Wednesday 31 January 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর ৩

 


“I travel not to go anywhere, but to go. I travel for travel’s sake. The great affair is to move.” রবার্ট লুই স্টিভেনসনের এই কথাগুলি আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয় আমার মনের কথা তিনি বলে গেছেন আমার জন্মের শত বছর আগে -  আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। ভ্রমণে আসার সময় তাই দ্রষ্টব্যের কোন নির্দিষ্ট তালিকা থাকে না আমার। যে কোনো নতুন জায়গায় নতুন পথ হেঁটে আমি যে আনন্দ পাই – তার সাথে অন্য কোনকিছুর তুলনা চলে না। আজ সারাদিন হেঁটে বেড়িয়েছি কলম্বোর পথে পথে।

হোটেলে ফিরেছি একটু আগে। পথ চিনতে সমস্যা হয়নি। রাস্তার নাম পড়ারও দরকার পড়েনি। সকালে বের হবার সময় আশেপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম এই ব্লকে এই হোটেলটাই সবচেয়ে উঁচু। ফেরার পথে সেটাই কাজে লেগেছে। দূর থেকে লাইটহাউজের কাজ করেছে আটাশ তলা বিল্ডিং-এর মাথায় চারদিকে লাগানো “সিনামন রেড”-এর টকটকে লাল জ্বলন্ত অক্ষরগুলি।

শ্রীলংকানরা নাকি খুবই নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন করে। কালচার শক সিরিজের বইগুলিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রীতিনীতি সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা থাকে। সেখানেই পড়েছিলাম শ্রীলংকানরা আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ টাইপের। মেলবোর্নে আমার পরিচিত যে ক’জন শ্রীলংকান আছে, তাদেরকে অবশ্য সেরকম নিয়মনিষ্ঠ বলে মনে হয় না। এখানেও আর্লি টু বেডের তেমন কোন জোরালো প্রমাণ দেখলাম না। রাত সাড়ে দশটাতেও কলম্বো শহরের রাস্তাগুলি ব্যস্ত, খাবারের দোকানে ভীড়, আর শহরের যে পাশে এসে মিশছে ভারত মহাসাগরের ঢেউ, সেখানে এখনো আনন্দমুখর মানুষ কোলাহলে মত্ত।  

অবশ্য শহুরে মানুষের জীবনযাপন সারাদেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না কিছুতেই। বিশেষ করে তা যদি হয় শ্রীলংকার মতো উন্নয়নশীল কোনো দেশ। এই কলম্বো শহরের আয়তন মাত্র ৩৭ বর্গকিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। আর এই শহরটি সারা পৃথিবীর পর্যটকদের এতই প্রিয় যে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ লাখের বেশি পর্যটক এখানে থাকে। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় সাড়ে তের হাজার মানুষ বাস করে এই শহরে। ঢাকার সাথে তুলনা এসেই যায়। ঢাকা কলম্বোর চেয়ে প্রায় দশ গুণ বড় শহর। আজ একদিন ঘুরেই কলম্বো শহর মোটামুটি দেখে ফেলেছি। অথচ শুরুতে আমি কলম্বোতেই পুরো সাত দিন থাকার প্ল্যান করেছিলাম।

কনিষ্ককে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। সে-ই আমাকে জোর করে প্ল্যান বদল করিয়েছে। বলেছে কলম্বোতে সাত দিন ধরে দেখার কিছুই নেই। তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ক্যান্ডি, এল্লা, ডামবুল্লা।

কনিষ্ক আমার মেলবোর্নের প্রতিবেশী। কয়েক বছর থেকেই সে বলছিল শ্রীলংকায় বেড়াতে যাবার জন্য। প্রসঙ্গ উঠলেই ঘ্যান ঘ্যান করতো - শ্রীলংকা কত সুন্দর, কত কিছু দেখার আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজের দেশ সম্পর্কে আমরা নিজেদের মধ্যে যতই সমালোচনা করি না কেন, অন্যদের কাছে নিজের দেশকে সবসময়ই স্বর্গের সাথে তুলনা করি। সেহিসেবে কনিষ্কের কথায় শুরুতে আমি স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা গুরুত্ব দিইনি।

তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম অজিতকে। সে কাজের সূত্রে অনেকবার ঢাকা থেকে কলম্বো গেছে। সে বললো, “ওখানে সমুদ্র ছাড়া আর দেখার কিছুই নেই। যেদিকেই হাঁটবি – সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছাবি। সমুদ্রের পাড়ে বসে বসে হাওয়া খাবি, ডাব খাবি, আর সন্ধ্যা হলে হোটেলে ফিরে আসবি।“

“শ্রী লংকায় আর কিছু নেই?” আমি কিছুটা হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

“আর কী থাকবে? বানর আছে, হাতি আছে। আর রত্নপুর নামে কলম্বো থেকে কিছু দূরে একটা জায়গা আছে – যেখানে রত্ন-টত্ন-পাথর-টাথর পাওয়া যায়। তুই যদি ওসব কিনতে চাস – তাহলে ওখানে যেতে পারিস।“

“রত্ন-টত্ন-পাথর-টাথর”-এ আমার কোন আকর্ষণ নেই, কৌতূহলও নেই। সুতরাং ওখানে যাবার দরকার নেই। তবে শ্রীলংকার পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করার খুব ইচ্ছে আছে। সে হিসেবে মোটামুটি একটা প্ল্যান করে এসেছি - দু-রাত কলম্বোয়, দু-রাত ক্যান্ডিতে, এক রাত এল্লায় আবার ফেরার পথে দু’রাত কলম্বোতে।

কলম্বোর প্রথম রাতের ঘণ্টাখানেকও পাইনি। হোটেলে পৌঁছাতেই ভোর হয়ে গেছে। একটা ক্লান্তিনিবারণী হট শাওয়ার নিয়ে এলিয়ে পড়েছিলাম বিছানায়। শুয়ে শুয়ে ভোরের কলম্বো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ইতিহাস।

সামনে টলটলে নীল পানির যে হ্রদ দেখা যাচ্ছে – তার পাড়ে বিশাল বিশাল আম গাছের সারি। কলম্বো নামের সাথে আছে আম গাছের নিবিড় সম্পর্ক। শ্রীলংকানরা আমকে বলে আম্বো। আর কোলা হলো যে গাছে প্রচুর পাতা হয়, কিন্তু ফল হয় না। এখানে অনেক আম গাছে প্রচুর পাতা হয়, কিন্তু ফল হয় না। সেই নিস্ফলা-আমগাছ ‘কোলা-আম্বো’ থেকে হয়েছে কলম্বো। 

কত দীর্ঘ ঝড় ঝাপটা টানাটানি গেছে এই শহর এই দ্বীপ নিয়ে। মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমে আর ভারত মহাসাগরের উত্তরে বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়েও কম আয়তনের  অশ্রুবিন্দুর মতো এই ছোট্ট দ্বীপটিকে পশ্চিমারা আদর করে নাম দিয়েছে ‘ইন্ডিয়াস টিয়ারড্রপ’। দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর শ্রীলংকার দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার। আবার এই দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যারা মুগ্ধ হয়েছেন – তাদের কাছে এর নাম হয়েছে ‘পার্ল অব দি ইন্ডিয়ান ওশেন’ – ভারত মহাসাগরের মুক্তা।

মণি-মুক্তার প্রতি মানুষের লোভ সাংঘাতিক। সেই লোভের বশবর্তী হয়ে ভারত মহাসাগরের মুক্তার মতো সুন্দর এই দ্বীপের দখল নিতে হামলে পড়েছে যুগে যুগে অনেকেই।

প্রায় দশ হাজার বছর আগে থেকে এই দ্বীপে আদিবাসিরা বাস করে আসছে। প্রস্তর যুগের মানুষের বসবাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে এখানে। সাড়ে নয় হাজার বছর নিজেদের মতো বাস করেছে তারা – দলভুক্ত গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ যেভাবে বাস করতো। ভারতবর্ষের এত কাছাকাছি দ্বীপ হওয়ার কারণে ভারতবর্ষ থেকে অনেকবার অনেকে দখল করে নিয়েছিল এই দ্বীপভূমি। ইতিহাস সেই সব দখলদারদের সেভাবে মনেও রাখেনি। রামায়ণ রচিত হয়েছিল যেই সময় – সেই সময় রামায়ণে এই দ্বীপের নাম লংকা হলেও – এই দ্বীপের সাংবিধানিক নাম শ্রীলংকা হয়েছে মাত্র সেদিন - ১৯৭২ সালে।

ইতিহাস যে রাজাকে মনে রেখেছে তার নাম বিজয় সিংহ। ক্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালে ভারত থেকে এখানে এসে তিনি রাজা হয়ে বসেন। বলা যায় – তখন থেকে এই দ্বীপের নাম হয় সিংহল, ভাষার নাম হয় সিংহলি। বর্তমানে বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য হলেও গৌতম বুদ্ধ কখনো এই দ্বীপে আসেননি। এই দ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং প্রভাব শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ থেকে ২১০ সালের মধ্যে। ভারতের সম্রাট অশোকের আমলে। তিনি ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের সিংহলে পাঠিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং প্রসার ঘটান।

পনের শ সাল পর্যন্ত অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে এই দ্বীপের সম্পদ আহরণের লোভে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা বিভিন্ন শাসকের মধ্যে। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজরা এলো এই দ্বীপের দারুচিনির লোভে। ততদিনে বিশ্বজোড়া নাম হয়ে গেছে দারুচিনি দ্বীপ – উন্নত মানের দারুচিনির প্রভূত উৎপাদনে। পর্তুগিজরা দ্বীপের চারপাশের সবকিছু দখল করে নিজেদের দুর্গ তৈরি করে ফেললো। ক্ষমতা দখলের পর চলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তৈরি হতে থাকে গীর্জার পর গীর্জা। লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে চলে ধর্মান্তর।

প্রায় দেড়শো বছর ধরে চলে পর্তুগিজদের শাসন শোষণ সম্প্রসারণ। এরপর আসে ওলন্দাজরা ১৬৫৬ সালে। পর্তুগিজদের হটিয়ে তারা দখল নেয় এই দ্বীপের। দামী মসলার রপ্তানী বাজার চলে আসে ওলন্দাজদের হাতে। কেটে যায় আরো ১৪০ বছর। ১৭৯৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাচদের হটিয়ে দখল নেয় সিলনের। পুরো ভারতবর্ষ তখন তাদের দখলে। ব্রিটিশ রাজত্ব চলে ১৯৪৮ পর্যন্ত। মূলত ব্রিটিশ আমলেই আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় সিলন।

ঘন্টা চারেকের একটা ঘুম দিয়ে উঠলাম। জেটল্যাগের জট পাকিয়ে গেছে। সময় পিছিয়ে গেছে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। এখানে সকাল সাড়ে দশ হলেও শরীরে বিকেল চারটার ক্লান্তি। কিন্তু ক্লান্তিকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম।

লিফ্‌টে দেখা হলো একজন শ্বেতাঙ্গ ইওরোপিয়ানের সাথে। বুড়ো আমাকে দেখেই সহাস্যে মাথা নেড়ে বললেন, “আয়ুবাওয়ান”। ভদ্রলোক নিশ্চয় আমাকে শ্রীলংকান মনে করেছেন। শ্রীলংকান শব্দ মুখস্ত করে মুগ্ধ করতে চাচ্ছেন। আমিও মাথা নেড়ে বললাম, “আয়ুবাওয়ান”। সিংহলি এই শব্দটির অর্থ ওয়েলকাম গুডবাই দুটোই হতে পারে। আমার বাংলা-কানে হঠাৎ শুনলে মনে হয় ‘আয়ু বাড়ান’।

হোটেলের বাইরে পা দিয়েই বুঝলাম চামড়া পুড়ে যাবার মত গরম এখানে। যেমন গরম, তেমন আর্দ্র আবহাওয়া। বাংলাদেশে এপ্রিল মে মাসে এরকম আর্দ্রতা থাকে। এখানে নাকি সারা বছরই এরকম - শুধুমাত্র দুটো ঋতু – গ্রীষ্ম এবং বর্ষা। এখন গ্রীষ্ম চলছে – অর্থাৎ বৃষ্টি তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হবে।

নতুন শহরে আমি যেদিকে দুচোখ যায় – চলি। রাস্তা ঝকঝকে না হলেও মোটামুটি পরিষ্কার। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার বদভ্যাস নেই এখানকার মানুষের। কিন্তু প্রচুর গাছপালায় ঢাকা ফুটপাত – পাখিদের মলে মলাকার। গাছের নিচ দিয়ে ছাতা খুলে না হাঁটলে বিপদের সম্ভাবনা আছে।

শনিবার, ছুটির দিন হলেও রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। ইন্ডিয়ান টাটা অনেক, কিন্তু জাপানি গাড়ির আধিক্য চোখে পড়ে। মার্সিডিজ এবং বিএমডাব্লিউর সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো। শ্রীলংকা গরীব দেশ নয়। এদের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় তিন হাজার এক শ ডলার, বাংলাদেশের দুই হাজার চারশ ডলার।

ট্রাফিক আইন মেনে চলে সবাই। সবচেয়ে যেটা ভালো লাগলো সেটা হলো রাস্তা পার হতে কোন সমস্যা হচ্ছে না, কারণ রেড লাইটে সব গাড়ি থামছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন শহরে হেঁটে রাস্তা পার হওয়া একটা বিরাট সমস্যা। এখানে সেই সমস্যা নেই।

পানি কেনার জন্য ছোট্ট একটা দোকানে ঢুকলাম। চমৎকার ইংরেজি বললেন মধ্যবয়সী দোকানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ইংরেজি শিক্ষার যে প্রভাব রেখে গেছে – তা অনেক ভালো ফল দিচ্ছে। ২০২৩ সালে প্রায় পনের লক্ষ পর্যটক এসেছেন শ্রীলংকায়। ভাষা নিয়ে কোন অসুবিধা হয় না তাদের। রাস্তার নামফলকও সিংহলি, তামিল আর ইংরেজিতে লেখা। পর্যটকবান্ধব শহর হবার পূর্বশর্ত এরা ঠিকই পূরণ করছে।

হাঁটতে হাঁটতে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছাকাছি চলে এসেছি। এই পার্কের নাম বদলে এখন বিহারা-মহাদেবী পার্ক রাখা হয়েছে। নাম বদলানোর ব্যাপারটাকে অনেকেই দেশাত্মবোধের পরিচয় মনে করেন। পার্কের কাছে খোলা জায়গায় ছোট্ট মেলা বসেছে। স্যাটারডে মার্কেট। শ্রীলংকান লোকজ খাবার পরখ করে দেখা যাক। কাঠাল পাতায় মোড়ানো পিঠে একটির দাম একশ রুপি, একটি বড় জিলাপি একশ রুপি। পিঠে সম্ভবত আজ সকালে বানানো হয়েছে – আমাদের তালের পিঠের স্বাদ। কিন্তু জিলাপির স্বাদ জঘন্য - নারকেল তেল দিয়ে ভাজা।

সারি সারি দারুচিনি গাছের সাজানো বাগান পার্কের এক পাশে। এই গাছের ছালের লোভেই কত যুদ্ধ হয়েছে এই দেশে, ছড়িয়েছে কত হিংসা। হয়তো সেজন্যই  তার একটু দূরে খোলা জায়গায় পাথরের বেদীর উপর স্থাপন করা হয়েছে ধ্যানরত সোনালী বুদ্ধমূর্তি – অহিংসার প্রতিমূর্তি।


দারুচিনি দ্বীপের ভিতর ২

 



সিটবেল্ট বেঁধে রাখার সাইনটা টুং করে অফ হয়ে যাবার সাথে সাথেই সিট থেকে উঠে দাঁড়ালেন আমার পাশের সিটের ভদ্রমহিলা। যেভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন, আমি ভয় পেয়েছিলাম পাছে তাঁর মাথা মাথার ওপরের লাগেজ কেবিনে ধাক্কা খায়। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষের পক্ষে যেখানে মাথা না নুইয়ে প্লেনের জানালার পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না, সেখানে তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

কেবিনের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম তিনি গোলাকার গম্ভীর মুখে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ‘এক্সকিউজ মি’ টাইপের কিছুর জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পরেও তিনি কিছু বলছেন না দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি বের হতে চান?”

তিনি কিছু না বলে আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। ছোট ছোট চোখগুলি মনে হলো আরো ছোট হয়ে গেল। তিনি কি আমার কথা বুঝতে পারেননি? হয়তো ইংরেজি বোঝেন না। আমি সিট থেকে উঠে তাঁকে বের হবার জায়গা দিলাম। হ্রস্বদৈর্ঘ্যের কারণে তিনি কিছুটা সুবিধাপ্রাপ্ত হলেও বহরের বাহুল্য তাঁকে করে তুলেছে অত্যন্ত ধীরগামী। দেড়ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সিট অতিক্রম করতে মনে হলো অনন্তকাল সময় নিলেন তিনি।

তিনি সামনে টয়লেটের দিকে রওনা হতেই আমি আবার বসে পড়লাম। ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসছে। কিন্তু খাবার দেবার আগে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক হবে না। তাছাড়া এই মহিলা ফিরে এলে আবার উঠতে হবে। জানালার পাশে বসলে পারলে এই ঝামেলা থাকতো না। এবার জানালার পাশে সিট পাইনি – কারণ অনলাইন চেক ইন করতে দেরি করে ফেলেছি। সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা আগে অনলাইন চেক ইন ওপেন হয়। কিন্তু আমি জানতাম না যে শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সে আটচল্লিশ ঘন্টা আগে অনলাইন চেক ইন করা যায়। আমি চেক ইন করার সময় সামান্য যে ক’টি সিট অবশিষ্ট ছিল তাদের মধ্যে পেছনের দিকের এই আইল সিটটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হয়েছিল। ফুল ফ্লাইট। একটা সিটও খালি নেই আজ। ওঠার সময় বিজনেস ক্লাসের ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে। সেখানকার বেশিরভাগ সিটই খালি। সেগুলি খালিই থাকবে, তবুও ইকোনমি ক্লাসের কাউকে সেখানে গিয়ে বসতে দেবে না। অর্থনৈতিক শ্রেণিবিদ্বেষ বর্ণবিদ্বেষের চেয়েও মারাত্মক।

ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের কর্মতৎপরতা বেড়ে গেছে। মেয়েদের পরনে শাড়ি আর ছেলেরা কোট-টাই। মেয়েরা যেভাবে জাতীয় পোশাক পরেছে, পুরুষ অ্যাটেনডেন্টদেরও উচিত ছিল সারং বা লুঙ্গি পরা। অবশ্য সেরকম কোন এয়ারলাইন্সেই দেখা যায় না। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসেও দেখা যায় মেয়েরা লুঙ্গি পরে, কিন্তু ছেলেরা স্যুট-টাই।

পনের-বিশ মিনিট কেটে গেছে, কিন্তু আমার পার্শ্ববর্তীনি তখনো ফিরেননি। তিনি সম্ভবত স্পেশাল মিলের অর্ডার দিয়েছিলেন। বিমানবালা খাবার এনে রেখে গেলেন তাঁর সিটের ট্রে-টেবলে। আরো মিনিট দশেক পর আমি খাবার পেলাম। শ্রীলংকান খাবারে যেরকম ঝাল থাকার কথা, সেরকম কিছুই নেই। খাবারের গন্ধটাও খুব একটা আকর্ষণীয় মনে হলো না, কেমন যেন ভিনেগার দেয়া আচারের গন্ধ।

আরো কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা ফিরলেন। শরীরের ভারে তাঁর হাঁটাচলার কষ্ট দেখেই বোঝা যায়। আধখাওয়া খাবারের ট্রে এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে ট্রে-টেবিল গুটিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ইকোনমি সিটে যেটুকু জায়গা থাকে সেটুকুতেই আমার হয়ে যায়, কিন্তু ভদ্রমহিলার জন্য তার দ্বিগুণ জায়গার দরকার ছিল। মনে হচ্ছে তিনি আমার সিটে ঢুকে আটকে গেছেন, অথবা বুঝতে পারছেন না তাঁর সিটের সামনের ট্রেতে রাখা খাবার নিয়ে কী করবেন। আমার হাতের ট্রেতে একটু ধাক্কা লাগলেই উল্টে যাবে প্লাস্টিকের গ্লাস। আমি চুপচাপ ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছি। বিরক্তি লাগছে, আবার কেমন এক ধরনের মায়াও হচ্ছে। বয়স্ক ভদ্রমহিলার চেহারা আর গায়ের রঙ অনেকটাই শ্রীলংকানদের মতো। কিন্তু শ্রীলংকানদের মধ্যে এত মোটা মানুষ সাধারণত দেখা যায় না। ইন্ডিয়ানও হতে পারেন। প্লেনে ওঠার সময় দেখেছি তাঁর সাথে আরো কয়েকজন ছিল। উনি হয়তো ওদের কাছাকাছি সিট পাননি।

“আর ইউ ওকে ম্যাম?” উত্তর পাবো না জেনেও জিজ্ঞেস করলাম পরোক্ষভাবে তাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে। তাতে কিছুটা কাজ হলো। তিনি কোনরকমে ঠেসেঠুসে বসলেন তাঁর সিটে। আমি আধখাওয়া খাবার শেষ করতে গিয়ে দেখলাম ঠান্ডা হয়ে গেছে সব।

শ্রীলংকা চায়ের জন্য বিখ্যাত। সেই বিখ্যাত চায়ের এক পেয়ালা নিয়ে চুমুক দিলাম। আমার স্বাদ্গ্রন্থি সম্ভবত ঠিকমতো কাজ করে না। পৃথিবীবিখ্যাত সিলন টি আর অখ্যাত টং-এর দোকানের টি-র মধ্যে আমি তেমন কোন পার্থক্যই খুঁজে পেলাম না। দ্বিতীয় বার চুমুক দিতেই কেমন যেন একটা বিশ্রী গন্ধের ঝাঁপটা নাকে এসে লাগলো। আশেপাশের কেউ একজনের প্রচন্ড বদহজম হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই কেউ একজন আমার পাশের জন হলে তো আমার ঘুমের বারোটা বাজবে আজ।

বিমানভ্রমণ যত দীর্ঘ হয়, আমার ততই ভালো লাগে। মেলবোর্ন থেকে কলম্বো সাড়ে দশ ঘন্টার ফ্লাইট। এখনো মাত্র দু’ঘন্টা গেছে। আট ঘন্টার একটা লম্বা ঘুম দেয়াই যায়। কম্বল ঢেকে সামনের মনিটর অফ করে চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ বন্ধ করে রাখা গেল না। পাশের ভদ্রমহিলা আবার দাঁড়িয়ে গেছেন। ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন যার একটা শব্দও আমি বুঝতে পারলাম না। তবে মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাঁর পেটে অশান্তি চলছে। ভ্রমণে পেট খারাপ হওয়া মানে চরম অশান্তি।

তিনি বের হবার পর মনিটর অন করে ফ্লাইটের গতিপথ দেখলাম। প্লেন এখনো সাউথ অস্ট্রেলিয়া পার হয়ে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপর দিয়ে ভারত মহাসাগরের দিকে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া  পার হয়ে কলম্বো পৌঁছাতে আরো সাড়ে সাত ঘন্টা লাগবে।

“এক্সকিউজ মি”

চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম সিটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন একজন স্বাস্থ্যবতী মহিলা।

“ক্যান ইউ পাস মি দ্য ব্যাগ আন্ডার দ্যাট সিট?” উচ্চারণে ইন্ডিয়ান টান স্পষ্ট।

“আপনি?”

“ওই সিটে যিনি বসেছিলেন তিনি আমার মা।“

নিচু হয়ে পাশের সিটের নিচ থেকে একটা ছোট্ট কাপড়ের ব্যাগ টেনে নিয়ে মহিলার হাতে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, “ইজ শি ওকে?”

“শি ইজ নট ফিলিং ভেরি ওয়েল।“

ব্যাগ নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন মহিলা। তার চেহারার সাথে তার মায়ের চেহারা ও ফিগারে যথেষ্ট মিল আছে। আমাদের উপমহাদেশের প্রবাসীরা তাদের মা-বাবাকে এদেশে নিয়ে আসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের প্রয়োজনে। প্রয়োজন শেষ হলে আবার দেশে পাঠিয়ে দেয়। এই ভদ্রমহিলাও মেয়ের কাছে এসেছিলেন, এখন দেশে ফিরে যাচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মা-কে এভাবে একা বসতে কেন দিলো বুঝতে পারছি না।

একটু চোখ লেগে এসেছিল। গায়ে ধাক্কা লাগতেই উঠে দাঁড়ালাম। আইল সিটে বসার মজা বের হচ্ছে। এভাবে আরো কতবার উঠবস করতে হয় জানি না।

এর মধ্যেই লম্বা একটা ঘুম হয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট দেয়ার ঘোষণা শোনা গেল। মনিটর অন করে দেখলাম আর দেড় ঘন্টা আছে কলম্বোতে পৌঁছানোর।

ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টরা ইতোমধ্যে ফ্রেশ হয়ে গেছেন। ব্রেকফাস্ট দেয়া হচ্ছে। সিট সোজা করতে গিয়ে পাশের সিটের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। মহিলা এত শীর্ণ হয়ে গেলেন কীভাবে? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম - সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। সিট পেছনে ঠেলে গলায় বালিশ লাগিয়ে জানালার দিকে মুখ গুঁজে শুয়ে আছেন যিনি তিনি কখন এই সিটে এলেন?

ব্রেকফাস্ট দিতে এসে ফ্লাইট অ্যটেনডেন্ট তাকে ডেকে তুলে সিট সোজা করতে বললেন। দেখলাম আঠারো উনিশ বছরের এক তরুণ। মহিলার নাতি? এই ছেলে তো শুরুতেই এখানে বসতে পারতো!

ফ্লাইট ল্যান্ড করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অ্যারাইভাল কার্ড বা অন্য কোন ফরম পূরণ করতে হলে তো ফ্লাইটে দেয়ার কথা। কোন ফরম দেয়া হলো না। নিশ্চিত হবার জন্য একজন অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, “এয়ারপোর্টের ভেতরে গেলে সব জানা যাবে।“

ফ্লাইট ভালোভাবে ল্যান্ড করলো। ফোনে মেলবোর্ন সময় দেখাচ্ছে সকাল আটটা। শ্রীলংকা মেলবোর্নের চেয়ে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পিছিয়ে। শ্রীলংকায় এখন রাত আড়াইটা। প্লেনের জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টের মূল বিল্ডিং থেকে অনেক দূরে প্লেন থেমে আছে। সবাই কেবিন ব্যাগ হাতে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নড়াচড়া নেই। যাত্রীদের কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারছি অনেকের কানেকটিং ফ্লাইট ছিল – কলম্বো থেকে দিল্লী। সেই ফ্লাইট অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে। এই ফ্লাইটটাই আবার মেলবোর্নে যাবে। যাবার শিডিউল ছিল রাত সাড়ে বারোটায়। আমাদের তো নামতে নামতেই তিনটা বেজে যাবে।

গুণে গুণে যাত্রী নামানো হচ্ছে। সবকিছু এত ধীরে ধীরে হচ্ছে যে মনে হচ্ছে আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ হচ্ছে এখানে। প্লেনের দরজায় লাগানো সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো অনেকক্ষণ। সিঁড়ির গোড়ায় বাস আসার পর নিচে নেমে বাসে উঠলাম। গুণে গুণে ঠিক কতজনকে বাসে তোলা হলো জানি না, কিন্তু বাসে ঠাসাঠাসি ভীড় হলো।

মূল টার্মিনালে এসে আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হলো। রাতের অন্ধকারে খুব একটা বুঝতে পারছি না এয়ারপোর্টিটি কত বড়। তবে ব্যবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ঢাকার শাহজালাল বিমান বন্দরের সাথে অনেক মিল আছে।

ইমিগ্রেশান এরিয়ায় বিরাট গন্ডগোল। অনেকগুলি কাউন্টার, অনেকগুলি লাইন। একটা আগমণী ফরম পূরণ করতে হয়। সেটা পূরণ করার পর কোন্‌ লাইনে দাঁড়াবো তা কয়েকজন উর্দিধারী এয়ারপোর্ট কর্মীকে জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পেলাম না।

অন এরাইভাল ভিসার লম্বা লাইন। অস্ট্রেলিয়ানদের ভিসা নিতে হয় অনলাইনে। সেটা নিয়ে এসেছি। তাতে কিছুটা সময় বেঁচেছে। ইমিগ্রেশান অফিসাররা ভীষণ ধীরস্থির। একেকটা পাসপোর্ট চেক করে সিল দিতে মনে হচ্ছে অনন্তকাল সময় নিচ্ছেন। লাইনে আমার ঠিক আগে একটা ভারতীয়-অস্ট্রেলিয়ান পরিবার। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তারা দিল্লী যাচ্ছিলেন। কানেকটিং ফ্লাইট চলে গেছে। এখন শ্রীলংকায় এক রাত থাকতে হচ্ছে। এতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর কাউন্টারে যখন পৌঁছলো – তখন তাদের বলা হলো আগমণী ফরম পূরণ করে আনতে। অথচ তাদেরকে নাকি বলা হয়েছে ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হবার কারণে এই ফরম পূরণ করতে হবে না। সরকারি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা কেন বাড়ানো যায় না আমাদের মতো দেশগুলিতে আমি জানি না।

ইমিগ্রেশান পার হয়ে লাগেজের জন্য আবার অপেক্ষা প্রায় ঘন্টা খানেক। লাগেজ নিয়ে মানি এক্সচেঞ্জ। শ্রীলংকান রুপির দাম এখন অনেক কম। অস্ট্রেলিয়ান এক ডলারে ২১৭ রুপি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এক টাকায় তিন রুপির চেয়েও বেশি।

অ্যারাইভাল গেটে বের হয়েই চোখে পড়লো অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন হাতে প্লাকার্ড নিয়ে। আমার জন্যও হোটেল থেকে একজনকে পাঠানোর কথা। এত কম আলোতে ছোট ছোট প্লাকার্ডের লেখাগুলি পড়াও যাচ্ছে না। কাছে গিয়ে দেখতে হলো। হ্যাঁ, আমার জন্য হোটেল সিনামন রেড থেকে একজন এসেছেন। আমার নাম লেখা একটা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নইলে এই ভোর চারটায় আমি কীভাবে হোটেলে যেতাম জানি না।

হোটেল থেকে যিনি এসেছেন – তাঁর বয়স বোঝার কোন উপায় নেই। শীর্ণ খর্বকায় একজন মানুষ। খুবই মৃদুভাষী। এয়ারপোর্টের কোলাহলের মধ্যে তাঁর কথাবার্তার অর্ধেকই আমি শুনতে পাচ্ছি না, যেটুকু শুনতে পাচ্ছি – তার বেশিরভাগই বুঝতে পারছি না। ইংরেজি তিনি বলছেন – তবে তা অনায়াসে বোঝার মতো নয়। তাঁর নাম কনিস্ক না  কলিন ঠিক বুঝতে পারলাম না।

এয়ারপোর্টের বাইরে এসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নাতিশীতোষ্ণ ভোরের বাতাস। এত ভোরেও অনেক গাড়ি, ট্যাক্সি, আর অনেক মানুষ। অনেকটাই বাংলাদেশের মতো লাগলো। কনিস্ক বা কলিন আমাকে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে রেখে গাড়ি আনতে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখতে লাগলাম। যাত্রীদের বেশিরভাগই শ্রীলংকান-অস্ট্রেলিয়ান। নিজেদের বাড়িতে এসেছেন। আত্মীয়স্বজনরা তাদের নিতে এসেছেন এয়ারপোর্টে। এই মিলনমেলা দেখতে কী যে ভালো লাগছে। একটি প্রায় বালিকা-বধূ এসেছে কয়েকমাস বয়সী ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে তার প্রবাসী স্বামীকে স্বাগতম জানাতে। স্বামীটি তার বাচ্চাকে সম্ভবত এই প্রথম দেখছে। কোলে নিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেললো। তাদের মুখের ভাষা আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু আবেগের ভাষা, ভালোবাসার ভাষা বুঝতে পারছি।

আরো আধঘন্টা পর কনিস্ক বা কলিন এলেন গাড়ি নিয়ে। হোটেলের নাম লেখা ছোট্ট গাড়ি। এয়ারপোর্ট থেকে কলম্বো শহরের দূরত্ব প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার। এই ভোরে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে যেতে প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো লাগলো। এক্সপ্রেস ওয়েতে টোল দিতে হয় চারশ রুপি।

শুনশান মসৃণ রাস্তা। ঘন সবুজ দুপাশে। কলম্বো শহরে ঢোকার পর বিল্ডিংগুলি বেশ সুন্দর বলে মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ভবনগুলি আলোকমালায় সজ্জিত। ক্রিসমাস আর নিউইয়ারের জন্য প্রস্তুত এই নগরী। এই শহরকেই ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক।

কনিস্ক বা কলিন টুকটাক পরিচিতি দিচ্ছেন শহরের। ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে এসে অনেকগুলি অলিগলি পার হয়ে হোটেল সিনামন। দারুচিনি দ্বীপের দারুচিনি হোটেল।

বহুতল ভবনের সাত তলায় হোটেলের রিসিপশান।

নিচের তলায় মেটাল ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে এসে লাগেজ স্ক্যান করে তারপর ঢুকতে হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা যত ভালো হবে – পর্যটকদের পর্যটন তত নিরাপদ হবে।

রিসিপশানের ছেলেটা বেশ চটপটে, রসিক। বললো, “আপনার দুই রাতের মধ্যে এক রাত তো চলেই গেল। অন্য দিন এবং রাতটা ভালো কাটবে আশা করি। এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার গাড়িভাড়া ৪৫ ইউএস ডলার এখন দিয়ে ফেললে ভালো হয়।“

চব্বিশ তলার চৌদ্দ নম্বর রুমে ঢুকে জানালার পর্দা সরাতেই চোখের সামনে জেগে উঠলো আলো ঝলমলে কলম্বো শহরের অনেকখানি।  


দারুচিনি দ্বীপের ভিতর ১

 




এয়ারপোর্টে যাবার জন্য রেডি হয়ে উবার রাইড কনফার্ম করতে যাবো – এই সময় ফোনটি এলো। শ্রীলংকান এয়ারলাইনসের মেলবোর্ন অফিসের একজন নাকিসুরে টেনে টেনে ইংরেজিতে যা বললেন, বাংলায় গুগল ট্রান্সলেশান করলে তা শোনাবে এরকম: জনাব, আপনার আজ বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটের শ্রীলংকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট সংখ্যা ইউ এল ছয় শূন্য পাঁচ দুই ঘন্টা পনের মিনিট বিলম্ব করা হয়েছে। শ্রীলংকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট সংখ্যা ইউ এল ছয় শূন্য পাঁচ উড্ডয়ন করার নতুন সময় সন্ধ্যা সাতটা চল্লিশ মিনিট। আপনার সাময়িক অসুবিধার জন্য শ্রীলংকান এয়ারলাইনস অত্যন্ত দুঃখিত।

আমি কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল। সম্ভবত রেকর্ডেড কল – সব প্যাসেঞ্জারকে পাঠাচ্ছে। তবুও ভালো যে রওনা দেবার আগে জানিয়েছে। ইমেইলও এলো প্রায় সাথে সাথে। মেলবোর্ন থেকে সরাসরি কলম্বো প্রায় সাড়ে দশ ঘন্টার ফ্লাইট। পৌঁছানোর কথা ছিল শ্রীলংকান সময় রাত সাড়ে দশটার দিকে। এখন সাতটা চল্লিশে ছাড়লে পৌঁছাবে মধ্যরাতের পর। হোটেল থেকে গাড়ি আসার কথা এয়ারপোর্টে। ওদেরকে জানাতে হবে ফ্লাইট ডিলের ব্যাপারটা। ওরা নিজেরাই হয়তো চেক করবে ফ্লাইট স্টেটাস, কিন্তু আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে।

ঘন্টা দুয়েক এক্সট্রা সময় পাওয়া গেল। কিন্তু দু’ঘন্টা পর বের হলে পিক-আওয়ারে আধঘন্টার জায়গায় দু’ঘন্টা লাগবে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে। খ্রিস্টমাসের ছুটি শুরু হচ্ছে কাল থেকে। আজ বিকেল থেকেই মানুষ বেরিয়ে পড়বে ছুটির আনন্দে। আবার উবার ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারলাম খ্রিস্টমাসের সুপার পিক-আওয়ারের প্রভাব। আটচল্লিশ ডলারের ভাড়া এখন হয়ে গেছে ছিয়াশি ডলার। তারপরও কয়েক মিনিট লাগলো রাইড কনফার্মড হতে।

ফ্রিওয়েতে বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক থাকলেও খুব একটা দেরি হলো না এয়ারপোর্টে পৌঁছতে। যেরকম উপচে পড়া ভীড় আশা করেছিলাম – সেরকম ভীড় এখনো হয়নি। ভেবেছিলাম শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের কাউন্টার খুলতে আরো দেরি হবে। কিন্তু দেখলাম ফ্লাইট ডিলে থাকলেও ওরা ঠিক সময়েই কাউন্টার খুলে রেগুলার কাজকর্ম করছে। কাউন্টারে খুব একটা ভীড় নেই। বোর্ডিং-পাসের সাথে বিশ ডলারের একটা ফুড ভাউচারও দিলো – দেরির সামান্য ক্ষতিপূরণ। এয়ারলাইন্সের এটুকু সৌজন্য দেখে মনে হলো তারা সত্যই আন্তরিক।

হাতে সময় থাকলে এয়ারপোর্টের ভেতর-বাহির ঘুরে দেখা আমার পুরনো অভ্যেস। মেলবোর্ন এয়ারপোর্ট আয়তনে খুব একটা বড় নয়। এখন কিছুটা এক্সটেনশান হচ্ছে। কিন্তু তাতে খুব একটা দৃষ্টিনন্দন কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্চার এরিয়ার ঘিঞ্জি অবস্থা দেখলে মনে হবে তৃতীয় বিশ্বের প্রচণ্ড ঘনবসতিপূর্ণ কোন দেশের এয়ারপোর্ট।

হলিউডের সিনেমায় খ্রিস্টমাসের মুভিতে যেরকম ঠাসাঠাসি ভীড় আর ক্যাওস দেখায় এয়ারপোর্টে, সেরকম কোনকিছুর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না এখনো। দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থানের কারণে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে খ্রিস্টমাসের সময় বরফ-পড়া তুষারঢাকা পরিবেশ কখনোই তৈরি হয় না। তাছাড়া ইওরোপ-আমেরিকার মতো অত উল্লাসও নেই খ্রিস্টমাস উপলক্ষে। নামকাওয়াস্তে কিছু খ্রিস্টমাস ট্রি সাজানো হয়েছে শপিং-মলগুলিতে। কিন্তু এয়ারপোর্টে আলাদা কোন সাজসজ্জাই করা হয়নি।

সিকিওরিটি গেট পার হবার আগেই ফুড ভাউচারের সদ্ব্যাবহার করা দরকার। ফুডকোর্টের অবস্থা ভয়াবহ। খুব বেশি অপশন নেই। টার্মিনাল-১ আর টার্মিনাল-২ এর মাঝখানের রাস্তায় দুটো মদের দোকান, একটি ভিয়েতনামি এবং একটি গ্রিক রেস্টুরেন্ট। টার্মিনাল-৩ এর  দিকে যাবার সময় আরো কয়েকটা আছে – কিন্তু সেদিকে যেতে ইচ্ছে করলো না।  চিকেন বার্গার আর সফ্‌ট ড্রিঙ্ক নিয়ে বসলাম বারান্দায়। এখান থেকে রানওয়ে দেখা যাচ্ছে। হাতে এখনো অফুরন্ত সময়।

ফোন বাজলো।

“অর্না, কী অবস্থা?”

“বাসায় যাচ্ছি দাদা।“

“তিনটা বাজে বাসায় চলে যাচ্ছিস! তোর না পাঁচটা পর্যন্ত কাজ?”

“লাঞ্চের পরে সবাই চলে গেছে। আমিও বের হয়েছি অনেক আগে। জ্যামে বসে আছি। ভয়াবহ জ্যাম এখন প্লেনটি রোডে। তুমি কি চেক ইন করে ফেলেছো?”

“আমার ফ্লাইট দুই ঘন্টা ডিলে। এখন বসে বসে খাচ্ছি। স্পাইসি বার্গারের অর্ডার দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে ঘাসে মোড়ানো সিদ্ধ চিকেন খাচ্ছি। সে কোন ঝালই দেয়নি।“

“কোত্থেকে খাচ্ছো?”

“গ্রিক রেস্টুরেন্ট একটা আছে এদিকে টার্মিনাল-১ এ ঢোকার মুখে।“

“গ্রিক রেস্টুরেন্টে তুমি ঝাল কোথায় পাবে? ওরা তো লংকা খায় না। লংকা কেন, তেমন কোন মসলাই তো ওরা খায় না। ওরা …”

গ্রিকদের খাদ্যতালিকা সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা শুরু করার আগেই অর্নাকে থামিয়ে দিলাম পরে কথা হবে বলে। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে লংকা শব্দটি।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা মরিচকে লংকা বলে। অর্না পুরোদস্তুর বাংলাদেশি, পশ্চিমবঙ্গে কখনও যায়ওনি। কিন্তু মেলবোর্নে তার পশ্চিমবঙ্গীয় সখিদের প্রভাবে তার কথাবার্তা শুনলে মাঝে মাঝে মনে হবে তার জন্ম বোলপুরের আশেপাশে। অবশ্য শান্তিনিকেতনে কি মরিচকে লংকা বলা হয়? জানি না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা মরিচকে কেন লংকা বলে আমি আজও জানি না। হতে পারে শ্রীলংকার সাথে মরিচের কোনো ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। সেভাবে ধরতে গেলে তো মরিচের সাথে উথাল-পাতাল সম্পর্ক আমাদের বাংলাদেশি বাঙালিদের। বিশেষ করে সময়ে-অসময়ে কাঁচা মরিচের দাম যখন জ্বালদেয়া দুধের মতো উথলে উঠে – দামের টানাটানিতে বাজেটের কাছা খুলে গেলেও কাঁচামরিচ ছাড়ি না আমরা।

মানি এক্সচেঞ্জে একটু ঢুঁ মেরে দেখলাম শ্রীলংকান রুপির দাম কত। তাদের সাফ জবাব, সরি, উই ডোন্ট ট্রেড শ্রীলংকান রুপিজ।

হেলে দুলে ইমিগ্রেশান গেটের কাছে গিয়ে আঁৎকে উঠলাম। এত মানুষ এতক্ষণ কোথায় ছিল? গিজ গিজ করছে মানুষ। এখানে ইমিগ্রেশান পার হবার আগে সিকিউরিটি চেকিং। ঠাসাঠাসি লাইনের দৈর্ঘ্য আর এগোনোর গতি দেখে মনে হচ্ছে ঘন্টা পেরিয়ে যাবে মেটাল ডিকেক্টর পর্যন্ত পৌঁছাতে।

অনেকের ফ্লাইটে বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে – অথচ লাইনে আটকে আছেন। এয়ারলাইনসের লোক এসে তাদের ডেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। যারা ম্যানেজ করছেন – তাদের কর্মতৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে তারা ধীরে কাজ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যার যতই ব্যস্ততা থাকুক – তারা তাদের কাজের গতি কিছুতেই বাড়াবে না।

প্রায় দেড় ঘন্টা লাগলো সিকিউরিটি চেকিং পার হতে। দেখলাম এরা পুরনো মেশিন সব বদলে ফেলেছে। এখন ল্যাপটপ বা এজাতীয় ইলেকট্রনিক্স আর ব্যাগ থেকে বের করতে হয় না। মেটাল ডিকেক্টরের বদলে বিশাল সাইজের বডি স্ক্যানার বসিয়েছে। কিন্তু সেগুলি যারা অপারেট করছেন তাদের ভেতর কেমন যেন একটা ঢিমেতালা ভাব।

ইমিগ্রেশান এখন পুরোটাই অটোম্যাটেড। মেশিনে পাসপোর্ট স্ক্যান করলেই গেট খুলে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া পাসপোর্টে সিল মারা বন্ধ করেছে অনেক বছর হয়ে গেল। আগে একটা বহির্গমন কার্ড পূরণ করতে হতো। সেটাও এখন আর পূরণ করতে হয় না।

ডিউটি ফ্রি শপের ভেতর দিয়ে যাবার সময় বোঝা যাচ্ছে খ্রিস্টমাসের প্রভাব। অন্যসময় এত ভীড় থাকে না এখানে।

আমার ফ্লাইটের বোর্ডিং চার নম্বর গেটে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি নিউজিল্যান্ডের ফ্লাইটের শিডিউল দেখাচ্ছে রাত আটটায়। কিন্তু তার আগের সাতটা চল্লিশের ফ্লাইটের কোন শিডিউল সেখানে নেই। হেঁটে গিয়ে জেনারেল ডিসপ্লে দেখলাম – আমাদের ফ্লাইটের গেট পরিবর্তন হয়েছে। এখন তা পাঁচ নম্বর গেটে গেছে। পাঁচ নম্বর গেট চার নম্বরের পাশাপাশি নয়, সম্পূর্ণ অন্যদিকে। গেলাম সেখানে। প্রচন্ড ভীড়। ভীড়টা কলম্বোগামী যাত্রীদের শুধু নয়, জেট স্টারের একটা ফ্লাইট যাচ্ছে ক্রাইস্টচার্চে – তাদেরও।

অনলাইনে ফ্লাইট স্ট্যাটাস দেখে বুঝতে পারলাম – অনেক ঝামেলা আছে সামনে। শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের যে বিমান আমাদের কলম্বো নিয়ে যাবে – সেই ফ্লাইট ইউ এল সিক্স জিরো ফোর এখনো কলম্বো থেকে এসে পৌঁছায়নি। মেলবোর্ন এয়ারপোর্টের এরাইভ্যাল শিডিউলে ফ্লাইটটির কোন চিহ্নও নেই। স্কাই স্ক্যানারের পেজে দেখলাম ওই ফ্লাইট মেলবোর্নে এসে পৌঁছাবে সাতটার দিকে। তার মানে সাতটা চল্লিশে ফ্লাইট ছাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

ক্রাইস্টচার্চের ফ্লাইট চলে যাবার পর পাঁচ নম্বর গেটে কোলাহল আরো বেড়েছে। যাত্রীদের মধ্যে প্রচুর শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ান শ্রীলংকা ভ্রমণে যাচ্ছেন। বাকিরা প্রায় সবাই শ্রীলংকান অথবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান বলে মনে হচ্ছে।

কোভিডের কারণে শ্রীলংকার পর্যটনে ধ্বস নেমেছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তাদের এতই কমে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিলো তারা দেউলিয়া হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল পুরো জাতি। এখন মনে হচ্ছে তারা ভালোভাবেই তা কাটিয়ে উঠেছে। আবারো পর্যটনের দেশ হয়ে উঠেছে শ্রীলংকা। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্সের অবস্থা তো মনে হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মতোই। যাত্রীরা অনিশ্চয়তায় হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে কোন আপডেট নেই।

হঠাৎ অনেকে খুশিতে চিৎকার করে হাততালি দিয়ে উঠতেই বাইরে তাকিয়ে দেখলাম শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের বিশাল বিমান পাঁচ নম্বর গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। এতক্ষণ সবাই ভয়ে ভয়ে ছিল – যদি ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে যায়। বিকেল চারটায় যে ফ্লাইটের এসে পৌঁছানোর কথা ছিল তা এসে পৌঁছেছে সোয়া সাতটায়।

অবশেষে আরো দুই ঘণ্টা পর রাত সোয়া নটায় প্লেনে উঠলাম। প্লেন ছাড়লো পৌনে দশটায়। চার ঘন্টা বিশ মিনিট লেট। 

Tuesday 9 January 2024

মহাজাগতিক মানসভ্রমণ

 


মহাজাগতিক প্রথম আলো’র পাঠ প্রতিক্রিয়া

____________________

মাত্র পঁচিশ বছর আগেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বয়স হিসেব করেছিলেন আনুমানিক সাত থেকে বিশ বিলিয়ন অর্থাৎ সাত শ থেকে দুই হাজার কোটি বছর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু স্যাটেলাইট আর টেলিস্কোপের আধুনিকায়ন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যান্ত্রিক পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিজ্ঞানের উন্নতির ফসল কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন প্রায় সুনির্দিষ্টভাবেই হিসেব করে দেখেছেন যে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১৩৭০ কোটি বছর, খুব বেশি হলে ২০ কোটি বছর এদিক ওদিক হতে পারে। মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের সৌরজগৎ তথা পৃথিবীর বয়স অনেক কম, মাত্র সাড়ে চারশ কোটি বছর। অর্থাৎ মহাবিশ্বের উৎপত্তি হবার প্রায় নয় শ কোটি বছর পর আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তি হয়েছে। এই সাড়ে চারশ কোটি বছর বয়সী পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র দুই লক্ষ বছর আগে। আর এতসব আমরা জানতে শুরু করেছি মাত্র কয়েক শ বছর আগে থেকে। 

এত অতীতের ঘটিনা – যখন মানুষ তো দূরের কথা, আমাদের সৌরজগতই ছিল না – সেই সুদূর অতীতের কথা আমরা কীভাবে জানলাম? এই জানার মূলে আছে আলো। মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম শক্তির বিকিরণ হয়েছিল যে আলোর আকারে – সেই মহাজাগতিক প্রথম আলোই আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে মহাবিশ্বের আদি অবস্থার, একেবারে গোড়ায় কী হয়েছিল সেসব ঘটনার। মহাবিশ্বের পটভূমিতে ছড়িয়ে থাকা সে আদি আলোর অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা খুঁড়ে আনছেন আমাদের মহাবিশ্বের অতীত ইতিহাস। আমাদের মাথার ওপর যে আকাশে জ্বলতে দেখছি লক্ষ কোটি তারার মেলা – তাদের অনেকেই হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক বছর আগে – কিন্তু যে আলো রওনা দিয়েছিল মিলিয়ন বছর আগে – সেই আলো এসে পৌঁছাচ্ছে এতদিন পরে – মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব পার হয়ে। 

থ্রিলারের চেয়েও রোমহর্ষক এসব মহাজাগতিক ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে একটার পর একটা ধারবাহিকভাবে চলে আসেনি। মহাবিশ্বের রহস্যের জটখোলা এত সহজ নয়। একেক সময় একেক ঘটনার ভেতর দিয়ে একেক রকমের আবিষ্কার ঘটে। সেসব আবিষ্কারের তথ্য থেকে মহাবিশ্বের রহস্যের ধারাবাহিকতা খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীদের বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করতে হয়। সেই গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে গবেষণাপত্র তৈরি হয়। নানাসময়ের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপন করতে হয় বিজ্ঞানের বইপত্রে। সেখান থেকে আমরা সাধারণ মানুষ জানতে পারি – মহাবিশ্বে কী ঘটলো কখন ঘটলো। সেরকম জুৎসই বই হলে বই পড়তে পড়তেই পাঠকের মানসভ্রমণ হয়ে যেতে পারে – মহাবিশ্বের একেবারে গোড়ার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। আবুল বাসারের “মহাজাগতিক প্রথম আলো বিগ ব্যাং ও পটভূমি বিকিরণের খোঁজে” তেমনই এক সুখপাঠ্য বিজ্ঞানবই যা পড়ার সময় মহাজাগতিক মানসভ্রমণের অনুভূতি হলো। 

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লেখা সহজ নয়। কারণ অনেক। প্রথমত বৈজ্ঞানিক শব্দগুলির যথাযথ বাংলা পরিভাষা আমাদের নেই। দ্বিতীয়ত আমরা বিজ্ঞানের বই হয়তো অনেক পড়ি, কিন্তু সেভাবে বিষয়ভিত্তিক বিজ্ঞানচর্চা আমাদের নেই। আমাদের বিজ্ঞানপাঠের প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষা পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়। ফলে বিজ্ঞান লেখকের জন্য পাঠকের কাছ থেকে যে চ্যালেঞ্জটা আসার কথা সেটা অনেকসময় আসে না। আরো একটা বড় কারণ হলো – বিজ্ঞানের জনপ্রিয় বই লিখতে গিয়ে আমরা ইংরেজিতে লেখা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইগুলির ভাষাশৈলিও অনুকরণ করি, অনেকসময় হয়ে ওঠে আক্ষরিক অনুবাদ। এটা দোষের কিছু নয়। একসময় জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হতো আমেরিকান বা ইংল্যান্ডের লেখকদের। 

বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন এখন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম লেখক আবুল বাসার। তিনি একাধারে জনপ্রিয় অনুবাদক, মাসিক বিজ্ঞানচর্চার নির্বাহী সম্পাদক। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই অনুবাদের পাশাপাশি তিনি ইতোমধ্যে নিজস্ব বই লিখেছেন বেশ কয়েকটি। প্রথমা থেকে প্রকাশিত মহাজাগতিক প্রথম আলো তাঁর অত্যন্ত দরকারি একটি বই। 

বিশটি অধ্যায় আছে এই বইতে। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম আকর্ষণীয় – যেমন ‘একঘেয়ে ভুতুড়ে হিসহিস’, ‘দুটি প্যারাডক্স ও আইনস্টাইনের মহা ভুল’, গ্যামো অ্যান্ড গং, একটি হরর মুভি ও থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, কফিনের শেষ পেরেক, নোবেল ও শোক সমাচার – ইত্যাদি। শিরোনাম পড়ে মনে হচ্ছিলো থ্রিলার কাহিনিতে ঢুকতে যাচ্ছি। বিজ্ঞানের ইতিহাসের কাহিনিগুলিও তিনি সাজিয়েছেন সেভাবে সমান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। 

শুরুতেই তিনি চমকে দিয়েছেন ১৯৬৫ সালে নিউ জার্সিতে বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসনের হর্ন অ্যান্টেনায় ধরা পড়া ভুতুড়ে হিসহিস নয়েজের ঘটনার মাধ্যমে। সেখান থেকে তিনি অতীতে গিয়েছেন, গিয়েছেন বিজ্ঞানীদের পরবর্তী কর্মকান্ডে। 

বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ই স্বয়ং-সম্পূর্ণ আবার উপন্যাসের মতো ঘটনার প্রবাহে সচল। ঘটনাপ্রবাহে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাজকর্ম বর্ণিত হয়েছে, বিজ্ঞানীদের অতিসংক্ষিপ্ত জীবনীও আছে সাথে যেখানে যেটুকু দরকার। রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেকসান্দার ফ্রিডম্যান, বেলজিয়ামের জর্জ লেমিত্রি, আমেরিকার হেনরিয়েটা লিভেট, হার্লো শ্যাপলি, হেবার কার্টিস, এডুইন হাবল, জর্জ গ্যামো, র‍্যালফ আলফার, রবার্ট হারম্যান, ফ্রেড হয়েল, রবার্ট ডিকি – প্রায় প্রত্যেক মহারথির কথাই এসেছে যথাপ্রসঙ্গে। 

জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্য এই বইয়ের ভূমিকায় সঠিকভাবেই লিখেছেন – যে এই বই ধরতে গেলে জ্যোতির্বিদ্যার আধুনিকতার সূত্রপাতের কাহিনি। আমি তাঁর সাথে সম্পূর্ণ একমত। সাবলীল ভাষা এই বইয়ের প্রধান আকর্ষণ। ভাষার কারণে হোঁচট খেতে হয়নি তেমন কোথাও। 

তবে কয়েকটি জায়গায় আমার সামান্য একটু মন্তব্য আছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৬৯ পৃষ্ঠায় বুনসেন ও কার্শভের যন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে “যেখানে একটি সরু স্লিট বা নল বসানো ছিল” – স্লিট আর নল কিন্তু এক জিনিস নয়। একই অধ্যায়ে ৭২ পৃষ্ঠায় হাইড্রোজেন পরমাণুর শক্তিস্তর বোঝানোর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের ফোটন শুষে নেয়ার ঘটনাটি খুব একটা পরিষ্কার হয়নি। আগত ফোটনের শক্তি আর ইলেকট্রনের বাইন্ডিং এনার্জির উপর নির্ভর করে ফোটনটি শোষিত হবার পর ইলেকট্রন শক্তিস্তর অতিক্রম করতে পারবে কি না, নাকি উত্তেজিত হবার পর আবার ফোটন বের করে দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়বে। 

সপ্তম অধ্যায়ে ৮২ পৃষ্ঠায় কিছুটা রূপক অর্থে বলা হয়েছে রসায়নবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীদের ভাগ্য কীভাবে জ্যোতির্বিদদের ভাগ্যের চেয়ে ভালো। এই ব্যাপারটিতে আমার মতো আরো অনেক পাঠকই হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানী কিংবা রসায়নবিদ কাউকেই বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। 

৮৭ পৃষ্ঠার গ্রাফে উলম্বিক অক্ষে মন্দন বেগ কেন হিসেব করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করলে ব্যাপারটি আরো বোধগম্য হতো।

নবম অধ্যায়ে ১০২ পৃষ্ঠায় কথার ছলে লেখা হয়েছে বর “শুভদিন দেখে” নিজের দেশ ডেনমার্ক ছেড়ে আশ্রয় নিলেন ব্রিটেনে। এখানে কথার কথা হলেও “শুভদিন” ব্যাপারটি নীলস বোরের ক্ষেত্রে খাটে না। একই অধ্যায়ের ১১৪ পৃষ্ঠায় বিটা ক্ষয় বা বিটা ডিকের ব্যাখ্যাটিতে নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয়ে একটি ইলেকট্রন বিটা পার্টিক্যাল আকারে বের হয়ে আসার ব্যাপারটা উল্লেখ করা হয়নি। 

একই অধ্যায়ে ১১৭ পৃষ্ঠায় যেখানে সূর্যের কেন্দ্রে শক্তির উৎপত্তি দেখানো হয়েছে – সেখানে আমাদের বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার আয়নাইজেশান সূত্রকে খুব বেশি মিস করেছি। এই বইতে মেঘনাদ সাহার কাজ খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল, অথচ মেঘনাদ সাহা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। 

১৫তম অধ্যায়ে ১৭৭ পৃষ্ঠায় ১৯৫৬ সালে ট্রানজিস্টার উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন বেল ল্যাবের দুজন বিজ্ঞানীর জায়গায় তিনজন বিজ্ঞানী হবে। 

এই বইয়ের শেষে তথ্যনির্দেশে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের টীকা দেয়া আছে – যা কোন পাঠককে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দেবে। 

শুধু এই বইয়ের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো বিজ্ঞানের বইতেই আমি বইয়ের শেষে শব্দের নির্ঘন্টটা খুব মিস করি। প্রকাশকরা হয়তো বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা না বাড়ানোর জন্য, বইয়ের দাম কম রাখার জন্য নির্ঘন্ট দেন না, কিন্তু ইনডেক্স বা নির্ঘন্ট ছাড়া যে কোনো মননশীল বই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কারণ এসব বই তো শুধুমাত্র একবার পাঠের জন্য নয়। পরে যখন এই বই আমি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবো – তখন পুরো বই আমাকে তন্ন তন্ন করতে হবে কোন নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য। 

আরো একটি ব্যাপার আমি খুব মিস করি বাংলা বইয়ে – সেটা হচ্ছে ক্রস রেফারেন্স বা টীকা। যেমন এই বই থেকেই উদাহরণ দিই – পৃষ্ঠা ৪৭ – “তাঁর এই গবেষণার ফল অচিরেই জার্নালে প্রকাশিত হলো।“ পাঠক এখানে জানতে চাইতে পারেন সেই জার্নালের ফুল রেফারেন্স। সেটা টীকা আকারে দেয়া যেতো। পৃষ্ঠা ৫৭ – হাবল তাঁর বাবার মৃত্যুর পর কীভাবে মনের অবস্থা বর্ণনা করেছেন তার উদ্ধৃতি আছে। কিন্তু রেফারেন্স নেই। পাঠকের কৌতূহল এখানে মিটছে না। সেজন্য লেখক ও প্রকাশকদের কাছে আমার আবেদন – বইয়ের পৃষ্ঠা কমিয়ে দাম যতই কম রাখার চেষ্টা করুন – যিনি বই কিনবেন না তিনি কিছুতেই কিনবেন না। আর ভালো বই ভালোভাবে বের করেন, পাঠক কিনবে। কারণ বাংলাদেশের বইয়ের দাম এখনো ফাস্টফুডের দামের চেয়ে অনেক কম। 

মহাজাগতিক প্রথম আলোর পাঠক আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি থেকে বর্তমান অবস্থায় আসার বিভিন্ন ধাপগুলির প্রমাণ তো পাবেনই – সাথে পাবেন মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করার খোরাক। এধরনের বিজ্ঞানের বই চিন্তার খোরাক জন্মায় – এখানেই লেখকের সাফল্য। 


বই - মহাজাগতিক প্রথম আলো

লেখক – আবুল বাসার

প্রকাশক – প্রথমা প্রকাশন

প্রকাশকাল – ২০২২

পৃষ্ঠাসংখ্যা – ২৪০

মুদ্রিত মূল্য – ৫০০ টাকা

ISBN 978 984 96885 0 1


স্টিফেন হকিং-এর জন্মদিন ২০২৪

 


স্টিফেন হকিং এর জন্মদিন ৮ জানুয়ারি। 

বেঁচে থাকলে তিনি আজ ৮২ হতেন। বিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর মতো জনপ্রিয়তা ছিল আর মাত্র তিনজনের – গ্যালিলিও, নিউটন আর আইনস্টাইনের। 

গ্যালিলিও, নিউটন এবং আইনস্টাইন তাঁদের নিজ নিজ আবিষ্কারের মাধ্যমে মহাবিশ্বের বিজ্ঞানের চেহারা বদলে দিয়েছেন – সেটা তাঁদের মৃত্যুর এত বছর পরেও বার বার প্রমাণিত হয়েই চলেছে। কিন্তু হকিং আসলে কী করেছেন যার জন্য তিনি এত খ্যাতি লাভ করেছেন – সেই প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর নেই – এমন কোনো প্রমাণও হাতে নেই যে বলা চলে হকিং না থাকলে এরকম হতো কিংবা ওরকম হতো। 

হকিং-এর মৌলিক কাজ যতটা – তার চেয়েও অনেক বেশি হলো তাঁর জনপ্রিয় বিজ্ঞান বা পপুলার সায়েন্সের বইগুলি। সেগুলিরও পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছে – হকিং-এর সার্বক্ষণিক মিডিয়া উপস্থিতির কারণে। হকিং-এর মতো মিডিয়া-পণ্য আর কোন বিজ্ঞানী কোন যুগেই হয়ে ওঠেননি। 

ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘ডেইলি সান’ প্রায় প্রতিদিনই স্টিফেন হকিং-কে নিয়ে নানারকম সংবাদ ছাপাতো। তাদের বিজ্ঞানপাতা জুড়ে হকিং-এর নামে যা থাকতো – তাতে আর যাই থাকুক – বিজ্ঞান থাকতো না। যেমন হকিং এর বয়ানে বলা হতো – এলিয়েনরা পৃথিবীতেই মানুষের মাঝে মিশে আছে- এরকম আরো অনেক কিছু। ২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি – হকিং-এর ৭৬তম জন্মবার্ষিকীর কয়েক দিন পরেই বিশাল এক প্রবন্ধ ছাপানো হয় ডেইলি সানে – যেখানে অনুমান করা হয়েছে প্রকৃত স্টিফেন হকিং মারা গেছেন অনেক বছর আগে, যে হকিং হুইল চেয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন – তিনি আসলে হকিং-এর মতো দেখতে একটি পুতুল। এরকম সন্দেহ হবার পেছনে তারা কিছু কারণ দেখিয়েছে – যেমন হকিং-এর যে অসুখ হয়েছে – তাতে এত বছর বেঁচে থাকার কথা নয় কিছুতেই, হকিং-কে ২০১৭ সালে দেখতে ১৯৮২ সালের চেয়েও তরুণ মনে হয়, কথা যেহেতু তিনি বলতে পারেন না, সেহেতু কম্পিউটারের ভয়েজ আগে যেমন ছিল এখনো তেমন আছে, কিন্তু আগে তিনি কথা বলতে অনেক সময় নিতেন, কিন্তু এখন অনেক তাড়াতাড়ি কথা বলতে পারেন, তিনি আগে এত রাজনীতি বিষয়ক (ট্রাম্প বিরোধী, ব্রেক্সিট বিরোধী) কথাবার্তা বলতেন না – ইত্যাদি ইত্যাদি। এর দুমাস পর হকিং সত্যিই মারা যাবার পর এ বিতর্ক আর বেশিদূর এগোয়নি। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেছেন যে হকিং আসলে ১৯৮৫ সালেই মারা গেছেন নিউমোনিয়ায়। অবশ্য তাদেরকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার  কোন দরকার নেই – কারণ হকিং-এর এত্তো জনপ্রিয় সব বই লেখা হয়েছে ১৯৮৫ সালের পরে। 

[ডেইলি সান এর রিপোর্টটির লিংক নিচে দেয়া হলো। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।]

হকিং-এর শারীরিক অক্ষমতা যতটা না তাঁর জীবনধারণ কঠিন করে তুলেছে – তার সেই অক্ষমতাকে ফোকাস করেই মিডিয়াগুলি দিনের পর দিন হকিং-কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বানিয়ে দিয়েছে সুপারস্টার। গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে শুরু করে আমৃত্যু হকিং তা উপভোগ করে গেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ভ্যাটিকানের পোপ, ইংল্যান্ডের রানি – সবার সাথেই তাঁর মিডিয়া-প্রেজেন্সের আয়োজন করেছিলেন তাঁর আয়োজক-কোম্পানি, বিভিন্ন ইভেন্টে জনপ্রিয় বক্তৃতা, নাসার জিরো-গ্রাভিটি শাটলে ভ্রমণ, বিগ-ব্যাং থিওরির মতো সিরিয়ালে উপস্থিতি –ইত্যাদির মাধ্যমে তারা শুধুমাত্র মিডিয়াস্বত্ব থেকেই উপার্জন করেছে লক্ষ লক্ষ ডলার/পাউন্ড/ইউরো। 

স্টিফেন হকিং এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে হলিউডের বিখ্যাত (যৌন নির্যাতক হিসেবে পরবর্তীতে কুখ্যাত) জেফরি এপস্টেইন তাঁর সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন এবং বিভিন্ন পার্টিতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন। অতিসম্প্রতি শিশুদের উপর যৌননির্যাতনের এক মামলার নথিতে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসন, ব্রিটিশ রাজপুত্র অ্যান্ড্রুর পাশাপাশি স্টিফেন হকিং-এর নামও এসেছে – যারা জেফরি এপস্টেইনের পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন যেখানে যৌন নির্যাতন ঘটেছিল। হকিং-এর বিরুদ্ধে অবশ্য কোন অভিযোগ করা হয়নি।

তাহলে যতটা মিডিয়া কভারেজ পেয়েছেন, সেই তুলনায় হকিং-এর যুগান্তকারী আবিষ্কার বলে কি কিছুই নেই? অবশ্যই আছে। ব্ল্যাক হোল থেকে যে বিকিরণ ঘটে যা ‘হকিং রেডিয়েশান’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে তা নিঃসন্দেহে তাঁর বড় তাত্ত্বিক আবিষ্কার। বেঁচে থাকলে ২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের তিনিও অংশীদার হতে পারতেন – সেক্ষেত্রে হয়তো রেইনহার্ড গেনজেল অথবা অ্যান্ড্রিয়া গেজ – কেউ একজনকে বাদ দিতে হতো। কিন্তু সিংগুলারিটি বিষয়ে রজার পেনরোজের তাত্ত্বিক কাজ হকিং-এর কাজের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তৃত। 

হকিং-এর বৈজ্ঞানিক অবদানের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন আরো অসংখ্য বিজ্ঞানী। তাঁদের কাজের জন্য তাঁরা নোবেল পুরষ্কার পেলেও – পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ তাঁদের চেনেনও না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা আর জনপ্রিয় হওয়া এক কথা নয়। স্টিফেন হকিং জনপ্রিয় ছিলেন – থাকবেন আরো অনেক বছর সন্দেহ নেই।

শুভ জন্মদিন স্টিফেন হকিং। 

___________

ডেইলি সানের লিংক



Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts