই – চার শ ন্যানোমিটার থেকে সাত শ ন্যানোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো – আমাদের চোখের রেটিনার কোষের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করতে পারে। তাই চারশ ন্যানোমিটারের কম বা সাত শ ন্যানোমিটারের বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমরা দেখতে পাই না। বাতাস ভরযুক্ত অক্সিজেন, নাইট্রোজেনসহ আরো কয়েকটি গ্যাসের মিশ্রণ – কিন্তু আমরা বাতাস দেখতে পাই না। রাসায়নিক কিংবা ভৌতবিক্রিয়া অনবরত ঘটছে আমরা জানি, কিন্তু সরাসরি তা দেখতে পাই না। বলা যায় বস্তুজগতের বেশিরভাগ সূক্ষ্ম ঘটনা, দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা আমাদের নেই।
কিন্তু সরাসরি দেখতে না পারলে কী হবে, পরোক্ষভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনাগুলি দেখার অনেক পদ্ধতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ২০২৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে এমনই আশ্চর্যজনক ক্ষুদ্রতম সময়ে ঘটা ঘটনাগুলি দেখার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য – যার নাম দেয়া হয়েছে অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স। এই অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স দ্রুততম সময়ে ঘটা ইলেকট্রনের কাজকর্ম দেখারও সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা এমনই এক আশ্চর্যজনক ফিজিক্স – যা বুঝতে হলে আমাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে অনেককিছু।
শুরুতেই দেখা যাক – অ্যাটোসেকেন্ড বলতে কতটুকু সময় বোঝায়। এক অ্যাটোসেকেন্ড হলো ১০-১৮ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক সেকেন্ডকে একশ কোটি ভাগ করে তার এক ভাগকে আবার এক শ কোটি ভাগ করলে এক ভাগের যে সময় হবে সেটা। আলো এক সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার যেতে পারে। অটোসেকেন্ডের হিসেব করলে এক মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে আলোর সময় লাগবে প্রায় তিনশ ত্রিশ কোটি অ্যাটোসেকেন্ড। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স হলো অ্যাটোসেকেন্ড স্কেলের পরিমাপের মতো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আলোর স্পন্দন তৈরি করার পদার্থবিজ্ঞান – যে স্পন্দনের মাধ্যমে সেই সূক্ষ্মতম স্কেলে পরিমাপযোগ্য সময়ের ভেতর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি দেখা সম্ভব।
দ্রুততম সময়ে ঘটা ঘটনাগুলি আমরা কীভাবে দেখতে পারি? যেমন ক্রিকেট খেলার কথা ধরা যাক। একজন ফাস্টবোলার যখন বল করেন, তখন ক্যামেরাম্যানরা সেই বল ব্যাটারের ব্যাটে লাগার মুহূর্তের ছবি তোলার জন্য লম্বা লম্বা লেন্স তাক করে বসে থাকেন। তখন তাদের ক্যামেরার শাটার স্পিড এমনভাবে সেট করা থাকে যেন দ্রুততম সময়ে ঘটনাটির ছবি তোলা যায়। ঘটনাটি যে বেগে ঘটবে, শাটারের বেগ হতে হবে তার চেয়ে বেশি। নইলে ছবি ঝাপসা হয়ে যাবে। শাটারের বেগ বেশি হবার অর্থ হলো ক্যামেরার ডায়াফ্রাম খোলা হবে খুব কম সময়ের জন্য। প্রচন্ড গতিশীল বস্তুর উপর তখন খুব কম সময়ের জন্য আলো পড়ে সেই সময়টিকে স্থির করে ধরে নেবে ক্যামেরায়।
কিন্তু ক্রিকেট বলের গতির চেয়ে কোটি কোটি গুণ দ্রুত ঘটে পরমাণুর ইলেকট্রনের কাজকর্ম। ইলেকট্রনের কক্ষপথ কিংবা শক্তিস্তরের পরিবর্তন ঘটতে সময় নেয় মাত্র কয়েকশ অ্যাটোসেকেন্ড। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স-এর প্রয়োগে ইলেকট্রনের দ্রুততম গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার সম্ভাবনার দরজা খোলার চেষ্টা করে চলেছেন যে ক’জন বিজ্ঞানী গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে – তাঁদেরই তিনজন অগ্রনায়ককে এবছর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এই তিনজন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী হলেন – অ্যান লুইলিয়ের, ফেরেঙ্ক ক্রাউজ এবং পিয়ের আগস্তিনি।
পিয়ের আগস্তিনি, ফেরেঙ্ক ক্রাউজ এবং অ্যান লুইলিয়ের |
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের মধ্যে নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা এখনো পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। ১৯০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত – চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন মাত্র তেরো জন নারী, রসায়নে মাত্র আট জন, এবং পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে কম – মাত্র পাঁচজন। ১৯০৩ সালে মেরি কুরির পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবার পরবর্তী ষাট বছর আর কোন নারী পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাননি। ১৯৬৩ সালে মারিয়া গোয়েপার্ট মেয়ার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার জয়ী দ্বিতীয় বিজ্ঞানী। এরপর আবার পঞ্চান্ন বছরের দীর্ঘ বিরতি। অবশেষে ২০১৮ সাল থেকে এবছর পর্যন্ত আরো তিনজন নারী পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের অগ্রনায়ক প্রফেসর অ্যান লুইলিয়ার নোবেলজয়ী পঞ্চম নারী পদার্থবিজ্ঞানী। এবছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার সেহিসেবেও অনন্য মাত্রা পেয়েছে।
অ্যান লুইলিয়ার (Anne L’Huillier)-এর জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৬ আগস্ট ফ্রান্সের প্যারিসে। প্যারিসের ইকোল নরমাল সুপেরিয়র থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএ পাস করার পর পিয়ের অ্যান্ড মেরি কুরি ইউনিভার্সিটি থেকে গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে ডাবল মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে ১৯৮৬ সালে। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল ‘মাল্টিফোটন অ্যান্ড মাল্টিইলেকট্রন আয়নাইজেশান’। উচ্চ তীব্রতার লেজার রশ্মি প্রয়োগে একাধিক ফোটন এবং ইলেকট্রনের আয়নাইজেশান সংক্রান্ত গবেষণা করেন তিনি তাঁর পিএইচডির সময় – যা পরবর্তীতে আরো গভীরে গিয়ে তাঁর নোবেল পুরষ্কারের পথ তৈরি করেছিল।
পিএইচডি করার পর তিনি সুইডেনের গুথেনবার্গের কালমার্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্টডক ফেলো হিসেবে যোগ দেন, এবং এর কিছুদিন পর আমেরিকার লস এঞ্জেলেস-এ ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান। তবে বেশিদিন ছিলেন না সেখানে। ইতোমধ্যে তিনি ফ্রান্সের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের অধীনে যে নয়টি গবেষণাকেন্দ্র আছে – তাদের অন্যতম কেন্দ্র স্যাকলে সেন্টারে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯২ সালে তিনি সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে টাইটানিয়াম-স্যাফায়ার সলিড স্টেট লেজার সিস্টেমে কাজ করেন। ওটা ছিল ইওরোপের প্রথম ফেমটোসেকেন্ড পাল্স উৎপাদনক্ষম লেজার। ফেমটোসেকেন্ড হলো ১০-১৫ সেকেন্ড, অর্থাৎ এক সেকেন্ডের একশ কোটি ভাগের একভাগ সময়কে আরো দশ লক্ষ ভাগ করলে প্রতি ভাগ সময়ের সমান। ফেমটোসেকেন্ড পাল্স হলো ফেমটোসেকেন্ড স্থায়ী আলোর স্পন্দন। লেজারের সাহায্যে এরকম স্পন্দন তৈরি করা শুরু হয়েছিল ১৯৯০র দশকে। ১৯৯৪ সালে অ্যান পাকাপাকিভাবে প্যারিস থেকে সুইডেনে চলে যান লুন্ড ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে। ১৯৯৭ সালেই তিনি লুন্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ২০০৪ সালে তিনি সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যপদ লাভ করেন। ২০০৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি নোবেল কমিটি ফর ফিজিক্সের সদস্য ছিলেন। সেই আট বছর তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
তাঁর গবেষণা – তাঁকে নোবেল পুরষ্কার ছাড়াও আরো অনেক পুরষ্কার এনে দিয়েছে। ২০০৩ সালে তিনি পেয়েছেন জুলিয়াস স্প্রিঙ্গার প্রাইজ, ২০১১ সালে পেয়েছেন ইউনেস্কোর লরিয়াল ওম্যান ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড, ২০১৩ সালে পেয়েছেন কার্ল-জেইস রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮ সালে মনোনীত হয়েছেন আমেরিকান ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের ফরেন অ্যাসোসিয়েট, ২০১৯ সালে পেয়েছেন ইওরোপিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটির প্রাইজ ফর ফান্ডামেন্টাল এস্পেক্টস অব কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অপটিক্স। ২০২১ সালে তিনি পেয়েছেন অপটিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার ম্যাক্স বর্ন অ্যাওয়ার্ড। ২০২২ সালে তিনি পেয়েছেন ইজরায়েলের উল্ফ ফাউন্ডেশানের উল্ফ প্রাইজ ফর ফিজিক্স। গত বেশ কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে যাঁরা উল্ফ প্রাইজ পান, তাঁদের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকগুণ। তাই ২০২২ সালে উল্ফ প্রাইজ পাবার পর অনেকেই সঠিকভাবে ধারণা করেছিলেন যে অ্যান লুইলিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাবেন।
২০২২ সালের উল্ফ ফিজিক্স প্রাইজ পেয়েছেন তিনজন – যাদের মধ্যে দু’জন এবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। দ্বিতীয় জন হলেন জার্মানির প্রফেসর ফেরেঙ্ক ক্রাউজ (Ferenc Krausz) । ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট অব কোয়ান্টাম অপটিক্স -এর পাঁচজন ডিরেক্টরের একজন হলেন ফেরেঙ্ক ক্রাউজ। একই সাথে তিনি মিউনিখ লুডবিগ ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটিরও প্রফেসর।
ফেরেঙ্ক ক্রাউজের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৭ মে হাঙ্গেরিতে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি হাঙ্গেরির ইউটভোস লোরান্ড ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি এবং টেকনিক্যাল ইউইভার্সিটি অব বুদাপেস্ট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ভিয়েনায় চলে যান পিএইচডি করার জন্য। ১৯৯১ সালে তিনি ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্সে পিএইচডি অর্জন করেন। এরপর মাত্র দুবছরের মধ্যেই তিনি ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে ‘হ্যাবিলিটেশান’ সম্পন্ন করেন। এই হ্যাবিলিটেশান পদ্ধতিটি ইওরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে অবশ্যই লাগে। শুধুমাত্র পিএইচডি সম্পন্ন করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত থেকে দীর্ঘদিন ধরে ক্লাসরুমে পড়ানো এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন নিয়মিত বেতন-ভাতাও পাওয়া যায় না। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। গবেষণার জন্য গবেষণা-বক্তৃতা দিতে হয় এবং প্রতিপক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। অনেক সময় পাঁচ থেকে দশ বছর সময় লেগে যায় এসব সম্পন্ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে। অবশ্য এটা হয়ে গেলে তখন পূর্ণ অধ্যাপকের মর্যাদা পাওয়া যায়। ফেরেঙ্ক ক্রাউজ খুব কম সময়ের মধ্যে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষক হয়ে গেলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ফুল প্রফেসর হয়ে গেলেন। ২০০০ সালে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এডভান্সড লাইট সোর্সেস-এর ডিরেক্টর নিযুক্ত হলেন। এর তিন বছর পর ২০০৩ সালে তিনি জার্মানিতে ম্যাক্স প্লাংক ইন্সটিটিউট অব কোয়ান্টাম অপটিক্স এর ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটির এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সেরও চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করে আসছেন।
অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের একজন পথিকৃৎ বলে ধরা হয় প্রফেসর ক্রাউজকে। এবছরের নোবেল পুরষ্কার পাবার আগে তিনি গত দুই দশক ধরে অনেকগুলি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা পুরষ্কার পেয়েছেন। ২০০৫ সালে পেয়েছেন জার্মান রিসার্চ ফাউন্ডেশানের লিবনিজ প্রাইজ, ২০০৬ সালে পেয়েছেন ইলেকট্রোঅপটিক সোসাইটির কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স অ্যাওয়ার্ড এবং ব্রিটিশ রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রগ্রেস মেডেল। ২০১১ সালে পেয়েছেন ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির গবেষণা পুরষ্কার, ২০১৩ সালে পেয়েছেন কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, একই বছর পেয়েছেন অটো হ্যান পুরষ্কার, ২০১৯ সালে পেয়েছেন ভ্লাডিলেন লেটোকভ মেডেল, ২০২২ সালে পেয়েছেন উল্ফ প্রাইজ ইন ফিজিক্স।
এবছরের তিনজন নোবেলজয়ীর মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র অথচ সবচেয়ে নিভৃতচারী বিজ্ঞানী হলেন ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পিয়ের আগস্তিনি (Pierre Agostini)। নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার আগে এই মানুষটির কোন উইকিপিডিয়া পেজও ছিল না। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটেও যেনতেনভাবে একটি পুরনো ছবির সাথে মাত্র দু-তিন লাইনের পরিচিতি ছিল প্রফেসর আগস্তিনির। পুরষ্কার ঘোষণার আগে নোবেল কমিটি ফোনে যোগাযোগও করতে পারেননি পিয়েরের সাথে। [ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক করার সময় পিয়ের আগস্তিনিকে এবং তাঁর কাজকর্মের কিছুটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তখন তিনি চৌষট্টি বছর বয়সে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সবেমাত্র যোগ দিয়েছেন প্রফেসর হিসেবে। তাঁর কাজকর্মে কেমন যেন একটা সন্নাসীসুলভ আচরণ ছিল, কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না এরকম একটা ভাব। এত বছর পর বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরষ্কার নোবেলস্বীকৃতি পাবার পরেও তাঁর ভেতর সেরকম কোন উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। তাঁর মেয়ে ফোন করে তাঁকে জানিয়েছেন যে তিনি গুগলে দেখেছেন যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।]
১৯৪১ সালের ২৩ জুলাই ফ্রেন্স টিউনিসিয়ার টিউনিসে জন্ম পিয়ের আগস্তিনির। ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের প্রাইতানি ন্যাশনাল মিলিটারি স্কুল থেকে স্কুল পাস করে দক্ষিণ ফ্রান্সের এইক্স-মারসিলি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন। ১৯৬১ সালে ফিজিক্সে বিএড এবং ১৯৬২ সালে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি অপটিক্সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। আলট্রাভায়োলেট রশ্মির মাল্টিলেয়ার ডায়ইলেকট্রিক ফিল্টার নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করেন আগস্তিনি। পিএইচডি করার পরের বছরই পিয়ের যোগ দেন ফ্রান্স এটমিক এনার্জি কমিশনের স্যাকলে সেন্টারে। সেখানেই তিনি গবেষণা করেছেন পরবর্তী চৌত্রিশ বছর। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অ্যান লুইলিয়ার এই গবেষণাকেন্দ্রে পিয়ের আগস্তিনির সহকর্মী ছিলেন। কিন্তু সেই সময় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যৌথগবেষণা সেরকম হয়নি। তাঁরা যে একদিন নোবেল পুরষ্কার শেয়ার করবেন সেদিন কেউই ভাবতে পারেননি। ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত পিয়ের আগস্তিনি নিউইয়র্কের ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করার পর ২০০৫ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন প্রফেসর হিসেবে। ২০১৮ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি অবসর গ্রহণ করার পর ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এবছর তিনি নোবেল পুরষ্কার পাবেন এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। অবশ্য এর আগে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সের গুস্তাভ রিবাউড প্রাইজ, ২০০৩ সালে গে-লুসাক-হামবোল্ট প্রাইজ, ২০০৭ সালে অপটিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার মেগার্স অ্যাওয়ার্ড ইন স্পেকট্রোস্কোপি।
এবার দেখা যাক অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ কীভাবে ঘটেছে। গত শতকের শেষের দুই দশকে লেজার বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নত ঘটেছে। লেজারের সাহায্যে ফেমটোস্কেলের আলোর স্পন্দন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় আণবিক স্কেলের পরিবর্তনগুলি দেখা সম্ভব হয়েছে ফেমটোসেকেন্ড স্পন্দনের মাধ্যমে। উদ্ভব হয়েছিল ফেমটোকেমিস্ট্রির। বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষে ১৯৯৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছিল ফেমটোকেমিস্ট্রির জন্য। ফেমটোমিটার হলো ১০-১৫ মিটার। ক্যালটেকের প্রফেসর আহমেদ জিওয়াইল নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় অণুর মধ্যে পরমাণুগুলি কীভাবে চলাচল করে তা দেখার একটি পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। তিনি সেটা করেছিলেন লেজার টেকনিক ব্যবহার করে। তখন ফেমটোকেমিস্ট্রির আবিষ্কার নিয়ে উদ্দীপ্ত হয়েছিল বিজ্ঞানসমাজ। এর কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের।
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের জন্য আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব লেজার রশ্মির মাধ্যমে। এটা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে লেজার কীভাবে তৈরি হয়। লেজার শব্দটি এসেছে লাইট অ্যামপ্লিফিকেশান বাই স্টিমুলেটেড এমিশান অব রেডিয়েশান (Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation) থেকে। বিশেষ উদ্দীপনায় আলোর বিকিরণ ঘটিয়ে সাধারণ আলোর ক্ষমতা ও শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তুলে লেজার তৈরি করা হয়। লেজার তৈরির প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৭ সালে। তিনি তাঁর ‘অন দি কোয়ান্টাম থিওরি অব রেডিয়েশান’ গবেষণাপত্রে ফোটনের ধর্ম কাজের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন [On the Quantum Theroy of Radiation, Physikalische Zeitschrift, vol 18 (1917) pp 121-128]। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যদি কোন ফোটন কোন পরমাণুর ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তবে ইলেকট্রনটি ফোটনের শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হবে। উত্তেজিত হয়ে ইলেকট্রনটি তার মূল শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যাবে। কিন্তু যদি ফোটন কোন উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, তখন উচ্চ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন তার অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের মূল শক্তিস্তরে ফিরে আসবে। এই শক্তিস্তর পরিবর্তনের সময় যে শক্তি ত্যাগ করবে সেই শক্তি যে ফোটনটি ধাক্কা দিয়েছিল সেই ফোটনের শক্তির সমান। এক্ষেত্রে একই শক্তির দুটি ফোটন একই দিকে একইভাবে ছুটে যাবে। এই দুটি ফোটন যদি আবার দুটি উত্তেজিত ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, আরো দুটি সমান শক্তির ফোটন পাওয়া যাবে। মোট ফোটন হবে চারটি। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে এই চারটি থেকে আটটি, আটটি থেকে ষোলটি, ষোলটি থেকে বত্রিশটি – এভাবে কোটি কোটি একই শক্তির ফোটনের স্রোত তৈরি হবে। এই ফোটনগুলির প্রত্যেকটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সমান। ফলে এদের সম্মিলিত প্রাবল্য হবে সাধারণ আলোর চেয়ে অনেক বেশি।
লেজার উৎপাদনের মূল পদ্ধতি |
লেজার উৎপাদনের মূলনীতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারপাশে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে এগুলি কক্ষপথে বিন্যস্ত থাকে – প্রথম কক্ষপথে ২টি, ২য় কক্ষপথে ৮টি, ৩য় কক্ষপথে ১৮টি ইত্যাদি। ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলি হলো তাদের শক্তিস্তর। একটি কক্ষপথে যতগুলি ইলেকট্রন থাকে সবগুলি ইলেকট্রনের শক্তি সমান। নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের যে কক্ষপথ (১ম কক্ষপথ) – সেই কক্ষপথে যেসব ইলেকট্রন থাকে তাদের শক্তি সবচেয়ে কম। এই শক্তিস্তরকে গ্রাউন্ড স্টেট বলা হয়। ইলেকট্রনগুলি যদি কোনভাবে শক্তি শোষণ করে তখন তারা উত্তেজিত হয়ে নিজেদের শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু একটু পরেই সেই অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। স্বতস্ফূর্তভাবে শক্তি নির্গমনের এই প্রক্রিয়াকে স্পনটেনিয়াস এমিশান (spontaneous emission) বলা হয়। পরমাণুর ইলেকট্রনগুলিকে যদি নির্দিষ্ট শক্তির ফোটনের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যায়, তাহলে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রনগুলি উত্তেজিত হয়ে উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন নিজের শক্তিস্তরে ফিরে আসে তখন যে শক্তি শোষণ করেছিল তা ফোটনের মাধ্যমে বের করে দেয়। এই নির্গত ফোটনের শক্তি শোষিত ফোটনের শক্তির সমান। ফোটনের প্রবাহ যদি অনবরত চলতে থাকে – তাহলে একটি ফোটন থেকে একই শক্তির ২টি ফোটন, ২টি থেকে ৪টি, ৪টি থেকে ৮টি ফোটন – এভাবে সেকেন্ডের মধ্যে কোটি কোটি ফোটনের প্রবাহ পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ফোটনের শক্তি সমান এবং প্রত্যেকেই একই সাথে একই দিকে যায়। তীব্র প্রাবল্যের এই ফোটনপ্রবাহই লেজার। সাধারণ দৃশ্যমান আলোতে ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে কোন তরঙ্গ থাকতে পারে। তাই আলোকরশ্মি সমশক্তির হয় না এবং বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মিশ্রণের কারণে সবগুলি ফোটন একদিকে না গিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু লেজারে সবগুলি ফোটনের শক্তি সমান, ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যও সমান। ফলে তারা সব একবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে। লেজার রশ্মি তাই একটুও না ছড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। পৃথিবী থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে লেজার রশ্মি পাঠানো হয়, সেই রশ্মি একটুও ছড়িয়ে না পড়ে চাঁদের পিঠে রাখা আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে।
সব ধরনের লেজারেরই মূল প্রস্তুত প্রণালী কমবেশি একই রকম। প্রথমে দরকার একটি উপযুক্ত পদার্থের অ্যামপ্লিফাইয়িং মিডিয়াম বা গেইন মিডিয়াম বা অ্যাকটিভ মিডিয়াম। এই মিডিয়ামের ইলেকট্রনকে উত্তেজিত করে ফোটন বের করা হয়। এই মিডিয়াম কঠিন, গ্যাস, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি হতে পারে। এই পদার্থের উপর বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রয়োগ করলে পদার্থের ইলেকট্রন উত্তেজিত হয় এবং ফোটন নির্গত হয়। অ্যাকটিভ মিডিয়ামের আলোর ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মিডিয়ামের চারপাশে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করা হয়, অথবা অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় পাম্পিং। ফ্ল্যাশ লাইট বা অন্য লেজার দিয়েও এই পাম্পিং করা যায়। পাম্পিংসহ অ্যাকটিভ মিডিয়ামকে একটি সিলিন্ডার আকৃতির নলের মধ্যে স্থাপন করা হয়। এই নলটিকে বলা হয় লেজার ক্যাভিটি। এই নলের দুই প্রান্তে দুটি আয়না বসানো থাকে। নলের ভেতর যে আলো উৎপন্ন হয় সেই আলো এই আয়না দুটোতে অনবরত প্রতিফলিত হতে থাকে। একটি আয়না নলের ভেতরের সব আলোর প্রতিফলন ঘটায়। অন্যদিকের আয়নাটি পুরোপুরি প্রতিফলক নয়। সেই আয়না কিছুটা স্বচ্ছ – যার ভেতর দিয়ে লেজার রশ্মি বের হয়ে আসে। সাধারণত অ্যাকটিভ মিডিয়ামের নাম অনুসারে লেজারের নাম হয়ে থাকে। যেমন অ্যাকটিভ মিডিয়াম রুবি হলে – রুবি লেজার, গেইন মিডিয়াম আর্গন গ্যাস হলে আর্গন লেজার ইত্যাদি। বিভিন্ন মিডিয়াম থেকে উৎপন্ন লেজারের শক্তি এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
লেজারের ক্ষমতা ফেমটোসেকেন্ড স্পন্দনে আটকে ছিল অনেকগুলি বছর। ফেমটোসেকেন্ড পার হয়ে অটোসেকেন্ডে আসার জন্য আরো ছোট সময়ের পালস তৈরি করতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। কীভাবে সম্ভব হয়েছে এত ক্ষুদ্র সময়ের আলোর স্পন্দন তৈরি করা?
একটি পদ্ধতি হলো – হাই হারমোনিক জেনারেশন (HHG) পদ্ধতি যেখানে পরমাণুর একটি ইলেকট্রন অনেকগুলি কম শক্তির ফোটন শোষণ করতে থাকে একের পর এক। এরপর একটি উচ্চশক্তির ফোটন বের করে দেয়। কিন্তু কয়েক দশক আগে এ ধরনের প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে ফোটনের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে ফোটন নির্গমনের হার কমে যাচ্ছে। ফলে উচ্চ শক্তির আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না।
১৯৮৭ সালে অ্যান লুইলিয়ার এবং তাঁর গবেষকদল আর্গন গ্যাসে ইনফ্রারেড লেজার (অবলোহিত লেজার) প্রয়োগ করে দেখলেন যে শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্গত ফোটনের সংখ্যা সেভাবে কমে না গিয়ে বরং একটা স্থিতাবস্থায় আসছে। এই ব্যাপারটি খুবই আশাপ্রদ মনে হয়েছে তাঁর দলের কাছে। এর কয়েক বছরের মধ্যেই লুইলিয়ার এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন এইচএইচজি-তে আসলে কী হচ্ছে।
আর্গন গ্যাসের মধ্যে লেজার রশ্মি চালনার ফলে ইলেকট্রন তিনটি কাজ করছে এক সাথে। প্রথমত কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারপর ত্বরণ লাভ করে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। এরপর আবার আলোর তরঙ্গের দিক পরিবর্তনের সময় ইলেকট্রন তার নিজের জায়গায় ফিরে আসছে – শক্তিক্ষয় করে। এই শক্তিক্ষয় হচ্ছে উচ্চশক্তির ফোটন নির্গমণের মাধ্যমে। আর্গনে লেজার প্রয়োগ করার পর এই ব্যাপারটি একাধিকবার ঘটছে – ফলে আলট্রাফাস্ট অ্যাটোসেকেন্ড স্কেলের আলোর স্পন্দন তৈরি হচ্ছে গ্যাসের মধ্যে।
অ্যান লুইলিয়ারের কাজ থেকে একটি কর্মক্ষম অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের উৎস তৈরি করতে আরো দুটো ধাপ পার হতে হয়েছে। দুটো নতুন দরকারি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হয়েছে। প্রথমত স্পন্দনের সময় মাপতে হয়েছে, দ্বিতীয়ত আলাদা আলাদা স্পন্দন তৈরি করতে হয়েছে। পদ্ধতিদুটোর কোনটিই সহজ নয়। এত ক্ষুদ্র সময়ের স্পন্দন মাপার একটি পদ্ধতির নাম FROG – ব্যাঙ পদ্ধতি। Frequency Resolved optical gating – FROG. কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড মাপা সম্ভব নয় এই পদ্ধতিতে। কারণ FROG পদ্ধতি খুবই কম শক্তি সম্পন্ন। এটি ফেমটোসেকেন্ডে সীমাবদ্ধ।
২০০১ সালে পিয়ের আগস্তিনি নতুন পদ্ধতি বানালেন – র্যাবিট (খরগোশ) পদ্ধতি। RABBIT – Reconstruction of Attosecond Beating by Interference of two-photon transitions. যেখানে একটি অপটিক্যাল লেজারের তড়িৎক্ষেত্র অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের সাথে যোগ করে দেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে পিয়ের আগস্তিনি এবং তাঁর দল ২৫০ অটোসেকেন্ডের ধারাবাহিক আলোর স্পন্দন তৈরি করতে সমর্থ হন।
এদিকে প্রফেসর ফেরেঙ্ক ক্রাউজের দল জার্মানিতে স্বতন্ত্রভাবে একই ধরনের আরেকটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন – যেখানে তিনি অ্যাটোসেকেন্ড স্ট্রিকিং (Streaking) পদ্ধতিতে ৬৫০ অটোসেকেন্ডের স্পন্দনকে স্বতন্ত্রভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। এভাবে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন পদ্ধতি আয়ত্বে আসার পর অতিক্ষুদ্র আলোর স্পন্দন তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে এখন।
প্রফেসর লুইলিয়ার এবং ক্রাউজ তাঁদের অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের গবেষণা ক্রমাগত চালিয়ে গেলেও – প্রফেসর পিয়ের আগস্তিনি আশাও করেননি যে বিশ বছর আগে তিনি যা উদ্ভাবন করেছিলেন তা এতদিন পরে এত গুরুত্ব পাবে।
অ্যাটোসেকেন্ড পাল্স বা স্পন্দনের অনেক বাস্তব ব্যবহারিক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। রাসায়নিক কার্যকলাপ দেখার জন্য ফেমটোসেকেন্ড কেমিস্ট্রি যথেষ্ট। কিন্তু আরো সুনির্দিষ্টভাবে ইলেকট্রনের কার্যক্রম দেখতে হলে অ্যাটোসেকেন্ড পাল্স দরকার। অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন এত বেশি সুনির্দিষ্ট এবং সূক্ষ্ম যে পরমাণুর ইলেকট্রনের কাজকর্ম দেখতে পারবে সেটা। তার মানে ইলেকট্রনের কাজকর্ম সরাসরি দেখা যাবে। অ্যাটোসেকেন্ড পাল্স সলিডের ধর্মাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, অপরিবাহীকে পরিবাহীতে রূপান্তরিত করতে পারবে। খুব কম সময়ের মধ্যেই – ইলেকট্রনিক্সের ডায়নামিক্স পরিবর্তন করা যাবে। আলট্রাফাস্ট সুইচিং সম্ভব হবে যেখানে – সিলিকন ডাই অক্সাইড – অপরিবাহী থেকে দ্রুত পরিবাহীতে পরিণত হতে পারে। ফলে ইলেকট্রনিক্সের জগতে এর বিরাট ব্যবহারিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে। উদ্ভাবিত হবে খুবই ফাস্ট ইলেকট্রনিক্স – জন্ম নেবে অনেক নতুন প্রযুক্তির।
মানুষের রোগ নির্ণয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে অ্যাটোসেকেন্ড পাল্স – যা হয়ে উঠবে মলিকিউলার ফিঙ্গার প্রিন্ট অব বায়োলজিক্যাল স্যাম্পলস। যেমন, রক্তের নমুনায় অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের এর মাধ্যমে রক্তের উপাদানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তনও লক্ষ্য করা সম্ভব হবে। ফুসফুসের ক্যান্সারের কথাই ধরা যাক – যেখানে রক্তের পরিবর্তন ধরতে পারা জরুরি। রক্তের উপাদানের রসায়নে কোন পরিবর্তন হলে তা দ্রুত মনিটর করা যাবে। দ্রুততম সময়ে শনাক্ত করতে পারলে উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব হবে। ক্ষুদ্রতম সময়ের আলোর স্পন্দন যতবার দরকার শরীরে প্রবেশ করানো যাবে, তাতে কোন ক্ষতি হবে না, কারণ এই আলো স্বাভাবিক কপাঙ্কের আলো – যার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নেই।
মৌলিক গবেষণা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতেও বিরাট ভূমিকা রাখবে অ্যাটোসেকেন্ড পাল্স। যেমন, আইনস্টাইনের ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। আলোর ফোটন বস্তুর উপর পড়ার পর ধাতু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। ধারণা করা হয় এই পদ্ধতিতে আলো পড়ার সাথে সাথেই ইলেকট্রন নির্গত হয়। কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড পাল্স দেখাচ্ছে যে এই পদ্ধতি সাথে সাথে ঘটছে না। আলো শোষণ এবং ইলেকট্রন নির্গমনের মধ্যে বেশ কয়েক অ্যাটোসেকেন্ড ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের আরো অনেক নতুন নতুন বিষয় জানা যাবে, কিংবা পুরনো বিষয় আরো ভালোভাবে জানা যাবে। অদূর ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম বায়োলজি অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। ফেমটোকেমিস্ট্রি থেকে অটোকেমিস্ট্রির জগত খুলে যাবে।
তথ্যসূত্র
১। সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ৩ অক্টোবর ২০২৩।
২। www.nobelprize.org October 3, 2023.
৩। ফেরেঙ্ক ক্রাউজ ও মিশা ইভানভ, অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স, ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল, কানাডা, ২০০৯।
৪। প্রদীপ দেব, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ২০২২।
৫। phys.org, October 3, 2023.