Showing posts with label স্মরণ. Show all posts
Showing posts with label স্মরণ. Show all posts

Monday, 31 March 2025

বাবা - ৭

 


আমি তখন ক্লাস থ্রি। এসএসসি পাস করার পর দিদি কলেজে পড়ার জন্য শহরে চলে গেল। আমার আনন্দ এবং বিপদ একসাথে হাজির হলো। সে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া মানে আমার মুক্তির আনন্দ। সারাক্ষণ তার খবরদারি থেকে মুক্তি।  ইচ্ছেমতো পুকুরে দাপাদাপি করার স্বাধীনতা, স্কুল ছুটির পর সোজা বাড়িতে না এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলে ধুলোকাদায় মাখামাখি হবার স্বাধীনতা। প্রতিবেশীদের নালিশ শুনে যার দোষই হোক, আমার পিঠেই দমাদম কিল মারতো সে। সেইসব নালিশকারী প্রতিবেশীদের লাউগাছ-সীমগাছ এবার কীভাবে আস্ত থাকে দেখবো। কিন্তু বিপদ দেখা দিল অন্যদিকে। দিদি চলে যাবার দুদিনের মধ্যেই আমার পাঁচ বছরের বড় দাদা যে আমার দন্ডমুন্ডের মালিক হয়ে উঠবে সেটা জানা ছিল না। আগে দুইভাই দিদির শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে একজোট হতাম। এখন দিদি চলে যাবার পর দাদাই আমাকে শাসন করার ক্ষমতা দখল করল। আগে দাদার অগোচরে দিদির কাছে তার নামে নালিশ করে তাকেও কত মার যে খাইয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দাদা আমার ষড়যন্ত্রের কথা জানতো না বা জানলেও মনে রাখেনি। কিন্তু আমার ভুল ভাঙতে দুদিনও লাগলো না। দিদির অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারলাম এতদিন সে শাসন করলেও দাদার অপশাসন থেকে রক্ষাও করতো। এখন বাবা বাজার করে দিলে বাজারের ব্যাগ আমাকেই বয়ে নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে। আর দাদা হাফপ্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে হেলেদুলে হাঁটে। বড় ভাইবোনদের অত্যাচারে বাড়ির ছোটদের যে কী যন্ত্রণা হয় তা তো বড়রা বুঝতেই চাইবে না। বাবা বেশিরভাগ সময়েই বাড়িতে থাকে না, ফলে দিদির অনুপস্থিতিতে দাদার শাসন দুঃশাসনের মতো লাগতে শুরু করলো। দিদিকে মিস করতে শুরু করলাম।

বার্ষিক পরীক্ষার পর বাবার সাথে শহরে চললাম দুই ভাই। দিদির হোস্টেলে গিয়ে দিদির কাছে দাদার নামে কী কী নালিশ করবো তার একটি তালিকা মনে মনে করে নিয়েছি। অবশ্য পরে দাদার হাত থেকে কে রক্ষা করবে সে ব্যাপারে তখনও কিছু ভাবিনি। সেটা পরে ভাবা যাবে। আপাতত লঞ্চের ভীড়ে যত কান্ড ঘটছে সবকিছুই চোখ দিয়ে গিলতে শুরু করলাম।

নাপোড়া থেকে শহরে যাবার সবচেয়ে সহজ পথ ছিল নদীপথ। সড়ক পথে যেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। নাপোড়া থেকে গুনাগরি পর্যন্ত হেঁটে বা  রিকশায় যেতে হতো। তাও সরাসরি যাবার উপায় ছিল না। শিল্কুপের পর একটা পাকা ব্রিজ একাত্তরে পাকিস্তানি মিলিটারিদের জিপ নিয়ে ভেঙে পড়েছিল বলে একাত্তরে আমাদের গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারিরা যেতে পেরেছিল যুদ্ধ শুরু হবার অনেক পরে। এই ব্রিজটির পাশ দিয়ে জমির উপর হাঁটা পথ ছিল। সেটা পার হয়ে আবার রিকশা নিতে হতো। গুনাগরি থেকে লক্কর ঝক্কর জিপ যেতো পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সাতকানিয়ায়। সেখান থেকে আরাকান সড়ক ধরে বাস অথবা সেই জিপ নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজ হয়ে শহরে যেতে যেতে সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। নদীপথ তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল বলে বাবা আমাদের নিয়ে নদীপথেই রওনা হলেন।

নাপোড়া থেকে রিকশা নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই চাম্বল বাজার। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে ছোট একটি পায়ে চলা পথে বাংলাবাজার ঘাট। আমার বাবার একটি দুই ব্যাটারির টর্সলাইট ছিল। আমি খুব আহ্লাদ করে টর্সটি বাবার হাত থেকে নিয়ে কয়েক কদম যাবার সাথে সাথেই অন্ধকারে আমার হাত থেকে টর্সটি কেড়ে নিয়েছিল দাদা। অন্ধকারে আলো দেখানোর দায়িত্ব নাকি ছোটদের হাতে থাকতে নেই। বারো বছর বয়সেই সে বিরাট জ্ঞানী হয়ে বসে আছে – ক্ষমতালোভী শয়তান। তালিকায় আরো একটি অভিযোগ যোগ করে নিলাম।

কত্তোবড় নৌকা – বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেই আমার সবজান্তা দাদা কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, ‘এটা নৌকা নয়, লঞ্চ। আর এটা তেমন কোন বড় লঞ্চ নয়। এর চেয়েও বড় লঞ্চ আছে।‘ এর আগে আর একবার মাত্র আমরা লঞ্চে চড়েছিলাম – তাও একসাথে। তবে সে কীভাবে এর চেয়েও বড় লঞ্চ দেখলো জানি না। কিন্তু প্রশ্ন করে জুলপির চুলে টান খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। তাই তার জ্ঞান নিরবে মেনে নিয়ে লঞ্চের টুলে বাবার পাশে বোচকাটা রেখে আমার কোটের গলার কাছের বড় বোতামটাও লাগিয়ে নিলাম। নাপোড়া বাজারে বুধবার ও শনিবার বাজার বসে। ঠেলাগাড়িতে করে অনেক শীতের জামাকাপড় বিক্রি করতে এসেছিল গত বুধবার। সেখান থেকে আমাদের দুজনের জন্য দুটো কোট কেনা হয়েছে শহরে যাওয়া উপলক্ষে। কোটে বুকের শীত মানলেও হাফপ্যান্ট পরা থাকার কারণে পায়ে ঠান্ডা লাগছে। বোচকার মধ্যে একটা কাঁথা আছে। সেটা বের করবো কি করবো না বুঝতে পারছিলাম না।

লঞ্চে খুব ভীড়। লম্বা বেঞ্চে ঠেলাঠেলি করে বসে আছে সবাই। মাঝখানে বিশাল কালো রঙের তেল আলকাতরা মাখা ইঞ্জিন গমগম করে প্রচন্ড শব্দে চলছে। কথা বলতে হচ্ছে জোরে জোরে। লঞ্চের খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। দাদা ইতোমধ্যেই তার কোটের আভিজাত্য ভুলে গিয়ে বোঁচকা থেকে কাঁথা বের করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে ফেলেছে। আমাকেও কোন রকমে সেই কাঁথার ভেতর ঢুকতে হবে।

লঞ্চের অনেক যাত্রীই বাবাকে চেনে। বাবার সাথে কথাবার্তা বলছে। লঞ্চ ছেড়ে দেয়ার পরও অনেকে বাবার কাছে এসে “বদ্দা, আইবান কত্তে?” “পোয়া অলরে লই যন দে নে শহর দেখাইবার লাই?” “মাইয়ারে ত গভমেন কলেজত দিয়ন হুন্নি। মাইয়া পোয়া পরাই এরে কন লাভ নাই। আঁরইবারে বিয়া দি ফেলাইয়ি।“ বাবা কোন কথা বলছেন না দেখে বুঝতে পারছি এই লোকের কথাবার্তা তাঁর পছন্দ হয়নি।

দিদিকে আর পড়াশোনা না করানোর জন্য গ্রামের অনেকেই নিজে থেকে এসে বাবাকে উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি দোকানে দাঁড়িয়ে অনেক কথাবার্তা শুনেছি। গন্যমান্য একজন শিক্ষক এসে বাবাকে বলেছিলেন, “মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করালে তাদের পাখা গজাবে। তুমি শহরের কলেজে মেয়েকে পড়তে দিলে সেই মেয়ে আর ঘরে আসবে না।“ বাবা মিনমিন করে বলেছিলেন, “মেয়ে আমার ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছে। আমাদের এই স্কুল থেকে তার আগে আর কোন মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেনি। মেয়ের আগ্রহ আছে আরো পড়াশোনা করার। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেয়ে সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছে। হোস্টেলে সিট পেয়েছে। আমি তাকে পড়াবো না? আমার মেয়ে যতদূর পড়তে চাইবে, আমি যেভাবেই হোক পড়াবো।“ মাস্টারমশাই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিলেন, “পরে পস্তাবে।“ আমার বাবা আর কিছু বলেননি। গ্রামের জমিদারমশাই এসেও বাবাকে বলেছিলেন, “তুমি দোকান চালাচ্ছো  এর ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে।  দুদিন পরে যে মেয়ে শ্বশুরবাড়ির ভাত রাঁধবে তাকে পড়াচ্ছো শহরের কলেজে। “পোঁদত নাই ত্যানা, মিঢা দি ভাত খানা!”” বাবা জমিদারমশাইর কথার কোনো জবাব দেননি। শুধু নিরবে তাকিয়ে ছিলেন তার মুখের দিকে।

চাঁদের আলোয় সাগরের পানি চিকচিক করছে। ঘাড় ফিরিয়ে কিছুক্ষণ তাকালাম। কিন্তু ঘুমে তলিয়ে গেলাম একটু পরেই। ঘুম ভাঙলো ভোরবেলায়। লঞ্চ তখন সদরঘাটের লঞ্চঘাটায় ভিড়ছে। যাত্রীরা জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছে। মনে আছে গতবার লঞ্চ থেকে আবার ছোট নৌকায় উঠতে হয়েছিল। এবার লঞ্চ সরাসরি লম্বা কাঠের এক সেতুর পাশে ভিড়েছে। কাঠের লম্বা সিঁড়ি দিয়ে সেখানে উঠে যাচ্ছে যাত্রীরা। বাবা উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়েই ভীষণ চঞ্চল হয়ে আশেপাশে বেঞ্চের নিচে দ্রুত কী যেন খোঁজ করতে শুরু করলেন। বোঁচকার ভেতর, আমাদের কাঁথা যা একটু আগেই ভাঁজ করেছি তার ভেতর – কী যেন খুঁজছেন। এই শীতেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফর্সা মুখ থমথম করছে। আমি ঘাটের সিঁড়ি সম্বন্ধে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, দাদা আমার হাত ধরে টান দিলো। অর্থাৎ কোন কথা বলবি না।

লঞ্চের সবাই নেমে গেছে। ড্রাইভার আর সহকারিরা বাবার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল বাবার পকেটমার হয়েছে। তাঁর সব টাকা তিনি একটি লম্বা কাপড়ের ব্যাগের ভেতর রেখে কোমরের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন। ঘুম আর ভীড়ের সুযোগে পকেটমার তাঁর সব টাকা নিয়ে গেছে। লঞ্চের ড্রাইভার বা হেলপারদের কারো কিছু করার নেই। কাপড়ের থলে কাঁধে আর বোঁচকা হাতে নিয়ে লঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে ওঠার সময় বাবাকে কেমন যেন সর্বস্বান্ত মনে হচ্ছিলো। ঘটনার গুরুত্ব আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে দাদা সম্ভবত বুঝতে পারছিল। অন্য সময় হলে সে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে কীভাবে পা টিপে টিপে হাঁটতে হবে সে সম্পর্কে অনেক উপদেশ দিতো। কিন্তু এখন একটাও শব্দ করছে না।

ঘাটের কাঠের সেতুর উপরেই কয়েকটা ছোট ছোট চায়ের দোকান। লম্বা একটি টুলে বসে পড়লেন আমাদের সদ্য সর্বস্ব হারানো বাবা। আমার ভীষণ বাথরুম পেয়েছে। চেপে বসে রইলাম।

“বদ্দা, কী অইয়ে দে?” – বলে বাবার পাশে এসে যিনি বসলেন তাঁকে আমরা চিনি। লঞ্চে তিনিও ছিলেন। বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথাও বলেছেন। আমরা তাঁকে চাচা ডাকি। “এভাবে কেন বসে আছেন? আমার ভাইপোদের নিয়ে শহরে এসেছেন, মন খারাপ করে থাকলে চলবে?”

বাবা হঠাৎ তাঁর হাত দুটো ধরে কেমন যেন কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “অ ভাই!”

চাচা তাঁর লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বের করে দ্রুত বাবার হাতে তুলে দিলেন তাঁর হারানো টাকার থলে। বাবার মুখে আলো জ্বলে উঠলো। চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কত আছে জানো?”

“জানি। দশ হাজার এক শ। দুইটা নোট ছেঁড়া আছে। সতীশ বহদ্দারের কাছ থেকে ধার করেছেন, তাই না?”

“জানার পরেও ফেরত দিচ্ছো?”

“বদ্দা। লোভ সামলাতে পারিনি প্রথমে। পরে আপনাকে দেখে কেমন যেন খারাপ লাগলো। নিজেকে নেমক হারাম বলে মনে হলো। আপনার মনে আছে কি না জানি না, যুদ্ধের আগে প্রচন্ড তুফানের সময় আমার বাড়িতে এক দানাও চাল ছিল না, হাতে একটা টাকাও ছিল না। গভীর রাতে আপনার কাছে আমি গিয়েছিলাম। আপনি সেই ঝড়তুফানের মধ্যে দরজা খুলে আমাকে চাল দিয়েছিলেন। সেই চালের ভাত খেয়েছি আমি, ভাত খেয়েছে আমার ছেলেমেয়েরা। আর আমি আপনাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিলাম।“ “আঁরে মাফ গরি দিয়ন বদ্দা।“

চাচা চলে গেলেন। বাবার মুখে হাসি ফিরে এলো। আমরা নদীর দিকে তাকালাম। সকালের কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠছে। 

Tuesday, 19 July 2022

একজন হুমায়ূন আহমেদ

 



মুনীর চৌধুরী সে কোন যুগে বলে গিয়েছিলেন – মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।  দশ বছর হয়ে গেলো হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। এই দশ বছর ধরে আমরা যাঁরা বেঁচে আছি, প্রত্যেকেই বদলে গেছি কোনো না কোনোভাবে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কাছে, নির্লজ্জ দুর্নীতিবাজদের কাছে নতজানু হতে হতে আমরা ভূমির সাথে মিশে গিয়েছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেও মানসিকভাবে মরে পচে গেছি। কিন্তু মৃত্যুর দশ বছর পরেও হুমায়ূন আহমেদ এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মানুষ আর লেখকের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। লেখকরা মরেন না। আসলে লেখকের মূল পরিচয় তো তাঁর লেখায়, লেখাগুলি বেঁচে থাকে। লেখার সাথে লেখকও।

বিজ্ঞানে কিছুটা সাহিত্য থাকতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য বিজ্ঞান নয় কিছুতেই। সাহিত্য পুরোপুরি সৃষ্টিশীল কাজ। সেখানে পুনরাবৃত্তির খুব একটা কদর নেই। আর সাহিত্যের বিচারের ব্যাপারটা মোটেও বস্তুনিষ্ঠ নয়। বিজ্ঞানে যেটা ভুল – সেটা সবার কাছেই ভুল। কিন্তু সাহিত্যে ভুল বলে কিছু নেই। ভালোমন্দ লাগার ব্যাপারটাও পাঠকের নিজস্ব ব্যাপার। সাহিত্যের যে বই একেবারে অ্যাকাদেমি পুরষ্কার পেয়ে আকাশে উঠে গেছে, সেই বইও অনেক পাঠকের কাছে তীব্র বিবমিষাময় মনে হতে পারে। অনেক পাঠকের যে বই ভালো লাগে, সেই বই পাঠকপ্রিয় হয়, সেই লেখক প্রিয় লেখক হয়ে উঠেন। সেখানে যখন দেখা যায় একজন লেখক, আরেকজন লেখককে বলছেন – খারাপ লেখক – প্রশ্ন জাগে – ভালো-খারাপ মাপার মাপকাঠিটি কী ভাই? হুমায়ূন আজাদ হুমায়ূন আহমেদকে “অপন্যাসিক” বলতেন। ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে তা তিনি বলতেই পারেন। তার অর্থ এই নয় যে হুমায়ূন আজাদ হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ভালো লেখক। কার কোন্‌ লেখককে ভালো লাগবে তার তো কোন নিয়ম নেই। ভালো লাগার স্বাধীনতা সবার আছে। যে লেখা পড়ে আনন্দ পাওয়া যায় – সেই লেখা যদি মানুষ পড়ে – লেখককে যদি মাথায় তুলে রাখতে চায়, তাহলে দোষের কী আছে? হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ পাঠক মাথায় তুলে রেখেছেন। মৃত্যুর দশ বছর পরেও তাঁর অবস্থান সেখানেই।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরক প্রকাশিত হয়েছিল ডক্টর আহমদ শরীফের লেখা ভূমিকাসহ। সেই ১৯৭২ সালে আর কোন উপন্যাসে এরকম অন্য বিখ্যাত মানুষের ভূমিকা প্রকাশিত হয়েছিল আমার জানা নেই। ডক্টর আহমদ শরীফ সেই ভূমিকায় লিখেছিলেন, “মাসিক মুখপত্রের প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্পের নাম ‘নন্দিত নরকে’ দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন একটি নতুন জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। লেখক তো বটেই, তাঁর নামটিও ছিল আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবু পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে আমি অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যে অনুভব করলাম।“ বাংলা সাহিত্যে যে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করেছিলেন শিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, পরবর্তী চল্লিশ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস-নাটকে ফসলের বান বইয়ে দিয়েছিলেন।

নন্দিত নরকে পড়ে সাহিত্যিক আবুল ফজল লিখেছিলেন, “লেখকের যেন কোন বক্তব্য নেই, কোন দৃষ্টিকোণ নেই, আশ্চর্য এক নির্লিপ্তির সাথে তুমি তোমার গল্প বলে গেছ। গল্প বলা তো নয়, এ যেন ছবি আঁকা। যাতে একটি রেখাও অযথা টানা হয়নি। আমাকে সবচে বিস্মিত করেছে তোমার পরিমিতিবোধ আর সংযম। এত অল্প বয়সে রচনায় এমন সংযম খুব কম দেখা যায়। তোমার লেখনী জয়যুক্ত হোক।“ হুমায়ূন আহমেদের লেখনী যেভাবে জয়যুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্যে অন্য কোন লেখকের ক্ষেত্রে ততটা ঘটেনি।

হুমায়ূন আহমেদ এর লেখার সমালোচনা করতে গিয়ে প্রায়ই দেখা যায় – ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের জীবনযাপন, বিশ্বাস, প্রেম-ভালোবাসা-বিবাহ এসব নিয়ে কথা বলা যাবে না তা নয়। অবশ্যই যাবে। জনপ্রিয় মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগত গন্ডির বাইরে চলে আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভিত্তিতে তাঁর লেখার বিচার করা অবিচারেরই নামান্তর। আর একজন লেখকের সব লেখাই সবার ভালো লাগবে – সেটা আশা করাও কোন কাজের কথা নয়।

নন্দিত নরকে শেষ হয়েছে এভাবে - “ভোর হয়ে আসছে। দেখলাম চাঁদ ডুবে গেছে। বিস্তীর্ণ মাঠের উপরে চাদরের মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই।“ ওখান থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের ভুবন।


Monday, 13 September 2021

সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিনে

 


"আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।"

রবীন্দ্রনাথের এই গান যতবারই শুনি - বিস্ময়ে ব্যাকুল হই - আকাশভরা সূর্যতারার এই মহাবিশ্বের এই অপার বিস্ময়ের কিছুই তো জানা হলো না।

রবিবিশ্বের মুগ্ধতা কাটবার নয়। সেরকমই মুগ্ধতায় বাক্যহারা হয়ে যাই - সৈয়দ মুজতবা আলীর পান্ডিত্যে, লেখার মণিমুক্তায়।

১১৭ বছর বয়স হলো তাঁর। ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ - সিলেটের করিমগঞ্জে তাঁর জন্ম। অগাধ পান্ডিত্যের ছিঁটেফোঁটাই মাত্র লিখেছেন। সেই লেখাও থেমে গেছে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ - প্রায় ৪৭ বছর আগে। কিন্তু তাঁর যেকোনো লেখা পড়লেই মনে হয় - নিত্যনতুন।

তাঁর যেসব লেখাকে আমরা 'রম্যরচনা' নাম দিয়ে হালকা ভাবার চেষ্টা করি - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেগুলি সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন - ওগুলি সব প্রবন্ধ।[1] আমাদের প্রচলিত ধারণা হলো - যেসব লেখা পন্ডিতী ফলানোর জন্য লেখা হয়, কয়েক লাইন পড়লেই ঘুম চলে আসে - সেগুলিই প্রবন্ধ। সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধগুলি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে রাখা যায় না -সে কারণেই কি সেগুলিকে প্রবন্ধ বলতে চাই না?

'দেশেবিদেশে' তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। কিন্তু প্রথম লেখা নয়। দেশেবিদেশে কি শুধুই ভ্রমণকাহিনি? ইতিহাস নয়? সমাজদর্পণ নয়?

প্রাণখোলা হাসি প্রচলিত পান্ডিত্যের পরিপন্থী। যেসব পন্ডিত আমাদের সমাজে সদর্পে স্বপ্রচারে সরব, তাঁদের কেউই প্রাণখুলে হাসেন না। পাছে লোকে তাঁদের পান্ডিত্য নিয়ে সন্দেহ করে। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী পাঠককে যেভাবে হো হো করে হাসিয়ে ছাড়েন, তেমনি নিজেও হাসতে পারতেন প্রাণখুলে, মন খুলে। কিছু কিছু পন্ডিতের সাথে আমরা পরিচিত - যাদের সাক্ষাৎ এত বেশি গম্ভীর যে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। অথচ সৈয়দ মুজতবা আলীর পান্ডিত্য ছিল ভোরের আলোর মতো স্নিগ্ধ, শরতের বাতাসের মতো নির্মল।

সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রত্যেকটি লেখায় কতো কিছু অজানা বিষয় থাকে।  অথচ একটুও মনে হয় না তিনি মাস্টারি করছেন। পাঠক মাস্টারদের তবু কোন রকমে সহ্য করতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যে মাস্টারি অসহ্য। সৈয়দ মুজতবা আলী ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই জানতেন।

এত কম কথায় এত বেশি তিনি বলতে পারতেন - যা মাঝে মাঝে তাঁর গুরুদেব রবিঠাকুরের ঠিক উল্টো। রবিঠাকুরের গল্প কিংবা উপন্যাসে কম-কথার চলন খুব একটা নেই। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী কম-কথায় এক কথায় অনবদ্য। 'মুখের রঙটি যেন শিশিরে ভেজা' - পাঁচ শব্দেই  তাঁর গল্পের নায়িকার রূপ মূর্ত হয়ে  ওঠে।

প্রেমে পড়ার বয়সে তাঁর 'প্রেম' পড়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। প্রেমিকার গর্ভে সন্তান রেখে প্রেমিক পালিয়ে গেছে প্রতারণা করে। আদালতে বিচারক যখন প্রতারিতাকে প্রশ্ন করেন, "আচ্ছা, তুমি সেই ছেলেটার সন্ধান নিলে না কেন? তাকে বিয়ে করাতে বাধ্য করালে না কেন?"[2]

কুন্ডুলি পাকানো গোখরো সাপ যে রকম হঠাৎ ফণা তুলে দাঁড়ায়, মেয়েটা ঠিক সেই রকম বলে উঠলো, 'কী! সেই কাপুরুষ - যে আমাকে অসহায় করে ছুটে পালালো! তাকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাকে দেব সেই কাপুরুষের, সেই পশুর নাম!'

এতটা আত্মসম্মান, আত্মশক্তি আবিষ্কার করতে পারেন যিনি - তিনিই তো সৈয়দ মুজতবা আলী।

শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক।



[1] সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডের ভূমিকা। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:, কলকাতা, শ্রাবণ ১৪০৮ বাংলা।

[2] সৈয়দ মুজতবা আলী, রাজা উজীর গ্রন্থের ‘প্রেম’।


Saturday, 11 September 2021

এগারো সেপ্টেম্বর

 

নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ারের ঘটনাস্থলে নিহতদের স্মরণে আলোকস্তম্ভ। [ছবি: pxfuel.com]

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর – আমেরিকানদের তারিখ লেখার পদ্ধতি অনুসারে নাইন-ইলেভেন। এইদিনের পর থেকে গত বিশ বছরে পৃথিবীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আর সর্বোপরি ধর্মীয় বিভাজন প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু আমেরিকা নয়, পুরো বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এই একটি তারিখ।

আমেরিকায় নাইন-ইলেভেনের সকালে এই ঘটনা যখন ঘটছে তখন মেলবোর্নে ১২ তারিখের ভোররাত। আমি তখন থাকতাম ফিলের অ্যাপার্টমেন্টের একটা রুম ভাড়া নিয়ে। আমার টেলিভিশন ছিল না। ফিল একটা বারো ইঞ্চি সাদা-কালো অ্যানালগ টেলিভিশন আমার রুমে এনে দিয়েছিল। তখন ডিটিজাল টেলিভিশন আসতে শুরু করেছে। লোকে পুরনো অ্যানালগ টেলিভিশনগুলি ফেলে দিচ্ছিলো। ফিল সেরকই কোন পরিত্যক্ত টেলিভিশন ফুটপাত থেকে তুলে এনে আমার রুমে ঢুকিয়ে দিয়েছে। শুয়ে শুয়ে ওটা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভোররাতে ঘুম ভাঙার পর দেখি টিভিতে টুইন টাওয়ারের ঘটনা দেখানো হচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম কোন মুভি চলছে। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম – কোন সিনেমার দৃশ্য নয়, সরাসরি দেখানো হচ্ছে আমেরিকায় তখন কী হচ্ছে। 

এরপর পরের দিনই সবাই জেনে গিয়েছে কী কী হয়েছিল সেখানে। আল্‌ কায়েদার ১৯জন জঙ্গী চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চারটি যাত্রীবাহী প্লেন হাইজ্যাক করেছে প্রায় একই সময়ে। দুটি প্লেন উড়ে গিয়ে আঘাত করেছে টুইন টাওয়ারের দুই টাওয়ারে। তৃতীয় প্লেনটি আছড়ে ফেলেছে পেন্টাগনের উপর। আর চতুর্থ প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়েছে পেনসিলভেনিয়ার শ্যাংকসভিলের মাঠে। তিন হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। সন্ত্রাসী জঙ্গিরা ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে বিভৎসভাবে খুন করেছে এতগুলি মানুষ – নারী, পুরুষ, শিশু। 


টুইন টাওয়ার জ্বলছে। [ছবি: skeptic.com]

১১ সেপ্টেম্বর ২০০১, নিউইয়র্ক সময় সকাল ৮টা ৪৫। মঙ্গলবার সকালের ঝকঝকে রোদে জেগে উঠেছে ম্যানহাটানের অফিসপাড়া। আমেরিকান এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৬৭ প্লেনটি উড়ে গিয়ে টুইন টাওয়ারের উত্তরের দিকের টাওয়ারের ৮০ তলায় ঢুকে গেল। বিশ হাজার গ্যালন জ্বালানি তেলের আগুন ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই। দমকলবাহিনি সর্বোচ্চ চেষ্টায় যখন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, টেলিভিশন ক্যামেরাগুলি যখন সরাসরি এই ঘটনা দেখাতে শুরু করেছে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে – তখনি – প্রথম আঘাতের আঠারো মিনিট পর আরেকটি বোয়িং ৭৬৭ – ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ১৭৫ উড়ে এসে আছড়ে পড়লো দক্ষিণের টাওয়ারের ৬০ তলায়।  তখনি বোঝা গেল – এগুলি দুর্ঘটনা নয়, সরাসরি আক্রমণ। 

পনেরো মিনিটের মধ্যেই দক্ষিণ টাওয়ারের পুরোটাই ধ্বসে পড়লো। সাড়ে দশটার মধ্যে উত্তরের টাওয়ারও মিশে গেল মাটির সাথে। ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়লো আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ। 


পেন্টাগনে আক্রমণ [ছবি Flickr]


লক্ষ লক্ষ আমেরিকান যখন টুইন টাওয়ার আক্রমণের ঘটনা টিভিতে সরাসরি দেখছিলো – তখন আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ডাউনটাউনের আকাশে ঘুরছিল আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৭৭। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে সেটা আছড়ে পড়লো আমেরিকান মিলিটারি হেড কোয়ার্টার – পেন্টাগনের উপর। বিশাল বিল্ডিং-এর একটা অংশ ধ্বসে পড়লো।  প্লেনের ৬৪জন যাত্রী এবং ১২৫জন মিলিটারি অফিসারের জীবনাবসান হলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই। 

চতুর্থ প্লেন ইউনাইটেড ফ্লাইট-৯৩ ৪৪জন যাত্রী নিয়ে নিউজার্সি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছিলো। উড়াল দেয়ার চল্লিশ মিনিটের মাথায় ওই প্লেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যাত্রীবেশী সন্ত্রাসীরা। ইতোমধ্যে যাত্রীদের অনেকেই এবং ক্যাপ্টেন ও ক্রুরা জেনে গেছে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনের ঘটনা। তারা বুঝতে পারে তাদের কেউই আর বাঁচবে না। মরার আগে অসহায়ভাবে মরার চেয়ে কিছু একটা করে মরার চেষ্টায় তারা হাইজ্যাককারী জঙ্গিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাত্রীদের কয়েকজন তাদের পরিবারের কাছে সেলফোনে বার্তা পাঠিয়ে বিদায় নিয়ে নেয়। যাত্রীরা ককপিটে সন্ত্রাসীদের উপর আক্রমণ চালায়। প্লেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সকাল ১০টা ১০-এ আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার একটি মাঠে। সবার মৃত্যু ঘটে। যাত্রীরা ওভাবে বাধা না দিলে এই প্লেনটি হয়তো আছড়ে পড়তো হোয়াইট হাউজে কিংবা ক্যাপিটল হিলে। 

পরে, আরো অনেক পরে জানা যায় এই আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী আল্‌ কায়েদার ওসামা বিন লাদেন এবং তার দল। ১৯জন জঙ্গীর মধ্যে অনেকেই আমেরিকায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এক বছরেরও বেশি ধরে আমেরিকায় থেকে পরিকল্পনা করেছে আমেরিকাকে ধ্বংস করার। এয়ারপোর্টের নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যেও আল-কায়েদার লোক ছিল। তাদের সহযোগিতায় জঙ্গীরা প্লেনে ছুরি নিয়ে উঠেছিল। অন্য কোন অস্ত্র ছাড়াই প্লেনের জ্বালানিসহ পুরো প্লেনকেই ব্যবহার করেছে বিশাল আকৃতির মিজাইল হিসেবে। 

২,৯৯৬ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এই নাইন-ইলেভেনের আক্রমণে। আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন ৩৪৩ জন ফায়ার-ফাইটার ও চিকিৎসাকর্মী, ৬০ জন পুলিশ। 

এরপর গত বিশ বছর ধরে চলছে এই ঘটনার প্রতি-ঘটনা। সারাপৃথিবীর বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির জন্ম হয়েছে। এর আদলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এয়ারপোর্টের নিরাপত্তাও হয়ে গেছে বাড়াবাড়ি রকমের ব্যয়বহুল ও বিরক্তিকর। 

এর বাইরেও সবচেয়ে যেটা বেশি ঘটেছে তা হলো মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভেঙে গেছে। নাইন-ইলেভেনের কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে একাধিকবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে – “আর ইউ অ্যা মুসলিম?” তার মানে – মুসলিম হলেই বিপজ্জনক ব্যক্তি? মুসলিম হলেই তাকে আর বিশ্বাস করা যায় না? 

২০০১ এর অক্টোবরে আমি নিউজিল্যান্ড গিয়েছিলাম। নাইন-ইলেভেনের ধকল যে কী জিনিস তা এয়ারপোর্টে দেখতে হয়েছে। ২০০২ এর এপ্রিলে গেলাম আমেরিকায়। চার-পাঁচ ঘন্টা লাগলো শুধুমাত্র সিকিউরিটি গেট পার হতে। আর অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ঘৃণার দৃষ্টি তো আছেই। ২০০৩ এর ফেব্রুয়ারিতে গিয়েছিলাম টুইন-টাওয়ারের গ্রাউন্ড জিরোতে। কিছু ধর্মান্ধ জঙ্গীর কৃতকর্মের চিহ্ন রয়েছে সেখানে। আর আছে তিন সহস্র পরিবারের কান্না। 

যুগে যুগে এরকমই ঘটে আসছে। গুটিকয় খারাপ মানুষের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয় সবাইকে। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনে

 


সাত সেপ্টেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন।
লেখক হিসেবে এই মানুষটাকে বেশ আলাদা মনে হয় আমার। রাফ অ্যান্ড টাফ লেখক বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে এটাও মনে হয় যে লেখার জন্য তাঁকে ভাবতে হয় না। কাগজ-কলম আর একটু সময় থাকলেই তাঁর লেখা হয়ে যায়। সেই সময়, পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলোর মতো মহাভারত সাইজের লেখা তিনি লিখে ফেলেছেন তর তর করে। আবার নিজের ভাষায় সত্যিকারের মহাভারতও লিখেছেন তিনি। যখন যেটাই লিখেছেন - সুখপাঠ্য হয়েছে। অথচ তাঁর প্রথম প্রেম - কবিতা। গদ্যে পদ্যে এমন হাতখোলা লেখক খুব বেশি নেই বলেই তিনি আলাদা। তাঁর সব লেখা পড়া হয়ে ওঠেনি এখনো। কখন হবে, কিংবা কখনো হবে কি না জানি না। আজ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার বই খুলে বসেছিলাম। কবির জন্মদিনে কবির কবিতা পড়ে কবিকে সম্মান জানানো উচিত ভেবেছিলাম। কবিতার বই পড়ার সুবিধা হলো যে কোনো পৃষ্ঠা থেকেই শুরু করা যায়, উপন্যাসের মতো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হয় না।
আজ বই উল্টাতেই যে পৃষ্ঠা খুললো - সেখানে যে কবিতা আছে তা পড়তে গিয়ে মনে হলো - রিচার্ড ফাইনম্যান শুধু শুধুই কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে দুর্বোধ্য বলে অপবাদ দিয়েছিলেন। তিনি যদি কোনোভাবে সুনীলের 'জ্বলন্ত জিরাফ' কবিতা পড়তেন - বুঝতেন দুর্বোধ্যতা কাকে বলে। বিশ্বাস হচ্ছে না? নমুনা দিলাম দুটো লাইন - "দাঁতের ডাক্তার আমার পায়ে ঘা করে দিয়েছিলো বলে আমি আর কখনও সেই শুয়ারের বাচ্চা বীজাণুসমন্বয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাইনি। তার বদলে আমি এখন পেচ্ছাপ ও কান্নার সম্পর্ক নিয়ে বই লিখছি।"
হ্যাপি বাড্ডে গুরু!!!

Sunday, 15 August 2021

বঙ্গবন্ধু স্মরণ

 


১৫ আগস্ট আমাদের শোকের দিন। শোক থেকে শক্তি সংগ্রহ  করার দিন। 
১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। 
শুধু কি সেই রাতেই হত্যা করা হয়েছিল? 

এরপর ১৯৯৬ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল তারা প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাঁর আদর্শকে হত্যা করেছে, তাঁর আদর্শ যারা ধারণ করেছে তাদের সবাইকে হত্যা করেছে। 
শারীরিকভাবে না হলেও অনেককেই আদর্শিকভাবে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। 

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবার পরও - এই বর্তমানেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা ব্যবসা করছে - তারা প্রতিনিয়তই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করছে। 

এই মারাত্মক আদর্শ-হত্যার, চরিত্র-হত্যার, নীতি-হত্যার খলনায়করা সমাজের আনাচে-কানাচে উপর থেকে নিচে সবজায়গায় নির্লজ্জভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ - দীর্ঘশ্বাস ফেলে শোক প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না। 

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেন কোনোদিন না হয় - সেই উদ্দেশ্যে ইমডেমনিটি বিল পাস করিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে চরম দুর্নীতি যারা করছে,  যারা এখনো প্রতিনিয়ত দেশকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে ঘোর অন্ধকারের দিকে তাদের বিচার কি কখনো হবে? 

নাকি আমরা যারা শুধু বছরের পর বছর ধরে শোক-পালনই করতে থাকবো - নিছক শোকদিবসের আনুষ্ঠানিকতায়?? 



ছবি: বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশান।


Friday, 6 August 2021

রবীন্দ্রনাথের শেষ লেখা

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৪১)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শারীরিকভাবে বেঁচেছিলেন আশি বছর (১৮৬১ – ১৯৪১)। তাঁর মৃত্যুর বয়সও আশি হয়ে গেল। অথচ তিনি আমাদের জীবনের মননশীল সব কাজে চিন্তায় আনন্দে বিষাদে প্রেমে বিরহে হেলাফেলায় সারাবেলায় কী অপরূপভাবে জীবন্ত। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ লেখা’ প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর। ১৩৪৮ বাংলার ভাদ্র মাসে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটে তার কিছুদিন আগে – ১৩৪৮ বাংলার ২২শে শ্রাবণ।

‘শেষ লেখা’ গ্রন্থের নামকরণ রবিঠাকুর নিজে করে যেতে পারেননি। বইয়ের ভূমিকায় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন এ কথা। এই বইতে ১৫টি কবিতা আছে – যার মধ্যে কয়েকটি কবিতা কবি নিজের হাতে লিখতে পেরেছিলেন। বাকিগুলি কবি রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে মুখে মুখে বলেছিলেন – অন্যরা লিখে নিয়েছিলেন। কবি পরে সেগুলি দেখে সংশোধন করেছিলেন। একেবারে শেষের কবিতা “তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’ সংশোধন করার সময় পাননি। 

এই কবিতাগুলির কোনটারই শিরোনাম নেই। কবিতার প্রথম লাইনকেই কবিতার শিরোনাম ধরা হয়েছে। এই ১৫টি কবিতার মধ্যে কয়েকটি কবিতা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। বহুল আলোচিত কবিতার একটি হলো – 


“প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে,

কে তুমি—

মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,

কে তুমি—

পেল না উত্তর।“

এই কবিতাটি কবি লিখেছিলেন ২৭ জুলাই ১৯৪১ সালে – তাঁর মৃত্যুর মাত্র ১২দিন আগে। এই কবিতার অনেক রকমের দার্শনিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে – এখনো হচ্ছে। কবিতাতে যে ব্যাপারটা স্পষ্ট – সেটা হলো জীবনের অস্পষ্টতা। যে আমিত্বের বড়াই মানুষ করে – তার স্বরূপ কী? কে আমি? – এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। 

রবিঠাকুরের জীবনের সর্বশেষ রচনা – 

“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি

বিচিত্র ছলনা-জালে,

হে ছলনাময়ী।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে

সরল জীবনে।

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;

তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।

তোমার জ্যোতিষ্ক তারে

যে পথ দেখায়

সে যে তার অন্তরের পথ,

সে যে চিরস্বচ্ছ,

সহজ বিশ্বাসে সে যে

করে তারে চিরসমুজ্জল।

বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,

এই নিয়ে তাহার গৌরব।

লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।

সত্যেরে সে পায়

আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।

কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,

শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে

আপন ভাণ্ডারে।

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার।“ 


মৃত্যুর আট দিন আগে রচিত (৩০ জুলাই ১৯৪১) এই কবিতায় কি কোনোভাবে কবির বিরক্তি প্রকাশিত হয়েছে ছলনা এবং মিথ্যার কারণে? 

‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে’ – এ যেন আমাদের প্রত্যেকের মনের কথা – যখন আমাদের বিশ্বাস ভেঙে যায় প্রতারণার ফাঁদে। 

কবির জীবনের শেষ পংক্তি – ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে, সে পায় তোমার হাতে – শান্তির অক্ষয় অধিকার।“ এ যেন নিজেকে সান্তনা দেয়া – ছলনা সয়ে যাবার পরেও মনে মনে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা। কষ্ট লাগে – যখন জীবনের সায়াহ্নে বসে বিশ্বকবিকেও ভাবতে হয় কী ছলনাময় এই জগতের চারপাশ। 


Monday, 26 July 2021

কাশেমভাই - দাদাভাই

 কাশেমভাই -দাদাভাই


কাশেমভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা কোন্‌দিন হয়েছিল তার দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন সবই মনে আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার তাঁর সাথে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল – সেদিনের কথাও মনে আছে। মাঝখানের অনেকগুলি বছরের অনেকগুলি দিন আলাদা আলাদাভাবে মনে করার উপায় নেই। কাশেমভাইয়ের সাথে শাহীন কলেজে একসাথে কাজ করেছি সাড়ে চার বছরেরও বেশি। পুরনো লাল বিল্ডিং-এ তাঁর সাথে ডেস্ক শেয়ার করেছি প্রায় তিন বছর। তারপর নতুন বিল্ডিং-এ আরো দেড় বছর মানুষটিকে দেখেছি কাছ থেকে, কাজ থেকে।

আমরা সবাই জানি – কাজের জায়গায় কত বিচিত্র রকমের মানুষ থাকে। তাঁদের প্রত্যেকের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে – যেগুলি দিয়ে তাদেরকে আলাদা করা যায়। অনেক সময় আমরা তাদের বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে তাদেরকে ঈর্ষা করি, আবার বৈশিষ্ট্যভেদে অনেক সময় বিরক্ত হই। গতকাল কাশেমভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পাবার পর থেকে অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম – কাশেমভাইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কোন্‌টি।

কাশেমভাইয়ের যেদিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তা হলো শাহীন কলেজ কর্তৃপক্ষের বহুবিধ চাপাচাপির মধ্যেও একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন থাকা। কত ন্যায্য-অন্যায্য কারণে আমাদের অনেকের মাথা গরম হয়ে গেছে, আমরা কমনরুমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, অনেক সময় ছাত্রছাত্রীদের কাছেও আমাদের মানসিক অস্থিরতা চাপা থাকেনি। মানসিক চাপে আমাদের শারীরিক ভাষাও বদলে গেছে অনেকসময়। আমাদের হাঁটার গতি বেড়েছে, কিংবা ডাস্টারের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে – অথবা নিদেনপক্ষে অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতা আছড়ে ফেলেছি। কিন্তু কাশেমভাইকে কোনদিন মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখিনি। শুরুতে ভেবেছিলাম তিনি সংসারে বাস করা সন্ন্যাসী টাইপের মানুষ। কিন্তু ক্রমে জেনেছি তিনি ঘোরতর সংসারী মানুষ। মানুষের যেসব স্বাভাবিক স্বার্থচিন্তা থাকে – তার কোনটা থেকেই তিনি মুক্ত ছিলেন না। তাহলে কোন্‌ জাদুবলে কলেজের সব চাপ তিনি উপেক্ষা করে সদাস্থির থাকতে পেরেছিলেন?

কমনরুমে আমরা কত কিছু নিয়ে, কত কাউকে নিয়ে কতরকমের মন্তব্য করেছি। কাশেমভাই সেসব মন্তব্য চলাকালীন আরাম করে পান চিবিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর গভীর মমতা ছিল তার প্রমাণ পেয়েছি অনেক সময়। ক্লাসের ভালো, কিংবা ধনী, কিংবা প্রভাবশালী, কিংবা গন্ডগোলে শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক শিক্ষকেরই ধনাত্মক-ঋণাত্মক কোন না কোন রকমের পক্ষপাতিত্ব থাকে। কিন্তু দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি মমতা দেখানোর মতো ধৈর্য অনেক শিক্ষকের থাকে না। কাশেমভাইয়ের মধ্যে আমি সেই মমতা দেখেছিলাম। তাঁর শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবে তারা তাদের কাশেমস্যারকে মনে রাখলে কেন মনে রাখবে। আমি আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী কাশেমভাইকে মনে রাখবো তাঁর কিছুতেই-কিছু-যায়-আসে-না স্বভাবের জন্য। কলেজে তিনি অনেক সিনিয়র ছিলেন – কিন্তু কখনোই সেটা জাহির করেননি। ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রভাবশালী শিক্ষকদের বলয়ে তিনি কোনদিনই ঢুকতে চেষ্টা করেননি।

কাশেমভাইয়ের সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে – ঢাকা ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টে। আমাদের আরেকজন সহকর্মী আলী হায়দারভাই কানাডা থেকে ঢাকায় এসে কানেক্টিং ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমিও বাড়িতে যাচ্ছিলাম। কাশেমভাই আলী হায়দারভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। আমার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কাশেমভাই তখন অবসর নিয়েছেন। আমার সাথে প্রায় এক যুগ পরে দেখা হলেও চিনতে পারলেন, বুকে টেনে নিলেন। মানুষকে আপন করে নেয়ার এই গুণের কারণে আপনাকে মিস করবো কাশেমভাই – আমাদের দাদাভাই।

Tuesday, 22 June 2021

হেরমান মিনকৌস্কির জন্মদিনে

 


হেরমান মিনকৌস্কি ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনের সরাসরি শিক্ষক। সুইস পলিটেকনিকের গণিতের অধ্যাপক ছিলেন মিনকৌস্কি। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রকাশিত হবার পর মিনকৌস্কি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর ক্লাসের 'অলস' ছাত্রটির হাত দিয়ে এত উন্নত মানের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। মনকৌস্কির মতে আইনস্টাইন ছিলেন খুবই অলস প্রকৃতির ছাত্র - গণিতের প্রতি যার কোন আকর্ষণই ছিল না। আইনস্টাইন ক্লাস খুব একটা করতেন না, সে হিসেবে তাঁকে 'অলস ছাত্র' বলতেই পারেন তাঁর শিক্ষক। শিক্ষকরা তো মনে করেন তাঁদের ক্লাসে যারা নিয়মিত উপস্থিত থাকেন, তাঁদের সাথে যারা সুসম্পর্ক বজায় রাখেন - তারাই ভালো ছাত্র। তবে মিনকৌস্কি তাঁর ছাত্র আইনস্টাইনের তত্ত্বের মূল সুর বুঝতে দেরি করেননি। তিনি বুঝেছিলেন যে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ঠিকমতো বুঝতে হলে শুধুমাত্র ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি দিয়ে কাজ হবে না, আরো একটি মাত্রা লাগবে - সেটা হলো সময়। মিনকৌস্কির হাত দিয়েই আমরা পেলাম চতুর্মাত্রিক জগত - x, y, z এবং সময়। যার গাণিতিক নাম মিনকৌস্কি স্পেস-টাইম। 

মাত্র ৪৪ বছর বেঁচেছিলেন হেরমান মিনকৌস্কি। ১৮৬৪ সালের ২২ জুন তখনকার রুশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পোলান্ডে জন্মেছিলেন তিনি। ১৯০৯ সালের ১২ জানুয়ারি অ্যাপেন্ডিসাইটিসের জটিলতায় হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন তিনি। 

আজ হেরমান মিনকৌস্কির জন্মদিন। 

শুভ জন্মদিন চতুর্থ-মাত্রার জনক। 

ছবির কপিরাইট: মিনকৌস্কির ছবিটি নিয়েছি Vesselin Petkov সম্পাদিত Minkowski Spacetime: A Hundred Years Later (Springer 2010) বই থেকে।

Sunday, 13 June 2021

সুফিয়া কামালের জন্মদিনে

 


শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল। 

বাংলাদেশের সাহিত্য, সংগ্রাম, নারীমুক্তি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ - সবকিছুর সাথে মিশে আছেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে লিখেছিলেন, "তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উর্ধ্বে এবং ধ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা।"
আজ ২০ জুন তাঁর জন্মদিন। ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালে তাঁর নানার বাড়িতে জন্ম। এরকম তথ্যই আছে সুফিয়া কামাল সংক্রান্ত বইপত্রে। 

কিন্তু তাঁর সঠিক জন্ম তারিখ সম্পর্কে সামান্য একটু খটকা লাগছে আমার। সুফিয়া কামালের একাত্তরের ডায়েরী-তে (হাওলাদার প্রকাশনী ২০১১) ২৬ জুন তারিখে সুফিয়া কামাল লিখেছেন, "গতকাল গেল ১০ই আষাঢ়, আমার জন্মদিন, তাই বুঝি অঝোর ধারা ঝরছে আজও। সোমবার বেলা ৩টা আমার জন্ম। ১৯১১ আর আজ ১৯৭১ কি দীর্ঘ দিন ..."(পৃষ্ঠা-৭৭)। বাংলা তারিখের সাথে ইংরেজি তারিখের তারতম্য দেখা যায় বিভিন্ন বছরে। প্রায় সব বইপত্রেই লেখা আছে সুফিয়া কামালের জন্মদিন ১৯১১ সালের ২০ জুন, সোমবার।   কিন্তু ১৯১১ সালের ২০ জুন ছিল মঙ্গলবার। সুফিয়া কামালের মত ব্যক্তিত্বের জন্মদিন নিয়ে এরকম তথ্য-বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয় বলেই মনে হয় আমার।







২০ জুন ২০১৯

পলাশ দফাদার - আমার বন্ধু

 



আমার ছোটবেলার খেলার সাথী ছিল সে। বয়সে আমার চেয়ে বছর খানেকের বড় হলেও আমাদের আচরণে সেটা কখনোই প্রকাশিত হয়নি ছোটবেলায়। পাশাপাশি বাড়ী। দিনের কিছুটা সময় তাদের উঠানেই কাটতো - খেঁজুর গাছের ডাল দিয়ে ঘোড়া ছোটানো, কিংবা টিনের তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়। ছুটির দিনের দুপুরে মাঝে মাঝে বাজারের  রাস্তায় নেমে স্বনির্মিত ফুটবল খেলতাম তার সাথে। সেই সময় রিক্সা ছাড়া আর কোন যানবাহন চলতো না আমাদের সেই রাস্তায়। পুরনো পত্রিকা আর ছেঁড়া পলিথিনে দড়ি পেঁচিয়ে তৈরি হতো আমাদের ফুটবল। এসব উপকরণ জোগাড়ে আশ্চর্য দক্ষতা ছিল তার। শৈশবের কত রকমের স্মৃতি তার সাথে। লেখাপড়া বেশি হয়নি তার। আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছি পড়াশোনা করার জন্য। নতুন প্রতিষ্ঠানে নতুন বন্ধু হয়েছে, বেড়েছে ব্যস্ততা। কিন্তু যতবারই গ্রামে গিয়েছি - দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে তার সাথে। তারও ব্যস্ততা বেড়েছে। আমি দেশের বাইরে চলে আসার পর থেকে কয়েক বছর পর পর দেখা হলেও অন্তরঙ্গতা কমেনি একটুও। সে গ্রামের চৌকিদার হয়েছে, তারপর দফাদার। তার ঘরসংসার ছেলে-মেয়ে সব নিয়ে একজন ভরপুর প্রাণবন্ত মানুষ সে - আমাদের সুতু - সবাই যাকে পলাশ দফাদার বলে। গত জানুয়ারির ২৬ তারিখ দেখা হয়েছিল তার সাথে। কালীবাড়ি রোডে। আগামী বছর আবার দেখা হবে বলেছিলাম। কিন্তু একটুও ভাবিনি যে আর দেখা হবে না। ২১ ফেব্রুয়ারি সুতু মারা গেছে। স্মৃতিগুলো বড্ড বেশি ভারী মনে হচ্ছে।

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

জাহানারা ইমামের জন্মদিনে

 


10+1+8+1+14, 
9, 1+13, 9+14, 12+15+22+5, 23+9+20+8, 25+15+21, 
1+18+5, 25+15+21? 
এটি একটি প্রেমপত্র। লেখা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে। তার উত্তরে কিশোরী জাহান লিখেছিলো - 
'পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি
আপন গন্ধে মম
কস্তুরী মৃগ সম
কোথা দিশা খুঁজে পাই না।' 
১৯৪৮ সালে চিঠির লেখক শরীফুল আলম ইমাম-এর সাথে বিয়ের পর তিনি হলেন জাহানারা ইমাম। 
আজ তাঁর জন্মদিন। 
শুভ জন্মদিন শহীদ জননী।

৩ মে ২০২০


Saturday, 12 June 2021

মেরি কুরির জন্মদিনে

 



বিয়ের এগারো বছরের মাথায় দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে ছোট ছোট দুটো মেয়েকে নিয়ে নিজের যোগ্য সম্মান ও অধিকার অর্জনের জন্য ধরতে গেলে সারাজীবনই সংগ্রাম করতে হয়েছে মেরি কুরিকে। ফ্রান্সের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেরির নামে কলংক রটিয়েছে - আর মেরি তখন তাঁর একক গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন দ্বিতীয় নোবেল পুরষ্কার। গবেষণা আর দুটো মেয়েকে বুকে ধরে এগিয়ে গেছেন নীরবে। গড়ে তুলেছেন বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান - রেডিয়াম ইনস্টিটিউট। মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণায় মেয়েদের অংশগ্রহণের অগ্রদূত মেরি কুরি। তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বপ্রথম নারী যিনি বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তিনিই প্রথম নারী যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এবং একমাত্র নারী বিজ্ঞানী যিনি দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। শুধু তাই নয় - নিজের মেয়ে আইরিনকে গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞানী হিসেবে। আইরিন কুরি ও তাঁর স্বামী ফ্রেদেরিক জুলিও রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রিতে তাঁদের মৌলিক অবদানের জন্য। ক্যান্সার চিকিৎসায় তেজষ্ক্রিয়তার ব্যবহারের পথিকৃৎ মেরি কুরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিশোরী মেয়েকে সাথে নিয়ে মেরি ছুটে গিয়েছিলেন যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসায়। এক্স-রে ও রেডিয়াম ব্যবহার করে তাঁরা প্রাণ বাঁচিয়েছেন শত শত মানুষের। তাঁর সম্মানে তাঁর জন্মদিনে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মেডিকেল ফিজিক্স দিবস। 

আজ মেরি কুরির জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রিয় বিজ্ঞানী।

৭/১১/২০২০

ফিওদর দস্তয়ভস্কির জন্মদিনে

 



ফিওদর দস্তয়ভস্কি (১১/১১/১৮২১ - ৯/২/১৮৮১)

"মাননীয় স্যার", রাজকীয় কায়দায় শুরু করলো লোকটা- "দারিদ্র্য কোন রোগ নয়। এ কথা কিন্তু সত্যি। মদ খেয়ে মাতাল হওয়াও যে কোন গৌরবের কাজ নয়, তাও আমি জানি। এটা আরো বেশি সত্যি। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি, মাননীয় স্যার, ভিক্ষাবৃত্তি একটি ভয়াবহ রোগ স্যার। দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও আপনি আপনার ভেতরের আদর্শ অটুট রাখতে পারেন। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তিতে - কক্ষনো না - কেউই পারে না। ভিক্ষা করলে সমাজ হয়তো আপনাকে লাঠি নিয়ে তেড়ে মারতে আসবে না, কিন্তু সম্মানের জায়গা থেকে আপনাকে একদম ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেবে। তাই এই কাজটাকে যতটুকু লজ্জাকর করে তোলা যায় -  হ্যাঁ স্যার, ঠিক তাই, ভিক্ষা করার আগে আমি নিজেকে নিজে অপমান করে নিচ্ছি সবার আগে।" 

- দস্তয়ভস্কির 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম অনেক বছর আগে। পর পর শব্দের প্রতিশব্দ বসিয়ে দিয়ে ভাষান্তর করা যায়, কিন্তু মূল ভাব ধরে রাখার কাজটা শক্তিমান শব্দশিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। দস্তয়ভস্কির ভাবের গভীরতার ধারে কাছে যাওয়াও আমার অসাধ্য। মানুষের অন্তর্জগতের এত গভীরে দস্তয়ভস্কির মতো  আর কেউ  ঢু মেরেছেন বলে আমার জানা নেই। প্রায় দু'শ বছর আগে আজকের দিনে জন্মেছিলেন ফিওদর দস্তয়ভস্কি। শুভ জন্মদিন বস্‌।

১১/১১/২০২০

আর্নল্ড সামারফেল্ড

 


স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা পদার্থবিজ্ঞান পড়েছেন তাঁরা সবাই জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ডের নাম শুনেছেন। পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেলের শুরু হয়েছে বোর মডেলের মধ্য দিয়ে। শুরুতে পরমাণুর সব কক্ষপথকেই বৃত্তাকার বলে ধারণা করা হয়েছিল। সামারফেল্ড তখন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর। তিনি গবেষণা করে ধারণা দিলেন যে ইলেকট্রনের কক্ষপথ বৃত্তাকার কিংবা উপবৃত্তাকার হতে পারে। এবং তিনি ইলেকট্রনের সাবশেল বা উপ-কক্ষপথের ধারণাও দেন। আর্নল্ড সামারফেল্ড ছিলেন ব্যতিক্রমী শিক্ষক। ইওরোপে – বিশেষ করে জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক অত্যন্ত ফরমাল। সেক্ষেত্রে আর্নল্ড সামারফেল্ড ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুব আন্তরিক। তিনি বন্ধুর মতো মিশতেন তাদের সাথে। ছাত্রদের যে কোন সমস্যায় তিনি এগিয়ে আসতেন। আইনস্টাইন তাঁর এই গুণটার তুলনা করেছেন – জ্ঞানের মাটিতে সোনা ফলানোর সাথে। ছাত্রদের মেধাবিকাশে সাধ্যাতীত চেষ্টা করতেন সামারফেল্ড। তাঁর গবেষণা-ছাত্রদের সবাই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। (তখনো ইওরোপে পদার্থবিজ্ঞানে ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল নগণ্য)। তাঁর চারজন ছাত্র নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন -  কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ  অনিশ্চয়তার নীতির জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩২ সালে, পিটার ডিবাই মলিকিউলার স্ট্রাকচারের গবেষণায় রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩৬ সালে, উল্‌ফগং পাউলি এক্সক্লুশান প্রিন্সিপালের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৪৫ সালে, হ্যান্স বেথে স্টেলার নিউক্লিওসিন্থেসিসের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৬৭ সালে। সামারফেল্ডের চার জন ছাত্র নোবেল পুরষ্কার লাভ করলেও – সামারফেল্ড নিজে নোবেল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের জন্য সামারফেল্ড সবচেয়ে বেশিবার মনোনয়ন পেয়েও নোবেল পুরষ্কার পাননি। ১৯১৭ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে তিনি ৮৪ বার মনোনয়ন পেয়েছিলেন নোবেল পুরষ্কারের জন্য। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি কর্মক্ষম ছিলেন। শেষের দিকে তিনি কানে শুনতেন না। ১৯৫১ সালে ৮২ বছর বয়সে রাস্তা পার হবার সময় চলন্ত ট্রাকের হর্নের শব্দ শুনতে পাননি তিনি। ট্রাকের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়েন তিনি। সেই ধাক্কা আর সামলাতে পারেননি। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে মৃত্যু হয় এই মহান শিক্ষক, মহান বিজ্ঞানীর। 
আজ সামারফেল্ডের জন্মদিন। 

৫/১২/২০২০


আমাদের রশীদুন্নবী স্যার

 



রশিদুন্নবী স্যারের প্রথম ক্লাস আমরা পেয়েছিলাম সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর। তিনি আমাদের ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম পড়াতেন। সেবছরই  তিনি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি একটা ক্লাসও মিস করতেন না।  থার্ড ইয়ারে প্রথম যেদিন ইলেকট্রোডায়নামিক্স ক্লাস নিলেন, মনে হলো স্বয়ং ম্যাক্সওয়েল আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন। বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের চেহারার সাথে কেমন যেন মিল ছিল রশিদুন্নবী স্যারের।  শ্বেত-শ্মশ্রুমন্ডিত দরবেশের মতো সুদর্শন রশিদুন্নবী স্যারের হাতের লেখা ছিল যেমন চমৎকার, তেমনি চমৎকার ছিল তাঁর বাচনভঙ্গি। এত সুন্দর করে হাসিমুখে ফিজিক্স বোঝাতেন যে মনের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্মে যেতো। ফাইনাল ইয়ারে আমরা কক্সবাজারে গিয়েছিলাম পিকনিক করতে। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে রশিদুন্নবী স্যারও গিয়েছিলেন আমাদের সাথে। আমাদের হৈ চৈ ছেলেমানুষীতে অন্যান্য স্যার-ম্যাডামরা যখন মাঝে মাঝে ধমক দিয়েছেন, রশিদুন্নবী স্যার তখন সস্নেহে প্রশ্রয় দিয়েছেন আমাদের। পরের দিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল তাঁর। ভোর রাতে উঠে তিনি কক্সবাজার থেকে এসে মিটিং-এ অংশ নিয়েছিলেন। আমরা জানতেও পারিনি যে তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যেও আমাদের অনুরোধে আমাদের সাথে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের পর স্যারের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। কিন্তু স্যারকে ডিপার্টমেন্টে যতদিন দেখেছি – সবকিছুই মনে আছে এখনো। আমার মতো স্যারের অন্য সব ছাত্র-ছাত্রীরও মনে আছে নিশ্চয়। স্যার আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষকতো বেঁচে থাকেন তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের স্মৃতির ভেতর দিয়ে। সৈয়দ রশিদুন্নবী স্যারও আছেন, থাকবেন।

৭/১২/২০২০

এ টি এম শামসুজ্জামান

 



এটিএম শামসুজ্জামানকে বাংলাদেশের সিনেমার দর্শকরা ভিলেন হিসেবেই চিনেন। তাঁকে বেছে বেছে সেরকম চরিত্রই দেয়া হতো, কিংবা তাঁর কথা মাথায় রেখেই সেরকম চরিত্র তৈরি করা হতো। আমাদের দেশের মেইনস্ট্রিম সিনেমার সংলাপ আর অভিনয়ে অতিনাটকীয়তা থাকেই। এটিএম শামসুজ্জামানও সেক্ষেত্রে খুব বেশি ব্যতিক্রমী ছিলেন না। তাঁকে পর্দায় দেখলেই দর্শক বুঝে ফেলতেন যে তিনি ঋণাত্মক ভূমিকায় অভিনয় করছেন। তাঁর মতো শক্তিমান অভিনেতাকে বাংলা সিনেমার পরিচালকরা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারেননি, যেটা পেরেছিলেন টেলিভিশনের নাটক নির্মাতারা - সিনেমাযুগের প্রায় অন্তদশা হবার পর। এটিএম শামসুজ্জামান যে প্রতিভাবান লেখক ও চিত্রনাট্যকার ছিলেন তার পরিচয় পেয়েছিলাম 'সীমার' সিনেমায়। সিনেমাটি খুব একটা ব্যবসাসফল হয়নি, কিন্তু কী চমৎকার কাহিনি। রাজনৈতিক নেতাদের টোপে পড়ে কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ পরিণত হয় ভয়ানক গুন্ডায়। আবার যখন ভালো মানুষের সংস্পর্শে এসে ভালো হতে চেষ্টা করে - তখন কীভাবে নেতারা তাকে ভালো হতে দেয় না। প্রকৃত শিল্পী কখনোই আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন না। এটিএম শামসুজ্জামান ছিলেন প্রকৃত শিল্পী। প্রতিভার পূর্ণ-প্রকাশের সুযোগ পাননি বলে আক্ষেপ নিয়ে চলে গেলেন।

২১/২/২০২১

আইনস্টাইন ও হকিং স্মরণে

 




বিজ্ঞান খুবই নৈর্ব্যক্তিক বিষয়। আদর্শিক অবস্থান থেকে বিজ্ঞানে ব্যক্তিপূজার কোনো স্থান নেই। তারপরও দেখা যায় মানুষ বিজ্ঞানীদের জীবন ও ব্যক্তিত্বকে ভালোবেসে তাদের জন্মদিন উদ্‌যাপন করে, মৃত্যুদিন স্মরণ করে। বিজ্ঞানীরাও যে রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদেরও ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ঘুম আছে, তারাও দরকার হলে ঝগড়া করেন, প্রেম করেন, বিয়ে করেন, তালাক দেন - এসব জানতে আমাদের খুব ভালো লাগে। আর খুব মজার ব্যাপার হলো বিজ্ঞানীরা এই পৃথিবীতে তাঁদের আবিষ্কারের চেয়েও ব্যক্তিত্ব ও প্রচারের কারণে জনপ্রিয়তা পান বেশি। জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে পৃথিবীর যে দুজন বিজ্ঞানীর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, তাঁরা হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন এবং স্টিফেন হকিং। ১৪ মার্চ তারিখের সাথে এই দু'জন বিজ্ঞানীর জীবনের দুটো প্রধান ঘটনার যোগ আছে। এই দিনে ১৮৭৯ সালে জন্মেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আর ২০১৮ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেছেন স্টিফেন হকিং। ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের যখন মৃত্যু হয় তখন স্টিফেন হকিং-এর বয়স মাত্র ১৩ বছর। আইনস্টাইনের জীবদ্দশায় এই দুই বিজ্ঞানীর মধ্যে কোন যোগসূত্র তৈরি হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীর যে মৃত্যু হয় না, তার প্রমাণ আমরা প্রতিনিয়তই পাই। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব দিয়ে মহাবিশ্বের হিসেবনিকেশ বদলে দিয়েছিলেন। আর স্টিফেন হকিং আইনস্টাইনের মহাবিশ্বের জটিল হিসেবনিকেশকে নিয়ে গিয়েছেন অন্যমাত্রায়। আইনস্টাইন জীবদ্দশায় ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। আর হকিং - এই ব্ল্যাকহোলের তত্ত্ব শুধু প্রতিষ্ঠা করেছেন তা নয়, ব্ল্যাকহোল খুঁজে পাবার পথ দেখিয়েছেন। ব্ল্যাকহোল এখন আর তত্ত্ব নয়, বাস্তব। বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব আমরা বুঝি বা না বুঝি তাতে মহাবিশ্বের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমরা সবাই আইনস্টাইন ও হকিং-কে ভালোবাসি তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভালোবাসার জন্য সবকিছু বুঝতে হবে এমন কোন কথা নেই। আজকের দিন ১৪ মার্চ - আইনস্টাইন ও হকিং এর দিন।

১৪/৩/২০২১

জামাল নজরুল ইসলাম - শ্রদ্ধার্ঘ্য

 




আজ জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের মৃত্যুবার্ষিকী।
আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই, জামাল নজরুল ইসলাম স্যার তখন গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। স্যার যে কতবড় বিজ্ঞানী ছিলেন - সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই ছিল না। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের দখলে থাকার কারণেই হয়তো - যে কোন মুক্ত আলোচনার উপর এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। বৈজ্ঞানিক সেমিনারেও সৃষ্টিতত্ত্ব বা কসমোলজি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি - যেমন বিগব্যাং থিওরি - বাধাহীনভাবে আলোচনা করা যেতো না। গবেষণা সেমিনার যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন জ্ঞান তৈরি এবং নতুন জ্ঞান বিস্তারের প্রধান পথ, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক সেমিনার প্রায় হতোই না বললে চলে। আমাদের স্যার-ম্যাডামদের কে কী বিষয়ে গবেষণা করছেন - আমরা ঠিকমতো জানতেও পারিনি কোনদিন। জামাল নজরুল ইসলাম স্যার আমাদের ক্যাম্পাসে থাকা সত্ত্বেও আমরা স্যারের সান্নিধ্যে আসার সেরকম কোন সুযোগ পাইনি। স্যারের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পর্কেও আমরা তেমন কিছুই জানতাম না। জামাল স্যার বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় অধ্যাপনা এবং গবেষণা ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনের অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছিলেন বলে আমরা স্যারকে নিয়ে গর্ববোধ করি, স্যারের প্রশংসা করি। কিন্তু সেই ১৯৮৪ থেকে ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত স্যার বাংলাদেশে ছিলেন, একটা গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু বিশ্ব পদার্থবিজ্ঞানের মহাসড়ক থেকে স্যার সরে গিয়েছিলেন। স্যার কম্পিউটার ব্যবহার করতেন না। কিন্তু ততদিনে ইন্টারনেট হয়ে পড়েছে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। এখন আর কে কোথায় বসে গবেষণা করছেন তা খুব বেশি ধর্তব্য নয়। এখন বিজ্ঞানের ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে গেছে ইন্টারনেটের কল্যাণে। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম স্যার - এই বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন যোগাযোগের মাধ্যমকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে। স্যারের অসীম বৈজ্ঞানিক ক্ষমতার ধরতে গেলে তেমন কিছুই আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।

১৬ মার্চ ২০২১




Tuesday, 18 May 2021

বাবা - ২

 



আজ আমার বাবার জন্মশতবার্ষিকী। ১৯২১ সালের ১৮ মে তাঁর জন্ম। 

আমাদের ছোটবেলায় এবং বড়বেলাতেও জন্মদিন পালনের কোন রেয়াজ ছিল না। আমাদের কার কখন জন্মদিন তা মনেও থাকতো না। ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় জন্মদিনের ব্যাপারটা মাথায় আসে। আমার বাবা খুব উৎসব করে একটা জন্মদিন পালন করতেন। সেটা ছিল তাঁর গুরু অদ্বৈতানন্দের জন্মদিন। শুধু অদ্বৈতানন্দ বললে বাবা খুব অসন্তুষ্ট হতেন। গুরুর ব্যাপারে তিনি খুব স্পর্শকাতর ছিলেন। অনেক বিশেষণ লাগিয়ে বলতে হতো শ্রীমৎ অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ। আর মহারাজদের তো জন্মদিন হয় না, হয় জন্মোৎসব। হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে উৎসব হতো প্রতি বছর ৪ঠা জৈষ্ঠ্য। পরে জেনেছি একই দিনে আমার বাবারও জন্ম। বাবাকে না বললেও - আমরা ভাই-বোনরা ধরে নিতাম ওটা আমার বাবারই জন্মদিন পালন। যদিও বাবাকে কখনোই বলা হয়নি - শুভ জন্মদিন বাবা। এখনকার মতো প্রচলিত ছিল না এই বাক্যগুলি।
    তাঁর আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো কোনদিনই ছিল না। কিন্তু তাঁর গুরুদেবের জন্মোৎসবে প্রায় চার-পাঁচ শ মানুষের জন্য পাঁচ রকমের নিরামিষ তরকারির ভোজের ব্যবস্থা তিনি করতেন। আমাদের বাড়িতে জায়গা তেমন ছিল না। বাজারের উপর আমাদের দোতলা বাড়ির নিচের তলায় আমাদের দোকান, দোতলায় আমরা থাকি। ভোজের আয়োজন হতো রাতের বেলা রাস্তার উপর। বেতের আসন বিছিয়ে বসা, আর কলাপাতায় খাওয়া। তখন আমাদের ওদিকের রাস্তায় রিকশা আর ঠেলাগাড়ি ছাড়া অন্য কোন গাড়ি চলতো না। যখন থেকে রাস্তার ব্যস্ততা বেড়ে গেল, বাজার বড় হলো, অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হলো - এই উৎসব স্থানান্তরিত হলো কালিবাড়িতে। আরো পরে বাবা নিজেই এটা বন্ধ করে দিলেন। তিনি তাঁর সন্তানদের উপর কোন ধরনের কাজ চাপিয়ে দিয়ে যাননি। 
    তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয় ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে। আমি বাড়ি থেকে চলে আসার সময় তিনি আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন - "তোর সাথে আর দেখা হবে কি না জানি না। তবে তুই আমাকে দেখতেই থাকবি। আমি তোর সাথে সাথেই থাকবো।" 
    বাবা মাঝে মাঝেই অনেক দার্শনিক কথাবার্তা বলতেন। এটাও সেরকম একটা কথা বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দিনে দিনে বুঝতে পারছি - তাঁর কথাগুলি ক্রমশ সত্যি হয়ে যাচ্ছে। যতই বয়স বাড়ছে আমার চেহারা আমার বাবার মতো হয়ে যাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই তাঁকে দেখা যায়। 

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts