Monday 4 November 2019

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ২১


পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

পৃথিবীতে মানুষের বাস প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে থেকে। প্রাণের উদ্ভব হয়েছে এই পৃথিবীতে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে। পৃথিবীর বয়স হলো প্রায় সাড়ে চারশ' কোটি বছর। ২০১৫ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা সাত শ' কোটির বেশি। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে নয় শ' থেকে এক হাজার কোটিতে। এই জনসংখ্যার বেশিরভাগ বাস করবে উন্নয়নশীল দেশে। তাদের সবার জন্য খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার জোগান দিতে অনেক কষ্ট করতে হবে পৃথিবীর মানুষের। 
            পৃথিবী খুবই গতিশীল একটি গ্রহ। খুবই সক্রিয় আর চঞ্চল গ্রহ। প্রচন্ড গতির পাশাপাশি এখানে চলছে আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ, মহাদেশ দু'ভাগ হয়ে যাচ্ছে, সমুদ্র মরে যাচ্ছে, আবার জেগে উঠছে পর্বত-মালা। ভবিষ্যতে পৃথিবীর আরো অনেক রকম পরিবর্তন হতে পারে।
            আগামী ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ বছর পরে পৃথিবী ভয়াবহ তুষার যুগে প্রবেশ করতে পারে। পৃথিবীর উপরিতল পুরোটাই বরফে ঢেকে যাবে। তারপর বরফ যুগ কেটে গিয়ে আবার হয়তো জেগে উঠবে পৃথিবী।
            ৫০ কোটি বছর পর             পৃথিবীর বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমতে কমতে একেবারে শেষ হয়ে যেতে পারে। তখন উদ্ভিদের সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাতাসে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন অক্সিজেন নির্ভর প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।
            আজ থেকে ২৩০ কোটি বছর পর পৃথিবীর চুম্বকত্বের পরিমাণ শূন্য হয়ে যাবে। ফলে পৃথিবীর বায়মন্ডলের বাইরের চৌম্বকক্ষেত্র উধাও হয়ে যাবে। তখন সূর্যের তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ সরাসরি পৃথিবীতে চলে আসবে। পৃথিবী তেজষ্ক্রিয় গোলকে পরিণত হবে। পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তন তখন সাংঘাতিকভাবে বদলে যাবে। পৃথিবীর প্রাণী হয়তো তেজষ্ক্রিয় বিকিরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
            মহাশূন্যের যেখানে আমাদের পৃথিবী এবং সৌরজগৎ অবস্থিত সেটা খুব একটা নিরাপদ জায়গা নয়। সেখানে পুরনো বিশাল নক্ষত্র বড় হতে হতে সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হতে পারে। সেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর স্থায়ীভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে মহাজাগতিক বিকিরণ এসে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্ব।
            এত কিছু সম্ভাবনার মধ্যে কোনটা হতে পারে আবার কোনটা নাও হতে পারে। কিন্তু যেটা অবধারিত তা হল সূর্যের মৃত্যু। সূর্যের হাইড্রোজেন একদিন শেষ হয়ে যাবে। মরে গিয়ে সূর্য রেড জায়ান্ট[1] বা লাল দৈত্যে পরিণত হবে। এটা কিন্তু ঠাকুরমার ঝুলির কাল্পনিক দৈত্য নয়। এটা মহাকাশের বাস্তব দৈত্য। তারপর কয়েক হাজার বছরের মধ্যে সেই লাল দৈত্য পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবে।
            এসব ঘটবে আরো প্রায় পাচ শ' কোটি বছর পর। তবে আমাদের এখনই সেটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক। ততদিনে মানুষ হয়তো পৃথিবীর চেয়েও নিরাপদ কোন গ্রহ আবিষ্কার করে সেখানে বসবাস করতে শুরু করবে। মানুষ তখন সত্যিকার অর্থেই ইউনিভার্সাল হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে বিশ্ব-নাগরিক থেকে মহাবিশ্ব-নাগরিক।

  


তথ্যসূত্র 
1.   Isaac Asimov, Our Planet Earth, Gareth Stevens Publishing, Wisconsin, USA, 1995.
2.   Chris Cooper, Pam Spence, Carole Stott, Stars + Planets an illustrated guide, Star Fire, London, 2007.
3.   Stuart Malin, Story of the Earth, Eagle Books, London, 1991.
4.   John Gribbin, Planet Earth a Beginner's Guide, OneWorld, Oxford, 2012.
5.   Martin Redfern, The Kingfisher Book of Planet Earth, Kingfisher, London, 2001.
6.   Gerard Cheshire, The Solar System and Beyond, Evans, London, 2006.
7.   Giles Sparrow, Planets and Moons, Hinkler Books, Australia, 2006.
8.   Dr Brian Knapp, Spaceship Earth, Atlantic-Europe Publishing, 2004.
9.   Cally Hall and Scarlett O'Hara, 1001 Facts About Planet Earth, Dorling Kindersley, London, 2003.
10. John Farndon, Planet Earth, Anness Publishing Ltd, Leicestershire, 2013.
11. Steve Parker, Solar System, Ticktock Media Ltd, Great Britain, 2006.
12. Colin Ronan, The Universe Explained, Ken Fin Books, Australia, 1997.
13. Susanna van Rose, Eyewitness Earth, DK Publishing, USA, 2005.
14. Heather Couper and Nigel Henbest, Encyclopedia of Space, DK Publishing, UK, 2003.


[1] নক্ষত্রের সব হাইড্রোজেন যখন শেষ হয়ে যায় তখন তার নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। নক্ষত্রটি তখন আয়তনে অনেক বড় হয়ে যায়। জ্বালানি শেষ হয়ে যাবার ফলে তাদের তাপমাত্রা কমতে কমতে নক্ষত্রটি লাল রঙ ধারণ করে। এই মৃতপ্রায় বিশাল আকৃতির নক্ষত্রকে রেড জায়ান্ট বা লাল দৈত্য বলা হয়। 

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ২০


পৃথিবীর সম্পদ

মহাবিশ্বের অতিসাধারণ একটি নক্ষত্র থেকে জন্ম নেয়া অসাধারণ একটি গ্রহ আমাদের পৃথিবী। এই পৃথিবী স্বয়ংসম্পূর্ণা। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের খাবার আসছে এই পৃথিবীর বুক থেকেই। বাসস্থান তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর পেট থেকে বের করা পদার্থ দিয়ে। আমাদের জ্বালানি আসছে পৃথিবীর ভেতর থেকে এবং প্রধান জ্বালানি সৌরশক্তি আসছে সূর্য থেকে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে বাতাস - সেটা আসছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল থেকে। পানি আছে আমাদের পৃথিবীর পিঠে, বাতাসে, মেঘে। মানুষসহ সব প্রাণী এবং উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার তার সবই জোগান দিচ্ছে আমাদের পৃথিবী।
            খনি থেকে আমরা তুলে আনছি সোনা, রূপা, প্লাটিনাম। ভূমিস্তরের চাপে তৈরি হয়েছে হীরা এবং আরো অনেক দামী পাথর। যান্ত্রিক সভ্যতার প্রধান উপকরণ যে ধাতু সেগুলো আমরা পৃথিবী থেকেই পাচ্ছি। লোহা ও তামার খনি থেকে আমরা প্রতিনিয়তই তুলে আনছি লোহা ও তামার আকরিক। পৃথিবীতে যেসব ধাতু খুব বেশি পাওয়া যায় না - আমরা তাদের নাম দিয়েছি রেয়ার মেটাল বা দুষ্প্রাপ্য ধাতু। স্ক্যানডিয়াম ও গ্যাডোলিনিয়াম পৃথিবীতে খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা ওসব ব্যবহার করছি মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ব্যাটারি, এবং মহাকাশযান তৈরিতে।
            আমাদের দৈনন্দিন কাজে যা যা লাগে তার সবকিছুই আমরা পৃথিবীরই কোন না কোন উপাদান দিয়ে তৈরি করছি। আমাদের খাদ্যশস্যের উৎপাদনে আমরা যে সার ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে। ইউরিয়া সার তৈরির কাঁচামাল হলো প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাতাস।
            মানুষ লবণের ব্যবহার শুরু করেছে আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। এই লবণ আসছে সমুদ্রের পানি ও খনি থেকে। ঘরবাড়ি তৈরির যে সিমেন্ট, পাথর, বালি সব আসছে পৃথিবী থেকেই।
            আধুনিক মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে গতি অর্জন করেছে তার প্রধান সহায়ক হিসেবে এখন আছে কম্পিউটার। যে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধ-পরিবাহী প্রযুক্তির মাধ্যমে এটা অর্জিত হয়েছে - সেই সেমিকন্ডাক্টরের একটি প্রধান উপাদান সিলিকন হলো পৃথিবীর বালি। অথচ মানুষের কাছে এখনো এক গ্রাম সোনার দাম এক গ্রাম বালির দামের চেয়ে বেশি।
            পৃথিবীর মানুষ ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু করেছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। ব্রোঞ্জ হলো টিন ও তামার সংকর। তিন হাজার বছর আগে শুরু করেছে লোহার ব্যবহার। মানুষ তখন থেকেই খনি থেকে লোহার আকরিক তুলতে শুরু করেছে। আজ পৃথিবীতে যে পরিমাণ ধাতু ব্যবহার করা হয় তার শতকরা ৯০ ভাগ হলো লোহা। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের বিপরীতে প্রায় দুই টন করে লোহা ব্যবহার করা হচ্ছে বর্তমানে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোহা উৎপাদন করে ব্রাজিল, তারপর অস্ট্রেলিয়া।
            পৃথিবীর নিজস্ব যে সম্পদ - প্রাকৃতিক সম্পদ তা ব্যবহার করে মানুষ টিকে আছে। তার ওপর ভিত্তি করে মানুষ আবিষ্কার করছে নতুন নতুন কৃত্রিম সম্পদ। রাজনৈতিক নীতি এবং বল প্রয়োগে মানুষ পৃথিবীকে আজ বিভিন্ন ভৌগোলিক সীমারেখায় ভাগ করে নিয়েছে। যে দেশের সীমানায় যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ আছে এবং যে দেশ যত বিচক্ষণতার সাথে সেই সম্পদ ব্যবহার করতে পারছে তারা তত ধনী দেশে পরিণত হচ্ছে। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর খনিজ পদার্থ আছে এবং তারা সেই খনিজ পদার্থ বিক্রি করে ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ তেল বিক্রি করে ধনী হয়েছে। আবার অনেক দেশে তেমন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই - কিন্তু তারা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ধনী হয়েছে। যেমন জাপান। আবার অনেক জাতি প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরেও বিশ্ব-রাজনীতির কারণে তেমন সুবিধা করতে পারছে না। যেমন আফ্রিকা। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সেখানকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে আমেরিকার চেয়ে কম ধনী। অথচ আফ্রিকায় আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরার খনি। ১৯০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে পাওয়া গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরা। যার ওজন তিন হাজার ক্যারেটেরও বেশি (৬২১ গ্রাম)।
            আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যাবার পর আমরা বেশিরভাগ ব্যবহার করে ফেলেছি আমাদের রান্নার কাজে। তার চেয়েও বেশি অপচয় করেছি গ্যাসের চুলা না নিভিয়ে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার পৃথিবীতে যে পরিমাণ গ্যাস এখন জমা আছে তা ২৩০০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।




জীবাশ্ম জ্বালানি ও বিকল্প শক্তি

পৃথিবীর তিনটি প্রধান জীবাশ্ম জ্বালানি হলো - কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস। পৃথিবীর মোট জ্বালানি চাহিদার ৩৪% মিটে তেল থেকে। প্রাকৃতিক গ্যাস পৃথিবীর জ্বালানি চাহিদার ২১% মেটায়। এটা তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি উৎস। কয়লা জ্বালানি চাহিদার বেশিরভাগ অংশ মেটায়। এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে কয়লার চাহিদা গত পাঁচ বছরে প্রায় ৮০% বেড়ে গেছে। পৃথিবীর উপরিস্তরের ক্রমাগত বিবর্তনের ফলে ভূ-গর্ভের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সময়ে এসব জ্বালানির উৎপত্তি হয়েছে।
            প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডায়নোসররা পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। মনে করা হয় এই বিপুল পরিমাণ প্রাণিদেহ মাটিতে মিশে মাটির একটা স্তরে হাইড্রোকার্বন তৈরি করেছে। সেখান থেকে খনিজ তেল আকারে জমা আছে ভূ-গর্ভস্থ বিভিন্ন স্তরে। কিন্তু তারও অনেক আগে, কার্বনিফেরাস যুগে (৩৬ থেকে ২৯ কোটি বছর আগে) পৃথিবীপৃষ্ঠে জলাভূমি ভর্তি বড় বড় গাছ, ফার্ন আর বড় বড় পাতাযুক্ত গাছে ভর্তি ছিল। সমুদ্রের পানিভর্তি শৈবাল। ছোট ছোট সামুদ্রিক উদ্ভিদে ভর্তি ছিল জলাভূমি। গাছপালাগুলো মরে জলাভূমিতে পচেছে বছরের পর বছর। পচতে পচতে নরম কাদার মতো স্পঞ্জি স্তর সৃষ্টি হয়েছে যার নাম পিট। তার পর শত শত বছর ধরে তার ওপর জমেছে বালি কাদা এবং আরো অনেক পদার্থের স্তর। তারা জমতে জমতে একটা নতুন ধরনের শক্ত স্তরে পরিণত হয়েছে। স্তরের ওপর স্তর জমতে জমতে নিচের স্তরের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। পিটের ওপর চাপ বাড়তে বাড়তে ওখান থেকে সব পানি বের হয়ে আসে। তারপর কোটি বছর পরে পিট স্তর - কয়লা, গ্যাস ও তেলে পরিণত হয়।




বর্তমানে যে হারে গ্যাস, তেল ও কয়লার ব্যবহার করছে মানুষ - তাতে বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন ২১৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ভূ-গর্ভস্থ সব তেল শেষ হয়ে যাবে। ২২৫০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে কয়লা এবং ২৩০০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে প্রাকৃতিক গ্যাস।
            আমাদের কি উচিত নয় একটু চিন্তাভাবনা করে এসব সম্পদের ব্যবহার করা? বিজ্ঞানীরা বসে নেই। তাঁরা ইতোমধ্যেই বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে শুরু করেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশে এখন সৌরশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে জ্বালানির কাজে। সৌরশক্তিচালিত গাড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে। এমনকি সৌরশক্তিচালিত বিমানও উড়েছে আকাশে। সম্পূর্ণ সৌরশক্তি চালিত বিমান 'সোলার ইমপাল্‌স'[1] পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পাড়ি দিয়েছে।




বর্তমানে পৃথিবীর জ্বালানি শক্তির শতকরা ১৬ ভাগ উৎপন্ন হচ্ছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে যা অদূর ভবিষ্যতে শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই এবং যারা গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদন করে না। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসে আছে বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি, পানিশক্তি ইত্যাদি। নিউক্লিয়ার জ্বালানিও জীবাশ্ম জ্বালানির একটা শক্তিশালী বিকল্প। কিন্তু নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর স্থাপন করা ও চালানোর খরচ অত্যন্ত বেশি। তাছাড়া নিউক্লিয়ার বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাও খুবই ঝামেলার ব্যাপার। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার ফল খুবই মারাত্মক হতে পারে। তাই নিউক্লিয়ার জ্বালানিকে খুব একটা নিরাপদ জ্বালানি বলা যায় না।
            পৃথিবীতে প্রতিবছর বায়ুশক্তি চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ হারে বেড়ে যাচ্ছে। এরকম একটা বড় টারবাইন যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে তাতে দশ হাজার বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব।





[1] সোলার ইমপাল্‌স - সুইজারল্যান্ডে নির্মিত পরীক্ষামূলক সৌরশক্তি চালিত বিমান। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এটা প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে আকাশে ওড়ে। তারপর অনেকবার এটা আকাশে ঊড়ে বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। এ পর্যন্ত এরকম দুটো বিমান তৈরি হয়েছে। সোলার ইমপাল্‌স-২ ২০১৫ সালে বিশ্বের বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে সফলভাবে পৌঁছাতে পেরেছে। এই বিমানে কোন রকমের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়নি।  বিমানের দৈর্ঘ্য ২২.৪ মিটার, পাখার দৈর্ঘ্য ৭১.৯ মিটার এবং উচ্চতা ৬.৩৭ মিটার। ভর ২৩০০ কিলোগ্রাম। ৬৩৩ কেজি ওজনের লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা হয় এই বিমানে। 

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ১৯


সমুদ্রের গভীরে

আমাদের পৃথিবীর শতকরা ৭০ ভাগ ক্ষেত্রফল দখল করে আছে সমুদ্র। সমুদ্রের আনুমানিক গড় গভীরতা চার কিলোমিটারের মত। সেখানে সূর্যালোক পৌঁছায় না। কিন্তু সমুদ্রের নিচের তল বা ওখানের জগৎ কিন্তু আমাদের ধারণা দেয় আমাদের প্রাথমিক পৃথিবী কেমন ছিল, কীভাবে কাজ করছিল। পৃথিবীর মোট প্রাণির মধ্যে আনুমানিক ৫০ থেকে ৮০% প্রাণির সন্ধান পাওয়া যায় সমুদ্রের পানিতে যার দুই তৃতীয়াংশ এখনো অজানা।
            ১৯৬০ সাল থেকে সমুদ্রের তলদেশ পরীক্ষা করা শুরু হয় - শব্দের প্রতিফলন, ম্যাগনেটমিটার, সাবমেরিন ইত্যাদির সাহায্যে। আবিষ্কৃত হয়  সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ৭০ হাজার কিলোমিটার লম্বা পর্বতমালার সারি। এগুলো পৃথিবীর ত্বকে জোড়া বা সেলাইয়ের মুখের মত। এই সত্তর হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সেলাই বরাবর ফুলে উঠেছে পর্বতমালার সারি।
            পৃথিবীর সমুদ্রের গভীরতা সবচেয়ে উঁচু পর্বতের উচ্চতার চেয়েও বেশি। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ৮.৯ কিলোমিটার। অথচ প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে গভীর স্থান (চ্যালেঞ্জার ডিপ) ১১ কিলোমিটার। এভারেস্টও ডুবে যাবে সেখানে।
            সাগরের নিচের স্তর (সমুদ্রের তলা) - নতুন হচ্ছে বারে বারে। পুরনো স্তর ডুবে যাচ্ছে - ঢুকে যাচ্ছে পৃথিবীর গায়ের ভেতর। সেই জায়গায় তৈরি হচ্ছে নতুন স্তর। সমুদ্রের তল যখন ঠান্ডা হয়ে যায় তখন তার ঘনত্ব বেড়ে যায় ফলে একটু ভারি হয়ে যায়। তখন তারা নিচের দিকে চলে যায়। একটু গরম স্তর উপরে চলে আসে। তখন সেখানে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠতে পারে, বা নতুন ডুবন্ত পাহাড়শ্রেণি জায়গা নেয় তার।
            মহাসাগরের নিচে যেখানে টেকটোনিক প্লেট সরে যায় সেখানে প্রচন্ড গরম পাথর বেরিয়ে আসে এবং তা আস্তে আস্তে পাহাড়-পর্বতে পরিণত হয়ে সমুদ্রের তলদেশে দাঁড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে এই পাহাড়গুলোর উচ্চতা এত বেশি হয় যে সমুদ্রের উপর দেখা যায় এর উপরিভাগ। আমরা এদেরকে দ্বীপ বলি। হাওয়াই দ্বীপ এরকমই একটি দ্বীপ।





সাগরের নিচের স্তরের গায়ে গভীর খাদের মতো যে অংশগুলো দেখা যায় সেগুলোকে উল্টানো পর্বত বলা যেতে পারে - অবশ্য জলীয় পর্বত বা লিকুইড মাউন্টেন। আলাস্কার নিচে যে খাদ পাওয়া গেছে তার গভীরতা হিমালয় পর্বতের চেয়ে বেশি। ফিলিপাইনের নিচে 'ভ্যালি ইন কোর' আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে দ্বিগুণ গভীর।
            পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালা পানির নিচে আছে। মধ্য-আটলান্টিক পর্বতমালা আটলান্টিক মহাসাগরকে তলদেশে দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে। এই পর্বতমালার দৈর্ঘ্য প্রায় ষোল হাজার কিলোমিটার।
            মাঝ-সমুদ্রের নিচে সুপ্ত পাহাড়শ্রেণি ভেদ করে মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির লাভা বেরিয়ে আছে। কিন্তু পানির কারণে তা কিছুটা টুথপেস্টের মতো হয়ে যায়। এগুলোকে পিলো লাভা বা বালিশ লাভা বলা হয়। এরকম লাভা-নির্গমন সাধারণত খুব একটা অশান্ত হয় না। তবে মাঝে মাঝে ছোটখাট ভূমিকম্প হয়ে যায় আশেপাশে।




প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় পুরোটাই একটা বড় টেকটোনিক প্লেটের ওপর বসে আছে। প্লেটের চারপাশে আগ্নেয়গিরির চক্র আছে যাকে রিংস অব ফায়ার বা আগুনের মালা বলা হয়। কিন্তু সব আগ্নেয়গিরিই প্লেটের চারধারে থাকে না। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি আছে - হাওয়াই। পুরো দ্বীপটাই বসে আছে আগ্নেয়গিরির উপর। কোটি বছর ধরে আগ্নেয়গিরির কেন্দ্র পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু প্যাসিফিক প্লেট সরে গেছে উত্তরপশ্চিম দিকে। ফলে বেশ কিছু আগ্নেয়গিরির দ্বীপ তৈরি হয়েছে সেদিকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটা জ্যন্ত ছিল দুই কোটি বছর আগে।

        



মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির ভেতর পানি ঢূকে যায়। তখন সেই পানি মিশে যায় খনিজ পদার্থের সাথে। তখন ছিদ্র দিয়ে গরম বাতাস বেরিয়ে আসার সময় পানি বেরিয়ে আসে। এর তাপমাত্রা ২০০ থেকে ৩০০ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। উচ্চ চাপের কারণে এই পানি ফুটে না। এই ছিদ্রগুলোর আশেপাশে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া দেখা যায়। ব্যাকটেরিয়াগুলো মাছের খাবার হয়। সালফার ও অন্যান্য দ্রবীভূত খনিজ যেগুলো বের হয় এই ছিদ্রপথে - ওগুলো খেয়ে প্রাণিগুলো বেঁচে থাকে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণের প্রতিনিধি।



পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় গ্রহ - পর্ব ১৮



আবহাওয়ার পরিবর্তন

পৃথিবীর আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে প্রতিদিন প্রতিঘন্টায়। এর মূল কারণ সূর্যের সাথে পৃথিবীর সম্পর্ক। সূর্য পৃথিবীকে একটি সৌরশক্তি চালিত তাপ-ইঞ্জিনে পরিণত করেছে। সুর্যের তাপে পৃথিবীর পিঠের বাতাস গরম হয়ে হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়, উপরের ঠান্ডা হাওয়া নিচে চলে আসে - এভাবে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়।
                পৃথিবীকে কোন রকম নাড়াচাড়া না করলে এর বায়ুপ্রবাহও যেমন আছে তেমন থাকতো। কোথাও কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু এটাকে তো তাপমাত্রা ও চাপের পরিবর্তন না করে রাখা যায় না। পৃথিবী নিজের অক্ষে ঘুরে। এর দিন-রাত্রি হয়। বাতাস ঠান্ডা গরম হয়। বায়ু প্রবাহ হয়। সেই প্রবাহ পাহাড়ে  বা অন্য কোথাও বাধা পেয়ে ক্ষেপে ওঠে। সবকিছু মিলিয়ে সারাক্ষণ বিশৃঙ্খলা চলছেই। ফলে পৃথিবীতে দমকা হাওয়া, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো এগুলো দেখা যায়। এগুলো পৃথিবীর চেহারা বদলে দেয়।






পানি চক্র

আমাদের জানামতে পৃথিবী হলো একমাত্র গ্রহ যেখানে কঠিন, তরল ও বাষ্প এই তিন অবস্থাতেই পানি আছে। এখানে কঠিন বরফ আছে, তরল পানি আছে, উষ্ণ জলীয় বাষ্প আছে। পানি পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, সূর্যের তাপ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচলন করে। পানি পৃথিবীর চেহারা বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। পানির ফলে মেঘ হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে, নদী ভাঙছে, চর জাগছে। পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের মূল ভূমিকা পালন করে  বাতাস ও পানি।   






জলীয় বাষ্প, মেঘ  ও কুয়াশা

পৃথিবীর বাতাসে গড়ে শতকরা এক ভাগ জলীয় বাষ্প আছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় দশ কিলোমিটার পর্যন্ত জলীয় বাষ্প পাওয়া যায়। সূর্যের তাপে পৃথিবীর উপরিতলে যেখানে যেখানে পানি আছে - পুকুর নদী হ্রদ সাগর মহাসাগর - সবখান থেকে পানি বাষ্প হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তাছাড়া উদ্ভিদ - বিশেষ করে গাছের পাতা ও ঘাস নিজেদের গা থেকে জলীয় বাষ্প বের করে দেয়। সেগুলোও বাতাসে মিশে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। সে সময় আমাদের শরীর থেকে ঘাম শুকাতে চায় না। ভেজা জামাকাপড় শুকায় না। এমনকি ঘরের দেয়াল পর্যন্ত ঘেমে যায়। পৃথিবীর বাতাসে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প ভেসে বেড়াচ্ছে তার সবগুলোকে পানিতে পরিণত করলে পুরো পৃথিবী আড়াই মিটার (আট ফুটের বেশি) পানিতে ডুবে যাবে।
            সাগরের উপর দিয়ে উষ্ণ বাতাস যাবার সময় জলীয় বাষ্প টেনে নেয়। তারপর মাটির উপর দিয়ে যাবার সময় সেই বাতাস ঠান্ডা হয়। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাবার সময়ও গরম বাতাস ঠান্ডা হয়ে যায়। তখন বাতাসের জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব বেড়ে গিয়ে তারা মেঘ হয়। মেঘে খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির অসংখ্য পানির অণু এবং বরফের কণা থাকে। কিন্তু তারা এত ছোট যে বাতাসের তুলনায় তাদের ওজন অনেক কম থাকে। তাই তারা বাতাসে ভেসে বেড়ায়।



কুয়াশাও এক ধরনের মেঘ তবে মেঘের চেয়ে কিছুটা ভারী। কোটি কোটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পানির অণু দ্বারা তৈরি। ভেজা মাটি থেকে যখন অনেকগুলো পানির অণু একসাথে হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে তখন কুয়াশার সৃষ্টি হয়। বাতাসের প্রবাহ খুব ধীর হলে এগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত যেতে পারে না। অনেক সময় বাতাসের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গেলে ভূমির কাছের জলীয় বাষ্প জমে গিয়ে কুয়াশার সৃষ্টি করে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে বেশিদূর দেখা যায় না।



বৃষ্টি

মেঘ যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায় তখন সেখানে যে পানির অণুগুলো থাকে সেগুলো প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। কিন্তু মেঘ যদি কোন কারণে চলাচলে বাধা পায় - যেমন পাহাড়ের গায়ে লেগে বা নিচের দিক থেকে আসা বাতাসের কারণে - তখন পানির অণুগুলো একটা অন্যটার সাথে লেগে গিয়ে বাতাসের চেয়ে ভারী হয়ে যায়। তখন তারা বৃষ্টির আকারে নিচের দিকে ঝরে পড়তে শুরু করে। তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করে দেখেছো - যখন হালকা বৃষ্টি বা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয় - তখন বৃষ্টির ফোঁটার আকার খুবই ছোট থাকে। হালকা বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাস এক মিলিমিটারের অর্ধেকের বেশি হয় না। কিন্তু যখন জোরে বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টির ফোঁটার ব্যাস দুই মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে যায়। যখন বজ্রপাত সহ বৃষ্টি হয় - তখন ফোঁটার ব্যাস পাঁচ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
            উষ্ণ বিষুবীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা খুব একটা কমে না। সেখানে বৃষ্টি হয় মেঘের সাথে মেঘের সংঘর্ষের ফলে। কিন্তু যেখানে খুব শীত পড়ে সেখানে মেঘের পানির অণুগুলো জমে বরফ হতে শুরু করে। তখন ভারী হয়ে বৃষ্টির আকারে পড়ে যায়। অনেক সময় ছোট ছোট বরফের টুকরোও নেমে আসে বৃষ্টির সাথে। আমরা তাকে শিলাবৃষ্টি বলি।
            পৃথিবীতে অনেক জায়গা আছে যেখানে সারাবছরই বৃষ্টি হয়। যেমন হাওয়াই দ্বীপের ওয়াই-অ্যালি-অ্যালি পাহাড়ে বছরে ৩৬৫ দিন বৃষ্টি হয়। আবার কলম্বিয়ায় লোরো নামে একটা জায়গা আছে যেখানে বছরে ১৩০০ সেন্টিমিটার[1] বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হয় কারণ সেখানে মেঘ শীতল হবার সুযোগ বেশি থাকে।
            বর্তমান পৃথিবীতে শিল্প-কারখানার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বাতাসে সালফার কার্বন-ডাই-অক্সাইড সহ আরো অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাচ্ছে। সেগুলো মেঘের গায়ে লাগছে - ফলে বৃষ্টির সময় সেগুলো দ্রবীভূত আকারে পৃথিবীতে নেমে আসছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে বৃষ্টি সামান্য অ্যাসিডিক হয়ে যায়। তখন অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। এই অ্যাসিড রাসায়নিক বিক্রিয়া করে পৃথিবীর পরিবেশ বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।





পৃথিবীর মানুষ পানির জন্য বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে বেশিরভাগ সময়। কারণ সমুদ্রের পানি লবণাক্ত বলে কৃষিকাজে এবং প্রাত্যাহিক ব্যবহারের জন্য সমুদ্রের পানি ব্যবহার করা যায় না। তাই বৃষ্টি অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের বড় বন্ধু। কিন্তু অনিয়মিত বৃষ্টি এবং পানি নিষ্কাশনে সঠিক পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের অভাবে বন্যা হয়ে যায়। আমাদের দেশে প্রতিবছরই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য মানুষ। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এখন সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়। আবার অন্যচিত্রও আছে। শুষ্ক মৌসুমে মাসের পর মাস অনাবৃষ্টির ফলে খরা দেখা দেয়। অনেক কৃষক তখন অসহায় হয়ে পড়েন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছিয়েপড়া জাতি বড় বেশি প্রকৃতিনির্ভর। ফলে তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না খুব বেশি। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত জাতিকে প্রাকৃতিক শক্তির কাছে সহজে মাথা নত করতে হয় না।





বজ্রপাত

কোন জায়গার বাতাস যখন গরম হয়ে ওঠে তখন তা হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে খুব দ্রুত। সেই বাতাসের জায়গা দখল করার জন্য ঠান্ডা বাতাস বেশ দ্রুত চলে আসে নিচের দিকে। ফলে উপরের দিকে যে গরম বাতাস উঠছে তার বেগ আরো বেড়ে যায়। বায়ুমন্ডল তখন ভারসাম্য হারায়। ভূমি থেকে উপরের মেঘের দিকে তখন একটা বাতাসের স্তম্ভ তৈরি হয়। মেঘের ভেতরের পানির কণা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফের কণার ওপর গরম বাতাসের ঘর্ষণে বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি হতে থাকে। ফলে মেঘের ভেতর প্রচুর স্থির বিদ্যুৎ জমা হয়। মেঘের ভেতরে ঋণাত্মক চার্জ জমে এবং মেঘের উপরের দিকে ধনাত্মক চার্জ জমে। ধনাত্মক চার্জ ঋণাত্মক চার্জকে আকর্ষণ করে। এই প্রচন্ড আকর্ষণের ফলে তারা যখন মিলিত হয় তখন প্রচুর স্থির বিদ্যুৎ হঠাৎ মুক্ত হয়ে পড়ে। প্রচন্ড শক্তির বিদ্যুৎ ঝলক দেখা দেয় তখন - আমরা এই বিদ্যুৎ ঝলককে বজ্র-বিদ্যুৎ বলি।



একটা বজ্রবিদ্যুতে প্রায় এক কোটি ওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি থাকতে পারে। খুব কম সময়ের জন্য যে আলো আমরা দেখি সেই আলোর উজ্জ্বলতা কেমন ধারণা করতে পারো? কোন জায়গায় যদি ২০ লক্ষটি  ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালাও যেরকম উজ্জ্বলতা হবে সেরকম উজ্জ্বলতা একটি বজ্রবিদ্যুৎচমকে।
            বিদ্যুৎচমকের কয়েক সেকেন্ড পরে যে আমরা প্রচন্ড শব্দ শুনি সেটা কোত্থেকে আসে? বিদ্যুৎচমকের আলোর সাথে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। যেখানে বজ্র উৎপন্ন হয় সেখানে সেই সময় তাপমাত্রা উঠে যেতে পারে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় বাতাস হঠাৎ এত বেশি সম্প্রসারিত হয় যে বাতাসের তরঙ্গের ধাক্কায় প্রচন্ড শব্দ হয়। যেটা বজ্রপাতের শব্দ। আলো এবং শব্দ প্রায় একই সময়ে উৎপন্ন হয়। কিন্তু শব্দের গতি আলোর গতির চেয়ে অনেক কম বলে আমরা শব্দটা দেরিতে শুনতে পাই।
            পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ টা বজ্রপাত হচ্ছে কোথাও না কোথাও। প্রতিদিন গড়ে ৮৬ লক্ষ বজ্রপাত হয় পৃথিবীতে।



টর্নেডো

বজ্রবিদ্যুৎপূর্ণ মেঘের নিচে মাঝে মাঝে দেখা যায় হঠাৎ একটা বিশাল বাতাসের ঘূর্ণি ঘুরতে ঘুরতে আকাশের দিকে টানেলের মতো উঠে যাচ্ছে। তারপর এই ঘূর্ণিটি যেদিকে যায় সেদিকে নিমেষে সবকিছু তছনছ করে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এগুলো টর্নেডো। এদের গতিবেগ ঘন্টায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এরা নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে পুরো এলাকা।




কীভাবে উৎপন্ন হয় এসব টর্নেডো? কীভাবেই বা এত দ্রুত শেষও হয়ে যায়? বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে অনেকটাই বুঝে ফেলেছেন টর্নেডোর গতিপ্রকৃতি - কিন্তু এটাকে থামানোর বা অনেক আগে এটার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে না।
            টর্নেডো সৃষ্টি হয় দুই ধরনের বায়ুপ্রবাহের মিশ্রণের ফলে। দুটো ভিন্ন গতির বায়ুপ্রবাহ যখন একে অপরের মুখোমুখি হয় বা ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় চলে আসে তখন টর্নেডো সৃষ্টি হতে পারে। ধরা যাক মেঘের মধ্যে অনেক উপরে বাতাস চলাচল করছে ঘন্টায় চল্লিশ কিলোমিটার বেগে। নিচের ভারী বাতাস চলছে ঘন্টায় ৮ কিলোমিটার বেগে। বজ্রপাতের মাধ্যমে যদি এই দুই বায়ুপ্রবাহের সংযোগ ঘটে তখন তাদের মাঝে একটা টানেলের সৃষ্টি হয়। বৃষ্টিপাত হলে সেই টানেলের এক মুখ ভূমি স্পর্শ করে। তখন সেই মুখে যা পড়ে তাই নিমেষে শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে যায়। অনেক সময় এই টানেলের মুখ ঘুরতে পারে প্রায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। তার মানে এই পুরো এলাকাটি লন্ডভন্ড হয়ে যায় কয়েক মিনিটের মধ্যে।
            আমেরিকার ওকলাহোমা ও ক্যানসাস রাজ্যে বছরে প্রায় এক হাজারটি টর্নেডো হয়। সেখানে মানুষজন নিজেদের বাড়ির নিচে ভূ-গর্ভস্থ বাংকার তৈরি করে। টর্নেডোর সংকেত পেলে তারা ওই ভূগর্ভের ঘরে ঢুকে যায়। টর্নেডো চলে যাবার পর বেরিয়ে হয়তো দেখতে পায় যে তাদের ভূমির উপরের ঘর কোথাও উড়ে চলে গেছে বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে ক্যানসাসে এক টর্নেডো ৮৮টি বগি সহ একটা ট্রেন উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল।






সাইক্লোন

ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সমুদ্রে নিম্নচাপ হলে সাইক্লোনের আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন সমুদ্রের উপকুলে সতর্ক সংকেত দেয়া হয়। আবহাওয়া দপ্তর একটু পরপর জানিয়ে দেয় নিম্নচাপটি কোনদিকে যাচ্ছে এবং সমুদ্রে সাইক্লোন তৈরি হচ্ছে কিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে বেশ কয়েকবার মারাত্মক সাইক্লোন বয়ে গেছে আমাদের দেশের ওপর দিয়ে। মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রতিবারই। সাইক্লোনের ফলে সমুদ্রের ঢেউ ফুঁসে উঠে। উপকুল ভেসে যায় বন্যার পানিতে। পৃথিবীতে এপর্যন্ত যত সাইক্লোন হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাইক্লোনে। সাইক্লোনের প্রভাবে সৃষ্ট বন্যায় সেই বছর দুই লাখ ৬৬ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৯১ সালেও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এক প্রকান্ড সাইক্লোনে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে। অন্যান্য সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে ভীষণ।
            প্রায়ই শোনা যায় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সাইক্লোনের সৃষ্টি হয়েছে। মাঝে মাঝে শোনা যায় হারিক্যান, আবার মাঝে মাঝে শোনা যায় টাইফুন। আসলে সাইক্লোন, হারিক্যান, আর টাইফুন একই জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন নাম। আটলান্টিক ও উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হলে সেই ঘূর্ণিঝড়ের নাম হয় হারিক্যান। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে (এশিয়ার দিকে) তার নাম টাইফুন, আর আমাদের দেশসহ ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নাম সাইক্লোন। তবে সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ১১৯ কিলোমিটার বা ৭৪ মাইলের বেশি হলেই তাকে সাইক্লোন বা টাইফুন বা হারিক্যান বলা হয়।


সাইক্লোন কীভাবে সৃষ্টি হয় তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে উপরের ছবি থেকে। একটা সাইক্লোনকে মাঝখানে কাটতে পারলে এই ছবির মতো দেখা যেতো। সাগরের পানি যখন গরম হতে থাকে তখন সেই জায়গার বাতাস গরম হয়ে জলীয় বাষ্প সহ উপরের দিকে উঠে যেতে থাকে। সেই বাতাসের খালি জায়গা দখল করতে ছুটে আসে আশেপাশের ঠান্ডা বাতাস। ফলে একদিকে গরম বাতাস উপরে উঠে যাচ্ছে - অন্যদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এভাবে একটা বাতাসের চক্র তৈরি হয়। ছবিতে লাল চক্রাকার চিহ্ন খেয়াল করো। বাতাসগুলো যখন ঘুরতে থাকে - যেই জায়গাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে - তাকে সাইক্লোনের চোখ বা আই অব দি স্টর্ম বলে। বাতাসগুলো যখন দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন নিচের তলের কাছে খুব বেশি বাতাস থাকে না - ফলে সেখানে বাতাসের চাপ কমে যায় বা নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। তখন আশেপাশের বাতাসের বেগ বেড়ে যায় - খালি জায়গায় আসার জন্য। তখন বাতাসের ধাক্কাধাক্কিতে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এবং তাপমাত্রার সাথে সাথে বাতাসে জলীয়বাষ্পও বেড়ে যায়। এই গরম বাতাসগুলো উপরের দিকে উঠতে উঠতে ঠান্ডা হয়ে মেঘ তৈরি করে।
            এই প্রক্রিয়াটি যতক্ষণ চলে ততক্ষণ ঘূর্ণিঝড়ের চোখের চারপাশে বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। বাতাসের বেগ বাড়তে বাড়তে যখন ঘন্টায় ১১৯ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি হয়ে যায় তখন উৎপত্তির স্থলভেদে তার নাম হয়ে যায় সাইক্লোন বা টাইফুন বা হারিক্যান। বাতাস ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গার দিকে চলে যেতে পারে। এভাবে তাদের গতিবেগ কমে যেতে পারে - আবার অনেক সময় কিছু সময়ের জন্য গতিবেগ দ্রুত বেড়েও যেতে পারে। গতিবেগ বেড়ে এটা যেদিকে যায় সেদিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সাইক্লোন তৈরি হবার প্রক্রিয়া গড়ে ৩ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত চলতে পারে। উত্তর গোলার্ধে যে সব ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় সেগুলো ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরে। আর যেগুলো দক্ষিণ গোলার্ধে সৃষ্টি হয় সেগুলো ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘুরে সেদিকে ঘুরে। পৃথিবীর অক্ষের ওপর ঘূর্ণনের ফলেই এরকম হয়।
            বর্তমানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর আবহাওয়ার ওপর নজর রাখা হচ্ছে সবসময়। কোথাও সাইক্লোন সৃষ্টির লক্ষণ দেখা দিলেই মানুষকে সতর্ক করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তখন সেই সাইক্লোনের চোখের ওপর চোখ রাখা হয় প্রতি সেকেন্ডে। লক্ষ্য করা হয় তার গতিবিধি এবং সে অনুসারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। সেজন্যই বর্তমানে সাইক্লোনের ক্ষয়ক্ষতি আগের চেয়ে অনেক কম হয়। এবং এটা আবারো সত্যি যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত দেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনুন্নত দেশের চেয়ে কম হয়।



[1] বৃষ্টিপাত মাপার জন্য ২০৩ মিলিমিটার (প্রায় ৮ ইঞ্চি) ব্যাসের একটি গোলাকার ফানেল একটা সিলিন্ডারের ওপর ভূমি থেকে ৩০ সেন্টিমিটার উপরে রেখে দেয়া হয়। সিলিন্ডারে বৃষ্টির পানি যতটুকু জমে সেটার উচ্চতাকে ততটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে ধরে নেয়া হয়। সিলিন্ডারে কমপক্ষে  এক মিলিমিটারের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বৃষ্টি জমা হলে তা মাপা যায়।

Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts