Friday, 30 September 2022

জান বাটিস্ট পাহ্‌রান - নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী

 


জান বাটিস্ট পাহ্‌রান (Jean Baptiste Perrin) ছিলেন খ্যাতনামা ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দশক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির যে তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। সেজন্য ১৯২৬ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি।

১৮৭০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের লিলে শহরে জন্ম হয়েছিল জান বাটিস্ট পাহরানের। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত ইকল নরমাল সুপেরিয়র ইউনিভার্সিটিতে। ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত তিনি সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণাসহকারী হিসেবে কাজ করেন। সেই সময় জার্মানিতে রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেছেন। পুরো ইওরোপজুড়ে তখন এক্স-রে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গেছে। পাহ্‌রানের ল্যাবেও তখন এক্স-রে ও ক্যাথোড রে নিয়ে চলছে তুমুল গবেষণা। এই গবেষণার ভিত্তিতে ১৮৯৭ সালে থিসিস লিখে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন পাহ্‌রান।

ডিএসসি অর্জন করার পর পরই তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে যোগ দেন। ১৯১০ সালে তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এই পদে তিনি ছিলেন ১৯৪০ সাল পর্যন্ত।

পাহ্‌রানের প্রথম দিকের গবেষণা ছিল ক্যাথোড রশ্মি সংক্রান্ত। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে ক্যাথোড় রশ্মিগুলি মূলত নেগেটিভ চার্জবিশিষ্ট কণা –  আমরা এখন জানি যে ওগুলি আসলে ইলেকট্রনের প্রবাহ। ১৮৯৭ সালের আগে ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হয়নি। এক্স-রে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন তিনি। গ্যাসের ভেতর এক্স-রে চালনা করলে  প্রবাহে কী ধরনের পরিবর্তন হয়, তা তিনি বের করেন। শব্দের পরিচলন নিয়েও গবেষণা করেছিলেন তিনি।

কিন্তু তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হলো ব্রাউনিয়ান গতি সংক্রান্ত গবেষণা। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর একটি গবেষণাপত্রে [On the Motion of small Particles Suspended in Liquids at Rest Required by the Molecular-Kinetic Theory of Heat, Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭(১৯০৫), পৃষ্ঠা ৫৪৯-৫৬০] ব্রাউনিয়ান গতি (Brownian Motion) সম্পর্কে আলোচনা করলেন। কোন তরল পদার্থের ওপর খালি চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট ছোট পদার্থের কণা ভাসতে থাকলে কণাগুলোর গতি কোন নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের গতি হয় অত্যন্ত অনিয়মিত। আঠারো শতকে স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী  ব্রাউন এ গতি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এ গতির নাম দেয়া হয়েছে ব্রাউনিয়ান গতি। আইনস্টাইন এই গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেন যে এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের একভাগের সমান বা তার চেয়েও ছোট কণাগুলো তরল পদার্থে ওরকম বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করার কারণ হলো তাদের থার্মাল ডায়নামিক্স। বোল্টজম্যানের সূত্র ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন এবং গ্যাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুগুলোর গতির গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

পাহ্‌রান আইনস্টাইনের এই তত্ত্বীয় গবেষণার ভিত্তিতে পরীক্ষাগারে ব্রাউনিয়ান গতির পরীক্ষা করে দেখেন। তাঁর পরীক্ষার ফলাফল থেকে তিনি সঠিকভাবে এভোগাড্রো সংখ্যার মান নির্ণয় করতে সক্ষম হন। এই গবেষণার জন্য তিনি ১৯২৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।

বিজ্ঞানী পাহ্‌রানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ। পরবর্তীতে সেখানে গবেষণা করে ফ্রান্সের অনেক বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

১৯৩৮ সালে ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্স-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রফেসর জান পাহ্‌রান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন জান পাহ্‌রান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৪০ সালে যখন হিটলার ফ্রান্স আক্রমণ করলো, সত্তর বছরের বৃদ্ধ পাহ্‌রানের আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

১৯৪২ সালের ১৭ এপ্রিল নিউইয়র্কেই মৃত্যু হয় বিজ্ঞানী জান পাহ্‌রানের। ১৯৪৮ সালে ফরাসি সরকার জান পাহ্‌রানের দেহাবশেষ নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসে নিয়ে এসে দেশের মাটিতে সসম্মানে সমাহিত করার ব্যবস্থা করে।



এনরিকো ফার্মি - পদার্থবিজ্ঞানের পোপ

 



মহাবিশ্বে যতগুলি কণা (particle) আছে, তাদের সবগুলিকে প্রধানত দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগের নাম বোসন, অন্যভাগের নাম ফার্মিয়ন। বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বের সাথে জানি – এই বোসন নামটা এসেছে সত্যেন বসুর নাম থেকে। বোস থেকে বোসন। তেমনিভাবে, অন্যভাগের নামটা এসেছে এনরিকো ফার্মির নাম থেকে। বোসন কণাগুলি পাউলির বর্জননীতি (Pauli’s exclusion principle) মেনে চলে না। অর্থাৎ একই পরমাণুর মধ্যে তাদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্র হতে হয় না। যেমন আলোর কণা ফোটন; একই শক্তিসম্পন্ন হলে, একটি ফোটন থেকে অন্য ফোটনকে আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না। কিন্তু ফার্মিয়নের ব্যাপার আলাদা। ফার্মিয়ন কণাগুলি খুবই শ্রেণিবিভাজন মেনে চলে। যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন কিংবা নিউট্রন। একই পরমাণুর একই শক্তিস্তরে থাকলেও, তাদের প্রত্যেকের কোয়ান্টাম সংখ্যায় কোনো না কোনোভাবে পার্থক্য থাকতে হয়। কণার এই বিভাজনের ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি এবং ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক যখন কণাগুলির জন্য ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। এর তিন বছর আগে ১৯২৪ সালে আমাদের সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে স্বয়ং আইনস্টাইনের সাথে মিলে আবিষ্কার করেন বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স।

ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মিকে তাঁর সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানীরা বলতেন “পোপ অব ফিজিক্স”। রোমান ক্যাথলিকরা যেমন তাঁদের পোপকে সকল ধর্মীয় সমস্যার সমাধান মনে করেন, তেমনি পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মনে করা হতো – এনরিকো ফার্মির কাছেই আছে সকল সমস্যার সমাধান।

পদার্থবিজ্ঞানের – বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে এনরিকো ফার্মির হাতে। আজ আমরা নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ মাপতে দৈর্ঘ্যের খুব ছোট একটা একক ব্যবহার করি – যার নাম ফার্মি ( ১ মিটারের ১০০০০০০০০০০০০০০০ ভাগের এক ভাগ; ১ এর পর পনেরটা শূন্য)। নিউক্লিয়াসের ফিশান প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন ফার্মি। তিনিই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিটাক্ষয়ের (beta decay)। প্রথম পারমাণবিক বোমার অন্যতম কারিগর ছিলেন এনরিকো ফার্মি। তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর। আজ পৃথিবীর প্রয়োজনীয় জ্বালানির একটি বড় অংশের জোগান আসছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এরজন্য যে মানুষটাকে আমাদের প্রতিদিন স্মরণ করা উচিত তিনি – এনরিকো ফার্মি।

১৯৩৮ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিজম থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যেতে হয়েছিল এনরিকো ফার্মিকে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, গবেষণা করেছেন লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে।

খুব বেশিদিন বাঁচেননি এই বিজ্ঞানী। ১৯০১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইতালির রোমে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ১৯৫৪ সালের ২৮ নভেম্বর মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন পাকস্থলীর ক্যান্সারে। পারমাণবিক বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করতে করতে নিজেই শিকার হয়েছেন তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়।

তাঁর মৃত্যুর পর আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি তাঁর নামে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার প্রবর্তন করে – এনরিকো ফার্মি পুরষ্কার। প্রথম পুরষ্কারটি এনরিকো ফার্মিকেই দেয়া হয় মরণোত্তর। একশতম মৌলিক পদার্থের নামকরণ করা হয় – ফার্মিয়াম। আমেরিকার প্রধান একটি জাতীয় গবেষণাগারের নাম রাখা হয় – ফার্মি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি।


তথ্যসূত্র:

1. World Book's Biographical Encyclopedia of Scientists, World Book, Chicago, 2003. 

2. Gino Segre and Bettina Hoerlin, The Pope of Physics Enrico Fermi and the birth of the atomic age, Henry Holt and Company, New York, 2016. 



Tuesday, 20 September 2022

মহাবিশ্বের রহস্য এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

 




‘আকাশভরা সূর্যতারা’ দেখেনি পৃথিবীতে এমন মানুষ মেলা ভার। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলেই মেঘহীন আকাশে তারা ঝকমক করতে শুরু করে। বুদ্ধিমান মানুষ, কৌতূহলী মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই অপার বিস্ময়ে আকাশের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি যেমন দেখছে, তেমনি গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনেক প্রাকৃতিক ঘটনারই রহস্য উন্মোচন করে ফেলেছে। মহাবিশ্বের মহাজাগতিক ঘটনাবলি বৈজ্ঞানিক উপায়ে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করার যে জ্যোতির্বিজ্ঞান – তার ইতিহাস অনেক পুরনো। খালি চোখে মকাকাশ পর্যবেক্ষণ করার আদি সময় আমরা পার হয়ে এসেছি গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও যখন আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কার করে ফেললেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের আকাশে নতুন সূর্যোদয় হলো। এর আগের প্রায় আড়াই হাজার বছরের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার ধরন বদলে গেল গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের মাধ্যমে।

পরবর্তী কয়েক শ বছরের মধ্যে একের পর এক তৈরি হতে থাকলো আরো অনেক শক্তিশালী টেলিস্কোপ। টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য তৈরি হলো অবজারভেটরি বা মানমন্দির। পৃথিবী থেকেই এসব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীতে বসানো টেলিস্কোপ যত শক্তিশালীই হোক, তাদের কিছু গুণগত সীমাবদ্ধতা কিছুতেই দূর করা সম্ভব হয়নি। যেকোনো টেলিস্কোপের প্রধান কাজ হলো মহাকাশ থেকে আসা আলো অনুসন্ধান করে শনাক্ত করা এবং সেই আলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা। সুদূর মহাকাশ থেকে আলো পৃথিবীতে আসার সময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে বিভিন্ন ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল মহাকাশের আলোর কিছু অংশ শোষণ করে ফেলে। আবার কিছু অংশ পৃথিবীর ধূলিকণার গায়ে লেগে বিক্ষিপ্ত হয়। আলোর স্ক্যাটারিং থিওরি বা আলোর বিক্ষেপণের তত্ত্ব থেকে আমরা জানি যে আলোর বিক্ষেপণের ফলেই দিনের বেলায় পৃথিবীর আকাশ নীল দেখায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে মহাকাশের মহাজাগতিক ঘটনাগুলি নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কোটি আলোকবর্ষ দূরের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসতে আসতে উজ্জ্বলতা হারায়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে দীপ্তমান তারাগুলিও মিটমিট করতে থাকে পৃথিবীর আকাশে। ফলে মহাকাশের অনেক রহস্যই অধরা থেকে যায় পৃথিবীতে স্থাপিত সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপগুলিতেও। অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে সেখানে টেলিস্কোপ স্থাপন করেও এই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হয়নি।

এতসব অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসংখ্য আবিষ্কার, মহাবিশ্বের অসংখ্য রহস্যের সমাধান পৃথিবীতে স্থাপিত টেলিস্কোপের মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা করে ফেলেছেন। তাতে আনন্দ যেমন আছে, অতৃপ্তিও আছে। অতৃপ্তি হলো যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল প্রেরণা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয়েছে স্যাটেলাইট যুগ। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে কৃত্রিম স্যাটেলাইট পাঠাতে শুরু করে। শুরু হয় মহাকাশকে জানার নতুন পদ্ধতি। ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এর মাধ্যমে স্থাপিত হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরেকটি নতুন যুগ – স্যাটেলাইট টেলিস্কোপের যুগ।

প্রায় ১৩ মিটার লম্বা ও ৪.৩ মিটার চওড়া এগারো টন ভরের হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘন্টায় প্রায় সাতাশ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে গত বত্রিশ বছর ধরে। প্রতি সপ্তাহে হাবল টেলিস্কোপ প্রায় ১৫০ গিগাবিট ডাটা পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। হাবল টেলিস্কোপের পাঠানো ডাটা থেকেই আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে ১৩৮০ কোটি বছর আগে। হাবল টেলিস্কোপের ডাটার সাহায্যে আমরা প্রমাণ পেয়েছি ব্ল্যাকহোলের। বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন বিশালাকৃতির ব্ল্যাকহোল। হাবল আমাদের খুঁজে দিয়েছে অনেকগুলি নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা। হাবল টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দিয়েছে আশ্চর্য গতি। এপর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে হাবলের সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে।

কিন্তু এটুকুতে খুশি হয়ে বসে থাকা বিজ্ঞানীদের কাজ নয়। হাবল টেলিস্কোপের যেটুকু দুর্বলতা আছে – সেটুকু দূর করে মহাকাশে আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ স্থাপনের পরিকল্পনা বিজ্ঞানীরা করছেন অনেক বছর থেকে। যেমন হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি ঘুরছে বলে অনেক সময় পৃথিবী নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় হাবল টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। আবার হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার সময়ে ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশান বেল্টের একটা অংশের কাছ দিয়ে যায়। তখন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হাবল টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতিতে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ সৃষ্টি করে যা ডাটা সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটায়। হাবল টেলিস্কোপের ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার অতিদূর নক্ষত্র থেকে আসা ক্ষীণতম আলো থেকে যে ছবি নির্মাণ করে – তা খুবই অনুজ্জ্বল আর অস্পষ্ট। এসব ত্রুটি দূর করে সম্পূর্ণ নতুন একটি স্যাটেলাইট নির্মাণ করে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে যার নাম জেমস ওয়েব।

২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর জ্যোতির্বিজ্ঞানে শুরু হয়েছে নতুন বিপ্লব। সেদিন পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও অনেক গুণ শক্তিশালী নতুন টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। হাবল টেলিস্কোপের সাথে জেমস ওয়েবের গঠনে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। হাবল টেলিস্কোপের আকার যদি একটি পঞ্চাশ সিটের বাসের সমান হয়, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আকার একটি টেনিস কোর্টের সমান। হাবলের দর্পনের ব্যাস  ২.৪ মিটার, জেমস ওয়েবের দর্পণের ব্যাস ৬.৫ মিটার। হাবলে যে ক্যামেরাগুলি আছে সেগুলি অতিবেগুনি আলো, দৃশ্যমান আলো এবং নিয়ার-ইনফ্রারেড বা কাছের অবলোহিত আলোর তরঙ্গ শনাক্ত করে ছবি তুলতে পারে। জেমস ওয়েবের ক্যামেরাগুলি কাজ করে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোকতরঙ্গে। হাবল টেলিস্কোপ যেখানে পৃথিবী থেকে ৫৪৭ কিলোমিটার দূরে থেকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, সেখানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে – চাঁদের অক্ষের কাছাকাছি দূরত্বে। এর ফলে মহাকাশের অনেক ভেতরে চোখ রাখা সম্ভব হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের।

মহাকাশে পূর্বনির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করার পর গত ছয় মাস ধরে চলছিল প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষাগুলোর বিভিন্ন ধাপ। এখন সেসব ধাপ সফলভাবে পার হয়ে মূল বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। শুরুতেই বিশ্বব্যাপী হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। ত্রিশ বছর আগে হাবল টেলিস্কোপ যেরকম হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল মহাকাশের নতুন নতুন তথ্য ও ছবি দিয়ে – সেরকম আরো অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব বিশ্ববাসীকে উত্তেজনায় টান টান করে দিয়েছে তার প্রথম কয়েকটি ছবি প্রকাশিত হতে না হতেই।

এবছরের ১২ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম চারটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে প্রস্তুতির পর এক হাজার কোটি ডলারের টেলিস্কোপ – জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে যে উদ্দেশ্যে – সেই উদ্দেশ্য সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে। প্রথম প্রকাশিত ছবিগুলি থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এতদিন আগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাকাশের যেসব চিত্র আবছা দেখা গিয়েছিল – এবার তা স্পষ্ট হলো। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ছবিগুলি হাবল টেলিস্কোপের ছবিগুলি থেকে দুই থেকে তিন গুন বেশি স্পষ্ট।

ঠিক কী কী বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য ঠিক করে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে? বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যগুলিকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম লক্ষ্য হলো একেবারে শৈশবের মহাবিশ্বের স্বরূপ উদ্ঘাটন। বিগ ব্যাং এর পর থেকে প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলির আলোর সন্ধান করতে পারলে বোঝা যাবে কীভাবে এই গ্যালাক্সিগুলির উৎপত্তি হয়েছিল। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো গ্যালাক্সিগুলির বিবর্তন অনুসন্ধান। প্রথম যুগের গ্যালাক্সিগুলি থেকে বর্তমান যুগের গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে কী কী বিবর্তন হয়েছে, এবং কীভাবে হয়েছে। তৃতীয় লক্ষ্য হলো নক্ষত্রগুলি কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে  – একেবারে প্রথম পর্যায় থেকে শুরু করে তাদের গ্রহ-উপগ্রহসহ নক্ষত্রজগতের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে তা খুঁজে বের করা। আর চতুর্থ লক্ষ্য হলো আমাদের সৌরজগতসহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলির বিভিন্ন ভৌত এবং রাসায়নিক ধর্মাবলি পরীক্ষা করে দেখা। এবং আমাদের পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।

পৃথিবীর কাছাকাছি হওয়াতে  হাবল টেলিস্কোপ সরাসরি আমাদের সূর্যের দিকে তাকাতে পারে না। ফলে সূর্যের কাছের গ্রহ বুধ, ও শুক্রের খুব বেশি তথ্য হাবল সরাসরি সংগ্রহ করতে পারেনি। জেমস ওয়েবের সেই সীমাবদ্ধতা নেই। আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলিকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আছে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের শক্তিশালী ক্যামেরাগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এগুলি ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করতে পারে এবং সেই আলোতে ছবি তুলতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো অবলোহিত আলোকরশ্মি শনাক্ত করার দরকার কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আলোর পদার্থবিজ্ঞান কিছুটা বুঝতে হবে। আলোর গতিবেগ  শূন্য মাধ্যমে যে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বা তিন লক্ষ কিলোমিটার তা আমরা জানি। আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে – আলোর শক্তি তার কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। আলো যখন কোন উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে একই মাধ্যমে চলতে থাকে, তখন এর গতিবেগের কোন পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু আলোক তরঙ্গ হলো তড়িৎচূম্বক তরঙ্গ, যার কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য একে অপরের বিপরীত অনুপাতিক। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি বেড়ে যায়, কম্পাঙ্ক কমে যায়। হাবল টেলিস্কোপ থেকে আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্ব যখন প্রসারিত হচ্ছে, একই সাথে আলোর তরঙ্গও প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে সময়ের সাথে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর সবচেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে লাল আলোর, আর সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য হচ্ছে বেগুনি আলোর। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গেলে তা হয়ে পড়ে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো। এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তির সীমানার বাইরে। অর্থাৎ অবলোহিত আলো আমরা দেখতে পাই না।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে গিয়ে লাল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় রেড শিফ্‌ট। আবার তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে গিয়ে বেগুনি বা নীল বর্ণের দিকে সরে যাওয়াকে বলা হয় ব্লু শিফ্‌ট। এই রেড শিফ্‌টের পরিমাণ হিসেব করে জানা যায় মহাবিশ্ব কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে, এবং সেই সময়ে আলো কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছে। সেই দূরত্বের হিসেব থেকে সময়ের হিসেব বের করা যায়। আলো এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার যায়। সে হিসেবে আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে সেই দূরত্বকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ। এখন কোন একটি নক্ষত্র যদি পৃথিবী থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে থাকে, সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে এক বছর। যেমন সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এই সময়কে আলোর গতি দিয়ে গুণ করলে আমরা সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বের করতে পারি। একই ভাবে আমরা বলতে পারি – পৃথিবী থেকে যখন আমরা সূর্যকে দেখি তখন আসলে দেখি আট মিনিট বিশ সেকেন্ড অতীতের সূর্য। অনুরূপভাবে আমরা বলতে পারি আকাশভর্তি যেসব সূর্য-তারা আমরা দেখি সেগুলি থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে যদি কোটি বছর লাগে – তাহলে সেগুলি কোটি বছর আগের নক্ষত্র আমরা দেখছি।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ইনফ্রারেড ক্যামেরা কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি থেকে ভেসে আসা অবলোহিত আলো শনাক্ত করতে পারে। কোটি বছরের সফর শেষে এই আলো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নায় এসে প্রতিফলিত হয়। ইনফ্রারেড ওয়েভ ডিটেকটর সেই আলো শনাক্ত করে। সেখান থেকে তৈরি হয় গভীর মহাকাশের ছবি। শুধু তাই নয়, ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফ থেকে মহাবিশ্বে ভাসমান সব ধরনের অণুর ধর্মাবলি বিশ্লেষণ করে দেখতে পারবে পৃথিবীর অন্য কোনো সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে প্রাণী আছে কি না।

এই টেলিস্কোপের প্রোগ্রাম ডিজাইনের সাথে সরাসরি যুক্ত আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা – নাসা (NASA), ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি – ইসা (ESA), ক্যানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি – সিসা (CSA)। টেলিস্কোপের সায়েন্স অপারেশান সেন্টার – যেখান থেকে মহাকাশের বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে – সেটা হলো আমেরিকার বাল্টিমোরে স্থাপিত স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউট। এখান থেকে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলিও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গত ১২ জুলাই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের যে কয়টি ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে  – সেগুলি বাছাই করেছেন স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন একটি জগতের পর্দা সরে গেলো এই ছবিগুলির মাধ্যমে।

 

চারটি ছবির একটি হলো SMACS 0723


এই ছবিটি তোলা হয়েছে টেলিস্কোপের নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার গ্যালাক্সি। সামনের উজ্জ্বল গ্যালাক্সির দল পেছনের গ্যলাক্সির আলোকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে। সামনের গ্যালাক্সির বয়স আমাদের পৃথিবীর বয়সের কাছাকাছি চার দশমিক ছয় বিলিয়ন বছর বা ৪৬০ কোটি বছর। পেছনের গ্যালাক্সিদল তৈরি হয়েছিল প্রায় তের বিলিয়ন বছর আগে, অর্থাৎ ১৩০০ কোটি বছর আগে। জেমস ওয়েব এই গ্যালাক্সিগুলোর অনেক ডাটা সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। এই ডাটা থেকে আমরা বুঝতে পারবো – কীভাবে প্রথম প্রজন্মের গ্যালাক্সিগুলি গঠিত হয়েছিল। এই গ্যালাক্সিগুলির মধ্যেই থাকতে পারে সবচেয়ে দূরের গ্যালাক্সি – যেগুলি তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং এর পাচ শ মিলিয়ন বা পঞ্চাশ কোটি বছরের মধ্যে – মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর দিকে। জেমস ওয়েবের এই ছবির ডাটা থেকে আমরা এতদিনের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি।

সবচেয়ে প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম কিছুক্ষণ (সময় তখনো শুরু হয়নি) সবকিছু অন্ধকার ছিল। পদার্থ যদি কিছু থেকে থাকে – তা ছিল সব ডার্ক ম্যাটার। ডার্ক ম্যাটার কোন আলো নির্গমন করে না, প্রতিফলন করে না। অথবা ছিল নিউট্রাল হাইড্রোজেন কিংবা হিলিয়াম। তারপর কয়েক শত মিলিয়ন বছর পর (প্রায় দশ কোটি বছর) পর গ্যাসগুলি আস্তে আস্তে জোট বাঁধতে বাঁধতে গ্যাসীয় নক্ষত্রের সৃষ্টি হলো। প্রথম আলোর আবির্ভাব হলো। এই আলোর বিকিরণের ফলে নিউট্রাল গ্যাস আয়নিত হলো। মহাবিশ্ব আস্তে আস্তে গ্যাস থেকে ফুটন্ত তরল তারপর গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ উপগ্রহের স্ট্রাকচার পেলো। এগুলি আমরা নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব থেকে জানি। কিন্তু সরাসরি তেমন জোরালো প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে নেই। জেমস ওয়েব আমাদের সেই প্রমাণ জোগাবে বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।

প্রকাশিত দ্বিতীয় ছবিটি স্টিফেন্স কুইনটেট (Stephan’s Quintet)। এই ছবিটি হলো এপর্যন্ত জেমস ওয়েবের তোলা সবচেয়ে বড় ছবি। এর ব্যাস চাঁদের ব্যাসের এক পঞ্চমাংশ। পনেরো কোটি পিক্সেলের এই ছবিতে আছে পাঁচটি গ্যালাক্সির একটি গ্রুপ – পরস্পরের কাছাকাছি আসছে ২৯০ মিলিয়ন আলোক-বর্ষ দূরের পেগাসাস নক্ষত্রপুঞ্জে। এই ছবি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে – এর কেন্দ্রে আছে একটি সুপারম্যাসিভ – প্রচন্ড ভরসম্পন্ন ব্ল্যাকহোল – যেখান থেকে একটি নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে। এখান থেকে যে ডাটা পাওয়া গেছে সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের জন্ম কীভাবে হয়, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের জন্মও কীভাবে হয়।

 


তৃতীয় ছবিটি  ক্যারিনা নেবুলা (CARINA NEBULA)


সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং বৃহত্তম নেবুলা হচ্ছে ক্যারিনা নেবুলা। নেবুলা হচ্ছে নক্ষত্রের জন্মভূমি – গ্যাস ও ধুলিকণা যেখান থেকে নক্ষত্রের জন্ম হয়। নক্ষত্রের উপাদানগুলির ভেতরের অনেক তথ্য জানা যাবে এখান থেকে – কারণ ইনফ্রারেড রে শনাক্ত করে বিশ্লেষণ করার উপায় আছে জেমস ওয়েবে। এথেকে নক্ষত্র কীভাবে সৃষ্টি হয় তা আরো ভালোভাবে জানা যাবে। ক্যারিনা নেবুলা সাউদার্থ কনস্টেলেশান ক্যারিনা থেকে ৭৬০০ আলোক-বর্ষ দূরে। এই ছবিতে যতগুলি ছোট ছোট উজ্জ্বল বিন্দু দেখা যাচ্ছে সেগুলি সবই নতুন নক্ষত্র। শত শত নতুন নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। আরো অনেক পরিষ্কার ঘটনা দেখা যাচ্ছে যেগুলি নতুন তথ্য দেবে আমাদের।

 চতুর্থ ছবি  

সাউদার্ন রিং নেবুলা (SOUTHERN RING NEBULA)


সাউদার্ন রিং নেবুলা হলো – প্লেনেটারি নেবুলা – যেখানে আছে গ্যাসের মেঘ যা সম্প্রসারিত হচ্ছে চারদিকে। গ্যাসগুলি মৃতপ্রায় নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে, অথবা দুটো মৃতপ্রায় নক্ষত্র – একে অপরের চার পাশে ঘুরছে । এর ব্যাস প্রায় অর্ধ-আলোকবর্ষ (এক আলোকবর্ষের অর্ধেক)। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় দুই হাজার আলোকবর্ষ। ফেনার মতো কমলা রঙের যে কোষগুলি দেখা যাচ্ছে – ওগুলি হাইড্রোজেন অণু। দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে হাইড্রোজেন অণু তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রে যে নীল রঙের অংশ দেখা যাচ্ছে – সেগুলি আয়নিত গ্যাস। ডান পাশের চিত্রে দেখা যাচ্ছে দুটো নক্ষত্র ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে কেন্দ্রে। এখান থেকে যে ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে সেখান থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের মৃত্যু কীভাবে হয়। নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ এর আগে কখনো হয়নি।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ তার বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য অনুসারে মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহে অনুসন্ধান চালাচ্ছে সেখানে কোথাও কোন প্রাণ ধারণের উপাদান পাওয়া যায় কি না। প্রাথমিক ছবিগুলির মধ্যে আমাদের সৌরজগতের বাইরের এক বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ WASP-96 b তে পানির অস্ত্বিত্বের প্রমাণ প্রকাশ করেছে। আমাদের সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে এই বিশাল গ্যাসীয় গ্রহ। শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহের গ্যাসীয় উপাদান বিশ্লেষণ করার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা আছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের – এই ছবি তারই প্রমাণ। 



মহাকাশ দেখার এতদিনের শক্তিশালী মাধ্যম হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা দিয়েছিল – সেই ধারণার সরাসরি প্রত্যক্ষ করার জন্য আরো শক্তিশালী টেলিস্কোপ – জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ – আমাদের চোখের সামনে এনে দিচ্ছে মহাকাশের গভীর থেকে গভীরের চিত্র। আগে যা আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়েছে এখন সেগুলি বাস্তবে চলে আসতে শুরু করেছে। আগামী দশ বছর ধরে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আমাদের মহাবিশ্বের অনেক নতুন রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

 

তথ্যসূত্র:

১। মারিয়া আরিয়াস, দ্য কসমস অ্যাজ উই হ্যাভ নেভার সিন বিফোর, নিউ সায়েন্টিস্ট, ৯ জুলাই ২০২২।

২। মার্টিন বারস্টো, দ্য কনভারসেশান ১৩ জুলাই, ২০২২।

৩।  কার্ল গ্ল্যাজারব্রুক ও সাইমন ড্রাইভার, দ্য কনভারসেশান, ১৩ জুলাই ২০২২।

৪। বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২১।

৫। webb.nasa.gov

_____________
বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত










Sunday, 4 September 2022

রোজালিন ইয়ালো: নোবেলজয়ী চিকিৎসা-পদার্থবিজ্ঞানী

 




আমাদের শরীরের মতো এত জটিল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র আর একটিও নেই। শরীরের ছোটখাট সমস্যাগুলির সমাধান শরীর নিজে নিজেই করে ফেলে। অনেক সময় আমরা জানতেও পারি না শরীরের স্বাভাবিক রাসায়নিক উপাদানের কী পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু যখনই শরীরের কোন সমস্যা শরীর নিজে নিজে ঠিক করে ফেলতে পারে না, তখন বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে শরীর সংকেত দিতে থাকে যে কোথাও কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে। তখন দরকার হয় চিকিৎসার। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। রোগনির্ণয়ের জন্য বর্তমানে যেসব উন্নত বৈজ্ঞানিক রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার একটি হলো রেডিওইমিউনোএসে (radioimmunoassay) বা আর-আই-এ (RIA)। এই পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের শরীরের রক্ত এবং অন্যান্য তরল পদার্থের মধ্য অন্য কোন পদার্থ ঢুকে গেলে – তা যত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাণেই হোক না কেন – তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে, খাবারের সাথে, এবং আরো বিভিন্নভাবে আমাদের শরীরে অনবরত ঢুকছে রোগজীবাণু, ভাইরাসছাড়াও আরো অসংখ্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। রক্ত এবং অন্যান্য তরলের সাথে মিশে গিয়ে এগুলি সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। আর-আই-এ পদ্ধতিতে এই উপাদানগুলির উপস্থিতি এবং পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। আর-আই-এ পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি নতুন দিগন্ত খুলে যায়। সম্ভব হয় শরীরের বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা মেপে দেখার। কোন ওষুধ রোগীর শরীরে কাজ করছে কী না, ভিটামিন শরীরের উপাদানের সাথে মিশতে পারছে কি না, কিংবা ভাইরাস আক্রান্ত হলে তা কোন্‌ মাত্রায় কতটুকু ক্ষতি করছে এবং তার প্রতিষেধক দিলে তা কার্যকর হচ্ছে কি না সবকিছুই মেপে দেখা সম্ভব হয়েছে এই আর-আই-এ উদ্ভাবনের ফলে। ওষুধের সঠিক মাত্রা নির্ধারণে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে এই পদ্ধতি। ১৯৫৯ সালে এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন পদার্থবিজ্ঞানী রোজালিন ইয়ালো এবং ডাক্তার সোলোমন বারসন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য রোজালিন ইয়ালো পেয়েছেন ১৯৭৭ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার। অথচ কর্মজীবনের শুরুতে হতদরিদ্র মা-বাবার সন্তান রোজালিন একটি শিক্ষকতার চাকরি চেয়েও পাননি। কাজ শুরু করেছিলেন স্টেনোগ্রাফার হিসেবে। একাগ্রতা, অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে রোজালিন হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রথম সারির চিকিৎসা-পদার্থবিজ্ঞানী। 

ইহুদি মা-বাবার সন্তান রোজালিনের জন্ম নিউইয়র্ক শহরে ১৯২১ সালের ১৯ জুলাই। তাঁর মা-বাবা পূর্ব ইওরোপ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছিলেন রোজালিনের মা-বাবা। বড় কোন স্বপ্ন দেখার সাহসও তাঁরা দিতে পারেননি তাঁদের সন্তানদের। নিজেরা বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু বুঝতে পেরেছেন সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারলে জীবনসংগ্রামে তারা হেরে যাবে না। 

আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে পড়াশোনা করার অনেক স্কুল আছে। নিউইয়র্কের ব্রংকস-এর সাধারণ সরকারি স্কুলেই পড়াশোনা রোজালিনের। হাইস্কুলে রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হন রোজালিন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনার জন্যও তাঁকে খুঁজতে হয়েছিল বিনাবেতনে পড়াশোনা কোথায় করা যায়। নিউইয়র্কের হান্টার কলেজ ছিল নিউইয়র্ক সিটির মিউনিসিপালিটি পরিচালিত বিনাবেতনে পড়ার কলেজ, যেখানে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়া হতো। হান্টার কলেজে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা করতে এসে রোজালিনের ভালো লেগে যায় পদার্থবিজ্ঞান। মেরি কুরির সন্তান ইভ কুরির লেখা মেরি কুরির জীবনী তখন প্রকাশিত হয়েছে। সেই বই পড়ে রোজালিন নিজেকে মেরি কুরির আদর্শে তৈরি করার অনুপ্রেরণা পেলেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের রমরমা তখন শুরু হয়ে গেছে। সেই সময় নিউক্লিয়ার ফিশানের জনক এনরিকো ফার্মির লেকচার শোনার সুযোগ হলো রোজালিনের। পদার্থবিজ্ঞান,  বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রতি গভীর ভালোবাসা তৈরি হলো রোজালিনের। মা-বাবা যতই বলুন যে একটা শিক্ষকতার চাকরি পেলেই চলবে, রোজালিন মনস্থির মনস্থির করে ফেলেছেন সুযোগ পেলে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাই করবেন জীবনে। ১৯৪১ সালে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান মেজর নিয়ে স্নাতক পাশ করলেন হান্টার কলেজ থেকে। 

কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা করতে গেলে তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাগবে, পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করতে হবে। পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য বৃত্তি লাগবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলেন রোজালিন। কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সরাসরি প্রত্যাখ্যানপত্র পেলেন তিনি। স্নাতকে এত ভালো রেজাল্ট করার পরও কোন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভর্তির সুযোগ দিচ্ছে না কেন জানতে গিয়ে উত্তর পেলেন – একে তো মেয়ে, তার উপর ইহুদি। শুধুমাত্র একারণেই তাঁর দরখাস্ত বাতিল করে দেয়া হচ্ছিল। 

তাঁর মা-বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে যদি কোনোভাবে লেখাপড়া শিখে কোনো একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পায় তাহলে কোনোরকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকতার জন্য দরখাস্ত করেও কোন ফল হলো না। অনেকে পরামর্শ দিলেন স্টেনোগ্রাফি শিখে নিলে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কেরানির চাকরি পাওয়া যেতে পারে। রোজালিন বাধ্য হয়ে তাই শুরু করলেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর রুডলফ শোয়েনহেইমারের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও সান্তনা এই যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের অফিসে বসে কাজ করছেন। 

অবশেষে একটা সুযোগ এলো রোজালিনের জন্য। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। আমেরিকার ছেলেদের অনেকেই যুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে অনেক সিট খালি থেকে যাচ্ছিল। তখন শূন্যতা পূরণ করার জন্য মেয়েদেরকে সুযোগ দেয়া হয়। সেই সুযোগে ইলিনয় ইউনিভার্সিটির আরবানা-শ্যামপেইন ক্যাম্পাসে গ্রাজুয়েট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান রোজালিন। ১৯১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে রোজালিনের আগে আর কোন মেয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়নি সেখানে। রোজালিন ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম মেয়ে শিক্ষার্থী। একটা অ্যাসিস্ট্যান্টশিপও পেয়েছিলেন তিনি। স্নাতক পর্যায়ের ফিজিক্সের ক্লাস নিতেন তিনি। তখন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির অধীনে। ফ্যাকাল্টির চারশ’র অধিক অধ্যাপক ও শিক্ষা-সহকারীর মধ্যে রোজালিনই ছিলেন একমাত্র মেয়ে। 

এখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় আরন ইয়ালোর সাথে। আরনও ছিলেন ইহুদি পরিবারের সন্তান। আরনের বাবা ছিলেন নিউইয়র্কের ইহুদি ধর্মযাজক। ১৯৪৩ সালে আরন ও রোজালিনের বিয়ে হয়। পরের চার বছরের মধ্যে তাঁদের দুই সন্তান – বেনজামিন ও ইলানার জন্ম হয়। অন্যান্য সব কাজের মতোই ঘরসংসারও খুব মনযোগ দিয়ে ভালোবেসে করতেন রোজালিন। 

১৯৪৫ সালে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পিএইচডি সম্পন্ন করেন রোজালিন। দুর্দান্ত ভালো রেজাল্ট করার পরও তিনি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোথাও কোন চাকরি পেলেন না। অনেক দরখাস্ত ব্যর্থ হবার পর প্রথম কাজ শুরু করলেন নিউইয়র্ক সিটির ফেডারেল টেলিকমিউনিকেশান কোম্পানিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে। তারপর হান্টার কলেজে যোগ দেন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে। এরপর ব্রোংক্‌স এর ভ্যাটেরান্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ভিএ) হাসপাতালের নিউক্লিয়ার মেডিসিনের গবেষক হিসেবে ১৯৪৭ সালে। এখানেই তিনি গবেষণা শুরু করলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে রেডিও-আইসোটোপের ব্যবহার সম্পর্কে। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে রেডিও-আইসোটোপের ব্যবহার তখন মাত্র শুরু হয়েছে। রোজালিন দেখতে পাচ্ছেন নিউক্লিয়ার মেডিসিনের বিপুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত। কিন্তু তাঁর একজন গবেষণা-সহযোগী দরকার যিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে জানেন। এই কাজের জন্য তিনি বেছে নেন ভিএ হাসপাতালে সদ্য যোগ দেয়া ইন্টার্নি ডাক্তার সোলোমন বারসনকে। ডাক্তার সোলোমন বারসনের সাথে রোজালিনের অচ্ছেদ্য গবেষণা-বন্ধন তৈরি হয়। পরবর্তী বিশ বছরেরও বেশি সময় তাঁরা একসাথে গবেষণা করেছেন। ১৯৭২ সালে ডাক্তার সোলোমন হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। 

১৯৫০ এর দশকের শুরুতে রোজালিন ও সোলোমন রক্তে আয়োডিন ও এলবুমিনের বিপাক প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। রোগীর শরীরে রেডিও-আইসোটোপ সংযুক্ত রাসায়নিক (রেডিওফার্মাসিউটিক্যাল) ইনজেকশানের মাধ্যমে প্রয়োগ করার পর রোগীর রক্তের তেজস্ক্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় সময়ের সাথে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা কীভাবে ক্রমশ কমে আসে। অতিদ্রুত কমে এলে বুঝতে হবে বিপাক প্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে, আর বিকিরণের হার যদি কম হয়, বুঝতে হবে বিপাক ধীরগতিতে হচ্ছে। 

ডায়াবেটিসের মূল কারণ যে ইনসুলিনের দ্রুত বিপাক – সেই ধারণা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মনে এলেও তখনো তা প্রমাণ করার উপায় জানা ছিল না। রোজালিন ডায়াবেটিক রোগীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তিনি ডায়াবেটিক রোগীর শরীরে রেডিও-আইসোটোপের বিকিরণের হার পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে ইনসুলিনের বিপাকের হার অনেক বেশি। অর্থাৎ ডায়াবেটিক রোগীর শরীর থেকে ইনসুলিন দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি এবার রোগীদের দুভাগে ভাগ করলেন। একভাগকে ইনসুলিন ইনজেকশান দেয়া হলো। অন্যভাগকে ইনসুলিন দেয়া হলো না। দেখা গেলো যাদেরকে ইতোমধ্যে ইনসুলিন দেয়া হয়েছে তাদের রক্তের ইনসুলিন বিপাকের হার, যাদেরকে আগে ইনসুলিন দেয়া হয়নি তাদের রক্তের ইনসুলিন বিপাকের হারের চেয়ে অনেক কম। তার মানে দাঁড়ালো শরীরে ইনসুলিন দেয়া হলে সেই ইনসুলিন রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে যা ইনসুলিনের বিপাক-প্রক্রিয়ার হার কমিয়ে দিয়ে শরীর থেকে ইনসুলিন ক্ষয়ের অস্বাভাবিক মাত্রাকে স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই আবিষ্কার একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। কিন্তু রোজালিন ও সোলোমন যখন তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল দ্য জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশন-এ প্রকাশের জন্য পাঠালেন, জার্নালের রিভিউয়াররা তা সরাসরি বাতিল করে দেন। এই প্রত্যাখ্যানে একটুও দমে গেলেন না রোজালিন। বরং আরো উৎসাহ নিয়ে আরো অনেক বিস্তারিত গবেষণা তিনি করলেন। সেখান থেকেই আবিষ্কার করলেন আর-আই-এ পদ্ধতি। সেই প্রত্যাখ্যানের চিঠি তিনি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন সারাজীবন। বিশ বছর পর ১৯৭৭ সালে তিনি যখন তাঁর এই গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন, তাঁর নোবেল বক্তৃতায় তিনি সেই প্রত্যাখ্যানপত্র দেখিয়েছিলেন। 

রোজালিন শিক্ষাজীবনে রসায়ন পড়েছেন, নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পিএইচডি করেছেন, কিন্তু  জীববিজ্ঞানের কোন কোর্স করেননি। অথচ তিনি নিজে নিজে পড়াশোনা করে এত বেশি ফিজিওলজি এবং মেডিসিনের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন যে তাঁর সমসাময়িককালের কোন ডাক্তারেরও এত জ্ঞান ছিল না। 

নোবেলজয়ী রোজালিনের গবেষণাগারটি ছিল অত্যন্ত সাধারণ। শুরু করেছিলেন হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝাড়ু-বালতি ইত্যাদি পরিচ্ছন্নতা কাজের সরঞ্জাম রাখার একটা ছোট্ট ঘরকে গবেষণাগারে রূপান্তরের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তার কিছুটা উন্নতি হলেও খুব দরকারি যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কোন বাহুল্য সেখানে ছিল না। সেরকম রোজালিনও ছিলেন সারাজীবন সাদামাটা। নোবেল পুরষ্কার পাবার আগেও যা ছিলেন, পরেও তাঁর সহজ-সরল সাদামাটা জীবনযাপনের কোন পরিবর্তন হয়নি। সপ্তাহে সবাই যেখানে চল্লিশ ঘন্টার বেশি কাজ করেন না, রোজালিন সপ্তাহে আশি ঘন্টা কাজ করতেন। তাঁর ল্যাবের কাছেই ছোট্ট একটা বাড়িতে স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি থাকতেন। এত গবেষণার ফাঁকেও তিনি বাড়ির কাজ করতেন। প্রথম সন্তানের বয়স এক মাস হবার আগেই তিনি সন্তান কোলে নিয়ে ল্যাবের কাজে যোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয় সন্তানের বেলাতেও তাই করেছেন। দুপুরে ল্যাব থেকে বের হয়ে বাসায় গিয়ে শিশু সন্তানদের জন্য খাবার তৈরি করে খাইয়ে আবার ল্যাবে এসেছেন। তিনি নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলতেন, নারী ও পুরুষের মধ্যে শুধুমাত্র একটাই পার্থক্য আছে – সেটা হলো নারী সন্তান জন্ম দিতে পারে, পুরুষ পারে না। এছাড়া অধিকারের ক্ষেত্রে আর কোন পার্থক্য থাকা উচিত নয়। 

১৯৯১ সালে সত্তর বছর বয়সে হাসপাতালের গবেষকের চাকরি থেকে অবসর নিতে হয় তাঁকে। তারপর বেঁচে ছিলেন আরো বিশ বছর। তখনো তাঁর পড়াশোনা, গবেষণা থেমে থাকেনি। ২০১১ সালের ৩০ মে তাঁর জীবনাবসান হয়। 


তথ্যসূত্র – সিমন গ্লিক, ন্যাচার, সংখ্যা ৪৭৪, ২০১১; সিয়াং ইয়ং ট্যান, সিঙ্গাপুর মেডিক্যাল জার্নাল, সংখ্যা ৬০, ২০১৯; নোবেল পুরষ্কার ওয়েবসাইট। 

___________
বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত






Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts