Monday, 24 December 2018

সূর্যনগর ব্রিসবেন - ৮ম পর্ব




স্পেশাল ইফেক্টের শেষ অংশ হলো আকাশে প্লেন বিস্ফোরণের দৃশ্যগ্রহণ। যুদ্ধ সংক্রান্ত যে কোন ছবিতে বা ইদানীং যে কোন অ্যাকশান ছবিতেই প্লেন বিধ্বস্ত হয় কোন না কোন ভাবে।
মোটামুটি আয়তনের একটি সেট এখানে। দেয়াল জুড়ে যেভাবে ছবি আঁকা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে বিশাল এক বিমানবন্দরের একটি অংশে আছি আমরা। সামনে অজস্র বিমান। একটা বিমানের ককপিটের অর্ধেক ছাদ থেকে ঝুলছে। নব নির্বাচিত পাইলটকে সিঁড়ি দিয়ে ককপিটের ভগ্নাংশে তুলে দেয়া হলো। সাথে মুভিওয়ার্ল্ডের কো-পাইলট। পর্দায় দেখা গেলো দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন পাইলট। একটু পরে দেখা গেলো বিশাল বোয়িং নিয়ে আকাশে এক ঝাঁক প্লেনের মাঝখানে আমাদের পাইলট। কেবল মুখটা দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে।



একটু পরেই দেখা গেলো প্লেনের ইঞ্জিনে আগুন লেগে গেছে। সামনে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট আলাদা মেশিন থেকে সাদা ধোঁয়া তৈরি করে দেয়া হচ্ছে শূন্যে ঝোলানো ককপিটে।
মানুষের মুগ্ধ হবার ক্ষমতা অসীম। আমরা পর্দায় যা দেখি তার সব কলাকৌশল জানার পরেও আমরা মুগ্ধ হই। সত্যি নয়- গল্প জেনেও আমরা কাঁদি-হাসি। আমরা যন্ত্র বানাই, কিন্তু নিজেরা যন্ত্র হয়ে যাই না বলেই তো আমরা মানুষ, অসীম ক্ষমতাশালী মানুষ।
সিনেমা তৈরির আরো একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এডিটিং। এডিটিং সম্পর্কে দেখানো হচ্ছে ওয়ার্নার ব্রাদার্স ক্লাসিকস-এ। ছোট্ট একটা হলে বসিয়ে পর্দায় দেখানো হলো বিভিন্ন বিখ্যাত সিনেমার ফুটেজ যা মূল সিনেমাতে নেই। বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীরা শুটিং-এর সময় পাঁচ সেকেন্ডের একটা শটও যে কতবার করে দিয়েছেন- কত হাস্যকর ঘটনা ঘটেছে ইত্যাদি। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা। এডিটিং সম্পর্কে কিছুটা প্রাথমিক কারিগরি জ্ঞান দেবার পর একটা মজার অ্যাডভেঞ্চার শো’তে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের।
একটা ছোট্ট রেলগাড়ির মতো কম্পার্টমেন্টে আমাদের বসানো হলো। গাড়িটি এগোচ্ছে একটা ভুতূড়ে পোড়াবাড়ির মধ্য দিয়ে। চারপাশে রাখা সিনেমার ফিল্ম আর ফিল্ম। মাকড়শার জাল আর প্রচন্ড ধুলাবালি দেখা যাচ্ছে, যদিও আমাদের গালে বা নাকে লাগছে না কিছুই। একটু পরে দেখা গেলো ভাঙা রাস্তা, রাস্তার পাশে বিধ্বস্ত দোকান পাট, ভাঙা শো-কেস যেন এক মৃতপুরীর ভেতর দিয়ে চলেছি আমরা। এক সময় নিকষ কালো অন্ধকার। তারপরেই হঠাৎ আলোয় বেরিয়ে এলাম মুভিওয়ার্ল্ডের বাস্তবতায়। এই গোলমেলে মৃতপুরীটার সাথে সিনেমার এডিটিং এর কী সম্পর্ক তা বুঝতে পারলাম না।
এবার গেলাম ব্যাটম্যান শো দেখতে। একটি ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে মোমের আলোয় অপেক্ষা করতে হলো শুরুতে। শো শুরুর আগেই মনে হচ্ছে ঘরে বাদুড় উড়ে বেড়াচ্ছে। দেয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা দরজা খুলে গেলো। মাথা নিচু করে ঢুকতে হয় এই দরজা দিয়ে। ঢুকতেই একটা গুহা। গুহায় একটি গাড়ির মতো কিছু আছে। তাতে চার সারিতে ষোলজনের বসার ব্যবস্থা। এই ষোলজনকে নিয়ে গাড়ি রওনা হলো বলে মনে হচ্ছে।
সামনের পর্দায় ছবি দেখানো হচ্ছে অনেক কিছুর। নানারকম দৃশ্যের সাথে গাড়ির দুলুনি ঝাঁকুনিতে দু’মিনিটের মধ্যেই বাস্তব পৃথিবী উধাও। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ট্রেনের নিচে ঢুকে যাবো, পর মুহূর্তেই মনে হচ্ছে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছি গাড়িসহ। সত্যি সত্যি দেখলাম পেছনের দিকে হেলে যাচ্ছে শরীর। একটু পরেই পাহাড় থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ার অনুভূতি। সবকিছু মিলিয়ে শরীর ও মনের ওপর এমন সূক্ষ্মচাপ পড়ে- মনে হয় যেন সত্যি আমরা ব্যাটম্যানের চেলা।
আরো অনেক কিছু দেখার বাকি এখনো। ৫২ ডলার নিয়ে যা দেখাচ্ছে তার আলাদা আলাদা মূল্য হিসেব করতে গেলে অনেক বেশি পড়বে। এবার রক্সি থিয়েটারে ঢুকলাম থ্রি ডাইমেনশানাল কার্টুন ছবি দেখতে। মারভিন দি মারসিয়ান। এটাই প্রথম ত্রিমাত্রিক কার্টুন ছবি। হলের ভেতর ত্রিমাত্রিক ছবির বাস্তবতাকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করতে কিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে এখানে। পর্দায় কার্টুনের একটা চরিত্র যখন পানি ছুঁড়তে থাকে তখন দর্শকদের গায়ের ওপরও কয়েক ফোঁটা পানি এসে পড়ে।





আলো কমে আসছে একটু একটু। মুভিওয়ার্ল্ডের রাস্তায় এখন নাচগান চলছে। পৃথিবীর বিখ্যাত পপ তারকাদের ডামিরা নেচে গেয়ে মানুষ জড়ো করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। চোখ গেলো মুভিওয়ার্ল্ডের লেটেস্ট আকর্ষণ লিথ্যাল ওয়েপন রাইডের দিকে। নানারকম অলিগলি পেরিয়ে গেলাম সেখানে। মনে মনে বললাম, দেখেই চলে আসবো। মুভিওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে দুঃসহ রাইড এটা। সামনেই বিশাল আকৃতির নোটিশ - উচ্চতা যাদের সাড়ে চার ফুটের কম বা ছ’ফুট দু’ইঞ্চির বেশি তারা এখানে চড়তে পারবে না। তারপর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দীর্ঘ বিবরণ। সিগারেটের গায়ে লেখা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো।
এক পা, দু’পা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। ভাবছি চড়া উচিত- নাকি উচিত নয়, টু বি অর নট টু বি টাইপের প্রশ্ন। শেষে মনে হলো যখন দেখাই যাক না কী হয়।
চেয়ারের বসার আগে পকেট খালি করে নিতে হয় যেন কিছু পড়ে টড়ে না যায়। কাউন্টারে জিনিসপত্র জমা রাখার আলাদা আলাদা খোপ আছে। কোন কিছু হারানো বা চুরি হবার ভয় নেই। বেশ মোটা মোটা বেল্ট দিয়ে কাঁধের ওপর থেকে দুদিকে টেনে বাঁধা হলো চেয়ারের সাথে। পাশাপাশি দুটো করে চেয়ার। আমার পাশের জন আমার চেয়ে মোটাতাজা শক্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আমি আড়চোখে দেখছি তাকে মিস্টার বিনের ভঙ্গিতে।
শুরুতে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে আমাদের আসন। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই চেয়ার ঘুরছে লাটিমের মতো। এলোমেলো পথে কীসের টানে যেন ছুটে চলেছে। একটু পরেই দেখা গেলো আমাদের মাথা নিচের দিকে। পেটের ভেতরে যা আছে সব যেন দলা পাকিয়ে মুখের দিকে চলে যাচ্ছে। সব এক সাথে বেরুতে চাচ্ছে বলেই বেরুতে পারছে না। মনে হলো মুখেও একটা মোটা বেল্ট লাগানোর ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিলো। আমি চোখের সামনে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেছি। চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে আমার। চারপাশে মনে হচ্ছে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্ল্যাক হোলে ঢুকে পড়েছি। হৃদপিন্ড ঠিক জায়গায় আছে কিনা বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড বেগে ডানে বামে উপরে নিচে ঝাঁকুনি চলছে। মহাভারতে ভীম কীচককে ধরে যেভাবে চটকেছিলো, আমাকেও যেন কোন অদৃশ্য ভীম সেভাবে চটকাচ্ছে। কীচকের তো সুনির্দিষ্ট অপরাধ ছিলো, কিন্তু আমার অপরাধ কী এখানে? শেষ পর্যন্ত কীচকের দেহ গিয়ে পড়েছিলো বিরাট রাজার দরবারে। এই মুহূর্তে ছিটকে পড়লে আমার দেহ হয়তো সোজা ব্রিসবেনে গিয়ে পড়বে।
অবশেষে ঝড় থামলো এক সময়। চোখ খুলে ঝাপসা দেখলাম। চোখের কী হলো? আসলে চশমা খুলে জমা দেয়ার কারণেই। বেল্ট খুলে প্লাটফরমে দাঁড়াতে গিয়ে মনে হলো পুরো প্লাটফর্ম দুলছে। শরৎ বাবুর সমুদ্রে সাইক্লোনের অভিজ্ঞতার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা কোন অংশে কম নয়। কয়েক মিনিট পরে স্বাভাবিক হয়ে মনে হলো নিজেকে মনে মনে যত গালাগালি করেছি ততোটা না করলেও চলতো।
মুভিওয়ার্ল্ড থেকে ব্রিসবেন ফিরতি বাস পৌঁছে পাঁচটায়। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে উঠতে গেলাম। ড্রাইভার ভদ্রমহিলা জানালেন ওটা ব্রিসবেনগামী গাড়ি নয়। ব্রিসবেনের পৌনে পাঁচটার বাসের কী হলো? তিনি বললেন ঐ লাইনের বাস নাকি সব সময়েই দেরি করে।
ভদ্রমহিলার কথা ঠিক। পৌনে পাঁচটার বাস এলো পাঁচটা বিশ মিনিটে। এ ধরনের অনিয়ম এখানে দেখলে আমার ভালোই লাগে। ক্লাসে ভালো স্টুডেন্টরা পড়া না পারলে বাজে স্টুডেন্টদের যেরকম ভালো লাগে, অনেকটা সেরকম। ব্রিসবেনে পৌঁছে হোস্টেলে ফেরার পথে টের পেলাম শরীরের সমস্ত কলকব্জা ঢিলে হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের সব স্ক্রু ঠিক মতো আছে কিনা কে জানে।

*****

হোস্টেলের চেকিং আউট টাইম সকাল সাতটা থেকে দশটার মধ্যে। আমার বাস ছাড়বে রাত আটটায়। সকাল নটায় হোস্টেলের চাবি ফেরত দিয়ে বেরিয়ে এলাম হোস্টেল থেকে। আমার ব্যাগটা বড় নয়, আর ভারীও নয়। কাঁধে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু রাত আটটা পর্যন্ত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোন অর্থ হয় না।
ট্রানজিট সেন্টারে বেশ কিছু অটোম্যাটিক লকার আছে। ২৪ ঘন্টার ভাড়া পাঁচ ডলার। মেশিনে পাঁচ ডলারের কয়েন ফেলে বোতাম টিপলেই একটা ম্যাগনেটিক কার্ড বেরিয়ে আসে। কার্ডটা নিয়ে কার্ডে লেখা নম্বর অনুযায়ী লকারে ব্যাগ রেখে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এখন মুক্ত হাত পা। শরীরের ব্যাথা ব্যাথা ভাবটা এখন আর নেই।
ব্রিসবেন সিটির ম্যাপটা ভালোভাবে দেখলাম। খুব কাছের অংশটা দেখা বাকি এখনো। প্রথমেই দেখতে হবে রোমা স্ট্রিট পার্কল্যান্ড। ব্রিসবেন ট্রানজিট সেন্টারের ঠিক পাশেই পার্কল্যান্ডে প্রবেশের প্রধান পথ। রেলওয়ে স্টেশনের দুনম্বর প্লাটফর্ম থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই পার্কল্যান্ডের শুরু।

১৬ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিশাল বাগান। আগে এখানে হাটবাজার বসতো মাঝে মাঝে আর বেশির ভাগ সময়েই জায়গাটা এমনিতে পড়ে থাকতো। ১৯৯৯ সালে কুইন্সল্যান্ড সরকার ৭২ মিলিয়ন ডলারের পার্কল্যান্ড প্রকল্প হাতে নেয়। মাত্র দু'মাস আগে এপ্রিল মাসে এই পার্ক অফিসিয়ালি চালু হয়েছে। এখনো সবকিছু ঝকঝকে নতুন।


প্রায় এক লক্ষ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এই পার্কে। পৃথিবীর বিরল প্রজাতির ফার্ণ থেকে শুরু করে বড় বড় গাছ পর্যন্ত। বিশাল আকৃতির প্রাচীন গাছ আছে ষোল শত। রেলওয়ে স্টেশনের দোতলায় পার্কল্যান্ডের বিশাল অফিস। সূর্যোদয় থেক সূর্যাস্ত পর্যন্ত সপ্তাহের প্রত্যেকদিন খোলা থাকে এই পার্ক। অমূল্য এই পার্কে ঢুকতে কোন টিকেট লাগে না।
পার্কে ঢুকতেই দেখি সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে পার্কের পরিচিতি মূলক বিভিন্ন পুস্তিকা। সেখানে ম্যাপ ছাড়াও আছে বিভিন্ন গাছের পরিচিতি। বাঁ পাশে বিস্তীর্ণ পার্কিং এলাকা। এর মধ্যেই প্রচুর গাড়ি এসে পৌঁছেছে। বেশির ভাগই স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফ্যামিলি পিকনিক করতে এসেছে। সামনেই বিশাল খোলা মাঠ সেলিব্রেশান লন।





মাঠের ওপাশে কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদের পানিতে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ। প্রত্যেক উদ্ভিদের পরিচিতিসহ নেমকার্ড দেয়া আছে। নানারকম শাপলা ফুটে আছে পানিতে। লেকের পাড় ঘেঁষে হাঁটা পথ মিশে গেছে লেক শেষের জঙ্গলে। সেখানে গহীন অরণ্যের শুরুতে ফার্ণ গ্যালারি। পৃথিবীর বৃহত্তম ফার্ণ এখন এখানে। রেইন ফরেস্ট দেখার জন্য পুরো বাগান জুড়ে আছে টানা ব্রিজ। ব্রিজ চলে গেছে বনের মাঝখান দিয়ে গাছের উপর দিয়ে। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে দারুণ লাগে এই জঙ্গল।




জঙ্গলের আকর্ষণ নানা সময়ে নানা রকম। আবার বিভিন্ন স্থানেও বিভিন্ন রকম। ফার্ণগুচ্ছের পরেই জলা জায়গায় পদ্মবন। হাজারো প্রজাতির পদ্ম আর শাপলা এখানে। অনেকটুকু জায়গা নিয়ে সাজানো হয়েছে মৌসুমী ফুলের বাগান। প্রজাপতি রঙের বর্ণিল ফুল দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। রঙের এমন আশ্চর্য কম্বিনেশান হয় কীভাবে! জানা গেলো এখানে অনেক ফুলের রঙ কম্পিউটারে তৈরি করা হয়েছে প্রথমে। পরে সে অনুযায়ী জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফসল এই বর্ণিল ফুল।
চার ঘন্টা কীভাবে যেন কেটে গেলো এই বাগানে। তারপরও মনে হচ্ছে আরো দেখি। সিটি এলাকা এক চক্কর দিলেই মনে হয় সব দেখা শেষ। অথচ এই বাগানে একটা ফুল শতবার দেখেও তৃপ্তি হচ্ছে না। প্রাণের স্পন্দনেই হয়তো আনন্দ। শহরের পাথরে প্রাণ নেই বলেই আমাদের প্রাণ সেখানে হাঁপিয়ে ওঠে।
পার্কে গাছের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে প্রচুর ধাতব শিল্পকর্ম। যাদের দ্রব্যমূল্য চৌদ্দ লাখ ডলার, আর শিল্পমূল্য অসীম।
পার্কের উত্তর দিকের অংশের নাম অ্যালবার্ট পার্ক। বেশ বড় আলাদা আরেকটি পার্ক। অ্যালবার্ট পার্কের শেষ ভাগে কলেজ রোড। কলেজ রোড ধরে একটু এগিয়ে স্প্রিং হিল। এখানে খুব সুন্দর একটা গির্জা আছে। সেন্ট পলস গির্জা। জায়গাটার নাম সেন্ট পলস ট্যারেস। খুব সুন্দর শান্ত আবাসিক এলাকা।
সেন্ট পলস থেকে ব্রাঞ্চ উইক স্ট্রিট পর্যন্ত হেঁটে এলে ব্রিসবেনের চায়না টাউন। চীনা স্থাপত্যে তৈরি সিংহের মুখওয়ালা লাল গেটও এখানে। চায়না টাউনগুলোতে হোটেল রেস্তোরা আর মুদি দোকান বেশি থাকে। এখানেও সেরকম। তবে এখানকার চায়না টাউনটা কেমন যেন নির্জীব। মার্কেট একটা হয়েছে তবে এখনো অনেক পজেশন খালি পড়ে আছে। চায়নিজদের বিরুদ্ধে ওয়ান নেশান পার্টির পলিন হ্যানসনের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণেই হয়তো এখানে চায়নিজরা মেলবোর্নের চায়নিজের মতো স্বচ্ছন্দ নয়।
কিছুক্ষণ ঘুরে আবার ফিরে এলাম রোমাস্ট্রিটের পার্কল্যান্ডে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে শুধু এই পার্কের আকর্ষণেও যদি কেউ ব্রিসবেনে আসে তাকে হতাশ হতে হবে না। আক্ষরিক অর্থেই পুরো একটা দিন কাটলো আমার এই পার্কে। হাত-পা ছড়িয়ে গাছের নিচে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকার এমন স্বাধীনতা আবার কখন কোথায় পাবো তা তো জানি না।
পৌনে আটটার বাসে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে জানা গেলো বাস ছাড়তে কমপক্ষে একঘন্টা দেরি হবে। অনেকে রেগে গেলো এই ঘোষণায়। আমার কোন অনুভূতিই নেই। আমার মনে হচ্ছে এই দুনিয়ার সবকিছুই ভালো। এখনো ভালো, এক ঘন্টা দেরিতেও ভালো।

*****

বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। ক’দিনেই এ জায়গাটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে বুঝতে পারছি। গাড়ি ছুটছে প্রচন্ড বেগে। নির্দিষ্ট স্থানে থামছে, আবার চলছে। পেরিয়ে যাচ্ছি গোল্ডকোষ্টের বিশাল মোটেল, প্রশান্ত মহাসাগর। যাত্রীদের প্রায় সবাই ঘুমুচ্ছে। আমার ঘুম আসছে না। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ। এখানে আসার সময় যে পথ পেরিয়েছি দিনের আলোয়, সে পথ এখন আধখানা চাঁদের আবছা আলোয় অদ্ভূত মায়াবী লাগছে। পেরিয়ে যাচ্ছি বায়রন বে’র সেই মন ভোলানো পথ। আমি ভুলে থাকতে চাচ্ছি কাল সিডনি, পরশু মেলবোর্ন, তারপরে আবার নিত্যদিনের দায়। জীবন জোছনার আলো দিয়ে তৈরি নয়, আমি তা জানি। কিন্তু তাই বলে ঘন বনের গাছের পাতায় ছিটকে পড়া জোছনা দেখতে তো আমার কোন বাধা নেই। আমি দেখছি। আমি আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে দেখতে চাচ্ছি- হে অসম্ভব সুন্দর- তোমাকে।
___________

এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ছবিগুলো আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। 


Sunday, 23 December 2018

সূর্যনগর ব্রিসবেন - ৭ম পর্ব



ব্রিসবেনে এসে যদি মুভি-ওয়ার্ল্ড, সি-ওয়ার্ল্ড বা ড্রিম-ওয়ার্ল্ডের কোন একটাও না দেখে ফিরে যাই তা হবে শতাব্দীর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। সুতরাং সকাল আটটা বাজতেই বেরিয়ে পড়লাম। মুভি ওয়ার্ল্ড দেখে দুঃখজনক ঘটনা ঘটার হাত থেকে শতাব্দীকে রক্ষা করতে হবে।
ট্রানজিট সেন্টারের তিনতলায় গোল্ডকোস্ট যাবার বাস। সরাসরি মুভিওয়ার্ল্ড যাওয়া যায় এখান থেকে। সম্প্রতি ব্রিসবেন এয়ারপোর্ট থেকে গোল্ডকোস্ট পর্যন্ত একটা নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। স্কাই ট্রেন। এই ট্রেনটি চলে মাটি থেকে অনেক উপর দিয়ে। না, উড়ে চলে না, একটা আলাদা ব্রিজের ওপর দিয়ে যায়। ব্রিসবেন এয়ারপোর্ট থেকে গোলকোস্ট পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার লম্বা একটা রেলব্রিজ তৈরি করে ফেলেছে এরা। তবে শুধুমাত্র এই ব্রিজটা দেখার জন্য এয়ারপোর্টে যেতে ইচ্ছে করলো না।
গোল্ডকোস্টের বাসে চেপে বসলাম। এখান থেকে মুভিওয়ার্ল্ড পর্যন্ত ভাড়া ১২ ডলার। এই পথ দিয়ে এসেছি কয়েকদিন আগে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাস এসে থামলো ড্রিমওয়ার্ল্ডের গেটে। গোল্ডকোস্টের তিনটি বিখ্যাত থিম-পার্কের একটি এই ড্রিমওয়ার্ল্ড- স্বপ্নজগৎ।
বাস থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রায় চল্লিশ মিটার উঁচু একটা স্তম্ভে তীব্রবেগে খাড়া উপরে উঠে যাচ্ছে একটি বড় অ্যালিভেটর। অনেক মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে সেখানে। স্তম্ভের মাথায় উঠে অ্যালিভেটর থামলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর ধাম করে নিচে পড়ে গেলো। পড়ে গেলো মানে তীব্রবেগে নিচে নেমে এলো। পতনের সময় অভিকর্ষজ ত্বরণের কারণে শরীরে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হবে। এরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী খেলায় অংশ নিতে মানুষ আসে এখানে।
বাসের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অ্যালিভেটরের মানুষগুলোর হা করা মুখ। চিৎকার করছে সবাই। এই চিৎকারে ভয়ের চেয়েও মজা বেশি নিশ্চয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাস এসে পৌঁছালো মুভিওয়ার্ল্ডের প্রবেশ পথে। হলিউডের ইউনিভার্সাল স্টুডিওর আদলে নির্মিত এই মুভিওয়ার্ল্ডকে বলা হয় হলিউড ইন অস্ট্রেলিয়া।
গোল্ডকোস্টের মূল সড়ক থেকে পশ্চিম দিকে অনেকটুকু ভেতরে এই বিশাল স্বর্গরাজ্য। সামনে পার্কিং এলাকায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার গাড়ি  একসাথে পার্ক করা যায়। বাস থেকে নামলেই সামনে পড়ে টিকেট কাউন্টার। মুভিওয়ার্ল্ডের মূল গেটের সমান্তরালে মোট চৌদ্দটি কাউন্টার এখানে।


প্রবেশ মুল্য ৫২ ডলার। ৬৫ বছরের বেশি ও ১৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য ৩৩ ডলার। আর কোন ধরনের কনসেশান নেই। একটি মাত্র টিকেটেই ভেতরের সব শো’র প্রবেশাধিকার পাওয়া যাবে। ভেতরে আর কোন কিছুর জন্যই টিকেট কাটতে হবে না। ভেতরে যত আকর্ষণ আছে সব কিছুর জন্য পয়সা দিয়ে ঢুকে ভেতরে গিয়ে তা যদি দেখতে ইচ্ছা না করে বা দেখার সময় না থাকে, তাহলেও কিছু করার নেই। এখানে আমার একার পক্ষে ৫২ ডলার হয়তো তবুও সহনীয়, কিন্তু যাদের ছেলেমেয়েসহ চার পাঁচজনের পরিবার, তাদের জন্য এ ধরনের একটা বাজেট করতে গায়ে লাগে। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের মানুষ এখানে তাই দেখা যায় না বললেই চলে। তাছাড়া এ ধরনের পার্কে যারা আসে, তারাও হয়তো কয়েক বছরে একবার আসে।
মুভিওয়ার্ল্ড এ বছর তার দশ বছরপূর্তি উৎসব করছে। তাই সাজগোজের আড়ম্বর একটু বেশি। গেট চেকিং পার হয়ে ঢুকলাম ভেতরে। টিকেটের সাথে গাইড ম্যাপ দেয়া আছে। ছোটবড় সব মিলিয়ে ৬০টি দর্শনীয় আইটেম। তাছাড়া আরো অনেক বিশেষ বিশেষ প্রদর্শনী। সুতরাং বেশ একটা তাড়াহুড়োর ভাব এসে গেলো মনে। যদিও সকাল মাত্র দশটা এখন।



ভেতরে কোথাও অস্ট্রেলিয়ার চিহ্ন পর্যন্ত নেই এখানে। সব ভবনে উড়ছে আমেরিকার পতাকা, রাস্তার নামগুলো পর্যন্ত আমেরিকার বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের নামে। দোকানগুলোর সাজসজ্জাও যেন সরাসরি আমেরিকা থেকে তুলে আনা হয়েছে।
ওয়ার্নার ব্রাদার্সের লোগো আঁকা মুভিওয়ার্ল্ডের সুদৃশ্য গেটটা পেরোঁলে সামনের গোলাকার চত্বরে সুদৃশ্য ঝর্ণা। ঝর্ণা থেকে একটু দূরে গাঁদা ফুলের হলুদ বাগান।


ডানদিকের রাস্তা ধরে কিছুদূর যাবার পর রাস্তায় একটি ১৯৩০ মডেলের হলুদ কার। তারপাশে রক্সি থিয়েটার। এখানে থ্রি-ডাইমেনশানাল সিনেমা দেখানো হচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন সুভেনির শপ। কার্টুন আঁকা নানারকমের খেলনা আর পোশাকের সমারোহ। একটু পরপর ফিল্ম আর ক্যামেরার দোকান। আর আছে বিচিত্র সব খাবারের দোকান।
এখানের খাবার আর পানীয়ের মূল্য সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করাই ভালো। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ৬৬০ মিলিলিটারের এক বোতল কোকের দাম বাইরে এক ডলার আশি সেন্ট। সেই একই পরিমাণ কোক একটি কার্টুন আঁকা মুভিওয়ার্ল্ড ছাপ মারা বোতলে নয় ডলার। অন্যান্য সবকিছুই এই অনুপাতে অনুমেয়। তাই বলে বিক্রি কিন্তু কম নয় এখানে। কারণ কোন ধরনের খাবার বা পানীয় নিয়ে ঢুকতে দেয়া হয় না এখানে। সুতরাং খাবার বা পানীয় এখান থেকে কিনতে অনেকটা বাধ্য করা হচ্ছে। তাছাড়া এ সমস্ত জায়গায় মানুষ প্রতিদিন আসে না। বছরে হঠাৎ এসে হঠাৎ খুব উদার হয়ে যায়। অনেক মা বাবা দেখা যাচ্ছে নিজেরা না খেলেও ছেলেমেয়েদের কিনে দিচ্ছেন।




রাস্তায় নানা রকমের কার্টুন চরিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিকিমাউস, লুনি টুনস প্রভৃতি সব বিখ্যাত কার্টুনের সাথে ছবি তোলার জন্য শিশুকিশোররা ঘিরে ধরছে। এই চরিত্রগুলোর পোশাকের নিচে যারা আছে তাদের চাকরিই হলো এটা। তারা দর্শকের কাঁধে বা হাতে হাত রেখে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে।
আর একটু সামনে গিয়ে দেখলাম শুধু কার্টুন নয়, সিনেমার মানুষ চরিত্রগুলোও ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছে এখানে। সিনেমার চরিত্রের মতো পোশাক, মেক আপ, গেট আপ নেয়া মানুষ। বিশেষ বিশেষ পোশাকের কারণে তাদের চেহারার খুব একটা প্রাধান্য পায় না এখানে, যেমন ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান।
পার্কের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির অংশ। এই অংশের নাম ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট। পুরো এলাকাটা যেন ওয়েস্টার্ন ছবি থেকে সরাসরি তুলে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে এখানে। একটা জায়গায় হারিকেন ঝুলছে। ঘোড়ার আস্তাবল দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় পুরনো ইট বসানো। কাঠের তৈরি ঘরবাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে গুলি ছুড়বে কোন কাউবয়।



এই অংশের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট অ্যাডভেঞ্চার রাইড। এই রাইডে অংশ নেয়ার জন্য ওয়েস্টার্ন সিনেমার নায়ক বা ভিলেনের মতো হিম্মত থাকা চাই। দেখতে ভাঙাচোরা একটি নৌকায় চড়ে রওনা হয়ে একটা পাহাড়ে ঢুকতে দেখা যায় বাইরে থেকে। তারপর কিছুক্ষণ পরে সেই নৌকাকে বেরিয়ে আছড়ে পড়তে দেখি পাহাড়ের চূড়ো থেকে সোজা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে নিচের পানিতে। আরোহীরা ভিজে যায়। গেটে ঢোকার সময় সবকিছুর জন্য পয়সা না নিয়ে নিলে এখানে এই অংশটার টিকেট খুব একটা বিক্রি হতো বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু যেহেতু পয়সা দিয়েই ঢুকেছি সবকিছু না দেখে গেলে ঠকে যাবো না? কেউ যদি ভিজতে না চায়, তিন ডলার নিয়ে একটা প্লাস্টিক কোট কিনে নিতে পারে এখানে।
একটা স্যাঁতস্যাঁতে দেখতে কয়লার গুদামের ভেতর দিয়ে ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট অ্যাডভেঞ্চারের প্রবেশ পথ। একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে পিঠে এক নলা এক জং ধরা বন্দুক ঝুলিয়ে। হলিউডের সিনেমা থেকে সে সোজা চলে এসেছে এই স্যাঁতস্যাঁতে কয়লার গুদাম পাহারা দেবার জন্য। এরা কি সকালে মেক আপ নেয়, নাকি চাকরির প্রয়োজনে স্থায়ীভাবেই এরকম হয়ে গেছে জানার উপায় নেই। অভিনেতা টাইপের এই মানুষগুলো মূর্তি না হলেও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করে বেশি।
ছোট ছোট নৌকাগুলোতে ছ'জনের বসার ব্যবস্থা। পানির গভীরতা দু’হাতের বেশি হবে না এখানে। পানির নিচে একটা পুরু বেল্ট যে পানির স্রোত নিয়ন্ত্রণ করছে তা বোঝা যাচ্ছে। নৌকায় উঠার মুখে হৃদপিন্ডের অবস্থা ও রক্তচাপ সম্পর্কে কিছু সতর্কবাণী দেয়া আছে। দুর্বল হৃদপিন্ড আর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে এখানে প্রবেশ নিষেধ।
নৌকায় কোন ইঞ্জিন বা দাঁড় নেই। বেল্টের টানেই ভেসে চলছে নৌকা। আস্তে আস্তে পাহাড়ের নিচে প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো নৌকা। বিচিত্র শব্দ চারদিকে। ভূত-প্রেতের যে সমস্ত সংস্করণ সিনেমা বা বইতে পাওয়া যায় এবং চট্টগ্রামের শিশুপার্কের ট্রেনে চড়ার সময়েও যেরকম কিছু গুহাভূত দেখা যায় সেরকম কিছু চরিত্র এখানেও ভয় দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো। কয়েকটা ড্রাকুলাও দেখা গেলো লম্বা লম্বা দাঁত ও নখ দেখিয়ে গেলো।
আমার সহযাত্রীদের চিৎকার ড্রাকুলার চিৎকারকেও হার মানাচ্ছে। আমার পাশে বসা কিশোরী চায়নিজ মেয়েটা যে কিনা নৌকায় উঠার সময় তার মায়ের ভয় পাওয়া দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলো- এখন আধো অন্ধকারে আমাকেই জাপটে ধরে আমার পিঠে মুখ গুঁজে আছে।
ভূত-প্রেত পেরিয়ে নৌকা হেলতে দুলতে এগোচ্ছে একটা ট্রেন স্টেশনের পাশ দিয়ে। স্টেশনের ওয়াগন ভ্যানে ডাকাতি হচ্ছে। গোলাগুলির প্রচন্ড শব্দ ধোঁয়া চারদিকে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে গুলি এসে লাগতে পারে। আমি বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বাস্তব গোলাগুলির মাঝখানে ছুটে পালিয়ে বেঁচেছি অনেকবার। সুতরাং এখানে ভয় পাবার কথা নয়। কিন্তু এদের নিখুঁত কারিগরি দক্ষতার প্রশংসা করতেই হয়।
হঠাৎ প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। পানির প্রবল টানে এগোচ্ছে নৌকা। একটা দরজা খুলে গেলো সশব্দে। কী হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই নৌকা সহ ছিটকে পড়েছি প্রায় বিশ ফুট নিচের পানিতে। জামা-কাপড় ভিজে একাকার।
ঝকঝকে রোদ আর আর্দ্রতাবিহীন বাতাসে বেশিক্ষণ লাগলো না জামাকাপড় শুকোতে। আস্তে আস্ত গিয়ে বসলাম পুলিশ অ্যাকাডেমির স্টান্ট শো দেখতে।
আমেরিকার অ্যাকশান সিনেমায় পুলিশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাফ এন্ড টাফ পুলিশ অফিসার হিসেবে ডার্টি হ্যারি একটা বিখ্যাত চরিত্র। বদরাগী এই পুলিশ অফিসারটির হাত থেকে কোন অপরাধীরই রেহাই নেই। এখানে ডার্টি হ্যারির নামে একটা মদের দোকানও আছে।
ছোটখাটো একটা স্টেডিয়ামের গ্যালারির সাইজের গ্যালারিতে দর্শকের বসার ব্যবস্থা। সামনে দেখা যাচ্ছে আমেরিকার পুলিশ একাডেমি বিল্ডিং। মনে হচ্ছে আমরা সত্যি সত্যি বসে আছি লস অ্যাঞ্জেলেসের কোন পুলিশ একাডেমির সামনে। ডান পাশে গাড়ির মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ। এল-এ-পি-ডি লেখা পুলিশের কয়েকটি গাড়ি আর মোটর সাইকেল সেখানে। বাম পাশে পুলিশের নতুন সদস্যদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশবাণী ইত্যাদি যা যা থাকে পুলিশ একাডেমিতে তার বাস্তব সম্মত স্থায়ী সেট।
আমেরিকান পুলিশের পোশাকে একজন মেয়ে দর্শকদের বসতে সাহায্য করছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম কৌতুকও করছে সে। যে দর্শক সামনের সারিতে বসতে চাচ্ছে তাকে সে পাঠিয়ে দিচ্ছে একদম পিছনের সারিতে। কোন কোন যুগলকে করে দিচ্ছে আলাদা। দর্শকরা হো হো করে হাসছে। বিশেষ করে যখন ট্যুরিস্টরা এই পুলিশের আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে শুরুতে, তখন হাসিতে ফেটে পড়ছে অন্য দর্শকরা। এখানকার দর্শক মনে হচ্ছে হাসি আর হাততালি দেয়ার ব্যাপারে ভীষণ উদার। এ দুটো ব্যাপারে তাদের কোন কার্পণ্য নেই।
এগারোটায় শো শুরু হবার কথা। দেখা গেলো তার আগেই আরেকজন মেয়ে পুলিশ একাডেমির প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে দর্শকদের গ্যালারিতে উঠে এলো। সেখানে দেখা গেলো অন্য একজন পুরুষ পুলিশ দাঁড়িয়ে। এই পুরুষ পুলিশের মেক আপ, বাচনভঙ্গি সবকিছু ডার্টি হ্যারি চরিত্রের স্রষ্টা ক্লিন্ট ইস্টউডের সরাসরি অনুকরণ।



এই নকল হ্যারি দর্শকদের মাঝ থেকে পাঁচজন নতুন পুলিশ নিয়োগ করলো আজকের এই শো’র জন্য। দু’জন ছেলে আর দু’জন মেয়ে সদস্য নেয়া হলো গ্যালারির চার কোণা থেকে। গ্যালারির একদম সামনের সারিতে নিয়ে তাদের বসানো হলো। পঞ্চম জন হিসেবে যাকে নির্বাচন করা হলো সে ছেলেটা কিছুতেই রাজি হয় না পুলিশ হতে। কিন্তু হ্যারি তাকে রাজি করাবেই। ছেলেটার পোশাক আর হাবভাব দেখে মনে হয় খুব হাবাগোবা ধরনের। বাংলাদেশের পুরোনো সিনেমাতে হাসমতকে দেখতে যেরকম লাগতো এই ছেলেটাকেও অনেকটাও সেরকম লাগছে। কিন্তু তার বুদ্ধি আর তাৎক্ষণিক প্রত্যুত্তর দেখে কেমন যেন খটকা লাগে। মনে হয় এগুলোও নিশ্চয় শো-এর স্ক্রিপ্টের অংশ আর ছেলেটা তাদেরই লোক। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা বাধ্য হলো বাকি চারজনের শামিল হতে। পুলিশের টুপি আর সাদা দস্তানা পরিয়ে তাদের মূল মঞ্চে অর্থাৎ বিশাল একাডেমির সামনের খালি জায়গায় বিচ্ছিন্ন স্থানে বসিয়ে দেয়া হলো।
ঠিক এগারোটায় মূল শো শুরু হলো। অ্যাকশান আর কৌতুক হলো শো’র মূল আকর্ষণ। সিনেমাতে যেসব লোমহর্ষক দৃশ্য দেখা যায় তা চোখের সামনে ঘটিয়ে দেখানো হলো। গোলাগুলি, বোমাবাজি, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট, হেলিকপ্টার ধ্বংস সব। ছোট্ট একটা জায়গায় প্রচন্ড বেগে গাড়ি চালানো, মোটরসাইকেল বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া, কামানের গোলা মেরে মানুষসহ একটা পুলিশবক্স উড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।







একাডেমির ছাদে বিধ্বস্ত হয় একটা হেলিকপ্টার। আগুন আর ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রিত অথচ ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক এবং অনেক সময় অনেক ঘটনা একসাথে। চোখের সামনে পুরো ১৮০ ডিগ্রি কোণে অনেকগুলো অ্যাকশান একসাথে চলার ফলে সবগুলোকে সমান মনোযোগ দেয়াও যায় না। এটাও বাস্তব দিকের একটা প্রতিফলন। বাস্তব জগতে আমাদের চোখের সামনে ঘটা ঘটনারও সবটুকু অংশ আমরা সমান মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারি না।
দর্শকদের মধ্য থেকে নেয়া হাবাগোবা ছেলেটি পুরো শো’তে যে ভূমিকা রাখলো তাতে আর সন্দেহ থাকে না যে এই লোক তাদেরই একজন। যে সমস্ত অ্যাকশান দেখানো হয়েছে সবগুলোই বিপজ্জনক। একটু এদিকে ওদিকে হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। সে কারণেই হয়তো মুভিওয়ার্ল্ডে রয়েছে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা। শক্তিশালী মেডিকেল টিম। দুটো হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স সবসময় রেডি।
পঁচিশ মিনিটের পুলিশ অ্যাকশান শেষে ১১টা ৩৫ মিনিটে মূল রাস্তায় স্টার প্যারেড। মুভিওয়ার্ল্ডে যত স্টার আছে সবাইকে নিয়ে প্যারেড। কার্টুন চরিত্রগুলোর পেছনে ব্যাটম্যানের কালো রঙের বিশেষ গাড়িতে ব্যাটম্যান ও তার সঙ্গিনী। তাদের পেছনে সুপারম্যান, সুপার ওম্যান, ১৯৬০ মডেলের একটি মার্সিডিজ ও মেরিলিন মনরোর সাজে একটি মেয়ে এবং আরো অনেকে। মোটর সাইকেলে পুলিশ সদস্যদেরও দেখা গেলো এই প্যারেডে।





প্যারেড শেষে স্টারদের সাথে লাঞ্চের ব্যবস্থা। লাঞ্চের খরচ অবশ্য যারটা তার। মুভি ওয়ার্ল্ডের নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে স্টাররা ঘুরে ঘুরে এসে বসবে লাঞ্চ টেবিলে। ছবিতে হাসিমুখে পোজ দেবে। অভিনেতা অভিনেত্রীদের সাথে নিজের থাকাটা অনেকের কাছেই চাট্টিখানি কথা নয়। মেরিলিন মনরোর মতো করে সাজগোছ করে নিজেকে মেরিলিন মনরো ভাবছে যে মেয়েটি তার সাথে ছবি তোলার জন্য মানুষের ব্যস্ততা দেখলে আশ্চর্য লাগে। এখানে আসলে উদার হবার সাথে সাথে মানুষ কি একটু পাগলও হয়ে যায়? অবশ্য পর্দার মানুষের প্রতি মানুষের একটা উন্মাদনা কাজ করে সব দেশেই।
এবার চললাম ম্যাভারিক শো দেখতে। ম্যাজিক অব দি ওয়েস্ট। ওয়েস্টার্ন ম্যাজিক। বিশাল হলে এই লাইভ ম্যাজিক শো। হলের ভেতরটাও রাফ এন্ড টাফ স্টাইলে তৈরি। বিরাট মঞ্চে ওয়েস্টার্ন স্টাইলের ঘরবাড়ি, একপাশে বিশাল নোঙর সহ একটি খেয়াঘাট দেখা যাচ্ছে। একটি গোডাউনের বিশাল গেট। তার পাশে বিরাট এক কাঠের পিঁপে। এগুলো সাধারণত মদের পিপে হিসেবে ব্যবহৃত হতো আগের দিনে।
শো শুরুর আগপর্যন্ত দর্শকদের জন্য বোনাস বিনোদন ক্লাউন শো। এই ক্লাউনটা ভালো মুকাভিনয় করে। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে দর্শকদের হাসালো কিছুক্ষণ। নাক উঁচু কিছু দর্শক বিরক্তও হলেন ক্লাউনের ভাঁড়ামিতে।

এই শো’কে বলা চলে ২৫ মিনিটের একটা হলিউডি মারদাঙ্গা মার্কা ওয়েস্টার্ন সিনেমার মঞ্চ রূপায়ন। কারিগরি দক্ষতা এতটাই নিপুণ যে চোখের সামনে ঘটলেও ঘটনাগুলো কিভাবে ঘটছে ঠিক বোঝা যায় না। ম্যাজিকে যা ঘটে আর কি।
মদের পিঁপেতে গুলি লেগে পিঁপে থেকে পানি হোক আর মদই হোক তীব্রবেগে বেরিয়ে এসে মঞ্চের উপর একটা গর্তে পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। মঞ্চের মাটি ভেদ করে উঠে আসছে রেড ইন্ডিয়ান। আবার ছোট্ট একটা টিনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্যও হয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে প্রতি পদে পদে। কিন্তু শো-এর কোথাও তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। ব্যাখার জন্য আলাদা শো’র ব্যবস্থা আছে অন্য জায়গায়।
এখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটলাম কিছুক্ষণ। দু’পাশেই রঙ বেরঙের জমকালো সব দোকানপাট। দু’হাতে নিজের পকেট আগলে ঢুঁ মারলাম কয়েকটাতে। পকেটমার নেই এখানে। কিন্তু বাহারী সামগ্রীগুলোর আবেদন উপেক্ষা করার মতো বুকের পাটা পকেটে পয়সা থাকলে থাকে না।
মুভিওয়ার্ল্ডের অভ্যন্তরীণ হিসাব দপ্তরের নাম এখানে আমেরিকান চেম্বার হাউজ। হঠাৎ মনে হয় যেন নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের কোন বিল্ডিং।
দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে মুভি ম্যাজিক স্পেশাল ইফেক্ট। শো দেখতে গেলাম। পাশাপাশি তিনটি ইনডোর স্টুডিওতে দেখানো হচ্ছে সিনেমায় বিভিন্ন কারিগরী কৌশল কীভাবে ব্যবহার করা হয়। দর্শকদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে বাছাই করা হলো বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। একজন সুপারম্যান, একজন নায়িকা, একজন ছোট বিমান পাইলট এবং তিনজন শব্দ গ্রাহক বাছাই করা হলো। যিনি দর্শকদের মধ্য থেকে এদের নির্বাচন করলেন তিনি নিজেকে বললেন পরিচালক। ব্যাখ্যা করলেন সিনেমায় কীভাবে লোক নির্বাচন করা হয়, নেপথ্য শিল্পীদের কার কী ভূমিকা।

প্রথম স্টুডিওতে দেখানো হলো বিশেষ দৃশ্যগুলো কীভাবে চিত্রায়িত হয়। সিনেমাতে ব্লু স্ক্রিন ইফেক্টের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। পর্দায় এ সম্পর্কে ছোট্ট একটা ভূমিকা দিলেন র্যা ম্বো নায়ক সিলভারস্টন স্ট্যালোন। তিনি দেখালেন স্টুডিওতে মোটর সাইকেলের উপর বসে থেকেই পেছনে পাহাড় পর্বত ট্রেনে ইত্যাদির প্রতিফলনের মাধ্যমে দেখানো হয়- মোটরসাইকেল উঠে যাচ্ছে পাহাড়ে, লাফ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে ছোট নদী বা ছুটছে ট্রেনের ছাদের ওপর দিয়ে।
সিনেমার পর্দায় মাঝে মাঝে দেখা যায় উঁচু বিল্ডিং-এর ছাদের কার্নিশ ধরে হাঁটছে নায়িকা, হয়তো তাকে কেউ তাড়া করেছে বা মনের দুঃখে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে সে। যে কোন মুহূর্তে নিচে পড়ে যেতে পারে সে। রাস্তায় অনেক মানুষ জমে গেছে। রুদ্ধশ্বাসে দেখছে এই দৃশ্য।
এরকম একটা দৃশ্য আমাদের সামনে গ্রহণ করা হলো স্টুডিওর ভেতরেই। দর্শকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত নায়িকাকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। ছোট মঞ্চটির পেছনের দুদিকে দেয়াল। বাম পাশের দেয়ালে একটি সিঁড়ি লাগানো। মঞ্চের উপরে বড় একটা পর্দায় ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে।
ক্যামেরা চালু করতেই পর্দায় দেখা গেলো আমাদের নায়িকা আটতলা একটি বিল্ডিং-এর ছাদের কার্নিশে লোহার সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে হাজারো মানুষ, পুলিশ দমকলের গাড়ি ইত্যাদি। পরিচালক নায়িকাকে নির্দেশ দিলেন লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। নায়িকা কয়েক ধাপ উঠার পরেই সিঁড়িটির উপরের দিকটা দেয়াল থেকে আলগা হয়ে গেলো একটুখানি। এই ব্যাপারটাই পর্দায় দেখা গেলো সিঁড়িটির একমাথা ধরে শূন্যে ঝুলে আছে আমাদের নায়িকা। সিনেমার দৃশ্যের সাথে এখানকার দৃশ্যের পার্থক্য হলো আমাদের নায়িকাটির চোখে মুখে ভয় আর উৎকন্ঠার পরিবর্তে এক গাল হাসি।
এবার সুপারম্যান পর্ব। সদ্য নির্বাচিত সুপারম্যানকে পর্দার সুপারম্যানের লাল হলুদ পোশাকটা পরিয়ে দেয়া হয়েছে। মঞ্চের মাঝখানে একটা দাগ দেয়া স্থানে তাকে দাঁড় করানো হলো। একদিকের একটা স্ট্যান্ড ফ্যানের বাতাসে সুপারম্যানের পোশাক উড়ছে পত পত করে। পর্দায় দেখা গেলো আমাদের সুপারম্যান ব্রিসবেন শহরের উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে। পরিচালকের নির্দেশে হাত দুটো সাঁতারের ভঙ্গিতে নাড়াতেই দেখা গেলো সুপারম্যান উড়ে আসছে মুভিওয়ার্ল্ডের দিকে।
এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিওতে। সিনেমাতে কুশীলবরা শুটিং-এর সময় সংলাপ বলেন ঠিকই। কিন্তু সেই শব্দ রেকর্ড করা হয় না সেসময়। পরে এক সময় স্টুডিওতে বসে শব্দ গ্রহণ করা হয়।
সংলাপ ছাড়াও ছবিতে হাজার হাজার অন্যান্য শব্দ থাকে-যা শুটিং-এর পরে স্টুডিওতে বসে যোগ করা হয়। আজ দেখানো হলো মেল গিবসনের বিখ্যাত অ্যাকশান সিনেমা লিথ্যাল ওয়েপনের একটা দৃশ্য। শুরুতে মেল গিবসন মুভিওয়ার্ল্ডের পক্ষ থেকে আমাদের স্বাগতম জানালেন। শব্দগ্রহণ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বললেন তিনি। তারপরে ছবির দু’মিনিটের একটা দৃশ্য দেখানো হলো।
দু’মিনিটের এই দৃশ্যে সংলাপ ছাড়াও দরজা নক করা, দরজা খোলা, খাবারের ট্রে উল্টানো, জানালার কাচভাঙ্গা এবং অনেক উপর থেকে দু’জন মানুষের সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দসহ মোট চব্বিশ রকমের শব্দ ধারণ করা হয়েছে।
দর্শকদের মধ্য থেকে নির্বাচিত শব্দগ্রাহক তিনজনকে এবার দায়িত্ব দেয়া হলো দু'মিনিটের এই অংশটার শব্দগুলো আবার ধারণ করতে। প্রত্যেককে আটটি করে শব্দের সিকোয়েন্স দেখিয়ে দেয়া হলো। পর্দায় দু’মিনিটের দৃশ্যটি আবার দেখানো হলো। এবার শব্দহীন। শব্দগ্রাহকদের টেবিলের সামনে রক্ষিত টিভি পর্দায় সিকোয়েন্সগুলি দেখা গেলো, এক, দুই, তিন করে ২৪ পর্যন্ত। নম্বার অনুযায়ী শব্দ তৈরি করতে হবে।
শব্দ তৈরির উপাদানগুলো অতি সাধারণ। একটা দুই ফুট বাই দুই ফুট কাঠের উপর লাগানো আছে দরজার লক, দরজার হুক। এই কাঠে টোকা দিয়ে তৈরি করতে হবে দরজার লকিং, হুক ঘুরিয়ে এবং লকে চাবি ঢুকিয়ে শব্দ তৈরি করতে হবে। একটা ছোট কাঠ লাগানো আছে টেবিলের সাথে কব্জা দিকে। এদিক ওদিক নাড়ালে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হয়। যেন দরজা খোলার শব্দ। একটি টিনের বাক্সের ভেতর রাখা আছে ভাঙা কাচের টুকরো। বাক্সের ঝাঁকুনি দিলে অবিকল কাচ ভাঙার শব্দ। বড় একটি পাত্রে কিছু পানি। তাতে প্লাস্টিকের একটা বড় খাঁচা ফেললেই তৈরি হবে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার শব্দ।
নবীন শব্দগ্রাহকরা তৈরি। পর্দায় শব্দহীন ছবিটি চালানোর সাথে সাথে সিকোয়েন্স অনুযায়ী শব্দ তৈরি করতে লাগলো তারা এবং তাদের তৈরি শব্দগুলো সাথে সাথে রেকর্ড করা হচ্ছে রেকর্ডারে। শব্দগ্রহণ শেষ হলো।
এবার সবচেয়ে মজার অংশ। নতুন শব্দ সম্বলিত দৃশ্যটা দেখানো হলো। দেখা গেলো দরজা খোলার পরে দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। নায়ক জানালার দিকে এগিয়ে যাবার আগেই জানালা ভাঙার শব্দ। আর পানিতে ঝপাস শব্দ হলো যখন ততোক্ষণে সুইমিং পুলের পানি শান্ত হয়ে গেছে, নায়ক হাঁপাচ্ছে।
হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলাম পরবর্তী স্টুডিও’র দিকে।

_________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ছবিগুলো আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। 

Friday, 21 December 2018

সূর্যনগর ব্রিসবেন - ৬ষ্ঠ পর্ব



সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে গেলাম। আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ট্যুরবাস ছাড়বে। অস্ট্রেলিয়ান ডে ট্যুর এর ‘সানশাইন ওয়াইল্ড লাইফ ট্যুর’এ যাচ্ছি। বিগ পাইনঅ্যাপেল, অস্ট্রেলিয়ান জু আর আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড ঘুরিয়ে দেখাবে। সব মিলিয়ে ৮৮ ডলার।
অস্ট্রেলিয়ান দর্শনীয় স্থানগুলো এত দূরে দূরে যে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাওয়া অনেক সময় সবার পক্ষে সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে ট্যুর কোম্পানিগুলোর সার্ভিস খুব উন্নতমানের।
সাড়ে আটটায় বোর্ডিং পাস নিলাম। একটি হলুদ রঙের স্টিকার লাগিয়ে দিলো বুকের ওপর। ট্যুর কোম্পানির চিহ্ন এটা। চিহ্ন দেখেই গাইড চিনে নিতে পারবে আমরা কে কোন গ্রুপের। বাসের অর্ধেক ভর্তি হয়ে এসেছে গোল্ডকোস্ট থেকে।
সানশাইন কোস্ট ব্রিসবেন থেকে প্রায় একশ' কিলোমিটার উত্তরে। বাসের ড্রাইভার ছাড়া বাকি সবাই ট্যুরিস্ট। বেশির ভাগই চায়নিজ। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইডের নাম স্টিফেন। অদ্ভুত সুন্দর তার বাচনভঙ্গি। চমৎকার তার শব্দচয়ন। আর প্রচুর জ্ঞান রাখে অনেক কিছু সম্পর্কে। পড়াশুনা যে তার ব্যাপক তা বোঝা যায় তার কথায়। মাইক্রোফোনে বিভিন্ন বিষয়ে ও বিভিন্ন স্থান বিস্তারিত বর্ণনা দিতে দিতে গাড়ি চালাচ্ছে সে।
ঠিক আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে যাত্রা করেছি আমরা। উইলিয়াম জলি ব্রিজ পার হবার সময় xxxx চিহ্নিত কারখানার পরিচয় দিলো স্টিফেন। ওটা ব্রিসবেনের বিয়ার ফ্যাক্টরি। মেলবোর্নের বিয়ারের নাম ভিক্টোরিয়া বিটার। আর এখানের স্থানীয় বিয়ারের নাম ফোর ক্রস বা xxxx। কেন এই নাম? বড় মজার সেই ইতিহাস। ১৮৫০ সালের দিকে যে সব কয়েদিদের নিয়ে এই ব্রিসবেন তৈরি হচ্ছিলো তারা ছিলো অশিক্ষিত। তাদের যখনই বিয়ার লাগতো ক্যাপ্টেনের কাছে স্লিপ পাঠাতো চারটা ক্রস চিহ্ন দিয়ে। সেই থেকে আস্তে আস্তে এখানকার বিয়ারের নামই হয়ে গেছে xxxx।
শহর ছাড়িয়ে চলেছি আমরা এখন। রাস্তা উঁচুনিচু। দু’পাশে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। স্টিফেন সব কিছুরই বিবরণ দিচ্ছে। তার কাছ থেকে জানা গেলো অনেক নতুন তথ্য।
কুইন্সল্যান্ড কাঠের জন্য বিখ্যাত। অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ কাঠই সাপ্লাই দেয় এই কুইন্সল্যান্ড। এখানকার ঘরবাড়িগুলোর বেশির ভাগই কাঠের তৈরি। আর পাহাড়ি অঞ্চল বলে বিভিন্ন টিলার উপর বাড়িগুলো তৈরি। বেশির ভাগ বাড়ির বেসমেন্টকে গাড়ির গ্যারেজ আর স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয় এখানে।
যেতে যেতে দেখছি কুইন্সল্যান্ডের সাবার্বগুলো। বাড়ির উঠানে দেখা গেলো উট চরছে। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না আমার। সত্যি সত্যি উট, বাচ্চাসহ চরছে। একমাত্র অস্ট্রেলিয়ায়ই এখনো বুনো উট চরে বেড়ায় জঙ্গলে। অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়মিত উট রপ্তানি করা হয় মধ্যপ্রাচ্যে। অস্ট্রেলিয়ার একটি বিরাট অংশ মরুভূমি। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মরুভূমি অস্ট্রেলিয়ায়।
ইউক্যালিপ্টাস গাছ অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সবখানেই আছে। কুইন্সল্যান্ড যেন ইউক্যালিপ্টাসের জঙ্গলে ভর্তি। ইউক্যালিপ্টাসকে এখানে ডাক নামে ডাকা হয়- গামট্রি। স্টিফেন এই গামট্রি সম্পর্কে অনেক মজার মজার তথ্য দিলো।
অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় নয়শ' প্রজাতির গামট্রি আছে। গামের পাতা বিষাক্ত এটা জানতাম। কিন্তু ইউক্যালিপ্টাসের তেল যে সর্দি কাশির মহৌষধ তা জানা ছিলো না। এ ওষুধ খাবার নয়, গন্ধ নেবার।
পথের পাশে বিরাট বিরাট ইউক্যালিপ্টাসের বাগান বা জঙ্গল। এক একটা বিরাট বিরাট এলাকা জুড়ে দেখা যাচ্ছে পুড়ে গেছে বন। জঙ্গলে আগুন লাগাটা অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার একটা বিরাট সমস্যা। দিনের পর দিন বন জ্বলতে থাকে। স্টিফেন বললো, প্রকৃতির এই ব্যাপারটারও প্রয়োজন আছে। স্টিফেনের কথা যতই শুনছি ততই অবাক হচ্ছি।
আগুন লাগলে থামে না কেন বা সহজে নেভানো যায় না কেন এখানে? কারণ ইউক্যালিপ্টাস গাছ থেকে তাপের সাথে সাথে যে রস বের হয় তা দাহ্য। বনে আগুন লাগার মাধ্যমেও ইউক্যালিপ্টাসের বংশবৃদ্ধি হয়। আগুনের সাথে সাথে ইউক্যালিপ্টাসের বীজ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আর আগুনে ইউক্যালিপ্টাসের বাইরের আবরণ সম্পূর্ণ পুড়ে গেলেও ভেতর থেকে আবার নতুন প্রাণ জন্মে। জন্মে নতুন গাছ।
"প্রকৃতির সব রহস্য যদি মানুষের জানা হয়ে যায় মানুষ তখন কী করবে?" নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলো স্টিফেন, "মানুষ প্রকৃতির রহস্য সবটুকু কখনোই জানতে পারবে না। মানুষ আসলে দিনের পর দিন তাদের অজ্ঞানতাকেই আবিষ্কার করবে।"
মনে পড়লো রিচার্ড ফাইনম্যানের কথা। তাঁর একটি লেখায় পড়েছিলাম, "ম্যান লার্ন সামথিং টু বিকাম ইগনোরেন্ট এগেইন।" মানুষ চিরদিনই অজানার পেছনে ছোটে।
আমি ভাবছি স্টিফেনের কথা। এত পড়াশোনা, এমন চমৎকার বাচনভঙ্গি, আর এমন সুদর্শন ছেলেটা বাস চালাচ্ছে কেন? তাকে এর চেয়ে বেশি ভালো মানাতো টিভিতে অনুষ্ঠান করলে।


রাস্তার বাঁ পাশে দেখা যাচ্ছে ছোটবড় কয়েকটি পাহাড়। এগুলোর নাম গ্লাস হাউজ মাউন্টেনস। তেরটি মৃত আগ্নেয়গিরি এখানে পাশাপাশি। দুই কোটি বছর আগে এই আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিলো। ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুক এই পাহাড়গুলোর নাম দিয়েছিলেন গ্লাস হাউজ মাউন্টেন। কেন? কারণ এগুলো দেখে কুক সাহেবের হঠাৎ মনে পড়েছিলো নিজের শহর ইয়র্কশায়ারের গ্লাস হাউজের কথা। মনে হচ্ছে তখন যদি তাঁর নিজের পোষা বেড়ালের কথা মনে পড়তো তাহলে হয়তো এই পাহাড়ের নাম হতো পেট ক্যাট মাউন্টেনস।






সোয়া দশটার দিকে পৌঁছে গেলাম বিগ পাইনঅ্যাপেলে। জায়গাটার আসল নাম উমবাই। কিন্তু বিগ পাইনঅ্যাপল নামেই চেনে সবাই। রাস্তা থেকে চোখে পড়ে বিশাল এক কৃত্রিম আনারস। গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত যার উচ্চতা প্রায় পঞ্চাশ ফুট। বিগ পাইনঅ্যাপল মূলত একটি আনারস বাগান। বিশাল আয়তনের বাগান। আনারস উৎপাদন আর আনারসের রসজাত অন্যান্য খাদ্য প্রস্তুতির পাশাপাশি এখন এটা একটি বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট।





গাড়ি থেকে নামতেই ছোট ছোট গ্লাসে আনারসের রস দিয়ে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলো কয়েকজন তরুণী। বিগ পাইনঅ্যাপল আঁকা টি-শার্টে তাদের দারুণ মানিয়েছে। ফার্মের একটি সীমা পর্যন্ত যেতে কোন প্রবেশ মূল্য লাগে না। কিন্তু ভেতরটা ঘুরে বেড়ানোর জন্য মিনি ট্রেনে উঠতে গেলে টিকেট কাটতে হয়। ট্রেন ছাড়াও আরো এক ধরনের গাড়ি আছে ভেতরে। তাও ট্রেনের মতো অনেকগুলো বগি যুক্ত গাড়ি। তবে চাকাগুলো সাধারণ গাড়ির চাকার মত। ঐ গাড়িতে চড়তেও টিকেট কাটতে হয় আলাদা। ফার্মের ভেতর পায়ে হেঁটে বেড়ানোর কোন সুযোগ নেই।
বিশাল আনারসটি ফার্মের বাইরে। শক্ত প্লাস্টিকের তৈরি। ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে আনারসের মধ্যভাগে উঠে পুরো আনারস বাগান আর আশেপাশের এলাকা দেখা যায়। আনারসের পেটের ভেতর বিভিন্ন ফল এবং ফলজাত খাবারের রেসিপি, উপকারিতা, খাদ্যমুল্য ইত্যাদি নানারকম ছবি আর তথ্যের সমারোহ।
গেট দিয়ে ঢুকতেই বিশাল রেস্তোরা আর স্যুভেনির শপ। এখানে বড় বড় পাকা আনারস বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি মাত্র এক ডলারে। কেউ কেউ কিনলেন এই তাজা পাকা আনারস। মজার ব্যাপার হলো আনারস কাটার যন্ত্রের দাম পনের ডলার।
ছোট্ট ট্রেনটি এঁকেবেঁকে চলে। মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে একটুও বেশি নয় এর গতি। আনারস উৎপাদনের প্রত্যেকটি ধাপ দেখানো হচ্ছে। আসলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আনারসের বৃদ্ধি ঘটিয়ে বীজতলা তৈরি থেকে আনারস উৎপাদন, বাগান থেকে আনারস তুলে তার কী কী প্রসেসিং করা হয় সব দেখানো হচ্ছে।
এখানে বিভিন্ন রকমের বোতলজাত খাবার তৈরি করা হচ্ছে। ফার্মের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য কিছু পশুপাখিও রাখা হয়েছে কয়েক জায়গায়। কয়েকটা ঘোড়া, উটপাখি আর হরিণ দেখা যাচ্ছে। ফার্মের পাশে একটা বড় পুকুর ছিলো কোন এক সময়। এখন দেখলাম সেখানে কোন পানি নেই। মাটি শুকিয়ে ফেটে ফেটে যাচ্ছে।
ফার্মটা সুন্দর। তবে আহলাদে নেচে ওঠার মতো কিছু নয়। শুধুমাত্র প্রচারের কল্যাণেই এই বিগ পাইনঅ্যাপলের এত নামডাক।
পৌনে বারোটায় পাইনঅ্যাপল ফার্ম থেকে বেরিয়ে দেখলাম আমাদের বাস বদল হয়েছে। স্টিফেন বড় বাসটি নিয়ে চলে গেছে। আমাদের সাথে তার আবার দেখা হবে বিকেল চারটায় আমাদের শেষ স্পটে। এখন এসেছে স্টোরি লাইনের একটা মিনিবাস। এই মিনিবাস আমাদের নিয়ে যাবে অস্ট্রেলিয়ান জু দেখাতে।
আমাদের এখনকার গাইডের নাম রয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইনি ভারতীয়। রায় পদবী এখানে রয় হয়ে গেছে। উচ্চারণে তিনি বিশুদ্ধ অস্ট্রেলিয়ান। ঠিক বারোটায় আমাদের নিয়ে মিনিবাস রওনা হলো। রয় বর্ণনা দিচ্ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের। অস্ট্রেলিয়ান জু-এর একটা ম্যাপ হাতে ধরিয়ে দিলেন এবং এই চিড়িয়াখানা সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা দিলেন।
অস্ট্রেলিয়ান জু হলো সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানাধীন। ইরউইন পরিবার এই চিড়িয়াখানার মালিক। আগে এটার নাম ছিলো অস্ট্রেলিয়ান রেপটাইল পার্ক। তখন শুধু সাপ আর কুমির ছিলো এখানে। এখন আস্তে আস্তে অন্যান্য কিছু প্রাণী যোগ করে একটা পূর্ণাঙ্গ চিড়িয়াখানাতে পরিণত করা হয়েছে এটাকে। কিন্তু এখনো এখানে কুমিরেরই প্রাধান্য।
স্টিভ ইরউইন এই চিড়িয়াখানার প্রধান নির্বাহী। তার বাবাই এই চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠাতা। এখন স্টিভ আর তার বোন এবং তাদের পরিবার মিলে চালায় এই বিশাল প্রতিষ্ঠান। স্টিভের বোন পেপার ওয়ার্ক দেখে আর স্টিভ দেখে ফিল্ড ওয়ার্ক অর্থাৎ জন্তু জানোয়ার। ডিসকভারি চ্যানেলে স্টিভ এখন ক্রোকোডাইল হান্টার নামে পৃথিবীর অনেক দেশেই পরিচিত নাম। দুপুর দেড়টায় ক্রোকোডাইল শো হলো এই চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ।
বনের ভেতর বিশাল এলাকা জুড়ে চল্লিশটি আলাদা আলাদা স্পটে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার রাখা আছে। প্রবেশ মূল্য পনের ডলার। আমাদের সবকিছু ট্যুর কোম্পানির সেই ৮৮ ডলারের মধ্যে।
প্রচুর দর্শক। আসলেই বিশাল এই ক্রোকোডাইল পার্ক। রিসেপশানের কাছাকাছি অজগরের আস্তানা। বিশ ফুট লম্বা বিশাল এক অজগর একটা সুপারি গাছ ঘিরে শুয়ে আছে। ছোটবেলায় এই অজগর সাপের ভয়ানক শক্তির কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে আমাদের স্কুলের এক শিক্ষক বলতেন অজগর সাপ নাকি একটা হাতির চার পা একসাথে বেড় দিয়ে চাপ দিলে হাতির সব হাড় ছাতু হয়ে যাবে। ব্যাপারটা যে বাড়াবাড়ি রকমের বাড়িয়ে বলা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আসলেই অজগর সাপ শিকার ধরে তাকে চাপ দিয়ে পিষে মেরে ফেলে। কারণ অজগর ছোবল দেয় না, বিষও নেই তার।
রয় জানালেন এই সাপ এসেছে ভারতের আসাম থেকে। এই তথ্য তিনি কীভাবে পেয়েছেন আমি জানি না। চিড়িয়াখানার দেয়া তথ্যের কোথাও এই অজগরের আদিবাসস্থান সম্পর্কে কিছু বলা নেই।

চিড়িয়াখানার একজন কর্মী একটা মাঝারি সাইজের অজগর গলায় পেঁচিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছে। লোকটার সাহস আছে সন্দেহ নেই। অজগরের বিষ নেই সত্য, কিন্তু সাপ বলতেই তো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার।
সাপের জন্য বিশেষ একটা ঘর আছে এখানে। কাচের বড় বড় খোপে রাখা আছে নানারকম জাতের সাপ। একটা কাচের বাক্সে নিরীহ টাইপের কালো চিকন একটা সাপ। দেখলে মোটেও ভয় লাগে না। একটা গালভরা নামও আছে এই সাপের। সাপটা নাকি পৃথিবীতে এ পর্যন্ত জানা সাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিষাক্ত। এই সাপের মধ্যে এক আউন্স বিষ নাকি একটা হাতিকে মেরে ফেলতে পারে কয়েক সেকেন্ডে। এ তথ্য জানার পরে সাপঘরে আর এক সেকেন্ডও থাকতে ইচ্ছে করলো না।






পার্কের অন্যদিকে প্রচুর কুমির। প্রধানত দু’ধরনের কুমির আছে। মিষ্টি পানির কুমির আর লোনা পানির কুমির। মিষ্টি পানির কুমির একটু ফর্সা টাইপের হয়, আর লোনা পানির কুমির হয় কুচকুচে কালো। সাইজেও লোনা পানির কুমির অনেক বড়। নানারকম কুমিরের জন্য বেশ বড় বড় কৃত্রিম জলাভূমি তৈরি করে তাদের আরামে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটা তারজালির বেড়া না থাকলে এই জায়গাটা যে মানুষের জন্য কত বিপজ্জনক হতো তা ভাবলেই কেমন লাগে।


একটা খোলা জায়গায় কিছু বিরাট বিরাট কচ্ছপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের একটার নাম হ্যারিয়েট। হ্যারিয়েট নাকি পৃথিবীর জীবিত কচ্ছপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বুড়ো। প্রাণিদের গাম্ভীর্য নিয়ে হ্যারিয়েট ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা ড্যামকেয়ার ভাব করে। হ্যারিয়েট কি জানে যে তাকে সব জীবিত কচ্ছপের মুরুব্বি বলা হচ্ছে? হ্যারিয়েট কি পুরুষ নাকি মহিলা? হ্যারিয়েটের কেয়ারটেকার মেয়েটাকে জ্ঞিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর পাইনি।

কুমিরের প্রাচুর্য ছাড়া বাকি সবগুলো প্রাণী অন্যান্য সাধারণ চিড়িয়াখানায় যেমন থাকে। ক্যাঙারু, কোয়ালা, ডিঙ্গু, উট, নানারকমের পাখি ইত্যাদি।
বেলা একটা বাজার আগে থেকেই ২৮নং এলাকার গ্যালারি ভরে যেতে লাগলো। ২৮নং এলাকা হলো অ্যাগ্রোর এলাকা। অ্যাগ্রো এখানকার দ্বিতীয় বৃহত্তম কুমির। অ্যাগ্রোর ওজন এক টনের বেশি। দৈর্ঘ্য পনের ফিট।
পার্কের সবচেয়ে বড় কুমিরের নাম অ্যাকো। দৈর্ঘ্য ১৬ফুট আর ওজন তার অ্যাগ্রোর চেয়ে কিছু বেশি। অ্যাগ্রোকে আপাতত দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কেবল ছোটখাট দুটো অতিথি কুমির দেখা যাচ্ছে ২৮নং এলাকার বিশ্রি পুকুরটার পাড়ে অলসভাবে রোদ পোহাচ্ছে।



পুরো এলাকাটি পরপর দুটো শক্ত লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা। বেড়ার বাইরে তিনদিকে দর্শকদের বসার জন্য গ্যালারি। দেড়টায় রেলিং টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো খাকি হাফ শার্ট ও হাফ প্যান্টের একজন মানুষ। হাতে বালতি ভর্তি মাংস। কুমিরের খাদ্য। মানুষটাকে দেখেই দর্শকদের চিৎকার হাততালি। লোকটা স্বাগতম জানালো সবাইকে। তার সার্টের কলারে লাগানো শক্তিশালী মাইক্রোফোন তার কথাগুলো পৌঁছে দিচ্ছে সবার কানে। এই লোকটাই স্টিভ। এতবড় আয়োজনের মালিক। অথচ অন্য একশত কর্মচারীর সাথে তার পোশাক বা আচরণের কোন পার্থক্য নেই এখানে। কুমিরকে খাওয়ানোর দৃশ্য হলো ক্রোকোডাইল শো। স্টিভ কুমির সম্পর্কে অনেক কথা বলছে।
অ্যাগ্রো নাকি অ্যাগ্রেসিভ। পুকুরের পানি এখন সম্পূর্ণ স্থির। যে পানিতে কুমির থাকে সেখানে আর কোন প্রাণী বাস করবে যে পানি নড়বে! স্টিভ একদিকের পানিতে সামান্য নাড়া দিলো। পুকুরের অন্যদিকে সামান্য একটা বুদবুদ দেখা গেলো। কুমির পানির নিচ দিয়ে নিঃশব্দে চলাফেরা করতে ওস্তাদ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দেখা গেলো স্টিভ যে জায়গায় পানিতে নাড়া দিয়েছিলো সেখানে অ্যাগ্রোর মাথা। এতবড় পুকুরের আর কোথাও সামান্য বুদবুদ দেখা গেলো না।
অ্যাগ্রোর মাথাটা বীভৎস কুচকুচে কালো। নানা কায়দায় খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে স্টিভ অ্যাগ্রোর দিকে। কিছুক্ষণ খেলা চললো। পুকুরের এপাশ থেকে ওপাশ ছুটোছুটি হলো যেদিকে খাবার যাচ্ছে  অ্যাগ্রো সেদিকে ছুটে যাচ্ছে পানির ভেতর দিয়ে। শুরুতে নিঃশব্দ চলাচল হলেও শেষে পানিতে দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। কয়েকবার স্টিভকে তাড়াও করলো অ্যাগ্রো।
স্টিভ চাচ্ছে অ্যাগ্রোকে পানি থেকে ডাঙায় তুলে আনতে। একবার মাত্র ডাঙায় উঠলো অ্যাগ্রো। স্টিভের সাইজের পাঁচটা মানুষকে একসাথে হজম করে ফেলতে পারবে এই কুমির।
খেলা শেষে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলো স্টিভ। স্টিভের বৌ টেরিও খেলা দেখায় মাঝে মাঝে। কুমির নিয়ে খেলা করা যেন তাদের কাছে কোন ব্যাপারই না। এমনকি তাদের তিন বছরের মেয়ে বিন্দিও অজগর নিয়ে খেলা করে। স্টিভদের এই পারিবারিক প্রতিষ্ঠানটি এখন অস্ট্রেলিয়ার একটি জাতীয় আকর্ষণ।
বেলা দুটোয় রয় আমাদের নিয়ে রওনা হলেন আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড দেখানোর উদ্দেশ্যে। যাবার পথে কয়েকজন ট্যুরিস্টকে ওঠাতে গেলেন সুপার বি নামে একটা মধু তৈরির কারখানায়।
এই কারখানার আশে পাশে গভীর জঙ্গল। বিশাল বিশাল গাছ। গাছগুলোকে খুব একটা পরিচিত মনে হচ্ছে না। হয়তো অন্য কোন প্রকার গাম। সুপার বি অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রধান মধু তৈরির কারখানা। মৌমাছির চাষ করা হয় এখানে। তারপর মধু। ট্যুরিস্টদের অনেকেই কৌটো ভর্তি মধু কিনলেন এখান থেকে। খাঁটি মধু নাকি কাজে লাগে। কিন্তু আমার ভালোই লাগে না এই মিষ্টি জাতীয় তরল পদার্থটি।



আমাদের প্যাকেজ ট্যুরের শেষ অংশ আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড। সাগর তলের প্রাণিদের জগত। অ্যাকোরিয়ামের অন্য নাম হয়েছে এখানে আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড। সিডনি বা মেলবোর্নের অ্যাকোরিয়ামের মতোই সবকিছু। হাঙর, ঈল, কাছিম, নানারকম জেলিফিশ ইত্যাদি। তবে ব্রিসবেনের এই স্থানের বিশেষ আকর্ষণ হলো সিল শো।



দুটো সিল মাছ নানারকম শারীরিক কসরৎ দেখালো। হাত মানে পাখনা তুলে স্যালুট দেয়। লেজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সিড়ি বেয়ে হেঁটে হেঁটে উঠানামা করতে পারে এই সিল মাছ। খাবারের লোভ দেখিয়ে এদের কাছ থেকে কাজ আদায় করা হয়। আর কাজের শেষে পুরস্কার হিসেবে মাছ খেতে দেয়া হয়। সিলমাছ দুটো মুখের ওপর প্লাস্টিকের বল নিয়ে ছোটে বা পরস্পর বল ছুঁড়ে ওয়াটার পোলো খেলে সত্যিই আশ্চর্য লাগে। মানুষ যে কীভাবে অন্যান্য প্রাণির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে, সিল মাছ থেকে কুমির সে যে প্রাণীই হোক।

এবার ব্রিসবেনে ফেরার পালা। ঠিক চারটায় বাস নিয়ে হাজির স্টিফেন। ফেরার পথে স্টিফেনকে একটু চুপচাপ মনে হলো। একটা ভিডিও চালিয়ে দিলো সে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে স্টিফেন একটা ট্যুর বাস অপারেট করছে। ধারাবিবরণী দিচ্ছে সে। এই হোম ভিডিওর মান প্রফেশনাল কোয়ালিটির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। স্টিফেনের এই প্রোগ্রাম প্রচারিত হয়েছে কিনা আমি জানি না। এখানে তো অনেকগুলো টিভি চ্যানেল। ট্যুরিস্টদের অনেকেই ব্রিসবেন পর্যন্ত আসার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
স্টিফেন হঠাৎ মাইক্রোফোনে বললো, "এই ট্যুর আমার শেষ ট্যুর। পনের বছর পরে কাল থেকে আমার ছুটি।"
ব্রিসবেন ট্রানজিট সেন্টারে বাস থেকে নামার পরে স্টিফেনকে ধন্যবাদ দিলাম তার চমৎকার গাইডিং-এর জন্য। জানতে চাইলাম, "শেষ ট্যুর বলতে তুমি কী বুঝাচ্ছো?"
"চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি আজ।"
"কেন? এত ভালো করছো এখানে।"
"অন্য চাকরিতে যাচ্ছি। কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকছি এবার প্রোগ্রামার হিসেবে।"
স্টিফেনের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলাম। স্টিফেন নাইট শিফটে পড়াশোনা করে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কম্পিউটার কাউন্সিলের স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং নতুন একটা চাকরিতে যোগ দিচ্ছে কাল থেকে। স্টিফেনের মেধা আর দক্ষতার যতটুকু পরিচয় পেয়েছি তাতে বুঝতে পারছি সে আরো অনেক উন্নতি করবে।
মানুষকে পরিশ্রম করে উন্নতি করতে দেখলে নিজের ভেতরও এক ধরনের অনুপ্রেরণা জাগে। মনে মনে বললাম, একদিন আমিও-। আমিও- কী করবো? বাস চালাবো নাকি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করবো? জানি না।
ট্রানজিট সেন্টারের দোতলায় নামতেই পেটের ক্ষুধাটা জেগে উঠলো। সারাদিনে একটা চিকেন স্যান্ডুইচ ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। আমার চায়নিজ রেস্তোরা ইতিমধ্যেই খাবার সাজিয়ে ফেলেছে। তেমন ভিড় নেই এখন। আসলে এখনো ডিনারের সময় হয়নি।
খাবার নিতে নিতে কাউন্টারের আধ বয়সী চায়নিজ ভদ্রলোকের সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। এই চায়নিজ ভদ্রলোকটি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলেন। সাত বছর ধরে তিনি আছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এই দোকানের মালিক তিনি। তার এখন তিন মেয়ে। বড়মেয়ের বয়স আঠারো। বাকি দুইজনের ছয় আর চার। বড় মেয়ে এখানে ক্যাশ সামলাচ্ছে।
ভদ্রলোক কথা বলতে ভালোবাসেন বুঝতে পারছি। কথা শুনে তাকে বেশ আমুদে লোক বলেই মনে হচ্ছে। চায়নিজরা নাকি মনের কথা মুখে বলে না বা মুখে যা বলে তার বেশির ভাগই তাদের মনের কথা নয়। সে যাকগে। আমি তাঁর খাবারের প্রশংসা করে বিদায় নিলাম।
হোস্টেলে ফেরার পথে রোমা স্ট্রিটের কর্নারে একজন বিশালদেহী খোঁচা খোঁচা দাড়িমুখ মাতাল পথ আগলে দাঁড়ালো আমার।
"ডু ইউ হ্যাভ ফিফটি সেন্টস ম্যান?"
অস্ট্রেলিয়ার সব শহরেই এরকম ব্যাপার দেখা যায় মাঝে মাঝে। মদ খাওয়ার জন্য বা ড্রাগ নেবার জন্য এভাবে পয়সা চায় লোকের কাছ থেক। বিশেষ করে আপাত দৃষ্টিতে দুর্বল লোকের কাছে। আমি লোকটার চোখের দিকে তাকালাম। ফিফটি সেন্ট দেবার জন্য যদি কিছু বের করি সব নিয়েই যে চলে যাবে এরকম একটা ভাব তার। তাকে পয়সা দেবার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। একটু ভয় ভয় করলেও খুব একটা বিচলিত হলাম না। কারণ জোরে চিৎকার করলে সাড়া পাবার মতো লোকজন এখনো আছে রাস্তায়। লোকটার কাছে কোন গাড়ি নেই, তাই ছুটে পালাবার আগেই ধরা পড়বে সে।
আমি সোজা বাংলায় হাসিমুখে বললাম, "তুমি কী বলছো আমি বুঝতে পারছি না।"
"হোয়াট!!!"
লোকটা চমকে উঠেছে। আমি এবার বেশ জোরে বললাম তার চোখে চোখ রেখে, "তোমার ভাষা আমি বুঝি না।"
লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আমি খুব মজা পেয়ে গেলাম তার এই প্রতিক্রিয়ায়। মনে হলো বাংলা খুব কার্যকরী ভাষা এখানে।

__________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ছবিগুলো আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি।

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts