Showing posts with label প্রতিক্রিয়া. Show all posts
Showing posts with label প্রতিক্রিয়া. Show all posts

Sunday, 14 November 2021

ডিজিটাল যুগ??

 

দেখিতেই পাইতেছেন ইহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করিবার নিমিত্তে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তি। যোগ্য প্রার্থীরা দরখাস্ত করিয়া নিয়ম মোতাবেক  যাহা যাহা করিতে হয় তাহা সম্পাদন করিয়া নিয়োগপত্র লাভ করিবেন। আমার জিজ্ঞাস্য সেইখানে নয়। আমার জিজ্ঞাস্য হইল - বাংলাদেশে বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতির সুবর্ণযুগ চলিতেছে বলিয়া বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হইতেছে - সেইখানে দরখাস্ত করিবার পদ্ধতি কী কারণে সেই আদিম যুগে থামিয়া রহিয়াছে? এই বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক দেখা যাইতেছে চাকরিপ্রার্থীকে প্রথমে কোন ব্যাংকে উপস্থিত হইয়া ৭৫০ টাকা মূল্যের পে-অর্ডার অথবা ব্যাক-ড্রাফ্‌ট সংগ্রহ করিতে হইবে। রেজিস্ট্রারের দপ্তরে উপস্থিত হইয়া নির্ধারিত ফরম সংগ্রহ করিতে হইবে। সেইখানে কী পরিমাণ অর্থমূল্য দিতে হইবে তাহা জানা নাই। তাহার পর দরখাস্ত পূরণ করিয়া তাহার আটটি কপি করিতে হইবে। দরখাস্তের সহিত পরীক্ষা পাসের সনদপত্র, প্রশংসাপত্র, নম্বরপত্র, অভিজ্ঞতার সনদপত্র যোগ করিতে হইবে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর এই চারটি পরীক্ষা পাসের চারটি করিয়া মোট ষোলটি সনদপত্র লাগিবে। এই ষোলটির প্রত্যেকটির আবার আটটি করিয়া কপি লাগিবে। তাহা হইলে মোট ১২৮টি পত্র তৈরি করিয়া সেইগুলিকে আবার সত্যায়িত করিতে হইবে। যিনি ১২৮টি কাগজে দস্তখত করিয়া সত্যায়িত করিবেন এবং সিলমোহর লাগাইবেন তাঁহাকে কীভাবে রাজি করাইবেন জানি না। ইহারপর এই বিশাল কাগজের বোঝা রেজিস্ট্রারের অফিসে পৌঁছাইতে হইবে। আমার জিজ্ঞাস্য হইল - আটকপি দরখাস্ত কী কারণে পাঠাইতে হইবে? অনলাইনে দরখাস্ত এবং সনদপত্র পাঠাইলে কি কর্তৃপক্ষ যত কপি খুশি দরখাস্ত ছাপাইয়া লইতে পারিত না? না কি কম্পিউটার ব্যবহার করিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আভিজাত্য লঙ্ঘিত হইবে??

Sunday, 29 August 2021

সংবাদ পাঠপ্রতিক্রিয়া - ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪

 


আমি তখন ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক করছিলাম। আমেরিকার জীবন খুব একটা ভালো লাগছিলো না। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলি তখন সবেমাত্র অনলাইনে আসা শুরু করেছে। সেগুলিই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম দেশের খবর জানার জন্য। মাতৃভূমির বাইরে অন্য যে কোন দেশেই যাই না কেন, থাকি না কেন - দেশ থেকে খুব বেশি দূরে যাবার উপায় থাকে না। সেই সময়ের প্রতিক্রিয়াগুলি খুঁজে পেলাম অনেকদিন পর। 

৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪

গত সপ্তাহে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে। এ নিয়ে বেশ রাজনীতি হচ্ছে এখন বাংলাদেশে। সংবাদপত্র পড়লাম। গতকালের প্রথম আলো পড়লাম। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এখন তদন্তে গেছে বাংলাদেশে। 

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার গোলাপবাগ রামনগর গ্রামের এমাজউদ্দিনের কিশোরী কন্যা ইয়াসমিন আক্তার ঢাকা থেকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে বাস থেকে নামার পরে পুলিশের এএসআই মইনুল হক, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও ভ্যানচালক অমৃতলাল বর্মন এগিয়ে আসে। বাড়িতে পৌঁছে দেবে বলে গাড়িতে তোলে ইয়াসমিনকে। তিনজনে মিলে তাকে ধর্ষণ করার পর খুন করে। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট তারিখে এই তিনজনের ফাঁসির আদেশ হয়। গত পরশু এই তিনজনের মধ্যে দুইজনের ফাঁসি হয়ে গেছে। অমৃতলাল এখনো বেঁচে আছে। সে নাকি প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমার আবেদন করেছে। 

আমাদের দেশের খবরগুলি একজন সুস্থ মানুষকে পড়তে দিলে সে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমরা হজম করছি কীভাবে? অনেক সময় দেখা যায় খাবার খেতে খেতেও পড়ছি এইসমস্ত খবর। খাদ্যের স্বাদও বদলে যাচ্ছে না। আমরা কি সুস্থ আছি? জীবাণুর আক্রমণ রেগুলার হতে হতে আমাদের সহ্যশক্তি বেড়ে গেছে। এই সহনশীল মানুষ কারা? আমরা যারা ভদ্রলোক নামক কিছু ক্লীব আছি - যারা ভালো ভালো কথা বলতে চেষ্টা করি, কিন্তু সমস্ত অন্যায় সহ্য করি। আমাদের এরকম সহনশীলতার কোন দরকার ছিল কি? 

প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার আরেকটি ছোট খবর এরকম: জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের জঙ্গলে এক গৃহবধূকে দেলোয়ার হোসেন ও লিটন মিয়া নামে দুইজন পুরুষ ধর্ষণ করার পর স্পাইনাল কর্ড কেটে দেয়, পায়ের রগ কেটে দেয়, গলা কেটে দেয়। গৃহবধূটি মরে না গিয়ে শরীরে পচন নিয়েও অপেক্ষা করেছে সাহায্যের। পুলিশ এসেছে। কারা ধর্ষণ করেছে জানা গেছে। কিন্তু তাদের কিছু হয়নি এখনো। ঐ পুরুষেরা তাদের পুরুষ শরীর নিয়ে পুরুষত্ব জাহির করে চলেছে। আমি নিজেও পুরুষ। আমার কিন্তু একটুও লজ্জা হচ্ছে না এজন্য। আমি কি সুস্থ আছি?

নওগাঁর মান্দা উপজেলার কাঁশোপাড়া গ্রামে বখাটে যুবকদের অত্যাচারে স্কুলশিক্ষিকা সেলিনা আক্তার আত্মহত্যা করেছেন। বখাটেরা আনন্দে আছে। তাদের পুরুষত্বের অস্ত্রে শান দিচ্ছে অন্য কোন সেলিনাকে টার্গেট করার জন্য। হোক না শিক্ষিকা, হোক না মন্ত্রী, মেয়ে তো! আমাদের দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দুই পার্টির দুই প্রধান হলেন মহিলা, নারী। তারপরও আমাদের দেশে নারীর উপর এত অত্যাচার কেন? 

সেলিনার আত্মহত্যা বিষয়ে সম্পাদকীয় লিখেছে প্রথম আলো। এরকম ঘটনায় প্রথম আলোতে আমিও একবার চিঠি লিখেছিলাম। এখন আর লিখি না। কারণ? কারণ মনে হচ্ছে আমি নিজেকে জাহির করার জন্যই লিখেছিলাম। কোন সামাজিক পরিবর্তনের আশায় নয়। কারণ পত্রিকায় চিঠি লিখে সামাজিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হলে সমাজ কত আগেই সোজা হয়ে যেতো। 

আমি নিজেও কত কিছু মেনে নিতে বাধ্য হই। আমার যে কোন ক্ষমতা নেই তা আমি জানি। সেলিনার উপর আমার রাগ হচ্ছে। রাগ হচ্ছে সিমির উপরও। রাগ আছে রহিমার উপরও। কারণ - মরেই যাবে সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছো, মেরেও তো মরতে পারতে। তাতে অন্তত কিছু কুকুর তো কমতো। সরি, কুকুর বলা ঠিক হয়নি। কুকুরের সম্মান তাদের প্রাপ্য নয়। কুকুররা টিজ করে না। কুকুরের সাধ্য নেই কোন কুকুরিকে ধর্ষণ করার। পারস্পরিক সম্মতিতেই পশুদের শারীরিক সম্পর্ক হয় বলে আমার ধারণা। 


 


Saturday, 18 April 2020

ছায়ামানবী: ইতিহাসের হাত ধরে মানুষের গল্প





স্কুলে পড়ার সময় যেসব ইতিহাস আমাকে পড়তে হয়েছিল সেগুলো আমি কখনোই পছন্দ করিনি। তার একটি কারণ হতে পারে আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক এবং পরীক্ষাপদ্ধতি। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর নাম, বাপের নাম এবং সন তারিখ মুখস্থ করানোটাই ছিল ইতিহাসের জ্ঞান মাপার মাপকাঠি। তারপর আমাদের দেশীয় রাজনীতির যে ইতিহাস আমাদের পড়ানো হয়েছিল – পরে জেনেছি সেগুলো ছিল বেশিরভাগই মিথ্যা। আমাদের  পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে। তাই সেরকম ইতিহাসের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মায়নি সেভাবে। পরবর্তীতে বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখেছি বিজ্ঞানের ইতিহাস আমার বেশ ভালো লাগছে। তার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসেরও কয়েকটা বই পড়ার পর মনে হলো – না ইতিহাস শুধু সন-তারিখ কিংবা চরিত্রগুলোর নামের মধ্যে সীমিত নয়। ইতিহাসের ঘটনা-পরম্পরা সামাজিক বিবর্তনের চলমান দলিল। ইতিহাস যে শুধু ইতিহাসের বইতে থাকে তা নয়, ইতিহাস আশ্রয় করে সৃষ্টি হয় কত গল্পের, কত উপন্যাসের। সেরকম একটি উপন্যাস ছায়ামানবী।

ছায়ামানবী উপন্যাসের লেখক অঞ্জন নন্দী। প্রফেসর অঞ্জন নন্দী। পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ, আবার দক্ষ প্রশাসক - সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ তিনি। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি সেমিনারে অঞ্জন স্যার তাঁর লেখা এই বইটি আমাকে দিয়েছেন স্নেহের স্মারক হিসেবে।




উপন্যাসের বিষয়বস্তু যদি ইতিহাস হয় এবং তাও আবার চারশ বছর আগের পর্তুগিজদের ইতিহাস  - ব্যাপারটা মোটেও সহজ থাকে না। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা কল্পনার ডানায় ভর করে উড়তে পারে, কিন্তু যে আকাশে উড়ছে সেই আকাশটা ইতিহাস অস্বীকার করতে পারে না। যে পটভূমিতে উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা দাঁড়ায় সেই পটভূমি ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত চরিত্র এবং ঘটনাগুলোর পরম্পরাতে সম্পৃক্ত। তাই লেখক এখানে দায়বদ্ধ থাকেন ইতিহাসের কাছে, সমসাময়িক স্থান-কালের বিজ্ঞানের কাছে। এই উপন্যাসে এই স্থান-কালের যুক্তিটা পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা হয়েছে। এখানেই লেখকের সার্থকতা।

মহসিন কলেজের পাহাড়ের চূড়ায় চারশ বছরের বেশি পুরনো পর্তুগিজ ভবনটা অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু তার ভেতর থেকে যে এমন একটা মানবিক প্রেম ও রাজনৈতিক গল্প বেরিয়ে আসতে পারে – তা ছায়ামানবী না পড়লে বুঝতেই পারতাম না। এই পর্তুগিজ ভবনের রহস্যঘেরা এক কাল্পনিক জগতে লেখকের সামনে কোন এক অলৌকিক প্রশ্রয়ে এসে পড়ে পর্তুগিজ ছায়ামানবী ইভা গনজালভেজ। এই তরুণী ইভার মাধ্যমেই আমরা জেনে যাই পুরো ঘটনা। একে একে আবির্ভুত হয় পর্তুগিজ দস্যু স্টিভ গনজালভেজ। বিয়ের আসর থেকে লুন্ঠন করে নিয়ে যাওয়া বাঙালি তরূণী স্বর্ণময়ীকে অপমান করার বদলে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দেয় স্টিভ। স্টিভ আর স্বর্ণময়ীর সন্তান ইভা।

মানুষ আর অমানুষের সংমিশ্রণ যে আমাদের প্রত্যেকের চরিত্রেই থাকে – লেখক সেই চিত্র একেঁছেন সুনিপুনভাবে এই উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রেই। এভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠে রবিন – ইভার প্রেমিক। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, গোয়া, কলকাতা – তথা এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও রাজনীতিতে পর্তুগিজদের যে ভূমিকা এবং সেখান থেকে আমাদের যে ফিরিঙ্গি সমাজ তৈরি হয়েছে – তার নিপুণ রেখাচিত্র হয়েছে এই উপন্যাসে। কল্পনা আর ইতিহাস মিলেমিশে এমন একটা টানটান বাস্তবতা তৈরি হয়েছে এখানে যাতে পড়ার সময় একবারও মনে হয়নি যে এটা লেখকের প্রথম উপন্যাস।

ঘটনার পাশাপাশি লেখক বিভিন্ন চরিত্রের জবানিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দর্শনও প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি লাইন এখানে উল্লেখ করা যায়:

বহুগামী শরীর যদি অপবিত্র হয় তবে পরশ্রীকাতর, লোভী, লাম্পট্যভরা মন কি অপবিত্র নয়?” – পৃষ্ঠা ৩৯

গোয়ায় রবিবার চার্চে যতো মানুষ যায় তার চেয়ে পতিতাপল্লীতে প্রতিদিন বেশি মানুষ আসা-যাওয়া করে। পৃষ্ঠা – ৪৬

একটা ঘর পুড়লে পাশের ঘরেও আগুন ছড়ায়, কিন্তু মনের ঘরে আগুন লাগলে, নিজেই পোড়ে, দোসর পায় না। পৃষ্ঠা -৪৮

মানুষ যত ক্ষমতাবান হয়, ততই সে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। একচ্ছত্র ক্ষমতা তাকে অন্ধ করে দেয়। চারপাশে সুখের মৌমাছি তোষামোদি শুরু করে। ফলে সে ভালোমন্দের পার্থক্য বুঝতে অপারগ হয়। পৃষ্ঠা - ৬৪

মানুষ বহুরূপী। তার মুখোশ পাল্টাতে সময় লাগে না। পৃষ্ঠা - ৬৮

মানুষ স্বার্থের ক্রীতদাস। সাপ শুধু নিজেকে রক্ষা করতে কাউকে ছোবল মারে। মানুষ সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর। স্বার্থের কারণে কাউকে দংশন করতে দ্বিধা করে না। পৃষ্ঠা - ১১৪

কুকর্মের স্বাক্ষী রাখতে নেই। পৃষ্ঠা - ১২৬

পথে নামলেই অচেনা পথ চেনা হয়ে যায়। নিজের প্রয়োজনেই মানুষ পথ চিনে নেয়। পৃষ্ঠা - ১৩৩

দুটো মানুষ সারাজীবন বিবাহিত জীবন কাটিয়েও হয়তো সুখী নয়। তাদের অজস্র যৌনস্মৃতি থাকতে পারে, কিন্তু তাদের দুই হৃদয়ের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। কেউ কাউকে ভালোবাসে না। সুখে থাকার অভিনয় করতে করতে অসুখী জীবনযাপনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। পৃষ্ঠা - ১৬০

সমসাময়িক ইতিহাসের কোন বিকৃতি ঘটেনি এই উপন্যাসে – সেটাই লেখকের বড় কৃতিত্ব। দুটো ব্যাপারে আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। যেমন - ইভা আর রবিনের বিয়ে হয় ২৪ জানুয়ারি ১৬৬৬। কিন্তু বলা হচ্ছে পরদিন খ্রিস্টানদের বড়দিন। এই তথ্যটি সঠিক নয়।  আরেকটি ব্যাপার ঘটেছে যখন স্টিভ গোয়ায় যায় ভাইসরয়ের সাথে দেখা করতে। সেই ঘটনা ঘটে ১৬৬৫ সালের দিকে। বলা হচ্ছে স্টিভকে থাকতে দেয়া হয়েছিল ডোনা পাউলা বিচের কাছে। আসলে ডোনা পাউলা বিচের নামকরণ হয়েছে আরো প্রায় একশ বছর পর। ডোনা পাউলা ছিলেন জাফনাপটনমের পর্তুগিজ ভাইসরয় -এর আত্মীয়। ডোনা ১৭৪৪ সালে গোয়ায় আসে। ১৭৫৬ সালে বিয়ে করে। ১৭৮২ সালে মারা যায়। স্টিভের জানার কথা নয় ডোনার কথা। অথচ স্টিভ ভাবছে ডোনা পাউলার কথা। উপন্যাসে ডোনাকে বলা হয়েছে একজন জেলের মেয়ে, বড় লোকের ছেলের প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। আসলে প্রচলিত কাহিনিটি ছিল উলটো। ডোনা বড়লোকের মেয়ে – প্রেম করেছিল একজন গোয়ানিজ জেলের ছেলের সাথে। (পৃ১১২)

এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়। প্রকাশ করেছে মুক্তধারা নিউইয়র্ক। মুদ্রিত হয়েছে চট্টগ্রামের দি অ্যাড কমিউনিকেশন থেকে। এমন চমৎকার ছাপা এবং কাগজ অনেকদিন কোন বইতে দেখিনি। দীপক দত্তের প্রচ্ছদ অসাধারণ – তবে প্রচ্ছদের ছায়ামানবীকে ভবিষ্যত পৃথিবীর কোন সাই-ফাই চরিত্র বলে মনে হয়, ইভা গঞ্জালভেসের সাথে মেলানো যায় না।

সবশেষে আমি লেখককে অভিনন্দন জানাতে চাই এই বলে যে ছায়ামানবীর মানবিক চারাগাছ বিকশিত হয়েছে পত্রপল্লবে। অভিনন্দন। 

Wednesday, 5 September 2018

আয়নাবাজি



 আয়নাবাজি দেখলাম। খুব ভালো লাগলো। বাংলাদেশের সিনেমা দেখে এত ভালো অনেকদিন লাগেনি। আমি  সিনেমাবোদ্ধা নই। সিনেমা দেখে বিজ্ঞজনোচিত সমালোচনা করার মতো পড়াশোনাও আমার নেই। আমি সিনেমা দেখি আনন্দ পাবার জন্য। বই পড়ে যেরকম আনন্দ পাওয়া যায়, কিংবা গান শুনে, খেলা দেখে, কিংবা দেশ-ভ্রমণে - সেরকম আনন্দ। বাংলাদেশের অনেক সিনেমা দেখে আমি আনন্দ যেমন পেয়েছি, তেমনি আবার অনেক সিনেমার পুরোটা দেখাও একটা বিরাট কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অমিতাভ রেজা চৌধুরির আয়নাবাজি দেখে খুবই আনন্দ পেলাম। কী যে ভালো লাগলো, মনে হচ্ছে আরো অনেকবার দেখলেও আনন্দ কমবে না একটুও।

কেন ভালো লাগলো এই সিনেমাটা? গল্প? নির্মাণশৈলী? চিত্রগ্রহণ? সংলাপ? চিত্রনাট্য? সংগীত? অভিনয়? এক কথায় বলা চলে সবকিছুই ভালো। তবে যদি একের পর এক লিখতে হয়, তাহলে সবচেয়ে প্রথমে লিখবো সংলাপ। বাংলা সিনেমায় এরকম স্বাভাবিক সংলাপ আমি অনেকদিন শুনিনি। হালকা থেকে ভারী সব সংলাপই প্রাণবন্ত। কয়েকটি উদাহরণ:

"হলিউড - এটা কি কাঠের দোকান?"
...
"আমার দুধের বাচ্চা কি জেল খাটতে পারবে? জেলখানায় কি এসি আছে?"
...
"আমি দৈনিক পত্রিকা পড়ি না।"
...
"ফাঁসি আয়নাদেরই হয়।"
...
"রাজনীতি তো সবচেয়ে বড় অভিনয়। দেশ একটা মঞ্চ। সামনে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ জনতা।"
...
"মালয়েশিয়া যেতে তো আমার কোন ভিসা লাগে না। অনেক জায়গা জমি কেনা আছে সেখানে।"




তারপর আসে অভিনয়। সব চরিত্রই অনবদ্য। চঞ্চল চৌধুরি সত্যিই আয়নার মতো অভিনয় করেছেন। যখন যে চরিত্র সামনে রাখা হয়েছে সেই চরিত্রই ফুটে উঠেছে আয়নায়। সিনেমার অভিনয় সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছেন - "সিনেমায় যদি কোন অভিনেতা ভাল অভিনয় না করতে পারেন, সেটা পরিচালকের দোষ। পরিচালক অভিনয় আদায় করে নিতে পারেননি, অথবা অভিনেতা নির্বাচন করতে ভুল করেছেন।" আয়নাবাজিতে পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরি প্রত্যেক অভিনেতার কাছ থেকেই যা চেয়েছেন আদায় করে নিয়েছেন। হলিউড স্টুডিওর ছোট্ট ছেলেটা থেকে শুরু করে সংলাপবিহীন পাগল চরিত্রটাও।

হৃদি চরিত্রটা সত্যিই হৃদয়ে গেঁথে যায়। যুক্তির কাঁচি দিয়ে কাটলে হয়তো টিকবে না কিছুই, কিন্তু পর্দায় হৃদি রূপে নাবিলার উপস্থিতি চারদিক স্নিগ্ধ করে দেয়। বাবা মেয়ের সম্পর্কটা কী যে সুন্দর সহজ আন্ডারস্ট্যান্ডিংটু বিউটিফুল টু বি ট্রু।

"সিংগেল লাইফ কেমন চলছে?"
"ওয়ান্ডারফুল।"
"ডাবল হবার ইচ্ছে আছে?"
"আপাতত নেই।"
"বাপের হোটেলে ক'দিন খাবি?"
"যতদিন বেঁচে আছি।"
"আর আমি ফুড়ুৎ করলে?"
"তখন একটা ভাতের হোটেল দেবো। নাম দেবো বাপের হোটেল।"

সাধারণ বাংলা সিনেমায় প্রেমের মুহূর্তগুলো বড় বেশি আরোপিত, বড় বেশি নাটকীয়। রোমান্টিক সংলাপগুলো যতটা রোমাঞ্চকর তার চেয়ে বেশি বিরক্তিকর। আর আয়নাবাজির মত অসাধারণ সিনেমায় মুহূর্তগুলোও অসাধারণ।

"কাপ অব ক্যাপাচিনো"
"কোন চিনি?"
... ... ...
"এরপর থেকে কোথাও গেলে আমাকে বলে যাবেন।"
... ......
"প্রতিদিন এখানে এসে দুপুরের খাবার খাবো।"
"তাই নাকি? কতদিন?"
"যতদিন নদী থাকে।"
............
"সকালে কখন ওঠ?" ... "তুমি আগে, না সূর্য?"
............
"আয়না পাগলা, আমার সাথে এসব চলবে না।"

সংলাপগুলো পড়লে মনে হয় কত সাধারণ, অথচ কী অসাধারণ রোমান্টিক মুহূর্ত তৈরি করেছেন চঞ্চল ও নাবিলা।

আর তাতে অনুঘটকের কাজ করেছে সংগীত। কী অপূর্ব সুরের কাজ অর্ণবের।

"ধীরে ধীরে যাওনা সময়
আরো ধীরে বও।
আরেকটুক্ষণ রওনা সময়
একটু পরে যাও।"




আয়না তার মায়ের সাথে কথা বলে; যে মা মারা গেছে অনেক বছর আগে। চরিত্রের এই অংশটা হিচককের "সাইকো"র নরম্যান বেইট্‌সকে মনে করিয়ে দেয়।

চলচিত্র সমালোচকদের অনেকেই সিনেমার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমার কাছে সিনেমা সিনেমাই - তথ্যচিত্র নয়। তাই ফাঁসির আসামী কীভাবে প্রতিদিন কারাগারের মধ্যে নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করতেন, নকল চুল-দাড়ি লাগাতেন তা নিয়ে প্রশ্ন আমি করি না। ক্ষমতাশালীদের হাত অনেক লম্বা। কিন্তু একটা অসম্পর্কিত অমূলক প্রশ্ন জাগে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরি বা মতিউর রহমান নিজামীদের মত ক্ষমতাশালীদের ঠিকঠাক ফাঁসি হয়েছে তো?

পুলিশ অফিসারের অতি-নাটকীয় সংলাপ "বিসিএস সেকেন্ড, পুলিশের চাকরি এমনি এমনি করছি না..." শুনে একটু হাসি অবশ্য পেয়েছে। বিসিএস সেকেন্ডদের এত ক্ষমতা!

সিনেমায় কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে - যাতে চোখে পানি এসে যায়। কখনো আনন্দে, কখনো বেদনায় মুহূর্তগুলো দেখতে দেখতে আমি কাঁদি। আয়নাবাজি দেখে কান্না আসেনি কোন দৃশ্যেযদিও গানের এই লাইনটা বড়ই সুন্দর - "জানি জীবন গল্পে অনেক ধাঁধা, একটু হাসি অনেক কাঁদা।"

অনেক অস্কার পুরষ্কার পাওয়া ছবিও দেখার সময় মাঝে মাঝে মনে হয় - ছবিটা শেষ হচ্ছে না কেন? আবার এমন অনেক ভালো লাগা সিনেমা আছে দেখতে দেখতে মনে হয় - সময় থেমে যাক। আয়নাবাজি দেখতে দেখতে তার গানের মতোই মনে হয়েছে, 

"ধীরে ধীরে যাও না সময়
আরো ধীরে বও।
আরেকটুক্ষণ রও না সময়
একটু পরে যাও।।"

Tuesday, 28 August 2018

জসীমউদ্দীন মন্ডলের জীবনের রেলগাড়ি




কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডলের "সংগ্রামী স্মৃতিকথা" 'জীবনের রেলগাড়ি' প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে। একজন সংগ্রামী শ্রমিক নেতা যখন ৮৮ বছর বয়সে স্মৃতিকথা লেখেন, তখন পাঠক সাধারণত আশা করেন যে ইতিহাসের একটা সময় সেখানে ধরা থাকবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। সেই ইতিহাস যে লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হবে সেটাও পাঠক জানেন। তবুও পাঠক আগ্রহ নিয়ে সে লেখা পড়েন - লেখকের হাত ধরে সময়-ভ্রমণ করার জন্য।
            
একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আগ্রহ নিয়ে আমি বইটি পড়েছি কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল তাঁর সংগ্রামী স্মৃতিগুলোকে কীভাবে স্মরণ করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন এবং কী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি জীবনকে দেখেছেন তা জানার জন্য। ১৯২৪ থেকে ২০১২ - ৮৮ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি সংগ্রাম করেছেন ব্রিটিশ সরকারের সময়, তারপর পাকিস্তান, তারপর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন একজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। তাই তাঁর স্মৃতিকথা - শুধু স্মৃতিকথা নয় কিছুতেই - এটা ইতিহাসের প্রতিফলক হবারও দাবিদার ছিল।
            
মাত্র ১৬ বছর বয়সে রেলগাড়িতে উঠেছেন জসীমউদ্দীন রেলইঞ্জিনে কয়লা ঢালার  শ্রমিক হিসেবে। সেই সময় - ১৯৪০ সালে মাইকিং করে রেলওয়ের শ্রমিক নিয়োগ করা হতো। কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনকার তুলনায় অনেক সহজ ছিল বলা চলে। শিয়ালদহ স্টেশনে গোরা সাহেবের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়ে কাজ পেয়ে গেলেন তিনি। মাসিক বেতন ১৫ টাকা। আর বেতন পাবার দিন থেকেই 'লাল ঝান্ডা' পার্টি তাঁর কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে এক টাকা চাঁদা। হিসেব করে দেখুন বেতনের শতকরা প্রায় সাড়ে ছয় ভাগ পার্টির চাঁদা দিতে হয়েছে সেই ১৯৪০ সালে।
            
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেছিল জার্মানি আর জাপানকে। জাপান যখন এশিয়ায় আগ্রাসন চালাচ্ছিল - এমনকি বার্মা পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল তখনো পার্টি সমর্থন করছে জাপানকে, জার্মানির হিটলারকে। সেটা শুধুমাত্র তখনই বদলালো যখন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলো।
            
তারপর ১৯৪৭। দেশ ভাগের পর জসীমউদ্দীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন রেলওয়ের চাকরির অপশন নিয়ে। ইংরেজ চলে গেলেও তখনো ইংরেজ কর্মকর্তা কাজ করছিলেন পাকিস্তানের অনেক জায়গায়। রেলের অনেক ড্রাইভারও ছিলেন ইংরেজ। এই ইংরেজ ড্রাইভারদের বেতন দেয়া হতো ইওরোপিয়ান গ্রেডে। সেই সময় ১৯৪৯ সালেই রেলওয়ে শ্রমিক থেকে শ্রমিকদের নেতা হয়ে ওঠেন জসীমউদ্দীন। শুরুটা খুবই ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেব থেকে। ১৯৪৯ সাল। দুর্ভিক্ষের আলামত দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান সরকার এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্য-চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে চালের অভাব। ট্রেন-ইঞ্জিনের শ্রমিক হিসেবে জসীমউদ্দীন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যান ট্রেন নিয়ে। আনমুরা থেকে তিনি চাল কিনে নিয়ে আসতেন ঈশ্বরদীতে। কাজটা ছিল বেআইনী। একদিন এরকম তিন মণ চাল রেলের ইঞ্জিনে করে নিয়ে আসার সময় সরকারের মিলিশিয়া বাহিনী সেই চাল জব্দ করে নিয়ে যায়। জসীমউদ্দীন মন্ডলের নেতৃত্বে রেলওয়ে শ্রমিকেরা ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। দাবি আদায় হয়। চাল ফেরত দেয়া হয়। শুধু তাই নয় - রেলওয়ে শ্রমিকেরা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চাল নিয়ে যেতে পারবে সেই অনুমতিও দেয়া হয়। জসীমউদ্দীন মন্ডল নেতা হয়ে যান।
            
তারপর এই কাজের জন্য তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু সমস্যা হয়নি। তাঁর যে চাল নিয়ে আসার পারমিট ছিল সেটা ব্যবহার করে তিনি চালের ব্যবসা শুরু করেন। ট্রেনে করে চাল নিয়ে আসেন বিভিন্ন জেলা থেকে  এবং তা বেশি দামে বিক্রি করেন দুর্ভিক্ষের বাজারে। এবং তখনো তিনি শ্রমিক নেতা।
            
১৯৪৯ সালে তিনি খুদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই খুদ আন্দোলন হয়েছিল রেলওয়ে শ্রমিকদের চালের বদলে খুদ দেয়াকে কেন্দ্র করে। রেলওয়ে শ্রমিকেরা মুরগি নয়, তারা খুদ খাবে না। তাদের চাল দিতে হবে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়। তিনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন অনেকদিন। তাঁকে সহায়তা করেছেন পার্টির কর্মীরা। একদিন ধরা পড়েন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত পাঁচ বছর জেলে ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। তারপর থেকে ধরতে গেলে তিনি পার্টির মাসোহারাতেই চলেছেন। তিনি শ্রমিক না হয়েও শ্রমিকনেতা ছিলেন এবং পার্টির নির্দেশে শ্রমিক সংগঠন করে গেছেন।
            
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। এত বড় শ্রমিক নেতা - দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে - সেখানে সম্পৃক্ত হননি সেভাবে এটা খুবই আশ্চর্যের। আসলে সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তা কোথাও তিনি পরিষ্কার করে লেখেননি। সেই ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে বর্ণনা কমরেড জসীমউদ্দীন দিয়েছেন তা এতটাই বিক্ষিপ্ত আর এতটাই পার্টি নির্দেশিত যে তা পড়ে খুবই হতাশ হতে হয়। জ্যোতিবসুর কথা তিনি লিখেছেন বার বার। মৌলানা ভাসানীর কথা লিখেছেন বার বার। আক্ষরিক অর্থেই তিনি মৌলানা ভাসানীর পা টিপেছেন তাও লিখেছেন, আইয়ুব খানের কথা লিখেছেন, ফাতেমা জিন্নাহ্‌র কথা লিখেছেন, অথচ একটি বারের জন্যও শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করেননি। যেন সেই মানুষটি কখনোই ছিল না তাঁর "সংগ্রামী" সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুদের আতিথ্যে বেশ আরামেই ছিলেন। স্বাধীনতার পর যথাসময়ে ফিরেও এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু একটি বারও বঙ্গবন্ধুর নাম না নিয়ে, একটি বারের জন্যও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা উচ্চারণ না করে "সংগ্রামী স্মৃতিকথা" লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একবারের জন্যও মুক্তিযোদ্ধা না বলে বলেছেন "প্রতিরোধ বাহিনী"। এটাই যদি তাঁর পার্টির আদেশ হয়ে থাকে - তাহলে বইতে "মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো" অধ্যায়টি না থাকলেই মনে হয় ভালো হতো।

স্বাধীন বাংলাদেশে এসে তিনি একবার মস্কোও গিয়েছিলেন। সেই বর্ণনাও আছে। তাঁর নিজের ছেলে যে বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে চোরাচালানী হয়েছে এবং সে কারণে তিনি তার ছেলের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেননি তাও আছে। কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল আজীবন পার্টির হুকুম তামিল করে গেছেন অন্ধ আনুগত্যে। বইয়ের শেষের দিকে তিনি ঠিকই লিখেছেন, "সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনের পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি, পাওয়ার পাল্লাটি শূন্য। বঞ্চনার পাল্লাটি ভারি হয়ে আছে বেশি। তবুও হতাশ হতে মন চায় না। এ যেনো এক কঠিন নেশা, সুতীব্র আকর্ষণ, যা উপেক্ষা করে থাকা কখনো সম্ভব নয়।" - এখানেই সমস্যা আমার মতো সাধারণ পাঠকের। যারা মনে করে কঠিন নেশা মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তোলে, বিপজ্জনক করে তোলে।  সেটা যদি রাজনৈতিক নেশা হয় - তাহলে তো আরো বিপজ্জনক।

Tuesday, 31 July 2018

ধোঁকাবাজির নাম তান্ত্রিকশক্তি


অন্ধবিশ্বাস আমাদের সমাজের সকল অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অবস্থানের মধ্যেই উপস্থিত আছে। এক্ষেত্রে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে মোটামুটি সর্বজনীন বলা চলে। কয়েকটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিও অন্ধবিশ্বাসের ডোবায় আটকে আছেন অনেক ব্যাপারে। তাঁরা সবাই কোন না কোন বিশ্বাসের ব্যাপারে অন্ধ এবং মজার ব্যাপার হলো এই - অনেক ব্যাপারে তাঁরা যে স্ববিরোধীতায় ভোগেন তা নিজেরাই বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না।

বাংলাদেশের হিন্দুধর্মাবলম্বী অনেক তরুণ-তরুণীকে ইদানীং থলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মালা জপতে দেখা যাচ্ছে। হাতে ভাগ্য-ফেরানোর পাথর বসানো আংটির সংখ্যা আঙুলের চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে। লাল-কালো-গোলাপী সুতার পাহাড় জমে যাচ্ছে কব্জিতে। অনেকেই নাকি নিয়মিত 'একাদশী' পালন করে। উপবাস আর নিরামিষ খাবারের ব্যাপারে এরা এতটাই উগ্র যে কিছু কিছু পরিচিত পরিবারে দেখলাম এ নিয়ে একটা নতুন ধরনের পারিবারিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মা-বাবা মাছ-মাংস খেতে অভ্যস্ত ছিলেন। সেখানে ছেলেমেয়েরা ঘোষণা দিচ্ছে তারা অমুক অমুক 'বাবা'র অনুসারী, সুতরাং অমুক অমুক বারে তারা বিশুদ্ধ নিরামিষ খাবে। মাছ-মাংস তারা নিজেরা তো খাবেই না, বাড়িতেও ঢুকতে দেবে না। যদিও তারা নিজেরা উপার্জন করে না, সংসারও নিজেদের নয়, কিন্তু বাবা-মা তো নিজের। বাংলাদেশের সব মা-বাবাই তো সন্তানের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গীকৃত। তা ছাড়া ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে বিশ্বাসী মাত্রেই দুর্বল। এই দুর্বলতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।




কিন্তু অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তথাকথিত গুরুরা মন্ত্রশক্তির যে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদেন তা যে কী পরিমাণ ভন্ডামি তার কিছু নমুনা দেখুন:














তান্ত্রিক শক্তি বনাম বিজ্ঞান। পন্ডিত সুরিন্দর শর্মা বনাম Rationalist International এর প্রেসিডেন্ট সানাল অ্যাডমারাকু। যুক্তি যদি সঠিক হয় - তাহলে ফল কী হবে তা দেখার জন্য বসে থাকতে হয় না। জানাই ছিল যে সুরিন্দর শর্মার মন্ত্রশক্তি কিছুই করতে পারবে না স্যান্যালকে। যেরকম হওয়া স্বাভাবিক - সেরকমই হলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কয়েকটি ব্যাপার এখানে অবশ্যই উল্লেখ করার দরকার আছে। ব্যাপারগুলো আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও - আসলে এখানেই লুকিয়ে থাকে মারাত্মক সব প্রতারণার কৌশল।

সুরিন্দর শর্মা তান্ত্রিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য যে চ্যালেঞ্জটি দিয়েছিলেন তা হলো তিন মিনিটেই তিনি সানালকে মেরে ফেলতে পারবেন শুধুমাত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে। তারপর তিন মিনিটের জায়গায় প্রায় কয়েক ঘন্টা ধরে যা করলেন তা নিছক ভাওতাবাজীর চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাতে যে মন্ত্রগুলো তিনি উচ্চারণ করলেন - তার কয়েকটি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ শ্রী শ্রী চন্ডী থেকে নেয়া। যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ এ মন্ত্রটি উচ্চারিত হয়েছে অনেকবার। বাকি যেগুলো তার বেশিরভাগই অর্থহীন কিছু সংস্কৃতরূপ শব্দাংশ।

যা দেবী সর্বভূতেষু ... মন্ত্রটি আসলে অনেকবার করে লেখা আছে চন্ডীতে। দেবদেবীরা ভীষণ আত্মপ্রেমী। তাঁদের খুব করে প্রশংসা না করলে তারা সন্তুষ্ট হন না। তাই এই মন্ত্রগুলোতে দেবী দুর্গার নানারকম প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি শক্তিরূপে বিরাজ করেন, তিনি মাতৃরূপে বিরাজ করেন, তিনি দেবী রূপে বিরাজ করেন ইত্যাদি। এখানে পন্ডিত সুরিন্দর শর্মা সেই শক্তিরূপী দেবীর প্রশংসাসূচক মন্ত্র পাঠ করে যুক্তিবাদী সানালকে খুন করতে চেয়েছেন। পন্ডিতের সাহস আছে বটে। কিন্তু আসলেই কি তিনি নিজে শুধুমাত্র মন্ত্রশক্তির উপর বিশ্বাস রাখেন? মোটেই না। মন্ত্র হলো সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। আসল খুন করার জন্য সুরিন্দর শর্মারা বস্তুজগতেরই আশ্রয় নেন। তাঁরা বিষ প্রয়োগ করেন, সুযোগ পেলে ছুরি চাপাতি বন্দুক বোমা সবই ব্যবহার করেন।

অনুষ্ঠানটি দেখার সময় আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে সুরিন্দর শর্মার একটি হাত সবসময় স্যান্যালের মাথায় চোখে কপালে ঘুরছিল। সানাল বাধা দেয়াতে সুরিন্দর এটাকেই তার মন্ত্রের নিস্ফলতার কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছে। হাতে ক্লোরোফর্ম ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণ করেন অনেক সময় এই সব তান্ত্রিকরা - অনেকটা আমাদের দেশের অজ্ঞানপার্টির মতো।

আবার রাতের বেলা যে যজ্ঞ করা হলো তাতে যে ধোঁয়া তৈরি করা হলো তাও বিপজ্জনক। যেকোনো বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে নেয়া অসম্ভব নয়। আবার সে ধোঁয়া একটি পাখার মত জিনিস দিয়ে সানালের নাকের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছিলো। টিভি স্টুডিওতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সানাল যে সুযোগ পেয়েছেন সবকিছু পরীক্ষা করে নেয়ার - বাইরের সুরিন্দর শর্মাদের পরিবেশে তা সম্ভব নয়। সেখানে সুরিন্দর শর্মারা যে কী কৌশল অবলম্বন করতে পারে তার জন্য প্রস্তুত না থাকলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

সুরিন্দর শর্মারা যুক্তিবাদীর চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত। এবং তারা নির্লজ্জ মিথ্যাবাদী। অনুষ্ঠানেই তো দেখলেন কত অজুহাত দেখালেন। তিন মিনিটের জায়গায় কয়েক ঘন্টা চেষ্টা করেও কিছু করতে না পেরে বললেন যে সানাল নিশ্চয়ই কোন দেবতায় বিশ্বাস করেন - এবং সেই দেবতা সানালকে রক্ষা করছেন। শেষ পর্যন্তও কিন্তু সুরিন্দর স্বীকার করেননি যে তার মন্ত্রের কোন জোর নেই। এক্ষেত্রে তাদের অজুহাতের শেষ নেই। কিছুদিন পর হয়তো বলা হবে - ঈশ্বর চান না যে তাঁর সৃষ্টির কোন ক্ষতি করা হোক। তাই ক্ষতি করতে গেলে তা কাজে লাগে না। কিন্তু উপকার করতে - যেমন রোগমুক্তি, লটারিতে ভাগ্য ফেরানো ইত্যাদি - মন্ত্রশক্তির তুলনা নেই।

স্বামীর নপুংশকতার কারণে যাদের সন্তান হয় না তারা অনেক সময় তান্ত্রিক সাধকদের দ্বারা সন্তান লাভ করেন। কীভাবে করেন তা না বোঝার কোন কারণ নেই। তান্ত্রিকরা বেশির ভাগ দাড়িগোঁফের জঙ্গলে নিজেদের চেহারা আড়াল করে রাখেন শুধুমাত্র ধরা পড়ার ভয়ে। সবকিছু জানার পরও, সমস্ত প্রমাণ দিয়ে অন্ধবিশ্বাসের অসারতা দেখানোর পরেও কিছু কিছু মানুষ অন্ধবিশ্বাসেই আগ্রহী।

অন্ধবিশ্বাস আমাদের সমাজের সকল অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অবস্থানের মধ্যেই উপস্থিত আছে। এক্ষেত্রে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে মোটামুটি সর্বজনীন বলা চলে। কয়েকটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিও অন্ধবিশ্বাসের ডোবায় আটকে আছেন অনেক ব্যাপারে। তাঁরা সবাই কোন না কোন বিশ্বাসের ব্যাপারে অন্ধ এবং মজার ব্যাপার হলো এই - অনেক ব্যাপারে তাঁরা যে স্ববিরোধীতায় ভোগেন তা নিজেরাই বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না।

পরিস্থিতি যখন এই - আমরা কীভাবে এগোব? বা আমাদের কী করা দরকার? আসলে এর সোজা কোন উত্তর আমার জানা নেই। আমাদের লেখাপড়া করা দরকার। মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা দরকার। আমাদের নতুন প্রজন্মকে অন্ধবিশ্বাসের কালো ছায়া থেকে রক্ষা করা দরকার। কীভাবে? নিজের ভেতর অন্ধবিশ্বাসের বীজ রেখে কি তা সম্ভব? খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজের ভেতরের বিশ্বাস অবিশ্বাসকে আবিষ্কার করা একেবারেই অসম্ভব। একমাত্র সঠিক জানার মধ্য দিয়েই অজানাকে জয় করা সম্ভব। অলৌকিক ভাবে কিছু ঘটতে পারে না এ ব্যাপারটা বোঝাতে পারলেই কাজ হয়ে যায়। কিন্তু বড়ই কঠিন এ কাজ, বড়ই সময়সাপেক্ষ। কিন্তু তাতে কী? আমাদের কি হাল ছাড়লে চলে? 

Saturday, 28 July 2018

বিগ ব্যাং -এর জনক বাইবেল!!!


. রস, আপনি দাবি করছেন বিগ ব্যাংসহ সবকিছুই বাইবেলে আছে। তাহলে ঈশ্বর যে ছয়দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন বলে বাইবেলে বর্ণিত আছে তার কী হলো? বিগ ব্যাং তো একবারই ঘটেছে এবং তা থেকে জীবনের সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত বিলিয়ন বছর লেগে গেছে। আর যে কোন কিছু বৈজ্ঞানিকভাবে আবিষ্কৃত হবার পরেই আপনারা তা বাইবেলে খুঁজে পান, আবিষ্কারের আগে পান না কেন?






ড. হিউ রস














Friday, 13 July 2018

এ আঁধার কাটবেই


২০০২ সালের ২৩ জুলাই গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে ভিসি আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরির আদেশে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বে পুলিশ ঢুকে বেধড়ক পিটিয়েছে ছাত্রীদের। পরের দিন ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদমুখর হলে তাদের উপর আবার হামলা করা হয়। শিক্ষকরাও বাদ যাননি। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই সময়ের প্রতিক্রিয়া। 





ভিসি আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরি








Monday, 9 July 2018

প্রাপক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস




শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের সন্তান সুমন জাহিদ মারা গেছেন ১৪ জুন ২০১৮। আমরা এখনো নিশ্চিত নই তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে। তিনি কি আত্মহত্যা করেছেন, না কি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে আমরা জানি না। চির-প্রতিবাদী সুমন জাহিদ জীবনে প্রতিবাদ করেছেন, লড়াই করেছেন কত ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে ডক্টর ইউনূস যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন - সেই সময়ের কিছু ঘটনা ধরা রয়েছে এই পুরনো লেখায় - যেখানে আছে সুমন জাহিদের প্রসঙ্গ।



প্রাপক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
প্রদীপ দেব



স্যার,

বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি দুটো খোলা চিঠি লিখে আপনি নাগরিক শক্তি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির খোলনলচে পালটে দিয়ে একটি সম্পুর্ণ নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের লক্ষ্যেই আপনার এই প্রয়াস। আপনার এই মহান প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

আপনার নোবেল পুরস্কার পাবার সাথে সাথে সারা বাংলাদেশ একাত্ম হয়ে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, আনন্দে গর্বে এভারেস্ট শৃঙ্গে উঠে গেছে, সমস্ত রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে নোবেল জয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। কিন্তু আপনি নিশ্চয় খেয়াল করেছেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সে উচ্ছ্বাস বিভক্ত হয়ে গেছে। কারণ নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনূস সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য হলেও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ডঃ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা সবার কাছে সমান নয়।

১১/০২/২০০৭ তারিখে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের প্রতি আপনি চিঠি লিখে আপনার রাজনৈতিক দল গঠন করার পক্ষে বিপক্ষে মতামত চেয়েছেন। আপনি লিখেছেন, আপনার কাছে আমি এই চিঠিটি লিখছি এর জবাবে আপনার কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে একটি চিঠি পাওয়ার আশায়। আপনার মতো মানুষকে ব্যক্তিগত চিঠি লেখার সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কয়েক লক্ষ মানুষ সে মহান সু্যোগ গ্রহণ করে আপনাকে চিঠি লিখেছেন, ইমেইল করেছেন ও এসএমএস পাঠিয়েছেন। এর সবগুলো আপনি নিজেই পড়েছেন এরকম অবাস্তব চিন্তা করা উচিত নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় হলে তা আপনার কর্মীরা নিশ্চয় আপনাকে দেখিয়ে থাকবেন।

১৪/০২/২০০৭ তারিখের দৈনিক সংবাদে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের সন্তান সুমন জাহিদের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। আপনাকে লেখা এ খোলা চিঠিটি আমার কাছে মনে হয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে আপনার যোগাযোগের ঠিকানাকে মারাত্মক ভুল বলা হয়েছে। 

সুমন জাহিদ লিখেছেন, আপনার পাঠানো খোলা চিঠি যা ১১-২-২০০৭ইং সব দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করেছে, সেখানে ঠিকানায় মারাত্মক ভুল আছে। আপনারা প্রচার করেছেন যোগাযোগের ঠিকানা:

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
হাল মারস
৬/ডি, ৬৬ আউটার সার্কুলার রোড
মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।

অথচ আউটার সার্কুলার রোড নামে ঢাকা সিটি করপোরেশন-এর নথিতে এখন আর কোন সড় কের নাম উল্লেখ নেই (এই নামে কোন রোড নেই)। পুরনোটা ছিল ৬৬, বড় মগবাজার। গত ২০-৩-২০০২ইং তারিখে সিটি করপোরেশনের এক আদেশ (২১১১/প্রঃবিঃ/৪০০) বলে মৌচাক মোড় হতে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তাটিতে এবং এর উভয় পার্শ্ব শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক নামে নামকরণ করা হয় এবং সেই সঙ্গে উভয় পাশের সব হোল্ডিং নম্বরও পরিবর্তন হয়। আপনাদের বর্তমান হোল্ডিং নং- ৫, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক। এই ভুলটা সম্ভবত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকতে পারে। তবে এর সংশোধনটা অতি জরুরি। ১৩-১২-২০০৬ইং দৈনিক প্রথম আলো নারীমঞ্চ পাতা পড়লেই এ ব্যাপারে আপনার সব তথ্য পাবেন। আশা করি স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহীদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করবেন। 

আশা করেছিলাম এ ব্যাপারটি আপনার নজরে আসবে। কিন্তু আপনার পরের চিঠিতেও (২২/২/২০০৭) যখন আপনি আপনার পুরনো ঠিকানাই ব্যবহার করেছেন বুঝতে পেরেছি সুমন জাহিদ সহ আমরা যে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি আপনার কাছে তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে কি সুমন জাহিদের দেয়া তথ্য সঠিক নয়?

২২/২/২০০৭ তারিখে নাগরিকের প্রতি আপনি আপনার রাজনৈতিক দল গঠন করার ঘোষণা দিয়ে যে চিঠিটি লিখেছেন সে প্রসঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। যাঁরা আপনাকে রাজনীতিতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন তাঁদের আপনি বলেছেন, আল্লাহই মানুষকে সম্মান দেন। সম্মান নিতে হলে তাঁকেই নিতে হবে। আপনার এরকম যুক্তি মুক্তচিন্তার পরিপন্থি। যে কলুষিত রাজনীতিকে বিশুদ্ধ করার ইচ্ছায় আপনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করছেন সে কলুষিত রাজনৈতিক দলগুলোর বেশির ভাগ দূষিত নেতাই কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেন। নিজেদের ব্যর্থতার দায় অলৌকিক সৃষ্টিকর্তার ওপর চাপিয়ে দেয়া অতি পুরনো পদ্ধতি। সে পদ্ধতি আপনাকে মানায় না।

প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে আপনি লিখেছেন, আপনারা যে যে দেশে আছেন সেখানে সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তুলুন। আপনাদের কর্মস্থলে কিংবা বাড়িতে কার্যালয় স্থাপন করুন। যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করুন। ইন্টারনেটে যোগাযোগ, মতবিনিময়ের এবং মত প্রচারের যত ব্যবস্থা আছে তার সদ্ব্যাবহার করুন। দেশে আপনার নিজের গ্রামে বা শহরে সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ নিন। সম্ভব হলে একবার সপ্তাহ বা দুসপ্তাহের জন্য দেশে এসে ঘুরে যান। নিজের এলাকায় গিয়ে সংগঠন সৃষ্টি করে দিয়ে আসুন। তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার নিশ্চয়তা দিন। নিজের এলাকার সৎ ও যোগ্য প্রার্থী চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের নাগরিক শক্তিতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করুন। আমাদের সঙ্গে ই-মেইলে ক্রমাগত যোগাযোগ রাখুন এবং আপনাদের কাজের বর্ণনা দিন। আমাদের প্রতি পদে পদে পরামর্শ দিন। সম্ভব হলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পর্যন্ত চাকরি কিংবা ব্যবসা যে কাজেই থাকুন না কেন, ছুটি নিয়ে দেশে চলে আসুন। আপনার নিজের হাতেই দেশের নতুন রাজনীতি গড়ার গৌরব অর্জন করার এখনই সুযোগ। বোঝা যাচ্ছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মত আপনিও প্রবাসীদের কাজে লাগাতে চাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাদের ভোটাধিকার প্রশ্নে আপনারও মাথাব্যথা নেই। ভোট দিতে হলে প্রবাসীদের দেশে গিয়ে ভোটার হতে হবে, ভোট দিতে হবে। আপনি লিখেছেন কর্মস্থলে আপনার রাজনৈতিক দলের কার্যালয় স্থাপন করার জন্য। কাজটি কতটুকু সমর্থনযোগ্য?

আপনার দলের হয়ে কাজ করার জন্য দীর্ঘ ছুটি নিয়ে দেশে চলে যেতে আহবান করেছেন প্রবাসী কর্মজীবীদের। রাজনীতি করার জন্য ছুটি চাইলেই কি দিয়ে দেবেন কর্তৃপক্ষ? যাঁরা দেশের ভেতরেও এলাকার বাইরে কর্মরত আছেন তাঁদের উদ্দেশ্যেও আপনি লিখেছেন, সম্ভব হলে কর্মক্ষেত্র থেকে কয়েক মাস দীর্ঘ বিরতি নিয়ে বাড়ি চলে যান। দেশে বা বিদেশে কোথাও কি সম্ভব এটা? আজ গ্রামীণ ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা যদি বলেন যে রাজনৈতিক কাজের জন্য দীর্ঘ ছূটি চাই দেয়া হবে তাঁকে? নাগরিক শক্তির কাজে হয়তো দেয়া হতে পারে। কিন্তু তিনি যদি হয়ে থাকেন আওয়ামি লিগের বা বিএনপির সমর্থক?

এখানেই নোবেল বিজয়ী আর রাজনীতিবিদের পার্থক্য। রাজনীতি করতে গেলে যে অনেক ওজনহীন কথা বলতে হয়, বলা হয়ে যায় তা তো আমরা আপনার দল গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই দেখতে পাচ্ছি। আমরা এখনো জানিনা আপনার আদর্শের সাথে অন্যান্য দলের আদর্শের পার্থক্য কোথায়। সব দলেই ভালো ভালো আদর্শের কথা থাকে। সে কথা কেউ রাখেনা। আপনি আপনার কথা রাখবেন এ আশা আমাদের।

একটা ছোট্ট প্রশ্ন আমাদের মনে জেগেছে। তা হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশে থেকেও আপনি শহীদ মিনারে যাননি। কেন? 


০২ মার্চ, ২০০৭।
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts