Sunday, 15 December 2019

চাঁদের নাম লুনা - ৩৫



চাঁদের ভবিষ্যৎ

চাঁদ তুলনামূলকভাবে খুব স্থির একটি উপগ্রহ। সেখানে কোন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটছে না। ভূমিকম্প নেই, আগ্নেয়গিরি নেই, মহাজাগতিক ঝড় নেই। পৃথিবী থেকে রকেটে করে মাত্র তিন দিনের পথ। মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহের উদ্দেশ্যে মহাকাশযান পাঠানোর জন্য চাঁদ হয়ে উঠতে পারে একটি মহাকাশ জংশন। একদিন হয়তো মানুষ চাঁদে কলোনি তৈরি করে বসবাস করবে।
            সৌরজগতের বিজ্ঞান জানার জন্যে চাঁদ একটা বড় উৎস। সৌরজগতের উৎপত্তির পর থেকে চাঁদের পরিবর্তন হয়েছে খুবই কম। তার মানে সৌরজগতের প্রথম একশ কোটি বছরে কী হয়েছে তা জানা যাবে চাঁদের বিজ্ঞান থেকে। পৃথিবীর শৈশব থেকেই চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবীর বিবর্তনের সাক্ষী চাঁদ। পৃথিবীর ভবিষ্যতের উপর অনেকখানি নির্ভর করছে চাঁদের ভবিষ্যৎ।
            পৃথিবীর মতোই চাঁদেও অনেক খনিজ সম্পদ থাকতে পারে। সেটা খুড়ে বের করবে মানুষ। হয়তো কোন একদিন চাঁদের বুকে খনি আবিষ্কারের জন্য খোড়াখুড়ি শুরু হবে।
            চাঁদ ও পৃথিবী পরস্পর টানাটানি করছে। এতে শক্তির ক্ষয় হচ্ছে অনবরত। ঘূর্ণনের বেগ কমে যাচ্ছে। চাঁদ আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। প্রতিবছর প্রায় তিন সেন্টিমিটার করে দূরে সরে যাচ্ছে। আজ থেকে কোটি বছর পরে চাঁদ আরো ছোট দেখাবে পৃথিবী থেকে। ৫ কোটি বছর পর পৃথিবীর চার পাশে ঘুরে আসতে চাঁদের লাগবে ৫০ দিন।


চন্দ্রবীক্ষণ 
আমাদের স্কুলের ছাদটি যে এত বড় তা আগে কখনো বুঝতেই পারিনি। বিকেল থেকেই স্কুলে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। চন্দ্রোৎসব। আজ সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরে সবাই বেশ সেজেগুঁজে এসেছে। আমরা বন্ধুরা সবাই সাদারঙের শাড়ি পরেছি, ছেলেরা পরেছে লম্বা পাঞ্জাবি। উঁচু ক্লাসের আপুরাও অনেকে শাড়ি পরেছে। স্যার-ম্যাডামদেরও অন্যরকম লাগছে। আসমানি ম্যাডাম মনে হয় পার্লার থেকে সেজে এসেছেন।
            ছাদের একপাশে স্টেজের কাছে দেখা গেলো আফতাব স্যার বিভিন্ন ক্লাসের ক্লাস-মনিটরদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। ফারজানাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না এতক্ষণ। দেখলাম সেও আছে এখানে সুব্রতর সাথে। আমাকে দেখতে পেয়েই আফতাব স্যার জিজ্ঞেস করলেন, "নুসরাত নীলিমা, তোমরা রেডি?"
            "জ্বি স্যার, আমরা রেডি।"
            আফতাব স্যারকে দেখে হঠাৎ খুব হাসি পেয়ে গেলো। স্যার একটা কুঁচকানো পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। পাঞ্জাবিটা হয়তো কোন একসময় সাদা ছিল।
            ছাদের উত্তরকোণায় ছোট্ট মঞ্চ। সেখানে আমরা বিভিন্ন ক্লাসের বিভিন্ন গ্রুপ গান গাইবো। অন্যদিকে ছাদের পূর্বদিকের রেলিং-এর কাছে আরেকটা মঞ্চ। সবার কৌতূহল সেই মঞ্চের উপর ট্রাইপডে স্থাপিত টেলিস্কোপের উপর। টেলিস্কোপের পাশে একটি টেবিলে রাখা আছে ল্যাপটপ কম্পিউটার ও প্রজেক্টর। জীবনে প্রথমবারের মতো টেলিস্কোপের সাহায্যে আমরা চাঁদ দেখবো। এই টেলিস্কোপও আমরা আগে কখনো দেখিনি।
            চারতলার ছাদ থেকে পূর্বদিকের আকাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খুব কাছেই গাড়ির রাস্তা। আর রাস্তার পাশেই নদী। সেদিকে বড় কোন বিল্ডিং মাথা তুলে আকাশ আড়াল করেনি এখনো। চাঁদ উঠলেই আমরা দেখতে পাবো।
            আজ চৌদ্দই নভেম্বর ২০১৬। আজকের এই সন্ধ্যার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি সেই মার্চ মাস থেকে। আজ দেখা দেবে সুপারসুপারমুন। ৬৮ বছর পর পৃথিবীর এত কাছে এসেছে চাঁদ।
            প্রোগ্রামের শুরুতে টেলিস্কোপের পাশে একটা বড় স্ক্রিনে আমাদের প্রজেক্ট-লুনার প্রেজেন্টেশান দেখানো হলো। প্রিন্সিপাল স্যার তাঁর বক্তৃতায় আমাদের বিজ্ঞান প্রজেক্টের খুব প্রশংসা করলেন। চাঁদের প্রজেক্ট আমরা শেষ করে ফেলেছিলাম সেই মার্চ মাসে। আফতাব স্যার আমাদের প্রেজেন্টেশানসহ বিভিন্ন ক্লাসের অনেকগুলো প্রজেক্ট-প্রেজেন্টেশান  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর ছয় মাস ধরে চেষ্টা করার পর স্কুলের জন্য এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি পাওয়া গেছে সরকার থেকে। প্রিন্সিপাল স্যার বললেন এটা আমাদের উৎসাহ ও পরিশ্রমের পুরষ্কার।
            কলেজের ভাইয়া ও আপুদের গানের পর ক্লাস টেন, তারপর নাইন। এভাবে আমাদের পালা যখন এলো ততক্ষণে পশ্চিমাকাশ লাল হয়ে উঠেছে। নভেম্বর মাসেও শীত পড়ছে না বলে আমরা কী যে খুশি। কারণ শীতের কুয়াশায় চাঁদ যদি ভালো করে দেখা না যায়! আজ কোন কুয়াশা নেই।
            আমি, ফারজানা, চিত্রা আর স্বাতী মঞ্চে উঠলাম। লুনাকেও দলে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লুনা কিছুতেই সবার সামনে মঞ্চে উঠে গান গাইতে রাজি নয়। তাছাড়া তার চন্দ্রভীতি নিয়ে সে এখনো চিন্তায় আছে - যদি চাঁদ দেখে সব গন্ডগোল হয়ে যায়।
           
ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে
ধরা দিয়েছ যে আমার পাতায় পাতায় ডালে ডালে।।
যে গান তোমার সুরের ধারায়
বন্যা জাগায় তারায় তারায়
মোর আঙিনায় বাজল গো, বাজল সে-সুর আমার প্রাণের তালে-তালে।।

আমাদের গান শেষ হতে না হতেই দেখলাম সবার চোখ পূর্বদিকের আকাশে। সেদিকে পাতায় পাতায় ডালে ডালে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
            আফতাব স্যার দূরবীণে চোখ রেখে চাঁদের দিকে তাক করলেন। প্রজেক্টরের পর্দায় স্পষ্ট হয়ে উঠলো উদীয়মান চাঁদ।
            আমাদের ক্লাসের মতো অন্যান্য ক্লাসেও চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদের প্রতিনিধিরা আছে। তারা খুব সক্রিয় এখন। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে দূরবীণে চোখ রাখছে। কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় দেয়া যাচ্ছে না কাউকেই। আফতাব স্যার বলেছেন সবার দেখা হয়ে গেলে পরে সময় থাকলে আবার দেখার সুযোগ দেয়া হবে।
            দূরবীণে যা দেখা যাচ্ছে তার সবকিছুই প্রজেক্টরের সাহায্যে বড়পর্দায় দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন আফতাব স্যার। এজন্য যে টেকনিক্যাল টিম আছে সেই টিমে আমাদের ক্লাস থেকে অর্ক ও  লুনাও আছে। লুনা খুব উৎসাহ নিয়ে প্রজেক্টরের কাছে বসে আছে।
            অনেকগুলো ঘটনা এক সাথে ঘটছে এখন। সামনের আকাশে বিশাল আকৃতির পূর্ণিমার চাঁদ আমরা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি। পূর্ণিমার আলোয় সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। যে সবিতা ম্যাডাম ধমক না দিয়ে কথা বলতে পারেন না, তিনিও কত মিষ্টি করে হেসে হেসে কথা বলছেন আজ। ভোলানাথ স্যার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন আফতাব স্যারের পাশে। গলায় হুইসেল থাকা সত্ত্বেও আজ একবারও হুইসেল বাজাননি তিনি।
            আকাশের চাঁদকে টেলিস্কোপ দিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে আরো কাছে - একেবারে প্রজেক্টরের পর্দায়। আমাদের ক্লাসের সবার দেখা হয়ে যাবার পর চন্দ্রবীক্ষণ পরিষদের প্রতিনিধিদের দেখার সুযোগ এলো। এই নিয়ম আফতাব স্যার চালু করেছেন। তিনি বলেন, "একজন সত্যিকারের ক্যাপ্টেন দায়িত্ব নেবে সবার আগে, কিন্তু সুযোগ নেবে সবার শেষে।"
            টেলিস্কোপের আইপিসে (eyepiece) চোখ রেখে মনে হলো সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা। আফতাব স্যার বললেন, "নিচু সমতল যে জায়গাটা দেখতে পাচ্ছো সেটাই হলো ..."
            "আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না স্যার।"
            আফতাব স্যার বড় পর্দার দিকে তাকালেন। সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চাঁদের বুকে লাভাস্রোতের থমকে থাকা চিহ্ন। আমি বড়পর্দার ছবি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু টেলিস্কোপে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আবার চোখ রাখলাম টেলিস্কোপে। এবারো সবকিছু ঝাপসা। আফতাব স্যার টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে একবার দেখলেন, তারপর হাত বাড়িয়ে আমার চশমাটা খুলে কুচকানো পাঞ্জাবির এক কোণায় মুছে আবার পরিয়ে দিলেন।
            "এবার দেখো।"
            মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো চাঁদের সি অব ট্রাংকুইলিটি - প্রশান্তির সাগর, যেখানে প্রথম পা রেখেছিল পৃথিবীর মানুষ।
            "টাইম'স আপ নয়ন, ইট্‌স মাই টার্ন।" লুনা ধাক্কা দিচ্ছে।
            পরের কয়েক সেকেন্ড ভয়ে ভয়ে লুনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লুনা টেলিস্কোপে চোখ রেখে চাঁদ দেখলো খুবই স্বাভাবিকভাবে। তারপর বললো, "ওয়ান্ডারফুল, অ্যামেজিং!"
            "তোর সেলিনোফোবিয়ার কী হলো?"
            "চলে গেছে।"
            "ইউ শিওর?"
            "নট শিওর। বাট আমি থিংক করি। হাহাহা।"
            লুনাকে এত জোরে হাসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। সেলিনোফোবিয়া সেরে গিয়ে লুনা কি লুনাটিক হয়ে গেলো?

_________


তথ্যসূত্র

1.   Ian Graham, My best book of the Moon, Kingfisher, London, 2005.
2.   Isaac Asimov, The Earth's Moon, Collins publishers Australia, Sydney, 1988.
3.   David A Rothery, Planets a very short introduction, Oxford University Press, Great Britain, 2010.
4.   Robin Birch, The new solar system The Moon, Macmillan Library, Auatrlia 2008.
5.   Carmel Reilly, Sky watching The Moon, Macmillan Library, Australia 2011.
6.   Chris Cooper, Pam Spence, Carole Stott, Stars + Planets an illustrated guide, Star Fire, London, 2007.
7.   Gerard Cheshire, The Solar System and Beyond, Evans, London, 2006.
8.   Giles Sparrow, Planets and Moons, Hinkler Books, Australia, 2006.
9.   Steve Parker, Solar System, Ticktock Media Ltd, Great Britain, 2006.
10. Colin Ronan, The Universe Explained, Ken Fin Books, Australia, 1997.
11. Heather Couper and Nigel Henbest, Encyclopedia of Space, DK Publishing, UK, 2003.
12. John Christopher, Apollo Story, The History Press, UK, 2009.
13. Steve Massey, Exploring the Moon, New Holland, Australia, 2004.
14. Michael Carlowicz, the Moon, Abrams, New York, 2007.
15. Rick Stroud, The Book of the Moon, Doubleday, London, 2009.
১৬। প্রদীপ দেব, অর্ক ও সূর্যমামা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫।
১৭। প্রদীপ দেব, পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬।

চাঁদের নাম লুনা - ৩৪


চলো যাই চাঁদের দেশে

"আচ্ছা লুনা, চাঁদের এত কিছু জানার পর এখনো কি তোর চাঁদের ভয় যায়নি?"
            স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে আমরা চাঁদের প্রেজেন্টেশান রেডি করছিলাম। লাইব্রেরি এখন ছুটির পর বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। লুনা তার ল্যাপটপ কম্পিউটারে প্রেজেন্টেশান স্লাইডে অ্যাপোলো মিশনের ছবি আপলোড করতে করতে আমার দিকে তাকালো। তারপর হাসিমুখে বললো, "ডোন্ট নো ইয়েট। চাঁদ দেখলে বুঝতে পারবো।"
            "তুই চাঁদ দেখবি?
            "তোরা সবাই দেখবি, আর আমি বসে থাকবো?"
            "তোর সেলিনোফোবিয়ার কী হবে?"
            "ভয়কে জয় করতে হলে ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় মাই ফ্রেন্ড।"
            "ইয়েস, ইফ ইউ ওয়ান্ট জয়, স্ট্যান্ড ইন ফ্রন্ট ভয়।"
            এরা দেখছি আফতাব স্যারের ডায়লগ ঝাড়ছে। লুনা এখন ইংরেজির চেয়ে বাংলা বেশি বলে। আর স্বাতীর হয়েছে উল্টো। সে ভয়ংকর রকমের ইংরেজি বলতে শুরু করেছে। চিত্রা তাড়া দিলো, "হেই তোরা কথা বন্ধ করে কাজ শেষ কর। বাসায় যেতে হবে।"
            "তার আগে চল চাঁদ থেকে ঘুরে আসি।"
            তার মানে আমাদের প্রেজেন্টেশান রেডি। এবার পুরোটা একবার দেখার পালা। চলো যাই চাঁদের দেশে।



মনে করো চাঁদে যাবার জন্য দীর্ঘদিনের কঠোর প্রশিক্ষণের পর সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কমান্ড মডিউলে উঠে বসলে। প্রচন্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে প্রচন্ড গতিতে রকেট উড়লো। তোমার মনে হবে শরীরের ওজন বেড়ে যাচ্ছে। পৃথিবী অভিকর্ষ বলে টেনে রাখতে চাইছে তোমাকে। রকেটের গতি যত বাড়ছে এই টানও তত বাড়ছে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই তুমি পৃথিবীর টান ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে মহাকাশে পৌঁছে যাবে।
            এবার তুমি দেখবে হঠাৎ সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তোমার মনে হবে তুমি শোলার মতো হালকা হয়ে গেছো। কমান্ড মডিউলে সবকিছু নিদির্ষ্ট জায়গায় আটকে না রাখলে শূন্যে ভাসতে থাকবে। ইচ্ছে করলে তুমি শূন্যে উড়তেও পারবে। কারণ সেখানে কোন মাধ্যাকর্ষণ নেই।
            পৃথিবী থেকে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছাতে তিন দিন লাগবে। চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছানোর পর চন্দ্রযানের কমান্ড ও সার্ভিস মডিউল এবং লুনার মডিউল ছাড়া রকেটের বাকি অংশ আলাদা হয়ে যাবে। কমান্ড মডিউল থেকে চাঁদের দিকে তাকালে পরিষ্কার দেখতে পাবে গোলাকার চাঁদ। চাঁদের যতই কাছে যাবে দেখবে চাঁদের আসল চেহারা। চাঁদের যে দিকটা আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই, সেটা তো দেখবেই, চাঁদের অন্যপিঠও দেখবে।
            চাঁদের কক্ষপথে বেশ কয়েকবার প্রদক্ষিণ করার পর কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউল আলাদা করে ফেলবে। কমান্ড মডিউলের পাইলট কমান্ড মডিউল চাঁদের কক্ষপথে চালাতে থাকবে। তুমি ও লুনার মডিউলের পাইলট লুনার মডিউলে উঠে চাঁদের দিকে যাবে। লুনার মডিউলের ইঞ্জিন ও স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশান সিস্টেম চাঁদে নামার উপযুক্ত স্থানে ল্যান্ড করাবে লুনার মডিউল। চাঁদে যেহেতু কোন বাতাস নেই নামার সময় কোন ঝাঁকুনি বা দুলুনি এসব কিছুই পাবে না। চাঁদের উপরিতল ধুলোময়। লুনার মডিউল ধুলোর উপর ল্যান্ড করবে।
            লুনার মডিউল থেকে বাইরে বের হবার সময় সাথে সব দরকারি যন্ত্রপাতি নিয়ে বের হবে। চাঁদের মাটিতে পা দিয়ে দেখবে নিজের ওজন ছয় ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। বাতাস নেই বলে ধুলোবালি একটুও নড়বে না। তুমি যদি কোন দাগ দাও সেখানে সেটা সেরকমই রয়ে যাবে কোটি বছর।
            তুমি দেখবে চাঁদের বুকে পৃথিবী থেকে পাঠানো অনেক যন্ত্রপাতি, অ্যাপোলো অভিযাত্রীদের ফেলে আসা যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসপত্র পড়ে রয়েছে।  আগের অ্যাপোলো মিশনের ছয়টি লুনার মডিউলের ল্যান্ডিং পার্টসও দেখতে পাবে সেখানে। তোমার বুটের নিচে চাঁদের মাটি রেগোলিথ দেখবে অনেকটা নরম পলির মতো। চারপাশে দেখবে অনেকটা ধূসর উঁচুনিচু নদীর চরের মতো। মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট গর্ত। তারপর কিছু উঁচু পাহাড় আর উপত্যকা।
            চাঁদের পাহাড়ের উপর উঠে দেখলে মনে হবে দিগন্ত যেন খুব কাছে চলে এসেছে। পৃথিবীর চারভাগের এক ভাগ সাইজের একটা গোলকের ওপর তুমি দাঁড়িয়েছো, তাই তাঁর সীমান্তের বাঁকগুলো চোখে পড়বে - কারণ তোমার দৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করার মতো কিছুই নেই সেখানে।
            আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখবে সূর্য। কিন্তু সূর্যকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেই দেখবে ঘন অন্ধকার। পৃথিবীতে যেমন সূর্য পূর্বদিকের আকাশে থাকলেও পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ে সেই আলো, চাঁদে কিন্তু সেরকম নয়। চাঁদের আকাশ কুচকুচে কালো। বায়ুমন্ডল নেই বলে সূর্যের আলোর কোন বিচ্ছুরণ নেই। চাঁদ থেকে পৃথিবীর উদয় ও অস্তও দেখতে পাবে। চাঁদ থেকে পৃথিবীকে একটি নীল গোল মার্বেলের মতো লাগবে।
            চাঁদের ল্যান্ডস্কেপ দেখতে হলে লুনার মডিউলে ঢুকে যাও। তারপর মডিউল নিয়ে চাঁদের উপর ভূমি থেকে ১০০ মিটারের মত উঁচু দিয়ে ঊড়তে উড়তে তুমি চাঁদের পিঠের বড় বড় গর্ত, পাহাড় আর শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো সমতল ভূমি দেখতে পাবে - যেগুলোর নাম মারিয়া বা সমুদ্র। চাঁদের পৃষ্ঠের প্রায় ১৭% জুড়ে আছে এই মারিয়া। এগুলো সব তৈরি হয়েছিল চাঁদের বুকে আগ্নেয়গিরির লাভার স্রোতের প্রবাহে।
            আগ্নেয়গিরির লাভার উপস্থিতিও পাওয়া গেছে চাঁদের পিঠে। কিন্তু ঠিক কোথায় আগ্নেয়গিরির ফাটলগুলো আছে তা বের করা সহজ নয়। তবে ভেতরের গ্যাস ও লাভা উদ্গীরণ ঘটে প্রায় কয়েক শ' কিলোমিটার পর্যন্ত চলে যায়। সেগুলো আবার শুকিয়েও যায়।
            তুমি দেখবে সি অব নেকটার বা অমৃত-সাগর যেটা সৃষ্টি হয়েছিল ৩৫০ কোটি থেকে ৩৮০ কোটি বছর আগে। প্রায় একই সময়ে সৃষ্টি হওয়া সি অব ট্রাংকুইলিটি - যেখানে নেমেছিল অ্যাপোলো-১১ এর লুনার মডিউল ঈগল।




কয়েকটি প্রধান মারিয়ার অবস্থান উপরের চিত্রে দেখানো হয়েছে। এই মারিয়াগুলোকেই আমরা পৃথিবী থেকে দেখতে পাই চাঁদের গায়ে কালো কালো দাগের মতো।
            ৬০০ কিলোমিটার লম্বা মারে ইমব্রিয়ামের কিনারা ঘেঁষে দেখবে অ্যাপেনিয়াস পর্বত যার সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা তিন কিলোমিটারের বেশি।
            ছোটবড় অসংখ্য ক্রেটার (Crater) বা গর্ত আছে চাঁদের গায়ে। বেশিরভাগই সৃষ্টি হয় চাঁদের পিঠে গ্রহাণুর আঘাতে তিন শ কোটি বছর আগে, যখন সৌরজগতের মধ্যে হাজার হাজার গ্রহাণু ঘুরে বেড়াতো আর চাঁদের পিঠও ছিল নরম। গ্রহাণুগুলো চাঁদের পিঠে এত জোরে পড়েছে যে গর্তগুলোর আকার হয়েছে বস্তুগুলোর আকারের চেয়ে ১৫ গুণ বড়।
            অনেকগুলো বড় বড় গর্তের নাম রাখা হয়েছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের নামে। দেখবে কম্পটন নামের ১৬০ কিলোমিটার ব্যাসের একটি বড় গর্ত। কপারনিকাসের ব্যাস ৯১ কিলোমিটার, প্ল্যাটোর ব্যাস ১০৯ কিলোমিটার, টাইকো ব্রাহের ব্যাস ৮৫ কিলোমিটার, আর্কিমেডিসের ব্যাস ৮২ কিলোমিটার।
            এবার তোমার লুনার মডিউলকে উড়িয়ে নিয়ে যাও চাঁদের অন্যপিঠে। এই পিঠটা পৃথিবী থেকে কখনোই দেখা যায় না। এদিকে তুমি কোন 'মারে' দেখতে পাবে না। কিন্তু অসংখ্য গর্ত দেখতে পাবে। চাঁদের এই অবস্থা থেকে এরপর থেকে তোমাকে কেউ 'চাঁদের মতো মুখ' বললে তোমার মেজাজ খারাপ হতে পারে। চাঁদের এই দিকের পিঠের সর্বনিম্ন ভূমি থেকে সর্বোচ্চ ভূমির উচ্চতার পার্থক্য প্রায় ষোল কিলোমিটার।
            এবার চলো চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে। সেখানে দেখতে পাবে চাঁদের সবচেয়ে বড় ক্রেটার - 'সাউথ পোল অ্যাইটকেন' (South Pole-Aitken)। ৪৩০ কোটি বছর আগে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি চওড়া এই গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। আগ্নেয়গিরির লাভার স্রোত এখানে এসে পৌঁছায়নি, তাই এটা ক্রেটারই রয়ে গেছে।


           

ফিরে আসার সময় লুনার মডিউলের ল্যান্ডিং অংশটা চাঁদেই রেখে দিয়ে ফিরে আসার ইঞ্জিন চালু করে লুনার মডিউল উড়িয়ে নিয়ে চলে আসো চাঁদের কক্ষপথে। সেখানে কমান্ড মডিউলের পাইলট তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কমান্ড মডিউলে ওঠার পর লুনার মডিউলের আর দরকার নেই। সেটা মহাশূন্যেই ছেড়ে দিয়ে আসো। কমান্ড মডিউল তোমাকে নিয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দেবে। ফ্রি রিটার্ন ট্র্যাজেক্টরি ধরে কমান্ড মডিউল চলে আসবে পৃথিবীতে। 

চাঁদের নাম লুনা - ৩৩



চাঁদের পরিবেশ

চাঁদের নভোচারীদের পোশাক তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করেছো। চাঁদে নামার সময় ওরকমই আটঘাট বেঁধে নামতে হয় কারণ আমরা পৃথিবীর যে পরিবেশে অভ্যস্ত সেই পরিবেশের কিছুই নেই সেখানে। বাতাস ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না।
            চাঁদের বায়ুমন্ডল বলতে কিছুই নেই। খুব সামান্য পরিমাণে হিলিয়াম, নিয়ন, হাইড্রোজেন আর আর্গনের অস্তিত্ব আছে চাঁদে। কিন্তু হাইড্রোজেন ছাড়া বাকিরা সবাই নিষ্ক্রিয় গ্যাস - ফলে চাঁদে কোন বায়ুমন্ডল গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া এই গ্যাসগুলো খুবই হালকা। সেগুলোকে চাঁদের পিঠে ধরে রাখার জন্য জোরালো অভিকর্ষ দরকার। কিন্তু চাঁদের অভিকর্ষের মান খুবই কম।
            চাঁদের অভিকর্ষ পৃথিবীর অভিকর্ষের ছয় ভাগের এক ভাগ। পৃথিবীতে তোমার ভর যদি ৪০ কেজি হয়, চাঁদে তোমার ভর কত হবে বলতে পারবে? কী বললে? ছয় ভাগের এক ভাগ? না, ভর ঠিক ৪০ কেজিই থাকবে। ভরের কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু ওজনের পরিবর্তন হবে।[1] পৃথিবীতে তোমার ওজন যত, চাঁদে ওজন হবে তার ছয় ভাগের এক ভাগ। তার মানে সবকিছুই হালকা বলে মনে হবে। চাঁদের অভিকর্ষ ত্বরণ ১.৬৩৫ মিটার/বর্গ-সেকেন্ড। চাঁদের সব জায়গায় অভিকর্ষের মান সমান নয়। কিছু কিছু স্থানে ভূমির ঘনত্ব খুবই বেশি। সেই জায়গাগুলোকে বলে ম্যাসকন। ম্যাসকনের কারণে চাঁদের অভিকর্ষ খুবই রহস্যময়।
            অভিকর্ষ কম হওয়াতে চাঁদের মুক্তিবেগ পৃথিবীর মুক্তিবেগের তুলনায় অনেক কম। পৃথিবীর মুক্তিবেগ ঘন্টায় ৪০,৩২০ কিলোমিটার। চাঁদের মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ২.৩৮ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ৮,৫৬৮ কিলোমিটার। তার মানে পৃথিবী থেকে বেরিয়ে যেতে যত বেগে বের হতে হয়, চাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে তার মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ বেগ হলেই চলে।
            চাঁদের তাপমাত্রা খুব চরম ভাবাপন্ন। বায়ুমন্ডল না থাকাতে চাঁদের যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে সেই অংশে তাপমাত্রা প্রায় ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায়। আবার যে অংশে সূর্যের আলো ও তাপ থাকে না সেই অংশের তাপমাত্রা খুবই কমে গিয়ে মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। চাঁদের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই হিসেবে বলা চলে চাঁদ একটি বিশাল আকৃতির ডিপ ফ্রিজ।
            চাঁদে শব্দ শোনা যায় না। কারণ শব্দতরঙ্গ কোন মাধ্যম ছাড়া চলাচল করতে পারে না। চাঁদে বাতাস নেই। তাই চাঁদ সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। চাঁদে নভোচারীরা পাশাপাশি দাঁড়িয়েও কথাবার্তা বলেছেন যান্ত্রিক মাইক্রোফোন ও রিসিভারের সাহায্যে।
            চাঁদে পানি নেই। চাঁদের মাটির শতকরা ৯৯ ভাগ জরিপ করেও কোন পানির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু চাঁদের স্পেস প্রোব লুনার প্রসপেক্টর চাঁদের মেরুতে খুব সামান্য কিছু জমাট বরফের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে। এগুলো চাঁদের মেরুর গভীর গর্তের ভেতর যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। বহুকোটি বছর আগে হয়তো কোন ধূমকেতু থেকে এই বরফ এসেছিল।
            চাঁদে মহাজাগতিক তেজষ্ক্রিয়তা অনেক বেশি। বায়ুমন্ডল না থাকার কারণে তেজষ্ক্রিয়তা শোষণ করার কোন উপায় নেই।
            চাঁদের চৌম্বকক্ষেত্র নেই বললেই চলে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে  পৃথিবীর কেন্দ্রে তরল লোহার ঘূর্ণনের ফলে। কিন্তু চাঁদের ঘনত্ব পৃথিবীর ঘনত্বের চেয়ে অনেক কম। চাঁদের কেন্দ্রে লোহা বা অন্য কোন ধাতুর গোলক থাকলেও তা হয়তো কঠিন। চাঁদের ঘূর্ণনের বেগ পৃথিবীর ঘূর্ণনের বেগের তুলনায় এত কম যে চাঁদের ঘূর্ণনের দ্বারা কোন বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই চৌম্বকক্ষেত্রও নেই।
            চাঁদের দিন-রাত্রি পৃথিবীর দিন-রাত্রির তুলনায় খুবই দীর্ঘ। চাঁদ নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে ২৮ দিন সময় নেয়। তাই চাঁদের একদিকে ১৪ দিন ধরে একটানা দিনের আলো থাকে, আর অন্যদিকে চৌদ্দ দিন ধরে একটানা রাতের অন্ধকার থাকে।
            চাঁদের আকাশ কালো। কারণ সেখানে কোন বায়ুমন্ডল নেই। তাই সূর্যের আলোর কোন বিচ্ছূরণ ঘটে না। চাঁদের যেখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে সেখানেই শুধু আলো থাকে। বাকি অংশে সেই আলো যায় না। পৃথিবীর আকাশের এক জায়গায় সূর্য থাকলেও বায়ুমন্ডলের কারণে সেই আলো সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চাঁদে সেটা ঘটে না। চাঁদের কালো আকাশে তারা দেখা যায়। কিন্তু সেই তারার আলো স্থির, পৃথিবীর আকাশের মতো ঝিকমিক করে না।
            চাঁদের মাটির রাসায়নিক উপাদান পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেখানে অক্সিজেন, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, ও সোডিয়ামের অস্তিত্ব আছে। খুব সামান্য পরিমাণে টাইটানিয়ামও আছে। মোট রাসায়নিক উপাদানের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ অক্সিজেন। কিন্তু এই অক্সিজেনগুলো সব অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত আছে যে আলাদা অক্সিজেন গ্যাস নেই বললেই চলে। সিলিকনের পরিমাণ শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ, আর অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণ শতকরা প্রায় দশ ভাগ। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ তার চেয়ে কম।


চাঁদের আলো

পূর্ণিমার চাঁদে যখন আলোর বন্যায় ভেসে যায় চারদিক, তখন মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বনে চলে যেতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ইচ্ছের কথা জেনেই মনে হয় লিখেছিলেন "আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে ... ...।" কিন্তু বনে যাওয়ার সুযোগ কোথায়? তাই বনের বদলে ছাদে চলে যাই চাঁদ দেখতে। কী যে ভালো লাগে। চাঁদের নিজের আলো নেই, সূর্যের আলো চাঁদের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে যেটুকু আসে তাতেই এত আলো! সূর্য হলো রাগী বড়মামার মতো, সরাসরি তাকানো যায় না। আর চাঁদ হলো হাসিখুশি ছোটখালার মতো, যতক্ষণ খুশি তাকিয়ে থাকা যায়।
            সুর্যের আলোর কতটুকু প্রতিফলিত হয় চাঁদের পিঠ থেকে? চাঁদ খুব একটা ভালো প্রতিফলক নয়। যতটুকু আলো তার গায়ে পড়ে তার মাত্র শতকরা সাত ভাগ আলো ফিরিয়ে দেয়। বাকি তিরানব্বই ভাগ আলো চাঁদের পিঠে শোষিত হয়ে যায়। সে তুলনায় আমাদের পৃথিবী অনেক বেশি ভালো প্রতিফলক। পৃথিবী শতকরা ৩৯ ভাগ আলোর প্রতিফলন ঘটায়। চাঁদ থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে চাঁদের চেয়েও উজ্জ্বল দেখায় আমাদের পৃথিবী।
            চাঁদের আলোর প্রখরতা (intensity of light) মাত্র ০.২ লাক্স।[2] একটি মোমবাতির আলোর প্রখরতাও চাঁদের আলোর প্রখরতার দশ গুণ। চাঁদের আলোয় তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গের সবগুলো কম্পাঙ্কই আছে। তবে সূর্যের আলোর দৃশ্যমান কম্পাঙ্কের সমস্ত বর্ণ চাঁদের আলোয় দেখা যায় না। তাই একেবারে ঝকঝকে পূর্ণিমার আলোতেও আমরা স্বাভাবিক আকৃতির অক্ষরে ছাপানো বই পড়তে পারি না। চাঁদের আলোয় রঙ চেনা যায় না।
            সন্ধ্যাবেলা যখন পূর্বদিকে পূর্ণিমার চাঁদ ঊঠে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখার সময় চাঁদকে স্বাভাবিকের চেয়েও বড় বলে মনে হয়। মনে হয় কত কাছে চলে এসেছে এই চাঁদ। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে চাঁদ যখন আকাশের উপরে উঠে যায়, মনে হয় চলে গেছে অনেক দূরে, আর আকারেও অনেক ছোট হয়ে গেছে।
            কেন এমন হয়? এটা হয় মূলত পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে চাঁদের আলোর প্রতিসরণ ও বিচ্ছুরণের কারণে, এবং কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক কারণে। গাছপালা ইত্যাদির দূরত্ব আমরা জানি। তাই সেগুলোর ফাঁক দিয়ে চাঁদ ওঠার সময় আপেক্ষিকভাবে মনে হয় চাঁদ অনেক কাছে। সেকারণে চাঁদের আকারও অনেক বড় মনে হয়। আবার চাঁদ যখন আকাশের অনেক উপরে উঠে যায় সেখানে দূরত্ব তুলনা করার মতো আর কোন কিছু থাকে না। তাই মনে হয় চাঁদ দূরে চলে গেছে। আর মনের স্বাভাবিক হিসেব - দূরের জিনিস ছোট দেখা যাবে। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো চন্দ্রোদয়ের সময় চাঁদের দূরত্ব মাঝ আকাশের চাঁদের দূরত্বের চেয়ে কয়েক হাজার কিলোমিটার বেশি।

           





[1] ওজন হলো ভর ও অভিকর্ষজ ত্বরণের গুণফলের সমান। চাঁদের অভিকর্ষজ ত্বরণের মান পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের ছয় ভাগের একভাগ।
[2] লাক্স (Lux) হলো আলোর প্রখরতার একক। একটা ছোট্ট মোমবাতি জ্বালালে সেটা থেকে এক মিটার দূরে আলোর যে প্রখরতা হবে সেটার পরিমাণ এক লাক্স।

চাঁদের নাম লুনা - ৩২



চাঁদের গঠন

গোলাকার চাঁদের উপরের স্তরকে চাঁদের ক্রাস্ট (Crust) বলা হয়। শক্ত পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি এই ক্রাস্টের পুরুত্ব চাঁদের দুই পিঠে দুই রকমের। চাঁদের যে পিঠ আমরা সবসময় দেখি সেদিকে এই পুরুত্ব ৬৫ কিলোমিটারের মতো। আর যেদিকটা পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, সেদিকের পুরুত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। চাঁদের ক্রাস্ট সব জায়গায় সমান নয়। কোন কোন জায়গায় এই আবরণ প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু। আবার কোন কোন জায়গায় এই আবরণ নেই বললেই চলে। যে মুখ পৃথিবী থেকে দেখা যায় সেদিকে ক্রাস্ট হালকা। জন্মের সময় এই স্তর নরম ও গরম ছিল। আস্তে আস্তে ঠান্ডা ও শক্ত হয়েছে চারশ চল্লিশ কোটি বছর ধরে।
            চাঁদের একেবারে উপরের স্তরে কয়েক মিটার পুরু খুবই মিহি ধুলোর আস্তরণ। এগুলোকে চাঁদের মাটি বলা যায়। এই চাঁদের মাটিকে ইংরেজিতে বলা হয় রেগোলিথ (regolith)। চাঁদের পিঠে ক্রমাগত আঘাত হেনে চলেছে ছোট বড় গ্রহাণু। সেগুলো সেখানে গুড়ো গুড়ো হয়ে মিহি পাউডারে পরিণত হয়েছে। চাঁদে যেহেতু কোন বায়ুমন্ডল নেই, তাই এই ধুলোগুলো কখনো উড়ে না। যেভাবে আছে সেভাবেই রয়ে গেছে শত কোটি বছর।
            ক্রাস্টের নিচে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু পাথরের স্তরের নাম ম্যান্টল (Mantle)। এই পাথরগুলো কঠিন ও তরলের মাঝামাঝি। ম্যান্টলের নিচের দিকের পাথরগুলো এখনো কিছুটা গরম ও আংশিক তরল। আগ্নেয়গিরির সময় এখান থেকেই লাভার স্রোত বেরিয়ে পড়েছিল ক্রাস্ট ভেদ করে। চাঁদের যে পিঠ আমরা দেখতে পাই সেদিকেই কালো কালো দাগ বেশি। এই কালো দাগগুলো লাভার স্রোতে তৈরি সমতল ক্ষেত্র। এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে চাঁদের সমুদ্র বা মারিয়া। এগারোটি ছোট বড় মারিয়া আছে সেদিকে।  সেদিকে ক্রাস্টের পুরুত্ব কম ছিল বলে লাভার স্রোত সেদিকেই বেশি বের হয়েছিল। চাঁদের বিপরীত পিঠে ক্রাস্টের পুরুত্ব বেশি বলে সেদিকে লাভার স্রোত বেশি বের হতে পারেনি। তাই সেদিকে কালো দাগ কম। সেদিকে শুধুমাত্র একটি বড় মারিয়া আছে।
            চাঁদের গোলকের একেবার কেন্দ্রে ছোট একটা কোর (Core) বা অন্তকেন্দ্র আছে। তবে সেটা পৃথিবীর কোরের মত অত বড় নয় এবং তত শক্তও নয়। কোরের ব্যাসার্ধ প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত ধরা যায়। একেবারে ভেতরের শক্ত কোরের ব্যাসার্ধ বা পুরুত্ব ২৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। সেখানে কোন লোহা নেই বলে মনে হচ্ছে। ফলে চাঁদের কোন চৌম্বকক্ষেত্র নেই।
            চাঁদের গোলকের ভেতরে কোন কাজকর্ম নেই। সক্রিয় কোন আগ্নেয়গিরি নেই। বলা চলে চাঁদ একটি মৃত গোলাকার প্রাচীন পাথরখন্ড। চাঁদের ভূমিকম্প মাপার জন্য যন্ত্রপাতি রেখে দেয়া হয়েছিল চাঁদের পিঠে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেখানে ভূমিকম্প নেই বললেই চলে।


চাঁদের নাম লুনা - ৩১



চাঁদের জন্ম
                                                                                                            পৃথিবীর বয়স যখন দশ কোটি বছর তখনো পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রাকৃতিক সংঘর্ষ চলছিলো। বিশাল আকৃতির গ্রহাণু আছড়ে পড়ছিলো পৃথিবীর উপর। এসময় পৃথিবীর দিকে প্রচন্ড গতিতে ধেয়ে এলো বিশাল আকৃতির একটা পাথর। পরে বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন থেইয়া (Theia)। থেইয়ার আকার ও আয়তন মঙ্গল গ্রহের সমান। থেইয়ার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে পৃথিবীর একপাশ থেকে বিরাট একটা অংশ ভেঙে গেলো, থেইয়া গেলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে। সংঘর্ষের ফলে যে তাপ উৎপন্ন হলো তাতে এতদিন ধরে পৃথিবীর যে বায়বীয় আবরণ তৈরি হচ্ছিলো তা একেবারে বাষ্প হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো।
            তারপরেও পৃথিবীর ঘূর্ণন কিন্তু থামেনি একটুও। থেইয়ার ধ্বংসাবশেষ আর পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়া অংশগুলো মহাকর্ষ বলের প্রভাবে মিশে গিয়ে একটা পিন্ডে পরিণত হয়ে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে শুরু করলো। এই গোলাকার পিন্ডটিই হলো পৃথিবীর চাঁদ। 



অ্যাপোলো মিশন চাঁদের যে পাথরের নমুনা নিয়ে এসেছে তা রেডিও-ডেটিং[1] করে দেখা গেছে যে সেগুলোর বয়স ৩১০ থেকে ৩৯০ কোটি বছরের ভেতর। দক্ষিণ মেরুতে ২০০৭ সালে পাওয়া একটি পাথরে চাঁদের উপাদান পাওয়া গেছে যার বয়স ৪৩৫ কোটি বছর। চাঁদের জন্মের সময় হয়তো এই পাথর ছিটকে পড়েছিল উত্তপ্ত পৃথিবীর গায়ে। সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য ও প্রমাণ থেকে হিসেব করে দেখা যায় চাঁদের বয়স প্রায় চার শ' চল্লিশ কোটি বছর। জন্ম থেকে এত বছরে চাঁদ অনেক বিবর্তিত হয়েছে। দেখা যাক কীভাবে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছালো সে।

চাঁদের বিবর্তন

চারশ' চল্লিশ কোটি বছর ধরে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে চলেছে চাঁদ। পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে চাঁদেরও অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু চাঁদের পরিবর্তনে পৃথিবীর মতো এত বৈচিত্র্য দেখা যায়নি কখনো। চাঁদে প্রাণের উদ্ভবের পরিবেশ তৈরি হয়নি কখনো। তাই চাঁদে জন্মেনি কোন প্রাণ।
            প্রথম দশ কোটি বছর ধরে উত্তপ্ত গ্যাস ও বস্তুপিন্ড পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে ঘুরতে ঘুরতে গোলাকার হয়েছে। পৃথিবীও তখন প্রচন্ড উত্তপ্ত চাঁদের চেয়ে চারগুণ বড় একটি গোলাকার পিন্ড। আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। ম্যাগনেসিয়াম ও লোহার পরমাণু ঠান্ডা হয়ে কঠিন পাথরের আকার নিতে শুরু করেছে। তারপর বিশ কোটি বছর ধরে আরো ঠান্ডা হতে হতে কিছু পটাশিয়াম ও ফসফরাসের পরমাণু তৈরি হয়েছে। কিন্তু পরের দশ কোটি বছরে চাঁদের ভেতরের গ্যাসের বিস্ফোরণে আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ ঘটেছে। আশি কোটি বছর পর্যন্ত চলেছে চাঁদের বুকে আগ্নেয়গিরির লাভার উদ্‌গীরণ। তার সাথে যোগ হয়েছে মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা গ্রহাণুর অজস্র আঘাত। গ্রহাণুগুলোর আঘাতে চাঁদের গায়ে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত। লাভার স্রোতে তৈরি হয়েছে সমতল  লাভার সাগর। তৈরি হয়েছে উঁচু পাহাড়, উপত্যকা।
            এর পরের ২৬০ কোটি বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ হয়েছে চাঁদে। চাঁদের ৩৮০ কোটি বছর বয়সে সৃষ্টি হয়েছে চাঁদের সবচেয়ে বড় গর্ত - যার নাম দেয়া হয়েছে কপারনিকাস। চাঁদের সবচেয়ে কমবয়সী গর্ত টাইকোর সৃষ্টি হয়েছে মাত্র দশ কোটি বছর আগে। চাঁদের বয়সের তুলনায় দশ কোটি বছর কিছুই না। কিন্তু মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র কয়েক লক্ষ বছর আগে।
            পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হওয়ার অনেক আগে থেকেই চাঁদ আস্তে আস্তে তার বর্তমান আকার ধারণ করে ফেলেছে। বর্তমানে চাঁদের যে ভৌগোলিক পরিবেশ আমরা দেখি তা কোটি বছর থেকেই আছে সেভাবে।



[1] রেডিয়েশান বা তেজষ্ক্রিয়তা পদার্থের একটি মৌলিক ধর্ম। তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাপ করে পদার্থের অর্ধ-জীবন বা হাফ লাইফের সাথে হিসেব করে পদার্থের বয়স হিসেব করা যায়।

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts