Friday 31 July 2020

সত্যেন্দ্রনাথ বসু - পর্ব ১১



সত্যেন্দ্রনাথ বসু - বোসন কণার জনক

একাদশ অধ্যায়

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


ইওরোপ থেকে ফিরে ১৯২৬ সালের অক্টোবরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন সত্যেন বসু। বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে ইউনিভার্সিটির এবং তাঁর ডিপার্টমেন্টেরও। ভাইস চ্যান্সেলর হার্টগ অবসর নিয়েছেন ১৯২৬ সালের জানুয়ারিতে। প্রফেসর জর্জ হ্যারি ল্যাংলি (G H Langley) নতুন ভিসি হয়েছেন। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর জেনকিন্স ইংল্যান্ডে চলে গেছেন। ড. আর এন ঘোষ ডিপার্টমেন্টের কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। প্রফেসর জেনকিন্সের পদে নিয়োগের জন্য যখন দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল সত্যেন বসু তখন বার্লিনে ছিলেন। প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধানের পদ। পিএইচডি ডিগ্রি ন্যূনতম যোগ্যতা। কিন্তু সত্যেন বসুর পিএইচডি ডিগ্রি নেই। গবেষণা করে ডক্টরেট করার কোন ইচ্ছে তাঁর হয়নি কখনো। তাঁর ক্লাসমেট বন্ধু সহকর্মী মেঘনাদ সাহা মাত্র দু'বছরের মধ্যে ডিএসসি ডিগ্রি পেয়ে গেছেন। অথচ সত্যেন বসুর কোন আগ্রহই জন্মায়নি রিসার্চ ডিগ্রি নেয়ার। এখন পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া কীভাবে দরখাস্ত করা যায়? তিনি ভেবে দেখলেন আইনস্টাইনের লেখা একটি পোস্টকার্ড যেভাবে তাঁর ইওরোপে আসা ত্বরান্বিত করেছে, সেখানে আইনস্টাইনের কাছ থেকে সুপারিশপত্র নিতে পারলে নিশ্চয় কাজ হবে।

          আইনস্টাইনকে বলতেই খুব আগ্রহ সহকারে প্রশংসাপত্র লিখে দিলেন।

 

16.3.26

 

The recent works of Mr S N Bose, especially his theory of radiation equilibrium, signify in my opinion an important and enduring progress of the physical theory. Also in personal discussion with Mr Bose, I have got the. impression that he is a man of unusual gift and depth, from whom science has much to expect. He has also at his command an extensive knowledge and certain ability in our science. As university teacher he will certainly develop a successful and prosperous activity.

 

Sd. A. Einstein

 

আইনস্টাইন লিখেছেন,

 

"মিস্টার এস এন বোসের সাম্প্রতিক গবেষণা কাজ, বিশেষত তাঁর বিকিরণ সাম্যতার তত্ত্ব, আমার মতে ভৌতিবিজ্ঞানের এক বিরাট অগ্রগতি সাধন করেছে। তাছাড়া মিস্টার বোসের সাথে ব্যক্তিগত আলোচনায় আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে তিনি অত্যন্ত প্রতিভাশালী মানুষ এবং বিজ্ঞান তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করে। আমাদের বিজ্ঞানে তাঁর বিশেষ দক্ষতা এবং ব্যাপক জ্ঞান আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি অবশ্যই একটি সার্থক ও সমৃদ্ধিশালী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।"

 

শুধু আইনস্টাইন নয়, সত্যেন বসু প্রফেসর পল লাঁজেভি এবং কাইজার উইলহেলম ইন্সটিটিউটের ড. হারমান মার্কের কাছ থেকেও প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁরা সবাই সত্যেন বসুর যোগ্যতার প্রশংসা করেছেন।

 

প্রফেসর লাঁজেভির প্রশংসাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

 

Paris, the 26th April 1926

10 Rue Vauquelin

 

...q uc Francaise

re' Egalite' Fraternite'

Ecole Municipale de

Physique et de Chimie

Industrielles

 

Office of Director

 

I the undersigned, Paul Langevin, Professor at College de France, Director of Ecole de Physique et Chimie de Paris, certih that Mr Satyendranuth Bose, Reader of Physics at the University of Dacca, has spent a year in Paris in 1924-25 and worked under my direction.

          I have the highest esteem for the personal merit and the works of Mr Bose whose own researches have been pursued here and whosepresence has contributed to increasing the scientific activity of our university. I am particularly happy that the initiative of the University of Dacca has permitted this useful stay of Mr Bose in Paris.

 

Sd. P  Langevin

 

 

. হারমান মার্ক লিখেছিলেন:

 

Berlin, 9 May 1926

 

Mr Satyendranath Bose is at present conducting a physical experimental investigation about the refractive index of Roentgen rays in the Kaiser Wilhelm Institute in Berlin-Dahlem. His large and profound knowledge which stretches over the whole ofphysics as well as the wider territory of chemistry marks Mr Bose out prominently. His most valuable quality which tnakes him of inestimable value to a collaborator is his deep and clear insight in the fundamentals of our science, his wealth of fruitful ideas and his capacity to combine theoretically important questions with experimentally feasible tests in an exceedingly happy manner. From the presence of Mr Bose, our institute derives thegreatest benefit all the more as he understands, in a masterly way, how to make the most difficult questions clear through discussion - a quality which seems to make Mr Bose eminently suitable specially to the profession of teaching.

Dr. Hermann Mark

Kaiser Wilhelm Institute

for Chemistry of Fibrous Materials

16 Fambay Road, Berlin-Dahlem

 

 

এইসব প্রশংসাপত্রসহ প্রফেসর পদের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন সত্যেন বসু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসুও দরখাস্ত করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই পদের প্রার্থীদের মূল্যায়ন করার জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত চাইলেন আর্নল্ড সমারফেল্ডের কাছে। সমারফেল্ড টেলিগ্রাম পাঠালেন, "সত্যেন বসু ও দেবেন্দ্রমোহন বসু দুজনই যোগ্য। সত্যেন বসু বিখ্যাত তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। আর দেবেন্দ্রমোহন বসু প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষণ এবং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। আমার মতে দেবেন্দ্রমোহন বসুকেই নিয়োগ দেয়া উচিত।"

          ১৯২৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মাসিক এক হাজার রুপি বেতনে ডক্টর দেবেন্দ্রমোহন বসুকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য নিয়োগপত্র পাঠানো হবে। কোন কারণে যদি দেবেন্দ্রমোহন বসু অসম্মতি প্রকাশ করেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে সেই পদে নিয়োগ করা হবে। দেবেন্দ্রমোহন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে রাজী হলেন না। সত্যেন বসু পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান পদে যোগ দিলেন। কিছুদিন পরে তিনি সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন নিযুক্ত হয়েছিলেন।

          তারপর আঠারো বছর ধরে সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে গড়ে তুলেছেন ভারতের একটি প্রথম শ্রেণির শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্রে। ইওরোপের বিখ্যাত সব ল্যাবোরেটরিতে কাজ করে এসেছেন তিনি। মেরি কুরির রেডিয়েশান ল্যাবে কাজ করেছেন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ও এক্স-রে স্পেকট্রোসকোপি নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এক্স-রে ল্যাব তৈরি হলো। গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত হলো ক্রিস্টালোগ্রাফি, ম্যাগনেটিক প্রোপার্টিজ, রামন স্পেকট্রা ইত্যাদি সব আধুনিক বিষয়ে।  

          সত্যেন বসুর আগ্রহ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে। যে কোন বিষয়ের অনেক গভীরে যেতেন তিনি। কিন্তু সে তুলনায় তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা খুবই কম। যে কোনো সমস্যার সমাধান যখন তিনি পেয়ে যেতেন তখন সেই সমাধান প্রকাশ করার বদলে তিনি ছিঁড়ে ফেলে দিতেন।

          রসায়নের অধ্যাপক সুশীলচন্দ্র বিশ্বাসের সাথে যৌথভাবে তিনি রসায়নেও গবেষণা করেন। ১৯২৭ সালে তাঁর রসায়নে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জার্মানির বিখ্যাত রাসায়নিক জার্নালে।[1] ১৯২৯ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় বেরিলিয়াম স্পেকট্রামের উপর একটি গবেষণাপত্র।[2] তার পরবর্তী সাত বছর তিনি কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-পরিবেশ গড়ে তুলেছেন শুধু পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে নয়, আরো অনেক বিভাগে। 

            ১৯২৮ সালে আর্নল্ড সামারফেল্ড ভারত সফরে এসেছিলেন। ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স-এ কিছুদিন কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সত্যেন বসুর সাথে দেখা করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে এস অসুস্থ হয়ে যাবার পর আর ঢাকায় আসতে পারেননি। ব্যাঙ্গালোর থেকে তিনি কলকাতায় সিভি রামনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কলকাতায় যাবার আগে তিনি ব্যাঙ্গালোর থেকে চিঠি লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-কে যে তিনি ঢাকায় আসতে পারছেন না অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে ১৪ দিন হাসপাতালে নষ্ট হয়েছে তাই সময় পাচ্ছেন না বলে। কিন্তু সত্যেন বসুর সাথে তিনি দেখা করতে খুব আগ্রহী। সত্যেন বসু যদি কলকাতা যান - তাহলে তিনি খুব খুশি হন। সত্যেন বসু কলকাতায় গিয়ে দেখা করেছিলেন তাঁর সাথে। সেই সময় সিভি রামন 'রামন ইফেক্ট' আবিষ্কার করেছেন। যদিও তখনো সেই আবিষ্কারের নাম তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়নি। সত্যেন বসু সিভি রামনকে ১৯২৮ সালে বলেছিলেন, "প্রফেসর রামন, আপনি একটি মহান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন। এই আবিষ্কারের নাম হবে 'রামন ইফেক্ট', আর আপনি নোবেল পুরষ্কার পাবেন এই আবিষ্কারের জন্য।"[3] সত্যেন বসুর কথা ঠিক হয়েছিল। দু'বছরের মধ্যেই ১৯৩০ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন সিভি রামন।

            রামনের প্রধান সহকারী কে এস কৃষ্ণানকে[4] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার পদে নিয়োগ দিয়েছেন সত্যেন বসু। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন কৃষ্ণান। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই পাঁচ বছরে তিনি প্রচুর গবেষণা করেছেন ক্রিস্টালের চৌম্বকধর্ম নিয়ে। বিভাগীয় প্রধান সত্যেন বসু তাঁকে গবেষণার জন্য যা যা লাগে সবকিছু দিয়ে সহায়তা করেছেন। এই পাঁচ বছরে কৃষ্ণানের বিশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু সত্যেন বসু কৃষ্ণানের সাথে যৌথভাবে কোন গবেষণা করেননি।

          ১৯২৯ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে ফিজিক্স ও ম্যাথম্যাটিক্‌স সেকশানের সভাপতিত্ব করেন সত্যেন বসু।

          ১৯৩১ সালে ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন শান্তিরঞ্জন খাস্তগীর। তিনি ১৯৪৫ সালে সত্যেন বসুর পদত্যাগের পর ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রফেসর খাস্তগীরের সাথে একটি যৌথ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন সত্যেন বসু। সে বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করবো।

          ১৯৩৩ সালে কে এস কৃষ্ণান কলকাতায় 'মহেন্দ্রলাল সরকার প্রফেসরশিপ' নিয়ে চলে গেলে তাঁর স্থলে রামনের আরেকজন ছাত্র কেদারেশ্বর ব্যানার্জিকে নিয়োগ দেন সত্যেন বসু। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন কেদারেশ্বর ব্যানার্জি। তিনি তরল পদার্থে এক্স-রে ডিফ্রাকশান নিয়ে গবেষণা করেন। সত্যেন বসু ব্যানার্জিকেও সমস্ত গবেষণা-সহযোগিতা দিয়েছিলেন কিন্তু যৌথভাবে কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি।

          ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পদার্থবিজ্ঞান নয়, সব বিভাগেরই গবেষণার বিস্তার, অগ্রগতি ও মানোন্নয়নে সদাসচেষ্ট ছিলেন সত্যেন বসু। কোন্‌ বিভাগে কী কাজ হচ্ছে তার খবর রাখতেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তিগত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা থেকেও। রসায়ন বিভাগের প্রধান প্রফেসর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ছিলেন তাঁর বন্ধু। রসায়নের অনেক গবেষণায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন সত্যেন বসু। জৈব রসায়নে সেই সময় প্রচুর উল্লেখযোগ্য গবেষণাকাজ সম্পাদিত হয়েছে সেই সময়। এ প্রসঙ্গে সত্যেন বসু নিজেই লিখেছেন,

 

"সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি। আমার এক ছাত্র Sulphonamide নিয়ে নানা গবেষণায় ব্যস্ত। ওদিকে জৈব-রসায়নের গবেষণা-কেন্দ্রে ড. কালীপদ বসু নানাপ্রকার চাউল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের বিশ্লেষণ করে চলেছেন। তাদের প্রত্যেকটির মধ্যে স্নেহ-কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনের শতকরা কয়ভাগ করে বর্তমান রয়েছে, তা নিরূপণ করে তালিকা করছেন। তার মধ্যে vitamin (খাদ্যপ্রাণ) সমূহের অবস্থানের খবরও থাকছে ও তাদের পরীক্ষণ নিরূপণের প্রয়াসও চলেছে। ঢাকার খুব কাছেই আমেরিকান বোমারু বিমানের ঘাঁটি। ঢাকা শহরের মধ্যে আমেরিকান, ইংরেজ ও ভারতীয় পল্টনের নানা হাসপাতাল বসেছে। নানাদেশের ডাক্তার ও বিজ্ঞানী এসে ঢাকায় রয়েছেন। তাঁরা মধ্যে মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান-মন্দিরে বেড়াতে আসেন ও আমরাও তাঁদের কাছ থেকে নানা খবর পাই।

            সেই সময় খবর এলো চীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব-রসায়নে অভিজ্ঞ পর্যটক এসেছেন ভারত ভ্রমণে। ভারতে নানাস্থানে কীভাবে নানা খাদ্যপ্রাণসমন্বিত বটিকা তৈরি হচ্ছে দেখতে। দক্ষিণ ভারতে টুটিকোরিনে দেখলেন মাছের তেল থেকে vitamin D এর সংগ্রহ, আবার আফ্রিকা দেশের লাল তালের তেল থেকে vitamin-এর সংগ্রহ। vitamin-এর অভাবে চীনা শিশুদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তারই প্রতিকারের চেষ্টায় এই পর্যটন। রাজপুতানা, বোম্বাই, পাঞ্জাব, দিল্লী বেড়ানো শেষ হলো, সব শেষে পূর্বপ্রান্তের শহর ঢাকায় তিনি উপস্থিত হলেন।

            শ্রী কালীপদ বসুর খাদ্যবিশ্লেষণ ও সংগ্রহের তালিকার কথা তিনি শুনেছিলেন। নিজেরও ওই বিষয়ে কিছু কাজ করা ছিলতাঁর, তাই কৌতূহলের উদ্রেক হয়েছে - কীভাবে ভারতে ওই প্রকারের অনুসন্ধান চালানো হয়।

            চীনা বিজ্ঞানীকে সাদরে অভ্যর্থনা করলাম আমরা। ঢাকা-হল অফিসের একটি কামরা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র দিয়ে তাঁর বাসের উপযোগী করে দেওয়া হলো। এক সপ্তাহেরও বেশী দিন তিনি আমাদের সঙ্গে কাটালেন।

            নানা প্রসঙ্গের আলোচনা হচ্ছে। নিজে কীভাবে চীনদেশের উদ্ভিজ্জের মধ্যে vitamin B C এর সন্ধান পেয়েছেন, তার কথা। চীনদেশে রসায়ন শিল্পের তখন সবে পত্তন হয়েছে। গন্ধকাম্লের কারখানা মাত্র কয়েক জায়গায় গড়ে উঠেছে, অন্যান্য দরকারী জিনিস ও ঔষধপত্র তখনও আসছে বিদেশ থেকে। পুরনো কেতায় জীবনযাত্রা চলেছে সাধারণ চৈনিকের, যদিও কয়েক বছর আগেই সুন-নত-সে-ন বিপ্লবের বন্যায় মাঞ্চু সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজেই Sulphonamide ও তাঁর নানা যৌগিকের প্রস্তুতি চলেছে শুনে প্রথমে তাঁর বিশ্বাস হলো না। আমাদের নিমন্ত্রণে এসে স্বচক্ষে প্রক্রিয়ার সব ধাপগুলিই ছাত্রকে অতিক্রম করে শুদ্ধবস্তুতে উপনীত হতে দেখলেন। এই প্রত্যক্ষ জ্ঞানদানের পরিবর্তে আমরা চাইলাম তাঁর কাছে সয়াবিন থেকে কীভাবে চীনদেশে দুধ তৈরী হয়, তার সন্ধান। কাশ্মীর থেকে আনা অনেক সয়াবিন শ্রীমান কালীপদ যত্ন করে রেখেছিলেন। তা থেকে যথানিয়মে দুধ তৈরি হলো, দুধ থেকে ছানা।"[5]

 

দেখা যাচ্ছে ৫০-৬০ বছর আগেও আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৈজ্ঞানিকভাবে চীনের চেয়েও উন্নত ছিল। আমরা সেদিন তাদের বিজ্ঞানীদের শিখাতে পারতাম এবং সমানে সমানে দাঁড়িয়ে শিখতেও পারতাম। এই ক'বছরের মধ্যেই তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে কোথায় উঠে গেল, আর আমরা কোথায় গেলাম!

 

চিত্রপ্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এমএসসি পাস করার ১৫ বছর পর ১৯৩০ সালে স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে মেঘনাদ সাহা। বাম থেকে ডানে -  পেছনে দাঁড়ানো: স্নেহময় দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দেবেন্দ্র মোহন বসু, নিখিল রঞ্জন সেন, জে এন মুখার্জি, এন সি নাগ। সামনে বসামেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু, জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ খোলার পেছনে সত্যেন বসুর অবদান অনেক। তিনি সহকর্মী ড. কাজী মোতাহার হোসেনকে শিক্ষাছুটি দিয়ে কলকাতায় বন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের কাছে পাঠিয়েছিলেন পরিসংখ্যান বিষয়ে শিক্ষা নেয়ার জন্য। অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতিচারণ করেছেন সে প্রসঙ্গে:

"একদিন আমাদের পদার্থবিদ্যা অনুষদের ১০/১১ জন শিক্ষককে একসঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বাজিয়ে নিলেন। ওঁর কাছে একখানে উচ্চ পর্যায়ের পাটিগণিত ছিল, অনেক কূট অংকে ভরা। অংকগুলো দেখতে অনেক সহজ মনে হয়, কিন্তু করতে গেলে জ্যামিতি, বীজগণিত, স্থানাংক জ্যামিতি বা কলন প্রণালীর জ্ঞানের আবশ্যক হয়। সেই বই থেকে আমাদের সবাইকে সাত-আটটা বাছা বাছা অংক করতে দিয়ে বললেন, "সাতদিন পরে যে যতটা পার এনে আমাকে দেখাবে।" আমি পরদিনই সবগুলো সমাধান করে তাকে দেখালাম। (অন্যেরা কে কয়টা করতে পারলো সেটা উল্লেখ করা শোভন হবে না)। যাহোক সত্যেনবাবু খুব খুশী হয়েছেন, বোঝা গেল। মন্তব্য করলেন, তোমার ত ম্যাথেমেটিক্স-এ অ্যাকুমেন (প্রকৃষ্ট পারদর্শিতা) আছে হে!" সত্যেনবাবুর মুখে এ খুব বড় প্রশংসা। অতঃপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি স্ট্যাটিস্‌টিক্স পড়বে?" বললাম, "তা সুযোগ পেলে পড়তে পারি, কিন্তু সে সুযোগ কোথায়?" তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, "আমি তোমাকে বেতনসহ নয় মাসের ছুটি দেব, আর বছরে তিনমাস তো এমনিই ছুটি আছে।" গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হলেই তিনি আমাকে সঙ্গে করে কলকাতা নিয়ে গেলেন, আর (ড. প্রশান্তচন্দ্র) মহলানবিশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, - "দেখ, এ আমার ছোট ভাই-এর মত। একে বছরখানিকের মধ্যে যতটা পার পরিসংখ্যান শিখিয়ে দেও। একে যোগ্য মনে করেছি বলেই, আমি তোমার হাওয়ালায় রেখে যাচ্ছি।"

            বুঝলাম সত্যেনবাবুর নির্বাচনী পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হয়েছি। এর মধ্যেই তাঁর মাথায় এসে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাগণিত চালু করতে হবে। আর সে জন্য শিক্ষক সৃষ্টি করতে হবে। আর সত্যেনবাবুর স্নেহ অনুগ্রহেই আস্তে আস্তে আমার পাঠনের মোড় ফিরে গেল পদার্থবিজ্ঞান থেকে পরিসংখ্যানে বা তথ্যগণিতের দিকে।

            এই মহাপুরুষের কাছে হিন্দু-মুসলিমের কোনও প্রশ্নই ছিল না; ছিল গুণের আদর আর সূক্ষ্ম বিচারবোধ। তিনি প্রথমে তথ্যগণিতকে অংক শাস্ত্রের সহিত সংযোজিত করে দিলেন। এর ফলে ১৯৩৯ সাল থেকে আমি তথ্যগণিত পড়াতে লাগলাম, আর পদার্থবিদ্যার ফলিত অংশ ত্যাগ করে অনার্স ক্লাসে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাও পড়াতে লাগলাম। এইভাবে কিছুদিন চলার পর তথ্যগণিতের একটা পুরো বিভাগ সৃষ্টি করা হল। প্রথমে তথ্যগণিতের পাস কোর্স আর অনার্স কোর্স একসঙ্গে আরম্ভ হল। তার দুই বছর পরে এম.. কোর্সও খোলা হল ১৯৫০-৫১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা বিষয়ে গর্ব করতে পারে; সে হচ্ছে, তথ্যগণিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে B.A. Honours Course খুলবার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উক্তি অনার্স কোর্স খোলা হয়েছিল।"[6]

 

সত্যেন বসু পদার্থবিজ্ঞানের এমএসসি পরীক্ষার বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেবেন্দ্রমোহন বসু, মেঘনাদ সাহা, শিশিরকুমার মিত্র প্রমুখ বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন। পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেলে চা-চক্রের আয়োজন করা হতো আর থাকতো সবার জন্য উন্মুক্ত বৈজ্ঞানিক আলোচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবাই বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের আলোচনা শোনার সুযোগ পেতেন। ১৯৩৭ সালে মেঘনাদ সাহা এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে তিনি একটি লেকচার দিয়েছিলেন। তিনি তখন আয়োনোস্ফিয়ারে বেতারতরঙ্গের প্রতিফলন সম্পর্কিত গবেষণা করছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল যে আয়নোস্ফিয়ারে বেতার তরঙ্গের কোন শোষণ ঘটে না। কিন্তু সেটা ছিল একটা ধারণামাত্র। মেঘনাদ সাহা সেই সভায় সবার সামনে সত্যেন বসুকে অনুরোধ করেছিলেন এই সমস্যার একটা সার্বিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য। সত্যেন বসু কয়েক মাসের মধ্যেই এই সমস্যার একটা সমাধান বের করেছিলেন। ১৯৩৭-৩৮ সালে 'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার' এবং 'ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স'-এ দুটো গবেষণাপত্র[7] প্রকাশ করেন তিনি আয়নোস্ফিয়ার সম্পর্কিত।

          ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ভিসি জর্জ ল্যাংলির মেয়দ শেষ হয় ১৯৩৪ সালের জুন মাসে। তৃতীয় ভিসি হন স্যার এ এফ রহমান। ১৯২১ সালে প্রফেসর হার্টগের অনুরোধে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ইতিহাস বিভাগের রিডার হিসেবে। সত্যেন বসুর সাথে তাঁর ছিল আন্তরিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ১৯৩৬ সালে স্যার এ এফ রহমানের মেয়াদ পূর্ণ হবার পর চতুর্থ ভিসি হন অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার। তিনিও ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক হয়ে। সত্যেন বসুর সাথে তাঁর বন্ধুত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সত্যেন বসু সাধারণত ছাত্রদের কোন অনুষ্ঠানে যেতেন না। ১৯৩৯ সালে তাঁকে ঢাকা হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর আগে প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন কেমিস্টির জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। প্রভোস্টের দায়িত্ব নেয়ার পর নিয়মানুযায়ী হলের সবগুলো অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করতে হতো সত্যেন বসুকে। ইউনিভার্সিটির যেসব অনুষ্ঠান তিনি এড়িয়ে চলতেন রমেশচন্দ্র মজুমদার ভিসি হবার পর সেসব অনুষ্ঠানেও তিনি সত্যেন বসুকে জোর করে নিয়ে যেতেন। ধূতিপাঞ্জাবি পরা শ্বেতশুভ্রচুলের সত্যেন বসু যখন মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে সেসব অনুষ্ঠানে বসে থাকতেন - দেখতে পৌরাণিক ঋষিদের মতো লাগতো তাঁকে।

          বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক, ছোট-বড় সবার কাছেই তিনি ছিলেন ঋষিতুল্য। এমনকি ঢাকার সাধারণ মানুষও খুব ভালোবাসতেন তাঁর আন্তরিক নরম ব্যবহার। তিনি এমনিতে খুব নরম স্বভাবের হলেও নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। ছাত্ররা সেই সময়েও মাঝে মাঝে পরীক্ষা পেছানোর আবদার করতো। তিনি সেই আবদার হাসিমুখেই বাতিল করে দিতেন। 

 ১৯৩৫ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের ফাউন্ডেশান ফেলো মনোনীত হন সত্যেন বসু। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের প্রথম কার্যকরী কমিটির পাঁচজন সদস্যের একজন ছিলেন তিনি।

          ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বদলে যেতে শুরু করেছে দ্রুত। পূর্ববাংলার অনেকেই বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেছিলো। রাজনৈতিক আন্দোলনের চাপে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে একটা বিভাজন রেখা তৈরি হচ্ছিল। ব্রিটিশরা যেভাবেই পারে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছিলো তাদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির আলোকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গের অবহেলিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিশ বছরের মধ্যেই একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে নিজস্ব আত্মপরিচয় ও স্বাদেশিক চেতনা নিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস রূপান্তরিত হচ্ছিল ঘৃণায়। শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে দাঙ্গা হচ্ছিলো। ১৯৪০-৪১ সালে এটা নিয়মিত ঘটনায় দাঁড়িয়ে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আর শান্তিপূর্ণ রইলো না।

          ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রফেসর সত্যেন বসুকে আহ্বান করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে। তখন সত্যেন বসু ইতস্তত করছিলেন ঢাকা ছেড়ে যেতে। তিনি তাঁর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানের প্রসঙ্গে অনেকগুলো শর্ত দিয়েছিলেন এমনভাবে যেন ভিসি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বুঝতে পারেন যে তাঁর ইচ্ছে নেই যাওয়ার। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি স্যার আশুতোষ মুখার্জির ছেলে। সে হিসেবে তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কটা ছিল খুবই শ্রদ্ধার। সত্যেন বসু শর্ত দিয়েছিলেন তাঁকে স্থায়ী পদ দিতে হবে, ঢাকায় যা বেতন পান তা দিতে হবে এবং মাসে ১৫০১ রুপি ঘরভাড়াও দিতে হবে - কারণ কলকাতায় খরচ ঢাকার চেয়েও বেশি। সত্যেন বসু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে লিখেছিলেন:

 

 Physics Laboratory

Dacca University

Dated, Ramna,

the 28th January 1938

 

My dear Mr. Mookerjee,

 

Thank you very much for your kind enquiry. I hope you will understand how difficult it is for me to make up my mind finally in the matter, especially as I do not as yet know the conditions under which the post may be offered. I hold a permanent appointment as the head of the Department of Physics here, and I feel it will not be wise for me to go in for change at this age, and accept any offer which does not mean the same security of tenure, and at least the same facilities for work. At the same time the prospect of being able to be of some service to my own Alma Mater has a great attraction for me. If she thinks my presence in Calcutta will be of some use to her, I feel it will be difficult for me to resist her demands. If it be possible for the Governing Body of the Palit Trust to offer me the same salary as I am drawing now, with an additional house allowance of say about Rs 1501- I may accept the offer. I mention the additional house allowance, as I fear Calcutta will be a very much more expensive place to live in than Dacca.

I hope this will help you in arriving at a definite decision. With kindest regards,

I remain

Yours sincerely

S.N.Bose

 

 

কিন্তু ১৯৩৮ সালে সত্যেন বসু যেভাবে ভেবেছিলেন পরিস্থিতি সেরকম রইলো না।  দিনে দিনে ঢাকার অবস্থা এত খারাপ হচ্ছিলো যে তাঁর এবং তাঁর পরিবার ঢাকায় আর নিরাপদ মনে করছিলেন না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের দাবি উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকেই চলে যাচ্ছিলেন কলকাতার দিকে। সত্যেন বসুকেও তাঁর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাই বোঝাচ্ছেন তাঁর কলকাতায় ফিরে যাওয়া উচিত।

          এর মধ্যেই ১৯৪২ সালে ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটির এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সাব-কমিটির সদস্য মনোনীত হয়েছেন। পরের বছর বাংলার প্রাদেশিক সরকারের ওয়েট্‌স অ্যান্ড মেজার্স কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। পরের দু'বছরে সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন এবং বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ কমিটির মেম্বার নিযুক্ত হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পথে। বিশ্বযুদ্ধের পরেই ব্রিটিশ সরকারের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিয়ে দেবে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটো রাষ্ট্রে ভাগ করে। ঢাকা হবে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। ইতোমধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে 'খয়রা অধ্যাপক' বিধুভূষণ রায়ের মৃত্যুতে পদটি খালি হয়। সত্যেন বসুকে সেই পদে যোগ দেয়ার আহ্বান করা হয়। সত্যেন বসু রাজি হয়ে যান।

          ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সত্যেন বসুকে কিছুতেই হারাতে চায়নি। সেই সময় ভিসি ছিলেন ডক্টর মাহমুদ হাসান। তিনি সত্যেন বসুর অবসরের তারিখ পিছিয়ে দেয়াসহ মাসিক ১৫০০ রুপি বেতনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সত্যেন বসু তো টাকার জন্য ঢাকা ছাড়ছেন না। দেশ যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে - এ সমস্যার সমাধান তো তাঁর হাতে নেই।



[1] Susil Chandra Biswas and S. N. Bose, Measurements of the Decomposition Voltage in Non-aqueous Solvents, English translation of Z Phys Chem 125, pp. 442-       451,1927      (Johnson Reprint Corporation, NY).

[2]  S. N. Bose and S. K. Mukherjee, Beryllium Spectrum in the Region l = 3367-1964. Phil Mag Ser 7,7, pp. 197-200,1929 (Taylor and Francis, London).

[3] Kameshwar C Wali, Chandra: a biography of S Chandrashekhar, Penguin Books, Delhi 1991, p. 260.

[4] কে এস কৃষ্ণান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন প্রদীপ দেবের "উপমহাদেশের এগারজন পদার্থবিজ্ঞানী", মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬।

[5] সত্যেন্দ্রনাথ বসু, 'পুরনো দিনের স্মৃতি', জ্ঞান ও বিজ্ঞান, অক্টোবর, ১৯৬৬। রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৮। পৃষ্ঠা ২২৭-২২৮।

[6] ড. কাজী মোতাহার হোসেন, বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে যেমন দেখেছি, ত্রৈমাসিক লোকসাহিত্য পত্রিকা, ১৯৮৫। সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্মারকগ্রন্থে পুনপ্রকাশিত। পৃষ্ঠা ৪২-৪৩।

[7] S. N. Bose and S. R. Khastgir, Anomalous Dielectric              Constant of Artificial Ionosphere, Sci. & Cult. 3, pp.        335-337 (1937).

      S. N. Bose, On the Total Reflection of Electromagnetic             Waves in the Ionosphere, Ind. J. Phys. 12, pp. 121-144      (1938).

 দ্বাদশ অধ্যায়

দশম অধ্যায়

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪১

41

রাতের রেলগাড়ি

দিল পাড়ি

কামরায় গাড়িভরা ঘুম,

রজনী নিঝুম।

অনেকক্ষণ থেকেই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে এই ক’টা লাইন। দু’লাইনে চলা আস্ত রেলগাড়ির একটা কম্পার্টমেন্টের পুরো দৃশ্য বর্ণনা করে ফেলেছেন মাত্র দু’লাইনে। এজন্যেই তো তিনি বিশ্বকবি। কবিতার আর কোন লাইন আমার মনে নেই, এই লাইন দুটো কোন্‌ কবিতার তাও জানি না। পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের বিজ্ঞাপনে প্রায়ই দেখা যায় এই দুটো লাইন। ঘন্টা দেড়েক আগে রিফাৎ আরা ম্যাডামের কেনা দেশ পত্রিকায়ও দেখেছি। সেখান থেকেই হয়তো মাথার ভেতর ঢুকে গেছে।

আমাদের রাতের রেলগাড়ি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পাড়ি দিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো। এরমধ্যেই কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম। আমারও ঝিমুনি এসেছিল। কিন্তু কিসের একটা ঝাঁকুনিতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। দুইটি সিটজুড়ে আরামে পা তুলে বসেছিলাম। ঘুম ভাঙার পর উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম সামনে তিন সিট পর রিফাৎ আরা ম্যাডাম আর নাসরীন ম্যাডাম চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছেন। তাদের সামনের সিটে আমার দিদির মাথা দেখা যাচ্ছে পেছন থেকে। সে ঘুমিয়েছে কি না বুঝতে পারছি না।

আমাদের সকালের ট্রেনেই চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার কথা ছিল। গোল্ডকাপ আর বিতার্কিকদের নিয়ে নাসির স্যার সকালে চলে গেছেন। রিফাৎ আরা ম্যাডাম আর নাসরীন বানু ম্যাডামের সাথে আমাকেও থেকে যেতে হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিতর্ক সংক্রান্ত একটা মিটিং-এ অংশ নেয়ার জন্য। স্কুল বিতর্কের নতুন সিজন শুরু হবে। কীভাবে আরো আকর্ষণীয় এবং উন্নত করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য গত দু’বছরে যেসব স্কুলের বিতার্কিকরা সেমিফাইনাল ও ফাইনাল রাউন্ডে বিতর্ক করেছে সেসব স্কুলের শিক্ষক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকদের সাথে আমরা তিন জনও যোগ দিলাম সেই মিটিং-এ। চ্যাম্পিয়ন দলের শিক্ষক হিসেবে আমাদের মর্যাদা কিছুটা বেড়েছে বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম ঢাকার শিক্ষকরা আমাদের কাউকেই তেমন কোন কথা বলতে দিলেন না। বিশেষ করে সেন্ট জোসেফ স্কুলের এক শিক্ষক – কথার মাঝখানেই কথা বলতে শুরু করেন। মনে হলো তাঁর পেটে বিদ্যা টগবগ করে ফুটছে। আর বিদ্যার বাষ্প ধরে রাখতে পারছেন না বলেই যখন-তখন জাহির করে ফেলছেন। বিদ্যা জাহির করার লোভ সামলানোর মতো বিদ্যা অর্জন করা তো সহজ কাজ নয়। দু’তিন ঘন্টা ধরে নানা মুনির নানা মত প্রকাশিত হলো। টেলিভিশন বিতর্ক পরিচালক কিরণ সাহেব চেষ্টা করেছিলেন কিছু গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় কি না। কিন্তু ঢাকার শিক্ষকরা বয়স এবং পরিচিতির প্রাবল্যে কিরণ সাহেবকে পাত্তাই দিলেন না। ফলে শেষ বিকেল পর্যন্ত বক বক করলেন তাঁরা, গপাগপ কেক-পেস্ট্রি খেলেন, চায়ে চিনির পরিমাণের ভালো-মন্দ সংক্রান্ত মতামত দিলেন, পান পাওয়া গেলে ভালো হতো বললেন, এবং আবার মিলিত হতে হবে – এব্যাপারে সবাই একমত হলেন। যদিও এই সবাইয়ের দলে আমরা তিন জন নেই – তাতে কারোরই কিছু যায় আসে না।

মিটিং রুম থেকে বের হবার সময় রিফাৎ আরা ম্যাডাম কিছু একটা বললেন আমি ঠিক শুনতে পেলাম না। আমি তখন কাছেই দাঁড়ানো শমী কায়সার আর খালেদ খানের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম টেলিভিশনের পর্দায় এঁদেরকে এত অন্যরকম দেখায় কেন।

“অ্যাই প্রদীপ, কী বলছি শুনেছেন?” – রিফাৎ আরা ম্যাডাম বেশ জোরেই বললেন।

“জ্বি ম্যাডাম, বলেন।“

“আবার মিটিং-এ আসতে হলে আমি কিন্তু আসবো না।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডাম বললেন।

“আপা না এলে আমিও কিন্তু আসবো না।“ – নাসরীন বানু ম্যাডাম যোগ করলেন। তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছে আপা যদি কোন কিছু না করেন, তিনিও কিছুতেই সেটা করবেন না। এমন আপা-ভক্ত খুব বেশি দেখা যায় না।

অফিসার্স মেসে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতে ট্রেন। মিটিং-এ যাবার আগে স্টেশনে এসে টিকেট করে গিয়েছিলাম। তিন জনের জন্য চারটি টিকেট কিনেছিলাম যাতে অন্তত একজন আরামে যেতে পারেন। তাড়াতাড়ি ডিনার করে সাড়ে দশটার মধ্যেই স্টেশনে চলে এসেছি।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সাথে আমার পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। ১৯৮০ সালে আমি প্রথমবার ঢাকায় এসেছিলাম আমার বাবার সাথে বেড়াতে। প্রথম দেখার অনুভূতি স্মৃতিতে রয়ে যায় কোন না কোনভাবে। তারপর আরো অনেকবার এসেছি এই স্টেশনে। প্রতিবারই সেই প্রথম বারের অনুভূতি ঘুরে ফিরে মনে আসে। সেই সময় ট্রেনের নামকাওয়াস্তে একটা সময়সূচি ছিল। অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতো প্লাটফরমে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে। অবশেষে ট্রেন যখন প্লাটফরমে ঢুকতো, কার আগে কে উঠবে হুড়োহুড়ি লেগে যেতো। মেইল ট্রেন, কোন সিট নম্বর থাকতো না। উচ্চ শ্রেণির টিকেটে হয়তো থাকতো। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণির চেয়ে উঁচুদরের টিকেট কেনার সামর্থ্য ছিল না আমার বাবার। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণিতেও আমাদের সুখের অভাব ছিল না। গাদাগাদি ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকার পর দেখা যেতো সবগুলো সিটেই লম্বা লম্বা গামছা মেলে রেখে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলিষ্ঠ মানুষ। তাদেরকে টাকা দিলে তারা গামছা সরিয়ে বসতে দিতো। অনেকে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতো। কিন্তু গামছাওয়ালারা ভালো করেই জানে তৃতীয় শ্রেণির টিকেটের ক্ষমতা কত। এখন অনেককিছুই বদলে গেছে।

ট্রেন প্লাটফরমেই দাঁড়ানো ছিল। আমরা আস্তে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এসে বগি খুঁজে বের করে জায়গামতো বসলাম। আমাদের তিন জনের জন্য চারটি সিট। রিফাৎ আরা ম্যাডাম আর নাসরীন ম্যাডাম জানালার পাশে মুখোমুখি বসলেন। আমি নাসরীন ম্যাডামের পাশে বসলাম। হকারের কাছ থেকে সানন্দা আর দেশ কিনলেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম। হকার টাকা নিয়ে চলে গেলো। অন্য যাত্রীদের কেউ কেউ কিনলেন, বেশিরভাগই ম্যাগাজিনগুলির প্রচ্ছদ উল্টেপাল্টে দেখে ফেরত দিলেন। হকার অন্য কম্পার্টমেন্টে চলে গেলো। কিন্তু একটু পর প্লাটফরম দিয়ে দৌড়ে এসে দাঁড়ালো আমাদের জানালায়। জানালার কাচ নামানো ছিল। কাচে টোকা মেরে কিছু একটা বলছে দেখে দাঁড়িয়ে জানালার কাচ উঠালাম।

“ম্যাডাম, আপনি টাকা বেশি দিছেন। পঞ্চাশ টাকা বেশি দিছেন।“ বলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিলো জানালার লোহার শিকের ভেতর দিয়ে। রিফাৎ আরা ম্যাডাম ব্যাগ থেকে ৬৫ টাকা ভাঙতি দিয়েছিলেন পঞ্চাশ দশ আর পাঁচ টাকায়। পঞ্চাশ টাকার নোট একটার বদলে দুইটা চলে গিয়েছিল। যখন ম্যাগাজিন নিয়ে কম্পার্টমেন্টের ভেতর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল তখন তাকে খেয়ালও করিনি। সানন্দার প্রচ্ছদের ঝলমলে মডেলের দিকে তাকিয়েছিলাম, হকারের মুখের দিকে তাকাইওনি। এখন তাকে দেখছি অপার বিস্ময়ে। তেরো চৌদ্দ বছরের এক কিশোর। কিন্তু সে তো ভালো করে দেখার সুযোগও দিলো না। রিফাৎ আরা ম্যাডাম টাকাটা নিতেই সে শীর্ণ হাতটা টেনে নিয়ে দ্রুত চলে গেল অন্যদিকে। আরো অনেকগুলি ম্যাগাজিন বিক্রি করতে পারলে হয়তো সে পঞ্চাশ টাকা কমিশন পাবে। সেটা তার ন্যায্য পাওনা। কেউ ভুল করে তাকে টাকা বেশি দিয়েছে বলে সে তা রেখে দেবে – এমন অসৎ সে নয়। কিন্তু মানুষের অসততায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া আমরা নির্ভেজাল সততা দেখলে ধাক্কা খাই। কয়েক মিনিট লাগলো আমাদের এই ধাক্কা সামলাতে।

“আপনি কি প্রায় সময়ই এরকম বেশি টাকা দিয়ে দেন?” – হাসতে হাসতে রিফাৎ আরা ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করলাম।

“কই, আর কেউ তো কখনো টাকা ফেরত দিতে আসেনি।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডাম দেশ-এর পাতা উল্টাতে উল্টাতে উদাসভাবে বললেন।

জানালার বাইরে তাকালাম। প্লাটফরমে মানুষ ছুটতে শুরু করেছে। ট্রেন ছাড়ার আর বেশি দেরি নেই। হঠাৎ মনে হলো তরণীদাকে দেখলাম। তরণীদা আমার দিদির কলিগ। আমাকে খুব স্নেহ করেন। নেমে একটু সৌজন্য দেখানো দরকার। দ্রুত নামলাম। নেমেই দেখলাম তরণীদার সামনে দিদি দাঁড়িয়ে আছে। সে যে ঢাকায় এসেছে তাও আমি জানি না। অফিসের কাজে তাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করতে হয় অনেক। আমাকে দেখে সেও একটু অবাক হলো। বললো, “তোর না সকালে চলে যাওয়ার কথা ছিল?”

“মিটিং ছিল তাই সকালে যেতে পারিনি।“

দিদির সিটও আমাদের কম্পার্টমেন্টে। তার সাথে উঠে এলাম। তার সিট আমাদের তিন সিট আগে। সেও দুইটা সিট নিয়েছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে একা ভ্রমণ করতে গেলে মেয়েদের যে কত ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। সেই অবাঞ্ছিত সমস্যা এড়ানোর জন্য তাদের কত কষ্ট সহ্য করতে হয়। ম্যাডামদের সাথে আমার দিদির এই প্রথম দেখা। তাদের তিনজনকে একসাথে বসতে দিয়ে আমি দিদির সিটে গিয়ে বসলাম। ট্রেন যথাসময়ে ছেড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কম্পার্টমেন্ট চুপচাপ হয়ে গেছে। রাত নিঝুম হবার সাথে সাথে গাড়িভরা ঘুম নেমে এসেছে। আমার সামনের দুজন যাত্রীই নাক ডাকছেন। একজন একটু মৃদু, অন্যজন একটু জোরালো। নাক ডাকার ফ্রিকোয়েন্সির পদার্থবিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী কোন এক সময় এই দুইজনের নাক একসাথে তীব্র জোরে ডেকে উঠবে, অর্থাৎ রেজোনেন্স বা অনুরণন হবে। সেই অদূর ভবিষ্যতের অনুরণনের কথা ভেবে একটু হাসি পেলো।

 

জানালার বদ্ধ কাচে বিন্দু বিন্দু শিশির জমেছে। এই ট্রেন সব স্টেশনে থামে না। বিমানবন্দর পার হয়ে এসেছে অনেক আগে। এরপর সম্ভবত ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে থামবে। জানালার কুয়াশা ভেদ করে মাঝে মাঝে গুচ্ছ গুচ্ছ আলো জোনাকির মত পিছু হটে যাচ্ছে। ট্রেনের একঘেয়ে তীব্র যান্ত্রিক শব্দে ঝিমুনি চলে আসছে। মনে হচ্ছে ঐ দূরে কোন গ্রামের বাড়িতে সবাই গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে অতল ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ তীব্র স্বরে চিৎকার করছেন, “ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে, ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে, ব্যাগ ।“ স্বাভাবিক রিফ্লেক্সে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম রিফাৎ আরা ম্যাডাম “ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে” বলে চিৎকার করছেন। আমি দেখলাম কেউ একজন ম্যাডামের ব্যাগটা নিয়ে কম্পার্টমেন্টের ভেতর দৌড়ে দরজার দিকে চলে যাচ্ছে। আমি কোন কিছু চিন্তা না করেই তাকে ধরার জন্য দৌড় দিলাম। আমি মোটেও ভালো দৌড়াতে পারি না। কিন্তু লোকটা দৌড়ে আমার চেয়েও খারাপ। আমি তাকে ধরে ফেললাম। ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে তার কলার ধরে ফেললাম। লোকটার গায়ের জোর আমার চেয়েও কম। নইলে সে আমার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালাতে পারতো। তাকে টেনে নিয়ে ম্যাডামদের কাছে আসতে নাসরীন ম্যাডাম দ্রুত ব্যাগটা নিয়ে নিলেন নিজের কাছে। বুঝতে পারলাম ব্যাগটা তাঁর। এবার আর উপরে রাখলেন না, সিটের নিচে পায়ের কাছে রাখলেন।

 

কামরার গাড়িভরা ঘুম টুটে গেল। অনেকেই ম্যাডামের চিৎকার শুনেছেন। লোকটি ব্যাগ নিয়ে যেদিকে যাচ্ছিলেন সেদিকের যাত্রীরাও শুনেছেন। কিন্তু কেউই উঠে দাঁড়াননি, ধরার চেষ্টা করেননি। হয়তো ভয়ে করেননি, বা সাঁতে-পাঁচে-থাকেন-না বলেই করেননি। এখন লোকটিকে নিয়ে আমি কী করি? আমার পায়ের জুতা খুলে রেখেছিলাম। শুধু মোজা পায়েই ছুটে গিয়েছিলাম। এখন লোকটাকে কি বলবো, ভাই আপনি আমার সিটে একটু বসেন, আমি জুতাজোড়া পরে নিই, তারপর আপনাকে রেলপুলিশের কাছে হস্তান্তর করবো। আমার সিটের আশেপাশে কিছু যাত্রী সিটে বসে বাক্য-বীরত্ব দেখাচ্ছেন। কত হিংস্র তাঁদের মন্তব্য। একজন বলছেন, তার চোখ দুটো গেলে দেন। একজন উঠে লোকটির মুখে ঘুষি মারতে উদ্যত হলেন। “কী করছেন আপনি? প্লিজ। গায়ে হাত দেবেন না। বসেন আপনি।“ – বেশ জোরে ধমক দিতে হলো।

এ তো মহা বিপদে পড়লাম। এদের হাতে এই লোককে তুলে দিলে এরা তো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। রাতের ট্রেনে পুলিশ থাকার কথা। যে যাত্রীরা বীরত্ব দেখাচ্ছেন, তাদের একজনকে বললাম, কাইন্ডলি আপনাদের কেউ কি রেল পুলিশকে খবর দিতে পারেন?

“এদিকে আসবে ওরা একটু পরেই।“ – বলে দায়িত্ব এড়ালেন তিনি। কিল ঘুষি মারতে উৎসাহ আছে, আইননিষ্ঠ কাজ করতে উৎসাহ নেই।  

আমি চোরের দিকে তাকালাম। বয়স ৩০-৩৫ এর বেশি হবে না। খুবই দুর্বল। পোশাক পরিচ্ছদে আধুনিক। পরিষ্কার শার্ট-প্যান্ট আর শীতের জ্যাকেট। হাতেনাতে না ধরলে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারতাম না যে এই লোক ট্রেন থেকে একটা ব্যাগ চুরি করে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো।

রেলপুলিশ যখন এদিকে আসবেই – তাহলে তাদের আর খোঁজার দরকার নেই। লোকটিকে আমার সিটে জানালার পাশে বসিয়ে তার পাশে আমি বসলাম। আমার সামনের সিটের যাত্রীদ্বয়ের নাসিকা-গর্জন অনুরণন পর্যায়ে পৌঁছার আগেই থেমে গেছে। দেখলাম তাঁরা দু’জনই চোখ বড় বড় করে আমার পাশে বসা ‘চোর’-এর দিকে তাকাচ্ছেন। আমি পায়ে জুতা পরতে পরতে জিজ্ঞেস করলাম, “চুরি করছিলেন কেন?”

“বিলিভ মি, আমি ওটা আমার ব্যাগ মনে করেছিলাম। খোদার কসম।“ – লোকটা গলা নিচু করে অনেকটা কাঁদো-কাঁদো ভাবে বললো। মানুষ মিথ্যা বলার সময়ও কী কারণে খোদার নামে কসম খায় জানি না। এরা কি আসলেই খোদায় বিশ্বাস করে?

“আপনার সিট কি এই কম্পার্টমেন্টে?”

লোকটা কোন উত্তর দিলো না। আমি তাঁকে বুঝাতে চাইলাম যে তার কথাগুলি কতটা অবিশ্বাস্য।

“অন্য একটা কম্পার্টমেন্টে আপনি এতক্ষণ বসেছিলেন। আর আপনি ভেবেছিলেন যে আপনার ব্যাগটা এখানে ম্যাডামদের সিটের উপরে আছে। আর আপনি নামার সময় তা নিয়ে নেমে যাবেন। এটা কেউ বিশ্বাস করবে?”

আমি লোকটার সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলছি দেখে আমার সামনে বসা যাত্রীদ্বয় এমনভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছেন যেন আমিও এই লোকের খালাতো ভাই।

জুতা পরে উঠে দাঁড়ালাম। এই লোককে এবার রেলপুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। লোকটা বললো, “ভাই আমারে ছেড়ে দেন। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নেমে যাবো।“

“আমি আপনাকে কীভাবে ছাড়ি বলেন। পুলিশকে দেবো। নইলে এরা আপনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। দ্যাখেন সবাই কীভাবে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। ছেড়ে দিলেই আপনাকে ছিঁড়ে ফেলবে সবাই মিলে।“

ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন চলে আসছে। কয়েকজন যাত্রী এখানে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় দু’জন রেলপুলিশের দেখা পাওয়া গেল। হাতে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই নেই। পোশাক দেখে এপার্টমেন্ট হাউজের নাইটগার্ডের মতো লাগছে।

“কী হয়েছে এখানে?”

“এই লোকটা ব্যাগ চুরি করে পালাচ্ছিল। ধরা পড়েছে।“

“এই ব্যাটা? দেখতে তো ভালা মানুষের পোলা মনে হয়।“ – একজন পুলিশ মন্তব্য করলেন।

“নিয়ে যান একে।“ – বললাম।

লোকটাকে নিয়ে পুলিশ দুজন যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে চলে গেলেন। সম্ভবত অন্য কম্পার্টমেন্টে তাদের কাজকর্মের জায়গা। পুলিশ চলে যাওয়ার পর সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমার দিদি চোখ বড় বড় করে পেছন ফিরে দেখছে আমাকে। দরকার না হলে সে কিছুই বলবে না। নিজের অফিসিয়াল পরিচয়ও দেবে না।

ভেবেছিলাম আমার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু একটু পরেই একজন পুলিশ আবার এলেন আমার কাছে। “আপনাকে একটু আসতে হবে। ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হবে।“

একেবারে দাপ্তরিক পরিভাষা ব্যবহার করছেন তিনি। পুলিশের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট পার হয়ে পাওয়ার কারের কাছাকাছি চলে এলাম। লোকটাকে একটা সিটে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আরেকজন পুলিশ লোকটার সামনের সিটে বসে পা নাচাচ্ছেন।

“কী হয়েছিল বলেন তো?” – পুলিশটি পা নাচাতে নাচাতে মাথা কাৎ করে বললেন।

“এই লোকটা ব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছিল। আমি ধরে ফেলেছি।“

“আপনি কী করেন?”

“আমি কী করি সেটা কি জরুরি?”

“জি, আমাদের তো সবার পরিচয় লাগবে।“

“আমি বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের …” – পুরোটা বলার আগেই পা নাচানো পুলিশ ইলেকট্রিক শক খাওয়া মানুষের মত তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা তুলে একটা স্যালুট দিয়ে ফেললেন।

“সরি স্যার। আপনারে চিনতে পারি নাই। কিন্তু ঠিকই আন্দাজ করছিলাম যে ডিফেন্সের কেউ হবেন। নইলে এদেরকে ধরে ফেলা তো এত সহজ না। সরি স্যার। আপনাকে কষ্ট দিছি।“

এরা আমাকে এয়ারফোর্সের অফিসার মনে করছে। শরীরের স্নেহপদার্থ আর চুলের দৈর্ঘ্য বাড়তে না দিলে মাঝে মাঝে কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। মনে মনে হয়তো এই সুবিধাটা আমি চাচ্ছিলামও। নইলে সরাসরি শাহীন কলেজ না বলে এত ঘটা করে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স বলার দরকার কী ছিল? এদের ভুল ভাঙিয়ে ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই। শেষে আবার আমাকেই ভুয়া অফিসার বলে বেঁধে রাখবে।

“স্যার, চিটাগং-এ স্টেশানে আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। স্টেশনেই স্যার ফর্মাল কমপ্লেইনটা করতে হবে। আমি সব ঠিক করে রাখবো স্যার।“ – কাঁচুমাচু হয়ে বললেন পুলিশ। আমার হঠাৎ বন্ধু বিশু, নুপুর, আর শৈবালের কথা মনে পড়লো। তারা তিনজন একটা নাটকে আর্মি অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। নাটকের আগে এবং পরে তাদের কথাবার্তা চাল-চলন সবকিছুই মিলিটারিদের মতো হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে কিছু জিজ্ঞেস করলেও তারা খেঁকিয়ে উঠতো, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলতো। এখন আমার অবস্থাও অনেকটা সেরকম হয়ে যাচ্ছে। ফিরে আসার সময় মনে হলো মেরুদন্ড একটু বেশি সোজা করে হাঁটছি।

কম্পার্টমেন্টে ফিরে এসে দেখলাম আবার সবাই ঘুমে নিস্তেজ হয়ে গেছে। দিদির কাছে গেলাম। দেখলাম নাসরীন ম্যাডাম চোখ বন্ধ করে আছেন। ঘুমাচ্ছেন কি না জানি না। রিফাৎ আরা ম্যাডাম জেগে আছেন।

“কী বললো তোকে?” – দিদি জিজ্ঞেস করলো।

“না, কী হয়েছিল এসব। বললো ওরা সব ঠিক করবে। স্টেশনে নামার পর আসবে ওরা আবার ফর্মালিটির জন্য।“

“আমি তো ভয়ে ভয়ে ছিলাম আপনি যদি আবার তাকে মারতে শুরু করেন।“– খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম। আমি একটু অবাক হলাম। ম্যাডাম কি আমাকে গুন্ডা-টুন্ডা মনে করেন নাকি?

আর কোন ঘটনা ছাড়াই চট্টগ্রামে পৌঁছে গেলাম। ট্রেন থেকে নেমে সবাই ওভারব্রিজের দিকে যাচ্ছি। দেখলাম নাসরীন বানু ম্যাডাম আমাদেরকে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আমরা ব্রিজের উপর থেকেই দেখলাম তিনি ব্রিজ থেকে নেমে তাঁর ব্যাগ নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেলেন। আমরা ব্রিজের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ট্যাক্সি দরদাম করে উঠতে যাবো – এমন সময় সেই পুলিশ দৌড়ে এলেন।

“স্যার, চলে যাচ্ছেন?”

“জ্বি।“

“ওইটাকে কী করবো স্যার? মামলা করতে হবে তো। আলামত লাগবে। ব্যাগটা লাগবে স্যার।“

“ব্যাগের মালিক তো ব্যাগ নিয়ে চলে গেছেন।“

“তাহলে স্যার?”

“রেলওয়ে অথরিটি বাদী হয়ে নালিশটা করে দেন। মনে করেন আপনি ধরেছেন।“

“কিন্তু স্যার, ধরেছেন তো আপনি।“

“তাতে কোন অসুবিধা নেই। আপনার কাজ আমি করে দিয়েছি। বাকিটা আপনারা করেন। আইনগতভাবে যা করার করেন।“

“ব্যাগের মালিককে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে স্যার। ব্যাগটা লাগবে।“

“মালিক চলে গেছেন। তাহলে আর কী করবেন। লোকটাকে ছেড়ে দেন।“

চলে এলাম। আমাদের আইনী ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল। এই যে চুরির ঘটনা, এটাতে আইনগতভাবে বাদী হতে হবে নাসরীন বানু ম্যাডামকে। কারণ ব্যাগটা তাঁর। তাহলে তাঁর সমস্ত কাজ ফেলে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে যতদিন এই মামলা চলবে ততদিন। ব্যাগটা চোরের হাত থেকে উদ্ধার পেলেও থানা থেকে উদ্ধার পাবে না, আলামত হিসেবে রেখে দেবে। অহেতুক ঝামেলায় কে জড়াতে চায়? নাসরীন বানু ম্যাডাম এসব জানেন বলেই তো নিরবে প্রস্থান করেছেন।

এই ঘটনার এখানেই শেষ। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ঘটনাটা কীভাবে যেন জেনে গেছে। নাজমুল খুব সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলো, “স্যার আপনি নাকি বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে চোর ধরেছেন?”

আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি তো জানি কেমন বীর, আর কেমন তার বিক্রম!

>>>>>>>>> 

বছরের শেষ দিনগুলিতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলছে। মাসের মধ্যে কয়েকটা হরতাল হচ্ছে। নভেম্বরের শেষে  পঞ্চম সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ১৫ ফেব্রুয়ারি। বলা হচ্ছে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য এই নির্বাচন হতেই হবে। কিন্তু বিরোধী দলগুলি এই নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়। এর মধ্যেই আমাদের কলেজে যেতে হচ্ছে। স্কুল সেকশানের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে হরতালের মধ্যেই।

১৯৯৬ শুরু হয়েছে হরতাল রাজনৈতিক সংঘর্ষ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে। কলেজে যাওয়া-আসা প্রচন্ড কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে। খুব ভোরে উঠে কলেজে চলে যাই। আবার ছুটির পর অনেক কষ্টে রিক্সা, ট্যাম্পু ইত্যাদিতে বাসায় ফেরা। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ভর্তির শর্ত পূরণের জন্য আই-ই-এল-টি-এস দিতে হবে। ঢাকায় গিয়ে ফর্ম ফিল আপ করে এলাম। জানুয়ারিতে কলেজের স্কুল সেকশানের ভর্তি পরীক্ষা হলো। ১৯৯৬ সালের উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষা হলো। তার কয়েকদিন পর থেকে রমজান শুরু হলো। কলেজ বন্ধ হয়ে গেল মাসখানেকের জন্য। জানুয়ারির শেষে ঢাকায় গিয়ে আই-ই-এল-টি-এস পরীক্ষা দিয়ে এলাম। তারপর বাড়িতে গেলাম। কিছুদিন থেকেই বুঝতে পারছিলাম শরীরে কিছু একটা হয়েছে। মুখের রুচি চলে গেছে একেবারেই। কোন কিছুতেই কোন স্বাদ পাই না। এর মধ্যে শত বিক্ষোভ, হরতাল, আন্দোলন করেও ১৫ ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচন ঠেকানো গেলো না। ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে অবরোধের হরতাল চলছিলো। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়ে যাবার পর বিএনপি আবার সরকার গঠন করেছে। সম্মিলিত বিরোধী দল সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।  ঈদের পর ২৮ ফেব্রুয়ারি কলেজ খুলেছে। ইতোমধ্যে আমার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। বিলিরুবিন বেড়ে গেছে অনেক গুণ। চোখ, চামড়া ক্রমশ হলুদ হয়ে যাচ্ছে। জন্ডিজ নামক ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। ডাক্তার বলেছেন মাসখানেক একেবারে বিছানায় শুয়ে থাকতে। কিন্তু কলেজ থেকে ছুটি নিতে হবে তো। ডাক্তারি সার্টিফিকেট ব্যাগে নিয়ে অসহযোগের ভেতর কলেজে যাবার জন্য বের হলাম ভোর পাঁচটায়। চকবাজারে গিয়ে রিফাৎ আরা ম্যাডাম আর লাইলুন নাহার ম্যাডামের সাথে দেখা। তাঁরা আমার কোন কথাই শুনতে চাইলেন না, আমাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। আমি ক্ষীণকন্ঠে বলার চেষ্টা করেছিলাম, “ছুটি না নিয়ে অনুপস্থিত থাকলে যদি কোন সমস্যা করে?”

“আপনার চাকরিও যদি চলে যায়, তাহলেও আমি আপনাকে এই অবস্থায় কলেজে যেতে দেবো না।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডামের এত কঠোর স্নেহ আগে কখনো দেখিনি। বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নড়াচড়া করার শক্তিও আমার অবশিষ্ট নেই।

পরের একমাস সারাদেশে যে প্রচন্ড রাজনৈতিক ঝড় বয়ে গেছে তার খবর আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে পেয়েছি। অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, এতকিছুর ভেতরেও কলেজে ক্লাস হয়েছে। স্যার-ম্যাডামদের যেতে হয়েছে। এত কষ্ট করে কলেজে যাবার পর আবার আমার বাসায় এসে আমাকে নিয়মিত দেখে গেছেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম, হোসনে আরা ম্যাডাম, পূর্ণিমা ম্যাডাম, শংকর স্যার, ইভা – সবাই। অনেক ছাত্রও এসেছিল। এঁদেরকে ঠিকমতো বসানোর জায়গাও আমার নেই। অথচ পরম স্নেহে আমার বিছানার পাশে এসে বসেছেন উনারা। এত ভালোবাসা আমি কোথায় রাখি!

অবশেষে দেশের রাজনীতির আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেল। ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করলেন। ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দেয়া হলো। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলো।

এর এক সপ্তাহ পর আমি কলেজে গেলাম। নতুন বিল্ডিং-এ নতুন বছরের ক্লাস শুরু করলাম এপ্রিলে। এবছরও ক্লাস ফাইভে অংক দিয়েছে আমাকে। ফার্স্ট ইয়ারের ফিজিক্স তো আছেই। সেকেন্ড ইয়ারের কোচিং-ও চলছে। একটা ক্লাস করে টিচার্স রুমে ফিরছি, করিডোরে ফার্স্ট ইয়ারের একজন ছাত্রী সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলো, “স্যার, আপনি নাকি বিয়ে করেছেন?”

“তোমাকে কে বললো?”

“সবাই জানে স্যার। আপনি বিয়ে করেছেন বলেই এতদিন ছুটিতে ছিলেন।“

আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। জন্ডিজের সময় শুয়ে থাকতে থাকতে মানুষ একটু নাদুসনুদুস হয়ে যায়। আমার অবস্থাও হয়তো সেরকম হয়েছে। অসুস্থ ছিলাম বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। আমি একটা অর্থহীন হাসি দিলাম। সে কী বুঝলো কে জানে।

>>>>>>>>>>>>>>>>>>>> 


Latest Post

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা - দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইল এলাকায় কিছু পুলিশ সদস্য ইয়াসমিন নামের এক ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এই ঘ...

Popular Posts