Showing posts with label বুদ্ধদেব গুহ. Show all posts
Showing posts with label বুদ্ধদেব গুহ. Show all posts

Sunday, 6 June 2021

বুদ্ধদেব গুহর প্রথম প্রবাস

 




বুদ্ধদেব গুহ প্রথমবার ইওরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন উনিশ শ সত্তরের দশকে। লন্ডনে তাঁর আত্মীয়-ভাই টবীর বাসায় কিছুদিন আতিথ্য গ্রহণ করে একটা কনডাক্টেড ট্যুরে চলে গিয়েছিলেন জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং আরো অনেক দেশে। ট্যুর কোম্পানির বাসে বারোদিন ধরে ঘুরেছেন তিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে চলার পথে। এরই সরস বর্ণনা তাঁর প্রথম প্রবাস বইতে। ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন ভারতের জরুরি অবস্থার সময় তাঁর লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায়। সেই সময় তিনি দেশের সমালোচনা করেছেন এই অজুহাতে তাঁর লেখার অনেক অংশ সেন্সরড হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। পুলিসের নজরদারিতেও থাকতে হয়েছিল। তাঁর বাড়িতে তল্লাশিও চালানো হয়েছিল। সেই যাই হোক। 

আমাদের দেশের মানুষ – বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ উন্নত দেশে ভ্রমণ করার সময় নিজের অজান্তেই তুলনা  করতে শুরু করে নিজের দেশের সাথে। কোন ব্যবস্থায় যখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই – অনেক সময় আমাদের সুযোগও থাকে না এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা কী হতে পারে তা জানার। কিন্তু সেই সুযোগটা আসে উন্নত দেশে ভ্রমণ করতে গেলে। তবুও আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে – দেশপ্রেমের নামে দেশের দোষগুলি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। কোন কারণ ছাড়াই আমরা যদি আমাদের দেশকে পৃথিবীর সেরা দেশ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকি – সেটাকেই দেশপ্রেমের প্রমাণ বলে মনে করা হয়। আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত যারা – তারা তো গলা ফুলিয়ে বলবেনই যে আমাদের দেশের মতো এমন ভালো দেশ আর কোথাও নেই – যেখানে এরকম খোলামেলাভাবে দুর্নীতি করা যায়। কিন্তু যারা এর শিকার, ভুক্তভোগী – তারা কী কারণে নিজের দেশকে পৃথিবীর সেরা দেশ বলে মনে করবে – যদি নিজের দেশে হাজারো অনিয়ম থাকে? লেখক এই প্রশ্নগুলি বিভিন্ন জায়গায় তুলেছেন।

অনেক পুরনো দিনের ভ্রমণকাহিনি পড়লে সেই ভ্রমণকাহিনি অনেকটা ইতিহাসের কাজও করে। যেই সময়ে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন ১৯৭৪-৭৫ সালে – মাত্র ৮ ডলার সাথে নিয়ে যেতে দেয়া হতো। তার স্থানীয় মুদ্রায় দাম ছিল ৫৬ টাকা। অর্থাৎ তখন এক ডলারের দাম ছিল ৭ টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়েছে প্রায় দশ গুণ।

ডিসি টেন প্লেন ছিল তখন আধুনিকতম প্লেন। তখন প্লেনে পাইপ টানা যেতো। ধুমপান পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে আরো অনেক বছর পর। তখনো প্লেনে সিনেমা দেখানো হতো। তবে তা দেখানো হতো ছোট্ট প্রজেক্টরে।

বিদেশী প্লেনের ঝলমলে চঞ্চলা এয়ার-হোস্টেসদের দেখে বুদ্ধদেব আক্ষেপ করেছেন এয়ার-ইন্ডিয়ার এয়ার-হোস্টেসদের ব্যাপারে। “এত টাকা মাইনে দিয়ে, এমন সুন্দর সাজপোশাক পরিয়ে এমন রাম-গরুডের ছানাদের কেন ইন্ডিয়ান এয়ার-লাইনসে রাখা হয় তা সাধারণ বুদ্ধির বাইরে।“

লন্ডনে পৌঁছে লেখক তার ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন। তারা ব্যস্ত দম্পতি। তবুও যথাসম্ভব সাথে করে নিয়ে গিয়ে পথঘাট দেখিয়ে দিয়েছেন। পরে লেখক নিজে নিজেই ঘুরেছেন লন্ডনে। তাঁর ভাই শুরুতে জার্মানিতে গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক বছর অনেক ধরনের কষ্ট করে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রবাসীদের কষ্ট বুঝতে চেষ্টা করেছেন লেখক। আবার প্রবাসী বাঙালীদের সমালোচনাও আছে – “পাঁচজন বাঙালি এই দূরদেশে এসেও মিলে মিশে থাকতে পারে না। পরনিন্দা, পরচর্চা, দলাদলি, ঈর্ষা, এইই সব।“ – পৃথিবীর সব দেশেই প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে। কিন্তু শুধুমাত্র কি বাঙালিদের মধ্যে? আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে – অন্যান্য জাতির মধ্যেও এই ব্যাপারগুলি কমবেশি আছে।

ইংরেজরা আমাদের উপমহাদেশ শাসন করেছিল। তাদেরকে ভারত থেকে তাড়ানোর পরেও কিন্তু আমাদের ইংরেজ-প্রীতি যায়নি। লেখক সেই প্রসঙ্গে বলছেন – “প্রভুত্ব করাতে তাদের যতটুকু বাহাদুরি ছিল, দাসত্ব সীকারে আমাদের বাহাদুরি তার দেয়ে প্রবলতর ছিল।

আমাদের দেশের হ্যাভ আর হ্যাভ-নটদের শ্রেণিবিভাজনের ব্যাপারে লেখক বলছেন – “আমাদের দেশে রাজার ছেলে প্রায়শই রাজা হয়, মন্ত্রীর ছেলে মন্ত্রী হয়,  মসৃণভাবে না হলে এই ঘটনা অমসৃণভাবে ঘটানো হয়। এবং চাষার ছেলে হয় চাষা।“ – লেখকের ক্ষোভটা এখানে বোঝা যায়। কিন্তু তিনি যেখানে গিয়ে এই উপলব্ধিটা প্রবলভাবে বুঝতে পারছেন – সেখানেই কিন্তু রাজা-বাদশাদের সমারোহ। ইওরোপে এখনো যত রাজা আছে আর কোন মহাদেশে এত রাজা নেই। সেখানে কিন্তু রাজার ছেলেরাই রাজা হয়।

কসমস কোম্পানির বাসে করে ইউরোপ ট্যুরে বের হয়ে লেখক মিশেছেন বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন ইজরায়েলি তরুণী সারা, আর অস্ট্রেলিয়ান তরুণী ক্যারল ও জেনির প্রতি। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন ক্যারল ও জেনিকে। তবে সারার সাথে তিনি একটি রাত একই ঘরে কাটিয়েছেন, শরীর বিনিময়ও করেছেন। তিনি হয়তো ঠিকই উপলব্ধি করেছেন – “ওদের দেশে কোনো মেয়েকে চুমু খেলেই সঙ্গে সঙ্গে তার সতীত্ব নষ্ট হয়ে যায় না এবং চুমু খেলেই ভালোবাসাও হয়ে যায় না।“

আবার এটাও উপলব্ধি করেছেন – পৃথিবীর সব মানুষই কিছু কিছু ব্যাপারে একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায় – যেমন, “তার পা মাড়িয়ে দিলে, তার স্বার্থে, আরামে বা মানিব্যাগে হাত পড়লে পৃথিবীর সব মানুষই সমান।“

শিল্পের শহর প্যারিসে গিয়ে লেখক আর্ট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলেছেন তা সঠিকভাবে নিয়ে এসেছেন – প্রয়োজনের অতিরিক্তটাই আর্ট। অর্থাৎ পেটের ক্ষুধা মিটানো প্রয়োজন। কিন্তু মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য যা করি – সেটা আর্ট।

প্যারিসে স্টেজ শো দেখতে গিয়ে দেখেছেন স্টেজে একেবারে নিরাবসনাদের প্রাচুর্য। তার প্রেক্ষিতে তিনি মন্তব্য করেছেন – “পৃথিবীতে মেয়েদের সমুদয় সাজপোশাকের আড়ম্বর শুধু খুলে ফেলার জন্যই।“ আমি জানি না লেখক পরিণত বয়সেও তা মনে করেন কি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এখানে লেখক যথেষ্ট উদার হতে পারেননি।

ভ্রমণকাহিনি পড়তে ভালো লাগে আমার। তাতে অন্য আরেকজন ভ্রমণকারির মনের ভেতরটাও দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। আর সেই ভ্রমণকারি যদি বুদ্ধদেব গুহর মতো লেখক হন – তাহলে তো কথাই নেই। লেখকরা ভ্রমণ কাহিনিতেও অনেক কাহিনি তৈরি করেন সেটা করেন আর্টের কারণে। সেই আর্টটুকু তো সহ্য করতেই হয়।


Sunday, 9 May 2021

বুদ্ধদেব গুহর হাজারিবাগের কথা

 


বুদ্ধদেব গুহ শক্তিমান লেখক। লেখায় তিনি শক্তিমান তো বটেই – আমার ধারণা তিনি আক্ষরিক অর্থেও ভীষণ শক্তিমান। যে হাতে তিনি কলম চালান, সেই হাতে তিনি বন্দুকও চালান। আবার সেই হাতে বাদ্যযন্ত্রও বাজান। তাঁর লেখা বেশ কিছু বই আগে পড়েছি। এখন পড়ছি তাঁর ভ্রমণ সমগ্র। প্রথম গল্প – হাজারিবাগের কথা। ভ্রমণ এবং শিকারের মিশ্রকাহিনি।

            হাজারিবাগে তিনি ভ্রমণ করেছেন অসংখ্যবার – পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বই এর দশক অবধি। প্রথমবার ১৯৫৭-তে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পেশার কারণে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য বন্ধু, পরিচিত, পেশাগত আত্মীয়স্বজন। বাঘ শিকার করেছেন তিনি গভীর রাতে জঙ্গলে গিয়ে। জঙ্গলের বর্ণনা, রুক্ষ ধুলিওঠা পথের বর্ণনা জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর লেখায়। আর আছে খাবারের বর্ণনা। তিনি নিজেই বলেছেন পেটুক এবং খাদ্যরসিক বলেই তাঁর বিভিন্ন জায়গার খাদ্যের স্বাদও পুরোপুরি মনে আছে।

            তাঁর সেন্স অব হিউমার – বাংলায় যাকে রসবোধ বলা যায় – অত্যন্ত উঁচুমানের। নেকড়ে শিকারের জন্য তিনি হাজারিবাগে গিয়েছিলেন। তাঁর শিকারের বন্ধু নাজিম সাহেব তখন একটি গাড়ি কিনেছেন। ৪২ মডেলের গাড়ি। “৩২ মডেলের ড্রাইভারের পরনে একটি ৩২ মডেলের পায়জামা ছিল। সেইটি এই দীর্ঘদিনের ব্যবহারে আন্ডারওয়ারে পরিণত হয়েছিল।“ সেই গাড়ির বর্ণনা দিচ্ছেন তিনি এভাবে – “আমরা দেখলাম, শীতে রাতের অন্ধকারে একটি অদ্ভুত দর্শন, প্রাগৈতিহাসিক জন্তু দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে দিয়ে ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌-ধক্‌ করে আওয়াজ আসছে আর পেছনের সাইলেন্সার পাইপের মধ্যে দিয়ে দুর্বাসা মুনির চোখের আগুনের মতো আগুনের হলকা বেরোচ্ছে।“

            “গাড়ি গিয়ারে দিতেই মনে হল গাড়িতে ভূমিকম্প উপস্থিত হল, আর গাড়ি পথে উঠতেই বিনা পয়সায় বেঠোফেনিক অর্কেস্ট্রা শুনতে পেলাম। গাড়ি সামান্য গতি পেতেই দেখলাম সামনের হেড লাইট দুটি ডিক ডিক শব্দ করে একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে যেতে লাগল।“

            “পিছনের সিটে বসার সঙ্গে সঙ্গে আমার পেছনে কে যেন কামড়ে ধরল এবং ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সাধের ব্যারেথিয়ার ট্রাউজারের এক  গিরে কাপড় পেছনের সিটেই আটকে রইল এবং পেছন দিয়ে হু হু করে হাজারিবাগি ডিসেম্বরের হাওয়া ঢুকতে লাগল।“

            সেই গাড়িতে নেংটি ইঁদুর ছোটাছুটি করছিল। এক পর্যায়ে গাড়িটি রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে যায় নদীর বালিময় বুকের উপর। গাড়ি ছত্রখান হয়ে সবাই ছিটকে পড়ে। পরে দুর্ঘটনার কারণ জানা গেল – “একটা নেংটি ইঁদুর ড্রাইভারের আধছেঁড়া আন্ডারওয়ারের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।“

            বুদ্ধদেব গুহ মুক্তচিন্তার মানুষ। পথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের মন্দির দেখেছেন। কিন্তু তাঁর দেবতা মন্দিরে থাকেন না। তিনি লিখছেন, “আমার ঈশ্বর কোনদিনই কোনো মন্দিরের মধ্যে অবস্থান করেননি। আমার ঈশ্বর ছিলেন পথে। সে জন্য তীর্থস্থানের পথই আমাকে চিরদিন আকৃষ্ট করেছে।“

            হাজারিবাগ পালামৌ – এসব জায়গার প্রকৃতি দেখতে যেতে হবে যদি কোনদিন সুযোগ হয়। এই পালামৌ-তে সত্যজিৎ রায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র শুটিং করেছিলেন। এর পরোক্ষভাবে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ।

            ভালো লাগলো তাঁর ভ্রমণ-শিকার কাহিনি। 

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts