পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের সমসাময়িক সময়ে আইরিনের জন্ম। উইলহেল্ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের দু’বছর পর, হেনরি বেকোয়ারেলের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরের বছর ১৮৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পিয়ের ও মেরি কুরির প্রথম সন্তান আইরিন কুরির জন্ম। নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার সপ্তাহ আগে জন্ম হয় আইরিনের। মেরি কুরি তখন প্যারিসের মেয়েদের স্কুলে ফিজিক্সের শিক্ষক এবং পিয়ের কুরি ইকোল মিউনিসিপেল দ্য ফিজিক অ্যাট কিমিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়েল্স (ইপিসিআই) এর ফিজিক্স ল্যাবের প্রধান। আইরিনের জন্মের দু’সপ্তাহ পর তার দিদিমা (পিয়েরের মা) মারা যান। কিছুদিন পর পিয়ের তাঁর বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন। ডাক্তার ইউজিন কুরি বুকে তুলে নেন নাতনি আইরিনকে। দাদুর সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আইরিনের।
গবেষণা ও পড়ানোর কাজে খুব ব্যস্ত আইরিনের মা-বাবা। পিয়ের কুরি গবেষণা করছেন কৃস্টালের চৌম্বক-ধর্ম নিয়ে। মেরি কুরি তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির গবেষণার জন্য কাজ শুরু করেছেন সদ্য আবিষ্কৃত তেজষ্ক্রিয়তার ধর্মের ওপর। দিনরাত পরিশ্রম করে নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয় পদার্থের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন মেরি। আইরিনের জন্মের পর সামান্য কয়েক সপ্তাহ বিশ্রামের পর দ্রুত কাজে ফিরে গেছেন তিনি। ১৮৯৮ সালের জুন মাসে পাওয়া গেলো নতুন তেজষ্ক্রিয় মৌল - নিজের জন্মভূমির নামানুসারে মেরি যার নাম রেখেছেন পোলোনিয়াম। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পাওয়া গেলো আরো শক্তিশালী নতুন মৌল রেডিয়াম। আইরিনের মতো রেডিয়াম-পোলোনিয়ামও যেন মেরির সন্তান। আইরিনের মা-বাবা আইরিনের চেয়েও বেশি সময় দিতে লাগলেন রেডিয়ামকে।
দাদুর কোলে-পিঠেই বেড়ে উঠছে আইরিন। শুধুমাত্র ছুটির দিনে কিছুটা সময় মা-বাবাকে কাছে পায়। তার বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর মা-বাবা আরো ব্যস্ত হয়ে যান। দেখা যায় সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে ডিনারের পর আবার গবেষণায় ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। আইরিন তখন কান্নাকাটি শুরু করে। মা তাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেন। অভিমান হয় ছোট্ট আইরিনের। মা-বাবা কেন তার কাছ থেকে দূরে থাকে সব সময়? অনেক সময় ঘুমের ভান করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। মা তখন তাকে দাদুর কোলে দিয়ে বাবার সাথে বেরিয়ে যান কাজে। আইরিন চোখ খুলে দেখে দাদুর মুখ।
![]() |
মা-বাবা ও দাদুর
সাথে আইরিন |
![]() |
এক্স-রে ইউনিট
নিয়ে কাজ করছেন মেরি ও আইরিন কুরি |
![]() |
মায়ের সাথে
ল্যাবরেটরিতে আইরিন |
সহকর্মীদের সাথে ল্যাবে কাজ করার সময় আইরিন ভীষণ কড়া। জ্ঞানে এবং শারীরিক দক্ষতায়ও তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে। ২৫ বছর বয়সেই তিনি অনেক বেশি জানেন। কিন্তু সামাজিক মেলামেশায় অভ্যস্ত না হবার কারণে তাঁর কথাবার্তা ভীষণ চাঁছাছোলা। তিনি কোদালকে শুধু কোদালই বলেন না - কোদালের খুঁত থাকলে তাও বলেন। বাড়ির লোকের সাথে মাঝে মাঝে হাসলেও - বাইরের কারো সামনে কখনোই হাসেননি আইরিন। অনেকে আইরিনকে অহংকারী ভেবে ভুল বোঝেন। ঈর্ষাতুর অনেকে মনে করেন ডিরেক্টরের মেয়ে হবার কারণে আইরিন ডাঁট দেখান। আড়ালে অনেকে তাঁকে ‘প্রিন্সেস’ বলেও ডাকেন। কিন্তু আইরিনের কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আইরিন জানেন তাঁর বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা কতটুকু। কিন্তু সে নিয়ে কোন অহংকার তাঁর নেই।
আইরিনকে কখনো কোন বিষয় নিয়ে রাগতে দেখেনি কেউ। আইরিন জীবনে কোনদিন মিথ্যা কথা বলেননি, কোনদিন কাউকে ইম্প্রেস করতে চান নি। তিনি যা তিনি তাই।
রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে মায়ের তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য গবেষণা শুরু করলেন আইরিন। মায়ের আবিষ্কৃত পোলোনিয়াম থেকে যে আলফা পার্টিক্যাল বের হয় তার ধর্ম বিশ্লেষণ শুরু করলেন তিনি। তাঁর গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য হলো পদার্থের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আলফা পার্টিক্যল কেন গতি হারায় এবং কীভাবে গতি হারায় তা খুঁজে বের করা। ১৯২১ সালে আইরিন কুরির প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ইনস্টিটিউটের চিফ অব স্টাফ ফারনান্দ হলউইকের সাথে একের পর এক পরীক্ষণ চলতে থাকে আইরিনের।
১৯২৪ সালের নভেম্বরে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য থিসিস লিখছেন আইরিন। থিসিসে তিনি যেসব পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন তার সবকিছুই নতুন। সেই সময় পোলোনিয়াম সম্পর্কে যত পরীক্ষা আইরিন করেছেন পৃথিবীর আর কোথাও কেউ ততটা করেননি।
![]() |
ডক্টর আইরিন
কুরি |
অডিটোরিয়ামে প্রায় হাজার দর্শক উপস্থিত রেডিয়াম-কন্যার বক্তৃতা শোনার জন্য। আইরিন যদিও সমাবেশ পছন্দ করেন না, কোন ধরনের টেনশান ছাড়াই তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি যা জানেন তা এত ভালো জানেন যে সেটা নিয়ে কোনদিনই কোন উৎকন্ঠায় ভোগেন না। আইরিনের পরীক্ষকদের ওপর মানসিক চাপ পড়বে ভেবে মাদাম কুরি যাননি সেই অনুষ্ঠানে। পরীক্ষকদের সবার ভূয়সী প্রশংসার ভেতর দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন আইরিন কুরি।
১৯২৬ সালের ৯ই অক্টোবর বিয়ে হলো আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলিওর। ফ্রেডেরিক জুলিও মেরি কুরির ইন্সটিটিউটে গবেষণা করছিলেন। সেখানে গবেষণা করতে করতেই আইরিন ও ফ্রেডেরিকের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। বিয়ের পর ফ্রেডেরিক নিজের পদবির সাথে কুরি পদবিও জুড়ে নেন। তখন থেকে তাদের পদবি হয় জুলিও-কুরি। বিয়ের পর আইরিন ও ফ্রেডেরিকের যৌথ গবেষণা আরো বেগবান হয়।
![]() |
গবেষণারত আইরিন ও ফ্রেডেরিক |
১৯২৭ সালে ফ্রেড সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তাঁদের প্রথম সন্তান হেলেনের জন্ম হয়। ১৯৩০ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল, “ইলেকট্রোকেমিক্যাল প্রপার্টিজ অব রেডিওঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ডস অব পোলোনিয়াম” ।
১৯৩২ সালে আইরিন ও ফ্রেডের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলো। আইরিন তাঁর বাবার নাম অনুসারে ছেলের নাম রাখলেন পিয়ের। হেলেন আর পিয়ের মাদাম কুরির চোখের মণি হয়ে উঠলো। সময় পেলেই মাদাম নাতি-নাতনিদের সাথে খেলতে চেষ্টা করেন। তাঁর কাজের অনেকটুকুই এখন আইরিন সামলাচ্ছেন। তবুও তিনি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে যাওয়া থামাচ্ছেন না। ১৯৩৩ সালের সলভে কনফারেন্সে যোগ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
এদিকে পিয়েরের জন্মের পর আইরিন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তাঁকে অনেক বয়স্কা মনে হচ্ছে। যক্ষা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। কিন্তু কোনকিছুই তাঁকে ঘরে আটকে রাখতে পারলো না। তিনি কাজে ফিরে গেলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ল্যাবে গিয়েই নতুন পরীক্ষায় হাত দিলেন।
নিউট্রন আবিষ্কৃত হবার পর ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের গবেষণায় বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। আইরিন ও ফ্রেড উইলসন ক্লাউড-চেম্বার ব্যবহার করে নিউট্রন নিয়ে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁরা দেখলেন ক্লাউড-চেম্বারে ইলেকট্রন-ট্র্যাকের পাশাপাশি নতুন ধরনের ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে - যা শুধুমাত্র সম্ভব যদি ইলেকট্রনের চার্জ পজিটিভ হয়। আইরিন ও ফ্রেডের আগে এ পরীক্ষা আর কেউ করেননি এবং এই পজিটিভ ইলেকট্রনের অস্তিত্ব সম্পর্কেও কেউ জানতেন না। তবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক পজিটিভ ইলেকট্রনের সম্ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। ডিরাকের পেপার আইরিন ও ফ্রেডের চোখে পড়েনি।
পজিটিভ চার্জের ট্র্যাক দেখে তাঁদের ফলাফল সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলেন আইরিন ও ফ্রেড। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) কার্ল এন্ডারসন আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষাটা করে একই রেজাল্ট পেলেন এবং সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে এগুলো পজিট্রনের ট্র্যাক। আরো একটা যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হলেন আইরিন ও ফ্রেড। [পজিট্রন আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন কার্ল এন্ডারসন।]
পরপর দু’বার সঠিক পরীক্ষণের মাধ্যমে আইরিন ও ফ্রেড নিউট্রন ও পজিট্রন আবিষ্কারে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাছে আইরিন ও ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বেড়ে গেলো। ১৯৩৩ সালের সল্ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হলেন তাঁরা। সল্ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হওয়া মানে বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া। মাদাম কুরি তো সল্ভে কনফারেন্সের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে সবগুলো কনফারেন্সেই আমন্ত্রিত হয়েছেন। আইরিন ও ফ্রেডের এটাই প্রথম।
কনফারেন্সে যাবার আগে অনেকগুলো পরীক্ষা করলেন তাঁরা। পোলোনিয়ামের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের পাতলা পাত রেখে দেখেছেন পোলোনিয়াম থেকে আলফা পার্টিক্যল এসে অ্যালুমিনিয়াম পাতে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে নিউট্রন ও পজিট্রন বের করে দিচ্ছে। বার বার পরীক্ষা করে একই রেজাল্ট পেয়েছেন আইরিন ও ফ্রেড।
১৯৩৩ সালের অক্টোবরে ব্রাসেল্সে সল্ভে কনফারেন্সে আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করলেন ফ্রেড। আইরিন কথা বলতে পছন্দ করেন না, তাই তিনি চুপচাপ বসে আছেন অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে। কনফারেন্সে চল্লিশ জন আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীর মধ্যে বিশ জন নোবেল বিজয়ী। চল্লিশ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন নারী বিজ্ঞানী - মাদাম কুরি, আইরিন আর লিজা মাইটনার।
![]() |
১৯৩৩ সালের সল্ভে কনফারেন্সে আইরিন ও মাদাম কুরি |
![]() |
নোবেলজয়ী আইরিন ও ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি |