Monday 31 August 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ৬

 


ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলফ্রেড ওয়াটারফ্রন্ট 

লাঞ্চবক্স নিয়ে জানালার পাশে একটা উঁচু টেবিলে বসলাম বাইরে ওয়াটারফ্রন্টের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে হুইল অব দি কেইপ টাউন - বিশাল চাকায় লাগানো ছোট ছোট কামরায় মানুষ উঠে দুলতে দুলতে দেখছে চারপাশ। মনে পড়লো সেই কোন্‌ ছোটবেলায় সূর্যব্রতর মেলায় ঘুরন্ত দোলনায় চড়তাম। এখন চোখের সামনে হাতের নাগালে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত চাকাগুলোর একটি। কিন্তু সেই ছোটবেলায় যে থ্রিলটা ছিল এখন কোথায় যেন তা নেই।

          চারদিকে নানা রঙের নানা রকমের মানুষ। ডানদিকে একজোড়া চায়নিজ তরুণ-তরুণী নিজেদের ভাষায় ভাব বিনিময় করছে। বামদিকে কয়েকটা টেবিল জড়ো করে বসেছে দশ বারোজনের একটা ভারতীয় গ্রুপ। তাদের হিন্দি কথোপকথন মোটামুটি বুঝতে পারছি। এই ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলফ্রেড ওয়াটারফ্রন্ট কেইপ টাউনের ট্যুরিস্টদের খুব প্রিয় জায়গা। বছরে প্রায় পঁচিশ লাখ মানুষ আসে এখানে। টেবিল পর্বতেও অত মানুষ যায় না।

          দ্রুত খাওয়া শেষ করে হারবার ক্রুজে উঠার জন্য রওনা দিলাম। অ্যাকোয়ারিয়ামের পাশ দিয়ে প্রায় দুশ মিটার যাবার পর পানিতে বাঁধা সারি সারি স্পিডবোট। তার পাশে সুন্দর জেটিতে বাঁধা টকটকে লাল রঙের দুটো ফেরি। সাইটসিয়িং বাসে টিকেটের সাথে হারবার ক্রুজের টিকেট ফ্রি পাওয়া গেছে। একটা ফেরি এইমাত্র ছেড়ে গেছে। পরেরটি ছাড়বে আরো আধঘন্টা পরে।

          ফেরির মাঝামাঝি একটা সিটে আরাম করে বসলাম। এখানেও ধারাবিবরণী শোনার ব্যবস্থা আছে বিভিন্ন ভাষায়। ইঞ্জিন চালু হবার পর শোনা যাবে। ফেরিতে আমার পিছু পিছু তিন চার বছরের একটা বাচ্চাকে নিয়ে একজন তরুণী-মা উঠে বসেছেন। আর কোন যাত্রী বা ক্রু নেই এখন। পানিতে ভাসমান ফেরিতে বসে ওয়াটারফ্রন্টের চারপাশ অন্যরকম দেখাচ্ছে। আকাশে মেঘের ফাঁকে সামান্য একটু আলোর রেখা। সেই আলোয় টলটলে পরিষ্কার পানিতে ছায়া পড়েছে চারপাশের বিল্ডিংগুলোর। পেছন দিকে তাকালে টেবিল পর্বতের অনেকখানি দেখা যায়। ওয়াটারফ্রন্টের রঙিন বুকলেট খুলে পড়তে শুরু করলাম।

 

ওয়াটারফ্রন্ট



         ওয়াটার ফ্রন্টের ইতিহাস চারশো বছরেরও বেশি পুরনো। ডাচ নাবিক ভ্যান স্পিলবার্গেন ১৬০১ সালে কেইপ টাউনের পশ্চিম তীর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার উজানে প্রাকৃতিক হারবার আবিষ্কার করে এই নাম দেন সালদানাহ বে। ১৫০৩ সালে পর্তুগিজ নাবিক অ্যান্টোনিও ডি সালদানাহ টেবিল মাউন্টেন আবিষ্কার করেছিলেন। স্পিলবার্গেন সালদানাহর নাম অনুসারে এই উপসাগরের নাম রেখেছিলেন।

          সালদানাহ উপসাগরের হারবারে মিঠা পানির সুবিধা ছিল না। তাই খুঁজতে খুঁজতে ১৪০ কিলোমিটার উজানে এসে স্পিলবার্গেন পেয়ে গেলেন মিঠা পানির সমৃদ্ধ আরেকটি হারবার। নাম রাখলেন টেবল বে। সেই হারবারই চারশ বছর ধরে আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান রূপ নিয়েছে।

          পর্তুগিজরা পশ্চিম থেকে পূর্বে যাবার পথে কেইপ টাউনকে তাদের মধ্যবর্তী স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছিলো শুরু থেকে। কিন্তু স্থানীয় আফ্রিকানদের ওপর তাদের অত্যাচারের মাত্রা এমন বেড়ে যায় যে আফ্রিকানরা বিদ্রোহ করে। ফলে ইউরোপিয়ান দখলদার ও স্থানীয় আফ্রিকানদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। মারা যায় কয়েকশ আফ্রিকান। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে মারা যায় ৭৫ জন। ফলে পর্তুগিজরা কেইপ টাউন থেকে সরে মোজাম্বিকে চলে যায়।

          পরবর্তী ৫০ বছরে আরো বিভিন্ন ইউরোপিয়ান কোম্পানি কেইপ টাউনের হারবার ব্যবহার করেছে- কিন্তু স্থায়ী কোন স্থাপনা তৈরি করেনি এখানে। ১৬৫২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে স্থায়ী কিছু ঘরবাড়ি তৈরি করে। প্রথম ঘরটি বানায় মাটি আর কাঠ দিয়ে। পাথর ব্যবহার করে প্রথম দুর্গ বানায়- ক্যাসল অব গুড হোপওটা এখনো আছে।

          ১৬৫৬ সালে এখানে তৈরি হয় প্রথম জেটি। বড় বড় কাঠের গুড়ি আর পাথর দিয়ে তৈরি জেটিতে ছোটখাট জাহাজ ভিড়তো ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত। বড় জাহাজগুলো দূরে মাঝসাগরে নোঙর করতো। কালো আফ্রিকান কুলিরা কিছু টাকার জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মাঝসাগরে জাহাজ থেকে মাল খালাস করে ছোট নৌকায় তুলতো।

          তারপর আড়াইশ বছর ধরে কেইপ টাউনের আকার ক্রমশ বড় হয়েছে। সাগরের তীর থেকে পাহাড়ের কোল পর্যন্ত ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে।

          শুরু থেকে খারাপ আবহাওয়া একটা বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করেছে কেইপ টাউনে জাহাজ নিয়ে আসার ক্ষেত্রে। প্রচন্ড ঝড়ে অনেক জাহাজ ডুবেছে এখানে। মারা গেছে অনেক মানুষ। নিরাপদে জাহাজ তীরে ভেড়ানোর জন্য প্রথম কার্যকরী ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭৩৭ সালে।

          প্রচন্ড ঝড়ে অনেক জাহাজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবার পর গভর্নর সোয়েলেংরেবেল প্রস্তাব করলেন সমুদ্রে পাথর ফেলে তীরের কাছে কিছু অংশ আলাদা করে ফেলতে। তাতে ঝড়ের সময় জাহাজগুলো সেখানে ঢুকে আশ্রয় নিতে পারবে। নিয়ম করা হলো কেইপ টাউনে যারাই কোনকিছু বিক্রি করতে আসবে বযাবার সময় সমুদ্রে সমান পরিমাণ পাথর ফেলে যাবে। কিন্তু কারোরই কোন উৎসাহ থাকে না এ ব্যাপারে। কিছুদিনের মধ্যেই সেই প্রকল্প মাঠে মারা যায়।

          সামুদ্রিক ঝড়ের বিরুদ্ধে কিছু করা না গেলেও ডাচ ও তাদের ফরাসি বন্ধুরা মিলে দুটো মিলিটারি চৌকি স্থাপন করলো বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষার্থে।

          ডাচদের ইউরোপিয়ান শত্রু ছিল ব্রিটিশরা। ১৭৯৫ সালে কেইপ টাউন দখল করে নেয় ব্রিটিশরা। ১৮০৩ সাল পর্যন্ত তাদের দখলে ছিল কেইপ টাউন।

          ১৭৯৫ সালে ডাচরা ব্যাটাভিয়ান রিপাবলিক গঠন করেছে। ১৮০৩ সালে তারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে কেইপ টাউন পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। কিন্তু তিন বছর পরেই ব্রিটিশরা আবার দখল করে নেয় কেইপ টাউন। তারপর থেকে ব্রিটিশরাই শাসন করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।

          কেইপ টাউনের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটার সাথে সাথে কেইপ টাউন বন্দরে জাহাজের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। সামুদ্রিক ঝড়ের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা না থাকায় জাহাজডুবির সংখ্যাও বেড়ে চললো। টাকার অভাবে কোন নিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিলো না। অনবরত জাহাজডুবির কারণে ইনসুরেন্স কোম্পানিগুলো কেইপ টাউনের বন্দরে ভিড়লে জাহাজের ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিলো। ব্রিটিশ সরকার এবার বাধ্য হয়ে কাজে হাত দিলো। কার্যকর হারবার তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলো।

          ১৮৬০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কুইন ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পুত্র ১৬ বছর বয়সী প্রিন্স আলফ্রেড এই বিশাল কর্মযজ্ঞের উদ্বোধন করেন। ট্রাক ট্রাক পাথর ফেলা হয় সমুদ্রে। শুরু হয় সমুদ্রশাসন - মহাসাগরের স্রোত নিয়ন্ত্রণ।

          পরবর্তী ২৫ বছর ধরে কাজ চলে। শত শত শ্রমিকের বেতন দেবার মতো টাকা নেই সরকারের। খরচ বাঁচাতে ব্রিটিশ কয়েদীদের নিয়ে আসা হলো কাজে। তৈরি হলো তাদের জেলখানা। সারাদিন কাজ করে তারা। ১৮৮৫ সালে ২৩৬০ জন কয়েদী কাজ করছিলো ওয়াটারফ্রন্টে। কয়েদীদের জন্য তৈরি হয় ব্রেকওয়াটার প্রিজন। (বর্তমানে ওটা ব্রেকওয়াটার লজ)।

          ব্রেকওয়াটার প্রিজন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর জেলখানা। বলা হয়ে থাকে সব জাতের কয়েদীই নাকি ছিল সেই জেলখানায়। শুরুতে জাতপাতের সমস্যা ছিল না। বরং কর্তৃপক্ষ দুজন কালো কয়েদীর মাঝখানে একজন সাদা কয়েদীকে ঘুমাতে বাধ্য করতো। তাতে শুয়ে শুয়ে কথা বলার সুযোগ থাকতো না।

          কালো কয়েদীদের বেশিরভাগের অপরাধ ছিল হীরাচুরি। হীরার খনির শ্রমিক তারা। অমসৃণ হীরার কোন কুচি তাদের পকেটে পাওয়া গেলে প্রচন্ড মারের সাথে পাঁচ থেকে বারো বছর জেল। তারা আসতো ব্রেকওয়াটার প্রিজনে। আর খাটতে হতো হারবার কনস্ট্রাকশনে।

          ১৮৯১ সালে কালো কয়েদীদের আলাদা করে ফেলা হয় সাদাদের কাছ থেকে। সাদাদের জন্য আরেকটি জেলখানা বানানো হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্রেকওয়াটার প্রিজন। এখন সেটাতে কেইপ টাউন ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেস এর ক্লাস চলে।

          ১৯০৫ সাল নাগাদ সাউথ পিয়ার ও ভিক্টোরিয়া বেসিনের কাজ শেষ হয়। কিন্তু ততদিনে আফ্রিকায় সোনার খনি হীরার খনির রমরমা শুরু হয়ে গেছে। সারা দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের নজর কেইপ টাউনের দিকে। অসংখ্য জাহাজ ভিড়তে শুরু করেছে কেইপ টাউন বন্দরে। বন্দরের পরিধি বাড়ানোর দরকার হয়ে পড়লো।

          ১৯৩৫ সালে ডক তৈরির কাজ শুরু হলো। পাথর আর মাটি দিয়ে বিরাট এলাকা ভরাট করে ফেলা হলো। বর্তমানে কেইপ টাউনের মোট ক্ষেত্রফলের অর্ধেক ১৯৩৫ সালের আগে সমুদ্রের অংশ ছিল। হারবারের পাশ দিয়ে যাওয়া বিচ স্ট্রিটও তখন পানির নিচে ছিল। তখনো কেইপ টাউন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের একমাত্র পথ।

          বন্দর, জেটি, ড্রাইডক, শিপইয়ার্ড ইত্যাদি কার্যক্রম ভালোই চলছিল। জায়গাটিকে ট্যুরিস্টিদের জন্য আকর্ষণীয় ব্যবসা ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ১৯৮৮ সালে এখানে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলফ্রেড ওয়াটারফ্রন্ট গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়।

          ১২৩ হেক্টর জমিতে ছয় ধাপে কাজ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর সরকারের অত্যাচারের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের অর্থনৈতিক অবরোধ চলছিলো। তাই কোন আন্তর্জাতিক কোম্পানি এগিয়ে এলো না। স্থানীয় কোম্পানিগুলো স্থানীয় সরকারে আস্থাশীল নয়। তারপরও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে প্রথম ধাপে পুরনো বিল্ডিংগুলোর সংস্কার কাজ সম্পন্ন হলো। সেগুলো আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য ভাড়া দেয়া হলো।

          দ্বিতীয় দফায় ভিক্টোরিয়া ওয়ার্ফ তৈরি হলো। প্রচুর দোকানপাট সিনেমাহল ইত্যাদি তৈরি হলো। দেখা গেলো ট্যুরিস্ট ও স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেলোএর মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলো। গণতন্ত্র ফিরে এলো। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হলেন। ওয়াটারফ্রন্টের কাজও চলতে লাগলো বেশ দ্রুতকয়েক বছরের মধ্যেই ওয়াটারফ্রন্ট কেইপ টাউনের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হলো।

          ১৯৯৬ সালে ওয়াটার ফ্রন্টের মালিকানা ছিল ট্রান্সলেট পেনশান ফান্ডের। ২০০৬ সালে ৭০০ কোটি র‍্যান্ডের বিনিময়ে ওয়াটার ফ্রন্ট কিনে নেয় দুবাই কনসার্টিয়াম। তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় গুজব রটে যায় যে ওয়াটারফ্রন্টের সাথে টেবল মাউন্টেনের একটা অংশও বিক্রি হয়ে গেছে। কিছুদিন পর প্রায় এক হাজার কোটি র‍্যান্ডের বিনিময়ে ওয়াটারফ্রন্টের মালিকানা চলে আসে সাউথ আফ্রিকান কনসার্টিয়ামে কাছে। এই কনসার্টিয়াম পাবলিক পেনশানের টাকায় গঠিত। ওয়াটারফ্রন্টের নির্মাণ কাজ এখনো চলছে। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ওয়াটারফ্রন্টে রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক এসেছিল। এখনো প্রতিবছর প্রায় পঁচিশ লাখ মানুষ ওয়াটারফ্রন্টে আসে। পর্যটকদের ভোটে V & A Waterfront কেইপ টাউনের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান

          আস্তে আস্তে ফেরির যাত্রী সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে আর বাইরের আলো কমছে কুয়াশা জমে উঠেছে আগের ফেরিটি ট্রিপ শেষ করে ফিরে আসতে না আসতেই আমাদের ফেরি চলতে শুরু করলো।

          আশেপাশে অনেকগুলো ছোটবড় স্পিডবোট, লঞ্চ, স্টিমার। কয়েকটা প্রমোদতরীতে উচ্চস্বরে বাজনার সাথে নাচছে অনেকে। সরু খাল দিয়ে যাবার সময় খালের উপরের লোহার ব্রিজটি উপরের দিকে উঠে জায়গা করে দিলো।

          আস্তে আস্তে মোহনার দিকে এগোচ্ছে ফেরি। কুয়াশার কারণে বেশিদূর দেখা যাচ্ছে না। খুব কাছ দিয়েই যাচ্ছে অনেকগুলো স্পিডবোট। যেরকম গতিতে চলছে যে কোন মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মানুষ অপ্রয়োজনীয় গতির দাপট দেখাতে কেন যে পছন্দ করে। আবার যেখানে গতি দরকার - সেখানে গতির দেখা পাওয়া যায় না। ওয়াটারফ্রন্ট মেরিনা, আলফ্রেড বেসিন ও ভিক্টোরিয়া বেসিনের চারপাশে ঘুরে আধঘন্টার মধ্যে ফিরে এলাম জেটিতে।

 

 

ওয়াটারফ্রন্ট সাইট সিয়িং ফেরি


 ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে। এবার ফেরা যাক। সারাদিনে অনেক ঘুরাঘুরি হয়েছে।

          হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম হোটেলে। লিফট থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেল ফ্লোর ম্যানেজার ক্লারার সাথে।

     গুড ইভনিং স্যার।

     গুড ইভনিং। হাউ আর ইউ?

     গুড। থ্যাংক ইউ স্যার। আপনার রুম গুছিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু লাগলে আমাকে জানাবেন।"

          এদের হাসিখুশি আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ।


পর্ব ৭

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ৫

 



পর্বতের নাম টেবিল 

আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণ দেশের আরামদায়ক এক বিছানায় ঘুম ভাঙলো ভোর চারটায় ঘুম ভাঙতেই আমার বাবার কথা মনে পড়লো স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে সূর্যওঠার অনেক পরেও যখন ঘুম থেকে উঠতে চাইতাম না, বাবা গায়ে পানির ছিটা দিতে দিতে বলতেন, সকালে শয়ন আর সকালে উত্থান, এই দুই আচরণ সুখের নিদান।

     শুধুমাত্র তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে আর তাড়াতাড়ি উঠেই যদি সুখি হওয়া যায়- তাহলে এই মুহূর্তে আমার সুখের সীমা নেই কিন্তু সুখের কথা খুব বেশি বলার উপায়ও নেই কারণ বাবার পরবর্তী দুটো লাইন ছিলো এরকম, অহঙ্কার না করিও সুখের সময়, সুফল ধরিলে গাছ নত হয়ে রয়।

          বিনীত হবার এই শিক্ষাটা সব দেশে সব সমাজে সব কালেই ছিলো বলে আমার ধারণা পৃথিবীর চিরকালীন জননায়কদের সবাই ছিলেন বিনীত মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু, নেলসন ম্যান্ডেলা কেউই উদ্ধত ছিলেন না যারা ক্ষমতা দখল করে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে তারা সাময়িকভাবে স্যালুট পেলেও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে গেছেন সময়ের টানে

          কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের এই ভূখন্ড কয়েক শ' বছর ধরে দখল করে শাসন করেছে উদ্ধত ইউরোপিয়ানরা তাদের হাত থেকে সবার জন্য সমান অধিকার আদায় করে দেশকে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে নিয়ে এসেছেন যে নেতা সেই নেলসন ম্যান্ডেলার ভেতর প্রচন্ড শক্তি ছিলো- কিন্তু শক্তির উন্মত্ততা ছিলো না বলেই তিনি শতবছরের বঞ্চিত মানুষদের ভেতরেও সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন- ক্ষমা ও পরমতসহিষ্ণুতার মহৎ গুণ

          কিন্তু দারিদ্র্য গুণনাশিনী দারিদ্র্যের সাথে সারাক্ষণ যুদ্ধ করতে হলে কোন মহৎগুণই অবশিষ্ট থাকে না মানুষের মধ্যে আফ্রিকা ভ্রমণের যতগুলো গাইড বই লেখা হয়েছে তার সবগুলোতেই গোটা গোটা মোটা মোটা অক্ষরে বারবার সর্তক করে দেওয়া হয়েছে এই ভূখন্ডের অপরাধপ্রবণতা, চুরি, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণের ব্যাপারে বারবার বলা হয়েছে পকেটে বেশি টাকা পয়সা রাখবে না, গায়ে অলংকার পরে বের হবে না, দামী ঘড়ি পরবে না, দামী ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে রাখবে না, নির্জন পথে একলা হাঁটবে না একটা দেশের জন্য এসব সাবধানবাণী খুবই অপমানজনক এই অপমান নিশ্চয় গায়ে লাগছে এদেশের মানুষের - বিশেষ করে যাঁরা প্রশাসনে আছেন, যাঁরা নিয়ত চেষ্টা করছেন দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে

          জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম বাইরে এখনো অন্ধকার রাস্তা নির্জন ওপারে পাহাড়ের উপরে ছবির মতো বাড়িগুলোর বাইরে আলো জ্বলছে সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর উঁচু দেয়ালের উপরে কাঁটাতাঁর দেয়া ধনী ও দরিদ্র্যের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধানটা এখানে বড়ই বেশি ধনতান্ত্রিক পৃথিবীর এটাই বর্তমান নিয়ম অর্থনৈতিক অবস্থা হয়তো ভালো হয়ে গেছে সবারই- কিন্তু ধনীর সম্পদ বাড়ছে যে গতিতে, দরিদ্র্যের ধন বাড়ছে তারচেয়ে অনেক কম গতিতে ফলে ব্যবধানটা বাড়ছে দ্রুত

          সামনে ওয়াচ অ্যাম্পোরিয়াম পাহারা দিচ্ছে একজন দারোয়ান একটা টুল নিয়ে বসে আছে বারান্দায় ভোররাতের কেইপ টাউন হেঁটে দেখার লোভ হচ্ছে কিন্তু সাবধানবাণী পিছু ছাড়ছে না তাই ঘরের ভেতর থেকেই দেখছি যতদূর চোখ যায়

          হুঁশ করে একটা গাড়ি চলে গেলো রাস্তার কোন শব্দ রুমে আসছে না এই শব্দনিয়ন্ত্রণ প্রশংসার দাবিদার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখলাম দুজন ছিন্নমূল মানুষ ডাস্টবিন ঘাঁটছে ঘড়ির দোকানের দোতলায় একটা বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট আছে ওখানকার উচ্ছিস্ট খুঁজছে দুজন মানুষ- কর্পোরেশনের গাড়ি এসে ডাস্টবিন সাফ করার আগেই

          আস্তে আস্তে আকাশ ফর্সা হয়ে উঠছে ভোরের আলোর একটা অগাধ স্নিগ্ধতা আছে আমি ছটফট করছি কখন বের হবো হোটেলের ব্রেকফ্রাস্ট শুরু হয় সাড়ে ছটায় আরো আধ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে

          টিভি অন করলাম আল জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন ইত্যাদির পাশাপাশি লোকাল চ্যানেলের কয়েকটায় আফ্রিকানস ভাষায় সম্প্রচার চলছে।

          আফ্রিকান্‌স ভাষার ইতিহাস কয়েকশ' বছরের পুরনো। আফ্রিকান্‌স ভাষাকে কালারড মানুষের ভাষা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এখন দক্ষিণ আফ্রিকার বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজির পাশাপাশি আফ্রিকান্‌স ভাষাতেও কথা বলে।

          আফ্রিকানস ভাষা মূলত এসেছে ডাচদের কাছ থেকে। আলাদা ভাষা হিসেবে আফ্রিকান্‌স এর উৎপত্তি কেইপ টাউনে। ফ্রেন্স ও ডাচ কলোনিস্টরা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতো। নগর সম্প্রসারণের কাজে স্থানীয় আফ্রিকানরা ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসেছে কেইপ টাউনে। ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশ থেকেও এসেছে অনেক শ্রমিক। তাদের উচ্চারণ ও নিজেদের শব্দের সাথে ডাচ শব্দ মিশে একটা কথ্যরূপ পেয়েছে। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আফ্রিকান্‌স ভাষাএই ভাষাকে কিচেন-ডাচ বা কেইপ-ডাচ নামেও ডাকা হয়।

          ১৯৬১ সালে একটা আলাদা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় আফ্রিকান্‌সএখন দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে এবং বৎসোয়ানাতেও আফ্রিকান্‌স ভাষা প্রচলিত। এই ভাষা লেখা হয় আরবি অক্ষরে। কয়েক দশক আগে ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এক প্রবন্ধে আফ্রিকানস ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত ভাষা হিসেবে উল্লেখ করায় ক্ষেপে গিয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ। বিখ্যাত মন্টব্ল্যাক কোম্পানির আফ্রিকান মালিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে কোন রকম বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দেয়। পরে তারা দুঃখ প্রকাশ করে তাদের দেয়া সবচেয়ে কুৎসিত" বিশেষণ প্রত্যাহার করে নেয়।

          সাড়ে ছটায় রেডি হয়ে নিচে নামলাম। রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। চার-পাঁচজন ওয়েটার ব্যস্ত বুফে ব্রেকফাস্টের টেবিল সাজাতে। খাবারের বেশিরভাগই আর্ন্তজাতিক। আফ্রিকান খাবার খেতে হলে হয় লোকাল স্ট্রিট ফুড খেতে হবে নয়তো কোন নির্ভেজাল আফ্রিকান রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হবে।

          খাদ্যের ব্যাপারে নিজেকে সর্বভূক মনে করলেও দুধ দই ঘি মাখন আমার সহ্য হয় না। অথচ ব্রেকফাস্টের বেশিরভাগ খাবারে ওসবেরই প্রাধান্য। ডিম, রুটি আর আফ্রিকান কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। আফ্রিকান আঙুরের স্বাদও চমৎকার। কেইপ টাউনে মদ তৈরির কারখানা এবং সংযুক্ত আঙুরক্ষেত প্রসিদ্ধ। আজ বা কাল আঙুরক্ষেত দেখতে যেতে হবে। আফ্রিকান পিয়ারের স্বাদও খুব ভালো লাগলো। পিয়ার অনেকটা আমাদের পেয়ারার মতো- তবে বিচি নেই।

          অলস পায়ে রাস্তায় নেমে এলামসকালের নরম রোদ হালকা সোনালীবাতাস একটু ভেজা ভেজা, ঠান্ডা। সমারসেট রোডে কিছু একটা আয়োজন চলছে। ক্যামেরা আর নিরাপত্তাকর্মীর উপস্থিতি চোখে পড়ছে। শ্যুটিং চলছে নাকি? কেইপ টাউন এখন হলিউড ও ইউরোপের অনেক সিনেমার শ্যুটিং স্পট। এখানে বেশ কিছু ফিল্ম স্টুডিও গড়ে উঠেছে।

          না শ্যুটিং নয়, রাস্তায় দৌড় শুরু হয়ে গেছে। অসংখ্য নারী-পুরুষ ছেলেবুড়ো রাস্তায় দৌড়াচ্ছে। তাদের গায়ে একটা করে নম্বর সাঁটা আছে। ম্যারাথন বা অন্য কোন দৌড়। কোন আদর্শ প্রচার বা কোন মহৎ কাজের তহবিল সংগ্রহের জন্য এরকম দৌড়ের আয়োজন ইদানিং খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

          কিছুদূর পর পর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে স্বেচ্ছাসেবক। প্রায় সবাই বয়সে তরুণ। দুদিন পর ১০ মে - ওয়ার্ল্ড মুভ ফর হেলথ ডে। ২০০২ সাল থেকে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের উদ্যোগে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এ দিনটিকে সামনে রেখে অনেকরকম কর্মসূচি পালন করা হয়। আজকের দৌড় তারই অংশ।

          ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সকালের কেইপ টাউনের রূপ দেখছিলাম। রবিবারের সকাল বলে দাপ্তরিক কাজের কোন চিহ্ন নেই কোনদিকে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা নামমাত্র।

 

 

সমারসেট রোডে ম্যারাথন


মিনিট পনেরো হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম ওয়াটার ফ্রন্টে যাবার মুখের গোলচত্বরে। কাল গিয়েছিলাম এর ডান দিকে দিয়ে শিপ-ইয়ার্ডের পাশ দিয়ে। আজ নতুন রাস্তায় হাঁটার ইচ্ছে হলো। বাম দিকে মোড় ঘুরতেই নতুন এলাকা। বাড়িঘরগুলো বিশাল। রাস্তার দুপাশে চমৎকার সাজানো বাগান। অভিজাত আবাসিক এলাকা। বাড়ির সীমানা প্রাচীর অনেক উঁচু। তার উপরে ঘন কাঁটাতার।

          সেখানে ছোট সাইনবোর্ডে যা লেখা আছে- তা পড়ে আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। হাইভোল্টেজ কারেন্ট প্রবাহিত হচ্ছে ওই কাঁটাতারের মধ্য দিয়ে। ইলেকট্রিক ফেন্স। ওই তারে কারো হাত লাগলেই ইলেকট্রিক শক খেতে হবে। মারাত্মক শকে মৃত্যুও হতে পারে। অবাঞ্চিত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা।

  

বাড়ির সীমানাদেয়ালের উপর বৈদ্যুতিক তার


এই বিশাল বাড়িগুলোতে যারা বাস করে তারা যে কী পরিমাণ ধনী তা বোঝা যায় সাধারণের কাছ থেকে তাদের আলাদা হয়ে থাকার প্রবণতায়। এই ধনীদের বেশিরভাগই কিন্তু কৃষাঙ্গ। দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হবার পর থেকে শ্বেতাঙ্গদের আস্ফালন চলে গেছে। এখন কৃষ্ণাঙ্গ ধনীরা শাসন করছে কৃষ্ণাঙ্গ গরীবদের। যেমন হচ্ছে বৃটিশ চলে যাবার এত বছর পরেও ভারতে বা বাংলাদেশে।

          সমুদ্রতীরবর্তী এই বাড়িগুলোর প্রত্যেকটিই একেকটা প্রাসাদ। কোন কোনটায় ইলেকট্রিক-বেড়া হাতছোঁয়া দূরত্বে। কিন্তু হাত বাড়ালেই ইলেকট্রিক শক লাগবে। একবিংশ শতাব্দীতে নিরাপত্তার নামে এরকম বিপজ্জনক ব্যবস্থা সমর্থন করছে রাষ্ট্রীয় আইন! আশ্চর্য! ধনীর ধনের চেয়ে গরীবের জীবনের মূল্য অনেক কম এখানে। অস্ট্রেলিয়ার এরকম কিছু চিন্তাও করা যায় না। সেখানে কোন কোন এলাকায় রাস্তার পাশে সীমানাপ্রাচীর দেয়াও নিষেধ।

          রাস্তার দুপাশে এবং মাঝখানের আইল্যান্ডে চমৎকার জংলি ফুল ফুটে আছে। প্রকৃতিকে কিছুটা শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করে আরো সুন্দর করে তোলা হয়েছে। আঁকা বাঁকা মসৃণ এই রাস্তাটির নাম ডক রোডওয়াটার ফ্রন্টের পাশ ঘেষে চলে যাবার পর এরই নাম হয়ে যায় বিচ রোড। কেইপ টাউনের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাগুলোর একটি এই বিচ রোড। এই রোড ধরে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে পৌঁছানো যায় আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের জায়গা কেইপ পয়েন্টে।

          ওয়াটারফ্রন্টে পৌঁছলাম। সামনেই টু ওশ্যান অ্যাকুয়ারিয়াম, সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন্ত সংগ্রহশালা। তার সামনেই রাস্তার পাশে কেইপ টাউন সিটি সাইট-সিয়িং ট্যুর অফিস। কেইপ টাউনের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার সবচেয়ে সুলভ এবং আরামদায়ক ব্যবস্থা এই ট্যুরবাসগুলো।

  

কেইপ টাউন ট্যুরবাস


চারটি রুটে লাল, নীল, হলুদ ও বেগুনি এই চার ধরনের বাস চলে। সবগুলো বাসই দোতলা, দোতলার ছাদ খোলা। চারপাশে দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। একই টিকেটে সবগুলো রুটের সবগুলো বাসেই চড়া যায়। প্রথম বাস ছাড়ে আটটা চল্লিশ মিনিটে। বিশ মিনিট পর পর বাস। শেষ বাস ছাড়ে সন্ধ্যা সোয়া ছটায়। একদিনের টিকেটের দাম ১৯০ র‍্যাল্ড। স্পেশাল অফার চলছে এখন। দুই দিনের টিকেটের দাম ২৯০ র‍্যাল্ড। দুই দিনের টিকেট কিনলে হারবার ক্রুজের টিকেট ফ্রি।

          টিকেটঘর সবেমাত্র খুলেছে। চারজন তরুণী চটপট সাজিয়ে ফেলছে টিকেট কাউন্টার। চারজনের মধ্যে একজন তরুণী হোয়াইট ব্লন্ড। তার উচ্চারণ শুনে মনে হলো সে আফ্রিকান নয়। ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার অনেকে এদেশে হলিডে ওয়ার্কভিসা নিয়ে কাজও করতে আসে। সিস্টেমটা কিভাবে কাজ করে জানি না। লোকাল অনেক ছেলেমেয়ে চাকরি পাচ্ছে না, আবার বিদেশীরা এসে কাজ করছে।

          দুদিনের একটা টিকেট কিনলাম। টিকেটের সাথে একটা লাল রঙের হেডফোন দেয়া হলো বাসে ধারাবিবরণী শোনার জন্য। বাস আসতে এখনো মিনিট দশেক বাকি। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে বাসস্টপে দাঁড়ালাম। আরো কয়েকজন ট্যুরিস্ট অপেক্ষা করছে সেখানে। এসময় টিকেট কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এলো সেই স্বর্ণকেশী তরুণী যে আমাকে টিকেট দিয়েছিলো। লাল স্কার্টে তাকে দারুণ মানিয়েছে। অবশ্য কিছু কিছু মানুষকে সব কিছুতেই মানিয়ে যায়। চোখাচোখি হতেই হাসলো সে। দেখলাম আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।

          সরি, আই ফরগট টু গিভ ইউ দি চেঞ্জ। - দশ র‍্যাল্ডের একটা নোট এগিয়ে দিতে দিতে বললো সে। ২৯০ র‍্যাল্ডের টিকেটের জন্য ৩০০ র‍্যান্ড দিয়েছিলাম।

     থ্যাংক ইউ

     ডু ইউ লাইক টু হ্যাভ ইউর পিকচার ট্যাকেন?

     সিওর

          টিকেট কাউন্টারের বাইরে এক কোণায় একটা সবুজ পর্দার সামনে আমাকে দাঁড় করালো সে। ততক্ষণে বড় একটা এস-এল-আর ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে এসেছে আরেকজন তরুণী। ঝটপট ছবি তুলে নিল। বুঝতে পারলাম এই ছবি দিয়ে কয়েকশ র‍্যান্ড খসাবে। সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর কেইপ টাউনের বিভিন্ন দৃশ্যে বসিয়ে তার সামনে আমাকে পেস্ট করে দেবে।

          লাল দোতলা বাস এসে গেছে। ড্রাইভারকে টিকেট দেখিয়ে বাসের ভেতর ছোট্ট সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। মাঝামাঝি একটা সিটে গিয়ে বসলাম। যাত্রীর সংখ্যা এখনো খুব বেশি নয়। নরম রোদে খুব ভালো লাগছিলো। আমার পেছনে এসে বসলো একজোড়া শ্বেতাঙ্গ তরুণ-তরুণী। তাদের কথাবার্তায় আমেরিকান টান। বাসের সামনের দিকে দশ বারোজন চায়নিজের একটা দল। চায়নিজরা নিচুস্বরে কথাবার্তা মনে হয় বলতে পারে না। প্রচুর চিৎকার চেঁচামেচি করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে প্রায় সবাই। দক্ষিণ আফ্রিকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটা প্রধান উৎস হলো ট্যুরিজম। চায়নিজদের অর্থনীতি চাঙা হয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন পৃথিবীর সব দেশেই চায়নিজ ট্যুরিস্ট বেড়ে গেছে।

          দক্ষিণ আফ্রিকার স্থলভূমির ক্ষেত্রফল ১১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৮২৫ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রফলের প্রায় সাড়ে আট গুণ, অথচ লোকসংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটিরও কম। বাংলাদেশের জনসংখ্যার তিনভাগের একভাগেরও কম।

নয়টি প্রদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের প্রদেশ ওয়েস্টার্ন কেইপের রাজধানী কেইপ টাউন। ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রশাসনের দক্ষতায় কেইপ টাউনের ট্যুরিজম ব্যবসা এখন জমজমাট। ২০১৪ সালে শুধুমাত্র পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি র‍্যাল্ড। সেখান থেকে শুধুমাত্র কেইপ টাউনেই আয় হয়েছে ১৩৬০ কোটি র‍্যাল্ড।[1]

          কেইপ টাউন সিটির ক্ষেত্রফল ২৪৬১ বর্গকিলোমিটার। ঢাকার ক্ষেত্রফল ২৭০ বর্গকিলোমিটার। কেইপ টাউনের জনসংখ্যা মাত্র চল্লিশ লাখ। তবে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ পর্যটক আসে এই শহরে। ট্যুরিস্টরা বছরে ১৯০ কোটি র‍্যাল্ডের জিনিস কেনে এই শহরে। ডে ট্রিপে খরচ করে আরো ৩২০ কোটি র‍্যাল্ড। পর্যটকরা এই শহরের প্রধান অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক।

          বাসের সিটের পাশে লাগানো সকেটে ইয়ারফোনের প্লাগ ইন করে ধারাবিবরণী শুনতে আরম্ভ করলাম। ইংরেজী ছাড়াও ডাচ, ফ্রেন্স, চায়নিজ, জাপানিজ এবং আরো কয়েকটি ভাষায় এই বর্ণনা শোনার ব্যবস্থা আছে।

          ট্যুর গাইডে চোখ বুলিয়ে কেইপ টাউন সম্পর্কে এবং এই ডে-ট্যুর সম্পর্কে অনেককিছু জানা গেলো। ধারাবিবরণী থেকেও জানতে পারলাম কেইপ টাউনের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনেককিছু।

          কেইপ টাউনের প্রধান আকর্ষণ টেবল মাউন্টেন। সিটি ট্যুরের ৭ নম্বর স্টপেজ হলো টেবল মাউন্টেন। মাঊন্টেনে ওঠার ক্যাবল-কারের টিকেট আগে করে না রাখলে টিকেট ঘরের সামনে লাইনেই নাকি চলে যাবে ঘন্টা-দুঘন্টা। কারণ মানুষ নাকি একেবারে ভোর থেকে গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। এই বাসেই ড্রাইভারের কাছ থেকে ক্যাবল-কারের টিকেট কেনা যাবে।

          সিটে ব্যাকপ্যাক রেখে নিচে নেমে ড্রাইভারের কাছে গেলাম। প্রায় সবাই টেবল মাউন্টেনের টিকেট কেটে নিচ্ছে। ২৪০ র‍্যান্ড দিয়ে টেবল মাউন্টেনে ওঠার টিকেট কিনে সিটে এসে বসার সাথে সাথেই বাস ছেড়ে দিলো।

          যে পথ দিয়ে সকালে হেঁটে এসেছি সেই ডক রোড ধরে চলতে শুরু করলো রেড বাস। চলন্ত দোতলার ওপর থেকে সবকিছু অন্যরকম লাগছে। উপরে ঘন নীল আকাশ। আর চারদিকে অপরূপ সুন্দর কেইপ টাউন। মিনিট পাঁচেক পরেই ওয়াটার ফ্রন্টের ক্লক-টাওয়ার স্টেশনে পৌঁছলাম। এখানে আরো অনেক পর্যটক অপেক্ষা করছিলো।

          এই বাসগুলো থেকে যেকোন স্টেশনে নেমে সেখানে সবকিছু দেখে আবার বাসে উঠে অন্য স্টেশনে চলে যাওয়া। এভাবেই সব দর্শনীয় জায়গা দেখে ফেলা যাবে। কিন্তু দুদিনের মধ্যে কতটুকু দেখা যাবে বলা যায় না।

          পরের স্টপ ওয়াল্টার সিসুলু স্ট্রিটে, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশান সেন্টারের সামনে। গতকাল এই রাস্তায় হেঁটেছিলাম। ওয়াল্টার সিসুলু ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা। গণতন্ত্রের সংগ্রামে নেলসন ম্যান্ডেলার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে জেল খেটেছেন। ২৫ বছর কাটিয়েছিলেন জেলে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর কেইপ টাউনের এই প্রধান রাস্তার নামকরণ করা হয় তাঁর নামে। তাঁর নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে দক্ষিণ আফ্রিকায়।

  

১৯৯০ সালে কারামুক্তির পর নেলসন ম্যান্ডেলা ও ওয়াল্টার সিসুলু


সিসুলু স্ট্রিটের আশেপাশে অনেকগুলো বড় বড় হোটেল। এই স্টপ থেকে অনেক ট্যুরিস্ট উঠলো বাসে। বেশ কয়েকজন বয়স্কা মহিলাও উঠলেন। সিসুলু স্ট্রিট ধরে কিছুদূর এগোনোর পর মিডিয়া-২৪ এর বিশাল গোলচত্বর। তার বাম পাশে সিভিক সেন্টার। এখানে সেন্ট্রাল বাস স্টেশন, আর কিছুদূর পরে কেইপ টাউন সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন।

          এই স্ট্রিটের নাম হিরেনগ্র্যাচ। ডাচ উচ্চারণে সম্ভবত ইরেনগ্রাখ। এই রাস্তা একদিকে মিশেছে এফ-ডব্লিউ-ডি ক্লার্ক বুলেভার্ড এর সাথে। অন্যদিক অ্যাল্ডারলি স্ট্রিটে। নেলসন ম্যান্ডেলার আগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এফ-ডব্লিউ ক্লার্ক। তিনিই নেলসন ম্যান্ডেলাকে জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে এফ-ডব্লিউ ক্লার্ককেও নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেয়া হয়েছে ১৯৯৩ সালে।

          হিরেনগ্র্যাচ স্ট্রিট যেখানে অ্যাডারলি স্ট্রিট ছুঁয়েছে সেখানেই ডানে মোড় নিয়ে লং স্ট্রিটের ট্যুর অফিসের সামনে এসে বাস দাঁড়ালো। এখানেও পর্যটকদের ভিড়। দেখতে দেখতে ভিড় হয়ে গেলো বাসের উপরের ডেক। উপরের ডেকে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করার নিয়ম নেই। তাই জায়গা না পেয়ে অনেককে নিচের ডেকে চলে যেতে হলো।

          বাস এখানে থামলো মিনিট পাঁচেক। লং স্ট্রিট- নামের সাথর্কতা আছে। এই রাস্তা লম্বা সেটা ঠিক, কিন্তু প্রস্থে একেবারেই ছোট। গতকাল এই স্ট্রিটে এসেছিলাম। তখন ভালো করে খেয়াল করিনি। এখন দেখছি এই রাস্তার দুপাশের দালানগুলোর স্থাপত্য একেকটা একেক রকমের। বিল্ডিংগুলো অনেক পুরনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।

          প্রায় তিনশ বছর আগে কেইপ টাউনে মুসলমান অভিবাসীরা এখানে এসে বাস করতে শুরু করেছিল। লং স্ট্রিটকে তখন কেইপ টাউনের সীমানা বলে ধরা হতো। ১৯৬০ সালের দিকে এই রাস্তা মাতাল ও দেহব্যবসায়ীদের দখলে থাকতো। এখনো অবশ্য এই রাস্তার কিছু কিছু অংশ তাদের দখলে। কেবল তাদের পোশাক পরিচ্ছদে আভিজাত্য এসেছে। এই স্ট্রিটে কেইপ টাউনের পানশালা আর অভিজাত শরীর-ব্যবসার দোকানপাট। খাবারের দোকান আর বেশ কিছু পুরনো ফানির্চার ও অ্যান্টিকের দোকান। এই স্ট্রিটে একটি মসজিদের পাশেই আছে মদের দোকান। তার পাশেই বইয়ের দোকান। প্রচুর ব্যাকপ্যাকারস হোস্টেল এখানে। আর আনুষঙ্গিক নাইট-ক্লাব। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে রাত যত গভীর হয় হুল্লোড় বাড়তে থাকে। সিডনির কিং-ক্রসের মতোই হয়ে ওঠে এই এলাকা।

          লং স্ট্রিট থেকে ওয়েল স্ট্রিটে ঢুকে বামে মোড় নিয়ে যে স্টপে থামলো সেখানে বিখ্যাত আফ্রিকান ডায়মন্ড মার্কেট জুয়েল আফ্রিকাএখানে কেউ নামলো না। একজোড়া বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ দম্পতি উঠলেন এখান থেকে। বাসের গতি ক্রমশ বাড়ছে।

          শহরের বহুতল ভবন এদিকে দেখা যাচ্ছে না আর। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট কিছু দোকানপাট আর আবাসিক এলাকা। একটা চার্চ দেখা গেলো। তার পাশে ভিলা মারিয়া কনভেন্ট। এই রাস্তার নাম ক্লুফ নেক রোড। রাস্তার বাম পাশে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে টেবল মাউন্টেন, আর ডানদিকে লায়নস হেড আর সিগনাল হিল। ১৮৪২ সালে সৈন্যদের যাতায়াত ও রসদ সরবরাহের জন্য তৈরি হয়েছিল এই রাস্তা। এখন কেইপ টাউনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার একটি ক্লুফ নেক।

          রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। দুপাশের প্রকৃতি সুন্দর শান্ত। সারি সারি পাইন গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটি জেব্রা দেখা গেলো আপন মনে চরছে। একটা গোলচত্বরে এসে দিক পরিবর্তন করলো আমাদের বাস। এই রাস্তার নাম টেবল মাউন্টেন রোড। গোলচত্বর থেকে অন্য একটি রাস্তা চলে গেছে বিপরীত দিকে তার নাম ক্যাম্পাস বে ড্রাইভ।

         

টেবল মাউন্টেনে ওঠার রাস্তা



টেবল মাউন্টেন রোডটি এঁকে বেঁকে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। নিচের দিকে তাঁকালে বুক কাঁপে। অনেক নিচের খাদ থেকে উঠে এসেছে বড় বড় পাইন গাছ। দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার এখন স্বদেশী গাছের প্রসারে মনোযোগী হয়েছে। পাইন গাছ আফ্রিকান গাছ নয়। তাই শত শত পাইন গাছ কেটে সেখানে দেশীয় আফ্রিকান গাছ লাগাচ্ছে সরকার। ইউক্যালিপটাস গাছও আফ্রিকান নয়
মূলত অস্ট্রেলিয়ান।

          ১১১ প্রজাতির পাইন গাছের মধ্যে মাত্র একটি প্রজাতির পাইন গাছ দক্ষিণ গোলার্ধের নিজস্ব, বাকি ১১০ প্রজাতিই এসেছে উত্তর গোলার্ধ থেকে। গত ২ থেকে ৩শ' বছর ধরে দক্ষিণ গোলার্ধে পাইন গাছ লাগানো হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার গবেষণায় দেখা গেছে এই গাছগুলো মাটি থেকে এত বেশিমাত্রায় পানি শোষণ করে যে ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত করে ফেলে সমস্ত জায়গা। যে পাহাড়ে পাইন বন আছে সেখান থেকে খুব কম পরিমাণে পানিই গড়িয়ে এসে সমুদ্রে মিশতে পারে।

          পাইন ছাড়াও আরো ৩২ রকমের ইমিগ্রান্ট গাছ শনাক্ত করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। যার মধ্যে ১৪ রকমের গাছ এসেছে অস্ট্রেলিয়া থেকে, ১০ প্রজাতির নর্থ আমেরিকা থেকে এবং ৮ প্রজাতির এসেছে এশিয়া ও ইউরোপ থেকে। এদেরকে বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল করার পাশাপাশি স্বদেশী গাছ লাগানো হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে।

          টেবল মাউন্টেনের পাদদেশে এসে দাঁড়ালো বাস। বেশিরভাগ পর্যটকই নেমে গেলো এখানে। নামতেই চোখে পড়লো সারি সারি মানুষের ভিড়। রাস্তার বাম পাশে পাশাপাশি দুটো লাইন। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকদূর গিয়ে লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালাম। একটা লাইন হলো যাদের অগ্রিম টিকেট কাটা আছে, অন্যটি যাদের টিকেট নেই।

 

টেবল মাউন্টেনে উঠার লাইন


অগ্রিম টিকেট কাটা থাকলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায় বলে প্রচার করা হয়েছে। তাই প্রায় সবাই অগ্রিম টিকেট কেটে এসেছে। দেখা যাচ্ছে যাদের টিকেট নেই তাদের লাইনের দৈর্ঘ্য অনেক কম। মানুষের লাইন এঁকে বেঁকে রাস্তার এক জায়গায় থেমেছে। সেখানে রাস্তা পারাপারের চিহ্ন আছে। রাস্তার অন্যপাশে টিকেট কাউন্টার। তার বাম পাশে সিঁড়ি উঠে গেছে একটা তিনতলা ভবনে। সেখানেও মানুষ গিজগিজ করছে।

          আমার সাথে বাস থেকে যারা নেমেছে তাদের অনেককেই দেখলাম রাস্তার ওপাশের লাইনে চলে গেছে। তাদের অগ্রিম টিকেট ছিল না। এরকম অবস্থা ইদানিং এয়ারপোর্ট চেক-ইন করার সময়ও দেখা যায়। সময় বাঁচানোর জন্য অনলাইন চেক-ইন করে আসে সবাই। ফলে ব্যাগ-ড্রপ এর লাইন হয়ে যায় অনেক লম্বা। আর যারা অনলাইন চেকইন করে আসে না তাদের সময় লাগে তুলনামূলক কম

          আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়েছে আমেরিকান তরুণ-তরুণী। লাইন এগোচ্ছে পিঁপড়ার গতিতে। আরো অনেক মানুষ আসছে দলে দলে। অগ্রিম টিকেট নেই লাইন প্রায় খালি। সেদিকে ঢুকলো চারজনের একটা অ্যারাবিয়ান টিম। আরবি ভাষায় উচ্চস্বরে কথা বলছে তারা আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। একেবারে মুখের উপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া যে অভদ্রতা তা কি এরা জানে না? তাছাড়া এখানে সব জায়গায় বড় বড় অক্ষরে পরিষ্কার ইংরেজিতে লেখা আছে নো স্মোকিংএই শুষ্ক আবহাওয়ার এরকম গাছপালার জঙ্গলে আগুন লাগলে মুহূর্তে তা দাবানল হয়ে যাবে। ঘাড় ফিরিয়ে অ্যারাবিয়ান যুবককে বললাম, ইউ কান্ট স্মোক হিয়ার।

          লোকটি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আরবিতে কিছু একটা বললো। মাথা এদিক ওদিক নেড়ে বললো, নো ইংলিশ

          পিলারের গায়ে লাগানো নো স্মোকিং সাইন দেখালাম। সে সিগারেট ফেললো না। শুধুমাত্র একটু সরে দাঁড়ালো। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এরকম আচরণ দেখলে।

          মিনিট দশেক পরে মিটার দশেক এগিয়েছি। দেখলাম অ্যারাবিয়ান লোকগুলো ঠেলে ঠুলে আমাদের লাইনে ঢুকে গেছে। মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। নিয়মের প্রতি কোন শ্রদ্ধাই নেই এদের।

          আরো মিনিট পনেরো পরে রাস্তা ক্রস করে ক্যাবল-কার এর বেস-স্টেশনে ঢুকলাম। সিঁড়ি দিয়ে পিঁপড়ার গতিতে উঠছি। দেয়ালে ক্যাবল-কার এবং টেবল মাউন্টেন এর আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া আছে। বাম দিকে নিচে তাকালে মনে হচ্ছে পুরো কেইপ টাউন দেখা যাচ্ছে আকাশের উপর থেকে।

          তিনতলার সমান উঁচুতে উঠার পর একটা রেস্টুরেন্ট। অনেকে এখানে বসে খাওয়া দাওয়া করছে। লিফটে উঠতে হলো এখান থেকে। লিফট থেকে বেরিয়ে ক্যাবল-কার স্টেশন। টিকেট স্ক্যান করে গুণে গুণে লোক ঢোকানো হচ্ছে ভেতরে। ক্যাবল-কারে একসাথে ৬৫ জন উঠতে পারে।

 

টেবল মাউন্টেনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস


ভেতরে একটা উঠানের মতো খোলা জায়গায় দাঁড়ালাম। দুপাশে দুটো স্টেশন। পাঁচ মিনিট পর পর একটা কার নিচে নেমে আসছে একদিকে। অন্যদিক থেকে আরেকটি কার উপরে উঠে যাচ্ছে।

          এই ক্যাবল-কারগুলো গোলাকার। চারপাশে কাচে ঢাকা। ঝুলন্ত মোটা তারের মাধ্যমে উঠানামা করে। নিচের স্টেশন থেকে দেখতে পাচ্ছি বিশাল আকৃতির পুলির সাহায্যে ধাতব তারগুলো টানা হচ্ছে। তারের সাথে লাগানো ঝুলন্ত কাচের খাঁচা উপরে উঠে বা নেমে আসে।

          টেবল-মাউন্টেন বর্তমান সাতটি নতুন প্রাকৃতিক অত্যাশ্চর্যর একটি। এখানে পৃথিবীর ম্যাপের ওপর এই প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকা প্রদর্শিত হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গল, ভিয়েতনামের হা-লং বে, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ইগাজু জলপ্রপাত, দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো, ফিলিপাইনের আন্ডারগ্রাউন্ড রিভার। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান আকর্ষণ এই টেবল মাউন্টেন বা টেবিল পর্বত।

          মিনিট দুয়েক পরেই ক্যাবল-কার নিচে নেমে এলো। যারা নামলো তাদের সাথে আমাদের দেখা হলো না। তারা চলে গেলো অন্যদিকের দরজা দিয়ে। তারপর ওদিকের দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর এদিকে ওঠার দরজা খুললো। গুণে গুণে ঠিক ৬৫ জনকেই স্টেশনের শেষ ধাপে ঢোকানো হয়েছে। সবাই উঠতে পারবে। কিন্তু তারপরেও সবাই কেমন হুড়োহুড়ি করে ভেতরে ঢুকলো। বিশেষ করে চায়নিজ ট্যুরিস্টদের মধ্যে কোনরকম ভদ্রতার ছিটেফোঁটা দেখলাম না। এক আধবুড়ো চায়নিজ আমার পায়ের উপরই দাঁড়িয়ে গেলেন। এক্সকিউজ মি বলে কোন কাজ না হওয়াতে জোর করে সরাতে হয়েছে তার পা। আমার বদলে কোন জাপানির পায়ের ওপর দাঁড়ালে ঐ জাপানি হয়তো ভদ্রতার খাতিরে নিজে পদপিষ্ট হতোটোকিওর ট্রেনে দেখছি এরকম ঘটনা।

 

ক্যাবল-কার


ক্যাবল-কার আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো। এক কিলোমিটার মতো দূরত্ব যেতে পাঁচ মিনিটের মতো সময় লাগে। মানুষভর্তি একটা কাচের বোতলের মতো লাগছে ভেতরটা। বাইরের প্রকৃতি অপূর্ব। টেবল-মাউন্টেন, অন্যদিকে সমুদ্র, পুরো কেইপ টাউন দেখা যাচ্ছে চারপাশ থেকে।

          ক্যাবল-কারের নিচের পাটাতন আস্তে আস্তে ঘুরছে। নিচের স্টেশন থেকে উপরের স্টেশনে যেতে যে পাঁচ মিনিট সময় লাগে সেই সময়ের মধ্যে এটা ৩৬০ ঘুরে যায়। ফলে ভেতরে যেখানেই দাঁড়াই চারপাশ দেখা হয়ে যায় সামনে থেকে।

          ভেতরে প্রচন্ড কোলাহল। যারা উঠেছে তাদের মধ্যে মাত্র কয়েক জোড়া পশ্চিমী, বাকিরা চায়নিজ। ১২০০ মিটার লম্বা কেবল টেনে নিয়ে চলেছে মানুষভর্তি গোল-বাক্স। প্রতি ঘন্টায় একটা কারে প্রায় ৮০০ মানুষ ওঠা-নামা করতে পারে।

          যখন বাতাসের গতি বেড়ে যায় ক্যাবল দুলতে থাকে খুব বেশি। বিপজ্জনক হয়ে ওঠে তখন এই ক্যাবল-ওয়ে। নিচের স্টেশনে তখন চার হাজার লিটারের একটা পানির ট্যাংক জুড়ে দেয়া হয় কারের নিচে। বাতাসের দুলুনি তখন কিছুটা কমে। ঐ পরিমাণ পানি নিচে থেকে উপরে ওঠাতে হয় প্রতিদিন উপরের স্টেশনে টয়লেট আর বাথরুমে ব্যবহারের জন্য। গড়ে প্রতিজনের জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার পানি লাগে উপরের স্টেশনে।

          পাঁচ মিনিটের মধ্যে উপরের স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ঝুলন্ত বাক্স থামলো। দরজা খুলে গেলো। ঝটপট নেমে গেলাম।

          গেট পার হতেই দেখলাম- নিচে নামার জন্য অন্যদিকে অপেক্ষা করছে অনেকে। তাদের সংখ্যা অবশ্য এখনো খুব বেশি নয়। একটা স্যুভেনির শপ আছে এখানে।

          ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০৮৫ মিটার উঁচু এই টেবল মাউন্টেনে উঠার সময় বড় বড় অক্ষরে কিছু সতর্কতা লেখা ছিল। এখানে দেয়ালেও তা লেখা আছে। টেবল মাউন্টেনে একা একা ঘুরতে গেলে পথ হারানোর সম্ভাবনা আছে। তাই ম্যাপ সাথে থাকা দরকার। অনেকক্ষণ হাঁটতে হতে পারে, তাই হাঁটার উপযোগী জুতা। আর অবশ্যই মোবাইল ফোনের ব্যাটারির যেন চার্জ থাকে পর্যাপ্ত।

          মোবাইল ইর্মাজেন্সি নম্বর ১১২ সেভ করে রাখলাম। টেবল মাউন্টেন-এর একটা সুনির্দিষ্ট ইমার্জেন্সি হেলপ লাইন আছে - ০৮৬১১০৬৪১৭। তাও সেভ করে রাখলাম। কারণ কখন কাজে লাগবে তা বলা যায় না।

          এখানে বাতাসের তাপমাত্রা নিচের তাপমাত্রার চেয়ে একটু কম। আরামদায়ক একটা বাতাস আছে। ওয়েলকাম টু টেবল-মাউন্টেন লেখা সাইনবোর্ডের সাথে টেবল মাউন্টেনের একটা বিশাল ম্যাপ টাঙানো আছে স্টেশন থেকে বের হলেই। পায়ে চলা পথ চলে গেছে বিভিন্ন দিকে।

          বাম দিকে একটা টিলায় উঠে চারদিকে তাকালাম। কেইপ টাউনের প্রকৃতি যে এত সুন্দর তা এখানে না উঠলে এভাবে ধরা পড়তো না। পাহাড়, জঙ্গল, গাছপালা, শহর-নগর, সাগর-বন্দর সব যেন একটা মাত্র ক্যানভাসে ধরা পড়েছে। দূরের মহাসাগরের পানি ঘন নীল। উপরে আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। দূরে ভেসে চলেছে কিছু সাদা মেঘ।

          পাহাড়ের পিঠ একেবারে টেবিলের মতো সমান। সেই কারণেই এই পর্বতের নাম টেবিল - টেবল মাউন্টেন।

          একটিমাত্র পাথর খন্ডের এই বিশাল টেবিল-পর্বতের উদ্ভব হয়েছে ৬০ কোটি বছর আগে। জন্ম হয়েছে আরো অনেক কোটি বছর আগে। পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল এটা। বিশাল আকৃতির গ্লেসিয়ার চেপে রেখেছিলো এই পাথরটিকে। তাই উপরের পিঠ হয়ে গেছে প্রায় সমতল। তারপর দুটো টেকটোনিক প্লেটের পারস্পরিক চাপের ফলে পানির উপর থেকে এক কিলোমিটারেরও বেশি উঁচুতে উঠে এসেছে এই পর্বত। এই পর্বতের ক্ষেত্রফল প্রায় ২২১ বর্গ কিলোমিটার। সমতল পিঠের ক্ষেত্রফল তিন বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি।

 

টেবল মাউন্টেনের ওপর থেকে কেইপ টাউন


এই এক কিলোমিটার বাই তিন কিলোমিটার প্রাকৃতিক টেবিলের উপর এখন শত শত মানুষ। ছবি তুলছে, সেলফি তুলছে, পিকনিক করছে। একদল দেখলাম মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট আর ক্যামেরা ইত্যাদি নিয়ে এসেছে। শ্যুটিং হবে হয়তো।

          টেবল মাউন্টেনের ২২১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ন্যাশনাল পার্কের আওতাভূক্ত। ক্যাবল-ওয়ে ছাড়াও আরো তিন চারটি পায়ে চলা পথ আছে পাহাড়ে উঠার। ওই পথগুলো দিয়ে হাইকিং করে উঠতে দুতিন ঘন্টা লেগে যায়। তবে সাথে গাইড না থাকলে অনেক সময় পথ হারানোর ভয় থাকে।

          দুতিন দিন এক নাগাড়ে হাইকিং করার ট্যুরও আছে। প্রায় ৭০-৭৫ কিলোমিটার হেঁটে এখানে থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বদক্ষিণের জায়গা কেপ পয়েন্টেও যাওয়া যায়।

          অতদূর হাঁটার শখ আমার নেই। তবে সমতল যতটুকু আছে- সেই তিন কিলোমিটার ঘুরে আসা যাক। তার আগে একবার প্রকৃতি সেরে নেয়া দরকার। স্যুভেনির শপের পাশ দিয়ে টয়লেট। নিচ থেকে ক্যাবল-কারের নিচে বেঁধে নিয়ে আসা হয় চার হাজার লিটারের পানির ট্যাংক। সেই পানি ব্যবহার করা হয় টয়লেটের বেসিনে হাত ধোয়ার কাজে। বেসিনের সেই ব্যবহৃত পানিগুলো জমা করা হয় আরেকটা ট্যাংক। সেখান থেকে পানি সাপ্লাই করা হয় টয়লেটের ফ্লাশে।

          পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটায় পর্যটকদের খুব একটা সহযোগিতা নেই বলেই মনে হলো। যার যার ময়লা সে সে পরিষ্কার করলে কোন সমস্যা তো হবার কথা নয়। কিন্তু টয়লেট এই সকালেই নোংরা হয়ে গেছে। বছরে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ এই টেবিল-পর্বতে উঠে। এরা যদি কেউই নিজের ময়লা নিজে পরিষ্কার না করে তাহলে এক বছরেই এই পর্বত একটি নোংরা ডাস্টবিনে পরিণত হবে।

          বাম দিকের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। নিচের কোন শব্দ এখানে নেই। চারদিকে ছোট ছোট গুল্মজাতীয় গাছ- আর অসংখ্য বুনোফুল। এখন শীতকাল বলে ফুলের সংখ্যা কম। গ্রীষ্মকালে এখানে ফুলের বন্যা বয়ে যায়।

         

টেবিল পর্বতে বুনো ফুল


৬০ কোটি বছর আগে থেকেই এই টেবিল-পর্বত এখানে থাকলেও আফ্রিকার বাইরের মানুষের প্রথম নজরে এসেছে এটা ১৫০০ সালের দিকে। পর্তুগীজ অভিযাত্রী অ্যান্টোনিও ডি সালদানা এই পর্বতের নাম দেন টেবল মাউন্টেন সেই ১৫০৩ সালে। এই পর্বতের সর্বোচ্চ শিখরের নাম ম্যাকলিয়ারস বিকন।

          হাঁটছি আর মানুষ দেখছি। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি এখন আর আগের মতো নেই। আগে ব্যাপারটা ছিল উপলব্ধির তারপর মুগ্ধতার। এখন হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির আর লোক দেখানো আত্মপ্রতিকৃতির। এখন মানুষ যতটা না নিজের চোখে দেখে তার চেয়ে বেশি দেখে স্মার্ট ফোনের ক্যামেরার চোখে। যেদিকেই মানুষ দেখছি- দেখছি নানা ভঙ্গিতে নিজের ছবি তোলার কসরৎ। নির্জন একটা জায়গায় বসে পড়লাম। সামনেই গভীর খাদ। তার পরে আবার খাড়া দেয়ালের মতো অনেক দূর চলে গেছে পাহাড়ের ঢাল।

          হঠাৎ নারীকন্ঠের খিলখিল হাসি শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঝোপের আড়ালে প্রায় বিবস্ত্র দুজন শ্বেতাঙ্গ তরুণী সেলফি তুলছে। প্রকৃতির কোলে প্রাকৃতিক পোশাকে বসে থাকলে ব্যাপারটা নান্দনিক হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। কিন্তু হাতের স্মার্টফোন ব্যাপারটাকে কেমন যেন গোলমেলে করে দেয়। পাশে তাকিয়ে দেখলাম একজন বুড়ো ফটোগ্রাফার টেলিফটো লেন্স লাগিয়ে গিলছে মেয়ে দুটোকে। আর বসা গেলো না।

          আফ্রিকার নিজস্ব ফুল আছে অনেক। প্রোটিয়া তাদের নিজেদের ফুল। হাজার রকমের প্রোটিয়া আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় ফুল কিং প্রোটিয়া ফুটে এখানে। সাড়ে আট হাজার প্রজাতির গাছ ফুল গুল্ম আছে যা দক্ষিণ আফ্রিকার একেবারে নিজস্ব প্রজাতির। তার মধ্যে দেড় হাজার প্রজাতির ফুল ফোটে এই টেবিল পর্বতে। একটা বিশেষ ফুল ফোটে এই টেবিল পর্বতে- যার নাম প্রাইড অব টেবল মাউন্টেন।

  

টেবিল পর্বতে ছবিটা তুলেছে আমান্ডা জনসন

      

এক ধরনের মিহি চিকন পাতার ঝোপ হয় এখানে। তাদের ইংরেজি নাম ফাইন বুশ। যেখান থেকে পরিবর্তিত হয়ে আফ্রিকানস ভাষায় হয়েছে ফিনবুশ। কেইপ টাউনের যেখানে সেখানে দেখা যায় এই ফিন বুশ।

          সেই অ্যারাবিয়ান দলকে দেখতে পেলাম সিগারেট টানতে টানতে যাচ্ছে। একজন সিগারেটের খালি প্যাকেট ছুঁড়ে ফেললো ঝোপের উপর। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা জীবনে কোন কিছুই শিখবে না বা মানবে না - এরকম প্রতিজ্ঞা করে বসে থাকে। এরা মনে হয় সেরকমই। কিন্তু কেইপ টাউনের বদলে সিঙ্গাপুর হলে কি এরা এরকম করতে পারবে? নগদ জরিমানা দিতে হলে? কী জানি - পেট্রো-ডলারের দাপটে এরা কী না করছে দুনিয়ায়।

          একটু পেছনে দেখলাম একজন আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা মহিলা হাঁটছেন একজন দাঁড়িওয়ালা হুজুরের সাথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বোরকাওয়ালির ছবিও তুললেন শরীরের একটা আঙুলও যেখানে দেখা যাচ্ছে না সেখানে ছবি দেখে বোরকার ভেতর কে আছে কীভাবে বুঝবেন জানি না।

          পাহাড়ের অন্যদিকের পায়ে চলা পথে অনেকেই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। গাইডেড ট্যুর। সেদিকে পাহাড় ঢালু হতে হতে মিশেছে সমুদ্রের পাড়ে। আবার উঁচু হতে শুরু করেছে। পরপর ১৭টি পাহাড়ের চূড়া সেখানে। এগুলোর নাম টুয়েলভ অ্যাপসটলস। প্রাচীন আফ্রিকান বিশ্বাস অনুযায়ী পাহাড়ের চূড়ায় স্বর্গীয় দূতের মুখ দেখা বিচিত্র কিছু নয়। তাই এই নাম। তবে এখানে সেভেনটিন অ্যাপসটলস না হয়ে টুয়েলভ অ্যাপসটলস কেন হলো জানি না।

          পাহাড় বেয়ে বেয়ে এগুলোতেও ওঠা যায়। অনেকেই মাউন্টেন হাইকিং করার জন্য আসে কেইপ টাউনে। দুতিনশ' ট্র্যাক আছে এই পাহাড়গুলোতে।

          পশ্চিম দিকে সিংহের মাথার মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি আলাদা পাহাড়। এটার নাম লায়নস হেড। দূর থেকে দেখতে আসলেই মনে হয় একটা সিংহের মাথা জেগে উঠেছে একটা ন্যাড়া পাহাড়ের একদিকে। ন্যাড়া পাহাড়টির নাম সিগনাল হিল। লায়নস হেড এর উচ্চতা ৬৭০ মিটার।

          অনেক বছর আগে এই সিগনাল হিল থেকে কেইপ টাউন বন্দরের দিকে অগ্রসরমান জাহাজকে পতাকা দেখিয়ে সিগনাল দেয়া হতো। এখন অবশ্য সেরকম সিগনালের দরকার হয় না। এখন এখানে রাখা একটি কামান থেকে দুপুর বারোটায় একবার গোলা ছোড়া হয়। সপ্তাহে রবিবার ছাড়া আর সবদিন দুপুরে। কেইপ টাউনের মানুষ সেই শব্দ শুনে ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয়। সময় মেলানো ছাড়াও দুইটি বিশ্বযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোও হয় এই কামানের গোলা ছুঁড়ে।

          সিগনাল হিলের পাদদেশে সমুদ্র সামনে নিয়ে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা- ব্যান্ট্রি বে। কেইপ টাউনের সবচেয়ে ধনী এলাকা এই ব্যান্ট্রি বে। 

          সিগনাল হিলের ঠিক সামনে টেবিল পর্বতের পূর্বদিকে আরেকটি পাহাড়ের চূড়া। এটাকে এরা ডেভিলস পিক বলে। কেইপ টাউনে এই ডেভিলস পিক সম্পর্কে একটা আজগুবি গল্প চালু আছে। ১৭০০ সালের দিকে জাঁ ফন হুনকস নামে একজন ডাচ ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বাস করতেন টেবল মাউন্টেনের কাছে। ভদ্রলোক খুব বেশি ধূমপান করতেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাঁকে ঘরের মধ্যে সিগার টানতে দিতেন না। বাধ্য হয়ে তাঁকে ঘরের বাইরে বারান্দায় সিঁড়িতে বসে সিগার টানতে হতো। একদিন তিনি এরকম সিগার টানছিলেন আর ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন তাঁর সামনের পাহাড়টাও ধোঁয়া ছাড়ছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন পাহাড়ের মাথায় দুটো শিং আর নিচে একটা লেজ আছে। নিশ্চয় ডেভিল। হুনকস চ্যালেঞ্জ করলেন ডেভিলকে। পাইপ টানার প্রতিযোগিতা। শুরু হলো একের পর এক পাইপ টানা। শেষ পর্যন্ত হুনকস জয়ী হলেন। ডেভিল পালিয়ে গেলো বিপরীত দিকে। সেখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ডেভিলস পিক। এই গল্প মানুষ যে কেন বিশ্বাস করে তা বোধগম্য নয়। অবশ্য মানুষ আরো কত আজগুবি ব্যাপার যে বিশ্বাস করে।

 

লায়ন্‌স হেড


ডেভিলস পিক এর ঢালুতে ব্রিটিশরা তিনটি বড় বড় কাঠের দুর্গ তৈরি করেছিলো। প্রিন্স অব ওয়েলস ব্লকহাউজ, কুইন্স ব্লকহাউজ ও কিং ব্লকহাউজ। কিং ব্লকহাউজকে তখন জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। প্রিন্স অব ওয়েলস ব্লকহাউজের কোন চিহ্ন নেই এখন। কুইন্স ব্লকহাউজ এখনো আছে। কোন কোন পর্যটক সেটা দেখতেও যায়।

          পর্যটকে গিজগিজ করছে এখন টেবিল পর্বত। এর মধ্যে কিছু আর্টিস্ট এর দেখা মিললো। পা ছড়িয়ে বসে ছবি আঁকছে। আবার কেউ কেউ একেবারে ধ্যানস্থ হয়ে রোদে বসে বই পড়ছে।

 

টেবিল পর্বতে নিবিষ্ট পাঠক


ঘুরতে ঘুরতে আবার ক্যাবল-কার স্টেশনের কাছে চলে এলাম। এদিকে সাগর আর পাহাড় খুব কাছাকাছি এসেছে। দু-তিনটা রেস্টুরেন্ট আছে এখানে। একটা ছোট কনফারেন্স হলও আছে। অনেক কোম্পানি বিজনেস মিটিং করতে আসে এখানে।

          এখানেই কোমরসমান উঁচু পাথরের দেয়ালের ওপর দেখা মিললো খরগোশের সাইজের ইঁদুরের মতো দেখতে কতগুলো প্রাণীরমানুষের হাত থেকে খাবার খাচ্ছে কাছে এসে। এগুলোর প্রচলিত নাম ডাসি (DASSIE)হাইর‍্যাক্স প্রজাতির এই রক-র‍্যাবিট দেখতে ইঁদুরের মতো হলেও ইঁদুর বা খরগোশ প্রজাতির সাথে এদের ডি-এন-র মিল নেই। এদের সাথে সবচেয়ে বেশি মিল আছে হাতির। এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো বৃহৎ হাতির পূর্বপুরুষ। গত একশ' বছর ধরে এরা এই অঞ্চলে সংরক্ষিত আছে। ডাসির চারপাশে অনেক মানুষ। ডাসিরা সাইজে ছোট হলে কী হবে, হাতির বংশধর তো - মানুষ ভয় পায় না।

 

আমান্ডা ও ডাসি


নিচে নেমে আসার জন্য স্টেশনে ঢুকলাম। ঢুকার সময় কম্পিউটার স্ক্যান করতে হয় টিকেট। টিকেট নম্বর ডিসপ্লেতে দেখা যায়। পর্যটকের নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা। ওঠার সময় স্ক্যান করা হয়েছিল। নামার সময় আবার স্ক্যান করা হলো। কোন বিপদ হলে কম্পিউটারের তথ্য থেকে জানা যাবে উপরে এখনো কতজন রয়ে গেছে।

          গত ৮৫ বছর ধরে ক্যাবল-কার চালু আছে এখানে। আগের পুরনো প্রযুক্তিকে উন্নত করা হয়েছে ১৯৯৭ সালে। এখনো প্রতিবছর ২-৩ মাস বন্ধ থাকে এই ক্যাবল-কার মেইনটেইনেন্স এর জন্য।

          টেবল মাউন্টেনের নিচের স্টেশন ও উপরের স্টেশনে যেসব দোকান-পাট আছে, রেস্টুরেন্ট আছে সেখানের সব সামগ্রী কেইপ টাউনের স্থানীয় মানুষরাই সরবরাহ করে। স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ খুবই কার্যকরী। প্রতিবছর যে বিশ লাখ মানুষ এখানে আসে তাদের মধ্যে কমপক্ষে দশ লাখ মানুষ কিছু না কিছু কিনে এখান থেকে।

          দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর ক্যাবল-কার এলো নিচ থেকে। নামার সময় বেশিরভাগ আমেরিকান ট্যুরিস্ট। আবার ঘুরতে ঘুরতে দেখতে দেখতে ৫ মিনিটের তার-পথ। স্টেশন বিল্ডিং থেকে বেরিয়েই দেখলাম লাল বাস দাঁড়িয়ে আছে। দোতলায় উঠে গেলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই উপরের সিটগুলো ভর্তি হয়ে গেলো। যতজন নামলো এখানে, উঠলো তার চেয়ে বেশি।

          ক্যাম্পস বের (Camps Bay) দিকে জেনিভা ড্রাইভ ধরে বাস চলছে টেবল মাউন্টেনের পশ্চিম দিকে সারি সারি পাহাড়চুড়ার পা ছুঁয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর। আর তার তীর ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাগুলোর একটি ভিক্টোরিয়া রোড। এখানে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে মুখ করে টেবিল পর্বতের ঢালুতে গড়ে উঠেছে খুবই পরিকল্পিত বসতি। কেইপ টাউনে শুধু নয় পুরো আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে দামী বাড়িগুলোর বেশিরভাগ এখানে।

          ক্যাম্পস বে ড্রাইভ এসে মিশেছে ভিক্টোরিয়া রোডেমহাসাগরের তীর ঘেঁষে পাহাড়ের পাশ দিয়ে এই ভিক্টোরিয়া রোড পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেরিন ড্রাইভগুলোর একটি। হলিউডের অসংখ্য সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এই রাস্তায়। এখন এখানে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো সিনেমাস্টুডিও। হলিউডের অনেক নায়িকাকে দেখা যায় ভিক্টরিয়া ড্রাইভের পাশের পশ পাব ও রেস্তোরায়।

 

জেনিভা ড্রাইভ


বাস থামলো বে হোটেলের সামনের স্টপে। কেইপ টাউনের পাঁচতারা হোটেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাস্যময়ী হোটেল। বাসের দোতলা থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে পাহাড়ের পেছন দিকে আটলান্টিক সাগরে হঠাৎ জেগে উঠেছে এই হোটেল।

          আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে। একটু আগেও ঝকঝকে রোদ ছিল। এখন সাদা মেঘ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে।

 

ভিক্টোরিয়া ড্রাইভ - কখনো রোদ কখনো মেঘ


 ক্যাম্পস বের সৈকতে বালির চেয়ে পাথর বেশি। ছোট নুড়ি থেকে শুরু করে ছোটখাট পাহাড়ের আয়তনের পাথরও আছে এখানে। সেগুলোর গায়ে আছড়ে পড়ছে আটলান্টিকের পানি। শীতকালে বরফঠান্ডা এই পানিতে নেমে দাপাদাপি করার প্রশ্নই ওঠে না। এত চমৎকার আয়োজন চারদিকে সে তুলনায় বিশ্বের সৌন্দর্য সাদামাটা।

          ক্যাম্পস বের একটু পরেই ক্লিফটন বে। এদিকের কয়েক মাইল জায়গা মিলিওনিয়ারস মাইল নামে পরিচিত। মিলিওনিয়ার ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এখানে বাড়ি কেনা অসম্ভব।

          ক্লিফটনে পরপর চারটি ছোট বিচ আছে। নামের বদলে তাদেরকে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড ও ফোর্থ বিচ নামে ডাকা হয়। গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি তাদের সীমানা। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের প্রচন্ড গরমে এই বিচের সাদা বালিতে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে অনেক মানুষ। বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ- কারণ যাদের চামড়া সাদা তারাই কেবল চামড়া পুড়িয়ে কালো করার মধ্যে আভিজাত্য খুঁজে পায়। ফার্স্ট ও সেকেন্ড বিচ রৌদ্রপিয়াসীদের স্বর্গ। বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীরা যায় থার্ড বিচে। আর ফোর্থ বিচের কাছে গাড়ি পার্কিং এর সুবিধা আছে বলে ফ্যামিলি আউটিং এর জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানেই যায় সবাই।

          ক্লিফটনের সৌন্দর্য পার হয়ে একটু এগিয়েই ব্যান্ট্রি বে। এটাও মিলিওনিয়ারদের এলাকা। সবগুলো বাড়ি খাড়া পাহাড়ের উপরে। আকাশের কাছাকাছি বসে এগুলোর মালিক আটলান্টিক মহাসাগরের সৌন্দর্য দেখে।

          কিন্তু তাদের একটা সমস্যা আছে। রাস্তার এত কাছে বাড়ি হলেও ভিক্টরিয়া রোডের দিক থেকে তাদের বাড়িতে ঢোকার কোন উপায় নেই। পাহাড়ের ওদিকে অনেক দূরের রাস্তা ঘুরে যেতে হয়। তাতে অবশ্য তাদের কোন সমস্যা নেই। কারণ তারা তো আর পায়ে হেঁটে বেড়ান না। কিন্তু সমস্যা হয় তাদের কাজের লোকদের। কাছাকাছি কোন সুপারমার্কেট বা অন্য দোকানপাট খুব একটা নেই। অসুবিধা হয় সাপ্লাইয়ারদেরও। তাছাড়া চোখের সামনে মহাসাগর, মহাসাগরের সৈকত। কিন্তু সেখানে যেতে হলে ঘুরে আসতে হয় তিন চার কিলোমিটার। এ সমস্যার সমাধান করলো তারা প্রযুক্তির সাহায্যে। এদিকের রাস্তা থেকে পাহাড়ে ওঠার জন্য কয়েকটা ছোট ছোট লিফট বানিয়ে নিয়েছে তারা।

          কিছুদূর এগিয়েই প্রেসিডেন্ট হোটেলের সামনে বাস থামলো। আরেকটি বনেদি হোটেল কেইপ টাউনের। কেইপ টাউনের প্রধান উপার্জনখাতটিই হলো পর্যটন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই শহর পেয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে। কিন্তু তার সংরক্ষণ ও পরিচর্যার দায়িত্ব নিজেরা এত ভালোভাবে পালন করছে যে সৌন্দর্য আরো বাড়ছে। বেড়াতে এলে মানুষের ভোগলিপ্সা কিছুটা হলেও বেহিসেবী রকমের বেড়ে যায়। তার যোগান দেয়ার ব্যবস্থা ভালো রকমেরই আছে এখানে।

          প্রেসিডেন্ট হোটেলের পরের স্টেশন আসার আগেই দেখলাম উপরের ডেকের সবার ভেতর চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। বাম পাশে চমৎকার সৈকত। সাদা বালি চিকচিক করছে সেখানে। ডানপাশে সারি সারি সাদা রঙের বাড়ি। উচ্চমূল্যের এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই ধনীদের দখলে। রাস্তার দুপাশে পাইন গাছের সারি।

          বাস থেকে নিচে নামতেই ঠান্ডা বাতাসের প্রচন্ড ঝাপটা লাগলো চোখে-মুখে। বাতাস এত ঠান্ডা- পানি যে কত ঠান্ডা হবে কে জানে। জায়গাটার নাম সী পয়েন্ট। বালির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পানির কাছাকাছি গেলাম। একটা বুনো গন্ধ চারদিকে। ঠান্ডা বাতাসের কারণে খুব বেশি মানুষ নেই। রোদ ছিল একটু আগে। এখন সূর্য মেঘে ঢাকা। ছোপ ছোপ কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ। আবহাওয়ার এই অবস্থা এবং আশপাশের পরিবেশের সাথে সাউথ মেলবোর্ন বিচ ও সেন্ট কিলদা বিচের খুব মিল আছে।

          বিচের কাছেই চমৎকার পাবলিক পার্ক। অনেকে পিকনিক করতে এসেছে। ছেলেমেয়ে শিশুবুড়ো নানা বয়সের মানুষস্থানীয় কালো মানুষদের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ছে না। সবাই কি ট্যুরিস্ট? পরক্ষণেই মনে হলো এই অঞ্চলে যারা থাকেন তাদের বেশিরভাগ ধনী মানুষ। দক্ষিণ আফ্রিকায় যারা গরীব মানুষ আছেন তাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

          বিশাল একটা চশমার ফ্রেম রাখা আছে পার্কের ঘাসের ওপর। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেটার ওপর ওঠে দাপাদাপি করছে। এদিকে সমুদ্রের পাড় রেলিং দিয়ে ঘেরা আর পাকা রাস্তা আছে স্বাস্থ্য-সচেতনদের হাঁটার সুবিধার জন্য। সাইকেল ট্র্যাকও আছে সেখানে। অনেকে সাইকেল চালাচ্ছে। মনে হচ্ছে কুয়াশা বা মেঘ বা ঠান্ডা হাওয়ার সাথে অভ্যস্ত সবাই।

 

 আটলান্টিকের পাড়ে পার্ক


         ২০০০ সাল পর্যন্ত সী পয়েন্ট ছিল কেইপ টাউনের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা। এদিকের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দাম ও চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০০০ সালের দিকে ওয়াটারফ্রন্ট তৈরি হবার পর ওয়াটারফ্রন্টের আশেপাশের ঘরবাড়ির দাম বেড়ে যায় রাতারাতি। কয়েক কিলোমিটার ইতস্তত হেঁটে আবার রাস্তার কাছে চলে এলাম। বাসস্টপে কয়েক মিনিট দাঁড়াতেই আরেকটি বাস এলো। এটাও রেড বাস। প্রতি বিশ মিনিট পরপর বাস আছে। তাই যে কোন স্টপে নেমে সেখানকার আশেপাশের সবকিছু দেখে আরেকটা বাসে উঠে যাওয়া যায়।

          ব্যান্ট্রি বে থেকে ভিক্টোরিয়া রোড মিশে গেছে বিচ রোডের সাথে। বিচ রোড অনেক ব্যস্ত অনেক প্রশস্ত রোড। এই রোড গিয়ে মিশেছে ওয়াটারফ্রন্টের সাথে। বিচ রোডের ডান পাশ পুরোটাই সুদৃশ্য বহুতল ভবন। আর বামপাশে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে বিচ ও পার্ক।

          কয়েক কিলোমিটার পরে রাস্তার ওপর একটা পুরনো লাইটহাউজ। উজ্জ্বল লাল রঙের মাঝারি উচ্চতার লাইটহাউজ। জায়গাটির নাম গ্রীন পয়েন্ট। এখান থেকে ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো কেইপ টাউনের বিশাল ফুটবল স্টেডিয়াম। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করার জন্য এটা বানানো হয়েছিল। সে উপলক্ষে এদিকে অনেক স্থাপনা যে নতুন করে বানানো হয়েছে তা দেখলেই বোঝা যায়।

          রাস্তার দুপাশে লোকজনের ভিড় হঠাৎ বেড়ে গেলো। বাস ঢুকছে ওয়াটারফ্রন্টে। শত শত পর্যটক এখানে। বাস এসে দাঁড়ালো অ্যাকোরিয়ামের সামনে প্রথম স্টেশনে। ম্যাপ খুলে দেখলাম রেড বাসে চড়ে কেইপ টাউনের অর্ধেক সীমানার চারপাশ ঘুরে ফেলেছি।

          লাঞ্চ করা দরকার। বাস থেকে নেমে খাবারের দোকান খোঁজার জন্য কয়েক পা এগোতেই একজন আফ্রিকান তরুণ ছুটে এলো আমার দিকে।

     মিস্টার দেব, হাউ ওয়াজ দি ট্রিপ?

     ট্রিপ ওয়াজ গুড।

          ছিপছিপে কালো এই ছেলেটিকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। অথচ সে আমার নাম জানে! কীভাবে সম্ভব? ছেলেটি বুঝতে পারলো আমার মনের অবস্থা। বললো, ইওর ফটো ইজ রেডি।

          মনে পড়লো সকালে ছবি তোলার কথা। আমার ছবি আর নাম ছেলেটার হাতে। চিনতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়।

          সকালে সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডে তোলা আমার ছবি কেইপ টাউনের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটের ছবির ওপর পেস্ট করে ছয়টি ছোটবড় ছবি প্রিন্ট করে নিয়ে এসেছে। ১৮০ র‍্যান্ড দিতে হলো। ছয়টা ছবি প্রিন্ট করতে খুব বেশি হলে বারো র‍্যান্ড লাগতে পারে। সেখানে ১৮০ র‍্যান্ডব্যবসাটা যে লাভজনক তাতে কোন সন্দেহ নেই।


          প্রায় পৌনে চারটা বাজে। দুপুরে খাওয়া হয়নি এখনো। ওয়াটারফ্রন্টের সবখানে ছড়িয়ে আছে নানারকমের খাবারের দোকান। বিশাল শপিং কমপ্লেক্সের নিচের তলায় ফুডকোর্টে গিয়ে কে-এফ-সির কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। লোকাল শপগুলোতে খাবার তৈরি করতে সময় নেয়। বাসের ধারাবিবরণী থেকে দক্ষিন আফ্রিকার ‘go slow’ নীতি সম্পর্কে জেনে বেশ মজাই লাগলো এরা নাকি যখন বলে just now’ ধরে নিতে হবে ভবিষ্যতের কোন একদিন, সেটা দুসপ্তাহ পরেও হতে পারে। কে-এফ-সিতে অন্তত কয়েক মিনিট পরেই খাবার পাওয়া যায়



[1] Enver Duminy, “Great Ideas hard work, Innovation in Tourism is boosting the Western Cape economy.” Explore South Africa, Issue 50, 2016. page 43.


পর্ব ৬

Latest Post

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা - দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইল এলাকায় কিছু পুলিশ সদস্য ইয়াসমিন নামের এক ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এই ঘ...

Popular Posts