Saturday 11 February 2023

কক্ষতাপমাত্রায় অদৃষ্টপূর্ব কোয়ান্টাম দশা

 




বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল গাণিতিক সমীকরণগুলি ক্রমশ বিকশিত হচ্ছিল, তখন বেশিরভাগ বিজ্ঞানী ধারণাই করতে পারেননি যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহারিক জীবনে কোনো কাজে লাগবে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যবহার তো দূরের কথা, তখন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কলকব্জা বুঝতে পারাটাই দুরুহ ছিল অনেকের পক্ষে। রিচার্ড ফাইনম্যানের মতো বিজ্ঞানীও বলেছেন  – যদি কেউ দাবি করেন যে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝেছেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসলে বোঝেন না। তবুও এই দুর্বোধ্য বিষয়টার অন্তর্নিহিত শক্তিকে ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তিতে কাজে লাগাতে অবিরাম গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। তার সুফল আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ভোগ করছি। একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি ক্রমশ হয়ে উঠছে কোয়ান্টাম-প্রযুক্তি নির্ভর। আর এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তিকে সহজে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য যে বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণা করছেন এবং ক্রমাগত সাফল্য লাভ করছেন তাঁদের অন্যতম প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ইউজিন হিগিন্স প্রফেসর জাহিদ হাসান। তাঁর নেতৃত্বে তাঁর গবেষণাগারে অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে স্বাভাবিক কক্ষতাপমাত্রায় কোয়ান্টাম দশা। যে কোয়ান্টাম দশা এতদিন শুধুমাত্র পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছিই পাওয়া গেছে, সেখানে তা বিশেষ কিছু পদার্থে স্বাভাবিক কক্ষতাপমাত্রায় পর্যবেক্ষণ করার ঘটনা অদৃষ্টপূর্ব অর্থাৎ আগে কখনো দেখা যায়নি। এই আবিষ্কার এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচার ম্যাটেরিয়েলস এর অক্টোবর সংখ্যা্র মলাটকাহিনি হয়েছে এই ঘটনা। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে প্রফেসর জাহিদ হাসানের এই আবিষ্কার। এই আবিষ্কার খুলে দিয়েছে কোয়ান্টাম ন্যানোপ্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনার দ্বার। অচিরেই প্রচলিত ইলেকট্রনিক্সের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে এই আবিষ্কার।

কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই হঠাৎ একদিনে হয়ে যায় না। প্রফেসর জাহিদ হাসানের দীর্ঘ সতেরো বছরের ধারবাহিক গবেষণার ফসল এই আবিষ্কার। বাংলাদেশি-আমেরিকান প্রফেসর জাহিদ হাসান এক্সপেরিমেন্টাল কোয়ান্টাম টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়ালের গবেষণায় অগ্রদূত। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন আমেরিকায়। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে স্নাতক শেষ করে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন ২০০২ সালে। কোয়ান্টাম টপোলজি নিয়ে গবেষণা করতে করতে ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যেই তিনি ত্রিমাত্রিক বিসমাথ-অ্যান্টিমনির কেলাসে আবিষ্কার করেছেন টপোলজিক্যাল বিন্যাস।

টপোলজি গাণিতিকভাবে খুবই জটিল জ্যামিতিক বিজ্ঞান। কোনো জ্যামিতিক আকার যদি ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে, যতই পরিবর্তন হোক না কেন, যদি মূল অংশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, তাহলে তাদেরকে একই টপোলজিক্যাল সেটের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা যায়। মোটা দাগের উদাহরণ হিসেবে মৃৎশিল্পের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। একতাল মাটি থেকে যখন ধাপে ধাপে আকার পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি পাত্র তৈরি হয়, তখন প্রত্যেকটি ধাপের আকার একেকটি টপোলজিক্যাল স্তর। কিন্তু মূল কাঠামো থেকে যদি কোনো অংশ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় – সেটা আর প্রথম টপোলজির অংশ থাকে না। সেটা থেকে আরেকটি নতুন টপোলজির সূচনা করা যায়। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে টপোলজির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। জীববিজ্ঞানে টপোলজি ব্যবহারের বিশাল ক্ষেত্র অপেক্ষা করে আছে। জীবকোষগুলি আণুবীক্ষনিকভাবে প্রতিক্ষণে আকার বদলাচ্ছে। সেগুলির গঠন পর্যবেক্ষণে তো বটেই – শরীরের প্রোটিন ও নিউক্লিকিক এসিডের প্রতিটি মোচড় ব্যাখ্যা করা যায় টপোলজি দিয়ে।

প্রফেসর জাহিদ হাসান টপোলজি প্রয়োগ করে চলেছেন পদার্থবিজ্ঞানের কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি এবং ম্যাটেরিয়েল সায়েন্সে। তিনি আবিষ্কার করেছেন টপোলজিক্যাল ডিরাক ম্যাটেরিয়েল বা ডিরাক সেমিমেটাল যা সেমিকন্ডাক্টরের জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাবে। তারপর তাঁর হাতেই আবিষ্কৃত হয়েছে টপোলজিক্যাল ম্যাগনেটিক ম্যাটেরিয়েল। ২০১৪-১৫ সালে তিনি আবিষ্কার করেছেন সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়েল যার নাম দেয়া হয়েছে ম্যাগনেটিক ভেইল সেমিমেটাল। জার্মান তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী হারমান ভেইল (Weyl), যিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতেও কাজ করেছিলেন, এধরনের সেমিমেটাল পাওয়ার সম্ভাবনার তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। প্রফেসর জাহিদ হাসান সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করেছেন গবেষণাগারে এই সেমিমেটাল আবিষ্কারের মাধ্যমে। আমেরিকান প্যাটেন্ট অফিস থেকে এই সেমিমেটাল আবিষ্কারের প্যাটেন্ট (স্বত্ব) পেয়েছেন প্রফেসর জাহিদ হাসান।

এই কোয়ান্টাম টপোলজিক্যাল ম্যাটেরিয়েলগুলির আবিষ্কারের সূচনা হয়েছে ১৯৮০-৮৫ সালে কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু মূল হল-ইফেক্ট আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রায় শতাধিক বছর আগে। কোন একটি পরিবাহীর ভেতর দিয়ে যখন বিদ্যুৎ চালনা করা হয় – তখন বিদ্যুৎপ্রবাহের সাথে লম্বভাবে যদি ভোল্টেজ মাপা হয় – তাহলে ঐ পরিবাহীর মধ্যে ভোল্টেজের কোন পার্থক্য দেখা যায় না। কিন্তু যদি বিদ্যুৎপ্রবাহের সাথে লম্বভাবে কোন চৌম্বক-প্রবাহ প্রয়োগ করা হয়, তখন পরিবাহীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ইলেকট্রনগুলি চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে কিছুটা বিচ্যুত হয়ে যায়। ফলে পরিবাহীর ভেতর ভোল্টেজের পার্থক্য দেখা যায়। আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী এডউইন হল (Hall) এই ব্যাপারটি আবিষ্কার করেছিলেন। এরপর শুধু পরিবাহী নয়, অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রেও হল ইফেক্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৮০ সালে। ১৯৮৫ সালে জার্মান প্রফেসর ক্লাউস ফন ক্লিটজিং পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য।

কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় কোয়ান্টাম টপোলজির মাধ্যমে। এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম টপোলজি নিয়ে গবেষণা করছেন। আবিষ্কৃত হয়েছে টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর বা অপরিবাহী, টপোলজিক্যাল সুপারকন্ডাক্টর, টপোলজিক্যাল ম্যাগনেট এবং প্রফেসর জাহিদ হাসান আবিষ্কার করেছেন ভেইল সেমিমেটাল।

এই আবিষ্কারগুলি ধারাবাহিকভাবে নোবেল পুরষ্কার পেয়ে আসছে। ১৯৯৮ সালে ফ্র্যাকশানাল কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রবার্ট লাভলিন, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির হোর্স্ট স্টুর্মার, এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড্যানিয়েল সুই (Tsui)। এরপর ২০১৬ সালে টপোলজিক্যাল ফেইজ ট্রানজিশান এবং টপোলজিক্যাল ফেইজেজ অব ম্যাটারের তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডেভিড থাউলেস, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডানকান হ্যালডেন, এবং ব্রাউন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মাইকেল কস্টারলিৎজ। এরই ধারাবাহিকতায় প্রফেসর জাহিদ হাসানের নোবেল পুরষ্কার পাওয়া এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

টপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম ম্যাটেরিয়েল এবং সেমিমেটাল এপর্যন্ত যতগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবগুলিই কাজ করে শুধুমাত্র পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি পরিবেশে। এরকম পরিবেশ তৈরি করা প্রচুর খরচসাপেক্ষ এবং শুধুমাত্র উন্নত গবেষণাগারেই তা করা সম্ভব। তাই এদের বাস্তবিক প্রয়োগের সবচেয়ে বড় বাধা হলো তাপমাত্রা। কক্ষতাপমাত্রায় কাজ না করলে – এসব পদার্থকে কাজে লাগানো সহজ নয়।

পদার্থের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার ব্যাপারটা অত্যন্ত দরকারি। পদার্থের কঠিন, তরল এবং বায়বীয় এই তিন অবস্থার কথা আমরা জানি। কক্ষতাপমাত্রায় পদার্থের এই তিন অবস্থা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এর বাইরে পদার্থের আরো দুটো অবস্থা আছে – প্লাজমা ও কোয়ান্টাম কনডেনসেট – যেদুটো পদার্থের বিশেষ অবস্থা। অত্যন্ত উচ্চতাপমাত্রায় পদার্থের পরমাণুর গতি এত বেশি বেড়ে যায় যে ইলেকট্রনগুলি পরমাণু থেকে আলাদা হয়ে আয়নিত গ্যাসে পরিণত হয়। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের মোট পদার্থের প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ প্লাজমা অবস্থায় আছে। আমাদের সূর্যসহ সবগুলি নক্ষত্রে পদার্থগুলি প্লাজমা অবস্থায় টগবগ করে ফুটছে ভীষণ উত্তপ্ত অবস্থায়। অন্যদিকে পদার্থের কোয়ান্টাম ঘনীভবন বা কোয়ান্টাম কনডেনসেট পাওয়া যায় তাপমাত্রা কমতে কমতে পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে। সত্যেন বসু এবং আইনস্টাইনের গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে পদার্থের বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট।

সূক্ষ্মভাবে হিসেব করলে দেখা যায়, পদার্থের সবগুলি ধর্মই কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পদার্থের কঠিন, তরল ও বায়বীয় দশায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধর্মগুলি অদৃশ্য থেকে যায়। কিন্তু তাপমাত্রা যখন কমানো হয়, পরমাণুর গতি ক্রমশ কমতে শুরু করে, এবং কণাগুলির কম্পন আস্তে আস্তে থেমে যায়। এই অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। কিন্তু এরকম শীতল পরিবেশ তৈরি করে গবেষণা করা আর প্রযুক্তিগতভাবে কাজে লাগিয়ে সাধারণের ব্যবহার উপযোগী বস্তুতে রূপান্তর করা ভিন্ন বিষয়। তাই এক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করছেন সেইসব বিজ্ঞানীদের সবাই প্রাণপন চেষ্টা করছেন কক্ষতাপমাত্রায় যদি কোয়ান্টাম ইফেক্ট দেখার মতো কোন পদার্থ পাওয়া যেতো। এই অসাধ্য সাধন করেছেন প্রফেসর জাহিদ হাসান এবং তাঁর গবেষণাদল। তাঁরা বিসমাথ-ব্রোমাইড শংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে কোয়ান্টাম হল ইফেক্ট আবিষ্কার করেছেন কক্ষতাপমাত্রায়।

পদার্থের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার ভিত্তিতে আমরা পদার্থকে পরিবাহী, অপরিবাহী এবং অর্ধপরিবাহীতে ভাগ করি। তবে পদার্থের কোয়ান্টাম শক্তিস্তরের ভিত্তিতে এদেরকে আরো সূক্ষ্মভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। পরিবাহীর মধ্যে কন্ডাকশন এবং ভ্যালেন্স ব্যান্ডের মধ্যে কোন ফাঁক থাকে না। সেখানে ইলেকট্রনের প্রবাহে তাই কোন সমস্যা হয় না। অপরিবাহী পদার্থের ভেতর কন্ডাকশন ব্যান্ড ও ভ্যালেন্স ব্যান্ডের মধ্যে শক্তির পার্থক্য প্রায় ১০ ইলেকট্রন-ভোল্ট। অর্ধপরিবাহীর ভেতর শক্তিস্তরের পার্থক্য পদার্থভেদে ভিন্নভিন্ন হতে পারে। ইনসুলেটর বা অপরিবাহী পদার্থ বললেই আমরা যেমন ধরে নিই যে তার ভেতর দিয়ে কোন ইলেকট্রনই প্রবাহিত হবে না, কোয়ান্টাম টপোলজির গবেষণায় যে টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর ব্যবহৃত হয় – তার ক্ষেত্রে তা খাটে না। টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর কাজ করে ভিন্নভাবে। এই অপরিবাহীর ভেতরে কোন ইলেকট্রন-প্রবাহ থাকে না, কিন্তু এর প্রান্ত ঘেঁষে যেসব ইলেকট্রন থাকে তারা মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে, ফলে প্রান্তে ইলেকট্রন-প্রবাহ থাকে। আকারের পরিবর্তন হলেও এই ইলেকট্রন-প্রবাহে তার কোন প্রভাব পড়ে না।

টপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম দশার পরীক্ষায়  টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর ব্যবহার করেছেন প্রফেসর জাহিদ হাসানের দল। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল বিসমাথ-ব্রোমাইডের সংকর পদার্থে ভাইল কণার ধর্ম পরিলক্ষিত হয় কি না দেখা। কিন্তু তাঁরা এই সংকরে ভাইল কণার ধর্ম খুঁজে পাননি। তবে তাঁদের আগের গবেষণা বিসমাথ-অ্যান্টিমনির সংকরের টপোলজিক্যাল ইনসুলেটরে প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফলের সাথে তুলনা করে দেখলেন যে বিসমাথ-ব্রোমাইডের সংকরে কক্ষতাপমাত্রায় কোয়ান্টাম স্পিন হল ইফেক্ট পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব এবং তা তাঁরা করে দেখিয়েছেন। এই আবিষ্কারের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কোয়ান্টাম-স্পিন কাজে লাগিয়ে তৈরি হবে আরো শক্তিশালী ইলেকট্রনিক্স। ন্যানোটেকনোলজি এবং পুরো ম্যাটেরিয়েল ইন্ডাস্ট্রিই এগিয়ে যাবে কোয়ান্টাম মেটেরিয়েলের দিকে। দুর্বোধ্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে বিরাট উত্তরণ ঘটিয়ে সবার ব্যবহার উপযোগী কোয়ান্টাম পদার্থের নতুন জগত তৈরি করার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছেন আমাদের বাংলাদেশের সন্তান জাহিদ হাসান।

 

তথ্যসূত্র: www.nobelprize.org, Tom Garlinghouse, Princeton University; Nature Materials, October 2022; https://phy.princeton.edu/people/m-zahid-hasan                                        

_________________

বিজ্ঞানচিন্তা ডিসেম্বর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত।

বিজ্ঞানচিন্তা অনলাইনের লিংক










ফাল্গুনী অমনিবাস কিংবা কিছুই না

 



লেখক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়কে আমি এই সেদিনও লেখিকা মনে করতাম। এখন অবশ্য লেখক শিক্ষক পরিচালক এরকম সব পেশাগত পরিচয়ের আর লৈঙ্গিক বিভাজন হয় না। এখন তসলিমা রুদ্র দুজনই লেখক। লেখিকা, শিক্ষিকা, পরিচালিকা এরকম শব্দগুলির ব্যবহার এখন খুবই অনাধুনিক। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বই কখন পড়েছিলাম হুবহু দিন-তারিখ মনে নেই। তখন এমন একটা সময়, যখন পরীক্ষার জন্য ‘সময়ের মূল্য’ রচনা মুখস্থ করতে হতো, কিন্তু সময়ের আলাদা কোন মূল্যই সেই সময় ছিল না আমার কাছে। সুনীলের ‘সেই সময়’ তখনো প্রকাশিত হয়নি, পড়া তো আরো অনেক পরের ব্যাপার।

বাড়িতে একজন ইঁচড়ে পাকা খুড়তুতো বড়ভাই ছিলেন। তার অনেকগুলি শখের একটি ছিল বইপড়া। নানান জায়গা থেকে নানান রকমের বই জোগাড় করে আনতেন তিনি। তক্কে তক্কে থাকতাম কখন হাত ঘুরে আমার হাতে আসবে। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বই যেটা আমার হাতে এসেছিল – মধুমিলন টাইপের কিছু একটা নাম ছিল তার। তখন সবে গোঁফ গজাতে শুরু করেছে, শরীরে গোলমেলে নতুন হরমোনের প্রভাব প্রকট। মাথার ভেতর যখন তখন উঁকি মারে নানান নিষিদ্ধ কৌতুহল। নামের কারণেই বইটির প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। পড়ার পর মনে হয়েছিল বইটির নামকরণের স্বার্থকতা নেই।

পরে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের আরো অনেক বই পড়া হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। তাঁর কাহিনি থেকে তৈরি ভারতীয় সিনেমা ‘শাপমোচন’ও দেখেছিলাম। তখন চট্টগ্রাম শহরে অনেকগুলি বইয়ের দোকান ছিল, বইয়ের ক্রেতাও ছিল অনেক। ফুটপাতেও বই বিক্রি হতো অনেক। বেশিরভাগই পাইরেটেড বই। তখন অবশ্য পাইরেসি সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। তিন-চার টাকা দিয়ে ফালগুনী, আশুতোষ, নীহাররঞ্জন, নিমাই ভট্টাচার্যের বই কিনতে পেরেই আমি খুশি ছিলাম। ফুটপাত থেকে কিনেই পড়েছিলাম ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নিমান’। বইটি পড়ে তখন কেমন লেগেছিল এখন আর মনে নেই। মানব-মানবীর মানসিক জটিলতার পুরোটা বোঝার মতো বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা কোনটাই ছিল না তখন। তাই সেই সময়ের অনুভূতির বিস্মরণ ঘটেছিল।

এতদিন পরে এই ফাল্গুনের প্রাক্কালে আবার নতুন করে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় পড়তে হলো। বাংলাদেশে হাতেগোনা যে ক’টা বইয়ের দোকান এখনো টিকে আছে, দেখলাম সেখানে ‘ফাল্গুনী অমনিবাস’ নামে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের তিনটি বইয়ের একটি সংকলন বেশ প্রকটভাবেই শোভিত হচ্ছে। আমার এক বন্ধু সেই বইটি আমাকে পাঠানো কর্তব্য মনে করে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে পেয়েই পড়তে বসে যেতো যে পাঠক – সেই পাঠক এখন আর নেই। আমার বন্ধুটিও তা জানে বলেই বারবার জিজ্ঞেস করে বইটি পড়েছি কি না।

‘অনেক আগে পড়েছি’ – বিরক্তি চেপে বলি।

‘অনেক আগে পড়েছিস সেটা তো জানি। এখন পড়ে বল – আগের মতো লেগেছে কি না।‘ কন্ঠ থেকে বিরক্তির ভাব চাপা দেয়ার ভদ্রতা আমি দেখালেও সে দেখায় না।

না পড়েই পড়েছি বলে ফেলতে পারতাম। শুনেছি অনেকে নাকি ফ্ল্যাপের দশ লাইন পড়েই বইয়ের রিভিউ করে ফেলে। কিন্তু প্যাথোলজিক্যাল লায়ারও কারো কারো কাছে মিথ্যা বলে না। বইটি – মানে ফাল্গুনীর তিনটি উপন্যাস আবার পড়তে হলো। চিতা বহ্নিমান, চরণ দিলাম রাঙায়ে, এবং স্বাক্ষর। এই বইগুলি প্রথম পড়ার কী অনুভূতি ছিল তা এখন মনে নেই। কিন্ত এখনকার পাঠে আগের যদি কোন ভালো লাগা থেকেও থাকে তা উধাও হয়ে গেছে। ঘটনা, বর্ণনা, পরিণতি – কোনটাই যুতসই মনে হলো না। তার চেয়েও বেশি যেটা খচখচ করছে সেটা হলো ঘটনা তৈরির পেছনের দর্শন। যুক্তিহীন দর্শন মেনে নিতে হলে মানসিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।

চিরায়ত সাহিত্য আমরা তাদেরকেই বলি – যারা বহুবার পাঠেও পুরনো হয়ে যায় না, ভালো লাগা একটুও কমে না। ফাল্গুনীর এই বইগুলি সেরকম নয়। তবে অনেক দিন আগের পড়া বই আবার পড়তে গেলে – ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়, সেটাই লাভ। ফাল্গুনী অমনিবাস উসকে দিয়েছে কিছু পুরনো দিনের স্মৃতি। এখন মনে পড়লো ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের দুইটি বই আমার বুকশেলফ থেকে কে নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেয়নি।


Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts