Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ২২



ম্যাক্স বর্নের সাথে রামনের তাত্ত্বিক বিরোধ

এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফিতে ম্যাক্স বর্ন ও রামনের মধ্যে তাত্ত্বিক বিরোধ পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ম্যাক্স বর্ন ছিলেন রামনের চেয়ে বয়সে ছয় বছরের বড়। ১৯৩৫ সালে স্যার রামন যখন ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ডিরেক্টর ছিলেন, তখন ম্যাক্স বর্নকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন ইন্সটিটিউটে। ম্যাক্স বর্ন ১৯৩৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৩৬ সালের মে পর্যন্ত ব্যাঙ্গালোরে ছিলেন। ম্যাক্স বর্নের জন্য স্থায়ী প্রফেসর পদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন রামন, কিন্তু কাউন্সিলের বাধার মুখে সফল হননি। তা সত্ত্বেও ম্যাক্স বর্নের সাথে রামনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতদ্বৈততার কারণে ক্রমে তাঁদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়।
            ১৯১২ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়াল্টার ফ্রেডরিক, পল নিপিং এবং ম্যাক্স ভন লাউ আবিষ্কার করেন যে ক্রিস্টালের ভেতর দিয়ে এক্স-রে প্রবেশ করালে এক্স-রের অপবর্তন (diffraction) ঘটে। পরবর্তীতে পিটার ডিবাই এই ঘটনার জন্য তাপের ফলে উৎপন্ন কম্পনকে দায়ি করে তত্ত্ব দেন। কিন্তু খুব বেশি আলোচনা হয়নি এব্যাপারে অনেক বছর। ম্যাক্স বর্ন এই তত্ত্বের ওপর আরো কাজ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে এই পারমাণবিক ঘটনার তত্ত্ব দাঁড় করান। ব্যাঙ্গালোরে ম্যাক্স বর্ন এই তত্ত্ব সম্পর্কে বেশ কিছু লেকচার দেন। কিন্তু রামন ম্যাক্স বর্নের তত্ত্বকে অস্বীকার করেন। রামন তাঁর এক্স-রে ডিফ্রাকশানের পরীক্ষায় যে ফলাফল পেয়েছেন তা ম্যাক্স বর্নের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।


ব্যাঙ্গালোরে ম্যাক্স বর্ন, হেইডি ও লোকম

 রামন নিজেই একটা তত্ত্ব দিলেন। রামনের মতে এই ডিফিউশান ঘটছে তাপীয় তরঙ্গের ফলে নয়, বরং ক্রিস্টালের গঠনের কারণেই। কোন একটি নির্দিষ্ট দিকে ক্রিস্টালের ইলেকট্রন-ডেনসিটির দোলনের ফলে এই ডিফিউশান সৃষ্টি হচ্ছে। রামন বেশ কিছু পেপার প্রকাশ করলেন এসময়। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উইলিয়াম ব্র্যাগও পেপার লিখলেন রামনের পরীক্ষামূলক ফলাফল ব্যাখ্যা করে। তিনিও ম্যাক্স বর্নের তত্ত্বকে সমর্থন করলেন না। তিনি বললেন ক্রিস্টালের গাঠনিক জ্যামিতির কথা, যা মূলত রামনের তত্ত্বকেই সমর্থন করে।
            পরবর্তী এক যুগ ধরে এই বিতর্ক চলতে থাকলো। রামন ইন্সটিটিউটের গবেষণাগারে তখন একটার পর একটা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন হীরার ওপর এক্স-রে প্রয়োগ করে। শুধু হীরা নয়, তিনি সালফার, ফসফরাস ও কোয়ার্টজের ওপর এক্স-রের পরীক্ষা করেও একই রকম সিদ্ধান্তে এলেন।
            কিন্তু সমস্যা হলো রামন তাঁর সব ব্যাখ্যা করেছেন ক্ল্যাসিক্যাল ফিজিক্স দিয়ে। অন্যদিকে ম্যাক্স বর্নের তত্ত্ব ছিল কোয়ান্টাম মেকানিক্স নির্ভর এবং খুব বেশি জটিল গাণিতিক। সেই তত্ত্বের গণিত বোঝার মতো গাণিতিক দক্ষতা রামনের ছিল না। রামনের ইন্সটিটিউটেও কেউ ছিলেন না যিনি রামনের পরীক্ষার ফলাফল কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। আরো একটা বড় সমস্যা হলো রামনের ব্যক্তিত্বে। তিনি নির্ভর করেছেন শুধুমাত্র তাঁর নিজের এবং তাঁর ছাত্রদের প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর। ইওরোপের অন্য কোন ল্যাবে কী রেজাল্ট পাওয়া যাচ্ছে এবং অন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা কী কী বলছেন তাকে কোন গুরুত্ব দিলেন না রামন। ফলে রামন মনে করলেন যাঁরা তাঁর তত্ত্বকে অস্বীকার করছেন তাঁরা ইচ্ছে করেই এটা করছে। রামনের কাছে তাঁরা সবাই হয়ে গেছেন 'ওয়েস্টার্নারস'।
            আর ইওরোপ আমেরিকার বিজ্ঞানীরা যখন বুঝতে পারলেন যে রামন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল তত্ত্ব বুঝতে পারছেন না তখন তাঁরাও রামনকে কটাক্ষ করতে শুরু করলেন। যেমন আরভিন স্রোডিংগার রামনকে আখ্যা দিলেন 'superb faculty of non-understanding'[1] স্রোডিংগার ম্যাক্স বর্নকে বললেন যে রামনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তিনি বুঝতে পারবেন না। রামন যে বর্নের তত্ত্ব একেবারেই বুঝতে পারেননি এটা ঠিক নয়। কিন্তু ম্যাক্স বর্ন তাঁর তত্ত্বের সাহায্যে পরীক্ষামূলক ফলাফলকে হিসেব করে বের করতে অনেক বেশি প্যারামিটার ব্যবহার করেছিলেন যে - যে কোন পরীক্ষণ-পদার্থবিজ্ঞানীরই মনে হবে এটা জোড়াতালি দিয়ে প্রমাণ করা।
            রামন ও ম্যাক্স বর্ন কেউই নিজের অবস্থান থেকে নড়লেন না। অনেক বছর ধরে বিতর্ক চলতেই থাকলো। রামন শেষের দিকে পুরো ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে ধরে নিলেন। ১৯৪৮ সালে রামন-ইফেক্ট আবিষ্কারের বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফ্রান্সের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রামনের সম্মানে একটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। সেখানে ম্যাক্স বর্নের সাথে রামনের দেখা হয় আবার। রামন খুবই অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা বলেন বর্নের সাথে। কিন্তু একদিন পরেই রামন ম্যাক্স বর্নের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং কথাবার্তা বন্ধ করে দেন।
            তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী ও পরীক্ষণ-পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই সবসময় থাকে। তত্ত্বীয় বিজ্ঞানীরা যত তত্ত্বই আবিষ্কার করুক, পরীক্ষার মাধ্যমে যদি তা প্রমাণিত না হয় তাহলে সেই তত্ত্বের কোন দাম নেই। আবার কোন একটা পরীক্ষামূলক আবিষ্কারের পেছনে কী তত্ত্ব কাজ করছে তা ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত না হলে সেই আবিষ্কারও প্রতিষ্ঠা পায় না। রামন তাঁর পরীক্ষণে যে ফল পেয়েছেন তা ম্যাক্স বর্নের তত্ত্ব দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিলো না। তাই রামন বলেছেন বর্নের তত্ত্ব ভুল। রামন নিজে একটা তত্ত্ব দিয়েছেন। তখন বর্নসহ অনেক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী শ্লেষাত্মক সুরে বলেছেন পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো।
            ১৯৫৬ সালে লিন্ডাউ সম্মেলনে ম্যাক্স বর্নের সাথে আবার দেখা হয় রামনের। সেই মিটিং-এ রামন বর্নের সাথে প্রথমদিন বেশ হাসিখুশি থাকলেও দ্বিতীয় দিন থেকে আর কথা বলেননি।
            ১৯৬৩ সালে কোপেনহেগেনে ল্যাটিস ডায়নামিক্স সংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেসে ম্যাক্স বর্নের তত্ত্বকেই সঠিক বলে স্বীকার করেন অনেক বিজ্ঞানী। কিন্তু সেই কংগ্রেসে রামনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
            অবশ্য রামন সেই সময় নিজেকে বাইরের পৃথিবী থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছিলেন। কোন ধরনের আমন্ত্রণ নিতেও তিনি মানা করেছিলেন তাঁর সেক্রেটারিকে। তাই কনফারেন্স কমিটি হয়তো তাঁকে আমন্ত্রণ করতে চেয়েও করতে পারেননি।


লোকমের দেয়া শাড়িতে মিসেস বর্ন




[1] Rajinder Singh, Max Born's Role in the Lattice Dynamic Controversy, Centaurus, Vol 43, 2001, pp. 260-277

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts