Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts

Friday, 8 June 2018

একজন পলাতকের বিজয় ভাবনা


সে আমার নাম দিয়েছে পলাতক। শুধু আমি নই, আমরা যারা পড়ালেখা করার নামে দেশের বাইরে এসে আর ফিরে যাইনি - সবাই নাকি পলাতক। যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেছি দেশ থেকে - এটাই তার যুক্তি। আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের যতগুলো যুক্তি আছে - তার কোনটাই কাজ করে না তার কাছে। সে মনে করে বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক দেশের বাইরে কাজ করতে যান - তাঁরা অনেক বেশি দেশপ্রেমিক - আমাদের চেয়ে। তাঁরা সারাজীবন দেশের বাইরে থাকলেও দেশেরই থাকেন। আর আমরা - দু'দিন দেশান্তরী হয়েই চিরদিনের জন্য দেশ ছাড়ি।
২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়েছিল এই লেখা। 














Thursday, 7 June 2018

অভিজিতের মৃত্যু নেই


আমি তাঁকে ডাকি 'গুরু' বলে। অভিজিৎ বিরক্ত হন। কারণ এক অর্থে এই পৃথিবী তথাকথিত গুরুদের জ্বালায় অস্থির। রাজনৈতিক গুরু, ধর্মীয় গুরু, সন্ত্রাসের গুরু এরকম আরো কত কী গুরুর দাপটে সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া সরল মানুষ, লেখাপড়া জানা ছাপোষা মানুষ, লোভী মানুষ, হাজার বছরের লালিত সংস্কারে আচ্ছন্ন দুর্বল মানুষ বড়ই বিপন্ন আজ। তাই 'গুরু' ডাকে অভিজিতের আপত্তি। আমিও বুঝি ব্যাপারটা। কিন্তু গুরু বলতে শিক্ষকও তো বোঝায়। যাঁর কাছ থেকে প্রতিদিনই আমি মুক্তমনা হবার পাঠ নিই তিনি তো আমার গুরুই।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই পড়ছি সেই কৈশোর থেকে। আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন, জহুরুল হক, তপন চক্রবর্তী, সুব্রত বড়ুয়া থেকে শুরু করে পশ্চিম বঙ্গের অনেক লেখকের বইও পড়া হয়েছে ততদিনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যখন ইংরেজিতে কিছু জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই পড়ার সুযোগ হয় - তখন এক নতুন ধরনের তৃষ্ণা জেগে ওঠে। মনে হতে থাকে, বাংলাভাষায় বিজ্ঞানের বইগুলো কেন এরকম প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে না? ২০০৫ সালে হাতে এলো 'আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী'। বইটি পড়ে মনে হলো - এরকম একটা বইয়ের জন্যই আমি আকুল হয়ে বসেছিলাম। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান যে কত গভীর অথচ কত তরতাজা হতে পারে তার প্রমাণ অভিজিৎ রায় তাঁর প্রকাশিত প্রথম বইতেই দিয়েছেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তরুণ বিজ্ঞানী অভিজিৎ রায়ের চিন্তা ও লেখার আকাশচুম্বী ক্ষমতা।




'আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী'র মলাট-তথ্য থেকে জানতে পারলাম 'মুক্তমনা' নামে একটা ওয়েবসাইট আছে যেখানে বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোচনা হয়পশ্চিম বঙ্গের প্রবীর ঘোষ যেভাবে যুক্তিবাদী সমিতি দাঁড় করিয়ে 'অলৌকিক নয় লৌকিক' এবং অন্যান্য বইগুলোর মাধ্যমে মানুষের মানসিক অন্ধত্ব দূর করার সংগ্রাম শুরু করেছেন, সেরকম কোন প্রচেষ্টা বাংলাদেশে হতে পারে তা ভাবতেও সাহস পাইনি সেই সময়। কিন্তু মুক্তমনা ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম - যে মহৎ কাজের কথা আমি ভাবতেও সাহস পাচ্ছিলাম না তা ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন অভিজিৎ রায়, ফরিদ আহমেদ, বিপ্লব পাল, জাফরউল্লাহ সহ আরো অনেক মুক্তমনা মানুষ।

২০০৬ সালে আমি মুক্তমনায় লিখতে শুরু করি। শুরু থেকেই অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের কাছ থেকে যে উৎসাহ পেয়েছি তা আমাকে ঋদ্ধ করেছে। তারপর আমার যা কিছু লেখা তার সবটুকুই হয়েছে মুক্তমনার জন্যমুক্তমনার সংস্পর্শে এসে প্রতিদিন একটু একটু করে মুক্তমনা হতে চেষ্টা করছি আমি এবং আমার মতো আরো অসংখ্য মানুষ। মুক্তমনায় আমরা মন খুলে আলোচনা করছি, সমালোচনা করছি, লিখছি, পড়ছি, শিখছি এবং ক্রমশ মুক্ত মনের মানুষ হবার পাঠ নিচ্ছি। আর এসব কর্মযজ্ঞের প্রধান পরশ পাথরের নাম অভিজিৎ রায়।

২০০৭ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর দ্বিতীয় বই 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে'বইটি তিনি লিখেছেন ফরিদ আহমেদের সাথে। মহাকাশ গবেষণার সাম্প্রতিকতম ফলাফল পর্যন্ত বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ এই বই বাংলাভাষায় বিজ্ঞান বইয়ের জগতে আরেকটি মাইলফলক।








বাংলাদেশের মত রক্ষণশীল দেশে সমকামিতা বা সমপ্রেম, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে যৌক্তিক কোন আলোচনা কখনোই হয় না বললে চলে। কারণ আমরা লজ্জা পাই, ভয় পাই সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার। কিন্তু প্রকৃত গবেষক অভিজিৎ রায় কী নির্মোহ অথচ প্রাঞ্জল যুক্তিবোধের আলোকে আমাদের জন্য রচনা করেন সমকামিতা বিষয়ে বাংলাভাষায় প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র গবেষণাগ্রন্থ 'সমকামিতা একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান'শুদ্ধস্বর থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে।





পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর 'অবিশ্বাসের দর্শন'বইটির যুগ্মলেখক রায়হান আবীর। বাংলায় বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক মনন-দর্শনের এই বই ব্যাপক সাড়া ফেলে বিদ্বজন সমাজে। প্রকাশিত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বইটির কয়েকটি মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়। বইটির তৃতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এ বছর।




 ভালোবাসা-বাসি নিয়ে আমরা বাঙালিরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বড় বেশি ভাবুক। মনে মনে আমরা সবাই কমবেশি প্রেমিক/প্রেমিকা। কিন্তু আমাদের ভাবনার স্তর একটা নির্দিষ্ট মাত্রার গভীরে কখনোই প্রবেশ করে না। বহুমাত্রিক অভিজিৎ রায় হাত দিলেন এই বিষয়ে। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর 'ভালোবাসা কারে কয় মানব মনের বৈজ্ঞানিক ভাবনা'ভালোবাসার এমন মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ গবেষণা আর কোন বাংলা বইতে আমরা পাইনি। একজন বিজ্ঞানী যে কতটা বহুমাত্রিক হতে পারেন - তার উজ্জ্বল উদাহরণ অভিজিৎ রায়। 




শত যুক্তির আলোকেও কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা আলোকিত হতে চান না। আসলে চান না নয়, পারেন না। কারণ তাঁদের মস্তিষ্কে এক ধরনের ভাইরাস আক্রমণ করেছে - বিশ্বাসের ভাইরাস। এই বিশ্বাসের ভাইরাস যে কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে - তার সাম্প্রতিক নমুনা আমরা দেখলাম। কিছু ভাইরাস আক্রান্ত মানুষ অভিজিৎ ও বন্যাকে আক্রমণ করলোধারালো চাপাতির আঘাতে তাঁদের ছিন্নভিন্ন করলোঅভিজিৎ রায় তাঁর 'বিশ্বাসের ভাইরাস' বইতে লিখে গেছেন যে কীভাবে মানুষের মগজ ধোলাই হয়, কীভাবে মানুষ হয়ে পড়ে বিশ্বাস নামক ভাইরাসের দাস, কীভাবে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার সমস্ত মানবিক গুণ। 'বিশ্বাসের ভাইরাস' বইটি আমাদের বাংলাভাষার পাঠকদের একটা অবশ্য-পাঠ্য বই।





'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব' বইটি প্রকাশিত হয়েছে  ২০১৫ সালে। বইটির সহলেখক অধ্যাপক মীজান রহমানকে আমরা হারিয়েছি সম্প্রতি। মহাবিশ্বের উদ্ভব কীভাবে হয়েছে তার এমন চমৎকার প্রাণবন্ত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেয়া একমাত্র অভিজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভব।




ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তাঁর ভ্রমণ ও গবেষণামূলক বই 'ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে' প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের বইমেলায়। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে শতাধিক বছর ধরে, প্রকাশিত হয়েছে হাজারো গ্রন্থ। কিন্তু অভিজিৎ রায় তাঁর এই বইতে এমন কিছু সন্নিবেশন করেছেন যা আগে কোন রবীন্দ্র-গবেষক আমাদের দিতে পারেননি। বাংলার খ্যাতিমান গবেষক গোলাম মুরশিদ নিজে বলেছেন এই কথা অভিজিৎ রায়ের বইটি সম্পর্কে।




এই বইগুলো ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন দুটো বিশাল বই: 'স্বতন্ত্র ভাবনা' এবং 'বিশ্বাস ও বিজ্ঞান'বাংলাভাষী মুক্তমনাদের লেখা ছাড়াও ইংরেজিভাষী মুক্তমনাদের লেখার স্বাদ আমাদের দেবার জন্য তিনি অনেক দরকারি লেখা অনুবাদ করেছেন, করিয়ে নিয়েছেন আমাদের দিয়ে। নিজের যোগ্যতায় ক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার আধুনিক মননের বাতিঘর। আমরা অনেকেই তাঁকে বাংলার 'রিচার্ড ডকিন্স' বলেও মানি







অভিজিৎ রায় এমন একজন মানুষ যিনি যখন কিছু বলেন - পুরোটা জেনেই বলেন। গবেষণা তাঁর ধমনীতে। বিষয়ের গভীরে ঢুকে যাবার ব্যাপারে তাঁর মতো আর কাউকে তেমন দেখা যায় না। অথচ এই মানুষটার একটুও অহংকার নেই। যে কোন মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে এই মানুষটার একটুও সময় লাগে না। ব্লগে এই মানুষটার নামে কত যা তা বলেছে ভাইরাস-আক্রান্ত মানুষেরা। কিন্তু অভিজিৎ একটা বারের জন্যও পরিমিতিবোধ হারাননি। একটা শব্দও তাঁর কলম দিয়ে কখনো বের হয়নি যেটা কোন মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করতে পারে। জীবন বাঁচানোর জন্য যে ইন্‌জেকশান দিতে হয়, তাতে কিছুটা ব্যথা লাগে। তার জন্য কেউ কি কোন ডাক্তারকে খুন করে? অভিজিৎ রায় আমাদের মননের ভাইরাস সারানোর ডাক্তার।

 ৩

অভিজিৎ রায় - শুধু একজন মানুষের নাম নয়, একটি আন্দোলনের নাম - মুক্তমনা আন্দোলন। বাংলাভাষী মুক্তমনাদের প্রাণের শক্তি আজ অভিজিৎ রায়। ঘাতকের ধারালো চাপাতি ভেদ করেছে অভিজিতের মগজ, হত্যা করেছে অভিজিতের শরীর। কিন্তু অভিজিৎ রায় যে আন্দোলনের সূচনা করে গেছেন, বিজ্ঞান ও যুক্তির যে আলো জ্বালিয়ে দিতে পেরেছেন অসংখ্য মানুষের মনে, তাকে হত্যা করার সাধ্য কারো নেই। আমাদের শোক পরিণত হোক আমাদের শক্তিতে। আমাদের লেখনি চলবেই। 



28/02/2015
Melbourne



আলো হাতে অভিজিৎ রায়




অভিজিৎ রায়ের লেখা আমি প্রথম পড়ি সাপ্তাহিক যায় যায় দিনে। শফিক রেহমানের সাপ্তাহিক যায় যায় দিন বাংলাদেশে এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। অভিজিৎ রায়ের লেখাটির শিরোনাম মনে নেই, তবে বিষয়বস্তু মনে আছে। বাংলা সাহিত্যে যৌনতা প্রকাশের মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা এরকম কিছু। লেখাটি এতটাই আধুনিক এবং অন্যরকম ছিল যে অভিজিৎ রায় নামক লেখকের অন্য লেখার খোঁজ করতে শুরু করি।

টেকনোলজিতে আমি খুঁড়িয়ে চলা মানুষ। ইন্টারনেটে যে তিনি বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন তা জানতেও পারিনি সেই সময়। ২০০৫ সালের শেষের দিকে আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকান থেকে পেয়ে গেলাম 'আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী'বইটা পড়ে মনে হলো অভিজিৎ রায় সত্যিই আলো হাতে বের হয়ে পড়েছেন আমরা যারা মনের কোণের অন্ধকারে ঈশ্বরের-ইচ্ছা-ছাড়া-গাছের-একটা-পাতাও-নড়ে-না জাতীয় অন্ধ-বিশ্বাসে ভর করে বেঁচে আছি তাদের চোখ খুলে দিতে। বইটি পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে ভাবতে বসলাম - এভাবেও বিজ্ঞান লেখা যায়? এত গভীর অথচ একটুও ভার লাগে না। এত জটিল বিষয় অথচ কত স্বচ্ছন্দ। বাংলায় বিজ্ঞান রচনায় একটা নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছেন অভিজিৎ রায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের মাধ্যমে।

'আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী'র মলাট-তথ্য থেকে জানতে পারি মুক্তমনা ওয়েবসাইট সম্পর্কে। মুক্তমনা ততদিনে পাঁচ বছর পার করে ফেলেছে। মুক্তমনা শব্দটি এতটাই জুৎসই এবং জোরালো ছিল আমার কাছে যে মুক্তমনার নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠতে আমার বেশিদিন সময় লাগেনি। মুক্তমনার যে ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল তা হলো সত্যিকারের মুক্তভাবে আলোচনার একটা প্লাটফর্ম। গভীর বিশ্লেষণ আর যুক্তির চর্চা চলছে সেখানে।

বাংলাদেশের গ্রামে প্রায় গর্তজীবী হয়ে বেড়ে উঠেছি আমি। সেখানে নিত্যদিন দেখেছি পেশির জোরের জয়। পেশির জোর বেশি না থাকলে নিদেন পক্ষে গলার জোর। বাংলাদেশে সবকিছুই বড় বেশি ব্যক্তিনির্ভর। বস্তুনিষ্ঠতার ঠাঁই সেখানে নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে অনেকের মতো আমারো অনেক ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।

বাংলাদেশে আমার পুরো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের শাসনে তলোয়ারের ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে। একটা ঘটনার কথা বলা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের সেমিনার 'কোরান তেলাওয়াত' ছাড়া শুরু হওয়ায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় ছাত্রশিবির। তাদের সাথে যোগ দেয় বিভাগের অনেক মৌলবাদী ইসলামী-পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু বিভাগীয় সভাপতি বললেন, "বিজ্ঞানের সেমিনার কি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান? আকিকা কিংবা জানাজা? জানাজায় গিয়ে আমি বিগ ব্যাং ও ব্ল্যাক হোলের তত্ত্ব আলোচনা করতে শুরু করলে ভালো লাগবে? বৈজ্ঞানিক সেমিনারে ধর্ম টেনে এনো না।" ছাত্র শিবির বললো, "তোমাকে টেনে ব্ল্যাক হোলে ঢুকিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি ব্যাটা নাস্তিক।" কার্যত তাই হলো। ছাত্রশিবির ওই প্রফেসরের দিনরাত্রি যন্ত্রণাময় করে তুললো। বাসায় তালা লাগিয়ে দিয়ে মাইক লাগিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে দিনের পর দিন। তবুও সান্ত্বনা যে প্রাণে মেরে ফেলেনি স্যারকে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন চুপচাপ মজা দেখেছে সেদিন। সেই প্রফেসরের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর গবেষণা করার কারণে আমাকেও সইতে হয়েছে অনেক দুর্ভোগ। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

প্রবীর ঘোষের 'অলৌকিক নয় লৌকিক' এবং অন্যান্য বই পড়ে খুব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কাজকর্ম দেখে একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনে হতো - তারা ভারতে বসে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার ও শোষণ এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে যেরকম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছেন সাংগঠনিকভাবে - বাংলাদেশে তা কতটুকু সম্ভব? অসম্ভব বলেই মনে হতো আমার। বাংলাদেশে তখন কেউই যে যুক্তিবাদের পক্ষে লিখছেন না তা কিন্তু নয়। আহমদ শরীফ এবং হুমায়ূন আজাদের লেখাগুলো যথেষ্ট উদ্দীপনাময়। কিন্তু তাঁদের লেখায় আবেগ একটু বেশি বলে মনে হয়েছে আমার। একেবারে নিরাবেগ হয়ে যুক্তির কথা বলা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু সেটা পাবার জন্যই মনের মধ্যে প্রচন্ড একটা তৃষ্ণা কাজ করছিল সব সময়।

মুক্তমনার ফোরামে খোলামেলা আলোচনা চলতে দেখে এবং আলোচনার ধরন দেখে মনে হলো এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতদিন। মুক্তমনায় দেখলাম যুক্তির আলোয় মনের আঁধার কেটে যাচ্ছে। যে মানুষটি মুক্তমনা দাঁড় করিয়েছেন এবং বিশাল বিশাল প্রবন্ধ লিখে চলেছেন তিনি অভিজিৎ রায়। আমি অভিজিৎ রায়ের লেখা এবং কাজ ভালোবেসে ফেললাম। মুক্তমনার প্রতি নিজের ভালোলাগার কথা জানিয়ে দুই পৃষ্ঠা লিখেও ফেললাম। লিখে ই-মেইল করে দিলাম মুক্তমনার ঠিকানায়। এক দিনের মধ্যেই আমি একটা ই-মেইল পেলাম স্বয়ং অভিজিৎ রায়ের কাছ থেকে। মুক্তমনায় নিয়মিত লেখার ব্যাপারে উৎসাহ জাগানিয়া উদার ই-মেইল।

অভিজিৎ রায়ের মতো এত শক্তিশালী লেখক এবং প্রভাবশালী সম্পাদকের কাছ থেকে আমি এতটা উদারতা আশা করিনি। কারণ আমি মনে করতাম যিনি যত বেশি শক্তিশালী লেখক তিনি তত বেশি অহংকারী এবং তিনি তত বেশি ধরা-ছোঁয়ার-বাইরে। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক আর হুমায়ূন আজাদকে দেখেছি তীক্ষ্ণ ভাষায় ব্যক্তিগত ঝগড়া করে জানান দিতে যে কে কত বড়। হুমায়ূন আজাদের লেখা এবং কথায় এত বেশি আমি-আমি-আমি-আমি থাকতো যে মাঝে মাঝে বেশ অস্বস্তিই লাগতো। আমি-কেন-ঈশ্বরে-বিশ্বাস-করি-না খ্যাত প্রবীর ঘোষেরও সব বইতে দেখেছি তাঁর নিজের প্রশংসা, নিজের কৃতিত্বের কথা। বড় বাঙালি লেখকরা অন্য বাঙালি লেখকের বেশি প্রশংসা কখনোই করবেন না এটাই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম দেখলাম অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে। এই মানুষটা যেন প্রশংসার সাগর। কারো লেখা একটু ভালো লাগলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। অথচ নিজের ব্যাপারে অসম্ভব বিনয়ী।

২০০৫ সাল থেকে ২০১৫- এই দশ বছরে অভিজিৎ রায় আটটি বই লিখেছেন এবং দুটো বই সম্পাদনা করেছেন। এই বইগুলোর প্রত্যেকটাই একেকটা নতুন মাইলফলক। তাঁর সর্বশেষ বিজ্ঞান বই "শূন্য থেকে মহাবিশ্ব" বাংলা ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞানের বইয়ের জগতে অনন্য সংযোজন। এই বইটা তিনি লিখে শেষ করেন ২০১৩ সালে। প্রকাশককে পাঠানোর আগে বইটির পান্ডুলিপি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। এটা ছিল আমার কাছে পরম সম্মানের বিষয়। শুদ্ধস্বর ২০১৩ সালে বইটির পান্ডুলিপি জমা নিয়েও ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশ করেনি। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়। এই মেলাই ছিল অভিজিৎ রায়ের শেষ বইমেলা।

২০০৬ সাল থেকে অভিজিৎ রায়ের লেখার নিয়মিত পাঠক আমি। লেখক অভিজিৎ রায় বাংলাদেশের মুক্তমনা আন্দোলনের পথিকৃৎ। বাংলার তরুণ সমাজে অভিজিৎ রায়ের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। মুক্তমনা ব্লগের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অভিজিৎ রায় ছিলেন মুখর। যে কোন সামাজিক রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক মানবিক সমস্যায় সোচ্চার একটি নাম - অভিজিৎ রায়। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই অভিজিৎ রায়ের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তি অভিজিতের সাথে আমার পরিচয় তেমন ছিল না। দেখা হয়নি কোনদিন। টেলিফোনেও কথা হয়নি। কিন্তু আমার লেখার ব্যাপারে সবসময়েই উৎসাহ দিয়েছেন তিনি। 

উপমহাদেশের ১১জন পদার্থবিজ্ঞানী বইয়ের একটা ভূমিকা লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলাম। বলেছিলাম, "সময় করে আমার বইয়ের একটা ভূমিকা লিখে দেবেন?"

তিনি বলেছিলেন, "লিখে দেবো না মানে? আমার বাবা লিখে দেবে।" 

তিনি সত্যিই তাঁর বাবা অজয় রায়কে দিয়ে আমার বইয়ের ভূমিকা লিখিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়। শুদ্ধস্বর আমার পান্ডুলিপি জমা নিয়েও যখন বছর দেড়েক প্রকাশের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নিচ্ছিলেন না তখন অভিজিৎ টুটুল ভাইকে বলেছিলেন, "দরকার হলে আমার বইয়ের কাজ বন্ধ রেখে হলেও প্রদীপের বইটা ধরেন।" এতটা উদারতা অভিজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভব। 


২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির পর মুক্তমনার পৃথিবী বদলে যায়। আমূল বদলে যায়। যে বইয়ের মাধ্যমে  লেখার মাধ্যমে লেখক অভিজিৎ রায় সমাজ পরিবর্তনের কাজ শুরু করেছিলেন, সেই বইমেলাতে অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে চুপচাপ ভীড়ের মধ্যে মিশে যায় খুনিরা। বইমেলায় আলো ছিল। বইমেলায় ভীড় ছিল। বইমেলায় সহস্র মানুষ ছিল। সেই মানুষের হাতে মোবাইল ছিল। মোবাইল বের করে ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল, সময় ছিল। কিন্তু খুনিকে ধরার সাহস ছিল না কারো। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদকে সাহায্য করার জন্য হাত ছিল না কারো।

তারপরের কাহিনি সবার জানা। কত রকমের আস্ফালন। কত রকমের চরিত্র-হনন। মাস পেরোতেই খুন হয়ে যান আশিকুর রহমান। তারপর অনন্ত বিজয়। তারপর নিলয় নীল। তারপর ...। 

রাষ্ট্র চুপ করে আছে। না, ঠিক চুপ করে নেই - বলছে নাস্তিকরা শাস্তি পাবে। কত রকমের রাষ্ট্রীয় ধারা আছে এখন নাস্তিকদের ধরার জন্য। ধরার পরে ধারায় ফেলে দিলেই হলো। এভাবে কতদিন চলবে জানি না। আশা করি না, তবুও একদিন হয়তো বিচার হবে। পৃথিবী বদলাবে একদিন। অভিজিৎ রায় স্টারডাস্ট হয়ে গেছেন - আগে পরে আমরা সবাই তাই হবো। সেটাই তো মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ। 

কিন্তু অভিজিৎ রায় আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁর হাতের আলো থেকে জ্বলে উঠছে আরো অজস্র আলো। এই আলো কাটবে কোন্‌ চাপাতিতে? বাঁধবে কোন্‌ ধারায়?

Wednesday, 6 June 2018

বিয়ের ভোজ ও অন্যান্য


রবীন্দ্রনাথ যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞগল্পটি লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে। কিন্তু যতবারই পড়ি মনে হয় গল্পটি এখনো সাম্প্রতিক, মনে হয় আমাদের সমাজ এবং সমাজের মানুষ একশ বছরেও বদলায়নি খুব একটা। 

গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে- এক সময় যজ্ঞেশ্বরের অবস্থা ভালোই ছিল। এখন প্রাচীন ভাঙা কোঠাবাড়িটাকে সাপ-ব্যাঙ-বাদুড়ের হস্তে সমর্পণ করিয়া খোড়ো ঘরে ভগবদ্‌গীতা লইয়া কালযাপন করিতেছেন। যজ্ঞেশ্বরের মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা যজ্ঞেশ্বর জানেন। তাই ধনীর ঘরে তার মেয়ের বিয়ে হবে এমন আশা করেন নি। কিন্তু কমলাকে দেখে পছন্দ করে ফেলে জমিদার গৌরসুন্দর চৌধুরির ছেলে বিভূতিভূষণ। অশিক্ষিত জমিদার শিক্ষিত ছেলের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারলেন না, দায়ে পড়িয়া মত দিলেন, কিন্তু মনে মনে যজ্ঞেশ্বরের প্রতি অত্যন্ত রাগ করিলেন। দুপক্ষে কথাবার্তা শুরু হলো। কিন্তু বিয়ে কোথায় হবে তা নিয়ে মহা হৈ চৈ।। জমিদার ছেলের বিয়েতে ধুমধাম করতে চান, কিন্তু গরীব যজ্ঞেশ্বরের সামর্থ্য কোথায় যে ধুমধাম করবে? তারপরও পুত্রের জেদের কারণে কন্যার বাড়িতেই যখন বিয়ের অনুষ্ঠান হবে ঠিক হলো গৌরসুন্দর এং তাঁহার দলবল কন্যাকর্তার উপর আরও চটিয়া গেলেন। সকলেই স্থির করিলেন, স্পর্ধিত দরিদ্রকে অপদস্থ করিতে হইবে। বরযাত্রী যাহা জোটানো হইল তাহা পল্টনবিশেষ। বিয়ের দুদিন থেকে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। বরযাত্রীগণ ভিজিয়া, কাদা মাখিয়া, বিধিবিড়ম্বনার প্রতিশোধ কন্যাকর্তার উপর তুলিবে বলিয়া মনে মনে স্থির করিয়া রাখিল। হতভাগ্য যজ্ঞেশ্বরকে এই অসাময়িক বৃষ্টির জন্য জবাবদিহি করিতে হইবে। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টিতে যজ্ঞেশ্বরের সমস্ত আয়োজন নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বরযাত্রীরা তা বুঝবেন কেন? তারা যজ্ঞেশ্বরের দুর্গতিতে মনে মনে খুশি হলেন, এবং প্রকাশ্যে রেগে গিয়ে মহা হাঙ্গামা শুরু করলেন। যজ্ঞেশ্বরের প্রতিবেশীরা যজ্ঞেশ্বরের বিপদে এগিয়ে এসে প্রচুর ছানার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু বরযাত্রীরা তাতে সন্তুষ্ট হলেন না। যজ্ঞেশ্বর যেমন-যেমন পাতে ছানা দিয়া যাইতে লাগিলেন তৎক্ষণাৎ বরযাত্রীগণ তাহা কাঁধ ডিঙাইয়া পশ্চাতে কাদার মধ্যে টপ্‌টপ্‌ করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। উপায়বিহীন যজ্ঞেশ্বরের চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল। বারম্বার সকলের কাছে জোড়হাত করিতে লাগিলেন; কহিলেন, আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আপনাদের নির্যাতনের যোগ্য নই। একজন শুষ্কহাস্য হাসিয়া উত্তর করিল, মেয়ের বাপ তো বটেন, সে অপরাধ যায় কোথায়
          
গত একশ বছরেরও আমাদের সামাজিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে কি? মেয়ের বাপ হওয়ার অপরাধে এখনো অনেককেই কত রকম গঞ্জনা সহ্য করতে হয় মেয়ের বিয়ের ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে। যজ্ঞেশ্বর মেয়ের বর গৌরসুন্দরের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামলেছিলেন সেদিন। কিন্তু এখনকার বেশির ভাগ বর ভোজের আয়োজনে একটু এদিক-ওদিক হলেই বর্বরের মত আচরণ করেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ঘটনাটি পড়ে দেখুন:



 এরকম ঘটনা নতুন নয়। নানারূপে নানাভাবে বাংলাদেশ ও ভারতে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। অনেক জায়গায় কন্যাপক্ষকে অপদস্ত করার জন্য পেশাদার খাদক নিয়ে যাওয়া হয়। যাদের সাথে আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে তাদেরকে অপদস্থ করতে পারলে যেন অফুরন্ত আনন্দ পাওয়া যায়।
          
আজকাল অনেকেই যৌতুক-প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। এটা ভালো দিক। কিন্তু যেখানে কোন দাবী-দাওয়া নেই - সেখানেও দেখা যায় কয়েক শত বরযাত্রীর ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন কন্যাপক্ষ। বরপক্ষকেও বৌ-ভাত নামে ভোজের আয়োজন করতে হয়। তবে সে আয়োজনে স্বাধীনতা থাকে। অন্যপক্ষের মনোরঞ্জন বাধ্যতামূলক নয় বলে বরপক্ষকে খুব বেশি মানসিক চাপে থাকতে হয় না।
          
বিয়েতে এরকম বিশাল ভোজের আয়োজন করাটা কি আসলেই খুব দরকার? এক বেলার ভোজের আয়োজনে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। যার পুরোটাই একেবারে বাজে খরচ। আমাদের মত গরীব দেশেও যাদের সামর্থ্য আছে তারা এত বেশি খরচ করে ভোজ দেন যে অবাক লাগে। চট্টগ্রামে একাধিক বিয়ের ভোজ হয়েছে স্টেডিয়ামে। শতাধিক বাস ভাড়া করে লোক নিয়ে আসা হয়েছে একবেলা খাওয়ার জন্য। সেখানে একবেলায় যা খরচ হয়েছে তা দিয়ে কয়েকটি স্কুল তৈরি করা যায়।
          
বাংলাদেশে অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন নামে একটা আইন আছে বলে শুনেছি। এই আইন অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি মানুষকে খাওয়ানো যাবে না। যারা ভোজের আয়োজনে বাধ্য হন তাদেরকে এই অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও করতে হয় - মানে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়।
          
বিয়েতে এলাহী-ভোজ বাদ দিয়ে বিকল্প কিছু কি ভাবা যায় না?

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।

Saturday, 26 May 2018

বিশ্বাস ও বিজ্ঞান



সেদিন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গিয়ে আলাপ হলো একজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের সাথে। আলাপ ঠিক নয়, তিনিই বলছিলেন সবকিছু, আর আমরা শুনছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, "এই বিশ্বব্রহ্মান্ড গাছপালা মানুষ পশুপাখি নদীর স্রোত গানের সুর সব সব কিছু সৃষ্টি করেছেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান ঈশ্বর।"

আজকাল এরকম কথার বিরোধিতা করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। কিন্তু ভদ্রলোক একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অধ্যাপক। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। কয়েকটা প্যাটেন্টও আছে তাঁর নামে। তিনি কি সেগুলোও ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছেন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,"ঈশ্বরই যদি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলেন কে?"

তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, "ঈশ্বরই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছেন। আগে তিনি নিজেকে বানিয়েছেন, তারপর অন্যান্য সবকিছু। একটার পর একটাওয়ান বাই ওয়ান।"

আমি বললাম, "ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম নাসৃষ্টি না হয়ে সৃষ্টিকর্তা হলেন কীভাবে? তিনি কি সবসময়েই ছিলেন, মানে সবকিছু সৃষ্টির আগে থেকেই?"
"ইয়েস, তাই তো বলছি।"
"বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আগে তিনি কোথায় থাকতেন? কী করছিলেন?"
"তিনি নরক বানাচ্ছিলেন তোদের মত নাস্তিকদের থাকার ব্যবস্থা করতেযত্তসব। দুপাতা বিজ্ঞান পড়েই মনে করছিস সবকিছু জেনে বসে আছিস! আমি তোদের মতো হাজার হাজার বিজ্ঞানের ছাত্রকে পড়াই। আরে ব্যাটা বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।"

এরপর আর কথা বাড়ানোর অর্থ হয় না। কারণ এরকম অন্তঃসার শূন্য তর্কবিতর্কের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। উপাসনা-ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রশ্নে অবিশ্বাসের ছায়া দেখলেই উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাসীরা খুব রেগে যান। বিশ্বাসের মতো তাঁদের রাগটাও অযৌক্তিক। বিশ্বাসের ভিত্তি শক্ত না হলে রাগ দেখানোই আত্মরক্ষার সহজ উপায়। রাগ দেখানোর পদ্ধতিটি অবশ্য একেক জনের কাছে একেক রকম -  ক্ষমতা ও সু্যোগ ভেদে তা সম্পর্কচ্ছেদ থেকে শিরচ্ছেদ পর্যন্ত হতে পারে।

ধর্মবিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানবিশ্বাসের কোন মিল নেইউপাসনা-ধর্মের পুরোটাই বিশ্বাস নির্ভর। কোন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা বা কার্যকারণের সাথে তার সম্পর্ক অতি সামান্য। ধর্মবিশ্বাসের বেশির ভাগই আরোপিত এবং জন্মসূত্রে পাওয়া। মানুষ যে পরিবারে জন্মায় ভালো লাগুক বা না লাগুক পারিবারিক ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য তাকে বাধ্য করা হয়। সেক্ষেত্রে যাচাই বাছাই করার কোন সুযোগই থাকে না। পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর ভিন্নতার কারণে ধর্মবিশ্বাসেরও পার্থক্য দেখা দেয়। সে কারণেই দেখা যায় রাজস্থানের হিন্দু আর বাংলাদেশের হিন্দুর ধর্মবিশ্বাস হুবহু এক নয়। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেও ধর্মবিশ্বাসে ভিন্নতা দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, সমস্ত পরিকাঠামো এক থাকার পরেও মানুষে মানুষে ধর্মবিশ্বাসে ভিন্নতা দেখা দিতে পারে।

ধর্মবিশ্বাস পরীক্ষা করে দেখার কোন উপায় নেই। ধর্মগ্রন্থে যা লেখা আছে, যেভাবে লেখা আছে তাকেই পরম সত্য বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয় ধর্মপালনকারীদের। যখন সাধারণ চোখেই দেখা যায় যে ধর্মগ্রন্থে যা লেখা আছে তার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই তখন নানারকম খোঁড়া যুক্তি ধার করে  ধর্মগ্রন্থের লেখাগুলোর অন্যরকম একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তাইতো ধর্মবিশ্বাসীদের বিশ্বাস করতে হয় যে যীশুখ্রিস্টের কোন বায়োলজিক্যাল ফাদার নেই। যীশুকে ঈশ্বরের সন্তান বলা হয়ে থাকে, কিন্তু যে জৈব প্রক্রিয়ায় প্রাণীর জন্ম হয় সেরকম কোন প্রক্রিয়া মাতা মেরি ও ঈশ্বরের মধ্যে ঘটেছে বলে বাইবেলে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে নানারকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

ধর্মবিশ্বাস কথাটি যতটা প্রচলিত বিজ্ঞানবিশ্বাস সে তুলনায় কমকারণ বিজ্ঞানে শুধুমাত্র বিশ্বাস দিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞান পরীক্ষামূলক প্রমাণ ও কার্যকারণের ওপর নির্ভরশীল।  বিজ্ঞানে একটা তত্ত্বের সাথে অন্য তত্ত্বের মিল থাকতে হয়। বিজ্ঞান ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে ভিন্ন হয় না। যদি হয় তারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ম্যাগনেটিক প্রোপার্টিজ বদলে যেতে পারে। তা ধনী দরিদ্র সাদা কালো যে কোন মানুষের পক্ষেই পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। কিন্তু একটি ইঁদুর যেমন মাধ্যাকর্ষণ এড়াতে পারে না তেমনি ভ্যাটিকানের পোপের পক্ষেও মাধ্যাকর্ষণ এড়ানো সম্ভব নয়। বিজ্ঞানে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা অবশ্যই জানেন যে মাধ্যাকর্ষণ বল সাধারণ অবস্থায় সব সময়েই কাজ করছেওটা নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলেই তাতে বিশ্বাস রাখা যায়। কিন্তু যদি কেউ দাবি করেন যে তিনি কোন প্রকার প্রতারণার সাহায্য না নিয়ে অলৌকিক উপায়ে মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে শূন্যে ভেসে থাকতে পারেন তাতে বিশ্বাস রাখা যায় না। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসীদের সকলেই কোন না কোন ক্ষেত্রে অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন। বিজ্ঞানে অলৌকিক বলে কিছু নেই।

বিজ্ঞানের যে সব তত্ত্ব এখনো প্রমাণিত হয়নি সেখানে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ এবং অনুমান কাজ করতে পারে। যেমন স্ট্রিং থিওরি এখনো প্রমাণিত হয়নি। সেখানে তাই এখনো মতভিন্নতা কাজ করছে। নিউক্লিয়ার থিওরিতে বিভিন্ন মডেলে মতভিন্নতা আছে। কিন্তু সেসব আছে মূল সত্য বের করে আনার উদ্দেশ্যেই। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য ভিন্ন মতাবলম্বীরাও একসাথে কাজ করে যায় বিজ্ঞানে। ভুল মতবাদ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করে নেন। স্টিফেন হকিং আর রজার পেনরোজের মধ্যে অনেক বছর ধরে বিতর্ক চলেছে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন নিয়ে। শেষপর্যন্ত দেখা গেছে হকিং এর একটি ধারণা ভুল ছিলো। এ ভুল স্বীকার করে নিতে হকিং এর একটুও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসে এরকম হয় না। সেখানে অহংবোধ বড় বেশি। আর সে কারণেই ধর্মে ধর্মে বিভাজনও এত বেশি। বিভাজনের কারণে হানাহানিও এত বেশি।

বিজ্ঞানবিশ্বাসের সাথে ধর্মবিশ্বাসের আরেকটি প্রধান পার্থক্য হলো ধর্মবিশ্বাস একটা পর্যায়ে বড়বেশি হিংস্র। ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়তো করুণা করা হয়, কিন্তু সম্মান করা হয় না ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে। পৃথিবীতে ধর্মীয় হানাহানির কারণে যত মানুষ মারা গেছে আর কোন কিছুতে সেরকম হয়নি। আর বিজ্ঞানবিশ্বাসীরা বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে কখনো হিংস্র হয়ে ওঠেনি। অনেকে পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানকে দায়ী করতে পছন্দ করেন। কিন্তু যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে বোমা তৈরি করা হচ্ছে সে একই পারমাণবিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর মানুষের দৈনন্দিন জ্বালানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে, ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হচ্ছেবিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানের দোষ প্রচার করা হয় রাজনৈতিক স্বার্থে।

রাজনীতি দিয়ে বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি চেষ্টা পৃথিবীর সব দেশেই হয়। সেটা হয় ধর্মবিশ্বাসের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে। যেমন স্টেমসেল রিসার্চের ক্ষেত্রে আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো দেশও অনেক ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করে বসে আছে। ফলে যে গবেষণা থেমে আছে তা নয়। কিন্তু যে গতিতে চলতে পারতো সে গতিতে তা চলছে পারছে না। বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে সবসময়েই পেছনে টেনে ধরে রেখেছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এবং এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ হিসেবে সবসময়েই দেখা যায় এক ধরণের ধর্মবিশ্বাস কাজ করেছে। একটু পেছনের দিকের ইতিহাস খুঁজে দেখলেই দেখা যাবে বিজ্ঞানকে কোন সময়েই সহজে মেনে নেয়নি ধর্মবিশ্বাসীরা।

যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রতি ধর্মবিশ্বাসীদের দৃষ্টিভংগিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক ভাবে কী আবিষ্কৃত হলো তা না জেনেই বলে দেয়া হয় যে এটা ধর্মবিরুদ্ধ, শয়তানের কারসাজী, এই আবিষ্কার ঈশ্বরবিরুদ্ধ।

দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং সবাই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে থাকে তখন ধর্মবিশ্বাসীরা হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলে যে এসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সবকিছুই ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে। ধর্মগ্রন্থের পাতায় পাতায় বিজ্ঞান। হুঁ হুঁ বাবা, ঐশ্বরিক গ্রন্থ হলো সকল বিজ্ঞানের উৎস!!

আর তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ধর্ম-বিরুদ্ধ বিজ্ঞানকে ধর্ম-প্রচারে কাজে লাগানো। একটা উদাহরণ দিই - মাইক্রোফোন আবিষ্কারের পর ওটা ব্যবহার করে আজান দেয়াকে না-জায়েজ বলা হতো।

আর এখন? বাংলাদেশের প্রতিটি শহরের হাজারো মসজিদের মাইক দৈনিক কী পরিমাণ শব্দ-শক্তি তৈরি করে তা যদি কেউ গবেষণা করে প্রকাশ করে তার জীবন সংশয় দেখা দিতে পারে।

আজকাল অনেক জ্যোতিষী কম্পিউটারে ভাগ্য গণনা করেন এবং অনেকেই তাতে বিশ্বাস করে।

মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় একদম শুরুতে ধর্ম ও বিজ্ঞানে খুব একটা বিরোধ ছিলো না। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। উপাসনা-ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে অনেক পরে। সৃষ্টিকর্তার ধারণাও তৈরি হয়েছে আরো অনেক পরে। বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের বিরোধের স্বরূপটা এক পলক দেখার জন্য আমাদের একটু পেছন দিকে যেতে হবে। ইতিহাসের দিকে। অবশ্য প্রচলিত ইতিহাস আর বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের মধ্যে কিছু মৌলিক  পার্থক্য আছে। প্রচলিত ইতিহাস মূলত রাজনৈতিক ইতিহাস। রাজা বা শাসনকর্তার ইচ্ছামতো এ ইতিহাস রচিত হয়, বিকৃত হয়, সত্যি ঘটনা মুছে ফেলা হয় বা সাজানো ঘটনার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। তবে মিথ্যার একটি বড় দুর্বলতা হলো এটা সবকিছুর সাথে সমন্বিত অবস্থায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। সামান্য সমন্বয়হীনতার লেজ যখন বেরিয়ে পড়ে সে লেজ ধরে টান দিলেই মিথ্যার আবরণ খসে পড়ে একসময়। সত্য ইতিহাস সেভাবেই বেরিয়ে আসে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ইতিহাস লেখা হয় প্রকৃতিতে। একটি ফসিল কত বছরের পুরনো, বা এক খন্ড মাটি কী কী সভ্যতা ছুঁয়ে এসেছে তা বৈজ্ঞানিক উপায়েই নির্ণীত হয়। সেরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই আজ জানা যায় পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে কত বছর আগে।


প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় পাওয়া নানারকম তথ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যায় আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়ান্‌স এর আগের প্রজাতি হোমো ইরেক্‌টাসের সময় থেকেই পৃথিবীতে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ লক্ষ বছর থেকে দশ লক্ষ বছর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হোমো ইরেক্‌টাসের উদ্ভব হয়েছিলো। চীনের বেইজিং এর কাছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গুহায় পাওয়া নিদর্শন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আজ থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্‌টাসরা প্রাকৃতিক আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার প্রযুক্তি অর্জন করেছিলো।

আগুন যে প্রযুক্তির একটি প্রধান উৎস তা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে। আগুন জ্বালানো, আগুনকে প্রয়োজন মত কাজে লাগানো এবং প্রয়োজন শেষে আগুন নেভানোর পদ্ধতি মানুষের আয়ত্ত্বে আসার সাথে সাথে সভ্যতার বিরাট একটি ধাপ অতিক্রান্ত হলো। আগুনের শক্তিকে আবিষ্কার করতে গিয়ে মানুষ দেখেছে আগুনের বিধ্বংসী ক্ষমতাও। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে আগুনের প্রতি ভয়ও তৈরি হয়েছে। ভয় থেকে মানুষ আগুনকে দেবতা জ্ঞান করতে শুরু করেছে। সনাতন যুগের সব ধর্মেই আগুন এর ভূমিকা বিশাল।

প্রকৃতিতে বাতাসের শক্তি দেখেছে মানুষ, দেখেছে ঘূর্ণিঝড়। তারপর মানুষ যখন কৃষিকাজ শুরু করেছে আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে দেখেছে মাটি থেকে খাদ্য শস্য উৎপন্ন হচ্ছে, সব কিছু মাটিতে মিশে যাচ্ছে এক সময়পরবর্তীতে গ্রিক দার্শনিকরা যখন পদার্থের মূল উপাদান নির্ধারণ করতে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে তখন প্রাথমিক যুগ থেকে বয়ে আসা এ ধারণা কাজে লেগেছে। তাদের মনে হয়েছে আগুন, পানি, মাটি আর বাতাসই হলো মূল উপাদান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখতে দেখতে মানুষ প্রকৃতিকে ভয় করতে শিখেছে এবং সে ভয়কে জয় করার জন্য সংগ্রাম করতে শিখেছে। দেখেছে প্রত্যেক কাজের পেছনে কারো না কারো হাত রয়েছে। প্রকৃতির অদৃশ্য হাতকে ঈশ্বরজ্ঞান করতে শিখেছে।

ঈশ্বরের ধারণা তৈরি হবার পর মানুষের পর্যবেক্ষণে নতুন একটি ধারা তৈরি হলো। সমাজবদ্ধ ভাবে বাস করার জন্য সামাজিক নিয়ম কানুন তৈরি হলো। শুরু হলো সামাজিক শ্রেণীবিভাগ। নিজেদের মধ্যেই টিকে থাকার সংগ্রামে শারীরিক শক্তির সাথে বুদ্ধিমত্তাও যুক্ত হলো। যাঁরা বুড়ো হয়ে শারীরিক শক্তিতে পিছিয়ে পড়লেন তাঁরা সমাজে নিজেদের আসন ঠিক রাখার জন্য শুরু করলেন ধর্মব্যাখ্যা। পরবর্তীতে এদের নিয়েই একটা শ্রেণী তৈরি হলো। সামাজিক ধর্মগুরু বা পুরোহিত শ্রেণী। এ পেশায় টিকে থাকার জন্য তাদের দরকার হলো গভীর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত জোয়ার ভাটা ঋতু পরিবর্তন জলবায়ুর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এসবের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হলো। এদের হাত ধরেই ক্যালেন্ডার তৈরি হলো আজ থেকে প্রায় ২৮০০ বছর আগে। প্রতিষ্ঠিত হলো সময়ের হিসেব বছর, মাস, দিন, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড। সংখ্যার ব্যবহার শুরু হলো। সংখ্যা লেখার চিহ্নও তৈরি হলো। শুরু হলো পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা।

যেহেতু এদের ব্যাখ্যার ভুল ধরার কেউ নেই- কোথাও কোন বিরোধ ঘটলো না। এদের এবং এদের উত্তরাধিকারীদের হাতেই রয়ে গেলো সামাজিক ক্ষমতা। আরো পরে যখন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো রাজত্ব পরিচালনার ব্যাপার এলো তখনো এই পুরোহিত শ্রেণীর দাপট ঠিকই থাকলো। কারণ রাজারা দেখলো পুরোহিতদের কাজে লাগাতে পারলে রাজত্ব করা সহজ হয়। কারণ যে মানুষ রাজাকে ভয় পায় না সেও প্রকৃতির অজানা রহস্যকে ভয় পায়। ততোদিনে এ প্রকৃতির নাম হয়ে গেছে ঈশ্বর। কিন্তু রাজাদের মন যুগিয়ে চলতে গিয়ে পুরোহিত শ্রেণীর সততায় কিছুটা ভন্ডামীও ঢুকে পড়েছে। নিজেদের অজান্তেই তারা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ও তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে চাইলেন না। ফলে স্বাধীন গবেষক ও রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি গবেষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে আলাদা হতে শুরু করলো বিজ্ঞান ও ধর্মবিশ্বাস। পরবর্তীতে যখন পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করলো পুরোহিতরা ভাবলো এতে তাদের আসন টলে যাবে। তাই তারা সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণার বিরোধীতা করলো। রাষ্ট্র পুরোহিতদের সমর্থন করলো।  সে কথায় আসছি আর একটু পরের দিকে।

মানুষের শরীর সম্পর্কে প্রত্যেক ধর্মই খুব স্পর্শকাতর। সব ধর্মই শরীরকে খুব গুরুত্ব দেয়। এতই গুরুত্ব দেয় যে ধর্মের এ বাড়াবাড়ির কারণে প্রথম দিকে মানুষের শরীর নিয়ে কোন গবেষণা করাই সম্ভব ছিলো না। মৃত মানুষের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে দেখা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবে নিষেধ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের দেহের প্রথম ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিলো আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে। গ্রিক ডাক্তার আল্কমেইয়ন গোপনে মানুষের মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে শিরা ও ধমনীর পার্থক্য খুঁজে পান। আর শরীরের বিভিন্ন অংগপ্রত্যংগের মধ্যে স্নায়বিক সংযোগের ধারণাও আল্কমেইয়নই দেন। কিন্তু পরবর্তী ছয় শ বছর ধরে মানুষের এনাটমি নিয়ে আর কোন গবেষণা করা যায়নি ধর্মগুরুদের বাধার কারণে।

খ্রিস্টান ধর্মের উত্থান ঘটার পর এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটলো। খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা প্রচার করতে লাগলো যে মানুষের শরীর ঈশ্বর প্রদত্ত আত্মা রাখার একটি খাঁচা ছাড়া আর কিছু নয়। এবং সে খাঁচা খুলে দেখার অধিকার মানুষের নেই। সে সময় ১২৯ সালে ক্লডিয়াস গ্যালেনের জন্ম। তুরস্কের একটি ধনী পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে গ্যালেনের পক্ষে মানুষের শরীর পর্যবেক্ষণ করার কিছুটা সু্যোগ হয়েছিলো। চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য গ্যালেন রোমে গিয়ে রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্তাক্ত দেহ পর্যবেক্ষণ করলেন অনেকদিন ধরে। হৃদপিন্ডের কাজ, শিরা ও ধমনীর কাজ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। কিন্তু মানুষ তখনো বিশ্বাস করে যে আত্মা থাকে শরীরের ভেতর। গ্ল্যাডিয়েটররা আহত হয়ে মারা যাবার সময় গ্যালেন দেখলেন যে তাজা টকটকে ঘন লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে শরীর থেকে। গ্যালেন ভাবলেন এর নাম জীবন। মারা যাবার সময় এভাবেই জীবন বেরিয়ে যায়। আর বেঁচে থাকলে ধমনী ও শিরা দিয়ে রক্তের সাথে জীবন প্রবাহিত হয়। গ্যালেনের অনেক ধারণা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হলেও তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো তের শ বছর। গ্যালেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। তাঁর এ বিশ্বাসের কারণে তাঁর পর্যবেক্ষণও ছিলো কিছুটা ঈশ্বর-কেন্দ্রিক।

বিজ্ঞানের অন্যান্য কিছু শাখা যখন ডানা মেলতে শুরু করেছে তখনো মানুষের শরীরের রহস্য জানার জন্য কোন গবেষণাই করা যাচ্ছে না ধর্মগুরুদের নিষেধের কারণে। ক্লসিয়াস গ্যালেনের পর্যবেক্ষণকেই সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে চললো ১৪৯০ সাল পর্যন্ত। ধর্মগুরুদের প্রবল আপত্তির মুখেও ইতালির পাদুয়াতে এনাটমিক্যাল থিয়েটার তৈরি হলো। সেখানে এনাটমি নিয়ে কাজ করলেন লিওনার্দো দা ভিনচি, এন্ড্রিয়াস ভেসিলাস

মানুষের শরীরের ওপর ধর্মের বাধা নিষেধ কিছুটা কমে এলেও এখনো একেবারে থেমে নেই। এখনো মানুষের শরীর নিয়ে নতুন গবেষণায় ধর্ম একটি প্রধান বাধা।

জন্মনিয়ন্ত্রণকে অনেক ধর্মেই ধর্মবিরুদ্ধ কাজ বলে ধরে প্রচার করা হয়। গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা কোন ধরণের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করাকে ধর্মবিরুদ্ধ মনে করে। ১৯৫৬ সালে জন্মবিরতিকরণ পিল উদ্ভাবনের পর ধর্মগুরুরা ক্ষেপে গেলেন। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। মেয়েদের জীবন অনেকভাবেই বদলে গেলো এরপর থেকে। সন্তানজন্মসংক্রান্ত নানারকম রোগের হাত থেকে বাঁচতে আরম্ভ করলেন মেয়েরা। কিন্তু কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাস এখনো বিজ্ঞানের এ অবদানকে স্বীকার করে না।

গর্ভপাতকে ধর্ম প্রবল ভাবে বাধা দিয়ে আসছে। খুব দরকার না হলে শখের বশে কেউ গর্ভপাত করে না। কিন্তু কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাসী মনে করেন এটা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ। তাঁরা আবার এটাও বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু করার ক্ষমতা কারো নেই। তাহলে গর্ভপাত যেহেতু হচ্ছে তা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয় কীভাবে! কিন্তু যুক্তির কথা তো ধর্ম শোনে না।

টেস্টটিউব বেবিকেও ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মবিরুদ্ধ কাজ মনে করেন। সে একই রকম অন্ধকারাচ্ছন্ন মানসিকতার কারণে স্টেমসেল রিসার্চ বাধাগ্রস্ত। অথচ সে গবেষণা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে আল্‌ঝেইমারের মত মারাত্মক ডি-এন-এ ঘটিত রোগ থেকে।

বিবর্তনবাদকে কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাসী মোটেই স্বীকার করেন না। ১৮৫৯ সালে ডারউইনের দি অরিজিন অব স্পেসিস প্রকাশিত হবার পর পৃথিবীর ধর্মাকাশে একটি ঝড় বয়ে গেলো। সে ঝড় এখনো থামেনি। ধর্মবিশ্বাসীরা মানতেই চাচ্ছেন না যে মানুষ সরাসরি ঈশ্বরের হাতে কাদামাটি থেকে তৈরি নয়। আদম বা হাওয়ার কোন অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়নি বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। মানুষ এসেছে অনেক অনেক বছরের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

ধর্মবিশ্বাসীরা বিবর্তনবাদকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে না পেরে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে এখন। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন নামে একধরণের ছদ্ম বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ঈশ্বর ছাড়া এরকম অপূর্ব বুদ্ধিবৃত্তিক নির্বাচন আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যোগ্যতমকে খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব ঈশ্বর নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন।

ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন বা আইডি তত্ত্ব মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ ক্ষমতায় আসার পর। সহজেই বোঝা যায় যে এটা একটা সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চাল। আমি বেশ কয়েকজন গোঁড়া খ্রিস্টান বাইবেলবোদ্ধাকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি বাইবেলে আইডি সম্পর্কে কী লেখা আছে বা আদৌ কিছু আছে কিনা। ঈশ্বরই সব কিছু ডিজাইন করেছেন জাতীয় এলোমেলো কিছু কথাবার্তা ছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু তাঁরা জানাতে পারেননি। আসলে তত্ত্বটা খুব বৈজ্ঞানিক করতে গিয়ে সহজপাচ্য করতে পারেনি। এ প্রসংগে একটি চমৎকার বই এর নাম এখানে করা যায়। তা হলো রবিন উইলিয়াম্‌স এর আনইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন, হোয়াই গড ইজন্‌ট এজ স্মার্ট এজ শি থিঙ্কস শি ইজ

বিবর্তন প্রশ্নে ধর্মবিশ্বাসীদের সাথে অনেকদিন থেকেই বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব চলছে পৃথিবীর সৃষ্টি ও বয়স নিয়ে। বাইবেলের পক্ষ নিয়ে একপক্ষ বলছে পৃথিবীর বয়স মাত্র ছয় হাজার বছর। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ অনুসন্ধান, গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে হিসেব করে দেখিয়েছেন যে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে। বাইবেলে বলা আছে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়েছে মাত্র ছয়দিনে। ১৬৪২ সালে ব্রিটিশ মন্ত্রী ও বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ জন লাইটফুট অবজারভেশন্‌স অন জেনেসিস নামে ২০ পৃষ্ঠার একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি লেখেন যে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯২৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। আর মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে এর পাঁচ দিন পর, ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকাল নয়টায়। ডক্টর লাইটফুট উচচশিক্ষিত মানুষ, বই লেখার কিছুদিন পর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছিলেন।

এর পর ১৬৫০ সালে অ্যাংলিকান বিশপ জেম্‌স উশার ওল্‌ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা ও দেবতাদের বয়স হিসেব করে ঘোষণা করলেন, পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছে যীশুখ্রিস্টের জন্মের ৪০০৪ বছর আগে, অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ রবিবার সকাল নয়টায়। সময়টি কোন্‌ দেশের স্থানীয় সময় তা জানা যায়নি।

এঁদের এসমস্ত দাবীর সাথে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের কোন মিল নেই। বৈজ্ঞানিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে প্রায় সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে। যেহেতু ধর্মগ্রন্থগুলো এসব বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেনি, ধর্মবিশ্বাসীরা এখনো বিশ্বাস করে পৃথিবীর বয়স মাত্র চার হাজার বছর। আর বৈজ্ঞানিক প্রমাণগুলো ঈশ্বরই ওভাবে রেখে দিয়েছেন মানুষের জ্ঞানের সীমানা দেখার জন্য। কারণ তিনি মানুষের জ্ঞান পরীক্ষা করে দেখতে খুব পছন্দ করেন। এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছে এখনো, হয়তো চলবে অনেকদিন। তবে একসময় দেখা যাবে নতুন করে লেখা হচ্ছে বাইবেলের জেনেসিস সেখানে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রবেশ করানো হবে, এবং আবারো প্রচার করা হবে যা সব লেখা আছে বাইবেলে!!

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে এ সত্য কখনোই মেনে নিতে চায়নি ধর্মবিশ্বাসীরা। কারণ মানুষকে ক্ষমতার কেন্দ্রে দেখতে ভালোবাসে সবাই। আর মানুষের পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরবে আর সবকিছু পৃথিবী স্থির থাকবে এরকমই বিশ্বাস ছিলো তখন। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ সালে গ্রিক দার্শনিক হিপার্‌কাস ধারণা দেন যে বিশ্বব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে আছে পৃথিবী। এর প্রায় আড়াই শ বছর পর টলেমি হিপার্‌কাসের তত্ত্ব সমর্থন করে নানারকম যুক্তি দেন। তাঁর একটি যুক্তি ছিলো, যেহেতু পৃথিবীতে মানুষ বাস করে সেহেতু সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই ঘুরবে। চার্চের খুব ভালো লাগলো টলেমির কথা। ভালো লাগাই কাল হলো মহাকাশ গবেষণা ভুল পথে এগোতে থাকলো পরবর্তী প্রায় সাড়ে তের শ বছর ধরে।

১৫০৭ সালে পোলান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস দেখলেন টলেমির গাণিতিক যুক্তিগুলো প্রচুর ভুলে ভরা। কোপার্নিকাস হিসেব করে দেখালেন যে পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।

চার্চের রোষানলে পড়ার ভয়ে তিনি অনেক বছর এসব গবেষণা প্রকাশ করেননি। শেষে ১৫৪৩ সালে তিনি এ তথ্য প্রকাশ করেন অন দি রিভিলিউশান অব দি হেভেনলি বডিজ বইতে। তিনি জানতেন যে বইটি প্রকাশিত হলে চার্চের নেতারা ক্ষেপে যাবেন। বুদ্ধি করে কিছুটা ঘুষ দেয়ার মতোই তিনি বইটি উৎসর্গ করলেন পোপ তৃতীয় জন পল্‌কে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। চার্চের নেতারা কোপার্নিকাসের বইগুলো পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দিলেন। তবুও ভালো যে কোপারনিকাস্‌কেই পুড়িয়ে মারার আদেশ দেয়া হয়নি।

পরে গ্যালিলিও যখন এ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন ক্যাথলিক চার্চ আদেশ দিলো কাজ বন্ধ করতে। গ্যালিলিওকে হুমকি দেয়া হলো যেন তিনি পৃথিবীর ঘূর্ণন সম্পর্কে আর একটি কথাও না বলেন। কিন্তু সহজে থেমে থাকার পাত্র গ্যালিলিও নন। তিনি একটি বই লিখলেন এবং তাতে পোপের বিরুদ্ধেও লিখলেন অনেক কিছু। এতে ক্ষেপে গেলেন পোপ।

গ্যালিলিওর সামাজিক প্রতিষ্ঠার কারণে তাঁকে হত্যা করলে জনমত চার্চের বিরুদ্ধে যেতে পারে ভেবে গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করা হলো। দীর্ঘদিন বন্দী অবস্থার মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গ্যালিলিও একসময় বাধ্য হয়ে ঘোষণা করেন যে, তিনি ভুল বলেছেন। কিন্তু সংগে সংগে এটাও বলেন যে, পৃথিবীর ঘূর্ণন কিন্তু পোপের কথামতো থেমে যাবে না।

থেমে যায়নি। এত বছর পরে ভ্যাটিকানের পোপ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে গ্যালিলিওর প্রতি অবিচার করা হয়েছিলো সেদিন। ১৬০০ সালে নুহ্‌র প্লাবন কখনোই হয়নি বলার অপরাধে ব্রুনোকে রোমের রাস্তায় প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মেরেছে ইউনাইটেড চার্চের যাজকেরানতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও মতামতের কাছে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলো চার্চ। তখন চার্চের শক্তি সংহত করার উদ্দ্যেশ্যেই ব্রুনোর মতো মানুষকে খুন করা হলো। ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে ধর্মবিশ্বাসীদের এ হলো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করলেই যে চার্চ ক্ষেপে যেতো তা নয়। মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমুলক আচরণ কোন ধরণের কারণ ছাড়াই ঘটেছে তখন। মিশরের হাইপাশিয়া ছিলেন ৩৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৫ সাল পর্যন্ত একমাত্র মেয়ে যিনি সমতল জ্যামিতিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি টলেমির পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণাকেও স্বীকার করতেন। কিন্তু তারপরও তাঁকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছেরাস্তা থেকে টেনে চার্চের  ভেতর নিয়ে গিয়ে হিংস্রভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে তাকে। তারপর রাস্তার উপর পুড়িয়ে মেরেছে তথাকথিত প্রেমের অবতার যীশুখ্রিস্টের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা। পরবর্তী এক হাজার বছরে আর একজন মহিলাও বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে আসতে পারেননি।

বিজ্ঞান ও ধর্মের ইতিহাস অনেক দ্বন্দ্বে ভরা। অনেক সময় নিজেদের ব্যক্তিগত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশও ঘটায় অনেকে। যেমন প্রথম জীবনে আইনস্টাইনকেও ইহুদি পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাঁর গবেষণাকে জার্মানিতে ইহুদিদের বিজ্ঞান নামে প্রচার করা হয়েছে। এখনো অনেক দেশে শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু শ্রেণীর প্রতিনিধি হবার কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হয় বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানের কথা বললে তা যদি ধর্মের বিরুদ্ধে যায় তা ব্যক্তিগত মত বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু সুখের কথা হলো বিজ্ঞানকে অস্বীকার করলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় না।

বর্তমানে সব ধর্মবিশ্বাসীরাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে তাদের ধর্ম বিজ্ঞানসম্মত তাতে বিজ্ঞানের শক্তিকেই স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে। কারণ বিজ্ঞান চলবে বৈজ্ঞানিক ধর্মের ভিত্তিতে, কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অচিরেই অচল হয়ে যাবে। 

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts