Tuesday 31 March 2020

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ৯


ব্যক্তি আবদুস সালাম

আবদুস সালামের আই-সি-টি-পির অফিসের দেয়ালে একটি ষোড়শ শতাব্দীর পারসিক প্রার্থনার লিপি ঝোলানো আছে: তিনি চিৎকার করে বললেন, ঈশ্বর, একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা সংঘটিত করুন।আবদুস সালামের শক্তি এই যে তিনি বিশ্বাস করতেন আশ্চর্যজনক ঘটনা সম্ভব যদি আমরা এগিয়ে গিয়ে ঘটতে সাহায্য করি। তিনি তা বিশ্বাস করতেন বলেই সারাজীবন বিজ্ঞানের মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছেন।
          প্রফেসর সালাম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন আজ থেকে বিশ বছর পরেও স্বল্পোন্নত দেশগুলো আজকের মতোই ক্ষুধার্ত, আপেক্ষিকভাবে অনুন্নত এবং হতাশাজনকভাবে দরিদ্র থাকবে।তাই তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স। এই একাডেমির স্কলারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় পৃথিবীর অনেক দরিদ্র দেশের অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা করার সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই প্রফেসর আবদুস সালামের সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রফেসর আবদুস সালাম কয়েকবার বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন।
          প্রফেসর সালাম বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে কখনোই দেখতে চাননি। সারাদেশের জীবনযাত্রার মান দ্রুত উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাই তিনি সারাজীবন বলেছেন। তাঁর ভাষায় আমাদের মানবিক ও বস্তুগত যে সম্পদ রয়েছে তার সবচেয়ে ভাল প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবহারের চিন্তাশীল হিসাব নিকাশই হল বিজ্ঞান।
          পৃথিবীর অনুন্নত অংশ যে ভীতিপ্রদ সংকটের সম্মুখীন তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে যেসব অগণিত মানুষ চিন্তাভাবনা করেন তাঁর মধ্যে অল্প কয়েকজন আছেন যাঁরা শুধু কথা বলেন না, কাজও করেন। প্রফেসর আবদুস সালাম শেষের দলে। কাজ করতে করতে ছুটে গেছেন পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে।
          নিজের জন্মভূমি পাকিস্তানের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা ছিল আবদুস সালামের। জীবনের বেশিরভাগ সময় ইউরোপে কাটালেও অন্য কোন দেশের নাগরিকত্ব নেননি তিনি। পাকিস্তানি পাসপোর্টের কারণে অনেকবার তাঁকে বিব্রত হতে হয়েছে এয়ারপোর্টে। অপমানিতও হতে হয়েছে। হিথরো বিমানবন্দরে যখন ততটা কড়াকড়ি ছিল না তখন আবদুস সালাম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে 'কমনওয়েল্‌থ কান্ট্রি সিটিজেন্‌স লাইন' দিয়ে ইমিগ্রেশান পার হতেন। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী জঙ্গিদের উৎপাতে এয়ারপোর্টের কড়াকড়ি যখন বাড়াতে হলো আবদুস সালামকেও ইমিগ্রেশান অফিসারদের হাতে নাজেহাল হতে হলো বারবার। শেষে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন তিনি। তখন সালামকে একটা বিশেষ অনুমতিপত্র দেয়া হলো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশান দ্রুত পার হবার জন্য। অথচ তিনি ইচ্ছে করলে কত সহজেই ব্রিটেনের নাগরিকত্ব নিতে পারতেন।
          সময়কে কাজে লাগানোর অসম্ভব দক্ষতা আবদুস সালামের। কাজের সময় সবকিছু ভুলে যান, আবার কাজের মাঝখানে মিটিং বা অন্যকিছু করে এসে দ্রুত কাজে ডুবে যেতে পারেন।
          বাসার কাজে কিছুটা আনাড়ি বা আত্মভোলাও ছিলেন তিনি। একবার তাঁর এক বছর বয়সী মেয়ে সাইদাকে তাঁর কাছে রেখে বাসার সবাই কোন একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। আবদুস সালামের স্ত্রী ফিরে এসে দেখেন যে তাঁর স্বামী সাইদাকে ঘুম পাড়িয়েছেন সংবাদপত্র মুড়িয়ে।
          আবদুস সালাম সব ধরনের বই পড়তে পছন্দ করতেন। তার লাইব্রেরিতে নাচ শেখার বইও পাওয়া গেছে। আবদুস সালাম পোশাকে সবসময় ফর্মাল। তবে তাঁর কোটের পকেটে বিভিন্ন রকম চকলেট, লজেন্স, বাদাম, মশলা ইত্যাদি থাকতো। মাঝে মাঝেই তিনি পকেট থেকে লজেন্স বের করে খেতেন।
          আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা আবদুস সালামকে এড়িয়ে চলতো। কারণ তিনি সারাক্ষণই কাজ দিতেন তাদের। আপাতদৃষ্টিতে কঠোর ব্যক্তিত্বের মনে হলেও আবদুস সালাম মাঝে মাঝে বেশ হাসিখুশি থাকতেন। সালাম এত জোরে হাসতেন যে ইম্পেরিয়েল কলেজের করিডোর কেঁপে উঠতো। (ইম্পেরিয়েল কলেজের সেই সময়ের ভবনগুলো ছিলো খুবই পুরনো। শব্দ নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থাই ছিল না। আবদুস সালামের হাসির শব্দ তাই করিডোরে প্রতিধ্বনিত হতো মাঝে মাঝে।)
        আবদুস সালাম পদার্থবিজ্ঞানী হলেও তুখোড় রাজনৈতিক দক্ষতা ছিল তাঁর। তিনি কখনো কোন সুযোগের রাস্তা একেবারে বন্ধ করে দিতেন না। তাই তিনি কাজ করতে পেরেছেন আইয়ুব খানের সাথে, ইয়াহিয়া খানের সাথে, জুলফিকার আলি ভুট্টোর সাথেও। জিয়াউল হক বা বেনজির ভুট্টো কারো সাথেই তিনি আলোচনার দরজা কখনো বন্ধ করে দেননি। ইসলামী দেশগুলোর সাথে যেমন বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের জন্য আলোচনা চালিয়েছেন, একই ভাবে আলোচনা চালিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, ইউরোপ, এবং চীনের সাথেও। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেও তিনি কখনো কাউকে একেবারে বর্জন করেননি। প্রফেসর পাউলির কারণে তিনি প্যারিটি ভায়োলেশন আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। যে পেপারটি প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন পাউলি সেই পেপারটা তিনি প্রকাশ করেছেন ঠিকই - তবে সেখানেও পাউলির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
          ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল আবদুস সালামের। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। রাত ন'টায় ঘুমাতে যেতেন, উঠতেন ভোর সাড়ে তিনটায়। উঠে নামাজ পড়ে কাজ শুরু করতেন বাসায় টেপরেকর্ডারে কোরান পাঠ শুনতে শুনতে। ১৯৬২ সালে মা-বাবাকে নিয়ে ওমরাহ পালন করেছেন। হজ্ব পালন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি আহমদিয়া বলে সৌদি সরকারের অনুমতি পাননি।
          নোবেল পুরষ্কার পাবার খবর জানার সাথে সাথেই আবদুস সালাম ছুটে গিয়েছিলেন মসজিদে শোকরানা নামাজ আদায় করার জন্য। কিন্তু বিজ্ঞান ও ধর্মকে তিনি কখনো মেলাতে চাননি। ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিজ্ঞান আছে বলেও তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মবিশ্বাস মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই তিনি পরম ধর্মবিশ্বাসী হয়েও চরম নাস্তিক স্টিভেন ওয়েনবার্গের সাথে গবেষণা করতে পেরেছেন কোন সমস্যা ছাড়াই। নোবেল পুরষ্কারও শেয়ার করেছেন তিনি এই চরম নাস্তিকের সাথে। 
          ব্যক্তিগত জীবনে এই কাজ-পাগল বিজ্ঞানী ছিলেন অনেকটাই একা। খুব কাছের বন্ধু, যাদের কাছে মন খোলা যায়,  ছিল না বললেই চলে। তাই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো খুব একটা জানাও যায় না। ১৯৪৯ সালে হাফিজা বেগমের সাথে বিয়ের পর ১৯৬০ সালের মধ্যে তাঁদের তিনটি কন্যা আজিজা, আসিফা, বুশরা ও একটি পুত্র সন্তান আহমদের জন্ম হয়। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে আবদুস সালাম থাকতেন লন্ডনের পুটনিতে। সুখের সংসারই বলা চলে। নিজের গবেষণা, প্রশাসনিক কাজ, অধ্যাপনা সব করার পর যেটুকু সময় পেতেন কিছুটা হলেও স্ত্রী ও সন্তানদের দিতে চেষ্টা করতেন। মেয়েদের স্কুলের পড়াশোনার অগ্রগতির খবর নিতেন।
          ১৯৬০ সালে ছোট ছেলে আহমদের যখন জন্ম হয় তখন পাকিস্তানের বিজ্ঞান উন্নয়নের কাজ, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল  ফিজিক্স গড়ার কাজ নিয়ে তিনি এত ব্যস্ত যে আহমদ তাঁকে কাছেই পেতো না। পাঁচ ছয় বছর বয়সে আহমদ তার মাকে বলতো, "মা, বাবার রুমের ফ্লোরে আমার বিছানা করে দাও, বাবার কাছে থাকবো।" কিন্তু ততদিনে আহমদ তার বাবাকে কাছে না পাবার আরো একটা কারণ ঘটে গেছে যা আবদুস সালাম গোপন রেখেছিলেন প্রায় সাত বছর।  
          বিজ্ঞানের অঙ্গনে আবদুস সালামের স্থান যত উঁচু হচ্ছিলো,  পারিবারিক জীবনে তিনি মনে হয় কিছুটা একঘেঁয়েমি বোধ করছিলেন। তাঁর তেমন লেখাপড়া না জানা স্ত্রী হাফিজা বেগম তাঁর বৈজ্ঞানিক মননের সঙ্গী হতে পারেননি। হয়তো তাই, স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আরেকটা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন প্রফেসর আবদুস সালাম।
          ১৯৬২ সালে আবদুস সালামের সাথে পরিচয় হয় অক্সফোর্ডের ছাত্রী লুইস জন্‌সনের। আবদুস সালাম তখন ইম্পেরিয়াল কলেজের বিখ্যাত প্রফেসর। লুইস জীববিজ্ঞানের ছাত্রী। আবদুস সালাম আর লুইসের ঘন ঘন দেখা হতে লাগলো। জটিল গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানীর মুখে ইংরেজি সাহিত্য আর কবিতা নিয়ে আলোচনা শুনে মুগ্ধ লুইস। ছয় বছর ধরে চললো তাঁদের গোপন প্রেম। ১৯৬৮ সালে আবদুস সালাম লুইস জনসনকে বিয়ে করেন। আবদুস সালামের বয়স তখন ৪২ আর লুইসের ২৬। আবদুস সালামের বড় মেয়ের বয়স তখন ১৮। লুইস পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার বায়োলজির প্রফেসর হন। লাইসোজমের রাসায়নিক গঠন আবিষ্কারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন লুইস জনসন। রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপও পেয়েছেন লুইস জনসন। 

লুইস জনসন
এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে আরেকজনকে বিয়ে করা ব্রিটিশ আইনে অপরাধ। কিন্তু আবদুস সালাম পাকিস্তানি নাগরিক। তাছাড়া রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করার সময় তিনি প্রথম স্ত্রীর কথা গোপন করেছিলেন। একই শহরে মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে পাশাপাশি দুটো সংসার আলাদা আলাদা ভাবে চালিয়ে নিয়ে গেছেন আবদুস সালাম। লুইসের সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা বারো বছর তিনি গোপন রেখেছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রীর কাছে।        
          যে আবদুস সালাম বিজ্ঞানের সাধক, যে আবদুস সালাম ভীষণ ধার্মিক, যে আবদুস সালাম উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য দিনরাত খাটছেন, সেই আবদুস সালাম তাঁর স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করলেন গোপনে আরেকটি বিয়ে করে।
          ১৯৭৪ সালে আবদুস সালাম ও লুইস জনসনের ছেলে উমরের জন্ম হয়। তারপর সব জানাজানি হয়ে যায়। নীরবে সব কিছু মেনে নেন অসহায় চার সন্তানের জননী হাফিজা বেগম। ১৯৮২ সালে লুইস ও সালামের কন্যা সাইদার জন্ম হয়।

লুইস ও সালামের ছেলে উমর ও মেয়ে সাইদার সাথে পার্কে

 ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করার জন্য স্টকহোমে যাবার সময় প্রফেসর আবদুস সালাম তাঁর দুই স্ত্রীকেই সাথে নিয়ে যান। এরকম পরিস্থিতি আগে কখনো দেখেননি নোবেল ফাউন্ডেশানের কর্মকর্তারা। নোবেল বিজয়ীর স্ত্রীকে যথাযোগ্য প্রটোকল দিতে হয়। ভোজের টেবিলে রাজার পাশে আসন দেয়া হয় নোবেল বিজয়ীর স্ত্রীকে, আর রানির পাশে বসেন নোবেল বিজয়ী। এখন নোবেল বিজয়ীর দুজন স্ত্রী উপস্থিত। কাকে কোথায় বসাবেন- সমস্যায় পড়ে গেলেন কর্মকর্তারা। হাফিজা বেগম স্বামীর সাথে গেলেও নোবেল পুরষ্কারের আনুষ্ঠানিকতায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। অন্যদিকে লুইস জনসন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির খ্যাতনামা প্রফেসর। সুতরাং আবদুস সালামের যোগ্য স্ত্রীর সম্মান তিনিই পেলেন। 

নোবেল ভোজসভায় সুইডেনের রানির পাশে আবদুস সালাম

অনেকেই মনে করেন আবদুস সালাম - তৃতীয় বিশ্বের সাথে প্রথম বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সুযোগের বৈষম্যের প্রতি রেগে ওঠা মানুষ। সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কারণেও তিনি মাঝে মাঝে রেগে যেতেন। তাঁকে ফর্মালি প্রফেসর সালাম বলে ডাকবেন, নাকি ইনফর্মালি আবদুস বলে ডাকবেন তা নিয়ে সমস্যায় পড়তেন তাঁর পশ্চিমা সহকর্মীরা। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করাতে তিনি কিছুটা রেগে গিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন আমার নাম আবদুস সালাম। মানে আল্লাহ্‌র চাকর। এখন তুমিই ঠিক করো আমাকে সালাম মানে আল্লাহ বলে ডাকবে, নাকি আবদুস মানে চাকর বলে ডাকবে।
          কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পল ডিরাক একবার আবদুস সালামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তুমি কীভাবে চিন্তা করো? গাণিতিকভাবে, নাকি জ্যামিতিকভাবে?" বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ চিন্তা করেন গাণিতিকভাবে। অর্থাৎ একটা বিষয়ের সাথে অন্য বিষয় মিলিয়ে মিলিয়ে। আর মুষ্টিমেয় কয়েকজন থাকেন যাঁরা একই সাথে অনেকদূর দেখার ক্ষমতা রাখেন, তাঁরা চিন্তা করেন জ্যামিতিকভাবে। পুরো জটিল চিত্রটাই তাঁরা একসাথে ভেবে ফেলতে পারেন। আবদুস সালাম ছিলেন সেই মুষ্টিমেয় কয়েকজনের একজন।


পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ৮


নোবেল পুরষ্কারের পর

প্রতিবছর ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয় নোবেল পুরষ্কার প্রদানের মহোৎসব। সুইডেনের রাজার কাছ থেকে নোবেল পদক ও সনদ গ্রহণ করেন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীরা। (একই দিনে নরওয়ের অস্‌লোয়  অনুষ্ঠিত হয় নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান।) নোবেল পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরুষরা পরেন বিশেষ ডিজাইনের কালো স্যুটের সাথে সাদা বো-টাই, আর মহিলারা পরেন আনুষ্ঠানিক সান্ধ্যকালীন পোশাক। নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে যাঁরা সাধারণত আটপৌরে পোশাক পছন্দ করেন, তাঁরাও এদিনে এই বিশেষ নোবেল-পোশাক পরেই পুরষ্কার নিতে যান।
          কিন্তু ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলো। মঞ্চে বসা নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে দেখা গেলো একজনের পোশাক সম্পূর্ণ অন্যরকম। কালো লম্বা গলাবদ্ধ কোটের সাথে সাদা সালোয়ার পরনে, পায়ে জরির নাগরা জুতো, আর মাথায় সাদা পাগড়ি। হলভর্তি অতিথিদের সবার চোখ এই অন্যরকম পোশাকের অন্যরকম মানুষটির দিকে- যাঁর নাম আবদুস সালাম, নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম।

শেলডন গ্ল্যাসো, আবদুস সালাম, ও স্টিভেন ওয়েনবার্গ

পদার্থবিজ্ঞানের জগতে প্রফেসর আবদুস সালামের সত্যিকারের বিচরণ শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে যখন তিনি কেমব্রিজে পড়তে আসেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৯ - এই বত্রিশ বছর ধরে যাঁরা চেনেন তাঁকে, পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে তাঁরা মোটেও অবাক হননি। কিন্তু সবাই খুব অবাক হয়েছেন নোবেল পুরষ্কারের অনুষ্ঠানে তাঁর পোশাক দেখে। কারণ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই প্রফেসর আবদুস সালাম দামী থ্রি-পিস স্যুট পরতে অভ্যস্ত। তাই বিশেষ দিনে বিশেষ পোশাকের পেছনে এই বিজ্ঞানীর নিশ্চয়ই বড় কোন যুক্তি আছে।
          প্রফেসর আবদুস সালাম জানেন তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে নোবেল পুরষ্কারের মূল্য কতখানি। তিনি দেখেছেন পৃথিবীতে উন্নত-বিশ্ব ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মাঝে সম্পদের বিশাল ব্যবধানের কারণে উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীও উন্নত-বিশ্বের মেধাহীনদের চেয়েও পিছিয়ে পড়ে। তাই তিনি এই অনুষ্ঠানে উন্নত বিশ্বের কাছে নিজের দেশের পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছেন পোশাকের মাধ্যমে।
          পোশাকের নাটকীয়তার গুরুত্ব ঠিক কতটুকু তা জানার উপায় নেই। তবে এই নাটকীয়তার উপাদান জোগাড় করার জন্য তাঁকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে পাগড়ি পরেছিলেন, তাও অন্যের সাহায্যে। এত বছর পর পাগড়ি পরতে গিয়ে দেখা গেলো পাগড়ি কীভাবে পরতে হয় তা তিনি জানেনই না। সুইডেনের পাকিস্তান দূতাবাসে খোঁজ নেয়া হলো। সেখানেও অফিসারদের কেউই স্বদেশী পোশাক পরেন না। সুতরাং পাগড়ি কীভাবে পরতে হয় জানার প্রশ্নই ওঠে না। খুঁজতে খুঁজতে দূতাবাসের রাঁধুনিদের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেল যে পাগড়ি পরতে জানে। তাকে নিয়ে আসা হলো প্রফেসর আবদুস সালামের পাগড়ি বেঁধে দেয়ার জন্য। তার পরানোর ধরন দেখে প্রফেসর সালাম বুঝতে পারলেন রাঁধুনিটি এসেছে পাকিস্তানের অন্য একটা প্রদেশ থেকে- যে প্রদেশের পাগড়ির প্যাঁচের সাথে তাঁর নিজের প্রদেশের পাগড়ির প্যাঁচের মিল নেই। কিন্তু কী আর করা যাবে। ভুল-পাগড়ি মাথায় নিয়েই হাজির হলেন নোবেল-অনুষ্ঠানে।
    নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির পর স্বাভাবিক ভাবেই পুরষ্কার ও পদকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলো আবদুস সালামের। অসংখ্য পুরষ্কারের পাশাপাশি বিশ্বের পয়ঁত্রিশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে পরবর্তী কয়েক বছরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে তাঁর অংশগ্রহণ বেড়ে গেলো। সারা পৃথিবী থেকেই তাঁর নিমন্ত্রণ আসতে শুরু করেছে।
          প্রথম মুসলমান নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী হিসেবে আবদুস সালাম খুব গর্বিত। মুসলিম দেশগুলো আবদুস সালামকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গর্ব বোধ করতে শুরু করেছে।
          ট্রিয়েস্তের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের সুনাম বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। সেন্টারের জন্য তহবিল সংগ্রহ অনেকটাই সহজ হয়ে গেলো। আই-সি-টি-পিকে কেন্দ্র করে আবদুস সালাম গড়ে তুললেন আরো অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেস (TWAS)। উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যেই গঠিত হয় এই প্রতিষ্ঠান। আবদুস সালাম হন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।


নোবেল পুরষ্কার পাবার পর আই-সি-টি-পিতে আবদুস সালামকে অভিনন্দন

১৯৮৮ সালে ট্রিয়েস্তে প্রতিষ্ঠিত হয় থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক অব সায়েন্টিফিক অর্গানাইজেশান্‌স (TWNSO)। তৃতীয় বিশ্বের মৌলিক বিজ্ঞান ও উচ্চ-প্রযুক্তির উন্নয়নে সাহায্যের জন্য গঠিত হলো ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড হাই টেকনোলজি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে আই-সি-টি-পি'র নেতৃত্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শাখার ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৯৯৩ সালের ২২ মে ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফর ডেন্সলি পপুলেটেড রিজিয়ন্‌স (ICSTED)'র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
          ১৯৮৪ সালে আবদুস সালামের দেশ, সমাজ, অর্থনীতি, উন্নয়ন ইত্যাদি নানা-বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন 'আইডিয়েলস অ্যান্ড রিয়েলিটিস' প্রকাশিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনুদিত হয়।
          আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কারের পর অনেকেই মন্তব্য করেছেন পুরষ্কারটা W Z বোসন আবিষ্কারের আগেই দিয়ে দেয়াটা কতটুকু যুক্তিসংগত হয়েছে? অনেকে এমনও বলেছেন যে যদি W Z  বোসন পাওয়া না যায় তাহলে কি সালামরা নোবেল পুরষ্কার ফেরত দেবেন? কিন্তু সেরকম অঘটন ঘটেনি। তাঁদের তত্ত্বে যে W Z বোসনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল তা সার্নের পরীক্ষাগারে আবিষ্কৃত হয় ১৯৮৩ সালে কার্লো রুবিয়ার নেতৃত্বে। এজন্যে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান ১৯৮৪ সালে।


১৯৮৩ সালে সার্নে পরীক্ষামূলক প্রমাণের পর

ওয়েনবার্গ, সালাম আর গ্ল্যাশোর তত্ত্ব থেকে W Z কণার ভর হিসেব করে বের করা যায়। তখন প্রশ্ন জাগে বস্তুর ভরের আসল উৎস কী? আমরা সম্প্রতি এ প্রশ্নের উত্তর জেনেছি। হিগ্‌স বোসনই যে বস্তুর ভরের জন্য দায়ী তা আমরা জেনেছি। ২০১২ সালে হিগ্‌স বোসন পাওয়া গেছে সার্নের ল্যাবোরেটরিতে। হিগ্‌স বোসনের ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন পিটার হিগ্‌স ও ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট।
          নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর আবদুস সালামের নিজের দেশ পাকিস্তানে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হলো। যখন বলা হলো আবদুস সালাম প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী, অস্বস্তিতে পড়লেন মিলিটারি প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। কোনরকমে একটা রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনার আয়োজন করতে হলো আবদুস সালামের জন্য। রাষ্ট্রীয় খেতাব নিশান-ই ইমতিয়াজ দেয়া হলো আবদুস সালামকে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জিয়াউল হককে আবদুস সালামের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে দেখা গেছে। জিয়াউল হকের জন্য ব্যাপারটা খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। জুলফিকার আলি ভুট্টো সৌদি আরবসহ আরো কিছু মুসলিম দেশের সমর্থন পাবার জন্য, পাকিস্তানের ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাতে রাখার জন্য আইন করেছিলেন আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে। আহমদিয়াদের অমুসলমান ঘোষণা করেছিলেন ভুট্টো। জিয়াউল হক একদিকে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছেন, অন্যদিকে আহমদিয়াদের ওপর আরো কঠিন হয়েছেন।
          জিয়াউল হক আইন করেছেন কোন আহমদিয়া যদি কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করে তাকে ছয় মাস পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হবে। কিন্তু টিভি ক্যামেরার সামনে আবদুস সালামের সাথে জিয়াউল হকের কথোপথনের সময় আবদুস সালাম কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন অনেকবার। টিভিতে প্রচার করার সময় সালামের কথার মাঝখান থেকে কোরানের আয়াতগুলো সব এডিট করে বাদ দেয়া হলো।
          কিন্তু সমালোচনা থামানো গেলো না। পাকিস্তানের অনেকগুলো উগ্র মৌলবাদী সংবাদপত্রে লেখা হলো আবদুস সালামের মত একজন আহমদিয়াকে নোবেল পুরষ্কার দেয়াটা পশ্চিমাদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র। বলা হলো নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় সুদের টাকায়। তাই নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করা হারাম। মৌলবাদীদের কুযুক্তির অভাব হয় না। তাদের অর্থপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা বের করলেন ১৯৭৯ সাল হলো আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী। আইনস্টাইন ইহুদি। এই ১৯৭৯ সালেই আবদুস সালামকে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার অর্থ হলো সালামের সাথে ইহুদিদের আঁতাত চলছে।
          আবদুস সালাম অবশ্য এসবে খুব একটা বিচলিত হলেন না। তিনি লাহোরে গিয়ে দেখা করলেন তাঁর শিক্ষক প্রফেসর সিরাজুদ্দিনের সাথে। সিরাজুদ্দিন লাহোর কলেজে থাকাকালীন আবদুস সালামকে নানাভাবে হেনস্তা করেছিলেন। আবদুস সালাম সে সব মনে রাখেননি।
          স্বাধীনতার পর লাহোর ছেড়ে সব হিন্দুদের ভারতে চলে যেতে হয়েছে, ঝাং স্কুলের গণিত শিক্ষককেও। তাঁর সাথে দেখা করতে ভারতের পাঞ্জাবে গেলেন আবদুস সালাম। বৃদ্ধ হতদরিদ্র শিক্ষকের গলায় তিনি তাঁর নোবেল মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন।
          আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কারের অর্থমূল্য ছিল দুই লাখ ছেষট্টি হাজার সুইডিশ ক্রোনার যা ৬৬ হাজার আমেরিকান ডলারের সমমানের। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সাথে সাক্ষাতের সময় আবদুস সালাম প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, "আমি আমার পুরষ্কারের পুরোটাই পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য দিয়ে দিতে পারি একটি শর্তে।"
          "কী শর্ত?"
          "যদি পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানের শিক্ষাবৃত্তির জন্য এক মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে।"
          "আমি ব্যাপারটা নিয়ে আমার উপদেষ্টাদের সাথে কথা বলে আপনাকে কয়েকদিনের মধ্যে জানাবো।"


আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কারের চেক

কয়েকদিন পরে জানানো হলো আবদুস সালাম যত দেবেন পাকিস্তান সরকার ঠিক ততটাই দিতে রাজি আছেন। খুব রেগে গেলেন আবদুস সালাম। বললেন, "তাহলে আমার টাকা দিয়ে আমি নিজেই বৃত্তি দেবো। পাকিস্তান সরকারের সাহায্য দরকার নেই।"
           আবদুস সালাম তাই করলেন। একটা ফান্ড করে নোবেল পুরষ্কারের পুরোটাই সেই ফান্ডে দিয়ে দেন। প্রতি বছর সেই ফান্ড থেকে তরুণ (৩৫ বছরের কম বয়সী) পাকিস্তানি পদার্থবিজ্ঞানীদের 'আবদুস সালাম পুরষ্কার' দেয়া হয়।
          প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে আরো একটা ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন আবদুস সালাম, "আমি শুনেছি অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কর্মচারি কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। আপনি যদি তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন।"
          "অবশ্যই। আপনি আমাকে কমিশনে কর্মরত আহমদিয়াদের একটা তালিকা পাঠিয়ে দেবেন। আমি ব্যবস্থা করবো যেন আর কখনো তাদের ওপর কোন অনিয়ম না হয়।"
          প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের এমন আশ্বাস পেয়ে খুশি হয়ে আহমদিয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের তালিকা জোগাড় করে প্রেসিডেন্টের অফিসে পাঠিয়েছিলেন আবদুস সালাম। ক'দিন পর আবদুস সালাম খবর পেলেন তালিকাভুক্ত সকল আহমদিয়াকে পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
          নোবেল পুরষ্কার পাবার পর আবদুস সালাম বহুবার বলেছেন নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলমান হিসেবে তাঁর গৌরবের কথা। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককেও বলেছেন এই কথা। পাকিস্তান টিভিতে তা প্রচারিত হবার পর মৌলবাদীরা সেটা নিয়েও হৈ চৈ শুরু করলো। আবদুস সালাম নাকি আহমদিয়াদের মুসলমানত্ব ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন!
          নিজের দেশ পাকিস্তানে আবদুস সালামের সমালোচনা আর অপমান চলছে তো চলছেই। এর মধ্যেই ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয় আবদুস সালামকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি দেবার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবরোধ ভাংচুর করে এবং প্রফেসর সালামকে হত্যা করার হুমকি দেয়। ১৯৭৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন মিশরের আনোয়ার সাদাত। তিনি ছিলেন প্রথম মুসলমান নোবেল বিজয়ী। ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করে মিশরের মৌলবাদিরা। মিশরের প্রধানমন্ত্রী হয়েও মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা পাননি তিনি। তাই আবদুস সালামকে হত্যার হুমকিকে উপেক্ষা করা গেলো না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সালামের সম্মানে অনুষ্ঠানটি  সরিয়ে নিয়ে যায় পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের একটি রুমে।
          আবদুস সালাম পাকিস্তানকে পারমাণবিক বোমা বানাতে বাধা দিয়েছেন এই 'অপরাধে' সালামকে পাকিস্তানের 'গাদ্দার' বলে মিছিল করেছে উগ্রপন্থীরা। আবদুস সালাম যখন পাকিস্তানের বিজ্ঞান গবেষণার উন্নয়ন ঘটাচ্ছিলেন তখন ভুট্টো চেয়েছিলেন পাকিস্তানে পারমাণবিক বোমা বানাতে। কিন্তু আবদুস সালাম আর পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর উসমানি বোমা বানানোর প্রকল্প হাতে নিতে রাজি হননি।
          ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে সুদানের খার্তুম ইউনিভার্সিটি আবদুস সালামকে সম্মানসূচক পিএইচডি দেবার জন্য একটি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জানুয়ারির নয় তারিখে অনুষ্ঠানটি হবার কথা। অনুষ্ঠানের দুদিন আগে সৌদি রাষ্ট্রদূত সুদানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জাফের নামেরির সাথে দেখা করে অনুষ্ঠানটি বাতিল করার অনুরোধ জানান। সৌদি সরকার চান না যে 'আবদুস সালাম  আহমদিয়া'কে সম্মান জানানো হোক।
          সেদিনই প্রেসিডেন্ট নামেরি খার্তুম ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে ডেকে এনে সৌদি সরকারে আপত্তির কথা জানালেন। সুদানের সামরিক সরকার সৌদি আরবকে চটাতে চান না। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর প্রেসিডেন্টের কথায় সাথে সাথে সম্মতি দিলেন না। তিনি বললেন, "আমাকে একাডেমিক কাউন্সিলের সাথে কথা বলতে হবে।"
          সেদিন সন্ধ্যায় একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা বসলো। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আত্মসম্মান তখনো কিছুটা অবশিষ্ট ছিল। "সারা পৃথিবী যেখানে আবদুস সালামকে সম্মান জানাচ্ছে, একবারও কেউ আবদুস সালামের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না সেখানে আমরা মুসলমানরা এসব কী শুরু করেছি? সত্যিকারের গুণীর কদর করতে আমরা পিছপা হচ্ছি?"
          একাডেমিক কাউন্সিলের সবাই ঘোষণা দিলেন সমাবর্তন বাতিল করা হলে সবাই একযোগে পদত্যাগ করবেন। পরদিন সকালে খার্তুম ইউনিভার্সিটির সকল ডিন ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা সামরিক জান্তা নামেরির মুখোমুখি হয়ে তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন। সুদানের ইতিহাসে এটা একটা অভিনব ঘটনা। সামরিক একনায়কের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো না থাকাটাই স্বাভাবিক। জেনারেল নামেরি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাহস দেখে অবাক হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ব শাসনকে অসম্মান করলেন না। তিনি সমাবর্তন অনুষ্ঠান চালিয়ে নেবার অনুমতি দিলেন এবং নিজেও উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। 
          ১৯৮৮ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর সাথে দেখা করার জন্য দু'দিন ইসলামাবাদে অপেক্ষা করেছিলেন আবদুস সালাম। কিন্তু বেনজির ভুট্টো তাঁর সাথে দেখা করেননি। সালামের তখন মনে পড়েছিলো কয়েক বছর আগে তাঁর ভারত সফরের কথা। ১৯৮১ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী নিজের হাতে চা ঢেলে দিয়েছিলেন আবদুস সালামের পেয়ালায়। উন্নয়নশীল বিশ্বে বিজ্ঞানের উন্নয়নে দেশের রাজনীতিবিদরা যে কী ভূমিকা রাখেন তা আবদুস সালাম হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন।


পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ৭


নোবেল পুরষ্কার 


১৬৮০ সালে স্যার আইজাক নিউটন যখন মহাকর্ষ বলের সূত্র দিলেন- বলা যায় তখন থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়। মহাবিশ্বের সবকিছুই এক সূত্রে গাঁথা - এটা ভাবতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ঠিক কোন সূত্রে সবকিছু গাঁথা তা তো আমরা সঠিকভাবে জানি না। তবে জানার চেষ্টা চলছে সেই তখন থেকেই। প্রকৃতিতে বিদ্যমান বলগুলোর পারস্পরিক ঐক্যের সন্ধানে অবিরত কাজ করতে থাকেন অনেক বিজ্ঞানী।
          ১৮৩০ সালে অ্যাম্পিয়ার ও মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তিকে একত্রিত করে তড়িৎচৌম্বকএর ধারণা দেন। এরপর ১৮৬৬ সালে ম্যাক্সওয়েল প্রতিষ্ঠা করলেন তড়িৎ-চৌম্বক বল এর সূত্রাবলী। মাইকেল ফ্যারাডেই প্রথম চেষ্টা করেছিলেন মহাকর্ষ বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের মধ্যে সমন্বয় সাধনের। কিন্তু তিনি সফল হননি।
          উনবিংশ শতাব্দীর শেষে নিউক্লিয়ার বল আবিষ্কৃত হয় এক্স-রে, তেজষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি আবিষ্কারের পর। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উদ্ভবের পর পদার্থবিজ্ঞানে বিল্পব ঘটে গেলো। পারমাণবিক নিউক্লিয়াস আবিষ্কৃত হলো। পরমাণুর ইলেকট্রন এবং পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রন আবিষ্কৃত হলো। নিউক্লিয়ার তত্ত্ব থেকে সবল নিউক্লিয়ার বল (strong nuclear force) ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল (weak nuclear force) এবং তাদের ধর্ম সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানীরা কিছু কার্যকরী মডেল দাঁড় করাতে পেরেছেন। নিউক্লিয়ার বল মহাকর্ষ বলের চেয়ে অনেক অনেক অনেক গুণ (প্রায় 1040 গুণ) শক্তিশালী। কিন্তু তাদের ব্যাপ্তি খুব খুব খুব কম (10-15 মিটার থেকে 10-10 মিটার)। নিউক্লিয়াসের বাইরে এই বলের কোন অস্তিত্ব থাকে না। আর নিউক্লিয়াসের ব্যাস মাত্র 10-15 মিটার, অর্থাৎ এক মিটারের এক কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ। এই নিউক্লিয়ার বল নিউক্লিয়াসের ভেতর প্রোটন ও নিউট্রনকে একসাথে বেঁধে রাখে।
          ১৯১৬ সালে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কারের পর  আলবার্ট আইনস্টাইন চেষ্টা শুরু করেছিলেন মহাকর্ষ বলের সাথে অন্যান্য বলগুলোর ঐক্য খুঁজতে। ১৯১৬ থেকে ১৯৫৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত চেষ্টা করেও আইনস্টাইন সফল হননি। ১৯৩০ সালে এনরিকো ফার্মি যখন চেষ্টা করেন দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে- তখন আবদুস সালামের বয়স মাত্র চার বছর।
          আবদুস সালাম ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সালের মধ্যে মৌলিক বলগুলোকে একীভূত করার কয়েকটি দুরুহ ধাপ অতিক্রম করতে সমর্থ হলেন।
          পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের বিটা ক্ষয় (beta emission) ঘটায় দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় (weak interaction) নিউক্লিয়াসের চার্জহীন নিউট্রন পজিটিভ চার্জযুক্ত প্রোটনে রূপান্তরিত হয় আর পরমাণুর চার্জের সাম্যতা রক্ষার জন্য নিউক্লিয়াসে একটা নেগেটিভ চার্জের ইলেকট্রন তৈরি হয়ে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসে। চার্জহীন নিউট্রিনো নিউক্লিয়ার বলের আদানপ্রদান ঘটায়।
          দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের কারণেই নক্ষত্রগুলোতে শক্তি উৎপন্ন হয়। আমাদের প্রাকৃতিক মূল উৎস যে সূর্য, সেই সূর্যের ভেতর যে হাইড্রোজেন আছে তা ডিউটেরিয়ামে রূপান্তরিত হয় দুর্বল পারমাণবিক মিথষ্ক্রিয়ার ফলে। সোলার এনার্জি বা সৌরশক্তির মূল উৎসই হলো দুর্বল পারমাণবিক বল। ১৯৩৪ সালে ইটালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি দুর্বল পারমাণবিক বলের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নিউট্রিনোর ভূমিকা খুব একটা পরিষ্কার ছিল না।
          ১৯৫৬ সালে নিউট্রিনোর সিমেট্রি ব্রেকিং বা প্যারিটি ভায়োলেশান প্রমাণিত হবার পর দুর্বল পারমাণবিক বল ও তড়িৎচুম্বক বলের মধ্যে সমন্বয়ের একটা সঠিক সম্ভাবনার পথ পাওয়া গেলো। নিউট্রিনোর প্যারিটি ভায়োলেশানের ওপর গবেষণাপত্র লিখেও পাউলির হস্তক্ষেপে তা প্রকাশে অনেক দেরি করে ফেলেন আবদুস সালাম। ফলে প্যারিটি ভায়োলেশান আবিষ্কারের যথার্থ কৃতিত্ব দেয়া হয়নি আবদুস সালামকে। কিন্তু আবদুস সালাম হাল ছাড়েননি।
          ১৯৬০এর দশকে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের ওপর স্বতন্ত্রভাবে কাজ হয়েছে এম-আই-টি, হার্ভার্ড আর ইম্পেরিয়েল কলেজে। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারঅ্যাকশানের গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্বের সমন্বয়ে সাফল্য আসে এক দশকের মধ্যেই।
          গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্ব প্রথম দিয়েছিলেন এমি নোইথার ১৯২০ এর দশকে। এই তত্ত্ব মতে প্রকৃতিতে যেখানেই সাম্যতা কাজ করে, সেখানে অবশ্যই সাম্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদার্থ এবং শক্তির ধর্মের সংরক্ষণশীলতার নীতিও কার্যকর থাকে। যেমন, স্থান ও কালের সাম্যতা বজায় থাকলে শক্তি, ভরবেগ ও কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার নীতি বজায় থাকে।
          একটা উদাহরণ দিলে গেইজ সিমেট্রি বা গেইজ ইনভেরিয়েন্ট তত্ত্ব  বুঝতে সুবিধে হবে। মনে করা যাক আমাকে একটা পাহাড়ে উঠতে হবে ভূমি থেকে যার উচ্চতা একশ' মিটার। যদি পাহাড়টা সিমেট্রিক হয় অর্থাৎ সবদিক একই রকম হয় তাহলে পাহাড়টিতে আমি যেদিক দিয়েই উঠি না কেন আমার সমান শক্তি খরচ হবে। সেই ক্ষেত্রে আমি পাহাড়ের কোন্‌ দিক দিয়ে উঠেছি তাতে মোট শক্তি খরচের কোন তারতম্য হবে না। এখন পাহাড়টির সিমেট্রি যদি নষ্ট হয় তাহলে শক্তি-ব্যয়ের সমতাও থাকবে না। এখানে পাহাড়ে ওঠার জন্য যে শক্তি খরচ হচ্ছে তা মাধ্যাকর্ষণ বলের সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণটি গ্র্যাভিটেশান ফিল্ডের গেইজ সিমেট্রি।
          আবদুস সালাম দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল একত্রীকরণে গেইজ সিমেট্রি কাজে লাগালেন। এটা করতে গিয়ে আবদুস সালাম স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গ বা স্পনটেনিয়াসলি ব্রোকেন সিমেট্রির অবতারণা করেন। স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গের ব্যাপারটা অবশ্য আবদুস সালামের আবিষ্কার নয়। ১৯২৮ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ফেরোম্যাগনেটিজমের ক্ষেত্রে এই স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছিলেন।
          স্বাভাবিক অবস্থায় একটি চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই মেরু থাকে। মেরুর ভিন্নতার কারণে চুম্বক সিমেট্রিক নয়। কিন্তু একটি দন্ডচুম্বককে গরম করতে থাকলে তার চুম্বকত্ব কমতে থাকে এবং একটা তাপমাত্রার পর আর কোন চুম্বকত্ব অবশিষ্ট থাকে না। তখন দন্ডচুম্বকটির দুটো মেরুর ধর্মই একই রকম। তখন কোন্‌টা উত্তর মেরু কোন্‌টা দক্ষিণ মেরু তা আলাদা করা যায় না। তার মানে ওটা তখন সিমেট্রিক। তারপর যদি তাপমাত্রা কমতে থাকে একটা সময়ে চুম্বকত্ব ফিরে আসে এবং সাথে সাথে তার সাম্যতা ভেঙে যায়। এরকম ব্যাপারকেই স্বতস্ফূর্ত সাম্যতাভঙ্গ বলা হয়।
          ১৯৬৭ সালে সালাম তাঁর তত্ত্ব ইম্পেরিয়েল কলেজের লেকচারে প্রকাশ করেন। সেই বছর ডিসেম্বরে স্টিভেন ওয়েনবার্গের গবেষণাপত্র প্রথম চোখে পড়ে সালামের। সালাম দেখলেন ওয়েনবার্গও তাঁর মতোই চিন্তা করেছেন। ওয়েনবার্গ তাঁর গবেষণাপত্রে শুধু লেপটন সংক্রান্ত হিসেবই দেখিয়েছিলেন। আবদুস সালাম ভাবলেন আরো বিস্তৃত হিসেব করে তিনি গবেষণাপত্র লিখবেন।
          মৌলিক কণাগুলোর মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া বা ফান্ডামেন্টাল ইন্টারঅ্যাকশান ঘটে বোসন বিনিময়ের মাধ্যমে। তড়িৎচৌম্বক মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ পার্টিক্যাল বা বিনিময় কণা হলো ফোটন। পরমাণুর কোয়ার্ক মডেল আবিষ্কৃত হবার আগপর্যন্ত ইউকাওয়া মডেল ব্যবহার করা হতো। ইউকাওয়া মডেল অনুযায়ী প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে যে সবল মিথষ্ক্রিয়া ঘটে তার জন্য বিনিময় কণা বলে মনে করা হতো মেসনকে।
          কোয়ার্ক মডেল অনুসারে নিউক্লিয়াসের প্রোটন, নিউট্রন, মেসন কোয়ার্ক দ্বারা গঠিত। কোয়ার্কগুলো পরস্পর সবল পারমাণবিক বল দ্বারা আবদ্ধ। সুতরাং সবল বল প্রাথমিক ভাবে কাজ করে কোয়ার্কগুলোর মধ্যে। তারপর কাজ করে মেসনের মধ্যে। কোয়ার্কের মধ্যে যে মিথষ্ক্রিয়া হয় তার বিনিময় কণা হলো গ্লুয়ন। বিনিময় কণা হিসেবে গ্লুয়ন আর ফোটন প্রায় একই রকম। উভয়েরই স্পিন সংখ্যা ১, উভয়েই ভরহীন। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। তা হলো ফোটনের কোন চার্জ নেই, কিন্তু গ্লুয়নের চার্জ আছে।
          দুটো কোয়ার্ক পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় যখন পরস্পর কাছে আসতে থাকে অর্থাৎ তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমতে থাকে তখন তাদের পারস্পরিক আকর্ষণ বলও কমতে থাকে। আবার তারা যখন পরস্পর দূরে চলে যেতে চায় তখন তাদের মধ্যে আকর্ষণ বল বাড়তে থাকে। অন্যদিকে দুটো ইলেকট্রনের মধ্যে যে তড়িৎচৌম্বক বল কাজ করে সেই বল ইলেকট্রন দুটোর পারস্পরিক দূরত্ব বাড়ার সাথে কমতে থাকে। কুলম্বের সূত্র থেকে আমরা জানি এই বলের পরিমাণ তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের বিপরীত অনুপাতিক।
          যেহেতু সবল বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা হলো গ্লুয়ন - দুটো কোয়ার্কের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বল বেড়ে গেলে বলা যায় গ্লুয়নের পরিমাণ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কোয়ার্কগুলো যতই পরস্পর দূরে সরতে থাকে গ্লুয়নের পরিমাণ তথা সবল বলের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে দুটো কোয়ার্ককে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করতে হলে অসীম পরিমাণ শক্তির দরকার যা কার্যত অসম্ভব। তার মানে বিচ্ছিন্ন কোয়ার্ক পাওয়া অসম্ভব।
          অন্যদিকে তিনটি কোয়ার্ক বা কোয়ার্ক-অ্যান্টিকোয়ার্ক জোড়া যখন পরস্পরের কাছে আসে সবচেয়ে কম গ্লুয়ন বিনিময় হয়। তখন নিউক্লিয়ার বলের পরিমাণ হয় সবচেয়ে কম। এই অবস্থাকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় অ্যাসিম্পটটিক ফ্রিডম। অর্থাৎ পরস্পরের কাছাকাছি থাকলে কোয়ার্কগুলো মুক্ত কণার মতো কাজ করে।
          দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে সকল ফার্মিয়ন পরস্পরের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে। অর্থাৎ সমস্ত কোয়ার্ক ও লেপটনের মধ্যেই সংযোগ ঘটে যাদের স্পিন সংখ্যা ১/২। কিন্তু দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ব্যাপ্তিও সবল নিউক্লিয়ার বলের মতো নিউক্লিয়াসের বাইরে আসে না। দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এক ফ্লেভারের কোয়ার্ককে অন্য ফ্লেভারের কোয়ার্কে পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ নিউট্রন প্রোটনে পরিণত হতে পারে, আর প্রোটন নিউট্রনে।
          দুটো চার্জের মধ্যে তড়িৎচুম্বক বল বিনিময়ের জন্য দরকার হয় একটি ফোটন। আবদুস সালাম, স্টিভেন ওয়েনবার্গ আর শেলডন গ্ল্যাশো দেখালেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল বিনিময়ের জন্য দরকার হয় তিনটি চার্জ বহনকারী গ্লুয়ন W+, W- এবং Z0 বোসন। সবল নিউক্লিয়ার বলের জন্য দরকার হয় আটটি গ্লুয়ন।
          ১৯৬৮ সালে শ্যালডন গ্ল্যাশো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারণা দেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল আর তড়িৎচুম্বক বলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং তাদেরকে একই সূত্রে বেঁধে ফেলা সম্ভব। স্টিভেন ওয়েনবার্গ এবং আবদুস সালাম গ্ল্যাশোর ধারণার গাণিতিক সমীকরণ বের করেন।
          দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল মূলত একই রকম। কিন্তু তাদেরকে ভিন্ন মনে হয় কারণ দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের বিনিময় কণার ভর আছে, কিন্তু তড়িৎচৌম্বক বলের বিনিময় কণার ভর নেই। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই বল বিনিময় কণা হলো বোসন। তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা ফোটন যার স্থির ভর শূন্য। ফোটন আলোর বেগে চলে। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণার ভর আছে। ফলে এই বোসনগুলোর বেগ দূরত্বের সাথে বদলে যায়।
          দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়ায় চার্জের পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ চার্জহীন নিউট্রন ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন বা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রনে পরিণত হয়। ফলে যে কারেন্ট পাওয়া যায় তাকে চার্জড কারেন্ট বলা যায়। অন্যদিকে তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে চার্জের কোন পরিবর্তন ঘটে না। ফলে এক্ষেত্রে যে কারেন্ট পাওয়া যায় তাকে নিউট্রাল কারেন্ট বলা যায়।
          ওয়েনবার্গ ও সালামের তত্ত্ব প্রমাণ করে যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হলো বিনিময় কণা বোসনের ভরে। তড়িৎচৌম্বক বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা ফোটন ভরহীন, কিন্তু দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে বিনিময় কণা বোসনের ভর প্রোটনের ভরের প্রায় একশ' গুণ। দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের বোসনকে এ কারণে ভারী ফোটনও বলা হয়।
          আবদুস সালাম ও স্টিভেন ওয়েনবার্গ ধারণা দেন যে দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ক্ষেত্রে নিউট্রাল কারেন্ট ও চার্জড-কারেন্ট দুটোই পাওয়া যেতে পারে। দুটো মিথষ্ক্রিয়ার বল বিনিময় কণাগুলোকে একই পরিবারভুক্ত করে নাম দেয়া হয় W+, W- এবং Z0 বোসন। +, - এবং ০ যথাক্রমে ধনাত্মক, ঋণাত্মক এবং নিউট্রাল চার্জড বোসন বোঝায়। তিনটাকে এক সাথে ইন্টারমিডিয়েট ভেক্টর বোসন বলা হয়। এই ভেক্টর বোসনগুলো নিউক্লিয়াসের ভেতরে খুবই ভারী। আর সেখানেই দুর্বল মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। নিউক্লিয়াসের বাইরে ঘটে তড়িৎচৌম্বক মিথষ্ক্রিয়া।
          আই-সি-টি-পি'র কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশ করা তখনো সম্ভব হয়নি সালামের। তবে ১৯৬৮ সালের মে মাসে সুইডেনের গুটেনবার্গে 'নোবেল সিম্পোসজিয়াম'এ আবদুস সালাম তাঁর 'ইলেকট্রো-উইক ফোর্স'এর বর্ণনা দেন। নোবেল ফাউন্ডেশান প্রতি বছর নোবেল সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে। অনেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উপস্থিত থাকেন সেই সিম্পোজিয়ামে। আবদুস সালাম সিম্পোজিয়াম চলাকালীন সময়েও ভীষণ ব্যস্ত। কারণ ট্রিয়েস্তে তাঁর আই-সি-টি-পি'র নতুন ভবন তৈরি হয়ে গেছে। জুন মাসে নতুন ভবনের উদ্বোধন। সিম্পোজিয়াম থেকেও তাঁকে ইতালিতে যাওয়া আসা করতে হচ্ছে।
          সিম্পোজিয়ামে আবদুস সালামের বক্তৃতাকে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। কারণ অনেকে বুঝতেই পারেননি তিনি আসলে কী বলতে চাচ্ছিলেন। এমনকি সিম্পোজিয়ামের আয়োজক মারি গেল-মান তাঁর সমাপনী বক্তৃতায় সালামের প্রবন্ধের উল্লেখ পর্যন্ত করেননি।
          তারপর কেটে গেলো আরো তিন বছর। ১৯৭১ সালে আমস্টার্ডামের পার্টিক্যাল ফিজিক্স কনফারেন্সে আবদুস সালামের বক্তৃতার পর তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী টি-হুফ্‌টের বক্তৃতা শুনে অবাক হয়ে গেলেন সালাম সহ কনফারেন্সের সবাই। টি-হুফ্‌ট তখন মাত্র পিএইচডি'র ছাত্র। দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল একত্রীকরণের একটি কার্যকরী পদ্ধতির বর্ণনা দিয়েছেন টি-হুফ্‌ট। সালাম দেখলেন তাঁর তত্ত্ব কাজ করতে শুরু করেছে।
          ১৯৭৩ সালে যোগেশ পতির সাথে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে কোয়ার্ক-লেপটনের একত্রীকরণের ধারণা প্রকাশ করেন আবদুস সালাম। পরে গ্র্যান্ড ইউনিফাইড থিওরি (GUT) আলাদা একটা গবেষণা-ক্ষেত্রই হয়ে ওঠে। যোগেশ পতি ছিলেন ভারতের উড়িষ্যার মানুষ। আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পতি ছুটিতে ট্রিয়েস্তে এসে আবদুস সালামের সাথে গবেষণায় যোগ দেন। ১৯৭৪ সালেও যোগেশ পতির সাথে প্রকাশিত হয় আবদুস সালামের বিখ্যাত পেপার। প্রফেসর সালাম কোয়ান্টাম নাম্বার কালার কোয়ার্ক হিসেবে লেপটনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন তাতে। একই বছর জন স্ট্রাথডির সাথে সুপারসিমেট্রিক কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির ওপর তাঁর বিখ্যাত পেপার প্রকাশিত হয়।
          পরীক্ষাগারে নিউট্রাল কারেন্ট আর ভারী বোসন পাওয়া গেলেই সালাম-ওয়েনবার্গ-গ্ল্যাশোর তত্ত্ব প্রমাণিত হয়ে যাবে। আবদুস সালাম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না তাঁকে। ১৯৭৩ সালে সার্নের পরীক্ষাগারে নিউক্লিয়াস ও নিউট্রিনোর মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়ে কোন ধরনের চার্জ বিনিময় ছাড়াই দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়া ঘটানো সম্ভব হলো। নিউট্রাল কারেন্টের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলো। ফার্মি ল্যাবেও একই ধরনের রেজাল্ট পাওয়া গেলো। প্রফেসর সালামের তত্ত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হলো।
          ১৯৭৮ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রন এক্সিলারেটরে (SLAC) ইলেট্রন ও ডিউটেরনের মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়েও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং তড়িৎচালক বলের সমন্বয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।
          আবদুস সালাম যে নোবেল পুরষ্কার পাবেন সে ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল। তাঁর শিক্ষক ও নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী পল ডিরাক বেশ কয়েকবার আবদুস সালামের নাম প্রস্তাব করেছেন নোবেল কমিটির দেয়া নমিনেশানে। নোবেল পুরষ্কারের নিয়ম অনুযায়ী নমিনেশান গোপন থাকার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীমহলে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক কিছুই জানা হয়ে যায়। আবদুস সালামের কাছে নোবেল পুরষ্কারের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ তিনি জানেন উন্নয়নশীল বিশ্বে নোবেল পুরষ্কারের মর্যাদা তুলনাহীন। ইতোমধ্যেই তিনি অনেক মর্যাদাপূর্ণ পুরষ্কার পেয়ে গেছেন।  ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন অ্যাটম্‌স ফর পিস মেডেল। ১৯৭১ সালে রবার্ট ওপেনহেইমার মেমোরিয়্যাল মেডেল, ১৯৭৭ সালে লন্ডন ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্সের গাথিরি মেডেল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক, ১৯৭৮ সালে রোমের মেট্রেউটিক মেডেল ও রয়েল সোসাইটি অব লন্ডনের রয়েল মেডেল, ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর আইনস্টাইন পদক। 
          অবশেষে ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার। আবদুস সালাম তখন লন্ডনে। দুপুর বারোটায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির পরিচালকের অফিস থেকে ফোন পেলেন আবদুস সালাম। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্টিভেন ওয়েনবার্গ ও শেলডন গ্ল্যাশোর সাথে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন আবদুস সালাম।
          মৌলিক কণার মধ্যে দুর্বল পারমাণবিক বল ও তড়িৎচৌম্বক বলের সমন্বয়ে দুর্বল নিউট্রাল কারেন্টের ধারণা আবিষ্কারের কৃতিত্বও তাঁদের। স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে সালাম, ওয়েনবার্গ এবং গ্ল্যাশো মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মৌলিক অবদান রেখেছেন। প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে তাঁরা দুইটির সমন্বয় সাধন করেছেন। হাই-এনার্জি ফিজিক্সের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কেন্দ্রে আছে সালাম-ওয়েনবার্গের ইলেকট্রো-উইক ফোর্স। পুরষ্কারের ইতিহাসে আরেকটি নতুন মাইলফলক স্থাপিত হলো। আবদুস সালাম হলেন নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলমান বিজ্ঞানী।


নোবেল পুরষ্কার পাবার পর সাংবাদিকদের সাথে আবদুস সালাম


পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ৬




আই-সি-টি-পি
(International Centre for Theoretical Physics)

প্রফেসর আবদুস সালাম পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী। নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন বলেই যে তিনি স্মরণীয় তা নয়। অনেক পদার্থবিজ্ঞানীই নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এ পর্যন্ত। কিন্তু তাঁদের অনেকেরই নাম পর্যন্ত আমরা মনে করতে পারি না। কিন্তু আবদুস সালাম ছিলেন ব্যতিক্রমী একজন। বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য তিনি যা করেছেন তার তুলনা তিনি নিজে। বাংলাদেশ পাকিস্তান ভারত নেপাল বা শ্রীলংকার মতো উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানের উন্নয়নে আবদুস সালামের মতো এত সাংগঠনিক কাজ আর কোন বিজ্ঞানী করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
          একজন লেখক যখন লেখেন - একাই লেখেন। শিল্পী যখন ছবি আঁকেন, একাই আঁকেন। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী যখন গবেষণা করেন, একাকী করতে পারেন না। বিজ্ঞান একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হলে তার খবর বিজ্ঞানের সেই শাখায় যাঁরা কাজ করেন তাঁদের রাখতে হয়। উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীরা উন্নত দেশের বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কারের খবর ঠিকমতো রাখতে পারেন না। উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে আসার কোন সুযোগ পান না উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীরা। প্রত্যক্ষ সুযোগ মানে সরাসরি আলোচনা করে গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া- সে তো দূরের কথা; পরোক্ষভাবেও কাজ করার সুযোগ পান না। পরোক্ষ মানে - গবেষণাপত্র পড়ে, সেমিনার বা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বক্তৃতা শুনে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানার সুযোগও তেমন হয় না তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞানীদের।
          প্রফেসর সালাম ভাবলেন উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানীদের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে এমন একটা গবেষণাকেন্দ্র দরকার যেখানে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাবেন ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা, উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞান সাধকেরা।
          সালামের মতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানের মধ্যে বিদ্যমান বিশাল গুণগত পার্থক্যের কারণ বিবিধ। সারা পৃথিবীর মাত্র দুই থেকে তিন ভাগ মানুষ বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়। উন্নয়নশীল দেশ তাদের এই দুই থেকে তিন শতাংশ গবেষক তৈরির জন্য কী করছে? সোজা উত্তর হলো- কিছুই করছে না। করতে পারছে না সংগতি নেই বলে। এটাই আশ্চর্যের যে এত কম চেষ্টা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশে এখনো কিছু মেধাবী মানুষের জন্ম হয় যারা নিজের চেষ্টায় বড় হয়।  
          উন্নয়নশীল বিশ্বে বিজ্ঞানী তৈরি না হবার প্রধান কারণগুলো হলো:
·      উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার মান খুবই খারাপ।
·      তার মধ্যেও যারা ভালো তারা চলে যায় সিভিল সার্ভিসের প্রশাসনে (আই-সি-এস, বি-সি-এস, সি-এস-পি ইত্যাদি)।
·      গবেষণার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই বললেই চলে।
·      গবেষক নেই বলেই গবেষক তৈরি করার সুযোগ নেই।
·      প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে উন্নত মানের বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হয়তো গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে গবেষণা শিক্ষা দেয়া হবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না।
·      বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হয় না বললেই চলে। (আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হয়। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষণা হয় না। তারা একটা গবেষণাপত্র লেখা তো দূরের কথা, পড়েও দেখে না কোনদিন।)
·      উন্নয়নশীল বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষা পাসের ব্যাপারটাই বেশি গুরুত্ব পায়।
প্রতিভা বিত্ত-নিরপেক্ষ নয়। অর্থাৎ ধনীদেশের প্রতিভাবান শিক্ষার্থী আর দরিদ্রদেশের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেক দূরত্ব। ধনীদের সামান্য মেধা থাকলে সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মেধার বিকাশের সমস্ত সুযোগ থাকে। কিন্তু দরিদ্র দেশে মেধা থাকলেও মেধা বিকাশের সুযোগ থাকে না বললেই চলে। তাছাড়া দরিদ্রদেশের মেধাবীদের ওপর প্রচুর সামাজিক দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়। দরিদ্রদেশের একজন মেধাবী গবেষককে নিজের গবেষণার পাশাপাশি দেশের জন্য, সমাজের জন্যেও অনেককিছু করতে হয় যার ফলে গবেষণার ক্ষতি হয়। অন্যদিকে ধনী দেশের বিজ্ঞানীকে দেশের জন্য আলাদা করে কিছু চিন্তা করতে হয় না। ধনী ও দরিদ্রদেশের মেধার এই পার্থক্য ঘুচে যাওয়া দরকার।
          উন্নতবিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের মেধাবীদের জন্য বিভিন্ন রকমের বৃত্তি দিয়ে সহায়তা যে করছে না তা নয়। কিন্তু তাতে যেটা হচ্ছে তা হলো মেধা পাচার। উন্নয়নশীল দেশের মেধা যদি আমরা উন্নয়নশীল দেশে না রাখতে পারি তাহলে অবস্থার উন্নতি হবে কীভাবে? মেধা বিকাশের সুযোগ তৈরি না করে আমরা তো জোর করে কাউকে ধরে রাখতে পারবো না।
          তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার কথা ধরা যাক। গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য কোন গবেষণাগারেরে দরকার হয় না, দামী কোন যন্ত্রপাতিরও দরকার হয় না। ফলে উন্নয়নশীল দেশ, যেমন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, লেবানন, তুরস্ক, আর্জেন্টিনার অনেক মেধাবীই গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার দিকে ঝোঁকে। মেধার জোরে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পায় এবং গবেষণার জন্য যায়। উন্নত প্রশিক্ষণ নেবার পর অনেক স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসে নিজের দেশে।
          নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে কী হয়? শুরুতে মহা উৎসাহে গবেষণার আয়োজন করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। ক'দিন পরেই গবেষক বুঝতে পারেন তাঁর দরকারি বই নেই, গবেষণাপত্র পাওয়ার সুযোগ নেই, বৈজ্ঞানিক আলোচনা করার জন্যে কোন রিসার্চ গ্রুপ নেই, কাজের সুযোগ বা সমালোচনা কিছুই নেই। এভাবে চলতে থাকলে নতুন আইডিয়া আসে অনেক ধীরগতিতে। নতুন আইডিয়া এলেও তা রক্ষা করা বা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। এই মানুষগুলো নিজের দেশেই ক্রমশ একা হয়ে যায়। ফলে তাদের গবেষণা ছাড়তে হয়। আর গবেষণা রাখতে চাইলে তাদের দেশ ছাড়তে হয়।
          বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিচ্ছিন্নতা বা একাকিত্ব মানেই গবেষকের মৃত্যু। চিলি আর্জেন্টিনা পাকিস্তান বাংলাদেশ সবখানে এখনো একই অবস্থা। এই একাকিত্বের বাধা দূর করার জন্য আবদুস সালাম আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (International Centre for Theoretical Physics - ICTP) প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।
          ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (IAEA) সহযোগিতায় আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠা করেছেন আবদুস সালাম বহু বছরের পরিশ্রম ও নিরলস চেষ্টায়। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত অক্লান্তভাবে লবি করেছেন প্রফেসর সালাম এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য।  
          ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে আই-এ-ই-এ'র বার্ষিক সাধারণ সভায় পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন প্রফেসর সালাম। প্রস্তাবটি আলোচনার জন্য গৃহীত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স সহ অনেক উন্নতদেশই এই সেন্টার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ওখানেই থেমে থাকে সবকিছু। প্রকল্প আর এগোয় না। তারপর ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৩ প্রতিবছরই কমিশনের বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রস্তাবটির অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা করার দাবি করেছেন আবদুস সালাম। তাঁর চেষ্টায় ধীরে ধীরে অগ্রগতি হয়েছে আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে।
          আবদুস সালাম নিজেই বর্ণনা করেছেন ১৯৬২ সালের কমিশনের সভায় কী হয়েছিল। আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা শুরু হলো। দু'বছর আগে প্রস্তাবের শুরুতে ইউরোপ আমেরিকার প্রায় সব দেশই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সবাই সহযোগিতা করবে। আই-এ-ই-এ'র আমেরিকান প্রতিনিধি ডক্টর হ্যারি স্মিথ আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, "এসময় আরেকটি ফিজিক্স সেন্টার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।"
          চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সব দেশের প্রতিনিধি আমেরিকার সাথে একমত হলেন। বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ড সব দেশই আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে মত দিলো। ইতালি ছাড়া ইউরোপের সব দেশই বিরোধিতা করলো এই ইনস্টিটিউট গড়ার ব্যাপারে।
          জার্মানির প্রতিনিধি বললেন, "১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট গড়ার প্রাথমিক প্রস্তাবটি আমি সমর্থন করেছিলাম ঠিকই। ওটা ছিল আমার ব্যক্তিগত সমর্থন। এখনো ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রস্তাবটা সমর্থন করি। আমি বিশ্বাস করি যে একদিন এই সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হবে, ভালোভাবে কাজও করবে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে জার্মানির পক্ষে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করা সম্ভব নয়।"
          অস্ট্রেলিয়ান প্রতিনিধি খুব বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, "থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স হলো বিজ্ঞানের রোল্‌স রয়েস। উন্নয়নশীল দেশগুলো রোল্‌স রয়েস নিয়ে কী করবে? তাদের দরকার গরুর গাড়ির।"
          এরপর দরিদ্র সমর্থকগোষ্ঠীর দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একে একে সমর্থন জানাতে শুরু করলেন। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফিলিপাইনসহ ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেন। ১৮টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকলো। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিবেচনার বিল পাস হলো।  কিন্তু সেন্টারটি কোথায় হবে, খরচ আসবে কোত্থেকে সে ব্যাপারে তেমন কোন সিদ্ধান্ত হলো না। আই-এ-ই-এ'র গভর্নরস বোর্ডের সম্মতি ছাড়া কোন কিছু করা সম্ভব নয়। গভর্নর্‌স বোর্ড সিদ্ধান্তটি প্রায় ধামাচাপা দিয়ে ফেলেছিলো - কিন্তু সম্ভব হলো না বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এর চেয়ারম্যান ডক্টর ইশরাত হোসেন উসমানির হস্তক্ষেপে।
          আই-এ-ই-এ সেন্টার গড়ার জন্য মাত্র ৫৫ হাজার ডলার দিতে রাজি হলো। আবদুস সালাম বুঝলেন এটাও এক ধরনের কূটচাল। সবাই জানে যে মাত্র ৫৫ হাজার ডলার দিয়ে এরকম একটা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান কয়েক মাসও চালানো সম্ভব নয়। আই-এ-ই-এ দেখতে চায় যে কেন্দ্রটি চালু হবার সাথে সাথেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাহলে আর কেউ ভবিষ্যতে এরকম চেষ্টা করবে না।
          আই-এ-ই-এ'র প্রভাবশালী সদস্যদেশগুলো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি দেখাতে গিয়ে বললো, যে মগজ পাচার ঠেকানোর জন্য এই কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে, দেখা যাবে এই কেন্দ্রই মগজ পাচার বাড়িয়ে দেবে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে সবাই এই কেন্দ্রে এসে উপস্থিত হবে, তারপর আর দেশে ফিরতে চাইবে না। কিন্তু সালাম জানেন তাঁরা ইচ্ছে করেই তাঁর প্রস্তাবের বিকৃত অর্থ করছে। সালামের প্রস্তাবে আছে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা এই সেন্টারে গিয়ে ছয় মাস পর্যন্ত থাকতে পারবেন গবেষণার জন্য। উন্নত বিশ্বের সাথে উন্নয়নশীল বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক সেতু তৈরি করাই এই কেন্দ্রের উদ্দেশ্য।
          ইউরোপিয়ানদের গড়িমসি অবস্থা দেখে আবদুস সালাম পাকিস্তান সরকারকে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন এই কেন্দ্র গড়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য। পাকিস্তানের মাটিতে যদি এই গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা যায় বিজ্ঞান গবেষণায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটি। আবদুস সালাম প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিশ্বাসভাজন। পাকিস্তান বিজ্ঞান কমিশনের সভায় তিনি এই প্রস্তাব পাঠালেন। বিজ্ঞান কমিশনে পাশ হয়ে প্রস্তাবের ফাইল গেলো অর্থমন্ত্রীর টেবিলে। পাকিস্তানের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবনার ফাইলে নোট লিখলেন, "পাকিস্তানের মাটিতে আন্তর্জাতিক কেন্দ্র করার উদ্দেশ্য হচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ধরনের আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এদেশে এরকম কোন কেন্দ্রের দরকার নেই। এরা গবেষণা কেন্দ্রের নামে  আসলে একটা হোটেল বানাতে চায় যেন উন্নত দেশের বিজ্ঞানীরা এদেশে এসে আরাম-আয়েস করতে পারে। আমাদের টাকায় আমরা তা করতে দিতে পারি না।"
          ১৯৬২ সালের জুন মাসে আই-এ-ই-এর বোর্ড অব ডিরেক্টর্‌স সিদ্ধান্ত দিলো যে সেন্টার হতে পারে। হতে পারে মানে কিন্তু হয়ে যাওয়া নয়। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত না হলে এ প্রতিষ্ঠান গড়া সম্ভব নয়। বোর্ডের সদস্যদের ঐকমত্য অর্জনের জন্য প্রফেসর সালাম একটি অন্যরকম কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি আই-এ-ই-এ'র পরিচালক ডক্টর সিগভার্ড একলুন্ডকে রাজি করালেন একটা পরীক্ষামূলক কনফারেন্সের আয়োজন করতে - যাতে দেখা যাবে ভবিষ্যতে আই-সি-টি-পি প্রতিষ্ঠিত হলে তা কীভাবে কাজ করবে।


আই-এ-ই-এ'র ডিরেক্টর সিগভার্ড একলুন্ড ও আবদুস সালাম

ইতালির ট্রিয়েস্তের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর পল বুডিনিক এগিয়ে এলেন আবদুস সালামকে সাহায্য করার জন্য। তিনি ইতালির সরকার ও ট্রিয়েস্তের স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করলেন ট্রিয়েস্তে কনফারেন্সটি আয়োজন করার ব্যাপারে। মাস খানেকের মধ্যেই তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের সম্মেলন হলো ট্রিয়েস্তে। জুলিয়াস সুইঙ্গার, ইউজিন উইগনার প্রমুখ বিজ্ঞানী সেই সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। সম্মেলনের সাফল্যে উপস্থিত সব বিজ্ঞানীই আই-এ-ই-এ'র ডিরেক্টরদের অনুরোধ করলেন যেন প্রস্তাবিত সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

          আই-এ-ই-এ'র ডিরেক্টর ডক্টর একলুন্ড ১৯৬৩ সালের মে মাসে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করলেন সেন্টার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। কমিটির সদস্যরা ছিলেন আমেরিকান প্রফেসর রবার্ট মারশ্যাক, ব্রাজিলের প্রফেসর জে জে টিয়মনো এবং বেলজিয়ামের প্রফেসর ভ্যান হোভ। প্রফেসর সালামের গবেষণা, কর্মতৎপরতা, পান্ডিত্য আর প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী মাত্রেই জানেন। কমিটির তিন সদস্যের একমত হতে সময় লাগলো না। তাঁরা সুপারিশ করলেন যেন যত দ্রুত সম্ভব সেন্টার গড়ার কাজ শুরু করা হয়।
          আই-এ-ই-এ'র কাছ থেকে আর কোন বাধা থাকলো না। কিন্তু আই-এ-ই-এ সেন্টারের পুরো খরচ বহন করতে রাজি হলো না। তারা প্রস্তাব করলো আই-এ-ই-এ'র সদস্যদেশের মধ্য থেকে চাঁদা তুলে সেন্টার গড়ে তোলার। ডেনমার্ক এগিয়ে এলো কোপেনহেগেনে সেন্টার গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়ে। তুরস্ক এগিয়ে এলো আংকারাতে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়ে। ইতালির প্রস্তাবটা সবচেয়ে ভালো। ইতালির ট্রিয়েস্তে সেন্টার গড়ার জন্য জায়গা ছাড়াও তিন লাখ ডলার দিতে রাজি ইতালি সরকার।      যার পেছনে সক্রিয় ছিল সালামের ইটালিয়ান বন্ধু প্রফেসর পল বুডিনিক।
          ১৯৬৪ সালে আই-সি-টি-পি স্থাপিত হলো ইতালির ট্রিয়েস্তে যুগোস্লাভিয়ার সীমান্তের কাছে এড্রিয়াটিক সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের উপর। এক সময়ের রোমান কলোনি ট্রিয়েস্ট এখন বহুসংস্কৃতির মিলনস্থল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটি। উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানীরা প্রফেসর আবদুস সালামের কাছে অবশ্যই কৃতজ্ঞ ট্রিয়েস্তে এই ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স গড়ে তোলার জন্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত প্রফেসর আবদুস সালাম এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। প্রফেসর পল বুডিনিক হলেন সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর।
          ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে আই-সি-টি-পি'র কাজ শুরু হয়। ট্রিয়েস্তের পিয়াজা ওবারডেনের একটা অস্থায়ী ভবন থেকে শুরু হয় সেন্টারের পথ চলা। উদ্বোধন উপলক্ষে জলি হোটেলে একটি কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, জাপান, নরওয়ে, পাকিস্তান, ঘানা, চিলি সব দেশ থেকেই পদার্থবিজ্ঞানীরা যোগ দেন এই সম্মেলনে।
         ১৯৬৪ সালে আই-সি-টি-পি'র পরিচালকের দায়িত্ব নেবার পর আবদুস সালামের কাজের পরিধি বেড়ে গেলো আরো বহুগুণ। এমনিতেই তিনি ইম্পেরিয়েল কলেজ, জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিটি, পাকিস্তানের সরকারের বৈজ্ঞানিক প্রকল্প ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত খাটছেন। এর মধ্যেই চলছে তাঁর মৌলিক গবেষণার কাজ। নতুন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের এই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করানোর জন্য তাঁর সময় দরকার।
          ইম্পেরিয়েল কলেজ থেকে এক বছরের ছুটি নিলেন আবদুস সালাম। ট্রিয়েস্তের একটি বদ্ধ ঘরে বসে দিনরাত কাজ করতে করতে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন আবদুস সালাম। প্রায় সারাক্ষণই জ্বর থাকছে শরীরে। পরীক্ষা করে দেখা গেলো তাঁর টনসিলাইটিস। লন্ডনে ফিরে তাঁর টনসিল অপারেশান করানো হলো।
          
আই-সি-টি-পির প্রথম অফিস


          আই-সি-টি-পি'র কাজ শুরু হবার মাত্র আট নয় মাসের মধ্যেই সারা পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানীদের মনযোগ আকর্ষণ করলো ফিজিক্স সেন্টার। রবার্ট ওপেনহেইমার খুশি হয়ে আবদুস সালামকে চিঠি লিখে প্রশংসা জানালেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানীরা আসতে শুরু করলেন ইতালিতে। আস্তে আস্তে তাঁদের প্রকাশনা আলোর মুখ দেখতে শুরু করলো। এক বছরের মধ্যেই উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হবার পথ অনেকটাই তৈরি হয়ে গেলো।


আই-সি-টি-পি'র নতুন ভবনের চাবি দেখাচ্ছেন আবদুস সালাম


১৯৬৮ সালের মে মাসের মধ্যে সেন্টারের নতুন ভবন তৈরি হয়ে গেলো। পরের মাসব্যাপী একটা সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে নতুন ভবনে সেন্টারের কাজ শুরু হলো। সিম্পোজিয়ামে থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের নামকরা সব বিজ্ঞানীরা উপস্থিত ছিলেন। সারা পৃথিবী থেকে পার্টিক্যাল ফিজিক্স, কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স, কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, রিলেটিভিটি, প্লাজমা ফিজিক্স, কসমোলজি, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, বায়োফিজিক্সের  তিনশ'রও বেশি শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী এই সিম্পোজিয়ামে যোগ দেন। পুরো চার সপ্তাহ ধরে উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীদের সাথে উন্নত দেশের বিজ্ঞানীদের আলোচনা, বক্তৃতা, সংলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ ঘটে। সিম্পোজিয়ামের সন্ধ্যাবেলা বসতো 'গ্র্যান্ড মাস্টার্স অব মডার্ন ফিজিক্স' সেশান। সেখানে প্রফেসর ডিরাক, হাইজেনবার্গ, হ্যান্স বেথেসহ পদার্থবিজ্ঞানের আরো সব গ্র্যান্ড মাস্টাররা।
         শুরুতে আই-সি-টি-পি'র তহবিলে ছিল মাত্র তিন লাখ সাতাত্তর হাজার ডলার। যার মধ্যে ৫৫ হাজার ডলার দিয়েছিল আই-এ-ই-এ, ইতালি সরকার তিন লাখ আর ইউনেস্কো দিয়েছিল ২২ হাজার ডলার। আবদুস সালাম ফোর্ড ফাউন্ডেশান ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির কাছ থেকে আরো কিছু অর্থ সাহায্য আদায় করেন। এগুলো দিয়ে ১৯৬৯ সালে তিনি সেন্টারকে একটি বহুমুখী গবেষণা-কেন্দ্রে পরিণত করেন। মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞান (elementary particle physics), নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান (nuclear physics), প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞান (plasma physics), ও কন্ডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স (condensed matter physics) এই চারটি প্রধান শাখায় কাজ আরম্ভ হলো।
        আই-সি-টি-পি'র পরিচালক পদে কাজ করার জন্য আই-এ-ই-এ'র সাথে আবদুস সালামের চুক্তি হলো। বছরে চার মাস থাকবেন লন্ডনে - ইম্পেরিয়েল কলেজে, বাকি আট মাস ট্রিয়েস্তে। পরিচালক হিসেবে আবদুস সালামের বেতন ঠিক হলো মাসে ২২৭০ ডলার যার জন্য তাঁকে কোন আয়কর দিতে হবে না। লন্ডন থেকে ট্রিয়েস্তের আসা-যাওয়ার বিমানভাড়াও আই-এ-ই-এ দেবে। 
          আবদুস সালাম প্রশাসনিক কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে এবং লালফিতা মুক্ত রাখতে পছন্দ করতেন। দিনের প্রথম ভাগ তিনি নিজের গবেষণা কাজে লাগাতেন, আর দ্বিতীয় ভাগে করতেন প্রশাসনিক কাজ। একটা বড় মাপের আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের যে কী পরিমাণ প্রশাসনিক কাজ করতে হয় সে ব্যাপারে আবদুস সালামের ধারণা ছিল। পাকিস্তানের সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে তিনি অনেক কাজ দেখেছেন। কিন্তু সেখানে যে লাল-ফিতার দৌরাত্ম্য তিনি দেখেছেন তা যেন গবেষণা কেন্দ্রে না ঘটে সে ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট।


আই-সি-টি-পির অফিসে আবদুস সালাম

প্রশাসন চালানোর ব্যাপারে তিনি রবার্ট ওপেনহেইমারকে আদর্শ মানেন। তিনি দেখেছেন কী অসাধারণ দক্ষতায় প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ চালাচ্ছেন ওপেনহেইমার। প্রফেসর সালাম তাঁর সেন্টারে প্রশাসন চালাতে শুরু করলেন- প্রশাসক হিসেবে নয়, বিজ্ঞানী হিসেবে। তিনি মনে করেন, "যদি কোন রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মনে করেন যে প্রশাসনিক কাজ করতে করতে তিনি বিজ্ঞানী হতে পারছেন না, তাহলে বুঝতে হবে তিনি কোন কাজের নন। একজন বোকাও প্রশাসন চালাতে পারে। যে বিজ্ঞানী প্রশাসনিক পদে আছেন তাঁর জানা উচিত যে বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের কারণে বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যেই তাঁকে এই পদে বসানো হয়েছে, বিজ্ঞান ছেড়ে দেয়ার জন্য নয়।" কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী প্রশাসনে এসে ভুলে যান সব। তখন তাঁরা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান নিজের পদ ধরে রাখার জন্য। আবদুস সালাম সেই দলের ছিলেন না।

          ১৯৭০ সালে ইউনেস্কো আই-সি-টি-পি'র পার্টনার হয় আই-এ-ই-এ'র মতো সমান অংশীদারিত্বে। গবেষণা কেন্দ্রের আরো প্রসার ঘটানো সম্ভব হলো তাতে। গণিত, আবহাওয়া বিজ্ঞান, সামুদ্রিক বিজ্ঞান, লেসার ফিজিক্স, এনার্জি ফিজিক্স, ফিজিক্স টিচিং ইত্যাদি সব বিষয়ে গবেষণা চালু হলো পুরোদমে।
          ১৯৭২ সালে আবদুস সালাম কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সব শীর্ষবিজ্ঞানীদের নিয়ে আই-সি-টি-পিতে আয়োজন করলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স সিম্পোজিয়ামের। হাইজেনবার্গ, ডিরাক, উইগনার, পিয়ের্লস- সবাই উপস্থিত ছিলেন এই সিম্পোজিয়ামে। উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য এটা যে কতবড় সুযোগ।
          ১৯৭৯ সালে আবদুস সালামের নোবেল পুরষ্কার পাবার পর আই-সি-টি-পি'র সম্মান মর্যাদা এবং সামর্থ্য বেড়ে গেলো বহুগুণ। সেন্টারের তহবিল নিয়ে তেমন কোন সমস্যা নেই কারণ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন আই-সি-টি-পিতে নিয়মিত অনুদান দিতে শুরু করেছে। আরো অনেক বৃত্তি, বিভাগ এবং গবেষণা প্রকল্প চালু হলো এই গবেষণা কেন্দ্রে। সময়ের সাথে সাথে কেন্দ্রের গবেষণার ব্যপ্তি বেড়েছে অনেক। উন্নয়নশীল বিশ্বের বিজ্ঞানীদের জন্য নিয়মিতভাবে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে 'আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স'। 


Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts