Saturday 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ২১



রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট

সম্পূর্ন স্বাধীনভাবে গবেষণা করার জন্য একটা নিজস্ব রিসার্চ ইন্সটিটিউট গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল রামনের। নোবেল পুরষ্কার পাবার অনেক আগে থেকেই তিনি এই স্বপ্ন দেখছিলেন। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর স্বপ্ন পূরণের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছিল।
            ১৯৩৪ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটের পরিচালক থাকাকালীন রামন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস। ১৯৩৫ সালে মাইসোরের রাজা রামনকে এগার একর জমি উপহার দিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর রামনের অনুরোধে রাজা ইন্সটিটিউটের ক্যাম্পাসের দক্ষিণ পাশে আরো চার একর জমি দান করেন। ১৯৪৩ সালে অ্যাকাডেমির সাথে রামনের এই মর্মে চুক্তি হয় যে এই জমির উপর একটা রিসার্চ ইন্সটিটিউট স্থাপিত হবে। সেই ইন্সটিটিউটের ওপর অ্যাকাডেমির কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। প্রতিষ্ঠানটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে স্যার রামনের হাতে এবং প্রতিষ্ঠানের সব খরচও তাঁর নিজের।
            রামন প্রতিষ্ঠানের খরচ জোগানোর জন্য একজন প্রাক্তন ছাত্রের সহযোগিতায় দুটো রাসায়নিক কারখানা খুললেন। উদ্দেশ্য ছিল এই কারখানা দুটোর আয় থেকে রিসার্চ ইন্সটিটিউটের খরচ মিটবে।
            পুরো জায়গাটির চারপাশের সীমানায় বেঁড়া দিয়ে ঘিরে দিলেন। ভবিষ্যত ক্যাম্পাসের ম্যাপ তৈরি করে পরিকল্পনামত প্রচুর গাছ লাগালেন। নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই ইন্সটিটিউটের বাগান তৈরি হয়ে গেলো। ১৯৪৮ সালে রামন যখন ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স থেকে অবসর নিলেন, তাঁর রিসার্চ ইন্সটিটিউট তখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। মূল দোতলা ভবনটি তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু তখনো বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। একশ সিটের লেকচার থিয়েটার তৈরি হয়েছে। আধুনিক গবেষণাগারে যন্ত্রপাতি লাগানো হয়েছে। ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে অনেকগুলো হীরা, চুনি, পান্না এবং আরো অনেক দামী পাথর ছিল। সেগুলোর উপর অনেক গবেষণা চালাচ্ছিলেন রামন। সেগুলো সব নতুন ইন্সটিটিউটে একটা আলাদা বিশেষ রুমে রাখা হলো। সেই রুমে অতিবেগুনি আলো লাগানো হয়েছে। ব্যক্তিগত সংগ্রহের বিরাট লাইব্রেরি তৈরি হয়েছে। বিশাল জাদুঘরে অনেক সংগ্রহ।
            স্যার রামন একটা দিনও অবসরে কাটানোর মানুষ নন। বৈদ্যুতিক সংযোগ রেডি না হলেও তিনি সূর্যের আলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। সেই যে প্রথম দিন থেকে গবেষণা শুরু করেছেন তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানে, আমৃত্যু চালিয়ে গেছেন তাঁর বিজ্ঞান-সাধনা।
            ষাট বছর বয়সে 'রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট' স্থাপন করে পরবর্তী বাইশ বছরে তাঁর এই প্রতিষ্ঠান থেকেই দুই শতাধিক গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেছেন রামন। এই সময়ের প্রথম দশক তিনি হীরার উপর গবেষণা করেছেন, আর পরের দশক গবেষণা করেছেন ফিজিওলজি অব ভিশান বা আমাদের চোখ কীভাবে দেখে তার ওপর।
            রামন নিজের ইন্সটিটিউটের জন্য দরকারি লোক নিয়োগ করলেন। প্রথমে নিয়োগ করলেন একজন স্টেনোটাইপিস্ট। তারপর একজন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান। স্যার রামন জানতেন তাঁর কেমন কীরকম দক্ষ মানুষ দরকার। তাঁর ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান পদ্মনাভন ছিলেন একজন হীরা বিশেষজ্ঞ। রামনের হীরা এবং অন্যান্য স্ফটিকের গবেষণার জন্য এরকম একজন বিশেষজ্ঞের দরকার ছিল। হীরার মধ্যে রামন-ইফেক্ট দেখে হীরা খাঁটি কিনা সহজেই পরীক্ষা করা যায়। পদ্মনাভন এই কাজে খুব দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।
            বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের দরকারি যন্ত্রপাতি সেট করা ও মেরামতের জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান ও যান্ত্রিক ব্যবস্থা গবেষণাগারের সাথে থাকা উচিত বলে মনে করতেন রামন। একটি ছোট যন্ত্রের জন্য পরীক্ষণ-কাজ ব্যাহত হলে অনেক ক্ষতি। তাছাড়া বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি কেনার ঘোরবিরোধী ছিলেন রামন। তাঁর ল্যাবের জন্য তিনি উপযুক্ত যন্ত্র-কারিগর নিয়োগ করলেন। আসবাবপত্রের জন্য কাঠমিস্ত্রী এবং লাইব্রেরির জন্য লাইব্রেরিয়ানের পাশাপাশি বুক-বাইন্ডারও নিয়োগ দিলেন। পুরোদমে শুরু হয়ে গেলো রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণা-কার্যক্রম।
            রামন ইন্সটিটিউটে কাজ করার জন্য শত শত ছাত্র আবেদন করলেও রামন খুব যাচাই বাছাই করে নিজের গবেষণায় সাহায্য করতে পারবে এরকম দু'একজন গবেষক-ছাত্র নিতে শুরু করলেন। রামনের সবচেয়ে ছোটভাই রামস্বামী ইন্সটিটিউটে রামনের অধীনে গবেষণা করেছেন। রামনের ছোটবোন সীতালক্ষ্মীর তিন ছেলে পঞ্চরত্নম, রামশেসন ও চন্দ্রশেখর রামনের কাছে গবেষণা শিখেছেন। রামশেসন ধরতে গেলে রামনের উত্তরাধিকার বহন করেছেন।
            ১৯৪৮ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে রামন গবেষণা করেছেন হীরা ও অন্যান্য দামী পাথরের ক্রিস্টালোগ্রাফি। সেই সময় তিনি যত বিচিত্র ধরনের উজ্জ্বল পাথর পেয়েছেন সবগুলো পরীক্ষা করে দেখেছেন। তিনি অনেক মানুষের কাছ থেকে হীরা-মণি-মুক্তার গয়না ধার করে সেগুলোর উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে, বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করে পরে আবার ফেরৎ দিয়েছেন। তাঁর নিজের সংগ্রহে প্রায় পাঁচ শতাধিক হীরা ছিল।
            ১৯৫০ সালের শেষের দিকে তিনি আরো পাঁচ একর জমি সংগ্রহ করলেন তাঁর ইন্সটিটিউটের পাশে। সেখানে গড়ে তুললেন বিশাল লাইব্রেরি। লাইব্রেরির চার পাশে লাগালেন প্রচুর গাছপালা। তাঁর ইন্সটিটিউটে এত গাছপালা যে মনে হয় যেন গভীর অরণ্যের ভেতর তিনি গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞান-সাধনক্ষেত্র। এপ্রসঙ্গে রামন বলতেন, "প্রাচীন দার্শনিকরা বলতেন অবসর জীবনে বানপ্রস্থে চলে যেতে, অর্থাৎ বনে গিয়ে বাস করতে। আমার পক্ষে তো বনে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই বনকেই নিয়ে এসেছি আমার কাছে।"
           
 
রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরি

ইন্সটিটিউটে ছাত্রদের জন্য হোস্টেল এবং স্টাফ-কোয়ার্টার নির্মাণ করা হলো। নিজে থাকার জন্য খুবই নান্দনিক ডিজাইনের 'ডিরেক্টর'স বাংলো' তৈরি করলেন। ডিরেক্টর্‌স বাংলো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। রামন সেই বাংলোয় উঠেন ১৯৫৯ সালে। ১৯৪৮ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স থেকে অবসর নেয়ার পর সেখানকার কোয়ার্টার থেকে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন রামন ও লোকম। সেখানেই ছিলেন ১৯৫৯ পর্যন্ত।
            রামন জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি করার ইচ্ছায় বেশ কিছু জমি কিনেছিলেন। কলকাতায় থাকার সময় ভেবেছিলেন সারাজীবন সেখানেই থেকে যাবেন। সেই ভেবে শিলং-এর কাছে চল্লিশ হাজার রুপি দিয়ে বেশ কিছু জমি কিনেছিলেন লোন নিয়ে। কলকাতা থেকে চলে আসার পর সেই জমি কেনার লোন একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জন্য।
            রামন তাঁর জীবদ্দশায় ছোট ভাই ও বোনদের মৃত্যু দেখেছেন। তিনি বুঝেছেন জীবন বড়ই অনিশ্চয়তায় ভরা। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি তাঁর বাবার যে বিষয়সম্পত্তির ভাগ পাবেন তা নিতে চাইলেন না। তিনি আসলে সব কিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে চাইলেন। তাই পৈত্রিক সম্পত্তির নিজের অংশটুকু তিনি ছোটভাই রামস্বামীর নামে লিখে দিলেন। এতে বড়ভাই সুব্রাহ্মণ্য ক্ষেপে গেলেন। তিনি ভাবলেন রামন পারিবারিক দায়িত্ব এড়াতে চাচ্ছেন। রামন ও সুব্রাহ্মণ্যর মাঝে ভাব যেরকম ছিল গলা উঁচিয়ে ঘোরতর ঝগড়াও হতো তেমনি। রামনও বলে দিলেন যে তিনি বাপের ঋণের অর্ধেক শোধ করেছেন। এখন তাঁর আর কোন দায়িত্ব নেই। তাই তিনি বাপের কোন সম্পত্তির অধিকারীও হতে চান না।
            ১৯২৮ সালে রামন কলকাতা শহরের কাছে আরেকটি জমি কিনেছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি মাদ্রাজেও জমি কিনেছিলেন।  ১৯৪০ সালে তাঁর মনে হলো অবসর নিয়ে থাকার জন্য বাড়ি দরকার। নিজের ইন্সটিটিউট করার জন্য জমি পেয়েছেন মাইসোরের মহারাজার কাছ থেকে উপহার হিসেবে। এবার তাঁর একটা বসতবাড়ি দরকার। রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের কাছাকাছি বাড়ি খুঁজছিলেন তিনি। সেই এলাকায় তখন কিছু বড় বড় বাড়ি তৈরি হতে শুরু করেছে। সামনে পেছনে অনেক জায়গা নিয়ে একটা বাড়ি তাঁরা পেয়ে গেলেন। ১৯৪২ সালে তাঁরা বাড়িটা কিনলেন। লোকম বাড়িটার নাম দিলেন 'পঞ্চবটি'। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত এই বাড়িটি তাঁরা ভাড়া দিয়েছিলেন।
            ব্যাঙ্গালোর থেকে আট মাইল দূরে একশ' একর জায়গাসহ একটা খামারবাড়ি কিনেছিলেন রামন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রামন ও লোকম সেখানে যেতেন। এমনিতে সেখানে লোকমের দুই বিধবা বোন থাকতেন। লোকম সেখানে অনেকগুলি গাভী পালতেন। দুধের জন্য কয়েকটি গাভী তাঁদের পঞ্চবটি বাড়িতেও থাকতো।
১৯৪৮ সালে রামনের অবসরের পর বাস করার জন্য পঞ্চবটি কিনেছিলেন। কিন্তু অবসরের পর পরই পঞ্চবটিতে উঠতে পারেননি তাঁরা। বাড়িটি যাঁরা ভাড়া নিয়েছিল রামনের কাছ থেকে তাদের সাথে চুক্তি ছিল রামনের অবসরের আগেই তারা বাড়ি ছেড়ে দেবে। কিন্তু তারা সেখানে একটি হোস্টেল চালাতে শুরু করেছিল। হোস্টেলে যারা থাকতো তারা বাড়ি ছাড়তে চাইলো না। ফলে রামনকে আইনের আশ্রয় নিয়ে বাড়ি খালি করাতে হয়েছিল। পরে বাড়িটির অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা বদলে ফেলে তারপর সেখানে ওঠেন তাঁরা।
            শুরুতে রামন বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে ইন্সটিটিউটে যেতেন। কিন্তু ষাট বছর বয়সে রামনের সাইকেল চালানোটা একটু বেশি রিস্কি হয়ে যায়। লোকম তাঁকে বাধ্য করলেন গাড়ি কিনতে। একজন সার্বক্ষণিক ড্রাইভারও রাখা হলো।
            পঞ্চবটিতে রামনের ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ ছিল ঈর্ষনীয়। সেই সময়ের ইংরেজি সাহিত্যের সব ধ্রুপদি লেখকের সব বইই তাঁর সংগ্রহে ছিল এবং তিনি সেগুলো সবই পড়ে ফেলেছিলেন তাঁর স্কুলজীবনে। ইংরেজিতে তাঁর এত দক্ষতা তো আর এমনি এমনি হয়নি। লোকম পঞ্চবটিতে থাকতেই পছন্দ করছিলেন। রামনও ভেবেছিলেন সেখানেই থাকবেন। তাই পরিচালকের বাংলোটি একজন আমেরিকান প্রফেসরকে ভাড়া দিয়েছিলেন দু'বছরের জন্য। পরে রামন দেখলেন ইন্সটিটিউটের কাছেই পরিচালকের থাকা উচিত। তাই তিনি বাংলোয় চলে আসেন।
            পঞ্চবটিতে লোকমের শিশুকল্যাণ সমিতির অফিস ছিল। সেটা সেখানেই থাকলো। লোকম প্রতিদিন পরিচালকের বাংলো থেকে পঞ্চবটিতে আসেন। তাঁর বাগান, গরু ইত্যাদির দেখাশোনা করেন, এবং শিশুকল্যাণ সমিতির কাজকর্ম পরিচালনা করেন। মূল বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন রামনের বড়ভাই সুব্রাহ্মণ্যের বড় মেয়ে রাজলক্ষ্মীকে। রাজলক্ষ্মীর স্বামী গনেশন তখন ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের বিজ্ঞান-সাময়িকী 'কারেন্ট সায়েন্স'-এর সম্পাদক।
            ১৯৭০ সালে রামনের মৃত্যুর পর রামন ইন্সটিটিউটের পরিচালকের বাংলো থেকে লোকম আবার চলে আসেন তাঁর বাড়ি পঞ্চবটিতে।
            রামন ইন্সটিটিউট চালাবার খরচ জোগানোর জন্য অনেক রকমের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে সরকারের কাছ থেকে কখনো কোন সাহায্য তিনি দেবেন না। কারণ কারো খবরদারি তাঁর সহ্য হয় না। নোবেল পুরষ্কারের টাকাটা থাকলে তিনি সেটা দিয়ে কিছুটা খরচ মেটাতে পারতেন। কিন্তু নোবেল পুরষ্কারের পুরো টাকাই তিনি হারিয়েছেন ভুল জায়গায় লগ্নি করে। তারপর তিনি জনগণের কাছে হাত পেতেছেন ইন্সটিটিউটের ফান্ডের জন্য। তখন এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন একজন নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীর এরকম ভিক্ষাবৃত্তি শোভা পায় কিনা। রামন যুক্তি দেখালেন, আমাদের সব বিখ্যাত মনীষীরাই ভিক্ষুক ছিলেন। গৌতম বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য, এমন কি মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত।
কিন্তু তাতেও খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। একটা গ্যাস-বাতির কারখানা স্থাপন করেছিলেন একজন প্রাক্তন ছাত্রের সহযোগিতায়। সেখান থেকেও খুব বেশি আয় হয়নি।
১৯৫৬ সালে রামন তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দিয়ে একটি ট্রাস্ট গঠন করলেন। ঠিক করা হলো এই ট্রাস্টের উপার্জন থেকে ইন্সটিটিউটের যাবতীয় খরচ সামলানো হবে।
             
 
পল ডিরাকের সাথে রামন


১৯৫৬ সালে জার্মানিতে লিন্ডাউ কনফারেন্সে যোগ দেন স্যার রামন। নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীদের এই সম্মেলনের সেই বছর ছিল পদার্থবিজ্ঞানের বছর। সেই মিটিং-এ স্যার রামনের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটে পৃথিবীবিখ্যাত অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে। পল ডিরাক, আর্নেস্ট হাইজেনবার্গ, উল্‌ফগং পাউলি, ইউকাওয়াসহ আরো অনেকে ছিলেন সেই মিটিং-এ। রামন সেখানে 'ফিজিক্স অব কৃস্টাল' বিষয়ে বক্তৃতা দেন।[1] ইওরোপের তরুণ বিজ্ঞানীরা ভীষণ অনুপ্রাণিত হন রামনের ব্যক্তিত্ব ও উৎসাহে।


হাইজেনবার্গ, পাউলি ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে রামন



 
তরুণ বিজ্ঞানীদের সাথে রামন




১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন রামনকে লেনিন শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত করে। রামন ব্যক্তিগত কারণে কমিউনিস্টবিরোধী ছিলেন। কেন তিনি কমিউনিজম পছন্দ করতেন না তার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু লেনিন পুরষ্কার পাবার পর তিনি সানন্দে কমিউনিস্টদের দেশ রাশিয়ায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। সোভিয়েত সংবাদপত্র প্রাভদার এক সাংবাদিক লেনিন পুরষ্কার প্রাপ্তিতে রামনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, "লেনিন শান্তি পুরষ্কার পেয়ে আমার নিজের এবং আমাদের দেশের জন্য আমার ভীষণ গর্ব হচ্ছে। শান্তির সপক্ষে আমার চেষ্টার স্বীকৃতি এই পুরষ্কার।"[2]
            রামন বিজ্ঞানের ক্ষতিকর ব্যবহার সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। ১৯৪৫ সালে জাপানের ওপর আমেরিকার পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের ঘটনার তীব্র নিন্দার পাশাপাশি রামন বিজ্ঞানীদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কথা বলেছেন সব সময়। রামন বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞানীদের এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে মানুষের ক্ষতি হতে পারে।


রাশিয়ায় রামন



১৯৫৮ সালের ৯ মে লোকমকে সাথে নিয়ে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের আমন্ত্রণে তিন মাসের জন্য ইওরোপে যান। রামন রাশিয়ায় লেনিন শান্তি পুরষ্কার গ্রহণ করেন। তারপর হাঙ্গেরিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের আমন্ত্রণে ফেলোশিপ গ্রহণ করার জন্য বুদাপেস্ট যান।
            রামনের ছোটছেলে রাধাকৃষ্ণান তখন সুইডেনে শালমার্স (Chalmers) ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে মহাজাগতিক বেতারতরঙ্গের ওপর গবেষণা করছিলেন। রাধাকৃষ্ণান যোগ দিলেন তাঁর মা-বাবার সাথে তাঁদের ইওরোপ ট্যুরে। তাঁরা একসাথে ভ্রমন করলেন চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, ইতালি, ও অস্ট্রিয়া।


হাঙ্গেরিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্টের সাথে রামন ও লোকম



শুরুতে রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। যে কেউ ইচ্ছে করলেই ভেতরে ঢুকে দেখতে পারতেন কী কী হচ্ছে সেখানে। অনেকেই বিনাকারণে ঢুকে যেতেন। রামন আস্তে আস্তে বিরক্ত হতে শুরু করলেন এরকম সময়নষ্টকারীদের ওপর। পরে সেখানে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
            ১৯৪৯-৫০ সালে কয়েকজন রিসার্চ-স্টুডেন্ট নিয়েছিলেন রামন তাঁর ইন্সটিটিউটে। রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউট ছিল রামনের ব্যক্তিগত গবেষণার জায়গা। সেখান থেকে ডিগ্রি দেয়া হতো না সেই সময়। কিন্তু রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে ছাত্ররা সহজেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়ে যান। রামনের ছাত্ররা সবাই কয়েক বছরের মধ্যে পিএইচডি নিয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। রামন সবাইকে উৎসাহ দিয়েছেন যার যার পছন্দ মতো চাকরি নিতে। তারপর রামন আর কোন ছাত্র নিতে অস্বীকার করেন। তার মনে হলো জীবনের শেষের বছরগুলোতে একা একা গবেষণা করে যাবেন। স্বাধীন ভারতে তখন অনেকগুলো সরকারি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অনেকগুলোর পরিচালকপদে রামনের ছাত্ররা যোগ দিয়েছেন। তাঁদের ডাকেও রামন সাড়া দেন না। তাঁর ভেতর একটা দুর্বোধ্য অভিমান জমতে থাকে। তিনি নিজেকে বাইরের জগৎ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চাইলেন। ইন্সটিটিউটের বাইরে একটা বড় সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলেন, "এই প্রতিষ্ঠান দর্শনার্থীর জন্য উন্মুক্ত নয়। দয়া করে আমাদের বিরক্ত করবেন না।"




[1] লিন্ডাউ কনফারেন্সে রামনের বক্তৃতার জার্মান ও ইংরেজি উভয় ভাষায় অডিও পাওয়া যায় অনলাইনে:
http://www.mediatheque.lindau-nobel.org/videos/31549/physics-of-crystals-german-and-english-presentation-1956/meeting-1956
[2] দি হিন্দু, ৩ জানুয়ারি ১৯৫৮

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts