Wednesday, 20 January 2021

লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ১২

 



সপ্তম অধ্যায়

মঙ্গলে বসতি

 

স্পেস-এক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন আগামী কয়েক দশকের মধ্যে তিনি মঙ্গল গ্রহে গিয়ে বাস করবেন। শুধু তাই নয়, তিনি পৃথিবী থেকে অন্য যারা মঙ্গল গ্রহে গিয়ে বাস করতে ইচ্ছুক, তাদেরকেও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন।  তার জন্য আপাতত খরচ ধরা হচ্ছে জনপ্রতি পাঁচ লক্ষ ডলার বা চার কোটি টাকা। নিসন্দেহে এটা একটি উচ্চাভিলাসী প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবার পথে এখনো অনেক বাস্তব বাধা আছে। যদি ধরেও নেয়া যায় যে মঙ্গলে যাওয়ার জন্য মঙ্গল-যান তৈরি সম্পন্ন হয়েছে, এবং মানুষ মঙ্গলে পৌঁছে গেছে, কিন্তু মঙ্গলে যাওয়ার পর প্রথম বাধা হলো মঙ্গল গ্রহের বর্তমান পরিবেশ। মঙ্গল গ্রহের বর্তমান বায়ুচাপ মাত্র ৬০০ প্যাসকেল, আর গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গল গ্রহের বায়ুচাপ আর্মস্ট্রং লিমিটের অনেক নিচে। আর্মস্ট্রং লিমিট হলো বায়ুচাপের সেই সীমা - যার কম হলে মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পানি ফুটতে শুরু করে। পৃথিবীতে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮ কিলোমিটার উপরে বায়ুর চাপ ৬.৩ কিলো-প্যাসকেল। এই চাপে পানি ফুটতে শুরু করে। মঙ্গলের বায়ুচাপ আর্মস্ট্রং লিমিটের দশ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম। সেই চাপে কোন মানুষ যদি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ছাড়া মঙ্গলে যায় - তার শরীরের সমস্ত জলীয় অংশ মুহূর্তেই বাষ্প হয়ে যাবে।

          অনেকেই বলছেন মঙ্গল গ্রহে বাস করার জন্য প্রয়োজনীয় কলোনি গড়ে তোলা হবে। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে যদি মানুষ কলোনি গড়ে তুলতে চায় তাহলে মঙ্গল গ্রহই তুলনামূলকভাবে উপযুক্ত গ্রহ। কারণ পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য আর মঙ্গলের দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান। পৃথিবী ও মঙ্গলের অক্ষের নতিও প্রায় একই ধরনের। ফলে পৃথিবীর মতো মঙ্গলেও ঋতু পরিবর্তন হয়। মঙ্গলের বুকে অনেক সমতল জায়গা আছে যেখানে ঘরবাড়ি তৈরি করা যাবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী কীভাবে নিয়ে যাওয়া হবে - নিয়ে যেতে কী পরিমাণ সময় ও খরচ লাগবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

          সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পরিবেশ। মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর প্রাণির জন্য উপযুক্ত নয়। বায়ুমন্ডলের ৯৫% কার্বন-ডাই-অক্সাইড, গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের শতকরা মাত্র ৩৮ ভাগ, সর্বোপরি পানির উৎস সম্পর্কে এখনো কোন নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় এ শতাব্দীর মধ্যেই মানুষ মঙ্গলে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করবে বলাটা খুব বেশি যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অনেকে প্রস্তাব করছেন মঙ্গলে আগে রোবট পাঠানো হবে। তারা ঘরবাড়ি তৈরি করবে, তারপর আস্তে আস্তে মানুষ যাবে।

পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব মাত্র ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এই দূরত্বে পৃথিবী থেকে চার লিটার পানি চাঁদে পাঠাতে খরচ হবে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ টাকা। পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের ১৪২ গুণ বেশি। সে হিসেবে মঙ্গলে যদি পৃথিবী থেকে নিয়মিত খাবার ও পানীয় পাঠাতে হয়, তাহলে যে পরিমাণ খরচ হবে তা অকল্পনীয়। যদি মানুষকে মঙ্গলে কলোনি তৈরি করতে হয়, তাহলে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে খাদ্য ও পানীয়ের সমস্যার সমাধান কীভাবে করবে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য অনেকেই এখন মহাকাশ-বাগান বা অ্যাস্ট্রো-গার্ডেনিং এর কথা বলছেন।

          মানুষ মঙ্গলে যাবার সময় সাথে করে নিয়ে যাবে প্রচুর বীজ ও উদ্ভিদ। উদ্ভিদ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করবে আর অক্সিজেন ত্যাগ করবে। মানুষের বর্জ্য গাছের সার হিসেবে দেয়া যাবে। মঙ্গলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমৃদ্ধ বাতাসে টিকতে পারে এরকম উদ্ভিদের চাষ করতে হবে। তার জন্য দরকার হবে মঙ্গলে প্রচুর গ্রিন হাউজ গড়ে তোলা। পৃথিবীতে যে গ্রিন হাউজ সমস্যার সৃষ্টি করছে, মঙ্গলে সেই গ্রিন হাউজ হতে পারে খুবই দরকারি একটি উপায়।

 

চিত্র: মঙ্গলে গ্রিন হাউজের কল্পিত চিত্র

 

মঙ্গল গ্রহে জমাট পানি আছে নিশ্চিত। এই পানিকে গলানোর জন্য মঙ্গলের তাপমাত্রা বাড়াতে হবে। পুরো মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা এক সাথে বাড়ানো সম্ভব নয়। মানুষকে নিজেরা থাকার জন্য মঙ্গল গ্রহের ঘরের ভেতর পৃথিবীর পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে। যেমন আমরা প্লেনে ভ্রমণ করার সময় আকাশে বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, অক্সিজেন লেভেল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে রাখি, সেভাবেই করতে হবে। পৃথিবীর বাইরে ছোট্ট একটা এলাকাতে পৃথিবীর পরিবেশ তৈরি করাকে বলা হয় প্যারা-টেরাফর্মিং (paraterraforming)। এরকম প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকতে থাকতে মানুষ মঙ্গলের সামগ্রিক পরিবেশ বদলে পৃথিবীর মতো করে ফেলার একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেবে। এটাকে বলা হয় টেরাফর্মিং (terraforming) বা পৃথিবীকরণ। লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যেতে পারে মঙ্গলের পরিবেশ বদলাতে।

           

চিত্র: মঙ্গলের পৃথিবীকরণের কল্পিত চিত্র

 

মঙ্গলের পরিবেশ বদলে পৃথিবীর মত করতে তিনটি প্রধান পরিবর্তন ঘটাতে হবে - ১) জলবায়ুর পরিবর্তন, ২) তাপমাত্রা বৃদ্ধি - যেন তরল পানির প্রবাহ ঘটে, ৩) জলবায়ু সুরক্ষা - যে অক্সিজেন তৈরি হবে তা যেন হারিয়ে না যায়। এগুলো করার জন্য নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি নেই। জীবনের বিকাশ ঘটলে এগুলো জীবনচক্রের মধ্যেই আস্তে আস্তে গড়ে উঠবে।

          শুরুতেই বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে হবে, এবং তার সাথে গ্রহটির সামগ্রিক তাপমাত্রা বাড়াতে হবে। মঙ্গলের মাটি থেকে গ্রিন-হাউজ গ্যাস পারফ্লুরোকার্বন নিসরণ করে বাতাসে ছেড়ে দিতে হবে। মাটিতে অনেক জমাট কার্বন-ডাই-অক্সাইড আছে। ভূস্তরের তাপমাত্রা বাড়লে সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসে পরিণত হবে। সেগুলো বাতাসের সাথে মিশে বায়ুচাপ বাড়তে শুরু করবে। বায়ুচাপ বাড়লে তরল পানির প্রবাহ পাওয়া যাবে। তখন মঙ্গলের লাল পাথরে আটকে পড়া মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসবে বেশি পরিমাণে। তারপর শুরু হবে ব্যাকটেরিয়া ও শ্যাওলার চাষ যেগুলো প্রচন্ড বৈরি পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। গাঢ় রঙের উদ্ভিদ ও শৈবালের চাষ করলে মঙ্গলের ভূমিস্তরের রঙ গাঢ় হবে এবং সূর্য থেকে অনেক বেশি তাপ শোষণ করবে। ফলে ভূস্তরের তাপমাত্রা বাড়বে। এভাবে হাজার বছর পরে হয়তো মঙ্গলে উদ্ভিদ জন্মানো শুরু হবে। তাতে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করবে।

          এসব পরিকল্পনা অনেক লক্ষ বছর পরে কী হতে পারে তার পরিকল্পনা। কিন্তু আর দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যেই যখন মানুষ মঙ্গল গ্রহে পা রাখবে - আমাদের অনেক চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটবে। যে কোন নতুন আবিষ্কার পুরনো অনেক ধারণা বদলে দেয়।

          ২০১০ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০৩৫ সালের মধ্যে আমেরিকা মঙ্গল গ্রহে নভোচারী পাঠাবে এবং তাদের আবার সুস্থ শরীরে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। সে লক্ষ্যে কাজ করছে নাসা এবং আরো অনেক মহাকাশ সংস্থা। মঙ্গল গ্রহে এপর্যন্ত অনেকগুলো মিশন সাফল্যের সাথে পরিচালিত হয়েছে। মঙ্গল গ্রহের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট। মঙ্গলের বুকে নেমে পরীক্ষা চালাচ্ছে যান্ত্রিক রোবট - রোভার। রোবট দিয়ে আমরা যে কাজ করিয়ে নিতে পারছি - সেখানে মানুষ পাঠানোর কী দরকার? দরকার হলো - যে যান্ত্রিক রোবটকে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পাঠানো হয় - তা যতই স্বয়ংক্রিয় হোক না কেন, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হয় পৃথিবীর কন্ট্রোল রুম থেকে। এক টন ওজনের রোভার মঙ্গলের বুকে এক কিলোমিটার যেতে যে সময় নেয়, তার অনেক কম সময়েই একজন নভোচারী তা করে ফেলতে পারে। মঙ্গলের ক্রেটারের দেয়াল বেয়ে একটি রোভারের নামতে বা উঠতে বছর লেগে যায়, সেখানে একজন মানুষ তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই করে ফেলতে পারে। মঙ্গলে যদি নভোচারী পাঠানো যায়, তাহলে তারা খুব সহজেই নমুনা সংগ্রহ করে নিজেদের মহাকাশযানে ফিরে এসে ল্যাবরেটরি টেস্ট করে পৃথিবীতে ফলাফল পাঠিয়ে দিতে পারে। তারপর আবার নমুনা সংগ্রহ করতে পারে। মঙ্গলকে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি জানা যাবে, যদি মঙ্গলে মানুষ পাঠানো যায়। মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর বাধা অনেক। প্রথম বাধা হলো দূরত্ব। পৃথিবী এবং মঙ্গল নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পরস্পর সবচেয়ে কাছের যে দূরত্বে আসতে পারে - সে দূরত্ব ৫ কোটি ৪৭ লক্ষ কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে রকেটে চড়ে সেই দূরত্বে যেতে সময় লাগবে ৫ থেকে ১০ মাস। ফিরে আসতে লাগবে আবার ৫ থেকে ১০ মাস। মঙ্গলে গিয়ে কিছুদিন কাজ করতে হবে। নভোচারীদের জন্য শুধুমাত্র খাবার ও পানীয় নিতে হবে প্রায় দুই বছরের। কী পরিমাণ ওজন হবে এগুলোর? নভোযানের ভর যত বাড়বে, তার জ্বালানিও লাগবে তত বেশি। তাছাড়া আছে মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। মঙ্গল গ্রহে নভোচারীদের যাওয়ার সময় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিয়ে যেতে হবে।

          মঙ্গলে যাওয়া-আসার পুরো সময়টাতে নভোচারীদের থাকতে হবে অনেকটা ওজনহীন অবস্থায়। মহাকাশে মহাকর্ষ বল শূন্য নয়। কিন্তু পৃথিবী থেকে আমরা যতই দূরে যাবো আমাদের মহাকর্ষ বলের মান ততই কমতে থাকবে। আমরা নিজেদের ওজনহীন বলে মনে করবো। দিনের পর দিন এরকম ওজনহীন অবস্থায় থাকার ফলে শারীরিক ও মানসিক অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরজন্য দরকার অনেকদিনের ট্রেনিং। নভোচারীদের সে ট্রেনিং থাকে। তবে মঙ্গলের মত এত দীর্ঘ মহাকাশভ্রমণের ট্রেনিং এখনোপর্যন্ত কোন নভোচারীর নেই, সাধারণ মানুষের থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।

          মহাকাশবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মঙ্গল গ্রহে যাবার পথ আরো সুগম হয়ে উঠবে। এই শতাব্দীতে না হলেও ভবিষ্যত শতাব্দীতে হয়তো গড়ে উঠবে মঙ্গলে মানুষের বসতি।

 

তথ্যসূত্র 

1.    Clare Gibson, the Solar System, King Books, UK, 2012

2.    Giles Sparrow, Planets and Moons, Hinkler Books, Australia, 2006.

3.    Colin Ronan, The Universe Explained, Ken Fin Books, Australia, 1997.

4.   David A Rothery, Planets a very short introduction, Oxford University Press, Great Britain, 2010.

5.    Chris Cooper, Pam Spence, Carole Stott, Stars + Planets an illustrated guide, Star Fire, London, 2007.

6.    Gerard Cheshire, The Solar System and Beyond, Evans, London, 2006.

7.    Steve Parker, Solar System, Ticktock Media Ltd, Great Britain, 2006.Clare

8.    Heather Couper and Nigel Henbest, Encyclopedia of Space, DK Publishing, UK, 2003.

9.    Robin Kerrod & Carole Stott, Hubble the Mirror on the Universe, Third Edition, David and Charles, London, 2008.

10.  Patrick Moore, Mission to the Planets, Cassell, New York 1995.

11. Linda T. Elkins-Tanton, Mars, Chelsea House Publishers, New York, 2006.

12. Eric Burgess, To The Red Planet, Columbia University Press, New York, 1978.

13.  NSSDC Master Catalog, http://nssdc.gsfc.nasa.gov/nmc/

14.  Oliver De Goursac, Visions of Mars, Harry N. Abrams, Inc., Publishers., 2004.

15.  National Space Science Data Center,

       http://nssdc.gsfc.nasa.gov/

16.  Solar System Log by Andrew Wilson, published 1987 by Jane's Publishing Co. Ltd.

17. Mars Science Fiction to Colonization, Lighting Guides, Berkeley, California, 2015.

18.  Louisa Preston, Goldilocks and the Water Bears, the Serach for Life in the Universe, Louisa Preston, Bloomsbury Sigma, 2016.

19. Donald Rapp, Human Missions to Mars, Springer, Uk, 2008.

20. William K Hartmann, Mars The Mysterious Landscapes of the Red Planet, New York, 2003.

21.  Rod Pyle, Destination Mars New Explorations of the Red Planet, Prometheus Books, New York, 2012.

22.  Andrew Chaikin, A Passion for Mars, HNA Inc., 2008.

23.  To Mars and Beyond Search for the Origins of Life, National Museum of Australia, Canberra, 2001.

24.  Alfred S McEwen, Francis Rocard, Xavier Barral, This is Mars, Aperture, New York, 2013.

25.  Marc Kaufman, Mars Up Close Inside the Curiosity Mission, National Geographic, USA, 2014.

26.  Peter Bond, Space Recognition Guide, Collins, UK, 2008.

 ______


লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ১১

 


ষষ্ঠ অধ্যায়

মঙ্গলে প্রাণ 

মঙ্গল গ্রহে সবগুলো অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হলো একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা - মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব কি না নাসার অনেকগুলো সফল মিশন থেকে মঙ্গল গ্রহের বর্তমান পরিবেশ সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে - তাতে বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমান অবস্থায় মঙ্গল গ্রহে স্বাভাবিক-প্রাণ থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এই 'স্বাভাবিক-প্রাণ' বলতে আমরা বুঝছি পৃথিবীর প্রাণ-রাসায়নিক ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা প্রাণ। পৃথিবীর প্রাণের মূল ভিত্তি তরল পানি। পৃথিবীতে তরল পানির অস্তিত্ব যেখানে আছে - সেখানেই প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা মঙ্গলেও যদি পানির অস্তিত্ব থাকে - তাহলে প্রাণের অস্তিত্বও থাকতে পারেবিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পানির অস্তিত্বের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র পানির আভাস থাকলেই যে প্রাণের উদ্ভব ঘটবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।

মঙ্গল মিশনগুলো মঙ্গল গ্রহের সবদিক থেকে হাজার হাজার ছবি তুলে পাঠিয়েছে। সাথে পাওয়া গেছে অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত। সেগুলো বিশ্লেষণ করে মঙ্গল গ্রহে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে কি না সে ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

          মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ধারণা পেয়েছেন। মঙ্গলের বায়ুচাপ মাত্র ৬.১ মিলিবার। পৃথিবীর গড় বায়ুচাপ ১০১৩.২৫ মিলিবার। পৃথিবীর গড় বায়ুচাপকে আমরা হিসেবের সুবিধার্থে ১ atm বা ১ অ্যাটমোস্ফেরিক প্রেসার একক ধরে থাকি। সে হিসেবে মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ হলো পৃথিবীর বায়ুচাপের এক হাজার ভাগের ছয় ভাগ (6.0 x 10-3) মাত্র। মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা -৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় পানি বরফ হয়ে যায়। সেখানে শূন্য ডিগ্রিরও ৬৩ ডিগ্রি নিচে কোন তরল পানি থাকতে পারে না। তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের পরিবর্তনের সাথে পানির যে তিন অবস্থা - তরল, কঠিন, বায়বীয় - তার পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীর এক বায়ুমন্ডলীয় চাপে শূন্য ডিগ্রি থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি তরল আকারে থাকে, ১০০ ডিগ্রির উপরে গেলে পানি বাষ্পে বা বায়বীয় অবস্থায় চলে যায়, আর শূন্য ডিগ্রির নিচে গেলে পানি বরফ বা কঠিন অবস্থায় চলে যায়।

বায়ুর চাপ কমতে থাকলে পানির স্ফুটনাংকও কমতে থাকে। বায়ুর চাপ কমতে কমতে ৬.১ মিলিবার বা 6.0 x 10-3 atm এর কাছাকাছি এলে ০.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি একই সাথে কঠিন, তরল কিংবা বায়বীয় অবস্থায় থাকতে পারে। এই অবস্থাকে পানির ট্রিপল পয়েন্ট বলা হয়। মঙ্গল গ্রহের বায়ুচাপ পানির ট্রিপল পয়েন্টের বায়ুচাপের সমান। কিন্তু তাপমাত্রায় শূন্য ডিগ্রির অনেক নিচে হওয়াতে মঙ্গলে তরল পানি থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কিন্তু মঙ্গলের তাপমাত্রা দিনের বেলায় বিষুবীয় অঞ্চলে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। তার মানে সেই অঞ্চলে খুব সামান্য পরিমাণে তরল পানি থাকলেও থাকতে পারে। সেই আশায় মঙ্গলে পানির সন্ধান করে চলেছে সবগুলো আধুনিক মঙ্গল মিশন।

মঙ্গল গ্রহের ভূমিতে অসংখ্য নদী নালা হ্রদের চিহ্ন রয়েছে যা কালের আবর্তনে শুকিয়ে গেছে। ভূমির এসব গঠন তরল পানি-প্রবাহের প্রমাণ বহন করছে। মঙ্গল গ্রহের ভূমির উপরিস্তরে এখন কোন তরল পানি নেই। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মঙ্গলের ধূলি বা রেগোলিথের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচুর বরফ জমে আছে। রেগোলিথের মাঝে মাঝে এই রন্ধ্র বা ছিদ্রগুলো তৈরি হয়েছে জমাট কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা ড্রাই আইস থেকে। শীতকালে ড্রাই আইসের উপর সামান্য ধূলি পড়লে তা আটকে যায় সেখানে। শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তখন অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত ধূলো বা রেগোলিথের আস্তরণ ভূমিতে রয়ে যায়। এভাবে বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে চলতে এক মিটারেরও বেশি পুরু রেগোলিথের স্তর জমা হয়েছে ভূমির উপর। এই ছিদ্রগুলোর মধ্যে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের জলীয়বাষ্প জমে বরফ হয়ে থাকার সম্ভাবনা আছে।

 

চিত্র: তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের সাথে পানির অবস্থার পরিবর্তন

 

মার্স ওডিসি মিশনের ছবি ও ডাটা থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মঙ্গলের ভূমির উপরিস্তরের কাছাকাছি প্রচুর জমাট বরফ আছে। নাসার মঙ্গল মিশন ওডিসি গামা রে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে এই পানি শনাক্ত করেছে। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র থেকে শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি মঙ্গলের ভূমিতে আসে। ভূমির রাসায়নিক উপাদানের সাথে মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়ায় ভূমি থেকে গামা রশ্মি ও নিউট্রন কণা নির্গত হয়। কী ধরনের মৌলের সাথে মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়া ঘটছে তার উপর নির্ভর করে নিউট্রন কণাগুলোর নির্গমনের গতি। নিউট্রন কণাগুলো কত বেগে নির্গত হচ্ছে তা শনাক্ত করা হয় মার্স ওডিসি স্যাটেলাইটের গামা রে স্পেকট্রোমিটারের সাহায্যে। দেখা গেছে মঙ্গলের ভূমির মাত্র এক মিটার নিচেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি। এই হাইড্রোজেন প্রচুর পানির উপস্থিতির প্রমাণ। ঠিক কী পরিমাণ পানি মঙ্গলের ভূমির নিচে আছে তা সঠিকভাবে বলা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে আনুমানিক হিসেবে দেখা গেছে পৃথিবীর মহাসাগরগুলোতে একশ মিটার গভীরতা পর্যন্ত যতটুকু পানি ধরবে তার চেয়ে কম হবে না মঙ্গলের পানির পরিমাণ।

 

চিত্র: ২০১৫ সালে নাসা ঘোষণা করেছে যে মঙ্গলে তরল পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। গার্নি ক্রেটারের পাড় থেকে যে সরল রেখাগুলো নিচের দিকে নেমে গেছে সেগুলোর একেকটার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ মিটার। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে এগুলো সব মঙ্গলের লবণাক্ত পানির ধারা।

         

মঙ্গল গ্রহে প্রাণ থাকার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা খুব বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীতে পাওয়া মঙ্গলের উল্কাপিন্ড পরীক্ষা করে। ১৯৮৪ সালে অ্যান্টার্কটিকার অ্যালেন হিল্‌স-এ পাওয়া যায় উল্কাপিন্ড এ-এল-এইচ-৮৪০০১। আইসোটোপিক ডেটিং পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে এই উল্কাপিন্ডের বয়স প্রায় ৪০০ কোটি বছর। এই পাথরটি মঙ্গল গ্রহের অংশ। প্রায় দেড় কোটি বছর আগে এটা মঙ্গল গ্রহ থেকে ছিটকে পড়েছিল। তারপর মহাকাশে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ বছর আগে। ১৯৮৪ সালে এই পাথরটি আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে এই পাথরে মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ আছে। এই দাবির ভিত্তিতে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে। তারপর থেকে এপর্যন্ত কয়েক শ' গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে শুধুমাত্র এই উল্কাপিন্ডের উপর ভিত্তি করে মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সপক্ষে।

          এই পাথরটিতে পাওয়া গেছে সিলিকেট ছাড়াও আরো অনেক ধরনের খনিজ কার্বনেট, যাদের মধ্যে আছে ক্যালসাইট, ম্যাগনেসাইট, অ্যানকেরাইট, ও সাইডেরাইট। সাইডেরাইটের মধ্যে আছে ম্যাগনেটাইট ও পাইরোটাইটের কৃস্টাল। দেখা গেছে পাথরের সিলিকেটগুলোর বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। কিন্তু কার্বনেটগুলোর বয়স ৩৯০ থেকে ৪১০ কোটি বছরের মধ্যে। তার মানে মঙ্গল গ্রহ তৈরি হবার সময় যে সিলিকেট ছিল তার উপর কার্বনেট এসেছে আরো ৫০ কোটি বছর পর। খনিজ কার্বনেট তৈরি হয় পানি থেকে। সুতরাং মঙ্গলে কার্বনেট থাকার অর্থ হচ্ছে সেখানে সেই সময় পানি ছিল। ১ কেজি ৯৩১ গ্রাম ভরের পাথরটির মাত্র ১% অর্থাৎ মাত্র ১৯ গ্রাম হলো খনিজ কার্বনেট। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হয়ে উঠেন মঙ্গলে প্রাণ থাকার ব্যাপারে।

          মঙ্গলে প্রাণ থাকার ব্যাপারে বড় প্রমাণ হলো এই উল্কাপিন্ডের একটি অংশে অণুজীবের ফসিল পাওয়া যায়। সূক্ষ্ম নলাকৃতি এসব ফসিল ন্যানো-ব্যাকটেরিয়ার বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এখনো নিশ্চিন্তভাবে প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে মঙ্গল গ্রহে এধরনের ফসিল আরো পাওয়া যাবে - যা মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।

কার্বনেট মিনারেলের মধ্যে সামান্য পরিমাণে ম্যাগনেটাইট পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা মঙ্গলের ব্যাকটেরিয়াগুলো এই ম্যাগনেটাইট তৈরি করেছে। পৃথিবীতে এক শ্রেণির ব্যাকটেরিয়া নিজেদের শরীরে মাইক্রোস্কোপিক ক্রিস্টাল তৈরি করে, পৃথিবীর চুম্বকত্ব কাজে লাগিয়ে সমুদ্রের গভীরে দিক নির্ণয় করার জন্য। তাই এই ক্রিস্টালগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ম্যাগনেটাইট। মঙ্গলের পাথরে পাওয়া ম্যাগনেটাইট ক্রিস্টালগুলোর গঠনের সাথে পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ম্যাগনেটাইটের ক্রিস্টালের গঠনের মিল নেই। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে এই ক্রিস্টালের গঠনের সাথে পৃথিবীর ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্ট ম্যাগনেটাইটের ক্রিস্টালের গঠনের মিল আছে। সেসূত্রে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন যে এগুলো মঙ্গলের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে দুটো সিদ্ধান্তে আসা যায়। এক - মঙ্গলে অণুজীব ছিল, দুই - মঙ্গলের চুম্বকত্ব ছিল।

 

চিত্র: এ-এল-এইচ-৮৪০০১ উল্কাপিন্ডে অণুজীবের ফসিল

 

মঙ্গলে এখন কোন চুম্বকত্ব অবশিষ্ট নেই। কোন কোন পাথরে সামান্য চুম্বকত্বের আভাস পাওয়া গেছে, যেখান থেকে প্রমাণিত হয় যে মঙ্গলে এক সময় চুম্বকত্ব ছিল। কিন্তু ঠিক কখন এবং কী কারণে মঙ্গলের চুম্বকত্ব নষ্ট হয়ে গেছে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি।

          কোন কোন বিজ্ঞানী যুক্তি দিচ্ছেন যে যে প্রচন্ড সংঘর্ষের ফলে মঙ্গল গ্রহের এই পাথরটি ছিটকে বেরিয়ে গেছে - সেই সংঘর্ষের ফলে প্রাণের কোন অস্তিত্বের প্রমাণ টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু মহাকাশ হলো প্রচন্ড ঠান্ডা। এই উল্কাখন্ডগুলো যতদিন মহাকাশে ভ্রমণ করে - একটা বিশাল প্রাকৃতিক ডিপ-ফ্রিজের মধ্যে থাকে। সুতরাং জীবনের কোন চিহ্ন যদি সেখানে থাকে তা মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে আসার ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে না। মঙ্গলের পাথরে কার্বনেটের চিহ্ন - মঙ্গলে জীবনের চিহ্নই নির্দেশ করে।

          মঙ্গল গ্রহের যে পরিবেশ তাতে কোন জীব বা অণুজীব বেঁচে থাকতে পারে কি না - সে প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীতে কিছু অণুজীব আছে যারা অত্যন্ত প্রতিকুল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। কিছু ব্যাকটেরিয়া - যাদের নাম দেয়া হয়েছে কেমোলিথোওঅটোট্রোফস - নিজের শরীর থেকে শক্তি নিয়েই পাথরের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। এরা কোন ধরনের সূর্যালোক ছাড়া শুধুমাত্র ১% অক্সিজেন লেভেলেও বেঁচে থাকতে পারে। এরা মিথেন, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা কিংবা আর্সেনিক থেকেও তাদের দরকারি শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। এদের অনেকে খনিজ সালফার খেয়ে সালফিউরিক এসিড তৈরি করে নিজের শরীরে। সাগরের কয়েক কিলোমিটার নিচে পাথরের খাঁজে খাঁজে বাস করছে এসব ব্যাকটেরিয়া। তীব্র এসিডিক পানিতেও বেঁচে থাকতে পারে অনেক ব্যাকটেরিয়া। একধরনের অণুজীব - ফেরোপ্লাজমা - তীব্র এসিডের  (pH = 0) মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে। পৃথিবীতে আরো অণুজীব আছে, যেমন এক্সট্রিমোফিলস, - যারা প্রচন্ড ঠান্ডা কিংবা প্রচন্ড গরমেও বেঁচে থাকে। বিজ্ঞানীরা যুক্তি দিচ্ছেন পৃথিবীতেই যদি এরকম অণুজীব থাকতে পারে - তাহলে মঙ্গলের অণুজীবরাও পারবে। মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না সে প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দেয়ার জন্য মঙ্গলে আরো অনেক অভিযান চালানো দরকার। বিশেষ করে নভোচারীরা যদি মঙ্গলে সশরীরে গিয়ে পরীক্ষা চালাতে পারেন, তাহলে মঙ্গলে জীবনের জীবাশ্ম পাওয়া যেতেও পারে।

লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ১০

 



পঞ্চম অধ্যায়

মঙ্গলের চাঁদ

 

মঙ্গল গ্রহের চারপাশে ঘুরছে তার দুটো উপগ্রহ - ফোবোস ও ডিমোস। মঙ্গলের এই উপগ্রহ দুটোর আকৃতি আমাদের চাঁদের মত জ্যামিতিক গোলাকার নয়, অনেকটা বড় সাইজের আলুর মত। আর আকারেও আমাদের চাঁদের তুলনায় অত্যন্ত ছোট। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আসফ হল ১৮৭৭ সালের আগস্ট মাসে মঙ্গলের এই উপগ্রহদুটো আবিষ্কার করেছিলেন। রোমান পৌরাণিক কাহিনির যুদ্ধের দেবতা মার্সের ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া দুটোর নাম ছিল ফোবোস ও ডিমোস। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে ফোবোস হলো অ্যারিস (মার্স)  ও আফ্রোদিতি (ভেনাস)'র ছেলে। আসফ হল মঙ্গলের এই উপগ্রহদুটোর নাম রাখলেন ফোবোস ও ডিমোস - আতঙ্ক ও ভয়। উপগ্রহদুটো মঙ্গলের বিষুব রেখা বরাবর প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরছে। দুটো উপগ্রহই অনুজ্জ্বল পদার্থ দিয়ে তৈরি, তাই এরা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। এদের গঠন ও উপাদান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এরা আসলে উপগ্রহ নয় - এরা হয়তো অন্য কোন গ্রহের বিচ্ছিন্ন অংশ, যারা মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ বলের টানে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু ওরকম হলে তারা এমন বৃত্তাকার কক্ষপথে এত কাছ থেকে ঘুরতো না। পৃথিবীর চাঁদ পৃথিবী তৈরি হবার সময়েই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলের চাঁদদুটো মঙ্গলের সাথে তৈরি হয়নি। হতে পারে এগুলো মঙ্গলেরই ছিটকে পড়া অংশ থেকে তৈরি হয়েছে। কোন একটা মহাজাগতিক সংঘর্ষে মঙ্গলের দুটো অংশ ছিটকে পড়েছিল। সেই অংশদুটোই মঙ্গলের মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্রে আটকে পড়ে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে উপগ্রহের মতো।

          উপগ্রহদুটোর মধ্যে ফোবোসের আয়তন ডিমোসের চেয়ে বড়। মঙ্গলের ভূমি থেকে ফোবোসের দূরত্ব ৫,৯৮১ কিলোমিটার। ফোবোসের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ, অর্থাৎ মঙ্গলের কেন্দ্র থেকে ফোবোসের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব, ৯৩৭৮ কিলোমিটার। ৭ ঘন্টা ৩৯ মিনিটে মঙ্গলের চারপাশে একবার ঘুরে আসে ফোবোস। মঙ্গলের ভূমি থেকে বিষুবরেখা বরাবর তাকালে দেখা যায় ফোবোস মঙ্গলের পশ্চিম দিকে উঠে আর ৪ ঘন্টা ২০ মিনিট পর পূর্ব দিকে অস্ত যায়। তারপর ১১ ঘন্টা পর আবার উদয় হয়।

          ফোবোসের আকৃতি এবড়ো-খেবড়ো। এর গড় ব্যাস মাত্র ২২.২ কিলোমিটার এবং ক্ষেত্রফল ৬,১০০ বর্গ কিলোমিটার। এর উজ্জ্বলতা খুব কম, কারণ সূর্যের আলোর মাত্র ৭.১% প্রতিফলিত হয় এর গা থেকে। পৃথিবীর চাঁদ যেমন আলো দেয়, মঙ্গলের চাঁদ সেরকম আলো দেয় না। ফোবোসের ঘনত্ব এত কম যে এটাকে কঠিন পাথুরে উপগ্রহ বলা চলে না। ধারণা করা হচ্ছে ফোবোস গঠিত হয়েছে খুবই হালকা ধুলোর মত পদার্থ দিয়ে। এর  উপরিতলের ধুলোর আস্তরণের পুরুত্ব হতে পারে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু এর মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ প্রায় নগণ্য। এত কম মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে এত ধুলো কীভাবে ধরে রাখছে এটা এখনো রহস্যময়।

          ফোবোসের গায়ে ৯ কিলোমিটার চওড়া বিশাল এক ক্রেটার। এই ক্রেটারের নাম স্টিকনি। ধারণা করা হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের উপর গ্রহাণুর আঘাতের ফলে মঙ্গল গ্রহ থেকে ছিটকে আসা বড় কোন পাথরের টুকরোর আঘাতে এই ক্রেটারের সৃষ্টি হয়েছে।

          ফোবোস মঙ্গলের ভূমির এত কাছে থেকে চারপাশে ঘুরছে যে, ঘুরতে ঘুরতে এটা মঙ্গলের আরো কাছে চলে আসছে। আগামী ৮০ লক্ষ বছরের মধ্যে ফোবোস মঙ্গলের ভূমির মাত্র ৭,১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসবে। এই দূরত্ব হলো ফোবোসের রোশ লিমিট (Roche Limit)। ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুয়ার্ড রোশ ১৮৪৮ সালে হিসেব করে দেখিয়েছিলেন কোন গ্রহের উপগ্রহ যদি একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের চেয়ে গ্রহটির কাছে চলে আসে, তখন গ্রহটির মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে উপগ্রহটি ভেঙে যায়। তারপর সেই ভাঙা টুকরোগুলো গ্রহটির চারপাশে একটি বৃত্ত তৈরি করে ঘুরতে থাকে। ফোবোসও ভেঙে গিয়ে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে থাকবে।

 

চিত্র: ফোবোসের ক্রেটার - স্টিকনি

         

ফোবোসের তুলনায় অনেক ছোট উপগ্রহ ডিমোস। মঙ্গল থেকে ২৩,৪৫৯ কিলোমিটার দূরে থেকে ৩০ ঘন্টা ১৮ মিনিটে মঙ্গলের চারপাশে একবার ঘুরে আসে ডিমোস। ফোবোস যেমন ক্রমশ মঙ্গলের কাছে চলে আসছে, ডিমোস আস্তে আস্তে মঙ্গল থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। মঙ্গলের বিষুব রেখা থেকে দেখলে ডিমোস মঙ্গলের আকাশে পূর্ব দিকে উঠে, আর ৬০ ঘন্টা পর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়।

          ডিমোসের আকৃতিও এবড়ো-খেবড়ো। এর আকার ১৫ কিমি x ১২.২ কিমি x ১০.৪ কিমি, মোট ক্ষেত্রফল মাত্র ১৪০০ বর্গ কিলোমিটার। ডিমোসের গায়েও ক্রেটারের চিহ্ন আছে, তবে ফোবোসের মত অত বড় নয়। ডিমোসের ক্রেটারগুলোর ব্যাস ২.৫ কিলোমিটারের কম।

 

সারণি: ফোবোস ও ডিমোসের ভৌত উপাত্ত

উপাত্ত

ফোবোস

ডিমোস

কক্ষপথের ব্যাসার্ধ

৯,৩৭৮ কিমি

২৩,৪৫৯ কিমি

কক্ষপথে একবার ঘুরতে সময় লাগে

৭ ঘন্টা ৩৯ মিনিট

৩০ ঘন্টা ১৮ মিনিট

কক্ষপথের নতি

.০৮ ডিগ্রি

.৭৯ ডিগ্রি

কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা

.০১৫১

.০০০৫

গড় আকার

২৬.৮ কিমি x ২২.৪ কিমি x ১৮.৪ কিমি

১৫ কিমি x ১২.২ কিমি x ১০.৪ কিমি

ভর

১০৬ কোটি কোটি কিলোগ্রাম

২৪ কোটি কোটি কিলোগ্রাম

গড় ঘনত্ব

১৯০০ কেজি/ঘন মিটার

.৯ গ্রাম/সিসি

১৭৫০ কেজি/ঘন মিটার

.৭৫ গ্রাম/সিসি

ক্ষেত্রফল

৬,১০০ বর্গ কিমি

১,৪০০ বর্গ কিমি

 

লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ৯

 



চতুর্থ অধ্যায়

মঙ্গলের অভ্যন্তরে 

মঙ্গলগ্রহে পাঠানো স্যাটেলাইট ও রোভারগুলো যে সব তথ্য ও উপাত্ত পাঠিয়েছে তা থেকে মঙ্গল গ্রহের গঠন সম্পর্কে আমরা অনেককিছু জানতে পেরেছি। এবার চলো দেখি মঙ্গল গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন কী রকম। সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে পৃথিবী গঠিত হবার সময়েই সূর্যের অন্যান্য গ্রহের মত মঙ্গল গ্রহও গঠিত হয়েছে। গ্যালাক্সির ঘূর্ণায়মান নেবুলাতে গ্রহগুলো গঠিত হবার সময় নেবুলার কৌণিক ভরবেগ সঞ্চালিত হয়েছে গ্রহগুলির মধ্যে। প্রচন্ড বেগে ঘুরতে ঘুরতে গ্রহগুলোর আকার হয়েছে গোলাকার। উৎপন্ন হওয়ার সময় প্রচন্ড গরম এবং নরম ছিল গ্রহগুলোর দেহ। সেই সময় অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলগুলো চলে গেছে গ্রহের ভেতরের দিকে, আর হালকা মৌলগুলো রয়ে গেছে গ্রহের উপরের স্তরগুলোতে। এভাবেই সৌরজগতের চারটি কঠিন গ্রহ - বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গলের কেন্দ্রে রয়েছে কঠিন কোর বা অন্তকেন্দ্র, আর উপরিস্তরে রয়েছে পাতলা ক্রাস্ট। কোর ও ক্রাস্টের মাঝখানের স্তর অপেক্ষাকৃত হালকা পদার্থের তৈরি ম্যান্টল। গ্রহের আকার অনুযায়ী এই স্তরগুলোর পুরুত্ব ও ঘনত্বের পার্থক্য দেখা যায়।

 

মঙ্গলের ভূমির স্তর

মঙ্গল গ্রহের একেবারে কেন্দ্রে আছে কঠিন কোর (core) বা অন্তকেন্দ্র, যার ব্যাসার্ধ ১,৭৯৪ কিলোমিটার। এই কোরের শতকরা ৮৩ থেকে ৮৪ ভাগ লোহা ও নিকেল, বাকি ১৬ থেকে ১৭ ভাগ সালফার। আয়রন সালফাইড আংশিক তরল। পৃথিবীর অন্তকেন্দ্রে যে পরিমাণ হালকা পদার্থ আছে, মঙ্গলের অন্তকেন্দ্রে হালকা পদার্থ আছে তার দ্বিগুণ। ফলে পৃথিবীর অন্তকেন্দ্রের চেয়ে মঙ্গলের অন্তকেন্দ্রের ঘনত্ব কিছুটা কম।

 

চিত্র: মঙ্গল গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন

         

অন্তকেন্দ্রের বাইরে রয়েছে প্রায় ১৪৭৭ কিলোমিটার পুরু সিলিকেটের স্তর - ম্যান্টল। এই ম্যান্টল এক সময় খুবই সক্রিয় ছিল। এখানেই ছিল টেকটোনিক প্লেট। মঙ্গলের ভূমির উপরিস্তরে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট পাহাড়-পর্বত এবং খাঁজ ও খাদের প্রমাণ আছে। মঙ্গল গ্রহের এই স্তর থেকেই ঘটেছিল আগ্নেয়গিরি - যার লাভাস্রোতের চিহ্নও দেখা যায় মঙ্গলের ভূমিতে। ধারণা করা হচ্ছে মঙ্গলের ম্যান্টলে এখন আর ভূতাত্ত্বিক সক্রিয়তা নেই।

 

চিত্র: মঙ্গলের ভূমিতে গ্রহাণু বা উল্কাপিন্ডের আঘাতে সৃষ্ট গহ্বর

         

মঙ্গলের উপরিস্তর ক্রাস্টের গড় পুরুত্ব ৫০ কিলোমিটার। কোন কোন জায়গায় এই ক্রাস্ট প্রায় ১২৫ কিলোমিটার পুরু, আবার কোন কোন জায়গায় ৩০ কিলোমিটারেও কম। মঙ্গলের ক্রাস্ট পৃথিবীর ক্রাস্টের তুলনায় অনেক বেশি পুরু। মঙ্গলের ক্রাস্টের উপাদানের মধ্যে আছে লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, এবং পটাসিয়াম। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন মঙ্গল গ্রহের মোট গাঠনিক উপাদানের শতকরা ৪৩.৯ ভাগ সিলিকন ডাই-অক্সাইড (SiO2) বা সিলিকা, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Al2O3) ৩.১৫ ভাগ, ফেরাস অক্সাইড (FeO) ১৮.৮ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড (MgO) ৩১.৬৬ ভাগ, ও ক্যালসিয়াম অক্সাইড (CaO) ২.৫ ভাগ।

 

মঙ্গলের চুম্বকত্ব

মঙ্গল গ্রহে কোন চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া যায়নি। মঙ্গল মিশনগুলোর পাঠানো তথ্য থেকে জানা গেছে যে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে মঙ্গল গ্রহে চৌম্বকত্ব ছিল। পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রে বা অন্তকেন্দ্রে আছে প্রায় চাঁদের সমান আয়তনের একটা বিশাল লোহার গোলক। এটার তাপমাত্রা প্রায় ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এত তাপে কোন স্থায়ী চুম্বক তৈরি হতে পারে না। তাই লোহার বলটা চুম্বক নয়। কিন্তু এই লোহার বলকে ঘিরে রয়েছে আউটার কোর বা বহিকেন্দ্র। সেখানে আছে লোহার তরল (অনেকটা ঘন কাদার মতো)। পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে এই তরলেও একটা স্রোত তৈরি হয়েছে - যার ফলে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে। বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত হলে তাকে ঘিরে চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়। পৃথিবীর কেন্দ্রেও তাই হয়েছে। পৃথিবী পরিণত হয়েছে একটা বিরাট আকারের চুম্বকে। পৃথিবীর মত মঙ্গল গ্রহেরও চৌম্বকত্ব থাকার অর্থ হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের অন্তকেন্দ্রের বাইরে একটি তরল স্তর ছিল। কিন্তু মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গিয়ে সেই তরল স্তরটা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। ফলে মঙ্গল গ্রহের অন্তকেন্দ্রের ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে যায়, মঙ্গল গ্রহের চৌম্বকত্বও নষ্ট হয়ে যায়।

 

মঙ্গলের বায়ুমন্ডল

মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ বলের মান পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের মাত্র ৩৮%। পৃথিবী যে বলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে ভূমির দিকে টেনে রাখতে পারে মঙ্গলের সে বল নেই। তা সত্ত্বেও মঙ্গলের গড় তাপমাত্রা কম এবং বায়ুমন্ডলের উপাদানের গড় ওজন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপাদানের গড় ওজনের চেয়ে বেশি হওয়ার কারণে মঙ্গলের ভূমি থেকে প্রায় ১০.৮ কিলোমিটার উপর পর্যন্ত মঙ্গলের বায়ুমন্ডল বিস্তৃত। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল কিন্তু ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫ কিলোমিটার উপরে গেলেই শেষ। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ৩% নাইট্রোজেন, ১.৬% আর্গন, ১.৩% অক্সিজেন, খুবই সামান্য পরিমাণ মিথেন ও পানির বাষ্প। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে যেসব উপাদান আছে, মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে তার সব উপাদানই আছে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়। ফলে সেই বাতাসে পৃথিবীর প্রাণিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপাদানগুলোর পরিমাণের তুলনামূলক চিত্র নিচের সারণিতে দেয়া হলো।

 

 

সারণি: মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলের উপাদান

উপাদান

মঙ্গল গ্রহে

পরিমাণ (%)

পৃথিবীতে পরিমাণ (%)

কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2)

৯৫

৩৪৫ পিপিএম*

নাইট্রোজেন (N2)

.

৭৮.০৮

আর্গন (Ar)

.

.৯৩

অক্সিজেন (O2)

.

২০.৯৫

কার্বন-মনোক্সাইড (CO)

৭০০ পিপিএম

১০০ পিপিবি**

পানির বাষ্প (H2O)

৩০০ পিপিএম

.৩ থেকে ০.৪ পিপিএম

নিয়ন (Ne)

২৫ পিপিএম

১৮ পিপিএম

ক্রিপটন (Kr)

০৩ পিপিএম

১ পিপিএম

জিনন (Xe)

০০৮ পিপিএম

১ পিপিটি***

ওজোন (O3)

০১ পিপিএম

 ০ থেকে ১২ পিপিএম

*পিপিএম - পার্ট পার মিলিয়ন

**পিপিবি - পার্ট পার বিলিয়ন

***পিপিটি - পার্ট পার ট্রিলিয়ন

 

মঙ্গলের তাপমাত্রা

মঙ্গল গ্রহের গড় তাপমাত্রা  মাইনাস ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু মঙ্গলের কক্ষপথ এমন উৎকেন্দ্রিক যে সূর্যের চারপাশে ঘুরার সময় সূর্য থেকে গ্রহটির দূরত্ব অনেক বেশি বাড়ে কমে। ফলে তার তাপমাত্রাও খুব বদলে যায়। যখন সূর্যের খুব কাছে আসে তখন মঙ্গলের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়, আবার যখন সূর্য থেকে অনেক দূরে চলে যায়, সূর্যের আলো ঠিকমত পায় না, তখন সেদিকে গ্রহের তাপমাত্রা কমে গিয়ে শূন্যের নিচে আরো ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।

 

মঙ্গলের বায়ুচাপ

মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ পৃথিবীর তুলনায় খুবই কম। সমুদ্রপৃষ্ঠে পৃথিবীর গড় বায়ুচাপ যেখানে ১০১.৩ কিলোপ্যাসকেল, সেখানে মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ মাত্র ৬০০ প্যাসকেল বা ০.৬ কিলোপ্যাসকেল যা পৃথিবীর চেয়ে ১৪০ গুণ কম। বায়ুচাপ মাপার আন্তর্জাতিক একক হলো প্যাসকেল, আর ব্যবহারিক একক হলো মিলিবার। ১ বার = ১০০ কিলোপ্যাসকেল। ১ মিলিবার = ১০০ প্যাসকেল। মঙ্গলের সর্বোচ্চ স্থান অলিম্পাস মন্‌স-এর চূড়ায় বায়ুচাপ সবচেয়ে কম, মাত্র ৩০ প্যাসকেল। যেখানে পানি শুধুমাত্র থাকতে পারে কঠিন অবস্থায়, অথবা বাষ্প আকারে। এত কম চাপে পানি তরলে পরিণত হতে পারে না। আবার দক্ষিণ গোলার্ধের হেলাস অববাহিকার সবচেয়ে গভীর স্থানে বায়ুচাপ সবচেয়ে বেশি, ১,১৫৫ প্যাসকেল। এখানে কোন কোন জায়গায় তরল পানি থাকা অসম্ভব নয়, কারণ তাপমাত্রা বাড়লে এই চাপে পানি তরল আকারে থাকতে পারে। পানির ট্রিপল পয়েন্টে পানি কঠিন, তরল, কিংবা বায়বীয় - যে কোন অবস্থায় থাকতে পারে। পানির ট্রিপল পয়েন্টের তাপমাত্রা হলো ০.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবং বায়ুচাপ ৬০০ প্যাসকেল। মঙ্গলের গড় বায়ুচাপ পানির ট্রিপল পয়েন্টের চাপের সমান। কিন্তু তাপমাত্রা অনেক কম বলেই মঙ্গলে স্বাভাবিক অবস্থায় তরল পানি থাকতে পারে না। কিন্তু মঙ্গলের হেলাস বেসিনের কোন কোন জায়গায় বায়ুচাপ ও তাপমাত্রা তরল পানি থাকার অনুকুলে।

 

মঙ্গলে বায়ুপ্রবাহ

মঙ্গলে স্যাটেলাইট পাঠানোর আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে মঙ্গলে বায়ুপ্রবাহ আছে। মঙ্গলে মাঝে মাঝে দীর্ঘদিনব্যাপী বালিঝড় বয়ে যায়। পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গল পর্যবেক্ষণ করার সময় দেখা যায় বায়ুপ্রবাহের কারণে মঙ্গলের উজ্জ্বলতার হ্রাস-বৃদ্ধি চোখে পড়ে। স্যাটেলাইট ম্যারিনার-৯ মঙ্গলের বালিঝড়ের কবলে পড়ে। বায়ুপ্রবাহের কারণে মঙ্গলের ভূমিতে তৈরি হয়েছে অনেক বালিয়াড়ি।

 

চিত্র: মঙ্গলে বায়ুপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট বালিয়াড়ি

 

মঙ্গলে মেঘ

পৃথিবীর আকাশে যেমন অবিরাম মেঘের আনাগোনা চলছে, মঙ্গলের আকাশে সেরকম নয়। মঙ্গলের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যদিও খুব কম, কিন্তু যেটুকু আছে তাতেই মেঘ তৈরি হতে পারে। পৃথিবীর টেলিস্কোপ থেকে মঙ্গলের আকাশে হালকা মেঘের আনাগোনা দেখা যায়। অলিম্পাস পর্বতের উপর থেকে এবং থারসিস ভলকানো অঞ্চলে প্রায়ই মেঘের সৃষ্টি হয়। মেরু অঞ্চলে সমান্তরাল রেখার মত মেঘের উৎপত্তি ঘটে। নিচু এলাকায় কুয়াশা দেখা যায়, বিশেষ করে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের সময়।

মাঝে মাঝে মঙ্গলের মিহি ধুলো থেকেও তৈরি হয় ধুলিমেঘ। মঙ্গলের বাতাস মিহিধুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে মঙ্গলের আকাশ হয়ে ওঠে গোলাপী। এই রঙের তীব্রতা নির্ভর করে বাতাসে ধুলির পরিমাণের উপর। মঙ্গলের ধুলির কণার ব্যাস মাত্র ১.৫ মাইক্রোমিটার।

মঙ্গলের বায়ুমন্ডল যখন সূর্যালোকে উত্তপ্ত হয়, তখন বাতাসের সাথে মিহিধুলি উড়তে থাকে। অনেক ধুলিকণা একসাথে মিশে সূর্যের আলোর প্রায় ২৫% প্রতিফলন ঘটায়। পৃথিবী থেকে এই উড়ন্ত ধুলিগুলোকে ধুলিঝড়ের মত লাগে। এপর্যন্ত অনেকগুলো ধুলিঝড় দেখা গেছে মঙ্গলে।

 

চিত্র: মঙ্গলের আকাশে মেঘের আনাগোনা

 

মঙ্গলে উল্কাপাত

পৃথিবীর কক্ষপথে যত ধুমকেতু আসে, তার প্রায় চারগুণ বেশি আসে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে। তাই মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রচুর উল্কাপিন্ড প্রবেশ করে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে উল্কাপিন্ড প্রবেশ করার সময় বাতাসের সাথে সংঘর্ষে উল্কাপিন্ড চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে যায়। মঙ্গল গ্রহেও একই ব্যাপার ঘটে। মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চেয়ে হাল্কা হলেও, মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের চেয়ে বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বায়ুমন্ডলের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষের ফলে উল্কাপিন্ডগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার সময় ধাতব কণাগুলো চার্জিত হয়ে যায়। ফলে ক্ষণস্থায়ী প্লাজমার একটা লম্বা রেখা তৈরি হয় - যা পৃথিবীর রেডিও-টেলিস্কোপে ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীরা এভাবে অনেক ধুমকেতু এবং উল্কাপাত পর্যবেক্ষণ করেন।

           

চিত্র: মঙ্গলের মাটিতে পাওয়া উল্কাপিন্ড 'হিট শিল্ড রক'।

 

ছোট ছোট উল্কাপিন্ডগুলো বায়ুমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে মাটিতে পড়ার আগেই বাতাসে মিশে যায়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত বড় উল্কাপিন্ডগুলোর কিছু কিছু অংশ মঙ্গলের মাটিতে নেমে আসে।     

 

মঙ্গলের ভূমির বিবর্তন

মঙ্গলের উপরিস্তরে অসংখ্য গ্রহাণুর আঘাতের ফলে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গহ্বর। হিসেব করে দেখা গেছে এসব ঘটেছিল প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে যখন মঙ্গল গ্রহের ক্রাস্ট নরম ছিল। এই গ্রহাণুগুলোর কিছু এসেছে সৌরজগতের ভেতর থেকে। তবে বেশিরভাগই এসেছে সৌরজগতের বাইরের অন্যান্য বিশাল গ্রহের সাথে সূর্যের মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে। বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং চাঁদেও এরকম অসংখ্য গ্রহাণু আছড়ে পড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির গহ্বর তৈরি করেছে। শুক্র ও পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত সেই গহ্বরগুলোর বেশিরভাগ ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর চাঁদ, বুধ এবং মঙ্গলের ক্রাস্টে সেই ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। মঙ্গল গ্রহ উষ্ণ ও আর্দ্র অবস্থা থেকে বেশ দ্রুত ঠান্ডা হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ৩৮০ কোটি বছর আগে অসংখ্য গ্রহাণুর আঘাতের সাথে সাথে অসংখ্য বরফ-শীতল ধুমকেতুও আছড়ে পড়েছিল মঙ্গলের বুকে। মঙ্গল গ্রহের চারপাশে আবর্তনরত স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি, মঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো রোভার এবং ল্যান্ডার থেকে প্রাপ্ত ছবি ও অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাতে গত সাড়ে চারশ কোটি বছরে মঙ্গলের গঠনের কী কী পরিবর্তন হয়েছে তার একটা গ্রহণযোগ্য চিত্র পাওয়া যায়।

          মঙ্গল গ্রহের উত্তর মেরুতে ক্রেটারের সংখ্যা দক্ষিণ মেরুর ক্রেটারের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া উত্তর মেরুর গহ্বরগুলোর আয়তনও দক্ষিণ মেরুর গহ্বরগুলোর আয়তনের চেয়ে বেশি। বোঝাই যাচ্ছে উত্তর মেরুর ক্রাস্ট দক্ষিণ মেরুর ক্রাস্টের চেয়ে পুরনো। তার মানে দক্ষিণ মেরুর ক্রাস্টে যেসব পরিবর্তন হয়েছে উত্তর মেরুর ক্রাস্টে সেরকম পরিবর্তন ঘটেনি। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মঙ্গলের ভূমির উপরিতলের প্রায় পুরোটাই জরিপ করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের হাতে এখন যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে মঙ্গল গ্রহ একসময় পৃথিবীর মতই উষ্ণ এবং আর্দ্র ছিল। তারপর প্রচুর উল্কাপাত হয়েছে সেখানে। গ্রহাণুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মঙ্গলপৃষ্ঠ। অসংখ্য শীতল ধুমকেতু আছড়ে পড়েছে মঙ্গলের পিঠে। তারপর দ্রুত ঠান্ডা হতে শুরু করেছে মঙ্গল। আগ্নেয়গিরির ফলে লাভাস্রোত এসে ভরাট করে ফেলেছে অনেকগুলো ক্রেটার। সেখানকার ভূমি হয়ে গেছে সমতল। ভূমিতে শুকিয়ে যাওয়া চিহ্ন সেই সময়ের সাক্ষ্য দেয়।

          মঙ্গল গ্রহের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমির উপাদান পরীক্ষা করে ভূমির পরিবর্তনকে চারটি পর্যায়কালে ভাগ করা যায়:

  • প্রাক-নোয়াচিস পর্যায় (Pre-Noachian Period)
  • নোয়াচিস পর্যায় (Noachian Period)
  • হেস্পেরিয়া পর্যায় (Hesperian Period)
  • আমাজনিস পর্যায় (Amazonian Period)

 

মঙ্গলের ভূমির এই পর্যায়কালগুলোর নাম দেয়া হয়েছে মঙ্গলের ভূমিতে প্রাপ্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ের তিনটি অঞ্চলের নামে। নোয়াচিস (Noachis) টেরা হলো মঙ্গলের সবচেয়ে পুরনো অঞ্চল। টেরা হলো সমতল থেকে অনেক উঁচু ভূমি। ৪১০ কোটি থেকে ৩৭০ কোটি বছর আগে এই অঞ্চল গঠিত হয়েছিল। তারপর আর কোন পরিবর্তন সেখানে হয়নি। এই অঞ্চলের নামানুসারে নোয়াচিস পর্যায়। হেস্পেরিয়া পর্যায়ের নাম দেয়া হয়েছে হেস্পেরিয়া প্ল্যানামের নামানুসারে। প্ল্যানাম হলো খাড়া উঁচু সমতল ভূমি। এই প্ল্যানামের বয়স ৩৭০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি বছরের মধ্যে। আমাজনিস পর্যায়ের নাম দেয়া হয়েছে আমাজনিস প্ল্যানেটিয়ার নাম অনুসারে। প্ল্যানেটিয়া হলো আশেপাশের ভূমি থেকে নিচু সমতল ভূমি। মঙ্গলে এধরনের ভূমি সৃষ্টি হয়েছে ভূমির অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এটাকেই মঙ্গলের আধুনিক পর্যায় বলে মনে করা হয়। ৩০০ কোটি বছর আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত আমাজনিস পর্যায়।

         

প্রাক-নোয়াচিস পর্যায়

বর্তমান সময় থেকে ৪৫০ থেকে ৪১০ কোটি বছর আগপর্যন্ত সময়কালকে প্রাক-নোয়াচিস পর্যায় ধরা হয়। এই সময়ের মধ্যে উত্তর গোলার্ধ ও দক্ষিণ গোলার্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য সৃষ্টি হয়। মঙ্গল গ্রহের উত্তর মেরুতে ক্রাস্টের গড় পুরুত্ব ৩২ কিলোমিটার, কিন্তু দক্ষিণ মেরুতে ক্রাস্টের পুরুত্ব ৫৮ কিলোমিটার। ধারণা করা হচ্ছে উত্তর মেরুতে বিশাল আকৃতির এক গ্রহাণু - (যার আয়তন চাঁদের আয়তনের ৬০%) এসে আঘাত হানে। ফলে উত্তরমেরু প্রায় ২৬ কিলোমিটার দেবে গিয়ে সমতল হয়ে যায়। উত্তর মেরুর বরিয়ালিস বেসিন বা বরিয়ালিস অববাহিকার সৃষ্টি হয়েছে এভাবে। সৌরজগতের সবচেয়ে বড় অববাহিকা এই বরিয়ালিস অববাহিকা, যার দৈর্ঘ্য ১০,৬০০ কিলোমিটার, আর প্রস্থ ৮,৫০০ কিলোমিটার। এতবড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মঙ্গলের আদি বায়ুমন্ডলের বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

 

চিত্র: বরিয়ালিস অববাহিকা

 

উত্তর মেরুতে ১০০০ কিলোমিটারের বেশি ব্যাসের ২০টির বেশি অববাহিকা সৃষ্টি হয়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যে এগুলো তৈরি হয়েছে। মঙ্গলের বয়স মাত্র ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি বছর হবার আগেই ২০টার মধ্যে ১৮টা অববাহিকা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।  মঙ্গল গ্রহের আরো তিনটি প্রধান অববাহিকা হলো: দক্ষিণ গোলার্ধের হেলা বেসিন (ব্যাস ২৩০০ কিলোমিটার), দক্ষিণ গোলার্ধের আরগ্যার বেসিন (ব্যাস ১৮০০ কিলোমিটার), উত্তর গোলার্ধের ইসিদিস (ব্যাস ১৫০০ কিলোমিটার)।

          প্রাক-নোয়াচিস পর্যায়ের শেষ এক কোটি বছর আগে প্রচুর গ্রহাণুঝড়ের কারণে মঙ্গলের চৌম্বকক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এই চৌম্বকক্ষেত্র মহাজাগতিক রশ্মি ও সৌরঝড়ে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে মঙ্গল গ্রহকে রক্ষা করতো। চৌম্বকক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাওয়াতে মঙ্গল গ্রহে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে মঙ্গল গ্রহে প্রাণ ধারণের পরিবেশ যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও মুছে যায়।

 

নোয়াচিস পর্যায়

৪১০ থেকে ৩৭০ কোটি বছর - এই চল্লিশ কোটি বছর সময়কালকে মঙ্গল গ্রহের নোয়াচিস পর্যায় ধরা হয়। এই সময়ে মঙ্গল গ্রহ উষ্ণ ও আর্দ্র ছিল। মঙ্গলের কিছু কিছু জায়গার ভূমি এখনো সেই সময়ের সাক্ষ্য দেয়। মঙ্গলের বিষুবরেখা বরাবর ৯৫ ডিগ্রি পশ্চিমে ১২০ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ৮০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে আগ্নেয়গিরির অগ্নোৎপাতে বিশাল এক মহাদেশ আকৃতির অঞ্চল ভূমির উপরে ফুলে উঠেছে - যার নাম দেয়া হয়েছে থারসিস বাল্‌জ।

 

চিত্র: থারসিস বাল্‌জ

 

নোয়াচিস পর্যায়ে মঙ্গলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তরল পানিতে পূর্ণ ছিল। তখন মঙ্গলে অনেক নদী ও সাগর সৃষ্টি হয়েছে। বিশাল হেলাস অববাহিকা সৃষ্টি হয়েছে এই সময়ে। নোয়াচিস পর্যায়ের শেষ ভাগে বায়ুমন্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ফলে উপরিস্তরের পানি শুকিয়ে যায়, পানির স্তর নেমে যায় ক্রাস্টের অনেক নিচে।

 

হেস্পেরিয়া পর্যায়

৩৭০ থেকে ৩০০ কোটি বছর - এই ৭০ কোটি বছর সময়কালকে মঙ্গল গ্রহের হেস্পেরিয়া পর্যায় ধরা হয়। এই সময়কালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ ঘটে এবং সীমাহীন লাভাস্রোত ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে ভূস্তরে লাভার সমতল স্তর তৈরি করেছে। আবার ভূস্তর ঠেলে উপরের দিকে বেরিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনেক পাহাড়-পর্বত। মঙ্গল গ্রহে আছে সৌরজগতের সবচেয়ে উঁচু পর্বত - অলিম্পাস মন্‌স, যার উচ্চতা প্রায় ২২ কিলোমিটার যা এভারেস্ট পর্বতের প্রায় তিন গুণ। এভাবে আরো সৃষ্টি হয় অ্যালবা পর্বত, যার উচ্চতা প্রায় ৬.৮ কিলোমিটার। প্রচন্ড প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগ্নেয়গিরির অগ্নোৎপাতে মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা এবং বায়ুচাপ বেড়ে যায়। ভয়ানক বন্যার পানিতে ডুবে যায় নিচু এলাকা।

 

চিত্র: মঙ্গল গ্রহের অলিম্পাস পর্বত

 

আমাজনিস পর্যায়

৩০০ কোটি বছর আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কালকে আমাজনিস পর্যায় ধরা হয়। এই তিনশ কোটি বছরে মঙ্গলে ক্রাস্টের পরিবর্তন হয়েছে অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে। আগ্নেয়গিরির উৎপাত আস্তে আস্তে থেমে গেছে। তরল পানি উধাও হয়ে গেছে। তাপমাত্রা ও বায়ুচাপ কমে গিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এই পর্যায়েই মানুষ মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠিয়েছে, রোভার পাঠিয়ে মঙ্গলের ভূমি জরিপ করে তৈরি করা হয়েছে মঙ্গল গ্রহের নিখুঁত ম্যাপ।

 পর্ব ১০

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts