Showing posts with label Memoir. Show all posts
Showing posts with label Memoir. Show all posts

Friday, 10 January 2025

বিশ্বজিত সাহার "হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো"

 



বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান সে নিয়ে কারোরই কোন দ্বিমত নেই। ২০১২ সালে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর আরো এক যুগ কেটে গেছে। এখনো হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। তাঁর বই এখনো পাওয়া যাচ্ছে, এখনো মানুষ তাঁর বই পড়ছে। অবশ্য তাঁর নতুন প্রজন্মের কোন পাঠক তৈরি হয়েছে কি না আমি জানি না। কারণ আমাদের দেশের পাঠকদের মন এবং পাঠাভ্যাস নিয়ে নির্ভরযোগ্য তেমন কোনো গবেষণা হয় না।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার শনাক্ত হবার পর যখন তিনি চিকিৎসার্থে আমেরিকায় গেলেন তখন থেকে প্রায় প্রতিদিনই তাঁর চিকিৎসার অগ্রগতি সম্পর্কে নানারকম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলি সংবাদপত্রে। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও লিখেছেন তাঁর নিজের চিকিৎসা এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত কলাম “নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ”সহ আরো অনেক লেখা। তাঁর লেখা এবং তাঁর সম্পর্কে খবরগুলি নিয়মিত পড়েছি অনলাইনে পাওয়া বাংলাদেশের সংবাদপত্রে।

২০১২ সালের ১৯ জুলাই যখন তাঁর মৃত্যু হলো – দুঃখে বুক ভেঙে গেছে তাঁর লক্ষ লক্ষ পাঠকের। হুমায়ূন আহমেদের কট্টর সমালোচকরাও কেউ তাঁর এরকম মৃত্যুতে অবিচল থাকতে পারেননি। এটাই স্বাভাবিক।

তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বেশ কিছু অপ্রিয় বাদানুবাদ, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে যা কিছুতেই অভিপ্রেত ছিল না। তাঁকে কোথায় কবর দেয়া হবে – তা নিয়েও হূমায়ূন আহমেদের পরিবারের ভেতরই মতভিন্নতা দেখা দিয়েছিল – এবং প্রচারমাধ্যম তা খুবই বিস্তারিতভাবে, অনেকক্ষেত্রে ফুলিয়ে ফাঁপিয়েও প্রচার করেছে। সর্বযূগে সর্বদেশে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা এরকমই।

নিউইয়র্কের মুক্তধারার মালিক বিশ্বজিত সাহার সাথে লেখক হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক বছরের। হুমায়ূন আহমেদের বই, নাটক, চলচিত্রের উত্তর আমেরিকার পরিবেশক মুক্তধারা। বিশ্বজিত সাহা হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবসময়েই কাছে ছিলেন এবং আমেরিকায় হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে অনেক কিছু করেছেন। তাই ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ সম্পর্কে স্বয়ং বিশ্বজিত সাহাই যখন একটি বই লিখলেন – তখন সেই বই সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ জন্মাবে সেটাই খুব স্বাভাবিক।

২০১৩ সালের বইমেলায় এই বই প্রকাশিত হবার পর সেটা নিয়ে হৈচৈ যেমন হয়েছে – তেমনি মেহের আফরোজ শাওনের সাথে বিশ্বজিত সাহার মনোমালিন্যও প্রকাশ্যে এসেছে। শাওন তথা মিসেস হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে বইটির প্রকাশককে উকিল নোটিশ পাঠান যেন বইটি বইমেলা থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং প্রচার ও বিক্রয় করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু তাতেও কাজ না হলে পুলিশ পাঠিয়ে বইমেলা থেকে সেই বইয়ের অনেকগুলি কপি বাজেয়াপ্ত করান। তাতে বইয়ের কাটতি অনেক বেড়ে যায়। সেই সময় বিশ্বজিত সাহা ইত্তেফাক পত্রিকায় এবং আরো কয়েকটি পত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদের শেষের দিনগুলি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন। সেইসময় সেগুলিও পড়েছিলাম।

এতবছর পর ‘হূমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ পড়ে আবারো মনে হলো হুমায়ূন আহমেদের মতো মানুষের শেষ দিনগুলি বিশেষ করে শেষের এক মাস ভীষণ যন্ত্রণাময় ছিল। এই যন্ত্রণা তাঁর পাবার কথা ছিল না।

হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের জন্য পুত্রশোক সহ্য করা ভীষণ কঠিন ছিল। অসহনীয় শোকের মধ্যেও তিনি কয়েক লাইনের একটি মন্তব্য করেছেন এই বইটি সম্পর্কে যে তিনি এই বইটি পড়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, কারণ বিশ্বজিত সাহা হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের কাছে ছিলেন।

লেখক আয়েশা ফয়েজের এই কথাগুলি খুবই গুরুত্বের সাথে বইয়ে সংযুক্ত করেছেন ভূমিকারও আগে প্রাক-ভূমিকা হিসেবে। আমার মনে হয়েছে লেখক এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন এই বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। লেখক নিজের ভুমিকাতেও উল্লেখ করেছেন আরো অনেক লেখকের এই বিষয়ে অনেক লেখা এবং বই প্রকাশের কথা। সেসব লেখার চেয়েও তাঁর নিজের লেখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য এটা প্রমাণের জন্য লেখক পুরো বইতে ডিটেলস এর প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন – যেমন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ওষুধের নাম, সময়, হাসপাতালের ডিটেলস – যা বইটিকে করে তুলেছে অনেকটাই ফ্যাক্ট ফাইল এর সংকলন।

হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত অভ্যাস থেকে শুরু করে তাঁর পরিচিত, ভক্ত, বন্ধুবান্ধব, হিতৈষীদের অনেকের – বিশেষ করে যারা প্রবাসে সেই সময়ে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন সবার কথা উঠে এসেছে।

লেখকের নিজের ভূমিকা এবং তাঁর স্ত্রী রুমা সাহার কথা স্বাভাবিকভাবেই এসেছে প্রতিটি অধ্যায়ে কারণ হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বিশ্বজিত সাহা যতটুকু ভূমিকা রেখেছেন, প্রতিদিন হাসপাতালে যাওয়া, হুমায়ূন আহমেদের শিশুপুত্রদের দেখাশোনা করা, মেহের আফরোজ শাওনকে সঙ্গ এবং সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া সবই করেছেন রুমা সাহা।

প্রবাসী লেখক এবং বিজ্ঞানী পূরবী বসুও অনেক কিছু করেছেন হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার ব্যাপারে।

আমেরিকায় ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ অনেক। মুক্তধারার মাধ্যমে চিকিৎসার বেশিরভাগ খরচ স্পন্সর করেছেন বিশ্বজিত সাহা। তিনি কম খরচে চিকিৎসা যেন হয় সেজন্য হুমায়ূন আহমেদকে একটি মেডিক-এইড কার্ডেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই কার্ড সাধারণত আমেরিকার স্বল্প-আয়ের মানুষদের জন্য ফেডারেল সরকারের স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের অধীনে আমেরিকানদের দেয়া হয়। যদিও কার্ডটি দেয়া হয়েছে চিকিৎসার মাঝামাঝি সময়ে – তারপরও অনেক হাজার ডলার খরচ হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের জন্য যা যা করা সম্ভব সব করেছে। হুমায়ূন আহমেদকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অবৈতনিক একটি পদ দেয়া হয়েছিল – যেন যতদিন দরকার হয় তিনি আমেরিকায় থাকতে পারেন, আমেরিকার বাংলাদেশ দূতাবাসের সুযোগ-সুবিধা দরকার হলে নিতে পারেন। অনেক সময় বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা নিয়েছেনও তিনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর নিউইয়র্কের বাসায়। অর্থ সহায়তাও দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ অর্থ সাহায্য নেননি।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের সাথে বাস্তববাদী হুমায়ূন আহমেদ ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি সেইসব দিনগুলি নিয়ে বই লিখেছেন। নিয়মিত রসিকতা করেছেন। ছবি এঁকেছেন। তাঁর আঁকা ছবির ফ্রেম করেছেন লেখকের স্ত্রী রুমা সাহা। নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনীও হয়েছে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ছবি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ ওঠানো হবে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত বদলান। তিনি ছবির প্রদর্শনী করতে রাজি হলেও বিক্রি করতে রাজি হননি।

২০১২ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখ সকাল আটটায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হুমায়ূন আহমেদ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। পরবর্তী ফলো আপের তারিখ দেয়া হয়েছিল ১৫ আগস্ট। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই ঘটে যায় ভয়ংকর ঘটনা এবং ঘটনা কিছুটা রহস্যময়ও হয়ে ওঠে।

১৯ তারিখ রাতেই নাকি হুমায়ূন আহমেদের নিউইয়র্কের বাসায় পার্টি হয়, সেখানে ঠিক কী কী হয় জানা যায় না। হুমায়ূন আহমেদ নাকি চেয়ার থেকে পড়ে যান, যদিও সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে বলে লেখক দাবি করেছেন। গোপন করেছেন মিসেস হুমায়ূন আহমেদ এবং প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম।

বিশ্বজিত সাহাকে খবর দেয়া হয় দুদিন পর – যখন হুমায়ূন আহমেদকে জ্যামাইকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরপর অনেকগুলি অপারেশন করাতে হয়। ডাক্তাররা শনাক্ত করেছেন হয়তো পড়ে গিয়ে আগের অপারেশনের সেলাই ছিড়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে পুরো একদিন বাসায় রেখে দেয়াতে তাতে ইন্টারন্যাল হেমারেজ হয় এবং ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে।

জুনের ২০ তারিখ থেকে জুলাইর ১২তারিখ পর্যন্ত অনেকগুলি অপারেশন, লাইফ সাপোর্ট এবং আমেরিকার হাসপাতালের সর্বোচ্চ চেষ্টাতেও বাঁচানো যায়নি হুমায়ূন আহমেদকে।

লেখকের কাছে সেই সময়ে শাওন ও মাজহারুল ইসলামের ব্যবহার এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। অনেকগুলি প্রশ্নের উদয় হয়েছে সেখানে। সেই প্রশ্নগুলির কোন নৈব্যক্তিক উত্তর আজও পাওয়া যায়নি।

হুমায়ূন আহমেদের মরদেহও একদিন বেশি আমেরিকায় রেখে দিতে হয় – শুধুমাত্র শাওন প্রথম শ্রেনির বিমান টিকেট ছাড়া দেশে ফিরবেন না বলে জেদের কারণে। শাওনের মা সরকার দলীয় এমপি হওয়াতে বেশ প্রভাব খাটিয়েছেন সেটাও স্পষ্ট।

হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় দাফন করা হবে সেটা নিয়েও হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পক্ষের সন্তানসন্ততি এবং ভাইবোন বনাম শাওনের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত নুহাশ পল্লীতেই দাফন করা হয়।

এই বইটি শাওন কেন নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর এই বইয়ের পাঠক হিসেবে আমি যতটুকু বুঝেছি তা হলো – শাওন চাননি তাঁর ব্যবহারের অসংলগ্নতা কেউ জানুক, কিংবা কেউ তাঁকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান।

হুমায়ূন আহমেদের ছবিগুলি লেখক বইতে দাবি করেছেন হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ছবিগুলি নিয়ে পরে কোনো ঝামেলা হতে পারে এটা কি তিনি টের পেয়েছিলেন?

বই প্রকাশের অনেক বছর পর সম্ভবত ২০২১ সালে মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূন আহমেদের ছবি চুরির অভিযোগে মামলা করেছিলেন রুমা চৌধুরি ও মঞ্জুরুল আজিম পলাশের বিরুদ্ধে। এগুলি বইয়ের বাইরের ঘটনা। আমি বেশ হতবাক হয়েছি বিশ্বজিত সাহা ও  রুমা সাহার বিবাহবিচ্ছেদ এবং রুমা সাহার মঞ্জুরুল আজিম পলাশকে বিয়ে করে আমেরিকা ছেড়ে বাংলাদেশে এসে বাস করার সংবাদে। ২০১২ সালে নাকি চব্বিশটি ছবির মধ্যে বিশটি ফেরত দেয়া হলেও চারটি ছবি ফেরত দেয়া হয়নি। রুমা সাহা নাকি বলেছিলেন সেগুলি হারিয়ে গেছে। ২০২১ সালে কুমিল্লায় এক প্রদর্শনীতে হুমায়ুন আহমেদের সেই হারিয়ে যাওয়া ছবিগুলি দেখা যায় – যে প্রদর্শনী করছিলেন রুমা চৌধুরি ও পলাশ। শাওন মামলা করেছিলেন এদের বিরুদ্ধে। দুবছর পর ছবিগুলি উদ্ধার করে শাওনের হাতে তুলে দেয়া হয়।

বিশ্বজিত সাহার বইটি হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলোর ক্রমানুগতিক ঘটনাপঞ্জি তাতে সন্দেহ নেই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে লেখক যেন পাঠকের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছেন তিনি হুমায়ূন আহমেদের জন্য কী কী করেছেন এবং কতখানি করেছেন। ভবিষ্যতের হুমায়ূন গবেষকদের তো বটেই, হুমায়ূনের শিশুপুত্রদ্বয় নিষাদ ও নিনিতও যদি কোনোদিন কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় – এই বই থেকে জানতে পারবে অন্য একটা ভার্সন যেটা হয়তো তাদের মা তাদেরকে অন্যভাবে বলেছেন।

বইটি দুঃখদিনের ঘটনা, তাই সুখপাঠ্য হবার দাবি রাখে না। কিন্তু তবুও বেশ কিছু ঘটনা এবং বর্ণনার পুনরুক্তি আছে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ইতিহাসের অংশ। সে হিসেবে এই বইও ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছে।

------------

হুমায়ূন আহমেদের ছবি আঁকার হাতও যে এত চমৎকার তা আমরা জানতে পেরেছি তাঁর জীবনের একেবারে শেষের দিকে। এখানে তাঁর আঁকা কিছু ছবি রেখে দিলাম। 





Tuesday, 7 January 2025

প্রবীর মিত্র: বড় ভালো লোক ছিল এবং অন্যান্য

 


অভিনেতা প্রবীর মিত্র মারা গেছেন ৫ জানুয়ারি ২০২৫।

১৯৪১ সালের ১৮ আগস্ট তাঁর জন্ম। সে হিসেবে তিরাশি বছর বয়সে জীবনাবসান কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। প্রবীর মিত্র  চার শ’র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন এটা নিসন্দেহে একটি বিরাট গৌরবের বিষয়। চারশ সিনেমায় চারশ টি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের চিত্রায়ণ। শুধুমাত্র অভিনেতারাই এক জীবনে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে হাজির হতে পারেন মানুষের সামনে। [অবশ্য নষ্ট রাজনীতির কিছু কিছু মানুষ অভিনেতাদের চেয়েও বড় অভিনেতা, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।]

আমি যখন থেকে সিনেমা দেখতে শুরু করেছি – তখন থেকেই প্রবীর মিত্রের অভিনয় দেখেছি। একক নায়ক হিসেবে তিনি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। একেবারে শুরুর দিকে ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমায় কবরীর বিপরীতে নায়ক হিসেবেই অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র। অবশ্য সেই চরিত্রে তেমন বিশেষ কিছু করার ছিল না তাঁর। হঠাৎ করে কবরীকে বিয়ে করে ফেলা, নৌকায় ডাকাতের আক্রমণ হওয়া, কবরীকে হারিয়ে পাগল হয়ে যাওয়া। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ জেলেদের সরল জীবন নিয়ে লেখা হলেও সরল উপন্যাস বলা যাবে না কিছুতেই। তাকে সিনেমায় রূপান্তরকরণ ঋত্বিক ঘটকের পক্ষেই সম্ভব। তিনি যাকে দিয়ে যা আদায় করতে পারবেন – ঠিক ঠিক তাকে তাকেই সেসব চরিত্রের জন্য বেছে নিতেন। প্রবীর মিত্র ঋত্বিক ঘটকের চোখে পড়েছিলেন – এটা অবশ্যই তাঁর অভিনয় জীবনে বড় প্রভাব রেখেছিল। তখন প্রবীর মিত্রের ক্যারিয়ার সবে শুরু হচ্ছে।




তিতাস একটি নদীর নাম – আমি দেখেছি অনেক পরে। ততদিনে সিনেমার অভিনয় সম্পর্কে আমার ভালোলাগার ধরন বদলে গেছে। কৈশোরে এই সিনেমা দেখলে আমার সম্ভবত মোটেও ভালো লাগতো না। সেই সময় অতিনাটকীয় মেলোড্রামাই বেশি ভালো লাগতো।

বাংলাদেশে একক নায়ক হিসেবে বেশ কয়েকটি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বেবী ইসলাম তৈরি করেছিলেন ‘চরিত্রহীন’। না, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের গল্প নয়। মীনা খান নামে এক নতুন নায়িকার বিপরীতে প্রধান নায়ক ছিলেন প্রবীর মিত্র। কিন্তু সিনেমাটি খুব একটা ব্যবসাসফল হয়েছিল বলে মনে হয় না। ঐ নায়িকাকেও পরে আর বেশি দেখা যায়নি।


শাবানার বিপরীতে তিনি নায়ক হয়েছিলেন এইচ আকবরের ‘জালিয়াত’ সিনেমায়। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল সিনেমাটি। কেমন ব্যবসা করেছিল জানি না। তবে একক নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্রকে যে কোন পরিচালকই আর সেভাবে সুযোগ দেননি তা বোঝা যায়।


আমি যখন থেকে বাছবিচারহীনভাবে সিনেমা দেখতে শুরু করেছি – সেই আশির দশকের শুরুতে – সিনেমার পোস্টারে প্রবীর মিত্রের নাম তখন সাধারণত থাকতো তিন কিংবা চার নাম্বারে। সহনায়ক হিসেবে কিংবা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে প্রবীর মিত্র অভিনয় করতেন। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তিনি খুবই নির্ভরযোগ্য ছিলেন। সেই সময়ে অন্য সবার মতো তিনিও খুব লাউড অভিনয় করতেন। অভিব্যক্তিতেও তেমন কোন স্বাতন্ত্র্য ছিল না। তিনি যেসব চরিত্রে অভিনয় করেছেন, আমার কখনোই তাঁকে সেইসব চরিত্রের জন্য অপরিহার্য বলে মনে হয়নি। তবে সেই সময় বেশিরভাগ অভিনেতাই খুব টাইপড হয়ে গিয়েছিলেন। যেমন আনোয়ার হোসেন – সৎ, গরীব, দুঃখী টাইপ। এটিএম শামসুজ্জামান – খল এবং কৌতুক। অভিনেতা দেখেই আমরা দর্শকরা শুরু থেকেই চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা করে নিতাম, এবং সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিলে যেতো। কিন্তু প্রবীর মিত্র সেক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তিনি নেগেটিভ রোলেও অভিনয় করেছেন মাঝে মাঝে।

এ জে মিন্টুর প্রায় সব সিনেমাতেই প্রবীর মিত্র অভিনয় করেছেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সিনেমাগুলি খুবই ব্যবসাসফল হয়েছিল – কারণ দেখতাম সিনেমাহলে সেগুলি কয়েক সপ্তাহ ধরে হাউজফুল হতো। বলিউডের হিন্দি সিনেমা ‘জনি মেরা নাম’-এর হুবহু নকল করে এ জে মিন্টু তৈরি করলেন ‘মিন্টু আমার নাম’। সেখানে সোহেল রানার সাথে সমানে সমানে অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র  এবং মাঝে মাঝে সোহেল রানাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। মারপিট নাচগান আর অত্যন্ত উচ্চস্বরে বলা নাটকীয় সংলাপ ছিল এসব ‘নকল’ সিনেমার প্রাণ। তখনো কিন্তু জানতাম না যে এই সব সিনেমা কোনো ধরনের কৃতজ্ঞতাস্বীকার ছাড়াই ফ্রেমের পর ফ্রেম হিন্দি সিনেমা থেকে নকল করে বানিয়েছেন বাংলাদেশের পরিচালকরা। অভিনেতারা কি জানতেন? জানলে কি অভিনয় করতেন? জানি না।


মিন্টু আমার নাম-এ রাগী, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুবকের চরিত্র থেকে এ জে মিন্টুর পরের সিনেমা ‘প্রতিজ্ঞা’য় প্রবীর মিত্র সম্পূর্ণ আলাদা হাবাগোবা এক কৌতুকপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেন। এই সিনেমা দুটো আমি দেখেছি পুরনো হয়ে যাবার পর পটিয়ার সিনেমা হলে – তৃতীয় শ্রেণির টিকেট কেটে ছারপোকা সমৃদ্ধ কাঠের চেয়ারে বসে।

চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় চট্টগ্রাম শহরের এমন কোন সিনেমা হল ছিল না যেখানে আমি সিনেমা দেখিনি। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি সিনেমা দেখতাম, মাঝে মাঝে একাধিক। সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি – বেশিরভাগ সিনেমাতেই কোনো না কোনোভাবে প্রবীর মিত্র থাকতেন। এ জে মিন্টুর ‘প্রতিহিংসা’ ছবিতে যদিও সোহেল রানাকেই নায়ক বলা হচ্ছে, আমার মতে সেখানে আসল নায়ক প্রবীর মিত্র। এই সিনেমাটি এ জে মিন্টু কোন্‌ সিনেমা থেকে নকল করেছেন জানি না, তবে কাহিনি, মেকিং বেশ চমৎকার ছিল। জসীম সেই সময় খলনায়ক থেকে ক্রমশ নায়ক হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।

প্রতিহিংসা সিনেমায় জসীম একজন কুখ্যাত ডাকাত। বিচারক বিচার করার সময় মন্তব্য করেন যে ডাকাতের ছেলে ডাকাতই হবে – এর কোন ব্যতিক্রম হতে পারে না। জসীম তার সদ্যোজাত ছেলের সাথে বিচারকের সদ্যোজাত ছেলেকে বদলে ফেলে। বিচারকের ছেলে ডাকাতের ছেলে হিসেবে বড় হয়ে ঠিকই গুন্ডা প্রকৃতির হয় – যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র। আর ডাকাতের ছেলে বিচারকের ছেলে হিসেবে সৎ পুলিস অফিসার হয় (আশির দশকে বাংলাদেশের কোন সিনেমায় পুলিসকে অসৎ দেখানো যেতো না।) – যে চরিত্রে অভিনয় করেন সোহেল রানা। সিনেমাতে সোহেল রানার চেয়েও প্রবীর মিত্রের অভিনয় অনেক বেশি ডায়নামিক ছিল।


এ জে মিন্টুর ঈদের ছবি ছিল মানসম্মান। তখন আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা বেশ কাছে চলে এসেছে। কিন্তু তাতে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ হয়নি আমার। মানসম্মান দেখে ফেলেছিলাম ঈদের দিন মর্নিং-শোতে। সেই সময় শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে একটি শো চলতো। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানি উপন্যাস থেকে সৈয়দ শামসুল হক ‘মান সম্মান’-এর চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন তা এখন চিন্তা করলে কেমন যেন অস্থির লাগে। অথচ তখন কী দারুণ উত্তেজনা নিয়ে মানসম্মান দেখেছি। প্রবীর মিত্র সেখানে রাগী পুলিস অফিসার – যে ডাকু শাবানাকে ধরার জন্য দিনরাত এক করে ফেলে। কিন্তু ধরতে পারে না।


প্রবীর মিত্রের আরো কিছু সিনেমার কথা মনে পড়ছে যেগুলি দেখে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। সুচন্দা তাঁদের তিনবোনকে নিয়ে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন – তিনকন্যা। সেখানে সুচন্দা, ববিতা, চম্পা অভিনয় করেছিলেন। সুচন্দার নায়ক হয়েছিলেন প্রবীর মিত্র।


 আঁখি মিলন নামে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল – যেখানে সুরকার ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সেই সিনেমার একটি গান – ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে…’ এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে অনেকে ঐ গানটি দেখার জন্যও একাধিকবার সিনেমাটি দেখেছে। আমি সিনেমাটি দেখেছি নতুন সিনেমা এলেই দেখতাম বলে। সিনেমার গল্প আমার কাছে বেশ নতুন মনে হয়েছিল সেই সময়। [পরে অবশ্য জেনেছি এটাও একটি হিন্দি সিনেমার নকল।] রানী নামে নতুন একজন নায়িকা এসেছিলেন সেই সময়। এই সিনেমায় রানীর নায়ক হয়েছিলেন প্রবীর মিত্র। সিনেমায় প্রবীর মিত্রের সাথে রানীর বিয়ে হয়। প্রবীর মিত্রের ছোটভাই ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে রানীর ছোটবোন সুচরিতার প্রেম হয়ে যায়। রানী দুর্ঘটনায় মারা যায়। রানীর ছোট্ট শিশুকে মাতৃস্নেহ দেয়ার জন্য সুচরিতার সাথেই প্রবীর মিত্রের আবার বিয়ে ঠিক হয়। ইলিয়াস কাঞ্চন বা সুচরিতা কেউই মুখ ফুটে বলতে পারে না তাদের প্রেমের কথা। ইত্যাদি ইত্যাদি। খুবই মেলোড্রামাটিক হলেও প্রবীর মিত্রের অভিনয় খুব ভালো লেগেছিল সেখানে।


প্রবীর মিত্র অভিনীত আরো তিনটি সিনেমার কথা বলতেই হবে যেগুলি দেখে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। কামাল আহমেদ রাজ্জাক শাবানাকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন পুত্রবধু। কামাল আহমেদের সিনেমাগুলি পারিবারিক মেলোড্রামায় ভরপুর থাকে। গরীব গানের মাস্টারের মেয়ে শাবানাকে পরিবারের অমতে বিয়ে করে বড়লোকের ছেলে রাজ্জাক। রাজ্জাকের মা কিছুতেই পুত্রবধু হিসেবে মেনে নেন না শাবানাকে। রাজ্জাক বিদেশে গেলে সন্তানসম্ভবা শাবানাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। নানা পথ ঘুরে বিভিন্ন ঘটনার পর শাবানার আশ্রয় হয় এক বুটপালিসওয়ালার কাছে। এই বুটপালিসওয়ালা প্রবীর মিত্রের চরিত্রটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল। তখনও আমার গ্রুপ থিয়েটারে হাতেখড়ি হয়নি। সিনেমা দেখে দেখে আমি অভিনয় শিখতাম। পুত্রবধু সিনেমায় প্রবীর মিত্রের চরিত্রটি আমার এতই পছন্দ হয়েছিল যে তার অনেক সংলাপ আমি খাতায় লিখে রেখেছিলাম – যেন ভুলে না যাই। সেই খাতাটি অনেক বছর পর আমার অনুপস্থিতিতে আরো অনেক কিছুর সাথে উঁইপোকার পেটে গেছে।

১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল বেলাল আহমেদের ‘নয়নের আলো’। অন্যরকম একটি প্রেমের সিনেমা, গানের সিনেমা। আহমদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর করা এই সিনেমার সবগুলি গান ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। কাহিনিও চমৎকার। গ্রামের গায়ক জাফর ইকবাল শহরে আসে। গ্রামে রেখে আসে তার প্রেমিকা কাজরীকে। শহরে এসে অনেক সংগ্রাম করতে হয় তাকে। শহরে তার আশ্রয় হয় ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রবীর মিত্রের বাসায়। প্রবীর মিত্রের ছোটবোন সুবর্ণা মুস্তফা মনে মনে ভালোবেসে ফেলে জাফর ইকবালকে। অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে। আমার যে অংশটা খুব বেশি মনে দাগ কাটে সেটা বেশ করুণ। ঘটনাচক্রে কাজরীও বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে শহরে চলে আসে। সেখানে পরিচয় হয় রাইসুল ইসলাম আসাদের সাথে। দুর্ঘটনায় কাজরী অন্ধ হয়ে যায়। এদিকে সুবর্ণার ক্যান্সার ধরা পড়ে। এই সময় সুবর্ণা আর প্রবীর মিত্রের অভিনয় ভীষণ অন্যরকম লেগেছিল আমার। সুবর্ণা মোস্তফা তখন আস্তে আস্তে সিনেমায় নিয়মিত হচ্ছেন। কিন্তু অন্যদের মতো অতিঅভিনয় করেন না বলে তাঁর সাথে অভিনয় করতে গিয়ে প্রবীর মিত্র ভীষণ ভালো অভিনয় করেছেন সেখানে। তাঁর অভিনয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।

এ টি এম শামসুজ্জান যে সিনেমার কাহিনি চিত্রনাট্য লিখতেন তা আমার জানা ছিল না, কিংবা আগে কখনো খেয়াল করিনি। তাঁর লেখা কাহিনি, সংলাপ চিত্রনাট্যের সিনেমা ‘সীমার’ খুব ভালো লেগেছিল। সেই সিনেমায় প্রবীর মিত্রকে আলাদাভাবে ভালো লেগেছিল। সিনেমায় ফারুক একজন রাজনৈতিক গুন্ডা (ক্যাডার)। নেতাদের কথায় এমন কোন অপরাধ নেই যা সে করে না। প্রবীর মিত্র একজন বাম রাজনৈতিক সৎ নেতা। প্রবীর মিত্রের সংস্পর্শে আসার পর ফারুককে সৎ পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করে প্রবীর মিত্র। এই চরিত্রটিকে চমৎকার অভিনয় করেছিলেন তিনি।

সেই সময় বাংলাদেশের চলচিত্র পরিচালকদের মধ্যে আর্ট ফিল্ম নির্মাতা ছিলেন আলমগীর কবির। আলমগীর কবিরের সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া সবার পক্ষে সহজ ছিল না। শরৎচন্দ্রের পরিণীতা সিনেমাকে গল্প না বদলে ছবি তৈরি করেছিলেন আলমগীর কবির। [এর আগে শরৎচন্দ্রের কাহিনি নিয়ে ‘স্বামী’ এবং ‘বড়বাড়ির মেয়ে’ সিনেমা তৈরি হলেও সেখানে হিন্দু চরিত্রগুলিকে মুসলমান চরিত্র বানানো হয়েছিল। কারণ পরিচালকরা মনে করতেন বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে হিন্দুবিদ্বেষ বর্তমান। পরে অবশ্য চাষী নজরুল ইসলাম ‘দেবদাস’ তৈরি করার পর সিনেমায় হিন্দু চরিত্রের মুসলমানিকরণ বন্ধ হয়।]

আলমগীর কবির পরিণীতায় ললিতা চরিত্রে অঞ্জনা, শেখরের চরিত্রে ইলিয়াস কাঞ্চন এবং গিরীনের চরিত্রে প্রবীর মিত্রকে নিয়েছিলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জনা জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। প্রবীর মিত্রের চরিত্রটির দৈর্ঘ্য ইলিয়াস কাঞ্চনের চেয়ে কম হলেও প্রবীর মিত্র ইলিয়াস কাঞ্চনের চেয়ে সপ্রতিভ ছিলেন এই সিনেমায়।


সিনেমায় অভিনয়ের জন্য একবারই জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন প্রবীর মিত্র। সেটা হলো ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমায়। এই সিনেমাটি গতানুগতিক সিনেমার বাইরে। সৈয়দ শামসুল হক এই সিনেমার কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, গান রচনা করেছেন। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এই সিনেমাটি খুব যত্ন করে তৈরি করেছেন। প্রবীর মিত্র এই সিনেমায় রাজ্জাকের সহনায়ক। সিনেমা শুরু হয় প্রবীর মিত্রের হাহাকারের মধ্য দিয়ে। প্রথম দৃশ্যেই বোঝা যায় ট্রাক ড্রাইভার প্রবীর মিত্রের ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে একজন ফকিরবাবা মারা গেছেন। প্রবীর মিত্র গাড়ি চালাচ্ছিলেন না, তার হেলপার চালাচ্ছিল। চাপা দিয়ে হেলপার পালিয়ে গেছে। গল্প দানা বাঁধে ভিন্ন ভাবে। এই ফকিরের উপর জনগণের খুব বিশ্বাস ছিল। ফকির পানিপড়া দিলে লোকের অসুখ ভালো হয়ে যেতো। ফকিরের ছেলে রাজ্জাক এতদিন ফুফুর কাছে থেকে শহরে লেখাপড়া করেছে। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে গ্রামে আসে। প্রবীর মিত্র ধরা পড়ার ভয়ে কাউকে জানতে দেয় না যে তার ট্রাকের নিচেই প্রাণ গেছে ফকিরের। এদিকে রাজ্জাক খুঁজে বের করতে চায় তার বাবাকে কে মারলো। গ্রামের লোকজন ক্রমশ তাকেই ফকিরের সম্মান দিতে শুরু করে এবং তার কাছ থেকেই ফকিরি কেরামতি আশা করে। কিছু কিছু কাকতালীয় ব্যাপার ঘটেও যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের ঘটনাকাল। সিনেমার শেষে মুক্তিযুদ্ধও চলে আসে। কিন্তু ১৯৮২ সালে এরশাদের শাসনামলে তৈরি বলে সিনেমায় একবারও উচ্চারিত হয় না পাকিস্তানের কথা কিংবা রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধা। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য রাজ্জাক সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পান, প্রবীর মিত্র পেয়েছেন সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে। পুরষ্কার পেয়েছেন তা অবশ্যই তাঁর অভিনয়ের স্বীকৃতি। কিন্তু এরচেয়েও অনেক ভালো অভিনয় প্রবীর মিত্র করেছেন আরো অনেক ছবিতে যেগুলির কয়েকটির কথা উল্লেখ করেছি।


পরিচালক চাইলে যে ভালো অভিনয় আদায় করে নিতে পারেন – তা এই সিনেমার অঞ্জু ঘোষের অভিনয় দেখলেই বোঝা যায়। অঞ্জু ঘোষ সেই সময় সিনেমাতে এসে প্রচন্ড নাচগানের চটুল চরিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। কিন্তু বড় ভালো লোক ছিল সিনেমায় তাঁর অভিনয় খুবই সংযত এবং সাবলিল। রাজ্জাক, প্রবীর মিত্র, গোলাম মোস্তফার মতো দক্ষ অভিনেতার সাথে কী চমৎকার স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন তিনি। 

পরিণত বয়সেও অনেক সিনেমায় বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র। সেই সিনেমাগুলি অবশ্য দেখিনি। তাঁকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে আজহারুল ইসলাম তৈরি করেছিলেন ‘রিক্সাওয়ালা’।



এরকম আরো অনেক সিনেমায় অভিনয় করে করেই তিনি চার শ সিনেমা অতিক্রম করেছিলেন। একজন অভিনেতার জন্য এটুকু নিশ্চয় অনেক তৃপ্তির।

কিন্তু অতৃপ্তির মাঝেই বেঁচে থাকে প্রকৃত শিল্পীর শিল্পসত্ত্বা। প্রবীর মিত্র সেরকম কোনো অতৃপ্তির কথা কোথাও বলেছেন কি না জানি না।   

============

সিনেমার পোস্টারগুলি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে প্রকাশিত 'সিনেমার পোস্টার' বই থেকে নেয়া। 

Saturday, 4 January 2025

তাহার নামটি অঞ্জনা

 


তখন সবে ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছি। বাড়িতে যান্ত্রিক বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল একটি এক ব্যান্ড ফিলিপস রেডিও। ছুটির দিনের দুপুর কাটতো সেই রেডিওতে কান লাগিয়ে বিজ্ঞাপন তরঙ্গ শুনতে শুনতে। সেই সময় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কিংবা সহসা মুক্তি পাবে এরকম সিনেমাগুলির উপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। সেই অনুষ্ঠানগুলি ছিল আমার খুবই প্রিয়। বৌরানি সিনেমা তখন সদ্য মুক্তি পেয়েছে। বিজ্ঞাপনে প্রচারিত সেই সিনেমার অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে সবকিছু মুখস্থ করে ফেলেছি। রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, শাবানা, অঞ্জনা, গোলাম মোস্তফা – সবার যে ক’টা সংলাপ বিজ্ঞাপনে উচ্চারিত হয়েছে সেগুলি সব মুখস্ত হয়ে গেছে। ইত্তেফাক পত্রিকায় তখন সিনেমার অনেক বিজ্ঞাপন ছাপানো হতো। সেগুলি দেখতে দেখতে অনেক নায়ক নায়িকা চিনে ফেলেছিলাম। অঞ্জনার চেহারাও আমার চেনা হয়ে গেছে ততদিনে।  

বার্ষিক পরীক্ষার পর একবার শহরে যাবার সুযোগ হয়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন বাবা শহরে নিয়ে যাবেন। অবশেষে সেই সুযোগ এলো। তবে সরাসরি শহরে নয়। শহরের আগে এক রাত পটিয়ায় থাকতে হলো। আমার বড়ভাই তখন পটিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছে। কলেজের হোস্টেলে থাকে। আমি প্রথমবারের মতো গেলাম তার হোস্টেলে। আগের সপ্তাহে সে শহরে গিয়ে বৌরানি সিনেমা দেখে এসেছে। এজন্যও খুব ঈর্ষা হলো আমার।  

পরদিন ভোরে উঠেই ট্রেন ধরে শহরে। বাবার কাজকর্ম অনেক। তাঁর সাথে আন্দরকিল্লার বইয়ের দোকান থেকে কোর্টবিল্ডিং, বাংলাদেশ ব্যাংক – সবকিছু ঘুরতে ঘুরতে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম কখন সিনেমা হলে ঢুকবো। আমার বাবার প্রিয় সিনেমা হল ছিল সিনেমাপ্যালেস এবং খুরশিদ মহল। লালদিঘীর কাছাকাছিই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের এলাকা। আগের সপ্তাহে তিনি দাদাকে এই সিনেমা দেখিয়েছেন সিনেমাপ্যালেসে। কিন্তু এসপ্তাহে বৌরানির বদলে অন্য একটি সিনেমা চলছে সেখানে। যে কোনো সিনেমাই আকর্ষণীয়, কিন্তু আমাকে দেখতে হবে বৌরানি। সিনেমাটি আমার বাবারও এত ভালো লেগেছে যে আমাকে সাথে নিয়ে আবার দেখবেন তিনিও। 

স্টেশন রোডে নুপুর সিনেমা তখন চট্টগ্রামের অভিজাত সিনেমা হলগুলির একটি। জীবনের প্রথমবারের মতো ঢুকলাম সেখানে এবং মগ্ন হয়ে দেখলাম – বৌরানি। অঞ্জনা অভিনীত ওটাই আমার দেখা প্রথম সিনেমা। 





রাজ্জাকের বিপরীতে অঞ্জনা, আর বুলবুল আহমেদের বিপরীতে শাবানা। রাজ্জাক গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসে। কলেজের প্রিন্সিপাল শওকত আকবর তার চাচার বন্ধু। তাই প্রিন্সিপালের বাসায় তার থাকার জায়গা হয়। প্রিন্সিপালের মেয়ে অঞ্জনা। বাসায় কলেজে পড়ুয়া মেয়ে আছে বলে জোয়ান কোন ছেলেকে বাসায় থাকতে দেবেন না অঞ্জনার মা। তাই প্রিন্সিপাল রাজ্জাককে বিবাহিত হিসেবে পরিচয় দেন। এ নিয়ে নানারকম মজার ঘটনা ঘটতে থাকে। নেচে নেচে গান করা, প্রেম করা, অভিমান করা ছাড়া অঞ্জনার আর তেমন বিশেষ কিছু করার ছিল না সিনেমায়, তবুও ঐটুকুতেই আমার তাকে শাবানার চেয়েও বড় অভিনেত্রী বলে মনে হলো। 

কয়েক মাস পরেই আমার আরো অনেক সিনেমা দেখার সুযোগ এসে গেল। অঞ্জনা অভিনীত পরের সিনেমা যেটা দেখলাম সেটা হলো ‘সুখের সংসার’। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ভীষণ মেলোড্রামাটিক সিনেমা। তখন আমি সবেমাত্র বাঁশখালির অজপাড়া থেকে মহকুমা শহর পটিয়ায় এসে সেখানকার মডেল হাইস্কুলে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছি। থাকি বড়ভাইয়ের হোস্টেলে। পটিয়াতে একটি সিনেমা হল আছে – শুধুমাত্র এই কারণেই পটিয়াকে নির্দ্বিধায় শহর বলে মেনে নিয়েছি। হাতে কোনরকমে পাঁচ টাকা জমলেই তৃতীয় শ্রেণির টিকেট কেটে সিনেমা হলে ঢুকে পড়া যেতো। শুধুমাত্র পুরনো সিনেমাগুলিই সেই হলে মুক্তি পেতো – তাতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ আগে না দেখা যেকোনো সিনেমাই আমার কাছে নতুন এবং আকর্ষণীয়। সেই সময় আমি যে মনযোগ দিয়ে সিনেমা দেখতাম – অত মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে জীবনটা অন্যরকম হতো। সিনেমার প্রত্যেকটি সংলাপ, গান, এমনকি আবহসঙ্গীত পর্যন্ত আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকা নয়, সিনেমার ছোট-বড় সব চরিত্রই মনে গেঁথে যেতো নাটকীয় সংলাপের কারণে। এখন যেসব সংলাপকে অতিনাটকীয় বলে মনে হয়, সেই সময় সেইসব সংলাপসর্বস্ব চরিত্রগুলোকেই আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় মনে হতো। 

সেই সময় প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে একাধিক নতুন সিনেমা মুক্তি পেতো। ঢাকায় মুক্তি পাবার পরের সপ্তাহে চট্টগ্রামের সিনেমা হলে নতুন সিনেমা আসতো। পটিয়ায় সেই সিনেমা আসতো আরো কয়েক মাস পর। সুখের সংসার দেখার জন্য ততদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বড়ভাই তার বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখার জন্য শহরের বাসে ওঠার সময় নির্লজ্জভাবে একপ্রকার জোর করেই আমি বাসে উঠে গিয়েছিলাম। পটিয়া থেকে বাস আসতো তখন অনেক ঘুরে কালুরঘাটের ব্রিজ পার হয়ে। বহদ্দার হাট, মুরাদপুর পার হয়ে চকবাজারের গুলজার সিনেমার সামনে দিয়ে কলেজ রোড ধরে আন্দরকিল্লা চলে যেতো বাসগুলি। মনে আছে, গুলজার সিনেমার সামনে প্রায় চলন্ত বাস থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সিনেমার টিকেট কাউন্টারে। 





সুখের সংসার-এর নায়ক ফারুক এমএ পরীক্ষা দিয়ে পত্রিকার হকারি করছে। বড়লোক নায়িকা রোজিনার সাথে পরিচিত হচ্ছে তাদের বাড়িতে পেপার দিতে গিয়ে ঝগড়ার মাধ্যমে। নাটকীয়তায় ভরপুর। সেখানে অঞ্জনা ছিল ফারুকের ছোট বোন। তার বিয়ে হয় বড়লোকের ছেলে প্রবীর মিত্রের সাথে। প্রবীর মিত্র সারাক্ষণ বই পড়ে। বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে কীভাবে কথা বলবে সে বিষয়েও সে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করে। এত বইপড়া মানুষ এত হাবাগোবা কীভাবে হতে পারে সেই প্রশ্ন সেদিন মনেও আসেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেই সিনেমার অনেক সংলাপ আমার এখনও মনে আছে। অঞ্জনার অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অঞ্জনার অভিনয়ের প্রতি আমার মুগ্ধতা এরপর আরো যত সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখেছি – কোনোটাতেই কমেনি। যেকোনো চরিত্রেই অঞ্জনা তাঁর অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতেন। 





প্রধান নায়িকা হিসেবেও তিনি অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। নায়করাজ রাজ্জাকের সাথেও তিনি তিরিশটির বেশি সিনেমায় নায়িকা হয়েছেন। প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দুবার জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি যে তিন শ’র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সেই তথ্য আমার জানা ছিল না। আজ অঞ্জনার মৃত্যুসংবাদ পাবার পর আমার নিজের সেই কৈশোরের সিনেমা দেখার দিনগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অঞ্জনা অভিনীত অনেকগুলি চরিত্রের কথাই মনে পড়ছে। তিনি খারাপ অভিনয় করেছেন এরকম কোন চরিত্র মনে পড়ছে না। বাংলাদেশের সেরা ক্ল্যাসিক নির্মাতা আলমগীর কবীর অঞ্জনাকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন শরৎচন্দ্রের পরিণীতা। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি পরিণীতায় ললিতার চরিত্রে অভিনয় করে। এর আগে ১৯৮১ সালেও তিনি জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন ‘গাংচিল’ সিনেমায় ‘নীলা’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। [অঞ্জনার মৃত্যুর খবর পেয়ে ইউটিউবে গাংচিল দেখলাম কিছুক্ষণ আগে। নীলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কেন অঞ্জনাকে জাতীয় পুরষ্কার দেয়া হলো বুঝতে পারলাম না। চরিত্রটিতে বিশেষ কিছু করার ছিল না।]

বাংলাদেশের সিনেমায় যাঁরা অভিনয় করতেন সেই সময়  প্রায় প্রত্যেকেই অতিঅভিনয় করতেন। সেক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে অঞ্জনা ছিলেন অনেকটাই ব্যতিক্রম। তিনি যথাসম্ভব স্বাভাবিক অভিনয় করার চেষ্টা করতেন। অঞ্জনার অভিনয় প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে কি না আমি বলতে পারছি না। কারণ আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে দীর্ঘদিন ধরে অন্যদেশের সিনেমার সাথে কোন ধরনের প্রতিযোগিতা করতে হয়নি। তারপরও ইন্ডাস্ট্রিটি ধ্বংস হয়ে গেছে। শুনেছি ২০০৮ সালের পর অঞ্জনা আর কোন সিনেমাতে অভিনয় করেননি। অভিনয় করার মতো হয়তো তেমন কোন সুযোগই ছিল না। আমাদের পরের প্রজন্মের কেউ অঞ্জনার অভিনয় দেখেছেন বলেও মনে হয় না। সুতরাং অভিনয় শিল্পী হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন এরকম দুরাশা আমি করি না। তবে আমার মনে থাকবে তাঁর অভিনয়ের কথা। 

Sunday, 26 May 2024

Memories of My Father - Part 6

 


The habit of reading books was instilled in us from a young age, almost unknowingly. There was no specific encouragement or pressure for this. As far back as my memory can take me, I see that we grew up surrounded by books. This was because my father sold books in his shop. However, these weren’t the intellectual or creative books we now include in our collections. My father sold primary and secondary school textbooks.

At that time, in independent Bangladesh, one needed a license from the Textbook Authority to sell government-issued books. Obtaining that license required a lot of effort. I don't know how my father managed to get it, but until 1980, he was the only licensed textbook seller in Banshkhali. He used to go to Dhaka to get books from the Textbook Authority. Other booksellers in Banshkhali would come to our shop to get their supplies from him. As a result, our shop was always filled with a large number of books. We eagerly opened the crates of books. Even before I learned to read, I would flip through the pages to look at the pictures. Back then, apart from the cover, there were no coloured pictures in the books. Nowadays, children have the opportunity to handle beautifully colourful and shiny books from a much younger age.

Having books for various subjects from different classes at our fingertips meant we had the opportunity to read whatever we liked, and we made the most of it. We often saw our father extremely busy. He spent at least four to five days a week traveling here and there. On the two or three days he was at home, he would hand me a book from any class during his afternoon nap and ask me to read it aloud. I can’t say I was a very obedient child. I would wait for him to fall asleep so I could escape. Within two or three pages, he would be asleep. At that time, I thought it was so easy to fool him. It was much later that I realized parents often pretend to be fooled for the sake of their children.

Back then, from classes six to nine, alongside the Bangla textbooks, there was another book for rapid reading. These books had many beautiful stories. I had read all the stories from each class while reading to my father. When I grew up and tried to understand him, I observed that more than his desire to listen to stories, he wanted to cultivate a reading habit in us.


Memories of My Father - Part 5

 


Milestones along the roadside are rarely seen these days. In this era of Google Maps, those milestones have lost their importance. However, those of us who grew up listening to stories about Ishwar Chandra Vidyasagar’s childhood know the relationship between these milestones and Vidyasagar. My father, who regretted not being able to study in his own childhood, tried to make up for it through his children whenever he had the chance. When he no longer had the opportunity to become a Vidyasagar himself, he tried to become Vidyasagar’s father. This didn't particularly make his children happy. I used to get very annoyed when he talked about knowledge. But since expressing my annoyance might have resulted in our trip being cancelled, I kept my feelings to myself. We were allotted just one trip a year, which was to visit the city with my father after the annual exams. We had to leave very early in the morning, walk a long distance, and then take a rickshaw.

Vidyasagar’s father supposedly taught his son many things while walking with him. For instance, he taught him to count by showing him the milestones along the road: one, two, three, four. He even tested him on his math skills by hiding one of the milestones. My father once tried to do something similar with us very meticulously. However, there were only a few milestones along the main road from our village to the city. After crossing the small stream from our village and walking a bit north, we encountered a milestone that read "Chanpur 16 miles." Then, after several milestones were missing, there was another one in front of the Joldi CO office. Hence, it was impossible for him to directly test us on counting milestones. But it’s not a father’s job to cancel tests and give peace to his children. He found another way. He asked, "How many yards in a mile?"

I didn’t know the answer to this question. I had advanced to the third grade without learning much. My older brother, who was two grades ahead and good at math, answered – 1760 yards.

"How much distance is in one yard?" father asked again.

I couldn’t make any sense of it. I just enjoyed watching the red sky as the sun rose. But I saw my father draw a mark on the road with his foot and then, bending down, he measured a distance with his hands and made another mark. He said, “This distance is one yard. Now, you all walk normally and see how many 'kais' each of you take in one yard.” ‘Kai’ means steps. With enthusiasm, I measured that I took three steps to cover one yard. My older brother, in his excitement, tried to cover one yard with a long stride in one step, but father said, “You have to walk like that the whole way.” That deflated his enthusiasm. He took two steps to cover one yard.

After measuring our steps, the instruction was – we had to count our steps until the next milestone. By dividing my total steps by three, I could find out how many yards I had walked. Then, convert yards into miles.

I have walked on the roads of many countries for many years since then. Even now, I subconsciously count my steps. What we now call calibration is what my father taught us on the roads of our village. My father, who had only passed the fourth grade.


Saturday, 25 May 2024

Memories of My Father - Part 4

 


This is my first photo taken with my father. At that time, I had just moved up to ninth grade, my sister was studying for her honors, and my brother had taken his SSC exams. This photo was taken at Studio Aleya near the Gulzar Cinema in Chawkbazar.

Before this, I had the opportunity to enter a studio only three times. After moving up to third grade, I came to the city for the first time. My father had taken the three of us to see the city. Near Lal Dighi, at Mukul Studio, a photo was taken. That was the first photo of my life, but it was the second or third for my brother and sister. In the first photo they took with our parents, I was invisible. At that time, I was in my mother's womb. That was the first and last photo with our mother. I never had the opportunity to take a photo with my mother. At Mukul Studio, a photo of the three of us was taken, but I do not know why my father did not join us in that photo. Later, I realized that my father did not have the financial means to take multiple photos that day.

My second photo was taken after I moved up to sixth grade. It was a half-portrait, where only the face is visible. After receiving the primary scholarship, my father wanted to have his son's photo published in the newspaper. So, the photo was taken. But when we went to the newspaper office, the amount of money they asked for was more than my father could afford. I was with my father. As he walked out of the Azadi office in Anderkilla with his head down, I, who had just entered sixth grade, somehow felt responsible. The conflict between desire and the means that honest lower-middle-class people face was something my father never able to resolve.

My third photo was taken at a studio in Patiya after the junior scholarship exam. At that time, there was only one center for scholarship exams for all the schools in South Chittagong, which was at Patiya Abdus Sobhan Rahat Ali High School. That time too, a photo could have been taken with my father. But it wasn't. 

About six months later, this photo was taken—the first photo of my father with his three children.

This photo was framed in a thin wooden frame and hung on the cardboard wall of our house. Over time, as we left home to study in colleges and universities in various places, the photo became more and more faded while hanging on the wall. After my father's death, we realized there was no other copy of the photo. Several years later, we found the negative of the old photo among my father's disorganized papers. I don't know whether the studio used to give negatives or if my father had asked for it, but the negative was found. Although some parts had been damaged by chemicals, printing a photo from the negative with a digital scanner is not a big deal now.

My father didn't get the chance to see this technology, but his grandchildren were born in the digital age. Every time they see this photo, they feel sad. One of them, who is more sensitive, said, "You didn't even have good clothes, uncle. Grandfather's sandals were torn too."

I never thought that we didn't have good clothes. That day, we went to the studio in our best outfits to take this photo. The shirt I was wearing was my school uniform shirt. Besides that, I only had one other shirt. Even though my father's sandals were torn in several places, he used to say there was no need to buy new sandals yet. He never admitted to having financial difficulties. I can't exactly recall how many more years he wore them after getting them stitched by the cobbler.


Thursday, 23 May 2024

Memories of My Father - Part 3

 


Excess was something I never saw at our home during my childhood. Our needs were so limited that I never felt a lack of anything. Somehow, even at a young age, I understood that my father worked hard day in, day out but earned very little. I remember one time, on the day of Chaitra Sankranti (last day of Bengali year), our father took my brother and me to a fair in a village about three miles away. In the morning, we walked there with great enthusiasm without any problems. 

We spent the whole morning licking ice cream on sticks and watching people shaking their heads like mad in front of a tall bamboo pole wrapped in red cloth. On the way back, the sun was scorching overhead. Father opened an umbrella over our heads, sweating profusely himself.

"I can't walk anymore, father, rickshaw..." I almost cried.

At that time, there weren't many rickshaws. After standing by the roadside under a tree for a long time, a rickshaw finally appeared. Father approached and spoke to the rickshaw puller. The rickshaw puller shrugged and left. While pedalling away, he turned back and gave us a contemptuous smile. I don't think I'll ever forget that smile. Rickshaws were a luxury for the wealthy back then. Those who couldn't afford it walked miles and miles.

Father came to me and said, "Get on my back."

I was five years old at the time, already attending school. The war had ended about a year before. The war had left my father destitute. When the long struggle for independence ended, my father's struggle began, to rise again from the ashes of our burnt-down home. War ages a person mentally. Without realizing it, we had learned to understand many things. I understood why father offered his back. My leg pain disappeared. We continued walking in the shade of father's umbrella.

Parents sacrifice their lives for a bit of comfort for their children. If that’s not enough, they resort to philosophical sayings. "Money, wealth, status—none of these are permanent. They can be taken away any day for any reason. Everything I had was looted and burned. But the one thing that can never be destroyed, stolen, or taken away is education. I may not be able to leave you money, wealth, or status. I couldn't get an education myself, but if you study, no one can ever take that away from you."

I don't remember what I felt hearing these words at that age. But now, whenever I recall them, I wonder in amazement—does true philosophy arise from deprivation?


Monday, 20 May 2024

Memories of My Father - Part 2

 


In our childhood and even in our adulthood, there was no tradition of celebrating birthdays. We didn't even remember when anyone's birthday was. The idea of birthdays came to mind during my university years. 

My father used to celebrate only one birthday with great festivity. It was the birthday of his guru, Adwoitananda. If we just said Adwoitananda, my father would be very displeased. He was very sensitive about his guru. We had to use many honorifics and say Sri Sri Srimad Adwoitananda Puri Maharaj. And for Maharajs, there aren't birthdays, but birth festivals. Yes, we had a festival at our house every year on the 4th of Jaishtha in the Bangla month. Later I found out that my father was also born on the same day. Even though we never told him, my siblings and I assumed that it was our father's birthday celebration. Although we never said it - happy birthday, father. These phrases were not as common then as they are now.

His financial situation was never very good. But for his Gurudev’s birth festival, he would arrange a feast with five types of vegetarian dishes for about four to five hundred people. There wasn't much space in our house. Our house was above our shop in the market, with the shop on the ground floor and us living upstairs. The feast was arranged at night on the street. People would sit on mats and food used to be served on banana leaves. 

At that time, only rickshaws and pushcarts used to travel on our street. When the street became busier, the market grew, and the guest control law was introduced, this festival was moved to the Kalibari temple. Later, my father himself stopped it. He didn't impose any responsibilities on his children.

The last time I saw him was in December 2005. When I was leaving home, he hugged me and said, "I don't know if we'll meet again. But you will always see me. I will be with you always." My father often used to say many philosophical things. I took it as one of those sayings. But now, day by day, I'm realizing that his words are gradually becoming true. As I age, my appearance is becoming more and more like my father's. When I stand in front of the mirror, I see him.


Sunday, 19 May 2024

Memories of My Father - Part 1

 



What I now understand by "library" was something different when I was young. Until ninth grade, I thought a library was a bookstore where books were sold. My father had a library, meaning he had a bookstore. It existed even before I was born. During the Liberation War, the Razakars burned everything to ashes. Despite being ruined, my father painstakingly rebuilt his store, and in one corner of it, he set up a small library. Thus, a significant part of my childhood and upbringing was filled with various school textbooks. Somehow, through browsing books, I learned to read. It’s not that I did nothing but read books all the time – quite the opposite. After engaging in all sorts of games and mischief, I sometimes had to sit in my father's library – as an assistant.

My curiosity began from there. Gradually, I read all the stories in the Bengali textbooks from grades one to nine, one after another. The ones I liked, I read repeatedly. The ones I didn't enjoy, I never looked at again. There was no obligation in reading for pleasure. 

However, when I entered high school, my father started a new trouble. At that time, the English Rapid Readers were not published by the board. Various publishers gave my father sample copies of English Rapid Readers for different grades. He would ask me to read those English stories. He himself had studied up to the fifth grade during the British era and didn’t recognize English letters properly, yet somehow, he knew which English book belonged to which grade. Reluctantly, I would spell out the words in the English stories. My father didn’t understand English, so I thought he would get frustrated and let me go. He would let me go, but not out of frustration. I would only be freed when a customer came to the shop.

After a few days, the second phase of trouble began. Now, I had not only to read the English stories but also translate them into Bengali. I didn’t know the meaning of all the English words. As for my father, there was no question of him knowing them. If I had to look up the dictionary repeatedly while reading, it would take all day, and I didn’t have that much time. The allure of going to the field to play football was greater than reading “The Boys and the Frogs.” So, if I didn’t know the meaning of a word, I started making up my own. Even if the story got distorted, I didn’t care. 

One day, I was reading "The Boy and the Wolf." The English sentence reading and Bengali sentence forming were going on in turn. When the liar shepherd boy’s cry of “Wolf, wolf” was found to be false, no one believed him when the real wolf came the last time. No one came forward to help him. The wolf ate him. The story ended. As I was closing the book and getting up to leave, my father asked, “Didn’t the boy’s father come forward when he cried out?”

“Why would he come?” I asked back. “He had come and gone back several times before, hadn’t he? The boy was lying.”

“Even if he was lying, couldn’t his father come one more time?” 

“Why would he? Who would believe a liar?”

“Even if no one else believes, his father should have. If he had come one more time, the boy’s life would have been saved. Even if the child lies, why wouldn’t a father respond to his call? What harm would it have done to believe once more? The boy’s life would have been saved. What kind of stories do they write?” 

At that time, I didn't understand my father's words. Now I do. It seems that all fathers in the world think like my father. Parents never lose faith in their children.


বাবা - ৬

 


বইপড়ার ব্যাপারটা ছোটবেলা থেকেই আমাদের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল অনেকটা নিজেদের অজান্তেই। তারজন্য কোন ধরনের আলাদা অনুপ্রেরণা কিংবা জোর কোনটাই ছিল না। স্মৃতিকে অতীতের দিকে যতদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যায় – নিয়ে গিয়ে দেখতে পাই – একেবারে ছোটবেলা থেকেই বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে আমরা বড় হয়েছি। কারণ আমার বাবার দোকানে বই বিক্রি হতো। মননশীল বা সৃজনশীল বইয়ের তালিকায় আমরা যেসব বই এখন অন্তর্ভুক্ত করি সেসব বই নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের স্কুল পাঠ্যবই বিক্রি করতেন আমার বাবা। 

সেই সময় স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি বই বিক্রির জন্য টেক্সট বুক অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হতো। সেই লাইসেন্স পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। আমার বাবা কীভাবে সেই লাইসেন্স পেয়েছিলেন জানি না, তবে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাঁশখালিতে আমার বাবাই ছিলেন একমাত্র লাইসেন্সধারী পাঠ্যপুস্তক বিক্রেতা। তিনি ঢাকা গিয়ে টেক্সট বুক অথরিটির কাছ থেকে বই নিয়ে আসতেন। বাঁশখালির অন্যান্য বইবিক্রেতারা আমার বাবার দোকান থেকে বই নিয়ে যেতেন। সেজন্য প্রচুর বই আসতো আমাদের দোকানে। আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে সেসব বইয়ের গাইট খুলতাম। আমি পড়তে শেখার আগে থেকেই বইয়ের পাতা উল্টে ছবি দেখতে শুরু করেছিলাম। তখনকার বইগুলিতে প্রচ্ছদ ছাড়া আর কোথাও রঙিন ছবি থাকতো না।  এখনকার শিশুরা অবশ্য আরো কম বয়স থেকেই কত সুন্দর সুন্দর রঙিন ঝলমলে বই নাড়াচাড়া করার সুযোগ পায়।  

বিভিন্ন ক্লাসের বিভিন্ন বিষয়ের বই হাতের কাছে ছিল বলে যা খুশি তা পড়ার সুযোগ ছিল আমাদের, এবং তা যথাসম্ভব কাজে লাগিয়েছিলাম। আমার বাবাকে আমরা দেখতাম প্রচন্ড ব্যস্ত। সপ্তাহের সাতদিনের মধ্যে কমপক্ষে চার-পাঁচদিন তিনি এখানে ওখানে আনাগোনা করেন। যে দু-তিন দিন বাড়িতে থাকতেন, দুপুরে ঘুমানোর সময় আমার হাতে যেকোনো ক্লাসের একটি বই ধরিয়ে দিয়ে পড়ে শোনাতে বলতেন। আমি খুব বাধ্যছেলে ছিলাম তা বলা যাবে না। আমি তক্কে তক্কে থাকতাম কখন বাবা ঘুমিয়ে পড়বেন আর আমি পালিয়ে যাব। দুই-তিন পৃষ্ঠা পড়তে না পড়তেই বাবা ঘুমিয়ে পড়তেন। তখন ভাবতাম বাবাকে বোকা বানানো কত সহজ। বাবা-মায়েরা যে ইচ্ছে করে সন্তানদের কাছে বোকা হয়ে থাকেন – তা বুঝেছি আরো অনেক পরে। 

সেইসময় ক্লাস সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসে বাংলা বইয়ের পাশাপাশি আরেকটি দ্রুতপঠনের বই ছিল। অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প থাকতো সেখানে। সব ক্লাসের গল্পগুলি আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল বাবাকে শোনাতে গিয়ে। বড় হয়ে যখন তাঁকে বোঝার চেষ্টা করলাম, পর্যবেক্ষণ করলাম – সহজেই বুঝতে পারলাম তাঁর গল্প শোনার ইচ্ছের চেয়েও বেশি ছিল আমাদের ভেতর পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দেয়া। 


বাবা - ৫

 


রাস্তার পাশে দূরত্বনির্দেশক মাইলফলকগুলি তেমন দেখা যায় না আজকাল। গুগলম্যাপের এই যুগে ওরকম মাইলফলকের গুরুত্বও নেই আর। কিন্তু আমরা যারা ছোটবেলায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছোটবেলার কাহিনি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি – তারা জানি রাস্তার এই মাইলফলক আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কী সম্পর্ক ছিল। আমার বাবা তাঁর নিজের ছোটবেলায় পড়াশোনা করতে না পারার জন্য যে আফসোস পুষে রেখেছিলেন তা সুযোগ পেলেই তাঁর ছেলেমেয়েদের দিয়ে পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন। তাঁর নিজের যখন বিদ্যাসাগর হবার আর কোন সুযোগ ছিল না, তিনি বিদ্যাসাগরের বাবা হবার চেষ্টা করতেন। তাতে তাঁর ছেলেমেয়েরা যে খুব একটা খুশি হতো তা নয়। আমি তো ভীষণ বিরক্ত হতাম জ্ঞানের কথাবার্তা বললে। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করলে ভ্রমণ বাতিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতো বলে বিরক্তি প্রকাশ করতাম না। বছরে একটি মাত্র ভ্রমণ বরাদ্দ ছিল আমাদের। বার্ষিক পরীক্ষার পর বাবার সাথে শহরে বেড়াতে যাওয়া। অনেক ভোরে বের হয়ে অনেক দূর হেঁটে গিয়ে তারপর রিকশা নিতে হতো। 

বিদ্যাসাগরের বাবা নাকি ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কত কিছু শিখিয়ে ফেলেছিলেন। যেমন রাস্তার মাইলফলক দেখিয়ে দেখিয়ে এক দুই তিন চার গুণতে শিখিয়ে ফেলেছিলেন। মাঝখানে একটি মাইলফলক দেখতে না দিয়ে গণিত গণনার পরীক্ষাও নিয়ে ফেলেছিলেন। আমার বাবাও একবার এই কাজটা খুবই পরিকল্পনা করে করতে চেয়েছিলেন আমাদের সাথে। কিন্তু আমাদের গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রধান রাস্তার পাশে মাইলফলক ছিল মাত্র কয়েকটি। আমাদের ছোট্ট ছরা পার হয়ে উত্তর দিকে কিছুদূর আসার পর একটি মাইলফলকে লেখা ছিল চাঁনপুর ১৬ মাইল। তারপর বেশ কয়েকটি ফলক উধাও হয়ে যাবার পর জলদি সিও অফিসের সামনে আরেকটি। ফলে সরাসরি গণনার পরীক্ষা নেয়া সম্ভব ছিল না তাঁর। কিন্তু পরীক্ষা বাতিল করে ছেলেদের শান্তি দেয়া তো বাবাদের কাজ নয়। তিনি অন্য উপায় বের করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত গজে এক মাইল?’ 

এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। কিছু না শিখেই আমি ক্লাস থ্রিতে উঠে গেছি। 

আমার বড়ভাই আমার দুই ক্লাস উপরে পড়ে, গণিতের মাথাও ভালো। সে-ই উত্তর দিলো – ১৭৬০ গজ। 

“এক গজে কতটুকু পথ?” আবার প্রশ্ন বাবার।

আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আকাশ লাল হয়ে সূর্য উঠা দেখতেই ভালো লাগছিল আমার। কিন্তু বাবা দেখলাম রাস্তায় পা দিয়ে একটা দাগ কেটে নিচু হয়ে নিজের হাত দিয়ে দুই হাত মেপে আরেকটা দাগ কাটলেন। বললেন, “এইটুকু দূরত্ব এক গজ। এবার তোরা এখানে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে দেখ – এক গজে তোদের কার কত ‘কাই’ হয়।“ ‘কাই’ হলো স্টেপ। আমি উৎসাহ নিয়ে মেপে দেখলাম আমার তিন কাইয়ে এক গজ হয়। বড়ভাই অতিউৎসাহে লম্বা কাই মেরে এক কাইয়ে এক গজ করার চেষ্টা করছে দেখে বাবা বললেন, “সারা রাস্তা ওভাবেই হাঁটতে হবে।“ তাতে দমলো সে। তার দুই কাইয়ে এক গজ। 

 ‘কাই’ মাপার পর নির্দেশ হলো – পরবর্তী মাইলফলক আসা পর্যন্ত আমাদের ‘কাই’ গুণতে হবে। আমার মোট কাইকে তিন দিয়ে ভাগ করলে জানতে পারবো কত গজ গেলাম। তারপর গজ থেকে মাইল। 

তারপর কত বছর ধরে কত দেশের কত রাস্তায় হেঁটে চলেছি। এখনো নিজের অজান্তেই ‘কাই’ গুণতে থাকি। এখন যেটাকে আমরা ক্যালিব্রেশান বলি – সেটাই আমার বাবা শিখিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের রাস্তায়। ক্লাস ফোর পাস মানুষটা। আমাদের বাবাটা। 


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts