Saturday, 8 February 2025

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - স্বপ্নের ঠিকানা

__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - স্বপ্নের ঠিকানা
__________________________________________

স্বপ্নের ঠিকানা

 

ছুটির দরখাস্তখানা অধ্যক্ষের সামনে দিতেই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন তিনি - "তিন দিনের ছুটি!"

          "জী স্যার। ঢাকা যাব।"

          "ও আচ্ছা। মেয়ের কাছে?"

          এবার আর উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলেন না।

          "মেয়ের কাছে যাব, তবে এবার একটা বিশেষ দরকারে যাচ্ছি। একটা প্লটের বুকিং দিতে যাচ্ছি।"

          "সারাজীবন থাকলেন এখানে আর এখন প্লট বুকিং দেবেন ঢাকায়?"

          "কী করবো স্যার। ছেলেমেয়ে দুটো ঢাকায়। ওদের কথা হল ঢাকায় না থাকলে ক্যারিয়ার গড়া যায় না। লেখাপড়া, চাকরি সবকিছুর সুবিধা ঢাকায়। তো কিনব তো ওদেরই জন্য। তাই আর কি।"

          "কথাটা সত্যি। কত বিকেন্দ্রীকরণের কথা শুনলাম। কিন্তু সে কেবল কাগজে কলমে। বাস্তবে ঢাকা মাইনাস পুরো দেশটাই জিরো। ঠিক আছে, আমি সাইন করে দিচ্ছি। আপনি কেরানির কাছে জমা দিয়ে যান। উইশ ইউ বেস্ট অব লাক।"

          সালাম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আজ ক'দিন থেকে মনটা হাওয়ায় উড়ছে। ভাবতেই ভাল লাগছে একটা জমি হবে। এক টুকরো আবাস, একটা স্থায়ী ঠিকানা।

          টিকেট আগেই কাটা ছিল। বাসায় এসে শেষ মুহূর্তের গোছগাছ করতে করতেই মেয়ের ফোন এল - "রেডি হয়েছেন আম্মা?"

          "হ্যাঁ মা রেডি।"

          "তাহলে বেরিয়ে পড়েন। আর হ্যাঁ, স্টেশনে শিমুল আর রাশেদ থাকবে।"

          "আমিতো একাই যেতে পারতাম। তাছাড়া শিমুল একাই তো যথেষ্ট। রাশেদকে কেন আবার কষ্ট দিবি?"

          "সবকিছুতে সবার কষ্ট হবে ভাবেন কেন আম্মা? কোন কোন কষ্টে আনন্দও থাকে। স্টেশনে যাবে তাতে কষ্ট কিসের? তাছাড়া ট্রেনের কোন ঠিক-ঠিকানা আছে? ন'টার ট্রেন ক'টায় পৌঁছাবে কেউ নিশ্চিত করতে পারে? আপনি এসে পৌঁছালে আমার স্বস্তি। আর হ্যাঁ, ট্রেন ছাড়লে আমাকে একটা ফোন করবেন। রাখি তাহলে। খোদা হাফেজ।"

          "খোদা হাফেজ।"

          মোবাইল ফোনের লাইন কেটে দিলেন। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল। তৃপ্তির হাসি। আজকাল মেয়ের আচরণে কে মেয়ে কে মা বুঝে উঠতে পারেন না। বাচ্চামেয়ের মত সারাক্ষণ তত্ত্বতালাশ করে তাকে আগলে বেড়াচ্ছে।

          মেয়ের এই ছোট ছোট খোঁজ-খবর আর উদ্বিগ্নতায় এক ধরনের পরিতৃপ্তি বোধ করেন সুলেখা হাসান। নিজেকে সুখী মনে হয়। জীবনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার কষ্ট আর বঞ্চনাগুলো মুছে গিয়ে পরম শান্তিতে ভরে ওঠে মন। ছেলে-মেয়ে মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন - এরচেয়ে সুখ আর কী আছে?

          স্টেশনে এসে জানলেন যথারীতি ট্রেন লেট। বাংলাদেশে এটাই এখন সংস্কৃতি। ট্রেন লেট, বাস যানজটে আটকা - বসে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা। আর ঢাকা গেলে তো কথাই নেই - গলি থেকে রাজপথ সর্বত্রই যানজট দিন দিন বাড়ছেই। কবে যে এ অবস্থা থেকে মুক্তি কেউ জানে না।

          ভাবতে ভাবতেই নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে ঠাঁই খুঁজতে লাগলেন। নাহ্‌ কোথাও এতটুকু তিল ঠাঁই আর নাহি রে। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকলেন। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে আজকাল পায়ে ব্যথা হয়। হাঁটুর ওপর খুব চাপ পড়ে। কিন্তু কিছু করার নেই। চারপাশে লোক গিজগিজ করছে।

          মনে পড়ল হুমায়ূন আহমেদের একটা লেখায় পড়েছিলেন চারপাশের জগতকে ভুলে গিয়ে নিজের মধ্যে ডুব দিতে পারলে সব দুঃখকষ্টকে ভুলে থাকা যায়। যেমন প্রচন্ড গরমে কেউ যদি মনোজগত তৈরি করতে পারে যে সে খুব ঠান্ডার দেশে আছে, তার চারপাশে সবকিছু জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে তখন আস্তে আস্তে তার ঠান্ডার অনুভূতি হবে। জীবনের নানা যন্ত্রণাকে ভুলতে কয়েকবার চেষ্টাও করেছেন কিন্তু সফল হননি। কোন কিছু ভাবতে গেলে শুধু নিজের অতীতই ভেসে ওঠে।

          জন্মের দু'বছরের মধ্যে মাকে হারিয়ে নিঃসন্তান খালার কোলে মানুষ হয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর পর খালার কাছে দিতে বাধ্য হলেও বাবা কখনোই বিষয়টা মেনে নিতে পারেন নি। তাই মাঝে মাঝেই হানা দিতেন খালার বাড়িতে মেয়েকে নিতে। তখন যে কী কষ্ট হত ছোট্ট বুকটায়। বাবার চোখে না পড়ার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে হত। বাড়ির আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকতে থাকতে কখনো গাছ কখনো পাখি হয়ে যেতে ইচ্ছে করত।

          কিন্তু ছোট্ট মেয়েটার ছোট্ট বুকের ভেতর পাখাঝাপটানো কষ্টটা বাবা কখনও বুঝতে চাইতেন না। খালা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাবাকে মানাতে চেষ্টা করতেন - "একটু বড় হোক, তারপর নিজেই যাবে।"

          বাবা যাবার সময় শাসিয়ে যেতেন - "তুমি আমার মেয়ে। আমার সঙ্গে যেতেই হবে। ঠিক আছে এখন রেখে গেলামআমি আবার আসব।" এই "আসব" শব্দটা কী ভয়ঙ্কর হয়ে গুরগুর শব্দে বাজত মনের ভেতর।

          আবার একটু বড় হতেই বুঝতে পারলেন যে পরিবারে তিনি বেড়ে উঠছেন সেখানে তার কোন শিকড় নেই। তাই খালা-খালুর একমাত্র সন্তানের মত পরম আদরে বেড়ে উঠেও নিজেকে বৃন্তচ্যুত মনে হত। তখন বাবার ওপর খুব রাগ হত।

          কিন্তু বাবা ততদিনে রাগ-অভিমানের অনেক উর্ধ্বে। আঠারো বছর না পেরোতেই সত্যিকারের এতিম অনাথ হয়ে যাওয়া। তবু সইত। কিন্তু যাদের আঁকড়ে বড় হলেন ক্যান্সারে ভুগে অল্পদিনে তারাও চলে গেলেন। ভিড়ের মধ্যেই সুলেখা হারিয়ে গেলেন ফেলে আসা দিনে।

          খালুবাবার কাফনে জড়ানো শরীরটা বিশাল উঠানের মাঝখানে। আত্মীয়-স্বজন গিজগিজ করছে বাড়ি। হঠাৎ কানে এল বাবার ভাইয়ের ছেলে আলমের কন্ঠ মসজিদের মাইক থেকে - "প্রিয় গ্রামবাসী। আস্‌সালামু আলাইকুম। আমার চাচা আমানত আলী চৌধুরি গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি--। আপনারা জানেন তাঁর কোন ওয়ারিশ বা আওলাদ ছিল না। আমরাই তাঁর ওয়ারিশ। তাই জীবিত অবস্থায় তাঁর সকল ভুলত্রুটির জন্য আমরা আপনাদের কাছে মাফ চাইছি। যদি কেউ পাওনাদার থাকেন তাহলে আমাদের....."

          ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল- "এটা কী কইল আলম? মেয়েটা মাত্র বাপ হারাইল, এখন এ কথা কেন?"

          আর সুলেখা? তার মনে হচ্ছিল তার বুকের ভেতরটা এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে গেল। ভিতরটা উথলে উঠল বুকভাঙা কান্নায় - "আমি তবে কে গো? কে আমি?"

          সম্পত্তি এমনই একবস্তু মুহূর্তে আপনাকেও পর করে দেয়। সেই যে আশৈশব বেড়ে ওঠা গৃহপরিবেশ সেই পরিচিত গ্রাম মানুষজন ছেড়ে এসেছিলেন আর কোনদিন সেখানে যাননি। অথচ এখনও এত বছর পরও পেছনে তাকালেই দেখতে পান সেই গ্রাম ঘর আর মায়া-মমতায় অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়ানো মানুষগুলো।

          ঘোষণা হচ্ছে আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন স্টেশনে আসবে। নিজেকে নিজেই বললেন, "সুলেখা ওঠো। গাড়ি আসছে। ঢাকা যেতে হবে। সেখানে তোমার রাতুল শিমুল অপেক্ষা করছে। এবার তোর মরা গাঙে......"

          নিজেকে চাঙা করার জন্য এভাবেই মনে মনে গুনগুন করে ওঠেন। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।

          ট্রেন ছাড়তে ঠিকঠাক হয়ে বসেন। স্টেশন থেকে কেনা পত্রিকা আর ম্যাগাজিনগুলো ভাঁজ করে ব্যাগে রাখেন। আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। প্রতিবার এমন ভ্রমণে একটা গল্পের বই কিংবা উপন্যাস পড়া হয়ে যায়। আর পেপার ম্যাগাজিনতো থাকেই। ব্যস্ত জীবনে এই ভ্রমণটুকু একটা বড় বিনোদন। কিন্তু এবার যেন সবকিছু ছাপিয়ে শুধু আনন্দ খেলা করছে মনে।

          অপরিচিত বাবার বাড়িতে কোনদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যেখানে বড় হয়েছে সেই সুবর্ণগ্রামের সাথে চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেছে। হাসানদের গ্রামে বাড়ি ছিল। কিন্তু তারা কখনও যেত না। তাই শ্বশুরবাড়ির ভিটেখানাও তেমন করে চিনতে পারেননি।

          সারাজীবন ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে নিজেকে উন্মুল মনে হত। আজ মেয়ে উদ্যোগ নিয়েছে মায়ের জন্য ভাইয়ের জন্য একটা ঠিকানা গড়ার। প্রস্তাবটা দিয়েছিল এভাবে - "আম্মা, টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছেন?"

          "কোন্‌টা রে?"

          "ঐ যে বিখ্যাত গায়িকা রাশনা হক করে।"

          "দেখেছি তো। জান্নাতুল ফেরদৌস হাউজিং। ইদানীং প্রায়ই দেখাচ্ছে। বেশ সুন্দর জায়গাটা।"

          "হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আচ্ছা আম্মা ওখানে যদি আমরা একটা প্লট নিই কেমন হয়?"

          মেয়ের কথা শুনে হেসে উঠেছিলেন - "এত টাকা কোথায় পাবি? আমার তো প্রভিডেন্ট ফান্ড ছাড়া তেমন কিছু নেই।"

          "তাতে কী? এসবতো কিস্তিতে নেয়া যায়। আমি কিছু দেব, আপনি কিছু দেবেন। আর শিমুল চাকরিতে ঢুকেছে, পারলে সেও কিছু দেবে।"

          "ওর তো নতুন চাকরি। পারবে কি?"

          "পারবে পারবে। ইচ্ছে করলেই পারা যায়। জীবনের শুরু থেকে না করলে কীভাবে হবে? এরপর বিয়ে-শাদি হলে খরচ বাড়বে। তখন তো আরো পারবে না। আর আমি তো আছি।"

          মেয়ের 'আমি তো আছি' কথাটা সুলেখাকে একটা শক্ত জমির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয় যেন। বলেন "তাহলে দ্যাখ।"

          স্টেশনে ট্রেনটা থামতেই শিমুল আর রাশেদকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে দেখলেন। খুশিতে মনটা আবারো দাপাদাপি শুরু করল। হঠাৎ মনে হল এত যে সুখ - সইবে কি?

          ধুর্‌ এত আনন্দের মুহূর্তে মন কেন কু গাইতে বসল। তাড়াতাড়ি ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনেন।

          মেয়ে দরজা খুলেই দাঁড়িয়ে ছিল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দু'হাতে জড়িয়ে ধরল। এর চেয়ে সুখ আর কী! 'সুলেখা তুমি ভাগ্যবতী' মনে মনে বললেন নিজেকে।

          রাতুল মায়ের বুকের ওম নিতে নিতেই রাশেদকে জানাল -"মোহিতভাই এসে বসে আছে"

          "মোহিতভাই কে?"

          "জান্নাতুল ফেরদৌসের কো-অর্ডিনেটর।"

          ঘরে ঢুকতেই সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে সালাম দিল মোহিত।

          "ভাল আছেন খালাম্মা?"

          "জী ভাল।"

          "অনেক কষ্ট হয়েছে না? ঢাকা-চট্টগ্রাম মাশাহ্‌ আল্লাহ যে লম্বা জার্নি!"

          "হ্যাঁ তা তো একটু......."

          হাতমুখ ধুয়ে আসতেই মেয়ে ডাকল চা খেতে।

          বসার ঘরে মোহিত সহ সবার জন্যে চায়ের আয়োজন। মোহিতের হাতে একতাড়া কাগজ। চা খেতে খেতেই রাশেদ বলল -"প্লটগুলো নাকি হুড়হুড় করে নিয়ে নিচ্ছে লোকে। আমাদের অফিসেও বেশ কয়েকজন নিয়েছে। মোহিতভাই আমাকে বলল তাড়াতাড়ি খালাম্মাকে নিয়ে আসেন-"

          "হ্যাঁ তাইতো। আমি খালাম্মার জন্য একটা কর্নার প্লট রেখেছি খুব সুন্দর লোকেশানে। এই যে দেখেন।"

          স্ক্রল করা কাগজটা দ্রুত সেন্টার টেবিলে মেলে ধরল মোহিত। এত দ্রুত এবং নিপুণভাবে কাজটা করল যে তার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন সুলেখা।

          ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন মোহিতের দিকে। বয়স বত্রিশ-চৌত্রিশ হবে। সুদর্শন বলতে যা বোঝায় ছেলেটা তাই। তবে মুখে দাড়ি। সেগুলো কিছুটা বিশৃঙ্খল এবং পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে বেড়েছে যা সৌন্দর্যের কিছুটা হানি করেছে। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলেন। ছেলেটা কথায় কথায় সোবহান আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাহ আল্লাহ বলছে। ছেলেটার বয়স, পোশাক-আশাক কথাবার্তার সঙ্গে এ দুটো ব্যাপার কিছুটা বিসদৃশ ঠেকে।

          কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে শিমুল আর রাশেদ খুব মনযোগ দিয়ে প্লটটা বোঝার চেষ্টা করছে। মোহিত বার বার বলছে "পাঁচ কাঠার মাশাহ্‌আল্লাহ একটা ভাল প্লট ছিল খালাম্মা। ওটা নিলে ভাল হত।"

          "কিন্তু অত টাকা কোথায়?" যেন নিজেকে শুনিয়ে প্রশ্ন করলেন সুলেখা।

          "নাউজুবিল্লাহ। মন খারাপ করবেন না খালাম্মা। আল্লাহ্‌পাক যা দিয়েছেন তা নিয়ে শোকর করতে হয়। আপনার জন্য সাড়ে তিন কাঠার এই কর্নার প্লটটা খুউব সুন্দর" বলতে বলতে প্ল্যানটার ওপর আঙুল দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করে।

          সুলেখাও ব্যাগ থেকে চশমা জোড়া বের করে পরতে পরতে কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়েন। প্ল্যানটা দেখতে দেখতেই বলেন "আমাকে একবার জায়গাটা দেখাতে নিয়ে যাবে?"

          "জী খালাম্মা, কেন নয়? ইনশাল্লাহ আমি আগামী পরশুই আপনাকে নিয়ে যাব। কোন চিন্তা করবেন না।"

          সুলেখা আশ্বস্ত হন। মুগ্ধ হন মোহিতের করিৎকর্মা আচরণে। যাক্‌ কথাবার্তাগুলো খুব ভাল লাগছে।

          মোহিতের কথামত পরদিন রাশেদকে নিয়ে তাদের অফিসে যান সুলেখা। কিছু কাগজপত্র সই করতে হবে।

          ধানমন্ডির সুপরিসর সড়কের পাশে বিরাট সুউচ্চভবন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। ভবনের গায়ে উৎকীর্ণ অনুবাদসহ পবিত্র কোরানের বিভিন্ন আয়াত। অন্তরে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করেন। যাক এরা অন্তত ঠকাবে না। কালকে মোহিতকেও দেখেছেন প্রত্যেকটা কাজের শুরুতে আল্লাহর নাম নেয়।

          চুক্তিপত্র সই হবার পর রাশেদ আর মোহিতসহ আবাসন প্রকল্পের দিকে রওনা দেয় তারা। সারা পথ সুলেখার মনে অতীত স্মৃতির ওঠাপড়া। মামার বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে। মামাতো ভাইবোনেরা হাসানের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে। সুলেখা কাঁদছেন - খালাম্মা আর খালুবাবাকে মনে পড়ছে। হাসানদের বাড়ি - হাসানের বন্ধুরা বউ দেখতে এসে ঠাট্টা করছে। সুলেখা ঘোমটার আড়ালে হাসি চাপতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছেন। রাতুল এল। ফুটফুটে ছোট্ট রাতুল। জীবনের পরম পাওয়া। এতদিনের রিক্ত জীবনে যেন পূর্ণতার জোয়ার। বাবার কথা মনে পড়ছে। বুঝতে পারছেন তাকে নিয়ে বাবার পাগলামী। সন্তানের জন্য মনটা এমন করে বলেই বাবা বলতেন 'আমি আবার আসব'।

          আহারে! তখন কেন বুঝতে পারেনি!

          আরেকদিন - বসার বারান্দায় ওটা কে শুয়ে আছে? মুখটা ঢাকা কেন? সুলেখা দেখতে চানসবাই তাকে ধরে রেখেছে। একদিকে সুলেখা অন্যদিকে সবাই। কিছুতেই ওদের ছাড়াতে পারছেন না। কিন্তু নিঃসাড় মানুষটার কাছে তার যে অনেক জিজ্ঞাসা।

          মানুষটা অফিসে গেল আর ফিরে এল এভাবে। কেন সে অসাবধানে রাস্তা পার হতে গেল? কেন ভাবল না ছোট্ট রাতুল আর শিমুলের কথা। সুলেখার কি এই পৃথিবীতে আর কেউ আপন আছে? জীবনের সমস্ত না পাওয়া নিয়ে এই মানুষটার কাছেই তো হাত পেতেছিলেন। মানুষটাকে ঘিরে তার সুখ আর স্বপ্নগুলো এত তাড়াতাড়ি শেষ হতে পারে না। না কেউ দেখতে দেয়নি। সবার এক কথা - 'তুমি সইতে পারবে না'।

          অ্যাকসিডেন্টে ওর মাথার খুলিটা উড়ে গেছে। কেন, কেন এমন হবে? জীবন এত কঠিন কেন?

          তারপর একটানা সংগ্রাম। যৌথ পরিবারে থেকে পড়াশোনা করা। কী কঠিন পরিশ্রমে বিএ-এমএ পাশ করা। তারপর এই কলেজের চাকরিটা। বাইশ বছর একটানা ঘানি টানা।

          তবে সাফল্য পুরষ্কার একেবারে আসেনি তা নয়। ছেলেমেয়ে দুটো মেধাবী ছিল। ওরা গড়ে উঠেছে, চাকরি করছে। প্রতিষ্ঠার পথে এগুচ্ছে। এখন একটা ঠিকানা হলে আর কী! আর কী চাইতে পারেন সুলেখা?

          "না, আমার আর কিছু চাই না। একটা ঠিকানা হোক। আর আমার সন্তান থাক দুধে-ভাতে। হে খোদা, তুমি শুধু এটুকু দিও।"

          শহর থেকে বেশ অনেকটা দূরে এসে থামল গাড়ি। এতক্ষণ কথা বলছিল মোহিত আর রাশেদ।

          সাভারের এই এলাকাটা এখনো বেশ জঙ্গুলে। গাড়ি থেকে নেমে চারদিক তাকালেন। কই কাগজে যেভাবে দেখেছেন সেরকম কোথাও তো দেখতে পাচ্ছেন না। তাছাড়া ওদের অফিসের দেয়ালে একটা বিশাল মাস্টারপ্ল্যান বাঁধাই করা ছিল। সেখানেও মোহিত তাকে প্লটটা দেখিয়েছিল। কই এখানে তো তেমন দেখতে পাচ্ছেন না। এ তো এবড়ো থেবড়ো জঙ্গলে ভরা। এখানে প্লট কোথায়?

          কৌতূহল চাপতে না পেরে মোহিতকে ডাকেন। জানতে চান - "রাশনা হকের বাড়িটা কোন্‌ দিকে?"

          "রাশনা হক কে?" কিছুটা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে মোহিত।

          "কেন তুমি জান না? তোমাদের আবাসনের বিজ্ঞাপনে দেশের বিখ্যাত গায়িকা রাশনা হক আর তাঁর বাড়ি দেখায় যে।"

          "ওহ্‌ হো। আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পারছি। নাউজুবিল্লাহ। আমি কী বেকুব। কীভাবে ভুলে গেলাম, তওবা, তওবা।"

          "না, না এত অপ্রস্তুত হওয়ার কী আছে? ভুল তো হতেই পারে।"

          "তবুও এত বড় ভুল! আস্তাগফিরুল্লাহ। জী জী খালাম্মা আপনি ঠিকই বলেছেন। রাশনা হকের প্লট। আসলে কী জানেন খালাম্মা রাশনা হকের বাড়িটা আমাদের অন্য প্রকল্পে।"

          "তাহলে এখানে দেখাল কেন? আমি তো সেটা দেখে আগ্রহী হলাম। আমার কলিগদের মজা করে বলেছি আমি রাশনা হকের প্রতিবেশী হতে যাচ্ছি।"

          সুলেখার কথা শুনে একসঙ্গে হেসে ওঠে রাশেদ আর মোহিত।

          শেষ পর্যন্ত পাঁচ লাখ টাকা এককালীন আর মাসিক আঠার হাজার টাকা কিস্তির চুক্তি সই করে ঠিকানার স্বপ্নে বিভোর সুলেখা হাসান ফিরে এলেন কর্মস্থল চট্টগ্রামে।

          প্রায় সাত মাস পর এক সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাযের পর এক কাপ চা নিয়ে বিছানায় বসে টিভি অন করলেন সুলেখা।

          সান্ধ্যকালীন এই চা আর খবর শোনা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। শিরোনামগুলো শুনতে শুনতেই চমকে উঠলেনকী বলছে এসব! জান্নাতুল ফেরদৌস আবাসন প্রকল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে রাজউক। জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে যেন কোন রকম জমি বা প্লট তাদের কাছ থেকে না কিনে। রাজউক কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে জানতে পেরেছে সাভার মডেল টাউনে ভুয়া জমি দেখিয়ে তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

          খাটটা কি দুলে উঠল? ভূমিকম্প হচ্ছে? সুলেখা এখন কী করবেন?           হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। যন্ত্রচালিতের মত হাতে তুলে নিলেন মোবাইল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়ের কান্নাভেজা গলা শুনতে পেলেন - "আম্মা, আম্মা খবর শুনেছেন টিভিতে -"

          "হ্যাঁ শুনেছি। রাশেদ কি মোহিতের সাথে যোগাযোগ করেছে?"

          "আম্মা, ফোন করতে করতে রাশেদের হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফোন বন্ধ" - বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল রাতুল।

          সুলেখা কী সান্ত্বনা দেবেন? তার সারাজীবনের সঞ্চয় প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটার এ কী অপচয়!

          বিড়বিড় করে কোনমতে বললেন, "কারো কারো জীবনের ঠিকানা হয় না। স্বপ্নের ঠিকানা স্বপ্নই থেকে যায়।"


রিফাৎ আরার ছোটগল্প - পিতা

__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - পিতা
__________________________________________

পিতা

 

ঘরের দরজাটা বন্ধ করতে এসে হ্যাপি থমকাল। বাবা চেয়ারে বসে আছেন। প্রতিদিনই এভাবে ঘরের ভিতর দিকের দরজা বন্ধ করতে এসে হ্যাপি থমকে দাঁড়ায়। একবার চোখ বুলিয়ে দেখে পানির গ্লাস, বিস্কুটের বয়াম সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর একঠাঁয় বসে থাকা মানুষটার দিকে এক পলক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝট্‌ করে দরজার পাল্লাটা বন্ধ করে।

          এই ঝটতি বন্ধ করার মধ্য দিয়ে কি হ্যাপির নিজের মনের দুয়ারটাও বন্ধ করতে চায় কি না তাও ভাবতে চায় না। কারণ এ নিয়ে ভাবতে গেলে দরজা বন্ধ না করে সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবেভাবনা বড় খারাপ জিনিস। ভাবাতে ভাবাতে কখন যে কোথায় দাঁড় করিয়ে দেবে যেখান থেকে এ জীবনে আর ফেরা যাবে না।

          এই যেমন বাবা - ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে আজ তিন বছর এভাবেই প্রতীক্ষা করছেন তার বাবর ঘরে ফিরবে। আর সারাদিন শত কাজের মাঝে যে ঘটনাটি ভুলে থাকে রাতে দরজা বন্ধ করতে এসে প্রতিদিনই এ বাড়ির বড় ছেলের হারিয়ে যাবার ঘটনাটা তার মনের ভিতর একটা বিষন্ন আবহাওয়া তৈরি করে যা বিছানায় অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও কাটতে চায় না। আর আলমগীরের কাছে তো এ প্রসঙ্গ তোলা যায় না। রাগে-দুঃখে সে এত বেশি ক্ষেপে উঠে যে হ্যাপির ভয় হয় সেও না পাগল হয়ে যায়!

          টেবিল ল্যাম্পের আলোটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন সরওয়ারডায়রিটা টেনে পাতা ওল্টালেন। গত কয়েকদিন দিনে এত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন যে রাতে ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়েন। যেদিন একটু ভাল বোধ করেন সেদিন আগের ক'দিনের ঘটনাগুলো লিখে রাখার চেষ্টা করেন। না হলে ভুল হয়ে যায়। তাছাড়া টাকা পয়সার হিসেবেরও কিছু ব্যাপার আছে। সেগুলো মনে রাখার জন্য লিখে রাখতে হয়।

          ডায়রিটা হাতে নিয়ে প্রতিদিন প্রথমপৃষ্ঠা থেকে একবার চোখ বুলান। ঘটনাগুলো দু-একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে লেখা কিন্তু পড়ার সাথে সাথে মনে পড়ে যায় সমস্ত ঘটনা।

          আজ সাতদিন ধরে বাবরকে খুঁজে পাচ্ছি না। প্রথমে ভেবেছিলাম গ্রামের বাড়িতে গেছে। সেখানে খোঁজ নিলাম - যায়নি। তারপর তার নানার বাড়ি, খালা-মামাদের বাসা, ঢাকা-চট্টগ্রাম, পটিয়া, নারায়ণগঞ্জ কোথাও কারো বাসায় যায়নি।

          অথচ সেদিন তার মায়ের মৃত্যুর তৃতীয়দিন। অন্যদিনের মত সে যখন বেরিয়ে গেল তখন কি তিনি ভাবতে পেরেছিলেন ছেলেটা এভাবে ঘর ছাড়বে। মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল।

          কিন্তু সে তো এক যুগের বেশি। কখনও কোথাও গিয়ে তিন দিনের বেশি থাকেনি। মায়ের কাছে ঘরেই ফিরে আসতনিজের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত সরওয়ার ছেলের দিকে কখনও মনযোগ দেননি বা দেবার অবকাশও পাননি। বরং সোমত্ত ছেলে নিজের দোষে মাথাটা গুলিয়ে অকর্মার ধাড়ি বনেছে বলে মাঝে মাঝে মা-ছেলেকে দুষেছেন।

          মা পারতপক্ষে ছেলেকে বাপের সামনে আসতে দিত না। ছেলেকে সামনে দেখলেই তার প্রতি শত অভিযোগ বাবার ভিতরে গুমরে উঠত আর সেটাই বকাবকি হয়ে মা-ছেলেকে যুগপৎ বিঁধত। মাঝে মাঝে বাবার মন ভাল থাকলে মা অনুযোগ করতেন - "ছেলেটা অসুস্থ। তুমি ওকে এত গালি-গালাজ না করলে হয় না? নিজের ছেলেকে মানুষ বাপ তুলে গালি দেয়! ও তো তোমার বড় ছেলে। মনে করতো তিন-তিনটে মেয়ের পর ও যখন হল তখন কতো খুশি হয়েছিলাম আমরা।"

          "সেই দুঃখেই তো মরি। বড় ছেলে! কোথায় আমার কাজ-কর্ম দেখবে। কন্ট্রাক্টরি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের ব্যবসাটাকে দাঁড় করালাম। ভাবলাম এবার ছেলে দেখবে। তা না - এত সাধের ছেলে আমার হল পাগল।"

          "আহ্‌! পাগল কেন বলছ? ওর সমস্যাটা মানসিক। ডাক্তার পাগল বলতে মানা করেছে"

          "রাখো তোমার ডাক্তার। পাগলকে পাগল বলব না তো কি পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করব? থাক্‌। তোমার সাথে কথা বলাই বিপদ। এমন হাউ হাউ শুরু কর যে পাড়ার লোক পর্যন্ত ঘুম ভেঙে জেগে উঠে।"

          বাবরের মা নাসিমা বেগম স্বামীর মুখ বন্ধ করার জন্য মাঝে মাঝেই বিছানা ছেড়ে ছেলের কাছে চলে যেতেন।

          সরওয়ার নিজেও আশ্চর্য হতেন পাঁচটা ছেলে-মেয়ে তার। ছোট ছেলেটা ইউনিভার্সিটি শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখছে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে ওই অসুস্থ ছেলেটাই যেন দিনে দিনে মায়ের আরো বেশি আপন হয়ে উঠেছিল। এ নিয়ে ঘরের সবার মধ্যেও এক ধরণের অসন্তোষ ছিল।          ছোট মেয়ে রুমা প্রায়ই বলত - "আম্মার অবস্থা দেখে মনে হয় সুস্থ হওয়ার চেয়ে পাগল হওয়াই ভাল। তাহলে মায়ের আদর বেশি পাওয়া যায় তাইনা রে ভাইয়া!!"

          খোঁচাটা খেয়েও বাবর হাসত। আবার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে সিগারেটের পয়সা না পেলে এই ছেলেই জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে একটা কান্ড বাঁধাত। তারপর নিখোঁজ।

          কিন্তু সেও তিনদিনের বেশি নয়। ফিরে এসে মায়ের পা ধরে মাফ চাইত। আর মা - হারানো ছেলে পেয়ে আকাশের চাঁদ পেত যেন। মা-ছেলের এ আদিখ্যেতা একদম পাত্তা দিতেন না বাবা। তাকালেন ডায়রির পাতায় লেখা -

          "আজ সাতদিন আমি জানি না আমার ছেলেটা কোথায়।"

          এক মাস কেটে গেছে থানায় এজাহার করে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আর আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করে। আত্মীয়ের আত্মীয়ের বাড়িতেও লোক পাঠিয়েছেন যদি তারা কেউ কিছু জানে। ছেলেটা নাকি নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে পরের বার তার বাড়িতেও হাজির হত। মাঝে মাঝে মা-কে বলত - "মা আমরা ছোটবেলা থেকে দাদার বাড়িতে যাই না কেন?"

          "তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর নেয় না কেন?"

          মায়ের কথা শুনে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে আরো সঙ্কুচিত ভাবে ছোট হয়ে বসার চেষ্টায় নিজেকে গুটিয়ে নিত।

          "তুমি যাচ্ছ তো বাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে। আর কারো যাবার দরকার আছে? যেটুকু মানসম্মান ছিল সেটার তো বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ। লোকে জানছে আমার ছেলে একটা পাগল।"

          "জানো মা, বাড়ির ঘরটা না একদম পুরনো হয়ে গেছে। বেড়াগুলো ভাঙা, আর টিনের চালটায় অনেক ফুটো" - বাবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মাকে কথাগুলো বলত।

          মা সঙ্গে সঙ্গে আশ্বাস দিতেন - "তুই ভাল হয়ে যা। তাহলে আমরা গিয়ে নতুন ঘর তুলব।"

          "না মা, দাদার ঘরটাই ভাল। ওটা মেরামত করব।"

          "বাহ্‌ খুব বুদ্ধিমানের মত কথা। ভালো ভালো -" বলে বিদ্রুপ করে উঠে পড়তেন বাবা।

          আসলে আর বসতে ইচ্ছে করত না। বাড়ির কথা উঠলেই একটা পলায়নী প্রবৃত্তি জেগে উঠে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর ফুপুর বাড়িতে থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে নিজেদের মফস্বল শহর থেকে এই চট্টগ্রাম শহরে পালিয়ে এসেছিলেন।

          ফুপুর দেবরের ছেলে তখন শহরের বড় কন্ট্রাক্টর। চাকরির দিকে না গিয়ে তারই হাত ধরে একটু একটু করে ব্যবসা শিখে নিজের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। সেই যে নাগরিক মানুষ হয়ে গেলেন আর গ্রামে ফিরে যান নি। অবশ্য অন্য কারণও ছিল। বাড়িতে গেলে সংসারের দায়িত্ব নেয়ার প্রশ্ন উঠত। ছোটবেলা থেকে টানাটানির সংসারে হিসেব করে চলতে চলতে হিসেবটা ভালই শিখেছিলেন।

          সংসারের সবার জন্য খরচ করতে মন চাইত না। বাবা-মায়ের খরচটাও যতটা না দিলেই নয় ততটাই দিতেন। আর ঘরে যাকে এনেছিলেন তার সবার জন্য প্রাণ কাঁদত বলে আত্মীয়দের আরো বেশি এড়িয়ে চলতেন। নাসিমা বেগম আপন-পর ভাবতেন না। আর একটু বড় হতেই দেখেছিলেন ছেলেটাও স্বভাবে মায়ের মতো। যাদের দেখেনি সেইসব আত্মীয়দের দেখতেও কোথায় কোথায় চলে যায়। শুধু এত আকাঙ্ক্ষিত সন্তান হয়েও বাবার সাথে ছিল তার জন্মের দূরত্ব।

          আজ এক মাস কোথাও পেলাম না বাবরকে। আপনজনকে চিনতে পারিনি বলে কি আমার ছেলেই আমাকে পর করে দিল? কোথায় সে? কোথায় পাবো তারে?

          সরওয়ার পাতা উল্টালেন -

          দু'মাস সতের দিন হল বাবর হারিয়ে গেছে। না, হারিয়ে গেছে বলা ভুল হবেচলে গেছে। আমার ওপর অভিমান করে চলে গেছে। ওর মায়ের মৃত্যুর পর হয়তো মনে হয়েছে আমরা কেউ ওর আপন নই। যে ছিল তার সবার চেয়ে আপন সে চলে যাবার পর আর ঘরে ফিরতে মন চায় নি।

          ডায়রি থেকে চোখ সরিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালেন। দেয়ালের ঘড়িটা টিক্‌টিক্‌ শব্দে সময় জানিয়ে যাচ্ছে। রাত দুটো বেজে দশ মিনিট। সরওয়ার উঠে দাঁড়ালেন। ঘরময় একবার পায়চারি করে জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন।

          পাড়ার নাইটগার্ডদের হুইসেলের শব্দ আর রাতজাগা কুকুরের চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতাকে যেন মাঝে মাঝে ফুঁড়ে খান খান করে দিচ্ছে। রাতের পালার দারোয়ান গেটের কাছে টুলে বসে ঝিমাচ্ছে।

          বাবর চলে যাওয়ার বারোদিনের মাথায় রাতের পালায় আরেকজন পাহারাদার রেখেছেন গেটের দরজাটা খোলা রাখার জন্য। ভাড়াটেরা আপত্তি জানিয়েছিল। কারো আপত্তি শোনেননি। বরং অনুরোধ করেছেন - "আপনারা নিরাপদ বোধ না করলে অন্য কোথাও যান। আমি এ বাড়ির দরজা বন্ধ করতে পারব না আমার ছেলে ফিরে না আসা পর্যন্ত।"

          পাতা উল্টিয়ে যান সরওয়ার -

          আজ সাড়ে তিন মাস আমার স্ত্রী গত হয়েছেন। স্ত্রী-শোক ভুলে গেছি কিন্তু পুত্র-শোক ভুলতে পারছি না। ব্যর্থ এক পিতা আমি। প্রিয় সন্তান আমাকে পর ভেবে ঘর ছেড়েছে - এ কষ্ট আমি ভুলি কী করে?

          মনে পড়ছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার পর একজন ফোন করে বলেছিল এরকম একটা লোককে সে পাগলা শাহ্‌র মাজারে দেখেছে।

          হঠাৎ মনে হয়েছিল একথাটা এতদিন মনে পড়েনি কেন? অসুস্থ হবার পর তার মা-তো ছেলেকে নিয়ে মাজারেও কম ধরনা দেয়নি। সত্যি সত্যি মাজারে যায়নি তো!

          প্রায় তিন সপ্তাহের মতো সারা দেশের মাজারে ঘুরেছেন। পেছন থেকে কতজনকে বাবর মনে হয়েছে, তারপর মুখ ফিরাতেই চূড়ান্ত হতাশা। যেন শিখর থেকে গহ্বরে পতন। কত ঘরভোলা পাগলকে খুঁটিয়ে দেখেছেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তারপর আবার সেই বুকভাঙা কষ্ট নিয়ে ঘরে ফেরা।           নাসিমা বেঁচে থাকলে হয়তো এ কষ্ট ভাগাভাগি করে নেয়া যেত। কিন্তু সে তো গম্যের বাইরে। তাছাড়া সে থাকলে তো তার এই পাগলটাকে নয়নের মণি করে রাখত।

          আজ রাঙামাটি গিয়েছিলাম - পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল।

          মনে পড়ল পাড়ার এক দোকানি বলেছিল রাঙামাটিতে একজন বড় গুণীন আছে। তার কাছে তদবীর করালে ভাল ফল পাওয়া যায়।

          হ্যাঁ, গিয়েছিলেন সেই দোকানিকে নিয়ে। অদ্ভুত এক কাজ করতে হয়েছিল। দোকান থেকে কাঁচা মাংস কিনে সেই মাংস গুণীনকে দিয়ে মন্ত্রপূত করে একটা কুকুরকে খাওয়াতে হয়েছিল। অন্যসময় অন্য কেউ হলে হয়তো তিনি নিজেও এটা নিয়ে হাসাহাসি করতেন। কিন্তু সেদিন কুকুরকে মাংস খাওয়াতে খাওয়াতে আল্লাহ্‌কে ডেকেছিলেন মনস্কামনা পূরণের জন্য। কিন্তু না, কিছুই হয়নি। সব প্রার্থনা মিথ্যে হয়েছে। তবু যাচ্ছেন, খুঁজছেন।

          তিন বছর হয়ে গেল। তুকতাক দোয়াতাবিজ নিখোঁজ সংবাদ প্রচার কতকিছুই তো করলেন। মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলের মতই যেদিকে দু'চোখ যায় বেরিয়ে যেতে - দেশের প্রতিটা ঘরে, প্রতিটা কোণে, প্রতিটা লতা-পাতার নিচে খুঁজে দেখতে। কিন্তু এই বয়সে যে সে শক্তি নেই।

          তবু আমি তোকে খুঁজব। তোর অপেক্ষায় বসে থাকব। তুই শুধু একবার আয়। আর কখনও তোকে দূর দূর করব না। তুই যে আমার প্রাণের ধনরে বাপ। দেখিস না তোর জন্য আমি দরজা বন্ধ করি না। তুই যদি বন্ধ দরজা দেখে ফিরে যাস -  

          খস খস করে লিখতে থাকেন। তার দু'চোখে জলের ধারা।


রিফাৎ আরার ছোটগল্প - ক্রোধ

__________________________________________

রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র

গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪

গল্প - ক্রোধ
__________________________________________

ক্রোধ

 

শেফালীকে আমি কখনও অন্যরকম ভাবিনি। আর দশটা কাজের বুয়া যেমন সেরকমই আটপৌরে সাধারণ। চার বছর আগে আমার যখন কাজের বুয়া ছিল না তখন এলাকার সাইদের মা ওকে এনে দিয়েছিল।

          তখন জেনেছিলাম ওর স্বামী জেলে আছে। শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম - চোর ডাকাত ঘরে ঢুকাচ্ছি না তো? সাইদের মাকে বলেছিলাম - "দেখ বাপু, আমি অত সামলে সুমলে জিনিস রাখতে পারি না। চাবিটা আলমারির ডালার সঙ্গেই ঝুলে। চোর-টোর হলে তো বিপদ।"

          সাইদের মা অভয় দিয়েছিল - "না খালা। এমন হইলে কি আপনেরে দিমু?"

          এটা সত্যি। এই এলাকায় বাসা নেবার পর থেকে আমার বাড়িওয়ালি আপা সাইদের মাকে ডেকে পরিচয় করে দিয়েছিল। তারপর থেকে আজ প্রায় এগারো বারো বছর বাসার কাজের বুয়া সাইদের মা-ই জোগাড় করে দিয়েছে। শেফালীকে নিয়ে এ আমার তিন নম্বর বুয়া।

          শেফালী প্রথম এসেই আমাকে বলল - "খালাম্মা, আমারে মাঝে মাঝে ছুটি দেওন লাগব

          মনে মনে একটু রাগ হল। কাজ না নিতেই ছুটি! কিছুটা প্রশ্নবোধক চোখে ওর দিকে তাকাতেই বুঝে নিল।

          "হ খালাম্মা। আমার একটু জেলখানায় যাওন লাগে। আবার মাঝে মাঝে কোর্টে যাইতে হয়। পোলার বাপের মামলার তারিখ থাকে।"

          আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, "সে দেখা যাবে"।

          গত এক মাস কোন মানুষ না পেয়ে যা কষ্ট গেছে তাতে যে কোনরকম শর্তই আমি মানতে রাজি।

          মনে আছে অনেক আগে একবার এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। দেখলাম সকালে নাস্তার পর সে কাজের ছেলেকে দশ পয়সা করে দেয়। আর ছেলেটা বাইরে যায়। জিজ্ঞেস করতে বন্ধু বলেছিল, বিড়ি খাবার পয়সা দেয়। চাকরির শর্তে এটাই ছিল।

          আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম - "এমন শর্ত মানলি?"

          "না মেনে উপায় ছিল না। কাজ করতে করতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তখন কেউ এসে যদি বলত - আমাকে মদ খেতে দিলে কাজ করবো আমি তাতেও রাজি হতাম।"

          রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওর সাথে আমার টুকটাক কথা হত। তাতে জেনেছিলাম ওর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই স্বামীর ঘরে ওর একটা ছেলে আছে। এক বছর সংসার করার পর সেই লোক নিখোঁজ।

          তিন বছর তার অপেক্ষায় থেকে তারপর সে দ্বিতীয় স্বামী নিয়েছে। এখানেও কিছু ফাঁকি ছিল। ওর দ্বিতীয় স্বামী - মাবুদ যার নাম তারও আগের সংসারে একটা মেয়ে আছে। কিন্তু সে সেটা গোপন করে গেছে। জানার পর শেফালী এটাকে কাটাকুটি হিসেবে নিয়েছে। কারণ - "আবিতি বেডায় তো আর আমারে বিয়া কইরব না। তাই না খালা?"

          ও যা বলত আমি খুব কমই 'না' বলতাম। কারণ 'না' বললে কথা বাড়ে। আর ও একবার কথা শুরু করলে থামতে চায় না। তবে সাইদের মা'র কথা সত্যি। মানুষটা বিশ্বাসী। যদিও খুব চাওয়ার বাতিক তবু হাত নাড়ে না বলে দিতে খারাপ লাগে না।

          আমি শেফালীর কাছে জেনেছি নারী নির্যাতনের মামলায় ওর স্বামী জেলে আছে। এই মামলা খুবই সাংঘাতিক। একবার প্রমাণ হলে শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু এখনো মামলা চলছে। শেফালী বিশ্বাস করে না তার স্বামী এমন কাজ করেছে। কারণ মাবুদ তাকে কসম খেয়ে বলেছে সে এমন কাজ করেনি। আর ওই মেয়ে তাকে মামা ডাকত। মেয়ের বাবা টাকার জন্য তাকে এই ফাঁদে ফেলেছে। বিশ হাজার টাকা দাবি করেছিল কিন্তু মাবুদ দিতে অস্বীকার করায় তার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা মামলা।

          এরকম কি ঘটতে পারে? আমি বুঝি না। পত্র-পত্রিকা পড়ে আর রেডিও টেলিভিশনের খবর শুনে শুনে আজকাল বিশ্বাসের ভিত বড় নড়বড়ে হয়ে গেছে। কে যে সত্যি আর কে যে মিথ্যা বলছে বুঝতে পারি না। সব কেমন গোলক ধাঁধার মত লাগে। আগে যেমন চোর-ডাকাত আর ভালমানুষ আলাদা করা যেত এখন তেমনটা নয়। মনে হয় সবাই চোর-ডাকাত আবার সবাই ভাল।

          এই যে শেফালী বলছে তার স্বামী অপরাধ করেনি - এটা সত্যিও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। একই নামের মানুষ হওয়ার কারণে বহু নিরপরাধ লোকও দীর্ঘ মেয়াদে জেল খাটার খবর আমরা পত্রিকায় টিভি-রিপোর্টে দেখি। শেফালীর কথা শুনে আমি তাই সন্দেহের দোলায় দুলি। অনেকে এমন কি আমার ভাইবোনেরা শুনে বলে - 'ধুর! আপা তুমি যে কী! দোষ না করলে এমনি এমনি জেলে যায়?"

          আমি তবু বলি - "যায় তো। মাঝে মাঝেই তো খবরে আসে।"

          "হ্যাঁ আসে। আর তুমিও যেমন শুনে ওটা নিয়ে থাকো। তবু তুমি বাপু সাবধানে থেকো।" - আমার ছোটবোন জুলি আমাকে সতর্ক করে।

          শেফালী যত টাকা আয় করে তার বেশির ভাগ স্বামীর মামলার জন্য খরচ করে। আমার বাসা ছাড়াও আরো দুটো বাসায় সে কাজ করে। এত কাজের খাটুনিতে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন ওর ছোটবোন দুটোর একটাকে পাঠায়। আমি ওদের কাছে অনুযোগ করি - "এভাবে না খেয়ে পয়সা ছড়ালে কি ওর স্বামী ফিরে আসবে? মাঝখান থেকে টাকাগুলো সব জলে যায়।"

          এলাকার আবাসিক পল্লীটা অনেক বড়। ঈদের সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে জাকাতও কম পায় না। কিন্তু সব তার যায় উকিল আর মুহুরির পেটে। আর উকিলগুলো কেমন জানি না। দেখছে গরীব মানুষ তবু মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে মামলা চালিয়ে যাবে। ওর ছোটবোন বকুলও বলে - "হ খালা, বুবুরে কত কই। হে কারো কথা শুনে না। জামাই থাকতে কাম করে নাই। সি-এন-জি চালাইত। ভালাই খাইত পরত। এখন ব্যাডায় আশা দেয় হে বাইর অইলে বইনের আর কাম করি খাইতে অইব না। হের লাইগা কষ্ট করে।"

          "আসলে দোষ করেছে কি না এটাও জানা দরকার" - বলতে গিয়েও বলি না। থাক্‌, ওদের ভালমন্দ ওরাই বুঝবে।

          মাঝে মাঝে সকালে এসেই ঘোষণা দেয়, "খালা আইজ একটু ত্বরা কইরা কাম সারমু।"

          আমি বুঝতে পারি আজ সে জেলখানায় যাবে। অথবা কোর্টে উকিলের মুহুরির কাছে। খুব খারাপ লাগে। তিন বাসায় কাজ করে আবার দুপুররোদ মাথায় নিয়ে তাকে ছুটতে হবে কোর্টে।

          আমাদের এই শহরে বাস সার্ভিস নেই। রিক্সাভাড়া দিয়ে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ভরদুপুরে তাই হেঁটে সে একবার কোর্টপাড়ায় যায় আবার আসে।

          তবে যেদিন জেলখানায় যায় তার পরদিন তাকে বেশ চাঙা লাগে। সুযোগ পেলেই গল্প জুড়ে দেয়। আর সবকিছু ছাপিয়ে গল্পে যেটা প্রধান হয়ে ওঠে সেটা হচ্ছে - স্বামী বলেছে সে বের হয়ে এলে তাকে আর কাজ করতে দেবে না। একমাত্র মেয়ে যাকে সে বাপ নেই বলে এতিমখানায় দিয়ে রেখেছে তাকেও নিয়ে আসবে।

          আমি তাগাদা দিই। তাকে আরো দুটো বাসায় কাজ করতে যেতে হবে মনে করিয়ে দিই। এসব গায়ে না মেখেই সে গল্প করে যায়।

          মামলা কোর্টে ওঠার আগে কয়েকদিন শেফালী খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার স্বামী বলেছে মেয়েটার সাথে দেখা করে একটা আপোস করার চেষ্টা করতে। শেফালী বোঝাতে চেষ্টা করেছে নির্দোষ হলে আপোসের কী দরকার। তবু কদিন থেকে মেয়েটার খোঁজে শহরের বস্তিগুলোতে ঘুরছে শেফালী

          হন্যে হয়ে মেয়েটাকে খুঁজছে সে। তারা আগে যে বস্তিতে ছিল এখন সেখানে থাকে না। ঠিকানা ছাড়া এভাবে মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়? তবু সকালে এসে বড় কাজগুলো করে ছুটি নিয়ে যায়। নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। এ ক'দিনেই কেমন শুকিয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য  একেকদিন এক একটা বস্তিতে হানা দিচ্ছে।

          এভাবে মানুষ খুঁজে পাবে? - আমি প্রশ্ন করি।

          "পাইমু। একদিন না একদিন পাইমু। তাছাড়া ওরা নদীভাঙা মানুষ, যাইব কই? বাপটাও ল্যাংড়া-লুলা, আমার মাইয়ার বাপের লগে পরিচয় হওনের পর হেও মাঝে মাঝে সাহায্য করত। ছোড থাকতে আমাগো ঘরেও কয়েকবার আইছে। আমার স্বামীরে মামা ডাকত, আমারে মামী। আমি হেই মাইয়ারে খুঁইজ্যা বাইর করমু আপনে দেইখেন।"

          ওর সাথে সাথে আমিও অপেক্ষায় থাকি একটা ঘটনার পরিসমাপ্তি হবে। শেফালী ওর স্বামীকে ফেরত পাবে। আকন্ঠ ঋণের যে বোঝা বহন করতে হচ্ছে সে ঋণ থেকে মুক্তি পাবে। যদিও সে আমার কাজ করবে না এটা আমার জন্য দুঃসংবাদ তবু আমার ভাল লাগে এই ভেবে যে সমাজে স্বামীর কারণে সে দশজনের কাছে যে হীন হয়ে আছে তার থেকে মুক্তি পাবে।

          সেদিন সকালে যখন শেফালী এল তখন ওর গলায় খুশির আভাস - "মাইয়াডারে পাইছি খালা।"

          "আচ্ছা" - আমিও খুশি হই - "কীভাবে খুঁজে পেলে?"

          "আপনেতো জানেন আমি গত তিন মাস ধইরা সবগুলা বস্তি তন্ন তন্ন কইরা খুঁইজতাছি। কাইল রেললাইনের উত্তরপাশে মেথরপট্টির কাছে বস্তিতে যাইয়া দেখি মাইয়া উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। আমি তো বোরকা পইরা গেছিলাম। চিনতে পারে নাই। তারপরও অচিনা মানুষ দেইখ্যা দৌড় দিয়া ঘরে ঢুইকা গেল। আমি পরিচয় দিই নাই। আইজ আমার ভাইয়েরে নিয়া যামু। সইন্ধাকালে যামু যেন ঘর থেইকা কোন দিকে যাইতে না পারে।"

          শেফালীর ঘটনাটা আমার ভিতরেও কৌতূহল তৈরি করে। একটা রোমাঞ্চকর ঘটনার মত মনে হয়। সন্ধ্যায় বার বার মনে হয় - ও কি পারল মেয়েটাকে ধরতে?

          আমাকে হতাশ করে দিয়ে ও পরদিন এল না। দু'দিন পরে শেফালী যখন এল তখন আমার হবাক হওয়ার পালা। এ দু'দিনেই ও যেন অনেকটা বুড়িয়ে গেছে। এই প্রথম চোখে পড়ল ওর কপালের কাছে দু-তিনটি পাকা চুল।

          এলোমেলো বিধ্বস্ত শেফালী কিন্তু এসেই কাজে হাত দিল। আমার দিকে একবারও তাকাল না। নাস্তা খাওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। অন্যদিন এসময়ে চা খেতে খেতে আমাদের দু'জনের কিছু কথা হয়। দীর্ঘদিন একসাথে কিছুসময় সহাবস্থানের কারণে আমাদের এক ধরণের প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কখনো কখনো আমরা বাজারদর থেকে দেশের রাজনীতি নিয়েও আলাপ করি। এই আবাসিক পল্লীর অনেক মানুষ সম্পর্কে ওর কাছে শুনে শুনে আমি না চিনেও চিনি।

          একটু পরে রান্না-ধোয়ার কাজ গুছিয়ে অন্য বাসায় চলে যাবে। কিন্তু আমার জানা হলো না - কী হল তার মিশনের।

          নিচু হয়ে ফ্রিজ থেকে সবজি নিচ্ছিল আর তখনই আমি ওর পিঠে হাত রাখি - "কী হয়েছে শেফালী? তোমার সেই কাজ কদ্দুর হল? মেয়েটা কি রাজি?"

          হু হু করে কেঁদে ফ্রিজের সামনেই ও বসে পড়ল। আমি ওকে টেনে সামনে নিয়ে আসি। ফ্রিজের ডালাটা বন্ধ করে ওর সামনে মাটিতে বসে হাতটা ধরি।

          শেফালী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এক সময় হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলে - "ঘটনা সত্য খালা।"

          "কী ঘটনা?"

          "আমার স্বামী মাইয়াডারে নষ্ট করতে চাইছিল।"

          "অ্যাঁ?" - আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে।

          "হ খালা। মাইয়া নিজের মুখে আমারে কইছে। কইল মামী, মামারে আমি ভালামানুষ জানতাম। ছোডো থেইকা দেখছি। মাঝে মাঝে টেক্সি রাইখা আমাগো ঘরে ঘুমাইত। আমার লাইগা এডাসেডা আনত। কিন্তু হেদিন মা যখন কামে গেল আর আব্বায় ভিক্ষা করতে - তখন মামা আইসা ঘরে ঘুমাইতে গেল। আমি বাইরে থেকে আইসা ঘরে ঢুইকা ভাতের চাইল নিতে টিনে হাত দিছি তখন পিছন থেইকা আচমকা আমারে জাপটাই ধরে। মুখ চাইপা ধইরা আমারে বিছানায় নিতে চায়। আমি মামার হাত থেইকা ছুইটা বেড়ায় গোঁজা দাওটা লইয়া আচমকা মামার ডাইন হাতে একটা কোপ মারি। মামা চিৎকার কইরা উঠলে বাইরে থেইকা সবাই ছুইটা আইসা মামারে ধরে।"

          শেফালী চুপ করে। একটানা অনেক কথা বলে হাঁপিয়ে গেছে। আমি বলি "মেয়েটা যে সত্যি বলছে তার কী প্রমাণ?"

          "আছে আছে পরমাণ। অর হাতটা তখন কাটা আছিল। আমারে কইছিল একসিডেন্ট করছে। অখন বুঝতাছি ঘটনা মিল্যা গেছে। হে আমারে মিছা কতা কইছিল। ছি থু!"

          ঘৃণায় শেফালী কুঁচকে যায়। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানতে চাই - "তাহলে এখন কী করবে? শেফালী এবার সোজা আমার দিকে তাকায়। "কিচ্ছু করুম না। থাক পঁচুক জেলে। ওর শাস্তি হওনের দরকার। আমি আদালতে জজসাবরে কমু ওরে আরো বেশি শাস্তি দ্যান।"

          "কিন্তু মেয়েটা যে সত্যি বলছে তার প্রমাণই বা কী? তাছাড়া তোমার এতগুলো টাকা -"

          শেফালী আচমকা দাঁড়িয়ে গেল।

          "নিজের ইজ্জত নিয়া কোন্‌ মাইয়া মিছা কতা কইতে পারে? আমার নিজেরও একটা মাইয়া আছে। তারে যদি কেউ এমন করে আমি কি তারে ছাড়ুম! গরীব মানুষগুলান ইজ্জতের ভয়ে বস্তি ছাড়ছে। মাইয়াডা পালাই পালাই বেড়ায়। তারপরেও কইবেন মিছা?"

          আমাকে অবাক করে শেফালী বলে - "আমি অরে তালাক দিমু। আমার আর স্বামীর দরকার নাই।"

          আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি - এ কোন্‌ শেফালী? এই প্রতিবাদী নারীটিকে কি আমি চিনি?


Latest Post

রিফাৎ আরার ছোটগল্প - স্বপ্নের ঠিকানা

__________________________________________ রিফাৎ আরা রচনাসমগ্র গল্পগ্রন্থ - জীবনের গল্প ।। মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪ গল্প - স্বপ্নের ঠিকানা _...

Popular Posts