ব্যক্তি আবদুস সালাম
আবদুস
সালামের আই-সি-টি-পি’র অফিসের
দেয়ালে একটি ষোড়শ শতাব্দীর পারসিক প্রার্থনার লিপি ঝোলানো আছে: “তিনি চিৎকার করে বললেন, ঈশ্বর, একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা সংঘটিত করুন।” আবদুস সালামের শক্তি এই যে তিনি বিশ্বাস করতেন
আশ্চর্যজনক ঘটনা সম্ভব যদি আমরা এগিয়ে গিয়ে ঘটতে সাহায্য করি। তিনি তা বিশ্বাস
করতেন বলেই সারাজীবন বিজ্ঞানের মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছেন।
প্রফেসর সালাম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন “আজ থেকে বিশ বছর পরেও স্বল্পোন্নত দেশগুলো আজকের মতোই
ক্ষুধার্ত, আপেক্ষিকভাবে অনুন্নত এবং হতাশাজনকভাবে দরিদ্র থাকবে।” তাই তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন তৃতীয় বিশ্বের
বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স’। এই একাডেমির স্কলারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় পৃথিবীর অনেক দরিদ্র দেশের অনেক
বিজ্ঞানী গবেষণা করার সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই প্রফেসর
আবদুস সালামের সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রফেসর আবদুস সালাম কয়েকবার বাংলাদেশের ঢাকা ও
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন।
প্রফেসর সালাম বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে কখনোই
দেখতে চাননি। সারাদেশের জীবনযাত্রার মান দ্রুত উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাই তিনি সারাজীবন বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘আমাদের মানবিক ও বস্তুগত যে সম্পদ রয়েছে তার সবচেয়ে ভাল
প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবহারের চিন্তাশীল হিসাব নিকাশই হল বিজ্ঞান।’
পৃথিবীর অনুন্নত অংশ যে ভীতিপ্রদ সংকটের
সম্মুখীন তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে যেসব অগণিত মানুষ চিন্তাভাবনা করেন তাঁর মধ্যে অল্প
কয়েকজন আছেন যাঁরা শুধু কথা বলেন না, কাজও করেন। প্রফেসর আবদুস সালাম শেষের দলে।
কাজ করতে করতে ছুটে গেছেন পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে।
নিজের জন্মভূমি পাকিস্তানের প্রতি
নিঃশর্ত ভালোবাসা ছিল আবদুস সালামের। জীবনের বেশিরভাগ সময় ইউরোপে কাটালেও অন্য কোন
দেশের নাগরিকত্ব নেননি তিনি। পাকিস্তানি পাসপোর্টের কারণে অনেকবার তাঁকে বিব্রত
হতে হয়েছে এয়ারপোর্টে। অপমানিতও হতে হয়েছে। হিথরো বিমানবন্দরে যখন ততটা কড়াকড়ি ছিল
না তখন আবদুস সালাম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে 'কমনওয়েল্থ কান্ট্রি সিটিজেন্স
লাইন' দিয়ে ইমিগ্রেশান পার হতেন। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী জঙ্গিদের উৎপাতে এয়ারপোর্টের
কড়াকড়ি যখন বাড়াতে হলো আবদুস সালামকেও ইমিগ্রেশান অফিসারদের হাতে নাজেহাল হতে হলো
বারবার। শেষে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ
করেন তিনি। তখন সালামকে একটা বিশেষ অনুমতিপত্র দেয়া হলো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশান
দ্রুত পার হবার জন্য। অথচ তিনি ইচ্ছে করলে কত সহজেই ব্রিটেনের নাগরিকত্ব নিতে
পারতেন।
সময়কে
কাজে লাগানোর অসম্ভব দক্ষতা আবদুস সালামের। কাজের সময় সবকিছু ভুলে যান, আবার কাজের
মাঝখানে মিটিং বা অন্যকিছু করে এসে দ্রুত কাজে ডুবে যেতে পারেন।
বাসার
কাজে কিছুটা আনাড়ি বা আত্মভোলাও ছিলেন তিনি। একবার তাঁর এক বছর বয়সী মেয়ে সাইদাকে
তাঁর কাছে রেখে বাসার সবাই কোন একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। আবদুস সালামের স্ত্রী ফিরে
এসে দেখেন যে তাঁর স্বামী সাইদাকে ঘুম পাড়িয়েছেন সংবাদপত্র মুড়িয়ে।
আবদুস সালাম সব ধরনের
বই পড়তে পছন্দ করতেন। তার লাইব্রেরিতে নাচ শেখার বইও পাওয়া গেছে। আবদুস সালাম
পোশাকে সবসময় ফর্মাল। তবে তাঁর কোটের পকেটে বিভিন্ন রকম চকলেট, লজেন্স, বাদাম,
মশলা ইত্যাদি থাকতো। মাঝে মাঝেই তিনি পকেট থেকে লজেন্স বের করে খেতেন।
আন্ডারগ্র্যাজুয়েট
ছাত্ররা আবদুস সালামকে এড়িয়ে চলতো। কারণ তিনি সারাক্ষণই
কাজ দিতেন তাদের। আপাতদৃষ্টিতে কঠোর ব্যক্তিত্বের মনে হলেও আবদুস সালাম মাঝে মাঝে
বেশ হাসিখুশি থাকতেন। সালাম এত জোরে হাসতেন যে ইম্পেরিয়েল কলেজের করিডোর কেঁপে
উঠতো। (ইম্পেরিয়েল কলেজের সেই সময়ের ভবনগুলো ছিলো খুবই পুরনো। শব্দ নিয়ন্ত্রণের
কোন ব্যবস্থাই ছিল না। আবদুস সালামের হাসির শব্দ তাই করিডোরে প্রতিধ্বনিত হতো মাঝে
মাঝে।)
আবদুস
সালাম পদার্থবিজ্ঞানী হলেও তুখোড় রাজনৈতিক দক্ষতা ছিল তাঁর। তিনি কখনো কোন সুযোগের
রাস্তা একেবারে বন্ধ করে দিতেন না। তাই তিনি কাজ করতে পেরেছেন আইয়ুব খানের সাথে,
ইয়াহিয়া খানের সাথে, জুলফিকার আলি ভুট্টোর সাথেও। জিয়াউল হক বা বেনজির ভুট্টো কারো
সাথেই তিনি আলোচনার দরজা কখনো বন্ধ করে দেননি। ইসলামী দেশগুলোর সাথে যেমন বৈজ্ঞানিক
উন্নয়নের জন্য আলোচনা চালিয়েছেন, একই ভাবে আলোচনা চালিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন,
আমেরিকা, ইউরোপ, এবং চীনের সাথেও। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেও তিনি কখনো কাউকে
একেবারে বর্জন করেননি। প্রফেসর পাউলির কারণে তিনি প্যারিটি ভায়োলেশন আবিষ্কারের
কৃতিত্ব থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। যে পেপারটি প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন পাউলি
সেই পেপারটা তিনি প্রকাশ করেছেন ঠিকই - তবে সেখানেও পাউলির প্রতি কৃতজ্ঞতা
জানিয়েছেন।
ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল আবদুস
সালামের। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। রাত ন'টায় ঘুমাতে যেতেন, উঠতেন ভোর সাড়ে তিনটায়। উঠে
নামাজ পড়ে কাজ শুরু করতেন বাসায় টেপরেকর্ডারে কোরান পাঠ শুনতে শুনতে। ১৯৬২ সালে
মা-বাবাকে নিয়ে ওমরাহ পালন করেছেন। হজ্ব পালন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি আহমদিয়া
বলে সৌদি সরকারের অনুমতি পাননি।
নোবেল পুরষ্কার পাবার খবর জানার সাথে
সাথেই আবদুস সালাম ছুটে গিয়েছিলেন মসজিদে শোকরানা নামাজ আদায় করার জন্য। কিন্তু
বিজ্ঞান ও ধর্মকে তিনি কখনো মেলাতে চাননি। ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিজ্ঞান আছে বলেও
তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মবিশ্বাস মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত
ব্যাপার। তাই তিনি পরম ধর্মবিশ্বাসী হয়েও চরম নাস্তিক স্টিভেন ওয়েনবার্গের সাথে
গবেষণা করতে পেরেছেন কোন সমস্যা ছাড়াই। নোবেল পুরষ্কারও শেয়ার করেছেন তিনি এই চরম
নাস্তিকের সাথে।
ব্যক্তিগত জীবনে এই কাজ-পাগল বিজ্ঞানী
ছিলেন অনেকটাই একা। খুব কাছের বন্ধু, যাদের কাছে মন খোলা যায়, ছিল না বললেই চলে। তাই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো
খুব একটা জানাও যায় না। ১৯৪৯ সালে হাফিজা বেগমের সাথে বিয়ের পর ১৯৬০ সালের মধ্যে
তাঁদের তিনটি কন্যা আজিজা, আসিফা, বুশরা ও একটি পুত্র সন্তান আহমদের জন্ম হয়।
স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আবদুস সালাম থাকতেন লন্ডনের পুটনিতে। সুখের সংসারই বলা
চলে। নিজের গবেষণা, প্রশাসনিক কাজ, অধ্যাপনা সব করার পর যেটুকু সময় পেতেন কিছুটা
হলেও স্ত্রী ও সন্তানদের দিতে চেষ্টা করতেন। মেয়েদের স্কুলের পড়াশোনার অগ্রগতির
খবর নিতেন।
১৯৬০ সালে ছোট ছেলে আহমদের যখন জন্ম হয়
তখন পাকিস্তানের বিজ্ঞান উন্নয়নের কাজ, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স গড়ার কাজ নিয়ে তিনি এত ব্যস্ত যে আহমদ
তাঁকে কাছেই পেতো না। পাঁচ ছয় বছর বয়সে আহমদ তার মাকে বলতো, "মা, বাবার রুমের
ফ্লোরে আমার বিছানা করে দাও, বাবার কাছে থাকবো।" কিন্তু ততদিনে আহমদ তার
বাবাকে কাছে না পাবার আরো একটা কারণ ঘটে গেছে যা আবদুস সালাম গোপন রেখেছিলেন প্রায়
সাত বছর।
বিজ্ঞানের অঙ্গনে আবদুস সালামের স্থান
যত উঁচু হচ্ছিলো, পারিবারিক জীবনে তিনি
মনে হয় কিছুটা একঘেঁয়েমি বোধ করছিলেন। তাঁর তেমন লেখাপড়া না জানা স্ত্রী হাফিজা
বেগম তাঁর বৈজ্ঞানিক মননের সঙ্গী হতে পারেননি। হয়তো তাই, স্ত্রী বর্তমান থাকা
সত্ত্বেও আরেকটা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন প্রফেসর আবদুস সালাম।
১৯৬২ সালে আবদুস সালামের
সাথে পরিচয় হয় অক্সফোর্ডের ছাত্রী লুইস জন্সনের। আবদুস সালাম তখন ইম্পেরিয়াল
কলেজের বিখ্যাত প্রফেসর। লুইস জীববিজ্ঞানের ছাত্রী। আবদুস সালাম আর লুইসের ঘন ঘন
দেখা হতে লাগলো। জটিল গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানীর মুখে ইংরেজি সাহিত্য আর কবিতা নিয়ে
আলোচনা শুনে মুগ্ধ লুইস। ছয় বছর ধরে চললো তাঁদের গোপন প্রেম। ১৯৬৮ সালে আবদুস
সালাম লুইস জনসনকে বিয়ে করেন। আবদুস সালামের বয়স তখন ৪২ আর লুইসের ২৬। আবদুস
সালামের বড় মেয়ের বয়স তখন ১৮। লুইস পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার
বায়োলজির প্রফেসর হন। লাইসোজমের রাসায়নিক গঠন আবিষ্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা
রেখেছেন লুইস জনসন। রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপও পেয়েছেন লুইস জনসন।
লুইস জনসন
|
এক
স্ত্রী বর্তমান থাকতে আরেকজনকে বিয়ে করা ব্রিটিশ আইনে অপরাধ। কিন্তু আবদুস সালাম
পাকিস্তানি নাগরিক। তাছাড়া রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করার সময় তিনি প্রথম স্ত্রীর কথা গোপন
করেছিলেন। একই শহরে মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে পাশাপাশি দুটো সংসার আলাদা আলাদা
ভাবে চালিয়ে নিয়ে গেছেন আবদুস সালাম। লুইসের সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা বারো বছর
তিনি গোপন রেখেছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রীর কাছে।
যে আবদুস সালাম বিজ্ঞানের সাধক, যে
আবদুস সালাম ভীষণ ধার্মিক, যে আবদুস সালাম উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানের উন্নতির
জন্য দিনরাত খাটছেন, সেই আবদুস সালাম তাঁর স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করলেন গোপনে
আরেকটি বিয়ে করে।
১৯৭৪ সালে আবদুস সালাম ও লুইস জনসনের ছেলে
উমরের জন্ম হয়। তারপর সব জানাজানি হয়ে যায়। নীরবে সব কিছু মেনে নেন অসহায় চার
সন্তানের জননী হাফিজা বেগম। ১৯৮২ সালে লুইস ও সালামের কন্যা সাইদার জন্ম হয়।
লুইস ও সালামের ছেলে উমর ও মেয়ে সাইদার সাথে পার্কে
|
নোবেল ভোজসভায় সুইডেনের রানির পাশে আবদুস সালাম
|
অনেকেই
মনে করেন আবদুস সালাম - তৃতীয় বিশ্বের সাথে প্রথম বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সুযোগের
বৈষম্যের প্রতি রেগে ওঠা মানুষ। সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কারণেও তিনি মাঝে মাঝে রেগে
যেতেন। তাঁকে ফর্মালি ‘প্রফেসর
সালাম’ বলে ডাকবেন, নাকি ইনফর্মালি ‘আবদুস’ বলে
ডাকবেন তা নিয়ে সমস্যায় পড়তেন তাঁর পশ্চিমা সহকর্মীরা। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করাতে
তিনি কিছুটা রেগে গিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন “আমার নাম আবদুস সালাম। মানে আল্লাহ্র চাকর। এখন তুমিই ঠিক করো আমাকে ‘সালাম’ মানে
‘আল্লাহ’ বলে ডাকবে, নাকি ‘আবদুস’ মানে ‘চাকর’ বলে
ডাকবে।”
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পল
ডিরাক একবার আবদুস সালামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তুমি কীভাবে চিন্তা করো?
গাণিতিকভাবে, নাকি জ্যামিতিকভাবে?" বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ চিন্তা করেন
গাণিতিকভাবে। অর্থাৎ একটা বিষয়ের সাথে অন্য বিষয় মিলিয়ে মিলিয়ে। আর মুষ্টিমেয়
কয়েকজন থাকেন যাঁরা একই সাথে অনেকদূর দেখার ক্ষমতা রাখেন, তাঁরা চিন্তা করেন
জ্যামিতিকভাবে। পুরো জটিল চিত্রটাই তাঁরা একসাথে ভেবে ফেলতে পারেন। আবদুস সালাম
ছিলেন সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের একজন।