Sunday 31 October 2021

নিউরনের জাল ও মহাবিশ্ব

 




মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত জটিল। কয়েক হাজার বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের তথ্য সংগ্রহ করছেন। শুরুতে খালি চোখে, পরে আধুনিক টেলিস্কোপের সাহায্যে। কোটি কোটি তথ্যবিন্দু বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের জটিল নিয়ম বুঝতে চেষ্টা করে চলেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।

মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে বিজ্ঞানের সূত্রে বেঁধে ফেলার অনেক চেষ্টা হয়েছে। মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক নিয়ম সম্পর্কে আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি কথা বলেছিলেন। ১৯৩০ সালে লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে আলবার্ট আইনস্টাইনকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘টলেমি একটি বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্ব তৈরি করেছিলেন যা চৌদ্দ শ বছর টিকেছিল; এরপর নিউটন একটি বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্ব তৈরি করেছিলেন, যা টিকেটিল তিন শ বছর। তারপর এলেন আইনস্টাইন। আমরা এখনো জানি না আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্ব কত বছর টিকে থাকবে।‘ 

আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব থেকে আমরা যে মহাবিশ্বের ধারণা পেয়েছি তা এখনো সঠিকভাবে টিকে আছে। অভিকর্ষ বলের স্থান-কালের নীতির সাথে যুক্ত হয়েছে মহাবিশ্বে ছড়ানো বিপুল পরিমাণ অদৃশ্য বস্তু বা ডার্ক ম্যাটার এবং অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। 

শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বের সমন্বয়ে মহাবিশ্বকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করার সর্বাধুনিক মডেল হলো ল্যামডা কোল্ড ডার্ক ম্যাটার মডেল বা ল্যামডা-সি-ডি-এম (lamda-CDM) মডেল। মহাবিশ্বের তিনটি প্রধান উপাদান হলো -  অদৃশ্য শক্তি (ডার্ক এনার্জি), অদৃশ্য পদার্থ (ডার্ক ম্যাটার), এবং সাধারণ পদার্থ ও শক্তি। এই তিন ধরনের উপাদানকে ল্যামডা-সি-ডি-এম মডেলে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই এই মডেলকে মহাবিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলা হয়। ল্যামডা হলো মহাজাগতিক ধ্রুবক (কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট) যা ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি সার্থক এবং সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এই মডেলের সাহায্যে। কিন্তু তারপরেও ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি যেহেতু সরাসরি শনাক্ত করা যাচ্ছে না এখনো, মহাবিশ্বের অনেক রহস্য এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরেও দেখা যাচ্ছে মহাবিশ্বের জটিল রহস্যের জট খুব সামান্যই খুলতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। 

কিন্তু মহাবিশ্বের কাজকর্মের চেয়েও জটিল একটি অঙ্গ নিয়ে আমাদের জীবন। সেটা হলো আমাদের মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্কে প্রায় দশ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) নিউরন আছে। এ ই দশ হাজার কোটি নিউরনের  প্রায় এক কোটি কোটি (১০০ ট্রিলিয়ন) জটিল স্নায়বিক সংযোগের মাধ্যমে চলে আমাদের মস্তিষ্কের সমস্ত কাজকর্ম। আমাদের মস্তিষ্ককে সুপার কম্পিউটারের সাথে তুলনা করা হয় তা আমরা জানি। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের মরফোলজি বা গঠনবিজ্ঞান আর মহাবিশ্বের গঠনবিজ্ঞানের মধ্যে যে আশ্চর্যজনক মিল আছে তার সুনির্দিষ্ট তুলনামূলক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে অতি সম্প্রতি।
 
ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কো ভাজ্জা (Franco Vazza) এবং ভেরোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব নিউরোসার্জারির স্নায়ুবিজ্ঞানী আলবার্তো ফেলেত্তি (Alberto Feletti) মহাবিশ্বের কসমিক নেটওয়ার্ক বা মহাজাগতিক জাল এবং মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক বা নিউরনের জালের গঠনবিজ্ঞানের মধ্যে চমকপ্রদ মিল খুঁজে পেয়েছেন। ২০২০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি ফ্রন্টিয়ার্স ইন ফিজিক্স জার্নালে তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। 

আমাদের মস্তিষ্ককে থ্রি পাউন্ড ইউনিভার্স বা দেড় কেজি ভরের মহাবিশ্ব বলা হয়ে থাকে। এই তুলনাটা যে কেবল বাহ্যিক সাদৃশ্যের কারণে তুলনা নয়, তা প্রমাণ করার জন্য প্রফেসর ভাজ্জা ও প্রফেসর ফেলেত্তি নিউরাল নেটওয়ার্ক ও কসমিক নেটওয়ার্কের বিস্তারিত গাণিতিক বিশ্লেষণ করেন।
 
পদার্থবিজ্ঞানের অনেক মৌলিক সূত্রের মধ্যে গঠনগত সাদৃশ্য আছে তা আমরা জানি। যেমন নিউটনের মহাকর্ষ বলের সূত্রের সাথে তড়িৎচৌম্বক বলের কুলম্বের সূত্রের মিল আছে। উভয় বলই দূরত্বের বর্গের বিপরীত অনুপাতিক। কিন্তু তাদের প্রকৃতি অনেকটাই ভিন্ন। যেমন মহাকর্ষ বল মহাবিশ্বের সব জায়গায় সব ধরনের পদার্থের উপর কাজ করে। কিন্তু তড়িৎচুম্বক বল কাজ করে শুধুমাত্র চার্জযুক্ত কণার মধ্যে। তেমনি মস্তিষ্কের নিউরনের নেটওয়ার্ক এবং মহাবিশ্বের কসমিক নেটওয়ার্কের কার্যপদ্ধতির মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও তাদের গাণিতিক গঠনবিজ্ঞানে আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য আছে। 

আমাদের মস্তিষ্কের মোট ভরের শতকরা ৮০ ভাগ হলো গ্রে-ম্যাটার। এই গ্রে-ম্যাটারে আছে প্রায় ছয় শ কোটি নিউরন এবং নয় শ কোটি অন্যান্য কোষ। মস্তিষ্কের সেরিবেলামে (cerebellum) আছে প্রায় সাত হাজার কোটি নিউরন এবং প্রায় ষোল শ কোটি অন্যান্য কোষ। মানুষের মস্তিষ্কের মোট নিউরনের সংখ্যা মহাবিশ্বের মোট গ্যালাক্সির সংখ্যার প্রায় সমান। নিউরনগুলি মস্তিষ্কে জোটবদ্ধ হয়ে পরস্পরের মধ্যে স্নায়বিক সংযোগের মাধ্যমে তৈরি করে জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক। একইভাবে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলির মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ এবং অন্যান্য জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় কসমিক নেটওয়ার্ক। যদিও কসমিক নেটওয়ার্ক  নিউরাল নেটওয়ার্কের তুলনায় বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন (১০^২৭) বা ১০ লক্ষ কোটি কোটি কোটি গুণ বড়, নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং কসমিক নেটওয়ার্কের মধ্যে আছে আশ্চর্যজনক দৃশ্যমান সাদৃশ্য। 

চিত্র-১। কসমিক নেটওয়ার্ক (বামে) এবং নিউরাল নেটওয়ার্ক (ডানে)


ছবি-১ এর বাম পাশে দেখা যাচ্ছে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তৈরি মহাবিশ্বের একটি বাস্তব নমুনা। এক শ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের ভেতর কসমিক নেটওয়ার্কের যতটুকু দেখা যায়, তা দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। ডান পাশের ছবিটি হলো মস্তিষ্কের সেরিবেলামের  চার মাইক্রোমিটার পুরু একটি স্লাইসের আণুবীক্ষণিক চিত্র। দৃশ্যত একই আকারের দুটো চিত্রের পাওয়ার স্পেকট্রাম  অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে এই দুটো নেটওয়ার্কের গঠনবিজ্ঞান প্রায় কাছাকাছি। কসমিক নেটওয়ার্কে পাওয়া গেছে ৩৮০০ থেকে ৪৭০০ নোড বা সংযোগস্থল। প্রতিটি সংযোগস্থলে গড়ে ৩.৮ থেকে ৪.১টি সংযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে নিউরাল নেটওয়ার্কে ১৮০০ থেকে ২০০০ নোড পাওয়া গেছে, প্রতিটি নোডে আছে গড়ে ৪.৬ থেকে ৫.৪ স্নায়বিক সংযোগ। 

মস্তিষ্কের উপাদানের শতকরা ৭৭-৭৮% পানি, ১০ -১২% লিপিড, ৮% প্রোটিন, ১% কার্বোহাইড্রেট, ২% অন্যান্য জৈবযৌগ, লবণ ১%। পানি স্নায়বিক সংযোগে কোন ভূমিকা রাখে না। দেখা যাচ্ছে মস্তিষ্কের মোট ভরের ৭৭ থেকে ৭৮ ভাগ কোন ধরনের স্নায়বিক সংযোগে অংশ নেয় না। এদিকে মহাবিশ্বের মোট শক্তির প্রায় ৭৫% অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। কসমিক নেটওয়ার্কে এই অদৃশ্য শক্তির সরাসরি কোন ভূমিকা আমরা এখনো দেখতে পাই না। দেখা যাচ্ছে নিউরাল ও কসমিক উভয় নেটওয়ার্কেই শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ উপাদানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নেই। 

কসমিক নেটওয়ার্কের উদ্ভব কীভাবে হয়েছে তা সঠিকভাবে খুঁজে বের করা খুব সহজ কাজ নয় বলেই বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না ঠিক কীভাবে কী হয়েছে। কারণ কম্পিউটারে মহাবিশ্বের একটি সার্থক মডেল তৈরি করতে এক থেকে দশ পিটাবাইট (১ পিটাবাইট = ১,০২৪ টেরাবাইট) ডাটা দরকার। আর এত বিপুল পরিমাণ ডাটা বিশ্লেষণ করার জন্য দরকার সুপার কম্পিউটার। আমাদের মস্তিষ্কের সাথে কি এর তুলনা চলে? আমাদের মস্তিষ্কের সবগুলি নিউরনকে কাজে লাগালে আমরা ২.৫ পিটাবাইট ডাটা আমাদের মাথার মধ্যে রাখতে পারবো। আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে যত বেশি খাটাবো, মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক তত বেশি শক্তিশালী হবে, তত বেশি জটিল সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারবো। পুরো মহাবিশ্বের নেটওয়ার্কে যত তথ্য আছে, তার সবগুলি তথ্য ধরে রাখার মতো ক্ষমতা আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনে আছে। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্য দরকার নিয়মিত মাথা খাটানো - মগজের চর্চা। যে যত বেশি চর্চা করবে, তার নিউরাল নেটওয়ার্ক হবে ততই কার্যকরী। 

তথ্যসূত্র: ফ্রাংকো ভাজ্জা ও আলবার্তো ফেলেত্তি, ফ্রন্টিয়ার্স ইন ফিজিক্স (২০২০); নটিলাস (২০১৯)
_________________

বিজ্ঞানচিন্তা ডিসেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত






Saturday 30 October 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৪৪

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৪

ট্রেন থেকে নামার পর সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগছে। প্লাটফরমে ঘাস গজিয়ে গেছে। কাদায় থিক থিক করছে পুরো প্লাটফরম। প্লাটফরমের ছাদের বেশিরভাগ টিনই ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গেছে। ট্রেন থামতে না থামতেই এক-ট্রেন চঞ্চল শিক্ষার্থী হুড়মুড় করে নেমে পড়েছে প্লাটফরমের কাদায়।

মাঝখানের খোলা সিঁড়ি দিয়ে উপরে রাস্তায় উঠে এলাম। সবকিছু কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে গেছে এদিকে। রাস্তার পাশের বড় বড় গাছগুলির যেকটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাদের বিধ্বস্ত চেহারা। ছোট ছোট দোকানপাট যেগুলি ছিল – সেগুলির কোনটাই এখনো খোলার মতো অবস্থায় নেই। দীর্ঘ পাঁচ মাস ইউনিভার্সিটি বন্ধ। তাতে তাদের ব্যবসার এমনিতেই বারোটা বেজে গিয়েছিল। তার উপর ঘূর্ণিঝড় একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে তাদের।

রেলগেইট রাস্তা বরাবর বন্ধ। পাশের ছোট গেট দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঢুকতে হলো।  বিবর্ণ খাকি ড্রেস পরা কয়েকজন প্রহরী গেটের কাছে ছোট্ট ঘরে বসে-দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সেই ঘরের পেছনে রেলস্টেশনের মূল ভবন – যা এখন পুলিশের দখলে। এখানে পুলিশফাঁড়ি বসানো হয়েছে সেই ১৯৮৬ সালে – শিবিরের উত্থানের পর পর। তারপর পাঁচ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ পুষছে। কিন্তু তাতে আমাদের কী লাভ হচ্ছে জানি না। গত ডিসেম্বরে ছাত্রশিবিরের গুন্ডারা আমাদের শিক্ষকদের ধরে পিটিয়েছে এখানে এই রাস্তায় - পুলিশ-ফাঁড়ি থেকে যার দূরত্ব পঞ্চাশ ফুটও হবে না। শিবিরের গুলিতে মরেছে আমাদের সতীর্থ ফারুকুজ্জামান। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে অনেকে – যাদের মধ্যে আমাদের বন্ধু শরীফও আছে। তখন ফাঁড়ির পুলিশ কী করছিলো কেউ জানে না।

স্টেশনের কাছের কটেজগুলির মেরামতকাজ চলছে। যারা হলে থাকার সুযোগ পায় না, তাদের অনেকেই এসব কটেজে থাকে। এই কটেজগুলি ব্যক্তি-মালিকানাধীন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের কীরকম চুক্তি থাকে জানি না। কটেজের নামগুলি বেশ অর্থবহ। শাহজালাল হলের সামনে আছে ‘হোয়াইট হাইজ’ আর ‘ক্রেমলিন’। শনের ছাউনি বেড়ার ঘর ‘ক্রেমলিন’ এখন ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে আছে।

হলের সামনের রেস্টুরেন্টগুলির কিছু কিছু খুলেছে। সোহরাওয়ার্দীর সামনের রাস্তায় বিশাল শিরিষগাছের মোটা ডাল ভেঙে পড়ে আছে রাস্তার উপর। কিছুটা কেটে সরানো হয়েছে। বাস চলছে তার পাশ দিয়ে। ক্যাম্পাসেও অনেক গাছ উপড়ে পড়ে আছে, যেগুলি দাঁড়িয়ে আছে সেগুলিও প্রায়-ন্যাড়া।

“কী রে দোস্ত, বেঁচে আছিস?” - চাকসু ক্যাফেটোরিয়ার সামনে বাস থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলো আহসান হাবীব দীপক। ঘূর্ণিঝড়ে ভোলা, হাত্যা, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী লন্ডভন্ড হয়ে যাবার খবরে সে উদ্বিগ্ন ছিল। যে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে – তাদের মধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও আছে। দুর্যোগ যাদের উপর দিয়ে যায় – শুধু তারাই জানে কতটা যায়।

দীর্ঘদিন পর ক্লাস শুরু হলে যা হয়। সবকিছুই কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে। লাস্ট ক্লাস হয়েছিল গতবছর ডিসেম্বরে মাত্র কয়েকদিন। এই পাঁচ মাসে ভুলেই গিয়েছি কী পড়ানো হয়েছিল। কী কারণে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে এতদিন লাগলো আমরা কেউ জানি না। স্যার-ম্যাডামরা এমন ভাব করছেন যেন কিছুই হয়নি। শিক্ষাবর্ষ থেকে এত এত দিন, মাস, বছর যে নিষ্ফলভাবে কেটে যায় – তাতে কি শিক্ষকদের কিছুই যায় আসে না? কিছুই করার থাকে না? বিশ্ববিদ্যালয় তো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। স্বায়ত্বশাসনের অর্থ কী?

“তোমাদের ক্লাস হলো কি হলো না, তোমরা কিছু শিখলে কি শিখলে না তাতে কারোরই কিছু যায় আসে না। বছরের পর বছর ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলেও শিক্ষকদের কোন অসুবিধা হয় না। আমরা আমাদের বেতন পাই। প্রতি বছর আমাদের বেতন বাড়তে থাকে। প্রমোশনও আটকে থাকে না।“ – এরকম তিক্ত স্বীকারোক্তি প্রামাণিকস্যার ছাড়া আর কেউই করেননি কখনও। আজও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ক্লাসের শুরুতে তিনি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করলেন – কেন এতদিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলো, কেন একটা রাজনৈতিক দলের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি হয়ে থাকবে, কেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-সমিতির কোন ক্ষমতা নেই? কেন নির্বাচিত চাকসু নেতারা পদ পাওয়ার পরপরই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলো?

এসব আমাদের অনেকেরই মনের কথা, জানা কথা। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে যারা সোজাসাপ্টা ন্যায্য কথা বলেন তাদের হাতে তেমন কোন ক্ষমতা থাকে না, আর যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে – তারা এসব সত্যবাদীদের পছন্দ করেন না।

প্রামাণিকস্যারের ক্লাসের পর সোবহানস্যারের ক্লাস। তিনি ইলেকট্রনিক্স পড়াচ্ছেন। মাস্টার্সে ইলেকট্রনিক্স কী কারণে আবশ্যিক বিষয় করা হয়েছে আমি জানি না। সাবজেক্টের নাম ইলেকট্রনিক্স ও নিউক্লিয়ার ইন্সট্রুমেন্টেশান হলেও তার সিলেবাসে নিউক্লিয়ার ইন্সট্রুমেন্ট কিছুই নেই। সাবজেক্ট ম্যাটেরিয়েলগুলি – যেমন মাইক্রোওয়েভ, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশান, টেলিভিশন, র‍্যাডার, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি খুবই ইন্টারেস্টিং হতে পারতো। কিন্তু টিচারের কারণেই সাবজেক্টের প্রতি আগ্রহ হারায় শিক্ষার্থীরা। এখানেও তাই হলো। বিষয়বস্তু শেখার চেয়েও পরীক্ষায় পাস করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো।

আমাদের ক্লাসরুমে এখন জায়গার সংকট দেখা দিয়েছে। এক বেঞ্চে পাঁচ-ছয়জন বসতে হচ্ছে। এতে আমাদের সহপাঠীদের কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে এমন কিছু মন্তব্য করছে যা সহ্য করা যায় না। ক্লাসের পর বারান্দায় বের হয়ে একজন বললো, “পিলু আর কলুদের জ্বালায় তো ক্লাসে বসা যাচ্ছে না।”

পিলু আর কলু শব্দ দুটো ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স ক্লাসে খুব প্রচলিত। দুটোই তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত আপত্তিকর শব্দ। প্রিলিমিনারি পাস করে যারা মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে তাদেরকে পিলু, আর যারা কলেজ থেকে অনার্স পাস করে এসেছে তাদেরকে বলা হয় কলু। যারা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়ে মাস্টার্সে এসেছে তারাই এই শব্দদুটো তৈরি করেছে। ভালো কিছুর উত্তরাধিকার আমরা ধরে রাখতে না পারলেও খারাপ সবকিছু সযতনে বাড়িয়ে চলি। আমার যে সহপাঠী এই শব্দদুটো ব্যবহার করে নিজেকে কিছুটা উন্নত প্রজাতির বলে মনে করছে তার কোন ধারণাই নেই যে কতটা অন্তসারশূন্য এসব তুলনা।

আমাদের সাথে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, আর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে যারা অনার্স পাস করেছে তারা সবাই মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে এখানে। শফিক, দিলারা, ঝিনুক, নাজমুল, খায়ের, অসীম, উৎপল, শাহেদা, বিউটি, বাসনা, অশোক, রাহুল – অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে আমাদের। মাস্টার্সে এতজন নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় প্রতিবছর, সেজন্য আরো বড় ক্লাসরুমের দরকার - এই ব্যাপারে জোর না দিয়ে – আমাদের অনেকের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যেন এরা এসেছে বলেই আমাদের বসার জায়গার অভাব হচ্ছে। আমাদের চিন্তাভাবনার সংকীর্ণতা থেকে আমরা বের হতে পারছি না কেন জানি না।

ভেবেছিলাম ইউনিভার্সিটি এবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। নির্বাচনের আগে স্বপ্ন দেখেছিলাম – নির্বাচনের পর নতুন সরকার এলে ছাত্রশিবিরের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত হবে। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। জামায়াত-শিবির এখন সরকারেরই অংশ। তবুও যদি কোনরকমে ভালোয় ভালোয় পাস করে বের হয়ে যেতে পারি। ইতোমধ্যেই অনার্সের তিন বছরের জায়গায় পাঁচ বছর চলে গেছে। মাস্টার্সের এক বছর চলে যাচ্ছে কোন কিছু ছাড়াই। এখন যেভাবে চলছে সেভাবে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চললেও হবে।

কিন্তু না, হলো না। পনের দিনের মধ্যেই ছাত্রশিবির আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলি গেটে তালা লাগিয়ে দিলো। জুনের ২ তারিখ থেকে লাগাতার অবরোধ। তাদের দাবিদাওয়া কী, কার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ কিছুই বোঝার উপায় নেই। হতে পারে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তাদের নেতার মার খাওয়ার শোধ আমাদের উপর নিচ্ছে। ক’দিন আগে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এক বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী। ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে নিজামীকে। ওসব কেবল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই সম্ভব।

আমাদের ক্যাম্পাসে, হলগুলিতে নির্বাচিত চাকসু প্রতিনিধি থাকলেও তারা একদিনও কোন কাজ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তেজস্ক্রিয় পদার্থ যেমন নিজের শক্তি বিকীর্ণ করতে করতে ভেঙে যায় – সেরকম আমাদের দেশের নেতারাও এত বেশি তেজস্ক্রিয় যে বেশিদিন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না। চাকসু নির্বাচনের আগে যে ছাত্রঐক্য হয়েছিল – সেই ঐক্য ভেঙে গেছে অনেকদিন আগে। চাকসুর নেতাদের কাউকে এখন দুরবিন দিয়েও দেখা যায় না ক্যাম্পাসে। ছাত্রশিবিরকে যদি এতই ভয় – তাহলে পদত্যাগ করলেই তো হয়। পদ-পদবি নিয়ে পদাবলি গাইবে, কিন্তু বিপদ দেখলে পালাবে – এই হলো আমাদের নির্বাচিত নেতা!

কেমন যেন হতাশ লাগছে সবকিছু। আমার বন্ধুদের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করতে শুরু করেছে। আমি কী করবো এখনো জানি না। অনার্স পাস করেছি, বিসিএস পরীক্ষা দেয়া যায়। কিন্তু প্রশাসনিক কাজের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। শিক্ষকতা কিংবা কারিগরি যেসব পদ আছে – সেগুলিতে মাস্টার্স লাগবে। যীশুরা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখছে। আমাদের বন্ধু দেবাশিস, মহিউদ্দিন এরা কম্পিউটার শেখানোর স্কুল খুলে ফেলেছে আগ্রাবাদে। অনেকেই অনেক কিছু করে ফেলছে – আর আমি আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছি।

মাঝে মাঝে শিল্পকলা একাডেমিতে যাই। নাটকের গ্রুপেও অনিয়মিত হয়ে গিয়েছি। এখন সেখানে গেলে নিজেকে কেমন যেন অতিথি অতিথি মনে হয়। মাঝে মাঝে পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই। পাশে মুসলিম হলে মহিউদ্দিন চৌধুরির নেতৃত্বে বন্যার্তদের সাহাযার্থে ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। ওখানে গিয়ে কিছুটা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আসি।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধানে কারোরই কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ডিসেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যস্ত ছিল নির্বাচন নিয়ে। তারপর নতুন সরকার ব্যস্ত থাকলো সরকার গঠন নিয়ে। এখন ব্যস্ত সরকার-পদ্ধতি ঠিক করা নিয়ে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যেতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই সংসদের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়ে গেছে। এখন তোড়জোড় চলছে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা নিয়ে। রাষ্ট্রের এত বড় বড় সমস্যার সমাধান হচ্ছে যেখানে – সেখানে আমাদের ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলো কি বন্ধ থাকলো তাতে কারো কিছু যায় আসে না। প্রামাণিকস্যার ঠিকই বলেন – আমরা শিক্ষিত হলে সরকারের কোন লাভ নেই।

চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা একটা বিকল্প সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে। তেমন কোনও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নয়, প্রতিবাদী সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ জুন থেকে এমইএস কলেজে শুরু হলো ইউনিভার্সিটির ক্লাস।

এমইএস কলেজ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি এতদিন। এই কলেজ নাকি ছাত্রলীগের দুর্জয় ঘাঁটি। দুর্জয় শব্দের মধ্যে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব আছে। এই কলেজ সম্পর্কে যা শুনেছি তার সবগুলিই যুদ্ধং দেহি মারপিটের কাহিনি।

প্রচন্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকালবেলা কলেজে এলাম। শহরে যারা থাকে তাদের অনেকেই এসেছে। যারা এসেছে সবাই জামায়াত-শিবিরবিরোধী তা বলা যাচ্ছে না। ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজনের দেখা পেলাম – যারা আমার জানামতে শিবিরের নিরব সমর্থক। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করতে হয়। তারা এসেছে ইনফরমার হিসেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমার অভিজ্ঞতায় এপর্যন্ত ছাত্রলীগ আর ছাত্রশিবিরের প্রধান পার্থক্য হলো – ছাত্রলীগ প্রচুর গর্জন করে, বর্ষণ করে অতি সামান্য; কিন্তু ছাত্রশিবির বিনাগর্জনেই কাজ সেরে ফেলে।

আমাদের ক্লাসের অনেকেই এসেছে। হল থেকেও এসেছে কেউ কেউ। জামায়াত-শিবির-বিএনপি সমর্থন করেন না এমন অনেক শিক্ষক আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে – যাঁরা শহরে থাকেন। তাঁদের অনেকেই এলেন এমইএস কলেজে ক্লাস নিতে। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে পাবলিক বাসে চড়ে এখানে ক্লাস নিতে চলে এসেছেন প্রামাণিকস্যার। এই মানুষটার কি ভয়-ডর কিছুই নেই?

প্রামাণিকস্যার আমাদের ক্লাস নিলেন। সম্পূর্ণ-সিলেবাসবহির্ভূত ক্লাস, মুক্তচিন্তার ক্লাস। মুক্তচিন্তা ধর্মচিন্তার পরিপন্থি। ক্লাসে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। ফারুক ডাক্তার মরিস বুকাইলির বই থেকে ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে যা যা যুক্তি শিখেছে সব প্রয়োগ করে প্রামাণিকস্যারকে ঘায়েল করার চেষ্টা করলো, কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারলো না। আমি প্রামাণিকস্যারের ধৈর্য দেখে অবাক হয়ে গেলাম। পান্ডিত্য যে মানুষকে বিনীত করে, পরমতসহিষ্ণু করে তা প্রামাণিকস্যারকে এভাবে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।

প্রামাণিকস্যার দ্বিতীয় দিন থেকে সিলেবাসের কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়িয়েছেন। অনেককিছুই পড়িয়েছেন। যাক কিছুটা লাভ তো হলো। এমইএস কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বন্ধ রেখে আমাদের জন্য এতগুলি রুম ছেড়ে দেয়া তো দীর্ঘদিন সম্ভব নয়। তাই পরপর চার দিন প্রতিবাদী ক্লাসের পর ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল।

কোরবানের পর জুলাই মাসের শুরুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসার ব্যাপারে বিএনপি সম্মত হলো।  কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবিরের অবরোধমুক্ত করার ব্যাপারে কিছুই করা হলো না। ১৫ জুলাই চট্টগ্রামে হরতাল পালন করা হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবিরের হাত থেকে রক্ষা করার দাবিতে। এরশাদের পদত্যাগের পর এই প্রথম হরতাল হলো দেশে। তাতে কাজ হলো। ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় নির্দেশে তাদের অবরোধ তুলে নিলো। কিন্তু ক’দিন পরেই যে আবার সবকিছু বন্ধ করে দেবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই।

আমাদের ক্লাসের শুরুতেই ক্লাসের ভেতর গন্ডগোল লেগে গেল। শিবিরের প্ররোচনায় ক্লাসের কেউ কেউ দাবি করছে - এমইএস কলেজে প্রামাণিকস্যার কোয়ান্টাম মেকানিক্স যা পড়িয়েছেন তা অবৈধ। আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম - কোয়ান্টাম মেকানিক্স কীভাবে অবৈধ হয়?

একজন খুব ঠান্ডাভাবে উত্তর দিলো, 'কীভাবে হয় সময়মতো বুঝবা।'

মনে হলো সে আমাকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলো।


পরের পর্ব >>>>>>>>>

<<<<<<< আগের পর্ব 

Thursday 28 October 2021

জগদীশচন্দ্র বসু - প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী

 



উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইওরোপ আমেরিকার উন্নত গবেষণাগারে যখন ব্যাপক গবেষণা-যজ্ঞ চলছিল,  সেই সময় ভারতের বিজ্ঞান-মরুতে গবেষণার ফল ফলানোর জন্য একাই লড়ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। আমরা আজ যে বিজ্ঞান-গবেষণার পথে খুব আস্তে আস্তে হলেও হাঁটতে শুরু করেছি, সেই পথ অর্ধ-শত বছরের কঠিন পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। ১৯০৯ সালের শেষের দিকে ইতালির গুগ্লিয়েল্‌মো মার্কনি আর জার্মানির কার্ল ফার্ডিন্যান্ড ব্রোনকে যখন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো - সারাবিশ্ব জানলো যে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ বাঙালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বেতার তরঙ্গ নিয়ে মৌলিক গবেষণা শুরু করেন মার্কনিরও অনেক আগে এবং ১৮৯৫ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম কৃত্রিম মাইক্রোওয়েভ উৎপাদনে সাফল্য লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের পাশাপাশি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত করেন জগদীশচন্দ্র। উদ্ভিদও যে উদ্দীপনায় সাড়া দেয় - এ তথ্য জগদীশচন্দ্র বসুর আগে কেউ উপলব্ধি করেননি, প্রমাণ করতে পারেননি। বহুমুখী বিজ্ঞানের সাধক জগদীশচন্দ্র বিশ্ববিজ্ঞানীর আসরে যথোপযুক্ত আসন অর্জন করেছিলেন অনেক সাধনা, সংগ্রাম ও পরিশ্রমের বিনিময়ে। ১৯২৭ সালে লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস জগদীশচন্দ্রকে গ্যালিলিও  এবং নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী হিসেবে উল্লেখ করেছে। আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে “জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য প্রদান করেছেন, তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।

জগদীশচন্দ্র বসুর পৈত্রিক বাড়ি ছিল পুরাতন ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরে। তাঁর বাবা ভগবানচন্দ্র ছিলেন বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামের সম্ভ্রান্ত বসু পরিবারের সন্তান। তিনটি কন্যার পর ভগবানচন্দ্র ও বামাসুন্দরী দেবীর চতুর্থ সন্তান জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ শহরে ইংরেজ সরকার তখন প্রথম ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেছে। ভগবানচন্দ্র ছিলেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। জগদীশচন্দ্রের জন্মের কয়েক বছর পর ডেপুটি মেজিস্ট্রেট হয়ে ফরিদপুরে চলে আসেন ভগবানচন্দ্র। ফরিদপুরেই কাটে জগদীশচন্দ্রের শৈশব এবং কিছুটা কৈশোর।

পাঁচ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের। ফরিদপুরে তখন দুটো স্কুল - একটি ইংরেজি মাধ্যম এবং অন্যটি বাংলা মাধ্যম। জগদীশচন্দ্রকে ভর্তি করানো হলো  বাংলা স্কুলে। ১৮৬৯ সালে ভগবানচন্দ্র সহকারী কমিশনার হয়ে বর্ধমানে বদলী হয়ে যান। এদিকে জগদীশচন্দ্রের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি করানো হলো জগদীশচন্দ্রকে। কিন্তু প্রথম দিনই স্কুলে সহপাঠীরা তাকে ‘গাঁইয়াবলে ক্ষেপাতে লাগলো। সহপাঠীদের সাথে মারপিট করতে হলো তাকে। তিন মাসের মাথায় হেয়ার স্কুল ছেড়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হতে হলো জগদীশচন্দ্রকে। ১৮৭৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হলো জগদীশ বসুর। ১৮৭৭ সালে জগদীশচন্দ্র এফ-এ পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। এরপর ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে সাধারণ মানের বি-এ। ইতোমধ্যে তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বাবাকে ঋণমুক্ত করার উপায় খুঁজতে শুরু করলেন জগদীশচন্দ্র। ঠিক করলেন ইংল্যান্ডে গিয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবেন। চাকরি পেলে আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর বাবা চান না যে তাঁর ছেলে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করুক। আই-সি-এস অফিসার হবার চেয়ে অনেক ভাল ডাক্তারি পড়া। বাবা ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চাইলেও বাধ সাধলেন মা। ‘কালাপানিপার হয়ে ছেলে বিলেত যাবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বামাসুন্দরী দেবী। কিন্তু জগদীশচন্দ্র যাবেনই। বাবার আর্থিক অবস্থা ফেরানোর জন্য, ঋণ শোধ করার জন্য তাঁকে বিলেতে যেতেই হবে। মা-কে বোঝালেন। শেষপর্যন্ত বামাসুন্দরী দেবী শুধু যে রাজী হলেন তা নয়, নিজের গয়না বিক্রি করে ছেলের বিদেশ যাবার টাকা জোগাড় করার ব্যবস্থা করলেন।

১৮৮০ সালে জগদীশচন্দ্র ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অন্তর্ভুক্ত একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু একদিন অ্যানাটমির ক্লাসে মাথাঘুরে পড়ে গেলেন। শব ব্যবচ্ছেদের পরিবেশ সহ্যই হলো না তাঁর। শরীরও খারাপ। এ অবস্থায় শারীরবিদ্যার অধ্যাপক তাঁকে পরামর্শ দিলেন - চিকিৎসাবিজ্ঞান বাদ দিয়ে অন্য কোন বিষয়ে পড়াশোনা করার। একটা বছর নষ্ট হলো জগদীশচন্দ্রের। পরের বছর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। কেমব্রিজে তিন বছর পড়াশোনার পর ১৮৮৪ সালে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বোটানির সমন্বয়ে ন্যাচারাল সায়েন্সে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন জগদীশচন্দ্র। কেমব্রিজের রেজাল্টের ভিত্তিতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি ডিগ্রি লাভ করলেন জগদীশচন্দ্র। সেই সময় এরকম ব্যবস্থা ছিল। লেখাপড়া সম্পন্ন করার উপযুক্ত প্রমাণপত্র দাখিল করলে তা ডিগ্রির জন্য গৃহীত হতো।

লন্ডনে থাকার সময় পোস্টমাস্টার জেনারেল ফসেটের সাথে সৌহার্দ্য হয় জগদীশচন্দ্রের। ফসেট তখনকার ভাইসরয় লর্ড রিপনের কাছে একটা চিঠি লিখে জগদীশচন্দ্রের হাতে দিলেন। দেশে ফিরে এসে লর্ড রিপনের সাথে দেখা করলেন জগদীশচন্দ্র। ফসেট চিঠিতে লর্ড রিপনকে অনুরোধ করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের জন্য একটা অধ্যাপনার চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। লর্ড রিপন জগদীশচন্দ্রকে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরি দিতে সম্মত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে পাঠালেন শিক্ষাবিভাগের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফ্‌টের কাছে। এতে বিরক্ত হলেন স্যার ক্রফ্‌ট। ভারতীয়দের প্রতি তাঁর মনোভাব খুব একটা সম্মানজনক ছিল না। কিন্তু লর্ড রিপনের সুপারিশ তাঁর কাছে আদেশের সমতুল্য। স্যার ক্রফ্‌ট জগদীশচন্দ্রকে বললেন - “ইম্পেরিয়াল এডুকেশান সার্ভিসে কোন চাকরি খালি নেই, ইচ্ছে করলে প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে পারেন। প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসের বেতন ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ। জগদীশচন্দ্র জানতেন যে ইম্পেরিয়াল সার্ভিসে কোন ভারতীয়কে নিয়োগ দেয়া হয় না। ভারতীয়দের জন্য শুধুমাত্র প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসই বরাদ্ধ। স্যার ক্রফ্‌ট যে ইচ্ছে করেই তাঁকে অপমান করছেন তা বুঝতে পেরে জগদীশচন্দ্র প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে এলেন। কিছুদিন পরে লর্ড রিপন গেজেটে জগদীশচন্দ্রের নাম দেখতে না পেয়ে খবর নিয়ে সব জানলেন। তখন স্যার ক্রফ্‌ট বাধ্য হয়ে ১৮৮৫ সালে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের অধীনে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে জগদীশচন্দ্র বসুকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেন। কিন্তু প্রথম মাসের বেতন নিতে গিয়ে দেখলেন অস্থায়ী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবার কারণে তিনি বেতন পাচ্ছেন সমমানের পদের জন্য ব্রিটিশরা যত পাচ্ছেন তার এক তৃতীয়াংশ। এই বৈষম্য মেনে নেয়া সম্ভব হলো না জগদীশচন্দ্রের পক্ষে। তিনি বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। পর পর তিন বছর তিনি বিনা বেতনে কাজ করে গেলেন। সংসারে ঋণের বোঝা ক্রমশ ভারী হচ্ছিলো। কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপোষ করার কথা তিনি ভাবতেও পারেননি। ১৮৮৮ সালে তাঁকে স্থায়ী পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং আগের তিন বছরের পুরো বেতন এক সাথে দেয়া হয়। পরিবারের আর্থিক সমস্যা মিটে গেলো।

১৮৯৪ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর ছত্রিশতম জন্মদিনে বিজ্ঞানের সেবায় আত্মনিবেদন করার ঘোষণা দিলেন জগদীশচন্দ্র। এর আগপর্যন্ত তাঁর গবেষণা ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত, কোন গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়নি। ১৮৯৫ সাল থেকে শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের নিরলস গবেষণা।

জগদীশ বসুর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। বিদ্যুৎচৌম্বক তরঙ্গ সম্পর্কিত পদার্থবিদ্যা, জড় ও জীবের সাড়ার ঐক্য, এবং উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কিত গবেষণায় পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ। ১৮৯৫ সালে উইলহেল্‌ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের পর পদার্থবিজ্ঞানে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পথ খুলে যায়। পরমাণু-বিজ্ঞান, বেতারে বার্তা পরিবহন, তেজষ্ক্রিয়তা, অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত যুগান্তকারী আবিষ্কার এসময় বৈজ্ঞানিক মহলে বিরাট প্রভাব ফেলে। এসময় জগদীশ বসু অদৃশ্য বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মাধ্যমে সংকেত বার্তা প্রেরণের গবেষণায় বেশ সাফল্য লাভ করেন। হেন্‌রিখ হার্ট্‌জ, ও গুগ্লিয়েল্‌মো মার্কনির সমসাময়িক জগদীশ বসুই হলেন বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি ১৮৯৫ সালে সর্বপ্রথম সাফল্যের সাথে মাইক্রোওয়েভ উৎপাদন করেন এবং তার ধর্মাবলীও নির্ধারণ করেন। রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের রিমোট সেন্সিং সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেন জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে। এর ক’দিন পরে জগদীশ বসু কলকাতার টাউন হলে ৭৫ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তুপে আগুন জ্বালাতে সমর্থ হন নিজের উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশানের সাহায্যে।

            ১৮৯৫ সালে জগদীশচন্দ্রের চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এর জার্নাল, রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস, এবং  ইংল্যান্ডের ‘The Electrician’ জার্নালে। ১৮৯৬ সালে জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক সফরে যান ইউরোপে। সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ তরঙ্গ পরিমাপক যন্ত্রটি। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতায় দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্যার জে জে থমসন, অলিভার লজ, লর্ড কেলভিন প্রমুখ পদার্থবিজ্ঞানী। প্রথম বক্তৃতাতেই জগদীশচন্দ্র পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেন। জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতার সাফল্যে পরাধীন ভারতের বাদামী বর্ণের মানুষের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে ইংরেজদের তাচ্ছিল্যবোধ ও অবজ্ঞার ভাব কিছুটা হলেও বদলে গেলো। লন্ডন ইউনিভার্সিটি জগদীশ বসুকে ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান করলো। ১৮৯৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন জগদীশচন্দ্র।

প্রথম ইউরোপ সফর শেষে কলেজে ফিরে এসে একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করা তো দূরে থাক - পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের কাজের জন্য একটা ল্যাবরেটরি দাঁড় করিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু অনুদানের জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখার পর যে উত্তর পেলেন তা এরকম: “ডক্টর বসু এখন মাসে পাঁচশ টাকা মাইনে পান। কোন নেটিভ সরকারি চাকুরের মাসে পাঁচশ টাকায় পোষাচ্ছে না বলাটা নেহায়েৎ বোকামি।পদে পদে অপমানের উদাহরণ আরো অনেক আছে।

কিন্তু কিছুতেই দমে গেলেন না জগদীশচন্দ্র। ইউরোপ সফরের সাফল্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিদ্যুৎ তরঙ্গ নিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে গবেষণা শুরু করলেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় লন্ডনের রয়েল সোসাইটি থেকে। ১৮৯৯ সালে গবেষণায় তিনি জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণস্পন্দনের অনুরূপ সাড়া প্রত্যক্ষ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন প্রাণীদের মত জড়বস্তুও বাইরের উত্তেজনায় সংবেদনশীল। জড় ও জীবের এই গোপন ঐক্য সম্পর্কে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের কাছে প্রকাশের একটা সুযোগ এসে পড়লো। ১৯০০ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জগদীশ বসু দ্বিতীয় বারের মত ইউরোপে গেলেন। বাংলা ও ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্যারিসে পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জড়বস্তুর সংবেদনশীলতা বিষয়ে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করেন।

১৯০১ সালের মে মাসে রয়েল ইনস্টিটিউটের শুক্রবারের সান্ধ্য অধিবেশনে জগদীশচন্দ্র “The response of inorganic matter to mechanical and electrical stimulus” শীর্ষক প্রবন্ধে যান্ত্রিক ও তড়িৎ উদ্দীপনার প্রতি উদ্ভিদ ও প্রাণীর ‘সাড়া সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষণের বর্ণনা দেন। এর আগেই সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং দেশীয় উপাদানে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে জগদীশ বসু একটা বৈদ্যুতিক সংবেনশীল যন্ত্রের মডেল তৈরি করেছিলেন। গ্যালেনা বা লেড সালফাইড ব্যবহার করে যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘গ্যালেনা ডিটেক্টর। জগদীশচন্দ্র তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলে দেখালেন যে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনায় বস্তুর সাড়া দেওয়া ক্ষীণ হয়ে যায় - যাকে বস্তুর ‘অবসাদ বলা যায়। এ অবস্থায় আলো বা বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ প্রয়োগ করলে বস্তু পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে, কিন্তু পরিবাহিতাসহ আরো কিছু বৈশিষ্টের মান কিছুক্ষণ উঠানামা করে। তিনি প্রস্তাব করলেন যে কোন অত্যুজ্জ্বল বস্তু থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলে কিছুক্ষণ যাবৎ যে উজ্জ্বল বস্তুটি একবার দেখা যায় আবার অদৃশ্য হয়ে যায় বলে মনে হয় - তার কারণ চোখের রেটিনার পরিবাহিতা ধর্মের স্পন্দন। জগদীশবসুর আগে এরকম করে কেউ চিন্তা করেননি।

১৯০১ সালে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। প্রবন্ধগুলোতে আলোক ও অদৃশ্য বেতার তরঙ্গের সদৃশ ধর্ম নিয়ে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল আলোচিত হয়েছে। ১৯০২ সালে লিনিয়ান সোসাইটিতে বক্তৃতা দেন জগদীশচন্দ্র। ‘সাড়া মাপার যন্ত্র ‘রেসপন্স রেকর্ডার  তৈরি করার পদ্ধতি বর্ণনা করলেন জগদীশ। যন্ত্রটা অনেকটা কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মত। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সংবেদনশীলতা মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এই যন্ত্র। ১৯০২ সালের মে মাসে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান সংক্রান্ত শেষ গবেষণাপত্র “On electromotive wave accompanying mechanical disturbance in metals in contact with electrolyte”। তারপর  তাঁর গবেষণা পুরোপুরি উদ্ভিদ ও প্রাণির শারীরবৃত্তীয় ধর্মাবলী পরীক্ষার দিকে মোড় নেয়। জগদীশ বসুকে আমরা পেলাম পৃথিবীর প্রথম বায়োফিজিসিস্ট হিসেবে। তিনি উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কে গবেষণা করেছেন পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়ে। এই পদ্ধতির বিস্তৃত প্রয়োগে উদ্ভিদের প্রাণচক্র ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা জগদীশ বসুকে চিনলাম উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে।

১৯০২ সালে প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের প্রথম বই “Response in the living and non-living”। ১৯০৩ সালে জগদীশচন্দ্র বসু সি-আই-ই (Companionship of the Indian Empire) উপাধি লাভ করলেন। ১৯০৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় বই “Plan response: as a means of physiological investigations” প্রকাশিত হয় লংম্যান গ্রিন কোম্পানি থেকে। পরের বছর প্রকাশিত হলো তাঁর তৃতীয় গ্রন্থঃ “Comparative Electro-Physiology: A Physico-Physiological Study”।

১৯১১ সালে দিল্লীর দরবারে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে জগদীশচন্দ্রকে সি-এস-আই (Companionship of the star of India) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-এস-সি ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আরো দুবছর বাড়ানো হয় তাঁর চাকরির মেয়াদ। সে বছর প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ গ্রন্থঃ “Researches on irritability of plants”। ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন তিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ইমেরিটাস প্রফেসর পদে নিয়োগ করেন। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘নাইট উপাধি দেয় জগদীশচন্দ্রকে। তাঁর নামের আগে যোগ হলো ‘স্যার’।

১৯১৭ সালের তিরিশে নভেম্বর স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর ৫৯তম জন্মদিনে প্রতিষ্ঠিত হলো বসু বিজ্ঞান মন্দির। উদ্বোধনী বক্তৃতার শুরুতেই স্যার  জগদীশচন্দ্র ঘোষণা করলেন “আমার স্ত্রী ও আমি এই গবেষণাগারের জন্য সর্বস্ব দান করছি। জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু নিঃসন্তান ছিলেন।  আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের সবকিছু তাঁরা দান করেছিলেন বাঙলার বিজ্ঞান প্রসারের জন্য।

১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে জগদীশচন্দ্র তাঁর “Life movements in Plants” নামে বৃহৎ বইটি চার খন্ডে প্রকাশ করেন। ১৯১৯-২০ সালে পঞ্চম বৈজ্ঞানিক সফরে আবার ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। ১৯২০ সালের শুরুতে স্যার জগদীশচন্দ্রকে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কমিটির কয়েকজন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের ফলাফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ফলে একটি কমিটি গঠন করা হয় যাঁরা জগদীশচন্দ্রের যন্ত্র পরীক্ষা করে দেখলেন।

গাছের বৃদ্ধির হার শামুকের গতির চেয়েও দুহাজার গুণ কম। একটি সাধারণ গাছ এক সেকেন্ডে এক ইঞ্চির এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ বাড়ে। অর্থাৎ এক লক্ষ সেকেন্ড বা প্রায় আটাশ ঘন্টায় এক ইঞ্চি বাড়ে। এই অতিধীর চলনের গতি লিপিবদ্ধ করার জন্য খুবই সংবেদী যন্ত্রের দরকার যা আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ‘ম্যাগনেটিক ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে গাছের বৃদ্ধিকে দশ লক্ষ গুণ বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে গাছের বৃদ্ধির সূক্ষ্ম তারতম্য হিসেব করা সহজ হয়। ১৯২০ সালের ৪ঠা মে রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা জগদীশচন্দ্রের ক্রেস্কোগ্রাফ পরীক্ষা করে দেখলেন যে জগদীশচন্দ্র তাঁর যন্ত্রের ব্যাপারে কিছুই বাড়িয়ে বলেন নি। এর কয়েকদিন পর ১৩ই মে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য জগদীশচন্দ্রের নাম চূড়ান্ত করা হলো। ১৯২০ সালের ২০শে মে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফেলোশিপ দেয়া হলো স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে।

১৯২২ সাল থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। সেগুলো যথাক্রমে: The ascent of Sap (১৯২২), Physiology of photosynthesis (১৯২৪), Nervous mechanism of plants (১৯২৬), Plan autographs and their revelation (১৯২৭), Motor mechanism of plants (১৯২৭), Collected physical papers (১৯২৭), Wrowth and troic movements of plants (১৯২৯)।

১৯২৬ সালে ব্রাসেল্‌স-এ জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন বেলজিয়ামের রাজা। তিনি জগদীশচন্দ্রকে ‘কমান্ডার অব দি অর্ডার অব লিওপোল্ড উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯২৭ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন জগদীশচন্দ্র। ১৯২৮ সালের ৩০শে নভেম্বর সত্তর বছর পূর্ণ হয় জগদীশচন্দ্রের। সে উপলক্ষে ১লা ডিসেম্বর বসু বিজ্ঞান মন্দিরে সম্বর্ধনা দেয়া হয় জগদীশচন্দ্রকে। বাংলার বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। ভিয়েনার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন তিনি এ বছর। ১৯২৯ সালে ফিনল্যান্ডের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাঁকে সদস্যপদ দেয়। ১৯৩০ সালে জার্মান অ্যাকাডেমি ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ তাঁকে মেম্বারশিপ প্রদান করে। ১৯৩৩ সালে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে জগদীশচন্দ্রকে।

১৯৩৭ সালে্র শেষের দিকে  উচ্চরক্তচাপে ভুগছিলেন এবং শরীর ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল জগদীশচন্দ্রের। ২৩শে  নভেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান উপমহাদেশের বিজ্ঞান গবেষণার জনক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু।

তথ্যসূত্র

১। এম এন সাহা, বায়োগ্রাফিক্যাল মেমোরিজ অব ফেলোজ অব দি রয়েল সোসাইটি (১৯৪০),

২। ডি পি সেনগুপ্ত, জগদীশচন্দ্র বোস- দি ম্যান এন্ড হিজ টাইম (২০০৯)। 

৩। প্রদীপ দেব, জগদীশচন্দ্র বসু, মীরা প্রকাশন (২০১৫)।

______________________

বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত





Sunday 24 October 2021

ব্ল্যাকহোলের নোবেল বিজয়

 




নক্ষত্রের আলোকে আলোকিত আমাদের মহাবিশ্ব। আমরা জানি আলোর গতি সর্বত্র। কত লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে সুদূর অতীতের আলো এসে ঝিকমিক করে আমাদের রাতের আকাশে। কিন্তু আমরা এটাও এখন জানি যে এই মহাবিশ্বের মহাকাশে এমন কিছু জায়গা আছে যেখান থেকে আলোও ফিরে আসতে পারে না। গভীর নিকষ অন্ধকার সেখানে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং যাকে তুলনা করেছেন ইতালিয় কবি দান্তে আলিগিয়েরির ডিভাইন কমেডিতে বর্ণিত দোজখের সাথে – যেখানে প্রবেশ করার সময় সমস্ত আশা চিরতরে পরিত্যাগ করতে হয়। সেখানে মাধ্যাকর্ষণের টান এতটাই তীব্র যে সেই টানে আয়তন এত কমে যায় যে সেটা স্থান-কাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখান থেকে আলো, কিংবা তড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ কিংবা কোন কিছুই আর বের হয়ে আসতে পারে না। এই অদৃশ্য বস্তু মূলত মৃত নক্ষত্র। আগে এর নাম ছিলো ডার্ক স্টার। ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞানী জন হুইলার তাদের নাম দিয়েছেন ব্ল্যাক হোল। জন হুইলারের ছাত্র ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান, কিপ থর্ন প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী কিপ থর্ন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১৭ সালে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য। তাদের শনাক্তকরা মহাকর্ষ তরঙ্গের ঢেউ এসেছিল শত কোটি বছর আগে ঘটে যাওয়া দুটো ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ থেকে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের সাহায্যে  গ্যালাক্সি M87 এর কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাকহোলের ছায়া থেকে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের ছবি তৈরি করতে সমর্থ হন। পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক উৎসাহের জন্ম দিয়েছিল সেই ব্ল্যাকহোলের ছবি। তারই হাত ধরে ২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের মূল বিষয় – ব্ল্যাকহোল। 


M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাকহোলের ছবি


 ২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার যৌথভাবে পেয়েছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির  প্রফেসর রজার পেনরোজ, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট অব এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্স, ও  ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির অধ্যাপক রাইনহার্ড গেনজেল, এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসের অধ্যাপক এনড্রিয়া গেজ। 

 ব্ল্যাকহোলের আধুনিক গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের মূল উৎস আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। যদিও আইনস্টাইন নিজে ব্ল্যাকহোলের ফ্যান ছিলেন না, কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর দশ বছর পর ১৯৬৫ সালে ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সবচেয়ে ক্ল্যাসিক গাণিতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী রজার পেনরোজ। ১৯৩১ সালের ৮ আগস্ট ইংল্যান্ডের কোলচেস্টারে জন্ম রজার পেনরোজের। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত মনোচিকিৎসক লিওনেল পেনরোজ। ১৯৫৮ সালে তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির সেন্ট  জন’স কলেজ থেকে গণিতে পিএইচডি করেন। মূল গণিত থেকে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণিতে আকৃষ্ট হন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেনিস স্কিয়ামার উৎসাহে। ডেনিস স্কিয়ামা ছিলেন স্টিফেন হকিং-এর পিএইচডি সুপারভাইজার। রজার পেনরোজের সাথে যৌথভাবে অনেক গবেষণা করেছেন স্টিফেন হকিং। ব্ল্যাকহোলের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজের অসংখ্য গবেষণা রয়েছে। পেনরোজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব নিয়ে এসেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্ল্যাকহোলকে শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত করেছেন এবং জনপ্রিয়তা দিয়েছেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। এবছরের পুরষ্কারের অন্যতম একজন হতেন স্টিফেন হকিং। কিন্তু তিনি ব্ল্যাকহোলের ছবি পাওয়ার আগেই তিনি মারা যান ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ। রজার পেনরোজসহ অনেকেই ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত গবেষণায় স্টিফেন হকিং-এর অবদানের কথা স্মরণ করছেন। নোবেল কমিটিও এই কথা বলেছেন। নোবেল পুরষ্কারের প্রধান শর্ত হলো – বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ থাকতে হবে, এবং পুরষ্কার ঘোষণার সময় বিজ্ঞানীকে বেঁচে থাকতে হবে। সেই কারণেই ১৯৬৫ সালে উদ্ভাবিত তত্ত্বের জন্য রজার পেনরোজ নোবেল পুরষ্কার পেলেন আবিষ্কারের ৫৫ বছর পর। 

বিস্ময়কর রহস্যে ভরা আমাদের মহাবিশ্ব। সেই প্রাচীন কাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে কাজ করে চলেছেন। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিজ্ঞান হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান। মানুষের হাতে যখন কোন যন্ত্রপাতি ছিল না, ছিল না কোন পূর্ব-ধারণা, তখন থেকেই শুধুমাত্র কৌতূহল আর নিরন্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষ আবিষ্কার করেছে মহাবিশ্বের অনেক রহস্য। গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ, সৌরজগতের গ্রহ ও উপগ্রহগুলির অনেক বৈশিষ্ট্য মানুষের জানা হয়ে গেছে দূরবীণ আবিষ্কারের আগেই। দূরবীণ আবিষ্কারের পর মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের গতি বেড়ে যায় বহুগুণ। কাছের নক্ষত্র পেরিয়ে মানুষের দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয় গ্যালাক্সি থেকে গ্যালাক্সিতে। শত কোটি বছর আগের নক্ষত্র থেকে উৎসারিত আলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে মহাবিশ্বের উৎপত্তির নাক্ষত্রিক ইতিহাস। সপ্তদশ শতাব্দীতে নিউটনের হাত ধরে আমরা জানলাম মহাবিশ্বের সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে মহাকর্ষ বল। উনবিংশ শতাব্দীতে পেলাম তড়িৎচৌম্বক বল। এবং বিংশ শতাব্দীতে পেলাম সবল নিউক্লিয়ার বল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। এই চার ধরনের মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বল হলো সবচেয়ে দুর্বল। বাকি তিনটি বলই মহাকর্ষ বলের চেয়ে কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি (১০^৩৮) গুণ শক্তিশালী হলেও শুধুমাত্র মহাকর্ষ বলই সব জায়গায় সমস্ত ধরনের পদার্থের উপর কাজ করে। নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র থেকে আমরা দেখি দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বস্তু দুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের বিপরীতানুপাতিক। অর্থাৎ বস্তুর ভর বাড়লে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বাড়বে, দূরত্ব বাড়লে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ কমে যাবে। এই সহজ গাণিতিক হিসেব থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশিত হবার আগপর্যন্ত ধারণা ছিল যে যদি বস্তুর ভর শূন্য হয়, তাহলে তার উপর মহাকর্ষ বল কাজ করবে না। আলোর ভর নেই, এবং তার উপর মহাকর্ষ বল কাজ করে না – এরকম ধারণা ছিল। কিন্তু আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের সেই ধারণা বদলে দিয়েছেন তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন ভরের যে ধারণা আমাদের এতদিন ধরে ছিল – সেই ধারণা ভুল। মহাবিশ্বের সবকিছুর উপরই কাজ করে মহাকর্ষ বল। এই বলের প্রভাবেই স্পেস-টাইম বা স্থান-কালের পরিবর্তন হয়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব এত শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ধারণা আমূল বদলে দেয়। শুরু হয় মহাবিশ্বকে নিউটনীয় মেকানিক্সের বদলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগে দেখার যুগ। বিংশ শতাব্দী থেকে – আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যায় – আইনস্টাইনের যুগ থেকে মহাজাগতিক পদার্থগুলির গতিপ্রকৃতির সূক্ষ্ম হিসেবে আপেক্ষিকতার প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এতটাই যুগান্তকারী যে আইনস্টাইন নিজেও ভাবতে পারেননি যে তাঁর তত্ত্ব থেকে পাওয়া যেতে পারে মহাবিশ্বের গভীর গোপন রহস্য – ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির তত্ত্ব। 

ব্ল্যাকহোল কী? বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম ব্ল্যাকহোলকে বলেছেন – কৃষ্ণ বিবর। অনেকে কৃষ্ণ গহ্বরও বলে থাকেন। কিন্তু বিবর বা গহ্বর বললে যেরকম গর্তের ধারণা আমরা পাই – ব্ল্যাকহোল কিন্ত সেরকম কোন গর্ত নয়। কিন্তু বোঝার সুবিধার্থে আমরা ব্ল্যাকহোলকে একটা অসীম গভীরতার গর্ত ধরে নিতে পারি যেখানে মাধ্যাকর্ষণ বলের টান এত বেশি যে সেখান থেকে কোন কিছুই আর বের হয়ে আসতে পারে না, এমনকি আলোও নয়। কেন এমন হয়? মহাবিশ্বের কোথায় আছে কিংবা সৃষ্টি হয় এই ব্ল্যাকহোল? চৌদ্দ শ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের উদ্ভবের পর থেকেই নানারকম মহাজাগতিক ঘটনা ঘটে চলেছে মহাবিশ্বে। মানুষ সেগুলি ভালোভাবে জানতে শুরু করেছে মাত্র কয়েক শ বছর আগে থেকে। নিউটনের মহাকর্ষ বলের সূত্র থেকে হিসেব করা গেছে বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের ভর, তাদের মুক্তিবেগ। পৃথিবীর মুক্তিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ১১.২৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে কোন বস্তু যদি এই বেগে ছুড়ে দেয়া হয়, তাহলে সেটা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে চলে যাবে, আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। ১৭৮৩ সালে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন মিশেল এবং  ১৭৯৬ থেকে ১৭৯৯ সালের মধ্যে ফরাসি গণিতবিদ পিয়েরে-সাইমন ল্যাপলাস নিউটনের সূত্র কাজে লাগিয়ে বড় আকারের নক্ষত্রের মুক্তিবেগ হিসেব করে দেখালেন যে যদি নক্ষত্রের মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আলোও সেই নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করে যেতে পারবে না। তার মানে সেই নক্ষত্রটিকে কখনোই দেখা যাবে না। তাঁরা সেধরনের কল্পিত নক্ষত্রের নাম দিয়েছিলেন ডার্ক স্টার বা কৃষ্ণ নক্ষত্র বা কালো তারা। 

জন মিশেল যে নক্ষত্রটিকে কল্পনা করেছিলেন সেই নক্ষত্রটির ব্যাসার্ধ ছিল আমাদের সূর্যের ব্যাসার্ধের ৫০০ গুণ। আর ল্যাপলাসের নক্ষত্রটি ছিল আমাদের সূর্যের ২৫০ গুণ, আর ঘনত্ব ছিল পৃথিবীর সমান, অর্থাৎ আমাদের সূর্যের চার গুণ। তাঁদের হিসেব থেকে একটি নতুন ধারণা পাওয়া গিয়েছিল – তা হলো কৃষ্ণ নক্ষত্রের ধারণা। এখন প্রশ্ন হলো কোন্‌ নক্ষত্র কৃষ্ণ নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে তার হিসেব করার কোন উপায় কি আছে? প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই নক্ষত্র থেকে কোন কিছুই বের হতে পারবে না। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এবং গতি-শক্তির সূত্র কাজে লাগিয়ে সহজেই একটা বৈশিষ্ট্য বের করা গেল। দেখা গেল নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ যদি একটা নির্দিষ্ট পরিমাপের চেয়ে কম হয় তাহলে সেখান থেকে কোন কিছু বের হতে পারবে না। এই ব্যাসার্ধ হলো 2GM/c^2, যেখানে G হলো মহাকর্ষ ধ্রুবক, M হচ্ছে নক্ষত্রের ভর, আর c হচ্ছে আলোর বেগ।  (টেক্সট বক্স – ১)




১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে আইনস্টাইন পর পর তিনটি পেপারে তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি গ্রাভিটেশনাল ফিল্ড বা অভিকর্ষজ ক্ষেত্রতত্ত্বের সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে স্থান-কাল জ্যামিতিকভাবে সমতল। কিন্তু সার্বিক তত্ত্বে স্থান-কাল অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে বেঁকে যায়। এদিকে ইওরোপে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মান বিজ্ঞানীদের অনেকেই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্তশিল্ড তখন আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু যুদ্ধাবস্থাতেও বাংকারে বসে সময় পেলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছেন। আইনস্টাইনের পেপারগুলি তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি সেখানে বসেই আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশান বা ক্ষেত্রসমীকরণের একটি সমাধান বের করে ফেললেন। স্ফেরিক্যালি সিমেট্রিক ঘূর্ণায়মান নয় – এমন কোন বস্তুর চারপাশের স্থান-কালের বক্রতার মেট্রিক্‌স সমীকরণ তিনি প্রকাশ করলেন আইনস্টাইনের পেপার প্রকাশিত হবার দু’মাসের মধ্যেই – ১৯১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি। এর দুমাস পরেই যুদ্ধাবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান সোয়ার্তশিল্ড। তাঁর সমীকরণ থেকে পাওয়া যায় ব্ল্যাকহোলের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধ বা ইভেন্ট হরাইজন। (বক্স -২)





সোয়ার্তশিল্ড সমীকরণ থেকেও ব্ল্যাকহোলের যে ব্যাসার্ধ পাওয়া যায় তা ১৭৮৩ সালের জন মিশেলের দেয়া সমীকরণের সাথে মিলে যায়। এই ব্যাসার্ধের কম হলেই তা হয়ে পড়ে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। যাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা-দিগন্ত। এই সূত্র থেকে আমরা যে কোন গ্রহ-নক্ষত্রের জন্য ঘটনা-দিগন্তের দূরত্ব হিসেব করতে পারি। যেমন আমাদের সূর্যের ভর যদি হয় 2 x 10^30  কিলোগ্রাম, তাহলে তার সোয়ার্তশিল্ড ব্যাসার্ধ হবে 2.95 কিলোমিটার। অর্থাৎ আমাদের সূর্য যদি নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে সংকুচিত হতে হতে তার বর্তমান ব্যাসার্ধ প্রায় সাত লক্ষ কিলোমিটার থেকে কমে মাত্র তিন কিলোমিটারে চলে আসে তাহলে এই সূর্য ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। আমাদের পৃথিবীর ক্ষেত্রেও এই  হিসেব করা যায়। পৃথিবীর ভর 6 x 10^24 কিলোগ্রাম। পৃথিবীর বর্তমান ব্যাসার্ধ ৬,৩০০ কিলোমিটার থেকে সংকুচিত হতে হতে যদি মাত্র এক সেন্টিমিটারে চলে আসে তাহলে আমাদের পৃথিবী ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এই বিরাট ভরকে যদি মাত্র এত ছোট আকারের ভেতর রেখে দেয়া হয় তাহলে তার ঘনত্ব হবে সাংঘাতিকভাবে বেশি। পৃথিবী ও আমাদের সূর্যের ব্ল্যাকহোল হবার যে শর্ত হিসেব করলাম, বাস্তবে তা হওয়া অসম্ভব। সব নক্ষত্রের শেষ পরিণতি কিন্তু ব্ল্যাকহোল নয়। 

পেনরোজ এবং স্টিফেন হকিং ব্ল্যাকহোলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। হকিং দেখিয়েছেন বিশেষ অবস্থায় ব্ল্যাকহোল থেকে বিকিরণ নির্গত হতে পারে – যাকে আমরা হকিং রেডিয়েশান হিসেবে জানি। আর পেনরোজ তাঁর গাণিতিক মডেলে ব্ল্যাকহোলের  ইভেন্ট হরাইজন ব্যাখ্যা করেছেন কার্যকরভাবে। নক্ষত্র নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে চুপসে যায়। তারপর সেটা ঘটনা-দিগন্তে প্রবেশ করে ব্ল্যাকহোলে বিলীন হয়ে যায়।  সেখান থেকে কিছুই আর ফিরে আসতে পারে না। চুপসে যাওয়া নক্ষত্রের আয়তন কমতে কমতে এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে আয়তন হয়ে পড়ে শূন্য, ঘনত্ব হয়ে পড়ে অসীম। সেক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের কোন নীতিই আর কাজ করে না। এই বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। 

বিজ্ঞানীরা মহাকাশে ব্ল্যাকহোলের সন্ধান করতে শুরু করেছেন অনেক বছর আগে থেকে। জন মিশেল সেই ১৭৮৩ সালে ধারণা দিয়েছিলেন যে  কালো তারা বা কৃষ্ণ নক্ষত্র থেকে কোন আলো বের হবে না। আমরা তাদের দেখতে পাবো না। কিন্তু অন্যান্য নক্ষত্র সেই কালো নক্ষত্রের অভিকর্ষন বলের টানে তার চারপাশে ঘুরতে থাকবে। প্রায় দুই শতাধিক বছর পর আমাদের গ্যালাক্সিতে এরকম একটি ব্যাপার আবিষ্কার করেছেন আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এনড্রিয়া গেজ এবং জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাইনহার্ড গেনজেল। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ থেকে এটাই ধারণা করা হচ্ছে যে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে একটি ব্ল্যাকহোল। এই আবিষ্কারের জন্য ২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এনড্রিয়া গেজ এবং রাইনহার্ড গেনজেল। 

রাইনহার্ড গেনজেলের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ মার্চ জার্মানিতে। তাঁর বাবা লুডভিগ গেনজেল ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। রাইনহার্ড রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমিতে পিএইচডি করেন ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট অব রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি থেকে ১৯৭৮ সালে। তারপর তিনি কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলিতে। সেখানে তিনি প্রফেসর। একই সাথে তিনি জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্সের ডিরেক্টর। কর্মজীবনের শুরু থেকেই তিনি মহাকাশ গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর দল চিলির ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির টেলিস্কোপের মাধ্যমে গত তিরিশ বছর ধরে চোখ রেখেছেন আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে। 

এদিকে ১৯৯০ এর শুরুতে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপ্পুঞ্জের কেক পর্বতের উপর তৈরি হয়েছে অবজারভেটরি। সেখানে স্থাপিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যাসের টেলিস্কোপ। সেখান থেকে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে চোখ রাখলেন ২৫ বছর বয়সী মার্কিন তরুণী এনড্রিয়া মিয়া গেজ। তারপর ত্রিশ বছর ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণের পর আবিষ্কার করতে পেরেছেন মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে প্রচন্ড ঘনত্বের সুপার-ম্যাসিভ পদার্থ যার ব্ল্যাকহোল হবার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত। এই আবিষ্কারের জন্য এবছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এনড্রিয়া গেজ। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে এপর্যন্ত তিনিই চতুর্থ নারী। ২১৬ জন নোবেল বিজয়ীর মধ্যে মাত্র চার জন নারী – মেরি কুরি (১৯০৩), মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার (১৯৬৩), ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড (২০১৮) এবং এবছর এনড্রিয়া গেজ। 

এনড্রিয়া গেজের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৬ জুন নিউইয়র্ক সিটিতে। ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের দিকে তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। বড় হয়েছেন শিকাগোতে। শিকাগো ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এম আই টি থেকে ফিজিক্সে স্নাতক এবং ক্যালটেক থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৯২ সালে। তারপর গবেষণা ও অধ্যাপনা করেছেন আরিজোনা ইউনিভার্সিটিতে, কেমব্রিজে এবং ১৯৯৪ থেকে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসে। পদার্থবিজ্ঞানে মেয়েদের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম। তার মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরো কম। এমন একটি ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে এনড্রিয়াকে হতে হয়েছে অনেক বেশি শক্ত প্রকৃতির মানুষ। কৈশোরে স্বপ্ন ছিল চাঁদে যাওয়ার। প্রথম নারী হিসেবে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর মাকে। চাঁদে যাওয়ার কোন মিশন ছিল না সেই সময়। তাই ওই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু তিনি হয়েছেন বিশ্বের প্রথম নোবেলবিজয়ী নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী। মেয়েদেরকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে উৎসাহ দেয়ার জন্য ১৯৯৫ সালে তিনি একটি বইও লিখেছেন – ইউ ক্যান বি আ ওম্যান অ্যাস্ট্রোনমার। 

আমাদের  মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে আছে অনেকগুলি নক্ষত্র আর প্রচুর উত্তপ্ত গ্যাস। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের পরিমাপ হিসেব করার জন্য এই নক্ষত্রপুঞ্জ ও গ্যাসের চলাচলের দিকে অনবরত দৃষ্টি রেখেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। চিলির অবজারভেটরি থেকে রাইনগার্ড গেনজেলের দল, আর হাওয়াইর কেক অবজারভেটরি থেকে এনড্রিয়া গেজের দল স্বতন্ত্রভাবে নজর রাখছিলেন আর ডাটা সংগ্রহ করছিলেন মিল্কি-ওয়ে থেকে। প্রচন্ড মহাজাগতিক ধুলির ভেতর দিয়ে পৃথিবী থেকে কিছু দেখা প্রায় অসম্ভব। প্রতি একশ কোটি আলোর কণা থেকে মাত্র একটি আলোর কণা ফোটন এসে পৌঁছাতে পারে টেলিস্কোপের দৃষ্টিপথে। দুই দলই আলোর অবলোহিত তরঙ্গে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাতে খুব সামান্য বেশি ফোটন ধরা পড়েছে লেন্সে। কিন্তু অনেক বেশি সময় লাগে ডাটা সংগ্রহ করতে। তাছাড়া পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের পরিবেশ বদলে যায় অনেক দ্রুত। তাতে সমস্যা হয় আরো বেশি। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্য তাঁদের নতুন বৈজ্ঞানিক কৌশল আবিষ্কার করতে হয়েছে। অনেক বেশি মাত্রার সংবেদী ডিজিটাল লাইট সেন্সর ব্যবহার করে তাঁরা কিছুটা ভালো ইমেজ পেলেন। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের প্রায় তিরিশটি উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের দিকে নজর রেখেছেন তাঁরা। তিরিশ বছর ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করে এবং সংগৃহীত ডাটা থেকে  উভয় দলই প্রমাণ পেয়েছেন যে সেখানে একটি নক্ষত্র S-02 গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরে আসছে মাত্র ষোল বছরে। নক্ষত্রের ক্ষেত্রে এটা খুবই কম সময়। আমাদের সূর্যের প্রায় বিশ কোটি বছর লাগে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে। ভিন্ন ভিন্ন দুটি জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ করে দুটি স্বতন্ত্র দল একই ফলাফল পেলো। তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে আমাদের গ্যলাক্সির কেন্দ্রে একটা ব্ল্যাক হোল আছে যার প্রচন্ড টানে S-02 নক্ষত্র এত প্রচন্ড বেগে ঘুরছে। হিসেব করে দেখা গেছে এই ব্ল্যাকহোলের ভর আমাদের সূর্যের ভরের চল্লিশ লক্ষ গুণ। আর এই চল্লিশ লক্ষ সূর্যকে টেনে আনা হয়েছে আমাদের সৌরজগতের যতটুকু জায়গা ততটুকুতে। এর নাম দেয়া হয়েছে স্যাজিটেরিয়াস এ স্টার ( Sgr A*)। যদিও এটাকে এখনো পুরোপুরিভাবে ব্ল্যাক হোল বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি, কিন্তু বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে অচিরেই গ্যালাক্সি M87 এর কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোলের মতোই আমাদের Sgr A* ব্ল্যাকহোলেরও ছবি পাওয়া যাবে। 


তথ্যসূত্র:
1. www.nobelprize.org
2. রজার পেনরোজ - সায়েন্টিফিক আমেরিকান, মে ১৯৭২
3. রজার পেনরোজ - জার্নাল অব ফিজিক্স (০১২০০১, ২০০৯)
4. স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ - দ্য নেচার অব স্পেস এন্ড টাইম  (১৯৯৬)
5. জামাল নজরুল ইসলাম – কৃষ্ণ বিবর (২০১৮)

_________________
বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত









স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৪৩

 



#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৩

দুপুরের পরেই কারেন্ট চলে গেছে। রুমের ভেতর কেমন যেন গুমোট ভ্যাপসা গরম। দরজা-জানালা খুলে দেবার পরেও একফোঁটা বাতাস ঢুকছে না রুমে। বাইরে গাছপালাগুলি কেমন যেন স্থির হয়ে আছে। বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ছে তাদের গা থেকে, পাতাভর্তি মাথা থেকে। কিন্তু কেমন যেন নিষ্প্রাণ।

রেডিওতে অনবরত ঘোষণা দিচ্ছে – চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী জায়গায় দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। তা আজ রাতে উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানতে পারে।

আমাদের বিল্ডিং এখন অনেকটা সুনশান। ২৪ এপ্রিল ইউনিভার্সিটি খোলার কথা ছিল। কিন্তু সেটা পিছিয়ে গেছে দশ দিনের জন্য। তাই মেসের অনেকেই এখনো আসেনি। হল খুলে দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু খোলেনি। এখলাস হলে উঠতে না পেরে এখন এখানে আছে। মুকিতভাই বাড়ি গেছেন অনেকদিন। অজিত আছে – তার রুমে। ভীষণ পড়ছে। ইউনিভার্সিটি খুললেই তাদের মাস্টার্স পরীক্ষার ডেট দিয়ে দেবে।

বিল্ডিং-এর সামনে করাত-কলে কোলাহল চলছে। কারেন্ট না থাকাতে করাত চলছে না। শ্রমিকরা কাঠের উপর গোল হয়ে বসে তাস খেলছে। দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কথা না শোনার কথা নয়। স্থানীয় প্রশাসন বিকেল থেকে রিকশা করে মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক করছে ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে। কিন্তু জনগণ এসব সতর্কসংকেতকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে এলাম। আকাশের রঙ কেমন যেন অদ্ভুত ফ্যাকাসে হয়ে যেতে শুরু করেছে। বৈশাখের মাঝামাঝি, কালবৈশাখীর সিজন। কিন্তু কালবৈশাখীর আগে আকাশের মুখ যেমন গোমড়া হতে হতে থমথমে কালো হয়ে যায়, এখনকার আকাশের সাথে তার কোন মিল নেই। এখনকার আকাশ কেমন যেন রহস্যময়ী রঙে রাঙা।

পশ্চিমদিকের বড় আমগাছে থোকা থোকা আম ঝুলছে। এবার প্রচুর আম হয়েছে এই গাছটিতে। ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই আমের নাগাল পাওয়া যায়। ছোটবেলায় কাঁচা-আম খাওয়ার জন্য গাছে উঠে যেতাম। এখন হাতের নাগালে এত আম – অথচ খাওয়ার ইচ্ছেটা হারিয়ে গেছে।

ছাদেও বাতাস নেই। সকাল থেকে গুটি গুটি বৃষ্টি হচ্ছিলো। দুপুরে বৃষ্টির ফোঁটার আকার সামান্য বড় হয়ে একটু জোরে ঝরেই আবার হালকা হয়ে গেছে। এই বাদলা হাওয়াকে বিকেল পর্যন্ত খুব একটা পাত্তা দিইনি। দুপুরে ছাতা নিয়ে দেড় কিলোমিটার হেঁটে চৌধুরিহাটে গিয়েছিলাম ভাত খেতে। হোটেলের নাম শ্মশানেশ্বরী। শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ায় বলে দেবী কালীর আরেক নাম শ্মশানেশ্বরী। আয়তনে এত ছোট হোটেল আর কোথাও আছে কি না জানি না। ছোট্ট একটা টুলে চেপেচুপে খুব বেশি হলে এক সাথে তিন জন বসতে পারে। প্রধান সড়কের উপর এরকম শনের ছাউনি, বেড়ার ঘর এখনো কীভাবে টিকে আছে সেটাই আশ্চর্যের। দুপুরে যখন খেতে গিয়েছিলাম তখন সাত নম্বর সিগনাল চলছিলো। সাত নম্বরেও খুব একটা বিচলিত হননি হোটেলের মালিক কাম কুক কাম ওয়েটার। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি উপরের দিকে হাত তুলে বলেছেন, “ঈশ্বর যা করবেন, মঙ্গলের জন্য করবেন।“ কিন্তু সমস্যা হলো  মানুষ এরকম বিশ্বাসে স্থির থাকতে পারে না। বিশেষ করে তাদের নিজেদের ইচ্ছার সাথে তাদের ঈশ্বরের ইচ্ছার গরমিল হলে।

মাগরিবের আজানের সাথে সাথেই ঝপ করে সন্ধ্যা নামলো। ছাদের পুবদিকে সুপারিগাছের সারি। তাদের মাঝখানে একটা নারকেল গাছের মাথা ছাদ ছুয়েছে। সেখানে কাকের বাসা। সম্ভবত ডিম পেড়েছে বা বাচ্চা হয়েছে। ওদিকে গেলেই কাক কর্কশস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে এসে মাথায় ঠোক্কর দিতে চায়। ছোটবেলায় পড়েছিলাম কাক কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ে। তাই যদি হবে – তাহলে কাকের বাসায় কী? তাদের বাসার কাছে যেতে চাইলে তেড়ে আসে কেন? অনেকে বলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে পশুপাখিরা অনেককিছু আগে থেকেই টের পায়। এই পাখিরা কি পায়? কাক কি জানে যে এখন দশ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত চলছে! ঘূর্ণিঝড় এলে গাছের কী হবে, তাদের বাসার কী হবে?

অন্ধকারে ছাদে একা একা হাঁটতে ভালো লাগছে। গতকাল পূর্ণিমা ছিল। আকাশে এখন মেঘের পাতলা একটি আবরণ। তারা দেখা যাচ্ছে না। চাঁদও না। প্রকৃতি স্থির হয়ে আছে। সজলকে পড়াতে যাবার কথা ছিল, কিন্তু ইচ্ছে করছে না।

ছড়ারকুলের দোকানগুলিতে হারিকেনের আলো জ্বলছে। আজ রাতে আর কারেন্ট আসবে না। আশা করছি কাল সকালের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। হারিকেন আমাকেও জ্বালাতে হবে। রুমে এসে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে হারিকেন জ্বালালাম। কেরোসিন কমে গেছে। দোকানে যাওয়া দরকার।

দোতলায় উঠে দেখলাম – সব দরজাই বন্ধ। সবাই কি বাড়ি চলে গেল না কি? অজিতের রুমেও তালা – সম্ভবত টিউশনিতে গেছে। দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের সময়ও পড়াতে হবে? এখলাসকেও পেলাম না। দোকান থেকে কেরোসিন আর পাউরুটি কিনে নিয়ে এলাম। দোকানের প্রাত্যহিক ভীড়ে কারো মধ্যেই দশ নম্বর সিগনালের ব্যাপারে কোন উদ্বেগ দেখলাম না। সমুদ্র থেকে অনেক দূরে বলেই হয়তো।

কিন্তু আমাদের বাড়ি তো ধরতে গেলে সমুদ্র থেকে মাত্র পাঁচ-কিলোমিটারের মধ্যে। জলোচ্ছ্বাস হলে কি পাঁচ-কিলোমিটার প্লাবিত হবে? মানুষ যে কী পরিমাণ স্বার্থপর তা বিপদে না পড়লে বোঝা যায় না। সমুদ্রের আশেপাশে যাদের বাস তাদের জন্য আমার চিন্তা হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে আমার বাড়ির মানুষগুলির জন্য।

রাত দশটার দিকে বাতাসের বেগ বাড়তে শুরু করলো। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি চাঁদের আলোয় থৈ থৈ করছে চারপাশ। কিন্তু এতক্ষণ স্থির হয়ে থাকা গাছপালাগুলি আস্তে আস্তে গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে, বাতাসের সাথে প্রচন্ড-বেগে দুলতে শুরু করেছে। বাতাস আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। আমার রুমটা বিল্ডিং-এর উত্তর-পূর্ব কোণায় হওয়াতে বাতাস সরাসরি এসে লাগছে না আমার দরজা কিংবা জানালায়। কিন্তু বাতাসের বেগে সব দরজা-জানালা ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে।

একবার মনে হলো – এই ঝড়ের রাতে আমার তো করার কিছু নেই। ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখবো সব ঠিক হয়ে গেছে। অজিতও এই কথাই বলে গেছে ঘন্টা-দুয়েক আগে টিউশনি থেকে ফিরে। কিন্তু বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই যদি ঘুমানো যেতো – তাহলে তো আর কথা ছিল না।

প্রকৃতির কাছে মানুষ যে কত অসহায় তা বোঝা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। প্রকৃতির রহস্যসন্ধানই বিজ্ঞানের কাজ। হাজার বছর ধরে ক্রমাগত গবেষণার ফলে প্রকৃতির কিছু কিছু রহস্য জানা গেছে। আজ আমরা জানি ঘূর্ণিঝড় কেন হয়। এই ঘূর্ণিঝড়েরই আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম – সাইক্লোন, টাইফুন, হারিক্যান। আটলান্টিক ও উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হলে সেই ঘূর্ণিঝড়ের নাম হয় হারিক্যান। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে (এশিয়ার দিকে) তার নাম টাইফুন, আর আমাদের দেশসহ ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের নাম সাইক্লোন। তবে সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় ১১৯ কিলোমিটার বা ৭৪ মাইলের বেশি হলেই তাকে সাইক্লোন বা টাইফুন বা হারিক্যান বলা হয়। কেন এই পরিমাপ ১১৯ কিলোমিটার তা আমি জানি না। এখন বাতাসের বেগ মনে হচ্ছে ঘন্টায় দেড়শ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে।

হঠাৎ ঝনঝন শব্দে আমার পূর্বদিকের জানালার কাচ ভেঙে গেলো। বাতাসের সাথে বৃষ্টির পানি ঢুকছে সেদিক দিয়ে। বিছানা গুটিয়ে চেয়ারে তুলে রাখলাম যেন না ভিজে যায়। আমার রুমের দরজা বরাবর রুমের বাইরে দক্ষিণ দিকে একটা জানালা ছিল। ওটা বন্ধই ছিল। কিন্তু বাতাসের ধাক্কায় প্রচন্ড শব্দে ওটা ভেঙে গেল। এখন বাতাস সরাসরি দক্ষিণ দিক থেকে আমার জানালায় এসে ধাক্কা দিচ্ছে। একটি মাত্র হুক আছে দরজায়। একটু পরেই হুকটা পেরেকশুদ্ধ উঠে আসবে কাঠের ভেতর থেকে। খাটটা ঠেলে দরজায় লাগিয়ে দিলাম। তারপর খাটের মাঝখানে উঠে বসলাম। দরজা-জানালায় যত ফাঁক-ফোকর আছে সবগুলি দিয়ে বাতাস ঢুকছে। নানারকম বাঁশির মতো শব্দ হচ্ছে।

রেডিওতে শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সম্ভবত সম্প্রচার-টাওয়ার ভেঙে গেছে। রুমের জানালা দিয়ে বাইরের তান্ডবের কিছু কিছু আবছা দেখা যাচ্ছে। একটু পর পরই সুপারিগাছগুলি একটার পর একটা ভেঙে যাচ্ছে মাঝবরাবর। মাঝে মাঝে প্রচন্ড শব্দে বিল্ডিং কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে দক্ষিণ দিকের জানালা দরজা কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এখানেই যদি এরকম অবস্থা হয়, জানি না উপকুলীয় অঞ্চলগুলিতে কী হচ্ছে। চিন্তা হচ্ছে আমাদের বাড়ির কী অবস্থা হচ্ছে।

দুঃসময়ের গতি সম্ভবত সময়ের চেয়ে কম। নইলে সুসময় কত দ্রুত চলে যায়, অথচ দুঃসময় কাটতে এত সময় লাগছে কেন!

ভোরের দিকে আস্তে আস্তে বাতাসের বেগ কমে এলো। পুবাকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। জানালা খুললাম। জানালার অনেকগুলি কাচ ভেঙে গেছে। বাইরের গাছগুলির বেশিরভাগই ডালপালা ভেঙে ন্যাড়া হয়ে গেছে।

ছাদে উঠলাম। ছাদের রেলিং-এর দেয়াল ধ্বসে পড়েছে। সন্ধ্যাবেলা যে গাছগুলি দেখেছিলাম তার কোনটাই অক্ষত নেই। ফলবতী আমগাছটির সবচেয়ে বড় শাখাটি ভেঙে মাটিতে পড়ে গেছে। একটা গাছেরও মুন্ডু নেই। ডালপালা যা অবশিষ্ট আছে তাতে চেনার উপায় নেই কোন্‌টা কী গাছ। নারকেল গাছের সবগুলি ডাল দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। যে কাকটি কাল সন্ধ্যায় রুক্ষস্বরে ডেকে ডেকে বাসা পাহারা দিয়েছিল - আজ মরে পড়ে আছে রেলিং-এর ভাঙা দেয়ালের ইটের নিচে।

এদিকের কয়েকটি পাকাবাড়ি ছাড়া আর কোন ঘরবাড়িই অক্ষত নেই। আমার বাড়ি যাওয়া দরকার। আমি জানি না - গিয়ে কী দেখবো। কিন্তু যাবার কোন সুযোগ পেলাম না সারাদিন। রাস্তায় এত বেশি গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে যে সারাদিন গাড়ি চলাচল করতে পারেনি।

চট্টগ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম থেকে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে পারেনি। চট্টগ্রামের কোথাও বিদ্যুৎ-সংযোগ অক্ষত নেই। টেলিযোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে। দুপুরের পর রেডিওতে সিগনাল পাওয়া গেল। প্রাথমিক খবরেই বলা হচ্ছে মৃতের সংখ্যা হাজারের উপরে। বেশিরভাগই বাঁশখালী এবং সন্দ্বীপের। মাথার ভেতর কেমন যেন খালি খালি লাগছে।

এখলাসও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে তার বাড়ির জন্য। আনোয়ারাও সমুদ্রের খুব কাছে।

৩০ তারিখ শহরে যেতে পারলাম না। ফতেয়াবাদে খানসাহেবদের বাড়ির তেমন ক্ষতি হয়নি। পাকা দালান ঝড়ঝাপটা সইতে পারে। ফতেয়াবাদ স্কুলের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। হেডমাস্টারের কোয়ার্টারের চাল উড়ে গেছে। দেয়ালগুলি দাঁড়িয়ে আছে কোনরকমে।

চৌধুরিহাটেরও বিধ্বস্ত অবস্থা। শ্মশানেশ্বরী হোটেল শ্মশান হয়ে গেছে। বেড়া ভেঙে মিশে গেছে মাটির সাথে, শনের ছাউনির চিহ্নও নেই। বিপ্লবদের বাড়িতে গেলাম। তাদের বারান্দার ছাউনি উড়ে গেছে, মূল বাড়ির অনেকগুলি টিন উড়ে চলে গেছে এদিক সেদিক। মাদার্শায় প্রদীপনাথের বাড়ির কী অবস্থা জানি না। ওদিকের রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ ছিল। এখন সেই গাছগুলি রাস্তা আটকে শুয়ে আছে রাস্তায়।

১ মে ভোরবেলা বের হলাম এখলাসসহ। একটা-দুটো বাস চলছে। প্রচন্ড ভীড়। ঠেলাঠেলি করে উঠে গেলাম। মুদারপুরে নেমে বহদ্দারহাটগামী বাসে উঠলাম। চট্টগ্রাম শহর ভীষণ অচেনা ঠেকছে। সবকিছু কেমন যেন বিধ্বস্ত অবস্থা। বহদ্দারহাট থেকে বাঁশখালীর বাস ছাড়ে। সরাসরি বাসে আমাদের বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। সরাসরি যাবার ব্যবস্থা নেই। কর্ণফুলির উপর এরশাদ সরকার যে স্টিলের ব্রিজটি বানিয়েছিলো – একটা জাহাজ নোঙর ছিঁড়ে এসে ধাক্কা খেয়েছে এই ব্রিজে। ব্রিজ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম শহরের সাথে আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া যাবার সহজ রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এবার আবার যেতে হবে সেই কালুরঘাটের ব্রিজ পার হয়ে।

হাজার হাজার মানুষ স্টেশনে। কিন্তু পর্যাপ্ত গাড়ি নেই। যে দুঃসময়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি মানবিক হওয়ার কথা, আমাদের দেশে দেখা যায় সেই দুঃসময়েই মানুষ অমানবিক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। ত্রিশ-টাকার বাসভাড়ার জায়গায় দাবি করে এক শ টাকা।

রাস্তার দুপাশে ধ্বংসস্তুপ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। যতই দক্ষিণে যাচ্ছি ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বাঁশখালীর প্রধান সড়কের পশ্চিমদিকের পুরোটাই সমুদ্রের সাথে মিশে গেছে। অথচ সমুদ্র রাস্তা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। বিভিন্ন জায়গায় পানিতে ভাসছে মানুষের ব্যবহার্য জিনিস, গবাদিপশুর মৃতদেহ। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে লক্ষাধিক প্রাণ।

বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির মূল অংশটি কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে। টিন উড়ে গিয়েছিল। সেগুলি জোগাড় করে আবার লাগানো হয়েছে। রান্নাঘর আর বারান্দার পুরোটাই মাটিতে শুয়ে গেছে।

বাড়িতে এখন অনেক মানুষ। পাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের স্কুলের মাঠে আশ্রয়শিবির খোলা হয়েছে। দু’দিনের মধ্যেই মানুষ বদলে গেছে বিভিন্নভাবে।

পুরো দুটো দিন কেটে যাবার পরেও সরকারি কোন ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি। মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিলেমিশে কাজ শুরু করেছে। মানুষের জন্য মানুষ কাজ করছে দেখে ভালো লাগছে।

পরদিন অনেক বেশি ব্যস্ত সময় কাটলো। আমাদের ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে যতটুকু কাজে লাগা যায়। সরকারি এবং বেসরকারি সাহায্য আসতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। আমাদের গ্রামে ঘরবাড়ির ক্ষতি হলেও প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু পাশের গ্রামে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে শত শত প্রাণ। বিশেষ করে নারী ও শিশু। অনেকেই শত বার তাগাদা দেবার পরেও জলোচ্ছ্বাসের আগে ঘর থেকে বের হয়নি।

একজন মানুষ তাঁর পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পাগলের মতো ছটফট করছেন। কয়েকমাস আগেও এই মানুষটি ঈর্ষার পাত্র ছিলেন অনেকের কাছে। কুয়েতে চাকরি করতেন। প্রচুর টাকা পাঠাতেন বাড়িতে। কিন্তু গতবছরের শেষের দিকে হঠাৎ সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করে নেয়ার পর যুদ্ধ শুরু হলে প্রায় একবস্ত্রে সব হারিয়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। তবুও আপনজনরা ছিল। এই জলোচ্ছ্বাসে তারাও গেল। কিছু কিছু মানুষকে কেন এত কষ্ট পেতে হয়?

কিছুদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক সাহায্যের হাত বাংলাদেশের দিকে প্রসারিত হলো। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের মানুষের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন।

ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসনে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হলো। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা অনেক কাজ করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে কাজ করলো যত, ভয় দেখালো তার চেয়েও বেশি। ক্ষুধার্ত মানুষ মিলিটারি-কায়দায় অর্ডার মানতে জানে না, পারে না। সেজন্য তাদেরকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে পেটানোতে যে কোন বাহাদুরি নেই তা তাদের কে বোঝাবে!

প্রচন্ড খারাপ অবস্থা থেকেও ঘুরে দাঁড়ানোর আশ্চর্য ক্ষমতা আছে মানুষের। এই সর্বস্বহারানো মানুষগুলোও আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো।

অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ মাস পর ১৪ মে আমাদের  বিশ্ববিদ্যালয় খুললো। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই শিবিরের অত্যাচারে আবার বন্ধ হয়ে গেল।

<<<<<<< আগের পর্ব 

Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts