Showing posts with label ভালোবাসা. Show all posts
Showing posts with label ভালোবাসা. Show all posts

Wednesday, 12 June 2019

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক ভালোবাসা - পর্ব-৫ (শেষ পর্ব)


আইনস্টাইনের তত্ত্ব ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাঁর নোবেল পুরষ্কার পাওয়াটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। মিলেইভা ডিভোর্সে রাজি হলেন এই শর্তে যে ভবিষ্যতে আইনস্টাইন যদি নোবেল পুরষ্কার পান, পুরষ্কারের পুরো টাকাটাই মিলেইভাকে দিয়ে দিতে হবে। আইনস্টাইন শর্ত মেনে নিলেন।
            
১৯১৮ সালের শেষের দিকে ডিভোর্সের আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। আদালত থেকে দেয়া বিবাহ-বিচ্ছেদের শর্তগুলো পূরণ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আইনস্টাইনের। মনের মিল হচ্ছে না বা ভালোবাসা মরে গেছে জাতীয় যুক্তিগুলো বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট কারণ নয়। আদালতের শর্ত পূরণ করার জন্য আইনস্টাইন নিজেকে  ব্যাভিচারী ঘোষণা করে লিখিত বয়ান দিলেন। ফলে কোর্টের খরচ ছাড়াও ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে মোটা অংকের জরিমানাও দিতে হলো তাঁকে।
           
 সুইজারল্যান্ডের আদালত আইনস্টাইন ও মিলেইভার বিবাহ-বিচ্ছেদ অনুমোদন করল। অনুমোদনের দিন থেকে দুমাস পর ডিভোর্স কার্যকর হবে। আইনস্টাইন যেহেতু আইনগতভাবে স্বীকৃত ব্যাভিচারী তাঁকে শর্ত দেয়া হয়েছে পরবর্তী দুবছরের মধ্যে তিনি বিয়ে করতে পারবেন না।
            
১৯১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলেইভার সাথে আইনস্টাইনের বিবাহ-বিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে যায়। আইনস্টাইন নিজের বাসা ছেড়ে দিয়ে এলসার বাড়িতে এসে উঠলেন। এলসা আইনস্টাইনের জন্য থাকার ও পড়ার ঘর সাজিয়ে রেখেছেন। এলসার সাথে বিয়ে হতে এখন আর কোন বাধা নেই। সুইজারল্যান্ডের আদালত বিয়ের ব্যাপারে যে দুবছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তা বার্লিনে না মানলেও চলে। এলসা বিয়ের আয়োজন শুরু করলেন। 
            
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ করা যাচ্ছিলো না সুযোগের অভাবে। সূর্যের অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের টানে আলোর গতিপথ সত্যিই পরিবর্তিত হয় কিনা তা পরীক্ষা করা সম্ভব সূর্যের পূর্ণগ্রহণের সময়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্যার আর্থার এডিংটন তাঁর অবজারভেটরি থেকে শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখলেন সূর্যের পূর্ণগ্রহণের সময় আলোর গতিপথ সত্যিই বদলে গেছে। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি সত্যি বলে প্রমাণিত হলো।
            
এতদিন ইউরোপে খ্যাতিমান ছিলেন আইনস্টাইন। এখন রাতারাতি পৃথিবীবিখ্যাত হয়ে গেলেন। পৃথিবীব্যাপী নানারকম মিথ তৈরি হতে লাগলো আইনস্টাইনের প্রতিভা সম্পর্কে। লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো পৃথিবীর আনাচে কানাচে।
            
১৯১৯ সালের ৬ই জুন আইনস্টাইন ও এলসার বিয়ে হলো খুবই ঘরোয়া ভাবে। আইনস্টাইন ও এলসার বিয়েটা যতটা ভালোবাসার তারচেয়েও বেশি পারস্পরিক প্রয়োজনের। আইনস্টাইনের এমন কাউকে দরকার ছিলো যাকে তাঁর কষ্টগুলোর ভাগ দিতে পারবেন। এলসার মধ্যে সেরকম একটি মানসিক আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন আইনস্টাইন। আর এলসা আটত্রিশ বছর বয়সে দুটো কিশোরী মেয়ে নিয়ে ডিভোর্সি। তাঁর দরকার একটা ভালো সামাজিক পরিচয়। আইনস্টাইনের মত বিখ্যাত মানুষের স্ত্রী হওয়াটাকেই তিনি সবচেয়ে বড় পরিচয় বলে মনে করেন।
            
১৯২০ সালের শুরুতে আইনস্টাইনের মায়ের মৃত্যু হয়। মিলেইভাকে তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেন নি। মিলেইভার সাথে ডিভোর্স এবং নিজের বোনের মেয়ে এলসার সাথে আইনস্টাইনের বিয়ে হওয়াতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন তিনি আইনস্টাইন ও এলসার সাথে ছিলেন। ১৯২১ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে আমেরিকা সফর করেন আইনস্টাইন ও এলসা।

 



      
১৯২২ সালে আইনস্টাইনকে ১৯২১ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। আইনস্টাইন পুরষ্কারের পুরো এক লাখ একুশ হাজার পাঁচশ বাহাত্তর সুইডিশ ক্রোনার পাঠিয়ে দেন মিলেইভাকে। 






মিলেইভা সেই টাকা দিয়ে জুরিখে তিনটি বড় বড় বাড়ি কিনে দুটো ভাড়া দিলেন এবং একটিতে দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতে শুরু করলেন।

নোবেল লরিয়েট হবার পর আইনস্টাইনের খ্যাতি আরো বেড়ে গেল। পৃথিবীর নানা জায়গার বিখ্যাত সব মানুষের সাথে তাঁর ওঠাবসা।
            
১৯২৪ সালে এলসার বড়মেয়ে আইল্‌সের বিয়ে হয়ে গেলো সাংবাদিক রুডল্‌ফ কাইজারের সাথে। আইল্‌স এতদিন আইনস্টাইনের সেক্রেটারির কাজ করছিলো। এখন আইনস্টাইনের নতুন সেক্রেটারির দরকার। বন্ধু হ্যান্স বুশামের তেইশ বছর বয়সী ভাগ্নি বেটি নিউম্যানকে নিজের সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দিলেন আইনস্টাইন। বেটি নিউম্যান খুবই সুন্দরী। বেটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লেন ৪৫ বছর বয়সী আইনস্টাইন।             

এলসা তাঁর স্বামীকে বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকাতে চান না। কারণ তিনি জানেন বাধা দিলে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবেন আইনস্টাইন। তিনি এটাও জানেন যে একসময় আপনা-আপনিই কেটে যাবে আইনস্টাইনের মোহ। সত্যিই তাই। বছর খানেক পর বেটি নিউম্যানের প্রতি মোহ কেটে গেল আইনস্টাইনের। তারপর কিছুদিন মার্গারেট লেনবাখ নামে এক অস্ট্রিয়ান মহিলার প্রতি ঝুঁকলেন আইনস্টাইন। এবারো কিছুই বললেন না এলসা। 

বয়স বাড়ছে আইনস্টাইনের। বড় ছেলে হ্যান্সের বয়স এখন ২৩। জুরিখের পলিটেকনিক থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে সে। বাবার সাথে তার সম্পর্ক মোটেও ভাল নয়। মায়ের কষ্ট কীভাবে ভুলবে হ্যান্স? বাবার কাছ থেকে সবসময় দূরে থাকতে চেয়েছে সে। কিন্তু আইনস্টাইন পিতৃত্বের অধিকার খাটাতে চেয়েছেন সবসময়। হ্যান্সের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটাকে পছন্দ করেননি তিনি। অথচ হ্যান্স সিভিল ইঞ্জিনিয়ারই হয়েছে। এখন হ্যান্স ফ্রেইডা নেচ নামে এক মেয়েকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে। আইনস্টাইন যখন খবর পেলেন যে ফ্রেইডা হ্যান্সের চেয়ে বয়সে নয় বছরের বড় - ভীষণ রেগে গেলেন। যেকোন ভাবেই তিনি হ্যান্সের বিয়ে আটকাতে চাইলেন। তিনি ফ্রেইডা সম্পর্কে যত খবর নেয়া সম্ভব সব নিলেন। ফ্রেইডা খুবই বেঁটে, ফ্রেইডার মা মানসিক রোগী।
           
আইনস্টাইন যুক্তি দেখাচ্ছেন এতে হ্যান্সের ছেলে-মেয়ে হলে তাদের বামন ও পাগল হবার সম্ভাবনা আছে। এদিকে মিলেইভারও পছন্দ নয় ফ্রেইডাকে। মা-বাবার অমত সত্ত্বেও হ্যান্স বিয়ে করল ফ্রেইডাকে। বিয়ের পরেও আইনস্টাইন হাল ছাড়েন নি। হ্যান্সকে পরামর্শ দিচ্ছেন যেন কোন সন্তান না নেয়। তিনটি ছেলে হয় হ্যান্স ও ফ্রেইডার - ডেভিড, ক্লাউস ও ব্যানহার্ড। ডেভিড ও ক্লাউস শৈশবেই মারা যায়।
            
১৯২৮ সালে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন আইনস্টাইন। বেটি নিউম্যানের প্রতি তাঁর আসক্তি কমে যাবার সাথে সাথেই তাকে বরখাস্ত করেছিলেন এলসা। তারপর ভেবেছিলেন আর কোন সেক্রেটারি নিয়োগ দেবেন না। এতদিন নিজেই করছিলেন সেক্রেটারির কাজ। কিন্তু আইনস্টাইনের শত শত চিঠির উত্তর দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে গেলেন তিনি। দেখলেন একজন ফুলটাইম সেক্রেটারি না হলে চলছেই না।
            
এবার সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পেলেন এলসার এক বান্ধবীর ছোটবোন হেলেন ডুকাস। ছিপছিপে লম্বা সুন্দরী ব্যক্তিত্বময়ী হেলেন ডুকাস শুরুতে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলেন এতবড় একজন বিজ্ঞানীর সাথে কীভাবে কাজ করবেন। কিন্তু আইনস্টাইনের হাসিখুশি অন্তরঙ্গ ব্যবহারে খুশি হয়ে গেলেন হেলেন ডুকাস।
            
প্রথম দিন থেকেই আইনস্টাইনের সমস্ত কাজের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। এরপর আইনস্টাইনের মৃত্যু পর্যন্ত আইনস্টাইনের পরিবারের একজন হয়েই ছিলেন হেলেন ডুকাস। আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর হেলেন ডুকাস প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড স্টাডির আর্কাইভে আইনস্টাইনের ডকুমেন্টস আগলে রাখেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত। আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত দুর্বলতাগুলো যতদিন পেরেছেন গোপন করে রাখতে চেষ্টা করেছেন হেলেন ডুকাস। ধরতে গেলে আইনস্টাইনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন হেলেন। আইনস্টাইনের দেখাশোনা করতে করতে নিজের ব্যক্তিগত সুখদুঃখের কথা ভাবারও সময় পাননি তিনি, বিয়েও করেনি।
            
জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। ইহুদিদের অধিকার খুবই কমে যাচ্ছে। আইনস্টাইনের বিরুদ্ধেও নানারকম গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ১৯২৯ সালে বার্লিনের কাছে ক্যাপুথ নামে একটা গ্রামে হ্রদের পাশে একটা সামার হাউজ তৈরি করিয়েছেন আইনস্টাইন। গ্রীষ্মকালটা তিনি এখানেই কাটান।
            
পরের বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার আমেরিকায় গেলেন বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে। সামারে যখনই তিনি ক্যাপুথের বাড়িতে আসেন - টনি মেন্ডেল নামে এক ধনী ইহুদি বিধবা আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে আসেন সুযোগ পেলেই। শুরুতে এলসার সাথে ভাব জমিয়েছেন সুন্দরী মেন্ডেল। এলসা চকলেট পছন্দ করেন। মেন্ডেল তাঁর লিমোজিন থেকে নেমেই এলসার হাতে তুলে দেন চকলেটের প্যাকেট। তারপর আইনস্টাইনকে সাথে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে যান। বার্লিনের অপেরা হাউজে, কনসার্টে টনি মেন্ডেলের সাথে আইনস্টাইনকে দেখা যায় মাঝে মাঝেই।        

একটা সীমা পর্যন্ত ছাড় দিতে রাজি আছেন এলসা। কিন্তু যখন মাঝে মাঝে টনি মেন্ডেলের বাড়িতে রাত কাটান আইনস্টাইন, এলসা সহ্য করতে পারেন না। আইনস্টাইনের সাথে এ নিয়ে কিছুটা মনোমালিন্য দেখা দিতে শুরু করেছে। এসময় আমেরিকা থেকে ডাক এলে খুশিই হন এলসা। 
১৯৩২ সালে আইনস্টাইন যখন ক্যালটেকে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে গেলেন, তখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির নবপ্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট ফর এডভান্সড স্টাডির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আব্রাহাম ফ্লেক্সনার আইনস্টাইনকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান।
            
১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় এলে বাধ্য হয়ে আমেরিকায় চলে যেতে হলো আইনস্টাইনকে। অক্টোবরের ১৭ তারিখ আইনস্টাইন, এলসা ও হেলেন ডুকাস আমেরিকায় এসে পৌঁছালেন। এলসার মেয়েরা তাদের স্বামীর সাথে প্যারিসে রয়ে যায়। আইনস্টাইনের বড় ছেলে হ্যান্স ও তার পরিবার, মিলেইভা এবং ছোট ছেলে এডোয়ার্ড সুইজারল্যান্ডে। এডোয়ার্ড খুবই অসুস্থ হয়ে মানসিক হাসপাতালে আছে। আইনস্টাইন আমেরিকায় আসার পর এডোয়ার্ড এবং মিলেইভার সাথে আর কখনোই দেখা হয়নি তাঁর।
            
আমেরিকায় আসার পর আস্তে আস্তে আমেরিকান সমাজে স্থান করে নিয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করলেন আইনস্টাইন। ১৯৩৪ সালে প্যারিসে অসুস্থ হয়ে মারা যায় এলসার বড়মেয়ে আইল্‌স। ছোটমেয়ে মার্গট ও তার স্বামী প্যারিস থেকে চলে আসে আইনস্টাইনের কাছে।
            
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের কাছে মার্সার স্টিটের নতুন বাড়িটি সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন এলসা। কিন্তু বেশিদিন উপভোগ করতে পারলেন না তিনি। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ১৯৩৬ সালের ২০শে ডিসেম্বর মারা যান এলসা। এলসার মৃত্যুর পর কেমন যেন বৈরাগ্য দেখা দেয় আইনস্টাইনের মধ্যে। আইনস্টাইনকে দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন হেলেন ডুকাস।
            
অনেকদিন থেকে রোগে ভুগছিলেন মিলেইভা। ছোট ছেলে এডোয়ার্ডের চিকিৎসার জন্য জলের মত টাকা খরচ হচ্ছে। আইনস্টাইন যে টাকা পাঠান তাতে কুলোয় না। দুটো বাড়ির ভাড়া থেকে যে টাকা পান তাতে নিজের খরচই ঠিকমত চলে না। মিলেইভা বাড়ি দুটো বিক্রি করে দিলেন। সেই টাকাগুলোও দ্রুত শেষ হয়ে গেল। বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা মিলেইভা শংকিত হয়ে পড়লেন অবশিষ্ট বাড়িটাও যদি বিক্রি করতে হয়। তিনি বাড়িটা আইনস্টাইনের নামে রেজিস্ট্রি করে দিলেন। ভাবলেন এতে অন্তত তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁইটা থাকবে।
            
এর মধ্যে একদিন বরফের ওপর আছাড় খেয়ে পা ভেঙে ফেললেন মিলেইভা। শয্যাশায়ী মিলেইভার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। আইনস্টাইন খবর পেয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মিলেইভা মারা গেলে এডোয়ার্ডকে দেখবে কে? এডোয়ার্ডের চিকিৎসা ও দেখাশোনার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠনের পরিকল্পনা করলেন আইনস্টাইন। তাঁর নামে লিখে দেয়া মিলেইভার বাড়িটা বিক্রি করে তিনি টাকাটা মিলেইভার নামে পাঠিয়ে দিলেন এডোয়ার্ডের ট্রাস্টে জমা দেয়ার জন্য। বাড়ি বিক্রি করার সময় আইনস্টাইন পরিষ্কার শর্ত দিয়েছেন যে মিলেইভা যতদিন বাঁচবেন ততদিন বিনাভাড়ায় ঐ বাড়িতেই থাকতে পারবেন।

 কিন্তু মিলেইভা ভাবলেন আইনস্টাইন মিলেইভার দেয়া বাড়ি নিতে চান না বলেই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। ভীষণ মনোকষ্ট পেলেন তিনি। অভিমান করে আইনস্টাইনকে কোন খবরই দিলেন না তিনি। আইনস্টাইন অনেক দিন মিলেইভার কোন খবর না পেয়ে জুরিখে লোক পাঠালেন। খবর নিয়ে জানলেন বড় ধরনের স্ট্রোকে মিলেইভার শরীরের একদিক অবশ হয়ে গেছে। মিলেইভা মৃত্যুশয্যায়। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা আগস্ট মিলেইভার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাঁর বিছানার নিচ থেকে পাওয়া যায় আইনস্টাইনের পাঠানো পঁচাশি হাজার ফ্রাংক।
           
মিলেইভার মৃত্যুর পর আইনস্টাইনের শরীরও খারাপ হতে থাকে। তাঁর মনে হতে থাকে তিনি অবিচার করেছেন মিলেইভার প্রতি। মনে পড়ে মেরির কথাও।
            
মেরি - তাঁর প্রথম প্রেম। ১৯১১ সালে মেরি আলবার্ট নামেরই একজনকে বিয়ে করেছিলেন। দুটো ছেলে-মেয়ে হয়েছিল তাদের। কিন্তু বিয়েটা বেশিদিন টিকেনি। ১৯২৭ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪০ সালে মেরি আইনস্টাইনকে লিখেছিলেন আমেরিকায় আসার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। আইনস্টাইন কিছুই করতে পারেন নি মেরির জন্য। আমেরিকায় আসা হয়নি মেরির, পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
            
১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল আইনস্টাইন যখন মারা যান মেরি তখন সুইজারল্যান্ডের মানসিক হাসপাতালে। 


Tuesday, 11 June 2019

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক ভালোবাসা - পর্ব-৪




সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরটি বেশ প্রাণবন্ত। মিলেইভারও বেশ ভালো লাগছে। আইনস্টাইন অফিস টাইমে মন দিয়ে প্যাটেন্ট অফিসের কাজ করেন। অফিস শেষে মেতে ওঠেন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়। বাড়িতে তিন বন্ধুর সাথে মিলে একটা একাডেমি খুলেছেন - নাম দিয়েছেন অলিম্পিক একাডেমি। মিলেইভা হলেন একাডেমির চতুর্থ সদস্য। সলোভাইন, হ্যাবিশ্‌ট আর আইনস্টাইন মিলে যখন গভীর আলোচনা চলে মিলেইভা চুপ করে শোনেন।
            
এক সময়ের তুখোড় ছাত্রী মিলেইভা পরপর দুবার চেষ্টা করেও পাস করতে না পেরে নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিয়েছেন জ্ঞানবিজ্ঞানের জগৎ থেকে। তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিস্বত্বার মৃত্যু ঘটেছে। স্বামীকে আঁকড়ে ধরেই তিনি এখন বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন। একদা স্বপ্ন দেখেছিলেন মেরি কুরির মত হবেন। পলিটেকনিকে পড়ার সময় আইনস্টাইন যখন মিলেইভার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন ভাবনার কথা আলোচনা করতেন - মিলেইভা স্বপ্ন দেখতেন আইনস্টাইনের সাথেই তিনি এগিয়ে যাবেন বিজ্ঞান সাধনায় যেমন মেরি ও পিয়ের কুরি।
            
কিন্তু সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে কত আগে। এখন তো তিনি বোঝেনও না আইনস্টাইন কী নিয়ে গবেষণা করছেন। আইনস্টাইন এখন একান্তভাবেই তার, কিন্তু সম্পূর্ণ তার কি? মিলেইভা বুঝতে পারেন আইনস্টাইনের ভাবনার বেশির ভাগ জুড়েই এখন বিজ্ঞান। সেখানে মিলেইভার জন্য কতটুকুই বা সময় আছে তার জনির?
            
প্যাটেন্ট অফিসের কাজে কোন রকম নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছেন না আইনস্টাইন। একটা একাডেমিক চাকরি পেলে গবেষণায় পুরো সময় দিতে পারতেন। কিন্তু কীভাবে হবে? এখনো তো পিএইচডি-টাও করা হলো না। এদিকে বিয়ে করেছেন ছয় মাস হয়ে গেলো অথচ হানিমুনে যাওয়া হলো না। অবশেষে মিলেইভার পীড়াপীড়িতে লেক জেনেভায় গিয়ে কিছুদিন ঘুরে এলেন দুজনে। সেখান থেকে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যে তাঁর অলিম্পিক একাডেমি বন্ধ হয়ে গেল। কারণ তাঁর দুবন্ধুই চাকরি নিয়ে চলে গেছেন অন্য শহরে।
           
১৯০৪ সালের ১৪ই মে আইনস্টাইন ও মিলেইভার প্রথম পুত্র হ্যান্সের জন্ম হয়। আইনস্টাইন কিছুটা ঘরমুখী হবার চেষ্টা করছেন। ঘরের কাজে মিলেইভাকে সাহায্য করারও চেষ্টা করেন। অফিস থেকে ফিরে বাচ্চা কোলে কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। একসময় দেখা যায় ছোট্ট হ্যান্স তাঁর কোলে বসে চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে, আর আইনস্টাইন গভীর চিন্তায় মগ্ন।
            
পরের এক বছরের মধ্যেই আইনস্টাইন প্রকাশ করে ফেললেন চারটি বিখ্যাত গবেষণাপত্র যেগুলোর জন্য পৃথিবীর পুরো পদার্থবিজ্ঞানই বদলে যেতে বাধ্য হলো। আইনস্টাইন ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্ট, ব্রাউনিয়ান মোশান, স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করলেন ১৯০৫ সালে। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc2 এর জন্ম হলো এবছর। একই বছরে তিনি তাঁর পি-এইচ-ডি ডিগ্রিটাও পেয়ে গেলেন জুরিখ ইউনিভার্সিটি থেকে।
            
দ্রুত বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন আইনস্টাইন। যতই বিখ্যাত হচ্ছেন ততই ব্যস্ত হচ্ছেন। অফিস থেকে ফিরেই গবেষণা নিয়ে বসে পড়েন। ঘরে যে স্ত্রী আর শিশুপুত্র আছে তাদের কথা মনেই থাকে না আইনস্টাইনের। এ নিয়ে মিলেইভার ক্ষোভের শেষ নেই। তার মনে হচ্ছে খ্যাতির সাথে সাথে কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছেন আইনস্টাইন।
            
১৯০৯ সালে প্যাটেন্ট অফিসের চাকরি ছেড়ে জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর হিসেবে যোগ দিলেন আইনস্টাইন। সংবাদপত্রে বেশ ফলাও করে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রফেসর হওয়ার খবর। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের খ্যাতির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপের বিজ্ঞান-সমাজে।
            
অক্টোবর মাসে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বার্ন থেকে জুরিখে চলে এলেন আইনস্টাইন। জুরিখে তখন নির্মাণ শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বাসা পাওয়া খুব মুশকিল। কোনরকমে একটা ছোট বাসা জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে। মিলেইভা বার্ন ছেড়ে আসতে চাননি। আইনস্টাইনের খ্যাতি ও যশ যত বাড়ছে মিলেইভার আত্মবিশ্বাস ততই কমছে। তিনি দেখছেন আইনস্টাইন দিন দিন বহির্মুখী হয়ে যাচ্ছেন।
            
ইউরোপের মেয়েদের মধ্যে আইনস্টাইনের ভক্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পার্টিতে আইনস্টাইন থাকলে প্রায় সব মেয়েদেরই নজর থাকে তাঁর প্রতি। আইনস্টাইনও পছন্দ করেন মেয়েদের সঙ্গ। এসব দেখে মিলেইভার মাথা ঠিক থাকে না। ঈর্ষায় রাগে জ্বলতে থাকেন তিনি। নিজেকে খুবই অপমানিত ও অবহেলিত মনে হয় তাঁর।
            
আইনস্টাইনের প্রফেসর হওয়ার খবর পেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখছেন অনেকেই। তার মধ্যে বিশেষ একটা চিঠি - অ্যানা স্মিডের। আইনস্টাইনের মনে পড়লো এই সেই অ্যানা স্মিড যার খাতায় কবিতা লিখে দিয়েছিলেন তিনি অনেকদিন আগে। সেদিনের সপ্তাদশী অ্যানা এখন আটাশ বছরের যুবতী। জর্জ মেয়ার নামে এক উকিলের সাথে বিয়ে হয়ে অ্যানা স্মিড এখন অ্যানা মেয়ার। ভীষণ খুশি হয়ে অ্যানার চিঠির উত্তর দিলেন আইনস্টাইন। লিখলেন একবার যেন জুরিখে এসে দেখা করে যায়।   আইনস্টাইনের চিঠি পেয়ে অ্যানা তো ভীষণ খুশি। দেখা করার পরিকল্পনা করে অ্যানা চিঠি লিখলেন আইনস্টাইনকে। কিন্তু সে চিঠি পড়লো মিলেইভার হাতে। চিঠি পড়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মিলেইভার। তিনি রাগের মাথায় চিঠি লিখলেন অ্যানার স্বামীকে। লিখলেন স্ত্রীকে যেন সামলে রাখেন। অ্যানার স্বামী উকিল মানুষ। আইনস্টাইনকে জানালেন সব।
            
এবার আইনস্টাইন রেগে গেলেন মিলেইভার ওপর। মিলেইভাও ছেড়ে কথা বলার মানুষ নন। অ্যানার সাথে আইনস্টাইনের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। আইনস্টাইন কোন রকমে শান্ত করলেন মিলেইভাকে। মিলেইভা আবার গর্ভবতী হলেন। ১৯১০ সালের ২৮শে জুলাই তাঁদের দ্বিতীয় পুত্র এডোয়ার্ডের জন্ম হয়। 
            
বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপনার অফার আসছে আইনস্টাইনের। ১৯১১ সালে জার্মান ইউনিভার্সিটি অব প্রাগের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের পরিচালক পদে যোগ দিলেন আইনস্টাইন। এই নতুন পদের জন্য তিনি প্রায় দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছেন। ফলে সংসারে বেশ সাচ্ছন্দ্য এলো। অভিজাত এলাকায় বেশ বড় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করলেন আইনস্টাইন।
           
কিন্তু মনে সুখ নেই মিলেইভার। প্রাগের অভিজাত সমাজের মানুষের নাকউঁচু স্বভাব পছন্দ নয় মিলেইভার। জার্মান ছাড়া অন্য কোন জাতিকে মানুষ বলেই মনে করে না প্রাগের উঁচুতলার মানুষেরা। একটি গভীর অবসাদ সারাক্ষণ ঘিরে থাকে মিলেইভাকে।
            
১৯১২ সালের জুলাইতে জুরিখের ফেডারেল পলিটেকনিকে ফিজিক্সের প্রফেসর পদে যোগ দেন আইনস্টাইন। এখানে পড়ার সময়েই মিলেইভার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। প্রাগ থেকে সপরিবারে ফিরে এলেন নিজের অনেক স্মৃতিবিজড়িত শহর জুরিখে। জুরিখে ফিরে এসে মিলেইভা কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। প্রাগের পরিবেশ সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু জুরিখে এসে আইনস্টাইন আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। পুরনো সব বন্ধুদের সাথে নতুন করে আলাপ জমছে, নতুন নতুন বন্ধু জুটছে। অধ্যাপনা, গবেষণা আর আড্ডায় ঘরের বাইরেই বেশি সময় কাটে আইনস্টাইনের।
            
জুরিখে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই মিলেইভার পায়ের পুরনো ব্যথাটা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেলো। তিনি প্রায় হাঁটতেই পারছেন না। কিন্তু আইনস্টাইনের সময় নেই তাঁর দিকে তাকানোর। শরীরের কষ্ট আর মনের কষ্ট নিয়ে দুটো ছোট ছোট ছেলেকে সামলাতে সামলাতেই সময় কেটে যায় মিলেইভার।
            
পরের বছর মে মাসের শেষের দিকে প্যারিসে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা করতে যান আইনস্টাইন। সেখানে আইনস্টাইনের সাথে মেরি কুরির দেখা হবার সম্ভাবনা আছে জেনে মিলেইভা এক প্রকার জোর করেই আইনস্টাইনের সাথে প্যারিসে গেলেন।
            
প্যারিসে মেরি কুরি তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান আইনস্টাইন ও মিলেইভাকে। চোখের সামনে তাঁর আইডল মাদাম কুরিকে দেখে কী যে ভাল লাগছিল মিলেইভার, আবার একই সময়ে এটাও মনে হচ্ছিল যে তাঁর স্বপ্নের কেন মৃত্যু হলো এভাবে? মেরি কুরি স্বামীকে হারিয়ে একাই দুই মেয়েকে মানুষ করার পাশাপাশি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট চালাচ্ছেন, সরবোন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন, আর মিলেইভা? আফসোস হচ্ছে - কেন নিজের লেখাপড়াটা শেষ না করে নিজেকে জড়াতে গেলেন আইনস্টাইনের সাথে। তবে কি ভাগ্য বলে কোন কিছু আছে?
            
শরীর ও মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে গেলে অনেক মানুষ অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ে, ধর্মের দিকেও ঝুঁকে পড়ে। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মিলেইভাও কিছুটা ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। সেবছর সেপ্টেম্বর মাসে ছেলেদের নিয়ে হাঙ্গেরিতে গেলেন মিলেইভা তাঁর মা-বাবার সাথে দেখা করতে। সেখানে স্থানীয় সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চে গিয়ে ছেলেদের ব্যাপ্টাইজড করালেন। আইনস্টাইন এসবে বিশ্বাস করেন না, তাই তিনি যাননি।
১৯১৩ সালের নভেম্বরে প্রুসিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হলেন আইনস্টাইন। বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে চালু হচ্ছে কাইজার উইলহেল্‌ম ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স। আইনস্টাইনকে এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদে যোগদানের অফার নিয়ে জুরিখে এসে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক ও ওয়ালথার নার্নস্ট। বেতন অফার করা হচ্ছে এখন যা পাচ্ছেন তার দ্বিগুণেরও বেশি। এমন সুযোগ প্রত্যাখ্যান করার মত বোকা আইনস্টাইন নন।
            
জুরিখ ছেড়ে বার্লিনে যেতে চাচ্ছেন না মিলেইভা। আইনস্টাইন তাকে বোঝালেন ফিজিক্সের বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানী প্ল্যাঙ্ক, বিন, নার্নস্ট, সামারফেল্ড সবাই এখন বার্লিনে। এসময় বার্লিনে থাকলে তাঁর গবেষণার কত সুবিধে হয়। কেবল একটি অন্যরকম সুবিধের কথা কিছুতেই জানতে দিলেন না আইনস্টাইন তা হলো এলসার সাথে দেখা করার সুবিধা।
            
এলসা আইনস্টাইনের আপন মাসতুতো দিদি। তার চেয়ে তিন বছরের বড়। বিয়ে হয়েছিল ম্যাক্স লোয়েনথালের সাথে। কিন্তু বছর দুয়েক আগে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে এখন মা-বাবার সাথে থাকেন বার্লিনে। বছর দুয়েক আগে আইনস্টাইন যখন তাঁর মায়ের সাথে দেখা করতে যান তখন দেখা হয়েছিল এলসার সাথে।
           
ফুটফুটে দুই মেয়ে এলসার - তেরো বছরের আইল্‌স ও এগারো বছরের মার্গট। কিন্তু নীলনয়না ঝকঝকে স্মার্ট এলসাকে দেখে মনেই হয়না যে তার এত বড় দুটো মেয়ে আছে। আইনস্টাইনের উন্নতি ও খ্যাতির খবর এলসা খুব ভালোভাবেই রাখেন। এত বছর পর আইনস্টাইনকে দেখে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরেছিলেন এলসা। আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছেন এই আলিঙ্গনে দিদির স্নেহ ছিল না - ছিল অন্যকিছু। তারপর থেকে গত দুবছর অনেক চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে আইনস্টাইন ও এলসার মধ্যে মিলেইভার অজান্তে।
            
১৯১৪ সালে বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে কাজ শুরু করলেন আইনস্টাইন। বার্লিনে বাসা নিয়েছেন এলসাদের বাড়ির খুব কাছে। এলসার সাথে নিয়মিতই দেখা হচ্ছে আইনস্টাইনের। তাদের সম্পর্কটা আর গোপন নেই মিলেইভার কাছে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে আইনস্টাইন ও এলসাকে জড়িয়ে নানারকম স্ক্যান্ডাল এখন নিয়মিত ঘটনা।
            
মিলেইভা বুঝতে পারছেন আইনস্টাইনের সাথে তার সম্পর্ক ভেতরে ভেতরে মরে গেছে। এরকম একটি মৃত-সম্পর্ককে বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না। আইনস্টাইনকে এলসার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে রুচিতে বাধে মিলেইভার। কিন্তু অন্য কোন ব্যাপারেও খুব সামান্যতেই ঝগড়া লেগে যায় দুজনের মধ্যে।
           
আর আইনস্টাইন যেন এটাই চান। তিনি যে কোন অজুহাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলসাদের বাড়িতে চলে যান। মিলেইভাকে আর ভালো লাগছে না তাঁর। আইনস্টাইনের মনে হচ্ছে এলসা ছাড়া আর কেউ তাকে ঠিকমত বুঝতে পারে না। এলসার কাছে মিলেইভার নামে যা খুশি বলেন। একদিন বললেন, মিলেইভা হলো আমার এমন এক কর্মচারি যাকে ইচ্ছে করলেও ছাঁটাই করতে পারছি না।
            
বার্লিনে মিলেইভার তেমন কোন বন্ধু নেই। আইনস্টাইনের বস ফ্রিট্‌জ হ্যাবারের স্ত্রী ক্ল্যারা মিলেইভাকে বেশ স্নেহ করেন। মিলেইভার সাথে আইনস্টাইন যে ব্যবহার করছেন তাতে তিনি বিরক্ত। একদিন আইনস্টাইনের ব্যবহারে প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে ছেলে দুটোকে নিয়ে ক্ল্যারার কাছে চলে গেলেন মিলেইভা।


হ্যাবার দম্পতি আইনস্টাইনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা চাচ্ছেন না আইনস্টাইন ও মিলেইভার বিয়েটা ভেঙে যাক। কিন্তু মিটমাটের চেষ্টা করতেই আইনস্টাইন মিলেইভার জন্য লম্বা এক কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করলেন। মিলেইভা আইনস্টাইনের শর্তগুলো পড়ে দেখলেন। ওগুলো মেনে নিলে তাঁকে আইনস্টাইনের ক্রীতদাসী হয়ে যেতে হয়। এত্তো অপমান তিনি কীভাবে সহ্য করবেন?
           
মিলেইভা সহ্যের শেষ সীমানায় চলে গেছেন। জুলাই মাসের শেষে তাঁর ছেলেদের নিয়ে তিনি জুরিখে চলে গেলেন। আইনস্টাইনের সাথে সেপারেশান চুক্তি অনুসারে বছরে ৫,৬০০ মার্ক তিনি পাচ্ছেন আইনস্টাইনের কাছ থেকে ছেলেদের ভরণ-পোষণ বাবদ। এদিকে বার্লিনের খালি বাড়িতে এলসার সাথে ভালোবাসায় এখন আর কোন রাখঢাক নেই আইনস্টাইনের। এভাবে কেটে গেলো আরো দুবছর।
            
১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মিলেইভা তাঁর ছেলেদের নিয়ে সুইজারল্যান্ডে আছেন। সুইজারল্যান্ড নিরপেক্ষ যুদ্ধমুক্ত দেশ। আইনস্টাইন ছেলেদের ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিন্ত আছেন সেজন্য। কিন্তু মিলেইভার কাছ থেকে তিনি এখনো ডিভোর্স পাচ্ছেন না। ডিভোর্সের কথা তুললেই মিলেইভা রেগে যান। মিলেইভা জানেন আইনস্টাইনের সাথে তাঁর সম্পর্ক মরে গেছে। কিন্তু ডিভোর্স দিলেই আইনস্টাইন এলসাকে বিয়ে করে ফেলবে। এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
            
আইনস্টাইন জুরিখে ছেলেদের সাথে দেখা করতে গিয়ে আবারো ডিভোর্সের প্রসঙ্গ তুললেন। মিলেইভা আবারো রেগে গেলেন। আইনস্টাইন ছোট ছেলে এডোয়ার্ডের ব্যাপারে কিছুটা চিন্তিত। ছেলেটার শরীর ভালো নেই। কিন্তু মানসিক গড়নটা অস্বাভাবিক। বয়সের তুলনায় সে অনেক বেশি মেধাবী। তিন বছর বয়সেই সে সংবাদপত্র পড়তে শুরু করেছে। ফটোগ্রাফিক মেমোরি তার। পাঁচ বছর বয়স থেকেই সে পিয়ানো বাজাতে শুরু করেছে একেবারে পেশাগত দক্ষতায়।
            
আইনস্টাইন চিন্তিত মনে ফিরে গেলেন বার্লিনে। এদিকে মিলেইভা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সেই মিলেইভাকে দেখতে ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধা মহিলার মত দুর্বল আর জরাজীর্ণ মনে হয়। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো মিলেইভাকে।
            
আইনস্টাইন মিলেইভার অসুস্থতার খবর পেয়েও দেখতে এলেন না। মিলেইভার দেখাশোনার জন্য এগিয়ে এলেন আইনস্টাইনের বন্ধু মাইকেল বেসো। মাইকেল বেসোর স্ত্রী অ্যানা হলেন আইনস্টাইনের প্রথম প্রেমিকা মেরির দিদি। আইনস্টাইনের ওপর স্বাভাবিক ভাবেই বিরক্ত অ্যানা। এদিকে অ্যানা ও মেরির দাদা পলের সাথে বিয়ে হয়েছে আইনস্টাইনের ছোটবোন মায়ার। মায়াও এখন আইনস্টাইনের আচরণে ভীষণ বিরক্ত।
            
১৯১৭ সালের শুরুতে পাকস্থলীর সমস্যায় ভুগতে ভুগতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন আইনস্টাইন। দুমাসের মধ্যে প্রায় পঁচিশ কেজি ওজন কমে যায় তাঁর। এসময় এলসা তাঁর সেবাযত্ন করার জন্য তাঁর বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করেন।
            
এদিকে মিলেইভা ও এডোয়ার্ডও অসুস্থ হয়ে জুরিখের হাসপাতালে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে শুয়ে মিলেইভা ভেবে দেখলেন আইনস্টাইনকে ডিভোর্স না দিলে তার তো কোন লাভ হচ্ছে না। এলসার সাথে বিয়ে না হলেও তো তাদের এক সাথে থাকতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তিনি ঠিক করলেন এবার ডিভোর্স দিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর ছেলেদের কী হবে? ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি একটা শর্ত ঠিক করলেন। 

Monday, 10 June 2019

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক ভালোবাসা - পর্ব-৩


জুরিখে ফিরে আসার কিছুদিন পর বাবার চিঠি পেলো আলবার্ট। বাবা লিখেছেন, এখনই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা তোমার উচিত হবে না। চাকরি বাকরি নেই, কোন উপার্জন নেই,  এ অবস্থায় বৌয়ের ভরণ-পোষণের সামর্থ্য তোমার নেই। এখন বিয়ে করাটা হবে তোমার জন্য বিলাসিতা। এরকম বিলাসিতা শুধুমাত্র বড়লোকদেরই মানায়।
            
বাবার চিঠি পড়ে ক্ষোভে অপমানে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে আলবার্ট। বাবা এসব কী লিখলেন? বিয়ে করাটা কি রক্ষিতা রাখার সমতুল্য নাকি যে সেটা শুধু ধনীদেরই মানায়? ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আলবার্টের সহজ পথ হলো পড়াশোনায় ডুবে থাকা। পড়াশোনায় ডুবে থাকতে চাইলেও পারছে না। বাবার কথাগুলো শুনতে যতই খারাপ লাগুক - সত্যিই তো তার এখন একটা চাকরি দরকার।
            
আলবার্ট আশা করছে পলিটেকনিকে একটা অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি সে নিশ্চয় জোগাড় করতে পারবে। প্রফেসর ওয়েবারের কাছে একটা চাকরির দরখাস্ত করলো। ভেবেছিল চাকরিটা তার হবেই। কারণ আলবার্ট ও মিলেইভাই শুধু ফিজিক্স মেজর নিয়েছিল। মিলেইভা তো এখনো পাস করতে পারেনি। সুতরাং পলিটেকনিকে ফিজিক্সের প্রফেসরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাউকে নিয়োগ দিলে আলবার্টকেই দিতে হবে।
            
কিন্তু না, প্রফেসর ওয়েবার আলবার্টকে পছন্দ করতেন না। চাকরি তার হলো না। প্রফেসর ওয়েবারের অধীনে পি-এইচ-ডি করবে ভেবেছিল আলবার্ট। কিন্তু তার গবেষণা প্রস্তাব পছন্দ হয়নি ওয়েবারের। তরলের ক্যাপিলারিটি সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র লিখতে শুরু করেছে আলবার্ট। প্রকাশ করতে পারলে হয়তো চাকরি পেতে সুবিধে হবে।
           
পলিটেকনিকের প্রফেসরদের কোন সহযোগিতা না পেয়ে জুরিখ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলফ্রেড ক্লেইনারের সাথে দেখা করলো আলবার্ট। প্রফেসর ক্লেইনার রাজি হয়েছেন তাকে পিএইচডি স্টুডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করতে। শুরু হলো আলবার্ট আইনস্টাইনের ফর্মাল গবেষণা।
            
১৯০১ সালের জানুয়ারি থেকে আইনস্টাইনের পিএইচডি গবেষণা শুরু হলো। মার্চ মাসে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে নামী জার্নাল - অ্যানালেন ডার ফিজিকে। ভেবেছিলেন এবার হয়তো একটা চাকরি পাওয়া যাবে। কিন্তু না। একটা টিউশনিই তাঁর উপার্জনের একমাত্র সম্বল।
            
একের পর এক চাকরির দরখাস্ত পাঠাচ্ছেন সবগুলো ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু কোথাও কিছু হলো না। প্রচন্ড হতাশার মধ্যে একদিন বন্ধু মার্সেল গ্রোসম্যানের চিঠি পেলেন। বার্নের প্যাটেন্ট অফিসে একজন লোক নেয়া হবে। প্যাটেন্ট অফিসের পরিচালক গ্রোসম্যানের বাবার বন্ধু। গ্রোসম্যান তার বাবাকে দিয়ে আইনস্টাইনের ব্যাপারে সুপারিশ করিয়ে রেখেছেন। কিন্তু চাকরিটা কখন হবে তা এখনো জানেন না আইনস্টাইন। ইতোমধ্যে তার আরেক বন্ধু এহ্‌রাতের সুপারিশে উইন্টারথুর টেকনিক্যাল স্কুলে একটা ছুটিজনিত পদে মে থেকে জুলাই এই তিন মাসের জন্য চাকরি পেলেন আইনস্টাইন।
            
মাত্র তিন মাসের জন্য হলেও জীবনের প্রথম চাকরি পেয়ে খুবই খুশি আইনস্টাইন। মিলেইভাকে চিঠি লিখে আসতে বললেন কোমো হ্রদের অবকাশকেন্দ্রে। চাকরি পাবার আনন্দটুকু দুজনে মিলে উপভোগ করবেন।     মিলেইভা পলিটেকনিকে দ্বিতীয়বারের মত ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নানা চিন্তায় পড়াশোনা এগোচ্ছে না মোটেও। এরমধ্যে শরীরটাও খারাপ থাকে প্রায় সময়ই।
            
এপ্রিলের শেষের দিকে লেক কোমোতে এসে আইনস্টাইনের সাথে যোগ দিলেন মিলেইভা। আইনস্টাইন আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন সেখানে মিলেইভার জন্য। ভীষণ আনন্দে কেটে গেল কয়েকটি দিন, কয়েকটি রাত। দুজনে মিলে ঘুরে বেড়ালেন কোমো শহরে। নৌকাভ্রমণ করলেন কোমো হ্রদের জলে। উঁচু পাহাড়ে উঠে স্লেজ গাড়িতে চড়লেন দুজনে হানিমুনে আসা আরো সব যুগলের মত। কয়েকদিন তারা ভুলেই ছিলেন যে তখনো বিয়ে হয়নি তাদের।
            
কোমো থেকে ফিরে মিলেইভা চলে গেলেন জুরিখে, আর আইনস্টাইন যোগ দিলেন উইন্টারথুর টেকনিক্যাল স্কুলের চাকরিতে। সপ্তাহে ত্রিশ ঘন্টা পড়াতে হয় তাঁকে। রবিবার ছুটি - সেদিন জুরিখে গিয়ে সোজা মিলেইভার বাসায়। আইনস্টাইনের সব হতাশা যেন কেটে গেছে কদিনের মধ্যেই।
            
মাস দুয়েক পরের এমনি এক রবিবারে মিলেইভা জানালেন আইনস্টাইনকে, জনি, আমি তোমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছি।
            
চমকে উঠলেন আইনস্টাইন। তবে কি মায়ের কথাই ঠিক হলো? এখন কী হবে? মিলেইভার সমস্যার কথা না ভেবে তিনি নিজে কীভাবে তাঁর মাকে মুখ দেখাবেন তাই ভাবতে লাগলেন। তাছাড়া ইউরোপিয়ান সমাজে এধরনের ঘটনাকে কলঙ্ক বলে মনে করা হয়। জানাজানি হয়ে গেলে আইনস্টাইনের বন্ধুরা কী ভাববেন তাঁর সম্পর্কে? প্যাটেন্ট অফিসের চাকরিটি হবার কথা আছে। কিন্তু ব্যক্তিগত চরিত্রের খুঁত দেখিয়ে যদি চাকরিটি না দেয় তাকে? মিলেইভাকে এসব কিছু বলা যাবে না। যত শীঘ্র সম্ভব মিলেইভাকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু একটা চাকরি ছাড়া বিয়ে করবে কীভাবে? যে চাকরিটি এখন করছেন তা জুলাইতে শেষ হয়ে যাবে। তার আগেই আরেকটা চাকরি তাকে পেতেই হবে।
            
মিলেইভাও বুঝতে পারছেন তার মা হবার খবর গোপন রাখতে হবে। মাত্র কয়েক মাস পরেই তার ফাইনাল পরীক্ষা। এবারেও পাস না করতে পারলে তার পড়ালেখা এখানেই শেষ হয়ে যাবে। মিলেইভার কথা ভেবে আইনস্টাইন যেকোন ধরনের চাকরি করতেও প্রস্তুত। কিন্তু মিলেইভা নিজের জন্য তার জনিকে ছোট হতে দেবেন না কিছুতেই। তিনি আইনস্টাইনকে বলেছেন, তোমার যোগ্যতার চেয়ে ছোট কোন চাকরি তুমি করবে না। আমি সব কষ্ট সহ্য করতে পারবো, কিন্তু তোমার মেধার অবমূল্যায়ন কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না।
           
মিলেইভার দিন মোটেও ভাল যাচ্ছে না। দুসপ্তাহ পরেই তার ফাইনাল পরীক্ষা। প্রস্তুতি মোটেও ভাল হয়নি। মাথার মধ্যে রাজ্যের দুশ্চিন্তা, পেটে সন্তান, আর ল্যাবে প্রফেসর ওয়েবারের সাথে প্রতিদিনই মনোমালিন্য হচ্ছে। থিসিসটাও লেখা হয়নি ঠিকমত। এ অবস্থাতে পরীক্ষা দিলে যা হয় তাই হলো। মিলেইভা পাশ করতে পারলেন না এবারও। তিনি ভাবতে পারছেন না মা-বাবাকে মুখ দেখাবেন কী করে। তার পড়াশোনার জন্য কত কষ্ট করেছেন তার বাবা। একে তো ফেল করেছেন তার ওপর আইনস্টাইনের সন্তান তার পেটে। এ অবস্থায় কী ভাববেন তার মা-বাবা?
            
এদিকে উইন্টারথুর স্কুলের চাকরিটি শেষ হয়ে গেল আইনস্টাইনের। আবার পূর্ণ বেকার হয়ে তিনি মিলেইভার কাছে না থেকে চলে গেলেন মা ও বোনের কাছে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। মিলেইভার চিঠিতে জানলেন তার রেজাল্ট। আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেই হবে বলে সান্ত্বনা দিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু মিলেইভা জানেন তার পড়াশোনার এখানেই ইতি। মা-বাবার কাছে চলে যাবার আগে আইনস্টাইনকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন একটা চিঠি লিখে দেন মিলেইভার মা-বাবাকে যে খুব শীঘ্রই তিনি মিলেইভাকে বিয়ে করবেন। আইনস্টাইন তাই করলেন।
            
নভি সাদে মা-বাবার কাছে ফিরে মিলেইভা দেখলেন বাড়িতে তার অবস্থানটা ভীষণ নড়বড়ে হয়ে গেছে। তার পৌঁছানোর আগেই পৌঁছে গেছে আইনস্টাইনের চিঠি। মিলেইভার সন্তানধারণের খবর তারা পেলেন সেই চিঠিতে। এখন মিলেইভার মুখে শুনলেন তার ফেল করার কথা। মিলেইভার মা মারিয়া ভীষণ রেগে আছেন আইনস্টাইন ও মিলেইভার ওপর। যে সন্তানের জন্য তারা এত করেছেন - তার এই ফল? কদিন পরে তাদের ক্ষোভের আগুনে পেট্রোল ঢেলে দিল মিলান থেকে আসা একটা চিঠি। আইনস্টাইনের মা মিলেইভার মা-বাবাকে লিখেছেন মিলেইভা সম্পর্কে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন তিনি চিঠিতে। মিলেইভার মা-বাবাকেও ছেড়ে দেননি তিনি।
            
মিলেইভার বাবা মাইলোস মেরিক সেনাবাহিনীর উচ্চপদে কাজ করতেন। এখন সরকারের উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা। আর্থিক অবস্থা তুলনা করলেও আইনস্টাইনদের চেয়েও মেরিকদের অবস্থা ভালো। শুধুমাত্র মেয়ের ভুলের কারণে আজ তাদের অপমান করতে পারছেন আইনস্টাইনের মা। তবুও ভালো যে তিনি এখনো জানেন না যে মিলেইভা আইনস্টাইনের সন্তান ধারণ করেছে। জানলে চিঠির ভাষা কেমন হতো তা চিন্তা করেই শিউরে উঠছেন মিলেইভা। মিলেইভার বাবা-মা প্রতিজ্ঞা করেছেন আইনস্টাইনের সাথে তারা কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন না।
            
আইনস্টাইন সব জানতে পারেন মিলেইভার চিঠিতে। কিন্তু মাকে তিনি কী বলবেন? মিলেইভাকেও বা কী বলে সান্ত্বনা দেবেন? নভি সাদে গিয়ে মিলেইভার সাথে দেখা করাও সম্ভব নয় তার পক্ষে। মিলেইভার বাবা-মা তাকে সহ্য করতে পারবেন না। মিলেইভাও বোঝেন এসব। তিনিও ঠিক কী করবেন বুঝতে পারেন না। মনের দুঃখে বান্ধবী হেলেনকে চিঠিতে লিখলেন আইনস্টাইনের মা সম্পর্কে - মানুষ এরকম নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারেন আমি জানি না। তিনি যেন ব্রত নিয়েছেন যেভাবেই পারেন আমাকে শেষ করে ফেলবেন। তিনি শুধু আমার জীবনই নষ্ট করে দিচ্ছেন না, নিজের ছেলের জীবনও নষ্ট করে ফেলছেন। মানুষ যে এত খারাপ হতে পারে আমি কখনো ভাবতেই পারিনি।
           
উইন্টারথুরের বাসা ছেড়ে আইনস্টাইন চলে গেলেন প্রায় পনের মাইল দূরে জার্মান সীমান্ত ঘেঁষা সুইজারল্যান্ডের একটা গ্রাম স্যাফুসেনে। ওখানে একটা ফেল করা ছাত্রকে পড়িয়ে পাস করানোর চাকরি পেয়েছেন তিনি। বেতন মাসে ১৫০ ফ্রাঙ্ক। মিলেইভাকে চিঠি লিখে জানালেন তার চাকরির কথা।
            
কয়েক দিন পর মিলেইভার চিঠি এলো। আইনস্টাইনের সাথে দেখা করতে চান তিনি। মা-বাবার বাড়িতে ভালো লাগছে না তার। তিনি চান আইনস্টাইনের সাথে থাকতে। কিন্তু মা-বাবা জানতে পারলে তাকে জোর করে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তাই মিলেইভা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আইনস্টাইন এখন যেখানে আছেন সেখান থেকে বারো মাইল দূরে স্টেইন-আম-রেইন নামে একটি গ্রামে এসে থাকবেন। আইনস্টাইন যেন সেখানে গিয়ে দেখা করেন তার ডলির সাথে।
            
এ পর্যন্ত মিলেইভাকে লেখা প্রতিটি চিঠিতে আইনস্টাইন লিখেছেন তার ডলিকে দেখার জন্য তিনি অস্থির হয়ে আছেন, ডলিকে ছাড়া তিনি কিছুই করতে পারছেন না, দিন কাটতে চাইছে না ডলিকে কবে দেখবেন সেই আশায়, ইত্যাদি। কিন্তু প্রায় সাত মাসের অন্তসত্ত্বা মিলেইভা বাড়ি থেকে পালিয়ে আইনস্টাইনের কর্মস্থল থেকে মাত্র বারো মাইল দূরে এসে অপেক্ষা করছেন তার জনির জন্য। অথচ আইনস্টাইন একবারও মিলেইভাকে দেখতে গেলেন না।
            
মিলেইভা চিঠির পর চিঠি লিখছেন। তিনি নিজে যেতে পারতেন আইনস্টাইনের কাছে - কিন্তু আইনস্টাইনের চাকরির ক্ষতি হবে ভেবে তা করছেন না। আইনস্টাইন নানারকম অজুহাত দেখাচ্ছেন দেখা না করার জন্য। একবার লিখলেন তার কাছে গাড়িভাড়ার টাকা নেই। মিলেইভা টাকাও পাঠাতে চেয়েছেন। কিন্তু আইনস্টাইন দেখা করেন নি। অনেকদিন অপেক্ষা করার পর মিলেইভা মাথা নিচু করে ফিরে গেলেন মা-বাবার বাড়িতে।
            
১৯০২ সালের জানুয়ারিতে মিলেইভা একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। লোকলজ্জার ভয়ে মেয়ের জন্মের সময় উপস্থিত থাকা তো দূরের কথা - জন্মের পরেও একবারের জন্যেও নিজের মেয়েকে দেখেন নি আইনস্টাইন। মিলেইভা মেয়ের নাম রাখেন লিজেরেল। পরবর্তীতে আইনস্টাইন ও মিলেইভা কখনোই লিজেরেলের ব্যাপারে মুখ খোলেন নি। ধারণা করা হয় দুবছর পর্যন্ত মিলেইভার মা-বাবার কাছে রেখে মেয়েটিকে দত্তক দিয়ে দেয়া হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন লিজেরেল ছোটবেলাতেই মারা গেছে।
            
আইনস্টাইনের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। মা-বাবার কাছ থেকেও কোন আর্থিক সাহায্য পাচ্ছেন না কারণ তার বাবার ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি থিসিস জমা দেয়ার সময় ফি দিতে হয়েছে ২৩০ ফ্রাঙ্ক। অথচ প্রফেসর ক্লেইনার থিসিসটি এখনো অনুমোদন করেননি। কিছু কিছু ব্যাপারে তিনি আইনস্টাইনের সাথে একমত হতে পারছেন না। তাই বলছেন আবার নতুন করে থিসিস লিখে জমা দিতে। আইনস্টাইনের ইচ্ছে করছে না এখন থিসিস লিখতে। থিসিসটি প্রত্যাহার করে নিলে থিসিস-ফি ২৩০ ফ্রাঙ্ক ফেরত পাবেন। এসময় তার টাকার দরকার। থিসিস প্রত্যাহার করে নিলেন আইনস্টাইন।
            
বার্নের প্যাটেন্ট অফিসে চাকরিটা হলে বার্নে যেতে হবে। তাই চাকরি হবার আগেই তিনি বার্নে চলে এলেন। একটা এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে প্রাইভেট পড়ানো হবে মর্মে বিজ্ঞাপন দিলেন। শুধুমাত্র একজন ছাত্র পাওয়া গেল। অবশেষে জুন মাসের ১৬ তারিখ প্যাটেন্ট অফিসের চাকরির নিয়োগপত্র পেলেন। বাৎসরিক বেতন ৩৫০০ ফ্রাঙ্ক।
            
পরবর্তী ছয় মাসে নিজেকে গুছিয়ে নেন আইনস্টাইন। মিলেইভার সাথে দেখা করে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করেন। আইন অনুযায়ী বার্ন, জুরিখ ও নভি সাদের স্থানীয় সংবাদপত্রে বিয়ের নোটিশ প্রকাশ করা হয়।   ১৯০৩ সালের ৬ই জানুয়ারি বার্নের ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে আইনস্টাইন ও মিলেইভার বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়। তাদের দুজনের কারো পরিবার থেকেই কেউ উপস্থিত ছিলেন না তাদের বিয়েতে। সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইনস্টাইনের দুই বন্ধু মরিস সলোভাইন ও কনরাড হ্যাবিশ্‌ট। বিয়ের পর নবদম্পতির ছবি তোলা হলো। বন্ধুরা একটি হোটেলে ডিনারের আয়োজন করে রেখেছিলেন।
            
বিয়ে উপলক্ষে এক রুমের বাসা ছেড়ে একটা দুরুমের বাসায় উঠেছেন আইনস্টাইন। কিন্তু বাসাটা একটু গোছানোরও সময় করে উঠতে পারেননি। তার ওপর ডিনার শেষে নতুন বউকে নিয়ে বাসায় ঢুকতে গিয়ে দেখা গেলো বাসার চাবি খুঁজে পাচ্ছেন না আইনস্টাইন। কোথায় রেখেছেন কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেও চাবি না পেয়ে অত রাতে বাড়িওয়ালির ঘুম ভাঙিয়ে তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাসার দরজা খোলা হলো। এভাবেই শুরু হলো আইনস্টাইন ও মিলেইভার দাম্পত্য জীবন।


Sunday, 9 June 2019

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক ভালোবাসা - পর্ব-২


আলবার্ট মিলেইভাকে তখনো জানায়নি তার ভালোবাসার কথা। ভেবেছিল আস্তে আস্তে বলবে। কিন্তু এখন তো মিলেইভা চলেই যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না আলবার্ট। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের এখনো ডিগ্রি দেয়া হয় না। বিশেষ অনুমতি নিয়ে মেয়েরা ক্লাসে এসে লেকচার শুনতে পারে, কিন্তু সেজন্য কোন ক্রেডিট তারা পায় না এসব জেনেও সেখানে কেন যাচ্ছে মিলেইভা ভেবে পায় না আলবার্ট। মিলেইভাকে জিজ্ঞেস করেও কোন পরিষ্কার উত্তর পায়নি আলবার্ট। অক্টোবরের শুরুতে মিলেইভা চলে গেল হাইডেলবার্গে।
           
আলবার্টের সবকিছু কেমন খালি খালি লাগতে শুরু করলো। মনের আবেগ উজাড় করে দিয়ে চারপৃষ্ঠার একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলো সে মিলেইভাকে। সে জানে না মিলেইভার মনের অবস্থা কী। তাই চিঠির শেষে লিখলো - লেখার প্রচন্ড ইচ্ছে না হলে আলবার্টকে লেখার দরকার নেই। কদিন পরেই মিলেইভার চিঠি এলো। পরের দেড় বছর ধরে অনেক চিঠির আদান-প্রদান হলো। সাথে তাদের মনও। আদর করে মিলেইভাকে ডলি বলে ডাকে আলবার্ট, আর আলবার্ট হলো মিলেইভার জনি
            
১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইডেলবার্গ থেকে জুরিখে ফিরে এলো মিলেইভা। আলবার্ট ভীষণ খুশি। কারণ মিলেইভা এখন তার শুধু বন্ধু নয় - প্রেমিকাও। হাইডেলবার্গে যাওয়ার কারণে পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে মিলেইভা। তাকে সাহায্য করার দায়িত্ব নিলো আলবার্ট। পড়তে পড়তে গল্প করতে করতে আলবার্টের বেশির ভাগ সময়ই কাটে মিলেইভার বাসায়। দেখতে দেখতে মিডটার্ম পরীক্ষা এসে গেল। ক্লাস করতে ভাল লাগে না বলে আলবার্ট ক্লাসও করেনি - পরীক্ষার পড়াশোনাও কিছু করেনি। মিলেইভা বুঝতে পারে তার পক্ষে কিছুতেই এখন পরীক্ষা দিয়ে পাস করা সম্ভব নয়। একটা বছর তার নষ্ট হবেই। আর সে সাথে থাকলে আলবার্টের পড়াশোনাও কিছু হবে না। তাই সে নভি সাদে চলে গেলো তার মা-বাবার কাছে।
           
আলবার্ট দিন-রাত খেটে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ফেললো। তারপর বাসা বদল করে মিলেইভার বাসার কাছাকাছি একটা বাসায় চলে এলো। মিলেইভা তখনো ফেরেনি নভি সাদ থেকে। চিঠিতে যোগাযোগ হচ্ছে নিয়মিত। এদিকে বাড়িওয়ালীর মেয়ে সুজান মার্কওয়াল্ডারের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো আলবার্টের।
           
সুজান একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায় - বেশ হাসিখুশি তরুণী। আলবার্টের আবার হাসিখুশি তরুণীদের সাথে ভাব করতে সময় লাগে না। কয়েক দিন পরেই দেখা গেলো সুজানকে সাথে নিয়ে জুরিখের পাহাড়ে, নদীর ধারে হেঁটে বেড়াচ্ছে আলবার্ট। জুরিখ হ্রদে নৌকায় চড়ে হাওয়া খেতে লাগলো সুজান আর আলবার্ট। সুজানের সাথে বেশ আনন্দেই সময় কাটছে আলবার্টের। সুজান যখন পিয়ানো বাজায় আলবার্ট বাজায় বেহালা। কয়েক বছর আগে এরকম বেহালা বাজাতো মেরির সাথে। মিলেইভাকে চিঠি লেখার সময় সব ঘটনাই লেখে আলবার্ট, কেবল কী এক অজানা কারণে সুজানের কোন উল্লেখই থাকে না সেখানে।
            
সেবছর গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে আলবার্ট গেলো জুরিখের কাছে মেটমেনেস্টেটেনের একটা হোটেলে। তাঁর মা পলিন ও বোন মায়া মিলান থেকে সেখানে এসেছেন। সাথে অনেক বইপত্র নিয়ে গেছে আলবার্ট। কিন্তু পড়াশোনা সেরকম এগোচ্ছে না। মায়ের সাথে বোনের সাথে গল্প করে আগে দিনের পর দিন কাটাতে পারতো সে। এখন তাদের সঙ্গ কেমন যেন বোরিং মনে হচ্ছে। মিলেইভার কথা মনে পড়ছে তার।
            
মিলেইভা চলে গেছে তার মা-বাবার কাছে। কয়েক মাস পরে তার পরীক্ষা। মিলেইভার একটা ছবি মাকে দেখিয়েছিল আলবার্ট। ছবিটার দিকে তাকিয়ে খুব ঠান্ডা গলায় পলিন বলেছেন, খুবই ধূর্ত মেয়েটি। আলবার্ট বুঝতে পারছে না এটা প্রশংসা, নাকি নিন্দা।
            
হোটেলের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশেও অসহ্য লাগছে আলবার্টের। তার ওপর তার মায়ের বেশ কিছু বান্ধবী এসে জুটেছেন এ হোটেলে। দল বেঁধে তাদের রুমে এসে সবাই আড্ডা মারেন। আর মা আলবার্টকে বলেন তাদেরকে বেহালা বাজিয়ে শোনাতে। বিরক্তি লাগলেও বেহালা বাজাতে হয় আলবার্টকে।
           
হোটেলে ভাল বেহালা-বাদক হিসেবে বেশ নাম হয়ে গেল আলবার্টের। সেই সুবাদে হোটেলের মালিক রবার্ট মার্কওয়েলারের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল তার। একদিন রবার্ট আলবার্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সপ্তাদশী শ্যালিকা অ্যানা স্মিডের সাথে।
            
অ্যানার সাথে খুনসুটি করতে বেশ ভালোই লাগছে আলবার্টের। একদিন বেহালা বাজানোর পর অ্যানা আলবার্টের অটোগ্রাফ চাইলে আলবার্ট অ্যানার খাতায় একটা কবিতা লিখে দিলো যার বাংলা অর্থ অনেকটা এরকমঃ
ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে তুমি,
কী লিখি তোমার খাতায়
মনে আসে অনেক কিছু
চুমু দিলে মুখে তোমার
রাগ করে কেঁদে ফেলো না।
কঠিন শাস্তি সেটাই হবে,
চুমুর বদলে দিলে চুমু।
এই লেখাটা মনে রেখো,
স্মৃতি করে ধরে রেখো
দুষ্টু বন্ধু তোমার আমি
আলবার্ট আইনস্টাইন।।
           
            
একদিন হোটেলের ঠিকানায় একটা চিঠি পেলো আলবার্ট। লেখিকা আরাউয়ের জুলিয়া নিগলি। আলবার্টের মনে পড়লো জুলিয়ার সাথে পরিচয় হয়েছিল আরাউয়ের স্কুলে পড়ার সময়। জুলিয়া আলবার্টের চেয়ে ছয় বছরের বড়। আরাউয়ে থাকতে জুলিয়ার পিয়ানোর সাথেও কিছুদিন বেহালা বাজিয়েছিল আলবার্ট। জুলিয়ার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল তখন। সেই বন্ধুত্বের সূত্রে জুলিয়া তার কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলবার্টের পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখেছে।
           
একজন বেশ বয়স্ক লোকের সাথে প্রেমের সম্পর্ক চলছে জুলিয়ার অনেকদিন থেকে। লোকটি এখন জুলিয়াকে বিয়ে করতে চান। বিয়েটা করা উচিত হবে কিনা সে ব্যাপারে আলবার্টের পরামর্শ চাচ্ছে জুলিয়া। বিশ বছরের আলবার্ট পরামর্শ দিচ্ছে ছাব্বিশ বছরের জুলিয়া নিগলিকে। আলবার্ট লিখলো, কারো কাছ থেকে সুখের প্রত্যাশা করা উচিত হবে না। এমন কি যাকে ভালোবাস তার কাছ থেকেও নয়। যে মানুষটি আজ তোমাকে ভালোবাসে, কালই হয়তো সে বদলে যাবে। আজ যাকে তোমার বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে কালই হয়তো সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
            
লেখার সময় কি আলবার্টের নিজের কথাই মনে হয়েছিলো - সে যে মেরির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তা?
           
জুলিয়া আলবার্টের সাথে দেখা করতে চেয়েছে। আলবার্টেরও খুব ইচ্ছে করছে আরাউ গিয়ে জুলিয়ার সাথে দেখা করে আসে। কিন্তু মাকে কীভাবে বলবে? মেরির সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার পর মা খুব রেগে আছেন। মিলেইভার সাথে সম্পর্কটা মা পছন্দ করছেন না। এখন যদি মা শোনেন যে জুলিয়ার সাথে দেখা করতে যাবে - ভীষণ রেগে যাবেন। আলবার্ট অনেক ভেবে মাকে বলল যে আরাউয়ে ইয়োস্ট উইন্টেলারের বাড়িতে প্রফেসর হাব এসেছেন। তাঁর সাথে দেখা করা দরকার।
            
মাকে নিয়ে সমস্যা হলো না। কিন্তু আরাউয়ে যাবার পথে আলবার্টের কেমন যেন ভয় করতে লাগলো - যদি হঠাৎ মেরির সাথে দেখা হয়ে যায়! আলবার্ট জানে মেরি এখন আরাউ থেকে কিছুটা দূরে ওল্ডবার্গের একটু স্কুলে পড়াচ্ছে।
            
ভয়ে ভয়ে আরাউয়ে গিয়ে জুলিয়ার সাথে দেখা করলো আলবার্ট। জুলিয়ার কাছে জানা গেলো মেরি এখন আরাউয়ে নেই। আলবার্ট খুশি হয়ে গেলো। ভাবলো অনেকদিন পর জুলিয়ার পিয়ানোর সাথে বেহালা বাজাবে। কিন্তু জুলিয়ার কোন ইচ্ছেই নেই সে ব্যাপারে। জুলিয়া ব্যস্ত তার প্রেমের ব্যাপারে পরামর্শ নিতে।
            
আলবার্ট জুলিয়াকে পরামর্শ দিলো যদি পারে বিয়েটাকে যেন এড়িয়ে চলে। জুলিয়া ঠিক তাই করেছিলেন। সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন জুলিয়া নিগলি।
            
ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছে আলবার্ট ও মিলেইভার। মিলেইভা মিডটার্ম পরীক্ষায় কোন রকমে পাশ করে আলবার্টের সাথেই ফাইনাল পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তার ভয় হচ্ছে তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আলবার্টের মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মিলেইভাকে। 

মিলেইভার এক বান্ধবী হেলেন কাফলার জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের ছাত্রী। হেলেন জানালো সে মিলানে যাচ্ছে বেড়াতে। মিলেইভার ইচ্ছে হলো হেলেন গিয়ে আলবার্টের মায়ের সাথে দেখা করে জেনে আসুক তার সম্পর্কে আসলেই কী ভাবছেন মিসেস পলিন আইনস্টাইন।
            
মিলান থেকে ফিরে হেলেন যা জানালো তাতে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো মিলেইভার। পলিন হেলেনকে বলেছেন, ওই বুড়ি শয়তানীটা আমার কচি ছেলেটার মাথা খেয়েছে। ডাইনিটা কিছুতেই আমার ছেলের উপযুক্ত নয়।
            
ফাইনাল পরীক্ষার বেশিদিন বাকি নেই। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না মিলেইভা। কেবলই মনে হচ্ছে তার হবু শাশুড়ি যদি তাকে ডাইনি মনে করে - কীভাবে সে বিয়ে করবে আলবার্টকে? এদিকে মিনি-থিসিস জমা দিতে হয় পরীক্ষার আগে। আলবার্ট ও মিলেইভা একই বিষয় নিয়ে থিসিস লিখেছে। আলবার্ট তাপ পরিবাহিতা সম্পর্কিত থিসিসটি লিখে জমা দিতে গেলো প্রফেসর ওয়েবারকে।
            
প্রফেসর ওয়েবার থিসিসটি হাতে নিয়ে একটু দেখেই বললেন, এই থিসিস হবে না। তুমি যে কাগজে লিখেছো তা পলিটেকনিকের নিয়মের বাইরে। নিয়ম মতো কাগজে লিখে নিয়ে এসো।
            
পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। আলবার্টকে রাত জেগে থিসিসটি আবার লিখে জমা দিতে হলো।
            
ফাইনাল পরীক্ষা ভালো হলো না দু'জনের কারোরই। আলবার্ট কোন রকমে টেনেটুনে পাশ করলো, কিন্তু মিলেইভা পাশ করতে পারলো না। পরের বছর আবার পরীক্ষা দিতে হবে। খুব ভেঙে পড়েছে মিলেইভা। আলবার্ট গেলো মায়ের সাথে দেখা করতে। তার মা তখন লুসান হ্রদের দক্ষিণে ছোট্ট একটা পর্যটন শহরে ছুটি কাটাতে এসেছেন। আলবার্টও গিয়ে উঠলো সেখানকার হোটেলে।
           
ছেলে পাশ করেছে জেনে খুশিই হলেন পলিন। জিজ্ঞেস করলেন মিলেইভার কথা।
            সে পাশ করতে পারেনি।
            এবার কী হবে তার?
            
আলবার্ট বুঝতে পারছে মিলেইভা সম্পর্কে তার মায়ের মনোভাব। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন উঠলোই আর এড়িয়ে যাবার মানে হয় না। আলবার্ট বললো, এবার আর কী হবে? এবার সে আমার বউ হবে।


মুহূর্তেই পলিন চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মুখে  বালিশ চাপা দিয়ে বেশ শব্দ করেই কাঁদতে লাগলেন। আলবার্ট মায়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু প্রতিক্রিয়া যে এরকম কান্নাকাটির পর্যায়ে চলে যাবে ভাবেনি। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল আলবার্ট। পলিন বুঝতে পারলেন ছেলেকে শুরুতেই একটা ধাক্কা দেয়া গেছে। এবার তিনি চোখ মুছতে মুছতে শুরু করলেন বাক্যবাণ - নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারছিস তুই। নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছিস ওই বুড়ি ডাইনিটার জন্য।
            
আলবার্ট কিছু বলার আগেই পলিন আবার বিছানায় শুয়ে দ্বিতীয় দফা কান্নাকাটি শুরু করলেন। আলবার্ট আবার অপ্রস্তুত হয়ে গেছে দেখে আবার উঠে বসলেন পলিন। আরো তীব্র ভাষায় আক্রমণ শুরু করলেন - এখন ওই ডাইনিটা যদি গর্ভবতী হয়ে পড়ে দেখিস কী ঝামেলা পোহাতে হয় তোকে।
            তুমি আমাদের কী মনে করো মা? তুমি কি মনে করো আমরা অনৈতিক কোন কাজ করছি?
            করছিসই তো। ওই মেয়েটার কোন বিশ্বাস আছে? তোর চেয়ে কত বছর বড় সে জানিস? তোর মুন্ডু চিবিয়ে খাচ্ছে সেই মেয়ে তা কি আমি বুঝিনা? ওই মেয়ে সব পারে। পেটে বাচ্চা এনে সে তোকে বশ করবে দেখিস।
            আজেবাজে কথা বলবে না মা। আমি তাকে ভালবাসি।
            ভালোবাসার কিছুই বুঝিস না তুই। এটার নাম ভালোবাসা নয়। ওই মেয়ে জাদু করেছে তোকে। কী আছে তার? কুৎসিত বিকলাঙ্গ বুড়ি একটা।
            খবরদার মা-
            
ঝগড়া আরো অনেকদূর গড়ানোর আগেই দরজায় টোকা পড়লো। পলিনের বান্ধবী এসেছেন দেখা করতে। হঠাৎ রুমের পরিবেশ বদলে গেলো। আলবার্ট ও পলিন উভয়েই এমন ভাব করতে লাগলেন যেন কিছুই হয়নি। একটু পরেই তারা আবহাওয়া বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন, অবকাশকেন্দ্রের অন্যান্য লোকদের নিন্দা করতে লাগলেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের অবাধ্যতার কথা বলতে লাগলেন। পলিন বন্ধুকে ডিনার খেয়ে যেতে বললেন। ডিনারের পরে আলবার্ট বেহালা বাজিয়ে শোনালো। তারপর মায়ের বান্ধবী চলে গেলে নিজের রুমে ঘুমাতে গেল আলবার্ট।
            
কিন্তু একটু পরেই মা এলেন তার রুমে। এসেই বললেন, একটা কথা তোকে পরিষ্কার বলছি আলবার্ট, তুই সারাজীবন বিয়ে না করলেও আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ওই মেয়েকে তুই বিয়ে করতে পারবি না।
            
মায়ের সাথে এ ব্যাপারে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আলবার্টের। তাই কিছু না বলে সে চুপ করে রইল। কিন্তু পলিন চুপ করলেন না। তিনি বলেই চলেছেন, ওই মেয়েকে বিয়ে করলে খুব ভুল করবি তুই। কী আছে ওই মেয়ের? বই পড়তে পড়তে ওই মেয়ে নিজেই তো একটা বই হয়ে গেছে। তোর একটা বউ দরকার, বই নয়। তোর চেয়ে কত বড় মেয়েটা। তোর তিরিশ হতে হতে তো ওই মেয়ে বুড়ি ডাইনির মত হয়ে যাবে। কোন ছেলেমেয়েও তো হবে না ওই বুড়ির। রূপসী হলেও না হয় বুঝতাম রূপ দেখে মজেছিস। ওই তো ডাইনির মত দেখতে - কী দেখে তুই ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস আমি জানি না। আমরা হলাম ইহুদি। ওরা কোন্‌ জাতি কে জানে। ওরকম অজাত-কুজাতের মেয়ে তুই বিয়ে করতে পারবি না এটাই আমি বলে দিচ্ছি।
            
আলবার্ট বুঝতে পারছে না মাকে কীভাবে চুপ করাবে। মাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। কিন্তু মা কেন তার ভালোবাসা বুঝতে পারছেন না ভেবে পায় না আলবার্ট। মা যেরকম অবুঝ শিশুর মত আচরণ করছে তাতে কথায় আরো কথা বাড়বে। আলবার্ট বললো, ঠিক আছে মা, ঠিক আছে। তোমাদের আপত্তি থাকলে আমি বিয়ে করবো না। যাও, এবার ঘুমাতে যাও। 

Saturday, 8 June 2019

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক ভালোবাসা - পর্ব-১


পৃথিবীতে শুধুমাত্র একজন বিজ্ঞানীর নাম বলতে বললে বেশির ভাগ মানুষ যে নামটি বলেন তা হলো আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মতো এত বেশি প্রচার আর কোন তত্ত্বই পায়নি এখনো। তাঁর E=mc2 সমীকরণটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি আর চিরায়ত জীবনাচরণে একটা বিরাট জায়গা জুড়ে আছেন, তেমনি বিজ্ঞানের জগত জুড়ে আছেন আইনস্টাইন।
           
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে আমরা কমবেশি সবাই চিনি। কিন্তু ব্যক্তি আইনস্টাইনের অনেকগুলো দিক আমাদের কাছে অজানা রয়ে গিয়েছিল অনেকদিন। আইনস্টাইন নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনাগুলো কখনোই প্রকাশ করতে চাননি। আইনস্টাইনের মৃত্যুর পরেও তাঁর সেক্রেটারি হেলেন ডুকাস অনেক চেষ্টায় গোপন করে রেখেছিলেন আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত জীবনের অনেকগুলো দিক। আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত প্রেম ভালবাসার সম্পর্কের টানাপোড়ন ইত্যাদি কোন কিছুই জানা যায়নি এতদিন। ১৯৮৭ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি ও হিব্রু ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন আর্কাইভ গবেষকদের জন্য খুলে দেয়া হলে প্রকাশিত হতে থাকে ব্যক্তি আইনস্টাইনের অনেকগুলো অজানা দিক। 
            
ভালোবাসা প্রসঙ্গে আইনস্টাইন নিজের সম্পর্কে লিখেছেন - "অবশ্যই কাউকে না কাউকে ভালোবাসতে হয় আমার"। আসলেই তাই - আইনস্টাইন তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে অনেককেই ভালোবেসেছেন এবং তাঁকেও গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন অনেকেই। তবে সবার ভালোবাসার প্রতি যথোচিত সম্মান তিনি দিতে পেরেছিলেন কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। মেরি, মিলেইভা, এলশা, হেলেন - অনেক নারী এসেছেন আইনস্টাইনের জীবনে বিভিন্ন সময়ে। কৈশোরেই পেয়েছেন প্রথম প্রেমের স্বাদ। ১৮৯৫ সালের এক মন-খারাপ করা বিকেলে প্রথম দেখা হলো আলবার্ট ও মেরির। মেরি উইন্টেলার - আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম প্রেমিকা।
            
১৮৯৫ সালের অক্টোবরের ২৬ তারিখ আরাউ স্কুলের থার্ড গ্রেড অর্থাৎ দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ষোল বছরের আলবার্ট। আরাউ জুরিখের কাছে একটা ছোট্ট শহরতলী। আলবার্টের এখানে আসার পেছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে। বছর দুয়েক আগেও মা-বাবা আর বোনের সাথে মিউনিখের বাড়িতে বেশ আনন্দেই দিন কাটছিলো আলবার্টের। কিন্তু তার বাবা হারম্যান আইনস্টাইনের ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। বাধ্য হয়ে তাঁর বাবা মা ও বোন মায়াকে নিয়ে ইতালির মিলানে চলে গেলেন ১৮৯৩ সালে।
            
আলবার্টকে তাঁরা মিউনিখে তাঁদের এক আত্মীয়ার বাসায় রেখে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ আলবার্ট ইতালিয়ান ভাষা জানে না বলে ওখানের স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না। তাছাড়া মিউনিখের স্কুলের পড়া শেষ হবার পর আলবার্টকে ইউরোপের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ জুরিখের পলিটেকনিকে পড়ানোর ইচ্ছে তার মা-বাবার।
            
কিন্তু মা-বাবা আর বোনকে ছাড়া মিউনিখের আত্মীয়ের বাড়িতে একা একা থাকতে মোটেও ভাল লাগছিলো না আলবার্টের। তাছাড়া স্কুলেও ভালো লাগছে না তার। মিলিটারি স্টাইলের টিচাররা যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেন আলবার্টকে। ইহুদি পরিবারের ছেলে হওয়াতে তাকে অপমান করা হয় আরো বেশি। কোন রকমে চোখ-কান বুজে বছর খানেক সহ্য করার পর আর পারা গেলো না। ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বরে মিউনিখ থেকে পালিয়ে চলে গেল মিলানে মা-বাবার কাছে।
            
আলবার্টের এরকম স্কুল থেকে পালিয়ে আসাতে ভীষণ রেগে গেলেন মা পলিন আইনস্টাইন। তিনি আলবার্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। তিনি পলিটেকনিকের ভর্তি-পদ্ধতি সম্পর্কে খবর নিতে শুরু করলেন। জুরিখের ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি - সংক্ষেপে পলিটেকনিক - ইউরোপের সেরা বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া এত সহজ নয়। ছেলের মেধা আছে তা পলিন জানেন, কিন্তু শুধু ঘরে বসে পড়াশোনা করেই সে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে যাবে সে আশা কিছুটা দুরাশা। তাছাড়া স্কুল পাসের সার্টিফিকেট ছাড়া তাকে ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগও তো দেবে না।
            
পলিন চেষ্টা করতে লাগলেন ছেলের ভর্তির ব্যাপারে কী করা যায়। আঠারো বছরের আগে পলিটেকটিকে ভর্তি করানো হয় না। আলবার্টের বয়স মাত্র ষোল। পলিন তাঁর প্রভাবশালী বন্ধুদের কাজে লাগিয়ে বয়সের ব্যাপারে কিছুটা ছাড় পাবার আশ্বাস পেলেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় পাস না করতে পারলে কিছুতেই ভর্তি করানো সম্ভব নয়।
            
১৮৯৫ সালের অক্টোবরে ভর্তি পরীক্ষা হলো। বিজ্ঞান ও গণিত অংশে খুবই ভাল করেছে আলবার্ট। কিন্তু ইতিহাস, ভাষা ইত্যাদি সাধারণ অংশে এতই খারাপ করেছে যে দুটো অংশ মিলিয়ে সে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করলো। এখন কী করা? পলিটেকনিকের পরিচালক পরামর্শ দিলেন কাছের কোন স্কুল থেকে হাইস্কুলের পড়াটা শেষ করিয়ে পরের বছর আবার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য।
            
আলবার্টের আরাউ স্কুলে ভর্তি হবার পেছনে এই হলো ইতিহাস। আরাউ স্কুলের শিক্ষক ইয়োস্ট উইন্টেলারের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে আলবার্টের। মা-বাবার কাছে থাকা সম্ভব হচ্ছে না আলবার্টের। শুরুতে তাই মনটা খুবই খারাপ ছিল তার। কিন্তু যখন দেখলো ইয়োস্ট উইন্টেলার এবং তার পরিবারের সবাই খুব আন্তরিক - আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করলো আলবার্টের। ইয়োস্ট উইন্টেলারের স্ত্রীর নাম পলিন। নিজের মায়ের নামের সাথে মিল দেখে আলবার্ট তাঁকে মা বলে ডাকতে শুরু করলো। পলিনও আলবার্টকে মাতৃস্নেহে আপন করে নিলেন। উইন্টেলারদের চার ছেলে তিন মেয়ে। সবচেয়ে ছোট মেয়েটি অষ্টাদশী, ভীষণ সুন্দরী - নাম মেরি।
            
মেরি শুরুতে আলবার্টকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিল। হ্যান্ডসাম বিষন্ন এই কিশোরটি একা একা ঘরে বসে বেহালায় করুণ সুর তোলে। বড়ই মায়া লাগে মেরির। সে আলবার্টের ঘরে যায়। তার ঘর গুছিয়ে রাখা, জামা-কাপড় পরিষ্কার করা এসব। আলবার্টের বেহালার হাত সত্যিই ভালো। হবে নাই বা কেন? পাঁচ বছর বয়স থেকেই ছেলেকে পেশাদার বেহালা শিক্ষকের কাছে বেহালা বাজানো শেখাতে শুরু করেছিলেন পলিন আইনস্টাইন। আর মেরি উইন্টেলারও চমৎকার পিয়ানো বাজায়। আলবার্টের সাথে মেরির ভাব হতে দেরি হলো না। কয়েকদিনের মধ্যেই তারা দুজনে বেহালা ও পিয়ানোর যুগলবন্দী বাজানো শুরু করলো। শুরু হলো তাদের প্রেমেরও যুগল-বন্দী।
            
মেরির সেবা-যত্ন-ভালোবাসায় আলবার্ট তো মহাখুশি। উচ্ছসিত হয়ে মেরির কথা জানিয়ে মাকে চিঠি লেখে সে। ছেলে আনন্দে আছে জেনে আলবার্টের মাও খুব খুশি। মেরির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মেরিকেও একটা চিঠি লেখেন পলিন আইনস্টাইন।
            
মেরি পলিনের চিঠি পেয়ে মনে করলো অভিভাবক পর্যায় থেকে তাদের প্রেমের স্বীকৃতি পাওয়া গেলো। তারপর কিছুদিন শুধু প্রেম আর প্রেম। আরাউয়ের জুরা পাহাড়ে, আরি নদীর ধারে, বিস্তীর্ণ প্রান্তরে মেরির হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ালো আলবার্ট। মেরি আলবার্টের চেয়ে বয়সে দুবছরের বড় হলেও আলবার্টের মজবুত শারীরিক গড়নের কারণে আলবার্টকেই অনেক বড় দেখায় মেরির পাশে। আলবার্ট মেরিকে বাচ্চাদের মত আমার ছোট্ট সোনা বলে ডাকে।
            
পরের বছর এপ্রিলে কিছুদিনের ছুটিতে মা-বাবার কাছে বেড়াতে মিলানে গেলো আলবার্ট। মায়া ও পলিন মেরি ও আলবার্টের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। সমানে ক্ষেপাচ্ছে আলবার্টকে। পলিন মেরিকে না দেখেই পছন্দ করে ফেলেছেন ছেলের বৌ হিসেবে। আলবার্ট প্রায় প্রতিদিনই চিঠি লেখে মেরিকে। কী কবিত্বময় সে চিঠির ভাষা - আমার ছোট্ট পরী, …….., সারা পৃথিবী আমার জন্য যা করেছে তুমি করেছো তার চেয়ে বেশি। তুমি আমার সূর্যালোক …..”
            
ছুটির পর আলবার্ট ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের পরীক্ষা শুরু হলো। ভালোভাবে পাশ করলো আলবার্ট। এবার পলিটেকনিকের ভর্তি পরীক্ষাতেও কোন সমস্যা হলো না। জুরিখের পলিটেকনিকে ভর্তি হলো আলবার্ট। ১৮৯৬র অক্টোবর থেকে তার ক্লাস শুরু। সেখানে যাবার আগে মেরির সাথে অনেক রঙিন স্বপ্নের জাল বুনে, দুজনের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে আরাউ থেকে চলে গেল আলবার্ট।
            
জুরিখের পলিটেকনিকে ক্লাস শুরু হলো আলবার্টের। তাদের গ্রুপে মোট পাঁচজন শিক্ষার্থীর চারজন ছেলে এবং একজন মেয়ে। মেয়েটিরও আলবার্টের মত ফিজিক্স মেজর, বাকিদের সবারই ম্যাথ্‌স মেজর। আলবার্ট তার এতদিনের শিক্ষাজীবনের কোথাও কোন মেয়ে সহপাঠী দেখেনি। এই পলিটেকনিকেও আর কোন মেয়ে চোখে পড়েনি তার। ইউরোপে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ তখনো মসৃণ হয়নি। পাঁচজনের ক্লাসে পরস্পর বন্ধু হতে সময় লাগলো না আলবার্টের। মার্সেল গ্রসম্যান, ইয়াকব এহ্‌রাত ও লুই কলরোস বেশ ভাল বন্ধু হয়ে গেল আলবার্টের। কিন্তু মেয়েটি - মিলেইভা মেরিক - ভীষণ চুপচাপ, কারো সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, চোখ তুলে তাকায়ও না কারো দিকে। 
            
আলবার্ট ভালো করে লক্ষ্য করে মেয়েটিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মত সুন্দরী সে নয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। মাথার কালো চুলে কোনরকম যত্নের ছাপ নেই। ক্লাসের সব ছেলেরাই দেখে মেয়েটিকে। একজন মাত্র মেয়ে ক্লাসে থাকলে তাকে সহপাঠির চেয়ে মেয়ে হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছেলেরা। আলবার্ট একটু বেশি পরিমাণেই লক্ষ্য করছে মিলেইভাকে। মেরির শারীরিক সৌন্দর্যের সাথে কোন তুলনাই চলে না মিলেইভার। তবে কেন এত আকর্ষণ অনুভব করছে আলবার্ট? পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতে তুখোড় মিলেইভা। ঠিক এই কারণেই কি এত আকর্ষণ? কিন্তু একবার চোখ তুলে আলবার্টের দিকে তাকাচ্ছেও না সে। পড়াশোনার বাইরে কি আর কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই মিলেইভার?
            
না, পড়াশোনার বাইরে আর কোন কিছু নিয়ে ভাবতে চায় না মিলেইভা মেরিক। সে জানে পলিটেকনিকে ভর্তি হবার জন্য তাকে কী কষ্ট করতে হয়েছে। পলিটেকনিকের ইতিহাসে এই ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত তার আগে আর মাত্র চারজন মেয়ে এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। শুধু এখানে কেন সার্বিয়ার জাগরেভ রয়েল ক্লাসিক্যাল স্কুলে পড়তেও তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজ্যে সে-ই প্রথম মেয়ে যে ছেলেদের সাথে একই ক্লাসে বসে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে ১৮৯১ সালে।

পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর পরেও স্কুলে ভর্তি হবার জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিলো তখনকার ষোড়শী মিলেইভাকে। তার বাবা মিলোস মেরিক একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা না হলে হয়তো এই বিশেষ অনুমতি পাওয়া সম্ভব হতো না। তখন থেকেই মিলেইভার স্বপ্ন একদিন অনেক বড় হবে সে। সরবোর্ন ইউনিভার্সিটির মেরি স্ক্লোদভস্কা তার আদর্শ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে মিলেইভা - সারাজীবন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা করে যাবে। কোনদিনও বিয়ে করবে না। মেয়েরাও যে ছেলেদের মতো যে কোন পেশায় ভালো করতে পারে তা সে দেখিয়ে দেবে।
            
স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মিলেইভা ভেবেছিল ডাক্তার হবে। স্কুলের সব পরীক্ষায় তার রেজাল্ট অসাধারণ। জুরিখ ইউনিভার্সিটির মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হতে কোন সমস্যাই হলো না। ১৮৬৭ সাল থেকেই জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে মেয়েরা ভর্তি হবার সুযোগ পাচ্ছে।
            
১৮৯৬ সালের জুন মাসে মিলেইভা তার মেডিকেলের পড়াশোনা শুরু করলো। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই সমস্যা দেখা দিলো। মেডিকেলের ক্লাসে সে ছাড়া আর কোন মেয়ে নেই। ক্লাসের ছেলেরা নানাভাবে বিরক্ত করতে শুরু করলো তাকে। কনজেনিটাল হিপ ডিফরমিটির কারণে তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। সেটা নিয়েও বিদ্রুপ করে ছেলেরা যারা নাকি মেডিকেল কলেজে পড়তে এসেছে ডাক্তার হবার জন্য। মিলেইভা সর্বশক্তি দিয়ে সহ্য করে যেতে চাইলো, কিন্তু যখন এনাটমির ব্যবচ্ছেদ ক্লাসে তার নারীশরীর নিয়ে ছাত্রদের নোংরা আলোচনায় শিক্ষকরাও যোগ দিতে শুরু করলেন তখন আর পারলো না সে। ছেড়ে দিল মেডিকেলের পড়াশোনা। অক্টোবরে এসে ভর্তি হয়েছে পলিটেকনিকে। ভর্তি পরীক্ষা পাস করতে কোন অসুবিধে হয়নি তার। কিন্তু এখন তার ভয় হচ্ছে ক্লাসে একমাত্র মেয়ে হওয়াতে এখানেও যদি ছেলেদের টিটকিরি সহ্য করতে হয়! তাই সে ঠিক করেছে কারো সাথে কথাই বলবে না, কারো দিকে তাকাবেও না।
            
আলবার্ট জানতে পেরেছে মিলেইভা তার চেয়ে বয়সে সাড়ে তিন বছরের বড়। তাতে কিছু যায় আসে না। মেরিও তার চেয়ে দুবছরের বড়। মেরিকে সে এখনো আবেগপূর্ণ চিঠি লিখে যাচ্ছে বটে - কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা কেমন যেন রুটিন-কাজ হয়ে যাচ্ছে। মনের সাড়া ঠিক আগের মত নেই। তবুও সে মিলেইভার ব্যাপারে কিছুই জানায় না মেরিকে। নিজের ময়লা জামা-কাপড় এখনো আগের মতই মেরিকে পার্সেল করে দেয়, আর মেরি সযত্নে পরিষ্কার করে পাঠিয়ে দেয় তার কাছে।
            
প্রথম বার্ষিক পরীক্ষায় দেখা গেলো মিলেইভা ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট হয়ে গেছে। আলবার্ট বুঝতে পারলো এই মেয়ের মন জয় করতে হলে আবেগ দিয়ে কাজ হবে না। গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের আলোচনা শুরু করে দিলো মিলেইভার সাথে। পদার্থবিজ্ঞানে আলবার্টের চিন্তা-ভাবনার স্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা ইতোমধ্যেই খেয়াল করেছে মিলেইভা। আস্তে আস্তে আলাপ শুরু হলো দুজনের। ক্রমশ দুজনই বুঝতে পারে তাদের মধ্যে একটা ভালোলাগা তৈরি হচ্ছে।
            
১৮৯৭ সালের সেকেন্ড সেমিস্টারের মাঝামাঝি মিলেইভা জানালো যে সে হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে চলে যাচ্ছে। ভীষণ অবাক হলো আলবার্ট। মিলেইভার সাথে পরিচয়ের পর থেকে গত এক বছর ধরে সে মিলেইভাকে নিয়ে ভেবেছে। মেরি উইন্টেলারের সাথে মিলেইভা মেরিকের তুলনা করে দেখেছে সে। মিলেইভার মধ্যে যে জ্ঞান ও বুদ্ধির দীপ্তি সে দেখছে মেরির মধ্যে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। শুরুতে মেরিকে কিছু না জানালেও কিছুদিন আগে মেরির মাকে সে জানিয়ে দিয়েছে যে মেরির সাথে সে আর প্রেমের সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছে না। একথা শোনার পর মেরি যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আলবার্ট পারলো এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে! অনেক দিন থেকে আলবার্টের কোন চিঠিপত্র না পেয়ে আলবার্টের অসুখ-বিসুখ হয়েছে ভেবে মেরি দুশ্চিন্তা করছিল। আলবার্টের খবরের জন্য মেরি আলবার্টের মায়ের কাছে চিঠি লিখেছে। উত্তরে পলিন জানিয়েছিলেন - আলবার্ট সুস্থ আছে, তবে সে চিঠি লেখার ব্যাপারে ভীষণ অলস। মেরি ভেবে পায় না - যে আলবার্ট একসময় প্রতিদিন চিঠি লিখতো সে কীভাবে এত অলস হয়ে গেলো। পাগলের মত হয়ে গেল মেরি।


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts