Showing posts with label নারী. Show all posts
Showing posts with label নারী. Show all posts

Saturday, 8 March 2025

বিশ্ব নারী দিবস ২০২৫

 




এবছরও ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০২৫ সালের নারী দিবসের মূল স্লোগান – For All women and girls: Rights, Equality and Empowerment. সকল নারীর জন্য অধিকার, সমতা এবং ক্ষমতায়ন।

যতই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থাকুক না কেন,  নারীর সম্মান এবং নারীর অধিকার দুটো ভিন্ন বিষয়। পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই নারীদের সম্মান দেয়া একটি লোকদেখানো ব্যাপার। উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নারীর সম্মান রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে নারীর অধিকার হরণ করে নেয়া হয়। “আপনার সম্মান বজায় রাখার জন্যই আপনার উচিত হবে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলা”, “ঐ কমিটিতে আপনি থাকলে আপনার মানসম্মান থাকবে না”, “নারী যদি প্রকাশ্যে ধুমপান কিংবা চা-পান করে তাহলে তো নারীর সম্মান থাকে না” – এরকম আপাতসুশীল অজুহাতের কোন অভাব নেই প্রবল পুরুষালি মনোবৈকল্যে আক্রান্ত সমাজে। এগুলির সাথে আমরা আজন্ম এতটাই পরিচিত যে এর কোন ব্যতিক্রম হলেই বরং আমাদের – নারী পুরুষ উভয়েরই - অস্বস্তি লাগে।

তো আন্তর্জাতিক নারী দিবস যে ঘটা করে ঘন্টার পর ঘন্টা বকর বকর করে পালন করা হয় – তার মূল হেতু কী? হেতুর সেতু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বছর বছর লম্বা হয়, কিন্তু তাতে পৃথিবীর সকল নারীর অধিকার ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আমাদের বিশাল উপচে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক (৪৯%) নারী। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের স্বাভাবিক ফল প্রয়োগ করে বাংলাদেশের জনগণের সামগ্রিকভাবে বেঁচে থাকার গড় আয়ু বেড়েছে, গড় আয়ও কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র নারী হবার কারণে তাদের মানবিক নাগরিক রাষ্ট্রিক অধিকারগুলির সূচক থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছে।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলাদাভাবে আমাদের নারীগোষ্ঠীর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নারীরা পুরুষের সমান বেতন মজুরি পাবার দাবিতে এবং ভোটের অধিকার পাবার দাবিতে একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে এখনকার আমেরিকানরা লজ্জা পাবেন কি না জানি না, তবে সত্য এই – যে আমেরিকা ব্রিটিশদের চেয়ে ভালো সভ্য হবার দাবিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই, সংবিধান রচনা করেছে ১৭৮৭ সালে, সংবিধান অনুসারে দেশ চালানো শুরু করেছে ১৭৮৯ সাল থেকে – সেই  স্বাধীন আমেরিকায় ১৪৪ বছর ধরে নারীদের কোন ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। সেখানে নারীর সম্মান ছিল না – সেটা বলা যাবে না, কিন্তু তাদের মূল নাগরিক অধিকার – ভোট – সেটা প্রয়োগ করার অধিকার ছিল না। সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী এনে ১৯২০ সালে আমেরিকান নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। এর অনেক আগেই পৃথিবীর অনেক দেশের নারীরা ভোটাধিকার পেয়ে গিয়েছিলেন।

প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়েছিল ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ ইওরোপের অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে। নারীদিবস পালনের দাবি জোরদার হয় মূলত সোভিয়েত বিপ্লবের সময় সোভিয়েত নারীদের মাধ্যমে। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ রাশিয়ার নারীরা “রুটি ও শান্তি”র দাবিতে জোর আন্দোলন করেছিলেন। ১৯২১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষণা করে। তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী দিবস পালিত হয়েছে। তবে ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে প্রতিবছর নারীর অধিকার উন্নয়নের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করা হয়। এই সূচকগুলিকে আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলির উন্নয়নের সূচকে সংখ্যাগত উন্নয়নের চিহ্ন দেখে আমোদিত হবারও কিছু নেই। কারণ এগুলি সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয় সরকারের তোষামোদকারি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমেই।

তাহলে নারীর অধিকারের উন্নয়ন হয়েছে কি না কীভাবে বুঝবো? আপনি যে দেশে থাকেন, আপনি যদি নারী হন, নিজের অধিকার কেমন আছে আপনার পুরুষ সহ-নাগরিকের তুলনায় – তা দেখেই আপনি বুঝবেন। আপনি যদি পুরুষ হোন, তাহলে আপনি  কোন্‌ দেশের ক্ষেত্রে আপনার মা-বোন-স্ত্রী-কন্যাসহ নারী আত্মীয়দের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেমন উৎকন্ঠা অনুভব করেন – সেটা দিয়েই আপনি বুঝতে পারবেন সেই দেশের নারীদের কী অবস্থা। আপনার স্ত্রী, আপনার বোন, আপনার কন্যা কী পরে বাইরে বের হচ্ছে – তা নিয়ে যদি তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আপনার উদ্বেগ- বেড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই দেশে নারীর অধিকার বলতে কিছুই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কারণ নিরাপত্তাহীন অধিকার কেবল মূল্যহীন কথার কথা।

যে দেশে কন্যা-শিশুরাও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায় না, যে দেশে নারীর হেনস্তাকারিকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়, যে দেশে যৌন হেনস্তাকারির বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার আছে – কিন্তু মামলা করার পর মামলাকারিকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয় -  সে দেশের নারীর অধিকার উন্নয়নের সূচক যদি বাড়তে বাড়তে হিমালয়েও উঠে যায় – তা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সে দেশে কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে বর্ণাঢ্য নারীদিবস পালন অসহায় অপমানিত নারীর মুখে চপেটাঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়। 



Thursday, 7 June 2018

ডিজিটাল বাংলাদেশ বনাম রোকেয়া হল কর্তৃপক্ষ



হাস্যকর হলেও সত্যি,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে  ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ২০০৯ সালে। যুক্তি দেখানো হয়েছিল - ল্যাপটপ কম্পিউটার ব্যবহার করলে মেয়েরা 'খারাপ' হয়ে যাবে। এই লেখাটি সেই সময়ের সাক্ষী।


গত সপ্তাহটা কেটেছে সিডনিতে। ক্লিনিক্যাল রেডিওবায়োলজির একটা ওয়ার্কশপ ছিল। সেমিস্টার চলাকালীন একটানা এক সপ্তাহ সময় বের করাটা ভীষণ ঝামেলার কাজ। কারণ সপ্তাহের পাঁচদিনের মধ্যে চারদিন আমার ক্লাস আছে। তার ওপর গত সপ্তাহটা ছিল আমাদের ফার্স্ট সেমিস্টারের ফোর্থ উইক - টেস্ট উইক। তার মানে আমার স্টুডেন্টদের পরীক্ষাও ছিল সারা সপ্তাহ জুড়ে। কাজ থেকে ছুটি নেয়ার কোন উপায় নেই। কিন্তু ছুটি না নিয়েও - কাজের কোন ক্ষতি না করেও - মেলবোর্ন থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে সিডনিতে গিয়ে ওয়ার্কশপে অ্যাটেন্ড করা সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার প্রযুক্তির কারণে। ধন্যবাদ ডিজিটাল টেকনোলজি। লেকচারগুলো রেডি করে অনলাইনে দিয়ে দিয়েছিলাম। আর স্টুডেন্টদের জন্য অনলাইন-টেস্টের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ে তারা যার যার কম্পিউটারের সামনে বসে আমার লেকচার অ্যাটেন্ড করেছে। আর পরীক্ষাও দিয়েছে। আমি ওয়ার্কশপের ফাঁকে ফাঁকে - কফি ব্রেকে - লাঞ্চ ব্রেকে তাদের টেস্ট মনিটর করেছি, তাদের কোন প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর দিয়েছি। ডিজিটাল টেকনোলজি আমাদের গতি দিয়েছে- কাজকে সহজ করেছে - কদিন আগেও যা অসাধ্য বলে মনে হতো - তা সাধ্য করে তুলেছে।
        
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় বসে যা করা সম্ভব, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে বসে তা করা সম্ভব কি না। এটা সত্যি যে অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা এখনো খুব বেশি অগ্রসর নই। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটি স্টুডেন্ট এর জন্য কম্পিউটারের ব্যবস্থা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানই করে দেয়। এখানে স্টুডেন্টদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে বিশাল বিশাল কম্পিউটার ল্যাব। বাংলাদেশে সেরকম ব্যবস্থা করার জন্য ইউনিভার্সিটিগুলোর যে পরিমাণ অর্থ দরকার তা নেই। সেটা আমরা জানি। কিন্তু যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে কি সবার জন্য কম্পিউটারের ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হতো না? অবশ্যই হতো - এ বিশ্বাসে বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিতে কম্পিঊটারের দাবীতে কোন আন্দোলন হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা  নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিচ্ছে কোন না কোন ভাবে। মা-বাবা যেভাবেই হোক ছেলে-মেয়েদের কম্পিঊটার কিনে দিচ্ছেন। যাদের মা-বাবা পারছেন না, তারা নিজেরাই টিউশনির টাকা জমিয়ে কম্পিঊটার কিনছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কোন না কোন ভাবে নিজেদের ডিজিটাল যুগের সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করে নিচ্ছে। এখন কেউ যদি বলেন যে শিক্ষার্থীরা কম্পিঊটার ব্যবহার করতে পারবে না, কারণ কম্পিঊটার ব্যবহার করলে তারা খারাপ হয়ে যাবে - কেমন লাগবে?
        
গতকাল (২৮/৩/০৯) সমকালের প্রথম পাতায় অনলাইন জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছে মেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে যুক্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ল্যাপটপ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এ পদক্ষেপ কি ঠিক হয়েছে? দেখেই কেমন যেন মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা আমার। অন্যান্য পত্রিকাগুলোতেও খুঁজে দেখলাম। প্রথম আলো সম্পাদকীয় ছেপেছে এ ব্যাপারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রোকেয়া হলে একটি রুমে একটির বেশি কম্পিঊটার মানে ডেস্কটপ রাখতে দিচ্ছেন না, আর কাউকে ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না। কারণ ছাত্রীরা ল্যাপটপ ব্যবহার করলে খারাপ হয়ে যাবে।
        
আমার মনের ভেতর প্রথম যে প্রশ্নটি আসে তা হলো-  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সব উচ্চশিক্ষিত কর্তৃপক্ষ কি অত্যধিক গঞ্জিকা সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এরকম আবোল তাবোল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? খারাপ হয়ে যাওয়া বলতে কী বোঝাচ্ছেন তাঁরা? এটা ঠিক যে বাংলাদেশের মত দেশে প্রযুক্তির অনেক অপব্যবহার হয়। মোবাইল ফোনের অনেক অপব্যবহার হচ্ছে। নোংরা ভিডিও ক্লিপে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে গোপনে ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তা সামান্য কয়েকজনের বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন। তাই বলে আমরা বলছি না যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। এখন ল্যাপটপ ব্যবহার করার সাথে মেয়েদের খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্পর্ক কী? আর মানুষের খারাপ হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা এত বেশি ব্যক্তিনির্ভর যে - তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ কোন মন্তব্য করা যায় না। ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের সাথে তুলনা করলে ল্যাপটপের অন্যান্য সব সুবিধা বাদ দিলেও বাংলাদেশে ইলেকট্রিসির যে দুরবস্থা - তাতে ব্যাটারি সুবিধা থাকার কারণে ল্যাপটপই বরং কিছুটা হলেও কাজের সময়ে কাজ করার সুযোগ দেয়। সে অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় একটা উঁচু অবস্থানে থেকে যারা এরকম পশ্চাৎপদ মন নিয়ে হাস্যকর নিষেধাজ্ঞা জারি করছেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক হবার দরকার আছে। হয় তারা প্রযুক্তি সম্পর্কে আসলেই কিছু বোঝেন না, নয়তো বুঝেও না বোঝার ভান করেন। খালেদা সরকারের আমলে যেরকম কিছু মানুষ আমাদের বিনামূল্যে পাওয়া সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হতে দেননি।
        
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে দায়িত্বে এসেছে। কিন্তু এরকম ল্যাপটপ ব্যবহার নিষেধ করে কী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া হবে? অবশ্য ডিজিট শব্দের আরো একটি অর্থ হয়। মেডিকেল টার্মে ডিজিট মানে আঙুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের কর্মকর্তাদের মত কিছু লোক হয়তো মনে করছেন তাদের আঙুলের ইশারায় বাংলাদেশ চলবে - এবং তা হবে তাদের নিজেদের ডিজিটাল বাংলাদেশ। আসলেই কি তাই?

29 March 2009
Melbourne, Australia

Wednesday, 6 June 2018

বিয়ের ভোজ ও অন্যান্য


রবীন্দ্রনাথ যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞগল্পটি লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে। কিন্তু যতবারই পড়ি মনে হয় গল্পটি এখনো সাম্প্রতিক, মনে হয় আমাদের সমাজ এবং সমাজের মানুষ একশ বছরেও বদলায়নি খুব একটা। 

গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে- এক সময় যজ্ঞেশ্বরের অবস্থা ভালোই ছিল। এখন প্রাচীন ভাঙা কোঠাবাড়িটাকে সাপ-ব্যাঙ-বাদুড়ের হস্তে সমর্পণ করিয়া খোড়ো ঘরে ভগবদ্‌গীতা লইয়া কালযাপন করিতেছেন। যজ্ঞেশ্বরের মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা যজ্ঞেশ্বর জানেন। তাই ধনীর ঘরে তার মেয়ের বিয়ে হবে এমন আশা করেন নি। কিন্তু কমলাকে দেখে পছন্দ করে ফেলে জমিদার গৌরসুন্দর চৌধুরির ছেলে বিভূতিভূষণ। অশিক্ষিত জমিদার শিক্ষিত ছেলের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারলেন না, দায়ে পড়িয়া মত দিলেন, কিন্তু মনে মনে যজ্ঞেশ্বরের প্রতি অত্যন্ত রাগ করিলেন। দুপক্ষে কথাবার্তা শুরু হলো। কিন্তু বিয়ে কোথায় হবে তা নিয়ে মহা হৈ চৈ।। জমিদার ছেলের বিয়েতে ধুমধাম করতে চান, কিন্তু গরীব যজ্ঞেশ্বরের সামর্থ্য কোথায় যে ধুমধাম করবে? তারপরও পুত্রের জেদের কারণে কন্যার বাড়িতেই যখন বিয়ের অনুষ্ঠান হবে ঠিক হলো গৌরসুন্দর এং তাঁহার দলবল কন্যাকর্তার উপর আরও চটিয়া গেলেন। সকলেই স্থির করিলেন, স্পর্ধিত দরিদ্রকে অপদস্থ করিতে হইবে। বরযাত্রী যাহা জোটানো হইল তাহা পল্টনবিশেষ। বিয়ের দুদিন থেকে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। বরযাত্রীগণ ভিজিয়া, কাদা মাখিয়া, বিধিবিড়ম্বনার প্রতিশোধ কন্যাকর্তার উপর তুলিবে বলিয়া মনে মনে স্থির করিয়া রাখিল। হতভাগ্য যজ্ঞেশ্বরকে এই অসাময়িক বৃষ্টির জন্য জবাবদিহি করিতে হইবে। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টিতে যজ্ঞেশ্বরের সমস্ত আয়োজন নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বরযাত্রীরা তা বুঝবেন কেন? তারা যজ্ঞেশ্বরের দুর্গতিতে মনে মনে খুশি হলেন, এবং প্রকাশ্যে রেগে গিয়ে মহা হাঙ্গামা শুরু করলেন। যজ্ঞেশ্বরের প্রতিবেশীরা যজ্ঞেশ্বরের বিপদে এগিয়ে এসে প্রচুর ছানার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু বরযাত্রীরা তাতে সন্তুষ্ট হলেন না। যজ্ঞেশ্বর যেমন-যেমন পাতে ছানা দিয়া যাইতে লাগিলেন তৎক্ষণাৎ বরযাত্রীগণ তাহা কাঁধ ডিঙাইয়া পশ্চাতে কাদার মধ্যে টপ্‌টপ্‌ করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। উপায়বিহীন যজ্ঞেশ্বরের চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল। বারম্বার সকলের কাছে জোড়হাত করিতে লাগিলেন; কহিলেন, আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আপনাদের নির্যাতনের যোগ্য নই। একজন শুষ্কহাস্য হাসিয়া উত্তর করিল, মেয়ের বাপ তো বটেন, সে অপরাধ যায় কোথায়
          
গত একশ বছরেরও আমাদের সামাজিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে কি? মেয়ের বাপ হওয়ার অপরাধে এখনো অনেককেই কত রকম গঞ্জনা সহ্য করতে হয় মেয়ের বিয়ের ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে। যজ্ঞেশ্বর মেয়ের বর গৌরসুন্দরের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামলেছিলেন সেদিন। কিন্তু এখনকার বেশির ভাগ বর ভোজের আয়োজনে একটু এদিক-ওদিক হলেই বর্বরের মত আচরণ করেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ঘটনাটি পড়ে দেখুন:



 এরকম ঘটনা নতুন নয়। নানারূপে নানাভাবে বাংলাদেশ ও ভারতে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। অনেক জায়গায় কন্যাপক্ষকে অপদস্ত করার জন্য পেশাদার খাদক নিয়ে যাওয়া হয়। যাদের সাথে আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে তাদেরকে অপদস্থ করতে পারলে যেন অফুরন্ত আনন্দ পাওয়া যায়।
          
আজকাল অনেকেই যৌতুক-প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। এটা ভালো দিক। কিন্তু যেখানে কোন দাবী-দাওয়া নেই - সেখানেও দেখা যায় কয়েক শত বরযাত্রীর ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন কন্যাপক্ষ। বরপক্ষকেও বৌ-ভাত নামে ভোজের আয়োজন করতে হয়। তবে সে আয়োজনে স্বাধীনতা থাকে। অন্যপক্ষের মনোরঞ্জন বাধ্যতামূলক নয় বলে বরপক্ষকে খুব বেশি মানসিক চাপে থাকতে হয় না।
          
বিয়েতে এরকম বিশাল ভোজের আয়োজন করাটা কি আসলেই খুব দরকার? এক বেলার ভোজের আয়োজনে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। যার পুরোটাই একেবারে বাজে খরচ। আমাদের মত গরীব দেশেও যাদের সামর্থ্য আছে তারা এত বেশি খরচ করে ভোজ দেন যে অবাক লাগে। চট্টগ্রামে একাধিক বিয়ের ভোজ হয়েছে স্টেডিয়ামে। শতাধিক বাস ভাড়া করে লোক নিয়ে আসা হয়েছে একবেলা খাওয়ার জন্য। সেখানে একবেলায় যা খরচ হয়েছে তা দিয়ে কয়েকটি স্কুল তৈরি করা যায়।
          
বাংলাদেশে অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন নামে একটা আইন আছে বলে শুনেছি। এই আইন অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি মানুষকে খাওয়ানো যাবে না। যারা ভোজের আয়োজনে বাধ্য হন তাদেরকে এই অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও করতে হয় - মানে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়।
          
বিয়েতে এলাহী-ভোজ বাদ দিয়ে বিকল্প কিছু কি ভাবা যায় না?

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।

Friday, 1 June 2018

ভয়াবহ ধর্ষণ-তত্ত্ব

২০০৫ সালে সাপ্তাহিক মৃদুভাষণে প্রকাশিত একটি লেখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখেছিলাম এই লেখা। লেখাটি এখনো প্রাসঙ্গিক।



Thursday, 3 May 2018

পুরুষরাও হবে শুধু মানুষ

সচিত্র সময় নামে একটি ম্যাগাজিন বের হতো ১৯৯২-৯৩ সালে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি ছিলেন তাঁর প্রধান সম্পাদক। সেখানে এই প্রতিক্রিয়াটি প্রকাশিত হয়েছিল।


Sunday, 29 April 2018

বাঙালি নারীরা তাদের ঐতিহ্য হারাচ্ছে


বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে একটা পাতা থাকে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য - মহিলাদের পাতা। সপ্তাহে একদিন সেখানে শুধুমাত্র মেয়েদের লেখা প্রকাশিত হয়। দৈনিক পূর্বকোণ-এর মহিলাদের পাতায় অ্যানি একসময় লিখতে শুরু করেছিল। তার তখনকার লেখাগুলো আমি দেখে দিতাম। পূর্বকোণের মহিলাদের পাতায় একটা সিরিজ আলোচনা শুরু হয়েছিল 'বাঙালি নারীরা তাদের ঐতিহ্য হারাচ্ছে' শিরোনামে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট লেখকদের মধ্যে যাঁরা মহিলা তাঁদের অনেকেই লিখলেন সেখানে। অ্যানিরও একটা লেখা প্রকাশিত হলো। তার লেখার সমালোচনা করে একটি লেখা প্রকাশিত হলো। অ্যানির লেখার পক্ষে একটি লেখা তৈরি করে নিয়ে গেলাম পূর্বকোণ অফিসে। পত্রিকা অফিসের কারো সাথে, কোন সম্পাদকের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। কারো সাথে আমার নিজের লেখা নিয়ে আলোচনা করতেও আমার স্বস্তি হয় না। আমি সাধারণত পত্রিকা অফিসের চিঠির বাক্সে লেখা ফেলে দিয়ে আসতাম। সেদিন এই লেখাটা নিয়ে ভেতরে গেলাম। তখন মহিলাদের পাতা সম্পাদনা করতেন সাংবাদিক বিশ্বজিত চৌধুরি। তিনি লেখাটি হাতে নিয়েই বললেন, মহিলাদের পাতায় তো পুরুষ লেখকের লেখা প্রকাশ করা হয় না। তাহলে? লেখাটা নিয়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই তিনি বললেন, "একজন মহিলার নামে লেখাটি প্রকাশ করা যাক। একটা নাম দেন।" সেই মুহূর্তে যে নামটা মনে এসেছিল - সেই নামেই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালের ৯ জানুয়ারি।   











Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts