Showing posts with label আইরিন কুরি. Show all posts
Showing posts with label আইরিন কুরি. Show all posts

Sunday, 12 September 2021

আইরিন কুরি - নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী

 



পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের সমসাময়িক সময়ে আইরিনের জন্ম। উইলহেল্‌ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের দু’বছর পর, হেনরি বেকোয়ারেলের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরের বছর ১৮৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পিয়ের ও মেরি কুরির প্রথম সন্তান আইরিন কুরির জন্ম। নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার সপ্তাহ আগে জন্ম হয় আইরিনের। মেরি কুরি তখন প্যারিসের মেয়েদের স্কুলে ফিজিক্সের শিক্ষক এবং পিয়ের কুরি ইকোল মিউনিসিপেল দ্য ফিজিক অ্যাট কিমিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়েল্‌স (ইপিসিআই) এর ফিজিক্স ল্যাবের প্রধান। আইরিনের জন্মের দু’সপ্তাহ পর তার দিদিমা (পিয়েরের মা) মারা যান। কিছুদিন পর পিয়ের তাঁর বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন। ডাক্তার ইউজিন কুরি বুকে তুলে নেন নাতনি আইরিনকে। দাদুর সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আইরিনের।

গবেষণা ও পড়ানোর কাজে খুব ব্যস্ত আইরিনের মা-বাবা। পিয়ের কুরি গবেষণা করছেন কৃস্টালের চৌম্বক-ধর্ম নিয়ে। মেরি কুরি তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির গবেষণার জন্য কাজ শুরু করেছেন সদ্য আবিষ্কৃত তেজষ্ক্রিয়তার ধর্মের ওপর। দিনরাত পরিশ্রম করে নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয় পদার্থের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন মেরি। আইরিনের জন্মের পর সামান্য কয়েক সপ্তাহ বিশ্রামের পর দ্রুত কাজে ফিরে গেছেন তিনি। ১৮৯৮ সালের জুন মাসে পাওয়া গেলো নতুন তেজষ্ক্রিয় মৌল - নিজের জন্মভূমির নামানুসারে মেরি যার নাম রেখেছেন পোলোনিয়াম। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পাওয়া গেলো আরো শক্তিশালী নতুন মৌল রেডিয়াম। আইরিনের মতো রেডিয়াম-পোলোনিয়ামও যেন মেরির সন্তান। আইরিনের মা-বাবা আইরিনের চেয়েও বেশি সময় দিতে লাগলেন রেডিয়ামকে।

দাদুর কোলে-পিঠেই বেড়ে উঠছে আইরিন। শুধুমাত্র ছুটির দিনে কিছুটা সময় মা-বাবাকে কাছে পায়। তার বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর মা-বাবা আরো ব্যস্ত হয়ে যান। দেখা যায় সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে ডিনারের পর আবার গবেষণায় ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। আইরিন তখন কান্নাকাটি শুরু করে। মা তাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেন। অভিমান হয় ছোট্ট আইরিনের। মা-বাবা কেন তার কাছ থেকে দূরে থাকে সব সময়? অনেক সময় ঘুমের ভান করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। মা তখন তাকে দাদুর কোলে দিয়ে বাবার সাথে বেরিয়ে যান কাজে। আইরিন চোখ খুলে দেখে দাদুর মুখ। 

মা-বাবা ও দাদুর সাথে আইরিন


দাদু আইরিনকে বোঝান - মা-বাবার গবেষণার কাজ কত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এমন কিছু আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে পৃথিবীর কোটি মানুষের উপকার হবে। নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে মানুষের উপকারের চেষ্টা করার নামই যে মানব-ধর্ম তা আইরিনের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন তার দাদু। মা-বাবার কথা শুনতে শুনতে ‘ল্যাবরেটরি’, ‘রেডিওএক্টিভিটি’, ‘রেডিয়াম’, ‘পোলোনিয়াম’ ইত্যাদি শব্দের সাথে খুবই পরিচিত হয়ে যায় ছোট্ট আইরিন।

১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে আইরিনের ছোটবোন ইভের জন্ম হয়। আইরিনের একজন খেলার সাথি হলো। পাশের বাসার প্রফেসর জাঁ পেরির ছেলে-মেয়ে আলিন ও ফ্রান্সিস আইরিনের ভালো বন্ধু। আইরিন তাদের সাথেও খেলে। কিন্তু অপরিচিত কারো সাথে আইরিন কথাই বলতে চায় না। যতই বড় হচ্ছে তার এই সমস্যা বাড়ছে। মেরি কুরি মেয়ের এই সমস্যা কাটানোর জন্য বাড়িতে অনেক বন্ধুবান্ধব ডেকে পার্টি দিয়েছেন - যেন তাদের ছেলে-মেয়েদের সাথে আইরিনের বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু আইরিন তাদের কারো সাথেই কোন কথা বলে না। বাইরের কারো সামনে সে হাসেও না, গম্ভীর হয়ে থাকে।

১৯০৬ সালের এপ্রিলে আইরিনের বয়স যখন সাত – আইরিনের বাবা পিয়ের কুরি রাস্তা পার হতে গিয়ে ঘোড়ার গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান। সাড়ে আট বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়ে আরো গম্ভীর হয়ে গেলো আইরিন। দাদু যথাসম্ভব শোক সামলে নাতনিদের দেখাশোনা করতে লাগলেন আগের মতোই। মা প্যারিসের বাসা বদলে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন স্‌সোতে। সেখানে তাদের নতুন বাসায় বেশ বড় একটা বাগান আছে। মা আইরিনকে বাগানের একটা অংশ দিয়ে দিলেন ইচ্ছেমত বাগান করার জন্য। সাত বছরের আইরিন নিজের হাতে বাগান করা শুরু করে - তাকে সাহায্য করেন দাদু। 

কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দাদুর শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে যেতে শুরু করলো। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। বারো বছরের কিশোরী আইরিন যখনই সময় পাচ্ছে দাদুর সেবা করার চেষ্টা করছে। 
১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাদু মারা যান। আইরিনের পৃথিবীটা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর দাদু ছিল তার বন্ধু, শিক্ষক আর পথপ্রদর্শক। দাদুর কাছ থেকে যে ভালোবাসা, দেশপ্রেম, মানবতার শিক্ষা আইরিন পেয়েছে তার তুলনা নেই। দাদুকে হারিয়ে আইরিনের হঠাৎ ভয় করতে শুরু করলো - মাকেও যদি কোনদিন এমনি ভাবে হারাতে হয়! না, সে তার মা ও ছোট বোনকে দেখে রাখবে। 
দাদুর মৃত্যুর পর বাসাটা পুরুষ-শূন্য হয়ে গেল। মেরি দুটো কন্যাকে মানুষ করার জন্য যা যা লাগে সব ব্যবস্থা করলেন। মেয়েদের নিজের মাতৃভাষা পোলিশ শেখানোর উদ্দেশ্যে বাসায় পোলিশ গভর্নেস রাখলেন। ইভ ও আইরিন ফরাসির পাশাপাশি পোলিশ ভাষাতেও দক্ষ হয়ে উঠছে।

মেয়েদের শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি কড়া নজর মেরির। তিনি বিশ্বাস করেন ছেলেমেয়েদের শরীর সুগঠিত হলে কোন রোগজীবাণু তাদের আক্রমণ করতে পারবে না, মানসিক বিকাশও অনেক ভালোভাবে হবে। মেয়েদেরকে সাইকেল কিনে দিয়েছেন - তারা ইচ্ছেমতো সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়ায় উন্মুক্ত প্রান্তরে। সাঁতার কাটা, ঘোড়ায় চড়া, নৌকা চালানো, স্কেটিং, স্কিইং, জিমনেস্টিক্‌স সবকিছু শিখিয়েছেন মেয়েদের। আইরিন দেখেছে - যে সাইকেলে চড়া তার মায়ের এত প্রিয় ছিল, স্বামীর মৃত্যুর পর একটা দিনের জন্যেও আর সাইকেলে চড়েননি তার মা।

ফ্রান্সের স্কুলের গতানুগতিক শিক্ষাপদ্ধতির ওপর কোন আস্থা ছিল না মেরি কুরির। তিনি দেখছেন ফ্রান্সের স্কুলের শিক্ষার্থীরা দিন-রাত গাধার মত পরিশ্রম করছে, মুখস্থ করছে, পরীক্ষা দিচ্ছে - কিন্তু শিখছে না কিছুই। তিনি এই সিস্টেমের অবসান করতে না পারলেও নিজের মেয়েদের এই শিক্ষার নামে ‘কলুর বলদ’ বানাবার বিপক্ষে। তাঁর কাছের বন্ধু ও সহকর্মীদের নিয়ে তিনি একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক কো-অপারেটিভ স্কুল-ব্যবস্থার চালু করলেন। 

ছয় জন প্রফেসরের দশজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে শুরু হলো তাঁদের প্রচেষ্টা। প্রতি সপ্তাহে একেক জন প্রফেসর একেক বিষয়ে ক্লাস নেন। পদার্থবিজ্ঞানী জাঁ পেরি এবং পল লাঁজেভি পড়াতেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ও গণিত। মেরি কুরি পড়াতেন এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স।  সাহিত্য, শিল্পকলা, সাধারণ বিজ্ঞান, ইংরেজি, জার্মান ইত্যাদি পড়ানোর জন্য সেসব বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসা হতো। একেক সপ্তাহে একেক প্রফেসরের বাড়িতে ক্লাস বসতো। দশজন ছেলেমেয়ের প্রত্যেকে প্রত্যেকের বন্ধু হয়ে যায়। আইরিনও খুব সহজ ছিল তার এসব বন্ধুদের সাথে। এই দশজনের বাইরে আইরিনের সারাজীবনে আর কোন ফ্রেন্ডসার্কেল গড়ে ওঠেনি।

আড়াই বছর চলার পর কো-অপারেটিভ স্কুলটি আর চললো না। প্রফেসররা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। স্কুল উঠে গেলেও মেরি কুরি তাঁর ফিজিক্স স্কুলের একটা রুমে প্রতি বৃহস্পতিবার ছেলে-মেয়েদের সারাদিন পড়াতেন। মেরি বিশ্বাস করেন মৌলিক বিজ্ঞানে ভালো করতে হলে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বোঝার কোন বিকল্প নেই।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-পদ্ধতিকে অপছন্দ করলেও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। উচ্চ মাধ্যমিকের সমতুল্য পরীক্ষা দেয়ার জন্য আইরিনকে একটি প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। দু’বছর সেই স্কুলে পড়ার পর উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আইরিন।

মা যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যস্ত থাকেন তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে আইরিন। কিন্তু মা যে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী তা বুঝতে পারে মায়ের সাথে স্টকহোমে গিয়ে। ১৯১১ সালে দ্বিতীয় বার নোবেল পুরষ্কার পেলেন মাদাম কুরি। প্রথমবার ১৯০৩ সালে যখন বাবার সাথে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন মা - তখন অসুস্থতার কারণে বাবা-মা কেউই স্টকহোমে আসতে পারেননি। এবার রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পাবার পর প্যারিসের প্রেসের শত কুৎসা অপবাদ আক্রমণের পরেও মা একটুও দমে যাননি। মাথা উঁচু করে সুইডেনে এসেছেন নিজের যোগ্যতার স্বীকৃতি - নোবেল পুরষ্কার নিতে। 
অডিটোরিয়ামের চোখ ঝলসানো আলোয় সঙ্গীত মূর্ছনায় এবং প্রচন্ড করতালির সাথে রাজা পঞ্চম গুস্তাভের কাছ থেকে মা যখন নোবেল মেডেল নিচ্ছিলেন - গর্বে বুক ভরে গেছে আইরিনের। কিন্তু সেদিন একবারের জন্যও সে ভাবেনি যে চব্বিশ বছর পর তার নিজের জীবনেই সেরকম কোন ঘটনা ঘটবে।

মা নিজের কাজে এতই ব্যস্ত থাকেন যে আইরিন ও ইভ পুরোপুরি স্বনির্ভর হয়ে গেলো। বাসার কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য একজন গভর্নেস আছেন - তিনি রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজ করেন। আইরিন ও ইভ দুজনই যে যার নিজের কাজ করে নেয়। দুবোন দুরকম, দুজনের ইন্টারেস্টও দুরকম।
আইরিন তার বাবার মতোই খুব সল্পভাষী, ধীরস্থির এবং গভীর চিন্তাশীল। বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সবকিছু বিবেচনা করে দেখে আইরিন। কোন ব্যাপারেই সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নয় আইরিন। ফ্যাশনেবল প্যারিসে যেখানে মেয়েরা নিত্যনতুন ড্রেস আর রূপচর্চার পেছনে টাকা আর সময় খরচ করতে দু’বার চিন্তা করে না - সেখানে আইরিন কোন ধরনের প্রসাধন তো দূরের কথা ভালো কোন ড্রেসও কিনেনি কখনো। ঢিলেঢালা আরামদায়ক ও কাজ করতে সুবিধাজনক পোশাকই আইরিনের পছন্দ। তার জামার হাতায় পকেট থাকতো রুমাল রাখার জন্য। সময় বাঁচাবার জন্য তার সুন্দর কোঁকড়া চুল সে নিজেই কেটে ছোট করে রাখতো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের প্রথম দশ দিনের মধ্যেই প্রায় তিন লাখ ফরাসি সৈন্য নিহত হয়, আহত হয় আরো বেশি। যুদ্ধাহত সৈনিকদের শরীর থেকে বুলেট বের করে আনতে আর্মি-সার্জনদের অনেক সমস্যা হয়। শরীরের নানা জায়গায় অস্ত্রোপচার করতে হয় - ফলে অনেক সময় সৈন্যদের প্রাণ বাঁচানো যায় না। মাদাম কুরি একটা উপায় বের করলেন। শরীরে বুলেটের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য এক্স-রে ব্যবহার করা যায় কিনা দেখলেন তিনি। 
এক্স-রে’র বয়স তখন মাত্র পনেরো বছর। এক্স-রে তৈরি ও রেডিওগ্রাফ প্রযুক্তির সূচনা হয়েছে মাত্র। মাদাম কুরি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও হেল্‌থ ইউনিটকে কাজে লাগিয়ে বিশটি এক্স-রে ইউনিট তৈরি করালেন। দুর্গম যুদ্ধক্ষেত্রের অস্থায়ী হাসপাতালে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে না। মেরি কুরি বিশটি ছোট ট্রাকের মধ্যে জেনারেটর সহ এক্স-রে ইউনিট বসিয়ে এরকম হাসপাতালে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করলেন। 
যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ফরাসি মেয়েরা নার্সিং ট্রেনিং নিচ্ছিলো। আইরিনও নার্সিং ট্রেনিং নিলো। ইতোমধ্যে মাদাম গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছেন। আইরিনকে সাথে নিয়ে নিজে ভ্রাম্যমান এক্স-রে ইউনিট চালিয়ে দুর্গম হাসপাতালে পৌঁছে যান তিনি। এক্স-রে মেশিন সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান তিনি আইরিনকে দেন গাড়ি চালাতে চালাতেই। আইরিন দ্রুত শিখে নেয় সব।

১৯১৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আইরিনের বয়স আঠারো হবার পর মাদাম তাকে কয়েকটা এক্স-রে ইউনিটের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। এক্স-রে ইউনিট বসানো, সার্জনকে রোগীর এক্স-রে নিতে সাহায্য করা, সৈনিকদের এক্স-রে মেশিন চালানোর ট্রেনিং দেয়া সব করতে লাগলো আইরিন একা। যুদ্ধাহত সৈনিকেরা পরমা সুন্দরী আইরিনকে সত্যি সত্যিই গ্রিক শান্তির দেবী ‘আইরিন’ হিসেবেই দেখতে শুরু করলেন। 

এক্স-রে ইউনিট নিয়ে কাজ করছেন মেরি ও আইরিন কুরি



আমেরিকান সৈন্যরা ফ্রান্সে এসেছে যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য। তারাও যোগ দেয় আইরিনের ট্রেনিং ক্লাসে। তরুণ সৈন্যরা আইরিনকে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না। তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায় আইরিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিন্তু স্বভাব-গম্ভীর আইরিন ট্রেনিং দেবার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করে না।  
যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ফরাসি সৈনিকেরা বুঝতে পেরেছেন মাদাম কুরি ও রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গুরুত্ব কতখানি। তারা রেডিয়াম ইনস্টিটিউটকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য চারপাশে বালির বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি করে ট্যাংক নিয়ে পাহারা বসালো। সুন্দর নতুন বিল্ডিং-এর চারপাশে এরকম বিশ্রী বালির বস্তা দেখে আইরিনের মন খারাপ হয়ে গেল। সে বালির বস্তার ওপর সুন্দর করে ফুলের টব বসিয়ে দিলো। 
১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর আইরিনকে মিলিটারি মেডেল প্রদান করা হয় যুদ্ধে তার অবদানের জন্য। কিন্তু মাদাম কুরিকে কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হলো না। 
কিছুদিন পর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে আইরিন। আরো দু’বছর পর পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন আইরিন।

আইরিন তেজষ্ক্রিয়তার ধর্ম সংক্রান্ত বিজ্ঞানকে ভালোবেসে ফেলেছেন। মা মাদাম কুরি আইরিনকে তাঁর সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। গবেষণা বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে তাঁর। তেজষ্ক্রিয় বস্তুর আভা দেখে বাচ্চা মেয়ের মত খুশি হয়ে উঠেন আইরিন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গুরুত্বের চেয়েও আবিষ্কারের আনন্দটা অনেক বেশি দরকারি তাঁর কাছে। প্রতিযোগিতা ও সাফল্যে কিছু যায় আসে না তাঁর। বাবার পর্যায়ের কাজ তিনি করতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা তাঁর কখনোই ছিল না। তবে বাবার মত আইরিন বিজ্ঞান পড়েন প্রকৃতিকে জানার আনন্দে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য।

মায়ের সাথে ল্যাবরেটরিতে আইরিন



সহকর্মীদের সাথে ল্যাবে কাজ করার সময় আইরিন ভীষণ কড়া। জ্ঞানে এবং শারীরিক দক্ষতায়ও তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে। ২৫ বছর বয়সেই তিনি অনেক বেশি জানেন। কিন্তু সামাজিক মেলামেশায় অভ্যস্ত না হবার কারণে তাঁর কথাবার্তা ভীষণ চাঁছাছোলা। তিনি কোদালকে শুধু কোদালই বলেন না - কোদালের খুঁত থাকলে তাও বলেন। বাড়ির লোকের সাথে মাঝে মাঝে হাসলেও - বাইরের কারো সামনে কখনোই হাসেননি আইরিন। অনেকে আইরিনকে অহংকারী ভেবে ভুল বোঝেন। ঈর্ষাতুর অনেকে মনে করেন ডিরেক্টরের মেয়ে হবার কারণে আইরিন ডাঁট দেখান। আড়ালে অনেকে তাঁকে ‘প্রিন্সেস বলেও ডাকেন। কিন্তু আইরিনের কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আইরিন জানেন তাঁর বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা কতটুকু। কিন্তু সে নিয়ে কোন অহংকার তাঁর নেই।

আইরিনকে কখনো কোন বিষয় নিয়ে রাগতে দেখেনি কেউ। আইরিন জীবনে কোনদিন মিথ্যা কথা বলেননি, কোনদিন কাউকে ইম্প্রেস করতে চান নি। তিনি যা তিনি তাই।

রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে মায়ের তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য গবেষণা শুরু করলেন আইরিন। মায়ের আবিষ্কৃত পোলোনিয়াম থেকে যে আলফা পার্টিক্যাল বের হয় তার ধর্ম বিশ্লেষণ শুরু করলেন তিনি। তাঁর গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য হলো পদার্থের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আলফা পার্টিক্যল কেন গতি হারায় এবং কীভাবে গতি হারায় তা খুঁজে বের করা। ১৯২১ সালে আইরিন কুরির প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ইনস্টিটিউটের চিফ অব স্টাফ ফারনান্দ হলউইকের সাথে একের পর এক পরীক্ষণ চলতে থাকে আইরিনের।

১৯২৪ সালের নভেম্বরে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য থিসিস লিখছেন আইরিন। থিসিসে তিনি যেসব পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন তার সবকিছুই নতুন। সেই সময় পোলোনিয়াম সম্পর্কে যত পরীক্ষা আইরিন করেছেন পৃথিবীর আর কোথাও কেউ ততটা করেননি।

 ১৯২৫ সালে আইরিন সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল থিসিস জমা দিয়েছেন - ‘আলফা রে অব পোলোনিয়াম শিরোনামে। থিসিস উৎসর্গ করেছেন তাঁর মাকে - ‘টু মাদাম কুরি বাই হার ডটার এন্ড পিউপিল। আইরিন থিসিস ডিফেন্ড করতে গেলেন একটা ঢিলেঢালা ব্যাগি ড্রেসের ওপর কালো একাডেমিক গাউন পরে। 


ডক্টর আইরিন কুরি


অডিটোরিয়ামে প্রায় হাজার দর্শক উপস্থিত রেডিয়াম-কন্যার বক্তৃতা শোনার জন্য। আইরিন যদিও সমাবেশ পছন্দ করেন না, কোন ধরনের টেনশান ছাড়াই তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি যা জানেন তা এত ভালো জানেন যে সেটা নিয়ে কোনদিনই কোন উৎকন্ঠায় ভোগেন না। আইরিনের পরীক্ষকদের ওপর মানসিক চাপ পড়বে ভেবে মাদাম কুরি যাননি সেই অনুষ্ঠানে। পরীক্ষকদের সবার ভূয়সী প্রশংসার ভেতর দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন আইরিন কুরি।

১৯২৬ সালের ৯ই অক্টোবর বিয়ে হলো আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলিওর। ফ্রেডেরিক জুলিও মেরি কুরির ইন্সটিটিউটে গবেষণা করছিলেন। সেখানে গবেষণা করতে করতেই আইরিন ও ফ্রেডেরিকের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। বিয়ের পর ফ্রেডেরিক নিজের পদবির সাথে কুরি পদবিও জুড়ে নেন। তখন থেকে তাদের পদবি হয় জুলিও-কুরি। বিয়ের পর আইরিন ও ফ্রেডেরিকের যৌথ গবেষণা আরো বেগবান হয়।

গবেষণারত আইরিন ও ফ্রেডেরিক

১৯২৭ সালে ফ্রেড সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তাঁদের প্রথম সন্তান হেলেনের জন্ম হয়। ১৯৩০ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল, “ইলেকট্রোকেমিক্যাল প্রপার্টিজ অব রেডিওঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ডস অব পোলোনিয়াম” । 

১৯৩২ সালে আইরিন ও ফ্রেডের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলো। আইরিন তাঁর বাবার নাম অনুসারে ছেলের নাম রাখলেন পিয়ের। হেলেন আর পিয়ের মাদাম কুরির চোখের মণি হয়ে উঠলো। সময় পেলেই মাদাম নাতি-নাতনিদের সাথে খেলতে চেষ্টা করেন। তাঁর কাজের অনেকটুকুই এখন আইরিন সামলাচ্ছেন। তবুও তিনি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে যাওয়া থামাচ্ছেন না। ১৯৩৩ সালের সলভে কনফারেন্সে যোগ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। 

এদিকে পিয়েরের জন্মের পর আইরিন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তাঁকে অনেক বয়স্কা মনে হচ্ছে। যক্ষা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। কিন্তু কোনকিছুই তাঁকে ঘরে আটকে রাখতে পারলো না। তিনি কাজে ফিরে গেলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ল্যাবে গিয়েই নতুন পরীক্ষায় হাত দিলেন।

নিউট্রন আবিষ্কৃত হবার পর ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের গবেষণায় বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। আইরিন ও ফ্রেড উইলসন ক্লাউড-চেম্বার ব্যবহার করে নিউট্রন নিয়ে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁরা দেখলেন ক্লাউড-চেম্বারে ইলেকট্রন-ট্র্যাকের পাশাপাশি নতুন ধরনের ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে - যা শুধুমাত্র সম্ভব যদি ইলেকট্রনের চার্জ পজিটিভ হয়। আইরিন ও ফ্রেডের আগে এ পরীক্ষা আর কেউ করেননি এবং এই পজিটিভ ইলেকট্রনের অস্তিত্ব সম্পর্কেও কেউ জানতেন না। তবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক পজিটিভ ইলেকট্রনের সম্ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। ডিরাকের পেপার আইরিন ও ফ্রেডের চোখে পড়েনি। 

পজিটিভ চার্জের ট্র্যাক দেখে তাঁদের ফলাফল সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলেন আইরিন ও ফ্রেড। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) কার্ল এন্ডারসন আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষাটা করে একই রেজাল্ট পেলেন এবং সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে এগুলো পজিট্রনের ট্র্যাক। আরো একটা যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হলেন আইরিন ও ফ্রেড। [পজিট্রন আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন কার্ল এন্ডারসন।] 

পরপর দু’বার সঠিক পরীক্ষণের মাধ্যমে আইরিন ও ফ্রেড নিউট্রন ও পজিট্রন আবিষ্কারে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাছে আইরিন ও ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বেড়ে গেলো। ১৯৩৩ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হলেন তাঁরা। সল্‌ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হওয়া মানে বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া। মাদাম কুরি তো সল্‌ভে কনফারেন্সের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে সবগুলো কনফারেন্সেই আমন্ত্রিত হয়েছেন। আইরিন ও ফ্রেডের এটাই প্রথম।

কনফারেন্সে যাবার আগে অনেকগুলো পরীক্ষা করলেন তাঁরা। পোলোনিয়ামের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের পাতলা পাত রেখে দেখেছেন পোলোনিয়াম থেকে আলফা পার্টিক্যল এসে অ্যালুমিনিয়াম পাতে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে নিউট্রন ও পজিট্রন বের করে দিচ্ছে। বার বার পরীক্ষা করে একই রেজাল্ট পেয়েছেন আইরিন ও ফ্রেড।

১৯৩৩ সালের অক্টোবরে ব্রাসেল্‌সে সল্‌ভে কনফারেন্সে আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করলেন ফ্রেড। আইরিন কথা বলতে পছন্দ করেন না, তাই তিনি চুপচাপ বসে আছেন অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে। কনফারেন্সে চল্লিশ জন আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীর মধ্যে বিশ জন নোবেল বিজয়ী। চল্লিশ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন নারী বিজ্ঞানী - মাদাম কুরি, আইরিন আর লিজা মাইটনার।


১৯৩৩ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে আইরিন ও মাদাম কুরি

১৯৩৪ সালের শুরুতে আইরিন ও ফ্রেড পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন পোলোনিয়াম আর অ্যালুমিনিয়ামের পাত নিয়ে। তাঁরা দেখতে পেলেন পোলোনিয়ামের আলফা পার্টিক্যল অ্যালুমিনিয়ামের সাথে বিক্রিয়া করে নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয়তা তৈরি করছে। কীভাবে হচ্ছে? 

অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে পোলোনিয়াম থেকে আলফা পার্টিক্যল বের হয়ে অ্যালুমিনিয়ামের নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষ ঘটায়। তাতে অ্যালুমিনিয়ামের নিউক্লিয়াস থেকে একটি নিউট্রন বেরিয়ে আসে - ফলে অ্যালুমিনিয়াম নিউক্লিয়াস রূপান্তরিত হয় একটি তেজষ্ক্রিয় ফসফরাস নিউক্লিয়াসে। কয়েক মিনিট পর এই তেজষ্ক্রিয় ফসফরাস থেকে একটি পজিট্রন বের হয় - ফসফরাস নিউক্লিয়াস তার তেজষ্ক্রিয়তা হারিয়ে পরিণত হয় একটি সিলিকন নিউক্লিয়াসে। তার মানে তাঁরা কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তার সন্ধান পেয়েছে!

১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই সকালে মাদাম কুরি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেলেন আইরিন ও ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি।

নোবেলজয়ী আইরিন ও ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি


নোবেল বক্তৃতা দেবার সময় পদার্থবিজ্ঞানের অংশ বললেন আইরিন, আর রসায়নের অংশ বললেন ফ্রেড। সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর মহাউৎসাহে ফ্রেডই দিলেন। ফ্রেড প্রশংসা পেতে পছন্দ করেন, মিডিয়া কভারেজ তাঁর খুবই ভালো লাগে। আইরিন কিছুক্ষণ পরেই উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে আইরিনকে নোবেল অনুষ্ঠানের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। শেষে ফ্রেড নোবেল ফাউন্ডেশানের লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলেন আইরিন এক কোণায় বসে নিবিষ্টমনে বই পড়ছেন।

এদিকে ফ্রান্সে তখন প্রগতিশীল পপুলার ফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছে। সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট লিওন ব্লাম মেয়েদের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ফ্রান্সে তখনো মেয়েদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। [ফ্রান্সে মহিলারা ভোট দেয়ার অধিকার পায় ১৯৪৬ সালে।] প্রেসিডেন্ট ব্লাম শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলেন, শ্রমজীবীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেন। 

ফ্রান্সের বিজ্ঞান-গবেষণা বাড়ানোর জন্য প্রফেসর জাঁ পেরির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’। জাঁ পেরি আইরিনের বাবা-মার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জাঁ পেরির পরামর্শে প্রেসিডেন্ট ব্লাম ফ্রেডেরিককে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’র ডিরেক্টর নিযুক্ত করলেন। আর আইরিন কুরিকে করলেন বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। আইরিন কুরি হলেন ফ্রান্সের প্রথম মহিলা মন্ত্রী। 

পরদিন প্রেসিডেন্টের অফিসে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন আইরিন জুলিও-কুরি। তিনি সহ মোট তিন জন মহিলা মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। আইরিনকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে ছুটি নিতে হলো। সম্পূর্ণ নতুন এই প্রশাসনিক কাজে এসে সবকিছু একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করতে হলো আইরিনকে। দায়িত্ব নিয়ে তা ঠিকমত পালন না করার মানুষ আইরিন নন।

মন্ত্রীসভায় আইরিনের সততা আর স্পষ্টবাদিতা অনেকেরই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ছয় মাস ধরে কাজ করার পরও ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা ও আচরণ আয়ত্ত্ব করতে পারলেন না আইরিন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর একার পক্ষে পুরো সিস্টেম বদলানো সম্ভব নয়। তাঁর মনে হচ্ছে তিনি ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন, তাঁর বদলে ফ্রেড মন্ত্রী হলেই ভালো করতেন। কারণ ফ্রেড ক্ষমতার স্বাদ বোঝেন।

আইরিনের ইচ্ছে করছে বাবা-মার মতো সরবোনের প্রফেসর হতে। প্রফেসর হবার সব যোগ্যতা তাঁর আছে। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর পৃথিবীর যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হতে পারেন তিনি। কিন্তু সরবোনের প্রফেসরশিপ পেতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। আইরিন ভাবলেন তিনি যদি এখন দরখাস্ত করেন তাহলে তাঁর সহকর্মী শিক্ষামন্ত্রী কোন কিছু না দেখেই তাঁকে অনুমোদন দিয়ে দেবেন। এটা অনুচিত হবে ভেবে তিনি মন্ত্রীত্বে ইস্তফা দিলেন। মন্ত্রীপরিষদের সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

আইরিন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের পুরনো পদে ফিরে গেলেন। সেখান থেকে সরবোনে প্রফেসর পদের জন্য দরখাস্ত করলেন এবং সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সরবোনের প্রফেসর পদে যোগ দিলেন। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের পদটিও তাঁর থাকলো। অধ্যাপনা ও গবেষণার জগতে ফিরে এলেন আইরিন। কিন্তু ফ্রেডের সাথে যৌথ গবেষণা আর সম্ভব হলো না। ফ্রেড ‘কলেজ দ্য ফ্রেঞ্চ’ ও ‘ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’ নিয়ে ব্যস্ত। ফ্রেড ‘ল্যাবরেটরি অব অ্যাটমিক সিন্থেসিস’ নামে নতুন একটা গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করেছেন। অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস সংক্রান্ত নতুন নতুন গবেষণা চলছে সেখানে। ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে আইরিন ও ফ্রেডেরিকের হাত দিয়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রেডেরিক যুদ্ধে যোগ দেন। ছেলে-মেয়ে ও আইরিনকে পাঠিয়ে দেন সুইজারল্যান্ডে। ফ্রেডের নেতৃত্বে ফ্রান্সে গঠিত হয় পারমাণবিক গবেষণাগার। যুদ্ধের পর ফ্রেড ফ্রান্সের হিরো হয়ে গেলেন। ‘কমান্ডার অব দি লিজিয়ন অব অনার’ নিযুক্ত হলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন’ গঠিত হলো। ফ্রেড কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন, আইরিন কমিশনের সদস্য মনোনীত হলেন। ফ্রেড কমিশনের প্রশাসনিক কাজে তাঁর দক্ষতার ছাপ রাখতে শুরু করেছেন, আইরিন বৈজ্ঞানিক দিক দেখাশোনা করেন।

১৯৫০ এর দিকে ফরাসি সরকারের ওপর আমেরিকান সরকারের প্রভাব ও চাপ বাড়তে শুরু করেছে। আমেরিকান সরকার কমিউনিস্ট ফোবিয়ায় ভুগছে। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালের ২৮শে এপ্রিল ফ্রেঞ্চ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে ফ্রেডকে বরখাস্ত করা হলো। ফ্রেডের অপরাধ - তিনি ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। মানসিকভাবে খুব হতাশ হয়ে পড়লেন ফ্রেড। তাঁর শরীরেও তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন ফ্রেড। 

অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে আইরিনকে বরখাস্ত করা না হলেও ১৯৫১ সালের ১০ই জানুয়ারি তাঁর মেয়াদ শেষ হবার পর তাঁকে কমিশন থেকে বাদ দেয়া হয়। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় এবং রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের পদ এখনো আছে তাঁর। কিন্তু শরীর তাঁরও খুব খারাপ। এক সময়ের এত ভালো অ্যাথলিট আইরিন নানারকম রোগে ভুগছেন।

১৯৫৫ সালে লিউকেমিয়া ধরা পড়ে আইরিনের। সারাজীবন এক্স-রে আর রেডিয়াম পোলোনিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তার সাথে থাকতে থাকতে ব্লাড-ক্যান্সার হয়ে গেছে তাঁর। হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাঁকে। 
১৯৫৬ সালের ১৭ই মার্চ মারা যান আইরিন জুলিও-কুরি। 

তথ্যসূত্র:
প্রদীপ দেব, রেডিয়াম ভালোবাসা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪। 




Sunday, 14 October 2018

আইরিন কুরি - দশম পর্ব (শেষ পর্ব)


রাতে হেলেন আর পিয়ের ঘুমিয়ে পড়লে ফ্রেড আইরিনকে বললেন, “ব্যাকপ্যাকগুলো গুছিয়ে নাও। আমরা কাল সকালেই বেরিয়ে পড়বো।”
“কোথায় যাবো আমরা?”
“সুইজারল্যান্ডে। গোপনে চলে যেতে হবে আমাদের। অবস্থা কিন্তু আরো খারাপ হবে।”
“পালিয়ে যাবো?”
“উপায় নেই। ছেলে-মেয়েদের কথা তো ভাবতে হবে। জার্মানরা পরাজয় আঁচ করতে পারছে। ওরা এখন ফরাসি বিজ্ঞানীদের সবাইকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। ফ্রান্সকে মেধাশূন্য করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে তারা। কিন্তু আমাদের তো দায়িত্ব আছে - দেশের জন্য নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা। ভেবে দেখো আইরিন। আমাদের কী করা উচিত?”
আইরিন বুঝতে পারলেন। চারজনের দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাকপ্যাক রেডি করে রাখলেন। খুব ভোরে উঠে ছেলে-মেয়ে আর স্বামীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। 
ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে গিয়ে ফ্রেড আইরিনের হাত ধরে বললেন, “এবার আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবো আইরিন।”
“তুমি যাবে না আমাদের সঙ্গে?”
“না। আমি এখান থেকে ফ্রন্টে চলে যাবো। আমি একজন সৈনিক। আমাদের রেজিস্ট্যান্স ফোর্স সীমান্তে অপেক্ষা করছে। আমেরিকান সৈন্যরা আসতে শুরু করেছে। আমরা তাদের সাথে যোগ দেবো। তোমরা অন্য সবার সাথে নিরাপদেই সুইজারল্যান্ডে চলে যাবে। আশা করি যুদ্ধের পর দেখা হবে আমাদের।”
আইরিন জানেন ফ্রেডকে বাধা দেয়া যাবে না। হেলেন আর পিয়েরকে আদর করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ফ্রেড। 
ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আইরিনের সুইজারল্যান্ডে পৌঁছানোর খবর কীভাবে যেন প্রচারিত হয়ে গেছে বহির্বিশ্বে। আমেরিকার ‘মেরি কুরি ট্রাস্ট ফান্ড’ তাঁদের জন্য বেশ কিছু ডলার পাঠিয়ে দিয়েছে। ১৯২১ সালে মেরি কুরিকে রেডিয়াম উপহার দেয়ার জন্য ফান্ড গঠন করেছিলেন মেসি মেলোনি। সেখানে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সব আইরিনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। মায়ের মৃত্যুর পরেও এই দুঃসময়ে মায়ের দান এসে গেছে আইরিনের হাতে। 
১৯৪৪-এর ডিসেম্বরে জার্মান সৈন্যরা ফ্রান্স ছেড়ে চলে গেলো। আইরিনরা সবাই প্যারিসে ফিরে এলেন। ১৯৪৫-এ আমেরিকা পারমাণবিক বোমা বানালো। হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংস হয়ে গেলো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে। নিউক্লিয়ার ফিশান প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে এই বোমাগুলো বানানো হয়েছে। আইরিন নিজেও ফিশান প্রক্রিয়া আবিষ্কারের সাথে জড়িত ছিলেন। নিজেকে এ কারণে অপরাধী মনে করতে শুরু করেছেন তিনি। 
যুদ্ধের পর ফ্রেড ফ্রান্সের হিরো হয়ে গেলেন। ‘কমান্ডার অব দি লিজিয়ন অব অনার’ নিযুক্ত হলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন’ গঠিত হলো। ফ্রেড কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন, আইরিন কমিশনের সদস্য মনোনীত হলেন। ফ্রেড কমিশনের প্রশাসনিক কাজে তাঁর দক্ষতার ছাপ রাখতে শুরু করেছেন, আইরিন বৈজ্ঞানিক দিক দেখাশোনা করেন। 
পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পের কাজ চলছে। ফ্রান্স ইউরোপের প্রথম অ্যাটমিক রিঅ্যাক্টর স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। প্রথম প্ল্যান্টের নাম দেয়া হয়েছে জোয়ি (ZOE)। হেভি ওয়াটার আর ইউরেনিয়াম ১৯৩৯ সালেই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন ফ্রেড। এখন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে পুরোদমে। 
বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত হচ্ছেন ফ্রেডেরিক ও আইরিন। তেজষ্ক্রিয়তার শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রতি জোর দিচ্ছেন তাঁরা। আমেরিকার ‘অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট রিফিউজি কমিটি’র আমন্ত্রণে স্প্যানিশ রিফিউজিদের সাহায্যের জন্য ১৯৪৮ সালের মার্চে আমেরিকা গেলেন আইরিন। 
আগে মায়ের সাথে যখন গিয়েছিলেন বিপুল সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন আমেরিকায়। কিন্তু এবার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। প্যারিস থেকে বিমানে নিউইয়র্কের লা গোয়ার্ডিয়া এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারেরা আইরিনকে আটক করে এলিস আইল্যান্ডের হাজতে নিয়ে গেলেন। আইরিন তাঁর স্বভাব মতই শান্ত। হাজতে রাত কাটাতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন সেখানকার ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়। 
পরদিন ফরাসি দূতাবাসের কর্মকর্তারা ছুটে এলেন। ফরাসি সরকার তীব্র নিন্দা জানালেন এই ঘটনার। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী, ফ্রান্সের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সদস্য, কমিশনের চেয়ারম্যানের স্ত্রী, রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর আইরিন কুরিকে আটকে রাখায় আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠলো। উপর মহলের আদেশে আইরিনকে ছেড়ে দেয়া হলো। কী কারণে তাঁকে আটক করা হয়েছিল তা কর্তৃপক্ষ না জানালেও সবাই অনুমান করলেন যে কমিউনিস্ট সন্দেহে আইরিনকে আটক করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা কমিউনিস্ট আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে। 
এলিস আইল্যান্ডের হাজত থেকে বেরিয়ে আইরিন একটা টেক্সি নিয়ে চলে গেলেন রিফিউজি কমিটির অফিসে। তাঁরা তো ভীষণ অবাক। আগের দিন তাঁরা এয়ারপোর্টে গিয়ে ফিরে এসেছেন। 
“মাদাম আপনি নিজেই চলে এসেছেন! আমাদের ফোন করলে তো আমরা গিয়ে নিয়ে আসতাম আপনাকে।”
“নিয়ে আসতে হবে কেন? আমার কাছে তো ঠিকানা আছে আপনাদের।”
আইরিন রিফিউজিদের সমর্থনে বেশ কিছু সমাবেশে বক্তৃতা করলেন। তারপর প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করলেন। আইনস্টাইনও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার একজন জোরালো সমর্থক। 

আইরিন জুলিও-কুরি ও আইনস্টাইন


১৯৪৮ সালে আইরিন ও ফ্রেডের মেয়ে হেলেন একুশ বছরের তরুণী। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি পাস করেছে। রূপে গুণে অদ্বিতীয়া হেলেন ভালোবাসে সহপাঠী মাইকেলকে। মাইকেল পল লাঁজেভির নাতি (ছেলের ছেলে)। মাদাম কুরির নাতনির সাথে মঁসিয়ে লাঁজেভির নাতির বিয়ে - এর চেয়ে ভালো সম্পর্ক আর কী হতে পারে? 

১৯৪৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর হেলেন আর মাইকেলের বিয়ে হয়ে গেলো। আইরিন তখন ভীষণ অসুস্থ। ম্যাস্টয়ডাইটিসে ভুগছিলেন। অপারেশন দরকার। কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য অপারেশন পিছিয়ে দিয়েছিলেন। হেলেনের বিয়ের পরেই অপারেশন হলো আইরিনের। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই বাড়িতে চলে এলেন তিনি। 
ফ্রেড পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে চালু হলো পাঁচ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন ‘জোয়ি’। এই প্রাথমিক প্রকল্পের সাফল্য বড় মাপের প্রকল্প হাতে নিতে সহায়তা করলো। ক্রমে ক্রমে ফ্রান্সের বিদ্যুৎ শক্তির সিংহভাগ পারমাণবিক শক্তি থেকেই উৎপাদিত হয় যার সূচনা করেছিলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। 
প্রত্যেক গ্রীষ্মকালেই লা’কোয়েস্টে ছুটি কাটাতে যান ফ্রেড ও আইরিন। সেখানে তাঁরা একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ‘কুরি হাউজ’ নাম দিয়েছেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, মাছ ধরে আনন্দে কাটে কয়েক দিন। ১৯৪৯ সালের এমনি এক দিনে আড্ডায় আলোচনা হচ্ছিলো প্রেম-ভালোবাসা বিষয়ে। ফ্রেড ভালোবাসা সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা বলছিলেন। তিনি যে আইরিনকে কত ভালোবাসেন তার সরস বর্ণনা দিচ্ছিলেন। আইরিন সাধারণত এসব আলোচনায় শ্রোতা হিসেবেই থাকেন - কখনো কোন মন্তব্য করেন না। কিন্তু সেদিন ফ্রেডের কথা শুনে হঠাৎ আইরিন বললেন, “আচ্ছা, তোমাদেরকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বিবাহিত পুরুষ তাদের ওয়ালেটে কার ছবি রাখে?”
“স্ত্রীর”
“ফ্রেড আমাকে এত ভালোবাসে বললো - তার ওয়ালেটে কার ছবি আছে?”
“অবশ্যই তোমার” - বন্ধুদের একবাক্যে উত্তর। 
“ফ্রেড, তোমার ওয়ালেটটা খুলে এদের দেখাও।”
ফ্রেড কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ওয়ালেট খুলে দেখান - সেখানে আইরিনের বদলে বিশাল একটা মাছের ছবি। অপ্রস্তুতের হাসি হেসে ফ্রেড বললেন, “লা’কোয়েস্টে এত বড় মাছ আর কেউ ধরেনি।”
ফরাসি সরকারের ওপর আমেরিকান সরকারের প্রভাব ও চাপ বাড়তে শুরু করেছে। আমেরিকান সরকার কমিউনিস্ট ফোবিয়ায় ভুগছে। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৫০ সালের ২৮শে এপ্রিল ফ্রেঞ্চ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে ফ্রেডকে বরখাস্ত করা হলো। ফ্রেডের অপরাধ - তিনি ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। মানসিকভাবে খুব হতাশ হয়ে পড়লেন ফ্রেড। তাঁর শরীরেও তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন ফ্রেড। 
এর কিছুদিন পর ২১শে মে হেলেন ও মাইকেলের প্রথম সন্তান ফ্রাঁসোয়ার জন্ম হয়। নাতনির মুখ দেখে হতাশা কিছুটা কাটিয়ে উঠলেন ফ্রেড। 
অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে আইরিনকে বরখাস্ত করা না হলেও ১৯৫১ সালের ১০ই জানুয়ারি তাঁর মেয়াদ শেষ হবার পর তাঁকে কমিশন থেকে বাদ দেয়া হয়। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় এবং রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের পদ এখনো আছে তাঁর। কিন্তু শরীর তাঁরও খুব খারাপ। এক সময়ের এত ভালো অ্যাথলিট আইরিন নানারকম রোগে ভুগছেন। 
১৯৫১ সালের ২৫শে জুলাই হেলেনের ছেলে ইভিসের জন্ম হয়। আইরিন ও ফ্রেড তাঁদের নাতি-নাতনির সাথে সময় কাটান যতটুকু পারেন। ফ্রাঁসোয়ার বয়স দু’বছর হতে না হতেই তাকে সাঁতার শেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন আইরিন। 
১৯৫৫ সালে লিউকেমিয়া ধরা পড়ে আইরিনের। সারাজীবন এক্স-রে আর রেডিয়াম পোলোনিয়ামের তেজষ্ক্রিয়তার সাথে থাকতে থাকতে ব্লাড-ক্যান্সার হয়ে গেছে তাঁর। হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাঁকে। ফ্রেড প্রায় সারাক্ষণই আইরিনের বেডের কাছে চুপচাপ বসে থাকেন। আইরিন জানেন তাঁর সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। যতক্ষণ জেগে থাকেন ফ্রেডের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফ্রেড তাঁর হাত ধরে জিজ্ঞেস করেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“আমার নিজের জন্য কোন কষ্ট নেই ফ্রেড। আমি তো জীবনে যা যা চেয়েছি সবই পেয়েছি। কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য।”
“আমার জন্য কেন?”
“আমি মরে গেলে তুমি একা হয়ে যাবে। অবশ্য একা নাও হতে পারো - লা’কোয়েস্টের সাগরে বড় বড় মাছ আছে। সেগুলো ধরবে আর ছবি তুলে ওয়ালেটে রাখবে। দেখি তোমার ওয়ালেটটা।”
ফ্রেড চুপচাপ ওয়ালেট বের করে আইরিনের হাতে দেন। আইরিন কাঁপা কাঁপা হাতে ওয়ালেট খুলে মাছের ছবিটা দেখেন। ফ্রেড বলেন, “তোমার কি ধারণা আমি শুধু মাছই দেখি?”
“না, তুমি এটাও দেখো” - মাছের ছবির নিচ থেকে আরেকটি ছবি বের করেছেন আইরিন। তিরিশ বছর আগের আইরিনের গ্র্যাজুয়েশানের ছবি। সরবোনের কালো গাউন পরে এক হাতে ফুল আর অন্যহাতে সার্টিফিকেট নিয়ে উজ্জ্বল চোখে দাঁড়িয়ে আছে তরুণী আইরিন। 

“ছবিটা যে ওখানে থাকে তুমি জানতে?”
“হ্যাঁ”
“তবে সেদিন সবার সামনে মাছের ছবি নিয়ে ওরকম করলে কেন?”
আইরিন চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলেন, “শুধু গুনগুন করলে হয় না, মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গাইতে হয়।”
১৯৫৬ সালের ১৭ই মার্চ মারা যান আইরিন জুলিও-কুরি। ২১শে মার্চ সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় তাঁর স্মরণে। 

আইরিন ও ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি


আইরিনের মৃত্যুর পর ফ্রেড ছেলে পিয়েরের সাথে তাঁদের স্‌সোর বাড়িতেই দিন কাটাতে থাকেন। ফ্রেডের লিভারের তিন চতুর্থাংশই নষ্ট হয়ে গেছে  অত্যধিক তেজষ্ক্রিয়তায়। এ অবস্থাতেও আইরিনের শূন্যপদে যোগ দিলেন তিনি। সরবোনের প্রফেসর পদ এবং রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের সম্প্রসারণ ঘটছে। নিউক্লিয়ার ইনস্টিটিউট চালু করলেন ফ্রেড। 
১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে পাকস্থলীর সমস্যাও দেখা দেয় ফ্রেডের। হেপাটাইটিসের অপারেশান হয় ১০ই আগস্ট। অস্ত্রোপচারের চারদিন পর ১৪ই আগস্ট মারা যান ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। 

পরিশিষ্ট

আইরিন ও ফ্রেডের ছেলে-মেয়ে দু’জনই পরবর্তীতে বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছেন - হেলেন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী এবং পিয়ের জীব-পদার্থবিজ্ঞানী।
১৯৫৭ সালে হেলেন তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে যোগ দেন। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে সায়েন্টিফিক এডভাইজরি কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি অনেক বছর।
হেলেনের ছেলে ইভিসও একজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। 
আইরিন ও ফ্রেড জুলিও-কুরির ছেলে পিয়ের জুলিও কলেজ দ্য ফ্রান্সের প্রফেসর এবং সেলুলার বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের হেড। ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যপদ লাভ করতে কোন অসুবিধাই হয়নি তাঁর। তিনি আমেরিকান একাডেমি অব সায়েন্সেরও সদস্য। 
ইভ কুরি সারাজীবন একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৪ সালে ৫০ বছর বয়সে। তাঁর স্বামী হেনরি ল্যাবোইসি ইউনিসেফের পরিচালক ছিলেন এবং ১৯৬৫ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছেন। ইভ ১০২ বছর বেঁচেছিলেন। ২০০৭ সালের ২২শে অক্টোবর ইভ কুরি মারা যান তাঁর নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে।
১৯৯৪ সালে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের কুরি মিউজিয়ামের নতুন নাম হয় - ‘দি মিউজিয়াম এন্ড আর্কাইভস ফর দি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট, পিয়ের এন্ড মেরি কুরি, এন্ড ফ্রেডেরিক এন্ড আইরিন জুলিও-কুরি’। 

__________
আইরিন কুরির কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে রেডিয়াম ভালোবাসা বইতে




Friday, 12 October 2018

আইরিন কুরি - নবম পর্ব



নোবেল বক্তৃতা দেবার সময় পদার্থবিজ্ঞানের অংশ বললেন আইরিন, আর রসায়নের অংশ বললেন ফ্রেড। সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর মহাউৎসাহে ফ্রেডই দিলেন। ফ্রেড প্রশংসা পেতে পছন্দ করেন, মিডিয়া কভারেজ তাঁর খুবই ভালো লাগে। আইরিন কিছুক্ষণ পরেই উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। 

সংবাদ সম্মেলন শেষে আইরিনকে নোবেল অনুষ্ঠানের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। শেষে ফ্রেড নোবেল ফাউন্ডেশানের লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলেন আইরিন এক কোণায় বসে নিবিষ্টমনে বই পড়ছেন। 

নোবেল পুরষ্কারের টাকা দিয়ে আইরিন স্‌সোতে তাঁর বাবার বাড়িটা নতুন করে তৈরি করালেন। বাড়িতে ফুলের বাগান, ছেলে-মেয়েদের খেলার মাঠ সবকিছুর ব্যবস্থা করলেন। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর স্বাভাবিকভাবেই আইরিন ও ফ্রেডেরিকের সামাজিক মর্যাদা আরো বেড়ে গেলো। তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কলেজ দ্য ফ্রেঞ্চ’-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিলেন। ফ্রান্সের প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরির উদ্‌যোগ গ্রহণ করলেন ফ্রেডেরিক।  

এদিকে ফ্রান্সে তখন প্রগতিশীল পপুলার ফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেছে। সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট লিওন ব্লাম মেয়েদের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ফ্রান্সে তখনো মেয়েদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। [ফ্রান্সে মহিলারা ভোট দেয়ার অধিকার পায় ১৯৪৬ সালে।] প্রেসিডেন্ট ব্লাম শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলেন, শ্রমজীবীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেন। 

ফ্রান্সের বিজ্ঞান-গবেষণা বাড়ানোর জন্য প্রফেসর জাঁ পেরির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’। জাঁ পেরি আইরিনের বাবা-মা’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জাঁ পেরির পরামর্শে প্রেসিডেন্ট ব্লাম ফ্রেডেরিককে ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’র ডিরেক্টর নিযুক্ত করলেন। 

ফ্রান্সের বিজ্ঞান গবেষণা আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে ব্লাম সরকার কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য একদিন প্রেসিডেন্টের পিএস এসে ফ্রেডেরিককে ডেকে নিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্টের অফিসে। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরলে আইরিন জিজ্ঞেস করলেন, “প্রেসিডেন্ট নিশ্চয় তোমাকে বড় কোন দায়িত্ব দিয়েছেন?”
“না, আমাকে দেননি, তোমাকে দিয়েছেন।”
“তার মানে?”
“মানে তোমাকে মন্ত্রী হতে হবে। বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে।”
“তুমি সিরিয়াস?”
“ইয়েস মাদাম। তুমি আবারো আমার বস হয়ে গেলে।”
“কীভাবে?”
“আমার ব্যুরো তোমার মন্ত্রণালয়ের অধীনে।”
“আমার কি এ দায়িত্ব নেয়া উচিত?”
“ইয়েস বস্‌। দেশের কাজে যোগ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে না এলে চলবে কীভাবে? ফ্রান্সের ইতিহাসে তুমিই হবে প্রথম মহিলা মন্ত্রী।”

মন্ত্রী আইরিন কুরি


পরদিন প্রেসিডেন্টের অফিসে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন আইরিন জুলিও-কুরি। তিনি সহ মোট তিন জন মহিলা মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। আইরিনকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে ছুটি নিতে হলো। সম্পূর্ণ নতুন এই প্রশাসনিক কাজে এসে সবকিছু একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করতে হলো আইরিনকে। দায়িত্ব নিয়ে তা ঠিকমত পালন না করার মানুষ আইরিন নন। 

প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে দেখেন তাঁর টেবিলে শত শত চিঠি ফাইল করে রাখা। চিঠিগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন বিষয়ের জন্য ‘আবেদন’। আইরিন দেখলেন সবগুলো চিঠির উত্তর দিতে গেলে তাঁর আর কিছু করার সময় থাকবে না। বেশির ভাগ চিঠিরই লেখক উল্লেখ করছেন যে  মেরি কুরির মেয়ে মন্ত্রী হয়েছে, সুতরাং তাঁদের সব আবেদনই পূর্ণ হবে। মেরি কুরির মেয়ের প্রতি এতটাই বিশ্বাস সবার! 

আবার প্রচুর চিঠি আসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে যাবার জন্য, বিভিন্ন কিছুর উদ্বোধন করার জন্য। আইরিন কিছু কিছু চিঠির উত্তর লিখতে গিয়ে দেখেন যে মন্ত্রী হিসেবে নিজেকে লিখতে হচ্ছে না কিছুই। তিনি শুধু নির্দেশ দেবেন, নির্দেশ অনুযায়ী লিখে দেবার লোক আছে। আইরিন লিখতে নির্দেশ দেন, “আপনাদের সভায় গিয়ে প্রধান অতিথি হবার এবং বক্তৃতা দেবার মত সময় এবং ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই।” 

প্রবীণ অভিজ্ঞ পি-এস বিনীতভাবে বলেন, “মাদাম, এভাবে সরাসরি তো কেউ বলেন না। শুরুতে তাদের আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে পরে যেতে না পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হয়”।
“কেন? তারা তো ধন্যবাদ পাবার মতো কোন কাজ করেননি। আর আমি তো দুঃখ পাচ্ছি না যে দুঃখ প্রকাশ করবো। আমার তো আসলে বলা উচিত এভাবে আমার সময় নষ্ট করার জন্য আমি বিরক্ত।”

আইরিন দেখেন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকরা সারাদিন বসে থাকে খবর সংগ্রহের জন্য। আইরিন যা করেন সবকিছুই তাদের জন্য খবর। আইরিনের দাপ্তরিক চিঠির ভাষা নিয়েও বড় বড় বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। সাংবাদিকদের ওপর তাঁর ক্ষোভ ছোটবেলা থেকেই। এখন এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে এত সময় ও শ্রম নষ্ট হচ্ছে দেখে ক্ষুব্ধ হন তিনি। 
কিন্তু দেশের উপকার হবে এমন কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবং ব্যবস্থা নিতে দেরি করেন না আইরিন। একদিন একটা চিঠি পেলেন সিভ্‌রের ‘স্কুল অব ফিজিক্স ফর গার্লস’র ডিরেক্টরের কাছ থেকে। ডিরেক্টর জানাচ্ছেন তাঁর স্কুলের মেয়েরা পড়ালেখায় খুবই পরিশ্রমী। সবাই পড়াশোনা করছে ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হবার জন্য। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে সংগতি রেখে তাদের গবেষণাগারের কোন উন্নয়ন করা হয়নি গত চল্লিশ বছর। বিজ্ঞানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন কিনা। 
চিঠির পুরোটা পড়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আইরিন। এই স্কুলে তাঁর মা শিক্ষকতা করেছেন অনেক বছর। সেই সময়ও ভালো কোন গবেষণাগার ছিল না এই স্কুলে। তাঁর মা স্কুলের শেড ব্যবহার করেছিলেন গবেষণার কাজে। গত চল্লিশ বছরেও কোন ব্যবস্থা হয়নি! আইরিনের মন্ত্রণালয় অবশ্যই এই স্কুল শুধু নয়, এরকম সব স্কুলেই বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণাগারের ব্যবস্থা করবে। চিঠির শেষে ডিরেক্টরের নাম দেখে চমকে উঠলেন আইরিন। ইউজিনি কটন! 
আইরিনের মনে পড়ে - তাঁর মায়ের ছাত্রী ছিলেন ইউজিনি। প্রায়ই তাদের বাসায় যেতেন ইউজিনি। ভীষণ আদর করতেন আইরিনকে। একেবারে ছোটবেলায় আইরিন যখন সবে সাইকেল চালানো শিখতে শুরু করেছে - ইউজিনি আইরিনের সাইকেল ধরে ধরে আইরিনের সাথে হাঁটতেন। কত গল্প করতেন তখন। আইরিনের স্পষ্ট মনে আছে ইউজিনি বলছেন - “অনেক বছর আগে বিশাল বিশাল ডাইনোসর ছিল এই পৃথিবীতে।”
“তুমি ডাইনোসর দেখেছো?”
“না আইরিন। আমি অত বুড়ো নই।”
“তাহলে গ্র্যানপি ডাইনোসর দেখেছে। গ্র্যানপি অনেক বুড়ো।”
আইরিন ইউজিনির সাথে দেখা করলেন। 
মন্ত্রীসভায় আইরিনের সততা আর স্পষ্টবাদিতা অনেকেরই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ছয় মাস ধরে কাজ করার পরও ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা ও আচরণ আয়ত্ত্ব করতে পারলেন না আইরিন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর একার পক্ষে পুরো সিস্টেম বদলানো সম্ভব নয়। তাঁর মনে হচ্ছে তিনি ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন, তাঁর বদলে ফ্রেড মন্ত্রী হলেই ভালো করতেন। কারণ ফ্রেড ক্ষমতার স্বাদ বোঝেন। 
আইরিনের ইচ্ছে করছে বাবা-মা’র মতো সরবোনের প্রফেসর হতে। প্রফেসর হবার সব যোগ্যতা তাঁর আছে। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর পৃথিবীর যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হতে পারেন তিনি। কিন্তু সরবোনের প্রফেসরশিপ পেতে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। আইরিন ভাবলেন তিনি যদি এখন দরখাস্ত করেন তাহলে তাঁর সহকর্মী শিক্ষামন্ত্রী কোন কিছু না দেখেই তাঁকে অনুমোদন দিয়ে দেবেন। এটা অনুচিত হবে ভেবে তিনি মন্ত্রীত্বে ইস্তফা দিলেন। মন্ত্রীপরিষদের সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
আইরিন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের পুরনো পদে ফিরে গেলেন। সেখান থেকে সরবোনে প্রফেসর পদের জন্য দরখাস্ত করলেন এবং সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সরবোনের প্রফেসর পদে যোগ দিলেন। রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের পদটিও তাঁর থাকলো। অধ্যাপনা ও গবেষণার জগতে ফিরে এলেন আইরিন। কিন্তু ফ্রেডের সাথে যৌথ গবেষণা আর সম্ভব হলো না। ফ্রেড ‘কলেজ দ্য ফ্রেঞ্চ’ ও ‘ব্যুরো অব সায়েন্টিফিক রিসার্চ’ নিয়ে ব্যস্ত। ফ্রেড ‘ল্যাবরেটরি অব অ্যাটমিক সিন্থেসিস’ নামে নতুন একটা গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করেছেন। অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস সংক্রান্ত নতুন নতুন গবেষণা চলছে সেখানে। ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে আইরিন ও ফ্রেডেরিকের হাত দিয়ে। 
১৯৩৮ সালে আইরিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যক্ষা তাঁকে ছাড়ছে না। যেদিন সুস্থ থাকেন সেদিন ল্যাবে যান, পরের দিন আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু এর মধ্যেও তিনি ইউরেনিয়াম নিয়ে নতুন পরীক্ষা চালাচ্ছেন। এনরিকো ফার্মি জুলিও-কুরির কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তা সৃষ্টির প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে ইউরেনিয়ামের মধ্যে নিউট্রন প্রবেশ করিয়ে তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়াম আইসোটোপ তৈরি করতে পেরেছেন এবং দেখেছেন সেখান থেকে প্রচুর তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ঘটছে। 
আইরিনও একই রকমের পরীক্ষা করলেন তাঁর ল্যাবে। তাঁরাও একই রেজাল্ট পেলেন। কিন্তু তাঁরা ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলেন না কী হচ্ছে আসলে। তাঁদের গবেষণাপত্র পড়ে একই পরীক্ষা চালালেন জার্মান বিজ্ঞানী লিসা মেইটনার, অটো হান ও ফ্রিট্‌জ স্ট্রসম্যান। তাঁরাও একই রেজাল্ট পেলেন। লিসা মাইটনার তাঁর ভাইপো অটো ফ্রিসের সাথে আলোচনা করে বুঝতে পারলেন যে ভারী ইউরেনিয়াম আইসোটোপ ভেঙে অপেক্ষাকৃত হাল্‌কা তেজষ্ক্রিয় নিউক্লিয়াসে পরিণত হচ্ছে - যা ক্রমাগত চলতে থাকবে - যা ‘নিউক্লিয়ার ফিশান প্রসেস’ নামে পরিচিতি লাভ করে। 
এই নিউক্লিয়ার ফিশান প্রসেস নিয়ে ভীষণ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন ফ্রেডেরিক। ফিশান পদ্ধতিতে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। পারমাণবিক নিউক্লিয়াস হতে পারে বিপুল পরিমাণ শক্তির উৎস। ফ্রেড জানেন ফ্রান্স সমস্ত জ্বালানি তেল আর এক তৃতীয়াংশ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করে। সেক্ষেত্রে পারমাণবিক নিউক্লিয়াস থেকে ভবিষ্যতের জ্বালানি শক্তির জোগান দেয়ার লক্ষ্যে ফ্রেডেরিক ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করতে শুরু করলেন।  ১৯৩৯ সালের মধ্যে তিনি প্রায় নয় টন খনিজ ইউরেনিয়াম কেনার ব্যবস্থা করেন বেলজিয়ামের খনি থেকে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে কিছু করার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো।
১৯৪০ সালের জুন মাসে ফ্রান্সে জার্মান সৈন্য মার্চ করতে শুরু করেছে। আইরিন নিজে অসুস্থ, বাচ্চাদের নিয়ে ভীষণ আতঙ্কে আছেন। মনে পড়ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল সতেরো। মা তাকে নিয়ে যুদ্ধের মধ্যেই যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখন আইরিন তাঁর তেরো বছরের মেয়ে হেলেন আর আট বছরের ছেলে পিয়েরের জন্য দুশ্চিন্তা করছেন। আইরিন বুঝতে পারছেন তাঁর সাহস তাঁর মায়ের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু আইরিনের বড় চিন্তা হচ্ছে জার্মানদের হাত থেকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউট রক্ষা করবেন কীভাবে। 
ইভ যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য রণক্ষেত্রে চলে গেছেন। দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। ভারতে গিয়ে মহাত্মা-গান্ধী, নেহেরু আর জিন্নাহ্‌র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইভ। 
যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে ফ্রেড যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত। মিলিটারি আর্টিলারির ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব নিতে গেলেন। কিন্তু তাঁকে আরো বড় দায়িত্ব দেয়া হলো। তাঁকে ‘ডিরেক্টর অব ওয়ার রিসার্চ স্টাফ’-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই প্যারিস জার্মানদের দখলে চলে গেলো। ফ্রেডের ল্যাবে জার্মান সৈন্য এসে ইউরেনিয়াম আর হেভি ওয়াটারের খোঁজ করতে লাগলো। তাদের কাছে তথ্য আছে যে ফ্রেড অ্যাটমিক রিঅ্যাক্টর তৈরির জন্য তেজষ্ক্রিয় পদার্থ সংগ্রহ করেছেন। জার্মানি সেগুলো দখল করতে চায়। ফ্রেড আগেই ওসব লুকিয়ে রেখেছিলেন নিরাপদ জায়গায়। জার্মান সৈন্যরা তাঁর ল্যাবে তালা লাগিয়ে দিলো। 
ফরাসি সরকার নাৎসিদের নির্দেশে চলছে। স্বাধীনতাকামীদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠছে। ফ্রেড ও লাঁজেভির মত মানুষেরা গোপন প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। যে কোন মুহূর্তে জার্মান সৈন্যরা তাঁদের তুলে নিয়ে যেতে পারে। শীতকাল চলে আসছে। নাৎসিরা ফ্রান্সের সমস্ত কয়লা জার্মানিতে নিয়ে যাচ্ছে। শীতকালে ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বলবে না কোন ফরাসির বাড়িতে। ছেলে-মেয়েদের নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করছেন আইরিন ও ফ্রেড। পিয়ের এখনো ছোট - তাই হেলেনকেই তাঁরা সুইজারল্যান্ডে এক বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। 
নাৎসিদের সমালোচনা করার অপরাধে পল লাঁজেভিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। তারপর তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো জার্মান ক্যাম্পে। ফ্রেডের অনেক বন্ধুকে জার্মানরা হত্যা করেছে - যাদের মধ্যে লাঁজেভির মেয়ের স্বামীও ছিলেন। ফ্রেডের গতিবিধির ওপর জার্মানরা নজর রাখছে। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানরা রাশিয়ায় ঢুকতে শুরু করেছে।
একদিন খুব সকালে ফ্রেড ও আইরিনের বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো। সাদা পোশাকে ফরাসি পুলিশ। নাৎসিরা ফরাসিদের ওপর অত্যাচার করার জন্য ফরাসিদেরই ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
“আপনাকে আমাদের সাথে একটু পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে মঁসিয়ে।”
“আইরিন, আমার জন্য অপেক্ষা করো না। পিয়েরকে কিছু বলার দরকার নেই।”
আইরিন দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন তাঁর স্বামীকে নিয়ে চলে গেলো পুলিশের জিপ। কখন ফিরবে ফ্রেড, কিংবা আদৌ ফিরবে কিনা কিছুই জানেন না আইরিন। কিন্তু চিন্তা করে কী হবে। আইরিন সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলেন। পিয়েরকে বাবার ব্যাপারে কিছুই বললেন না। কিন্তু মনে মনে সারাক্ষণ আশা করছেন ফ্রেড ফিরবেন, আবার আশংকাও করছেন যদি না ফেরে? 
গভীর রাতে ফ্রেড ফিরে এলেন। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। নাৎসিরা তাঁকে সারাদিন ধরে মানসিক অত্যাচার করেছে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। একটা প্রশ্ন একশ’ বার করে করা। মেজাজ ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে অবস্থা আরো কত খারাপ হতে পারে ভেবে আতঙ্কিত ফ্রেড ও আইরিন।
আইরিনের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ফ্রেড। তিনি আইরিন আর পিয়েরকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়ে দিতে চান। কিন্তু আইরিন ফ্রেডকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না। ফ্রেড জানেন আইরিনের সিদ্ধান্ত বদলানো যায় না। হেলেনও মা-বাবা-ভাইকে ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে বেশিদিন থাকতে না পেরে ফিরে এসেছে বাড়িতে। 
ছদ্ম-জার্মান শাসনে ফ্রান্স চলছে। এমনভাবে চলছে যেন কিছুই হয়নি। স্কুল কলেজ অফিস আদালত চলছে। সবকিছু স্বাভাবিক আছে প্রমাণ করার জন্য ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্স ফ্রেডকে একাডেমির সদস্যপদ দিয়েছে। আইরিনও দরখাস্ত করেছিলেন, কিন্তু যে কারণে তেত্রিশ বছর আগে মাদাম কুরিকে সদস্যপদ দেয়নি এবং আইন পাস করিয়ে রেখেছে যে একাডেমিতে কোনদিনই কোন মহিলাকে একাডেমির সদস্যপদ দেয়া হবে না, সেই কারণ দেখিয়ে আইরিনের দরখাস্ত বাতিল করা হলো। [আইরিন তারপর থেকে প্রতিবছরই নিয়মিত দরখাস্ত করে গেছেন একই রেজাল্ট দেখার জন্য।]
হেলেনের স্কুলের পরীক্ষা হয়ে গেলো। এবার তার সরবোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার কথা। মা-বাবার মতোই বিজ্ঞানী হবার ইচ্ছে হেলেনের। ১৯৪৪ সালে প্যারিসে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। পল লাঁজেভির কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। একদিন ভোরে আবার পুলিশ এলো বাড়িতে। ফ্রেডকে আবার তুলে নিয়ে গেল নাৎসি ক্যাম্পে। সন্ধ্যার পর বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে এসে আইরিনকে জানালেন, “আমাকে আমার সব পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।”

Tuesday, 9 October 2018

আইরিন কুরি - অষ্টম পর্ব


১৯৩০ সালে জুলিও-কুরিরা প্রতিযোগিতা করছিলেন পৃথিবীর অন্যান্য নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীদের সাথে। যে কজন বিজ্ঞানী তখন পরমাণুর নিউক্লিয়াস নিয়ে গবেষণা করছিলেন তাঁরা হলেন ইংল্যান্ডে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, বার্লিনে লিজা মেইটনার, এবং কোপেনহ্যাগেনে নিল্‌স বোর। তখন পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের ধারণা ছিল এরকম: পরমাণুতে শুধু ইলেকট্রন আর প্রোটন আছে। নিউট্রন সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না কারো।
            
আইরিনের মা পোলোনিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৯৮ সালে। রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম ছিল মেরি কুরির সন্তানের মত। আইরিন ও ফ্রেড প্রচুর পোলোনিয়াম উৎপাদন করেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। এই পোলোনিয়াম খুবই বিষাক্ত। ফুসফুস, প্লিহা ও যকৃতের খুব ক্ষতি করে এর তেজষ্ক্রিয় গ্যাস। ফ্রেড ও আইরিন ক্রমে ক্রমে এই বিষে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে তেজষ্ক্রিয়তার বিষে মাদাম কুরির শরীরের সমস্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি ভীষণ অসুস্থ। তারপরেও একটু সুস্থ বোধ করলেই তিনি ইনস্টিটিউটে চলে আসেন।
            
১৯৩২ সালে আইরিন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গবেষণা-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এসময় গবেষণাগারের জন্য একটা আধুনিক হফম্যান ইলেকট্রোমিটার কেনা হয় যার সাহায্যে বাতাসে তেজষ্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট ইলেকট্রিক চার্জের পরিমাপ করা যায়। ফ্রেড দিনরাত খেটে এই ইলেকট্রোমিটার বসানোর কাজ করছেন। এদিকে ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও আবার মা হতে চলেছেন আইরিন।
            
এসময় জার্মান ফিজিসিস্ট ওলাল্টার বোথের একটা পেপার পড়ে খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠেন আইরিন। বেরিলিয়ামের সাথে আলফা কণার সংঘর্ষ ঘটানোর পর দেখা গেলো বেরিলিয়াম থেকে কিছু একটা বেরিয়ে দুই সেন্টিমিটার পুরু সীসার পাত ভেদ করে চলে গেলো। বেরিলিয়াম থেকে এত শক্তিশালী কী বেরোচ্ছে? এটা কি কোন নতুন ধরনের গামা রশ্মি?    আইরিন অসুস্থ শরীরে এই নতুন ধরনের গামা রশ্মি পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। তিনি বেরিলিয়ামের পাশে তেজষ্ক্রিয় পোলোনিয়াম রাখলেন। দেখলেন বেরিলিয়াম থেকে শক্তিশালী রশ্মি বের হয়ে সীসার পাত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। এবার সামনে নানারকম পদার্থ রেখে পরীক্ষা করা হলো। প্যারাফিন ওয়াক্স (মোম) রেখে দেয়া হলো। মোম কার্বন আর হাইড্রোজেনে ভর্তি - প্রোটনের সমৃদ্ধ উৎস। দেখা গেলো মোম থেকে প্রোটন বেরোল প্রায় আলোর বেগের এক দশমাংশ বেগে। এর কারণ কী? প্রোটনকে এত জোরে  ছুঁড়ে দেবার কাজ করছে কে? আইরিন আর ফ্রেড মনে করলেন এটা নতুন ধরনের শক্তিশালী গামা রশ্মি। দ্রুত গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন জুলিও-কুরি।

তাঁদের পেপার পড়ে রাদারফোর্ড বুঝতে পারলেন ভুলটা কোথায়। গামা রশ্মির কোন ভর নেই। তাই গামার পক্ষে প্রোটনের মত ভারী কণাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া সম্ভব নয়। তার মানে নিউক্লিয়াসে প্রোটন ছাড়াও আরো কিছু আছে যা প্রোটনের মতোই ভারী।
            
ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে রাদারফোর্ডের ছাত্র জেমস চ্যাডউইক আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষাটা করে একই ফল পেলেন। কিন্তু ফলাফল ব্যাখ্যা করলেন সঠিকভাবে। আবিষ্কৃত হলো নিউক্লিয়াসের আরেকটি উপাদান - নিউট্রন। অল্পের জন্যই নিউট্রন আবিষ্কারের কৃতিত্বটা আইরিন ও ফ্রেডের হাত থেকে ফস্কে চলে গেলো জেম্‌স চ্যাডউইকের হাতে। [নিউট্রন আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন চ্যাডউইক।]
            
১৯৩২ সালে আইরিন ও ফ্রেডের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলো। আইরিন তাঁর বাবার নাম অনুসারে ছেলের নাম রাখলেন পিয়ের। হেলেন আর পিয়ের মাদাম কুরির চোখের মণি হয়ে উঠলো। সময় পেলেই মাদাম নাতি-নাতনিদের সাথে খেলতে চেষ্টা করেন। তাঁর কাজের অনেকটুকুই এখন আইরিন সামলাচ্ছেন। তবুও তিনি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে যাওয়া থামাচ্ছেন না। ১৯৩৩ সালের সলভে কনফারেন্সে যোগ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
            
এদিকে পিয়েরের জন্মের পর আইরিন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তাঁকে অনেক বয়স্কা মনে হচ্ছে। যক্ষা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। কিন্তু কোনকিছুই তাঁকে ঘরে আটকে রাখতে পারলো না। তিনি কাজে ফিরে গেলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ল্যাবে গিয়েই নতুন পরীক্ষায় হাত দিলেন।
            
নিউট্রন আবিষ্কৃত হবার পর ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের গবেষণায় বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। আইরিন ও ফ্রেড উইলসন ক্লাউড-চেম্বার ব্যবহার করে নিউট্রন নিয়ে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁরা দেখলেন ক্লাউড-চেম্বারে ইলেকট্রন-ট্র্যাকের পাশাপাশি নতুন ধরনের ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে - যা শুধুমাত্র সম্ভব যদি ইলেকট্রনের চার্জ পজিটিভ হয়। আইরিন ও ফ্রেডের আগে এ পরীক্ষা আর কেউ করেননি এবং এই পজিটিভ ইলেকট্রনের অস্তিত্ব সম্পর্কেও কেউ জানতেন না। তবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক পজিটিভ ইলেকট্রনের সম্ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। ডিরাকের পেপার আইরিন ও ফ্রেডের চোখে পড়েনি।
            
পজিটিভ চার্জের ট্র্যাক দেখে তাঁদের ফলাফল সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলেন আইরিন ও ফ্রেড। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) কার্ল এন্ডারসন আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষাটা করে একই রেজাল্ট পেলেন এবং সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে এগুলো পজিট্রনের ট্র্যাক। আরো একটা যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হলেন আইরিন ও ফ্রেড। [পজিট্রন আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন কার্ল এন্ডারসন।]
            
পরপর দুবার সঠিক পরীক্ষণের মাধ্যমে আইরিন ও ফ্রেড নিউট্রন ও পজিট্রন আবিষ্কারে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাছে আইরিন ও ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বেড়ে গেলো। ১৯৩৩ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হলেন তাঁরা। সল্‌ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হওয়া মানে বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া। মাদাম কুরি তো সল্‌ভে কনফারেন্সের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে সবগুলো কনফারেন্সেই আমন্ত্রিত হয়েছেন। আইরিন ও ফ্রেডের এটাই প্রথম।
            
কনফারেন্সে যাবার আগে অনেকগুলো পরীক্ষা করলেন তাঁরা। পোলোনিয়ামের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের পাতলা পাত রেখে দেখেছেন পোলোনিয়াম থেকে আলফা পার্টিক্যল এসে অ্যালুমিনিয়াম পাতে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে নিউট্রন ও পজিট্রন বের করে দিচ্ছে। বার বার পরীক্ষা করে একই রেজাল্ট পেয়েছেন আইরিন ও ফ্রেড।

১৯৩৩ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে আইরিন ও মাদাম কুরি


১৯৩৩ সালের অক্টোবরে ব্রাসেল্‌সে সল্‌ভে কনফারেন্সে আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করলেন ফ্রেড। আইরিন কথা বলতে পছন্দ করেন না, তাই তিনি চুপচাপ বসে আছেন অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে। কনফারেন্সে চল্লিশ জন আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীর মধ্যে বিশ জন নোবেল বিজয়ী। চল্লিশ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন নারী বিজ্ঞানী - মাদাম কুরি, আইরিন আর লিজা মাইটনার। 
ফ্রেডের বক্তৃতার পর লিজা মাইটনার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি নিজে বেশ কয়েক বার এই পরীক্ষাগুলো করে দেখেছি, কিন্তু একবারও কোন নিউট্রন বের হবার প্রমাণ পাইনি। সুতরাং জুলিও-কুরির ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য নয়।” 
লিজা মাইটনার বিখ্যাত পরীক্ষণ-বিজ্ঞানী। তাঁর প্রভাব অনেক বেশি। তাই অনেকেই নবীন বিজ্ঞানী আইরিন ও ফ্রেডের ফলাফল বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু নিল্‌স বোর ও উল্‌ফগং পাউলি ফ্রেড ও আইরিনের ফলাফলে খুবই খুশি। তাঁরা আইরিন ও ফ্রেডের কাজ খুবই সম্ভাবনাময় বলে মত দিলেন। 
প্যারিসে ফিরে মাদাম কুরি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর গলব্লাডার অপারেশন করাতে হলো। পজিট্রনের দুঃখ ভুলতে আইরিন একটা বই লিখলেন - ‘লা ইলেকট্রন-পচিটিফ’ বা ‘দি পজিটিভ ইলেকট্রন’। ১৯৩৪ সালের শুরুতে আইরিন ও ফ্রেড পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন পোলোনিয়াম আর অ্যালুমিনিয়ামের পাত নিয়ে। তাঁরা দেখতে পেলেন পোলোনিয়ামের আলফা পার্টিক্যল অ্যালুমিনিয়ামের সাথে বিক্রিয়া করে নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয়তা তৈরি করছে। কীভাবে হচ্ছে? 
অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে পোলোনিয়াম থেকে আলফা পার্টিক্যল বের হয়ে অ্যালুমিনিয়ামের নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষ ঘটায়। তাতে অ্যালুমিনিয়ামের নিউক্লিয়াস থেকে একটি নিউট্রন বেরিয়ে আসে - ফলে অ্যালুমিনিয়াম নিউক্লিয়াস রূপান্তরিত হয় একটি তেজষ্ক্রিয় ফসফরাস নিউক্লিয়াসে। কয়েক মিনিট পর এই তেজষ্ক্রিয় ফসফরাস থেকে একটি পজিট্রন বের হয় - ফসফরাস নিউক্লিয়াস তার তেজষ্ক্রিয়তা হারিয়ে পরিণত হয় একটি সিলিকন নিউক্লিয়াসে। তার মানে তাঁরা কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তার সন্ধান পেয়েছে! 
ফ্রেড তো খুশিতে আত্মহারা। আইরিনও খুশি - তবে তাঁর তেমন কোন উচ্ছ্বাস নেই। ফ্রেড ছুটে গিয়ে মাদামকে খবর দিলেন। আবার ছুটে এসে আইরিনকে চুমু খেয়ে ছুটলেন ইপিসিআইতে পল লাঁজেভিকে খবর দিতে। একটু পর লাঁজেভিকে সাথে নিয়ে ল্যাবে এসে দেখলেন মাদাম ইতোমধ্যে আইরিনের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন কী কী ঘটেছে। 
আইরিন ও ফ্রেড পুরো পরীক্ষাটা আবার করলেন মাদাম কুরি আর পল লাঁজেভির সামনে। পল লাঁজেভি আইরিন ও ফ্রেডকে অভিনন্দন জানালেন। আর মাদাম কুরিকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, “এবার আরো দুটো নোবেল পুরষ্কার আসছে কুরি পরিবারে”। 
পরের বছরই পল লাঁজেভির কথা সত্যি হয়েছে। কিন্তু মাদাম কুরি তা দেখে যেতে পারেননি। কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পর আইরিন ও ফ্রেড স্কি করতে স্যাভোই পাহাড়ে যাবার সময় মাদাম কুরি ছেলেমানুষের মত বায়না ধরলেন মেয়ের সাথে যাবার জন্য। কিছুতেই বোঝানো গেলো না ৬৬ বছর বয়স্কা শিশু মেরিকে। স্কি না করলেও বরফঢাকা পাহাড়ে উঠে হাঁটাহাঁটি করলেন তিনি এবং আছাড় খেয়ে পড়লেন। প্যারিসে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো তাঁকে। 
একটু সুস্থ হয়ে বাড়িতে এসে মে মাসে শুধু একবারের জন্য ইনস্টিটিউটে পা রেখেছিলেন মেরি। তারপর আর হাঁটাচলা করতে পারেননি। ইভ সব কাজকর্ম ছেড়ে বাড়িতে মায়ের সেবা করতে লাগলেন। ত্রিশ বছর বয়সী ইভ বেশ কয়েকটি ভালোবাসার সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আইরিন ও ফ্রেড হেলেন ও পিয়েরকে নিয়ে প্রতিদিনই মাকে দেখতে আসেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা ইনস্টিটিউটের সব খবর জানতে চান। 
 
অনেক ডাক্তার এসে মেরিকে দেখে যাচ্ছেন। রোগ নির্ণয়ে নানারকম মতামত দিচ্ছেন। এখন বলা হচ্ছে তিনি মারাত্মক যক্ষায় আক্রান্ত। বাড়ির চেয়ে হাসপাতালেই ভালো থাকবেন। বিজ্ঞানী হিসেবে মাদাম যতটা ভালো রোগী হিসেবে ততটাই খারাপ। তিনি ডাক্তারের কোন পরামর্শ মেনে চলেন না। দুই বোন অনেক জোর করে মা-কে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ক’দিন পর ডাক্তাররা বললেন তাঁর ফুসফুসের চেয়েও বড় সমস্যা তাঁর রক্তে। রক্ত পরীক্ষা করার পর ধরা পড়লো - লিউকেমিয়া। মাদাম কুরির তৃতীয় সন্তান রেডিয়ামের প্রতি ভালোবাসার ফল তাঁর ব্লাড ক্যান্সার।
আইরিন প্রতিদিনই অফিসে যাচ্ছেন, সব কাজ করছেন ঠিকমত। কিন্তু মায়ের জন্য তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। নিজের কষ্টের কথা বলার অভ্যাস নেই বলে কাউকেই বলতে পারছেন না মা তাঁর জীবনে কতখানি। জুলাইয়ের তিন তারিখ মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। তিনি কাউকে আর চিনতে পারছিলেন না। ১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই সকালে মাদাম কুরি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 
মাদাম কুরির মৃত্যুর পর রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নেন আইরিন। গবেষণার সাথে সাথে প্রশাসনিক কাজও বেড়ে যায় অনেক। ফ্রেডের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থান ঘটেছে। আইনস্টাইন সহ অনেক বিজ্ঞানী জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন। ফ্রেড কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছেন। 
১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেলেন আইরিন ও ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। একই বছর নিউট্রন আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন জেম্‌স চ্যাডউইক। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ স্টকহোমে নোবেল পুরষ্কার নেবার সময় সারাক্ষণই মায়ের কথা মনে পড়ছিল আইরিনের। চব্বিশ বছর আগে মায়ের সাথে এসেছিলেন আইরিন মায়ের নোবেল পুরষ্কার অনুষ্ঠানে। আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন! পুরষ্কার দেবার সময় রাজা পঞ্চম গুস্তাভও মাদামের কথা বললেন আইরিনকে। 

Sunday, 30 September 2018

আইরিন কুরি ।। সপ্তম পর্ব



 পরদিন সকালে নাস্তা করার সময় মাকে বললেন আইরিন, “মি, আমি এন্‌গেজড।”
চমকে উঠলেন মাদাম কুরি - “হোয়াট?”
“আমি এন্‌গেজড। আমার বয়স এই সেপ্টেম্বরে আটাশ হবে। আমার এখন বিয়ে করা উচিত। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমি এন্‌গেজড হয়েছি।”
“কার সাথে?”
“মঁসিয়ে জুলিও”
“ফ্রেডেরিক জুলিও? কিন্তু তার তো কোন ডিগ্রি নেই। একজন ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টের বউ হয়ে জীবন কাটাবি?”
“আমি তো তার ডিগ্রিকে বিয়ে করবো না মি। তাছাড়া এখন তার ডিগ্রি নেই, ডিগ্রি হবে। সে তার গ্র্যাজুয়েশানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
“ভালো” - বলে চুপ করে গেলেন মাদাম। তাঁর চোখেমুখে হতাশার চিহ্ন খেয়াল করলেন না আইরিন।

মাদাম কুরি কাউকে কিছু না বললেও ফ্রেড আর আইরিনের সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। ফ্রেডের চেয়ে শিক্ষায় পদমর্যাদায় সিনিয়র অনেকেই আছেন সেখানে। তাঁরা ফ্রেডের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলাবলি করতে লাগলো - ফ্রেড রাজকন্যা আর রাজত্ব দুটোই দখল করার জন্য ইনস্টিটিউটে এসেছেন। আইরিনের এসবে কিছু এসে যায় না। কিন্তু ফ্রেড কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন যখন সহকর্মীরা তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন। 

ফ্রেড নিজেকে সবদিক দিয়েই আইরিনের যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে সরবোন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ফ্রেড। 

গবেষণাগারে আইরিন ও ফ্রেড

১৯২৬ সালে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন ফ্রেড ও আইরিন। জুন মাসের পাঁচ তারিখ ফ্রেডের মা মাদাম কুরির সাথে দেখা করলেন। মাদাম খুবই আন্তরিক ব্যবহার করলেন মাদাম জুলিওর সাথে। জুনের বিশ তারিখ আইরিন গেলেন ফ্রেডদের বাসায় সবার সাথে লাঞ্চ করতে। ফ্রেডের বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করলেন আইরিনকে। আইরিন কারো সাথে তেমন কোন কথা না বললেও তাঁর আন্তরিক সোজাসাপ্টা আচরণে সবাই বেশ খুশি হলেন। 

২৪শে জুন কুরি পরিবার আর জুলিও পরিবার একসাথে ডিনারে গেলো। ফ্রেডকে খুবই পছন্দ হলো ইভের। তার মনে হলো আইরিনের শুষ্ক নীরস সাদাকালো জীবনের ক্যানভাস রঙে রঙে ভরিয়ে দিতে পারবেন ফ্রেড। কিন্তু মাদামের গাম্ভীর্য আইরিনের চোখে না পড়লেও ইভের চোখ এড়ালো না। 

লা’কোয়েস্টে প্রতিবছর সামারে ছুটি কাটাতে যান আইরিন ও ইভ। এ’বছর ইভের বদলে ফ্রেডকে সাথে নিয়ে গেলেন আইরিন। লা’কোয়েস্টের ফিশিং বোটে ইচ্ছেমতো মাছ ধরলেন ফ্রেড। লা’কোয়েস্টের প্রায় প্রত্যেকের সাথেই পরিচয় হয়ে গেলো ফ্রেডের। জেলেদের সাথে তো রীতিমত বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তাঁর। 

আইরিন তাঁর বিয়ের তারিখের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। লা’কোয়েস্ট থেকে প্যারিসে মাকে চিঠি লিখলেন আইরিন, “মি, আমাদের বিয়ের তারিখ এখনো তুমি ঠিক করে দাওনি। তোমার কোপেনহ্যাগেনে যাবার আগে বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হয়। কোপেনহ্যাগেন থেকে তোমার ফিরে আসার পরে হলে হয়তো আরো ভালো হতো, কিন্তু তখন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা চলবে। আমার মনে হয় অক্টোবরের নয় তারিখে বিয়ে হলে সবদিক দিয়ে ভালো হয়। তুমি তাড়াতাড়ি তোমার মত জানাও। আমি সেই মত টাউন হল বুকিং দেবো।” 

আইরিনের কথামতোই সবকিছু ঠিক হলো। ১৯২৬ সালের ৯ই অক্টোবর দুপুরে বিয়ে হয়ে গেলো আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলিওর। খুবই অনানুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হবার কথা থাকলেও দেখতে দেখতে বেশ বড় অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। জুলিও পরিবারের সবাই, কুরি পরিবারের সবাই, সহকর্মী বিজ্ঞানীরা, সিটি মেয়র সহ বড় বড় সরকারি অফিসারের অনেকেই বিয়েতে এসেছিলেন। লাঞ্চের পর ফ্রেড আইরিনের সাথে আইরিনদের বাসায় গেলেন। তারপর সব অতিথিরা চলে গেলে নিজেও চলে গেলেন তাঁর নিজের বাসায়। আইরিন রয়ে গেলেন তাঁর মি’র সাথে। 

পরদিন সকালে ইভকে নিয়ে মাদাম কুরি চলে গেলেন কোপেনহ্যাগেনে। ফ্রেড চলে এলেন আইরিনের বাড়িতে। সেখানেই শুরু হলো তাঁদের দাম্পত্য জীবন। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস ফ্রেড ও আইরিন মাদাম কুরির বাসাতেই ছিলেন। 

ফ্রেড ও আইরিন

আইরিনের বিয়ের পর মাদাম বেশ গম্ভীর হয়ে গেছেন। ফ্রেডকে তিনি সহজে মেনে নিতে পারছেন না। আইরিনকে মাদাম বলেছেন ম্যারেজ অ্যাগ্রিমেন্ট করিয়ে নিতে - কারণ তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না ফ্রেডের সাথে আইরিনের বিয়ে টিকবে। 

পুরুষ-শাসিত ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী স্ত্রীর সমস্ত সম্পদ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে স্বামীর হাতে। মেরির ধারণা ফ্রেড আইরিনকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁর নিজের কাছ থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে আইরিন হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অবলম্বন। কিন্তু মাদামের মনে হচ্ছে ফ্রেডের সাথে পরিচয়ের পর থেকে আইরিন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। অভিমানে মাদাম কতগুলো ছেলেমানুষী কাজ করতে শুরু করলেন। 

যেমন একদিন আমেরিকা থেকে কয়েকজন বিজ্ঞানী এসেছেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। মাদাম তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইনস্টিটিউটের গবেষক ও অ্যাসিস্ট্যান্টদের সবাইকে মিটিং রুমে ডাকলেন। সবাই এসে পাশাপাশি দাঁড়ালেন। মাদাম একে একে পরিচয় দিচ্ছিলেন - “ইনি ডক্টর লুইস - আমাদের ল্যাব টু’র ডিরেক্টর, ইনি ডক্টর সল্‌সবেরি - মাস্টার্স প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, ইনি ডক্টর কুরি - রিসার্চ ইনচার্জ, ইনি মঁসিয়ে টেপার, ….” এভাবে যখন ফ্রেডের নাম বলার পালা এলো তখন এমন ভাব করলেন যেন ফ্রেডকে দেখতেও পাননি। ফ্রেডকে বাদ দিয়ে পরের জনের পরিচয় দিতে শুরু করলেন। কিন্তু ফ্রেডের উজ্জ্বল উপস্থিতি ভিজিটরদের চোখ এড়ায় না। যখন তাঁরা মাদামকে ফ্রেড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন - মাদাম দায়সারা ভাবে জবাব দেন - “ওই লোকটা? আইরিন ওই লোকটাকে বিয়ে করেছে”। 

কিন্তু মাদামের অভিমান চোখেই পড়ছে না আইরিনের। তিনি তাঁর স্বামীর সাথে নতুন জীবন নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর জন্য রান্না করতে গিয়ে আইরিন আবিষ্কার করলেন তিনি এত কিছু শিখেছেন জীবনে - কিন্তু রান্না শিখতে ভুলে গেছেন। তবে কোন সমস্যা নেই। দেখা গেলো ফ্রেড চমৎকার রান্না করেন। অবশ্য রান্না করার সময় রান্নাঘর এত  অগোছালো করে ফেলেন যে অস্বস্তি লাগে। রান্না শেষে ফ্রেড ভয়ে ভয়ে গোছানোর চেষ্টা করেন। আইরিনের খুব মজা লাগে এসব দেখে। রান্নাঘর থেকে মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো যা এই বাসায় আগে কখনো শোনা যায়নি। ইভ বাসায় থাকলে সেও যোগ দেয় তাদের সাথে। কিন্তু মাদাম একেবারেই একা হয়ে গেলেন।   

কয়েক মাস পর মাদাম আইরিনের হাতে একটা অ্যাপার্টমেন্টের চাবি তুলে দিলেন বিয়ের উপহার হিসেবে। তাঁদের বর্তমান বাসা থেকে কাছেই সরবোন অ্যানেক্সে একটা ছয়তলা ভবন কিনেছিলেন মাদাম কুরি, জাঁ পেরি আর ফ্রান্সিস বোরেল - এই তিন বন্ধু মিলে। প্রতি তলায় একটা করে অ্যাপার্টমেন্ট। তিন তলায় পাঁচ রুমের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেলেন আইরিন ও ফ্রেড। ছয় তলায় আইরিনের ছোটবেলার বন্ধু আলিনও থাকেন তাঁর স্বামী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো আইরিন ও ফ্রেডের সংসার। 

কিন্তু বিজ্ঞান-সমাজে ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। আইরিন ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানী হিসেবে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। অনেকগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর। কিন্তু ফ্রেড এখনো মাস্টার্সও পাস করেননি। অনেকেই প্রকাশ্যে বলাবলি করতে লাগলো এই বিয়ে ফ্রেডের ওপরে উঠার সিঁড়ি,  ক্যারিয়ার বাগানোর জন্য আইরিনকে বিয়ে করেছেন ফ্রেড। 

ফ্রেড রেগে যান এসব শুনে। বিয়ের পরেও আইরিন ‘কুরি’ নামে তাঁর পেপার প্রকাশ করতে থাকেন। মিডিয়াতে এই জুটি জুলিও-কুরি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আইরিনের সাথে কথা বলে ফ্রেড নিজের পদবীর সাথে স্ত্রীর পদবী লাগিয়ে ‘জুলিও-কুরি’ হয়ে যান। 

মায়ের কাছ থেকে আলাদা থাকতে শুরু করার পর মাদাম কুরির মনের অবস্থা বুঝতে পারেন ফ্রেড। তিনি আইরিনকে বোঝান - “আমাদের কিন্তু প্রতিদিনই একবার মাদামের বাসায় যাওয়া উচিত, তাঁর সাথে ডিনার করা উচিত।”
“মি কি সেটা পছন্দ করবেন?”
“তুমি কি মি’র পছন্দ অপছন্দ বুঝতে পারো? তুমি কি বুঝতে পারছো যে তিনি এখন কতটা একা হয়ে গেছেন? তিনি ভাবছেন আমি তোমাকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। তোমার উচিত তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া যে এখনো তুমি তাঁরই আছো। তাঁর মেয়ে পর হয়ে যায়নি বরং মেয়ের মাধ্যমে তিনি একটা ছেলে পেয়েছেন।”
“সেটা তো ঠিকই, কিন্তু তাঁকে বোঝাতে হবে কেন? মি পৃথিবীর এত কঠিন কঠিন জিনিস বোঝেন, আর এই ব্যাপারটা বোঝেন না?”
“স্নেহ ভালোবাসার ব্যাপারটা হলো অনেকটা সঙ্গীতের মতো। শুধু মনে মনে গুনগুন করলে হয় না, মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গাইতে হয়।”

আইরিনও ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। ফ্রেডের কাছ থেকে অনেক মানবিক ব্যাপার শিখছেন আইরিন যা আগে তাঁর চোখেও পড়তো না। সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকদিনই মেরির সাথে ডিনার করেন ফ্রেড ও আইরিন। আস্তে আস্তে মেরি সহজ হতে থাকেন ফ্রেডের সাথে। 

১৯২৭ সালে ফ্রেড সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তাঁদের প্রথম সন্তান হেলেনের জন্ম হয়। নাতনির মুখ দেখার পর মাদাম কুরির সব অভিমান জল হয়ে যায়। তিনি নাতনিকে একদিন না দেখলে ছটফট করতে থাকেন। 

মা হবার পর আইরিন যক্ষায় আক্রান্ত হলেন। ডাক্তার বললেন ‘কমপ্লিট রেস্ট’ নিতে হবে। এটাও বললেন যে ভবিষ্যতে আর মা হওয়া চলবে না। কয়েক সপ্তাহ রেস্ট নিয়ে শিশু হেলেনকে নার্সের হাতে দিয়ে ল্যাবে ফিরলেন আইরিন। ল্যাবে ডক্টরেটের জন্য পূর্ণোদ্যমে গবেষণা করছেন ফ্রেড। আইরিন সুপারভাইজ করছেন তাঁকে। 

১৯৩০ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল, “ইলেকট্রোকেমিক্যাল প্রপার্টিজ অব রেডিওঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ডস অব পোলোনিয়াম”। 

রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফ্রেড ও আইরিন যে বেতন পান তাতে ঠিকমত সংসার চলে না তাঁদের। মায়ের দেয়া অ্যাপার্টমেন্টটা না থাকলে তাঁদের অবস্থা যে কী হতো বলা যায় না। এতদিন ফ্রেডের একাডেমিক ডিগ্রি ছিল না। এখন ডক্টরেট হবার পর ফ্রেড ইন্ডাস্ট্রিতে চলে চাকরি নিয়ে চলে যাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে গবেষণা করার তেমন সুযোগ নেই।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে ফ্রেডের। জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট নাৎসিদের উত্থান ঘটছে। ফ্রেড সরকারি চ্যানেলে বোঝাতে সক্ষম হন যে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রচুর বাজেট না দিলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিস্টদের ঠেকানো যাবে না। সরকার একটা বড় অংকের রিসার্চ গ্রান্ট দেয় ফ্রেডকে। ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ফ্রেড আইরিনের সাথে পূর্ণকালীন গবেষণা শুরু করেন। 

ফ্রেড আর আইরিনের টিম-ওয়ার্ক খুবই ভালো চলছিল। ফ্রেড ফিজিসিস্ট হলেও তাঁর ডক্টরাল থিসিস ছিল কেমিস্ট্রিতে। আর আইরিন কেমিস্ট, কিন্তু তাঁর থিসিস ছিল পিওর ফিজিক্সের ওপর। ফ্রেড যেকোন ব্যাপারেই দ্রুত চিন্তা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আবার ঘনঘন সিদ্ধান্ত বদলানও। কিন্তু আইরিন সেরকম নন। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন বলে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর অনেক দেরি হয়। গবেষণায় সাফল্য এলে সকলের প্রশংসা পেতে পছন্দ করেন ফ্রেড, কিন্তু বিরাট সাফল্যেও কোন ভাবান্তর হয় না আইরিনের। 

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts