Monday 29 November 2021

বুদ্ধদেব বসুর 'আমি চঞ্চল হে'

 


বুদ্ধদেব বসুর ভ্রমণকাহিনি ‘আমি চঞ্চল হে’র রচনাকাল ১৯৩৫-৩৬। তার মানে আজ থেকে ৮৫ বছর আগে। পড়ে মনে হলো – জীবন পাল্টেছে, কিন্তু জীবনবোধ খুব একটা পাল্টায়নি এই এত বছরেও।

ভ্রমণকাহিনি বলতে আমরা যেসব বইয়ের সাথে পরিচিত, কিংবা আমরা যেভাবে কী কী ভ্রমণ করলাম, কী কী খেলাম, কী কী মজা হলো এসব আত্মপ্রচার করি – এ বইটা সেরকম নয়। এটাতে ভ্রমণ সামান্যই, দর্শন – সেটা দেখা কিংবা ফিলোসফি – দুই অর্থেই হতে পারে – যথেষ্ট পরিমাণে আছে।

বুদ্ধদেব বসু গদ্যের রাজা, কবিতার মহারাজ। তার লেখা সুখপাঠ্য তো হবেই, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু আশ্চর্য লাগলো তার অনুভূতির সূক্ষ্মতায়।

সারাবইতে ভ্রমণের কথায় ‘আমরা’ এসেছে অনেকবার, কিন্তু এই আমরা কারা – তার পরিচয় একবারও আসেনি।

বইয়ের শুরুতে কালের বর্ণনা। শরৎকাল – পুজোর ছুটি। কলকাতার মানুষ। তারপর পাতার পর পাতা তাঁর লেখার কাহিনি। অনেকবার বলেছেন “আমাকে লিখতে হয়”।

কাজের কাজে আনন্দ থাকে না – যদি কাজটা বাধ্য হয়ে করতে হয়, পেটের দায়ে করতে হয়। জীবনে বৈচিত্র্য না থাকলে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। কিন্তু লেখক বলছেন, বৈচিত্র্যের অভাব আমাদের মনে – অভাব আমাদের মনের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করবার ক্ষমতায়।“

ব্রিটিশ লেখক চেস্টারটনের কথা লিখেছেন – যিনি লন্ডন থেকে বের হবার সময় সহযাত্রীর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন – “আমি লন্ডনে যাচ্ছি – প্যারিস, ভিয়েনা, বার্লিন, রোম হয়ে।“ আমাদের ভ্রমণ তো আসলেই এক ধরনের পরিভ্রমণ।

ভ্রমণ শেষে ঘরে ফিরে ঘরকেই আমরা আবার নতুন করে পাই। লেখকের এই কথার সাথে আমার মিলে যায়। তিনি কিছু মারাত্মক সত্য কথা বলেছেন, - “যেমন বই পড়লেই শিক্ষা হয় না, তেমনি জলে স্থলে আকাশে বিভিন্ন যানে ঘোরাঘুরি করলেই ভ্রমণজনিত নানা মহৎগুণ অন্তরে বর্তায় না।“ তাই আমরা অনেক সময়েই অনেক দূরে গিয়েও নিজের দৃষ্টির বাইরের কিছু দেখতে পাই না।

“নিজেদের ভিতরে যা নেই, বাইরে আমরা তা কখনোই দেখতে পাবো না।“

“ভ্রমণের প্রতি যে মহৎগুণই সাধারণত আরোপিত হোক না, সকলের জন্য সেটা নয়।“

“কোন জিনিসই নিরপেক্ষ শুভ নয়, সমস্ত সত্যই ব্যক্তিগত।“ – সেজন্যই আমাদের এক যাত্রায় পৃথক ফল খুবই স্বাভাবিক।

“কেউ বাড়ি থেকে বাস্‌ এর রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে এসে যা সংগ্রহ করতে পারবে, অন্য কেউ আফগানিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত ঘুরে এসেও তা পারবে না।“

বাইরের ঘটনা থেকে কে কতটুকু নিতে পারবে সেটা নির্ভর করবে তার নিজস্ব ক্ষমতার উপর। মানুষকে যুক্তি দেয়া যায়, বুদ্ধি নয়। ভ্রমণের বই আর টিকেট দেয়া যায়, অভিজ্ঞতা অর্জন করার ক্ষমতা নয়।

“বই থেকে চরম রস নিষ্কাষণ করতে পারে যে মানুষ, যে পারে সুখি হতে নিজের মনে চুপচাপ একা বসে, ঠিক সে-ই পারে ভ্রমণ থেকে পূর্ণতম লাভ নিঙড়ে নিতে।“

“অধিকাংশ – এবং অতিশয় অধিকাংশই মূঢ়ের মত পড়ে, অন্ধের মত বেড়ায়, জীবনের নানা অনিবার্য ঘটনা থেকে মূল্যবান কিছুই সঞ্চয় করতে পারে না। ঘটনার নামই অভিজ্ঞতা নয়, ঘটনা হচ্ছে কাঁচামাল যা থেকে অভিজ্ঞতার সৃষ্টি।“

লেখক এখানে অনেক ভ্রমণকাহিনি-লেখকের সমালোচনা করেছেন – যাদের ভ্রমণকাহিনি পড়ে মননশক্তির পরিচয় তিনি পাননি। হতেই পারে এরকম। সবার তো সবার প্রকাশভঙ্গি ভালো লাগবে না। কিন্তু নিজের লেখায় অন্য লেখা ভালো না লাগার কথা আনার দরকার কী।

লেখক কলকাতাকে কেন ভালোবাসেন তা লিখলেন। এটা ভালোবাসার জাদু। এতে কোন যুক্তি কাজ করে না। সমস্ত রকমের পার্থিব সমস্যা থাকার পরেও আমরা কোন কোন জায়গার প্রেমে পড়ে যাই – প্রায়ই দেখা যায় সেটা আমাদেরই কোন আবাসস্থল।

নিজের কথা লিখেছেন – চার্লি  চ্যাপলিন ছাড়া আর কারো সিনেমা দেখতে তাঁর ভালো লাগে না। থিয়েটার দেখাও ছেড়ে দিয়েছেন শিশির ভাদুড়ীর শেষের দিকের কিছু নাটক ভালো লাগেনি বলে। খেলা তিনি দেখেন না। অবশ্য এটাও বলেছেন, “আমার এই ক্রীড়া-বৈরাগ্য আসলে বৈরাগ্য নয়, অক্ষমের হতাশা।“ খেলাকে তাঁর যুদ্ধ যুদ্ধ বলে মনে হয়, যেখানে প্রাণ হয়তো যায় না, কিন্তু অন্যভাবে খুনোখুনি হয়।

কলকাতার আড্ডার কারণেই কি তাঁর ভালো লাগে? তিনি জানাচ্ছেন কলকাতার খুব বেশি মানুষের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই। “ব্যক্তিগত সম্পর্ক সবসময় স্থাপিত হয় না – সব ব্যক্তিগত সম্পর্কে সুখও হয় না।“

চিন্তার বিনিময় করার জন্য সবাইকে এক জায়গায় থাকতে হয় না। সেই ৮৫ বছর আগে যা চিঠিতে চলতো – এখন তো ডিজিটাল যুগ। তিনি এমন মানুষের সাথে সাহচর্য করেন যাঁরা তাঁর নিজের চেয়ে মস্ত বড় নন। “মস্ত বড়”দের সম্পর্কে খুবই খাঁটি অপ্রিয় কথা বলেছেন তিনি, “সেরকম কোন লোকের সংসর্গে এলে কেবল কথা শুনেই যেতে হয়, এবং কেবল শোনাকে আলাপ বলে না। তাছাড়া, সেকথা যতই বুদ্ধিদীপ্ত, যতই গভীর চিন্তাপ্রসূত, যতই সূক্ষ্ম-সরস হোক, খানিক পরে ক্লান্ত লাগতে আরম্ভ করেই।“

মানব-মানবী যখন পরস্পরকে ভালোবাসে, তার কি কোন নির্দিষ্ট কারণ থাকে? ভালো অর্থে যেটা থাকে সেটা মোহ। “জীবনকে লালন করবার যত কৌশল আছে প্রকৃতির, তার মধ্যে মোহই শ্রেষ্ঠ।“

লেখক রেলগাড়িতে চড়ে পুরী গিয়েছেন। ভুবনেশ্বর। ভ্রমণের ক্লান্তি গন্তব্যকে মহিমান্বিত করে। “কষ্ট করে যেখানে পৌঁছাতে হয়, সেটাই তীর্থ।“

৮৫ বছর আগে কোথাও যেতে যে পরিমাণ কষ্ট হতো – এখন তো কোন কষ্টই হয় না। তবে কি এখনকার ভ্রমণ মহিমা হারিয়েছে? হয়তো বা।

আমাদের এখনকার ব্যস্ততার দিনে – একেবারে পূর্ণবেকারেরও কেমন যেন অবসর নেই। যারা সারাজীবন কাজ করার পর অবসরে গেছেন – তাঁরাও ছুটছেন অন্য কোন কাজে, কিংবা অবসরকালীন প্রাপ্ত টাকায় আরো কীভাবে টাকা কামানো যায়, পূর্বক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আরো কীভাবে ক্ষমতার মালিক হওয়া যায় – তার খোঁজে। অথচ প্রকৃত অবসর হলো যখন পৌঁছবার তাড়া নেই, লক্ষ্যটা হয়ে উঠলো উপলক্ষ্য, পথ চলাটাই হলো গন্তব্যের চেয়ে প্রধান।

“What is life if full of care, we have no time to stand and stare?”

রাতের ট্রেনে পুরী যাওয়ার পথের কী সুন্দর অন্ধকারের বর্ণনা – “আলোজ্বালা জানলাগুলো নিয়ে লম্বা রেলগাড়িটা ছবির মতো দাঁড়িয়ে। শুধু দূরে শোনা যাচ্ছে এঞ্জিনের অসহিষ্ণু নিঃশ্বাস।“

সেই ৮৫ বছর আগে পুরী ছিল নির্জন। ধরমশালায় থাকতো মানুষ। পান্থনিবাসগুলি সব ছিল মাড়োয়ারিদের দান। ধর্মবিশ্বাস আর চুরি সম্পর্কে কী দুর্দান্ত মারাত্মক সত্য কথা বলেছেন লেখক এখানে। “সমস্ত দেশের খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে জেনেশুনে যে পাপ এরা করেন, তারই ক্ষতিপূরণ হয় ধর্মশালা নির্মাণে, মন্দিরে-মন্দিরে মহার্ঘ উপঢৌকনে। অন্ধবিশ্বাসের মস্ত একটা সুবিধা এই যে বিবেক অতি সহজেই পরিষ্কার রাখা যায়। এরা বিনা দ্বিধাতেই বিশ্বাস করেন যে প্রেম ও যুদ্ধের মত বাণিজ্যেও কিছু অন্যায় নয়, কেননা মুনফার একটা অংশ তো দেয়া হয় দেবতাকেই।“

লেখক ভুবনেশ্বরের মন্দির দেখেন, প্রকৃতি দেখেন, মন্দিরের স্থাপত্য দেখেন, এর পেছনের দর্শন দেখেন। মানুষ মন্দির বানানোর সময়, উপাসনালয় বানানোর সময় যে উৎসাহ নিয়ে কাজ করে – সিনেমাহল বানানোর সময় সেই উৎসাহ নিয়ে করে না – এটা লেখকের কথা। “ভালোবাসার কাজে শরীর আর মনের বিকাশ, নিছক রোজগারের কাজে বিনাশ।“ – মানলাম। তব এয়াধুনিক স্থাপত্য যারা বানাচ্ছে তাতে ভালোবাসা নেই বা থাকে না – এ ব্যাপারে লেখক কীভাবে নিশ্চিত হলেন?

এখানে লেখকের নিজের লেখার প্রসঙ্গ আসে। একটা লেখা লিখতে যে পরিশ্রম হয় – সেই পরিশ্রম কোন টাকা আনবে না জানার পরেও লেখকের ক্লান্তি আসে না। এর কারণ ভালোবাসার তৃপ্তি। একজন লেখকের প্রধান ভালোবাসা তার লেখা। এই ভালোবাসা কীভাবে জন্মে?

পুরীর সমুদ্রের ধারে হোটেলের ঘরে আছেন তাঁরা। ছাদ তাঁদের দখলে। সমুদ্র দেখা যায় সেখান থেকে। সহকারী গোবিন্দ আর জং বাহাদুর সমুদ্র স্নান ও অন্যান্য কাজের গাইড। তাদের পিঠে চড়ে লেখক এবং পরিবার (‘আমরা’ – কে কে উল্লেখ নেই) সমুদ্রস্নান করেছেন। মানুষের পিঠে চড়ে সমুদ্রস্নান!!

ভ্রমণের ছবি তোলার ব্যাপারে লেখক অনেকটাই কট্টরবিরোধী। সেই সময় অবশ্য ছবি তোলা এত সহজ ছিল না। লেখক ছবি তোলাকে এবং সেই ছবি কাউকে দেখানোকে নিছক লোকদেখানো মনে করেন। “ক্যামেরার ছবি তো মরা; আসল ছবি থাকে মনে।“ এখনকার যুগে হলে কী বলতেন জানি না। তবে স্মৃতি ধরে রাখার যান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যদি অস্বীকার করতে হয় – তাহলে তো স্মৃতিচারণকেও, বইলেখাকেও অস্বীকার করতে হয়।

পুরীর সমুদ্রতীর ৮৫ বছর আগে অনেকটাই নির্জন ছিল। তখন লেখক কল্পনা করেছিলেন যদি এই সমুদ্রতীর মানুষে কিলবিল করে, সবাই যদি একসঙ্গে বীচে শুয়ে সময় কাটাতে আরম্ভ করে, তখন হোটেলের দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকাটাই হয়ে উঠবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। এখন তো সেরকম হয়ে গেছে।

লেখক অন্ধকার ভালোবাসেন। যখন অন্ধকার দেখতে চান কলকাতায় তা পারেন না। “অন্ধকারের শরীরকে খোঁচা খোঁচা আলো ফুটো করে দেবেই।“

পুরী থেকে চিল্কায় গিয়ে সেই আকাঙ্খিত অন্ধকারকে আবিষ্কার করেন তিনি - “সে অন্ধকার অতি উজ্জ্বল আলোর মতোই মনকে প্রচন্ড ধাক্কা দেয়।“

উড়িষ্যা পার হয়ে মান্দ্রাজের ছোট্ট একটা স্টেশন রম্ভাতে নামতে হয়। কাছেই চমৎকার নির্জন ঘরে থাকার ব্যবস্থা। এই চিল্‌কা নিয়েই বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত কবিতা – চিল্কার সকাল। কবিতাটি এই বইতেও আছে। এখানেই হয়তো প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ডাকবাংলোর ব্যাপারে লিখেছেন, “নির্জনতা ও গোপনতাই এদের প্রধান আকর্ষণ। অন্য মানুষের সান্নিধ্যে সমস্ত সুরটাই কেটে যায়।“

উড়িষ্যায় “অতি সহজেই নবাবের মতো থাকা যায়।“ প্রতিটি ডাকবাংলোতে একাধিক ভৃত্য – আদেশ পালনে প্রস্তুত নামমাত্র বখশিসের বিনিময়ে। বোঝাই যাচ্ছে এই রাজ্যটি ৮৫ বছর আগেও যেমন গরীব ছিল – এখনো রয়ে গেছে।

আমাদের বিস্মিত হবার ক্ষমতা আমরা যতই বড় হই – ততই হারিয়ে ফেলি। এই বড় হওয়া বয়সের ক্ষেত্রে তো বটেই – শিক্ষা, বিত্ত কিংবা ক্ষমতার ক্ষেত্রেও। অবাক হওয়াটাকে আমাদের অহং এর কারণে আমরা অনেক সময় প্রকাশ করতে চাই না।

চিল্কার “কী ভালো আমার লাগলো আজ

এই সকালবেলায়

কেমন করে বলি।“

চিল্‌কা থেকে আবার পুরীতে।

রাজনীতিতে আগ্রহ নেই লেখকের। রাজনীতিকে তিনি প্রতিভাহীন মানুষের কাজ বলে মনে করেন। যেসময় এই কথাগুলি তিনি লিখেছেন সেসময় ভারতে স্বাধীনতা আসেনি। স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে। তাহলে তাঁর এরকম মতের কারণ কী?

লেখক কোনারকে গিয়েছেন গরুর গাড়িতে। ষোল ঘন্টা গরুর গাড়িতে চড়ে। কোনারকের সৌন্দর্য দেখতে দেখতেও সচেতনতা বিলুপ্ত হয় না বলে আক্ষেপ প্রকাশ পায়।

বাড়ির বাইরে গেলে সেই সময় মানুষ চিঠি লিখতো। যেন সবাইকে জানানো – দেখ আমি কোথায় এসেছি। এখনো চলছে এসব – এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনবরত ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। আগে পোস্ট করা হতো চিঠি। মৌলিক পরিবর্তন খুব বেশি হয়েছে কি?

এই বইটিকে ঠিক ভ্রমণকাহিনি আমি বলবো না। এখানে গল্প অল্পই আছে। আমি যদি এই গল্পটা বলতে চাইতাম – বিশ পঁচিশ পৃষ্ঠার বেশি হতো না। কিন্তু লেখক কী অবলীলায় ১০৮ পৃষ্ঠা লিখে ফেলেন।

তাঁর ভাষা আর যেকোনো বিষয় প্রকাশের ক্ষমতা অসাধারণ। কিন্তু যে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি তা হলো নিজের লেখায় অন্যরা যে ভালো লেখেন না তার বিচার। কোন বিশেষ বইয়ের সমালোচনায় তা লেখা চলে। কিন্তু কারো নাম না নিয়ে ঢালাওভাবে বলাটা ভালো লাগেনি। যারা ভালো লেখেন তাঁদের কাছে এই ব্যাপারটা আমি আশা করি না।

Sunday 28 November 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৪৮

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৮

আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ দায়িত্বমুক্ত হলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “একজন জ্যন্ত মানুষকে কবর দেয়ার পর তাকে কবর থেকে তুললে যে অবস্থা হয়, আমারও সে অবস্থা হয়েছে।“ 

বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে খুবই ন্যায়নিষ্ঠ নীতিবান মানুষ বলে মনে হয়েছে আমার। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পুরো সাত মাস বন্ধ ছিল শিবিরের কারণে। তিনি সেদিকে নজর দেয়ার সময় পাননি। তবুও একটা বিশ্বাস ছিল যে তাঁর শাসনামলে শিবির লাগামহীন বেপরোয়া হতে পারবে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করা কঠিন। নীতিবানদের জন্য তো আরো কঠিন। হয়তো সে কারণেই তিনি দায়িত্ব পালনের সময়টাকে জ্যন্ত কবরে থাকার সাথে তুলনা করেছেন। এখন তিনি তো দায়িত্বপালন শেষে নিজের আগের পদে ফিরে গেছেন। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রপতি। নতুন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস দলীয় ভোটে নির্বাচিত হয়ে কতটুকু সর্বদলীয় হয়ে উঠতে পারেন সেটাই দেখার। 

কাগজে-কলমে নিয়ম মানার জন্য কতকিছু যে করতে হলো। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসার জন্য সংসদে সংবিধান সংশোধনের বিল পাস হবার পরেও একটা গণভোট করতে হলো। সেপ্টেম্বরের সেই গণভোটে ভোট পড়েছে মাত্র ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশ ভোটার ভোটই দেননি। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফেরার পর সংসদ-সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের শরিকদের সব মিলিয়ে এক শ ভোটও নেই। তারপরও তারা বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরিকে জাতীয় ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন। গণতান্ত্রিক পন্থায় সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সেই প্রার্থী কী কারণে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের কাছে গিয়ে দোয়া ভিক্ষা করেন আমার বোধগম্য নয়। আমার পরিচিত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকে আমি এই প্রশ্ন করেছি। তারাও খুব বিব্রত এই ব্যাপারে। আমি মনে করি এই কাজের ফলে আওয়ামী লীগের কোন লাভ তো হয়নি – বরং এই কাজের খেসারত তাদের দিতে হবে দীর্ঘদিন। যে গোলাম আযম এতদিন অনেকটাই আড়ালে থাকতে বাধ্য ছিলেন, হঠাৎ করে তিনি অনেক বেশি প্রকাশ্যে চলে এলেন। তার প্রভাব সাংঘাতিকভাবে পড়লো আমাদের ক্যাম্পাসে। 

আমাদের আগের ব্যাচের মাস্টার্স পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। তারা পরীক্ষা দিয়ে চলে গেলে সব হলে বেশ কিছু সিট খালি হবে। মাস্টার্সের ছাত্রদের জন্য প্রায় সব হলেই কিছু সিংগেল রুম আছে। মেধাভিত্তিক সিটবন্টন করা হবে বলে সব হলেই বলা হয়ে থাকে। অনার্সের রেজাল্টের ভিত্তিতে সিট দিলে একটা সিট তো আমি পেতেই পারি। আলাওল হলে সিটের জন্য দরখাস্ত জমা দিলাম। 

মাস্টার্সে ভর্তি হবার সময় আমি হল পরিবর্তন করে সোহরাওয়ার্দী থেকে আলাওলে নাম লিখিয়েছি। এর পেছনে একটাই কারণ কাজ করেছে – সেটা হলো আগে পরীক্ষা শেষ করার ইচ্ছা। আমি খেয়াল করে দেখেছি – পরীক্ষার রোল নম্বর শুরু হয় আলাওল হল থেকে। ভাইভা হয় রোল নম্বর অনুসারে। আলাওল হলের ছাত্রদের ভাইভা আগে হয়। ভাইভার মানসিক চাপ আমার সহ্য হতে চায় না। মৌখিক পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায় ততই ভাল। 

নভেম্বরের ১৩ তারিখ দুপুরে হলে সিট বন্টনের তালিকা প্রকাশিত হবার কথা। প্রদীপ নাথ গতবছর সিট পেয়েছে। সে এখন নিয়মিত হলেই থাকে। হাফিজও থাকে আলাওলে। যীশু শাহজালালে দরখাস্ত করেছিল – তাকে সিট দেয়া হয়নি। আমি নিশ্চিত – সায়েন্স ফ্যাকাল্টির কাউকে একটা সিটও যদি দেয়া হয় – নিয়ম অনুযায়ী সেই সিট আমাকে দিতে হবে। 

ক্লাস শেষ করে গেলাম আলাওলে। অনেকটা নিশ্চিন্তমনে কবে থেকে হলে উঠবো এসব আলোচনা করতে করতে আলাওল হলের অফিসে গেলাম। বারান্দায় নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। অনেকগুলি সিট বন্টন করা হয়েছে। কিন্তু তালিকার কোথাও আমার নাম নেই। এরকম তো হবার কথা নয়। যীশুরা সবাই কয়েকবার করে দেখলো। না, আমাকে কোন সিট দেয়া হয়নি। 

সেকশান অফিসারের রুমে ঢুকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “হলের সিট বন্টন কীসের ভিত্তিতে হয়েছে?”

“মেধার ভিত্তিতে হয়েছে। যাদের রেজাল্ট ভালো তাদেরকে সিট দেয়া হয়েছে।“

“অনার্সে যারা ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে তারা কি সিট পেয়েছে?”

“অবশ্যই, সেকেন্ড ক্লাস পেয়েও অনেকে পেয়েছে। ফার্স্ট ক্লাস তো বেশি পায় না।“ – সেকশান অফিসারকে খুব অমায়িক মানুষ বলে মনে হলো। 

“তাহলে আমার তো একটা সিট পাবার কথা। আমাকে তো সিট দেয়া হয়নি।“

যীশু এসব ব্যাপারে অল্পতেই রেগে যায়। সে হড়বড় করে অনেক কিছু বলে ফেললো। সেকশান অফিসার দরখাস্তের ফাইল বের করলেন। ফাইলে বিশ-পঁচিশটা দরখাস্তের মধ্যে আমার দরখাস্ত নেই। 

“আপনি কি দরখাস্ত জমা দিয়েছিলেন?”

“অবশ্যই জমা দিয়েছি। আমার জমা-রশিদ দেখেন।“ 

দরখাস্তের ফরম কেনার রশিদ, জমা দেয়ার রশিদ আমার সাথে ছিল। দেখালাম। সেকশান অফিসারের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, কপালের ভাঁজগুলি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিলো। 

প্রদীপনাথ এই হলের আবাসিক ছাত্র। তার নিজের হলে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে – এটাতে তার সম্ভবত খুব অপমান লাগছিল। সে বিচক্ষণ হেডমাস্টারের মতো ঠান্ডা মাথায় নির্দেশ দিলো, “ফরম এখানে আপনার অফিসেই জমা দিয়েছি আমরা সবাই একসাথে এসে। আপনি খুঁজে বের করেন। নইলে আমরা প্রভোস্টের কাছে যাচ্ছি। দরকার হলে ভিসির কাছে যাবো।“

দেখলাম ছোট্ট অফিসঘরে ভীড় জমে গেছে। অফিসার এবং সহকারীছাড়া বাকি যারা কান্ড দেখার জন্য ভীড় করেছে তাদের সবাইকে শিবিরের কর্মী বলে মনে হচ্ছে। 

“আপনাদের এক ঘন্টা সময় দিলাম। ফরম খুঁজে বের করেন। আমরা ১০৪ নম্বর রুমে আছি। এক ঘন্টার মধ্যে খবর না পেলে সমস্যায় পড়বেন আপনারা।“

ঠান্ডা গলায় বললেও অনেকটা ধমকের মতো শোনালো কথাগুলো। সিটের দরখাস্তই ফেলে দিয়েছে আমার! মেজাজ ঠিক থাকে এরকম অন্যায় ঘটলে! 

১০৪ নম্বর রুমে – প্রদীপ নাথ, সুকুমার আর ননী থাকে। তাদের রুমে এসে বসলাম। এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে তা কখনো চিন্তাও করিনি। আমার হলে ওঠা বন্ধ করতে আমার দরখাস্ত গায়েব করে ফেললো ওরা? এটা যে শিবিরের কাজ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না – আমার উপর তাদের ক্ষোভ কিসের? আমি তো ক্যাম্পাসে সরাসরি শিবিরের বিরুদ্ধে কিছু করিনি। অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলার সাহসও নেই আমার। 

“সম্ভবত অন্য কোন ফাইলে রেখেছে ওরা। খুঁজে বের করে ফেলবে। নইলে প্রভোস্টের কাছে যাবো।“ – প্রদীপ নাথ আমাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে। 

মিনিট বিশেক পরেই দরজার সামনে লম্বা হ্যান্ডসাম কোঁকড়া চুলের এক সুঠাম তরুণ এসে প্রমিত বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “এখানে প্রদীপ দেব কে?”

বাহ্‌, একঘন্টা সময় দিয়েছিলাম, বিশ মিনিটেই খুঁজে বের করে ফেললো! খুব করিৎকর্মা অফিস বলে মনে হচ্ছে। খুশি হয়ে বললাম, “আমি।“

“আপনি প্রদীপ দেব?” ছেলেটা নিজের বাম হাতের তালুর দিকে তাকাচ্ছে। সেখানে বলপয়েন্টে আমার নাম লিখে এনেছে।

“আপনি আসুন আমার সঙ্গে।“

যীশুও উঠে দাঁড়ালো আমার সাথে। 

“খবরদার, আপনারা কেউ বের হবেন না। আপনি আসেন আমার সঙ্গে।“

আমার গা দিয়ে একটা ঠান্ডাস্রোত বয়ে গেল। বুঝতে পারলাম – বড় বিপদ উপস্থিত। শিবির তাদের ক্যাডার পাঠিয়েছে। শিবিরের নিয়ম হলো সিনিয়র স্টুডেন্টদেরকে জুনিয়রদের দিয়ে পেটায়। দিনে-দুপুরে জবাই করে ফেলবে নাকি?

বেশিক্ষণ চিন্তা করারও সুযোগ পেলাম না। সুঠাম তরুণ তার লম্বা হাত বাড়িয়ে আমার ঘাড় ধরলো। তারপর শেয়াল যেভাবে মুরগি ধরে টেনে নিয়ে যায় – সেভাবে টেনে নিয়ে চললো আলাওল হলের বারান্দা দিয়ে। স্বাভাবিক রিফ্লেক্সে বাধা দিতে গিয়েছিলো আমার হাত। সেই হাত মুচড়ে পিছমোড়া করে ফেললো। মনে হচ্ছে এসব কাজে তার বিশেষ প্রশিক্ষণ আছে। একটূ আগে সবগুলি রুমের দরজা খোলা দেখেছিলাম। এখন সব দরজা বন্ধ। একটু পরপর দাঁড়িয়ে আছে শিবিরের ক্যাডার। তাদের হাতে কিছু না কিছু আছে। একজন এসে আমার পেছনে একটা লাথি মারলো। তার কী ক্ষতি আমি করেছিলাম জানি না। হাত-পায়ের রগ কেটে দেবে, না জবাই করবে বুঝতে পারছি না। কয়েক শ ফুট বারান্দা – মনে হচ্ছে কয়েক হাজার কিলোমিটার। 

ঘাড়ের পেছনে কানের নিচে একটা ঘুষি খেয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মুহূর্তে শুনলাম, “এই হলে আর জীবনে যদি আসিস, আল্লাহর কসম – জবাই করে দেবো। আর কাউকে যদি এসব ঘটনা বলিস, তোর লাশও খুঁজে পাবে না কেউ।“ – হুবহু বাংলা সিনেমার ডায়লগ। ভিলেন জসিম এভাবেই শাসিয়েছে অসংখ্য সিনেমায়। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা সিনেমার কোন দৃশ্য নয়। 

একটু পরপর ঘাড়ের দু’পাশে কানের গোড়ায় ঘুষি মারছে, আর পশ্চাৎদেশে লাথি। এমন জায়গায় মারছে – রক্ত বের হবে না, কিন্তু ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাবে। অবশেষে বারান্দা শেষ হয়ে অফিসের কাছাকাছি গেটের কাছে পৌঁছলাম। এখানে শিবিরের ক্যাডারে ভর্তি হয়ে গেছে বারান্দা। শুধুমাত্র আমাকে মারার জন্য এতগুলি ক্যাডার জড়ো হয়েছে এখানে? 

এখানে দোতলায় উঠার সিঁড়ির মুখে একটি পরিচিত মুখের দিকে চোখ পড়তেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই লোক – আমার মেসে ছিল। কতদিন হাই-হ্যালো করেছি। আরো একজন পরিচিত মুখ ভীড়ের মধ্যে সরে গেল। সেই যে আযমভাইকে ভিসি-আর বন্ধ করার জন্য বলতে এসেছিল অনেকদিন আগে।  

হলের গেটে এনে আক্ষরিক অর্থেই পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে বের করে দিলো আমাকে। আমি পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গেলাম। চারপাশে অনেক মানুষ দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিচ্ছু বলছে না। মিনিটখানেক পর যীশু দৌড়ে এসে আমাকে টেনে তুললো। সে কীভাবে আসতে পারলো জানি না। আমার ঘাড় ফেরানোর শক্তি নেই। ঘাড়ের দুপাশের পেশিগুলি মনে হচ্ছে তরল হয়ে গেছে ঘুষির পর ঘুষি খেয়ে। 

হলের সামনের বাগানে শীতকালীন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। প্রচুর গাঁদা ফুটে হলুদ হয়ে আছে এদিকটা। কিন্তু আমি চোখে অন্যরকম হলুদফুল দেখছি। আমি হাঁটতে পারছি না, কিন্তু আমাকে দ্রুত গেট পেরিয়ে চলে যেতে হবে রাস্তায়। এটা আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমি এই হলের ছাত্র। কিন্তু শিবিরের হুকুম - আমি এই হলে আর আসতে পারবো না। আমার হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়নি সেজন্য আমার খুশি হওয়া উচিত। তীক্ষ্ম তলোয়ারে ক্ষত-বিক্ষত করেনি আমার শরীর, সেজন্য আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।  কিন্তু আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে পানিতে। শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও অপমানের যন্ত্রণা বেশি। 

<<<<<<<< আগের পর্ব

Wednesday 24 November 2021

ভ্যান ডার ভাল্‌স - নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী

 




পদার্থের কঠিন, তরল এবং বায়বীয় অবস্থার প্রধান কারণ যে তাপমাত্রা এবং চাপ – তা আমরা এখন খুব সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারি। তাপমাত্রা বাড়াতে থাকলে কঠিন পদার্থ গলে গিয়ে তরলে পরিণত হয়। তাপমাত্রা আরো বাড়াতে থাকলে তরল পদার্থ বায়বীয় পদার্থে পরিণত হয়। তরল ও গ্যাসের আয়তন, চাপ ও তাপমাত্রার সমন্বয়ক দ্বিমাত্রিক সমীকরণ যিনি আবিষ্কার করেছেন - ইংরেজি থেকে সরাসরি বাংলায় উচ্চারণে আমরা তাঁকে বলি ভ্যান-ডার-ওয়ালস। নেদারল্যান্ডে জন্ম নেয়া এই পদার্থবিজ্ঞানীর পুরো নাম ইওহানেস ডিডেরিক ভ্যান ডার ভাল্‌স (Johannes Diderik van der Waals)। ১৯১০ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। অথচ এই বিজ্ঞানী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি। তাঁর যাকিছু আবিষ্কার – সবই তাঁর নিজস্ব। স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীর জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি।

১৮৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর নেদারল্যান্ডের লেইডেনে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা-মা ইয়াকুবাস ও এলিজাবেথ ছিলেন নিতান্তই সাধারণ মানুষ। অভিজাত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা তখন উচ্চশিক্ষার জন্য ক্লাসিক্যাল ভাষা ল্যাটিন ও গ্রিক শিখতো। কিন্তু ইওহানেস ল্যাটিন কিংবা গ্রিক – কোনটাই শিখেননি। ফলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি।

নিজের ডাচ ভাষায় যতদূর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেয়া যায় – সেটা হলো মাধ্যমিকের সমতুল্য। সেটুকু পাস করার পর তিনি ১৮৬৪ সালে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু ল্যাটিন কিংবা গ্রিক ভাষার কোনটাই জানেন না বলে – তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়নি। ১৮৬৬ সালে তিনি লেইডেন থেকে হ্যাগে গিয়ে অন্য একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি একটি মাধ্যমিক স্কুলের পরিচালক বা হেডমাস্টার হয়েছিলেন।

মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হয়েছেন বলে কি নিজে নিজে বিজ্ঞানচর্চা করতে পারবেন না? তিনি নিজে নিজে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে শুরু করলেন। আবিষ্কার করলেন গ্যাস ও তরলের মধ্যবর্তী আয়তন ও তাপমাত্রার সম্পর্ক। তিনি আবিষ্কার করলেন যে গ্যাসকে ঠান্ডা করলে তা তরলে পরিণত হয়। ‘ইকুয়েশান অব স্টেট’ থিসিসে তিনি গ্যাসের সমীকরণের আদ্যোপান্ত লিখলেন।

১৮৭৩ সালে নেদারল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা জানার শর্তটি তুলে নেয়া হয়। ভ্যান-ডার-ভালস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন এবং তাঁর থিসিসটি দাখিল করলেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর থিসিসের ভিত্তিতে তাঁকে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি দিলো।

ভ্যান-ডার-ভাল্‌স এর গবেষণার ভূয়সী প্রশংসা করলেন ম্যাক্সওয়েল। ডাচ ভাষায় লেখা বলে তাঁর পেপার তখনকার বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের অনেকেই পড়তে পারেননি। তখন জার্মান ও ল্যাটিনে অনুবাদ করে প্রকাশ করতে হয়েছে তাঁর পেপার। অচিরেই তিনি বিশ্ববিজ্ঞানীদের সারিতে নিজের আসন পোক্ত করে ফেলেন।

১৮৭৬ সালে নেদারল্যান্ডের উচ্চশিক্ষা আইন অনেক উদার করা হয়। প্রাচীন পদ্ধতির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে আধুনিক পদ্ধতির বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়। আর্মস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় সেভাবে রূপান্তরিত বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৭৭ সালে ভ্যান-ডার-ভাল্‌স সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম প্রফেসর নিযুক্ত হলেন। ১৯০৭ সালে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

১৯১০ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।

১৯২৩ সালের ৮ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।


Saturday 20 November 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৪৭

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৭

অনুসন্ধিৎসার ব্যাপারটা প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের সবার ভেতর কম-বেশি আছে। বিষয়ের ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে ব্যাপারটা আছে। যেমন ক্যাম্পাস এবং হলের কোন্‌ কোন্‌ কোণে গেলে সিগারেট কেনা যাবে কিংবা খাওয়া যাবে তা প্রদীপ নাথ খুঁজে বের করে ফেলেছে অনেক আগেই। ব্রিটিশ ফটোগ্রাফিক জার্নালের কোন্‌ সংখ্যায় ‘গরম’ ছবি প্রকাশিত হয়েছে, এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের কোন্‌ তাকে সেই ম্যাগাজিন আছে সে খবরও সে কীভাবে যেন নিয়মিত পেয়ে যায়। ক্যাম্পাসের প্রায় সব সুদর্শনার নাম-পরিচয় হাফিজ-স্বপন-মামুন-ইকবাল জানে। অর্পণ ‘দেশ’ পত্রিকা পড়ে নিয়মিত। নতুন বই আর গানের খবর তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। এখলাস রিডার্স ডাইজেস্টের নিয়মিত পাঠক, লাইব্রেরিতে গিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়। তাকে ওয়ার্ল্ড নিউজ চ্যানেল বলা চলে। হুমায়ূন আহমেদ আর তসলিমা নাসরিনের সব খবর রাখেন মুকিতভাই। বিপ্লব খুঁজে ফেরে নতুন নতুন ক্যাকটাস। 

সবচেয়ে বিচিত্র ধরনের কৌতূহল দেখেছি যীশুর মধ্যে। শাক-সব্জি থেকে শুরু করে পোকা-মাকড় সবকিছুতেই তার সমান কৌতূহল। বাসায় সে কাচের বাক্সে মাছ পোষে, কাঠের বাক্সে খরগোশ। শহীদ মিনারের সামনের নার্শারিতে নিয়মিত যায় নতুন ধরনের ফুলের চারার সন্ধানে। তার বাসার বারান্দা ভর্তি হয়ে গেছে বিচিত্র ধরনের ফুলের গাছে। নতুন ওঠা শাক-সব্জিকে হাতে ধরে দেখার জন্য সে বাস থেকে নেমে যায় মাঝে-মধ্যে। ক্যাম্পাসেও সে প্রায়ই তার অনুসন্ধানী কার্যকলাপ চালায়। 

চাকসুর ক্যাফেটরিয়া থেকে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে ফরেস্ট্রি ও মেরিন সায়েন্সের দিকে – সেই রাস্তার বাম পাশে নিচু জলাভূমি। অনেকটা লম্বা ডোবার মতো। বর্ষাকালে পানিতে টইটুম্বুর থাকে। এখন সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ডোবার পানি অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। যীশু হাঁটতে হাঁটতে আজ হঠাৎ ডোবার পাড়ে থমকে দাঁড়ালো দেখে আমি মোটেও অবাক হলাম না। 

হাতে সময় থাকলে যীশু  ঘোলা পানির কাছে গিয়ে মৎস্য-অনুসন্ধান করে। একদিন একটা ছোট্ট কাঁকড়াকে সেখানে কাদার উপর হাঁটতে দেখে জুতা-মোজা খুলে সে কাদায় নেমে গিয়েছিল কাঁকড়া ধরার জন্য। এখনো হয়তো সেরকম কিছু একটা দেখেছে। 

যীশু কীসের অনুসন্ধান করছে সে ব্যাপারে আমি খুব একটা কৌতূহলী হলাম না। মাছ কিংবা কাঁকড়া দেখলেই তার ধরতে ইচ্ছে করে। আরো কী কী ধরতে ইচ্ছে করে কে জানে। আমার কোনকিছুই ধরতে ইচ্ছে করে না – মাছ, কাঁকড়া, পাখি, পোকা – কিছুই না। ধরে ফেলার মধ্যে কেমন যেন একটা বল-প্রয়োগের ব্যাপার থাকে, বীরত্ব দেখানোর ব্যাপার থাকে। 

ক্যাম্পাসের গাছগুলিতে আবার পাতা গজিয়ে গেছে। এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে বেশিরভাগ গাছই আধমরা হয়ে গিয়েছিল। চার মাসের মধ্যেই তারা নতুন উদ্যমে বেঁচে উঠছে। প্রকৃতি ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেয় না, মানুষেরই সময় লাগে। 

একটা টিচার্স-বাস এসে থামলো আমাদের কাছেই। আমাদের ফরায়জি কামালস্যার, বিকিরণস্যার, গণিতের নীলরতনস্যার, গনেশস্যার, কেমিস্ট্রির বেনুগোপালস্যারসহ আরো দু-তিনজন স্যার নেমে রাস্তা পার হয়ে ফ্যাকাল্টির দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। বাসটি তখনো দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর নামলেন সোবহানস্যার। লম্বা ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবীর কারণেই কি এতক্ষণ লাগলো নামতে?

স্যার নামতেই বাস চলে গেল সামনের দিকে। হাত তুলে সালাম দিলাম স্যারকে। স্যার সম্ভবত আমাদের খেয়াল করেননি। রাস্তা পার হয়ে খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলেন ফ্যাকাল্টির দিকে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবীর সাথে খয়েরি রঙের ব্রিফকেস – কেমন যেন বিসাদৃশ্য লাগছে। ব্রিফকেসের বদলে কাপড়ের থলি নিলেই কি সাদৃশ্য লাগতো? 

“চল্‌ চল্‌ তাড়াতাড়ি চল্‌” বলে যীশু হঠাৎ জোরে হাঁটতে শুরু করলো। তাল মিলিয়ে হাঁটার সময় শুনতে পেলাম কিছুটা উচ্চ ডেসিবেলের কয়েকটা শব্দ নির্গত হলো তার শরীরের মধ্যাঞ্চল থেকে। ব্যাপারটা সুবিধাজনক ঠেকছে না। তার পাকস্থলিতে নিম্নচাপের লক্ষণ। কিন্তু সে যেদিকে দৌড়াচ্ছে – সেদিকে না গিয়ে তার উচিত ছিল ক্যাফেটরিয়ার দিকে যাওয়া। আমাদের ফ্যাকাল্টির টয়লেটগুলির যে কী জঘন্য অবস্থা তা তো তার অজানা নয়। কিন্তু তাকে কিছু বলার আগেই সে আরো কিছুটা বায়ুদূষণ ঘটিয়ে দৌড়ে উঠে গেল ফ্যাকাল্টির সিঁড়িতে। 

সায়েন্স ফ্যাকাল্টির স্থাপত্যের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো দুই পাশের সিঁড়িগুলি। মাঝখানে প্রশস্ত র‍্যাম্প আছে। কিন্তু দুই পাশের এই সিঁড়িগুলির প্রস্থ এত কম যে পাশাপাশি একজনের বেশি উঠতে বা নামতে হলে অন্যজনের গায়ে লাগবেই। যীশু এতক্ষণ দৌড়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে আটকে পড়লো। সোবহানস্যার সিঁড়ি ধরে উপরে উঠছেন আস্তে আস্তে। প্রকৃতির বড় ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য নেই যীশুর। স্যারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। আমি দূর থেকে দেখলাম সে সিঁড়িতে স্যারকে কোন রকমে পাশ কাটিয়ে চলে গেল উপরে। কিন্তু এজন্য যে তাকে পরে মূল্য দিতে হবে তা তখন একবারও মনে আসেনি। 

ক’দিন আগেই ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হয়েছেন সোবহানস্যার। ডিপার্টমেন্টে অনেক নতুন নিয়ম তিনি চালু করতে চলেছেন – এ ব্যাপারে কানাঘুষা চলছে। ক’দিন আগে ক্লাসে তিনি বলেছেন – প্রক্টরের পদটা নাকি সৃষ্টি করা হয়েছিল ক্যাম্পাসে ছেলেদের সাথে মেয়েদের মেলামেশা বন্ধ করার জন্য। স্যারের কথা শুনে ফারুকের দিকে তাকিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম সে এই তথ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করবে। কিন্তু ফারুক কোন কথা বলেনি। তবে কি ইতোমধ্যেই তাকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে? তবে কি আমাদের ডিপার্টমেন্টে সেরকম কোন বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে “প্রক্টর” নিয়োগ করা হবে?

সেকেন্ড পিরিয়ডে সোবহানস্যার ক্লাস নিতে এসে যীশুকে খুঁজে বের করলেন। 

“তোমার নাম কী?”

“যীশুখৃস্ট চোধুরি, স্যার।“

“তুমি কি খ্রিস্টান?”

“না স্যার, হিন্দু।“

“যীশুখৃষ্ট নাম – তাই জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা, তখন কি তোমার খুব বেশি তাড়া ছিল?”

যীশুর মুখ অপমানে বেদনায় কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমতা আমতা করে সে বললো, “জি স্যার, একটু তাড়া ছিল স্যার।“

“না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। স্টুডেন্ট তো টিচারদের পাশ কাটিয়ে যেতেই পারে।“ – স্যার হাসিহাসি মুখ করে কথাগুলি বললেও আমাদের কারোরই বুঝতে বাকি থাকলো না যে স্যার ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেননি। যীশুর ভয়ের অনেক কারণ আছে। 

মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। সেকেন্ড পিরিয়ডের পর আর কোন ক্লাস হলো না। যীশুর শরীর-মন কিছুই ভালো নেই। সে চলে গেল বাসায়। নাথ গেলো তার সঙ্গে। আমি একটু বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে থাকার চেষ্টা করছি। সেমিনারে বা লাইব্রেরিতে যাবার অভ্যাস করছি। অনার্সের সময়টাতে মনের উপর আলাদা কোন চাপ ছিল না। কিন্তু এখন কেমন যেন একটা টেনশান তৈরি হয়েছে। 

তিন তলায় উঠে সেমিনারে ঢুকলাম। সেমিনাররুমের ভেতরে আরেকটি ছোট রুম আছে। সেখানে দেয়ালঘেঁষে ফ্লোরের উপর রাখা হয়েছে শত শত ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নাল। এই জার্নালটি যে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বনেদি জার্নাল তা জেনেছি মাত্র কয়েকদিন আগে। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এই দামী জার্নাল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে বিনামূল্যে। উন্নয়নশীল দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই জার্নাল আমরা ফ্রি-তে পাচ্ছি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির কাছ থেকে। ফ্রি জিনিসের কোন মূল্য নেই বলেই এত দামী জার্নালটিকে রাখা হয়েছে সবচেয়ে অবহেলায়। জার্নালের ভলিউম এবং নাম্বার অনুযায়ী সাজিয়ে রাখার কথা। কিন্তু আমাদের সেমিনার-লাইব্রেরিয়ানের সেরকম কোন ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। 

সেমিনার রুমের ভেতরের রুমের সাথে লাগানো মোবাশ্বেরস্যারের অফিস। আমি ভেতরের রুম থেকেই শুনতে পেলাম মোবাশ্বেরস্যারের গলা,  অঞ্জন আর রিনার গলা। অঞ্জন আর রিনা মোবাশ্বেরস্যারের কাছে থিসিস করছে। 

অনেকদিন রিনার সাথে কথা হয় না আমার। ইদানীং সবাই কেমন যেন অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। আমি নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আজ কথা বলতে হবে তাদের সাথে। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে সেমিনারের মেইন রুমে ঢুকতেই শায়লাআপার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। 

“প্রদীপ, প্রামাণিকস্যারের কিটেলের বইটা তুমি নিয়ে গেছ না?” 

শায়লাআপা প্রামাণিকস্যারকে খালু না বলে স্যার কেন বলেন কে জানে। অবশ্য খালু তো ব্যক্তিগত সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রয়োগ প্রামাণিকস্যার নিশ্চয় পছন্দ করবেন না। বললাম, “জি আপা।”

“তুমি কি বইটা এনে দিতে পারবে?”

“কালকে নিয়ে আসবো।“

“আজকে পারবে না? আজকে নিয়ে এসো। বাসায় দিয়ে যাও আজকে কোন এক সময়।“ 

শায়লাআপার উচ্চারণ এত সুন্দর, কথাগুলি কেমন যেন কবিতার মতো শোনায়। 

সেমিনার থেকে বের হয়ে মোবাশ্বেরস্যারের অফিসে উঁকি দিয়ে দেখলাম। অঞ্জন ও রিনা এখনো স্যারের সামনে বসে আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি তাদের জন্য। 

মাস্টার্স পরীক্ষার্থীরা আসতে শুরু করেছে। অবশেষে আমাদের আগের ব্যাচের মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এদের সার্টিফিকেটে লেখা থাকবে ১৯৮৮ সালের মাস্টার্স পরীক্ষা। অথচ হচ্ছে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আমাদেরটা যে আগামীবছর এসময় হবে – তার কোন গ্যারান্টি নেই। এতগুলি বছর যে শিক্ষাজীবন থেকে নিষ্ফলা ঝরে যাচ্ছে তার জন্য ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা চালান – তারা সুযোগ-সুবিধা সব ভোগ করেন, কিন্তু কোন দায়িত্ব নেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মাসের পর মাস বন্ধ থাকে, খোলা থাকলেও ঠিকমতো ক্লাস হয় না, যথাসময়ে পরীক্ষা হয় না, পরীক্ষার রেজাল্ট দিতে মাসের পর মাস লেগে যায়। অথচ সব দোষ দেয়া হয় সরকারকে। এতদিন এরশাদ সরকারের দোষ ছিল, এবার খালেদা জিয়ার সরকারের দোষ।

রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে দেশের স্কুল-কলেজের পড়াশোনাও তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হয়ে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজে তো কোন সেশান-জট নেই। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কেন এই অবস্থা? বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশান-জট থেকে মুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু আমার ধারণা সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া – বেশিরভাগই সে ব্যাপারে আন্তরিক নন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর অচল হয়ে থাকলেও শিক্ষকদের কোথাও কোন অসুবিধা হয় না, কারো কাছেই কোন জবাবদিহি করতে হয় না তাঁদের। আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো এমন সুখের চাকরি আর হয় না। 

কিন্তু এতসব স্বাধীনতার পরেও আমাদের স্যারদের দেখলে খুব একটা সুখি মানুষ বলে মনে হয় না। সুখি মানুষ ছোট-খাট ব্যাপারে খিটমিট করেন না। কিন্তু আমাদের স্যারদের কেউ কেউ করেন। যেমন আজ সোবহানস্যার করলেন। একজন ছাত্র শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে গেলেই চরম বেয়াদবি হয়ে গেল? ছাত্ররা শিক্ষক-বাসে উঠলেই শিক্ষকদের অপমান হয়ে গেল? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কি প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক?

“কী রে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?” রিনার গলার স্বর কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শোনাচ্ছে।

“তোদের জন্য।“

অঞ্জন জানতে চাইলো, “যীশুর সাথে সোবহানস্যারের কী হয়েছে?”

পুরো ঘটনাটি শোনার পর তারা আতঙ্কিত হয়ে গেল। স্যারদের পাশ দিয়ে যাবার সময় সর্বনিম্ন কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখলে বেয়াদবি হবে না তা জানা থাকলে ভালো হতো। 

রুমে ফিরে আবার বের হতে হলো। প্রামাণিকস্যারের বইটা শায়লাআপাকে দিয়ে আসতে হবে। আদম শফিউল্লাহস্যার কিটেলের বই থেকে সলিড স্টেট ফিজিক্স পড়াচ্ছেন। আমি কিটেলের বই কিনেছি। আন্দরকিল্লায় যে ইন্ডিয়ান প্রিন্ট পাওয়া গেছে সেটা সিক্সথ এডিশান। কিন্তু স্যার পড়াচ্ছেন ফিফ্‌থ এডিশান থেকে। প্রামাণিকস্যারের কাছ থেকে ফিফ্‌থ এডিশানের বইটা এনেছিলাম। স্যারের কাছে যেসব বই আছে সেগুলি তো বটেই, লাইব্রেরি থেকেও যদি কোন বই লাগে – স্যার নিজে সেগুলি লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করে দিচ্ছেন। 

প্রামাণিকস্যারের বাসায় যাবার সময় ইউনিভার্সিটির দুই নম্বর গেটে নামলে কাছে হয়। আমাদের ইউনিভার্সিটির এলাকাটা যে কত বড় তা পুরো ক্যাম্পাস না ঘুরলে বোঝা যাবে না। স্যারের বাসা খেলার মাঠের ঐপাশে পাহাড়ের উপর। একতলা সুন্দর বাসা। বাসার সামনে বিশাল সাইজের একটা গোলাপ ফুটে আছে। যীশু এই ফুল দেখলে খুশি হয়ে যেতো। 

“বই এনেছো?”

আমাকে ভেতর থেকে দেখতে পেয়ে বের হয়ে এসেছেন শায়লা আপা। 

“জি। আপনার পরীক্ষা কেমন হলো?”

“পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করবে না। কোনদিন জিজ্ঞেস করবে না।“

“ঠিক আছে। আপনিও জিজ্ঞেস করবেন না। এই নেন আপনার বই।“

“থ্যাংক ইউ। এবার বিদায় হও।“

“স্যারের সাথে দেখা করবো না?”

“না, স্যার বাসায় নেই।“ 

ফিরে আসার সময় আলাওল হলের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম। থিসিসের কাজ শুরু করার পর প্রামাণিকস্যারের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানতে পারছি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমস্যার চেয়েও স্যারের কাছ থেকে জীবন-দর্শন ও নিয়মনিষ্ঠতার পাঠ অনেক বেশি আনন্দময় বলে মনে হচ্ছে। 

স্যার বলেন, “নিয়মনিষ্ঠতা আর নীতিবোধ কিন্তু এক জিনিস নয়। যে সব নিয়ম মেনে চলে তাকে নিয়মনিষ্ঠ বলতে পার। কিন্তু সে যে খুব নীতিবান হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন কোন কমিটিতে থাকেন, তখন মিটিং-এ উপস্থিত থাকার জন্য অনেক টাকা সম্মানী পান। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে অনেকগুলি কমিটি থাকে। প্রত্যেক টিচারই একাধিক কমিটির মেম্বার। প্রতি মাসে অনেকগুলি কমিটির অনেকগুলি মিটিং হয়। শুধুমাত্র মিটিং-এর সিটিং-মানিও কিন্তু অনেক। এগুলি সব বেতনের বাইরে। পরীক্ষার প্রশ্ন করার জন্য, খাতা কাটার জন্য, পরীক্ষায় ডিউটি করার জন্য, ভাইভা নেয়ার জন্য – আলাদা আলাদা সম্মানী আছে। এর সবকিছুই কিন্তু নিয়মের মধ্যে আছে। এখন প্রশ্ন হলো সব কাজের জন্য যদি আলাদা আলাদা সম্মানী দেয়া হয় – তাহলে নিয়মিত বেতন-ভাতা কী কারণে দেয়া হয়? এখানে অনিয়ম কেউ করছে না। কিন্তু নীতির প্রশ্ন যদি তোল, তাহলে অন্য কথা।” 

নীতির প্রশ্ন কোথায় তুলবো, কার কাছে তুলব? গতকাল অঞ্জনদার সাথে দেখা হয়েছিল ফ্যাকাল্টিতে। অঞ্জন কুমার চৌধুরি – আমাদের দু’ব্যাচ সিনিয়র। প্রামাণিকস্যারের কাছে থিসিস করেছেন। অনার্স মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছেন। বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়নি দুইটি কারণে - হিন্দু হওয়ার কারণে, এবং প্রামাণিকস্যারের কাছে থিসিস করার কারণে। 

পনেরো দিন ক্লাস হবার পর সায়েন্স ফ্যাকাল্টির গেটে আবার তালা পড়লো। সকালে ক্লাস করতে গিয়ে দেখলাম ফ্যাকাল্টির কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে গেট আগলে দাঁড়িয়ে আছেন – না, কোন ছাত্রসংগঠন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের নেতারা। ডীন নির্বাচন প্রতিহত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আমাদের পরিচিত শিক্ষকদের এই ভূমিকায় দেখে একটা প্রশ্নই মনে আসে - বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা কী সুনীতির শিক্ষা পাচ্ছি?

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>>>>>

<<<<<<< আগের পর্ব


চন্দ্রগ্রহণ – প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা

 



আজকের পূর্ণিমায় আংশিক চন্দ্রগ্রহণ ঘটবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই ঘটনার ভবিষ্যতবাণী করেছেন অনেক বছর আগে। মহাবিশ্ব প্রকৃতির যে নিয়ম মেনে চলে – সেই নিয়মের অনেক কিছুই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, এবং সেই নিয়মের ভিত্তিতেই তাঁরা জানেন কখন সূর্য, পৃথিবী আর চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে একই রেখায় চলে আসবে। সূর্যের আলো সরাসরি পৃথিবীর ওপর পড়ে। ফলে যেদিকে চাঁদ আছে সেদিকে পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক ছায়া পড়ে। যেহেতু সূর্য পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড় সেহেতু পৃথিবীর ছায়ার দু'পাশে অনেক বড় প্রচ্ছায়াও তৈরি হয়। পূর্ণিমার চাঁদ যখন পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে থাকে তখন উজ্জ্বল ধবধবে রূপালী চাঁদ লাল হয়ে যায়। চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে আলোর বিচ্ছুরণে এই লাল রঙ তৈরি হয়। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় পুরো চাঁদটিই পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে থাকে। তখন চাঁদ পৃথিবীর ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। তারপর চাঁদ আস্তে আস্তে সরে গিয়ে পৃথিবীর প্রচ্ছায়ায় যখন আসে তখন চাঁদ আস্তে আস্তে তার উজ্জ্বলতা ফিরে পেতে থাকে। এই ঘটনা প্রকৃতির খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত যেমন আমাদের পৃথিবী থেকে দেখা একটি স্বাভাবিক নিত্যদিনের ঘটনা, তেমনিই স্বাভাবিক ঘটনা চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি। 

এগুলি কীভাবে ঘটে সেই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানুষের হয়েছে কমপক্ষে দুই-তিন শ বছর আগে। এখনকার স্কুলের নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও জানে কীভাবে চন্দ্রগ্রহণ হয়, সূর্যগ্রহণ হয়। বিজ্ঞানের বই থেকে তারা এটাও জানে যে পৃথিবী থেকে প্রায় পনের কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সূর্য কিংবা তিন লক্ষ ৮৫ হাজার কিলোমিটার দূরের চাঁদ আমাদের শরীরের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এত কিছু জানার পরেও কিছু কিছু মানুষ এমন কিছু বিষয় এখনো বিশ্বাস করে যা আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হলেও – খুবই ক্ষতিকর কুসংস্কার। 

ধরা যাক বাংলাদেশ ও ভারতের কথা। এখানকার অনেকেই চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় খাওয়াদাওয়া করে না, ফ্রিজ খালি করে ফেলে, ঘরে রান্না করা কোন খাবার থাকলে তা ফেলে দেয় ইত্যাদি। কিন্তু তাদের অস্বাভাবিক বুদ্ধিতে এটা কিছুতেই ধরা পড়ে না যে সেই সময় যদি খাবার-দাবারের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে – তা পৃথিবীর সব খাবার-দাবারের উপর পড়বে। নিজের ফ্রিজ খালি করে – পরে দোকানের ফ্রিজের খাবার কিনে আনা তো একই ব্যাপার হলো। 

গ্রহণ চলাকালীন সবচেয়ে বেশি বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়া হয় সন্তানসম্ভবা নারীদের উপর। এই সময়ে তাদেরকে ঘুমাতে মানা করে অনেকে। ঘুমালে নাকি সন্তান অন্ধ হয়ে জন্মাবে। এই ঘটনা সত্য হলে পৃথিবীতে কোটি কোটি অন্ধ সন্তানের জন্ম হতো। এই সময় গর্ভবতী নারী যদি কিছু কাটে – তাহলে নাকি সন্তানের শরীরে কাটা দাগ দেখা দেয়। এইসব কথার কোন ভিত্তি নেই। 

মানুষের শরীরের উপর চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণের কোন প্রভাব নেই। চন্দ্রগ্রহণ খালি চোখেই দেখার মতো একটি সুন্দর প্রাকৃতিক ঘটনা। চাঁদ দেখতে ভালো লাগলে চাঁদে গ্রহণ লাগার দৃশ্য দেখতেও ভালো লাগবে। 


Wednesday 17 November 2021

ইউজিন বিগনার

 



বিজ্ঞানী ইউজিন বিগনার (Eugene Wigner) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের একজন। পদার্থবিজ্ঞানের অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আবিষ্কার ঘটেছে তাঁর হাত দিয়ে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিসাম্যতা বা সিমেট্রির তত্ত্ব তাঁর আবিষ্কার। ১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কারের পর পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতর যে নিউক্লিয়ার ফোর্স কাজ করে তার অনেক মৌলিক ধর্ম আবিষ্কার করেছেন ইউজিন বিগনার। নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রনের মধ্যে যে তড়িৎচুম্বকীয় বল কাজ করে তার তুলনায় নিউক্লিয়ার ফোর্স যে কোটি গুণ শক্তিশালী তা বিগনারের আবিষ্কার। আমরা জানি সমধর্মী চার্জ পরস্পর বিকর্ষণ করে। যেমন একটি ইলেকট্রন আরেকটি ইলেকট্রনকে বিকর্ষণ করে। কিন্তু বিগনার আবিষ্কার করলেন যে নিউক্লিয়াসের ভেতর এই ব্যাপারটা খাটে না। নিউক্লিয়ার ফোর্সের আওতায় প্রোটন কিংবা নিউট্রন প্রত্যেকে প্রত্যেককে আকর্ষণ করে। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার সার্বিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় বিগনারের হাতে। তিনি ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার। 

ইউজিন বিগনারের জন্ম ১৯০২ সালের ১৭ নভেম্বর হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা তিনি হাঙ্গেরিতেই করেছেন। ১৯২১ সালে বার্লিনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গবেষণা করেন। ১৯২৫ সালে তিনি ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কয়েক বছর তিনি ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণা করেছেন। 

১৯৩০ সালে তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকায় চলে যান। এদিকে ইউরোপে হিটলারের উত্থান ঘটলে ইহুদি হওয়ার কারণে ইউজিন বিগনারের হাঙ্গেরিতে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৩৭ সালে তিনি আমেরিকান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার পারমাণবিক বোমা প্রকল্পে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। মূলত তিনিই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লেখার জন্য আইনস্টাইন ও লিও শিলার্ডকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। 

তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের জন্য তিনি অসংখ্য পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৬৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৪৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদক, ১৯৫০ সালে ফ্রাঙ্কলিন মেডেল, ১৯৫৮ সালে এনরিকো ফার্মি পুরষ্কার, ১৯৫৯ সালে অ্যাটমস ফর পিস পুরষ্কার, ১৯৬১ সালে ম্যাক্স প্ল্যাংক মেডেল, ১৯৬৯ সালে ন্যাশনাল সায়েন্স মেডেল, ১৯৭২ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন পুরষ্কার পান তিনি। 

১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। 


Monday 15 November 2021

মঙ্গলে অধ্যবসায়


২০২০ সালে পৃথিবী্র মানুষ যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে জর্জরিত, স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবন যেখানে থমকে গিয়েছিল, সেই কঠিন সময়েও নাসার বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করে গেছেন মঙ্গল গ্রহের সাম্প্রতিক মিশন মার্স-২০২০ সফল করার লক্ষ্যে। তাঁদের পরিশ্রম বিফলে যায়নি। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই ফ্লোরিডার কেইপ ক্যানাভেরাল থেকে যথাসময়েই উৎক্ষিপ্ত হয় রকেট অ্যাটলাস ভি-৫৪১। এই রকেট পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে পৌঁছে দেয় বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট মার্স-২০২০। পৃথিবী থেকে  বের হয়ে সাড়ে ছয় মাস ধরে মহাকাশে ৪৭১ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ির আকারের বৈজ্ঞানিক রোবট পারসিভারেন্স – যাকে বাংলায় বলা যায় অধ্যবসায়। মহাকাশ গবেষণায় এই মঙ্গল অভিযান – অন্যান্য সবগুলি অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি উন্নত, এবং অনেক বেশি চমকপ্রদ। মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম একটি হেলিকপ্টার উড়বে – পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহের ভূমির উপর দিয়ে। মার্স-২০২০ মিশনে রোভার পারসিভারেন্সের সাথে গেছে একটি ছোট্ট হেলিকপ্টার – ইঞ্জেনুইটি। 

মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ হাজার বছরের পুরনো হলেও, তার প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে বৈজ্ঞানিক আগ্রহ এই শতাব্দীতে বেড়ে যাবার প্রধান কারণ – মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলি যেভাবে লাগামহীন অতিরঞ্জন করতে পারে, বিজ্ঞান তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সেরকম কিছুই করতে পারে না। তাই এইচ জি ওয়েল্‌স এর ‘দি ওয়র অব দি ওয়ার্ল্ডস’-এ মঙ্গল গ্রহের প্রাণিরা এসে পৃথিবী দখল করে নেবার কল্পনার মধ্যে শিহরণ থাকলেও তার কোন বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু কল্পকাহিনিগুলির প্রভাবে সাধারণ মানুষের আগ্রহ জন্মে পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য গ্রহগুলি সম্পর্কে। প্রথমে খালি চোখে, তারপর দূরবীণের সাহায্যে এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর থেকে একের পর এক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু জেনেছেন মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে। ১৯৬০ থেকে শুরু করে মার্স-২০২০ মিশনের আগপর্যন্ত ৪৮টি বৈজ্ঞানিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য জানার লক্ষ্যে। তার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল ১৭টি, আমেরিকার ছিল ২২টি। শুরুটা সোভিয়েত ইউনিয়নের থাকলেও ক্রমে ক্রমে সাফল্যের দিক থেকে আমেরিকার মঙ্গল মিশনগুলি অনেক বেশি এগিয়ে যায়। ১৯৬৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা যে ২২টি মঙ্গল অভিযান পরিচালনা করে তাদের মধ্যে ১৭টি মিশন সফল হয়। মঙ্গল গ্রহের ভূমি থেকে প্রথম ছবি আমরা পাই সেই ১৯৬৫ সালে ম্যারিনার-৪ স্যাটেলাইট থেকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মহাকাশের অভিযানগুলিও দ্রুত আধুনিক হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে পাঠানো মার্স গ্লোবার সার্ভেয়ার মঙ্গল গ্রহের পুরোটাই জরিপ করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা পেয়ে যান মঙ্গল গ্রহের ভূমির সম্পূর্ণ মানচিত্র। এর পরবর্তী বছরগুলিতে মঙ্গলের পিঠে নামানো হয় একের পর এক স্বয়ংক্রিয় রোবট এবং রোভার বা যান্ত্রিক গাড়ি। ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাইকিং-১ ও ভাইকিং-২ ছিল মঙ্গলের বুকে প্রথম ও দ্বিতীয় রোবট। ১৯৯৬ সালে নাসার পাঠানো সোজার্নার ছিল মঙ্গলের বুকে প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোভার। তারপর ২০০৩ সালে স্পিরিট ও অপরচুনিটি, এরপর ২০১২ সালে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে তখনপর্যন্ত সবচেয়ে আধুনিক রোভার কিওরিসিটি। কিওরিসিটি রোভার এখনো কাজ করছে মঙ্গলে। 

নাসার পাঠানো সাম্প্রতিক রোভার পারসিভারেন্স হলো মঙ্গলের বুকে তাদের পঞ্চম রোভার। প্রায় ২৪০ কোটি ডলার বা বিশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মার্স-২০২০ মিশন পরিচালনা করার উদ্দেশ্য কী? মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে অনেক তথ্য তো বিজ্ঞানীরা আগের মিশনগুলি থেকে জেনে গেছে। মঙ্গলের চারপাশে এখনো ঘুরছে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট – যেগুলি নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত ও ছবি পাঠাচ্ছে। রোভার কিওরিসিটি এখনো সক্রিয়ভাবে মঙ্গলের ভূমি থেকে তথ্য পাঠাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আরেকটি রোভার পাঠানোর দরকার কী ছিল? বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে অনবরত চালিয়ে যেতে হয়। পৃথিবী থেকে ২২ কোটি কিলোমিটার দূরের একটি গ্রহের সবকিছু পৃথিবীতে বসে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হলে ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হয় বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম। এপর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে তাতে আমরা নিশ্চিন্তভাবে জানি এই গ্রহের আয়তন পৃথিবীর অর্ধেক। মঙ্গলের ভূমি শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে কয়েক শ কোটি বছর আগে। এর মোট ভূমির ক্ষেত্রফল পৃথিবীর স্থলভাগের ক্ষেত্রফলের প্রায় সমান। মঙ্গলের ভর পৃথিবীর ভরের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ, মঙ্গলের অভিকর্ষজ ত্বরণের মান পৃথিবীর অভিকর্ষজ মানের তিন ভাগের এক ভাগের চেয়ে সামান্য বেশি। মঙ্গলের দিন পৃথিবীর দিনের চেয়ে প্রায় ৪০ মিনিট লম্বা, কিন্তু মঙ্গলের এক বছর হয় পৃথিবীর ৬৮৭ দিনে। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব খুব কম, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ঘনত্বের মাত্র একশ ভাগের এক ভাগ। মঙ্গল খুব ঠান্ডা একটি গ্রহ। দিনের বেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর রাতের ঠান্ডায় তাপমাত্রা মাইনাস ১২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। 

প্রত্যেকটি অভিযান থেকে পাওয়া তথ্য ও উপাত্ত একই কথা বলে এ ব্যাপারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিন্ত হতে পারেননি কিছু কিছু ব্যাপারে। যেমন, শুরুতে পৃথিবীর সমান বয়সী এই গ্রহের উপাদান এবং পরিবেশের মধ্যে মিল ছিল। সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে বাঁচানোর জন্য উভয় গ্রহেই চৌম্বকক্ষেত্র ছিল। উভয় গ্রহেই পানি এবং অন্যান্য অনুকুল পরিবেশ থাকলেও পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। তবে মঙ্গলেও কি ঘটেছিল? যদি ঘটে থাকে, তাহলে সেই প্রাণের উপাদানের ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কেন? মঙ্গলে শুকিয়ে যাওয়া নদী ও পানির প্রবাহের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। শুধুমাত্র পানি থাকলেই যে জৈবপ্রাণ থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু প্রাণের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় এমন রাসায়নিক উপাদানগুলি তো খুঁজে পাবার চেষ্টা করতে হবে। এর আগের রোভার কিওরিসিটি তো সেই কাজ করেছে। কিন্তু ফলাফলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ কিওরিসিটি রোভার মঙ্গলের যে উপাদান সংগ্রহ করেছে তা সেখানেই বিশ্লেষণ করে তথ্য ও উপাত্ত পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। এই উপাদানগুলিকে যদি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসা সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীর আরো আধুনিক পরীক্ষাগারে সেগুলিকে পরীক্ষা করে হয়তো আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। এটা করার জন্যই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর প্রকল্প মার্স-২০২০ চালানো হচ্ছে মঙ্গলে। পারসিভারেন্স রোভার মঙ্গলের উপদান তো পরীক্ষা করবেই, সাথে আরো অনেক উপাদান সংগ্রহ করে তা একটি নির্দিষ্ট জায়গায়  সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করবে। পরে অন্য কোন মিশন মঙ্গল থেকে সেই নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে। 

মার্স-২০২ মিশনটি সবচেয়ে উচ্চক্ষমতার এবং উচ্চাভিলাসী প্রকল্প। এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য প্রধানত চারটি: (১) প্রাচীন অণুজীবের সন্ধান করবে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কি না প্রমাণ করবে, (২) মঙ্গলের ভূতত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করবে, (৩) মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পর্যবেক্ষণ করবে, এবং (৪) ভবিষ্যতে মঙ্গলে মানুষের যাওয়ার পথ সুগম করবে। 

এই উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়ন করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছেন। ২০১২ থেকে এই মিশনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নাসার জেট প্রপালসান ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছে আধুনিক মঙ্গলযান পারসিভারেন্স রোভার। এই রোভার – গাড়ির আকারের একটি অত্যন্ত আধুনিক রোবট যা মঙ্গলের বুকে একটি স্বয়ংক্রিয় গবেষক ও গবেষণাগারের কাজ করবে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কাজগুলি করার জন্য প্রচন্ড অধ্যবসায়ের দরকার হয়। রোভারের কাজের সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয়েছে পারসিভারেন্স। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে নাসা তাদের বিভিন্ন মিশনের নাম দেয়ার জন্য স্কুল ছাত্রছাত্রীদেরকে আহ্বান করে। আটাশ হাজার নাম পাঠায় আমেরিকার বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা। সেখান থেকে আন্তর্জাতিকভাবে অনলাইনে ভোটের মাধ্যমে  ভার্জিনিয়ার লেক ব্রাডক স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র আলেকজান্ডার মাথিরের পাঠানো নাম ‘পারসিভারেন্স’ নির্বাচিত হয় মার্স-২০২০ মিশনের রোভারের নাম। 

স্বয়ংক্রিয় রোবট রোভার – পারসিভারেন্স এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি সফলভাবে সম্পন্ন করা যায়। পারসিভারেন্স রোভারটি ৩ মিটার লম্বা, ২.৭ মিটার চওড়া, এবং ২.২ মিটার উঁচু। পৃথিবীতে এর ওজন ১,০২৫ কেজি। এর সাথে সংযুক্ত আছে ২ মিটার লম্বা রোবটিক হাত যা প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুরতে পারে, ছবি তুলতে পারে, পাথর খুড়তে পারে, নমুনা সংগ্রহসহ অন্যান্য দরকারি সব কাজ করতে পারে। এই হাতের ওজন ৪৫ কেজি। মঙ্গলের অভিকর্ষ ত্বরণ যেহেতু পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের শতকরা ৩৮ ভাগ, মঙ্গলে রোভারের ওজন দাঁড়াবে প্রায় ৩৯০ কেজি। চলার জন্য রোভারটিতে লাগানো আছে ছয়টি ধাতব চাকা। শক্ত কিন্তু হালকা অ্যালিমিনিয়ামের তৈরি চাকাগুলি মঙ্গলের মরুভূমিতে চলার উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলি ধুলোবালির উপর দিয়ে যেমন যেতে পারবে, তেমনি পাথরের উপর দিয়েও চলতে পারবে। পাথর আর বালির ঘর্ষণে এই চাকার খুব একটা ক্ষতি হবে না। 

পারসিভারেন্স রোভার খুবই আধুনিক রোবট। এই রোবট ক্যামেরার সাহায্যে দেখতে পারে, মাইক্রোফোনের সাহায্যে শুনতে পারে, আর কম্পিউটারের সাহায্যে ভাবতে পারে। বেশ কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে। দুটি শক্তিশালী কম্পিউটার তার মস্তিষ্কের কাজ করে। দুটো কম্পিউটারই একই রকমের, দুটোই একই কাজ করে, তবে এক সাথে করে না। একটা যখন কাজ করে, তখন অন্যটা ব্যাক-আপ হিসেবে কাজ করে। রোভারে লাগানো ক্যামেরার মাধ্যমে যে ছবি তোলা হয়, তা বিশ্লেষণ করে রোভারটির কম্পিউটার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সামনে কী আছে, এবং কীভাবে তা অতিক্রম করতে হবে। যেমন মঙ্গলে নামার সময় ভূমি থেকে কত দূরে আছে তা হিসেব করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এই রোভার। নামার পরে কম্পিউটার নতুন একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে যা দিয়ে মঙ্গলের ভূমিতে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে নিজে নিজে। 

ছোটবড় সব মিলিয়ে ২৩টি ক্যামেরা ফিট করা আছে পারসিভারেন্সের গায়ে। এর মধ্যে ৯টি ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যামেরা, ৭টি ইডিএল অর্থাৎ এন্ট্রি-ডিসেন্ট-ল্যান্ডিং ক্যামেরা, এবং ৭টি সায়েন্স ক্যামেরা। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যামেরার সবগুলিই ২০ মেগাপিক্সেল রেজ্যুলেশনসম্পন্ন শক্তিশালী ক্যামেরা – যার মধ্যে ২টি নেভিগেশান ক্যামেরা লাগানো আছে রোভারের মাথায়। রোভারের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয় এদের দ্বারা। ৬টি হ্যাজক্যাম বা হ্যাজার্ড এভয়ডেন্স ক্যামেরার চারটি সামনে আর ২টি পেছনে লাগানো আছে। চলাচলের সময় পাথর বা অন্যকিছু সামনে বা পেছনে পড়লে তা এড়িয়ে চলায় সাহায্য করবে এই ক্যামেরাগুলি। 

মঙ্গলে নিরাপদে অবতরণ করা সবচেয়ে কঠিন এবং জটিল কাজ। পারসিভারেন্স অবতরণ করানো হয়েছে সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে। এই কাজে সাহায্য করেছে ৭টি ইডিএল ক্যামেরা। এর মধ্যে তিনটি ক্যামেরা প্যারাশুট আপলুক ক্যামেরা – যেগুলি নামার সময় প্যারাশুট নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে। ভূমির দিকে নেমে আসার সময় সামনে পেছনে এবং পাশে লাগানো ক্যামেরার সাহায্যে সঠিক অবতরণ সম্ভব হয়েছে। 

সাতটি সায়েন্স ক্যামেরার প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা কাজ আছে এবং তাদের গঠন এবং অবস্থানও সেরকম। রোভারের ডান দিকে এবং বাম দিকের মাথায় লাগানো আছে ২টি ২ মেগাপিক্সেল রেজ্যুলেশনসম্পন্ন মাস্টক্যাম-জেড বা জেডক্যাম। রোভারের মাথায় মাঝামাঝি জায়গায় লাগানো আছে ৪ মেগাপিক্সেলের সুপারক্যাম রিমোট মাইক্রো-ইমেজার বা আর-এম-আই। রোভারের রোবটিক হাতের মাথায় লাগানো আছে ২টি গোয়েন্দা ক্যামেরার সেট- শার্লক হোমসের নাম অনুসারে যাদের নাম দেয়া হয়েছে শার্লক। অবশ্য শার্লক (SHERLOC) -এর লম্বা বৈজ্ঞানিক নাম Scanning Habitable Environments with Raman & Luminescence for Organics & Chemicals. শার্লক থাকলে ওয়াটসনের নামও থাকতে হয়। শার্লক ক্যামেরার একটির নাম ওয়াটসন। ওয়াটসন (WATSON) এর লম্বা বৈজ্ঞানিক নাম Wide Angle Topographic Sensor for Operations and eNgineering. 

মঙ্গল গ্রহের শব্দ শোনা এবং ধারণ করার জন্য পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো হয়েছে দুটো মাইক্রোফোন। একটি মাইক্রোফোন রোভার নামার সময় মঙ্গলের শব্দ ধারণ করে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে এবং রোভার কাজ করার সময় কী ধরনের শব্দ হয় তা সংগ্রহ করবে। অন্য মাইক্রোফোনটি লাগানো আছে সায়েন্স ক্যামেরার সাথে। এটি লেজার দিয়ে পাথর ভাঙার সময় শব্দ ধারণ করবে। 

পৃথিবী থেকে ২২ কোটি কিলোমিটার দূরে সমস্ত জটিল যন্ত্রপাতিসহ অক্ষত অবস্থায় পারসিভারেন্স এবং হেলিকপ্টার ইঞ্জেনুইটিকে মঙ্গলের বুকে নিরাপদে নামাতে পারা মানেই  মিশনের প্রধান ধাপ সম্পন্ন হওয়া। পৃথিবী থেকে সোজা পথে মঙ্গলে পৌঁছে যাবার কোন উপায় নেই। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ, মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ, সূর্যের সাথে আকর্ষণ ইত্যাদি সব হিসেব করে মার্স-২০২০ এর গতিপথ নির্ধারণ করতে হয়েছে। ২০৩ দিন ধরে মহাকাশ ভ্রমণ করে ৪৭ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গলে পৌঁছেছে পারসিভারেন্স। শেষের ৪৫ দিন ধরে তার গতিপথ ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ করে তাকে নিতে হয়েছে মঙ্গলের সীমানায়। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সময় প্রচন্ড গতিশীল স্যাটেলাইটের সাথে বাতাসের ঘর্ষণের ফলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। সেই তাপ থেকে বাচানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইঞ্জেনুইটিসহ পারসিভারেন্স গুটানো অবস্থায় রাখা ছিল বেশ কয়েকটি স্তরের নিরাপদ ধাতব আস্তরণবিশিষ্ট বিশেষ ধরনের ক্যাপসুলের ভেতর। এই ক্যাপসুল বিশেষ ধাতুর সংকর দিয়ে তৈরি যা প্রচন্ড তাপেও গলে না এবং অত্যন্ত ঘাতসহ। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে প্রবেশের ১০ মিনিট আগে স্যাটেলাইটের যে অংশটি পারসিভারেন্সের ক্যাপসুলকে মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে সেই ক্রুজ স্টেজ আলাদা হয়ে মহাকাশে ভাসতে থাকে। ক্যাপসুল ঘন্টায় ১৫০০ কিলোমিটারের অধিক বেগে মঙ্গলের সীমানায় ঢুকে বায়ুমন্ডলের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি কমাবার ব্যবস্থা আছে ক্যাপসুলের নিচের তাপনিরোধক অংশ বা হিট শিল্ডে। চার মিনিটের মাথায় মঙ্গলের ভূমির ৯ থেকে ১৩ কিলোমিটার উপরে ক্যাপসুলের উপরের অংশে লাগানো প্যারাসুট খুলে যায়। এই ফলে ক্যাপসুলের গতি কমে আসে ঘন্টায় ৫৭৬ কিলোমিটারে। ভূমির ৭ থেকে ১১ কিলোমিটার উপরে থাকতে ক্যাপসুলের নিচের অংশ খুলে পড়ে যায়। তখন পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো ইডিএল ক্যামেরা এবং রাডার তরঙ্গ চালু হয়ে যায়। গতি আরো কমতে থাকে। রাডারের মাধ্যমে প্যারাসুটে লাগানো ক্যাপসুলের অংশসহ পারসিভারেন্স মঙ্গলের বুকে যেখানে নামার কথা সেই জায়টাটি খুঁজে বের করে। ভূমি থেকে চার কিলোমিটার উচ্চতায় প্যারাসুটসহ ক্যাপসুলের উপরের অংশ আলাদা হয়ে যায়। ইঞ্জেনুইটিসহ গুটানো পারসিভারেন্স তখন ভূমির দিকে নামতে থাকে। পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো থাকে স্কাই ক্রেইন। স্কাই ক্রেইন হলো অনেকটা বাস্তবের ক্রেইনের মতো যেটায় লাগানো থাকে নাইলনের শক্ত সুতা। এই সুতার সাহায্যে পারসিভারেন্স রোভারকে আস্তে আস্তে ভূমিতে নামিয়ে দেয় স্কাই ক্রেইন। স্কাই ক্রেইন ভেসে থাকার জন্য চারটি থ্রাস্টার ব্যবহার করা যায় যা প্রচন্ড বেগে নিচের দিকে ধোঁয়া বের করে, ফলে বিপরীতমুখি বলের প্রভাবে ভূমি থেকে প্রায় ২৫ ফুট উঁচুতে ক্রেইনটি ভাসতে থাকে। সেকেন্ডে ৭৫ সেন্টিমিটার গতিতে খুব আস্তে আস্তে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করার সময় পারসিভারেন্স রোভার তার ছয় চাকার উপর দাঁড়িয়ে যায়। তখন স্কাই ক্রেইন আলাদা হয়ে থ্রাস্টারের বিপরীত বেগে উড়ে চলে যায় অন্যদিকে। সেটার আর কোন কার্যকারিতা থাকে না। 

মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে ঢুকার পর থেকে ভূমিতে অবতরণ করা পর্যন্ত প্রায় সাত মিনিট সময় লাগে। এই সাত মিনিট সময়ের উপর নির্ভর করে পুরো মিশনের সাফল্য। কোন গন্ডগোল হলেই কিন্তু মিশন ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। নামার সময় কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে তা এড়িয়ে চলার ক্ষমতা ছিল রোভার পারসিভারেন্সের। এই রোভারটি এমন এক জায়গায় নেমেছে যেখান থেকে মার্স-২০২০ মিশনের মূল উদ্দেশ্য পূরণ করা সহজ হবে। পুরনো একটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বদ্বীপে নেমেছে এটা – যেখানে আছে ঢালু জায়গা, বালিয়াড়ি, আর বড় বড় পাথর। জায়গার নাম জেজিরো ক্রেটার যেটা মঙ্গল গ্রহের উত্তর গোলার্ধের একটা ৪৫ কিলোমিটার বিস্তৃত শুকিয়ে যাওয়া অববাহিকা। ৩৫০ কোটি বছর আগে এখানে নদী বয়ে যেতো। সেই নদী শুকিয়ে পলি জমে একটি বদ্বীপ তৈরি করেছে এখানে। পারসিভারেন্সের বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এখানে জৈবযৌগের কিছু উপাদান এবং প্রাণধারণের আরো কিছু চিহ্ন এখনো অবশিষ্ট আছে। 

মঙ্গলে ঠিকমতো নামতে পারলো কি না সেই তথ্য পৃথিবীতে নাসার নিয়ন্ত্রণকক্ষে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে মঙ্গলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান মার্স রেকনিসেন্স অরবিটার বা এম-আর-ও’র মাধ্যমে। মঙ্গলে নামার সময় পারসিভারেন্সের কম্পিউটার ডাটা পাঠিয়ে দিয়েছে এম-আর-ও’র নেটওয়ার্কে। সেখান থেকে পৃথিবীর ডিপ-স্পেস-নেটওয়ার্ক অ্যান্টেনায়। মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ডাটা আসতে প্রায় ১১ মিনিট ২২ সেকেন্ড সময় লাগে। ডাটা আসে আলোর গতিতে বেতারতরঙ্গের মাধ্যমে। 

মঙ্গলে নেমেই কাজ শুরু করে দিয়েছে পারসিভারেন্স। কাজ করার জন্য যে বৈদ্যুতিক শক্তি লাগে সেই শক্তির জোগান দেয়ার জন্য পারসিভারেন্সে আছে মাল্টি-মিশন রেডিও-আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর বা এম-এম-আর-টি-জি। এটা মূলত নিউক্লিয়ার ব্যাটারি। প্রায় ৫ কেজি তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম অক্সাইডের বিকিরণ থেকে দুটো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি চার্জ করা হচ্ছে অবিরাম। এই ব্যাটারি দুটির ওজন প্রায় ২৭ কিলোগ্রাম। প্রতিটি ব্যাটারির ক্ষমতা ৪৩ অ্যাম্পিয়ার-ঘন্টা। জ্বালানি ইউনিটটি লাগানো আছে রোভারের কেন্দ্রে। পুরো ইউনিটের ওজন প্রায় ৪৫ কেজি। কমপক্ষে ১৪ বছর অনবরত বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ করতে পারবে এই ইউনিট। ফলে রোভারকে সৌরশক্তির উপর নির্ভর করতে হবে না। মঙ্গলে প্রচন্ড ধুলিঝড় হয়, সেই ঝড়ে সৌরপ্যানেল ঢেকে যায়। তাই সৌরশক্তির উপর নির্ভর করা যায় না। 

পারসিভারেন্স মঙ্গলে নেমেই সংযুক্ত ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তুলে পাঠাতে শুরু করেছে। অবতরণ করার সময় শব্দ ধারণ করেও পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী – মঙ্গলে অবতরণের সময় থেকে পারসিভারেন্সের কার্যদিবস শুরু। মঙ্গলের দিনকে বলা হয় সোল। পারসিভারেন্স মঙ্গলের বুকে কমপক্ষে মঙ্গলের এক বছর বা পৃথিবীর ৬৮৭ দিন ধরে কাজ করবে, এবং কমপক্ষে ৩০টি নমুনা সংগ্রহ করে তার বিশ্লেষণ করে ডাটা পাঠাবে এবং নমুনাগুলি নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করে  সেখানে রেখে দেবে। পারসিভারেন্স নিয়ন্ত্রণ করবেন যেসব বিজ্ঞানীরা, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে তাদের ঘড়ি চলবে মঙ্গলের সময়ের সাথে মিলিয়ে। অর্থাৎ তাঁদের সময় আর পারসিভারেন্সের সময় হবে একই। (আগামী ৬৮৭ দিনে হবে তাদের এক বছর)। প্রথম ৯০ সোল ধরে বিজ্ঞানীরা পারসিভারেন্সের কার্যক্রম এবং যন্ত্রপাতির দিকে ক্রমাগত লক্ষ্য রাখবেন। প্রথম ৩০ সোলের মধ্যে পারসিভারেন্সের অ্যান্টেনা চালু হবে। নির্দিষ্ট পথে ৫ মিটার আসা-যাওয়া করবে। রোভারের কম্পিউটারের সফ্‌টওয়ার আপডেট করা হবে। সবকিছু ঠিকমতো কাজ করছে কি না পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হবার পর মূল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং ডাটা সংগ্রহ শুরু হবে। এরপর হেলিকপ্টার এঞ্জেনুইটিকে পারসিভারেন্সের গা থেকে খুলে হেলিপ্যাডে রাখা হবে এবং হেলিকপ্টারের কাজ শুরু হবে। 

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম পৃথিবীর কোন হেলিকপ্টার পৃথিবীর বাইরে অন্যকোন গ্রহের বায়ুমন্ডলে উড়বে। অবশ্য এই হেলিকপ্টারের আকার খুবই ছোট। মাত্র ১৮০০ গ্রাম ওজন তার, অনেকটা ড্রোনের মতো। মঙ্গলে এর ওজন হবে মাত্র ৬৮০ গ্রাম। 

এটা উড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে এধরনের হেলিকপ্টার উড়ানো যায় কি না। যদি যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এরকম আরো অনেক পাঠানো হবে ভিন্ন ভিন্ন কাজে। পারসিভারেন্স রোভারের পেটে এই হেলিকপ্টার লাগানো আছে। হেলিকপ্টারের জন্য একটি তিন মিটার দৈর্ঘ্য ও তিন  মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট হেলিপ্যাড গুটানো অবস্থায় আছে হেলিকপ্টারের সাথে। পারসিভারেন্স নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমতল জায়গায় গিয়ে এই হেলিপ্যাড বিছানোর ব্যবস্থা করবে। তারপর তার উপর হেলিকপ্টারটি রাখবে। হেলিকপ্টারের গায়ে দুটি ক্যামেরা লাগানো আছে। মঙ্গলের প্রচন্ড ঠান্ডায় হেলিকপ্টার নিজেকে গরম রাখার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করতে পারে কি না দেখা হবে প্রথম কাজ। তারপর হেলিকপ্টারের গায়ে লাগানো সোলার প্যানেল থেকে শক্তি উৎপন্ন করবে। যে কম্পিউটারের মাধ্যমে হেলিকপ্টার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সেটা ঠিকমতো ডাটা আদানপ্রদান করতে পারে কি না পরীক্ষা করা হবে। পাখা ঠিকমতো কাজ করে কি না সব দেখার পর নিজে নিজে উড়তে পারে কি না এবং হেলিপ্যাডে নামতে পারে কি না দেখা হবে। 

পারসিভারেন্স রোভার প্রধানত সাত ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করবে মঙ্গলের বুকে। প্রথমেই আসে পারসিভারেন্সের প্রধান বৈজ্ঞানিক চোখ – মাস্টক্যাম-জেড। এটার জুমিং পাওয়ার এতই বেশি যে প্রায় একশ মিটার দূর থেকে এটা ছোট্ট মাছিকেও পরিষ্কার দেখতে পায়। ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে ঘুরে এটা রঙিন ছবি এবং ভিডিও তুলতে পারে। মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনেক বেশি কার্যকর হবে এর সাহায্যে। 

পারসিভারেন্সের মাথায় এবং শরীরে লাগানো আছে কয়েকটি সেন্সর যেগুলিকে বলা হচ্ছে মার্স এনভায়রনমেন্টাল ডায়নামিক্স এনালাইজার বা মেডা। মঙ্গলের আবহাওয়ার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করবে এসব সেন্সর। আকাশের দিকে তাক করা স্কাইক্যাম পর্যবেক্ষণ করবে মঙ্গলের মেঘ। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক্সের কার্যক্ষমতায় কোন পরিবর্তন ঘটে কি না তা দেখা হবে এই পদ্ধতিতে। 

সম্পূর্ন নতুন ধরনের একটি পরীক্ষা করা হবে মঙ্গলে – যার নাম মক্সি (MOXIE – Mars Oxygen In-Situ Resource Utilization Experiment)। এই যন্ত্র ব্যবস্থা মঙ্গলের বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে অক্সিজেন তৈরি করবে। যদিও বর্তমানে পারসিভারেন্সের মক্সি প্রতিঘন্টায় মাত্র ১০ গ্রাম অক্সিজেন তৈরি করতে পারবে, এটা সফল হলে ভবিষ্যতে এভাবে আরো বড় মাত্রায় অক্সিজেন তৈরি করে রকেটের জ্বালানির সমস্যা মেটানো যাবে। নভোচারীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজেও লাগবে। 

এরপর আছে পিক্সল (PIXL – Planetary Instrument for X-ray Lithochemistry) – এটা পাথর ও অন্যান্য অংশ থেকে রাসায়নিক উপাদান জরিপ করবে। কী কী আছে দেখবে। বিজ্ঞানীরা এসব আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন মঙ্গলে প্রাণের উপাদান আছে কি না। এর আগে এরকম বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা যায়নি। পারসিভারেন্সের পিক্সল ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ২০টির বেশি রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করতে পারে একেবারে বালুকণার মতো ছোট জায়গা থেকেও। 

এরপর আছে রিমফ্যাক্স (RIMFAX – Radar Imager for Mars’ Subsurface Experiment) -  রাডার তরঙ্গ ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ ভূতাত্ত্বিক জরিপ করবে এই যন্ত্র। ভূমির উপাদানে যদি পানির কোন উপাদান থাকে তা শনাক্ত করতে পারবে এই যন্ত্র। 

পারসিভারেন্সের রোবটিক বাহুতে লাগানো আছে ক্যামেরা শারলক। শারলক হোমস এর মতো এই যন্ত্রের নাম শারলক (SHERLOC – Scanning Habitable Environments with Raman & Luminescence for Organics & Chemicals)। এর সাহায্যে পাথর বা যে কোন নমুনার উপর অতিবেগুনি লেজার প্রয়োগ করা হবে। রামন ইফেক্টের ফলে প্রতিফলিত লেজারের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে জানা যাবে সেই নমুনায় কী কী রাসায়নিক উপাদান আছে। শারলকের ক্যামেরা ওয়াটসন মাইক্রোস্কোপিক ছবি তুলবে। ফলে মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক গঠন বুঝার জন্য অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। 

এরপর আছে শক্তিশালী লেজার প্রয়োগ করার যন্ত্র সুপারক্যাম। সুপারক্যাম লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে পাথর ও রেগোলিথ ভেঙে বাষ্প করে ফেলবে। লেজার প্রয়োগে খুব ছোট জায়গায় তাপমাত্রা প্রায় ১০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে সেই বস্তুর সেই জায়গা বাষ্পিভূত হয়ে যাবে। তারপর সেই বাষ্প থেকে তাদের রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে পারবে। সুপারক্যাম ৭ মিটার দূর থেকে কোন বস্তুর রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে পারবে। এর সাথে একটি মাইক্রোফোন লাগানো আছে। লেজার প্রয়োগের ফলে বস্তু থেকে কী শব্দ উৎপন্ন হয়, সেই শব্দের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেও অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। 

মঙ্গলের ভূতত্ত্ব এবং জলবায়ু সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে পারসিভারেন্স। মঙ্গলের চারপাশে যে দুটি অরবিটার ঘুরছে – সেগুলি জেজিরো ক্রেটারের ৩২২ কিলোমিটার উপর থেকে ছবি তুলছে অনবরত। কিন্তু প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পেতে হলে আরো কাছ থেকে ছবি দরকার। পারসিভারেন্স সেই প্রয়োজন মেটাবে। আগের অভিযানগুলিতে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল তা পূরণ করবে এই পারসিভারেন্স। 

এপর্যন্ত চাঁদ ছাড়া অন্য সব জায়গায় যেসব অভিযান চালানো হয়েছে তার সবগুলিই একমুখী। অর্থাৎ শুধু যাওয়া, কোনটাই ফিরে আসা নয়। এবার পারসিভারেন্সের ডাটা থেকে আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে গিয়ে আবার ফিরে আসার মতো অভিযান চালানোর  পদক্ষেপ নেয়া হবে ভবিষ্যতে। এর আগে কিউরিসিটি রোভার মঙ্গলের মাটিতে গর্ত করে তার উপাদান বিশ্লেষণ করেছে। এবার পারসিভারেন্স রোবটিক বাহুতে লাগানো যন্ত্রের মাধ্যমে পাথর কাটবে ছোট ছোট চকের আকারে। তারপর সেগুলি রাখবে নমুনা টিউবে। টিউবগুলি রোভার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাবে। পরে সেগুলি পৃথিবীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে ভবিষ্যতের কোন অভিযানের সময়। পৃথিবীতে নিয়ে আসার পর সেই নমুনাগুলি পরীক্ষা করা হবে পৃথিবীর ল্যাবে। 

ভবিষ্যতে পৃথিবী থেকে চাঁদে আবার যাবে মানুষ। মংগলে যাবার ব্যবস্থাও হবে। পারসিভারেন্স  থেকে প্রাপ্ত তথ্য, উপাত্ত এবং যান্ত্রিক অভিজ্ঞতা সেই সুযোগ তৈরি করে দেবে। ল্যান্ডিং সিস্টেম – টেরেইন-রিলেটিভ ন্যাভিগেশানের মাধ্যমে পারসিভারেন্স জেজিরো ক্রেটারে নামতে পেরেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামতে পারবে বিভিন্ন রোভার বিভিন্ন গ্রহে কিংবা উপগ্রহে। এই পদ্ধতিতে ভবিষ্যতে কিছুটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে, কিছুটা রোবটের মাধ্যমে চাঁদে নামতে পারবে মানুষ।

পারসিভারেন্স নিজে নিজে চলতে পারবে মঙ্গলের পিঠে। পৃথিবী থেকে অনেক কম নিয়ন্ত্রণেই পারসিভারেন্স চলতে পারবে। উন্নত সেন্সর, কম্পিউটার আর এলগোরিদমের মাধ্যমে অনেক বেশি বিজ্ঞান জানা যাবে। পারসিভারেন্সের কম্পিউটারের জন্য যে এলগোরিদম লেখা হয়েছে তা সফলভাবে কাজ করলে ভবিষ্যতে আরো অনেকভাবে কাজে লাগানো যাবে এগুলি। এরকম রোভারের মাধ্যমে চাঁদে, মঙ্গলে এবং অন্যান্য গ্রহেও কাজ চালানো যাবে ভবিষ্যতে।

মার্স-২০২০ মিশনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য নাসা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বোর্ডিং পাস দিয়েছিল। প্রায় ১ কোটির বেশি মানুষ মঙ্গলের রোভারে যাওয়ার জন্য নাম সই করেছিলেন। তাদের সবার নাম সেখানে নিয়ে গেছে পারসিভারেন্স তিনটি সিলিকন চিপের মাধ্যমে। পারসিভারেন্সের গায়ে একটা প্লেটে মোর্স কোডে লেখা আছে explore as one’। 

করোনার সময় মঙ্গলে পারসিভারেন্স পাঠানো সহজ কথা ছিল না। সারাপৃথিবীর ডাক্তার নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীরা পারসিভারেন্স মঙ্গলে পাঠাতে পেরেছেন। ডাক্তারদের সম্মানে পারসিভারেন্সের সাথে মঙ্গল গ্রহে একটি আলাদা স্মারকপত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে সারাপৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবা, ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। মঙ্গলের সাম্প্রতিক অভিযান সম্পূর্ণ সফল হবে – আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতার উপর এই আস্থা রাখা যায়। 

তথ্যসূত্র: www.mars.nasa.gov, মঙ্গলে অভিযান – প্রদীপ দেব, প্রথমা, ২০২০, 

_____________
বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত

Sunday 14 November 2021

ডিজিটাল যুগ??

 

দেখিতেই পাইতেছেন ইহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করিবার নিমিত্তে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তি। যোগ্য প্রার্থীরা দরখাস্ত করিয়া নিয়ম মোতাবেক  যাহা যাহা করিতে হয় তাহা সম্পাদন করিয়া নিয়োগপত্র লাভ করিবেন। আমার জিজ্ঞাস্য সেইখানে নয়। আমার জিজ্ঞাস্য হইল - বাংলাদেশে বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতির সুবর্ণযুগ চলিতেছে বলিয়া বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হইতেছে - সেইখানে দরখাস্ত করিবার পদ্ধতি কী কারণে সেই আদিম যুগে থামিয়া রহিয়াছে? এই বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক দেখা যাইতেছে চাকরিপ্রার্থীকে প্রথমে কোন ব্যাংকে উপস্থিত হইয়া ৭৫০ টাকা মূল্যের পে-অর্ডার অথবা ব্যাক-ড্রাফ্‌ট সংগ্রহ করিতে হইবে। রেজিস্ট্রারের দপ্তরে উপস্থিত হইয়া নির্ধারিত ফরম সংগ্রহ করিতে হইবে। সেইখানে কী পরিমাণ অর্থমূল্য দিতে হইবে তাহা জানা নাই। তাহার পর দরখাস্ত পূরণ করিয়া তাহার আটটি কপি করিতে হইবে। দরখাস্তের সহিত পরীক্ষা পাসের সনদপত্র, প্রশংসাপত্র, নম্বরপত্র, অভিজ্ঞতার সনদপত্র যোগ করিতে হইবে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর এই চারটি পরীক্ষা পাসের চারটি করিয়া মোট ষোলটি সনদপত্র লাগিবে। এই ষোলটির প্রত্যেকটির আবার আটটি করিয়া কপি লাগিবে। তাহা হইলে মোট ১২৮টি পত্র তৈরি করিয়া সেইগুলিকে আবার সত্যায়িত করিতে হইবে। যিনি ১২৮টি কাগজে দস্তখত করিয়া সত্যায়িত করিবেন এবং সিলমোহর লাগাইবেন তাঁহাকে কীভাবে রাজি করাইবেন জানি না। ইহারপর এই বিশাল কাগজের বোঝা রেজিস্ট্রারের অফিসে পৌঁছাইতে হইবে। আমার জিজ্ঞাস্য হইল - আটকপি দরখাস্ত কী কারণে পাঠাইতে হইবে? অনলাইনে দরখাস্ত এবং সনদপত্র পাঠাইলে কি কর্তৃপক্ষ যত কপি খুশি দরখাস্ত ছাপাইয়া লইতে পারিত না? না কি কম্পিউটার ব্যবহার করিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আভিজাত্য লঙ্ঘিত হইবে??

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৪৬

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৪৬

ফিজিক্স অব লাইট বা আলোক সংক্রান্ত পদার্থবিজ্ঞান ঘাঁটতে গিয়ে  ‘জাস্ট নোটিশেবল ডিফারেন্স’ বা জেএনডি বলে একটা ব্যাপার জেনেছি। ব্যাপারটা হলো আলোর কারণে অনেক কিছুই বদলে যায়, কিন্তু সব পরিবর্তন আমাদের চোখে পড়ে না। পরিবর্তন চোখে পড়ার জন্য কিছু শর্ত মেনে চলে আমাদের চোখ, আমাদের স্নায়ু, আমাদের মস্তিষ্ক। 

হঠাৎ পরিবর্তন যেভাবে আমাদের চোখে লাগে, চোখের সামনে প্রতিদিন একটু একটু করে ঘটতে থাকা পরিবর্তন আমরা সেভাবে টের পাই না। গত পাঁচ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে এই ক্যাম্পাসের যা আমরা আলাদাভাবে খেয়াল করিনি। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে আমাদের লাইব্রেরির। চমৎকার ঝকঝকে নতুন গ্রন্থাগারভবন তৈরি হয়েছে। আগের অপরিসর ভবন থেকে নতুন সুপরিসর ভবনে এসে হাজার হাজার বই যেন নতুন করে আলোর মুখ দেখছে। যদিও আমরা এখনো লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি না, তবে লাইব্রেরিতে বসে পড়তে পারি যে কোনো বই। বইয়ের তাকগুলি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এখন বইয়ের তাক থেকে টেনে নিয়ে পড়তে পারি যে কোনো বই – আগের মতো স্লিপ দিয়ে অপেক্ষা করতে হয় না। লাইব্রেরির রেফারেন্স সেকশানে অসংখ্য বই। এতদিন এই বইগুলিকে কেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছিল জানি না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হলো উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানবৃদ্ধি আর নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি। মুক্তচিন্তার লালন ও অনুশীলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হতে পারে না। এই নতুন লাইব্রেরি নিশ্চয় আমাদের নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সহায়ক হবে। ইদানীং একটু সময় পেলেই লাইব্রেরিতে ঢুকে যাচ্ছি।

লাইব্রেরির ভেতরের হাজার হাজার বইয়ের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে লাইব্রেরির সামনের সিঁড়ি। মূল রাস্তা থেকে লাল ইটের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে পাহাড়ের উপর লাইব্রেরির প্রধান ফটকে। সেখানকার মোজায়েক করা প্রশস্ত সিঁড়িতে বসে আড্ডা দেয়া শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। লাইব্রেরির সিঁড়ি হয়ে উঠেছে অনেকের মিটিং-পয়েন্ট। এখানেই আজ অনামিকাদের সাথে দেখা হবার কথা। 

বাস থেকে নেমে রাস্তার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। লাইব্রেরির সিঁড়ি আজ জনশূন্য। সিঁড়ির মাঝামাঝি একটুখানি জায়গা রেখে বাকিটাতে মোটা মোটা নাইলনের দড়ি আর বিশ্রি বাঁশ বেঁধে নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে – “এখানে বসা নিষেধ।“ এসব কাদের কাজ তা আর বলে দিতে হবে না। ক্যাম্পাসে কে কোথায় বসবে – তাও ঠিক করে দেবে ছাত্রশিবির? 

অন্ধকারে থাকতে থাকতে অনেক পোকা অন্ধ হয়ে যায়। কয়েক প্রজন্ম পরে সেই প্রজাতির পোকা অন্ধ হয়েই জন্মায়। আমাদেরও অনেকটা সেই দশাই হয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরে রেলস্টেশনে গেলেই আমাদের বীরত্ব বেড়ে যায়। ট্রেনে সিটের জন্য আমরা মারামারি করি, বাসে হাফ-ভাড়া দেয়ার জন্য আমরা কন্ডাক্টরের উপর চড়াও হই – কিন্তু ক্যাম্পাসে আমরা শিবিরের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকি। আসলে গত পাঁচ বছরে আমরা সবাই কেঁচো হয়ে গিয়েছি। 

আশেপাশে তাকালাম। প্রদীপ নাথ আর সুশান্তের এখানে থাকার কথা। হলে থাকে বলে তারা আমার আগেই ক্যাম্পাসে আসে। লাইব্রেরির বারান্দায় উঠে এলাম। সেখানেও নেই তারা। 

চলে এলাম ডিপার্টমেন্টে। ক্লাসরুমের সামনে প্রদীপ নাথের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সুশান্ত আর তার বোন অনামিকা। প্রদীপ নাথের মাধ্যমে সুশান্তের সাথে আমাদের পরিচয় অনেকদিনের। আমাদের ব্যাচে অ্যাকাউন্টিং-এ পড়ে সুশান্ত, শাহজালালে থাকে। অনামিকা এবার ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে। অনামিকার আরো কয়েকজন বন্ধু - মুক্তি, প্রীতি, জিনাতের সাথেও পরিচয় হলো। তাদের ক্লাস এখনো নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং-এ হচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারের পর আর যাওয়া হয়নি সেই বিল্ডিং-এ। আমাদের পর আরো চার ব্যাচ ভর্তি হয়ে গেছে ডিপার্টমেন্টে!

সোবহানস্যারকে আসতে দেখে তাদের বিদায় দিয়ে ক্লাসে ঢুকলাম। সোবহানস্যারের পাঞ্জাবীর দৈর্ঘ্য ক্রমশ বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে অচিরেই তা ভূমি স্পর্শ করবে। ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের লজিক গেইট পড়াচ্ছেন তিনি। বিদেশী বই থেকে পড়ালে যা হয় – উদাহরণগুলি থাকে বিদেশী। এক্সক্লুসিভ অর গেইটের একটা উদাহরণে আছে ব্লন্ড আর ব্রুনেটের কথা। এগুলি কী বস্তু কোন ধারণাই নেই আমার। সোবহানস্যার ব্লন্ডের বাংলা বললেন ফর্সা মেয়ে, আর ব্রুনেট – কালো মেয়ে। হতেই পারে – ফর্সা মেয়ে আর কালো মেয়ের পছন্দের ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু স্যারের ব্যাখ্যায় বাধ সাধলো ফারুক। সে বলে উঠলো – ব্লন্ড মানে স্যার সোনালী চুলের মেয়ে, আর ব্রুনেট মানে লিপির মতো। 

আমার ধারণা ফারুকের জ্ঞানবোতলের ছিপি নেই। তাই তার জ্ঞান বিপজ্জনকভাবে বের হয়ে আসে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে। নইলে সে সোবহানস্যারের ভুল ধরতে যায়! আর এক সপ্তাহ পরেই সোবহানস্যার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হবেন এটা জানার পরেও ফারুক ব্লন্ড আর ব্রুনেট নিয়ে তর্ক করে! সোবহানস্যার ফারুকের কথায় একটুখানি হাসলেন। তারপর লজিক গেইটের লজিক অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। ফারুককে এর জন্য কী মুল্য দিতে হয় কে জানে। 

সেকেন্ড পিরিয়ডের পর আজ আর কোন ক্লাস হবে না। নিচের তলায় এক নম্বর গ্যালারিতে এখলাসউদ্দিনস্যারের স্মরণে অনুষ্ঠান আছে। এবার তিনদিন ব্যাপী ‘এখলাসউদ্দিন স্মারক বক্তৃতামালা’র বক্তা হচ্ছেন প্রামাণিকস্যার। সেকেন্ড পিরিয়ড ছিল নুরুল ইসলামস্যারের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। কিন্তু স্যার ক্লাস নিতে এলেন না। 

মিজান আর প্রেমাঙ্কর আমাকে ডেকে নিয়ে গেল সেমিনার-লাইব্রেরিতে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সেমিনার-লাইব্রেরিরও স্থানান্তর ঘটেছে। দোতলা থেকে সেমিনার-লাইব্রেরি উঠে এসেছে তিন তলায়। মোবাশ্বেরস্যারের অফিসের পাশেই এখন সেমিনার-লাইব্রেরি। আয়তনে আগের রুমের চেয়ে অনেক বড়। সেমিনার-লাইব্রেরিয়ান সুশীলদাকে আমি এখনো ভয় পাই। সেই ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে একবার সেমিনারে ঢোকার পর তিনি শীতলকন্ঠে বলেছিলেন “ফার্স্ট ইয়ারেই সেমিনারে ঢুকে পড়েছেন? ফাইনাল ইয়ারে উঠেন, তারপর আসবেন।“ তাঁর সেই আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পরও অনেক ভয়ে ভয়ে আমি সেমিনার-লাইব্রেরিতে ঢুকেছি। ক্রমে ক্রমে সেদিনের গাম্ভীর্যে ভরপুর সুশীল রুদ্র এখন আমাদের হাসিখুশি ‘সুশীলদা’ হয়ে গেছেন। 

প্রেমাঙ্কর আর মিজান সেমিনারের দেয়াল থেকে এখলাসউদ্দিন স্যারের ছবিটা খুলে গ্যালারিতে নিয়ে গেলো অনুষ্ঠান উপলক্ষে। আমি প্রামাণিকস্যারের সেমিনারের পোস্টার লিখতে বসলাম – ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন জায়গায় আর লাইব্রেরির সামনে লাগিয়ে দিয়ে আসতে হবে। ভাবছি – লাইব্রেরির সিঁড়িতে যেখানে ‘এখানে বসা নিষেধ’ নোটিশ টাঙানো হয়েছে – সেখানে গিয়ে লাগিয়ে দিয়ে আসবো। 

“সুশীলদা, আপনি তো এখলাসস্যারের সাথে কাজ করেছেন। স্যারের কথা মনে আছে আপনার?” 

“মনে আছে মানে? এখলাসস্যারের সাথে যার একবার পরিচয় হয়েছে সে কখনো স্যারকে ভুলবে না। স্যার খুবই ভালোমানুষ ছিলেন। আবার প্রচন্ড বদরাগী ছিলেন। একটুও অনিয়ম সহ্য করতেন না।“ 

সুশীলদার কাছ থেকে এখলাসস্যার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনলাম। এখলাসস্যারের কথা আমি প্রথম শুনেছিলাম চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় ফিজিক্সের মোজাম্মেল হকস্যারের কাছে। এখলাসস্যার নাকি ভাইভা নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে নিজে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রশ্নটি আবার জিজ্ঞেস করতেন। শিক্ষার্থী উত্তর দেয়ার পর বলতেন, “ভেরি গুড। এই তো তুমি পারো।“ এসব শুনে কেমন যেন রূপকথার মতো মনে হতো – এমন শিক্ষকও আছেন! কিন্তু আমরা উচ্চমাধ্যমিকে থাকতেই এখলাসস্যারের জীবনাবসান হয় ১৯৮৪ সালের ২০ আগস্ট। 

আমাদের ডিপার্টমেন্টকে নিজের হাতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষাঙ্গন হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন এখলাসস্যার। শুধু আমাদের ডিপার্টমেন্ট নয়, সায়েন্স ফ্যাকাল্টির বর্তমান ভবন তৈরি হয়েছে তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে। ফরেস্ট্রি এবং মেরিন সায়েন্স ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়েছে তাঁর চেষ্টায়। ক্যাম্পাসের নান্দনিকতার অনেকটুকুই তাঁর অবদান। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়েছে তাঁর উদ্যোগে। 

মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু আমাদের ডিপার্টমেন্ট শুধু নয়, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই ছিল মারাত্মক শোকের। আমাদের হামিদাবানুম্যাডাম ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন এখলাসস্যারের জন্যই। আমাদের ডিপার্টমেন্টের বর্তমান শিক্ষকদের অনেকেই এখলাসস্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। 

এখলাসস্যারের মৃত্যুদিবসে এখলাসস্যারের স্মরণে আলোচনাসভা এবং বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা হয় ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু এবছর আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয় অবরুদ্ধ থাকার কারণে এই অনুষ্ঠানটি সেসময় হতে পারেনি। তাই এবার সেপ্টেম্বরের নয় থেকে এগারো এই তিন দিনের বক্তৃতামালার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত প্রামাণিকস্যার বক্তৃতা দেবেন “রিলিজিয়াস অ্যান্ড সায়েন্টিফিক ভিউজ অব দ্য ইউনিভার্স” বিষয়ে। 

এরকম সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে পরপর তিনদিন বক্তৃতা দেয়ার দুঃসাহস প্রামাণিকস্যারের আছে দেখে মুগ্ধ হবার পাশাপাশি এক ধরনের উত্তেজনাও অনুভব করছি। 

দলবেঁধে পোস্টার লাগিয়ে এসে গ্যালারিতে ঢুকে মনে হলো পোস্টার লাগানোর কোন দরকার ছিল না। এমনিতেই গ্যালারি পূর্ণ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে জামাল নজরুল ইসলামস্যার মহাবিশ্বের প্রসারণ বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন এই গ্যালারিতে। এখনকার এক তৃতীয়াংশ মানুষও ছিল না সেদিন। তবে কি প্রামাণিকস্যার জামাল নজরুল ইসলামস্যারের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়? কিন্তু দর্শকদের চেহারা দেখে তা মনে হচ্ছে না। বেশিরভাগ দর্শকই অপরিচিত। মনে হচ্ছে সবাই এসেছে প্রামাণিকস্যারের বিজ্ঞানের হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করতে। 

প্রামাণিকস্যার বক্তৃতার শুরুতেই বলে দিলেন – তিনি যা বলবেন তার কোনটাই তার নিজের মতামত নয়। বিজ্ঞানের যা কিছু সবই বিজ্ঞানের জার্নাল বা বইতে প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মের যা বলবেন – সবই ধর্মের বইগুলিতে আছে। সবই তিনি সুনির্দিষ্ট রেফারেন্সসহ উল্লেখ করবেন। সুতরাং এখানে ব্যক্তিগত আক্রমণের কোন সুযোগ নেই। 

কিন্তু বক্তৃতা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল চিৎকার চেঁচামেচি। প্রামাণিকস্যারকে বক্তৃতার মাঝেই প্রশ্ন করতে শুরু করলেন উপস্থিত শিক্ষকদের অনেকে। বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে রশীদুন্নবীস্যার অনুষ্ঠানের সভাপতি। তিনি সভায় শৃঙ্খলা বজায় রাখার দিকে কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। 

প্রামাণিকস্যার যখন ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন কেন ছয় দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সম্ভব নয় – আমাদের নুরুল ইসলামস্যার বলে উঠলেন এখানে এক দিন মানে ২৪ ঘন্টা নয়, এখানে দিন মানে অনেক লম্বা সময় – যা এক হাজার বছরও হতে পারে। এরকম যুক্তিও দেয়া যায়! প্রচন্ড হট্টগোলের মধ্যে প্রথম দিনের বক্তৃতা শেষ হলো। আরো দুই দিন বাকি। 

পরের দিন রশীদুন্নবীস্যার গ্যালারিতে এলেন না। শিক্ষকরা কয়েকভাগে ভাগ হয়ে গেলেন। বেশিরভাগই প্রামাণিকস্যারের বিপক্ষে। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম – গ্যালারিতে একজন ছাত্রীও নেই। আগেরদিন বেশি না হলেও কয়েকজন ছাত্রী উপস্থিত ছিল। তারা কি ভয় পেয়ে এলো না, নাকি এসবের প্রতি কোন আগ্রহই নেই কারো? শিবিরের ক্যাডাররা গ্যালারির বিভিন্ন জায়গায় দলবদ্ধ হয়ে বসেছে। কয়েকটি চেনামুখের সাথে চোখাচোখি হলো আমার। তাদের মধ্যে একজন আমার মেসেই থাকে। 

নির্দিষ্ট সময়ে বক্তৃতা শুরু করলেন প্রামাণিকস্যার। মিনিট দুয়েক পরেই শুরু হয়ে গেল হৈচৈ। গ্যালারির মাঝখান থেকে একজন প্রবীণ অধ্যাপক দাঁড়িয়ে উর্দূতে বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। প্রামাণিকস্যারের স্নায়ু কী দিয়ে তৈরি জানি না। তিনি একটুও না রেগে, উত্তেজিত না হয়ে একটার পর একটা স্লাইড দেখিয়ে তাঁর যুক্তি দিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু গ্যালারিতে উপস্থিত জামায়াতে ইসলামের সমর্থক শিক্ষক ও তাদের সাথে আসা শিবিরের ক্যাডাররা কোন ধরনের শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে চিৎকার করতে লাগলো। 

সময় শেষ হয়ে গেল। এটুকু জানা হলো যে এখলাসস্যারের গড়া আমাদের ডিপার্টমেন্টে বর্তমানে প্রগতিশীল শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম। 

পরদিন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে দেখি যে পোস্টারগুলি লাগিয়েছিলাম সেগুলি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির গেটের কাছে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের নোটিশবোর্ডে – কোথাও কোন চিহ্ন রাখেনি। সব তুলে ফেলেছে। 

ফার্স্ট পিরিয়ডে প্রামাণিকস্যারের ক্লাস। তিনি ক্লাসে এসে বললেন, “কাল রাতে আমার বাসায় ফোন করে আমাকে প্রাণে মারার হুমকি দিয়েছে ছাত্রদের কেউ। আমার হাত কেটে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। টেলিফোনে হুমকি দেয়ার দরকার ছিল না। ইচ্ছে করলে আমি বোর্ডে লেখার সময়ও কেউ এসে আমার হাত কেটে ফেলতে পারো। যুক্তি খন্ডন করা – মানে যুক্তি কাটতে না পারলে আর কী করবে! আমার আজকের বক্তৃতা হচ্ছে না। আমি ভয় পেয়ে বন্ধ করে দিইনি। তোমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান নিজের ক্ষমতাবলে তা বন্ধ করে দিয়েছেন।“ 

এরপর যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতে শুরু করলেন প্রামাণিকস্যার। 

সমরেশ মজুমদার কালবেলা উপন্যাসে লিখেছেন – আমাদের দেশে তিন শ্রেণির মানুষ খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকে। এক – যাদের প্রচুর টাকা আছে, যা ইচ্ছে প্রয়োজনে কিনে নিতে পারে। দুই – যারা শিক্ষিত এবং শিক্ষাটাকে বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহার করে সমাজে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। তিন – মাস্তানরা – যারা যেকোনো জায়গায় যেতে পারে, যাদেরকে অনেকেই পোষণ করে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকাওয়ালাদের খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু আর দুই শ্রেণির মানুষকে খুব দেখা যায়। শিক্ষাকে ধূর্তের মতো কাজে লাগিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অধিকার করেছেন – তাদের কয়েকজনকে তো গত দু’দিনে চোখের সামনেই দেখলাম। আর তাদের পোষা মাস্তানদেরও দেখলাম। এই মাস্তানরা এখন জামায়াত-শিবিরের দখলে। ক্ষমতার পালাবদল হলে অন্য কোনো দলের দখলে যাবে। মাস্তানদের সবাই পোষণ করে, কাজে লাগায়। 

কিন্তু এর বাইরেও প্রামাণিকস্যারের মতো একজন দু’জন থাকেন, যাঁরা প্রচন্ড বৈরি পরিবেশেও মাথা উঁচু করে থাকতে পারেন। এরা আরামে থাকেন না, কিন্তু আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকেন। মনস্থির করে ফেললাম - প্রামাণিকস্যারের কাছেই আমি থিসিস করবো। 

Wednesday 10 November 2021

রায়চৌধুরী সমীকরণ

 



বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞানী ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আর গত শতাব্দীর শেষের দশক থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর দুই দশক জুড়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আছে যে বিজ্ঞানীর নাম – তিনি স্টিফেন হকিং। আইনস্টাইন কিংবা হকিং-এর মূল বৈজ্ঞানিক অবদান সম্পর্কে পরিষ্কার কোন ধারণা বিজ্ঞান জগতের বাইরের অনেকের নাও থাকতে পারে, কিন্তু মহাবিশ্বের রহস্য সন্ধানে এই দুই বিজ্ঞানীর অবদান সম্পর্কে অনেক কিছুই তাঁরা জানেন প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে। স্টিফেন হকিং-এর মতো এত প্রচার আর কোন বিজ্ঞানী এখনো পাননি। স্টিফেন হকিং জটিল গাণিতিক সমীকরণের মাস্টার-মেকার বা ওস্তাদ লোক ছিলেন। মহাবিশ্বের সূক্ষ্ম রহস্য তিনি উন্মোচন করেছেন জটিল সব গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি সাধারণ পাঠকের জন্য অনেকগুলি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বই লিখেছেন যেগুলিতে ধরতে গেলে কোন গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করেননি। তাঁর নিজের গবেষণার ভিত্তি গড়ে উঠেছে যেসব মৌলিক সমীকরণের উপর – তাদের একটা তালিকা যদি তিনি দিতেন, সেখানে প্রথমদিকেই থাকতো রায়চৌধুরি সমীকরণের কথা। এই সমীকরণটি যিনি তৈরি করেছেন, সেই বিজ্ঞানী অমলকুমার রায়চৌধুরিকে ধরতে গেলে প্রায় কেউই চিনতো না। আজ তাঁকে যাঁরা চেনেন, তাঁরাও চেনেন মূলত স্টিফেন হকিং-এর কারণে। অধ্যাপক  অমলকুমার রায়চৌধুরির সমীকরণকে  ‘রায়চৌধুরি সমীকরণ’ হিসেবে প্রথম উল্লেখ করেছিলেন স্টিফেন হকিং তাঁর নিজের পিএইচডি থিসিস লেখার সময়। তারপর থেকে মহাবিশ্বের রহস্য সন্ধানের তাত্ত্বিক গবেষণায় রায়চৌধুরি সমীকরণ ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। এই সমীকরণকে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির একটি প্রধান প্রায়োগিক সমীকরণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব সম্পর্কে এত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা যিনি করেছেন, কে তিনি? কে এই অমলকুমার রায়চৌধুরি? 

অমলকুমার রায়চৌধুরি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের বরিশালে। তাঁর বাবা সুরেশচন্দ্র রায়চৌধুরি ছিলেন কলকাতার এক স্কুলের গণিতের শিক্ষক। অমলের লেখাপড়া কলকাতাতেই। ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল তার। গণিতের জটিল সমস্যার সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সমাধান করে ভীষণ আনন্দ পেতেন অমলকুমার। ১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করার পর গণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর বাবার তাতে ভীষণ আপত্তি ছিল। গণিতে প্রথম শ্রেণির এমএসসি হয়েও তাঁকে স্কুল-মাস্টারি করে কোন রকমে সংসার চালাতে হচ্ছিল। তাই তিনি চাননি তাঁর ছেলেকেও একই ধরনের অভাব-অনটনের ভেতর দিয়ে যেতে হোক। গণিতের সবচেয়ে কাছের সাবজেক্ট ফিজিক্স। অমলকুমার ফিজিক্সে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স তখন অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত। স্যার সিভি রামন ওখান থেকে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩০ সালে। পরীক্ষণ-পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় খুব নামডাক তখন এই অ্যাসোসিয়েশানের। এমএসসি পাস করার পর এখানে রিসার্চ ফেলোশিপ পেলেন অমলকুমার রায়চৌধুরি। এক্স-রে কৃস্টালোগ্রাফির ল্যাবে কাজ শুরু করলেন তিনি। পরবর্তী চার বছর ধরে তিনি অনেক চেষ্টা করেও পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে তেমন কোন অগ্রগতি দেখাতে পারলেন না। পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে তিনি কোন আগ্রহই পেলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন – ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেন তিনি। এক্স-রে ফিজিক্স ছাড়া অন্য ফিজিক্স বলতে তখন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। মেঘনাদ সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স চালু করেছেন। কিন্তু মাস্টার্সে পড়ার সময় তিনি দেখেছেন মেঘনাদ সাহা ছাত্রদের সাথে সহজ ব্যবহার করেন না, কথায় কথায় ধমক দেন। অমলকুমার মেঘনাদ সাহার কাছে যেতে চান না। অ্যাসোসিয়েশানের ফেলোশিপ শেষ হবার পর  ১৯৪৯ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আশুতোষ কলেজে। শিক্ষক হিসেবে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ছাত্রদের খুব প্রিয় হয়ে উঠলেন। কিন্তু শুধুমাত্র ক্লাসরুমে পড়িয়ে একাডেমিক জগতে উন্নতি করা যায় না – তা অমলকুমার জানেন। তিনি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করতে চাইলেন। গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর দক্ষতা আছে। তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিতের অধ্যাপক এন আর সেন তখন রিলেটিভিটি রিসার্চ গ্রুপ তৈরি করেছেন। অমলকুমার সেখানে যোগ দিলেন। গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো তাঁর। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলো ফিজিক্যাল রিভিউতে ১৯৫১ সালে। আশুতোষ কলেজে ক্লাসরুমে পড়ানোর চাপ অনেক বেশি। সারাদিন ক্লাস নিয়ে, পরের দিনের ক্লাসের জন্য রেডি হতে হতে গবেষণার জন্য তেমন কোন সময় থাকে না। তাঁর জন্য গবেষণা-প্রধান চাকরি হলে সুবিধা হয়। 

১৯৫২ সালে তিনি আরেকটি ফেলোশিপের জন্য দরখাস্ত করলেন অ্যাসোসিয়েশানে। ১৯৫২ সালে গবেষণা শুরু করলেন সেখানে। এবার অনেকটা নিজে নিজে গবেষণা শুরু করতে হলো তাঁকে। কারণ তখন তাঁর প্রফেসররা সবাই পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে কাজ করছেন। সত্যেন বসু তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইনস্টাইনের সাথে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে সত্যেন বসু খ্যাতিমান হয়েছেন অনেক বছর হয়ে গেলো। এরপর বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন সত্যেন বসু, কিন্তু তাঁর বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে নিজে খুব বেশি কাজ করেননি। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির প্রয়োগে মহাবিশ্বের স্ফীতি সম্পর্কে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন জাগছে অমলকুমারের মনে। তিনি সে সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য গেলেন সত্যেন বসুর কাছে। কিন্তু সত্যেন বসু খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। ভীষণ দমে গিয়েছিলেন অমলকুমার। নিজে নিজে গবেষণা করে তিনি লিখে ফেললেন তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাপত্র – ‘কনডেনসেশান্স ইন এক্সপান্ডিং কসমোলজিক্যাল মডেলস’। ১৯৫২ সালে তা প্রকাশিত হলো আমেরিকার ফিজিক্যাল রিভিউতে। 

মহাবিশ্বের গঠন এবং স্ফীতি সংক্রান্ত গবেষণার ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছিল ১৯৩০এর দশকে স্যার এডিংটনের নেতৃত্বে। কিন্তু পরের দুই দশকে সেই উৎসাহে বেশ ভাটা পড়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সবার উৎসাহ চলে গিয়েছিল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের দিকে। ১৯৫০-এর দশকে অমলকুমার রায়চৌধুরি যখন আপেক্ষিকতার তত্ত্বে নতুন গবেষণা শুরু করেছিলেন, তখন সেই ক্ষেত্রটা খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। সেই অর্থে অমলকুমার জনপ্রিয় পথে অগ্রসর হননি। আইনস্টাইনের রিলেটিভিস্টিক ফিল্ড ইকুয়েশান বা ক্ষেত্র-সমীকরণের সমাধান দিয়েছিলেন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্তশিল্ড। সোয়ার্তশিল্ডের সমাধান থেকে সিঙ্গুলারিটি এবং ইভেন্ট হরাইজন না ঘটনা-দিগন্তের হিসেব করা সম্ভব হয়েছে। মহাকর্ষ বলের টানে নক্ষত্রগুলির সংকুচিত হয়ে ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবার সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্ব তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৩ সালে অমলকুমার রায়চৌধুরি যখন সিঙ্গুলারিটি বিষয়ে তাঁর আরেকটি গবেষণাপত্র  ‘আরবিট্রেরি কনসেন্ট্রেশান্স অব ম্যাটার অ্যান্ড দি সোয়ার্তশিল্ড সিঙ্গুলারিটি’ প্রকাশ করেন, স্টিফেন হকিং-এর বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। সোয়ার্তশিল্ড দেখিয়েছিলেন কীভাবে সিঙ্গুলারিটি অর্জিত হবে। আর অমল রায়চৌধুরি দেখিয়েছেন কী কী শর্তে সিঙ্গুলারিটি এড়িয়ে চলা যাবে, এবং এই ঘটনাটাই প্রকৃতিতে বেশি ঘটছে। 

১৯৫৫ সালে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় অমল রায়চৌধুরির সবচেয়ে বিখ্যাত গবেষণাপত্র ‘রিলেটিভিস্টিক কসমোলজি’। এখানেই প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ যেটাকে স্টিফেন হকিং ও জর্জ এলিস ‘রায়চৌধুরি সমীকরণ’ নামে সর্বপ্রথম উল্লেখ করেছিলেন তাঁদের গবেষণাপত্রে ১৯৬৫ সালে। কী ছিল অমলরায় চৌধুরীর সেই গবেষণাপত্রে? রায়চৌধুরি সমীকরণটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? 

আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে জানা যায় মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারণ সম্পূর্ণরূপে বুঝতে হলে আমাদের সঠিকভাবে বুঝতে হবে মহাবিশ্বের গঠন। তত্ত্বীয় সুবিধার জন্য আমরা ধরে নিই মহাবিশ্ব জ্যামিতিকভাবে সুষম গোলকাকার। ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে – সেখানেও আইনস্টাইনের সমীকরণের সোয়ার্তশিল্ড সমাধানের একটি পর্যায়ে ধরে নিচ্ছি এর স্ফীতিও সুষম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি মহাবিশ্ব ঘূর্ণায়মান হয়, তাহলে স্ফীতির কী অবস্থা হবে? স্ফীতি যদি সুষম না হয়, তাহলে কী অবস্থা হবে? সিঙ্গুলারিটি পাবার ক্ষেত্রে সময়ের পরিমাণ কি নির্দিষ্ট, নাকি অসীম? এই প্রশ্নগুলির গুরুত্ব সীমাহীন। অমল রায়চৌধুরী আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের অন্যরকম সমাধান দিয়েছেন যে সমীকরণের মাধ্যমে সেটাই ‘রায়চৌধুরি সমীকরণ’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে। সেই সমীকরণে মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থের উপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব হিসেব করা হয়েছে। মহাকর্ষ বল নির্দেশক রাশির সাথে একটি ঋণাত্মক চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে সিঙ্গুলারিটির পথে এর গন্তব্য। অর্থাৎ পারস্পরিক আকর্ষণে সবকিছু একবিন্দুতে মিলেমিশে যেতে চায়। কিন্তু অন্যান্য অনুষঙ্গের কারণে তা বাস্তবে হচ্ছে না। সমীকরণের আরেকটি ধনাত্মক রাশি মহাবিশ্বের স্পিন বা ঘূর্ণন নির্দেশ করছে। এই ঘূর্ণন মহাবিশ্বের সিঙ্গুলারিটি অর্জনের পথে বাধা দিচ্ছে। আরেকটি রাশি মহাবিশ্বের বিকৃতির পরিমাণ নির্দেশ করছে। এই বিকৃতি ঘটে মূলত অনেকগুলি ঘটনার সম্ভাবনার উপর। সার্বিকভাবে রায়চৌধুরি সমীকরণ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে মহাবিশ্বের স্ফীতির সম্ভাবনার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, এবং তা আছে বলেই মহাবিশ্বের স্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এই সমীকরণের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরা পরবর্তীতে পেয়েছি স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজের সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব এবং ব্ল্যাকহোলের আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান। 

অমল রায়চৌধুরি নিজের গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন কোন সুপারভাইজার ছাড়াই। ১৯৬১ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে অবসর গ্রহণ করার পর আরো দু’বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাম্মানিক ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন। সারাজীবন ধরে নিজের মতো করে গবেষণা করে গেছেন। ২০০৪ সালে তাঁর শেষ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ২০০৫ সালের ১৮ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

জীবদ্দশায় অমলকুমার রায়চৌধুরিকে নিয়ে খুব একটা চর্চা হয়নি। তবে ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত গবেষণা এবং অন্যান্য তথ্যের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকার ফলে রায়চৌধুরি সমীকরণের এখন নানাবিধ প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে ব্ল্যাকহোলের তত্ত্বের জন্য রজার পেনরোজ নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর রায়চৌধুরি সমীকরণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখা – বিশেষ করে ফ্লুইড ডায়নামিক্স এবং ইলেকট্রোডায়নামিক্সে রায়চৌধুরি সমীকরণের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে।  

_____________________
বিজ্ঞানচিন্তা ফেব্রুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত






Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts