Sunday 27 November 2022

অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস

 



সেলসিয়াস শব্দটির সাথে আমরা খুব পরিচিত। তাপমাত্রার যে একক পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে ব্যবহৃত হয় – তার নাম সেলসিয়াস। কিন্তু এই শব্দটি কোত্থেকে এসেছে সে ব্যাপারে হয়তো আমরা খুব একটা খোঁজখবর রাখি না। হিট অ্যান্ড টেম্পারেচার – অর্থাৎ তাপ এবং তাপমাত্রা যে এক জিনিস নয় সে জ্ঞান মানুষের হয়েছে হাজার বছর আগে। আজ থেকে প্রায় ১৮৫০বছর আগে গ্রিক বিজ্ঞানী গ্যালেন তাপমাত্রা মাপার জন্য যন্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন ১৭০ খ্রিস্টাব্দে। এরপর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি তাপমাত্রা মাপার সেন্টিগ্রেড স্কেল। 

১৭৪২ সালে সুইডেনের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস পানির হিমাঙ্ককে ১০০ ডিগ্রি আর ফুটনাঙ্ককে ০ ডিগ্রি ধরে সেন্টিগ্রেড স্কেলের প্রবর্তন করেন। এর আগে ১৭১৪ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ফারেনহাইট চালু করেছিলেন ফারেনহাইট স্কেল। ফারেনহাইট স্কেলে ৩২ ডিগ্রিকে পানির হিমাঙ্ক এবং ২১২ ডিগ্রিকে পানির ফুটনাঙ্ক ধরে নিয়ে মধ্যবর্তী পার্থক্যকে ১৮০ ভাগে ভাগ করে এক ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার হিসেব করা হয়েছে। এই হিসেবটা বড্ড গোলমেলে হিসেব বলে সেলিসিয়াসের প্রবর্তিত সেন্টিগ্রেড স্কেলটাকে অনেক বেশি সহজ এবং গ্রহণযোগ্য মনে হলো সবার। কিন্তু একটু গোলমাল রয়ে গিয়েছিল গিয়েছিল। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ডিগ্রির পরিমাণ বাড়া উচিত। সেক্ষেত্রে ১০০ থেকে ০ -তে না গিয়ে ০ থেকে ১০০ ডিগ্রিতে যাওয়া উচিত। কিন্তু প্রস্তাবিত উল্টো স্কেলকে সোজা করার সময় পাননি অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস। ১৭৪৪ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি। 

সেলসিয়াসের মৃত্যুর পর উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস সেলসিয়াস স্কেলকে উল্টে দিয়ে ঠিক করে দেন। নতুন স্কেলে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পানি জমে বরফ হয়ে যায়, আর ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পানি ফুটতে শুরু করে। 

সেলসিয়াসের প্রবর্তিত সেন্টিগ্রেড স্কেল এরপর প্রায় দু’শ বছর ওভাবেই ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে জ্যামিতিক মাপজোকের পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। কোণের পরিমাণও ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হিসেবে মাপা হয় বলে তাপমাত্রা আর কোণের পরিমাপের মাপ আলাদা করতে ঝামেলা হচ্ছিল। তাই ১৯৪৭ সালে তাপমাত্রা মাপার একককে 'ডিগ্রি সেলসিয়াস' হিসেবে প্রচলন করা হয়।

সুইডিশ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্ডার্স সেলসিয়াসের জন্ম ১৭০১ সালের ২৭ নভেম্বর, সুইডেনের উপসালায়। যে পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল – সেই পরিবারের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য প্রায় দু’শ বছরের। তাঁর পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সবাই ছিলেন বিজ্ঞানী। তাঁর বাবা নিলস সেলসিয়াস ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় দক্ষতা অর্জন করে অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস উপসালা ইউনিভার্সিটিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৭৩০ সালে। ১৭৪৪ সালের ২৫ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৭৪০ সালে তাঁর তত্ত্বাবধানে উপসালা ইউনিভার্সিটিতে তৈরি হয় মানমন্দির।

সেলসিয়াসের বৈজ্ঞানিক জীবনে সবচেয়ে বেশি অবদান জ্যোতির্বিজ্ঞানে হলেও – তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁর তাপমাত্রা পরিমাপের স্কেলের মধ্যে।


Saturday 19 November 2022

কোয়ান্টামের জটাজাল - পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ২০২২

 




“আচ্ছা, তুমি কি বিশ্বাস করো যে যখন তুমি চাঁদের দিকে তাকাও তখনি শুধু চাঁদের অস্তিত্ব আছে, আর অন্য সময়ে নেই?” এ কেমন প্রশ্ন? আমরা তো জানি যে চাঁদ আছে গত সাড়ে চারশ কোটি বছর থেকে পৃথিবীর আকাশে। থাকবে আরো কয়েক শ কোটি বছর। কিন্তু সেখানে চাঁদের অস্তিত্ব কেন নির্ভর করবে তার দর্শকের উপর? প্রশ্নটাকে এলেবেলে প্রশ্ন বলে উড়িয়ে দেয়ার কোন উপায় নেই যখন স্বয়ং আইনস্টাইন এই প্রশ্ন করেন। আইনস্টাইন তাঁর জীবনীকার পদার্থবিজ্ঞানী আব্রাহাম পেইজকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের রহস্যময়তার প্রতি তাঁর অস্বীকৃতির সমর্থনে। এটা ঠিক যে চাঁদের মতো বড় আকারের বস্তুর প্রসঙ্গে এরকম প্রশ্ন খাটে না। কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার যে ধর্ম কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয় – সেখানে দেখা যায় – কোন একটি কণা কীরকম আচরণ করবে তা নির্ভর করে তার দর্শকের উপর। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কণার আচরণের সম্ভাবনার কথা বলতে পারে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কী হবে তা বলতে পারে না। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কণাটিকে দেখতে হবে।

পরমাণুর ভেতর তার উপাদান – ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন – এগুলি কীভাবে বিন্যস্ত হয়ে থাকবে তার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেয়া যায় কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে। ধরা যাক হাইড্রোজেন পরমাণুর কথা। এর একটিমাত্র ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রনের অন্তঃঘূর্ণন বা স্পিন হতে পারে +১/২ কিংবা -১/২। দেখার আগ পর্যন্ত কিছুতেই সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় যে কোন একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রনের স্পিন +১/২ হবে কি -১/২ হবে। হাইড্রোজেন পরমাণুর বদলে যদি হিলিয়াম পরমাণুর কথা বিবেচনা করি – দেখা যাবে ব্যাপারটা আরো রহস্যময়। হিলিয়াম পরমাণুতে দুটো ইলেকট্রন আছে। তারা একই কক্ষপথে থাকে। পাউলির বর্জননীতি মেনে চলতে হয় তাদের। সেই নীতি অনুযায়ী একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি +১/২ হয়, অন্য ইলেকট্রনের স্পিন অবশ্যই -১/২ হবে। কোন ইলেকট্রনের স্পিন কী হবে তা না দেখে সুনির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি জানতে পারি, অন্যটির স্পিন কী হবে তা না দেখেই বলে দেয়া যায়। কিন্তু একটাও না দেখা পর্যন্ত কোনটারই স্পিন কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে ফলাফল নির্ভর করছে দর্শকের উপর? কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে - ঠিক তাই । যতক্ষণ দেখা না হচ্ছে – ততক্ষণ সম্ভাবনার সুপারপজিশান স্টেটেই থাকছে ইলেকট্রনের স্পিন।

এরকম ব্যাপার আমরা কয়েন টস করার সাথেও তুলনা করতে পারি। একটি কয়েন শূন্যে ছুঁড়ে দিলে তা নিচে পড়ার পর হেড অথবা টেল উঠবে তা আমরা জানি। কিন্তু ঠিক কী উঠবে তা দেখার আগপর্যন্ত বলতে পারি না। তাহলে কয়েন যতক্ষণ শূন্যে থাকে – ততক্ষণ কি তার হেড কিংবা টেল কোনোটাই থাকবে না? এই গোলমেলে প্রশ্নের উত্তর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিজ্ঞানীদের দিতে হয়েছে অনেক বছর। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্ভাবনার নিয়ম মেনে নিতে পারেননি। তাই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণার প্রতি তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন বার বার। এবং বলা যায় তা থেকেই পথ খুলে গেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিশাল ব্যবহারিক দিকের।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম তথ্যপ্রবাহসহ কোয়ান্টাম প্রযুক্তির অসংখ্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেছে আজ। এই সম্ভাবনার দরজা যাঁরা খুলে দিয়েছেন, তাঁদেরই তিনজন পদার্থবিজ্ঞানী এবছরের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যে তিনজন পরীক্ষণ-বিজ্ঞানী ২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন – তাঁরা হলেন ফ্রান্সের ইকোল পলিটেকনিকের অধ্যাপক আলান এসপেক্ট (Alan Aspect), ক্যালিফোর্নিয়া জে এফ ক্লাউসার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এর প্রধান বিজ্ঞানী জন এফ ক্লাউসার (John F Clauser), এবং অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্তন সাইলিঙ্গার (Anton Zeilinger)। ২০১০ সালে যখন এই ত্রয়ী পদার্থবিজ্ঞানে উল্‌ফ পুরষ্কার পেয়েছিলেন, তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা আশা করে আসছিলেন যে এই তিনজনকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হবে যেকোনো বছর। তাই এবছর যখন নোবেল কমিটি এই তিনজনের নাম ঘোষণা করলো, তখন পদার্থবিজ্ঞানের সবাই খুব খুশি হয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্য হননি। এই তিনজন বিজ্ঞানীরই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরীক্ষণ কাজের প্রতি আগ্রহের মূল কারণ ছিল আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরোধিতা।

আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে ১৯২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম স্থপতি নীলস বোর। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্থপতিদের মধ্যে ম্যাক্স প্ল্যাংক, নীলস বোর, লুই ডি ব্রগলি, ম্যাক্স বর্ন, পল ডিরাক, ভার্নার হাইজেনবার্গ, উলফগং পাউলি, এরভিন শ্রোডিঙ্গার, রিচার্ড ফাইনম্যান – সবাই নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তার নীতিকে সমর্থন করেননি। কিন্তু তাঁর আপেক্ষিকতার সূত্র প্রয়োগে কোয়ান্টাম মেকানিক্স হয়ে উঠেছে আরো বেশি শক্তিশালী। আইনস্টাইন নিজের অজান্তেই শক্ত ভিত্তি দিয়ে গেছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের। বলা চলে আইনস্টাইনের বিরোধিতার কারণেই আবিষ্কৃত হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনেক কিছু।

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এই নীতি অনুসারে কোন কণার শক্তি এবং সময় একই সাথে সঠিকভাবে মাপা যায় না। মাপতে গেলে সেখানে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকবেই। একই ব্যাপার ঘটে কোন কণার অবস্থান এবং ভরবেগ মাপার ক্ষেত্রেও। আমরা যদি কোন কণার সঠিক অবস্থান মাপতে যাই, সেই সময়ে তার ভরবেগ কত তা সঠিকভাবে জানি না। যখন ভরবেগ মাপতে যাই, তখন কণার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। আইনস্টাইন এই ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বলতেন, কোন নিয়মের মধ্যে যদি অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকে তাহলে সেই নিয়ম অসম্পূর্ণ।

১৯৩০ সালের ব্রাসেলস এ অনুষ্ঠিত সলভে কনফারেন্সে আইনস্টাইন নীল্‌স বোরকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিলেন। আইনস্টাইন একটি থট-এক্সপেরিমেন্ট বা মানস-পরীক্ষার বর্ণনা দিলেন। ধরা যাক একটি আলোভর্তি বাক্সের কথা। বাক্সের ভেতর আলোর ফোটন রয়েছে। বাক্সটি ওজন করা হলো। সঠিকভাবে বাক্সের ওজন নেয়া সম্ভব। এরপর বাক্স থেকে সুনির্দিষ্টপদ্ধতিতে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে একটিমাত্র ফোটন বের করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ফোটনটি ঠিক কোন্‌ সময়ে বের হয়েছে তা বাক্সের ভেতর রাখা ঘড়ির সাহায্যে সঠিকভাবে মাপা সম্ভব। এখন ফোটনটি বের হয়ে যাবার পর বাক্সটির আবার ওজন নেয়া হলো। ফোটন বের হবার আগের এবং পরের ওজনের পার্থক্য থেকে E = mc2 সূত্র প্রয়োগ করে জানা যাবে বের হয়ে যাওয়া ফোটনটির শক্তি। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে একই সময়ে কণার শক্তি এবং সময় দুটোই মাপা যাচ্ছে। তা যদি যায়, তাহলে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র আর খাটছে না।

নীলস বোর বিপদে পড়ে গেলেন। আইনস্টাইনের এই মানস-পরীক্ষায় আপাত কোন ভুল তিনি বের করতে পারলেন না। কিন্তু কোন ভুল যদি সেখানে না থাকে, তাহলে পুরো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে। নীলস বোর ব্রাসেলস এর হোটেলরুমে বসে আইনস্টাইনের মানস-পরীক্ষা নিয়ে ভাবলেন সারা রাত। ভাবতে ভাবতে পেয়ে গেলেন সমাধান। আইনস্টাইনের মানস-পরীক্ষায় আইনস্টাইন নিজের তত্ত্বই প্রয়োগ করতে ভুলে গেছেন!

পরদিন নীলস বোর আইনস্টাইনকে বললেন কোথায় ভুলটা করেছেন আইনস্টাইন। বাক্স থেকে ফোটন যখন বের হচ্ছে তখন ফোটনের স্থান পরিবর্তন হচ্ছে। এই স্থান পরিবর্তনের ফলে ঘড়ির স্থান-কালের (স্পেস-টাইম) পরিবর্তন ঘটবে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব অনুসারে তখন সময়ের মাপে অনিশ্চয়তা দেখা যাবে – তা যত ছোটই হোক। সুতরাং ফোটনের শক্তি ঠিকমতো মাপা গেলেও সময়ের মাপে অনিশ্চয়তা রয়েই যাবে। আইনস্টাইন মেনে নিতে বাধ্য হলেন।

এরপর কয়েক বছর মোটামুটি চুপ করে থাকলেও আইনস্টাইন মন থেকে মানতে পারছিলেন না যে এত অনিশ্চয়তা নিয়েই কোয়ান্টাম মেকানিক্স এতটা সাফল্য লাভ করছে। ১৯৩৫ সালে তিনি তাঁর দুজন নবীন সহকর্মী রাশিয়ান-আমেরিকান বরিস পডলস্কি এবং ইসরায়েলি-আমেরিকান নাথান রোজেনের সাথে যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন ফিজিক্যাল রিভিউতে। তাঁদের তিনজনের নামানুসারে এই গবেষণাপত্রটি ইপিআর পেপার নামে খ্যাতিলাভ করেছে। বিশেষ করে আমেরিকার প্রচারমাধ্যমগুলির কল্যাণে। এই পেপারটি প্রকাশিত হবার পর নিউইয়র্ক টাইমস “আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে আক্রমণ করেছেন” শিরোনামে মুখরোচক সংবাদ প্রকাশ করেছিল।

কী ছিল এই গবেষণাপত্রে? এই গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন আক্রমণ করেছিলেন কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা বিশেষ ধর্ম হলো – কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টামের জটাজাল। একই উৎস থেকে উৎপন্ন দুটো কোয়ান্টাম কণা এমন যুগলভাবে কাজ করে যেন কোন অদৃশ্য সূতার টানে একটি অপরটির সাথে যোগাযোগ করতে থাকে – তাদের মাঝখানের বাস্তব দূরত্ব যাই হোক না কেন। সেই অবস্থায় একটি কণাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অন্য কণাকেও আপনাআপনি  নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে তা সহজে বোঝা যায় না।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের গোড়া থেকেই কোয়ান্টাম-কণার পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটাকে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেলের ভিত্তিই হলো কোয়ান্টাম নাম্বার  – যা কণাগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই পাওয়া যায়। যেমন হিলিয়াম পরমাণুর দুটো ইলেকট্রনের স্পিনের কথা আমরা আগেই বলেছি। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে কোয়ান্টাম-কণা তরঙ্গ আকারেও থাকতে পারে।

তরঙ্গের ক্ষেত্রে দুটো তরঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায় আরো সহজে। দুটো তরঙ্গ যখন একটি আরেকটিকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করে তখন তারা পরস্পরের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এরপর তাদের অবস্থা আর আগের মতো থাকে না। এরপর তারা যদি পরস্পরের কাছ থেকে অনেক দূরেও চলে যায়, তাদেরকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায় না। তখন একটি তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি দেখে অন্য তরঙ্গের গতিপ্রকৃতি অনুমান করা যায়।




আইনস্টাইন এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলেন না। একই উৎস থেকে উৎপন্ন দুটি কণা পরস্পরের কাছ থেকে যত দূরেই যাক না কেন, একটির সাথে অন্যটি এনটেঙ্গেল্ড হয়ে থাকবে বা জটাজালে যুক্ত থাকবে তা স্বাভাবিক চিন্তায় কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অবশ্য কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট কথাটি প্রথম চালু করেছিলেন এরভিন শ্রোডিঙ্গার, আইনস্টাইনের ইপিআর গবেষণাপত্র প্রকাশের পর তার জবাব দিতে গিয়ে।

১৯৩৫ সালের ফিজিক্যাল রিভিউর ৪৭ সংখ্যায় প্রকাশিত Can quantum mechanical description be considered complete? প্রবন্ধ – যা ইপিআর পেপার নামে খ্যাত, আইনস্টাইন, পডলস্কি এবং রোজেন একটি মানস-পরীক্ষণ বিশ্লেষণ করেছেন। একই উৎস থেকে দুটো কোয়ান্টাম-কণা উৎপন্ন হয়ে পরস্পরের বিপরীত দিকে চলে গেছে অনেকদূর। এই দুটো কণা পারস্পরিক অদৃশ্য জটাজালে আবদ্ধ। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুযায়ী একজন পর্যবেক্ষণকারী যতক্ষণ কণাগুলির স্পিন না দেখছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের কোনটারই স্পিন সুনির্দিষ্ট নয়। তারা তখনো কোয়ান্টাম সুপারপজিশান স্টেটে আছে। এখন কোন দর্শক যদি একটি কণার স্পিন +১/২ বা স্পিন-আপ দেখে, তাহলে অন্য কণাটির স্পিন সাথে সাথে -১/২ বা ডাউন হতে বাধ্য। কারণ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী মোট স্পিন সংরক্ষিত। অর্থাৎ কোন সিস্টেমের শুরুতে যদি মোট স্পিন শূন্য হয়, শেষেও মোট স্পিন হবে শূন্য। সেক্ষেত্রে একটি কণার স্পিন +১/২ হলে অন্যটির স্পিন -১/২ হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে যে কোনো একটি কণা দেখে অন্য কণাটি যেখানে যত দূরেই থাকুক না কেন তার ধর্ম বলে দেয়া সম্ভব। আইনস্টাইনের ভাষায় এটা এক ধরনের স্পুকি অর্থাৎ ভুতুড়ে ব্যাপার। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে একটি কণা আরেকটি কণাকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাৎক্ষণিকভাবে। কণাগুলি যদি পরস্পরের কাছ থেকে আলোকবর্ষ দূরেও থাকে, তাহলেও তৎক্ষণাৎ নিয়ন্ত্রণ ঘটে যাচ্ছে। এরকম কাজের যে গতি তা আলোর গতির চেয়েও দ্রুত। কিন্তু তা তো অসম্ভব। এরকম ভুতুড়ে ব্যাপার বিজ্ঞানে চলতে পারে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স যদি সত্যিই এভাবে কাজ করে তাহলে এখানে এমন কিছু হিডেন ভ্যারিয়েবল বা গুপ্ত চলক আছে যা আমরা এখনো জানতে পারিনি। এই যুক্তি দেখিয়ে ইপিআর পেপারে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন আইনস্টাইন এবং তাঁর সহযোগীরা।

এই প্রবন্ধের উত্তরে আরভিন শ্রোডিঙ্গার Mathematical Proceedings of the Cambridge Philosophical Society’র জার্নালে প্রকাশিত ‘Discussion of probability relations between separated system’ প্রবন্ধে লেখেন যে দুটো কোয়ান্টাম কণা পরস্পরের সান্নিধ্যে এলে পরস্পর এনটেঙ্গেল্ড বা জটাজালে আবদ্ধ হয়ে যায়। কোয়ান্টাম জটাজাল বুঝতেও জটিল, তার কাজকর্মও জটিল, কিন্তু সত্য।

এরপর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাফল্য অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ইপিআর পেপার নিয়ে অনেক বছর কেউ আর মাথা ঘামায়নি। বিশেষ করে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী জন ফন নিউম্যান তত্ত্বীয়ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কাজ করার জন্য কোন গুপ্ত চলকের দরকার নেই।

কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর প্রায় এক দশক পরে ইপিআর পেপারের সমর্থনে ১৯৬৪ সালে একটি নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট বেল। বেল কাজ করতেন জেনিভার সার্ন গবেষণাকেন্দ্রে। এক বছরের ছুটিতে তিনি এই পেপার লিখেছিলেন যা পরে ‘বেলস ইনইকুয়েলিটি’ নামে খ্যাতিলাভ করে। আইনস্টাইনের মতো বেলও একটি মানস-পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন যে কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টে হিডেন ভ্যারিয়েবলগুলি তথ্য জোগান দেয়। যাদের উপস্থিতি দেখা যায় না, কিন্তু গুপ্তভাবেই তারা কাজ করে। তিনি তাঁর সহকর্মী গবেষক প্রফেসর বার্টলম্যানের উদাহরণ দিলেন – যিনি দুই পায়ে দুই রঙের মোজা পরেন। এখন এই তথ্য যদি কারো জানা থাকে, তাহলে তাঁর এক পায়ের মোজার রঙ দেখেই অন্য পায়ের মোজার রঙ জেনে যাবেন যে কেউই। এখানে গুপ্ত তথ্য দেয়াই আছে। একই রকম ভাবে স্পিনের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। কিন্তু সবগুলি গুপ্ত চলকের মান জানা না থাকলে কোয়ান্টাম-কণার একটিকে জানার পর অন্যটির সব ধর্ম জানা যাবে এমন কোন কথা নেই। সেখানে ফলাফলের অসমানতা থাকবে। এটাই বেলের অসমানতা বা বেলস ইনইকুয়েলিটি। জন বেল তাঁর প্রবন্ধে পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীদের আহ্বান করেছিলেন কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য।

জন বেলের তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য প্রথম এগিয়ে এলেন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন ক্লাউজার – যিনি এবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

জন ফ্রান্সিস ক্লাউজারের জন্ম ১৯৪২ সালের ১ ডিসেম্বর, ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায়। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি করেন ১৯৬৪ সালে। এরপর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে এমএ এবং ১৯৬৯ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল মলিকিউলার অ্যাস্ট্রোফিজিক্স। কিন্তু ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাশাপাশি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রতিও খুব আগ্রহী ছিলেন।

১৯৭২ সালে জন ক্লাউজার  ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় পোস্টডক্টরেট করার সময় তাঁর পিএইচডি গবেষক-ছাত্র স্টুয়ার্ড ফ্রিডম্যানের সাথে মিলে বেলের অসমানতা পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিলেন। তিনি ইলেকট্রনের স্পিনের বদলে আলোর কণা ফোটনের পোলারাইজেশানের মাধ্যমে ফলাফল মাপার চেষ্টা করলেন। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানসহ অনেকেই তখন ক্লাউজারকে নিরুৎসাহিত করে বলেছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে আর পরীক্ষা দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু জন বেল ক্লাউজারকে খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন পরীক্ষাটি করে দেখার জন্য। জন বেল দুই ডলার বাজি ধরেছিলেন আইনস্টাইনের পক্ষে। অর্থাৎ বেলস ইনইকুয়েলিটি সত্য প্রমাণিত হবে।


 



ক্লাউজার ক্যালসিয়াম পরমাণুর উপর বিশেষ আলো ফেলে ক্যালসিয়াম থেকে ফোটন নির্গমনের ব্যবস্থা করলেন। ফোটনগুলি একই জায়গা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে – ফলে কোয়ান্টাম জটাজালে আবদ্ধ। দুইটি বিপরীত পাশে ফিল্টার স্থাপন করে ফোটনের পোলারাইজেশান মেপে দেখলেন। ফিল্টারের দিক অনেকবার পরিবর্তন করে তিনি দেখলেন যে একটি ফোটনের পোলারাইজেশান থেকে অন্য ফোটনের পোলারাইজেশান যেরকম হবার কথা ঠিক সেরকমই হচ্ছে। তার মানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্য কোন হিডেন ভ্যারিয়েবলের দরকার নেই। বেলস ইনইকুয়েলিটি ভুল। জন বেল বাজিতে হেরে গেলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জয় হলো।


 

জন ক্লাউজার তাঁর পরীক্ষা করছেন (ফিজিক্স টু ডে’র সৌজন্যে প্রাপ্ত ছবি)



জন ক্লাউজারের পরীক্ষণে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটাজাল সঠিক প্রমাণিত হলেও সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। ফিল্টারগুলিকে আগে থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় বসানো হয়েছিল। হতে পারে এই ফিল্টারের অবস্থান ফোটনগুলির গতিতে কোনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আরো নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করে দেখার জন্য এগিয়ে এলেন ফ্রান্সের পদার্থবিজ্ঞানী আলান অ্যাসপেক্ট যিনি এবছরের আরেকজন নোবেলজয়ী।

অ্যলান অ্যাসপেক্ট এর জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ জুন ফ্রান্সের আজান (Agen) শহরে। ১৯৬৯ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন প্যারিস-সুদ থেকে। এরপর তিনি তিন বছর ক্যামেরুনে গিয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৮৩ সালে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। পিএইচডি গবেষণা করার সময়েই তিনি বেলস ইনইকুয়েলিটির পরীক্ষাটি করেন।

 



জন ক্লাউজারের পরীক্ষণে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল – যেমন ফিল্টারের অবস্থান আগে থেকে জানা, এসব দূর করার ব্যবস্থা করেন অ্যালান অ্যাসপেক্ট। তিনি ফোটন নির্গমনের হার বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রান্সডিউসার ব্যবহার করে ফিল্টারের অবস্থান প্রতি সেকেন্ডে কয়েক লক্ষবারের বেশি পরিবর্তন করার ব্যবস্থা করলেন। আলোর দিক পরিবর্তন করার ব্যবস্থা করলেন সেকেন্ড আড়াই কোটি বার। এই পরিবর্তনের ফলে ফোটনগুলি আলোর গতিতে চললেও একটি থেকে অন্যটিতে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবে না। ফলে কোন গুপ্ত চলক থাকলেও তা কাজে লাগবে না। এবারেও দেখা গেল – কোয়ান্টামের জটাজালে আবদ্ধ ফোটনগুলি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম মেনেই চলছে।

অ্যালান অ্যাসপেক্টের পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টে কোন ধরনের গুপ্ত চলকের মাধ্যমে কণাগুলি আগে থেকে কোন তথ্য পেয়ে যায় না। কিন্তু তারপরেও বিজ্ঞানীদের সন্দেহ যায় না। এমনও তো হতে পারে কণাগুলি আগে থেকেই বুঝে ফেলছে কীভাবে ডিটেক্টরগুলি কিংবা ফিল্টারগুলির দিক পরিবর্তন হবে! এই সন্দেহও দূর করার জন্য এগিয়ে এলেন অস্ট্রিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী আন্তন সাইলিঙ্গার – যিনিও এবার নোবেল পুরষ্কার পেলেন।

আন্তন সাইলিঙ্গারের জন্ম অস্ট্রিয়ায় ১৯৪৫ সালের ২০ মে। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি অর্জন করেছেন ১৯৭১ সালে। বর্তমানে তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর।

২০১৭ সালে প্রফেসর সাইলিঙ্গারের গবেষকদল মহাকাশের তারার আলো থেকে ভেসে আসা ফোটনকে কাজে লাগিয়ে বেলস ইনইকুইলিটি পরীক্ষাটি আবার করেন।



 

প্রফেসর সাইলিঙ্গার বিশেষ ধরনের কৃস্টালের উপর লেজার আলো প্রয়োগ করে ফোটন তৈরি করেন। আবার একই সাথে মহাকাশের দূর নক্ষত্র থেকে ভেসে আসা আলো ফেলার ব্যবস্থাও করেন কৃস্টালের উপর। মহাকাশ থেকে ভেসে আসা ফোটনগুলিও কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট মেনে চলেছে। তার মানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্য কোন ধরনের গুপ্ত চলকের দরকার নেই। কিন্তু কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট কীভাবে কাজ করে তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।

এই পরীক্ষা করার বিশ বছর আগে থেকেই কোয়ান্টামের জটাজাল কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশান পরীক্ষা করা শুরু করেছেন। যেহেতু কোয়ান্টামের জটাজালে আবদ্ধ কণার একটিকে জানতে পারলে অন্যটিকেও জানা হয়ে যায়, সেহেতু একপ্রান্তের কণার পর কণা সাজিয়ে অন্যপ্রান্তে হুবহু কপি করে ফেলা সম্ভব। প্রফেসর সাইলিঙ্গারের দল কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশানে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছেন।

কোয়ান্টামের জটাজালের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে এবং কোয়ান্টাম এনক্রিপশানে। তথ্যপ্রযুক্তির এই দুর্বার গতির যুগে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়তে হয় তথ্যচুরি হয়ে যাবার সম্ভাবনার কারণে। প্রচলিত ডিজিটাল কম্পিউটারের তথ্যপ্রবাহে তথ্যচুরির হাত থেকে বাঁচতে এবং গোপনীয়তা রক্ষায় যে কৌশল অবলম্বন করা হয় – তাতে একই তথ্যের অনেকগুলি কপি করে গুপ্ত সংকেতের মাধ্যমে তা সুরক্ষিত রাখা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম এনক্রিপশানে কোয়ান্টামের জটাজাল অত্যন্ত জটিল গুপ্ত সংকেত তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করবে যা চুরি করার কোন উপায় থাকবে না।

আমাদের ভবিষ্যত প্রযুক্তি হবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি – যার অনেক প্রয়োগ আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। এই সময় এবছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলপুরষ্কার কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যবহারিক সাফল্যের উজ্জ্বল স্বীকৃতি।

 

তথ্যসূত্র:

১। এ এম হারুন অর রশীদ, একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত, (বিজ্ঞান সমগ্র), অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা ২০১০।

২। Brian Clegg, Cracking Quantum Physics, Cassell, London, 2017.

৩।  www.nobelprize.org

৪। Louisa Gilder, The age of entanglement, Vintage Books, New York, 2008. 

____________

বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত











Sunday 23 October 2022

লুই ডি ব্রগলি: কোয়ান্টাম তত্ত্বের রাজপুত্র

 




আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য সবচেয়ে দরকারি এবং কার্যকরী তত্ত্ব হলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ম্যাক্স প্ল্যাংক ও নীল্‌স বোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের গাণিতিক প্রয়োগ শুরু করেন। এর মাত্র কয়েক বছর আগে উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে ১৮৯৫ সালে এক্স-রে, ১৮৯৬ সালে তেজষ্ক্রিয়তা এবং ১৮৯৭ সালে ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলোর ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্ট এর কার্যকর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ১৯১১ সালে পরমাণুর নিউক্লিয়াস এবং প্রোটন আবিষ্কার করেছেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। এসবের ভিত্তিতে নীল্‌স বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল দাঁড় করিয়েছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তি তখন দিনে দিনে শক্ত হচ্ছে। আলোর ফোটন কণা হিসেবে যেমন কাজ করে, তেমনি তরঙ্গ হিসেবেও কাজ করতে পারে। অর্থাৎ আলোর দ্বৈতচরিত্র – কণা এবং তরঙ্গ তা ততদিনে প্রমাণিত হয়ে গেছে। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের (স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি) সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন সর্বকালের জনপ্রিয় সমীকরণ E = mc2। এই সূত্র থেকে দেখা যায়, পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, আবার শক্তিকেও রূপান্তর ঘটিয়ে পদার্থ পাওয়া যায়। আলোর কণা ও তরঙ্গের দ্বৈতসত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে পদার্থেরও যে কণা ও তরঙ্গের দ্বৈতসত্ত্বা থাকতে পারে – সেই তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলেন পদার্থবিজ্ঞানের জগতে প্রায়-নবাগত লুই ডি ব্রগলি। ১৯২৪ সালে লুই ডি ব্রগলি তাঁর পিএইচডি থিসিসে এই তত্ত্ব প্রকাশ করেন যে আলোর যেমন কণা ও তরঙ্গের দ্বৈতধর্ম আছে, অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় আলো তরঙ্গ হলেও কণার ধর্মও প্রদর্শন করে, তেমনি ইলেকট্রনও স্বাভাবিক অবস্থায় কণা হলেও, তরঙ্গের ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে। তারপর  মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এই তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করে। প্রিন্স লুই ভিক্টর পিয়েরে রেমন্ড ডি ব্রগলি ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম আবিষ্কার করার জন্য ১৯২৯ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো লুই ডি ব্রগলি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শুরুর দিকে জেনারেল ফিজিক্স পরীক্ষায় ফেল করে বিজ্ঞান পড়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর নানা পথ পের হয়ে ফিরে এসেছেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে। আর তার দশ বছর পরেই তিনি পদার্থবিজ্ঞানে ইতিহাস তৈরি করলেন।

প্রিন্স বা রাজপুত্র বলতে যেরকম কোন রাজ্যের রাজার পুত্রকে বোঝায় – ঠিক সেরকম না হলেও ফ্রান্সের অত্যন্ত ধনী, বনেদী এবং ক্ষমতাশালী পরিবারের সন্তান লুই ডি ব্রগলি। পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রেই তিনি ছিলেন প্রিন্স। রোমান সাম্রাজ্যের উচ্চপদাধিকারীদের এই উপাধি দেয়া হতো। লুই ডি ব্রগলির প্রপ্রপিতামহ ভিক্টর ফ্রাঁসোয়া ডি ব্রগলি প্রিন্স উপাধি পেয়েছিলেন আস্ট্রিয়ার সম্রাটের কাছ থেকে। ভিক্টর ও পলিন ডি ব্রগলির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট লুই ডি ব্রগলির জন্ম ১৮৯২ সালের ১৫ আগস্ট। ভিক্টর ছিলেন ডিউক – ফ্রান্সের অত্যন্ত উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। ডিউক পদমর্যাদা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। ডিউকের বড় ছেলে ডিউক হবে এটাই নিয়ম। ভিক্টরের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে মরিস ডিউক হলেন। লুইয়ের চেয়ে সতের বছরের বড় মরিস ডি ব্রগলি ছিলেন তখনকার সময়ে ইওরোপের খ্যাতিমান পরীক্ষণপদার্থবিজ্ঞানীদের একজন। নিজের টাকায় নিজের বাড়িতে তিনি বিশাল ল্যাবরেটরি তৈরি করে গবেষণা করতেন।

বাড়িতে খ্যাতিমান অগ্রজ থাকলে অনুজদের যা হয়, লেখাপড়া নিয়ে সারাক্ষণই একটা মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়; মরিসের ছোট ভাইবোনদের ক্ষেত্রেও তা হলো। লুইয়ের চেয়ে চার বছরের বড় বোন পলিনের নাম রাখা হয়েছিল মায়ের নামে। পলিন পদার্থবিজ্ঞান পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু মরিস তাতে বাধ সাধলেন। ইওরোপে তখনো মেয়েদেরকে বিজ্ঞানশিক্ষায় উৎসাহিত করা হতো না। পলিন বিজ্ঞান পড়তে না পেরে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পরবর্তীতে ফ্রান্সের অত্যন্ত খ্যাতিমান সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন। পলিনের সাথে লুইয়ের খুব বন্ধুত্ব ছিল।

বড়ভাই বিজ্ঞানী মরিসের তত্ত্বাবধানে বাড়িতেই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে লেখাপড়া শুরু হলো লুইয়ের। ১৯০৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর মরিস ডিউক হলেন। মরিস এবার চৌদ্দ বছর বয়সী লুইকে প্যারিসের বিখ্যাত স্কুল লাইসি জ্যানসন দ্য সেইলি-তে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করলেন। তিন বছর পর দর্শন ও গণিতে ভালো নম্বর পেয়ে স্কুল-ফাইনাল পাস করলেন লুই।

১৯১০ সালে আঠারো বছর বয়সে ভর্তি হলেন সরবোন ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু তখনো তিনি জানেন না ঠিক কী হতে চান জীবনে। তার সমবয়সী ভাগনে চার্লসও ভর্তি হয়েছেন সরবোনে। চার্লসের প্রভাবে লুই ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। কিন্তু  ইতিহাসের গৎবাঁধা গবেষণা-বিশ্লেষণহীন পড়াশোনা তাঁর ভালো লাগলো না। অনেকদিন ইতিহাস পড়ার পর মাঝপথে ছেড়ে দিলেন। পারিবারিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি সহজেই বড় আমলা হতে পারতেন, কিংবা রাজনৈতিক নেতা হতে পারতেন। কিন্তু সেসবের কিছুই লুইকে টানে না। কী হতে চান সেটা তখনো না জানলেও আমলা বা নেতা কোনটাই যে হতে চান না সে ব্যাপারে তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন। ইতিহাসে আনন্দ না পেয়ে তিনি আইন পড়তে শুরু করলেন। এক বছর তিনি আইন পড়লেন। কিন্তু তাতেও কোন আগ্রহ পেলেন না। গণিতের বিশেষ কোর্স করার পর তিনি ক্রমে পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের একটি পরীক্ষায় (জেনারেল ফিজিক্স) তিনি ফেল করলেন। এতে তাঁর মনোবল একেবারেই ভেঙে গেল। শৈশব কৈশোরে যে লুই এত প্রাণবন্ত ছিলেন, তিনি এবার হঠাৎ খুব নিষ্প্রাণ হয়ে গেলেন। কারো সাথেই তেমন মেশেন না, সারাক্ষণ চিন্তিত থাকেন।

১৯১১ সালে ব্রাসেল্‌স এ অনুষ্ঠিত প্রথম সলভে কনফারেন্সের অন্যতম সেক্রেটারি ছিলেম মরিস ডি ব্রগলি। তিনি ব্রাসেলস-এ যাবার সময় ছোটভাই লুইকেও সাথে নিয়ে গেলেন। ইওরোপের প্রথম সারির সব পদার্থবিজ্ঞানীদের মাঝে গিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্রমবর্ধমান গতিপথ লক্ষ্য করে উনিশ বছরের তরুণ লুই ডি ব্রগলি তাঁর ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পেলেন। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা অনুভব করলেন। ১৯১৩ সালে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন সায়েন্স’ বা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেন।

পরবর্তী ধাপের পড়াশোনা কিংবা গবেষণা শুরু করার আগেই ১৯১৩ সালের তাঁর বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস শুরু হয়ে গেলো। পরের বছরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেলো। যুবকদের যুদ্ধে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। লুই-এর পোস্টিং হয়ে গেলো মিলিটারির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে। প্রচন্ড বিরক্তিকর কাজ তাঁর জন্য। প্রভাবশালী বড়ভাই থাকলে তখনো কমবেশি কাজ হতো। ডিউক মরিস ডি ব্রগলি সেনাবাহিনীর উঁচুপর্যায়ে তদবির করে লুইকে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে আইফেল টাওয়ারের নিচে পোস্টিং দেয়ার ব্যবস্থা করলেন – যেখানে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার বসানোর কাজ চলছিলো। পরবর্তী ছয় বছর ধরে লুই ডি ব্রগলি এই ট্রান্সমিটারের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেছেন ইলেকট্রিসিয়ান হিসেবে। এটাকে পরে তিনি তাঁর হাতেকলমে বেতার যোগাযোগের ইলেকট্রনিক পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের সুযোগ হিসেবে দেখেছেন।

১৯১৯ সালের আগস্ট মাসে মিলিটারি সার্ভিস থেকে অব্যাহতি পেলেন লুই ডি ব্রগলি। ছয় বছরের মিলিটারি সার্ভিসের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে অ্যাডজুটেন্ট পদবী দেয়া হয়। বাড়িতে ফিরে এসে আবার লেখাপড়া শুরু করলেন লুই ডি ব্রগলি। মরিসের ল্যাবে এক্স-রে সংক্রান্ত পরীক্ষণ-গবেষণায় কিছুদিন হাত লাগালেন। এক্স-রে বর্ণালী এবং ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট সংক্রান্ত অনেকগুলি পরীক্ষণে তিনি অংশ নিলেন। পরীক্ষণ ফলাফলগুলিকে কোয়ান্টাম পরমাণুতত্ত্ব প্রয়োগ করে বিশ্লেষণমূলক অনেকগুলি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন তিনি।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অগ্রগতি তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আলোর তরঙ্গ ও কণার দ্বৈতধর্ম প্রমাণিত হয়ে গেছে। লুই ডি ব্রগলি ১৯২৩ সালে পরপর তিনটি ছোট গবেষণাপত্রে প্রমাণ করে দিলেন যে আলো তরঙ্গ হয়েও যেভাবে কণার ধর্ম প্রদর্শন করে, তেমনি ইলেকট্রন কণা হয়েও তরঙ্গের ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে। অর্থাৎ যে কোনো বস্তুও কণা ও তরঙ্গের দ্বৈতধর্ম ধারণ করে।

লুই ডি ব্রগলির বস্তু-তরঙ্গের গাণিতিক ভিত্তি কয়েকটি সহজ সমীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আইনস্টাইনের শক্তি ও পদার্থের সমীকরণ E = mc2, যেখানে E = শক্তি, m = বস্তুর ভর, c = আলোর বেগ। আবার শক্তি ও তরঙ্গের সমীকরণ লেখা যায়, E = hf, যেখানে E = শক্তি, h = প্ল্যাংকের ধ্রুবক = 6.63 x 10-34 Joule-second, এবং f = তরঙ্গের কম্পাঙ্ক। শক্তির উভয় সমীকরণের সাম্যতা বিবেচনা করে লেখা যায়, mc2 = hf. আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি L হয়, কম্পাঙ্ক যদি f হয়, তাহলে আলোর বেগ c = Lf; যা থেকে লেখা যায় f = c/L; কম্পাঙ্কের মান বসানোর পর সমীকরণ দাঁড়ায়, mc2 = hc/L, যেখান থেকে লেখা যায়, L = h/mc, অর্থাৎ বস্তুর তরঙ্গদৈর্ঘ্য = প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক/বস্তুর ভরবেগ।

১৯২৪ সালে লুই ডি ব্রগলি তাঁর পিএইচডি থিসিস প্রকাশ করলেন। ইওরোপের অনেক বিজ্ঞানীর চোখেই পড়েছে তাঁর বস্তু-তরঙ্গের সূত্র, কিন্তু কেউই খুব একটা পাত্তা দিলেন না। কিন্তু আইনস্টাইন আর শ্রোডিঙ্গার খুবই গুরুত্বের সাথে নিলেন তাঁর এই তত্ত্ব। শ্রোডিঙ্গার তাঁর ওয়েভ মেকানিক্সে লুই ডি ব্রগলির বস্তু তরঙ্গ প্রয়োগ করলেন।

পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষণের সাহায্যে প্রমাণিত নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই তত্ত্ব খুব একটা গুরুত্ব পায় না। অনেক বিজ্ঞানীকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয় তাঁদের তত্ত্ব প্রমাণিত হবার জন্য। পিটার হিগ্‌স ১৯৬৫ সালে যে হিগ্‌স বোসনের তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তার ৪৭ বছর পর হিগ্‌স বোসন পাওয়া গেছে। লুই ডি ব্রগলিকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁর তত্ত্ব প্রমাণিত হয়ে গেল। ১৯২৭ সালে আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী ক্লিনটন ডেভিডসন ও লেস্টার জারমার, এবং ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ থমসন পরীক্ষণের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে ইলেকট্রনও তরঙ্গের ধর্ম প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে ইলেকট্রনের ধর্মাবলী বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে লুই ডি ব্রগলির তত্ত্ব বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ডি ব্রগলির তত্ত্ব থেকেই পাওয়া গেছে ম্যাগনেটিক লেন্স – যা কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।

১৯২৪ সালের নভেম্বর মাসে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করার পর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর অবৈতনিক শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়েই ১৯২৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করলেন লুই ডি ব্রগলি। ১৯৩২ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে যোগ দেন। সেই সময় হেনরি পয়েনকেয়ার ইন্সটিটিউটে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয় এবং লুই ডি ব্রগলির জন্যই ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৩২ সালের শেষের দিকে তিনি সেই পদে যোগ দেন এবং পরবর্তী তিরিশ বছর সেখানেই ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৩৩ সালে ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি একাডেমির পার্মানেন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি সেই পদে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আমেরিকান একাডেমি অব সায়েন্স এবং ১৯৫৩ সালে রয়েল সোসাইটির সদস্য মনোনীত হন।

পদার্থবিজ্ঞানীরা সাধারণত ঠোঁটকাটা হয়ে থাকেন। নম্রতা ও ভদ্রতার প্রচলিত সামাজিক সংজ্ঞাগুলি নিয়ে তাঁরা খুব একটা মাথা ঘামান না। কিন্তু লুই ডি ব্রগলি ছিলেন খুবই ব্যতিক্রমী একজন। কয়েক প্রজন্মের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক ঐশ্বর্য, খ্যাতি এবং ক্ষমতার কোনকিছুই তিনি ব্যক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেননি। সবার সাথেই খুব নম্রভাবে কথা বলতেন লুই ডি ব্রগলি।

এত ক্ষমতা ও  ঐশ্বর্যের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। বড়ভাই মরিসের মৃত্যুর পর – মরিসের ছেলে সন্তান না থাকাতে লুই ডি ব্রগলি ডিউক হলেন। তাতেও তাঁর জীবনযাপনে কোন পরিবর্তন আসেনি। জগতসংসারের প্রতি এক ধরণের বৈরাগ্যই ছিল তাঁর। ব্যক্তিগত কোন গাড়ি তিনি ব্যবহার করতেন না। দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। কখনো বিয়ে করেননি। শেষ বয়সে দেখাশোনার জন্য দু’জন বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিল। অনেকটা ঘরকুনো স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। কয়েকবার সলভে কনফারেন্স আর একবার নোবেল পুরষ্কার নেয়ার জন্য স্টকহোমে ছাড়া আর কোন দেশে ভ্রমণও করেননি। অদ্ভুত নির্লিপ্ত নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করেছেন রাজপুত্র লুই ডি ব্রগলি। ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ ৯৫ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়।

 

তথ্যসূত্র: (1) Ioan James, Remarkable Physicist, Cambridge University Press, UK, 2004; (2) Biographical Encyclopedia of Scientists, World Book Chicago, 2003; (3) Heinrich A. Medicus, Fifty years of matter waves, Physics Today, February 1974; Mary Jo Nye, Aristocratic culture and the pursuit of science: the De Broglies in Modern France, JSTOR Vol 88, No 3, (1997).

_____________

বিজ্ঞানচিন্তা সেপ্টেম্বর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত







Monday 3 October 2022

বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ৬

 



পরীক্ষার হলে বসে বই দেখে দেখে উত্তর লিখলে সেটাকে কি পরীক্ষা বলা চলে? বাংলাদেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত হিসেব করলে কয়েক শ পরীক্ষা আমাদের দিতে হয়েছে। সেখানের কোন পরীক্ষায় সবচেয়ে সাহসী নকলবাজও প্রকাশ্যে বই খুলে লেখার মতো চরম অপরাধ করার সাহস পায় না। অথচ এখানে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সাত তলার এই ছোট্ট পরীক্ষার হলের আটজন পরীক্ষার্থীর সবাই এখন বই খুলে পরীক্ষা দিচ্ছে। এর নাম ওপেন বুক এক্সাম।

ওপেন বুক এক্সাম সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। প্রফেসর অ্যালেন যখন বলেছিলেন স্ক্যাটারিং থিওরির পরীক্ষাটি ওপেন বুক এক্সাম হবে – আমি শুরুতে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। একে ওকে জিজ্ঞেস করে যা জানতে পারলাম তাতে বেশ অবাক হলাম। এখানে কত ধরনের পরীক্ষা যে আছে! ওপেন বুক এক্সামে যত খুশি বই খুলে প্রশ্নের উত্তর লেখা যায়। কিছু কিছু পরীক্ষা নাকি ঘরে বসেও দেয়া যায়। ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্টে নাকি কয়েকটি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার এক্সাম আছে -  ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রশ্ন আর খাতা নিয়ে যে কোনো জায়গায় বসে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে প্রশ্নের উত্তর লিখে আবার ডিপার্টমেন্টে জমা দিতে হয়। আমি জানি না এ কেমন ধরনের পরীক্ষা! এরকম পরীক্ষা হলে পরীক্ষার্থী তো মাস্টার ভাড়া করে এনে পরীক্ষা দিতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটি যে মোটেও সহজ নয় তা বুঝতে পারলাম ক’দিন পরেই।

ওপেন বুক এক্সাম দিতে এসে যে জিনিসটি আবারো উপলব্ধি করলাম – সেটা অনেকটাই দার্শনিক। দর্শনটা হলো - নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবার মধ্যে কোন দোষ নেই, কিন্তু অন্যকে বোকা ভাবা মারাত্মক দূষনীয়। আমি ভেবেছিলাম বই দেখে দেখে যখন লেখা যাবে, তখন পরীক্ষা দেয়া তো কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু এটা ভাবিনি - যে বুড়ো প্রফেসর এই প্রশ্নটি তৈরি করেছেন, তিনিও ভালো করেই জানেন যে প্রশ্নে যা দিয়েছেন তার উত্তর বই দেখে পাওয়া যাবে না।

পরীক্ষার হলে বেশ দূরে দূরে ছোট ছোট টেবিলে আমরা বসেছি। আমি স্ক্যাটারিং থিওরির তিন-চারটি বই নিয়ে এসেছি। অন্যরা দেখলাম ট্রলি ভর্তি করে বই নিয়ে এসেছে। প্রফেসর অ্যালেন এলেন আটটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে হাতে একগাদা খাতাপত্র নিয়ে।

মাত্র এক পাতার প্রশ্নপত্র। তাতে গুটি গুটি অক্ষরে ছাপানো আপাতনিরীহ স্ক্যাটারিং থিওরির আটটি প্রশ্ন। আটটি প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য মোটা মোটা তিনটি উত্তরপত্র দেয়া হয়েছে, আর সময় দেয়া হয়েছে আট ঘন্টা। সকাল আটটায় শুরু হয়ে এই পরীক্ষা শেষ হবে বিকেল পাঁচটায়। মাঝখানে বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত এক ঘন্টার বিরতি।

শুরুতে প্রশ্ন হাতে নিয়ে মনে হয়েছিল – মশা মারতে কামান দাগার কথা। কিন্তু আধঘন্টা পরেও যখন প্রশ্নই বুঝতে পারছিলাম না, মনে হলো কামান কেন, পারমাণবিক বোমা মেরেও স্ক্যাটারিং মশা মারা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

পরীক্ষা শুরু করে দিয়ে প্রফেসর অ্যালেন চলে গেলেন নিজের অফিসে। আবার আসবেন বারোটায়। পরীক্ষার হলে শিক্ষক না থাকলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই  কথায় কথায় তা বাজার হয়ে যাবার কথা। কিন্তু সেরকম কিছুই হচ্ছে না। বইয়ের পাতা ওল্টানোর খচখচ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা তুলে একে একে সবার দিকে তাকালাম। অন্যরা কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না।

স্কুলে থাকতে সব বইয়েরই আবার নোটবই ছিল। সেখানে কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে লেখা থাকতো – সারমর্ম দেখো। আমার অবস্থা এখন অনেকটাই সেরকম। সব প্রশ্নের উত্তরেই আমাকে বইয়ের চ্যাপ্টার খুলে খুলে সারমর্ম লিখতে হবে। সারমর্ম লিখতে হবে চ্যাপ্টারের মর্ম বুঝতে হবে। কী ঝামেলায় পড়া গেল।

প্রফেসর অ্যালেন ক্লাসে যে নোটগুলি দিয়েছিলেন – সেখান থেকে সরাসরি কোন প্রশ্নই করেননি। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসেছি – সেখানে নিয়মই ছিল – যা পড়ানো হবে সেখান থেকেই প্রশ্ন করা হবে। এখানে মনে হয় সেই নিয়ম চলে না। প্রশ্ন কমন না এলে টিচারের রুম ভাঙচুর করার রীতিও সম্ভবত নেই।

পরবর্তী চার ঘন্টা বসে থেকে আর জি নিউটনের স্ক্যাটারিং থিওরি অব ওয়েভস অ্যান্ড পার্টিকলস উল্টাতে উল্টাতে উত্তরপত্রের অনেকগুলি পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেললাম। বারোটায় রুমের দরজা খুলে প্রফেসর অ্যালেন ঢুকলেন।

“ওয়েল গাইস, আই হোপ ইউ আর হ্যাভিং আ গুড টাইম। নাউ টাইম টু হ্যাভ আ ব্রেক।“

একঘন্টার বাধ্যতামূলক বিরতি। খাতাপত্র সবকিছু ভেতরে রেখে আমাদের সবাইকে রুম থেকে বের করে রুমে তালা লাগিয়ে দিলেন প্রফেসর অ্যালেন। একটায় আবার খোলা হবে। এই এক ঘন্টার ভেতর খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সেরে সময় থাকলে অন্য কারো সাথে আলাপও করা যাবে প্রশ্ন নিয়ে – যদি প্রশ্ন মনে থাকে।

ছয়তলায় নেমে নিজের ডেস্কে এলাম। জিনেট, ক্যামরুন আর নিকোল আড্ডা মারছে। আমাকে ঢুকতে দেখে তিনজনই ফিরে তাকালো। নি্কোল আমার চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছিল রুমের মাঝখানে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার চেয়ার ঠেলে দিল আমার ডেস্কের দিকে। নিকোল সাধারণত খুবই কম কথা বলে। আড্ডায় সে হচ্ছে একনিষ্ঠ শ্রোতা, আর জিনেট প্রচন্ড রকমের বক্তা। যেকোনো বিষয়েই তার বক্তব্য থাকে।

“পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?” – ক্যামরুন জানতে চাইলো।

এই ব্যাটা পরীক্ষার কথা জানলো ক্যামনে? আমি যে পরীক্ষা দিচ্ছি তা তো এদের কারো জানার কথা নয়। হয়তো প্রফেসর অ্যালেনই বলেছেন। এখানে প্রফেসররা  স্টুডেন্টদের সাথে দূরত্ব মেনে চলার নিয়ম জানেন না।

ক্যামেরুনের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই রুমের ফোন বেজে উঠলো। ক্যামেরুন ফোনের সবচেয়ে কাছে ছিল। সে রিসিভার তুলতেই আমি আবার বের হয়ে গেলাম।

কেনের অফিস এখনো বন্ধ। এখনো ফেরেননি ইওরোপ থেকে। ফিরলেই আমাকে নিয়ে বসবেন বলেছেন। বলেছেন যা জানি তার ওপর একটা বক্তৃতা দিতে হবে। নিউক্লিয়ার মডেল সম্পর্কে পরীক্ষায় পাসের জন্য যা পড়েছিলাম তা সব ভুলে গিয়েছি। এখন শুধু এটুকুই বুঝতে পারছি – আমি কিছুই জানি না।

একটায় আবার গেলাম সাততলার পরীক্ষার হলে। আরো চারঘন্টা থাকতে হবে এখানে? পরীক্ষার প্রশ্নগুলি কোনোটাই ঠিক প্রশ্ন নয়। বরং বলা চলে নিউক্লিয়ার স্ক্যাটারিং-এর প্রসঙ্গ এবং প্রাসঙ্গিক সমস্যা। এই সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। সমাধানগুলির বেশিরভাগই গাণিতিক। কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে তার সমাধান করতে হয়। অনার্স ও মাস্টার্স মিলিয়ে দু’বছর কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়ার পরেও এরজন্য যতটুকু গাণিতিক দক্ষতা লাগে  তার কিছুই অর্জন করতে পারিনি। প্রামাণিকস্যার যখন বিভিন্ন গাণিতিক ফাংশান জানার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন, তখন রাগে গা জ্বলতো। এখন কেন সেই সময় ঠিকমতো শিখিনি বলে নিজের মাথার চুল খাবলে তুলে নিতে ইচ্ছে করছে।

দুটোর দিকে বের হয়ে গেল মার্ক। উত্তরপত্রগুলি সামনের একটি খালি টেবিলে রেখে ট্রলিতে বইপত্র গুছিয়ে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে গেল। আমার আটটি প্রশ্নের উত্তরই আমি সারমর্ম জাতীয় কিছু লিখে দিয়েছি। এখন আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বের হয়ে যাবার জন্য উশখুশ করছি। অপেক্ষা করছি আরো কেউ বের হয় কি না। দেখলাম মার্ক ফিরে এসেছে আবার। এসেই র‍্যাচেলের টেবিলের কাছে গিয়ে তার বইপত্র গোছাতে শুরু করেছে। র‍্যাচেলকে সে পটানোর চেষ্টা করছে কয়েক বছর থেকে। সম্ভবত কিছুটা পটেছে। খাতাপত্র গুছিয়ে বের হয়ে গেল মার্কের সাথে।

একটু পরে আমিও বের হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে একটা ফাঁড়া কাটলো। এই পরীক্ষাটা আমার না দিলেও চলতো। কেমন পরীক্ষা হয় দেখার কৌতূহল হচ্ছিলো। এখন কৌতূহল মিটে গেছে।

কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই বুঝতে পারলাম বইখোলা পরীক্ষার কিছু সুফলও আছে। এধরনের পরীক্ষায় সম্ভবত ফেল করা সম্ভব নয়। সারমর্ম লিখলেও সেগুলি বই থেকে লেখার কারণে কিছুটা শুদ্ধ হয়েছে। অন্যান্যদের সাথে আমিও পাস করে ফেলেছি। প্রফেসর অ্যালেন উত্তরপত্র দিয়ে দিয়েছেন তাঁর মন্তব্যসহ। মনে হচ্ছে এদেশের প্রফেসররাও পুরো উত্তরের একটা নির্দিষ্ট অংশ ছাড়া বাকিটা পড়েনও না। 


Friday 30 September 2022

জান বাটিস্ট পাহ্‌রান - নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী

 


জান বাটিস্ট পাহ্‌রান (Jean Baptiste Perrin) ছিলেন খ্যাতনামা ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দশক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির যে তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। সেজন্য ১৯২৬ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি।

১৮৭০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের লিলে শহরে জন্ম হয়েছিল জান বাটিস্ট পাহরানের। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত ইকল নরমাল সুপেরিয়র ইউনিভার্সিটিতে। ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত তিনি সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণাসহকারী হিসেবে কাজ করেন। সেই সময় জার্মানিতে রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেছেন। পুরো ইওরোপজুড়ে তখন এক্স-রে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গেছে। পাহ্‌রানের ল্যাবেও তখন এক্স-রে ও ক্যাথোড রে নিয়ে চলছে তুমুল গবেষণা। এই গবেষণার ভিত্তিতে ১৮৯৭ সালে থিসিস লিখে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন পাহ্‌রান।

ডিএসসি অর্জন করার পর পরই তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে যোগ দেন। ১৯১০ সালে তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এই পদে তিনি ছিলেন ১৯৪০ সাল পর্যন্ত।

পাহ্‌রানের প্রথম দিকের গবেষণা ছিল ক্যাথোড রশ্মি সংক্রান্ত। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে ক্যাথোড় রশ্মিগুলি মূলত নেগেটিভ চার্জবিশিষ্ট কণা –  আমরা এখন জানি যে ওগুলি আসলে ইলেকট্রনের প্রবাহ। ১৮৯৭ সালের আগে ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হয়নি। এক্স-রে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন তিনি। গ্যাসের ভেতর এক্স-রে চালনা করলে  প্রবাহে কী ধরনের পরিবর্তন হয়, তা তিনি বের করেন। শব্দের পরিচলন নিয়েও গবেষণা করেছিলেন তিনি।

কিন্তু তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হলো ব্রাউনিয়ান গতি সংক্রান্ত গবেষণা। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর একটি গবেষণাপত্রে [On the Motion of small Particles Suspended in Liquids at Rest Required by the Molecular-Kinetic Theory of Heat, Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭(১৯০৫), পৃষ্ঠা ৫৪৯-৫৬০] ব্রাউনিয়ান গতি (Brownian Motion) সম্পর্কে আলোচনা করলেন। কোন তরল পদার্থের ওপর খালি চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট ছোট পদার্থের কণা ভাসতে থাকলে কণাগুলোর গতি কোন নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের গতি হয় অত্যন্ত অনিয়মিত। আঠারো শতকে স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী  ব্রাউন এ গতি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এ গতির নাম দেয়া হয়েছে ব্রাউনিয়ান গতি। আইনস্টাইন এই গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেন যে এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের একভাগের সমান বা তার চেয়েও ছোট কণাগুলো তরল পদার্থে ওরকম বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করার কারণ হলো তাদের থার্মাল ডায়নামিক্স। বোল্টজম্যানের সূত্র ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন এবং গ্যাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুগুলোর গতির গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

পাহ্‌রান আইনস্টাইনের এই তত্ত্বীয় গবেষণার ভিত্তিতে পরীক্ষাগারে ব্রাউনিয়ান গতির পরীক্ষা করে দেখেন। তাঁর পরীক্ষার ফলাফল থেকে তিনি সঠিকভাবে এভোগাড্রো সংখ্যার মান নির্ণয় করতে সক্ষম হন। এই গবেষণার জন্য তিনি ১৯২৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।

বিজ্ঞানী পাহ্‌রানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ। পরবর্তীতে সেখানে গবেষণা করে ফ্রান্সের অনেক বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

১৯৩৮ সালে ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্স-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রফেসর জান পাহ্‌রান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন জান পাহ্‌রান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৪০ সালে যখন হিটলার ফ্রান্স আক্রমণ করলো, সত্তর বছরের বৃদ্ধ পাহ্‌রানের আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

১৯৪২ সালের ১৭ এপ্রিল নিউইয়র্কেই মৃত্যু হয় বিজ্ঞানী জান পাহ্‌রানের। ১৯৪৮ সালে ফরাসি সরকার জান পাহ্‌রানের দেহাবশেষ নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে নিয়ে এসে দেশের মাটিতে সসম্মানে সমাহিত করার ব্যবস্থা করে।



এনরিকো ফার্মি - পদার্থবিজ্ঞানের পোপ

 



মহাবিশ্বে যতগুলি কণা (particle) আছে, তাদের সবগুলিকে প্রধানত দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগের নাম বোসন, অন্যভাগের নাম ফার্মিয়ন। বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বের সাথে জানি – এই বোসন নামটা এসেছে সত্যেন বসুর নাম থেকে। বোস থেকে বোসন। তেমনিভাবে, অন্যভাগের নামটা এসেছে এনরিকো ফার্মির নাম থেকে। বোসন কণাগুলি পাউলির বর্জননীতি (Pauli’s exclusion principle) মেনে চলে না। অর্থাৎ একই পরমাণুর মধ্যে তাদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্র হতে হয় না। যেমন আলোর কণা ফোটন; একই শক্তিসম্পন্ন হলে, একটি ফোটন থেকে অন্য ফোটনকে আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না। কিন্তু ফার্মিয়নের ব্যাপার আলাদা। ফার্মিয়ন কণাগুলি খুবই শ্রেণিবিভাজন মেনে চলে। যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন কিংবা নিউট্রন। একই পরমাণুর একই শক্তিস্তরে থাকলেও, তাদের প্রত্যেকের কোয়ান্টাম সংখ্যায় কোনো না কোনোভাবে পার্থক্য থাকতে হয়। কণার এই বিভাজনের ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এবং ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক যখন কণাগুলির জন্য ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। এর তিন বছর আগে ১৯২৪ সালে আমাদের সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে স্বয়ং আইনস্টাইনের সাথে মিলে আবিষ্কার করেন বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স।

ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মিকে তাঁর সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানীরা বলতেন “পোপ অব ফিজিক্স”। রোমান ক্যাথলিকরা যেমন তাঁদের পোপকে সকল ধর্মীয় সমস্যার সমাধান মনে করেন, তেমনি পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মনে করা হতো – এনরিকো ফার্মির কাছেই আছে সকল সমস্যার সমাধান।

পদার্থবিজ্ঞানের – বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে এনরিকো ফার্মির হাতে। আজ আমরা নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ মাপতে দৈর্ঘ্যের খুব ছোট একটা একক ব্যবহার করি – যার নাম ফার্মি ( ১ মিটারের ১০০০০০০০০০০০০০০০ ভাগের এক ভাগ; ১ এর পর পনেরটা শূন্য)। নিউক্লিয়াসের ফিশান প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন ফার্মি। তিনিই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিটাক্ষয়ের (beta decay)। প্রথম পারমাণবিক বোমার অন্যতম কারিগর ছিলেন এনরিকো ফার্মি। তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর। আজ পৃথিবীর প্রয়োজনীয় জ্বালানির একটি বড় অংশের জোগান আসছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এরজন্য যে মানুষটাকে আমাদের প্রতিদিন স্মরণ করা উচিত তিনি – এনরিকো ফার্মি।

১৯৩৮ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিজম থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যেতে হয়েছিল এনরিকো ফার্মিকে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, গবেষণা করেছেন লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে।

খুব বেশিদিন বাঁচেননি এই বিজ্ঞানী। ১৯০১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইতালির রোমে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ১৯৫৪ সালের ২৮ নভেম্বর মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন পাকস্থলীর ক্যান্সারে। পারমাণবিক বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করতে করতে নিজেই শিকার হয়েছেন তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়।

তাঁর মৃত্যুর পর আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি তাঁর নামে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার প্রবর্তন করে – এনরিকো ফার্মি পুরষ্কার। প্রথম পুরষ্কারটি এনরিকো ফার্মিকেই দেয়া হয় মরণোত্তর। একশতম মৌলিক পদার্থের নামকরণ করা হয় – ফার্মিয়াম। আমেরিকার প্রধান একটি জাতীয় গবেষণাগারের নাম রাখা হয় – ফার্মি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি।


তথ্যসূত্র:

1. World Book's Biographical Encyclopedia of Scientists, World Book, Chicago, 2003. 

2. Gino Segre and Bettina Hoerlin, The Pope of Physics Enrico Fermi and the birth of the atomic age, Henry Holt and Company, New York, 2016. 



Tuesday 20 September 2022

মহাবিশ্বের রহস্য এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

 




‘আকাশভরা সূর্যতারা’ দেখেনি পৃথিবীতে এমন মানুষ মেলা ভার। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলেই মেঘহীন আকাশে তারা ঝকমক করতে শুরু করে। বুদ্ধিমান মানুষ, কৌতূহলী মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই অপার বিস্ময়ে আকাশের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি যেমন দেখছে, তেমনি গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনেক প্রাকৃতিক ঘটনারই রহস্য উন্মোচন করে ফেলেছে। মহাবিশ্বের মহাজাগতিক ঘটনাবলি বৈজ্ঞানিক উপায়ে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করার যে জ্যোতির্বিজ্ঞান – তার ইতিহাস অনেক পুরনো। খালি চোখে মকাকাশ পর্যবেক্ষণ করার আদি সময় আমরা পার হয়ে এসেছি গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও যখন আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কার করে ফেললেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের আকাশে নতুন সূর্যোদয় হলো। এর আগের প্রায় আড়াই হাজার বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার ধরন বদলে গেল গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের মাধ্যমে।

পরবর্তী কয়েক শ বছরের মধ্যে একের পর এক তৈরি হতে থাকলো আরো অনেক শক্তিশালী টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য তৈরি হলো অবজারভেটরি বা মানমন্দির। পৃথিবী থেকেই এসব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে বসানো টেলিস্কোপ যত শক্তিশালীই হোক, তাদের কিছু গুণগত সীমাবদ্ধতা কিছুতেই দূর করা সম্ভব হয়নি। যেকোনো টেলিস্কোপের প্রধান কাজ হলো মহাকাশ থেকে আসা আলো অনুসন্ধান করে শনাক্ত করা এবং সেই আলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা। সুদূর মহাকাশ থেকে আলো পৃথিবীতে আসার সময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে বিভিন্ন ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল মহাকাশের আলোর কিছু অংশ শোষণ করে ফেলে। আবার কিছু অংশ পৃথিবীর ধূলিকণার গায়ে লেগে বিক্ষিপ্ত হয়। আলোর স্ক্যাটারিং থিওরি বা আলোর বিক্ষেপণের তত্ত্ব থেকে আমরা জানি যে আলোর বিক্ষেপণের ফলেই দিনের বেলায় পৃথিবীর আকাশ নীল দেখায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে মহাকাশের মহাজাগতিক ঘটনাগুলি নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কোটি আলোকবর্ষ দূরের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসতে আসতে উজ্জ্বলতা হারায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে দীপ্তমান তারাগুলিও মিটমিট করতে থাকে পৃথিবীর আকাশে। ফলে মহাকাশের অনেক রহস্যই অধরা থেকে যায় পৃথিবীতে স্থাপিত সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপগুলিতেও। অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেখানে টেলিস্কোপ স্থাপন করেও এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হয়নি।

এতসব অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসংখ্য আবিষ্কার, মহাবিশ্বের অসংখ্য রহস্যের সমাধান পৃথিবীতে স্থাপিত টেলিস্কোপের মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা করে ফেলেছেন। তাতে আনন্দ যেমন আছে, অতৃপ্তিও আছে। অতৃপ্তি হলো যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল প্রেরণা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয়েছে স্যাটেলাইট যুগ। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে কৃত্রিম স্যাটেলাইট পাঠাতে শুরু করে। শুরু হয় মহাকাশকে জানার নতুন পদ্ধতি। ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এর মাধ্যমে স্থাপিত হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরেকটি নতুন যুগ – স্যাটেলাইট টেলিস্কোপের যুগ।

প্রায় ১৩ মিটার লম্বা ও ৪.৩ মিটার চওড়া এগারো টন ভরের হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘন্টায় প্রায় সাতাশ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে গত বত্রিশ বছর ধরে। প্রতি সপ্তাহে হাবল টেলিস্কোপ প্রায় ১৫০ গিগাবিট ডাটা পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। হাবল টেলিস্কোপের পাঠানো ডাটা থেকেই আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে ১৩৮০ কোটি বছর আগে। হাবল টেলিস্কোপের ডাটার সাহায্যে আমরা প্রমাণ পেয়েছি ব্ল্যাকহোলের। বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন বিশালাকৃতির ব্ল্যাকহোল। হাবল আমাদের খুঁজে দিয়েছে অনেকগুলি নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা। হাবল টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দিয়েছে আশ্চর্য গতি। এপর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে হাবলের সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে।

কিন্তু এটুকুতে খুশি হয়ে বসে থাকা বিজ্ঞানীদের কাজ নয়। হাবল টেলিস্কোপের যেটুকু দুর্বলতা আছে – সেটুকু দূর করে মহাকাশে আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ স্থাপনের পরিকল্পনা বিজ্ঞানীরা করছেন অনেক বছর থেকে। যেমন হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি ঘুরছে বলে অনেক সময় পৃথিবী নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় হাবল টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। আবার হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার সময়ে ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশান বেল্টের একটা অংশের কাছ দিয়ে যায়। তখন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হাবল টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতিতে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ সৃষ্টি করে যা ডাটা সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটায়। হাবল টেলিস্কোপের ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার অতিদূর নক্ষত্র থেকে আসা ক্ষীণতম আলো থেকে যে ছবি নির্মাণ করে – তা খুবই অনুজ্জ্বল আর অস্পষ্ট। এসব ত্রুটি দূর করে সম্পূর্ণ নতুন একটি স্যাটেলাইট নির্মাণ করে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে যার নাম জেমস ওয়েব।

২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর জ্যোতির্বিজ্ঞানে শুরু হয়েছে নতুন বিপ্লব। সেদিন পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও অনেক গুণ শক্তিশালী নতুন টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। হাবল টেলিস্কোপের সাথে জেমস ওয়েবের গঠনে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। হাবল টেলিস্কোপের আকার যদি একটি পঞ্চাশ সিটের বাসের সমান হয়, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আকার একটি টেনিস কোর্টের সমান। হাবলের দর্পনের ব্যাস  ২.৪ মিটার, জেমস ওয়েবের দর্পণের ব্যাস ৬.৫ মিটার। হাবলে যে ক্যামেরাগুলি আছে সেগুলি অতিবেগুনি আলো, দৃশ্যমান আলো এবং নিয়ার-ইনফ্রারেড বা কাছের অবলোহিত আলোর তরঙ্গ শনাক্ত করে ছবি তুলতে পারে। জেমস ওয়েবের ক্যামেরাগুলি কাজ করে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোকতরঙ্গে। হাবল টেলিস্কোপ যেখানে পৃথিবী থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, সেখানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে – চাঁদের অক্ষের কাছাকাছি দূরত্বে। এর ফলে মহাকাশের অনেক ভেতরে চোখ রাখা সম্ভব হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের।

মহাকাশে পূর্বনির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করার পর গত ছয় মাস ধরে চলছিল প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষাগুলোর বিভিন্ন ধাপ। এখন সেসব ধাপ সফলভাবে পার হয়ে মূল বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। শুরুতেই বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। ত্রিশ বছর আগে হাবল টেলিস্কোপ যেরকম হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল মহাকাশের নতুন নতুন তথ্য ও ছবি দিয়ে – সেরকম আরো অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব বিশ্ববাসীকে উত্তেজনায় টান টান করে দিয়েছে তার প্রথম কয়েকটি ছবি প্রকাশিত হতে না হতেই।

এবছরের ১২ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম চারটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে প্রস্তুতির পর এক হাজার কোটি ডলারের টেলিস্কোপ – জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে যে উদ্দেশ্যে – সেই উদ্দেশ্য সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে। প্রথম প্রকাশিত ছবিগুলি থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এতদিন আগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাকাশের যেসব চিত্র আবছা দেখা গিয়েছিল – এবার তা স্পষ্ট হলো। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ছবিগুলি হাবল টেলিস্কোপের ছবিগুলি থেকে দুই থেকে তিন গুন বেশি স্পষ্ট।

ঠিক কী কী বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য ঠিক করে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে? বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলিকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম লক্ষ্য হলো একেবারে শৈশবের মহাবিশ্বের স্বরূপ উদ্ঘাটন। বিগ ব্যাং এর পর থেকে প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলির আলোর সন্ধান করতে পারলে বোঝা যাবে কীভাবে এই গ্যালাক্সিগুলির উৎপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো গ্যালাক্সিগুলির বিবর্তন অনুসন্ধান। প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলি থেকে বর্তমান যুগের গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে কী কী বিবর্তন হয়েছে, এবং কীভাবে হয়েছে। তৃতীয় লক্ষ্য হলো নক্ষত্রগুলি কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে  – একেবারে প্রথম পর্যায় থেকে শুরু করে তাদের গ্রহ-উপগ্রহসহ নক্ষত্রজগতের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে তা খুঁজে বের করা। আর চতুর্থ লক্ষ্য হলো আমাদের সৌরজগতসহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলির বিভিন্ন ভৌত এবং রাসায়নিক ধর্মাবলি পরীক্ষা করে দেখা। এবং আমাদের পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।

পৃথিবীর কাছাকাছি হওয়াতে  হাবল টেলিস্কোপ সরাসরি আমাদের সূর্যের দিকে তাকাতে পারে না। ফলে সূর্যের কাছের গ্রহ বুধ, ও শুক্রের খুব বেশি তথ্য হাবল সরাসরি সংগ্রহ করতে পারেনি। জেমস ওয়েবের সেই সীমাবদ্ধতা নেই। আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলিকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আছে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের শক্তিশালী ক্যামেরাগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এগুলি ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করতে পারে এবং সেই আলোতে ছবি তুলতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করার দরকার কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আলোর পদার্থবিজ্ঞান কিছুটা বুঝতে হবে। আলোর গতিবেগ  শূন্য মাধ্যমে যে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বা তিন লক্ষ কিলোমিটার তা আমরা জানি। আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে – আলোর শক্তি তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। আলো যখন কোন উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে একই মাধ্যমে চলতে থাকে, তখন এর গতিবেগের কোন পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু আলোক তরঙ্গ হলো তড়িৎচূম্বক তরঙ্গ, যার কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য একে অপরের বিপরীত অনুপাতিক। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি বেড়ে যায়, কম্পাঙ্ক কমে যায়। হাবল টেলিস্কোপ থেকে আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্ব যখন প্রসারিত হচ্ছে, একই সাথে আলোর তরঙ্গও প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে সময়ের সাথে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে লাল আলোর, আর সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে বেগুনি আলোর। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেলে তা হয়ে পড়ে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো। এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তির সীমানার বাইরে। অর্থাৎ অবলোহিত আলো আমরা দেখতে পাই না।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়ে লাল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় রেড শিফ্‌ট। আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে গিয়ে বেগুনি বা নীল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় ব্লু শিফ্‌ট। এই রেড শিফ্‌টের পরিমাণ হিসেব করে জানা যায় মহাবিশ্ব কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে, এবং সেই সময়ে আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে। সেই দূরত্বের হিসেব থেকে সময়ের হিসেব বের করা যায়। আলো এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার যায়। সে হিসেবে আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে সেই দূরত্বকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ। এখন কোন একটি নক্ষত্র যদি পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে থাকে, সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে এক বছর। যেমন সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এই সময়কে আলোর গতি দিয়ে গুণ করলে আমরা সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বের করতে পারি। একই ভাবে আমরা বলতে পারি – পৃথিবী থেকে যখন আমরা সূর্যকে দেখি তখন আসলে দেখি আট মিনিট বিশ সেকেন্ড অতীতের সূর্য। অনুরূপভাবে আমরা বলতে পারি আকাশভর্তি যেসব সূর্য-তারা আমরা দেখি সেগুলি থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে যদি কোটি বছর লাগে – তাহলে সেগুলি কোটি বছর আগের নক্ষত্র আমরা দেখছি।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ইনফ্রারেড ক্যামেরা কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি থেকে ভেসে আসা অবলোহিত আলো শনাক্ত করতে পারে। কোটি বছরের সফর শেষে এই আলো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নায় এসে প্রতিফলিত হয়। ইনফ্রারেড ওয়েভ ডিটেকটর সেই আলো শনাক্ত করে। সেখান থেকে তৈরি হয় গভীর মহাকাশের ছবি। শুধু তাই নয়, ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ থেকে মহাবিশ্বে ভাসমান সব ধরনের অণুর ধর্মাবলি বিশ্লেষণ করে দেখতে পারবে পৃথিবীর অন্য কোনো সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে প্রাণী আছে কি না।

এই টেলিস্কোপের প্রোগ্রাম ডিজাইনের সাথে সরাসরি যুক্ত আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা – নাসা (NASA), ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি – ইসা (ESA), ক্যানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি – সিসা (CSA)। টেলিস্কোপের সায়েন্স অপারেশান সেন্টার – যেখান থেকে মহাকাশের বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে – সেটা হলো আমেরিকার বাল্টিমোরে স্থাপিত স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউট। এখান থেকে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলিও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গত ১২ জুলাই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের যে কয়টি ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে  – সেগুলি বাছাই করেছেন স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন একটি জগতের পর্দা সরে গেলো এই ছবিগুলির মাধ্যমে।

 

চারটি ছবির একটি হলো SMACS 0723


এই ছবিটি তোলা হয়েছে টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার গ্যালাক্সি। সামনের উজ্জ্বল গ্যালাক্সির দল পেছনের গ্যলাক্সির আলোকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে। সামনের গ্যালাক্সির বয়স আমাদের পৃথিবীর বয়সের কাছাকাছি চার দশমিক ছয় বিলিয়ন বছর বা ৪৬০ কোটি বছর। পেছনের গ্যালাক্সিদল তৈরি হয়েছিল প্রায় তের বিলিয়ন বছর আগে, অর্থাৎ ১৩০০ কোটি বছর আগে। জেমস ওয়েব এই গ্যালাক্সিগুলোর অনেক ডাটা সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। এই ডাটা থেকে আমরা বুঝতে পারবো – কীভাবে প্রথম প্রজন্মের গ্যালাক্সিগুলি গঠিত হয়েছিল। এই গ্যালাক্সিগুলির মধ্যেই থাকতে পারে সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সি – যেগুলি তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং এর পাচ শ মিলিয়ন বা পঞ্চাশ কোটি বছরের মধ্যে – মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর দিকে। জেমস ওয়েবের এই ছবির ডাটা থেকে আমরা এতদিনের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি।

সবচেয়ে প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম কিছুক্ষণ (সময় তখনো শুরু হয়নি) সবকিছু অন্ধকার ছিল। পদার্থ যদি কিছু থেকে থাকে – তা ছিল সব ডার্ক ম্যাটার। ডার্ক ম্যাটার কোন আলো নির্গমন করে না, প্রতিফলন করে না। অথবা ছিল নিউট্রাল হাইড্রোজেন কিংবা হিলিয়াম। তারপর কয়েক শত মিলিয়ন বছর পর (প্রায় দশ কোটি বছর) পর গ্যাসগুলি আস্তে আস্তে জোট বাঁধতে বাঁধতে গ্যাসীয় নক্ষত্রের সৃষ্টি হলো। প্রথম আলোর আবির্ভাব হলো। এই আলোর বিকিরণের ফলে নিউট্রাল গ্যাস আয়নিত হলো। মহাবিশ্ব আস্তে আস্তে গ্যাস থেকে ফুটন্ত তরল তারপর গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ উপগ্রহের স্ট্রাকচার পেলো। এগুলি আমরা নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব থেকে জানি। কিন্তু সরাসরি তেমন জোরালো প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে নেই। জেমস ওয়েব আমাদের সেই প্রমাণ জোগাবে বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।

প্রকাশিত দ্বিতীয় ছবিটি স্টিফেন্স কুইনটেট (Stephan’s Quintet)। এই ছবিটি হলো এপর্যন্ত জেমস ওয়েবের তোলা সবচেয়ে বড় ছবি। এর ব্যাস চাঁদের ব্যাসের এক পঞ্চমাংশ। পনেরো কোটি পিক্সেলের এই ছবিতে আছে পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি গ্রুপ – পরস্পরের কাছাকাছি আসছে ২৯০ মিলিয়ন আলোক-বর্ষ দূরের পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জে। এই ছবি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে – এর কেন্দ্রে আছে একটি সুপারম্যাসিভ – প্রচন্ড ভরসম্পন্ন ব্ল্যাকহোল – যেখান থেকে একটি নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে। এখান থেকে যে ডাটা পাওয়া গেছে সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের জন্ম কীভাবে হয়, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের জন্মও কীভাবে হয়।

 


তৃতীয় ছবিটি  ক্যারিনা নেবুলা (CARINA NEBULA)


সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং বৃহত্তম নেবুলা হচ্ছে ক্যারিনা নেবুলা। নেবুলা হচ্ছে নক্ষত্রের জন্মভূমি – গ্যাস ও ধুলিকণা যেখান থেকে নক্ষত্রের জন্ম হয়। নক্ষত্রের উপাদানগুলির ভেতরের অনেক তথ্য জানা যাবে এখান থেকে – কারণ ইনফ্রারেড রে শনাক্ত করে বিশ্লেষণ করার উপায় আছে জেমস ওয়েবে। এথেকে নক্ষত্র কীভাবে সৃষ্টি হয় তা আরো ভালোভাবে জানা যাবে। ক্যারিনা নেবুলা সাউদার্থ কনস্টেলেশান ক্যারিনা থেকে ৭৬০০ আলোক-বর্ষ দূরে। এই ছবিতে যতগুলি ছোট ছোট উজ্জ্বল বিন্দু দেখা যাচ্ছে সেগুলি সবই নতুন নক্ষত্র। শত শত নতুন নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। আরো অনেক পরিষ্কার ঘটনা দেখা যাচ্ছে যেগুলি নতুন তথ্য দেবে আমাদের।

 চতুর্থ ছবি  

সাউদার্ন রিং নেবুলা (SOUTHERN RING NEBULA)


সাউদার্ন রিং নেবুলা হলো – প্লেনেটারি নেবুলা – যেখানে আছে গ্যাসের মেঘ যা সম্প্রসারিত হচ্ছে চারদিকে। গ্যাসগুলি মৃতপ্রায় নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে, অথবা দুটো মৃতপ্রায় নক্ষত্র – একে অপরের চার পাশে ঘুরছে । এর ব্যাস প্রায় অর্ধ-আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষের অর্ধেক)। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় দুই হাজার আলোকবর্ষ। ফেনার মতো কমলা রঙের যে কোষগুলি দেখা যাচ্ছে – ওগুলি হাইড্রোজেন অণু। দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে হাইড্রোজেন অণু তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রে যে নীল রঙের অংশ দেখা যাচ্ছে – সেগুলি আয়নিত গ্যাস। ডান পাশের চিত্রে দেখা যাচ্ছে দুটো নক্ষত্র ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে কেন্দ্রে। এখান থেকে যে ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের মৃত্যু কীভাবে হয়। নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ এর আগে কখনো হয়নি।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তার বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অনুসারে মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহে অনুসন্ধান চালাচ্ছে সেখানে কোথাও কোন প্রাণ ধারণের উপাদান পাওয়া যায় কি না। প্রাথমিক ছবিগুলির মধ্যে আমাদের সৌরজগতের বাইরের এক বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ WASP-96 b তে পানির অস্ত্বিত্বের প্রমাণ প্রকাশ করেছে। আমাদের সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে এই বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ। শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহের গ্যাসীয় উপাদান বিশ্লেষণ করার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা আছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের – এই ছবি তারই প্রমাণ। 



মহাকাশ দেখার এতদিনের শক্তিশালী মাধ্যম হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা দিয়েছিল – সেই ধারণার সরাসরি প্রত্যক্ষ করার জন্য আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ – জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ – আমাদের চোখের সামনে এনে দিচ্ছে মহাকাশের গভীর থেকে গভীরের চিত্র। আগে যা আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়েছে এখন সেগুলি বাস্তবে চলে আসতে শুরু করেছে। আগামী দশ বছর ধরে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের মহাবিশ্বের অনেক নতুন রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

 

তথ্যসূত্র:

১। মারিয়া আরিয়াস, দ্য কসমস অ্যাজ উই হ্যাভ নেভার সিন বিফোর, নিউ সায়েন্টিস্ট, ৯ জুলাই ২০২২।

২। মার্টিন বারস্টো, দ্য কনভারসেশান ১৩ জুলাই, ২০২২।

৩।  কার্ল গ্ল্যাজারব্রুক ও সাইমন ড্রাইভার, দ্য কনভারসেশান, ১৩ জুলাই ২০২২।

৪। বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২১।

৫। webb.nasa.gov

_____________
বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত










Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts