Showing posts with label সিডনি. Show all posts
Showing posts with label সিডনি. Show all posts

Wednesday, 31 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৯ম পর্ব



সেরাহ আর তার বন্ধুরা চলে গেলো সকালে। তারা যাবার পরে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। আজ সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে ব্রেকফাস্ট করে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। সেন্ট্রাল রোড ধরে সোজা হাঁটতে হাঁটতে হাইড পার্ক। সিডনি সেন্ট্রালের সামনেই এই বিশাল হাইড পার্ক। ইংল্যান্ডেও নাকি একটা হাইড পার্ক আছে। বেশ সুন্দর পার্ক। বেশ কিছু মূর্তি আছে এখানে সেখানে। একটা সুন্দর ঝরনা আছে পার্কের মাঝখানে। অনেক মানুষ শুয়ে বসে আছে পার্কের ঘাসে, বেঞ্চে। পার্কের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে ম্যাককুয়ারি স্ট্রিট। এই রাস্তা পার্ক থেকে শুরু হয়ে মিশেছে অপেরা হাউজে গিয়ে। কাছেই পার্লামেন্ট হাউজ, ট্রেজারি। হাইড পার্কে সুন্দর একটা মিউজিয়াম আছে। আগে নাকি এটা জেলখানা ছিলো। বিশাল একটা সিনেগগ রাস্তার ওপারেই। এর স্থাপত্য দেখার মতো। ধর্মের সাথে স্থাপত্যের একটা চমৎকার সম্পর্ক আছে। যে কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপত্যই দেখার মতো।



পার্কের কাছেই অ্যানজেক মিউজিয়াম। অ্যানজেক হলো অস্ট্রেলিয়া এন্ড নিউজিল্যান্ড অক্সিলিয়ারি কর্পস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের অনেক মানুষ অংশ নিয়েছিলো। তাদের স্মরণে এই মিনার আর জাদুঘর। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদদের নামও যোগ করা হলো এখানে। দেয়ালে অনেক নাম খোদাই করা, শহীদদের নাম। শহীদ পরিবারের লোকজন এসে এখনো বাতি জ্বালিয়ে ফুল রেখে যায় এখানে।
       
হাইড পার্কে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে পিট ষ্ট্রিটে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। সেখান থেকে সিডনি টাওয়ার পার হয়ে কুইন ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং এ ঢুকলাম। কিছুক্ষণ উইন্ডোসশপিং করে গেলাম চায়না টাউনে। চায়না টাউনের পুরোটাই চায়নিজদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মনে হয় যেন সিডনির ভিতরে ছোট্ট একটা চায়না ভূখণ্ড । তার একটু পরেই প্যাডি মার্কেট। এখানে সব অস্থায়ী দোকানের সমাবেশ। মাছ থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স পর্যন্ত সব কিছু পাওয়া যায় এখান। মেলবোর্নের কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেটের মতো। এখানের দোকানপাট মেলবোর্নের মতো সুন্দর মনে হলো না খুব একটা।



রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা মনোরেল। কাছেই স্টেশন। তিন ডলার ভাড়া লাগে প্রতি ট্রিপের জন্য। সাতটা স্টপ। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকার উপর দিয়ে চলে যায় এই মনোরেল। শহর দেখার বেশ ভালো ব্যবস্থা।  মেলবোর্নে শহর দেখার জন্য সিটি সার্কেল ট্রাম আছে। তার জন্য ভাড়াও লাগে না। সিডনিতে ট্রাম নেই বললেই চলে। একটা মাত্র ট্রাম লাইন আছে, সেটা খুব একটা বেশি এলাকা কভার করতে পারে না।



মনোরেলে একটা চক্কর দিয়ে নামলাম ডার্লিং হারবারে। শহরের পশ্চিম প্রান্তে ওয়াটার ফ্রন্টে অলস সময় কাটানোর চমৎকার জায়গা। প্রচুর রেস্টুরেন্ট। হাত বাড়ালেই সমুদ্র। সিডনি অ্যাকোয়ারিয়াম, মেরিটাইম মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি আর প্যানাসনিক আইম্যাক্স থিয়েটার সব এখানে যেন পর পর সাজানো। আইম্যাক্স থিয়েটারে থ্রি-ডাইমেনশনাল সিনেমা দেখানো হয়। এর পর্দা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়। মেলবোর্নেও আছে এই আইম্যাক্স থিয়েটার। কিন্তু এখনো দেখার সুযোগ হয়নি। আজ এখানে টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম ডকুমেন্টারি দেখার জন্য। 
হলে ঢোকার সময় একটা কালো চশমা দেয়া হলো। ত্রিমাত্রিক ছবি দেখার জন্য এই চশমা চোখে দেয়া দরকার। ডকুমেন্টারির নাম ‘গ্যালাপাগোস'। ছোট্ট একটা দ্বীপের নাম। চার্লস ডারউইন গিয়েছিলেন সেখানে তার জীবদ্দশায়। তারপর আর কেউ নজর দেয়নি এদিকে। সম্প্রতি ডক্টর মিশেল নামে একজন প্রাণিবিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন এই দ্বীপের প্রাণিগুলো নিয়ে। প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণিগুলো দেখতে অনেকটা গিরগিটির মতো। ত্রিমাত্রিক ছবির কল্যাণে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ধরা যাবে এগুলোকে।
ডক্টর মিশেল নামে ছিপছিপে এই তরুণীর সাহস দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। একদম হাতের দূরত্বে বসে ছবি আঁকছেন একশ’ বছর বয়সী বিশাল কচ্ছপের। এক একটার ওজন পাঁচ ছয় মণের কম হবে না। সাগর তলের অনেক রহস্যময় প্রাণির দেখা মিললো পর্দায়।
হলের ভিতর পরিচয় হলো মেডিক্যাল স্টুডেন্ট মোহান্তের  সাথে। সে ইন্ডিয়ান কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের তিন পুরুষের বাস। ভালো লাগলো তার সাথে কথা বলে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সে এসেছে সিডনির বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখতে।


হল থেকে বেরিয়ে দেখি আকাশ আবার মেঘে ছেয়ে গেছে। সিডনির আকাশ ঘন ঘন মুড বদলায়। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট এখানে। প্রতি বছর বিশ লাখ ট্যুরিস্ট আসে সিডনিতে। ইন্টারন্যাশনাল ‘ট্রাভেল আন্ড লেইজার’ ম্যাগাজিনের জরিপে দেখা গেছে ৮৭ ভাগ ট্যুরিস্ট সিডনিকে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে দর্শনীয় শহর মনে করেন।
কাল রাতে সেরাহ বলছিলো সিডনি শহর সম্পর্কে। ম্যাপ দেখে বোঝা যায় না এই শহরটা কত বড়। ক্ষেত্রফলের হিসেবে সিডনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটি। সিডনি শহরের ক্ষেত্রফল ১৫৮০ বর্গকিলোমিটার। লন্ডন শহরের প্রায় সমান। আর নিউইয়র্ক শহরের দ্বিগুণ।  নিউইয়র্ক শহরের ক্ষেত্রফল ৭৮০ বর্গকিলোমিটার। আমস্টার্ডাম শহরের ক্ষেত্রফল মাত্র ১৬৭ বর্গকিলোমিটার আর বিখ্যাত প্যারিসের মাত্র ১০৫ বর্গকিলোমিটার। সে তুলনায় সিডনি জায়ান্ট সিটি।
এই শহরে মাত্র সাড়ে পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ বাস করে। সরকারি হিসাব মতে এখানে সাড়ে চৌদ্দ লাখ বাসা আছে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতি হলো সিডনিতে।  তারপরও দেখা যাচ্ছে টোকিওর একজন বাসিন্দার চেয়ে ছয়গুণ বেশি জায়গা নিয়ে থাকে একজন সিডনিবাসী। সিডনি শহরে যারা থাকে তাদের প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। সিডনি যুবকদের শহর। সিডনি শহরে নাকি ১৮০টি দেশের নাগরিক বাস করে। ১৪০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে তারা। কালচারাল মেলটিং পট এমনিতে বলা হয় না সিডনিকে ।
             
হারবার ব্রিজে উঠার জন্যে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ব্রিজের গোড়ায়। সিঁড়ি আছে এখানে। সিঁড়ি বেয়ে অনেক উপরে ওঠার পর ব্রিজের পায়ে হাঁটার পথ। ডান দিকে তাকালে পুরো সিডনি শহর দেখা যাচ্ছে। সামনে অনেক নিচে অপেরা হাউজ মনে হচ্ছে পানির মাঝে ভেসে আছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে অসংখ্য গাড়ি। একটা ট্রেন এসে থামলো ব্রিজের ওপর স্টেশনে।



সিডনি হারবার ব্রিজ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় (সবচেয়ে লম্বা নয়) স্টিল ব্রিজ। সেরাহর কথা মনে পড়ছে। কাল রাতে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে সে আমাকে এই ব্রিজ সম্পর্কে। ১৯২২ সালে এই ব্রিজ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার দেয়া হয়। ছয়টি কোম্পানি বিশটি দরপত্র জমা দেয়। ১৯২৪ সালের ২৪ মার্চ তারিখে ব্রিটিশ ফার্ম ডোরম্যান লং এন্ড কোম্পানিকে ব্রিজ তৈরির কাজ দেয়া হয়। বাজেট ছিলো ৪২ লাখ ১৭ হাজার ৭২১ পাউন্ড ১১ শিলিং ১০ পেন্স। এই তথ্যগুলো এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
এই ব্রিজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ডক্টর ব্রাডফিল্ড। ডক্টর ব্রাডফিল্ডকে এই ব্রিজের পিতা বলা হয়। ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিজের কাজ শেষ হয়। সেই বছরই মার্চের ১৯ তারিখে ব্রিজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন  ঘোষণা করেন নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার জন লেং। শুরু হয় এক নতুন সভ্যতার।
৫০৩ মিটার লম্বা এবং ৪৯ মিটার চড়া ব্রিজ। আট লাইনে গাড়ি চলে এর ওপর দিয়ে। দুটো ট্রেন লাইন, একটা সাইকেল ট্রাক আর পায়ে হাঁটার ফুটপাত। হেঁটে পার হতে গিয়ে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে ওঠে। অথচ অনেকেই এই ব্রিজের উপরে লোহার সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। রেগুলার এই ব্রিজ ক্লাইম্বিং চলে এখানে। পাঁচ ডলার দিতে হয় এর জন্য। আমার সাহস নেই অত উপরে উঠে ব্রিজ পার হবার। কিন্তু সাহসী মানুষের অভাব নেই। ব্রিজ ক্লাইম্বিং অফিসে ভিড় লেগে আছে।
                  



হারবার ব্রিজকে আদর করে কোট হ্যাঙ্গার নামেও ডাকা হয়। দূর থেকে দেখতে বিশাল একটা কোট হ্যাঙ্গারের মতোই লাগে এটাকে। সমুদ্র সমতল থেকে এই ব্রিজের উচ্চতা ১৩৪ মিটার। প্রায় ষাট লাখ স্ক্রু লাগানো হয়েছে এই ব্রিজে। সব স্ক্রু নাকি হাতেই লাগানো হয়েছে। ৫২ হাজার ৮০০ টন ইস্পাত ঝুলে আছে এই ব্রিজে। ব্রিজ তৈরির পরে প্রথম তিনবার পেইন্ট কোটিং করতে রঙ লেগেছে দু’লাখ বাহাত্তর হাজার লিটার। এই ব্রিজে প্রতিদিনই রং করা হয় কোন না কোন অংশে। সারা বছর ধরে  এ প্রক্রিয়া চলে। ব্রিজের মেন্টেইনেন্সের জন্য এই কাজ খুব জরুরি। ব্রিজের যে সমস্ত অংশে রঙ লাগাতে হয়, সব মিলিয়ে তার মোট ক্ষেত্রফল হিসেব করলে তা ষাটটি বড় বড় স্টেডিয়ামের ক্ষেত্রফলের সমান হবে। সাড়া বছর গড়ে দৈনিক প্রায় দেড় লাখ গাড়ি পার হয় এই ব্রিজের ওপর দিয়ে।
ব্রিজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে গেলাম। এপারে খুব বেশি কিছু নেই। আবাসিক এলাকায় কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে এলাম আবার।



রাত হয়ে যাচ্ছে। কাল চলে যাবো মেলবোর্নে। আজ সারাদিন হেঁটেছি। পা টনটন করছে এখন। ক্ষুধাও লেগেছে খুব। একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। মনে হচ্ছে সিডনি শহরের অনেক কিছুই  দেখা হয়ে গেলো। অনেক কিছুই বাদ রয়ে গেছে যদিও, তবুও মনে হচ্ছে মেলবোর্ন এর চেয়েও সুন্দর। কেন মনে হচ্ছে জানি না, হয়তো আমি মেলবোর্নে থাকি বলেই। হাঁটতে হাঁটতে আবার কিংস ক্রস। আলো ঝলসিত রং মাখা সং সাজা সভ্যতার দেউলেপনা দেখতে দেখতে ঘরে ফেরা। আজ সারা ঘরে আমি একা।

******

আমি মনে করেছিলাম আমার বাস সোয়া দশটায়। সে হিসেবে আটটার দিকে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছাতে গিয়ে টিকেটে চোখ বুলিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ার জোগাড়। সোয়া ন'টায় বাস আমার। তাড়াহুড়ো কাকে বলে আর কত প্রকার! কিংস ক্রস থেকে আরাম করে হেঁটে সেন্ট্রাল আসার সময় আর নেই। রাস্তা পার হয়েই কিংস ক্রস আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশন। কয়েক মিনিট পর পর সিটি সার্কেল ট্রেন। সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছাতে খুব একটা দেরি হলো না। কাল সিটিতে ঘুরে সিডনির রাস্তা ঘাট সব চিনি এরকম একটা ভাব চলে এসেছিলো আমার। কিন্তু এখন ট্রেন থেকে বের হয়ে হাঁটছি তো হাঁটছিই। স্টেশন থেকে বের হবার রাস্তা আর খুঁজে পাই না। একটা সুড়ঙ্গ পথে হাঁটছি আরো অনেকের সাথে। শেষ পর্যন্ত যেখানে বেরোলাম সেখান থেকে সেন্ট্রালের লেজও দেখা যাচ্ছে না। কিলবিল করে মানুষ বেরুচ্ছে মাটির নিচের গর্ত থেকে যেটা দিয়ে একটু আগে আমিও বেরিয়েছি। কোথায় এলাম আমি!
               
হাতে সময় আছে মাত্র পনের মিনিট। এখনো চেক ইন করা, বোর্ডিং পাস নেয়া কিছুই হয়নি। বাসের নিয়ম অনুযায়ী বাস ছাড়ার কমপক্ষে পনের মিনিট আগে রিপোর্ট করার কথা। হেঁটে হেঁটে পথ খুঁজে বের করার সময় হাতে নেই। একটা ট্যাক্সি নিলাম। চায়নিজ ট্যাক্সিওয়ালাকে সেন্ট্রাল স্টেশান যাবো বলার পরে মাথা নেড়ে স্টার্ট দিলো ট্যাক্সিতে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে যখন মোড়টা ঘুরলো আমার নিজেকে একটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করলো। মোড়টা আমি হেঁটে দু’মিনিটেই ঘুরতে পারতাম। আর মোড় ঘুরলেই আমার বাসস্টপ। কিন্তু কোন কিছু ভালো ভাবে না চিনলে এরকম আক্কেল সেলামী তো দিতেই হবে। ট্যাক্সিওয়ালা আমার তাড়া দেখেই ঘোষণা করলো তার কাছে খুচরো ডলার নেই। ফেরত নেবার সময় নেই আমার। ব্যাগটা নিয়ে এক দৌড়ে টিকেট কাউন্টার।
           
আগে ভাগে এসে গেলে দেখা যায় গাড়ি ছাড়তে দেরি হয়। কিন্তু যখন তাড়াহুড়ো হয়, তখন গাড়িও পারলে সময়ের আগে ছেড়ে দেয়। মারফির সূত্র। দেখা গেলো বাসে সব যাত্রী উঠে বসে আছে, যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বাসে উঠে বসার প্রায় সাথে সাথেই ড্রাইভারের স্বাগত ভাষণ শুরু হয়ে গেলো। মেলবোর্নের বর্ণনা দিচ্ছেন, পথে কোথায় কোথায় থামবেন তা বলছেন। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে পেছনে চলে যাচ্ছে সিডনি সিটি, হাইড পার্ক, সিডনি টাওয়ার। যৌক্তিক বিচারে একবিংশ শতাব্দী এখনো না এলেও সবাই একবিংশ শতাব্দীকেই বরণ করে নিয়েছে এই সিডনিতে, শতাব্দীর মোহনায় দাঁড়িয়ে। গতি বাড়ছে বাসের।                       

__________
দ্বিতীয় অধ্যায়  এডেলেইডে সাত দিন
____________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Tuesday, 30 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৮ম পর্ব



কিংস ক্রস ট্যুরিস্ট আর ব্যাকপ্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। দিনের আলো কমার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় নাইট লাইফ। বোঝাই যাচ্ছে কিংস ক্রস সিডনির রেড লাইট এরিয়া। এখানে নাইট লাইফ মানে বড় বেশি উচ্ছৃঙ্খলতা। পলিশের গাড়ি ঘন ঘন টহল দিতে শুরু করেছে। রাস্তার দু’পাশেই অনেকগুলো নাইট ক্লাব। একটু পর অ্যাডাল্ট শপ। লাইভ অ্যাডাল্ট শো চলছে নানা রকম ছোট বড় থিয়েটারে। সংক্ষিপ্ত পোশাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ, শরীর বিক্রি করা এদের পেশা। যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে পার হয়ে এলাম এই এলাকা। সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখের সামনে সাগর। একদম সাগর ঘেঁষে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গার নাম দেখলাম উলুমুলু বে। নামটা বেশ সুন্দর। আরেকটু সামনে যেতেই রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন। সিডনি শহরের বেশ কয়েকটা পার্কের একটা। সেই ১৮১৬ সালে গোড়াপত্তন হয়েছে এই পার্কের। পার্কের মাঝখানে পিরামিড আকৃতির গ্রিন হাউজে আছে হাজার রকমের ট্রপিক্যাল প্ল্যান্ট। বৃষ্টি না হলে পার্কে ওপেন এয়ার সিনেমা দেখানো হয় গ্রীষ্মকালে। পার্কের একপাশ দিয়ে সাইকেল ট্র্যাক আর পায়ে চলার পথ। এই পথ গিয়ে মিশেছে সিডনি অপেরা হাউজে।




অপেরা হাউজের চত্বরে এসে চোখ জুড়িয়ে গেলো। আলো ঝলমলে সিডনি অপেরা হাউজ যে এত সুন্দর তা নিজের চোখে না দেখলে মনে হয় খুব একটা বিশ্বাস করতাম না।
সিডনি শুধুমাত্র এই অপেরা হাউজ নিয়েই গর্ব করে বলতে পারে ‘আমিই অনন্য’। পৃথিবীর সেরা কয়েকটি স্থাপত্যের একটি হলো এই সিডনি অপেরা হাউজ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাগর থেকে জেগে উঠেছে  বিরাট বিরাট ছয়টি সাদা ঝিনুক।
এই অপেরা হাউজ সম্পর্কে পড়েছিলাম একটা ম্যাগাজিনে। সিডনি শহরে কনসার্ট আর অপেরা মঞ্চস্থ করার জন্য ভালো কোন অডিটোরিয়াম ছিলো না। ১৯৪৭ সালে স্যার ইউজিন গুজেনস নিউ সাউথ ওয়েলসের কনজারভেটোরিয়াম অব মিউজিকের ডিরেক্টর হয়ে আসার পর উদ্যোগ নিলেন একটা ভালো কনসার্ট হল তৈরি করার। কিন্তু পরবর্তী সাত বছরেও তিনি তেমন কিছু করতে পারলেন না এ ব্যাপারে। রাজ্যের মান তো আর থাকে না অবস্থা যখন হলো, তখন ১৯৫৪ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস এর প্রিমিয়ার জোসেফ কেহিল একটা কমিটি করে কনসার্ট হল তৈরির ব্যাপারটা এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হলেন।
প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছিল সত্তর লাখ ডলার। এই টাকা সংগ্রহ করার জন্য নানারকম সাহায্য তহবিল করা হলো। কিন্তু সব মিলিয়ে নয় লাখ ডলারের বেশি সংগ্রহ করা গেলো না। তখন অপেরা হাউজের নামে লটারি ছাড়া হলো। হু হু করে বিক্রি হলো লটারি। অনেক বছর ধরে চললো এই লটারি বিক্রি আর উঠে এলো এক কোটি ডলারেরও বেশি। অপেরা হাউজের বাজেটও বেড়ে গেলো সেভাবে।
যেখানে অপেরা হাউজ তৈরি হয়েছে সেই জায়গার নাম ছিলো বেনেলাং পয়েন্ট। বেনেলাং নামে একজন আদিবাসি জন্মেছিলেন এখানে এবং তিনিই ছিলেন প্রথম আদিবাসি যিনি ইংরেজি ভাষাকে নিজের ভাষা করে নিয়েছিলেন।
ডিজাইনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সেরা সেরা স্থপতিরা ২৩৩টি ডিজাইন সাবমিট করলেন। ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হলো। ডেনমার্কের স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোনের ডিজাইন সেরা ডিজাইন মনোনীত হলো। ধারণা করা হয়েছিল পরবর্তী চার বছরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে অপেরা হাউজ। কিন্তু তা হয়নি।
১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হলো। কিন্তু এতই ধীরে ধীরে কাজ চলতে লাগলো যে পরবর্তী চৌদ্দ বছরেও কাজ শেষ হলো না। এর কারণও ছিলো অনেক। নির্মাণ কাজ শুরু করার পর দেখা গেলো স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোন তাঁর ডিজাইন কমপ্লিট করেননি তখনো। ডিজাইন আর কন্সট্রাকশন একই সাথে চলতে লাগলো।
এদিকে সরকারের মনোভাবও ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। প্রথমে বলা হয়েছলো সাড়ে তিন হাজার দর্শক বসতে পারে এরকম একটা বড় অপেরা হল হবে আর একটা বারোশ' লোক বসার মতো ড্রামা হল হবে। সে হিসেবে প্রাথমিক ডিজাইন করা হয়েছিলো। এখন সরকার হাতে বেশি কিছু টাকা পেয়ে মনে করলো দুটোর জায়গায় চারটা থিয়েটার হল করা যেতে পারে। সে হিসেবে ডিজাইন চেঞ্জ করতে গিয়ে জোয়ের্ন উৎজোনের মাথা খারাপ হবার জোগাড়। 
সরকার অবশ্য আবারো তার মনোভাব চেঞ্জ করে চারটার জায়গায় পাঁচটা থিয়েটার বানিয়েছে এই অপেরা হাউজে। জোশের বশে প্রথমে যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছিলো, কাজে হাত দিয়ে দেখা গেলো সেভাবে হাউজ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। পরে ছাদের ডিজাইন বদলে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসতে আরো চার বছর গবেষণা করতে হয়েছে উৎজোনকে। কাজ কিছুদিন এগোয় কিছুদিন বন্ধ থাকে। বাজেটে কুলোয় না, নির্মাণ খরচ বেড়েই চলেছে। সব দোষ গিয়ে পড়েছে স্থপতি উৎজোনের ঘাড়ে। কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে উৎজোনের ওপর।
১৯৬৫ সালের নির্বাচনে এই অপেরা হাউজ নির্মাণ একটা বিরাট ইস্যুতে পরিণত হলো, সরকারই বদলে গেলো। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলো অপেরা হাউজের নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করবে এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
ক্ষমতায় এসেই তারা স্থপতি জোয়ের্ন উৎজোনের বেতন বন্ধ করে দিলো, আর নানারকম দোষ ধরতে লাগলো উৎজোনের ডিজাইনের। একজন শিল্পীর পক্ষে এরকম অপমান সহ্য করা সম্ভব নয়। উৎজোন পদত্যাগ করলেন। এটাই চাইছিলো নতুন সরকার।
১৯৬৬ সালে নির্মাণ কাজের হাল ধরলো অস্ট্রেলিয়ান স্থপতিদের একটি টিম। তারাই কাজ শেষ করলো। ১৯৭৩ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হলো এই অপেরা হাউজ। অস্ট্রেলিয়ান অপেরা গোষ্ঠীর ‘ওয়ার এন্ড পিস’ ছিলো প্রথম অপেরা এই সিডনি অপেরা হাউজের। এর এক মাস পরে অক্টোবরের ২০ তারিখে অপেরা হাউজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রানি এলিজাবেথ।
অপেরা হাউজের প্রশস্থ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। সামনেই হারবার ব্রিজ। ব্রিজের রেলিং এ এখনো জ্বলজ্বল করছে ‘ইটারনিটি’। দু’দিন আগে এখানে লক্ষ মানুষ জড়ো হয়েছিলো, আজ সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা। নীরবতা চারিদিকে। অনেক মানুষ অবাক চোখে দেখছে এই অপূর্ব সৃষ্টি।
প্রায় এক হাজার ছোট বড় রুম আছে এই অপেরা হাউজে। পাঁচটি অডিটোরিয়াম, বিরাট এক রিসেপশান হল, পাঁচটি রিহার্সাল স্টুডিও, চারটি রেস্টুরেন্ট, ছয়টি থিয়েটার বার, ষাটটি গ্রিনরুম। অপেরা হাউজের এরিয়া হলো মোট সাড়ে পাঁচ একর। সাড়ে চার একর জায়গা জুড়ে এই ভবন সমুদ্রতলের চেয়ে ৬৭ মিটার উঁচুতে মাথা তুলে বসে আছে।
কী পরিমাণ লোহা সিমেন্ট লেগেছে এই বিশাল ভবন তৈরিতে তা নিয়ে সাধারণ কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু কেউ যদি জানতে চায় তাহলে খুব সহজেই জানা যায় এখানের অফিস থেকে। পুরো অপেরা হাউজের ওজন এক লাখ একষট্টি  হাজার টন। ৫৮০টি বিশাল বিশাল কংক্রিট পিলার চলে গেছে সমুদ্রের নিচে ৮২ ফুট গভীরে। তার ওপর বসে আছে এই বিশাল আইকন। এই বিল্ডিংএর সব কাঁচ এসেছে ফ্রান্স থেকে। পরিমাণও কম নয়, ৬৭ হাজার বর্গফুট। বৈদ্যুতিক তার যা ব্যবহার করা হয়েছে তা একটার সাথে অন্যটা যোগ করলে দৈর্ঘ্য হবে প্রায় চারশ মাইল। একদিনে এখানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে তা দিয়ে পঁচিশ হাজার লোক বাস করে এমন একটা শহর আলোকিত করা যাবে।
সিঁড়ি বেয়ে একদম উপরের তলায় উঠে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সামনেই সমুদ্র। ঢেউ এসে লাগছে অপেরা হাউজের দেয়ালে। ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকে। অপেরা হাউজের তিনদিকে ঘুরে দেখা যায় নৌকায় বসে। মনে হচ্ছে সিডনি শহর পুরোটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এরকম একটা পরিবেশে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট যেন দূর হয়ে যায়। যে কোন বিশালত্বের এটাই হয়তো বিশেষত্ব। সিডনির সব মানুষ কি সময় পায় এখানে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকার? কোন কিছু না করে শুধু সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার! ইন্ডিয়ান কারি পয়েন্টের ছেলেটা কি কখনো এসেছে এখানে?


আস্তে আস্তে নেমে এলাম। হারবার ব্রিজের ‘ইটারনিটি’ আমাকে টানছে। বাম দিকের পায়ে চলার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ব্রিজের কাছে। যতটা কাছে মনে হয়েছিল আসলে ততটা কাছে নয়। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ হাঁটতে হলো। ব্রিজের কাছে এসে দেখি উঠতে হবে প্রায় একশো ধাপ উপরে। পায়ে শক্তি নেই তত। কাল আবার আসতে হবে ভেবে জর্জ স্ট্রিটে উঠে এলাম।
রাত এখন গভীর। কিন্তু মনে হচ্ছে না এই শহর ঘুমাবে কখনো। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম  কিংস ক্রসে। এখানে এখন আরো ভিড়। ফুটপাতে হাঁটতে গেলে অন্যের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বা অন্যের ধাক্কা খেয়ে হাঁটতে হচ্ছে। উচ্চস্বরে বাজনা বাজছে। তার উপরে মাতাল দেহজীবীদের উপদ্রব আছে। গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করে সঙ্গী লাগবে কিনা। আর সবচেয়ে বেশি আছে ড্রাগ ডিলিং। পুলিশ সব জানে। তারা পয়সা হয়তো খায় না, কিন্তু কঠিন হাতে দমনও করে না। জাস্ট রুটিন টহল দিয়েই খালাস। আর ঘুষ তারা খায় না এটাও বলি কিভাবে। একটা বোঝাপড়া না থাকলে এরকম প্রকাশ্যে ড্রাগের ব্যবসা চলে কীভাবে? কোন রকমে গা বাচিয়ে চলে এলাম আমার হোস্টেলে।
রুম অন্ধকার। বাতি জ্বালালাম। সারাহ ঘুমাচ্ছে। রুমে আর কেউ নেই। আমি জুতো খুলে বাথরুমে ঘুরে এসে আমার দোতলা বিছানায় উঠে বসতেই চোখ খুলল সেরাহ - "হাই!"
সেরাহর চোখ ফোলা ফোলা। অনেকক্ষণ থেকে কি ঘুমাচ্ছে সে? 
জিজ্ঞেস করলাম, "বাইরে যাওনি আর?"
"গিয়েছিলাম, ফিরে এসেছি।"
"বন্ধুরা কোথায়?"
"তারা নাইট ক্লাবে গেছে। সেখানে আমাকে আর দরকার নেই তাদের। তাছাড়া নাইট ক্লাবে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। তুমি কোথায় কোথায় ঘুরলে?"
গল্প করার মুডে আছে সেরাহ। আমারও খারাপ লাগছে না তার সাথে কথা বলতে। এরকম মিষ্টি গলা আমি অনেকদিন শুনিনি। সেরাহ তার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছে। আমি আমার বিছানায়। মুখোমুখি কথা বলছি আমরা। মাঝখানে লোহার বিছানার ছয় ইঞ্চি উচ্চতার রেলিং।
সিডনি শহরের অনেক তথ্য জানে সেরাহ। মনে হচ্ছে কলেজে তার মেজর সাবজেক্ট সিডনির ইতিহাস। কিন্তু না, তার মেজর সাবজেক্ট হলো সাইকোলজি। সিডনি শহর সম্পর্কে অনেক জানা-অজানা তথ্য শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে


শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৭ম পর্ব



হোটেলের ভাড়ার সাথে কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম হোটেলের নিয়ম কানুন লেখা কাগজটা। ব্রেকফাস্ট খেতে চাইলে ন'টার ভিতর যেতে হবে ডাইনিং হলে। পোশাকের ব্যাপারে লেখা আছে অবশ্যই জুতো পরে যেতে হবে। আর কিছু লেখা নেই পোশাক সম্পর্কে। অস্ট্রেলিয়ানরা পোশাকের ব্যাপারে মোটেই খুঁতখুঁতে নয়। এখানে কেন যে জুতোর কথা লিখেছে জানি না। কোন জামাকাপড় ছাড়া শুধুমাত্র পায়ে জুতো গলিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে হাজির হলে কেমন হয়? আইনত কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু সভ্যতার সব নিয়ম তো আর লিখে দিতে হয় না। এখন বাজে সাড়ে আটটা। নটার ভিতরে ডাইনিং রুমে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ছুটির দিনে শুধুমাত্র ফ্রি ব্রেকফাস্ট করার জন্য কেউ এত তাড়াতাড়ি উঠবে না ঘুম থেকে। আসলে উইকডেতে এখানে যারা আসে বেশির ভাগই আসে প্রশাসনিক বা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। তাদের জন্য রেডি ব্রেকফাস্ট খুবই জরুরি।
হোটেল রুমটা বেশ সুন্দর করে সাজানো।  কাল রাতে এত সব চোখে পড়েনি। জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই দিনের আলোয় ভরে গেলো সারাঘর। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ক্যাপিটাল হিল। যেখানে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। বাংলাদেশের হাই কমিশনও সেখানে। অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পার্লামেন্ট দেখতে যেতে হবে সেখানে।
সিডনি ফিরে যাবার বাসের টিকেট করা আছে সাড়ে বারোটায়। হাতে কয়েক ঘন্টা সময় আছে ঘুরে বেড়ানোর। রেডি হয়ে হোটেলের চাবি জমা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। পা রাখলাম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানীতে। চোখের সামনে উড়ছে অস্ট্রেলিয়ান পতাকা। ক্যাপিটাল হিলে পার্লামেন্ট হাউজের উপর থেকে উড়ছে পতপত করে।
ছোট্ট শহর ক্যানবেরা। মাত্র তিন লাখ মানুষের বাস এখানে। দু'হাজার চারশ’ স্কয়ার কিলোমিটারের ছোট্ট টেরিটরি। এ-সি-টি বা অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি। নিউ সাউথ ওয়েলস ষ্টেটের মাঝখানে এই টেরিটরিতে সম্পূর্ণ পরিকল্পিত এই রাজধানী শহর। ক্যানবেরা সিটির চারপাশে একটা কৃত্রিম হ্রদ, নাম লেক বার্লি গ্রিফিন।
অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রফলের সাথে তুলনা করলে ক্যাপিটাল টেরিটরিকে একটা বিন্দুর মতো মনে হবে। উত্তর দক্ষিণে মাত্র ৮৮ কিলোমিটার লম্বা আর পূর্ব পশ্চিমের দূরত্ব মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। এই শহরের প্রায় সবকিছুই পূর্ব পরিকল্পিত। এখানকার প্রত্যেকটি গাছও নাকি পরিকল্পনা মতো লাগানো। এ সিটির শতকরা চল্লিশ ভাগ জায়গা জুড়ে আছে ন্যাশনাল পার্ক। মুরামব্রিজ নদী বয়ে গেছে শহরের দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে। ক্যাপিটাল হিলকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল গড়ে উঠেছে অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে। এলাকার নামও তাই নানারকম ক্রিসেন্ট। ঝলমলে সূর্যের আলোয় এত সবুজ ভরা ক্যানবেরা দেখে বোঝাই যায় না যে এখানের সমস্ত প্রাকৃতিক দৃশ্যকেও মানুষের শাসনে বেড়ে উঠতে হয়েছে।
ক্যানবেরার বয়স এখনো একশ বছরও হয়নি। ১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশন গঠিত  হবার পরে একটা ন্যাশানাল ক্যাপিটাল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সমস্যা হলো কোথায় হবে তা নিয়ে। মেলবোর্ন চায় তাদের ওখানেই হোক, আর সিডনি চায় তাদের শহরেই  হোক ফেডারেল ক্যাপিটাল। শেষ পর্যন্ত ১৯০৮ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মেলবোর্ন বা সিডনি কোথাও না হয়ে এই দুই শহরের মাঝামাঝি কোন জায়গায় হবে রাজধানী শহর।
শহরের ডিজাইন করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিযোগিতায় জিতলো একজন আমেরিকানের ডিজাইন। আমেরিকান স্থপতি ওয়ালটার বার্লি গ্রিফিনের ডিজাইন অনুসারে গড়ে তোলা হয়েছে এই ক্যানবেরা শহর। নতুন শহরের নাম কী হবে তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ১৯২৭ সালে নাম ঠিক করা হয় ‘ক্যানবেরা’। আদিবাসীদের শব্দ ক্যানবেরা যার অর্থ হলো মিটিং প্লেস বা সম্মিলন ক্ষেত্র। 
ক্যানবেরার বেশির ভাগ স্থাপনা তৈরি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৪৬ সালে গড়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি। সেই হিসেবে বেশ নতুন বলা চলে এই শহরটাকে।

পার্লামেন্ট হাউজের সামনে

পার্লামেন্ট হাউজের কাছে এসে অভিভূত হয়ে গেলাম। প্রথমেই চোখ যায় চার পায়ের উপর দাঁড়ানো বিরাট ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের ওপর। জাতীয় পতাকাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেখানো হয় এখানে। তবে এই সম্মান একেক জনের কাছে একেক রকম। জাতীয় পতাকার রঙে এরা অন্তর্বাসও তৈরি করে।
অনেক ট্যুরিস্ট এসে গেছে এর মধ্যেই। দর্শকদের জন্য সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে এই পার্লামেন্ট হাউজ, সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। গেট দিয়ে ঢুকতেই বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি অফিসার দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে ভয় পাবার কথা হলেও তারা কেউ ভয়ানক দর্শক নয়। বেশ হাসি খুশি। সিকিউরিটি অফিসারদের হাসিখুশি দেখলে তাদের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা হয় না। কিন্তু আমার ধারণা নিয়ে তারা কেউ খুব একটা বিচলিত বলে মনে হলো না। হাসি মুখেই ওয়েলকাম জানালো আমাকে।
সিকিউরিটি ইউনিটে একটা মেটাল ডিটেক্টরের ভিতর দিয়ে যেতে হয় সবাইকে আর সাথের সব জিনিসপত্র চালান করে দিতে হয় স্ক্যানারের ভিতর দিয়ে। খুব সহজ যান্ত্রিক ব্যবস্থা। এটাই একমাত্র প্রবেশপথ সাধারণের জন্য। আর কোথাও কোন চেকিং এর ব্যবস্থা নেই। গাইড আছে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই। কিছু জানাতে চাইলে ঝটপট করে বলে দিচ্ছে। ভিতরের প্রত্যেকটা ঘরেই যাওয়া যায়। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো।
এই পার্লামেন্ট হাউজের বয়স মাত্র বারো বছর। ১৯৮৮ সালে তৈরি হয়েছে এই ভবন। ইতালিয়ান স্থপতি রোমালডো জিউরগোলা এই ভবনের ডিজাইন করেছেন। বার্লি গ্রিফিন লেকের ঠিক দক্ষিণ পাড়েই এই পার্লামেন্ট হাউজ। সবুজ পাহাড়ের চূড়োয় বসে আছে এক টুকরো ছবির মতো।
পার্লামেন্ট হাউজের ভিতর অসংখ্য পেইন্টিংস। সবগুলিই অস্ট্রেলিয়ান শিল্পীর আঁকা। সিনেট হল, পার্লামেন্ট হল সব ঘুরে ঘুরে দেখালাম। যখন পার্লামেন্ট অধিবেশন চলে তখনো নাকি দর্শক এসে দেখতে পারে। এদেশের এমপিরা সম্ভবত জনগণকে খুব একটা ভয় পায় না। অথবা জনগণকে খুব বেশি আলাদা মনে করে না। জনগণ যে এদেশের কাউকেই ছেড়ে কথা কয় না।

সিনেট হাউজ

অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের জন্য ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক আর এদেশের সরকারের মেয়াদ তিন বছর। পার্লামেন্ট হাউজের তিন তলায় বিরাট একটা আর্ট গ্যালারিও আছে আর আছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস সম্বলিত ছবির প্রদর্শনী। ইতিহাসকে এরা আড়াল করে না। মনে হয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার মানসিকতাও আছে এই জাতির।
পার্লামেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যায় বার্লি গ্রিফিন লেকের পাড়ে। এই লেক কাটা হয়েছে ১৯৬৩ সালে। মুলুংগুলু নামে একটা নদী ছিলো আগে এখানে। নদীটি মরে যায় প্রবাহ না থাকায়। তখন নগর কর্তৃপক্ষ এই লেক কাটার ব্যবস্থা করে। শহরের স্থপতি বার্লি গ্রিফিনের নামে নামকরণ হলো এই হ্রদের। লেকের চারপাশে বাঁধানো পাড়ে সাইকেল চালানো যায়, স্কেটিং করা যায়। ইচ্ছে করলে হেঁটে পার হওয়া যায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পথ।
হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট নৌকা। ভাড়া করা যায় ঘন্টা হিসেবে। পানিতে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে হলে একটা নৌকায় চড়ে বসলেই হলো। হ্রদের মাঝখানে এক জায়গায় ক্যাপ্টেন কুক মেমোরিয়াল ওয়াটার জেট। এখান থেকে শূন্যে পানি উঠে যাচ্ছে প্রায় দেড়শো মিটার। সূয্যের আলোয় হীরক কুচির মতো ঝরে পড়ছে এই জেটের পানি।
হাতের সময় দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। চলে এলাম বাস টার্মিনালে। সাড়ে বারোটার বাস সাড়ে বারোটাতেই ছাড়লো। এই বাস আসছে মেলবোর্ন থেকে। এখানে যাত্রী নামিয়ে সিডনিগামী যাত্রীদের তুলছে। আমার সিট একদম পেছনের দিকে। আবার চলছি সিডনির দিকে। এবার সিডনি শহরকে দেখতে হবে নিজের মতো করে।
চার ঘন্টা লাগলো সিডনি পৌঁছাতে। পথে একবারও থামেনি বাস। সিডনি শহরে ঢোকার সময় একটু রোদ ছিলো আকাশে। কিন্তু বাস থামতে না থামতেই বৃষ্টি নেমে এলো। প্রথমে এক দুই ফোঁটা, একটু পরেই অঝোর ধারায়। আকাশ আলকাতরা হয়ে আছে। এই বৃষ্টি কখন থামবে জানি না। হোটেল খুঁজতে হবে রাতে থাকার জন্য।
সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে একটা ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল আছে। কিন্তু কোন সিট খালি নেই। আরো কয়েকটা হোটেলে ফোন করে দেখলাম। ছোট বড় সব হোটেলেই ক্রেডিট কার্ড চায়। আমার কোন ক্রেডিট কার্ড নেই। সুতরাং আমার কোন আইডেন্টিটি নেই বড় হোটেলে থাকার জন্য। উঠতে হবে ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলে।
কিংস ক্রস অ্যারিয়া হলো ব্যাকপ্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। অনেকগুলো ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেল আছে এখানে। বিছানা থেকে শুরু করে সব কিছু প্যাক করে পিঠে নিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের জন্য কম খরচে থাকার ব্যবস্থা থাকে বলেই তা ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেল। বৃষ্টি ধরে এসেছে একটু। কয়েক ফোঁটা যা ঝরছে এখনো, তাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না। রেইনকোটটা গায়ে চড়িয়ে পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটতে লাগলাম কিংস ক্রসের উদ্দেশ্যে।
সিডনি সিটি ম্যাপ ফলো করতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না।  আকাশ মেঘলা হলেও আলোর অভাব নেই কোথাও। রাস্তার আনাচে-কানাচে আলো। পার্কের মাঝখানে পায়ে চলার পথে আলো। আক্ষরিক অর্থেই আলোয় ভুবন ভরা। কিংস ক্রস এলাকায় এসেই বুঝতে পারলাম কত ব্যস্ত আর মনোহারি এলাকা এটা। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে আবার। কিন্তু ফুটপাতে শেড দেয়া আছে।
রাস্তার ধারেই একটা ব্যাকপ্যাকার্স চোখে পড়লো। দোতলায় রিসেপশান। ম্যানেজার ইন্ডিয়ান, নাম ভিক্টর। আমি জায়গা পেলাম ওয়ান সি রুমে। ছয়জনের একটা রুমে একটা সিট খালি আছে। চাবি নিয়ে রুমে ঢুকলাম। ছয়জনের জন্য তিনটা দোতলা বিছানা। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডে কিছু ঢালাও বিছানার হোটেল আছে। সারি সারি বিছানা পাতা। ঘুমানোর জন্য বিছানা ভাড়া দেয়া হয়, রুম নয়। এখানেও সেরকম। ছয়জনের জন্য একটা বাথরুম, ঘরের ভিতরেই আছে। ফলে রুম থেকে বেরোবার দরকার নেই। টেলিভিশন ফ্রিজ সবকিছু আছে। এত কম ভাড়ায় এর চেয়ে বেশি আশা করা উচিত নয়। তাছাড়া বেড়ানো যেখানে মূল উদ্দেশ্য সেখানে হোটেলে বসে তো কেউ সময় কাটাবে না। সামর্থ্য না থাকলে কত ধরনের যুক্তিই দেখানো যায়। আমার বেশ থ্রিলিং লাগছে।
রুমের ভিতর এই বিকেলবেলায় চার বিছানায় চার জন ঘুমাচ্ছে। তিনটে দোতলা বিছানায় একটার উপরের একটা আর অন্যটার নিচের একটা বিছানা খালি আছে। কিন্তু নিচের খালি বিছানায় একটা জ্যাকেট মেলে দেয়া, আর ওপরেরটায় দুটো বই রাখা। এই দুটোর মধ্যে ঠিক কোন বিছানাটা খালি বুঝতে পারছি না। বামদিকের দেয়াল ঘেঁষে লম্বালম্বি লাগানো দুটো বিছানার একটার দোতলায় ঘুমাচ্ছে একটা মেয়ে। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি এ সময় মেয়েটি চোখ খুলে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো, "হাই"।

"হাই, ডু ইউ নো, হুইচ সিট ইজ ভ্যাকেন্ট হিয়ার?"
"দিস ওয়ান। প্লিস টেক দিস ওয়ান।" বলেই সে উঠে বসলো বিছানার ওপর। হাত বাড়িয়ে অন্য বিছানার উপর থেকে বই দুটো টেনে নিলো নিজের বিছানায়। মেয়েটার গলার স্বর অদ্ভুত মিষ্টি।

ছেলে আর মেয়ে একই রুমে থাকাটা এদেশে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমি ধীরে সুস্থে আমার লকার গুছালাম। লকারের লক ছিলো না, ম্যানেজারের কাছ থেকে তালা চেয়ে নিয়ে এলাম। তালার জন্য আলাদা দশ ডলার জমা দিতে হলো। যাবার সময় তালা ফেরত দিলে টাকা ফেরত দেবে।
লকারে ব্যাগটা রেখে সিডনি সিটির ম্যাপ নিয়ে উঠে এলাম আমার দোতলা বিছানায়। মেয়েটি দেয়ালের দিকে পা দিয়ে শুয়ে আছে। এখন আমি যদি অন্য দেয়ালের দিকে মাথা দিয়ে শুই তাহলে তার মাথায় আমার পা লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আপাতত তার মাথার দিকেই আমাকে মাথা দিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ট্রেনের বাংকে শুয়ে আছি। কয়েক মিনিট পরেই মেয়েটি আলাপ শুরু করলো।

"হাই, আয়াম সেরাহ।"
সেরাহ নামটা খুব প্রচলিত একটা নাম এখানে। বোধহয় প্রতি দশ-বিশজন মেয়ের মধ্যে একজনের নাম সেরাহ। আমরা যাকে সারা বা সারাহ উচ্চারণ করি তাই হয়ে গেছে সেরাহ। আমি আমার নাম বললাম। সে তা উচ্চারণ করার চেষ্টা করলো। এরা ‘দ’ উচ্চারণ করতে পারে না। প্রদীপ হয়ে যায় প্রাডিব।
জানা গেলো সারাহ সিডনির মেয়ে। এখানেই থাকে, পড়ে কোন একটা কলেজে। যে ছেলেরা ঘুমাচ্ছে তারা সব তার বন্ধু। ব্রিসবেন থেকে এসেছে তারা। সারাহ তাদের সিডনি শহর দেখাচ্ছে।
আমি আর দেরি করলাম না। পরে দেখা হবে বলে ছাতা আর রেইনকোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঘরে বসে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
রাস্তায় বেরিয়ে বুঝতে পারলাম ক্ষুধা লেগেছে। ম্যাকডোনাল্ডস খাব কিনা ভাবছি - চোখে পড়লো ‘ইন্ডিয়ান ক্যারি পয়েন্ট’ ঠিক রাস্তার ওপারেই।
ইন্ডিয়ান টেকওয়ে প্লেস যেরকম হয়ে থাকে সেরকম। খুব ছোট ছোট দোকান। মাত্র তিনটা টেবিল আর গোটা দশেক চেয়ার পাতা আছে। টেবিলের ওপর ময়লার আস্তরণ। কাউন্টারে তরকারি যেগুলো রাখা আছে সব আমার পরিচিত। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করতে করতে আমি মোটামুটি বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি এ ব্যাপারে।
ভাত আর একটা তরকারি নিয়ে খেতে বসলাম। প্লেটেও মনে হচ্ছে ময়লা লেগে আছে। মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করেছে। ভাবছি যাবার সময় এই বিষয়ে কথা বলবো। হঠাৎ কাউন্টারে ছেলেটাকে টেলিফোনে বাংলায় কথা বলতে শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কথায় ঢাকাইয়া আঞ্চলিক টান। বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে খারাপ হয়ে যাওয়া মেজাজ আবার ভালো হয়ে গেলো। টেবিলের ময়লাকেও আর অসহ্য মনে হচ্ছে না । খুব বাজে স্বাদের রোগেনজোশকেও খুব একটা খারাপ লাগছে না।
পয়সা দেবার সময় জানতে চাইলাম, "ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনি কি বাংলাদেশি?"
"হুঁ" - গলার ভেতর ছোট্ট একটা শব্দ করলো ছেলেটা। মনে হচ্ছে  আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় সে খুব একটা। আমার বাংলা কথা শুনেও তার মুখে হাসি ফুটলো না। আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার নাম বললাম। সে হ্যান্ডশেক করা বা তার নাম বলা - কোনটাই করলো না। তার চোখে-মুখে বিরক্তি।
আমি জানতে চাইলাম, "দোকানের মালিক কি ইন্ডিয়ান?"                                                               
        "না, বাংলাদেশি"
"তবে দোকানের নাম ইন্ডিয়ান কেন? বাংলাদেশি দোকান বললে বুঝি চলে না?"
আমার কথা শুনে ছেলেটা এত রেগে যাবে বুঝতে পারিনি। বেশ রাগী রাগী কন্ঠে বললো, "খাবারগুলো সব যে ইন্ডিয়ান তা চোখে দেখেন না?"
 
ইন্ডিয়ান তরকারি সম্পর্কে সে আমাকে যা বলতে চাচ্ছে তাতে আমার সন্দেহ হচ্ছে সে আদৌ কিছু জানে কিনা। তার কথা বলার ভঙ্গিতে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। আমার সঙ্গে বাংলাদেশি মানুষের এরকম বিতৃষ্ণ ব্যবহার এই বিদেশে আশা করিনি।
মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, কোন রকমে সামলে নিলাম। কী দরকার! ছেলেটা হয়তো বড় কষ্টে আছে এখানে। হয়তো অবৈধভাবে আছে। কাজ করে যা পায় সব যায় উকিলের পেটে। শুনেছি এই সিডনি শহরে অনেক ছেলে অবৈধভাবে এক রুমে দশ-বারোজন গাদাগাদি করে থাকে। ঘন্টায় দু’তিন ডলার মজুরিতে কাজ করতে হয় রেস্টুরেন্টের কিচেনে বা গ্রোসারির গুদামে। বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নেই বলে কম মজুরির জন্য কোথাও নালিশও করতে পারছে না। দেশেও চলে যেতে পারছে না। কী দরকার তার সাথে রাগারাগি করার। নিজের দেশের একজন মানুষ পেয়েও ভালভাবে কথা বলতে না পারাতে একটু কষ্ট লাগছে বৈকি।
___________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Monday, 29 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৬ষ্ঠ পর্ব



নতুন বছরের প্রথম দিনের সূর্যালোক জানালায় আসার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙেছে। স্বপনদারা ফিরেছেন একটু আগে। গতকাল সারাদিন, সারারাতের ক্লান্তির পরে এখন তাঁদের দরকার একটা দীর্ঘ নিরুপদ্রব ঘুম। আমি যথাসম্ভব নীরবে সকালের কাজ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি। আমাকে যেতে হবে। দাদা বৌদিকে কিছু না বলে বেরোই কীভাবে? আবার এসময়ে ঘুম থেকে তাঁদের জাগাতে ইচ্ছে করছে না একটুও। তাঁদের উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে ঘরের অটোম্যাটিক লক অন করে বেরিয়ে গেলাম। মিনিট খানেক পরেই চেপে বসেছি সিডিনিগামী ট্রেনে। পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে নামলাম সিডিনি সেন্ট্রাল স্টেশনে।

নিউ ইয়ার্স ডে উপলক্ষে শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ আজ। স্টেশনেও খুব একটা ভিড় নেই। আমার ক্যানবেরার বাস সোয়া দশটায়। হাতে এখনো ঘন্টাখানেক সময় আছে। এ শহরের রাস্তায় রাস্তায় নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে আছে। কাল ক্যানবেরা থেকে ফিরে এসে তা করা যাবে।

সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের বিল্ডি-এর মধ্যেই গ্রেহাউন্ড বাস কাউন্টার। চেক ইন করে বোর্ডিং পাস নেবার পরও দেখি হাতে আরো কিছু সময় আছে। স্টেশন চত্বরে হাঁটতে লাগলাম। রোদে ঝলমল করছে চারদিক। স্টেশনের যাত্রীদের বেশির ভাগই  ট্যুরিস্ট। 

এই সেন্ট্রাল স্টেশনের ২৬ আর ২৭ নম্বর প্লাটফরমকে বলা হয় ভুতুড়ে প্লাটফরম। তার কারণ হলো ১৯৭৯ সালে এই প্লাটফরম দুটো তৈরি হবার পর থেকে একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। এ দুটো প্লাটফরম থেকে কোন ট্রেন ছাড়ে না বা কোন ট্রেন থামেও না এ দুটো প্লাটফরমে।    একজন দু'জন করে যাত্রী এসে জমা হতে শুরু করেছে ক্যানবেরাগামী বাসের কাছে। সোয়া দশটার বাস ছাড়লো প্রায় দশ মিনিট দেরিতে। ছুটির দিন। কারো কোন তাড়া নেই। সবার মুখ হাসি হাসি। অস্ট্রেলিয়ার মানুষ গায়ে পড়ে আলাপ জমায় অনেক সময়। ভালোই লাগে তাদের দিলখোলা ভাব। অষ্টাদশী ক্যারেনের সাথে আলাপ হলো। সে ক্যানবেরার মেয়ে। সিডনিতে এসেছিল কোন কাজে, এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ক্যাবেরার ঠিক কোথায় বাড়ি তা তো আর সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না, আর সে বললেও আমি চিনবো না। ঊর্মিরা থাকে নারাবুন্ধায়। ক্যারেনের কাছে জানতে চাইলাম নারাবুন্ধা কীভাবে যেতে হয়। সে বললো ক্যানবেরা গিয়ে দেখিয়ে দেবে।

হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে আমাদের বাস। একটা সিনেমা দেখানো হচ্ছে বাসের টেলিভিশনে। রাস্তার দু’পাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে ঘন গাছপালা, বেশির ভাগই ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। অস্ট্রেলিয়ান গরু চরছে। এদিকে সম্ভবত প্রচুর ডেইরি ফার্ম আছে। সিডনি থেকে ক্যানবেরার সড়ক দূরত্ব সাড়ে তিনশ কিলোমিটারের মতো। বিরাট চওড়া হাইওয়ে। ওয়ান ওয়ে হওয়াতে অন্যদিক থেকে আসা গাড়ির সাথে তাদের দেখা হচ্ছে না। বাইরের ঝকঝকে নীল আকাশ আর দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর দেখতে দেখতে এক সময় ক্লান্তিই চলে আসে। সুন্দরের সরবরাহ বেশি হয়ে গেলে সুন্দরও মনোটোনাস হয়ে পড়ে।
ক্যারেনের দিকে চোখ গেলো। সে সিটে পা তুলে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। দিনের বেলায় ঘুমানোটা এদেশের সংস্কৃতির সাথে ঠিক মেলে না। কিন্তু বাসে ট্রেনেতো অনেককেই ঘুমাতে দেখি।

বাসের গতি ক্রমশ কমে আসছে। অনেক রকম বিল্ডিং আর সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে। মনে হচ্ছে ক্যানবেরা পৌঁছে গেছি। ক্যারেন চোখ খুলে বাইরে তাকিয়ে বললো, "আমরা এসে গেছি"।
সোয়া দুটোয় গাড়ি থামলো ক্যানবেরা সেন্ট্রাল স্টেশনে। এদেশের সব সিটিতে একটা করে সেন্ট্রাল স্টেশন থাকে মনে হয়। বেশ সুন্দর লাগল ক্যানবেরা সেন্ট্রাল। এখানে শুধু বাস থামে। ক্যানবেরায় ট্রেন আছে কিনা আমি জানি না। ক্যারেনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও জানে না। ট্যুরিস্টদের জন্য ইনফরমেশন সেন্টার আজ বন্ধ।  তবে বিভিন্ন হোটেলের টেলিফোন নম্বর আর ছবিসহ বিরাট বিলবোর্ড  দেখা যাচ্ছে। বিলবোর্ডে লাগানো নম্বরে ডায়াল করলে বিনামূল্যে হোটেলের রিসেপশনে কথা বলা যায়। বুকিং করার পর হোটেলের লোক এসে নিয়ে যাবে এখান থেকে। ব্যবস্থাটা খুব ভাল লাগলো।
আমি আপাতত হোটেলে যাচ্ছি না। আগে ঊর্মিদের ওখান থেকে ঘুরে আসি। রায়হানকে ফোন করলাম। তারা বসে আছে আমার জন্য। এখন হোটেলে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ক্যারেন অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমাকে সিটি বাসে তুলে দেবে। ক্যানবেরার সবাই এরকম পরোপকারী কিনা জানি না।

ক্যারেন একটা ম্যাপ নিয়ে এলো কোত্থেকে। বাসের রুট আর সময় দেয়া আছে সেখানে। মার্কেট টার্কেট সব বন্ধ আজ। ক্যারেন আমাকে নিয়ে কয়েকটি রাস্তায় হাঁটলো, যদি কোন দোকানপাট খোলা থাকে। আমি ঊর্মির জন্য কিছু কিনতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু একটা দোকানও খোলা পেলাম না। ক্যারেন খুঁজছে সিগারেট। আমি সিগারেট খাই না জেনে একটু লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গিতে হাসলো। কিন্তু তার নাকি সিগারেটের তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। দোকান খোলা না পাওয়াতে এবার সে একজন পথচারীকে থামিয়ে একটা সিগারেট চেয়ে নিলো। ভিক্ষা চাইতে লজ্জা লাগলেও সিগারেট চাইতে সম্ভবত লজ্জা লাগে না। নেশার কাছে মানুষের অনেক বোধেরই মৃত্যু ঘটে।
আমাকে ধরতে হবে ৩৫ নম্বর বাস। নারাবুন্ধায় যায় এই বাস। ঊর্মি আর রায়হান থাকে সেখানে। ক্যারেন যাবে ঠিক উল্টো দিকে। তার বাস আমার বাসের আগে। সে বারবার জিজ্ঞাসা করছে আমি যেতে পারবো কিনা। ভালো লাগলো তার আন্তরিকতায়। তার সাথে আমার হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না। কিন্তু হু কেয়ারস ফর দ্যাট? মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারটা হয়তো ক্যারনের সহজাত একটা গুণ। তার সাবলীলতায় আমি মুগ্ধ। হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল সে। আমি ৩৫ নাম্বার বাসে চড়ে বসলাম।
বাসে আমিসহ মাত্র চারজন যাত্রী। সবাই বৃদ্ধ। ড্রাইভারও বেশ বয়স্ক। ক্যানবেরাতে বৃদ্ধদের সংখ্যা বেশি বলে শুনেছি। তরুণরা এইরকম একটা ছোট চুপচাপ এলাকায় থাকতে চায় না হয়তো।
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী এই ক্যানবেরা। কিন্তু রাজধানী বলতে যেরকম একটা ব্যস্ত বাণিজ্যিক শহরের কথা মনে হয়, এটা সেরকম নয়। শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাজের জন্য প্ল্যান করে এই শহর গড়ে তোলা হয়েছে। ক্যানবেরাই নাকি পৃথিবীর একমাত্র সিটি যেটা আগে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তারপর নগরায়ন হয়েছে। সাধারণত হয়ে থাকে উল্টো। কোন ভাবে বসতি গড়ে ওঠে কোথাও তারপর পরিকল্পনা করা হয় কীভাবে তার উন্নয়ন করা যায়।
      
বাসের জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি আমি। কোথাও কোন জনমানুষ চোখে পড়ছে  না। মনে হচ্ছে রূপকথার কোন ঘুমন্ত শহরে এসে পৌঁছেছি। বিরাট বিরাট রাস্তা । সব গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এ যেন সেই ‘গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়’। বাসের ভিতরে যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখি চারজনেই তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই একজন বললেন "হ্যাপি নিউ ইয়ার মাইট"।
আজ নিউ ইয়ার্স ডে এটা এখানে কীভাবে সেলিব্রেট করেছে আমি জানি না।

"হোয়ার ইউ গোয়িং?"
আমি কোথায় যাবো? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন এরা। বাসের টিকেট করার সময় কোথায় যাবো একবার বলেছি। তখন হয়তো খেয়াল করেননি কেউ। কারণ এখানে সিটি বাসের ভাড়া যেখানেই যাও, সমান। দুই ডলার প্রতি ট্রিপ।
বাসের ড্রাইভার আর যাত্রীরা প্রতিযোগিতা করে সাহায্য করলেন আমাকে। ৪৭ নম্বর বাড়ির সামনে কোন স্টপেজ নেই। কিন্তু ড্রাইভার সেখানেই গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, আমি যে ঠিক জায়গায় নেমেছি তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন।  আমাকে দেখে রায়হান ছুটে আসার পরে বাস ড্রাইভার হাত নেড়ে চলে গেলেন তাঁর গন্তব্যে। ভালো লাগলো খুব। মনে হল নিয়ম যে মানুষের জন্য তৈরি তা এরা খুব ভালোভাবে জানেন। আসলে নিয়মের চেয়ে মানুষের সংখ্যা কম হলে এই রকম বদান্যতা দেখানো সব দেশে সম্ভব।
রায়হানকে আমি আগে কখনো দেখিনি। ঊর্মির যখন বিয়ে হয়, তখন আমি দেশের বাইরে। রায়হান আমাকে দেখে দৌঁড়ে রাস্তায় চলে এসেছে। লুঙ্গি আর টিশার্ট পরা মোটা পাওয়ারের চশমা চোখে রায়হানকে দেখেই ভালো লেগে গেলো আমার। কত দিন পরে ঊর্মিকে দেখলাম। ঊর্মি আমার দিদির ননদের মেয়ে। খুব শুকিয়ে গেছে মেয়েটা।
ছোট্ট ছিমছাম বাসা। ঢুকতেই রান্নাঘর, তারপর বসার ঘর আর শোবার ঘর। সবকিছু চমৎকারভাবে গোছানো। রান্না হিটিং সবকিছু ইলেকট্রিক এখানে। গ্যাস থাকলে ভালো হতো। এদেশে ইলেকট্রিসিটির দাম গ্যাসের চেয়ে বেশি।
ক্যানবেরার বড় সমস্যা হলো এখানে বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না সহজে। কারণ ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়ি এখানে খুব একটা বানায় না কেউ। বৃদ্ধ আর চাকরিজীবীরাই মূল বাসিন্দা ক্যানবেরার। এখন অবশ্য ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু ঘর তৈরি হচ্ছে। রায়হানের বাড়িওয়ালা নিজের থাকার ঘর থেকে একটা অংশ ভাড়া দিয়েছে এদের। এর চেয়ে বড় বাসা লাগে না আসলে এখানে। দু'জনের সংসার। রায়হান কাজ করে উলওয়ার্থে। ঊর্মি ভর্তি হয়েছে ক্যানবেরা ইউনিভার্সিটিতে। সুখে আছে তারা। দেখে খুব ভালো লাগলো আমার।
           
পোলাও, মাংস, মাছ ইত্যাদি হরেক রকম আয়োজন করে রেখেছে তারা। খেতে খেতে গল্প আর গল্প করতে করতে খাওয়া হলো। দেশের গল্প। দেশের মানুষের গল্প। এখানকার বাঙালিদের গল্প, রায়হানের বন্ধুদের গল্প, ক্যানবেরার চাকরির বাজার আর বাংলাদেশের রাজনীতি সবকিছু নিয়ে প্রাণ খুলে আড্ডা মারলাম অনেকক্ষণ। রায়হানের সাথে গল্প করে বেশ মজা পাওয়া যায়। ছেলেটা মামাশ্বশুর বলে আমার সাথে কোন সংকোচজনক দুরত্ব রাখছে না এজন্যই তাকে এত ভালো লাগছে।
            
সন্ধ্যার দিকে বেরোলাম একটু। ঘুরে বেড়ানোর জন্য। রায়হান সাথে আসতে চাইলো। কিন্তু ঊর্মিকে বাসায় একা রেখে বেরোতে মানা করলাম। এমনিতেই তো তাকে অনেকটা সময় একা কাটাতে হয়। আজ ছুটির দিনেও সেটা করা উচিত হবে না। তাছাড়া একটু একা ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করলো। নতুন জায়গা দেখার জন্য একা ঘুরে বেড়ানো খুব ভালো মনে হয় আমার।
              
ক্যানবেরার রাস্তাগুলো বিশাল। সে তুলনায় ফুটপাত খুব ছোট। রাস্তা আর ফুটপাতের মাঝে বেশ চওড়া, রাস্তার চেয়েও প্রশস্ত জায়গা। সেখানে গাছ আর ঘাসে ভর্তি। স্ট্রিট লাইট খুব কম। যে কয়টা লাইট আছে সেখান থেকে আলো যা আসে তাও খুব টিমটিমে। এখানে বোধ হয় সন্ধ্যার পরে কেউ হাঁটতে বেরোয় না। আমি ছাড়া আর কোন ব্যক্তির দেখা পেলাম না রাস্তায়। হেঁটে হেঁটে ক্লে ক্রিসেন্ট থেকে মানুকা সেন্টার পর্যন্ত আসার পথে আর একটা মানুষও দেখলাম না। ছুটির দিন বলেই হয়তো।
মানুকা সেন্টারে বেশ কিছু দোকানপাট, ব্যাংক আর সুপার মার্কেট আছে। এখান থেকে একটা ট্যাক্সি নিলাম। ট্যাক্সিওয়ালা ভিয়েতনামি। এগারো বছর ধরে নাকি আছে এই ক্যানবেরায়। কথা শুনে মনে হলো সে ক্যানবেরার প্রেমে পড়ে গেছে। ক্যানবেরার সব কিছুই ভালো তার কাছে। এখানে ট্যাক্সির সংখ্যা খুব বেশি না হওয়াতে খুব একটা প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে না তাকে। সে আমাকে নিয়ে চললো ম্যাককোয়ারি হোটেলে।
   
বেশ বড় হোটেল এই ম্যাককোয়ারি। রুম পেতে কোন অসুবিধা হলো না। চাবি নিয়ে একই ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম মানুকা সেন্টারে। আমি ট্যাক্সি ছাড়তে চাইলেও সে আমাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। সে বলছে ফেরার পথে আমি রাস্তা ভুল করতে পারি। সে তখন দেখা যাবে। একটু আগে আমি হেঁটে এসেছি এই পথে। ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় ট্রিপস দেওয়ার প্রথা চালু নেই। কিন্তু আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বেশ ভালোই ট্রিপস দিলাম।  উলওয়ার্থে ঢুকলাম। এই চেইন সুপার মার্কেটের নাম সব জায়গায় উলওয়ার্থ, কিন্তু মেলবোর্নে সেফওয়ে। আমি জানি না কেন।  উলওয়ার্থ সাহেবের এই ব্যবসা পৃথিবী বিখ্যাত। ভিতরে ঢুকে স্বাভাবিক ভাবেই  তুলনা এসে যাচ্ছে মেলবোর্নের সাথে। দেখলাম মেলবোর্নের তুলনায় এখানে জিনিস পত্রের দাম অনেক বেশি। একই কোম্পানির জিনিস একেক জায়গায় একেক দাম। দ্রব্যমূল্য কীভাবে নির্ধারিত হয় আমি জানি না।
সুপার মার্কেট থেকে বেরিয়ে দেখলাম রাস্তার রাউন্ড এবাউট থেকে দুই-তিনটি রাস্তা চলে গেছে ভিন্ন ভিন্ন দিকে। এর কোনটা ধরে এসেছিলাম আমার আর মনে নেই। ট্যাক্সিওয়ালার কথা মনে হলো। রাস্তা ভুল করতে পারি! পকেটে ম্যাপ আছে। খুলে বের দেখলাম আর খুব নিশ্চিত হয়ে পথ ঠিক করলাম। এবার মিনিট দশেক হাঁটলেই পৌছে যাব ঊর্মিদের বাসায়। কিন্তু না, পথ শেষ হচ্ছে না। আমি কি বাড়ির নম্বর ভুল করছি? সবগুলো বাড়িই একই রকম দেখতে। আসার সময় দিনের আলো কিছুটা অবশিষ্ট ছিলো। এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের আলোয় যেটুকু বৈষম্য দেখা যেতো বিভিন্ন বাড়ির মধ্যে এখন তা আর চোখে পড়ছে না। কোন রাস্তায় আছি তা বোঝার কোন উপায় নেই। রাস্তায় কোন লাইট নেই। লোক নেই। বাস বন্ধ হয়ে গেছে ছ’টার সময়। পকেটের ম্যাপতো নিজে নিজে কথা কইবে না। ম্যাপ খুলে যে দেখবো, আলো নেই কোথাও। মানুষের বাসার সামনে লাগানো বাতির আলোয় গিয়ে ম্যাপ দেখেও কিছু বোঝার উপায় নেই। রাস্তায় নির্দেশক সাইনগুলো এতো দূরে যে তা পড়া যায় না কোনটা কোন স্ট্রিট।
শহরটার পরিকল্পনাকারীদের কেউই আমার মতো ট্যুরিষ্টদের কথা ভাবেননি তাতে আমি নিঃসন্দেহ হলাম। মনে হচ্ছে আমি এক ভুতুড়ে শহরের গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছি। প্রায় দুঘন্টা হাঁটার পরে মনে হলো যথেষ্ট হয়েছে। এবার ট্যাক্সি ডাকা দরকার। ডাকবো যে টেলিফোন বুথ কোথায়? আশে পাশে থাকার কথা। প্রতি রাস্তাতেই থাকার কথা। কিন্তু সব কথা সম্ভবত ক্যানবেরার জন্য খাটে না। চোখেই পড়ছে না টেলিফোন বুথ। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর মেইন স্ট্রিটে এসে একটা মার্কেট টাইপের চোখে পড়লো। কিন্তু তা বন্ধ। একটা টেলেস্ট্রা ফোনবুথ চোখে পড়লো। ট্যক্সিকে ফোন করলাম। একটা কলের জন্য চল্লিশ সেন্ট লাগার কথা। আমি দুই ডলারের কয়েন দিয়েছি টেলিফোন কয়েন স্লটে। এক ডলার ষাট সেন্ট ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু কয়েন রিটার্ন স্লটে কোন শব্দ নেই। বার কয়েক ঝাঁকুনি খেয়েও নির্বিকার টেলিফোন বক্স। কোন কোন মেশিন পয়সা ফেরত দেয় না, সেটা কিন্তু লেখা থাকে। এখানে সেরকম কিছু লেখাও নেই। ব্যাথা লাগা আঙুলেই ব্যাথা লাগে বার বার। সেরকম হচ্ছে এখানে। অবশেষে ট্যাক্সি এলো। ঊর্মিদের বাসায় আসতে ট্যাক্সিতেই লাগলো পুরো বিশ মিনিট। আমি যে শহরের কোন প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। রায়হান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করছিলো আমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলাম! তাকে তো আর বলা যায় না যে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম!
রাতের খাবার খেলাম বারোটার দিকে। ঊর্মিদের দৈনন্দিন রুটিন অনেকটা এরকম। রায়হানের রাতের শিফটে কাজ থাকে বারোটা থেকে তিনটা। সে ফিরে এলে তাদের রাত হয়। সে হিসেবে সকাল হয় দশটা এগারোটার দিকে। এদেশে ভালোভাবে থাকার জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। আগে অভ্যাস কারো থাকে না এরকম কষ্ট করার। কিন্তু আস্তে আস্তে সিস্টেমের সাথে এডজাস্ট হয়ে যায়।
আমি হোটেলে চলে যাবো শুনেই মন খারাপ করে ফেললো ঊর্মি আর রায়হান। বিদেশে এতোদিন থাকার পরেও এরা একটুও প্র্যাকটিক্যাল হয়নি এখনো। আমি কাল দুপুরে চলে যাবো। আজ তাদের দেখে গেলাম। কাল সকালে ক্যানবেরা ঘুরবো নিজের মতো করে। কিন্তু তারা কিছুই বুঝতে চাচ্ছে না। ঊর্মিটা বরাবরই খুব চাপা। নিজের কষ্টের কথা সে কাউকেই বলে না। এখন তার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি আমি তাদের বাসায় রাতে থাকছি না এটা সে মেনে নিতে পারছে না। তার মামা তার শহরে এসে হোটেলে থাকবে এটা তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তাকে বলি আমার নিজের অসুবিধার কথা, আবার এক সময় এসে বেড়িয়ে যাবার কথা।
রায়হান ফোন করে ট্যাক্সি ডেকে দেয়। আমার খুব কষ্ট হয় তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। কষ্ট তাড়াতে আলাপ জমাই ট্যাক্সিওয়ালার সাথে। দশ মিনিটেই আমাকে পৌঁছে দেয় লেবানিজ ট্যাক্সিওয়ালা।
           
হোটেলের বামদিকে ‘এ’ ব্লকে আমার ঘর। গেটের চাবি আর রুমের চাবি আলাদা। আমার রুম একদম ভিতরের দিকে। রুমে ঢুকে বিছানায় ছুঁড়ে দিলাম নিজেকে। মনে হচ্ছিলো শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়বো। কিন্তু হলো উল্টো। বিছানায় আরামে শুলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুম পালালো। দিনের বেলায় খুব গরম লাগলেও এখন বেশ ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড শীত পড়ছে। ক্যানবেরায় শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাসে চলে যায়। এখন প্রচণ্ড গ্রীষ্মকালেও দেখি শীতকালের ঠাণ্ডা। পাশের রুম থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। হাসির সাথে সাথে প্রচণ্ড দাপাদাপি। হয়তো নিউ ইয়ার্স সেলিব্রেশান চলছে। আমার মন ঘুরে ফিরে চলে যাচ্ছে আবারো বাংলাদেশে। মনের উপর জোর খাটানো যায়। কিন্তু কতক্ষণ? 
______________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Sunday, 28 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৫ম পর্ব



বছরের শেষ দিন আজ। অনেকেই বলছেন শতাব্দীর শেষ দিন। স্বপনদার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ হচ্ছিলো সকাল বেলা। আজ বছরের শেষ দিন নাকি বিংশ শতাব্দীর শেষ দিন? যেটুকু হিসাব আমরা জানি, যেমন প্রথম শতাব্দী হলো এক সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ১০০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় শতাব্দী হলো ১০১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথম মিলেনিয়াম বা প্রথম হাজার বছরের ব্যাপ্তি হলো এক সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ১০০০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। সে হিসেবে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিন আর দ্বিতীয় হাজার বছরের শেষ দিন হবে ২০০০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। তার মানে আরো এক বছর পর। কিন্তু মানুষের অপেক্ষা সইছে না। তাই আজকেই নতুন মিলেনিয়ামকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি হয়ে আছে সবাই। সারা পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক আয়োজন চলছে এই ২০০০ সালকে আহ্বান করার জন্য। অনেকদিন থেকে শোনা যাচ্ছে কম্পিউটারের জগতে একটা বিরাট ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে ২০০০ সাল শুরু হবার সাথে সাথে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ওয়াই-টু-কে বাগ বা মিলেনিয়াম বাগ।

ওয়াই-টু-কে মানে দুই কিলোবছর। মানে দুই হাজার সাল। সিডনি দুই হাজার সাল নিয়ে অনেক বেশি মাতামাতি করছে, কারণ এই ২০০০ সালেই সিডনি অলিম্পিক, আর সিডনির পোষ্টকোডও ২০০০। এ দুটোর পারষ্পরিক সম্পর্ক না থাকলেও এখানকার মানুষ বাঙালিদের চেয়েও হুজুগে। ওয়াই-টু-কে বাগ সামলানোর জন্য নানারকম কম্পিউটার  সফটওয়ার বেরিয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে অনেকে তাদের জমানো টাকা পয়সা তুলে নিয়ে নাকি বাড়িতে এনে রেখেছে। কারণ কেউ কেউ বলছে ব্যাংকের কম্পিউটারগুলো ২০০০ সালের শুরুতেই গণ্ডগোল শুরু করে দেবে।

সে যাই হোক। কম্পিউটার সম্পর্কে যাদের কিছুটা হলেও ধারণা আছে তারা জানে এরকম কোন ঝড় বয়ে যাবার সম্ভাবনা শুধুমাত্র একটা নতুন বছর শুরু হবার কারণে নেই। তারিখ লেখার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র দুই ডিজিট ব্যবহার করা হলে সেখানে ৯৯ এর স্থলে হঠাৎ ০০ হয়ে গেলে কম্পিউটার পাগলামি শুরু করে দেবে এইরকম ভাবার খুব জোরালো  কারণ নেই। তারপরও সব রকমের সাবধানতা নেয়া হয়েছে। সাবধানতার জন্য আলাদা করে কোথায় কী করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। আমার ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টের লোকজনের মধ্যে এটা নিয়ে উত্তেজনা দেখিনি কখনো।

সিডনির বাঙালি কমিউনিটি নিউইয়ার্স ইভ পালন করে বেশ ধুমধাম করে। সেখানে যাবার সময় অনেকে খাবার দাবার বানিয়ে নিয়ে যায়। স্বপনদা আর নীলিমাবৌদিও যাবেন সেখানে আজ। তবে অনেক রাতে। আগে আমাকে নিয়ে সিটিতে হারবার ব্রিজের ফায়ার ওয়ার্ক্স দেখতে যাবেন। পরে ফিরে এসে সময় আর শক্তি থাকলে যাবেন বাংলাদেশের পার্টিতে।

নীলিমাবৌদি মাছের চপ বানাচ্ছেন পার্টির জন্য। স্বপনদা দোকান থেকে জিনিসপত্র এনে দিয়ে টেলিফোন নিয়ে বসেছেন। খবর নিচ্ছেন এক এক করে অনেকের। বুঝতে পারছি বাংলাদেশ থেকে যারা নতুন  এসেছেন পড়তে বা ইমিগ্র্য্যান্ট হয়ে, তাদের মধ্যে যারা স্বপনদাকে চেনেন তাদের সবার খবর স্বপনদা রাখেন। টেলিফোনের এইপ্রান্তে স্বপনদার কথার কয়েকটা টুকরো শুনেই বুঝতে পারছিলাম স্বপনদা আন্তরিকভাবেই তাদের সাথে থাকেন তাদের সুখেদুঃখে। নীলিমাবৌদি রান্না ঘর থেকেই কিছু কিছু বিষয় মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন স্বপনদাকে। নীলিমাবৌদিও খবর রাখেন সবার। স্বপনদার সত্যিকারের সহধর্মিণী তিনি।

বাদলদার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। হাসপাতালে দেখতে গেলাম তাঁকে স্বপনদা আর নীলিমাবৌদির সাথে। এদেশের হাসপাতালগুলোতে আগে ঢুকিনি কখনো। এটা এই সাবার্বের হাসপাতাল।  বেশ বড় আর ঝকঝকে পরিষ্কার। রোগী দেখার তেমন কড়াকড়ি নিয়ম নেই। এদেশের মানুষ ভীষণ ব্যস্ত। হাসপাতালে এসে  অহেতুক ভীড় করার মত সময় কারো নেই, আর তত বেশি মানুষও নেই এই দেশে। সে কারণেই হয়তো যে কেউ যে কোন রোগীকে দেখতে যেতে পারে।

আমাদের কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না। রোগীর  বিছানার কাছে চলে যাওয়া যায়। এখানে আরো একজোড়া ডক্টরেট দম্পতির সাথে দেখা হয়ে গেলো। বাদলদারা এখনো সন্তানের নাম ঠিক করেননি। এইজন্য একটু উশখুস করছিলেন। কারণ সন্তান হওয়ার সাথে সাথে বার্থ-সার্টিফিকেটের জন্য নাম লাগে। নামটা তাই আগেভাগে ঠিক করে রাখে সবাই। কিন্তু আমরা তো বাঙালি। আমাদের নামকরণ এইভাবে হাসপাতালে হয় না। আমাদের ঠিকমতো বার্থ-সার্টিফিকেটেরই ব্যবস্থা নেই এখনো। তবে মনে হল ছেলে অথবা মেয়ের জন্য একটা করে দুটো নাম ঠিক করে রাখাটা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। যে আসবে সে তো নোটিস ছাড়া হঠাৎ চলে আসে না। তার জন্য সব রকমের প্রস্তুতির সাথে একটা নাম ঠিক করে রাখাটাও আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে যাওয়া উচিত।

দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সিডনির উদ্দেশ্যে। টিভিতে সকাল থেকেই লাইভ দেখাচ্ছে হারবার ব্রিজের আয়োজন। দেখে মনে হচ্ছে লোকজন কাল রাত থেকেই সেখানে জড়ো হতে শুরু করেছে। অনেকে দেখলাম স্লিপিং ব্যাগ পেতে ঘুমাচ্ছে হারবার ব্রিজের কাছের চত্বরে। জায়গা পাব কিনা এইরকম একটা ভাবনা ক্ষণে ক্ষণে উঁকি মারছে। কিন্তু খুব একটা পাত্তা দিলাম না তাকে।

সিডনি যাবার পথে একটা সূর্যমন্দির আছে। বেশ সুন্দর। শ্রীলংকান কমিউনিটির মন্দির। মন্দিরের গায়ে নানারকম মূর্তি খোদাই করা আছে। এই মূর্তিগুলি ঠিক পরিচিত নয় আমার কাছে। তবে সবার চেহারা মানুষের মতো। শ্রীলংকায় এক সময় রাক্ষসরা থাকতো, রামায়ণ আমাদের এইরকম একটা ধারণা দেয়।


শ্রীলংকান সূর্য মন্দির। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল


শ্রীলংকান মন্দিরের ভেতরে। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল



মন্দিরে গিয়ে দেবতা দেখা আর মানুষ দেখা দুটোই সমান উপভোগ্য আমার কাছে। মন্দিরকে মাঝে মাঝে ক্যাসিনোর মতো মনে হয় আমার। এখানে মানুষ আসে ভক্তি দিয়ে জুয়া খেলতে। কেউ বিনিময়ে কিছু পায় আর বেশিরভাগ মানুষ কিছুই পায় না। তবে পাবার লোভ থাকে সবারই। যারা প্রার্থনা করে - ইহজগতের নানা প্রাপ্তির আবেদনই থাকে তাদের প্রার্থনায়। পুণ্যলোভী প্রবাসী মানুষগুলোকে দেখে কেমন একটা মায়া লাগে। মনে হয় তারা কত অসুখি। সুখি মানুষ নাকি বেগার খাটে না, প্রার্থনাও তারা করে না। এরকম একটা কথা পড়েছিলাম কোথাও। সম্ভবত ‘ডক্টর জিভাগো’তে।

স্বপনদা এবার জোরে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এলেন সিডনি সিটিতে। সিডনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কাছে একটা পার্কিং পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন স্বপনদা।  সিটির আরো ভিতরের দিকে ঢুকলে রাতে আর গাড়ি বের করা যাবে না। কয়েক লক্ষ মানুষ সিটি থেকে বেরুবে তখন একসঙ্গে।

গাড়ি থেকে আমাদের শুকনো খাবার আর পানীয়ের ক্যান ব্যাকপ্যাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম সিটির দিকে। কয়েকটা রাস্তা আমার কাছে পরিচিত মনে হলো।

আকাশ জুড়ে রোদের মেলা।  রাস্তায় গাড়ি চলাচলের ভীড় খুব একটা নেই, তবে জনস্রোত বাড়ছে। সবার হাতে নানারকম বাঁশি - বাজাতে বাজাতে চলছে। মনে হচ্ছে মেলায় চলছে সবাই। প্রায় প্রত্যেকের হাতে পানীয়ের ক্যান। কাঁধে বিয়ারের বড় বড় প্যাকেট নিয়ে চলেছে অনেকে। পাবলিক প্লেসে অ্যালকোহল পান করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে এই দেশে। কিন্তু আজ নিউইয়ার্স ইভের জন্য সে নিয়ম শিথিল।


ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং-এর ভেতরে। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং এর কাছে। আঠারো শতকের এই ভবন চেয়ে চেয়ে দেখার মতো সুন্দর। সাম্প্রতিক এক জরিপে এই বিল্ডিংটাকেই সবচেয়ে প্রিয় বিল্ডিং ভোট দিয়ে ছেন সিডনিবাসী। বিশাল ক্রিসমাস ট্রি সাজানো রয়েছে, হাজার রকমের রঙিন আলোর বাল্‌ব ঝুলছে তার পাতায় পাতায়। পুরো ভবন জুড়েই নানারকম দোকান।

দোতলায় কফিশপে এক পেয়ালা কফির দাম ছয় ডলার, আর নিচের তলায় তার দাম মাত্র এক ডলার। এই রকম পার্থক্যে কেমন ধন্দ লেগে যায়।  এদেশে নাকি মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই সেভাবে। যে কোন জিনিসের যে কোন দাম হাঁকা যায়। তবে কীভাবে চলছে এই দেশ? আসলে এই প্রশ্নটা বড় বেশি অর্থনৈতিক, যার সম্পর্কে নীলিমাবৌদি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলে বুঝতে পারলাম যে এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

কফি খেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। পিটস্ট্রিট মলে ঢুকে ঠিকই বুঝতে পারলাম কেন পিটস্ট্রিট মলকে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ব্যস্ত বিপণীকেন্দ্র বলা হয়। পরিসংখ্যান বলছে সপ্তাহে গড়ে প্রায় দশ লাখ মানুষ এখানে কেনাকাটা করে।



সিডনি টাওয়ার

পিটস্ট্রিট মলের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে বেরুলাম সিডনি টাওয়ারের কাছে। এই টাওয়ার সিডনির সেন্টারপয়েন্ট নামে পরিচিত। ৩০৫ মিটার উঁচু এই টাওয়ারে উঠে সিডনি সিটিকে দেখা যায় চারিদিক থেকেই। ভেতরে ঢোকার সময় নেই বলে ঢুকলাম না কেউই। হাঁটতে হাঁটতে দেখা আর দেখতে দেখতে হাঁটা।

মানুষের ঢল নেমেছে সিডনি শহরে। গাড়ি চলাচল আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় শহরে গাড়ি ঢোকার পথ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে আস্তে আস্তে। হারবার ব্রিজের কাছে পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম। এর মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে পুরো হারবার এলাকা। মানুষ বসে আছে দল বেঁধে। যে যেখানে বসেছে সেখান থেকে নড়ছে না, যদি জায়গা চলে যায়! স্বপনদার নেতৃত্বে এক জায়গায় বসে পড়লাম। আসার সময় একটা বড় পলিথিন নিয়ে এসেছিলাম আমরা বসার জন্য। সেটা বিছিয়ে জায়গা দখল করলাম। আশে পাশে হাজার হাজার মানুষ। সব মুখই পরিচিত মনে হচ্ছে, আবার কাউকেই চিনি না। জায়গাটি মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।  এখান থেকে হারবার ব্রিজের উপরের দিকের কিছু অংশ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভাল কোন জায়গা পাবার চেষ্টা করা উচিত। এখন বাজে মাত্র পাঁচটা। আরো সাত ঘন্টার বেশি সময় কাটাতে হবে এখানে।
স্বপনদাকে বসিয়ে রেখে আমি আর নীলিমাবৌদি হাঁটতে বেরুলাম। যদি আর কোন ভাল জায়গা পাওয়া যায়। ভিড় ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের কাছাকাছি এসে দেখলাম এদিকে অনেক জায়গা এখনো খালি। পানির কাছাকাছি। এখান থেকে ব্রিজ পরিষ্কার দেখা যায়। আর সামনেই পানির মধ্যে যেন জেগে উঠেছে বিখ্যাত সিডনি অপেরা হাউজ। আমার মনে হচ্ছে এখানেই বসে থাকি। কিন্তু স্বপনদাকে আনতে হবে এখানে।

ডাকতে গেলে স্বপনদা বললেন ঐ জায়গা থেকে কিছু দেখা যাবে না বলেই তা এখনো খালি রয়েছে। এত মানুষ যারা আগে এসেছে তারা কি বোকা নাকি যে জায়গাটা খালি রেখে দেবে? অকাট্য যুক্তি। কিন্তু যুক্তির বাইরে ইন্টুইশান বলে একটা কথা আছে। সেটার জন্যই খচখচ করছিলো মনের ভেতর। তবুও একবার সরে এসে আর একটু কাছে এসে বসলাম সবাই মিলে। ঠিক কোন দিক থেকে ফায়ার ওয়ার্ক্স হয় তা স্বপনদা বা নীলিমাবৌদি কারোরই ধারণা নেই। কারণ তারাও আমার মতো এ বছরই প্রথমবারের মতো এসেছেন।

যেখানে বসেছি সেখান থেকে অপেরা হাউজ দেখা যায় না। হেঁটে হেঁটে অপেরা হাউজের দিকে যাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের ভিড় ঠেলে এক পাও সামনে যাওয়ার উপায় নেই। কিছুক্ষণ পর পর একজন একজন করে বাইরে থেকে ঘুরে আসছি। সারি সারি অস্থায়ী টয়লেট বসানো হয়েছে। কয়েক লক্ষ মানুষের জন্য অপ্রতুল হলেও তেমন কোন অসুবিধা নেই। সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্নতা সেবকেরা কাজ করে যাচ্ছেন। আর দেখলাম পুলিশিং। সিডনির পুলিশ গিজগিজ করছে সবখানে। সবাই খুব অ্যালার্ট। মানুষের নিরাপত্তা এদেশে সবচেয়ে জরুরি। অনেক অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র চোখে পড়লো। অস্থায়ী হ্যালিপ্যাড চোখে পড়লো, যেখানে ছোট্ট একটা বায়ুযান অপেক্ষা করছে যদি কোন দরকারে লাগে। হারবার ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, ট্রেনও।
বাংলাদেশের মানুষ এসেছেন অনেক। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এসেছেন তাঁরা। বেশ উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে। জায়গা ছেড়ে বেশি দূরে যাওয়াটাও বিপদ। হারিয়ে গেলে আমার পক্ষে কোথাও অপেক্ষা করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু আমার জন্য স্বপনদার সমস্ত আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। তাই জায়গায় ফিরে এলাম। এইবার স্বপনদা আর নীলিমাবৌদি বেরুলেন একটু ঘুরে আসার জন্য।

জায়গা রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আমার একার পক্ষে। আমাদের পাতা আসনেই বসে পড়েছে একজন অস্ট্রেলিয়ান তরুণী। একটু পরে হয়তো তার বয়ফ্রেন্ডও এসে বসে যাবে। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে তার একটু পরেই। আমি শুয়ে পড়লাম যতটা সম্ভব নিজেকে প্রসারিত করে। জায়গা আমাকে রাখতেই হবে। স্বপনদারা ফিরে আসার পরে টেনশান কমলো। কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখা। কতক্ষণ বাকি আছে এই বছরের!

এবার গল্প করার সময় পাওয়া গেলো। স্বপনদা সিডনি সম্পর্কে জানেন অনেক কিছু। এখানে আসার সময় যে পিট স্ট্রিট আমরা পার হয়ে এসেছি সেই পিট সাহেব ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। ১৭৮০ সালের কথা এইসব। তখনো স্বাধীন অস্ট্রেলিয়ার জন্ম হয়নি। ইংল্যান্ড তখন নানারকম সমস্যায় পড়েছে। আমেরিকার সাথে যুদ্ধে হেরে গেছে। আমেরিকা স্বাধীন হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধেছে। দাসপ্রথাবিরোধী বিক্ষোভ চারিদিকে। প্রিন্স অব ওয়েলস ঋণে জর্জরিত। নানারকম অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে মানুষ। জেলখানা ভরে যাচ্ছে। জেলখানায় জায়গা করার জন্য প্রায় ১৬০ ধরনের অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়ে আইন পাস করা হয়েছে। প্রতিদিন শত শত লোককে ফাঁসি দিয়েও জেলখানায় জায়গা খালি করা যাচ্ছে না। এই ক্রিমিনালদের কোথাও দ্বীপান্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করার ভার পড়লো লর্ড সিডনির উপর। ১৭৮৬ সালে লর্ড সিডনি অস্ট্রেলিয়ায় এসে যে জায়গা ঠিক করেন তার নাম দেন সাউথ ওয়েলস। এই সিডনি শহরের নাম হয়েছে লর্ড সিডনির নাম অনুসারে। নিউ সাউথ ওয়েলস ষ্টেটের রাজধানী সিডনি।

১৭৮৮ সাল থেকে এখানে কয়েদিদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। তারা এখানে এসে আদিবাসীদের মেরে কেটে কীভাবে শেষ করতে চেয়েছে তা আরেক ইতিহাস।

রাত ন'টা বাজার সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দে ফুটতে শুরু করলো শত শত আগুনের ফুল। আকাশে পাখা মেলে উড়তে না উড়তেই মিলিয়ে গেলো তা। মিনিট পাঁচেকের বেশি স্থায়ী হলো না এই বাজি পোড়ানো। এই-ই যদি আয়োজন হয় তাহলে মনে হচ্ছে বৃথাই গেলো লক্ষ মানুষের এই সমাবেশ। কিন্তু মানুষকে নড়তে দেখা গেলো না একটুও।




রাত নয়টায় বাজি পুড়িয়ে আসলে বিদায় জানানো হল ১৯৯৯ সালের শেষ দিনের সূর্যকে। বিদায়ের বাজনাকে কেউ মনে রাখতে চায়না বলেই  তা সংক্ষিপ্ত। এবার আহবানের পালা। আমাদের কাছ থেকে দশ পনেরো হাতের মধ্যেই সাগরের পানি। সেখানে ভাসছে নানারকম সাজে সাজানো ছোট ছোট নৌকা। কী অপরূপ আলোয় সেজেছে সেগুলো। কোনটা হাঁসের মতো, কোনটা আবার ডলফিনের মতো সাজ নিয়েছে।

সময় কেটে যাচ্ছে তার নিজস্ব নিয়মে। মানুষের ঘনত্ব বাড়ছে বেশ দ্রুত। এখন আর বসে থাকার উপায় নেই। আমাদের সামনের সারির সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। আমরাও উঠে দাঁড়িয়েছি। পাশের মানুষের সাথে এখন আর পার্সোনাল স্পেস রাখা সম্ভব হচ্ছে না কারো।

হঠাৎ যেন সবকিছু থেমে গেছে। নিশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যাচ্ছে না আর। ১৯৯৯ সালের শেষ মিনিট। হঠাৎ প্রচণ্ড গর্জনে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেলো। প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ একসাথে গুনতে শুরু করেছে টেন, নাইন, এইট, ......... থ্রি, টু, ওয়ান। জিরো আর শোনা গেলো না। প্রচণ্ড শব্দের সাথে আকাশ ভরে গেলো আগুনের ফুলে। হারবার ব্রিজের উপর থেকে নিচে, নিচ থেকে উপরে।




অপেরা হাউজের উপর থেকে হাজার হাজার আগুনের ফুল ফুটতে লাগলো। শ্যাম্পেনের বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম মুহূর্তেই। মানুষ চিৎকার করছে হ্যাপি নিউ ইয়ার। আলিঙ্গন করছে পরস্পর। চুমু খাচ্ছে প্রেমিক প্রেমিকা। এমন মিলন মুহূর্ত আর হয় না। মোবাইল ফোনে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে যারা কাছে নেই তাদের। এক একটা বাজি আকাশে উঠে হাজার খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই খণ্ডগুলি আবার ফুটছে শব্দে আর বর্ণে। হারবার ব্রিজে আগুন দিয়ে লেখা হয়ে গেলো ‘ইটারনিটি’। চারিদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। পরিচিত অপরিচিত সবাই বলছে নতুন বছরটা শুভ হোক। সবার মুখে হাসি।




ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নতুন বছর সবার আগে এসেছে নিউজিল্যান্ডে। তারপর এসেছে অস্ট্রেলিয়ায়। দুই মিলিয়ন মানুষ এসে সমবেত হয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে এখানে।  প্রায় এক মিলিয়ন নারী এসেছে এখানে। কোথাও কোন বাধা নেই, জড়তা নেই, ভীরুতা নেই। হিংসা নেই, বৈষম্য নেই। মনে হচ্ছে সব মানুষের ভিতরের সব মানবিক গুণই এখানে বিকশিত আজ। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই এখানে সামান্য হলেও মদ্যপান করেছে আজ। কিন্তু কোথাও কোন উচ্ছৃঙ্খলা দেখা যায়নি। সিকিউরিটির কল্যাণেই হয়তো। এরকম একটা সফল আয়োজনের জন্য সিডনি সিটি কর্তৃপক্ষ কৃতিত্ব পেতেই পারেন।

গাড়ির কাছে আসতে অনেকক্ষণ সময় লাগলো। মানুষের স্রোত কাটিয়ে  অলিগলি পার হয়ে আসতে সময় লাগে তো বটেই। সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে স্বপনদাকে। যে রাস্তায় সাধারণ অবস্থায় কখনোই গাড়ির হর্ন শোনা যায় না সেখানে আজ তীব্র শব্দে গাড়ির হর্ন বাজছে। আর মনে হচ্ছে সর্বোচ্চ গতির সীমা কে কীভাবে ভাঙতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। লেফট লেন ধরে সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছেন স্বপনদা। পাশ দিয়ে তীব্র শব্দে হর্ন বাজাতে বাজাতে তীব্রবেগে চলে যাচ্ছে নানারকম গাড়ি। এতক্ষণ সুশৃঙ্খল বলে যাদের প্রশংসা করেছি তারা যেন আমাকে বিদ্রূপ করছে এখন।

বাড়ি এসে স্বপনদা আর নীলিমাবৌদি আবার বেরুলেন ব্ল্যাক টাউনে বাঙালির পার্টিতে যোগ দিতে। আমাকেও যাবার জন্য বলেছেন, কিন্তু কাল সকালে আমাকে ক্যানবেরা যাবার বাস ধরতে হবে সিডনি থেকে। আমি রয়ে গেলাম বাসায়।

নীলিমাবৌদি এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার খাবারের ব্যবস্থা করে গেলেন। একসাথে এত কাজ করার ক্ষমতা তিনি কোথায় পেয়েছেন আমি জানি না। টিভি খুলতেই দেখা গেলো পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশে বসে সিডনির অনুষ্ঠান নিশ্চয় দেখছে আমার প্রিয় মানুষেরা। তারা কি আমার কথা একবারও ভেবেছে? ঘুরে ফিরে তাদের কথাই মনে হচ্ছে এখন। হে আমার প্রিয় মানুষেরা, নতুন বছর তোমাদের জন্য সুখ বয়ে আনুক। 

[ষষ্ঠ পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]
__________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Saturday, 27 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৪র্থ পর্ব



'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী, ওগো মা -।' ঘুম ভেঙে যাবার পরেও চোখ খুলছি না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। চোখ খুললে যদি স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়, যদি হারিয়ে যায় এই অপূর্ব রবীন্দ্রনাথ! চোখ না খুলেও বুঝতে পারছি জানালা জুড়ে ভোরের আলো। ক'টা বাজলো? হঠাৎ সময়ের কথা মনে হতেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বুঝতে পারলাম আজ আর কাজে যেতে হবে না, আমি এখন ছুটিতে, স্বপনদার বাড়িতে। রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে লাউঞ্জরুম থেকে।
মাত্র সাতটা বাজে। এর মধ্যেই উঠে গেছেন স্বপনদা। বাইরের ঘরে এসে দেখি তিনি বেলকনিতে টবের ফুলগাছে পানি দিচ্ছেন। নীলিমাবৌদি রান্নাঘরে। জিভে পানি আসা সুগন্ধ আসছে রান্নাঘর থেকে। মনে হচ্ছে এমন অপরূপ সকাল অনেকদিন দেখিনি।
"গুড মর্নিং প্রদীপ। চলে এসো এদিকে।" - স্বপনদা ডাকলেন বেলকনি থেকে।
বেশ প্রশস্ত বেলকনি। থরে থরে সাজানো অসংখ্য টবে ফুটে আছে নানা রকমের ফুল। এখানে দাঁড়িয়ে বাম দিকে চোখ ফেরালেই ট্রেন স্টেশন দেখা যায়। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে সাবার্বের রেসিডেনশিয়াল রোড। এদেশে রেসিডেনসিয়াল এরিয়ায় গাড়ি চলে প্রায় নিঃশব্দে।
স্বপনদা গাছ ভালোবাসেন। শুধু গাছ কেন, সব ধরনের ভালো জিনিসই মনে হয় ভালোবাসেন এই মানুষটি। ভালোবাসার আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর। আজ ছুটির দিন নয়, অথচ স্বপনদা কাজে যাচ্ছেন না। আমার জন্যই ছুটি নিয়েছেন তা বুঝতে পারছি, কিন্তু তিনি তা একবারও জানতে দিচ্ছেন না আমাকে। বাগানের কাজ শেষ হতে না হতেই নীলিমাবৌদি ডাক দিলেন রান্নাঘর থেকে।
রান্নাঘরের পাশেই ডাইনিং টেবিল। টেবিলে সাজানো ব্রেকফাস্টের আয়োজন দেখে আমার চোখ কপালে উঠে যাবার জোগাড়। নীলিমাবৌদির কি রান্নাতেও একটা পিএইচডি নেয়া আছে? কখন করলেন এত্তোসব? কাল এতদূর থেকে এত ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসার পরে একটুও বিশ্রাম না নিয়ে এতসব আয়োজন করতে লেগেছেন। আমার খুব লজ্জা লাগছে, কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না। নীলিমাবৌদি বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। বললেন, "আজ সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়বো। এখন ভালো করে খেয়ে না নিলে শেষে পথে কষ্ট পাবে।"
অনেকের কাছে শুনেছি, গল্প উপন্যাসেও পড়েছি - বিদেশে গেলে নাকি মানুষ বদলে যায়, যন্ত্র হয়ে যায়, কোন আন্তরিকতা থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সেরকম কোন কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না এখানে। বরং মনে হচ্ছে উন্নত দেশের উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশজ সংস্কৃতিই আরো প্রাণ পাচ্ছে এই প্রবাসীদের কাছে। নাকি আমি যাদের দেখছি তাঁরা আসলেই ব্যতিক্রম।

"তোমার নিজের কোন প্ল্যান আছে ঠিক কী কী দেখতে চাও, বা কোথায় কোথায় যেতে চাও?" স্বপনদা জানতে চাইলেন।
আমার সেরকম নির্দিষ্ট কোন প্ল্যান নেই। সিডনি হারবার ব্রিজের নিউ মিলেনিয়াম ফায়ারওয়ার্ক্স দেখবো। কিন্তু সেটা তো কালকে।

"তবে আজ উলংগং-এর দিকে চলো।"
গাড়ির বুটে চিপ্‌স, সফ্‌ট ড্রিংকস আর এক ঝুড়ি ফল বোঝাই করে চেপে বসলাম স্বপনদার গাড়িতে। চালকের আসনে স্বপনদা, পাশের সিটে নীলিমাবৌদি আর পেছনে সিডনিতে নতুন আসা আমি। গাড়ি চলছে আস্তে আস্তে। ঘুরছে প্যারামাটা সাবার্বের বিভিন্ন রাস্তায়। গাড়ি চালাতে চালাতে স্বপনদা আমাকে দেখাচ্ছেন কোন্‌টা কী। আমার চোখ গাড়ির জানালায়।
এদেশের প্রত্যেকটি সাবার্ব প্রায় স্বয়ং-সম্পূর্ণ। স্কুল, শপিং সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা থিয়েটার, জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুল, পার্ক - কোন কিছুরই অভাব নেই। হাসপাতাল মানুষের জন্য তো আছেই, পশুদের জন্যও আছে কয়েকটা। ২০০০ সালের অলিম্পিক হবে এখানে, এই প্যারামাটায়। বেশ কাছেই সম্পূর্ণ নতুন তৈরি অলিম্পিক ভিলেজ।


সিডনি অলিম্পিক ভিলেজ। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল

প্যারামাটা নদীর তীরে হোমবুশ বে। সিডনি সিটি সেন্টার থেকে মাত্র পনের কিলোমিটার পশ্চিমে। আজ যেখানে গড়ে উঠেছে অলিম্পিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অলিম্পিক ভিলেজ, সেখানে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ছিলো ময়লার ডিপো। শহরের সব ময়লা এনে ফেলা হতো এখানে। এখন সেখানে অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে একটা আধুনিক রিসাইক্লিং সেন্টার। ময়লা বিশুদ্ধকরন কারখানা। শত বছরের ময়লা যেগুলোকে সরিয়ে নেয়ার কোন উপায় নেই, সেগুলোকে পিরামিডের মতো করে জমিয়ে তার ওপর গাছ লাগিয়ে চমৎকার কৃত্রিম পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে। এখন পাহাড়টা দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এটা এখানে আগে থেকে ছিল না।
প্রায় মাইল খানেক জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে খেলোয়াড় আর কর্মকর্তাদের থাকার জন্য আবাসিক এলাকা। বেশ কয়েকটা ছোটবড় স্টেডিয়াম পাশাপাশি। এই সিডনি অলিম্পিক স্টেডিয়ামে দর্শক ধারণক্ষমতা এক লাখ দশ হাজার। অলিম্পিকের ইতিহাসে এ পর্যন্ত এর চেয়ে বড় কোন স্টেডিয়াম তৈরি হয়নি। অলিম্পিক ইতিহাসের বৃহত্তম আটটি স্টেডিয়ামের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় সিডনির পরে ক্রমান্বয়ে আছে লস অ্যাঞ্জেলেস, সিউল, মস্কো, আটলান্টা, মুনিখ, মনট্রিয়েল ও বার্সিলোনা।


সিডনি অলিম্পিক ভিলেজে স্বপনদা ও নীলিমা বৌদি। ছবি তুলেছি আমি।


সিডনি অলিম্পিক স্টেডিয়াম তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় সত্তর কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার। বাংলাদেশের টাকায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই টাকার বেশির ভাগই অবশ্য এসেছে প্রাইভেট ফান্ড থেকে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়েছে প্রায় সাতান্ন কোটি ডলার। গোটা অলিম্পিক গেইমে খরচ হবে প্রায় পাঁচশো কোটি ডলার। বাংলাদেশের টাকায় কত হবে তা হিসেব করার কোন কারণ আছে বলে মনে হয় না। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু হয়ে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই এই স্টেডিয়াম তৈরি হয়ে বসে আছে। এ বছর মার্চের ছয় তারিখে এর উদ্বোধন হয়ে গেছে।


অলিম্পিক ভিলেজে সুইমিং পুলের সামনে। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল

স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে স্বপনদা বলছিলেন স্টেডিয়াম সংক্রান্ত নানা কথা। পার্কিং লটে এখনো মিটার লাগানো হয়নি, ফলে গাড়ি পার্কিং এখনো ফ্রি। তবে কিছুদিন পর এই সুযোগ আর থাকবে না। বিরাট বিরাট হোটেল তৈরি হয়েছে অলিম্পিক ভিলেজের ভেতর। সুইমিং পুল খুলে দেয়া হয়েছে দর্শকদের জন্য। জনপ্রতি দুই ডলারের টিকেট লাগে সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে। এই পুলেই সাঁতার কাটবে পৃথিবীর সেরা সাঁতারুরা আর মাত্র কয়েক মাস পরেই। অস্ট্রেলিয়ান সাঁতারু ইয়ান থর্প অলিম্পিকে সোনা জিতবেই এরকম আশা করেন বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান।

অলিম্পিক ভিলেজ ট্রেনস্টেশন। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল


দলে দলে লোক আসছে অলিম্পিক ভিলেজ দেখতে। একটা নতুন রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। সিডনি থেকে রেল লাইন তৈরি করা হয়েছে। দিনের মধ্যে অনেক বার আসা যাওয়া করে ট্রেন সিডনি সিটি সেন্টার থেকে। কোন ট্রেনই খালি থাকে না।
স্টেডিয়ামের ডিজাইন আর গঠন দেখলে অবাক লাগে। ছাদ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন স্টেডিয়ামের ছায়া বা চোখ ধাঁধানো সূর্যের আলো কোনটাই সরাসরি খেলার মাঠে না পড়ে। ছাদ দেয়া হয়েছে স্বচ্ছ পলিকার্বোনেটের টাইল্‌স। একেকটা টাইল্‌সের ক্ষেত্রফল দশ বর্গমিটার। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি কাঠামো। বৃষ্টি হলেও ভয়ের কোন কারণ নেই। পুরো স্টেডিয়াম ঢেকে ফেলার মতো ছাদ আছে এই স্টেডিয়ামে। স্বাভাবিক অবস্থায় এই ছাদ খোলা থাকবে। দরকার হলে সুইচ টিপে দিলেই হলো। গ্যালারির উপর থেকে স্বচ্ছ ছাদ এগিয়ে এসে ঢেকে দেবে পুরো স্টেডিয়াম।
স্টেডিয়ামটা এত বড় যে খোলা অবস্থায় ছাদের ফাঁক দিয়ে চারটা জাম্বো জেট একসাথে নামতে পারবে পাশাপাশি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ব্যবহার করা হয়েছে সর্বোচ্চ দক্ষতায়। পেইন্টের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ ভাবে তৈরি রঙ যাতে পরিবেশদূষণের মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকবে।
অলিম্পিক ভিলেজে লাগানো হয়েছে সারি সারি গাছ। অক্সিজেনের অভাব এখানে হবে না কখনো। পনেরো হাজার খেলোয়াড় আর কর্মকর্তাদের থাকার জন্য যে আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে তার পুরোটাই সোলার এনার্জিতে চলছে। এত বিরাট আবাসিক এলাকার বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে সূর্যের আলো থেকে। সিডনিতে বছরে গড়ে ৩৩৫ দিন সূর্যের আলো থাকে। অলিম্পিক শেষ হয়ে যাবার পর কী হবে এই আবাসিক এলাকার? প্রাইভেট প্রপার্টি হয়ে যাবে। যাদের টাকা আছে তারা কিনে নেবে এখানকার একেকটা বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট।
এখন থেকেই যে হারে মানুষ আসতে শুরু করেছে অলিম্পিক ভিলেজ দেখার জন্য, শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের কাছ থেকেই তো কয়েক লাখ ডলার আয় করতে পারবে অলিম্পিক অথরিটি অলিম্পিক শুরু হবার আগেই।

সিডনি সেন্টেনিয়েল পার্কে। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল


স্বপনদা জানালেন তিনি অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকেট পাচ্ছেন সেন্টেনিয়াল পার্কের কর্মকর্তা হবার সুবাদে। সেন্টেনিয়েল পার্ক অলিম্পিক ভিলেজের কাছেই। স্টেডিয়াম এলাকা থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যাবার পরেই শুরু হয়েছে সেন্টেনিয়েল পার্ক। স্বপনদা এই পার্কের সায়েন্টিফিক অফিসার। পার্কের মাঝখান দিয়ে কিছুদূর যাবার পর স্বপনদা গাড়ি থামালেন। গাড়ির কাছে এগিয়ে এলো কয়েকজন তরুণ-তরুণী।
স্বপনদার সাথে তাদের কথা বলার ধরন দেখেই বুঝতে পারলাম স্বপনদা তাদের বস। বেশ হাসিমুখে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন স্বপনদা তাদের। তারা গদগদ হয়ে ইয়েস ইয়েস বলছে দেখতে আমার বেশ ভালোই লাগছিলো।
একটা মেয়ে কিছু কাগজপত্র এগিয়ে দিলো স্বপনদাকে গাড়ির জানালা দিয়ে। স্বপনদা বেশ মনযোগ দিয়ে দেখলেন আর সাইন করে দিলেন। সাইন করা কাগজটা হাতে পেয়ে মেয়েটার মুখ দেখে মনে হলো এত আনন্দ সে অনেকদিন পায়নি। হাত নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন স্বপনদা।

"সুন্দরী মেয়েটি কে গো?"
"রোজলিন। বোটানিতে পিএইচডি করছে সিডনি ইউনিভার্সিটিতে। কিছু ডাটা কালেকশান করতে চায় আমাদের পার্কে।"
বাংলাদেশে মন্ত্রীর পাড়াতো ভাইরা নিজেদের যেরকম ক্ষমতাবান মনে করে, আমারো নিজেকে এখানে হঠাৎ সেরকম ক্ষমতাবান বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য এদেশে মন্ত্রীর পাড়াতো ভাইতো দূরের কথা, নিজের ভাইকেও কেউ পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না।
হাইওয়েতে উঠেই গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলেন স্বপনদা। ঘন্টায় একশ' কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে স্বপনদার বিশ্বস্ত টয়োটা। চলেছি উলংগং-এর দিকে। উলংগং সাউথ কোস্টের ছোট্ট একটা শহর। নিউ সাউথ ওয়েল্‌স-এর তৃতীয় বৃহত্তম শহর বলা হলেও সিডনির তুলনায় একটা গ্রামের সমান। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি হিসেবে সুনাম আছে উলংগং-এর।
পাহাড়ি ইলাওয়ারা এরিয়ায় উলংগং-এর কাছেই মাউন্ট ক্যামব্লা আর মাউন্ট মেইরা। রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছে পাহাড় আর সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তর। অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতি যে কী অদ্ভুত সুন্দর।
উলংগং সিটির মেইন স্ট্রিট ক্রাউন স্ট্রিট। এখানে গাড়ি থামিয়ে একটা স্ট্রিট-ডাইরেক্টরি কিনলেন স্বপনদা। আমরা যাবো কায়ামা বিচের দিকে। রাস্তা ভুল করলে অনেকটা সময় নষ্ট হবে, তাই সাথে একটা ডাইরেক্টরি থাকা ভালো।
ছোট্ট শহর হলেও উলংগং বেশ সুন্দর। দুটো বিচ আছে এখানে - নর্থ বিচ আর সিটি বিচ। নর্থ বিচ সার্ফিংয়ের জন্য বিখ্যাত। সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেলায় চড়ে ভেসে বেড়ানো। কাজটা দেখতে সুন্দর, কিন্তু ভয়ানক বিপজ্জনক।
দেখলাম ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বড়শিতে মাছ ধরছে অনেকে। বড়শিতে মাছ ধরার জন্যও নাকি লাইসেন্স লাগে এদেশে। পোস্ট অফিস থেকে নাকি কিনতে পাওয়া যায় এই লাইসেন্স। সমুদ্রের ধারে এসে অনেকে ছবিও আঁকে। বেশ কিছু আর্ট-গ্যালারিও আছে দেখলাম এই সৈকত শহরে।
একটু পরেই আবার চলতে শুরু করলাম আমরা। নীলিমাবৌদি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলেন গাড়িতে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকাচ্ছি চারপাশে। অস্ট্রেলিয়াকে নতুন করে ভালো লাগতে শুরু করেছে।
রাস্তা আস্তে আস্তে একেঁবেঁকে যাচ্ছে। পাহাড়ি পথ শুরু হয়েছে। একপাশে প্রশান্ত মহাসাগর। মাঝে মাঝে রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একেবারে সমুদ্রের কাছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা ধরে চলে গেলাম অনেক ভেতরে। সেখানে দারুণ একটা পিকনিক স্পট। রেইন ফরেস্টের ভেতর ছোট্ট বিশ্রামাগার। গাড়িপার্কিং, বাথরুম, ছোট্ট রেস্টুরেন্ট সব আছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো - এখান থেকে সমুদ্রের দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ।
পাহাড়ী রাস্তার পাশে লুক আউট। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল

জায়গায় জায়গায় পাহাড় কেটে বেলকনির মতো করে রেলিং দেয়া আছে। সেখান থেকে নিচের দিকে তাকালে গা শিরশির করে। নিচে সাগরের ঢেউ। নিচে মানে অন্তঃত একশ' মিটার। সাগরের পানি আর আকাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে এখানে। সৌন্দর্য দেখার ব্যবস্থা না থাকলে সে সৌন্দর্যের মূল্য কী? এ নিয়ে দার্শনিক বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাদের দেশের সমুদ্র পাহাড় মিলিয়ে সৌন্দর্য কম নেই, কিন্তু সেসব দেখার সুযোগ এদেশের মতো করে নেই বলেই 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি' আমরা কেবল মুখস্থই করতে থাকি।
কায়ামা বিচে পৌঁছাতে প্রায় একটা বেজে গেলো। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে সৈকত ঘিরে গড়ে ঊঠেছে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, মোটামুটি আয়তনের একটা টাউনশিপ। আকাশ ঝলমল করছে। বেশ কিছু নতুন ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে এদিকে। অবসরপ্রাপ্তরা অনেকেই এদিকে বাড়ি কিনে বাস করতে পছন্দ করছেন আজকাল।
বাঁধানো সাগরপাড়ে ক্যারাভানের সারি। ক্যারাভান - গাড়ি কাম বাড়ি। অনেকে নিজেদের ক্যারাভান নিয়ে এখানে এসে কাটিয়ে যায় কয়েকদিন। ক্যারাভান ভাড়াও পাওয়া যায় এখানে। পার্কিং লটে গাড়ি থামালেন স্বপনদা।
গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম সাগরের পাশ ঘেঁষে বাঁধানো রাস্তা ধরে। অনেকেই পায়ে চাকাওয়ালা জুতো পরে সাঁ সাঁ করে চলে যাচ্ছে আমাদের পাশ কাটিয়ে।
রাস্তার পাশেই সবুজ ঘাসের লন। সেখানে রোদচশমা লাগিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সারি সারি মানুষ। তাদের পরনে সামান্য একটু নেংটি ছাড়া আর কিছুই নেই। উলংগং-এর এই বিচে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা না থাকলে বোধহয় এই নেংটিটুকুও অবশিষ্ট থাকতো না। আমারও রোদচশমা নিয়ে আসা উচিত ছিলো। কালো চশমাটা রোদের পাশাপাশি চক্ষুলজ্জা নিবারণের কাজও করতে পারতো।
স্বপনদা হঠাৎ ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে হাত-পা শূন্যে ছুড়তে লাগলেন। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাতেই নীলিমাবৌদি বললেন, "ব্যায়াম করছে। অনেকক্ষণ একনাগাড়ে গাড়ি চালিয়েছে তো।"
আমি আশ্বস্ত হলাম। স্বপনদা যেভাবে ঘাসে শুয়ে হাত পা ছুড়ছেন, বাংলাদেশ হলে লোক জমে যেতো। মৃগিরোগী মনে করে জুতো শুঁকোতেও আসতো হয়তো। কিন্তু এখানে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। স্বপনদার হাতছোঁয়া দূরত্বে যে মহিলাটি শুয়ে আছেন কালো চশমায় চোখ ঢেকে, তিনিও মনে হয় একবারও তাকাননি স্বপনদার দিকে।

কায়ামা বিচের কাছে ব্লো হোল। ছবি তুলেছেন: ড. স্বপন পাল
একটু পরে শেষ হলো স্বপনদার ব্যায়ামপর্ব। কিছুদূর যাবার পর দেখা গেলো একটা জায়গা থেকে একটু পর পর প্রবল বেগে পানি উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। এই সেই বিখ্যাত ব্লোহোল। প্রায় একশ' ফুট ব্যাসার্ধের একটা গর্ত এখানে। সাগরের পানি ঢেউয়ের সাথে এখানে এসে পড়ে আর গর্ত দিয়ে সবেগে উঠে যায় আকাশের দিকে প্রায় দুশো ফুট। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক শক্তিতেই এই প্রক্রিয়া চলে। বেশ আকর্ষণীয় এই প্রক্রিয়া। দেখার সুবিধার জন্য জায়গাটা লোহার রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। খুব কাছে গেলে নিচে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে একটা সীমানার পরে আর যেতে দেয়া হয় না কাউকে। খুব বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে কেউ কেউ নাকি মারাও গেছেন এখানে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম ব্লোহোলের সৌন্দর্য।
সাগরের স্বাস্থ্যকর হাওয়ার কারণেই হয়তো, ক্ষিধে পেয়ে গেলো খুব। গাড়ি নিয়ে ফেরার পথে কে-এফ-সিতে ঢুকে খেয়ে নিলাম একপেট। এদেশের হাইওয়েতে ফাস্টফুডের অভাব নেই। খাবারের মানও বেশ ভালো আর দামও কিছু বেশি নয়।
ফেরার পালা এবার। ফেরা মানে উলংগং এর দিকে ফেরা। উলংগং এর কাছে একটা বৌদ্ধ মন্দির খুব বিখ্যাত। রাস্তা থেকে একটু ভিতরের দিকে বিরাট এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই বৌদ্ধ মন্দির। ফকুয়ানসাং নান টিয়েন টেম্পল। ইন্দোনেশিয়ান এক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী মিলিয়ন ডলার খরচ করে এখানে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। মন্দিরের পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে স্বপনদা আর মন্দিরের ভিতরে যেতে রাজি হলেন না। তিনি আগে এই মন্দির দেখেছেন বলে এখন একটু ঘুমিয়ে নিতে চাইলেন। আমি আর নীলিমা বৌদি চললাম মন্দিরের ভেতর।


ফকুয়ান্সাং নান টিয়েন টেম্পল। ছবি তুলেছেন: ড. নীলিমা পাল
চমৎকার ফুলের বাগান ঘেরা প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে হয় মন্দিরের প্রধান চত্বরে যাবার জন্য। পাহাড়ের উপর মূল মন্দির। বৌধমন্দিরগুলো খুব গাঢ় রঙে রাঙানো থাকে কেন জানি না। বেশ উজ্জ্বল। এখানে যারা আসেন সবাই খুব ধার্মিক এটা ভাবার কোন কারণ নেই। মন্দিরটা খুব সুন্দর বলেই দেখতে আসেন অনেকে। অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছেলেমেয়ে থাকে এখানে। মন্দিরে কাজ করার বিনিময়ে থাকতে আর খেতে পায়। কিছু শিক্ষাও নাকি পায়, তবে সেই শিক্ষা কেবল ধর্মীয় শিক্ষা বলেই মনে হলো আমার।
ফকুয়ান্সাং নান টিয়েন টেম্পল। ছবি তুলেছেন: ড. নীলিমা পাল

মন্দিরের ভিতরের চত্বরে ঢুকতে হলো জুতা খুলে। ভিতরের স্থাপত্য মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত সুন্দর। ছবি তোলা নিষেধ এখানে। চমৎকার একটি মিউজিয়াম আছে মন্দিরের ভিতর। নানারকম বৌদ্ধমূর্তিতে ঠাসা এই মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে ঢোকার জন্য একটা প্রবেশমূল্য দিতে হয়। অহেতুক ভিড় কমাবার জন্যই হয়তো এই ব্যবস্থা। ছোটবড় মোটাপাতলা অনেক পাথরের বুদ্ধ থরে থরে বসে আছেন প্রদর্শনী হয়ে। পাথরের হলেও এদের উপার্জন মনে হচ্ছে অনেক সুস্থ-সবল মানুষের চেয়ে বেশি। প্রত্যেকটা মূর্তির সামনে আশেপাশে হাতে-পায়ে পড়ে আছে অসংখ্য ডলার, মুদ্রায় আর নোটে। ঘুষ প্রথাটা হয়তো অত্যন্ত পুরোনো একটা প্রথা। মানুষ দেবতাদের টাকা পয়সা দিয়ে হলেও সন্তুষ্ট রাখতে চায়। দেশে থাকতে ট্রেনে কালুরঘাট ব্রিজ পার হবার সময় দেখেছি অনেকে পকেট থেকে পয়সা বের করে কপালে ঠেকিয়ে ফেলে দিচ্ছে কর্ণফুলিতে। এই পয়সা ভালো কাজে চাইলে কেউ দেবে না। নীলিমা বৌদিও দেখলাম একটা মূর্তির সামনে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ব্যাগ খুলে কিছু কয়েন বের করে ছুঁড়ে দিলেন। বিনিময়ে কী চাইলেন কে জানে।
বিকেল পাঁচটায় মন্দিরের গেট বন্ধ হয়ে যায়। আমরা পাঁচটা বাজার কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে এলাম। মন্দিরের পাশে বেশ বড় একটা পদ্মবন আছে। সেদিকে ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ। মন্দিরের বাইরেও বেশ কিছু বুদ্ধমূর্তি আছে। গৌতম বুদ্ধ নিজেকে কখনো ভগবান বলেননি, ভগবানে তাঁর বিশ্বাস ছিলো না। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গৌতমকেই ভগবান বানিয়ে ফেলেছেন। গৌতম বলেছেন যে রকম কাজ সে রকম ফলের কথা। আর বর্তমানে অনেক বৌদ্ধ কাজের উপর নির্ভর না করে গৌতমের কাছে সব কিছু চাইতে শুরু করেছেন। মন্দিরের শ্রমণ আর ভিক্ষুদের শারীরিক স্থুলতা দেখলে মনেই হয় না এঁরা কোন ধরনের বৈরাগ্যের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন।
স্বল্পমেয়াদী ঘুম থেকে উঠে স্বপনদার চায়ের তৃষ্ণা পেয়ে গেলো। বললেন, "চলো, সুধীর স্যারের বাসা থেকে চা খেয়ে আসি।"
"চলো, তবে শুধু চা খেয়ে তুমি আসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না" - নীলিমাবৌদির মন্তব্য।
"যাবো, এক কাপ চা খাবো, আর চলে আসবো" - বলতে বলতে গাড়ি চালু করলেন স্বপনদা।
সুধীর স্যার উলংগং ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্টিং এর প্রফেসর। বাংলাদেশে থাকতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। নীলিমাবৌদির সরাসরি শিক্ষক।
উলংগং-এর আবাসিক এলাকা বেশ নির্জন। মানুষজন খুব বেশি নেই। একটা রেল ব্রিজের নিচে গাড়ি পার্ক করে ছোট্ট রাস্তাটি পার হলেই সুধীর স্যারের বাড়ি। গাছপালাঘেরা খুব সুন্দর বাড়ি। নারকেল গাছ, কলাগাছ দেখে হঠাৎ বাংলাদেশের কোন বাড়ি বলে মনে হয়।

"বাড়িতে কেউ নেই? গাছে একটু জলটলও দেয় না!" বলতে বলতে স্বপনদা ঢুকে গেলেন বাড়ির পেছনের দিকের উঠানে। তাঁর পেছনে আমি, সাথে নীলিমাবৌদি।
সুধীর স্যার উঠানে একটা চেয়ারে বসে রিসার্চ পেপার দেখছিলেন। আমাদের দেখে হৈ চৈ করে অভ্যর্থনা করতে শুরু করলেন।

"আরে জামাই, এতোদিন পরে শ্বশুরকে মনে পড়লো! এসো এসো।"
নীলিমাবৌদির সূত্রে স্বপনদা সুধীর স্যারের জামাই হলেও মনে হচ্ছে শ্বশু-জামাইয়ের সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুত্বের। আমার দিকেও হাত বাড়িয়ে দিলেন সুধীর স্যার।
আমাদের কথা শুনে বাড়ির ভিতর থেকে হাসি মুখে বেড়িয়ে এলেন শ্যামলী ম্যাডাম - সুধীর স্যারের স্ত্রী। শুরু হয়ে গেলো আপ্যায়ন। কে বলবে এটা বাংলাদেশ নয়! কথায় কথায় জানা গেলো শ্যামলী ম্যাডামের বাড়ি চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের আমাকে পেয়ে অনেকের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তাদের কাউকে চিনি কাউকে চিনি না। কিন্তু তাতে কি, মানুষকে আপন করে নেবার ক্ষমতা এই পরিবারের মানুষদেরও আছে।
বিরাট উঠোন জুড়ে সবজি আর ফুলের বাগান। সুধীর স্যারের বাগানের শাকসবজি সিডনির বাঙালিদের অনেকের বাড়িতেই নিয়মিত পৌঁছে যায় সিজনাল উপহার হিসেবে। কচুর ফলন দেখে বুঝতে পারছি বেশ যত্ন করেই এই বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি আর গবেষণার পর যেটুকু সময় বাকি থাকে তার সবটাই সম্ভবত বাগানে দেন সুধীর স্যার। স্বপনদার 'এক কাপ চা খেয়ে চলে যাওয়া' আর হলো না। চায়ের আগে বিয়ার খাওয়া হলো। আমার বিয়ারও ভালো লাগে না শুনে একটু অবাক হলেও খুশি হলেন সুধীর স্যার।  বললেন, "তুমি ভাগ্যবান এ ব্যাপারে। এসব জিনিস একবার ভালো লেগে গেলেই মরেছো।"
সুধীর স্যার চমৎকার রাঁধেন। এক ঘন্টার মধ্যে তৈরি করে ফেললেন পাঁচটা তরকারি। তরকারির সংখ্যা পাঁচ না হলে নাকি অতিথি আপ্যায়ন সম্পূর্ন হয় না। আর অতিথি নাকি আমি, বাকি দু'জন ঘরের মানুষ। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক, আরো মজার সবজি, দু'রকম মাছ, মাংস। মনে হচ্ছে সুধীর স্যারের হাতে রান্নার জাদু আছে। শ্যামলী ম্যাডাম আমাদের সাথে বসে গল্প করতে করতেই সুধীর স্যারের রান্না শেষ হয়ে গেলো।
শ্যামলী ম্যাডাম সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়ছেন এখন। সেটা নিয়ে আলাপ হলো কিছুক্ষণ যে আলাপে আমিও যোগ দিতে পারলাম। ঘরের ভিতর এক পর্যায়ে মনেই হচ্ছিলো না যে আমারা বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের কোন দেশে আছি।
পরিচয় হলো পাপাই আর শর্মিলার সাথে। সুধীর স্যার আর শ্যামলী ম্যাডামের ছেলেমেয়ে। পাপাই আগামী বছর এইচ-এস–সি দেবে, আর শর্মিলা ক্লাশ ফোরে এখন। বেশ প্রাণবন্ত ছেলেমেয়ে। সুধীর স্যারের একটা অফার এসেছে সিডনি ইউনিভার্সিটি থেকে। এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সেখানে যাবেন নাকি এখানেই থাকবেন। এইরকম সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময়তো লাগেই। সেই সময়টা নিচ্ছেন এখন সুধীর স্যার।
সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। এইদিকে খুব সুন্দর একটা বেলাভূমি আছে। সেটা না দেখে ফিরে যেতে ইচ্ছে করলো না। সামান্য একটু হাঁটলেই সাগরের পাড়। আবছা অন্ধকারে সাগর দেখতে দারুণ লাগছিলো। এখন জোয়ারের সময়। বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পায়ের কাছে, আর তৃষ্ণার্থ বালি তা শুষে নিচ্ছে নিমিষেই।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। সাগরের সম্মোহনী শক্তির কাছে হয়তো আমরা কিছুক্ষণের জন্য পরাজয় বরণ করে নিয়েছি। আকাশে লক্ষ লক্ষ তারার মেলা। চাঁদ নেই একটুও। তারার আলোতেই দেখা যাচ্ছে সামনের বিশাল সাগর। দিনের আলোর নীল পানি এখন কুচকুচে কালো। কেমন মন উদাস করে দেয়া একটা পরিবেশ।
চলে এলাম একটু পরে। আমরা গাড়িতে আর সুধীর স্যার চললেন বাড়িতে। গাড়িতে খুব একটা কথা হলো না আর। সবাই খুব টায়ার্ড বুঝতে পারছি। কেমন যেন ঘুম ঘুম লাগছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। কথা বলে বলে স্বপনদাকে জাগিয়ে রাখা দরকার। গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়লে সাংঘাতিক বিপদে পড়তে হতে পারে। নীলিমাবৌদি ব্যাপারটা জানেন।
কথার পিঠে কথা চালিয়ে নেবার মোক্ষম অস্ত্র হলো ঝগড়া করা। কিন্তু কী বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা যায়! ঝগড়া করাই যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে বিষয় লাগে না। তেলাপোকা দিয়ে শুরু করে তিমিমাছ দিয়ে শেষ করা যায় ঝগড়া।
কিন্তু স্বপনদার সাথে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না নীলিমাবৌদি। স্বপনদা কোন ভাবেই কোন প্রতিক্রিয়া দেখান না। মনে হচ্ছে স্বপনদা ঝগড়াপ্রুফ। কিন্তু তাতে কোন অসুবিধা নেই।  ভালোয় ভালোয়  বাড়ি পৌঁছে যাওয়াই উদ্দেশ্য এবং তা সফল হলো।
সারাদিন জার্নিতে সবাই বেশ টায়ার্ড যে হয়েছি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাসায় এসে টিভি খুলে জানতে পারলাম ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা বিমান হাইজ্যাক করা হয়েছে।

[৫ম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]
___________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts