Saturday 23 May 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৭

7

দরজার হুকটা খুলে বাইরে পা দিয়েই চমকে উঠলাম। আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা এক লোক দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির মুখে। এখনো দিনের আলো ফোটেনি, বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তিন তলার সিঁড়ির লাইটটা কবে ফিউজ হয়েছে জানি না। কাল রাতেও এখানে অন্ধকার দেখেছি। কালো চাদরের ফাঁক দিয়ে শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে লোকটার।
"আরে প্রদীপ নাকি?"
মুখ চাদরে ঢাকা থাকলেও গলা চিনতে অসুবিধা হলো না। চারতলার রতনবাবু। যতবার দেখা হয় ততবারই জিজ্ঞেস করেন, "প্রদীপ নাকি?" ইচ্ছে হয় বলি, "না, আমি প্রদীপ নই। আমি হেমা মালিনী।" কিন্তু এভাবে বলা যায় না। আমার বড়বোনের স্বামীর বড়ভাই একদিন আমাকে ডেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, "বোনের বাড়িতে আসার সময় মান-সম্মান, রাগ-অভিমান, মেজাজ-ফাজলামি এসব নিজের বাড়িতে রেখে আসতে হয়।" বড়বোনের স্বামীর বড়ভাই বাসায় না থাকলেও আমি তাঁর উপদেশটা মেনে চলি। তাঁদের প্রতিবেশীদের সাথেও আমি সর্বোচ্চ ভদ্রতা দেখাতে চেষ্টা করি।
বিনীতভাবে ঘাড় কাত করে বললাম, "হ্যাঁ, আমি প্রদীপ।"
"এত ভোরে কই যাও?"
"কলেজে যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?"
"আমি এই তো, একটু হাঁটাহাঁটি করছি।"
সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি। বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক এই ভোরে উঠে বাসার বাইরে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করতে করতে সিগারেট খাচ্ছেন। আমার তাড়া আছে। কিন্তু তিনি সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
"কাল জয়েন করে ফেলেছো?"
"হ্যাঁ। এখন যেতে হবে।"
"এত সকালে যেতে হবে? এখনো তো ছ'টাও বাজেনি। ক্লাস ক'টা থেকে?"
"সোয়া আটটা থেকে।"
"তাহলে এত আগে যেতে হবে কেন? পিটি প্যারেড করতে হবে বুঝি? বিমান বাহিনীর কলেজ তো।"
"মনে হয় করতে হবে। যাই এখন।" - বলে নিজেকে যথাসম্ভব সংকুচিত করে রতনবাবুর পাশ ঘেঁষে নেমে গেলাম। নামতে নামতে শুনতে পেলাম তিনি বললেন, "পিটি করতে না হলে তো আমার গাড়িতে আগ্রাবাদ পর্যন্ত যেতে পারতে।"
আবার গাড়ি! এক প্রকার দৌড়েই রাস্তায় চলে এলাম। এখনো অন্ধকার কাটেনি। লাইটপোস্টের ঝাপসা আলোয় বিন্দু বিন্দু কুয়াশার বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে। ঘড়ি দেখলাম - ছয়টা পাঁচ। শুলকবহর থেকে গুলজার সিনেমায় যেতে খুব আস্তে আস্তে হাঁটলেও বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
ভোরে উঠার অভ্যাস নেই বলেই আজ হঠাৎ একটু বেশি ভোরে উঠে পড়েছি। ঋতুচক্রে শীত আসতে এখনো মাসখানেক দেরি আছে। অথচ ইতোমধ্যেই শীতের আভাস দেখা দিয়েছে। পুকুরপাড়ের মোড়ে গ্যারেজের কাছে এসে হাঁটার গতি একটু কমালাম। মনে পড়লো গতকাল সকালে এই জায়গায় দেখা হয়েছিল রতনবাবুর সাথে। কলেজে ক্লাস শুরু হবার আগেই জয়েন করে ফেলবো এরকম পরিকল্পনা ছিল। আমার ধারণা ছিল কলেজে ক্লাস শুরু হয় দশটায়। ফতেয়াবাদের মেস থেকে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে - তাই আগেরদিন এসে দিদির বাসায় উঠেছিলাম। আটটার দিকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে চকবাজার যাচ্ছিলাম ৩নং বাসে ওঠার জন্য। পুকুরপাড়ের মোড়টা ঘুরতেই পেছনে গাড়ির হর্ন শুনে যতটুকু সম্ভব রাস্তার কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আবার হর্নের শব্দ। হর্ন না দিয়ে মনে হয় গাড়ি চালানো যায় না। লাল রঙের গাড়িটা প্রায় আমাকে চাপা দেয়ার মত দূরত্বে এসে দাঁড়ালো। ড্রাইভারের সিটে বসে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রতনবাবু বললেন, "আরে প্রদীপ নাকি?"
"হ্যাঁ"
"কোথায় যাচ্ছ?"
"এয়ারপোর্ট"
"হেঁটে হেঁটে?"
"না, চকবাজার গিয়ে বাসে উঠবো।"
"গাড়িতে উঠে এসো।"
"না দাদা, ঠিক আছে, আমি আমার মত যেতে পারবো।"
"গাড়িতে উঠ বললাম।"
পদচারী যদি গাড়িওয়ালার আহ্বানে সাড়া না দেয়, গাড়িওয়ালার আঁতে ঘা লাগে। গাড়িওয়ালা তখন গালিওয়ালা হয়ে গালাগাল দিতে শুরু করেন। আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুললাম। সামনের সিটের উপর অনেকগুলো ফাইল।
"ফাইলগুলো কোলে নিয়ে বস।"
বসলাম। রতনবাবুর চকচকে ঝকঝকে বিদেশী ফাইলের সাথে আন্দরকিল্লা থেকে কেনা লাল দড়ি বাঁধা আমার ফাইলটাকে বড়ই বেমানান লাগছিল।
"এয়ারপোর্টে কেন যাচ্ছ?" - গাড়ি চালাতে শুরু করেছেন রতনবাবু। ডানহাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে।
"শাহীন কলেজে চাকরি পেয়েছি। জয়েন করতে যাচ্ছি।"
"শাহীন কলেজ ঢাকায় না? তুমি এখন প্লেনে করে ঢাকা যাচ্ছো জয়েন করার জন্য?"
"না, এখানেও একটি শাহীন কলেজ আছে। এয়ারফোর্সের ঘাঁটির ভেতর। এয়ারপোর্টের কাছে।"
"ও তাই নাকি? ঠিক আছে। আমি তোমাকে আগ্রাবাদে নামিয়ে দেবো। তুমি সেখান থেকে যে কোন বাসে উঠে চলে যেতে পারবে।"
"না দাদা, আপনি আমাকে চকবাজারে নামিয়ে দেন। সেখান থেকে আমি বাসে উঠে চলে যাবো।"
"আমি চকবাজার দিয়ে যাবো না।" বলতে বলতেই দেখলাম গাড়ি পাঁচলাইশের মোড়ের সোনালী ব্যাংক ডানে রেখে প্রবর্তকের দিকে চলে যাচ্ছে। মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। পড়েছি রতনবাবুর হাতে - যেতে হবে তার সাথে।
"তোমার স্কেল কত?"
"স্কেল?"
"বেতন স্কেল?"
"২৮৫০"
"চলবে কীভাবে? আমাদের কোম্পানিও তো স্টার্টিং টেন থাউজ্যান্ড দেয়। কী করবে - সবাই তো আর সেরকম চাকরি পায় না। প্রাইভেট পড়ানো যদি একবার জমাতে পারো - ফিজিক্সে তো - ব্যাচের পর ব্যাচ - এক ব্যাচে দশ জন করে যদি দিনে তিন ব্যাচও পড়াও... শোন তুমি কী করবে জানো...
এই ভদ্রলোককে আমি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ উপদেশ দেয়ার ব্যাপারে তিনি একেবারে দাতাকর্ণ। আমার দিদির পুত্র- আর তাঁর পুত্র উভয়েই ষষ্ঠ বর্ষীয় - এবং দুষ্টুমীতে চিরপ্রতিযোগী। দিদির বাসায় গেলে মাঝে মাঝে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। দেখা হলেই তিনি উপদেশের হাঁড়ি উপোড় করে দেন আমার ওপর। আমার সহ্যশক্তি কম, তাই এড়িয়ে চলি। কিন্তু আজ ফেঁসে গেছি তার গাড়িতে উঠে। টাইগার পাসে ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার মাঝখানে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়াচ্ছে দেখেই বললাম, "আমাকে এখানে নামিয়ে দেন দাদা। আগ্রাবাদ থেকে বাসে সিট পাবো না।"
"আরে এখানে তো ভীড় আরো বেশি হবে।"
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই টাইগারপাসের রাস্তার সব গাড়ি থেমে গিয়েছিল আর আমি দরজা খুলে টুপ করে নেমে গিয়েছিলাম।
টাইগারপাসের মোড়ে সকাল সাড়ে আটটায় প্রচন্ড ভীড়বাসে উঠার জন্য বিশেষ দক্ষতার দরকার হয়। সেই দক্ষতায় বাসে উঠেছিলাম ঠিকই, কিন্তু শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গিয়েছিল। আজ থেকে আর শহর এলাকার বাসে চড়তে হবে না। আজ থেকে উঠবো বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বাসে।
ভাবতে ভাবতে কাতালগঞ্জ বৌদ্ধমন্দিরের সামনে দিয়ে অলি খাঁ মসজিদের সামনে চলে এসেছি। পাঁচটি রাস্তা এসে মিশেছে এখানে। সন্ধ্যায় প্রচন্ড ভীড় থাকে, এখন রাস্তা খালি। গুলজার সিনেমার সামনে অনেকগুলো নতুন দোকান হয়েছে এখন। গতকাল এখানেই নেমেছিলাম বাস থেকে। ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এখানেই আসতে বলেছেন। কিন্তু আর কাউকে এখনো দেখছি না। সাড়ে ছ'টা বাজে। ছ'টা চল্লিশ মিনিটে বাস আসার কথা। ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়েছি তো?
পরবর্তী দশ মিনিটের মধ্যে ছোলায়মান স্যার, ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম, টুনি এবং লাইলুন্নাহার ম্যাডাম চলে এসেছেন, কিন্তু বাস এলো না। ছোলায়মান স্যারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি ম্যাডামদের নাম। আর টুনি যে আকতারুন্নেছা ম্যাডামের মেয়ে তা কালকেই বুঝতে পেরেছিলাম। লাইলুন্নাহার ম্যাডাম বাসকে 'বাঁশ' বলেন, শুনতে বেশ মজাই লাগে।
ছয়টা চল্লিশের বদলে বাস এলো আরো মিনিট পনেরো পরে। শিক্ষকদের জন্য কিছু সিট খালি রাখা হয়। কোথায় বসবো তা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। মিনিট খানেক পরেই বাস পাঁচলাইশের দিকে বৌদ্ধমন্দিরের সামনে দিয়ে এসে থামলো রাস্তার উপর। এখানে বিমান বাহিনীর একটি অফিস আছে। ড্রাইভার বাস থেকে দ্রুত নেমে রাস্তা থেকে একটু ভেতরে সেই অফিসের দিকে ছুটে গেলেন, আবার একটু পরে ফিরেও এলেন। তাঁর একটু পরেই বিমান বাহিনীর একজন অফিসার এসে উঠলেন বাসে। সামনের দিকের কয়েক সারি উঠে দাঁড়িয়ে অফিসারকে স্যালুট করলেন। অফিসার একেবারে সামনের আসনে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমি বাস কোথায় কোথায় থামে জেনে নিচ্ছি। বলা যায় না কখন কোন্‌ স্টেশন থেকে উঠতে হয়। এরপর থামলো ষোলশহর ট্রেন স্টেশনের সামনের রাস্তায়। সুপাল স্যার জানালেন ঘাঁটিতে অনেক সিভিলিয়ান ওয়ার্কার কাজ করেন। তাঁদের অনেকে পটিয়া থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেন। কত ভোরে যে তাঁদের উঠতে হয়। পটিয়া স্কুলে পড়ার সময় আমিও কয়েকবার ট্রেনে করে শহরে এসেছিলাম। ষোলশহর স্টেশন থেকে দৌড়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে বাসে এসে উঠলেন কয়েকজন মানুষ। উঠে মাথা নিচু করে সোজা পেছনের দিকের সিটে গিয়ে বসলেন। মানুষের এনাটমি ফিজিওলজি এক হতে পারে, কিন্তু মানুষে মানুষে বৈষম্য আছেই। জাতপ্রথা পৃথিবী থেকে কোনদিন ঘুচবে বলে মনে হয় না। আধুনিকতার সাথে তার রূপ বদলেছে মাত্র। সেনাবাহিনীর ভেতর যে র‍্যাংকিং ব্যবস্থা আছে তা জাতপ্রথার চেয়েও মারাত্মক। যে মানুষগুলোকে প্রতিদিন বাসে উঠে পেছনে গিয়ে বসতে হয়, সামনে সিট খালি থাকলেও তাঁরা সেখানে বসতে পারবেন না।

লালখান বাজারের পর বাস থামলো দেওয়ানহাটে। এখান থেকে বিমানবাহিনীর অনেকের সাথে উঠলেন আরেকজন ম্যাডাম - মেহেরুন্নেসা ম্যাডাম। সুপাল স্যারের কাছ থেকে আমি জেনে নিচ্ছিলাম ম্যাডামদের নাম। আগ্রাবাদ থেকেও অনেক বিমানসেনা উঠলেন। সাথে উঠলেন অঞ্জন স্যার। অঞ্জন স্যারের হাতে একটা কালো চকচকে ব্রিফকেস। ব্রিফকেসের সাথে পলিথিন ব্যাগের ভেতর সম্ভবত টিফিন ক্যারিয়ার। বন্দর ভবনের সামনে থেকে উঠলেন আরো কয়েকজন। আরো দু'জন ম্যাডাম উঠলেন সেখান থেকে। বাংলার নাসরিন বানু ম্যাডাম এবং বায়োলজির শাহনাজ ম্যাডাম।

নৌবাহিনীর ঘাঁটি পার হয়ে কর্ণফুলির তীর দিয়ে আসার সময় সকালের সোনালী রোদে নদীটিকে কত আপন বলে মনে হলো। একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরলো চারদিক থেকে। এভাবে আমার প্রথম সকাল বলেই হয়তো এত ভালো লাগা। মানুষের স্মৃতি কখন কীভাবে যে ফিরে আসে! সেই কোন্‌ ছোটবেলায় প্রথমবার এই শহরে এসেছিলাম বাবার সাথে লঞ্চে করে - এই নদীপথেই।

ঘাঁটিতে ঢোকার পর বাস কলেজের গেটে আসার আগেই কয়েক জায়গায় থামলো এবং শিক্ষকরা ছাড়া বাকি সবাই নেমে গেলেন যে যার স্টেশনে। তাহলে এই রুটটা হবে আমার প্রতিদিনের কলেজে আসার রুট। টিচার্স রুমে ঢুকে টেবিলে ব্যাগ, ব্রিফকেস রেখেই সবাই চললেন ভাইস-প্রিন্সিপালের রুমে। সাইন করতে হবে। কলেজে উপস্থিতির প্রমাণ। আমরা যখন সে রুমে গেলাম - ম্যাডামরা তখন সাইন করে একে একে বের হচ্ছেন রুম থেকে। স্যারদের সবার পরে আমি সাইন করে বের হচ্ছি - এমন সময় একজন ম্যাডাম আমাকে ডাকলেন, "প্রদীপ?"
এই ম্যাডামকে আমি আগে দেখিনি। আমাদের সাথে বাসেও আসেননি।
"জ্বি ম্যাডাম।"
অঞ্জন স্যার কাছেই ছিলেন। তিনি বললেন, "আয়শা আপা, এখন আপনি একটু রিলিফ পাবেন। প্রদীপকে সব ক্লাস দিয়ে দেন।"
ইনিই ফিজিক্সের আয়শা ম্যাডাম।
"তোমাকে কিন্তু ভাই আমি তুমি করেই বলবো। তুমি আমার অনেক পরে পাশ করেছো।" - হাসিমুখে বললেন আয়শা ম্যাডাম। তাঁর কথায় বড়বোনের স্নেহের পরশ।
"জ্বি ম্যাডাম। গতকাল আপনার সাথে কথা বলার কথা ছিল আমার। কিন্তু বলা হয়নি।"
"তোমাকে ফার্স্ট ইয়ারের সব ক্লাস নিতে হবে এ বছরের আর যে ক'দিন আছে। জানুয়ারিতে নতুন রুটিন হবে। আমি একটু পরে তোমাকে বলবো তাদের এপর্যন্ত কী কী পড়ানো হয়েছে।"
আমি রুমে এসে আমার চেয়ারে বসলাম। ছোট্ট একটা ড্রয়ারও আছে টেবিলের সাথে। অঞ্জন স্যার খোপযুক্ত স্টিলের আলমারিটার একটা খোপ আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিলেন।
একটু পরেই দেখলাম বারান্দা দিয়ে বেশ দ্রুত হেঁটে আসছেন প্রিন্সিপাল আবদুল মজিদ। স্যুট টাই আর কালো চশমায় তাঁকে অনেকটা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের মতোই লাগলো। দেখলাম অঞ্জন স্যার তাঁকে দেখে রুমের ভেতর দাঁড়িয়ে গেলেন। অঞ্জন স্যারকে অনুসরণ করে আমিও। প্রিন্সিপাল কারো দিকে না তাকিয়ে চলে গেলেন তাঁর রুমে। প্রিন্সিপালের পেছন পেছন ছোট্ট একটা ব্রিফকেস হাতে নিয়ে পিয়ন আবুল হোসেন। আমার হঠাৎ মনে হলো প্রিন্সিপাল হলে নিজের এই ছোট্ট ব্রিফকেসটিও নিজের হাতে বহন করা যায় না।
আরো অনেক স্যার ম্যাডাম এক সাথে এলেন। ঘাঁটির মধ্যেই শিক্ষকদের জন্য কিছু কোয়ার্টার আছে। এই শিক্ষকরা সেই কোয়ার্টারে থাকেন। আটটার মধ্যেই সবাই এসে গেলেন। একটা খাতা হাতে একজন পিয়ন এসে বললেন, "স্যার ডিউটি রোস্টার"।
স্কুল সেকশানের তৃতীয় মেয়াদী পরীক্ষা চলছে। সেই পরীক্ষার ডিউটি - কার কোন্‌ রুমে, ক'টা থেকে ক'টা ইত্যাদি। আমার কোন ডিউটি আছে কি না জানি না। আমার পরপর তিনটা ক্লাস আছে ফার্স্ট ইয়ারের সাথে। গতকাল রুটিন লিখে দিয়েছিলেন ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম।
"স্যার, আমার নাম ইদ্রিস। আমি স্যার ফিজিক্সের পিয়ন।" ডিউটির খাতাটা আমার সামনে রেখে বললেন পিয়নটি। এখানে কি প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের আলাদা আলাদা পিয়ন আছে? হয়তো আছে। আমি আমার ডিউটি আছে কি না দেখতে দেখতে ভাবি।
ডিউটি খাতায় শিক্ষকদের নাম লেখা আছে সংক্ষেপে - অকা, আকা, মআ, সুদ, মোছো, বিচ, আসো ইত্যাদি।
"প্রদীপবাবু, আপনি কি বুঝতে পারছেন কার কী নাম?" - ছোলায়মান স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
"বুঝার চেষ্টা করছি। আসো - আবদুস সোবহান, মআ - মহিউদ্দিন আহমদ, সুদ - সুপাল দত্ত।"
"আমাদের অকা, আকা, আকানি - অঞ্জন কান্তি, আবুল কাশেম, আবদুল কাইয়ুম নিজামী। হিহিহি" - ছোলায়মান স্যারের হাসিটা বেশ মজার।
"ফিজিক্সের ল্যাবরেটরির সব কাজ স্যার আমি করি।" -ইদ্রিস বললেন।
ইদ্রিস বয়সে আমার সমান বা বছর খানেক বড়ো হবে। পাতলা হাড্ডিসার শরীর, চোখেমুখে কিছুটা সারল্য আছে।
"ল্যাবরেটরিটা কোন্‌ দিকে?"
"ওটা স্যার এখন হ্যাংগারের দোতলায়। কিন্তু এখানের দোতলায় চলে আসবে।"
"এখানে দোতলা কোথায়?"
"ওদিকে আছে স্যার।"
ওদিকে বলতে ঠিক কোন্‌দিক বুঝতে পারলাম না। পরে বুঝে নেবো। আমাকে পরীক্ষার ডিউটি দেয়া হয়নি আজ।
"প্রদীপ, শোন" - আয়শা ম্যাডাম রুমে ঢুকলেন। আমি সৌজন্যবশত উঠে দাঁড়ালাম। তাঁর হাতে বিশাল সাইজের উচ্চমাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান বই। ইসহাক নুরুন্নবীর এই বইটা আমাদের উচ্চমাধ্যমিকে পড়েছিলাম। তারপর আরো কত সংস্করণ বেরিয়েছে আমি জানি না।
"শোন, তোমাকে দেখাই ফার্স্ট ইয়ারে আমি কী কী পড়িয়েছি। তাদের ভেক্টর অ্যানালাইসিস শুরু করেছিলাম। তুমি ভেক্টর থেকে আবার শুরু করতে পারো।"
"ঠিক আছে ম্যাডাম।"
"তোমার তো মনে হয় বই নাই। এই বইটা রাখো। প্রকাশকরা এলে তোমার জন্য এক কপি বই দিতে বলবো।"
আয়শা ম্যাডাম চলে গেলেন। আমি বইটার কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখলাম। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর কিছুই নেই। আমি উচ্চমাধ্যমিক পড়েছিলাম বাংলা মিডিয়ামে। কিন্তু অনার্স মাস্টার্সের সবকিছুই পড়েছি ইংরেজিতে। ফিজিক্সের অনেক টার্ম বাংলায় অনুবাদ করলে মূল ব্যাপারটা বোঝা যায় না। ক্লাসে গিয়ে কী পড়াবো কে জানে। প্রথম ক্লাসে গিয়েই যদি নার্ভাস হয়ে যাই! চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় কত বাঘা বাঘা স্যার-ম্যাডামদের ক্লাসে কাকের ডাক, মুরগির ডাক ডাকতো আমার সহপাঠীরা। যারা ভালো ছাত্র তারা আরো বেশি ডিস্টার্ব করতো ক্লাসে। সবাই তখন কারো না কারো কাছে প্রাইভেট পড়তো আর ক্লাসে এসে গন্ডগোল করতো। এখানেও যদি সেরকম হয়? দেখা যাক কী হয়।
টিচারদের প্রায় সবাই পরীক্ষার ডিউটিতে চলে গেলেন। সুপাল স্যার, ফারুকী স্যার আর আমি এক সাথে বের হলাম। একাদশ বি সেকশানের সাথে আমার প্রথম ক্লাস।
"অ্যাটেন শান্‌" - ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথেই তীক্ষ্ণ গলায় কেউ একজন বলে উঠলো। যতদূর জানি অ্যাটেনশান তো একশব্দ। শব্দটিকে দুভাগে ভাগ করে 'অ্যাটেন'কে ধনুর মত টেনে ধরে 'শান'-কে যেভাবে সাঁৎ করে তীরের মত ছেড়ে দিল - তাতে মনে হলো স্বাভাবিক একটি শব্দ হঠাৎ সামরিক মর্যাদা পেয়ে গেলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সামরিক শব্দটি সমর বা যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। সেখানে অন্ধ আনুগত্যের একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানে আনুগত্য থাকতে নেই, অন্ধত্বের তো প্রশ্নই ওঠে না।
দেখলাম ক্লাসভর্তি শিক্ষার্থী - সবাই কেমন যেন শক্ত জমাট পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। প্রত্যেকেরই দুই হাত সামনের বেঞ্চের উপর টান টান হয়ে সমান্তরাল রেখা তৈরি করেছে। দেয়ালে লাগানো ব্ল্যাকবোর্ড পরিষ্কার। ব্ল্যাক বোর্ডের বাম দিকে উপরের কোণায় সুন্দর করে লেখা আছে উপস্থিত ও অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, বিষয়: পদার্থ বিজ্ঞান, শিক্ষক: প্রকু। তাহলে আমার সংক্ষিপ্ত নাম প্রকু। কিন্তু এরা সবাই এতক্ষণ ধরে এরকম পাথর হয়ে আছে কেন?
তাদের দিকে তাকিয়ে আমার হাসি পেয়ে গেল। হাসি সংক্রমক। শিক্ষার্থীদের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো - কিন্তু পুতুলভাব গেল না। জিজ্ঞেস করলাম, "তোমরা এভাবে বসে আছো কেন সবাই?"
"স্যার, আপনি ইজি হতে বলেননি তো।" - ফার্স্ট বেঞ্চের যে মেয়েটা কথা বললো দেখলাম তার দিকে। ওড়নায় লাগানো নেমট্যাগে লেখা আছে - গুলশান।
"আমি কি তোমাদের আনইজি হতে বলেছিলাম? ইজি হও ইজি হও।"
পুরো ক্লাস যেন জেগে উঠলো এতক্ষণে। আমি বললাম, "দেখো আমি তো নতুন এসেছি। তোমাদের ক্লাসের নিয়মকানুন জানি না। তোমরা সব ক্লাসেই কি এরকম কর?"
"জ্বি স্যার। টিচার এলে আমরা অ্যাটেনশান হয়ে যাই।" - যে ছেলেটা উত্তর দিলো তার নাম ইয়াসির। নেমট্যাগ জিনিসটা খুবই কাজের। আমার মায়োপিয়া না থাকলে সবার নামই পড়তে পারতাম। কিন্তু এখন ফার্স্ট দুই বেঞ্চের পর বাকিদের নাম  ডায়াস থেকে পড়তে পারছি না।
"টিচারকে কী করতে হয়?" - ইয়াসিরকে জিজ্ঞেস করলাম।
"স্যার, সিট ইজি বলতে হয়।"
আমি তাদের "অ্যাটেন শান" বলার ভঙ্গিতে বললাম, "স্যার, সিট ইজি।"
সবাই হেসে উঠলো।

2 comments:

  1. আপনি কি মায়োপিয়া রোগের চিকিৎসা করিয়েছেন? একটা জায়গায় পড়েছি, সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে লেজি আই হবার সম্ভাবনা দেখা যায়। একবার লেজি আই হলে পরে চশমা দিয়েও দৃষ্টিতে উন্নত করা যায় না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি চশমা পরি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

      Delete

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts