Sunday 30 May 2021

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা - সীমাবদ্ধ

 



কথাশিল্পী শংকর তাঁর উপন্যাস থেকে চলচিত্র তৈরির ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন  এভাবে - গল্প হলো লেখকের কাছে নিজের কন্যার মতো। আর সেই গল্প যখন সিনেমার জন্য দিয়ে দেয়া হয় - তখন মূলত কন্যাসম্প্রদান করা হয়। কন্যার বিয়ের পর যেমন পিতার আর তেমন কিছু করার থাকে না, তেমনি গল্প থেকে সিনেমা হলে সেখানে পরিচালকের উপর কাহিনিকারের তেমন কিছু বলার থাকে না। সত্যজিৎ রায় শংকর এর উপন্যাস থেকে দুইটি সিনেমা তৈরি করেছেন। জন অরণ্য এবং সীমাবদ্ধ। দুটি সিনেমার কোনটির কাহিনিতেই তেমন কোন পরিবর্তন তিনি করেননি। সত্যজিৎ রায় সবসময় এমন কাহিনিই বাছাই করেন যেন কাহিনির খুব বেশি পরিবর্তন না করতে হয়। 

একটি বিদেশী কোম্পানির ফ্যান সেকশানের সেল্‌স চিফ শ্যামলেন্দু। খুব ধীরে ধীরে খুব ছোট অবস্থা থেকে কোম্পানির অনেক উঁচু লেভেলে উঠেছেন শ্যামলেন্দু। উঁচু পদে উঠতে যত কষ্ট করতে হয়, ধরে রাখতে আরো বেশি কষ্ট করতে হয়। এখানে কষ্ট মানে শারীরিক পরিশ্রম নয়। এখানে কষ্ট মানে কৌশল, অফিসের রাজনীতি আর প্রয়োজনে অন্যায় করার মানসিকতা। শ্যামলেন্দু ঠিক তাই করে - যতটা করতে হয় উপরে উঠার জন্য। মালিকের স্বার্থ দেখার জন্য কারখানায় গন্ডগোল লাগিয়ে দেয়। তার পুরষ্কারও পায় সে। কোম্পানির ডিরেক্টর হয়। কিন্তু নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যায়। নিজের শ্যালিকার কাছে সে মুখ দেখাতে পারে না। কারণ আদর্শবান শ্যালিকা সব জেনে যায়। 

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা মানে বাস্তব চরিত্রের দৃশ্যায়ন। একটুও বাহুল্য নেই কোথাও, আবার ডিটেল্‌স এর এক ফোঁটা কমতি নেই কোথাও। কী চমৎকার অভিনয় বরুন চন্দ, শর্মিলা ঠাকুরসহ সবার। 


ইউটিউব থেকে সিনেমাটি দেখতে পারেন লিংকে। 





Saturday 29 May 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - ২২

 

স্বপ্নলোকের চাবি – ২২

এই সেদিন পর্যন্তও কবিতার সাথে আমার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি তার ধারে কাছে যেতাম না। স্কুল-কলেজের সিলেবাসে যে কয়টা কবিতা ছিল তার বাইরে অন্য কোন কবিতা পড়ার প্রতি কোন উৎসাহ পাইনি তখন। স্কুলের ক্লাসে কবিতা মুখস্থ করতে হতো বলে খুব বিরক্ত লাগতো। কলেজে পড়ার সময় আ-ফ-ম সিরাজদৌলাস্যার আধুনিক-কবিতা রচনার আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল আধুনিক-কবিতা রচনার মতো সহজ কাজ আর নেই। সিরাজস্যার বলতেন, “এক পাতা গদ্য লিখে তাকে কোণাকুনি কেটে দুই টুকরা করে ফেললে দুইটা অত্যাধুনিক কবিতা হয়ে যাবে। কবিতায় যত বেশি দুর্বোধ্যতা, তত বেশি আধুনিকতা।“ কয়েকটা ছোটখাট উদাহরণও দিতেন। যেমন –

“জ্বর হয়েছে, সা

গু খেয়েছি।

চিঠি তোমার স

কালে পেয়েছি।।“

“উপরে আসমান নিচে মাটি

আমার গাল, তোমার চটি।“

“অস্তবেলার সূর্য টুকটুকে লাল,

যেন এক আস্ত মসুরের ডাল।“

সিরাজস্যার নিজেও যে একজন আধুনিক কবি তা সেই সময় জানতাম না। যে বয়সে আমরা সিরাজস্যারের এই বয়ান শুনেছি ক্লাসে বসে, সেই বয়সেই সুকান্ত ভট্টাচার্য রচনা করে ফেলেছেন কত কালজয়ী কবিতা। কবিতার আশ্চর্য শক্তি সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি মাত্র কিছুদিন আগে। শিল্পকলা একাডেমিতে কলকাতার আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষের আবৃত্তি শুনে কবিতার এক নতুন রূপ দেখতে পেলাম। পাঠগুণে কবিতার শক্তি বাড়ে। এরশাদ বাংলাদেশের ‘সিংহাসন’ দখল করার পর রাতারাতি কবি হয়ে গেছেন। দেশের অনেক বিখ্যাত কবিও এরশাদের ‘রাজকবি’ হবার জন্য এরশাদের দরবারে নিয়মিত কবিতা পাঠ করছেন। কিন্তু তার বিপরীতে জেগে উঠেছে সারাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সমাজ। যে কবিরা কবিতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাঁরা এখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। ফেব্রুয়ারির ২৫-২৬ তারিখে মুসলিম হলে বসেছিল প্রতিবাদী কবিতার আসর। সেই দুদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বুঁদ হয়ে ছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। মুহাম্মদ নুরুল হুদা, মহাদেব সাহা, জিয়া হায়দার, মুহাম্মদ রফিক, ইব্রাহিম আজাদ, হেলাল হাফিজ, অজয় দাশগুপ্ত, বিশ্বজিৎ চৌধুরি, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হকের মতো কবিদের কন্ঠে সরাসরি তাঁদের নিজেদের কবিতা। তার পাশাপাশি কেয়া চৌধুরি, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলাদেশের বিখ্যাত আবৃত্তিকাররা কবিতাকে নিয়ে গেছেন একটি অন্য মাত্রায়। কবিতা শুনে মনে হয়েছে প্রচন্ড ক্ষমতাশালী সামরিক বাহিনীর ট্যাংকের সামনে দাঁড়ানোর সাহস আর কারো না থাকলেও কবিতার থাকে। এই ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেলের চোখে চোখ রেখে একজন নিরস্ত্র শামসুর রাহমান লিখে ফেলতে পারেন,

“কিন্তু হে লৌহমানব

আপনি খেয়ালখুশির খেয়া ভাসালেই

নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে না সূর্যোদয় কিংবা পূর্ণিমা,

প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বন।

আপনি প্রাণভরে গার্ড অব অনার নিতে পারেন আর

একজন কবিকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন

ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে,

বহ্ন্যুৎসব করতে পারেন তার গ্রন্থরাজি দিয়ে,

পারেন আপনি পারেন;

তবু তার কবিতাবলি বন্দুকের ধমককে

উপেক্ষা করে ঈগলের মতো উড়তে থাকবে,

উড়তে থাকবে, উড়তে থাকবে।“

মানুষের ভেতরের শুভবোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য অবাধ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। নাটক, সংগীত, নৃত্য, কবিতা, ইত্যাদি শিল্পকলার যত মাধ্যম আছে সবগুলিরই ভূমিকা আছে একটি দেশের সাধারণ মানুষের মনন তৈরিতে। এসব বন্ধ করে দিলেই মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ মুখ থুবড়ে পড়বে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিবিরের রাজত্ব চলছে। এখানে যা কিছু বাঙালির সংস্কৃতি – তার সবই একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে কোন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চোখে পড়েনি ক্যাম্পাসে। সরাসরি কোন নিষেধাজ্ঞা কেউ জারি করেনি, তবে শুনেছি কেউ কিছু আয়োজন করার পরিকল্পনা করলেই শিবিরের গোয়েন্দা বিভাগ খবর পেয়ে যায়। আর আয়োজনকারীর কাছে শিবিরের ‘হুমকিবার্তা’ পৌঁছে যায়। প্রাণের মায়া তো সবারই আছে। সারাদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাস যেন বাংলাদেশের বাইরে – পাকিস্তানের কোন এলাকা। এতগুলি হলের কোথাও কোন সাংস্কৃতিক কাজকর্ম নেই।

সারাদেশে এত আন্দোলনের মধ্যেও এরশাদের আগ্রাসী কাজকর্ম থেমে নেই। মার্চের তিন তারিখ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কিংবা জামায়াত – কেউই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এরশাদের দল জাতীয় পার্টি তিন শ সিটের মধ্যে ২৫১ সিটে জয় লাভ করেছে, যার মধ্যে ১৮টি সিটে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। বিরোধী দলীয় নেতা হয়েছেন আ-স-ম আবদুর রব। রাজনীতির কী বিচিত্র খেলা। মওদুদ আহমেদ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আন্দোলন হচ্ছে আর পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এত কিছু ঘটছে- অথচ তার প্রতিবাদে আমাদের ক্যাম্পাসে কিছুই হচ্ছে না। দেশের কোথাও যদি জামায়াতে ইসলামী বা শিবিরের বিরুদ্ধে কিছু ঘটে তখনই শিবির আমাদের ক্যাম্পাসে অবরোধ ডাকে, মিছিল মিটিং করে, ক্লাস বন্ধ করে দেয়। কিন্তু অন্য কোন পার্টি যদি অবরোধ ডাকে, ক্যাম্পাসে শিবিরের ছেলেরা স্যারদের ডেকে নিয়ে এসে ক্লাস করায়। ক’দিন আগে ঐক্য পরিষদের ডাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবরোধ হবার কথা ছিল। আমরা যাইনি সেদিন। কিন্তু পরদিন শুনলাম রশীদুন্নবী স্যারের ক্লাস হয়েছে।

আমার ব্যক্তিগত পাঠ্যসূচিতে কবিতার বই ঢুকে পড়তে শুরু করেছে। শহরে গেলেই নিউমার্কেটের দোতলায় ‘বইঘর’-এ ঢুকে পড়ি। সারি সারি কাচের বুকশেল্‌ফ-এ সাজানো কত্তো কবিতার বই। শামসুর রাহমানের অনেক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এই বইঘর থেকে। বইঘরে ভীড় দেখিনি কখনোই। আশেপাশের অন্যান্য মনোহারি বিপনির দাপটের কাছে এই গ্রন্থবিপনি কতদিন টিকে থাকতে পারবে জানি না।

অনেকগুলি লিটল ম্যাগাজিন বের হয় উঠতি লেখকদের উদ্যোগে। বেশিরভাগই একটি দুটি সংখ্যার বেশি বের করতে পারে না। এই ম্যাগাজিনগুলি পাওয়া যায় জলসা সিনেমার পাশে কারেন্ট বুক সেন্টারে। সেখানেও নিয়মিত যাই। গ্রুপ থিয়েটারের নিয়মিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘থিয়েটার’-এর নতুন সংখ্যা বের হলেই কিনে ফেলি। খুব দামি সাদা কাগজে ছাপানো হয় এই পত্রিকা। প্রতিটি সংখ্যাতেই এক বা একাধিক নাটক থাকে। আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হক-এর নাটক মঞ্চস্থ করে ঢাকার থিয়েটার গ্রুপ। চট্টগ্রামে বছরে এক দু’বার মাত্র শো করতে আসে ঢাকার দলগুলি। আমি অপেক্ষা করতে থাকি – কখন তারা আসবে।

কবিতার ক্যাসেট বের হচ্ছে অনেক। নিউমার্কেটের চার তলায় বিভিন্ন দোকানের শোকেসে দেখা যায় কাজী সব্যসাচী, কামরুল হাসান মঞ্জু, পার্থ ঘোষ – গৌরী ঘোষ, ইকবাল বাহার চৌধুরি – এরকম অনেকের কবিতার ক্যাসেট। একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কেনার জন্য টাকা জমাতে থাকি। ইলেকট্রনিক্সের ব্যাপারে প্রদীপ নাথের অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তাদের বাড়িতে সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি আছে। সবই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তাদের গ্রামটাকে মধ্যপ্রাচ্যের গ্রাম বলা চলে। নাথকে নিয়ে একদিন গেলাম নিউমার্কেটে। নিউমার্কেটের চার তলার পুরোটাই ইলেকট্রনিক্সের মার্কেট। তার পরিচিত এক দোকানে গেলাম। আমার প্ল্যান হলো একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কেনা। রেডিওর দরকার নেই। কারণ রেডিও সাথে থাকলে তার জন্য লাইসেন্স করাতে হয়। প্রতি বছর সেই লাইসেন্স রিনিউ করতে হয়। এক ব্যান্ডের একটা রেডিও আমার আছে। আরেকটার দরকার নেই। এখন সবচেয়ে কম দামের একটা ক্যাসেট প্লেয়ার হলেই চলে। নাথ আমার হয়ে দোকানদারের সাথে কথাবার্তা বলছে। তাদের কথোপথন থেকে অনেক নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে। বাজারে নাকি দু’নম্বরী ইলেকট্রনিক্সে সয়লাব হয়ে গেছে। লেখা আছে ‘মেইড ইন জাপান’, আসলে মেইড ইন জিঞ্জিরা।

দোকানদার আমার জন্য একটা ‘এক-নম্বরী’ জিনিস বের করলেন। একদাম বারো শ টাকা। আমার পকেটে বাসভাড়া বাদ দিয়ে আছে মাত্র আট শ টাকা। নাথের কাছে আছে মাত্র পঞ্চাশ টাকা। বারো শ টাকা আমার দুই মাসের বাজেট। চার মাস টিউশনি করলে আমি বারো শ টাকা পাই। এতদূর এসে না কিনে চলে যাবো? কিন্তু আরো চার শ’ টাকা কোত্থেকে পাবো? দিদির বাসায় গিয়ে টাকা ধার চাইলে পাবো – কিন্তু উপযুক্ত কারণ দর্শাতে হবে। বই কিনতে হবে বললে সে টাকা দেবে, কিন্তু ক্যাসেট প্লেয়ার কেনার জন্য টাকা সে দেবে না। কিছুদিন পরে কিনতে হবে। কিন্তু দোকানদার সেটা শুনে বললেন, “এই জিনিস কয়েকঘন্টার মধ্যেই চলে যাবে। এই একটাই আছে।“ – এই একটাই কেন এতক্ষণ রয়ে গেছে জানি না, কিন্তু আমার মনে হলো আজকেই এই ‘ক্যাসেট প্লেয়ার কেনা প্রকল্প’ শেষ করে ফেলা দরকার।

রিকশা নিয়ে দ্রুত চট্টগ্রাম কলেজের রেড বিল্ডিং হোস্টেলে এলাম। জানতাম অজিতকে রুমেই পাওয়া যাবে। তার সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে কিছুদিনের মধ্যে। দেখলাম সে তার সিটের চারপাশে পর্দা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মনে হচ্ছে তাবুবাসী হয়ে গেছে পরীক্ষা উপলক্ষে। ধানাইপানাই না করে সরাসরি বললাম, “আমাকে চার শটা টাকা দে।“ সে নিঃশব্দে টেবিলে লাগানো বুকশেলফের বইয়ের ভেতর থেকে একটা মোটা বই টেনে নিয়ে তার ভেতর থেকে একতাড়া এক শ টাকার নোট বের করে বললো, “চার শ টাকায় হবে?”

“হ্যাঁ হবে।“

অজিতকে আমার আশ্চর্য লাগে। কী কারণে টাকা লাগবে একবারও জিজ্ঞেস করলো না। তার নিজের কাছে টাকা না থাকলে অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে হলেও টাকা দেবে। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে না কেন লাগবে। হোস্টেলে আমার আরো অনেক বন্ধু আছে। সবার সাথে দেখা করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। নাথকে নিয়ে আবার নিউমার্কেটে গেলাম। ক্যাসেট প্লেয়ারটি কিনলাম। আমার প্রথম ক্যাসেট-প্লেয়ার। এবার একটা আবৃত্তির ক্যাসেট। নিউমার্কেটে কাজী সব্যসাচীর একটা ক্যাসেট এক শ টাকা দাম। নাথ বললো, “তোকে আমি আরো ভালো দোকান দেখাচ্ছি, অনেক কম দামে পাবি।“ মিউনিসিপ্যালটি স্কুলের পাশ দিয়ে হকার্স মার্কেটে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে এলাম খুরশিদ মহল সিনেমার সামনে। এখানে হকার্স মার্কেটের এদিকের রাস্তার মুখে বেশ বড় ক্যাসেটের দোকান ‘ঝংকার’। কাজী সব্যসাচীর দাম এখানে মাত্র ত্রিশ টাকা।

তারপর থেকে রুমে অনবরত কবিতা চলছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলি ক্যাসেট কিনে ফেলেছি। যতক্ষণ রুমে আমি থাকি এবং কারেন্ট থাকে, ক্যাসেট চলতে থাকে। শুনতে শুনতে অনেক কবিতার অনেকটুকু মুখস্থও হয়ে গেছে। ইদানীং কবিতাচর্চায় একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে – নাথ যার নাম দিয়েছে কাব্যচর্চা। এই কাব্যচর্চার স্বরূপ হলো ছন্দ মিলিয়ে কথা বলা। আগে ক্যাম্পাসে-ক্লাসে মৃণালের রুমের আড্ডায় এরকম কাব্যচর্চা চলতো। এখন নাথ আমার রুমে ওঠার পর এই কাব্যচর্চা আরো বেগবান হয়েছে।

প্রদীপ নাথ বাড়ি ছেড়ে আগে কোথাও এভাবে থাকেনি। সেই অতদূর মাদার্শা থেকে সাইকেল চালিয়ে সে প্রতিদিন এসে বাস বা ট্রেন ধরে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করে আবার বাড়ি ফিরে যায়। এভাবে সে ইউনিভার্সিটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে দুই বছর। এতদিন পরে তার মনে হলো কিছুদিন বাড়ির বাইরে থেকে দেখার – কেমন লাগে। আমার রুমে এসেছে মাত্র দু’দিন হলো। এই দু’দিন কেটে গেছে নতুন কিছু করার উৎসাহে। যেমন, পুর্নোদ্যমে রান্না শুরু করেছি রুমে। চৌধুরি হাট থেকে বাজার করে নিয়ে এসেছি। ডেকসিতে করে চাল ধোয়ার ব্যাপারে তার উৎসাহ ছোট্ট বাচ্চাদের মতো। কারণ জীবনের প্রথম নিজের হাতে চাল ধোয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। এখন রান্না বসিয়েছি স্টোভে। তরকারি দেখে সে মন্তব্য করলো,

“দিতে হবে আরেকটু পানি”

আমি বললাম, “জানি, আমি জানি”

সে চুপ করে ভাবতে লাগলো জানি’র সাথে কী মেলানো যায়। আমি বললাম, “আজকের রান্না”

সে একটুও না হেসে গম্ভীরভাবে বললো, “খেলে আসবে কান্না।“


আমাদের সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। নাথ গণিতে খুব দক্ষ। কাব্যচর্চা করতে করতেও আমাদের প্রয়োজনীয় অনেক গণিতচর্চা হয়ে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত আমাদের হাহাহিহি চলতে থাকে। কিন্তু তিন রাত যেতেই নাথের গৃহকাতরতা প্রবল হতে শুরু করলো। পাঁচ দিন ঘরের বাইরে থাকার পর তাকে দেখে মনে হলো কারাবন্দী কয়েদিদের মতো। পদ্যে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে গদ্যে উত্তর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে তার জীবনের ছন্দ হারিয়ে গেছে। বললাম, ‘একবার বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আয়। তোর তো কোন সমস্যা নেই এখানে, দিব্যি মনের আনন্দে আছিস। কিন্তু তোকে ছাড়া বাড়ির সবাই তো এভাবে থাকেনি কোনদিন। একবার দেখা দিয়ে আয়।“ পরের দিনই সে বাড়ি চলে গেল দেখা দেবার জন্য। আমি ভেবেছিলাম সে একেবারেই চলে গেল। কিন্তু না, পরদিন ফিরে এলো। সেই রাত থাকলো। পরের দিন দেখলাম সে জামাকাপড় গোছাচ্ছে। বুঝতে পারলাম, ‘কাঁদিতেছে তার গৃহগত প্রাণ’। ঘরের বাইরে তার এক সপ্তাহও থাকা হলো না। আবার তার সেই প্রতিদিনের দশ কিলোমিটার যাতায়াত শুরু হলো।

আমাদের আগের ব্যাচের সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমাদের ক্লাসে তার কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। যারা ড্রপ করেছে তারা আমাদের সাথে যোগ দিলো। ক্লাসে এলো মানস চক্রবর্তী, আশিস দাশগুপ্ত, ডল আপা, ঝর্ণা আপা, রানু আপা, এবং চিত্রলেখা চৌধুরি। ঝর্ণা আপার সাথে স্টাটিসটিক্সের ম্যাক স্যারের প্রেমপর্ব চলছে সেটা আমরা জানি। ভবিষ্যতে স্যারের বউ হবেন সে কারণে একটা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখি তার সাথে। ডল আপা আর রানু আপা নিয়মিত ক্লাস করছেন। মানস চক্রবর্তী আর আশিস দাশগুপ্তকে মানসদা, আশিসদা বলে ডাকছি – তারা বেশ হাসিমুখেই সায় দিচ্ছে। যীশু অবশ্য তাদেরকে ‘মানইস্যা’, ‘আশিস্যা’ বলছে নির্দ্বিধায়। কিন্তু চিত্রলেখার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সে একদিন ক্লাসে এলো। মনে হলো তাকে অনেকেই চেনে। কী কারণে চেনে জানি না। করিডোরের যেখানে নোটিশ বোর্ড আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা যথারীতি আড্ডা মারছি – চিত্রলেখা এসে আমাকে বললো, “শোন, তোমার সাথে কথা আছে।“

“আমার সাথে?”

“তোমার নাম প্রদীপ্ত?”

“আমার নাম প্রদীপ্ত নয়, প্রদীপ।“

“প্রদীপ্ত বলিনি, প্রদীপ তো - বলেছি।“

“ওর নামও প্রদীপ।“ – নাথকে দেখিয়ে বললাম।

“তুমি সুমনের বন্ধু না? চিটাগং কলেজের ইকোনমিক্সের সুমন?”

“হ্যাঁ”

“তুমি তো সব ক্লাস কর। তোমার ক্লাসনোটগুলি কি আমাকে একটু দেবে? আমি তো ক্লাস করিনি একটাও। আমার নাম চিত্রলেখা চৌধুরি। হয়তো চেনো আমাকে।“

চিত্রলেখা চৌধুরির গলাটা বেশ জোরালো। উচ্চারণে রাবীন্দ্রিক শুদ্ধতা। চিনলাম। ইনিই চট্টগ্রাম বেতারের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী চিত্রলেখা চৌধুরি। সুমন বলেছিল তার কথা। তার ছোটভাই সুমনের ফ্রেন্ড। তাকে কি আমার দিদি বলা উচিত? না, দিদি বললে পেয়ে বসবে। বাংলার দিদিরা ছোটভাইদেরকে কাজের অর্ডার দিতে একটুও দেরি করে না।

“ও সব ক্লাস করেছে। সব ক্লাসনোট তার সাথেই আছে। আপনি এখনি নিয়ে নেন।“ – নাথ মহাউৎসাহে আমার খাতা ধরে টানাটানি শুরু করলো। আমি তার দিকে চোখ কটমট করে তাকানোর পরেও কোন কাজ হলো না।

“না, না, খাতা দিতে হবে না। তুমি খাতাগুলি সব ফটোকপি করে কালকে নিয়ে এসো আমার জন্য। ঠিক আছে?” – বলে রাজকীয় ভঙ্গিতে করিডোর ধরে হেঁটে চলে গেলেন। আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না এভাবে কাউকে অর্ডার দেয়া যায়। 


<<<<<<<<<<<<<<< আগের পর্ব

Thursday 27 May 2021

কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা

 



ভর মাপার আন্তর্জাতিক একক কিলোগ্রাম একটি নতুন সংজ্ঞা পেয়েছে ২০১৯ সালের ২০মে। সেদিন থেকে বদলে গেছে কিলোগ্রামের প্রচলিত সংজ্ঞা। ১৬ নভেম্বর ২০১৮ ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অনুষ্ঠিত 'ইন্টারন্যাশনাল ব্যুরো অব ওয়েটস অ্যান্ড মেজারস' (BIPM) এর ২৬তম 'জেনারেল কনফারেন্স অন ওয়েট্‌স অ্যান্ড মেজারস' (CGPM)-এর নীতিনির্ধারণী অধিবেশনে 'ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর ওয়েট্‌স অ্যান্ড মেজারস' (CIPM)-এর প্রস্তাবিত কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এর পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিলোগ্রামের পরিমাপ সম্পর্কে। কোন কোন সংবাদপত্র হেডলাইন করেছে 'কিলোগ্রাম বদলে গেছে' (kilogram has changed), 'কিলোগ্রাম মারা গেছে' (kilogram is dead) ইত্যাদি। উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য উন্মাদ হয়ে যায় সংবাদ মাধ্যমগুলো। আসল ব্যাপার হলো কিলোগ্রাম বদলেও যায়নি, মারাও যায়নি। ১৮৮৯ সাল থেকে এক কিলোগ্রাম পদার্থ বলতে যতটুকু পদার্থ বোঝানো হয়, এখনো ঠিক ততটুকুই বোঝানো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যেন ঠিক ততটুকুই থাকে তার জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এই নতুন সংজ্ঞায়। সঠিক সংবাদ শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল 'কিলোগ্রাম অমরত্ব পেতে যাচ্ছে'দেখা যাক ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছে। 

পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব এবং বুদ্ধির বিকাশের শুরু থেকেই মানুষ মাপজোখ শুরু করেছে। শুরুতে এ কাজে ব্যবহার করেছে নিজেদের শরীরের বিভিন্ন অংশ। দৈর্ঘ্য মাপার জন্য হাত, বিঘত, আঙুল, পা (ফুট) ইত্যাদি। ভর মাপার জন্য এক মুঠো, দুই মুঠো ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। তারপর ক্রমান্বয়ে বিবর্তন হতে হতে এক এক গোষ্ঠীর মধ্যে এক এক ধরনের পরিমাপের এককের প্রচলন ঘটলো। তারপর যখন এক গোষ্ঠীর সাথে অন্য গোষ্ঠীর মধ্যে জিনিস আদান-প্রদান বা ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হলো - তখন সবার গ্রহণযোগ্য এককের দরকার হলো। এভাবে শুরুতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের পরিমাপের প্রচলন ঘটলো। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, ইওরোপ, এশিয়া - ইত্যাদি অঞ্চলভিত্তিক পরিমাপ-ব্যবস্থা গড়ে উঠলো। ক্রমে ক্রমে অনেক রাজা-বাদশার হাতে অনেক রকমের পরিবর্তন পরিবর্ধন ও সংস্কারের পর একটা বিশ্বজনীন পরিমাপ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ম প্রবর্তিত হতে শুরু করলো।

ফরাসী বিপ্লব চলাকালীন ১৭৯০ সালে ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্স সব ধরনের পরিমাপের জন্য একটি আদর্শ পরিমাপ পদ্ধতির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেমেট্রিক পদ্ধতির প্রাথমিক সূচনা হয় সেই সময়। শুরুতে ভর মাপার মূল এককের নাম ছিল গ্রেভ (grave) - যা পরে রূপান্তরিত হয় গ্রাম-এ। এক গ্রাম আদর্শ ভর মাপা হতো ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক ঘন সেন্টিমিটার আয়তনের পানির ভরের সমান। কয়েক বছরের মধ্যে ফ্রান্সে ১৭৯৯ সালে এক মিটার দৈর্ঘ্যের একটি প্লাটিনাম রড এবং এক কিলোগ্রাম ভরের প্লাটিনাম সিলিন্ডার তৈরি করা হয়। এক কিলোগ্রাম আদর্শ ভর ধরা হয় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০০০ ঘন সেন্টিমিটার পানির ভরের সমান।

১৮৬০-এর দশকে বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল ও থমসনের নেতৃত্বে 'ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশান ফর দি এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স' সেন্টিমিটার-গ্রাম-সেকেন্ড বা সিজিএস পদ্ধতি চালু করে। উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের বেগ ও ব্যাপ্তি দ্রুত বাড়তে থাকে এবং আন্তর্জাতিক পরিমাপের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে।

১৮৭৫ সালের ২০ মে ১৭টি দেশের অংশগ্রহণে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় 'ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশান অব দি মিটার'। সেই সম্মেলনে গঠিত হয় 'ইন্টারন্যাশনাল ব্যুরো অব ওয়েট্‌স অ্যান্ড মেজার্‌স' (BIPM) যা মেট্রিক একক নিয়ন্ত্রণের প্রধান আন্তর্জাতিক সংস্থা। ফ্রান্সে স্থাপিত হলো তার প্রধান দপ্তর। ১৮৮৯ সালে BIPM-এর প্রথম সাধারণ সভায় দৈর্ঘ্য, ভর ও সময়ের মূল একক মিটার, কিলোগ্রাম ও সেকেন্ড বা এম-কে-এস পদ্ধতি গৃহীত হয়। সেই প্রথম অধিবেশনে এক কিলোগ্রাম আদর্শ ভর হিসেবে গৃহীত হয় প্লাটিনাম ও ইরিডিয়াম ধাতুর তৈরি একটি সিলিন্ডার। এই সিলিন্ডারকে বলা হয় ইন্টারন্যাশনাল প্রোটোটাইপ কিলোগ্রাম বা সংক্ষেপে বিগ-কে।

সেই আদর্শ কিলোগ্রাম ভরের সিলিন্ডারটি ফ্রান্সে সযত্নে রক্ষিত আছে ১৮৮৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত। বাতাসের আর্দ্রতা কিংবা ধুলোবালি বা অন্য কোন কিছুর প্রভাবেই যেন এই আদর্শ ভরের কোন পরিবর্তন হতে না পারে সেজন্য এই সিলিন্ডারটি রাখা আছে একটি কাচের জারের ভেতর। সেই জারের উপর আছে আরেকটি জার, তার উপরে আছে আরেকটি জার। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন চাবি লাগবে এই সিলিন্ডারটিকে জারের ভিতর থেকে বের করতে হলে। বিগ-কে'র সমান ভরের অনেকগুলো ভর রক্ষিত আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবোরেটরিতে। সেই নমুনাগুলোর মাপ থেকেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ভরের নমুনা-ভর।

তারপর এই ১৩০ বছরে অনেক কিছু বদলালেও আদর্শ কিলোগ্রামের সংজ্ঞার কোন পরিবর্তন হয়নি। ১৯৬০ সালে BIPM-এর সাধারণ অধিবেশনে পরিমাপের সাতটি মৌলিক একক গৃহীত হয়: দৈর্ঘ্য - মিটার (m), ভর - কিলোগ্রাম (kg), সময় - সেকেন্ড (s), বিদ্যুৎ প্রবাহ - অ্যাম্পিয়ার (A), তাপমাত্রা - কেলভিন (K), বস্তুর পরিমাণ - মোল (mol), আলোর তীব্রতা - ক্যান্ডেলা (cd)ভর ছাড়া আর সবগুলো এককের সংজ্ঞা ইতোমধ্যে কয়েক বার পরিবর্তিত হয়ে এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যে ওগুলোকে মাপার জন্য আর কোন নমুনার উপর নির্ভর করতে হবে না। যেমন ১৮৮৯ সালে এক মিটার দৈর্ঘ্যের যে প্লাটিনামের দন্ডকে আদর্শ মিটার হিসেবে ধরা হয়েছিল, ১৯৬০ সালে তা বদল করা হয় ক্রিপ্টন-৮৬ আইসোটোপের নিঃসরণ রেখার দৈর্ঘ্যের সাথে। ১৯৮৩ সালে সেটাকে পরিবর্তন করে বর্তমান সংজ্ঞা গ্রহণ করা হয় যেখানে এক মিটার হচ্ছে আলো শূন্য মাধ্যমে এক সেকেন্ডের ৩০ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ে যেটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে ততটুকু।

সাতটি মৌলিক এককের মধ্যে ভরের একক কিলোগ্রামই রয়ে গিয়েছে যাকে এখনো একটি ধাতব নমুনা ভরের সাথে তুলনা করে পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু তাতে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো এই যে যদি কোন কারণে এই আদর্শ ভরের কোন পরিবর্তন ঘটে যায় - তাহলে পৃথিবীর সব ভরের পরিমাণই বদলে যাবে। দৈনন্দিন জীবনে কয়েক গ্রাম ভরের পরিবর্তনও আমরা উপেক্ষা করি যদি যা মাপছি তা খুব বেশি দামী না হয়। যেমন মাছের বাজারে যে কেজির নমুনাগুলো আমরা ব্যবহার করি তাতে পানি লেগে কেজির চেয়ে অনেক বেশি ভারি হয়ে যায়। তাতে আমরা খুব বেশি বিচলিত হই না। কিন্তু সোনা মাপার ক্ষেত্রে এক গ্রামের বিচ্যুতিও অনেক বিচ্যুতি। বর্তমান সূক্ষ্ণ প্রযুক্তির যুগে, ন্যানো-টেকনোলজির যুগে ন্যানো-গ্রাম ভর অর্থাৎ এক কিলোগ্রামের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগও যদি কম-বেশি হয় তাহলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা দেখা দেবে

কিলোগ্রামের বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী এক কিলোগ্রাম ভর হলো বিগ-কে সিলিন্ডারের ভরের সমান। বিগ-কে'র ভরের সমান করে যে ভরগুলো তৈরি করা হয়েছিল - সেগুলো ব্যবহার করতে করতে বাতাসের আর্দ্রতা শোষণের ফলেই হোক, বা অন্য কোন কারণেই হোক, দেখা গেছে সেগুলোর ভর  বিগ-কে'র ভরের চেয়ে প্রায় ৫০ মাইক্রোগ্রাম বেড়ে গেছে। অর্থাৎ আদর্শ কিলোগ্রাম ৫০ মাইক্রোগ্রাম হালকা হয়ে গেছে। তার মানে গত ১৩০ বছরে যত ভর মাপা হয়েছে সবগুলোই ভুল! কোন ধাতব বস্তুকে আদর্শ ভর ধরলে এই ভুল ঘটতেই থাকবে। তাই কিলোগ্রামের বর্তমান সংজ্ঞা বদলে নতুন সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে যেখানে ভর মাপার জন্য কোন নির্দিষ্ট নমুনা ভরের সাথে তুলনা করতে হবে না। কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা হবে: এক কিলোগ্রাম ভর হবে সেই ভর যার মাধ্যমে প্ল্যাংকের ধ্রুবক h এর মান হবে 6.62607015 X 10-34 J.s বা kg.m2.s-1 যেখানে মিটার ও সেকেন্ড মাপা হবে তাদের নিজ নিজ আদর্শ সংজ্ঞা থেকে।  অর্থাৎ মিটার মাপা হবে আলোর বেগ থেকে এবং সেকেন্ড মাপা হবে সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুর বিকিরণ থেকে।

এই সংজ্ঞা ঠিক করার জন্য বিজ্ঞানীদের কাজ করতে হয়েছে বছরের পর বছর। কারণ প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মান অত্যন্ত ছোট (দশমিকের পর তেত্রিশটি শূন্যের পর ৬৬২৬)। এত ক্ষুদ্র একটি রাশির মান সঠিকভাবে বের করার জন্য উপযুক্ত কারিগরি ব্যবস্থা আবিষ্কার করতে সময় লেগেছে অনেক বছর। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ব্রায়ান কিবল ১৯৭৫ সালে আবিষ্কার করেছিলেন মুভিং কয়েল ওয়াট ব্যালেন্স - যার সাহায্যে কোন বস্তুর ওজন (বল) এবং সেই ওজনের ফলে সৃষ্ট তড়িৎ-চুম্বক বলের সমতা নির্ণয় করা যায়। ওয়াট ব্যালেন্সের নামকরণ করা হয়েছে বিজ্ঞানী কিবলের নামে এবং কিবল ব্যালেন্সের সাহায্যে কিলোগ্রামের আধুনিক সংজ্ঞা অনুসারে ভর মাপা যায়।

এখন প্রশ্ন হলো ভরের সাথে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের সম্পর্কটা কী? কিবল ব্যালেন্সে এই সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত সূত্রকে কাজে লাগিয়ে।



ধরে যাক m ভর মাপতে হবে। ব্যালেন্সের এক দিকে m ভর দিলে অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর কারণে তার ওজন বা যান্ত্রিক বল হবে Fm = mg.

ব্যালেন্সের অন্যদিকে L দৈর্ঘ্যের তারের একটি কয়েলের ভেতর দিয়ে I পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করার পর যদি B পরিমাণ চৌম্বকক্ষেত্রে তৈরি হয়ে যান্ত্রিক বল এবং তড়িৎচুম্বক বল সমান হয়, সেক্ষেত্রে তড়িৎচুম্বক বল Fel = ILB = Fm = mg লেখা যায়। যেখান থেকে আমরা পাই,

mg = ILB. .......(Eq1)



এখন কয়েলটিকে চৌম্বকক্ষেত্রের সাথে উলম্বভাবে v বেগে সরালে বিদ্যুতক্ষেত্র তৈরি হয়ে যে ভোল্টেজ পাওয়া যাবে তার পরিমাণ

U = BLv ......(Eq2)

এখন (Eq1) (Eq2) থেকে পাই


Eq3 থেকে আমরা ভর m মাপতে পারি। কিন্তু তার জন্য আমাদের বিদ্যুৎপ্রবাহ, ভোল্টেজ, অভিকর্ষজ ত্বরণ, এবং কয়েলের গতিবেগ খুবই সূক্ষ্মভাবে মাপতে হবে। ভোল্টেজ মাপার সবচেয়ে সঠিক পদ্ধতি হলো মাইক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম ইফেক্ট ব্যবহার করা। সেজন্য সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করতে হয় যা জোসেফসন জাংশান নামে পরিচিত। N সংখ্যক জোসেফসন জাংশানের ভেতর দিয়ে f কম্পাঙ্কের মাইক্রোওয়েভ চালনা করলে যে ভোল্টেজ পাওয়া যাবে তার পরিমাণ,

 


ভোল্টেজ ও রেজিস্ট্যান্স এর সম্পর্ক থেকে কারেন্ট পাওয়া যায়,

 




খুবই সূক্ষ্মভাবে রেজিস্ট্যান্স মাপার উপায় হচ্ছে কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট ব্যবহার করা। কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট অনুসারে, রেজিস্ট্যান্স,



(Eq4) এবং (Eq6)-h হলো প্ল্যাংকের ধ্রুবক, e হলো ইলেকট্রনের চার্জ, n হলো কোয়ান্টাম নাম্বার। এখন (Eq3)-তে (Eq4), (Eq5) এবং (Eq6) ব্যবহার করে আমরা ভরের মান পেয়ে যাই,







(Eq7) থেকে ভরের যে মান পাওয়া যাবে তা হবে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সঠিকএই সমীকরণ ব্যবহার করে যে ভরের জন্য প্ল্যাংক ধ্রুবকের মান হবে 6.62607015 X 10-34 J.s, সেই ভরের পরিমাণ ১ কেজি। এটাই কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা। 

কিবল ব্যালেন্স


আমেরিকার ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিতে কিবল ব্যালেন্স ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে এবং কিলোগ্রামের নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভর সঠিকভাবে মাপতে শুরু করেছে। 

_________________

বিজ্ঞানচিন্তা ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় ইষৎ সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত





Wednesday 26 May 2021

চাঁদে লেগেছে গ্রহণ



আজ পূর্ণিমা। জোছনায় প্লাবিত চরাচর। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা যে রূপার থালার মতো বিশাল চাঁদ উঠেছিল, সেই চাঁদ ক্ষয়ে যেতে যেতে ঈদের চাঁদের মতো সরু হয়ে গেল কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। এবং একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে গেলো। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ আজ। আমাদের উঠোন থেকেই দেখা গেল এই প্রাকৃতিক ঘটনা। প্রতি বছরই ঘটে এই ঘটনা। কোন কোন বছর দু'বারও ঘটে। প্রকৃতির এই রহস্য মানুষ জেনে ফেলেছে অনেক বছর আগেই। তারপরও আমরা মোহিত হই। প্রিয় কবিতার জানা লাইনগুলি যেমন হাজার বার শুনলেও পুরনো হয় না, তেমনি এই আমাদের চাঁদ দেখা, তেমনিই এই পূর্ণিমার মায়া। তেমনিই চিরআশ্চর্য অনুভূতি যখন আমাদের চাঁদে লাগে গ্রহণ। 




২৬/৫/২০২১ মেলবোর্নের চন্দ্রগ্রহণ


প্রাচীন গ্রিকরা পৃথিবী যে গোলাকার তা বুঝতে পেরেছিলেন চাঁদের বুকে পৃথিবীর ছায়া দেখে। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে যে চন্দ্রগ্রহণ হয় তা ইওরোপিয়ানরা জেনে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশ তখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানে ততটা উন্নতি করতে শুরু করেনি। বিভিন্ন দেশে চন্দ্রগ্রহণকে অশুভ বলে মনে করা হতো। তেমনি একটা ঘটনার সুযোগ নিয়েছিলেন স্পেনিশ নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস - যাকে আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয়। 
১৫০৪ সালে কলম্বাস জ্যামাইকায় গিয়েছিলেন সেখানে কোন ধনসম্পদ পাওয়া যায় কিনা দেখতে। জ্যামাইকানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনুন্নত। কলম্বাস ও তার লোকজন জ্যামাইকানদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছিলেন। অর্থাৎ শোষণ করছিলেন। ইওরোপিয়ানরা এক সময় বিশ্বজুড়ে তাই করেছে। একসময় জ্যামাইকানরা বিদ্রোহ করে। কলম্বাসের কাজ করে দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। কিন্তু ধূর্ত কলম্বাস জানতেন যে ২৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ হবে। তিনি সেদিন জ্যামাইকানদের ধমক দিয়ে বললেন তারা যদি স্প্যানিশদের নির্দেশমত কাজ না করে তাহলে স্প্যানিশ দেবতা তাদের শাস্তি দেবে। দেবতা তাদের কাছ থেকে আকাশের চাঁদ নিয়ে যাবে। 
যথাসময়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলো। জ্যামাইকানরা দেখলো সেই চাঁদ আস্তে আস্তে কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। কলম্বাস চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন যে এটা দেবতার অভিশাপ। জ্যামাইকানরা ভয়ে কলম্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। যথাসময়ে চন্দ্রগ্রহণও শেষ হলো। এই ঘটনা থেকে এটাই বোঝা যায় যে অজ্ঞতা থেকে মানুষের মনে কুসংস্কারের জন্ম নেয়। আর কুসংস্কারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মানুষ লাভবান হয়। যেমন এখনো অনেক মানুষ জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখিয়ে ভাগ্য গণনা করে, হাতে আংটি পরে হরেক পাথরের ভাগ্য ফেরানোর জন্য। জ্যোতিষীরা প্রায়ই বলে থাকেন অমাবস্যা-পূর্ণিমা, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণের সময় কী কী করতে হবে ইত্যাদি। আসলে চন্দ্রগ্রহণ খুবই সাধারণ স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। 




পূর্ণিমার সময় সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদ একই লাইনে চলে আসে। সূর্যের আলো সরাসরি পৃথিবীর ওপর পড়ে। ফলে যেদিকে চাঁদ আছে সেদিকে পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক ছায়া পড়ে। যেহেতু সূর্য পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড় সেহেতু পৃথিবীর ছায়ার দু'পাশে অনেক বড় প্রচ্ছায়াও তৈরি হয়। পূর্ণিমার চাঁদ যখন পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে থাকে তখন উজ্জ্বল ধবধবে রূপালী চাঁদ লাল হয়ে যায়। চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে আলোর বিচ্ছুরণে এই লাল রঙ তৈরি হয়। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় পুরো চাঁদটিই পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে থাকে। তারপর চাঁদ আস্তে আস্তে সরে গিয়ে পৃথিবীর প্রচ্ছায়ায় যখন আসে তখন চাঁদ আস্তে আস্তে তার উজ্জ্বলতা ফিরে পেতে থাকে। 
মানুষের শরীরের ওপর এই চন্দ্রগ্রহণের কোন প্রভাব নেই। স্বাভাবিক পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে আমরা যেভাবে চাঁদ দেখি ঠিক একই ভাবে চন্দ্রগ্রহণের সময়ও চাঁদ দেখা যায়। চন্দ্রগ্রহণে শুধুমাত্র চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়াটা পড়ে। খালি চোখে চাঁদ দেখলে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু অনেক মানুষ অজ্ঞতা ও সংস্কারের বশবর্তী হয়ে চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ দেখা তো দূরের কথা, কোন কিছু খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দেয়। অনেক বাড়িতে সেই সময় আগের রান্না করা খাবার থাকলে তা পরে ফেলে দেয়। এরকম অযৌক্তিক সংস্কার ত্যাগ করতে হবে। 


২০২৯ সাল পর্যন্ত পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের তারিখ

তারিখ

কোথা থেকে দেখা যাবে

৩১/০১/২০১৮

উত্তর-পশ্চিম ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু

২৮/০৭/২০১৮

ইওরোপের বেশিরভাগ, এশিয়ার বেশিরভাগ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার দক্ষিণভাগ, দক্ষিণ আমেরিকা, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু

২০/০১/২০১৯

ইওরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর মেরু

২৬/০৫/২০২১

উত্তর-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ, দক্ষিণ আমেরিকা, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু

১৫/০৫/২০২২

দক্ষিণ-পশ্চিম ইওরোপে, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু

০৮/১১/২০২২

উত্তর-পূর্ব ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু

১৩/০৩/২০২৫

ইওরোপের বেশিরভাগ, এশিয়ার বেশিরভাগ, অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু

০৮/০৯/২০২৫

ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার পশ্চিম ভাগ, দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু

০৩/০৩/২০২৬

পূর্ব ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু

৩১/১২/২০২৮

ইওরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, উত্তর মেরু

২৫/০১/২০২৯

দক্ষিণ-পশ্চিম ইওরোপে, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ, প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ মেরু




Saturday 22 May 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - ২১

 


স্বপ্নলোকের চাবি – ২১

 

সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস পুরোদমে শুরু হবার পর ক্লাসের বন্ধুবান্ধবদের সাথে আবার নিয়মিত দেখা হচ্ছে ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, ক্যান্টিনে, ট্রেনে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাস, তারপর প্র্যাকটিক্যাল – এর মাঝেই আড্ডা জমছে। দীর্ঘ ‘এরশাদ ভ্যাকেশান’-এ সবার ভেতরেই কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে। শুনলাম এই ছুটিতে শিবিরের কোন কোন নেতা নাকি বিয়ে-শাদী করে ফেলেছেন। আমাদের ক্লাসেও একজন আছে সেরকম নেতা। ইচ্ছে করছিলো তাকে জিজ্ঞেস করে খবরের সত্যতা যাচাই করতে। বন্ধুদের কাছে ইচ্ছের কথাটা প্রকাশ করতেই হাফিজ ঠোঁটের সিগারেট হাতে নিয়ে বললো,  “খবরদার, এই কাজটি করিস না। হুজুরের কাছে কখনোই তার বিবির খবর জানতে চাইবি না। বলার হলে সে নিজেই বলবে। প্রশ্ন করলে ভাববে ইচ্ছে করে বেয়াদবি করছিস। ধরে পায়ের রগ কেটে দিলে সারাজীবন আতুর হয়ে থাকতে পারবি।“

          তাই তো, শিবিরের নেতারা বেয়াদবি সহ্য করেন না বলে শুনেছি। এখন তারা কথায় কথায় রেগে গিয়ে রগ কেটে দেয়। সম্প্রতি আমানত হলের একজনকে ধরে দোতলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে। সে অবশ্য বিবির খবর জানতে চায়নি, তবে ফার্স্ট ইয়ারের কোন্‌ ছেলেকে নাকি মার্ক্সবাদের উপকারিতা বোঝাচ্ছিল।

          ফার্স্ট ইয়ারের কথা ওঠাতে বুঝতে পারলাম ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে একটা সিনিয়রিটির ভাব চলে এসেছে। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে আমরা যে কিছুটা সিনিয়র হয়ে গিয়েছি সেই ব্যাপারটাতে এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। কারণ আমাদের পরের ব্যাচের সাথে আমাদের সেভাবে দেখা হবার সুযোগই হয়নি। এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব আক্ষেপ করছিল হাফিজ।

          “দ্যাখ, এই লম্বা ছুটিটা আমাদের কী সর্বনাশ করেছে। ফার্স্ট ইয়ারের কেউ আমাদেরকে ঠিকমতো চেনারও সুযোগ পেলো না। পপির সাথে এখনো পরিচয়ই হলো না।“

          “পপি কে?”

          “ফার্স্ট ইয়ারের বিউটি কুইন উইথ ফুল অব ব্রেইন”

          সাথে সাথে মিজান, প্রেমাংকর, দেলোয়ার, দুলাল সবাই পপি নামের একজন ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে পপি রূপে সোফিয়া লরেন, মেধায় আলবার্ট আইনস্টাইন। কিন্তু তারা সবাই  তাকে দেখলো, আমি মিস করলাম কীভাবে?

          আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা এখনো হয়নি, তার আগেই সেকেন্ড ইয়ার সাবসিডিয়ারির ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটির ব্যাপার-স্যাপার এরকম জগাখিঁচুড়ি কেন বুঝতে পারছি না। সেকেন্ড ইয়ারের সাবসিডিয়ারিতে আবার দুইটি করে পেপার। ইউনিভার্সিটি যখন বন্ধ ছিল, তখন মনে হচ্ছিল ক্লাস কেন হচ্ছে না। এখন সব ক্লাস একসাথে শুরু হবার পর মনে হচ্ছে এত বেশি ক্লাস কেন?

          সেকেন্ড ইয়ারের অনার্সের সিলেবাস দেখে সেটাকে যতটা নিরীহ মনে করেছিলাম, ক্লাস করতে এসে দেখলাম সেটা ততটাই ভয়ানক। তবে সেটা যতটা না টপিকের কারণে, তার চেয়ে বেশি স্যারদের পড়ানোর ধরনের কারণে। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স পড়াচ্ছেন ফরাজি কামালস্যার। স্যার দুর্দান্ত পড়ান। ফার্স্ট ইয়ারে তাঁর প্রোপার্টিজ অব ম্যাটার খুব ভালোভাবে বুঝেছিলাম। কিন্তু এখন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স সেভাবে বুঝতে পারছি না। স্যার ফলো করতে বলছেন গোল্ডস্টাইনের বই। বইটা নাকি ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের ক্লাসিক বই। ক্লাসিক বই ক্লাসিক গানের মতোই দুর্বোধ্য বিরক্তিকর। স্যার সাধ্যমতো বুঝাচ্ছেন, কিন্তু এত বেশি গাণিতিক সমীকরণ ব্ল্যাকবোর্ড থেকে খাতায় তুলতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছি। হাত আর মস্তিষ্ক একসাথে কাজ করছে না। এক সমীকরণ থেকে অন্য সমীকরণ কীভাবে এলো তা বুঝতে চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম স্যার ইতোমধ্যে ব্ল্যাকবোর্ড ভর্তি করে তা আবার মুছতেও শুরু করেছেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর বিএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের বই কেন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তা এখন বুঝতে পারছি।

          সেকেন্ড পেপার ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম পড়াচ্ছেন রশীদুন্নবীস্যার। স্যারের গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। মুখভর্তি লম্বা দাড়ি, মাথায় মৌলানা-টুপি - স্যারকে প্রফেসর কম পীর বেশি লাগে। স্যারের হাতের লেখা খুব সুন্দর। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা শুরু করেন ব্ল্যাকবোর্ডের একেবারে উপরের অংশ থেকে। স্যারও সুন্দর করে বোঝান, বোর্ডে কার্শফ ল’এর সার্কিট আঁকেন। কিন্তু মাথায় খুব একটা ঢুকতে চায় না। সমস্যাটা কোথায় ঠিক বুঝতে পারছি না। ইলেকট্রিসিটির মতো প্র্যাকটিক্যাল সাবজেক্টকে খুব বায়বীয় মনে হতে থাকে। সমস্যা কী? সমস্যা হলো – এই তত্ত্বগুলির কোন প্রাত্যহিক ব্যবহারের উদাহরণ আমাদেরকে দেয়া হয় না। যে বইগুলি থেকে আমাদের পড়ানো হচ্ছে – লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখেছি – সেই বইগুলি সব ১৯৬০-৬৫ সালের সংস্করণ। এর চেয়ে ভালো বই কি লেখা হয়নি এর মধ্যে? আবার এটাও ঠিক – নিজে বুঝতে পারছি না বলেই হয়তো স্যারের দোষ খুঁজছি, কিংবা বইয়ের দোষ। যে ক্যাপাসিট্যান্স, এল-আর, সি-আর, এল-সি-আর সার্কিট নিয়ে কথা হচ্ছে – সেগুলির মূল পদার্থবিজ্ঞান তো একশ বছরের পুরনো।

          থার্ড পেপার রেডিয়েশান অ্যান্ড স্টাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স। স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স পড়াচ্ছেন বিকিরণস্যার। রেডিয়েশান অংশটা যদি তিনি পড়াতেন তাহলে বলা যেতো – বিকিরণ পড়াচ্ছেন বিকিরণস্যার। ডক্টর বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া চট্টগ্রাম কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। আমি যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছি তখনো তিনি সেখানেই ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটিতে এসেছেন। শুনেছি তাঁর সাথে চট্টগ্রাম কলেজের আরো একজন স্যার ডক্টর তপন চৌধুরীও বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি কলেজের শিক্ষক হবার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বিকিরণস্যার ছাড়পত্র নিতে পেরেছিলেন, তাই তিনি এখন এখানে। আর তপনস্যার ছাড়পত্র পাননি – তাই তিনি এখনো কলেজে।

          বিকিরণস্যার নায়ক আলমগীরের মতো লম্বা, সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান। পোশাকের ব্যাপারে খুবই সচেতন আধুনিক। সুন্দর করে আস্তে আস্তে কথা বলেন। কথা বলার সময় খেয়াল রাখেন যেন এক শব্দের সাথে অন্য শব্দ লেগে না যায়। আর প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। এ ব্যাপারে তিনি আমাদের সরাসরি উপদেশ দিলেন, “ইউ মাস্ট রিড ইংলিশ ম্যাগাজিন্‌স, লাইক রিডার্স ডাইজেস্ট, নট বাংলা বিচিত্রা।“ আমার মনে হলো বিচিত্রা বলার সময় স্যার আমার দিকে তাকিয়েই বললেন। কিন্তু আমি যে প্রতি সপ্তাহে বিচিত্রা কিনতে শুরু করেছি তা তো স্যারের জানার কথা নয়। আর ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ শব্দ দুটো এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যে শুনেই মনে হলো সবকিছু হজম হয়ে যাচ্ছে। এখলাস ক্লাসে থাকলে বেশ খুশি হতো, কারণ সে রিডার্স ডাইজেস্ট পড়ে। কিন্তু এখলাস ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কি পপির সাথে পড়ার জন্যই ড্রপ দিয়েছে?

          বিকিরণস্যার গুপ্ত-কুমারের বই থেকে হুবহু পড়াচ্ছেন স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স। বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স পড়ানোর সময় আশা করেছিলাম সত্যেন বসু সম্পর্কে অন্তত কিছু বলবেন। কিন্তু খুবই হতাশ হলাম। আমাদের দেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে যে বিশ্ববিখ্যাত তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে, যে বোসন কণার নামকরণ করা হয়েছে সত্যেন বসুর নামে – সেই বিজ্ঞানী সত্যেন বসু সম্পর্কে আমাদের ক্লাসের শিক্ষকরা কোন কথা বললেন না। তবে কি তাঁদের তেমন কোন আগ্রহ নেই আমাদের নিজেদের দেশের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কেও? অন্যান্য বিষয়েও কোন বিজ্ঞানীর জীবন ও কর্ম নিয়ে কোন আলোচনা হয় না।

          সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম রেডিয়েশানের ক্লাস নিতে যখন সিরাজস্যার ক্লাসে এলেন। শুরুতে স্যারকে দেখে মনে হয়েছিল ভীষণ সিরিয়াস কোন অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর। কিন্তু স্যার যখন কথা বলতে শুরু করলেন – মনে হলো কিছু একটা গন্ডগোল আছে কোথাও। স্যারের ব্যক্তিত্ব, আচরণ কোনটাই ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসুলভ নয়। স্যার বোর্ডে কিছু একটা লিখতে শুরু করেছেন – এর মধ্যেই কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে ক্লাসের মধ্যে। প্রেমাংকর কবি মানুষ। মানুষের মনের খবর রাখে। সে ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো সিরাজস্যারের অতীত ইতিহাস। সে কীভাবে এসব জানে কে জানে। সিরাজস্যার নাকি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন।  অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড হয়েছিলেন। তার রেজাল্ট দেখে তার প্রেমে পড়ে যায় কোন এক রূপবতী ধনবতী ছাত্রী। তারপর রূপকথার গল্পের মতো ‘তাহারা সুখে শান্তিতে প্রেম করিতে লাগিল’ হবার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম হয়নি। প্রেম ভেঙে গেলো। সিরাজস্যারের মগজের জগত এলোমেলো হয়ে গেল। মাস্টার্স পরীক্ষা ভালো হলো না। এরপর সিরাজস্যার অনেক বছর হাটহাজারি কলেজে পড়িয়েছিলেন। সম্প্রতি ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছেন। প্রেমাংকরের কথার সত্যমিথ্যা যাচাই করার কোন উপায় নেই। সিরাজস্যার নিজে যদি না বলেন, তাহলে অন্য কারো পক্ষেই এই তথ্য ভুল কিংবা সত্য প্রমাণ করার উপায় নেই। কিন্তু যেভাবেই হোক স্যারের মস্তিষ্কের জগত যে দোদোল্যমান তাতে কোন সন্দেহ নেই। অনেক সময় দেখা যায়, আচরণ এলোমেলো হলেও অনেক চমৎকার পড়ান এরকম অনেকে। সিরাজস্যারের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকম হলে ভালো লাগতো। কিন্তু কিছুতেই ব্যাপারটা সেরকম হলো না। আমার মনে হলো স্যারের পড়ানোর কিংবা বোঝানোর ক্ষমতা নেই। অবশ্য বইয়ের পাতা থেকে লাইনের পর লাইন বোর্ডে লিখে দেয়ার নাম যদি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্লাসে পড়ানোর মাপকাঠি হয়ে থাকে – তাহলে ভিন্ন কথা।

          সেদিন সিরাজস্যার ক্লাস থেকে বের হবার পর সবাই অভ্যাসমতো দুপাশের বারান্দায় বের হয়ে গেলো। দেখলাম দিলীপ বর্ধন ক্লাসে ঢুকছে। তাকে এ ক’দিন ক্লাসে দেখিনি। একটু পরে মিজান বাইরে থেকে আমার কাছে এসে বললো, “প্রদীপ, দোস্ত, তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।“

          “কী দুঃসংবাদ?”

          “তুমি আজ সকাল পর্যন্ত সেকেন্ড ছিলে, এখন থার্ড হয়ে গেছ।“

          “মানে কী?”

          “মানে সকাল পর্যন্ত হারুন ফার্স্ট ছিল, তুমি সেকেন্ড ছিলা। এখন দিলীপ ফার্স্ট, হারুন সেকেন্ড, তুমি থার্ড।“

          ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্টে এ জাতীয় কোন হিসেব প্রকাশ করা হয় না। আমি মার্কশিট নিয়েছি কয়েকদিন হলো। দুই পেপারে ফার্স্ট ক্লাস মার্কস আছে, কিন্তু থার্মোডায়নামিক্স আর প্র্যাকটিক্যালে সেকেন্ড ক্লাস মার্কস। গড়ে ফার্স্ট ক্লাস মার্কস আছে। কিন্তু খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু ছাড়া আর কে কত পেয়েছে সেটা নিয়ে কোন আগ্রহ অনুভব করিনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে মিজানদের আগ্রহ সীমাহীন।

           দিলীপের ব্যাপারে যেটা জানা গেল সেটা আসলেই খুব চমকপ্রদ। দিলীপ খুবই মেধাবী ছাত্র। কথাবার্তা খুব একটা বলে না। যেটুকু বলে তাতে সিলেটি টান প্রচন্ড। সে হাঁটেও জোরে, সিগারেটও টানে প্রচন্ড বেগে। রেজাল্ট বের হবার পর দেখা গেলো সে পাস করেনি। এতে স্বাভাবিকভাবেই খুব হতাশ হয়েছিল সে। মার্কশিট আসার আগে বোঝার উপায় নেই কী হয়েছে। রঞ্জুও ফেল করেছে। মার্কশিট আসার পর দেখা গেছে রঞ্জু ফেল করেছে মৌখিক পরীক্ষায়। মাত্র দশ নম্বরের একটি অংশে পাসমার্ক দেয়া হয়নি তাকে।  অন্য সব বিষয়ে সে পাস করেছে। এখন তাকে পুরো ফার্স্ট ইয়ারের সবগুলি সাবজেক্টের আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে হবে। দিলীপ দেখলো তার মার্কশিটে প্র্যাকটিক্যালের কোন নম্বর বসানো হয়নি। মার্কশিট নিয়ে ছুটে গেছে  ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান আদম শফিউল্লাহস্যারের কাছে। আদম শফিউল্লাহস্যার রাফ অ্যান্ড টাফ, কিন্তু খুবই নীতিবান স্যার। তিনি টেবুলেশান শিট খুলে দেখলেন দিলীপ প্র্যাকটিক্যালে অনেক মার্কস পেয়েছে। আরও দেখলেন সব বিষয়ে সে অত্যন্ত চমৎকার নম্বর পেয়েছে। বিশেষ করে আদম শফিউল্লাহস্যার আমাদের যে পেপারে দুটো ক্লাস নিয়েছিলেন সেই প্রোপার্টিজ অব ম্যাটারে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছে দিলীপ। এত ভালো করার পরেও দাপ্তরিক ভুলের কারণে দিলীপের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার নম্বর যোগ হয়নি। ফলে তাকে প্র্যাকটিক্যালে ফেল ধরে নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে ফেল দেখানো হয়েছে। এতে দিলীপের যে কষ্ট এবং অপমান হয়েছে তা পুষিয়ে দেয়ার জন্য পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে স্যার তার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার নম্বরের সাথে আরো দশ নম্বর যোগ করে দিয়েছেন। দিলীপের ফার্স্ট ইয়ারের নম্বর এখন ক্লাসের সবার চেয়ে বেশি।

          দিলীপকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাকে এই ক’দিন কী টেনশানে কাটাতে হয়েছে। সে গম্ভীর স্বভাবের মানুষ, কোন অভিব্যক্তিই তার চেহারায় ফুটে উঠে না। কিন্তু হারুনের চেহারায় একটা বিষাদমিশ্রিত ক্রোধের ছায়া দেখা যাচ্ছে।

          বেশ কয়েকজন বন্ধু ড্রপ দিয়েছে ফার্স্ট ইয়ারে। মেয়েদের মধ্যে ইলোরাকে দেখা যাচ্ছে না ক্লাসে। সম্ভবত সেও ড্রপ করেছে। কিছুদিন পর সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে গেলে সেখান থেকেও কেউ কেউ আমাদের সাথে যোগ দেবে। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় যারা ড্রপ দেয়, তারা দেখা যায় ড্রপ দিয়েই পরের বারের জন্য খুব উঠেপড়ে লাগে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় – অনেক আগে থেকে লাফালাফি করার কারণে শেষের দিকে আর দম থাকে না। উঠেপড়ে লাগার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো তার বন্ধুদের কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করা। তার প্রমাণ পেলাম রুমে এসে। আমি প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে পাঁচটার ট্রেনে ফতেয়াবাদ স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে বিল্ডিং-এ এসে দেখি একজন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিং-এর সামনের রাস্তায়।

    “কী রে, তুই এখানে?”

    “তোর কাছে এলাম।“

রুমে আসার পর তার প্রথম বাক্যটিই হলো, “তোর সবগুলি নোট আমাকে দিয়ে দে।“

     ইউনিভার্সিটিতে এই নোটের ব্যাপারটা অদ্ভুত। শুনেছি কারো কারো নোট নাকি বছরের পর বছর হলগুলিতে ঘুরতে থাকে। আমি নোট করেছি আমার নিজের জন্য। খুব সোজা করে না লিখতে পারলে আমি কিছু বুঝতে পারি না। আমি নিজে না বুঝলে তা লিখতে পারি না। ফলে বেশ কিছু বইপত্র ঘাঁটতে হয়। আমার নোটের কোন চাহিদা কারো কাছে থাকবে এটা আমি আশা করিনি। কিন্তু এই বন্ধুটি হলে তার আরো পঞ্চাশ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকতে আমার কাছে কেন এলো? এলোই যদি এতদিন আসেনি কেন? পরীক্ষা শেষ হয়েছে চার মাস আগে। এটা কি তবে মিজানদের হিসেবের প্রতিক্রিয়া? তবে কি গায়ে তথাকথিত ভালোছাত্রের তকমা লেগে যাচ্ছে? এই ভালোছাত্রের ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে এই অদৃশ্য সিলমোহর লাগানো হয়। কিন্তু তা সজ্ঞানে গায়ে লাগতে দিলে তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, একটা অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। আমি এই মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে চাই। বন্ধু সব নোট নিয়ে চলে গেল।

     ক্লাস চলছে পুরোদমে। ক্লাসে বেশ কিছু নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। তিনজন নতুন মেয়ে এসেছে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ট্রান্সফার নিয়ে। তাদের সাথে আমার এখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে তাদের নাম জেনেছি – সুপর্ণা লিপি, রোখসানা লিপি, আর রেহানা। হাফিজ, স্বপন, মামুন, ইকবাল ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, ক্লাসের বাইরে যথারীতি ঘিরে রাখছে তাদের। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শুরু হবার আগে হাফিজ, প্রদীপ নাথ, দিলীপ, স্বপন, ইকবাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে একসাথে সিগারেট টানে। এটা অনেকটা রুটিন হয়ে গেছে। আজ দেখলাম সুপর্ণা লিপিও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। সে অবশ্য সিগারেট টানছে না, কিন্তু সিগারেট টানার সমর্থনে কথা বলছে – “একটা দুটো সিগারেট না টানলে ছেলেদের ঠিক ম্যানলি লাগে না।“

এ কথা শুনে স্বপন তো পারলে খুশিতে ডিগবাজি খায়। সে আমার উদ্দেশ্যে বললো, “অ্যাই প্রদীপ, শুনলি তো, এখনো সময় আছে – টানতে শিখ।“

“প্রদীপ, তোর সাথে লিপির পরিচয় হয়নি?” – হাফিজ দুই আঙুলে সিগারেট রেখে মুখ থেকে ধুম্রচক্র নির্মগন করতে করতে বললো।

আমি কিছু বলার আগেই সুপর্ণা লিপি গম্ভীরভাবে বললো, “না, সে আমার সাথে কেন কথা বলবে? ভালো ছাত্রের একটা অহংকার আছে না?”

‘ভালো ছাত্র’ এবং ‘অহংকার’ দুটোই আমার কাছে গালির মতো লাগে। মেজাজটাই  খারাপ হয়ে গেল। এখন কথা বললে প্রথম আলাপেই ঝগড়া লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। ক্লাসে ঢুকে গেলাম।

প্র্যাকটিক্যাল শেষ হবার পর পাঁচটার ট্রেনে পৌঁছে দেখি একটা কম্পার্টমেন্টে আমাদের ক্লাসের অনেকেই উঠে বসেছে। হাফিজও দেখলাম শহরে যাচ্ছে। ফারুক, মামুন, স্বপন, ইকবাল, শাকিল, কবীর, গিয়াস, মিজান সবাই দলবেঁধে এক কম্পার্টমেন্টে। দেখলাম সুপর্ণা লিপিও বসে আছে তাদের সাথে। তাদের কাছে যেতেই সুপর্ণার সাথে চোখাচোখি হলো। বললাম, “তোমার সাথে কথা আছে আমার।“

সে সিট থেকে উঠে এলো।

“বলো”

“তুমি আমাকে অহংকারী বললে কেন?”

“তুমি কারো সাথে কথা বলো না, তাই।“

“আমি কারো সাথে কথা বলি না, কে বললো তোমাকে?”

“ক্লাসের মেয়েরা বলেছে। তুমি পুরো ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের ক্লাসের কোন মেয়ের সাথে কথা বলেছো?”

“অবশ্যই বলেছি। আর না বললেও কী প্রমাণিত হয়? আমি অহংকারী?”

“তুমি অহংকারী নও?”

“না।“

“প্রমাণ দিতে হবে।“

“কীভাবে?”

“আমার সাথে সহজভাবে কথা বলতে হবে।“

“আমি কি এখন কঠিনভাবে কথা বলছি?”

“হ্যাঁ বলছিস তো।“ – আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে ফেললো সে। 

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<<<<<<<< আগের পর্ব

Latest Post

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা - দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইল এলাকায় কিছু পুলিশ সদস্য ইয়াসমিন নামের এক ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এই ঘ...

Popular Posts