বিংশ শতাব্দীর শেষে অনেকেই ভেবেছিলেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীদের হাতে আবিষ্কারের জন্য সেরকম জটিল কোন সমস্যা থাকবে না। এরকম ধারণা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষেও হয়েছিল অনেকের। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্থপতি পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক যখন ছাত্রজীবনে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হচ্ছিলেন, তখন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফিলিপ জোলি প্ল্যাংককে বলেছিলেন, “ফিজিক্স পড়ে কী করবে? ফিজিক্সের সবকিছুই তো আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।“ অথচ আমরা দেখলাম বিংশ শতাব্দীর পুরোটাই ছিল পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক আবিষ্কারের শতক। বিংশ শতাব্দীতেই আবিষ্কৃত হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স; আইনস্টাইনের বিশেষ ও সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব বদলে দিয়েছে আমাদের মহাবিশ্বের সমস্ত হিসেবনিকেশ; মানুষ যে শুধুমাত্র আকাশভ্রমণ শুরু করেছে তা নয় - মানুষের তৈরি স্যাটেলাইট পৌঁছে গেছে আমাদের দৃশ্যমান আকাশ ছাড়িয়ে আকাশান্তরে, চাঁদের বুকে হেঁটে এসেছে মানুষ। মহাকাশে ঘুরে ঘুরে অত্যাধুনিক দুরবিন খুঁজে নিয়ে এসেছে মহাবিশ্বের কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের আলো। আমরা জেনে গেছি মহাবিশ্বের উৎপত্তির গোড়ার কথা। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বের করে ফেলেছেন মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর বা ১৩৮০ কোটি বছর। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড শনাক্ত করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পেয়ে গেছেন মহাজাগতিক প্রথম আলোর সন্ধান – যেখান থেকেই শুরু হয়েছিল মহাবিশ্বের বেড়ে ওঠার পালা। বিংশ শতাব্দীর শেষে তাই অনেকেই ভেবেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের কোন সমস্যা অমীমাংসিত থাকবে না, একবিংশ শতাব্দী হবে মূলত জীববিজ্ঞানের শতাব্দী – যেখানে জানা যাবে মহাবিশ্বে প্রাণের উদ্ভবের মূল কারণ এবং মানুষের জীববৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎ কী।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির আকাশচুম্বী সাফল্য এবং বিস্তারের পরেও বিজ্ঞানীদের হাতে এমন অনেক সমস্যা রয়ে গেছে যাদের সমাধানের ব্যাপারে কোন কূলকিনারা পাচ্ছেন না তাঁরা। বিজ্ঞানে এরকম ব্যাপারগুলি অনেকটা রহস্যকাহিনির ঘটনার মতো। যখনই মনে হয় যে রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে, তখনই দেখা যায় রহস্য নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। আমাদের মহাবিশ্ব আমাদেরকে এরকমই রহস্যের আবরণে জড়িয়ে দিচ্ছে বারবার।
যে মহাবিশ্বে আমরা বাস করি – কী আশ্চর্য সুন্দর তার অবয়ব যেটুকু আমরা দেখতে পাই। কিন্তু মহাবিশ্বের ঠিক কতটুকু আমরা দেখতে পাই? প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন চোখ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা ছিল না মানুষের দেখার, সেই সময় খালিচোখে আকাশ দেখেই মানুষ ভেবে নিয়েছিল আকাশই মহাবিশ্বের শেষ সীমানা। তখন মনে হতো মহাবিশ্বের পুরোটাই আমরা দেখতে পাই আকাশের দিকে তাকিয়ে। যেন প্রকৃতি আকাশের বুকে সূর্যতারাখচিত চাদরের মতো বিছিয়ে দিয়েছে পুরো মহাবিশ্বকে। তখন মনে হতো আমরা মহাবিশ্বের পুরোটাই দেখতে পাই।
তার কয়েক হাজার বছর পর মানুষ যখন মহাকাশ জয় করে ফেললো, গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়িয়ে মানুষের তৈরি নভোযান পাড়ি দিল আমাদের সৌরজগত থেকে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে, এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সির দিকে – আমরা জানতে পারলাম কী প্রচন্ড গতিশীল আমাদের গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সিসহ পুরো মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের যত বেশি তথ্য এবং উপাত্ত বিজ্ঞানীদের হাতে আসতে শুরু করলো, মহাবিশ্বের রহস্য ততবেশি উদ্ঘাটিত হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেলো মহাবিশ্ব নতুন নতুন রহস্যের চাদরে নিজেকে ঢাকতে শুরু করলো। এই একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ পার করার মুহূর্তে আমরা এই মহাবিশ্বের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ বস্তু ও শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছুই জানি না।
বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক হিসেব অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের শতকরা পঁচানব্বই ভাগই অদৃশ্য। এতবড় মহাবিশ্বের দৃশ্যমান কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি সবকিছুকে একসাথে যোগ করলে মহাবিশ্বের মাত্র পাঁচ ভাগ হয়, বাকি পঁচানব্বই ভাগ যে কীভাবে লুকিয়ে আছে তা এক অধরা রহস্য। এই পঁচানব্বই ভাগকে দেখার কোন উপায় নেই।
কোনো কিছু দেখতে হলে আলো কিংবা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সাথে সেই বস্তুর মিথষ্ক্রিয়া ঘটতে হয়। মহাবিশ্বের পঁচানব্বই ভাগ বস্তু এবং শক্তির সাথে আলো কিংবা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের কোন মিথষ্ক্রিয়া ঘটে না। ফলে তাদেরকে দেখার কোন উপায় বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেননি। তাই অদৃশ্য অংশের নাম ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি। মহাবিশ্বের এই অদৃশ্য অংশের তেইশ ভাগ ডার্ক ম্যাটার এবং বাহাত্তর ভাগ ডার্ক এনার্জি। ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। এদের কাজ আলাদা, ইতিহাস আলাদা। শুধুমাত্র নামের মিল ছাড়া এদের মধ্যে আর কোন পারস্পরিক সম্পর্ক নেই।
অবশ্য ডার্ক নামটি যুৎসই হয়নি। আলোর সাথে কোন মিথস্ক্রিয়া করে না বলে এদের নাম হওয়া উচিত ছিল ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ। অদৃশ্য বস্তু বোঝাতে ডার্ক ম্যাটার নামটি দিয়েছিলেন সুইডিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি ১৯৩৩ সালে। তারই অনুকরণে অদৃশ্য শক্তি বোঝানোর জন্য ডার্ক এনার্জি নাম দিয়েছেন আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল টারনার ১৯৯৮ সালে। সে হিসেবে ডার্ক এনার্জি তুলনামূলকভাবে খুবই সাম্প্রতিক বিষয়।
প্রথমে দেখা যাক ডার্ক ম্যাটারের ব্যাপারস্যাপার কী।
বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের আকার এবং আকৃতি মাপার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কয়েক শতাব্দী থেকে। সপ্তদশ শতকে আইজাক নিউটনের মহাকর্ষের সূত্র আবিষ্কারের পর গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্রসহ মহাবিশ্বের সবকিছুর ভর এবং গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের উপায় মানুষের হাতে চলে এলো। মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয় মহাকর্ষ বলের কারণে। নিউটনের গতির সূত্র থেকে ত্বরণ ও বল জানা থাকলে আমরা বস্তুর ভর মাপতে পারি। মহাকর্ষ বলের টানে গ্রহ-নক্ষত্রগুলির গতির পরিবর্তন হিসেব করে গ্রহ-নক্ষত্রের ভর হিসেব করতে সক্ষম হলেন বিজ্ঞানীরা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিউটনের সূত্রে হিসেবে বাগড়া দিতে আবিষ্কৃত হলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে মহাবিশ্বের বস্তুগুলি যদি পরস্পরের আকর্ষণে একে অপরকে কাছে টানতে থাকে, তাহলে মহাবিশ্ব ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা তো হচ্ছে না।
আলবার্ট আইনস্টাইন |
১৯১৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশিত হলে এই সমস্যার এক রকম সমাধান হয়ে যায়। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব মহাকর্ষ বলের সংজ্ঞাই বদলে দেয়। নিউটনের মহাকর্ষ বল শুধুমাত্র বস্তুর গতির পরিবর্তন ঘটায়, কিন্তু আইনস্টাইনের মহাকর্ষ বল বস্তুর গতির সাথে স্থান-কাল (স্পেস-টাইম)ও বদলে দেয়। আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের জটিল গাণিতিক সমীকরণ সমাধান করে দেখা গেলো মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইন ভাবলেন এটা অস্বাভাবিক। তিনি মহাবিশ্বের আয়তন স্থির রাখার জন্য ১৯১৭ সালে তাঁর আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের সমীকরণে একটি ধ্রুবক (কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট) বসিয়ে দিলেন। ফলে গাণিতিক হিসেবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বন্ধ করা গেলো।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এক যুগ পরেই দেখা গেলো আইনস্টাইনের প্রাথমিক হিসেবই ঠিক ছিল। ১৯২৯ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল আবিষ্কার করলেন যে মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। হাবল মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কোটি কোটি নক্ষত্রপুঞ্জের সমষ্টি একেকটি গ্যালাক্সি থেকে যখন আলো এসে পৌঁছায় টেলিস্কোপে, সেই আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে জানা যায় – গ্যালাক্সিটি পৃথিবী থেকে কত দূরে, কত বেগে ঘুরছে। আলো তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ। দৃশ্যমান আলোর লাল বর্ণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম। আলোর উৎস যদি টেলিস্কোপ থেকে যত দূরে চলে যেতে থাকে, আলোর তরঙ্গ ততই সম্প্রসারিত হতে থাকে। ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকা মানে তা ক্রমশ লাল বর্ণের দিকে সরে যাওয়া। তাই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে রেডশিফ্ট বা লোহিত সরণ। আবার আলোর উৎস যদি কাছে আসতে থাকে, তাহলে আলোর তরঙ্গ সংকুচিত হয়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যায়। অর্থাৎ তখন আলো ক্রমশ নীল কিংবা বেগুনির দিকে সরতে থাকে। তাকে বলা হয় ব্লু শিফ্ট বা নীল সরণ। রেড শিফ্ট দেখে বোঝা যায় আলো দূরে চলে যাচ্ছে, ব্লু শিফ্ট দেখে বোঝা যায় আলো কাছে আসছে।
এডুইন হাবল |
এডুইন হাবল দেখলেন যে দূরের গ্যালাক্সিগুলি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে দূরে চলে যাচ্ছে। তার মানে মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইন এই ফলাফল দেখে বুঝতে পারলেন তিনি শুরুতেই ঠিক ছিলেন। তাঁর কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট না বসালেই ঠিক ছিল।
এডুইন হাবলের আবিষ্কারের পর আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালাক্সির গতি পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। ১৯৩৩ সালে সুইজারল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ জুইকি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির মানমন্দিরের টেলিস্কোপে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিগুচ্ছ ‘কোমা ক্লাস্টার’-এর গতিপ্রকৃতি। এক হাজারের বেশি গ্যালাক্সির এই গুচ্ছের গ্যালাক্সিগুলি থেকে আসা আলোর বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে ফ্রিৎজ জুইকি অবাক হয়ে গেলেন। বর্ণালীর লোহিত সরণ হিসেব করে দেখলেন যে গ্যালাক্সিগুলি অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে ঘুরছে, কিন্তু গুচ্ছ থেকে ছিটকে বের হয়ে যাচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার গতির বেশি গতিতে ছুটলে বস্তু মাধ্যাকর্ষণ অতিক্রম করে বের হয়ে যায় – যাকে এসকেপ ভেলোসিটি বা মুক্তিবেগ বলে। যেমন পৃথিবী থেকে রকেট উৎক্ষেপণ করার সময় তা পৃথিবীর মুক্তিবেগের (সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার বা ঘন্টায় ৪০,৩২০ কিলোমিটার) বেশি বেগে উৎক্ষেপণ করতে হয়।
ফ্রিৎজ জুইকি |
জুইকি গ্যালাক্সিগুলির মোট ভর হিসেব করে দেখলেন – সেই ভরে গ্যালাক্সিগুলির মুক্তিবেগ যত হওয়া দরকার, গ্যালাক্সিগুলি তার চেয়ে অনেক বেশি বেগে ঘুরছে, তবুও ছিটকে বের হয়ে যাচ্ছে না গ্যালাক্সি থেকে। তার কারণ কী? বার বার হিসেব করেও হিসেবে কোন ভুল পেলেন না। তাহলে নিশ্চয় সেখানকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেক বেশি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বেশি হওয়ার একটিই কারণ হতে পারে – সেটা হলো গ্যালাক্সিগুচ্ছের ভর অনেক বেশি। কিন্তু দৃশ্যমান পদার্থের ভর হিসেব করে যা পাওয়া গেলো তার চেয়ে চল্লিশ গুণ বেশি ভর হলে তবেই গ্যালাক্সিগুলি ঐ বেগে ছুটতে পারে। এত বিশাল পরিমাণ বস্তু কোথায় গেলো? জুইকি জার্মান ভাষায় এই অদৃশ্য বস্তুর নাম দিলেন ‘ডাংকল ম্যাটেরি’ যা ইংরেজিতে হলো ‘ডার্ক ম্যাটার’।
জুইকির এত বড় আবিষ্কারের দিকে খুব একটা মনযোগ গেলো না তেমন কারো। ইওরোপ আমেরিকা তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ায় উপস্থিত। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে মেতে উঠেছে প্রায় সবাই। জুইকির আবিষ্কারের বছরখানেক আগে নেদারল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়ান ওর্ট-ও একই ধরনের ফলাফল পেয়েছিলেন আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সি – মিল্কিওয়ে পর্যবেক্ষণ করার সময়। মিল্কিওয়ের অনেকগুলি লেজের দিকের অনেকগুলি নক্ষত্র এতবেগে ঘুরছে যে ওগুলির ভর যদি যা দেখা যাচ্ছে তা হয়, তাহলে মিল্কিওয়ে থেকে ছিটকে বের হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না, অর্থাৎ সেখানেও যত বস্তু দেখা যাচ্ছে – তার চেয়ে অনেক বেশি বস্তু অদৃশ্য রয়ে গেছে। বছর চারেক পর ১৯৩৭ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী সিনক্লেয়ার স্মিথ পাঁচ কোটি আলোকবর্ষ দূরের ‘ভার্গো ক্লাস্টার’ গ্যালাক্সিগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করেও একই রকম ফল পেয়েছিলেন। কিন্তু সিনক্লেয়ার স্মিথ তাঁর গবেষণা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার আগেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের কারণে ডার্ক ম্যাটার নিয়ে আর কেউ তেমন মাথা ঘামাননি পরবর্তী ত্রিশ বছর।
১৯৭৫ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলির উপর তাঁর পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গুরুত্বদিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করলেন ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে।
ভেরা রুবিন |
ভেরা রুবিন খুবই বিস্তারিত গবেষণা করেছিলেন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলিকে নিয়ে। মিল্কিওয়ে, অ্যান্ড্রোমিডা – এরকম চ্যাপ্টা সর্পিলাকার গ্যালাক্সিগুলিতে বেশিরভাগ নক্ষত্রই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থান করে, ফলে গ্যালাক্সির ভরের বেশিরভাগই এর কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে। গ্যালাক্সির কিনারায় এবং লেজের দিকে যে নক্ষত্রগুলি থাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র অনুযায়ী তাদের উচিত কেন্দ্রের নক্ষত্রগুলির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম গতিতে ঘোরা। যেমন আমাদের সূর্যকে কেন্দ্র করে যেসব গ্রহ ঘুরছে – সূর্য থেকে তাদের দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে তাদের ঘূর্ণনের গতি কমে যায়। যেমন বুধ যে গতিতে সূর্যের চারপাশে ঘোরে (সেকেন্ডে ৪৭.৯ কিলোমিটার), বৃহস্পতির গতি তার তুলনায় অনেক কম (সেকেন্ডে ১৩.১ কিলোমিটার)। কিন্তু ভেরা রুবিন হিসেব করে দেখলেন গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরের নক্ষত্রগুলির ঘূর্ণনের গতি কেন্দ্রের কাছের নক্ষত্রগুলির গতির প্রায় সমান। তার মানে নিশ্চয় গ্যালাক্সিতে এমন কোন বস্তু আছে – যার প্রভাবে মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরি হচ্ছে, কিন্তু বস্তুগুলি দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই। পরবর্তী পাঁচ বছরে ভেরা রুবিন আরো শতাধিক গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলি পর্যবেক্ষণ করে একই ধরনের ফলাফল পেলেন।
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন যে গ্যালাক্সিগুলিতে এমন কিছু অদৃশ্য বস্তু ‘ডার্ক ম্যাটার’ আছে যেগুলি গ্যালাক্সির মাঝখানে কেন্দ্রিভূত থাকার বদলে পুরো গ্যালাক্সিজুড়ে ছড়িয়ে আছে – যার ফলে গ্যালাক্সির সব জায়গায় সমান মাধ্যাকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু অদৃশ্য বস্তুগুলি কোন ধরনের আলোর সাথেই কোন মিথষ্ক্রিয়া করে না। সেই থেকে অবিরাম চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটার শনাক্ত করতে পারেননি, বা গবেষণাগারেও তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু গ্রাভিটেশানাল লেন্সিং অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতির প্রমাণ পাচ্ছেন অহরহ।
গ্রাভিটেশানাল লেন্সিং ব্যাপারটা হলো – যখন অনেকগুলি গ্যালাক্সি একসাথে থাকে – তখন সামনের গ্যালাক্সিগুলি থেকে আলো দেখা গেলেও, পেছনের গ্যালাক্সিগুলির আলো সামনের গ্যালাক্সিগুলির কারণে দেখা যায় না। কিন্তু তাদের ভরের কারণে সৃষ্ট মাধ্যাকর্ষণের কারণে পেছনের গ্যালাক্সিগুলির আলো বেঁকে গিয়ে সামনের গ্যালাক্সিগুলির কিনারা দিয়ে বের হয়ে আসে। ভর যত বেশি হবে, মাধ্যাকর্ষণ তত বেশি হবে, আলোও তত বেশি বেঁকে যাবে। তাই আলো কতটুকু বেঁকে গেলো তা হিসেব করে কতটুকু বস্তু সেখানে আছে তা হিসেব করা যায়। গ্যালাক্সিগুলির দৃশ্যমান বস্তুর সমস্ত ভর একত্রিত করলেও আলোর যতটুকু বেঁকে যাওয়ার কথা, গ্যালাক্সিগুলিতে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বেঁকে যাচ্ছে আলো। তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, গ্যালাক্সিগুলিতে হিসেবের চেয়ে কমপক্ষে ছয়গুণ বেশি বস্তু আছে। এই বস্তুগুলি অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটার।
ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ডার্ক ম্যাটার আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিতভাবে বের করতে পারেননি। তবে ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে বেশ কয়েক ধরনের ধারণা দিয়েছেন অনেকে।
একদল বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল ডার্ক ম্যাটার সম্ভবত লুকানো ব্ল্যাকহোল। কিন্তু এই ধারণা সহজেই বাতিল হয়ে গেছে – কারণ অবস্থান জানলে ব্ল্যাকহোল খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না।
আরেকদল বিজ্ঞানী বললেন ডার্ক ম্যাটার হতে পারে মহাবিশ্বের গ্রহ, কিংবা নিউট্রন স্টার, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শ্বেত বামন কিংবা এরকম বস্তু যেগুলির নিজস্ব কোন আলো নেই। এই বস্তুগুলির একটি গালভরা নামও দেয়া হলো – ‘ম্যাসিভ অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল কম্প্যাক্ট হ্যালো অবজেক্টস’ বা ‘ম্যাচো (MACHO)। কিন্তু এই বস্তুগুলি তো আধুনিক টেলিস্কোপে ধরা পড়ার কথা। এদের নিজস্ব আলো না থাকলেও এদের গায়ে অন্য নক্ষত্রের আলো প্রতিফলিত হয়। তাছাড়া এরকম কতগুলি বস্তু মহাবিশ্বে থাকতে পারে – তাদের সম্ভাব্য সবগুলির ভর একসাথে যোগ করেও অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের ভরের কাছাকাছিও পৌঁছানো যাচ্ছে না। ফলে এই সম্ভাবনাও বাতিল হয়ে যায়।
‘ম্যাচো’ পদার্থের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যাবার পর আরেকটি সম্ভাবনা বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন – সেটা হলো নতুন ধরনের কোন কণা কিংবা কণার সমষ্টি দিয়ে গঠিত হতে পারে ডার্ক ম্যাটার। এই কণাগুলি কণা পদার্থবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত কণাগুলির বাইরে নতুন কোন কণা যেগুলির ভর আছে, কিন্তু অন্য কোন কণার সাথে খুব সামান্যই মিথষ্ক্রিয়া করে। এদের নাম দেয়া হয়েছে উইকলি ইন্টার-অ্যাকটিং ম্যাসিভ পার্টিক্যালস বা উইম্প (WIMP)। ধারণা করা হচ্ছে এই কণাগুলি শুধুমাত্র মহাকর্ষ বল এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে – অনেকটা নিউট্রিনোর মতো – যাদের শনাক্ত করা দুসাধ্য। ১৯৯৮ সালে জাপানি বিজ্ঞানীরা যখন নিউট্রিনোর ভর নির্ণয় করতে সক্ষম হলেন, তখন সবাই আশা করেছিল মহাবিশ্বে সম্ভাব্য সব নিউট্রিনোর ভর হিসেব করলে অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের ভরের সমান হবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। সমস্ত নিউট্রিনোর ভর যোগ করলেও অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের শতকরা এক ভাগের ভরের সমানও হয় না। বিজ্ঞানীরা আশা করে আছেন – কোনো একদিন হয়তো নিউট্রিনোর মতো কোন নতুন কণার সন্ধান পাওয়া যাবে।
আবার একদল বিজ্ঞানী মনে করেন – ডার্ক ম্যাটার বলে হয়তো কোন পদার্থ নেই – হয়তো আইনস্টাইনের হিসেবে কোন গন্ডগোল আছে, কিংবা গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব সমীকরণে পরিবর্তন আনার দরকার আছে – ডার্ক ম্যাটারের সমস্যা মেটানোর জন্য। আরেকদল বিজ্ঞানী মনে করেন নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র হয়তো মহাবিশ্বের সব জায়গায় সমানভাবে কাজ করে না। গ্রহ-উপগ্রহের ক্ষেত্রে যা কাজ করে, তা হয়তো বৃহত্তর গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে কাজ করে না। তারা তাদের ধারণার নাম দিলেন – মডিফাইড নিউটনিয়ান ডায়নামিক্স বা মন্ড (MOND)।
নানা বিজ্ঞানীর নানা মত থেকে মহাবিশ্বের মোট বস্তুর প্রায় শতকরা সাতাশ ভাগ অদৃশ্য বস্তু ‘ডার্ক ম্যাটার’ সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি, এটা এখনো মহাবিশ্বের অন্যতম প্রধান অমীমাংসিত রহস্য।
ডার্কম্যাটার রহস্যের মাঝেই নতুন রহস্য হাজির হয়েছে মহাবিশ্বে। সেটা ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে এসে ১৯৯৮ সালে। আর সেই নতুন রহস্যের নাম – ডার্ক এনার্জি। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ডার্ক ম্যাটার থেকেই ডার্ক এনার্জির উৎপত্তি।
ডার্ক এনার্জি রহস্যের শুরু হয়েছে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি নির্ণয় করতে গিয়ে। আমরা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি যে ১৯২৯ সালে এডুইন হাবল আবিষ্কার করেছিলেন যে গ্যালাক্সিগুলি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। কী গতিতে গ্যালাক্সিগুলি ছুটে চলেছে তার একটি সূত্র তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন – যাকে আমরা হাবলের সূত্র বলে জানি। এই সূত্র অনুযায়ী কোন একটি গ্যালাক্সির গতি পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সির দূরত্বের সমানুপাতিক। আর এই সমীকরণের সমানুপাতিক ধ্রুবকের নাম – হাবল কনস্ট্যান্ট বা হাবল ধ্রুবক। ১৯৯০ সালে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’ মহাকাশে পাঠায় – যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হাবল ধ্রুবকের মান প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখান থেকে মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় করা। পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য হাবল ব্যবহার করেছিলেন সেফিড নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা। সেফিড নক্ষত্রগুলির উজ্জ্বলতা একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর বাড়ে এবং কমে। এই উজ্জ্বলতার পরিমাণ হিসেব করে পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব হিসেব করা যায়। দূরত্ব যত বেশি হয়, উজ্জ্বলতা তত কমতে থাকে। সেফিড নক্ষত্রগুলি আন্তনাক্ষত্রিক দূরত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ‘আদর্শ বাতি’র কাজ করে। [সেফিড নক্ষত্র সম্পর্কে আরো বিস্তারিত দেয়া আছে আবুল বাসারের ‘মহাজাগতিক প্রথম আলো’ বইতে।] সেফিড নক্ষত্রের আলো ব্যবহার করে হাবল টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের বয়স নির্ণয় করেছে ১৩৮০ কোটি বছর।
অনেক দূরের গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সেফিড খুব বেশি কার্যকরী নয়। কারণ অত দূর থেকে আসতে আসতে আলো অনেক বেশি ম্লান হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা তাই সেফিডের চেয়েও উজ্জ্বল কোনকিছুর খোঁজ করছিলেন যাকে ‘আদর্শ বাতি’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ১৯৯০এর দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দুটো দল আলাদা আলাদাভাবে গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন সুপারনোভা-টাইপ-1aকে ‘আদর্শ বাতি’ ধরে। টাইপ-1a সুপারনোভায় একটি শ্বেত বামন (মৃত নক্ষত্র – যার সব হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম শেষ হয়ে গেছে, শুধুমাত্র কার্বন আর অক্সিজেন অবশিষ্ট আছে) অন্য একটি নক্ষত্রের সাথে যুথবদ্ধভাবে একে অপরের চারপাশে ঘুরতে থাকে। শ্বেতবামনের ঘনত্ব অন্য নক্ষত্রের চেয়ে বেশি এবং তার মাধ্যাকর্ষণও বেশি। ফলে ঘুরতে ঘুরতে অন্য নক্ষত্রের জ্বালানি এবং গ্যাসীয় পদার্থ শ্বেত বামনের দিকে চলে আসতে থাকে। ফলে শ্বেত বামনের ভর বাড়তে থাকে। চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের ‘চন্দ্রশেখর সীমা’ নীতি অনুযায়ী শ্বেতবামনের ভর বাড়তে বাড়তে যদি আমাদের সূর্যের চেয়ে ১.৪ গুণের বেশি হয়ে যায়, তখন সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে। কোনো গ্যালাক্সির সবগুলি নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা একসাথে যোগ করলে যে পরিমাণ উজ্জ্বলতা পাওয়া যায়, একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণে সেই পরিমাণ উজ্জ্বলতা তৈরি হয়। এই উজ্জ্বলতা কয়েকশ কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে এলেও পৃথিবীর টেলিস্কোপে ধরা পড়ে।
চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ান |
ক্যালিফোর্নিয়া কেন্দ্রিক ‘সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্ট’ এবং আন্তর্জাতিক ‘হাই-জেড সুপারনোভা সার্চ টিম’ দুটো দলই কাজ শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যে ফলাফল পেতে শুরু করলো। পাঁচশ থেকে সাতশ কোটি আলোকবর্ষ দূরের ৪২টি সুপারনোভা এবং অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের আরো ১৮টি সুপারনোভার আলোর বর্ণালীর রেডশিফ্ট বা লোহিত সরণ হিসেব করে বিজ্ঞানীরা খুবই আশ্চর্যজনক ফলাফল পেলেন। বিগ ব্যাং-এর পর মহাবিশ্বের দ্রুত প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু মহাকর্ষ বল তৈরি হবার পর একটা সময়ের পর থেকে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি কমে আসার কথা। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন উল্টো ঘটনা ঘটছে আমাদের মহাবিশ্বে। মহাবিশ্বের বয়স পাঁচশ কোটি বছর পার হবার পরবর্তী দুইশ কোটি বছর ধরে প্রসারণের গতি কিছুটা কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু বয়স সাতশ কোটি বছর পার হবার পর থেকে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। মহাকর্ষ বল বস্তুকে নিজের দিকে টানার বদলে কেন বাইরের দিকে ঠেলতে শুরু করেছে তার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। ১৯৯৮ সালে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হবার পর বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের এই নতুন রহস্যে হতবাক হয়ে গেলেন। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল টার্নার এর জন্য দায়ী করলেন অদৃশ্য শক্তি – ডার্ক এনার্জিকে। ডার্ক এনার্জি – যার সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট ধারণাই নেই কোন বিজ্ঞানীর। তবুও এই নতুন আবিষ্কারের জন্য সুপারনোভা প্রকল্পের দুটো গ্রুপের প্রধান বিজ্ঞানীদের তিন জন – সল পারমুটার, ব্রায়ান স্মিড এবং আদম রেইস পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১১ সালে।
২০১৩ সালে ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্ল্যাংক স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন পরিমাপ করে বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে মহাবিশ্বের মোট ভর এবং শক্তির শতকরা ৬৮.৩ ভাগ ডার্ক এনার্জি, ২৬.৮ ভাগ ডার্ক ম্যাটার এবং মাত্র পাঁচ ভাগ আমাদের দৃশ্যমান বস্তু। অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের শতকরা ৯৫ ভাগ সম্পর্কে আমরা এখনো নির্দিষ্টভাবে কিছুই জানি না – কেবল জানি যে তারা আছে।
তথ্যসূত্র:
১। লেফটেরিস পাপানটোনোপোলোস, দি ইনভিজিবল ইউনিভার্স: ডার্ক ম্যাটার অ্যান্ড ডার্ক এনার্জি, স্প্রিঙ্গার, বার্লিন ২০০৭।
২। আবুল বাসার, মহাজাগতিক প্রথম আলো, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০২২।
৩। জন ম্যাডক্স, হোয়াট রিমেইনস টু বি ডিসকভারড, দ্য ফ্রি প্রেস, নিউইয়র্ক, ১৯৯৮।
৪। পল স্টেইনহার্ডট ও নিল টুরক, এন্ডলেস ইউনিভার্স, ব্রডওয়ে বুক্স, নিউ ইয়র্ক, ২০০৭।
৫। গাইলস স্পারো, ফিফটি আইডিয়াস ইউ রিয়েলি নিড টু নো অ্যাস্ট্রোনমি, কোয়েরকাস, লন্ডন, ২০১৬।