Thursday 29 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ৮ম পর্ব



বেশ সকালেই ঘুম ভাঙলো। বক্তৃতার বিষয়ে একটু পড়াশুনা করে নিয়ে কনফারেন্স সেন্টারে চলে গেলাম। বিশ মিনিটের বক্তৃতার জন্য আমি যে পরিমাণ লেখাপড়া করেছি তিন ঘন্টা পরীক্ষার জন্যও এরকমভাবে পড়তে হয়নি আগে। ইউনিয়ন হাউজের নিচতলায় পানি আনতে গিয়েই দেখা হয়ে গেলো ডক্টর মহানন্দা দাশগুপ্তার সাথে। তিনি বললেন, "চলো, কোথাও বসে কথা বলি একটু।"
গাছের নিচে বসলাম দু’জনে। ইংরেজির মতো বাংলাও চমৎকার বলেন তিনি। জানা গেলো তাঁর আদিপুরুষ বাংলাদেশি। তাঁর বাবার জন্মও বাংলাদেশের খুলনায়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় দেশ ছেড়েছেন। ইন্ডিয়াতেও তাঁরা বাংলায় থাকেন না। তাঁদের বাড়ি রাজস্থানে। তিনি জন্মেছেনও রাজস্থানে। বাড়িতে বাবা মায়ের প্রেরণায় বাংলা বই পড়ে পড়ে বাংলা শিখেছেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রিয় লেখক। এখানে আছেন সাড়ে আট বছর ধরে। অস্ট্রেলিয়ার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হয়েছেন, কিন্তু নাগরিকত্ব নেননি। তিনি এখনো ভারতীয় নাগরিক। ভবিষ্যতে ভারতীয় পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করার ইচ্ছা আছে তাঁর। তাঁর ছোট ভাই থাকেন রাজস্থানে। ভবিষ্যতে ভাইয়ের সাথেই থাকবেন, এরকম প্ল্যান। বিয়ে করেননি এখনো, ভবিষ্যতে কখনো করবেন বলেও মনে হয় না। এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট হিসেবে ইতোমধ্যেই তিনি যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। জুয়ান,তানিয়া সবার মুখে ডক্টর মহানন্দার প্রশংসা শুনতে খুব ভালো লেগেছে আমারো। আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন তিনি। ক্যানবেরা গেলে অবশ্যই যেন তাঁর ওখানে যাই বললেন বারবার। তাঁর ক্যানবেরা ফেরার ফ্লাইট আজ চারটায়। দুঃখ করে বললেন, "আমার খুব খারাপ লাগছে প্রদীপ, তোমার টক শুনতে পেলাম না। আমি প্রোগ্রামটা আগে পেলে ফ্লাইটটা ক্যানসেল করতাম।"
"না, ঠিক আছে। আমি আপনাকে আমার পেপার পাঠিয়ে দেবো।"
কথা বলতে বলতে দু’জনে ফিজিক্স বিল্ডিং-এ চলে এলাম। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সকালের অধিবেশনে আজ ডক্টর অঞ্জলি মুখার্জীর বক্তৃতা আছে। ডক্টর মুখার্জীকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে। ডক্টর দাশগুপ্তা আমাকে কনুই দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, "দেখো অঞ্জলির দিকে। বেচারা নার্ভাস হয়ে পড়েছে।"
অধিবেশনের তৃতীয় বক্তা অঞ্জলি। প্রথম বক্তার বক্তৃতা শেষ হবার আগেই অঞ্জলি বেরিয়ে গেলেন অডিটোরিয়াম থেকে। হয়তো নার্ভাস ডায়রিয়া। আমার দাদার কথা মনে পড়লো। সে মাঝে মাঝে হোমিওপ্যাথি চর্চা করে। তার হোমিওপ্যাথিতে এই নার্ভাস হয়ে যাবার ওষুধ হলো সাইলেসিয়া। আমার হঠাৎ মনে হলো সাইলেসিয়ার মতো প্রয়োজনীয় বস্তু সাথে না এনে মস্ত ভুল করেছি।
ডক্টর অঞ্জলি মুখার্জী বক্তৃতা শুরু করার আগে স্লাইড প্রোজেক্টারে কপাল ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন। পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র হাতে পাবার পরে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি কপালে ঠেকাতে। এখানে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বিজ্ঞানী ডক্টর অঞ্জলি মুখার্জীও এরকম কিছু করবেন ভাবিনি। এর নাম কি সংস্কার নাকি অন্ধবিশ্বাস? এরকম কোন বিশ্বাস একজন বিজ্ঞানীর কেন থাকবে?
আমার বক্তৃতা দুপুর দুটোর অধিবেশনে। বেলা দেড়টার দিকে ফিজিক্স বিল্ডিং-এর পাশে খটমটে নামের বিশাল গাছের নিচে বাঁধানো চত্বরে বসে বক্তৃতার পয়েন্টগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছি। ভেবেছিলাম এখানে কেউ ডিস্টার্ব করবে না আমাকে। কিন্তু আমার ভাবনা কখনোই ঠিক হয় না। দু’মিনিটের ভেতর ইয়াসনা হাজির। ধুপধাপ করে এসেই বললো, "কোন চিন্তা করো না প্রাডিব। তোমারটা দেখবে সুপার হয়েছে।"
"ফাজলামি করবে না একদম, যাও এখান থেকে। আগামী তিন ঘন্টা আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না।"
"বললাম তো আমারটার মতো বাজে হবে না।"
"তোমারটা বাজে হয়েছে যদি কেউ বলে তার মুন্ডু ছিঁড়ে নেবো আমি।"
ইয়াসনা তার মোটামোটা দাঁত দেখিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো। সে যেতে না যেতেই ক্রেগ এসে হাজির। ক্রেগ এভারটন।
"প্রাডিব, কফি খাবে নাকি? প্রি-লেকচার কফি?"
আর থাকা সম্ভব নয় এখানে। উঠে চলে যাচ্ছি- এসময় ট্রেসি ইমাজিনসহ আরো চার পাঁচজন। ট্রেসিকে বললাম, "খেলা দেখতে গেলে না?"
অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ক্রিকেট শুরু হয়েছে এডেলেইড ওভালে। তাদের সবার সেখানে যাবার কথা। আমি ভেবেছিলাম আমার বক্তৃতার সময়ে বক্তারা ছাড়া আর কেউ থাকবে না। এখন দেখি সবাই ঘুরঘুর করছে এখানে। ট্রেসি বললো, "তোমার বক্তৃতার পরে যাবো খেলা দেখতে।" শুনে রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল।
অডিটোরিয়ামে ঢুকে বসে আছি চুপচাপ। এখনো পনের মিনিট বাকি অধিবেশন শুরুর। আমি অধিবেশনের চতুর্থ এবং শেষ বক্তা। সুতরাং এখনো যথেষ্ট সময় হাতে আছে। কেন্‌ আসবেন বলেছিলেন। এখনো তো এলেন না, ভাবতে না ভাবতেই হলের বাইরে কেনের গলা শোনা গেলো। হাসতে হাসতে হলে ঢুকলেন কেন্‌ আর প্রফেসর জর্জ ড্রাকুলিস।
জর্জ ড্রাকুলিস অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের হেড। কেন্‌ এসে বসার সাথে সাথে অনেক প্রফেসর হ্যালো কেন্‌ বলে তাঁর চারপাশে ভিড় জমালো। বুঝলাম কেনের দাপটই আলাদা। কেন্‌ এই ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন ছত্রিশ বছর আগে।
এসময় ডক্টর অ্যান্ড্রু সছবেরি এসে আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, "কেন্‌ তো মনে হয় তোমার জন্যই এসেছেন এখানে।"
বক্তৃতা শুরু হলো। হল ভর্তি মানুষ। এত মানুষ আজকে হবার কথা নয়। তানিয়ার সাথে চোখাচোখি হতেই হাসলো সে। তার তো আজ চলে যাবার কথা ছিলো। তবে কি ফ্লাইট চেঞ্জ করেছে সে?
অধিবেশনের সভাপতিত্ব করার কথা সিডনি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর লরেনস পিকের। কিন্তু বিকাল চারটার ফ্লাইটে তিনি চলে যাবেন বলে সভাপতির দায়িত্ব নিলেন সিডনি ইউনিভার্সিটির আরেক প্রফেসর রেজা হাশেমী নিজহাদ। আমার ঠিক আগেই জেসির বক্তৃতা। জেসি কার্লটন। নামটা মেয়েলী হলেও জেসি ছেলে। আমি কোন বক্তৃতায় কান দেবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ দেখছি অন্যের কথা কানের ভেতর ঢুকছে অন্যদিনের চেয়ে বেশি।
মেলবোর্নে থাকতে কেন্‌ বলেছিলেন, "বলার সময় মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাবে। আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ছি দেখলেই বুঝবে সব ঠিক আছে। আর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছি দেখলে বুঝতে হবে সামথিং রং।
তিনটা দশ মিনিটে আমার নাম ঘোষিত হবার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম ডক্টর লরেনস পিক চলে যাবার জন্য ব্যাগ হাতে নিয়েও আবার বসে পড়লেন। ডায়াসে দাঁড়িয়ে আমার খুব একটা ভয় লাগছে না। কেনের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি এর মধ্যেই মাথা নাড়াতে শুরু করে দিয়েছেন। পরবর্তী বিশ মিনিট ঝড়ের বেগে চলে গেলো। আমার জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক বক্তৃতা শেষ হলো। হাততালি দিতে এদেশের মানুষের কোন কৃপণতা নেই। প্রচুর করতালি দিলো আমাকেও। তার মানে এই নয় যে আমার বক্তৃতা খুব ভালো হয়েছে। তবুও ভালো লাগলো খুব। ডক্টর লরেনসকে দেখলাম তখনো বসে আছেন। কেনের আশেপাশের প্রফেসররা কথা বলছেন তাঁর সাথে। এবার প্রশ্নোত্তরের পালা।
প্রথম প্রশ্নটা এলো সিডনি ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসরের কাছ থেকে। তিনি মেডিকেল সায়েন্সের রেডিওথেরাপিতে আমাদের মাইক্রোস্কোপিক মডেলটা কীভাবে ব্যবহার করা যাবে সে বিষয়ে একটা সূক্ষ্ম প্রশ্ন করলেন। আমি আমার মতো করে উত্তর দিলাম। প্রশ্নের উত্তর দেয়াটাকে একটু আগেও খুব ভয় পাচ্ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে কোন ব্যাপারই না।
কেন্‌ বলেন গবেষণাটাতো আমি করছি, সুতরাং আমার গবেষণার বিষয়ে আমি ভালো জানবো অন্যদের চেয়ে। কেন্‌ আমার উত্তরের পরে আরো কিছু মন্তব্য যোগ করে দিলেন। সুপারভাইজারের দায়িত্বের মধ্যে এসব পড়ে কিনা জানি না। কিন্তু কেন্‌ আমাকে যেভাবে সহযোগিতা করছেন তা অন্যান্য সুপারভাইজাররা তাঁদের স্টুডেন্টের জন্য যে করেন না তা আমি আমার সাথের আরো পিএইচডি স্টুডেন্টের ক্ষেত্রে দেখেছি। কেন্‌ শুধুমাত্র আমার এই বক্তৃতার জন্য মেলবোর্ন থেকে উড়ে এসেছেন আজ সকালে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা করলো রাসেল। সেই অস্বাভাবিক স্বাস্থ্যবতী রাসেল বাট। আমি তো ভেবেছিলাম রাসেল শুধু সেলাই কাজই করে এখানে বসে। কিন্তু তার প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারছি সে বক্তৃতার প্রত্যেকটি শব্দ মনোযোগ দিয়ে শোনে। প্রশ্ন করার জন্য আরো অনেকে হাত তুললেও সভাপতি আর কাউকে সুযোগ না দিয়ে অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করে দিলেন। মনে হলো একটা বিরাট ভার নেমে গেলো আমার ঘাড় থেকে।
মাথা নিচু করে স্লাইডগুলো গুছিয়ে নিয়ে সিটের কাছে আসতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রফেসর জেফ টেইলর। "কনগ্রাচুলেশানস, ইট ওয়াজ এ ভেরি গুড টক।"
আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। জেফ টেইলর পৃথিবী বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট। অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল তাঁর প্রজেক্টে নয় মিলিয়ন ডলারের অনুমোদন দিয়েছে এ বছর। আমাদের ডিপার্টমেন্টে জেফ টেইলরের আলাদা ক্ষমতা। তিনি আমার কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলেন। আমার খুব ভালো লাগছিলো এরকম বড় একজন মানুষের সাথে কথা বলতে। কেন্‌ তখন অনেকের সাথে কথা বলছেন হলের অন্যপ্রান্তে। ম্যাট এসে হ্যান্ডশেক করলো, র‍্যাছেল এসে জড়িয়ে ধরে গালের সাথে গাল লাগিয়ে দিলো। এটা হলো ইংরেজি কায়দা, ছেলেদের সাথে ছেলেরা হাত মিলাবে আর মেয়েরা গাল মিলাবে।
ক্রেগ এসে বললো, "ভেরি গুড টক প্রাডিব। তুমি একটা সফটওয়্যার তৈরি করে বাজারে ছেড়ে দাও, রেডিওথেরাপিস্টরা লুফে নেবে।"
অভিনন্দনের ঘনঘটায় আমার লজ্জা লাগছে। আমার এইসব বন্ধুদের বক্তৃতার পরে আমি এভাবে অভিনন্দন জানাইনি তাদের। এবার কেন্‌ এগিয়ে এলেন আমার দিকে। পিঠে হাত দিয়ে বললেন, "ওয়েলডান মাই বয়।"
কেনের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে খুব ভালো লাগলো আমার। কেন্‌ জানতে চাইলেন আমার কোথাও কোন ধরনের অসুবিধা হয়েছে কিনা, থাকা খাওয়ার, কিংবা টাকা পয়সার। একজন বাবা যেভাবে সন্তানের সুযোগ সুবিধার দিকে চোখ রাখেন কেন্‌ও আমার ব্যাপারে সেরকম। বললেন কাল পরশু খেলা দেখতে যেতে। তারপর চলে গেলেন তিনি।
হল থেকে বেরোবার মুখে দেখি তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে তার মস্ত ব্যাগ আর মুখে হাসি। আমার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়েই দৌঁড়ে চলে গেলো সে। এখন ফ্লাইটটা মিস না করলেই হলো।
আমি এখন মোটামুটি ফ্রি হয়ে গেছি মনে হচ্ছে। আর একটি মাত্র অধিবেশনের পরে শেষ হয়ে গেলো সপ্তাহব্যাপী অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিউট অব ফিজিক্স কনফারেন্স।



কনফারেন্স শেষে মেলবোর্ন গ্রুপের কয়েকজনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে চলে এলাম। গ্রোট স্ট্রিট আর কিং উইলিয়াম স্ট্রিটের কোণায় চায়না টাউন। পৃথিবীর সব বড় বড় শহরের মতো এখানেও আছে চায়না টাউন। চায়না টাউনের ইন্টারন্যাশনাল ফুড কোর্টের যথেষ্ট নামডাক শুনেছি। চীন, জাপান, হংকং, মেক্সিকো, ইতালি সব দেশের খাবারের বিচিত্র সমাবেশ এখানে। কিন্তু বিক্রেতাদের বেশির ভাগই চায়নিজ। এক জায়গায় ভাত আর মাছ খেলাম। সবাই একসাথে এলেও যে যার মতো পছন্দের খাবার কিনে নিয়ে এক জায়গায় বসে গেলাম। বিরাট জায়গা জুড়ে চেয়ার টেবিল পাতা আছে। মাছ রান্নাটা দারুণ হয়েছে। কী মাছ সেটা বিবেচ্য নয় এখানে, খাদ্যটা যে মাছ তাতেই আমি খুশি। বেশ তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার পরে ইমাজিনের বিয়ারের পিপাসা পেয়ে গেলো। ‘বার’-এ না ঢুকতে পারলে যেন তাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তাই তাদের সাথে একটা বারে ঢুকে পড়লাম। আমি ছাড়া বাকি সকলেই সাউথ অস্ট্রেলিয়ান বিয়ার নিয়ে বসে পড়লো একটা বড় টেবিল দখল করে। আমি একগ্লাস কোকাকোলা নিলাম। গ্লাসের তিন-চতুর্থাংশ বরফের কুচি দ্বারা ভর্তি করে বাকিটাতে কিছু কোক ঢেলে দিলো, এর নাম কোকাকোলা। এটারই দাম অরিজিনাল কোকাকোলার দামের মাত্র দ্বিগুণ।
কয়েক বোতল বিয়ার পেটে ঢুকলে যা হয়, এদের হঠাৎ আন্তর্জাতিক সঙ্গীত শোনার ইচ্ছা করতে লাগলো। ট্রেসি বললো, "ইন্টারন্যাশনাল খাবারের পরে ইন্টারন্যাশনাল সঙ্‌স।"
ইয়াসনা এ বছরের শুরুতে জাপান ঘুরে এসেছে। সে একটা জাপানি গান গাইলো। আমার মনে হলো সে গানে ভেজাল দিয়েছে ইচ্ছেমতো। ট্রেসি ফরাসি জানে। সেটা জানানোর সুযোগ সে ছাড়লো না। জন অরিজিনাল চায়নিজ। তার মেয়ে ভালো গান গায় সেটা জানতাম, কিন্তু জনও যে এত ভালো গান গায় জানা ছিলো না। চীনা ভাষার কিছুই বুঝতে না পারলেও জনের গলায় যে সুর আছে তাতে কোন ভুল নেই। আমি আত্মগোপণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেও পার পেলাম না। পুরো বারে আমার মতো কালো চামড়ার আর কেউ নেই। সবাই চেঁচিয়ে চেপে ধরলো আমাকে, গান গাইতেই হবে। আমার গলায় যে কোন সুর নেই তা আমাকে যারা চেনে তাদের সবাই জানে। কিন্তু এরা তো আর বাংলা গান শোনেনি কখনো। কী গাইবো বুঝতেও পারছি না। বিপদের সময় কোন গানের কথাই মনে আসছে না। শেষ পর্যন্ত ‘ভালোবাসি ভালোবাসি, এই সুরে, কাছে দূরে' --- করে কোনরকমে থামলাম। রবীন্দ্রসঙ্গীত এরা কেউ আগে শোনেনি বলে প্রাণে বেঁচে গেছি। কিন্তু বিপদের ওপর বিপদ, আমাদের বিরল প্রজাতির মেয়ে ইমাজিন [তার থুতনিতে সামান্য দাড়ি আছে] জানতে চাইলো গানের ইংরেজি অনুবাদ। বললাম, "আই লাভ ইউ"।
এই একটি বাক্যই বিস্ফোরণের জন্য যথেষ্ট। সবাই উন্মাদের মতো হাসতে লাগলো।

*****

ভোরের এডেলেইড দেখার সু্যোগ আবার এলো আজ। এবারে পুরোপুরি পর্যটক। আমার পিঠে ব্যাগ, কাঁধে ব্যাগ আর হাতেও ব্যাগ। সাথে এনেছিলাম দুটো, কনফারেনসের ব্যাগসহ এখন তিনটি হয়েছে। আজ কোন ট্যাক্সি নয়, হেঁটেই রওনা দিয়েছি বাস স্টেশনের দিকে। মনে পড়লো আজ ষোলই ডিসেম্বর। ঊনত্রিশ বছর আগে আজকের দিনে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ জিতে ঘরে ফিরেছিলো। আমি ফিরছি এক শহর থেকে অন্য শহরে। কোনটাই আমার ঘর নয়।
হাঁটতে হাঁটতে গ্রাউন্ড পাইওনিয়ার বাস টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম। বোর্ডিং-পাস নিলাম। কর্তৃপক্ষ লাগেজের দায়িত্ব নিচ্ছে না। লাগেজ নিজের দায়িত্বেই বাসের লাগেজ-কেবিনে তুলে দিতে হবে। এই ব্যবস্থাটা মোটেও পছন্দ হলো না আমার। পৌনে আটটাতেও বাসের দেখা নেই। সকাল আটটায় বাস ছাড়ার কথা।
আটটায় একটা মেলবোর্নের বাস এলো। এই বাসের ড্রাইভারটা বেশ মজার। সুর করে কবিতা পড়ার মতো করে কথা বলে। আমার ব্যাগ দুটোতে মেলবোর্নের ট্যাগ দেখে লাগেজ কেবিনে তুলে নিলো। যাত্রীদের মধ্যে অনেকের টিকেট দেখছি অন্যরকম। তবে কি দুটো আলাদা বাস যাচ্ছে মেলবোর্নে? যা ভেবেছি তাই। আমাদের বাস হলো পরেরটা। অথচ আমরা সবাই যার যার লাগেজ তুলে দিয়েছি এই বাসে। আবার ব্যাগের পেট খোলা হলো। ড্রাইভারের কাছে ব্যাগ চাইলে বললো, "কেন চিন্তা করছো? এই বাসও একই জায়গায় যাবে। তোমার ব্যাগ ওখানে টার্মিনালে রেখে দেবো। তোমার বাস যখন যাবে তখন সেখান থেকে তোমার ব্যাগ নিয়ে নিও।"
হয়তো ড্রাইভারের কথা ঠিক। কেউ ধরেও দেখবে না আমার ব্যাগ। কিন্তু বাবারে, আমি বাঙালি। আমার ব্যাগ-অন্ত প্রাণ। ব্যাগ নিয়ে কোন রকমের বেগ পেতে আমি রাজি নই। আমার মতো অনেকেই যার যার ব্যাগ ফেরত নিয়ে এলো। ড্রাইভারটা সামনে যা পেয়েছে সবই তুলে নিয়েছে তার বাসে। দেখা গেলো সিডনির ব্যাগও উঠে গেছে সেখানে।
অবশেষে আমাদের আটটার বাস এলো সাড়ে আটটায়। অস্ট্রেলিয়ার সময়ানুবর্তিতায় বিরাট এক কালো দাগ টেনে দিয়ে বাস ছাড়লো পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরিতে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরি ক্ষমার অযোগ্য। তবুও ড্রাইভার বারবার ক্ষমা চাইবার পরে মনে মনে ক্ষমা করে দিলাম (ক্ষমা না করলেই যেন কী একটা হয়ে যেতো আর কি)!
আস্তে আস্তে পেছনে সরে যাচ্ছে এডেলেইড। পাহাড়ি পথের উপর থেকে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম এডেলেইডের পথ- যে পথ ক’দিনের জন্য হলেও বেঁধে দিয়েছিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি।


_______________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Wednesday 28 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ৭ম পর্ব



বিকেল তিনটা পর্যন্ত প্যারালাল সেশানে কাটিয়ে ইউনিয়ন হাউজের পাঁচতলায় গেলাম নিউক্লিয়ার এন্ড পার্টিক্যাল ফিজিক্সের পোস্টার প্রদর্শনী দেখতে। ঘুরে ঘুরে পোস্টার দেখছিলাম। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল পোস্টার আকারে প্রদর্শন করা হচ্ছে। আমার নিজের গবেষণার সাথে একটি গবেষণার মিল ছিলো কিছুটা। কনফারেন্স হ্যান্ডবুক থেকে সেই পোস্টার নম্বর দেখে সেখানে গিয়ে দেখি জায়গাটা খালি। তার মানে তিনি আসেননি। এখানে সামিনা মাসুদের পোস্টার থাকার কথা। পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম ইউনিভার্সিটির সামিনা মাসুদ। হয়তো সরকারি অনুমতি মেলেনি এখানে আসার। হয়তো বা ভিসা পাননি। এদেশে এখন পাকিস্তানিদের ভিসা পাওয়া খুব সহজ নয়।
জুয়ানের একটা পোস্টার আছে এখানে। সেটার কাছে যেতেই সে টেনে নিয়ে গিয়ে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তানিয়া- তানিয়া জে শুক। জার্মান। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এক বছরের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে এসেছে। প্রথম আলাপেই কেমন যেন ভালো লেগে গেলো তানিয়াকে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বিভিন্ন সেশানে তাকে দেখেছি গভীর মনোযোগ দিয়ে বক্তৃতা শুনতে। এই কনফারেনসে সে বক্তৃতা দিচ্ছে না, তবে একটা পোস্টার আছে তার। তার পোস্টারটা নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললাম। সে আমার গবেষণা সম্পর্কে জানতে চাইলো। তানিয়ার চেহারাটার সাথে আমার খুব আপন কোন মানুষের চেহারার মিল আছে বলেই হয়তো তানিয়াকে খুব আপন মনে হচ্ছে আমার। নিঁখুত একটা মিষ্টি মুখ তানিয়ার। দেখলেই তার ছোট করে ছাটা এলোমেলো কালো চুলগুলোকে আরো এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে করে। জার্মানিতে মনে হয় তানিয়ারা সংখ্যালঘু। হিটলার জার্মানিকে সোনালি চুলের বিশুদ্ধ আর্যদের দেশ বানাতে চেয়েছিলো। যদিও হিটলার নিজে ছিলো কালো চুলের মানুষ। তানিয়ার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু প্রফেসর সছবেরি এসে ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর পোস্টারের দিকে।
তানিয়ার পোস্টারের পাশেই প্রফেসর অ্যান্ড্রু সছবেরির পোস্টার। এই প্রফেসরটি মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। কেন্‌কে ভালোভাবেই চেনেন। তাঁর সাথে বিশুদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে আড্ডা জমে গেলো। তিনি এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট, আমি থিওরেটিক্যাল। আমরা এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের সমালোচনাও যেমন করি, আবার একে অন্যকে ছাড়া কাজও করতে পারি না। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির অনেকের পোস্টার আছে। সবার কাছে একটু একটু করে যেতে হলো। এক্স-রে অপটিকস গ্রুপের এসোসিয়েট প্রফেসর ডক্টর রবার্ট একটা পোস্টার এনেছেন এবং সাথে তার সম্প্রতি কেনা ডিজিটাল ক্যামেরাটাও নিয়ে এসেছেন। তাঁর পোস্টারের সামনে যেই যাচ্ছে রবার্ট সাথে সাথে ছবি তুলে নিচ্ছেন।
আমাদের মুটকো মেয়ে ট্রেসি বললো, "রবার্ট ইজ অ্যাজ ব্যাড অ্যাজ ডেভিড।"
ডেভিড মানে ডক্টর ডেভিড পেটারসন। ডেভিডেরও ফটো তোলার বাতিক আছে। বলাবাহুল্য ট্রেসিকে সারাক্ষণ রবার্টের আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে দেখলাম।


এডেলেইড হায়াত রিজেন্সি হোটেল

সন্ধ্যে সাতটায় কনফারেন্স ডিনার এডেলেইডের সবচেয়ে দামী হোটেলে। হোটেল হায়াত রিজেন্সি এডেলেইড। ছোটখাট একটি টিলার উপরে এই চমৎকার ফাইভ স্টার হোটেল। হোটেলের সামনে সুন্দর ফোয়ারা। তার নিচে বেশ বড় একটা গুহার মতো আছে। গুহার দেয়ালে আদিবাসিদের আঁকা বিভিন্ন দেয়ালচিত্র শোভা পাচ্ছে। গুহার দু’দিকে সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো দেখতে বেশ পুরনো মনে হয়। আসলে এভাবেই তৈরি করা হয়েছে এগুলো।
সাতটা বাজেনি তখনো। সিঁড়িতে বসে আছি আমরা কয়েকজন। আজ কিন্তু কেউ হাফপ্যান্ট বা টিশার্ট পরে আসেনি। আজ আমাকেই মনে হচ্ছে একমাত্র ক্যাজুয়েল। না, তানিয়াও কিছু সাজগোজ করে আসেনি। পোশাকও বদলায়নি সে এখানে আসার আগে। মনে হচ্ছে সে যেমন আছে সেভাবেই তাকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে। আমি কীভাবে যেন জুয়ানসহ আরো কয়েকজনকে পাশ কাটিয়ে তানিয়ার পাশে এসে বসে পড়েছি। বহুদিন পরে আড্ডা জমেছে। আন্তর্জাতিক আড্ডা। আমার একপাশে জার্মান, অন্যপাশে সুইডিশ, সামনে পেছনে অস্ট্রেলিয়ান আর চায়নিজ। তানিয়া ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হবে শুনে মনে হলো সেই ইংরেজি প্রবাদটির কথা। বলার লোভ সামলাতে পারলাম না, "হ্যাভেন ইজ অ্যান ইংলিশ পুলিশম্যান, এ ফ্রেনস কুক, এ জার্মান ইঞ্জিনিয়ার, অ্যান ইতালিয়ান লাভার অ্যান্ড এভরিথিং অর্গানাইজড বাই দি সুইস।"
তানিয়া হাসতে হাসতে বললো, "ডোন্ট টেল মি দ্যাট ইউ আর অ্যান ইটালিয়ান।"
হাসলে এই মেয়েটাকে যে কত মায়াবী লাগে তা কি সে জানে? আমি জানি না কী ভাবছিলাম, হঠাৎ জুয়ানের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
"তোমার বক্তৃতা কখন কাল?"
আমার বিশ্বসংসার হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলো। কালকেই যে আমার বক্তৃতা তা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কনফারেন্স ডিনারে আসবো না এরকমই ভেবে রেখেছিলা। কিন্তু কী যে হয়ে গেলো! এ সময় আমার ঘরে বসে বক্তৃতা প্র্যাকটিস করার কথা, আর আমি কিনা এখানে বসে আড্ডা মারছি। না, যথেষ্ট হয়েছে। এবার কেটে পড়তে হবে।
সাতটা বাজলে সবাই যখন আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকছে, আমি চোরের মতো চলে আসছিলাম কাউকে কিছু না বলে। কিন্তু তানিয়ার দৃষ্টি এড়ালো না ব্যাপারটা। সে এগিয়ে এসে বললো, "চলে যাচ্ছো তুমি?"
"হ্যাঁ, আমার লেকচার রেডি করতে হবে।"
"খাবে কোথায়?"
"যাবার পথে কিনে নিয়ে যাবো কিছু।"
"ঠিক আছে, যাও। কাল দেখা হবে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দিয়েছিলাম সাত বছর আগে। আজ এতদিন পরে পরীক্ষার পূর্বরাত্রির মতোই মনে হচ্ছে। বক্তৃতাটা আমার নিজের ভাষায় হলে কোন ব্যাপারই ছিলো না। এখন বিষয় এবং ভাষা দুটোর জন্যই ভাবতে হচ্ছে। অবশ্য কেন্‌ আমার বক্তৃতা শুনেছেন ডিপার্টমেন্টে। আমাদের থিওরি গ্রুপের যে কয়জন আমরা এসেছি, এখানে আসার আগে একদিন ডিপার্টমেন্টে সেমিনার টক দিয়ে এসেছি সবাই। সেখানে নানারকম প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়েছে। কোন অসুবিধা হবে না আশা করছি। তাছাড়া এখানে সবাই জানার জন্য প্রশ্ন করে। আমাদের দেশের মতো নিজেকে জাহির করার জন্য বা অন্যকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে কেউ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না এখানে।
আমার বক্তৃতার স্লাইডগুলি সব ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে মনে রিহার্সাল দিয়ে নিলাম আরেকবার। বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দেয়া এখানে একটু জটিল কাজ এই কারণে যে সময়টা খুব কম। সতের মিনিটের ভেতর তোমার যা বলার বলতে হবে এবং পরবর্তী তিন মিনিট প্রশ্নোত্তর পর্ব। অপ্রয়োজনীয় কোন শব্দ উচ্চারণ করার বা শব্দ হাতড়াবার সময় নেই। আমার স্লাইডের সংখ্যা মোট বিশটি। প্রতিটি স্লাইডের জন্য এক মিনিটেরও কম সময় বরাদ্দ। স্লাইড বদলানোর সময়ও কথা থামানো যাবে না
দেখা যাক কী হয়। এখানকার ছেলেমেয়েরা এসবের থোড়াই কেয়ার করে। কারণ তাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরেই আছে এ ধরণের উপস্থাপনার ছড়াছড়ি। শিক্ষাজীবনের প্রায় সর্বত্র তাদের নিজ নিজ বিষয়ে বলতে হয়। তারা আমাদের মতো মুখস্থ করে পরীক্ষায় একটানা লিখে আসতে পারে না সত্য, কিন্তু তারা যা জানে তা নিয়ে বলতে পারে। এসব এখন চিন্তা করে কী হবে! আমি তো আমার এতদিনের শিক্ষাপদ্ধতি একদিনে বদলাতে পারবো না। সুতরাং আমাকে খাটতে হবে।
চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। ঘুমও আসতে দেরি করছে আজ। মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যে এমন কোন স্বপ্ন দেখবো- বক্তৃতা দিতে উঠেছি অথচ একটা শব্দও বের হচ্ছে না আমার মুখ দিয়ে, অনবরত ঘামছি ইত্যাদি। কিন্তু না, কোন রকম দুঃস্বপ্ন ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়লাম একসময়।

__________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ছবিগুলো বইতে প্রকাশিত হয়নি।


Tuesday 27 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ৬ষ্ঠ পর্ব


সকালে দুটো প্লেনারি সেশান ছাড়া সারাদিন আর কোন অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম নেই আজ। দিনটা ফ্রি রাখা হয়েছে এডেলেইড ঘুরে দেখার জন্য। কনফারেনস থেকে পাঁচটি ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার মধ্যে তিনটি হলো ওয়াইনারি ট্যুর; মদ কিভাবে তৈরি করা হয় দেখার জন্য আঙুর ক্ষেত পরিদর্শন আর সাথে মদের ফ্যাক্টরি। বিনে পয়সায় মদ চেখে দেখার সুযোগ দেয়া হবে সেখানে। কনফারেনসের বেশির ভাগ ডেলিগেট যাচ্ছে সেখানে বিনে পয়সায় মদ খাবার লোভে। আরেকটি ট্যুর হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর। আর শেষ ট্যুরটি হলো ক্লেল্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ ট্যুর। আমি যাচ্ছি ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে ।
দুপুর একটায় আমাদের যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। ভিক্টোরিয়া ড্রাইভের নির্দিষ্ট পয়েন্টে গিয়ে দেখলাম আমিসহ মোট তিনজন যাচ্ছি ওয়াইল্ড লাইফ দেখতে। গাইড ভদ্রমহিলা হ্যান্ডশেক করে অভ্যর্থনা জানালেন। মোট চারজন ডেলিগেটের যাবার কথা। রমেন নামক চতুর্থ জনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এবং নানা জায়গায় রমেনের খোঁজ করতে করতে অনেক সময় চলে গেলো। কিন্তু রমেনের দেখা পাওয়া গেলো না। শেষে রমেনকে ছাড়াই রওনা দিলাম আমরা, মাইক্রোবাসে।
পরিচয় হলো অপর দুজনের সাথে। একজন জুয়ান। জুয়ান ইউরিবাসটেরা। সুইডিশ। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে একবছরের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে এসেছে। পৃথিবীর অনেক দেশের ইউনিভার্সিটির সাথে অস্ট্রেলিয়ান ইউনিভার্সিটির এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম আছে। বিদেশী ছাত্রছাত্রীরা তাদের কোর্সের একটা বা দুটো সেমিস্টার এদেশের ইউনিভার্সিটিতে এসে পড়ে যায়, পরে ক্রেডিট ট্রান্সফার করা হয় মূল ইউনিভার্সিটিত। জুয়ান এখনো জোয়ান, কিন্তু মাথায় এর মধ্যেই টাক চকচক করছে।
অন্যজনের নাম লং সং। ছিপছিপে পাতলা চায়নিজ। লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির ছাত্র। মেলবোর্নের বান্দুরা ক্যাম্পাসে তার অবস্থান। লং সং এর মুখে কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি। হাসতেই ময়লা দাঁত বেরিয়ে পড়লো। মনে হলো, না হাসলেই তাকে ভালো লাগে।
আমাদের গাইডের নাম ডায়না। ডায়না বললে যে ধরণের চেহারার কথা মনে হয় তার সাথে আমাদের এই ডায়নার কোন মিল নেই। ইনি খর্বাকৃতি, স্থুলাঙ্গী ও প্রবীণা। ডায়না এডেলেইড সিটির কয়েকটা রাস্তা ঘুরিয়ে দেখালেন আর বললেন এডেলেইডের ইতিহাস যার কিছুটা আমরা ইতোমধ্যে জানি। শহরটা এক চক্কর দিয়ে আমাদের নিয়ে এলেন বাস স্টেশনে। বললেন, "যেহেতু তোমরা মাত্র তিনজন, সেহেতু আমি তোমাদের একটি ট্যুরিস্ট বাসে তুলে দেবো। তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। সব পয়েন্টে তোমাদের নাম দেয়া আছে। পার্কের রেস্টুরেন্টে তোমাদের যা খুশি মন চায় ফ্রি খেতে পারবে।"
এডেলেইড ডে ট্যুর অফিসের লিজার হাতে আমাদের গছিয়ে দিয়ে এবং লিজা আমাদের দেখাশুনা করবে একথা বার বার বলে ডায়না অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আগুনের মতো সুন্দরী লিজা আমাদের সাথে যাবে, পাশে পাশে ঘুরবে এরকম একটা আশায় আমরা খুশি হয়ে গেলাম। জুয়ান তো পারলে এখুনি ছবি তুলতে শুরু করে। লিজা আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমাদের মনের অবস্থা সে ঠিকই বুঝতে পারছে। ট্যুরিজমে কাজ করতে করতে এটুকু অভিজ্ঞতা তার নিশ্চয় হয়েছে। সে মিটিমিটি হাসতে হাসতে আমাদের ইতিহাস জেনে নিচ্ছে। এডেলেইড কেমন লাগছে, ক’দিন আছি ইত্যাদি। বেচারা লং সং প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইংরেজি বাক্য বানাতে, কিন্তু তোতলাতে তোতলাতে কী বলছে তা লিজা কেন আমিও বুঝতে পারছি না।
ট্যুরিস্ট বাস এসে গেছে। লিজা আমাদের তিনজনকে নিয়ে বাসে উঠে পড়লো। বাসে খুব বেশি ভিড় নেই। লিজা ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে আর আমরা তিনজনই তিনটি আলাদা সিটে বসে প্রত্যেকেই আশা করছি লিজা এসে পাশে বসবে। একটু পরে লিজা হাসিমুখে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।
"হ্যাভ আ নাইস টাইম গাইস" বলে হাসি মুখে নেমে গেলো লিজা। ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিলো। চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেলো লিজা। আমাদের তিনজনেরই অবস্থা চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো। জুয়ানের মুখের দিকে তাকাতেই সে দার্শনিক হয়ে পড়লো। বললো, "লিজা আর লিজার্ডের মধ্যে পার্থক্য নেই মোটেও। দুটোই রক্তচোষা।"
লিজার শোক কাটিয়ে উঠতে সময় লাগলো না। বাসে বিশ-পঁচিশ জনের একটা ট্যুরিস্ট গ্রুপ। সবাই যে এডেলেইডে নতুন তা বোঝা যাচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে চমৎকার সব গাছের সারি, যা অস্ট্রেলিয়ার সব জনপদেই প্রায় একই রকম। ড্রাইভার মাইক্রোফোনে সবকিছুর একটা পরিচিতি দেবার চেষ্টা করছে।
আমি ভাবছি প্রকৃতি তার প্রাকৃতিক পোশাকেই বেশি সুন্দর নাকি তারও সামান্য রূপচর্চার প্রয়োজন আছে? যেমন এখানে সুন্দরী প্রকৃতিকে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে এরা। গাড়ি আস্তে আস্তে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে এঁকেবেঁকে। প্রায় দু’তিনশ’ মিটার উঁচু তো হবেই। নিচের এডেলেইড ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। এই পাহাড়েই দেখা গেলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার টাওয়ারগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আরো উপরে উঠে যাচ্ছি এখন। ড্রাইভার বলে চলেছে ডানদিকের গাছে গাছে কোয়ালা থাকে এখানে। আমরা গাছের শাখা-প্রশাখা দেখতে দেখতে ঘাড় ব্যাথা করে ফেললাম, কিন্তু কোয়ালার দেখা পেলাম না।
বিশাল পাহাড়ি এলাকা জুড়ে এই ক্লেল্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক। চিড়িয়াখানার মতো। তবে সংরক্ষিত প্রাণিগুলো অনেকটা স্বাধীন আর অহিংস। ড্রাইভার পার্কের রিসেপশানে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাস নিয়ে চলে গেলো। পৌনে পাঁচটায় এসে আমাদের তুলে নিয়ে যাবে। হাতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় পাওয়া গেলো।

তাসমানিয়ান ডেভিল

পার্কে ঢুকতেই একটা ঝোপের মতো জায়গা। চারপাশে এক মিটার উঁচু দেয়াল দিয়ে বৃত্তাকার ঘিরে রাখা হয়েছে ঝোপটি। তাসমানিয়ান ডেভিলের বাসা। কুচকুচে কালো এই প্রাণীটি দেখতে অনেকটা ইঁদুর আর শেয়ালের চেহারার মিশ্রণ। এর পাশেই বিশাল বিশাল ইউক্যালিপ্টাস গাছের নিচে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ক্যাঙারুর দল। অস্ট্রেলিয়ায় মোট ক্যাঙারুর সংখ্যা নাকি পাঁচ কোটির বেশি। অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। ক্যাঙারু পরিবারের সব বয়সী সদস্যরাই আছে এখানে। ছবি তোলা যায় সহজেই। ক্যাঙারুর সাথে নিজের একটা ছবি তোলার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে আছে। হাতে ক্যাঙারুর জন্য খাবার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্যাঙারুর আশে পাশে। ক্যাঙারুর খাবার এক প্যাকেট এক ডলার করে বিক্রি হচ্ছে কাউন্টারে। আমি কোন খাবার কিনিনি। কিন্তু তাতে কি?
ট্যুর গ্রুপের সাথে আসা কিশোরী ক্যারোলিনের সাথে আলাপ হয়ে গেলো ক্যাঙারু বিষয়ে কথা বলতে বলতে। ক্যারোলিন আমাদের বাসেই এসেছে এখানে। তাদের পুরো পরিবারই এসেছে। তারা নিউজিল্যান্ডের মানুষ। ক্যারোলিনের সাথে ক্যাঙারু পর্যবেক্ষণ করলাম কিছুক্ষণ।
ক্যাঙারু যখন দাঁড়ায় তখন তার মূল ভরকেন্দ্র চলে যায় তার লেজে। মূলত লেজ দিয়েই ক্যাঙারু দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে। দৌড়ানোর সময় সামনের দু’টো পা মাটিতে লাগে না। লাফিয়ে লাফিয়েই দৌড়ায় ক্যাঙারু। তাদের পেছনের দুই পায়ের দৈর্ঘ্য সামনের দুই পায়ের দৈর্ঘ্যের দ্বিগুণেরও বেশি। বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাঙারু দেখলাম। কিছু ক্যাঙারু থাকে পাথুরে জায়গায়। আবার কিছু থাকে ঝোপের মধ্যে।
উটপাখি দেখলাম অনেকগুলো। কৃত্রিম লেকে প্রচুর হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেশের পাতিহাঁসের মতো। এখানে চরে বেড়াচ্ছে বলেই হয়তো দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। পাখি আছে কিছু, তা খুব একটা মাতামাতি করার মতো আহামরি কিছু নয়।

অস্ট্রেলিয়ান ডিঙ্গু


অস্ট্রেলিয়ান ডিঙ্গু দেখলাম দুটো। একটা নিরাপদ বেষ্টনী ঘেরা জায়গায় রাখা আছে তাদের। কুকুর আর ডিঙ্গুর চেহারায় তেমন কোন পার্থক্য নেই। তবে ডিঙ্গু হলো ভয়ংকর। লাফ দিয়ে গলা কামড়ে ধরে বলে শুনেছি। আর কুকুরের সাথে বেসিক পার্থক্য হলো ডিঙ্গু কখনো ঘেউ ঘেউ করে না। ডিঙ্গুর পরিচর্যাকারী মহাউৎসাহে ডিঙ্গু মাহাত্ম্য প্রচার করছ। শোনার ধৈর্য হলো না। চলে গেলাম আরো ভেতরের দিকে। ঝোপের মধ্যে দেখা গেলো খরগোশ সাইজের কিছু ইঁদুর। কুচকুচে কালো। এদের অফিসিয়াল নাম হলো ব্যান্ডিকুটস।

ব্যান্ডিকুট

পার্কের মাঝখানে কোয়ালার বসতি। ভালুক টাইপের এই প্রাণীটি বড় বেশি অলস। মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে অলস প্রাণী। সারাক্ষণই ঘুমায়। যেখানেই বসাও, ঘুমিয়ে পড়ে। কোলে নিলে তো কথাই নেই। ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতা হলো কোয়ালার একমাত্র খাদ্য। ইউক্যালিপ্টাস পাতা বিষাক্ত। কিন্তু কোয়ালা এই বিষ হজম করতে পারে। কীভাবে পারে কে জানে। এখানে কোয়ালাকে কোলে নিয়ে ছবি তোলার জন্য লম্বা লাইন। কোয়ালার তত্ত্বাবধান করছে একটা মেয়ে। তাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। সে একের পর একজনের কাঁধে তুলে দিচ্ছে একটা নাদুস নুদুস কোয়ালা। আর ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলে দিচ্ছে সঙ্গী সাথীরা। পার্কের নিজস্ব ফটোগ্রাফারও আছে টাকার বিনিময়ে ছবি তুলে দেবার জন্য।

জুয়ান ও কোয়ালার সাথে

একটা ছোট্ট ঘরে বড় বড় কাচের বাক্সে বেশ কিছু সাপ রাখা আছে। মোটামুটি সুলভ প্রজাতির সাপ। কিছু বিষাক্ত, কিছু নির্বিষ। অস্ট্রেলিয়ায় বেশ বিষাক্ত সাপ আছে বিশেষ করে মরু অঞ্চলে। জুয়ান বলছিলো সুইডেনের সাপের কথা। সুইডেনের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপের কামড়ে নাকি বড়জোর একটা ফোসকা পড়তে পারে। গত পঁচিশ বছরে সুইডেনে সাপের কামড়ে মারা গেছে মাত্র একজন লোক। তাও সাপের বিষে অ্যালার্জির কারণে। লোকটার নাকি সাংঘাতিক রকম অ্যালার্জি ছিলো।
কিছু গুঁইসাপ দেখা গেলো এক কোণায় জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। চট্টগ্রাম শাহীন কলেজে কাজ করার সময় আমি এরচেয়ে বড় গুঁইসাপ কলেজের বারান্দায় দেখেছি। এখানে এর চেয়ে বড় গুঁইসাপ কি পাওয়া যায় না?
ময়নার মতো পাখি

ওয়াইল্ড লাইফ পার্কে ঠিক কোনটাকে ওয়াইল্ড বলবো বুঝতে পারছি না। এখানে কোন কিছুকেই সেই অর্থে ওয়াইল্ড মনে হলো না। পার্ক দেখা শেষ। রিফ্রেশমেন্ট সেন্টারে গিয়ে আমাদের কার্ড দেখানোর সাথে সাথে কাউন্টারের তরুণী জানালো আমরা যা কিছু খেতে চাই সব ফ্রি। সব? অস্ট্রেলিয়ান তরুণী চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো, "অ্যাবসলিউটলি এভরিথিং হোয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট।"


জুয়ানের সাথে

অস্ট্রেলিয়ার বারে বা রেস্টুরেন্টে কাজ করে এরকম অনেক ছেলেমেয়ে সুযোগ বুঝে আদিরসাত্মক রসিকতা করতে পছন্দ করে। এ ধরণের রসিকতার পরের স্তরে পৌঁছানোর মতো সাহস আমাদের কারোরই নেই। আমরা হাসতে হাসতে খাদ্য বাছাই করতে লাগলাম। আমি একটা হটডগ আর কোকাকোলা, লং সং দুটো বিয়ার আর জুয়ান একটা অরেঞ্জ জুস নিলো। এই হলো আমাদের এভরিথিং এর দৌড়।
ফেরার পথে আবার এডেলেইড সিটির রাস্তায় ঘোরা হলো বাস ড্রাইভারের ধারাবিবরণীর সাথে সাথে। ড্রাইভার জানালো আমরা যদি বিচে যেতে চাই আমাদের নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আসার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। এই বিচের কথাই বলছিলো জিন। চলে গেলাম বিচে।
এডেলেইড সিটি থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্লেনেল বিচ। চমৎকার সাজানো গোছানো স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বিচটাউন। ইউরোপীয় অভিবাসীরা এখানেই প্রথম নোঙর ফেলেছিলো ১৮৩৬ সালে। যে কর্নেল লাইট এডেলেইড সিটির স্থান নির্বাচন করেছিলেন তিনিও শুরুতে এখানেই এসেছিলেন।
বিস্তীর্ণ বালুচর। শতশত নারী-পুরুষ বালিতে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে এই প্রচন্ড রোদে। সানবাথ। অনেকেই সম্পূর্ণ নগ্ন। রোদেপুড়ে বাদামি হবার বিপজ্জনক চেষ্টা। অস্ট্রেলিয়ায় স্কিন ক্যানসারের হার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। প্রতি চৌদ্দজন অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে একজন স্কিন ক্যানসারে ভুগছে। নিজে কালো হবার সান্ত্বনা এখানেই।
ঠান্ডার দেশের মানুষ জুয়ান। তার হাতের চামড়ায় ফোসকা পড়ে গেছে মাত্র দুদিনের রোদে। লং সং কে নিয়ে নতুন বিপদ দেখা দিলো এখানে। কোন মেয়ে নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে দেখলেই সে হা করে তাকিয়ে থাকছে সেদিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকাটা আইনত নিষিদ্ধ না হলেও কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে আমাদেরই।

ভিক্টোরিয়া স্কোয়ার

রাত ন'টার দিকে চলে এলাম সিটিতে ট্রামে চড়ে। এডেলেইডের একমাত্র ট্রাম বিচ থেকে সিটির ভিক্টোরিয়া স্কোয়ার পর্যন্ত যাতায়াত করে। ভিক্টোরিয়া স্কোয়ারটা খুব সুন্দর। চমৎকার একটা ফোয়ারা এর মূল আকর্ষণ। রাতের হলুদ বাতিতে ঝর্ণাটাকে চমৎকার দেখাচ্ছিলো। তিনটি পাথরের মূর্তির মাথা থেকে তিনদিক দিয়ে পানি ঝরে পড়ছে। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার তিনটি নদী টরেনস, ওঙ্কাপারিঙ্গা আর মারি। নদী তিনটির প্রতীকী সংস্করণ এই মূর্তি তিনটি। চর্মসার মানুষরূপী এই নদীমূর্তি দেখলে জয়নুলের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবি মনে পড়ে।
জুয়ানকে এডেলেইড রিজ হোটেলে এগিয়ে দিয়ে আমি আর লং সং হোস্টেলে ফিরে এলাম। লং সং থাকে এগারো তলায়।

_____
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ছবিগুলো বইতে প্রকাশিত হয়নি।


Monday 26 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ৫ম পর্ব


দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেলো। ভোরে উঠার কোন পরিকল্পনাই আমার ছিলো না, অথচ উঠতে হলো। কিছুটা বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি দাড়িওয়ালা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে ভীষণ চমকে উঠলো। বুঝতে পারছি আর কাউকে আশা করছিলো সে। এত ভোর বেলায় সে আমার দরজা ধাক্কালো কেন এরকম একটা প্রশ্ন করার জন্য মুখের ভেতর শব্দ তৈরি হচ্ছিলো আমার। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই সে ‘সরি সরি’ বলে সামনের রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার রুমের সামনের রুম হলো ১০৫২। একটা মেয়ে উঠেছে সেখানে। কাল রাতে মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছে আমার। দাড়িওয়ালা ছেলেটাকেও আমি দেখেছি কনফারেনসে। তার রুম করিডোরের শেষ প্রান্তের কোন একটা হবে, ১০৪৮ বা ১০৪৯। বেচারা ঘুম ঘুম চোখে ১০৩২ কে ১০৫২ মনে করেছে।
জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম। পূর্বদিকটা লাল হতে শুরু করেছে। এখানে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। এতটা উপরে পাখিরা সম্ভবত উঠতে পারে না বা উঠতে চায় না। ভোরের এডেলেইড কেমন লাগে দেখতে শখ হলো খুব। ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো দাড়িওয়ালার সাথে। সাথে মেয়েটিও আছে। জগিং করতে বেরিয়েছে। দাড়িওয়ালা আমাকে দেখেই চিনতে পারলো। ছেলেটার চোখের দৃষ্টির প্রশংসা করতে হয়। সামান্য কয়েক সেকেন্ডের দেখা হয়েছে সকালে, তারপরও সে চিনতে ভুল করছে না। তাহলে ১০৩২ কে ১০৫২ ভাবার কারণ কী? সে যাকগে। কাছে এসে আলাপ করলো সে। আবার ক্ষমা চাইলো সকালে এরকম পরিস্থিতির জন্য। আমি বললাম, "ইটস ওকে ম্যান।"
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে গেলাম। ছেলেটার নাম প্রহলাদ। তার চেহারা বা গায়ের রঙ কোনটাই তার নামের সাথে মেলে না। আমার জ্ঞিজ্ঞাসার জবাবে জানা গেলো তাদের আদিবাড়ি দক্ষিণ আফ্রিকায়। ভারতীয় নামটা পেয়েছে তার মায়ের বাবার কাছ থেকে। আর গায়ের রঙ চেহারা সবকিছু পেয়েছে বাপের দিক থেকে। মেয়েটার নাম অ্যানেট। দু’জনই গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। তাদের গবেষণার বিষয় কম্পিউটেশনাল ফিজিক্স।
তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে এডেলেইডকে দেখলাম ভোরের নরম আলোয়। এতো ভালো অনেক দিন লাগেনি। ইচ্ছে করছিলো জুতো খুলে খালি পায়ে হাঁটি ঘাসের উপর। কিন্তু ইচ্ছা পূরণ হলো না। কে কী মনে করবে জাতীয় অনাবশ্যক সংকোচ এখানেও। হাঁটতে হাঁটতে সোনালি আলোয় এই শহরের রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রহলাদকে ধন্যবাদ দিলাম আমাকে জাগিয়ে দেবার জন্য।
সকাল নয়টায় বনিথন হলে গিয়ে বসলাম। আজ দেখি কিছু স্ট্যান্ডফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও গরম আয়ত্ত্বে আসবে বলে মনে হয় না। আজকের প্লেনারি সেশানের বক্তৃতা দুটো মোটামুটি আকর্ষণীয়। প্রথমটির বক্তা ডক্টর অ্যালেন জোনস। ব্রিটেনের ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্সের চিফ এক্সজিকিউটিভ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর জন্য ব্রিটেনে এখন উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না শুনে চমকে উঠলাম। ব্রিটেনে বর্তমানে শতকরা ৬৬ ভাগ স্কুলে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য কোন শিক্ষক নেই। স্কুলে পদার্থবিজ্ঞান যারা পড়ান তাদের কোন ফিজিক্স ডিগ্রি নেই। সেসব শিক্ষকদেরও শতকরা ৭০ ভাগের বয়স এখন চল্লিশের ওপর। ব্রিটেন এখন চিন্তা করছে আগামী ২০ বছর পরে দেশের পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার কী অবস্থা হবে। এখন থেকেই সরকারিভাবে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়ে গেছে। আমি বাংলাদেশের পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থাটা একটু চিন্তা করেই ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
অধিবেশনের দ্বিতীয় বক্তা আমেরিকার ক্যানসাস ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডিন ঝলম্যান। মাথার কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুলগুলি বাদ দিলে পুরোটাই প্রফেসর শঙ্কু। তিনি বললেন কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে কীভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স শেখানো যায়। তাঁদের তৈরি প্রোগ্রাম ডিজাইন করা এবং তার প্রয়োগ করা আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলোর পক্ষেই সম্ভব। কারণ এই একটা প্রোগ্রামের খরচ আমাদের দেশে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সারা বছরের মোট বাজেটের চেয়ে বেশি।
সকাল এগারোটা থেকে প্যারালাল সেশান শুরু আজ। আমি চলে গেলাম ফিজিক্স বিল্ডিং-এ। সারাদিন কেটে গেলো নিউক্লিয়ার এন্ড পার্টিক্যাল ফিজিক্সের লেকচার শুনতে শুনতে।
রাত আটটায় পাবলিক লেকচার বনিথন হলে। পল ডেভিসের লেকচার। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে লোকের ভিড় শুরু হয়ে গেলো। কনফারেনসের ডেলিগেট হিসেবে আমরা ফ্রি টিকেট পেয়েছি। সাধারণের জন্য প্রবেশমূল্য বিশ ডলার। দশ বারো বছরের স্কুল স্টুডেন্ট থেকে শুরু করে হুইল চেয়ারে বসে আশি বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত এসেছেন পল ডেভিসের বক্তৃতা শুনতে।
আটটার আগেই বারোশ' সিটের বনিথন হল কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেলো। আমি মঞ্চের একদম কাছে বসেছি। আমার সারিতেই আশেপাশে বেশ কিছু স্কুলের ছাত্রছাত্রী। ছাত্রীরা বেশ সেজেগুঁজে এসেছে, বেশ উচ্ছল দেখাচ্ছে তাদের। সে তুলনায় ছাত্ররা একটু নিষ্প্রভ। একজন অ্যাকাডেমিকের বক্তৃতা শোনার জন্য লোকজন বিশ ডলারের টিকেট কেটে হলে ঢুকেছে যেখানে সিনেমার টিকেটের দাম মাত্র আট ডলার। আমাদের দেশে এখনো এরকম আশা করা যায় না।
অস্ট্রেলিয়ানরা ক্রমে ক্রমে বিশ্বসভায় তাদের জায়গা করে নিচ্ছে। সারা পৃথিবীর প্রতি ৩০০ জন মানুষের মধ্যে মাত্র একজন অস্ট্রেলিয়ান, অথচ পৃথিবীর প্রতি ১০০ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের মধ্যে দুটি প্রবন্ধের লেখক অস্ট্রেলিয়ান। আর বাংলাদেশ? জনসংখ্যার অনুপাতে পৃথিবীর চল্লিশজন মানুষের মধ্যে একজন বাংলাদেশী। জ্ঞান বিজ্ঞানে আমাদের অবদান কেমন? আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা? প্রশ্ন না করাই ভালো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লাল নীল সাদা গোলাপি রঙের শিক্ষকদের নানা রকম রাজনৈতিক বিবৃতি দিতেই তো সময় চলে যায়, গবেষণা করার সময় কোথায়?

প্রফেসর পল ডেভিস
ঠিক আটটায় মঞ্চে এলেন ডক্টর পল ডেভিস। পল ডেভিসকে আগে দেখেছি টেলিভিশনে। ভিডিওতে তাঁর ব্ল্যাকহোল বিষয়ক আলোচনা দেখেছি। আজ এতটা কাছ থেকে পল ডেভিসকে দেখে দারুণ ভালো লাগছে। দেখে মনেই হয় না তাঁর বয়স চুয়ান্ন। পৃথিবীবিখ্যাত লেখক, গবেষক, বক্তা এই পল ডেভিস। কসমোলজিতে প্রফেসর স্টিফেন হকিং এর মতোই জনপ্রিয়তা পল ডেভিসের। ব্রিটেন থেকে এসে এখন স্থায়ীভাবে বাস করছেন এডেলেইডে। অসংখ্য মেডেল পুরস্কার সম্মানে ভর্তি তাঁর ক্যারিয়ার। ২০০১ সালের ক্যাভেন্ডিস পুরষ্কার তাঁর হাতে তুলে দেয়ার জন্য আজই চলে এসেছেন পুরষ্কার কমিটির চেয়ারম্যান নিজে ব্রিটেন থেকে। ২০০১ সালের পুরস্কার ২০০০ সালেই দিয়ে দিলেন পল ডেভিসের হাতে। পুরস্কার দেয়ার সময় মজা করে বললেন, "এটা এক ধরণের টাইম ট্রাভেল।" শুনে সবাই হেসে উঠলো। কারণ পল ডেভিসের আজকের বক্তৃতার বিষয় ‘টাইম ট্রাভেল, ফ্যাক্ট অর ফিকশান?’
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিরস খটমটে বিষয়ও যে কতটা প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা যায়, তা পল ডেভিসের বক্তৃতা শুনে আবারো বুঝলাম। এই লেকচার বোঝার জন্য ফিজিক্সের জটিল জটিল সূত্র জানার কোন দরকারই নেই। কেবল প্রাকৃতিক নিয়মগুলো বুঝতে পারার মতো সাধারণ বোধ থাকলেই হলো। পুরো দু'ঘন্টা ধরে সম্মোহিত হয়ে বক্তৃতা শুনলো মানুষ। হলের ভেতরের গুমোট গরমেও মানুষ উৎকর্ণ হয়ে বসে থাকলো। মাঝে মাঝে পল ডেভিসের রসিকতায় হল কাঁপিয়ে হাসছিলো, পরক্ষণেই প্রসঙ্গ বদলের সাথে সাথে চুপ করে যাচ্ছিলো। বিজ্ঞানে রস সৃষ্টি করার ক্ষমতা সবার থাকে না। যাঁদের থাকে তাঁরা অসাধারণ, তারা জনপ্রিয়। পল ডেভিস দুটোই। বক্তৃতা শেষে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন প্রায় আধঘন্টা ধরে। এর পরে পড়লেন অটোগ্রাফ শিকারিদের খপ্পরে। হল থেকে বেরিয়ে এলাম অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে।

______________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ছবিগুলো বইতে প্রকাশিত হয়নি।


Sunday 25 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ৪র্থ পর্ব



ইউনিভার্সিটি অব এডেলেইডের সবচেয়ে বড় অডিটোরিয়াম বনিথন হল। এই হলেই কনফারেনসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সকাল সোয়া আটটার ভেতর হলের সামনে এসে গেছি। আস্তে আস্তে এসে পড়ছে সবাই। যার সাথে চোখাচোখি হচ্ছে সেই মৃদু করে ‘হাই’ বলছে বা মিষ্টি করে হাসছে। অস্ট্রেলিয়ানদের এই মিশুকে স্বভাব সর্বজনবিদিত। প্রাচীন এই হলটিতে বারো শ’ মানুষ বসতে পারে একসাথে। হলের বাইরের দেয়াল পুরোনো কালের স্বাক্ষীস্বরূপ হলুদাভ পাথরের তৈরি। ভেতরটা কারুকার্যময়। সোনালি রঙের নানারকম নকশা ছাঁদ পর্যন্ত বিস্তৃত।

মেঝেতে সারি সারি কাঠের চেয়ার পাতা। দেখলে মনে হয় ভাড়া করে আনা হয়েছে এগুলো। একদিকে স্টেজ। স্টেজটা খোলামেলা, কিন্তু হলের তুলনায় বেশ ছোট। দু’পাশের দেয়ালে এডেলেইড ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন চ্যান্সেলরদের বড় বড় তৈলচিত্র। এঁরা সবাই সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এডেলেইড ইউনিভার্সিটির নিয়ম অনুযায়ী সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বিচারপতিই পদাধিকার বলে ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর হয়ে থাকেন।

বনিথন হল

হলটা বাইরে থেকে দেখতে যতটা সুন্দর লাগে, ভেতরে ঢোকার পরে হলের সীমাবদ্ধতা দেখে ততটাই হতাশ হলাম। কারণ হলটাতে শব্দ, আলো, তাপ এই অতি প্রয়োজনীয় তিনটি বিষয়ের কোনটার ওপরই কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। শহরের একটি প্রধান সড়কের ঠিক পাশে হওয়াতে গাড়ি চলাচলের শব্দ সরাসরি হলের ভেতর চলে আসে। অস্ট্রেলিয়ার কোথাও গাড়ির হর্ন সাধারণত কেউ বাজায় না বলে কিছুটা রক্ষা। সূর্যালোক হলের জানালা ভেদ করে সরাসরি হলে ঢুকে পড়ছে। জানালায় ভারী পর্দার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তাতে তেমন কাজ হচ্ছে না। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির আধুনিক অডিটোরিয়ামগুলোর সাথে পরিচয় না থাকলে এই বনিথন হলটাকেই একটা সুপারহল বলে মনে হতো।

মঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে একটা চেয়ার দখল করে বসলাম। আস্তে আস্তে হল ভরে যাচ্ছে নানা জায়গা থেকে আসা ছোট বড় ফিজিসিস্টে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত উদ্বোধনী সেশানের সভাপতি প্রফেসর টনি থমাস। এডেলেইড ইউনিভার্সিটির থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের জাঁদরেল প্রফেসর। গড়পড়তা অস্ট্রেলিয়ানদের উচ্চতার সাথে তুলনা করলে তাঁকে বেঁটে বলা যায়। তাঁর গোলগাল মুখটা দেখলে মনে হয় এখনো ছেলেমানুষ। এই মানুষটা সাব-অ্যাটমিক ফিজিক্সের একজন দিকপাল। এবছর হ্যারি ম্যাসে পুরস্কার পেয়েছেন থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের গবেষণায় অনন্য অবদান রাখার জন্য।

ঘড়ির কাঁটার প্রতি সম্মান দেখানো এখানে নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ঠিক সাড়ে আটটায় সূচনা বক্তৃতা দিলেন অস্টেলিয়ান ইনস্টিউট অব ফিজিক্স-এর প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডন পিলব্রাউ। ভদ্রলোকের স্মার্টনেস দেখার মতো। দশ মিনিটের ছোট্ট নিটোল ভাষণ।

আটটা দশ মিনিটে ওয়েল-কাম স্পিচ দিলেন ডি-এস-টি-ও’র ডিরেক্টর মিস্টার নেইল ব্রায়ানস। গোঁফবিহীন দাড়িতে ভদ্রলোককে দেখতে একটুখানি আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো লাগে। ডি-এস-টি-ও হলো অস্ট্রেলিয়ান ডিফেনস সায়েনস এন্ড টেকনোলজি অর্গানাইজেশান; অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কেনের প্রাক্তন ছাত্র ডক্টর পিটার ডরটসম্যান এখন ডি-এস-টি-ও’র লেফটেনেন্ট কর্নেল। ডি-এস-টি-ওএই কনফারেনসের প্রধান স্পনসর।

মিস্টার নেইলের ভাষণের পরেই ঘোষণা মতো দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। বেজে উঠলো অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় সংগীতের সুর। হলে প্রবেশ করলেন সাউথ অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর স্যার এরিখ নীল। তিনি এসে বসলেন না কোথাও। সরাসরি ডায়াসে চলে গেলেন। কনফারেনসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করলেন তিনি। তাঁর ভাষণ খুব সুন্দর বা বলা উচিত তাঁর যে সহকারী এই ভাষণটি রচনা করেছেন তিনি খুব খেটেখুটে তৈরি করেছেন এটা। বিজ্ঞানের ছাত্র নন বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন গভর্নর, কিন্তু তিনি যে সমস্ত তথ্য দিলেন সাউথ অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে তা আসলেই দরকারি।

১৮৩৯ সালে এডেলেইড শহরের গোড়াপত্তন হয়। অবশ্য তার আগে থেকেই প্রস্তুতি চলছিলো এই সাউথ অস্ট্রেলিয়ান স্টেট প্রতিষ্ঠার। সাউথ অস্ট্রেলিয়া হলো অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র স্টেট যেখানে কোন ধরনের কয়েদিকে এনে রাখা হয়নি ব্রিটেন থেকে। ১৮৩৪ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়া অ্যাক্ট বা ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট পাস হয়। সেখানে পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয় যে এই অঞ্চলে কোন ধরনের সাজা প্রাপ্ত আসামিকে এনে রাখা হবে না। সে হিসেবে বলা চলে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার আদি অভিবাসীরা অপরাধী ছিলেন না। অস্টেলিয়ান আদিবাসিদের অ্যাবোরিজিনাল বলা হয়। তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের অংশবিশেষ যখন তখনো বেঁচে আছে তখন তাদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রথমেই এগিয়ে এলো সাউথ অস্ট্রেলিয়া। ১৮৩৬ সালে আদিবাসিদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে আইন পাস করা হয় এখানে।

১৮৩৭ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়াতেই প্রতিষ্ঠিত হয় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সুপ্রিমকোর্ট। এর ধারাবাহিকতায় পরের বছর এখানেই গঠিত হয় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম পুলিশ ফোর্স। ১৮৪০ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা গঠিত হয় সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় আর তখন থেকেই শুরু হয় সরাসরি নির্বাচন প্রথা। অস্ট্রেলিয়াকে আধুনিক অস্ট্রেলিয়ায় পরিণত করার পেছনে যত ধরনের আধুনিক ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়েছে তার বেশির ভাগই শুরু হয়েছে সাউথ অস্ট্রেলিয়া থেকে।

আদিবাসিদের দেয়া কোন ধরণের সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণ করা হতো না অস্ট্রেলিয়ায়। এই অমানবিক ব্যবস্থা বিলোপ করতে এগিয়ে এলো সাউথ অস্ট্রেলিয়া। ১৮৪৪ সালে আইন পাস করে  আদালতে আদিবাসিদের সাক্ষ্য দেবার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হলো।

ধর্মের সাথে রাষ্ট্রক্ষমতার একটা সংযোগ অনেক দিন থেকেই আছে, কিন্তু এই সংযোগ থাকার দরুণ চার্চের অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবস্থায় নাক গলানো বন্ধ করা যাচ্ছিলো না। কাজটা করার সাহস দেখালো সাউথ অস্ট্রেলিয়ার মানুষ। ১৮৫১ সালে এক যুগান্তকারী আইন পাস হয়, ব্রিটিশ রাজত্বে এই ধরণের আইন এই প্রথম। রাষ্ট্র আর চার্চের মধ্যে সংযোগ কেটে দেয়া হয়। চার্চের আর কোন ক্ষমতা থাকলো না রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় নাক গলানোর।

ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য সর্বকালীন। সে সময় অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন প্রথা চালু থাকলেও দেখা গেলো যাদের জমি আছে তারাই কেবল ভোট দিতে পারেন। আবার যাদের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় জমি আছে তারা বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ভোট দেবার অধিকারী হচ্ছে। এ ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক। ১৮৫৬ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়াতেই প্রথম চালু করা হয় ‘একজনের এক ভোট’ ব্যবস্থা। সাউথ অস্ট্রেলিয়াই হলো অস্ট্রেলিয়ার প্রথম স্টেট যেখান থেকে আধুনিক নির্বাচন পদ্ধতি, গোপন ব্যালট সিস্টেম চালু করা হয়।

সবার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে এগিয়ে এলো সাউথ অস্ট্রেলিয়া। ১৮৭৫ সালে সাত থেকে তের বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল  শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। পরে ১৯১৫ সালে বয়সের সীমা এক বছর বাড়িয়ে সাত থেকে চৌদ্দ করা হয়।

১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ রাজত্বে প্রথমবারের মতো ট্রেড ইউনিয়ন করাটাকে আইনসিদ্ধ করা হয় সাউথ অস্ট্রেলিয়ায়।

মেয়েদের প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ভূমিকা অসীম। মেয়েদের ভোট দেবার অধিকার প্রদান করার ব্যাপারে এগিয়ে আসে সাউথ অস্ট্রেলিয়া। একবারে সব মেয়ের জন্যই ভোটের অধিকার প্রদান সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছে সেই ব্যবস্থার দিকে। ১৮৭৬ সালে  সম্পদশালী মহিলাদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। তখনো মেয়েরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার পায়নি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো বিশ বছর। ১৮৯৬ সালে সব প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাই ভোট দেবার অধিকার পায়। অথচ আমেরিকায় মেয়েরা ভোটাধিকার পেয়েছে আরো অনেক পরে- ১৯২০ সালে। ক্যাথেরিন হেলেন স্পেনস হলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম মহিলা যিনি ভোটে রাজনৈতিক প্রার্থী হয়েছিলেন সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় ১৮৯৭ সালে।

মেয়েদের শিক্ষার জন্য সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অবদান অপরিসীম। ১৮৭৯ সালে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় মেয়েদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রথম মাধ্যমিক স্কুল। ইউনিভার্সিটি অব এডেলেইড হলো অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইউনিভার্সিটি যেখানে মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম মহিলা স্নাতক হলেন এডিথ ডর্নওয়েল। ইউনিভার্সিটি অব এডেলেইড থেকে বি-এস-সি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি ১৮৮০ সালে। ১৯১৫ সালে এই এডেলেইডেই প্রথমবারের মতো মহিলা পুলিশ নিয়োগ করা হয় পুরুষদের সমান দায়িত্বে আর সমান বেতনে।

সাউথ অস্ট্রেলিয়ার মেয়ে ডেইম রোমা মিশেল অস্ট্রেলিয়ান মেয়েদের জন্য একজন আইকন। ১৯৬২ সালে তিনি মহারানির প্রথম মহিলা কাউন্সেলর নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি সুপ্রিম কোটের বিচারক পদে নিয়োগ পান, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে প্রথম মহিলা বিচারক। ১৯৮৩ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বিচারপতি হন তিনি আর পদাধিকার বলে এডেলেইড ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি আর চ্যান্সেলর।

শুনতে শুনতে চোখ চলে গেলো ডান পাশের দেয়ালে। সেখানে অন্য সব চ্যান্সেলরের সাথে রোমা মিশেলের তৈলচিত্রও রাখা আছে। ১৯৯১ সালে মিশেল স্টেট গভর্নর নিযুক্ত হন। তাঁর আগে আর কোন মহিলা এই পদে আসীন হননি। ধন্য সাউথ অস্ট্রেলিয়া।

অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসিরা পিছিয়ে আছে সবদিক থেকে। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেন স্যার পিটার ডগলাস নিকোলাস। আদিবাসি সমাজের স্যার ডগলাস সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন এবং এডেলেইড ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর। ১৯৭৬ সালে তিনি স্টেট গভর্নর হয়েছিলেন। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো একটা বৈপ্লবিক স্থানে এসেছি আজ। একটি জাতি গঠনে এই দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার গুরুত্ব অসীম।

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিয়ার নাকি পৃথিবীবিখ্যাত। এই বিয়ার পান করার আমন্ত্রণ জানিয়ে ভাষণ শেষ করলেন গভর্নর। ভাষণ শেষ করে তিনি আর বসলেন না। জাতীয় সঙ্গীতের সুরের সাথে পা ফেলে চলে গেলেন হলের বাইরে। গভর্নরের পদ সাংবিধানিক পদ, আর ক্ষমতাও আঁচ করা যায় যেখানে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে তাঁর আসা যাওয়া।

সকাল নয়টায় শুরু হলো প্রথম প্লেনারি সেশান। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জন ব্যারো বিশ্বব্রহ্মান্ডের উৎস সম্পর্কে বললেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রফেসর জন ব্যারো পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তি। কসমোলজি বিষয়ে তাঁর বেশ কিছু বই আছে। ‘থিওরি অব এভরিথিং’, ‘ইম্পসিবিলিটি’, ‘বিটুইন ইনার স্পেস এন্ড আউটার স্পেস’, ‘দি অরিজিন অব দ্যা ইউনিভার্স’, ‘দি বুক অব নাথিং’ ইত্যাদি বিখ্যাত সব বইয়ের লেখক তিনি। বাংলাদেশে থাকতে ব্রিটিশ কাউন্সিলে তাঁর ‘থিওরি অব এভরিথিং’ বইটার পাতা উলটে দেখেছিলাম। তখন ভাবিনি যে একদিন এই মানুষের সামনে বসে কথা শোনার সুযোগ পাবো। এখন জন ব্যারোর বক্তৃতা শুনছি মাত্র কয়েক হাত দূরে বসে, ভাবতেই বেশ গর্ব অনুভব করছি।

প্রথম অধিবেশনের শেষ লেকচার দিলেন ডক্টর মাইক কেলি; আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। হলের ভেতর প্রচন্ড গরম, শব্দ অনিয়ন্ত্রিত। ভালো লাগছে না আর। মঞ্চের এত সামনে এসে বসাতে বের হয়ে যেতেও পারছি না। আশেপাশে তাকাচ্ছি। আমার সামনের সারিতে বসা একটা মোটা মেয়ে সেলাই কাজ শুরু করেছে। বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর বক্তৃতা শুনতে শুনতে সেলাই করার কথা আমি ভাবতেও পারি না। কিন্তু বেশ দক্ষতায় হাত চলছে মেয়েটার। ডক্টর কেলি নিশ্চয় দেখছেন মেয়েটা কি করছে। কেমন লাগছে প্রফেসর কেলির? তাঁর ক্লাসে কোন ছাত্র বা ছাত্রী এরকম করলে তিনি নিশ্চয় ক্লাস থেকে বের করে দিতেন তাকে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম অনেকে বেশ উৎকর্ণ হয়ে শুনছে প্রফেসরের লেকচার। আবার কেউ কেউ কনফারেন্স হ্যান্ডবুক বের করে পাতা উল্টাচ্ছে।

প্লেনারি সেশানের মূল থিম হওয়া উচিত ফিজিক্সের সব শাখার উপযোগী। কিছুটা কমন প্রোবলেম বিষয়ক বা পপুলার সায়েন্স টাইপ। আমার প্ল্যান ছিলো প্লেনারি সেশানের সবগুলো লেকচার শুনবো। এখন সে প্ল্যান বাতিল করতে হলো। যে লেকচার আমি উপভোগ বা হজম করতে পারবো না সেখানে এসে বসে থাকার মানে হয় না। বুঝতে পারছি এজন্যই কেন্‌ বলেন, 'একসাথে সব বিষয়ে জানতে চাইলে কোন বিষয়ই ভালো করে জানতে পারবে না'।

সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত চা বিরতি। ইউনিয়ন হাউজের প্রথম, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় চা, কফি, বিস্কুট রাখা আছে। সাত-আটশ' মানুষের জন্য সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে কফি বা চা বানিয়ে নাও, চা-বিস্কুট নিয়ে বসে পড়ো গাছের ছায়ায়, ঘরের ভিতর, বাইরের রোদে যেখানে খুশি।

চারতলায় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী চলছে। চায়ের কাপ হাতে ঘুরে ঘুরে সেসব দেখা যায়। খাবার শেষে কাপ ডিস ঘরের ভেতর নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে এলেই হলো। উচ্ছিষ্টটুকু বিনে ফেলে দেয়ার জন্য অনেক বিন রাখা আছে আশেপাশে। যার কাজ সে করছে। কোথাও কোন সমস্যা নেই, জটলা নেই। এক্সট্রা কোন লোকেরও দরকার হচ্ছে না তেমন।

কালো কফি আর একমুঠো বিস্কুট নিয়ে ইউনিয়ন হাউজের পাশের বারান্দায় বেরোতেই সমস্বরে আহবান, "হাই প্রাডিব, কাম হিয়ার।"

দেখলাম জন, এরিখ আর ট্যান বসে বসে চা খাচ্ছে চারজনের একটা টেবিলে। আমি এগিয়ে গেলাম। জন লী আর ট্যান ল্যাং দুজনেই চায়নিজ। জন এখন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। মেলবোর্নে আমাদের স্কুলেই অপটিকস গ্রুপে পিএইচডি করছে। তাকে দেখে বোঝা যায় না যে তার একটা আঠারো বছরের মেয়ে আছে। ডক্টর ট্যান ল্যাং বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এসোসিয়েট প্রফেসর। কিন্তু তাঁকে দেখতে মনে হয় বাইশ তেইশ বছরের দুরন্ত মেয়ে। তিনি এখন মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে অপটিকস গ্রুপে পোষ্টডক্টরেট করছেন। এরিখ এম্পেম লেসেন ঘানার ছেলে। সেও মেলবোর্নের অপটিকস গ্রুপের পিএইচডি স্টুডেন্ট। পারস্পরিক খোঁজখবর নিলাম। এরিখ উঠেছে মেলবোর্ন স্ট্রিটের একটি বাসায়। এডেলেইডে এসেও মেলবোর্নের মায়া কাটাতে পারছে না বলে কিছুক্ষণ ঠাট্টা তামাশা করলাম সবাই মিলে। বাসার ব্যবস্থা নাকি অতি চমৎকার। এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ, মাইক্রোওভেন যেখানে যা লাগে। এরিখ খুব খুশি এ সমস্ত উপাদান পেয়ে।

প্লেনারি সেশানে আমি আর যাচ্ছি না শুনে এরাও আর না যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। আড্ডা জমে উঠলো। কীভাবে যেন সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ এ সমস্ত বিষয় চলে এলো আলোচনায়। আসলে সবাই বিদেশী হলে সম্ভবত এ সমস্ত বিষয়ে মন খুলে কথা বলা যায়। বর্ণবাদ বিষয়ে এরিখের অভিজ্ঞতা আমাদের সবার চেয়ে বেশি। সে বললো, "বর্ণবাদ তো তোমরা কিছুই দেখোনি। দেখেছি আমি, আমরা, আফ্রিকান কালোরা।"

সে যা বললো তার কিছু কিছু আমারও চোখে পড়েছে মেলবোর্নে। মালটিকালচারালিজমে মেলবোর্ন এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য স্টেট থেকে। এই মেলবোর্নেও আমি দেখেছি ট্রামে বা ট্রেনে কালো মানুষদের পাশে কোন সাদা অস্ট্রেলিয়ান বসতে চায় না। বিশেষ করে কোন বুড়ো অস্ট্রেলিয়ান। আর কোন কালোমানুষকে পাশে বসতে দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।

এরিখ বলছে, "আমার তো সুবিধাই তাতে। আমার পাশে কেউ ভীড় করে না, আমাকে ধাক্কা খেতে হয় না। আবার পাশে কেউ না বসলে আরামে দুটো সিট নিয়ে বসে যেতে পারি আমি।"

আমি বুঝতে চেষ্টা করছি এরিখের ভেতরের যন্ত্রণাটা। অন্যের নীরব অবহেলা যে মানুষকে কেমন কষ্ট দেয় তা কিছুটা হলেও তো বুঝি আমি। এরিখ আরো যা জানালো তা আমার কাছেও নতুন ।

"ঘানায় আমার নিজের দেশেও আমরা কালোরা অবহেলিত তা জানো? আমার নিজের দেশের কালো ট্যাক্সিওয়ালারা কালোদের নামিয়ে দিয়ে সাদাদের সামনের সিটে বসতে দেয়। ভেতরে ভেতরে আমরা এখনো ক্রীতদাস রয়ে গেছি।"

এরিখের ছোট ছোট চোখগুলো টকটকে লাল। স্বাভাবিকভাবেই হয়তো লাল থাকে সে দু’টো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সেখানে আগুন জ্বলছে। মনে পড়ছে ‘রুটস’-এর কুন্টা কিন্টের কথা। এরিখের মনটা আর খারাপ হতে দিলাম না। বললাম, "চলো ঘুরতে যাই।"

ট্যান আর জন তৎক্ষণাৎ রাজি। কিন্তু এরিখ রাজি হলো না। সে বাসায় চলে যাবে। কারণ পরদিন তার টক। আমার নিজের বক্তৃতা কনফারেনসের শেষের দিন। সুতরাং আমি এখনো রিলাক্সড।

ভিক্টোরিয়া ড্রাইভ পার হলেই টরেনস নদী। তার উপর ফুটব্রিজ। লোহার রেলিং ধরে দাঁড়ালে নিচের স্বচ্ছ পানিতে প্রতিবিম্ব দেখা যায়। ছোট্ট নদী, তিরতির করে বয়ে চলেছে শান্ত স্রোত। মনে হচ্ছে পাহাড় ধোয়া জল। নদীর পাড়ে যত্নে বর্ধিত ফুলের বাগান।

জনের সাথে টরেন্স নদীর উপরের ব্রিজে


জনের ছবি তোলার শখটা বাতিকের পর্যায়ে পড়ে। যা-ই দেখে তার পাশে দাঁড়িয়েই ছবি তুলতে চায়। পার্কে রাখা ডাস্টবিনের পাশে দাঁড়িয়েও একটা ছবি তোলা হয়ে গেছে তার। ক্যামেরা নিয়ে তার পিছু পিছু অনেক ঘুরতে হলো, অনেক ছবি তুলে দিতে হলো।

জনের সাথে

ডক্টর ট্যান ল্যাং-এর সাথে

ডক্টর ট্যান ল্যাং-এর সাথে

নদীর ওপারে সুন্দর সবুজ ঘাস, ফুলের বাগান, পার্ক। অদ্ভুত সুন্দর। নদীর দু’পাড়ে ফুলের গাছ, নানারকম ফুল ফুটে আছে সেখানে। হাঁটতে হাঁটতে এডেলেইড ওভালের কাছে চলে এলাম। এডেলেইডের ক্রিকেট স্টেডিয়াম, বিশ্ববিখ্যাত এডেলেইড ওভাল। শুক্রবার থেকে সেখানে শুরু হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট ক্রিকেট।


এডেলেইড কনভেনশান সেন্টার


এডেলেইড ওভালের পাশ দিয়ে চলে গেছে বিরাট রাস্তা। নদীর ওপর বিরাট ব্রিজ। এডেলেইড ফেস্টিভ্যাল সেন্টার ডানে রেখে রাস্তাটা সোজা গিয়ে মিলেছে মূল সিটিতে। এডেলেইড ফেস্টিভ্যাল সেন্টারটা চমৎকার। মেলবোর্ন আর্ট সেন্টারের মতো অতটা বড় নয় ঠিকই, তবে আকর্ষণীয়। বিশেষ করে নদীর ধারের ফুলের বাগানটা।



এডেলেইডকে আগে বলা হতো ‘সিটি অব চার্চ’, এখন বলা হয় ‘ফেস্টিভ্যাল সিটি’। ফেস্টিভ্যাল সেন্টারের মুখোমুখি রাস্তার ওপারে গভর্নমেন্ট হাউজ। বাগানের পর বাগান দিয়ে ঘেরা। দেখতে দেখতে ফিরে এলাম ইউনিয়ন হাউজে। সাড়ে বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত লাঞ্চ।

লাঞ্চের ব্যবস্থা চার জায়গায় করা আছে। যেরকম ভিড় হবে আশা করেছিলাম সেরকম কোন ভিড় হলো না। আটশ লোক লাঞ্চ করলো দেড় ঘন্টা সময়ের ভেতর। অথচ কোন বিশৃঙ্খলা বা কোলাহল বা ঠেলাঠেলি কিছুই হলো না। কয়েক রকম স্যান্ডুইচ, ফ্রুটস, সালাদ আর অরেঞ্জ জুস। যার যা খুশি যত খুশি নিয়ে নিয়ে খাও। কথা বলতে বলতে এরা যে কি পরিমাণে খেতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি একটা স্যান্ডুইচ শেষ করতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে ক্ষুদ্রাকৃতির ট্যান পর্যন্ত আড়াইটা চিকেন স্যান্ডুইচ শেষ করে ফেলেছে।

দুপুর দুটো থেকে আটটি অধিবেশন একই সময়ে শুরু হলো আটটি অডিটোরিয়ামে। যার যার পছন্দ মতো সেশানে গেলেই হলো। আমি নিউক্লিয়ার ও পার্টিক্যাল ফিজিক্সের সেশানে যোগ দিলাম। এই সেশান হচ্ছে ফিজিক্স বিল্ডিং এর কের গ্রান্ট অডিটোরিয়ামে। এই অডিটোরিয়ামটি দারুণ। শব্দ আলো তাপ নিয়ন্ত্রিত।

প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ডক্টর অ্যান্ড্রু সাছবেরি। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রফেসর আর নিউক্লিয়ার এন্ড পার্টিক্যাল ফিজিক্স সেকশানের আহবায়ক। প্রথম লেকচারটি দিলেন মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির এসোসিয়েট প্রফেসর মার্টিন সেভিয়ের। হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরে এসেছেন মার্টিন। বোঝা গেলো কনফারেনসে আর যাই হোক, পোশাক নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। এখানে তুমি কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেখাচ্ছো সেটাই বড় কথা, কী পোশাক পরে এসেছো হু কেয়ারস? অস্ট্রেলিয়ার বাইরে থেকে যারা এসেছেন দেখা যাচ্ছে স্যুট পরে এসেছেন। আর ঘরের কাছে যারা, তারা আটপৌরে পোশাকে। অস্ট্রেলিয়ার সবখানেই এরকম ক্যাজুয়েল পোশাক চলে। পোশাক এখানে আলাদা করে কোন ওজন বাড়ায় না। শেখ সাদী এখানে এলে খুব খুশি হতেন নিশ্চয়।

ইয়াসনাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে। ইয়াসনা দ্রাগিগ। শ্রীলংকান নাম মনে হলেও সে অস্ট্রেলিয়ায় জন্মেছে। অস্ট্রলিয়ানদের সাথে তার যতটা মিল শ্রীলংকানদের সাথে তার ততটাই অমিল। এমনকি তার গায়ের রঙও সাদার কাছাকাছি। আমি তাকে যাসনা এবং মাঝে মাঝে জোছনা বলেও ডাকি। সে কিছু মনে করে না। বেচারী ঘন ঘন পানি খাচ্ছে। অথচ আমি জানি একটু পরে যখন সে বক্তৃতা দিতে উঠবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

আমার সামনের সিটে বসেছেন ডক্টর অঞ্জলি মুখার্জী। তাঁর পাশে মোটা অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটি। এখানেও তার সুঁই চলছে সমানে। অঞ্জলি পেছন ফিরে দেখলেন আমাকে। আর আমাকে অবাক করে দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন পাশের মোটা মেয়েটির সাথে। নাম রাসেল বাট। রাসেল আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা সামান্য হাসি হাসি করার চেষ্টা করলো, কিন্তু খুব বেশি গোল মুখে হয়তো সব অভিব্যক্তি ভালোভাবে ফোটে না। হাত বাড়ানোর নিয়ম থাকলেও রাসেল তার সুচিকর্ম একটুক্ষণের জন্যও থামানোর কোন লক্ষণ দেখালো না। ফলে পরিচয় পর্ব খুব একটা জমলো না।

নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের বেশির ভাগ বক্তৃতাই দেখা যাচ্ছে হয় এক্সপেরিমেন্টাল নয়তো হাই এনার্জি ফিজিক্সের থিওরি। আমি যে ফিল্ডে কাজ করছি, নিউক্লিয়ন-নিউক্লিয়াস, খুব একটা নেই। ধরতে গেলে আমি একা এই ফিল্ডে। কারণ আমার কাজের জন্য যে ধরনের রিঅ্যাক্টর দরকার সে ধরনের রিঅ্যাক্টর এখনো নেই অস্ট্রেলিয়ায়। আমরা ডাটার জন্য নির্ভর করি আমেরিকা, জাপান, জার্মানি বা ফ্রান্সের ওপর। পাঁচটায় অধিবেশন শেষ হলো ।

সন্ধ্যা সাতটায় নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের রিসেপশান ইউনিয়ন বিল্ডিং-এর ছয়তলায়। এই রিসেপশানের অর্থ হলো খাদ্য ও পানীয়ের বিপুল সরবরাহ ও লাগামহীন আড্ডা। মেলবোর্ন গ্রুপের সাথে আড্ডা দিতে দিতে প্রায় সাড়ে আটটা বাজলো। র্যা ছেল, ম্যাট, ক্রেগ সবাই মিলে ইয়াসনার ‘ফ্রি’ হয়ে যাওয়া সেলিব্রেট করছে। বক্তৃতা শেষ হয়ে যাওয়া মানে মুক্ত পাখি। বিয়ারের বোতল সবার হাতে। আমার অবস্থা দশ চক্রে ভগবান ভূতের মতো। টয়লেটের নাম করে সোজা নিচে চলে এলাম। অর্থহীন হৈ চৈ আমিও কম করি না, কিন্তু এখন কেমন যেন ভালো লাগছে না।

টরেন্‌স নদীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম একা একা। নির্জন পথ। চলে গেছে ক্রমশ গভীর অরণ্যের দিকে। আমি হাঁটছি। জঙ্গল যে এত সুন্দর তা অনেক দিন পরে দেখলাম আবার। সূর্য ডোবার আগে যেটুকু লাল ঢেলে দেয় তার সবটুকুই যেন ছড়িয়ে পড়েছে গাছের মাথায় মাথায় পাতায় পাতায়। বিভূতিভূষণের কথা মনে পড়ছে আমার। আচ্ছা অস্ট্রেলিয়ানদের কি বিভূতিভূষণ আছে? আছে হয়তো। এমন অরণ্য যেখানে আছে সেখানে একজনও কি বিভূতিভূষণ তৈরি হয়নি?

প্রচুর পাখি দেখা যাচ্ছে। নানা রঙের পাখি, নানা সুরে ডাক দেয়া পাখি। বায়নোকুলার দিয়ে কিছুক্ষণ পাখি দেখলাম। এতপাখি এখানে এলো কোত্থেকে?

ক্রমশ আঁধার নেমে এলো। আঁধারের একটা সীমানা পর্যন্ত আমাদের চোখ যায়, তারপরে আঁধারকে ভালো লাগার পরিবর্তে ভয় লাগে। ফিরে আসার পথ ধরলাম।

হোস্টেলে ঢোকার মুখে জিনকে দেখলাম লবিতে বসে আছে চুপচাপ। আমাকে দেখে হাই বললো। আমিও ‘হাই’ বলে দ্রুত লিফটে উঠে গেলাম। লিফট উপরে উঠতে শুরু করার পরে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেলো। জিনকে আমি এড়িয়ে চলতে চাইছি কেন? লিফটে ওঠার জন্য এতটা ব্যস্ততা দেখানোর কোন দরকার ছিলো কি?


______
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ছবিগুলো বইতে প্রকাশিত হয়নি।



Saturday 24 November 2018

এডেলেইডে সাত দিন - ৩য় পর্ব



বিছানায় একটু বিশ্রাম নেবার জন্য শুয়ে উঠলাম দেড় ঘন্টা পর। ঘড়িতে বাজে পাঁচটা। জিন্‌স আর টি-শার্ট পরে শুয়েছিলাম। কনফারেন্‌সে এই পোশাকে যাওয়া চলে না। যতই এদেশে পোশাক সম্পর্কে উদাসীনতা থাকুক না কেন- কনফারেন্‌সে নিশ্চয় সবাই বেশ ভদ্র পোশাকে আসবে। আমিও ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট বের করে জুতো জোড়া আরো চকচকে করে মচমচ করে বেরুলাম।
ঠিক কোথায় যেতে হবে তা সকালে এসে চিনে গিয়েছিলাম। এর মধ্যেই ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন টার্নিং পয়েন্টে কনফারেন্সের ম্যাপ সেঁটে দেয়া হয়েছে। একজন আনাড়িও তীরচিহ্ন অনুসরণ করে পৌঁছে যেতে পারবে গন্তব্যে। আমাকে যেতে হবে ইউনিয়ন বিল্ডিংএর নিচের তলায়।


এডেলেইড ইউনিভার্সিটিটি বেশ কয়েকটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। ইউনিয়ন বিল্ডিংটি একটি পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে। ফলে নিচের তলাটা হলো পাহাড়ের নিচে। সিড়ি দিয়ে নামতে হয়। আর ইউনিয়ন বিল্ডিংএর চারতলা আর পাঁচতলায় পাহাড়ের উপর দিয়ে সরাসরি ঢোকা যায়। ফিজিক্স বিল্ডিংটা পাহাড়ের উপরে। ফলে ফিজিক্স বিল্ডিং-এর নিচের তলা ইউনিয়ন বিল্ডিং-এর ছয়তলার সমতলে।
ফিজিক্স বিল্ডিংএর দিক থেকে নিচের দিকে নামছি। প্রশস্ত লাল সিঁড়ি। মাঝপথে দেখা হয়ে গেলো মেলবোর্ন গ্রুপের সাথে। ওরে বাপুরে! সবাই দেখি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে চলে এসেছে। কনফারেন্‌সের পোশাকের মর্যাদা রক্ষার সমস্ত দায়দায়িত্ব দেখি আমিই ঘাড়ে তুলে নিয়েছি। তাদের হাতে কনফারেনস ব্যাগ। তার মানে তারা রেজিস্ট্রেশন ডেস্কের কাজ সেরে ফেলেছে।
পার্টিক্যাল ফিজিক্সের ছাত্রী র‍্যাছেলের চেহারার সাথে এক্স-ফাইলের স্ক্যালির চেহারার মিল আছে। সেটা আমাদের সাথে সাথে র‍্যাছেলও জানে। তাই তার চলনে বলনে একটু বেশি রকমের স্মার্টনেস দেখা যায় সব সময়। এখন সে যেটা পরে আছে সেটাকে হাফপ্যান্ট বলা চলে না, সেটা বড়জোর কোয়ার্টার প্যান্ট। আর গায়ে সেরকমই সংক্ষিপ্ত একটা গেঞ্জি। প্লেনে এসেছে এরা। এই পোশাকেই কি তারা প্লেনে বসেছিলো? কে জানে। র‍্যাছেলের সাথে চোখাচোখি হতেই সে বললো, "প্রাডিব, কফি খেতে যাবে?"
"না, আমার রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি এখনো।"
"তাহলে তুমি নিচে যাও। সেখানেই থেকো, আমরা কফি খেয়েই চলে আসবো।"
নিচে নামতেই দেখা হলো প্রফেসর স্টুয়ার্ট টোভির সাথে। ভদ্রলোক নামকরা এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট। কেমব্রিজ থেকে পিএইচডি করে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে চুল পাকিয়েছেন। তিনিও দেখি হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি আর চপ্পল পরে চলে এসেছেন। নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছে এখন। আর সবার পোশাক দেখেই হয়তো খুব গরম লাগতে শুরু করেছে আমার।
ইউনিয়ন বিল্ডিংএর নিচের তলায় রেজিস্ট্রেশন ডেস্ক। পেছনে কনফারেনসের ব্যাগের বিরাট পাহাড় নিয়ে বসে আছে পাঁচজন অল্পবয়সী মেয়ে - রেজিস্ট্রেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট। ডেস্ক নম্বর-ওয়ানে কাউন্টার এ থেকে ডি। ‘এ’ থেকে ‘ডি’ মানে হলো নামের পদবীর আদ্যাক্ষর। আগে আমি পদবীটাকে নামের সাথে ঝুলে থাকা অপ্রয়োজনীয় লেজ মনে করতাম। দেশের বাইরে এসে দেখি অফিসিয়ালি সবাই এই লেজ ধরেই টানাটানি করে। তবে ইনফরমালি অস্ট্রেলিয়াতে সবাই সবাইকে নাম ধরেই ডাকে। যেমন প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ডকেও মিস্টার হাওয়ার্ডের বদলে জন বা জনি বলে ডাকা যায়।
আমার কনফারেনস ব্যাগ পেয়ে গেলাম। ব্যাগের ভেতর রাজ্যের কাগজপত্র ঠাসা। নেমট্যাগ- যা বুকে লাগিয়ে রাখতে হবে কনফারেনসের সবটুকু সময় ধরে। তাতে সুবিধা এই- কাউকে আর ঘটা করে নিজের নাম, কোন্‌ ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছি এসব বলতে হবে না।
কনফারেনস হ্যান্ডবুকে প্রত্যেকটি বক্তৃতা আর ইভেন্ট এর সময়সূচি সুনির্দিষ্টভাবে দেয়া আছে। অ্যাবস্ট্রাক্ট বুকে রয়েছে এই কনফারেনসে যতগুলো পেপার উপস্থাপন করা হবে সবগুলোর সারমর্ম। আমি অ্যাবস্ট্রাক্ট বুক খুলেই নিজের পেপারটা দেখে নি। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। গ্রুপ ছবি দেখার সময় যেমন প্রত্যেকে নিজের মুখটা কোথায় আছে, কেমন আছে আগে দেখে নেয়।
ব্যাগে আরো আছে এডেলেইডের ম্যাপ। সিটি গাইড এবং একগাদা বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সম্মেলনের বিজ্ঞানীদের আহবান জানাচ্ছে তাদের তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য। কিছু বিজ্ঞাপন আছে চাকরিদাতাদের। সেখানে বলা আছে তারা আকর্ষণীয় বেতন দেবে, সুযোগ-সুবিধা দেবে ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা যেন তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ব্যাপারে একটু বিবেচনা করে দেখেন। একদিকে হাজার হাজার মানুষ চাকরি পাচ্ছে না, আর অন্যদিকে চাকুরীদাতারা ঘুরছে যোগ্যতমদের পেছনে। ডারউইন সাহেব ‘সার্ভাইভ্যাল অব দি ফিটেস্ট’ লেখার সময় কি এতসব বিবেচনায় এনেছিলেন?
এই সোনালি রুপালি ঝলমলে বিজ্ঞাপনগুলো ফেলে দিতে সামান্য মায়া হচ্ছিলো। কিন্তু জঞ্জাল যত আকর্ষণীয় মোড়কেই সাজুক না কেন সে তো জঞ্জালই। দেখলাম রিসাইক্লিং বিন দ্রুত ভরে যাচ্ছে এই উচ্ছিষ্ট বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপনদাতারা ঠিকই জানেন যে এগুলির এরকম পরিণতি হবে। এবং এটাও জানেন যে এর মধ্য থেকেই অনেকের টেলিফোন পাবেন তারা।
দেখতে দেখতে আমরা মেলবোর্নের গ্রুপটা বেশ বড় হয়ে গেলাম। সারা অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সবগুলি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সের বিভিন্ন শাখার পিএইচডি স্টুডেন্ট, পোষ্ট ডক্টরেট ফেলো আর প্রফেসররা এসেছেন। এসেছেন নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড আর আমেরিকা থেকেও। পাকিস্তানি একটি ইউনিভার্সিটি থেকেও একজনের নাম দেখলাম। রেজিস্ট্রেশন করেছেন প্রায় সাতশ' জন পদার্থবিজ্ঞানীই।
ঠিক সাড়ে ছ'টায় শুরু হলো ওয়েলকাম ককটেল রিসেপশান। ইউনিয়ন বিন্ডিং সংলগ্ন খোলা জায়গায়। ডান পাশে পার্কিং স্পট আর রাস্তাটা পেরোলে এ্ডেলেইডের নদী টরেনস। পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উষ্ণ অভ্যর্থনা। এই রিসেপশানের আয়োজক ইংল্যান্ডের ইনস্টিউট অব ফিজিক্স।
হার্ড ড্রিংকসের ফ্রি সরবরাহ থাকলে যা হয়; প্রায় সবাই বিয়ার আর মদের বোতল খালি করছে একটার পর একটা। সোমরসে অনাসক্তদের জন্য আছে অরেঞ্জ জুস। ক্যাটারাররা সবার সামনেই একের পর এক খাদ্য পাত্র তুলে ধরছে। যার যা খুশি তুলে নিচ্ছে পাত্র থেকে। এরকম খাবারের নাম হলো ফিঙ্গার ফুড। আঙুলে ধরে খাওয়া যায় বলেই হয়তো এই নাম। প্লেট লাগে না, চামচ লাগে না। দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে খাওয়া যায়। নানা রকম খাবারের সমারোহ। একটার পর একটা খাবার এসে দাঁড়াচ্ছে চোখের সামনে। খাবারের টেবিলের সামনে হেঁটে যেতে হচ্ছে না বলে কোন ধরনের লাইন দেখা যাচ্ছে না। সাদা মাংস, লাল মাংস, মাছ, চিংড়ি, কত ধরনের ফিশ-বল, মিট-বল। পার্টিক্যাল থিওরি গ্রুপের ম্যাট নিরামিষভোজী। তার জন্য শাক পাতা ভর্তি স্যালাদের ব্যবস্থাও আছে। ভাষণ আর খাওয়া একসাথে চললে যা হয়, কিছু না শুনেই হাততালি দিতে হয়। আমিও হাততালি দিলাম অনেকের সাথে। বক্তারাও জানেন এ ধরণের অনুষ্ঠানে কেমন ভাষণ দিতে হয়। কোন বক্তৃতাই তাই দু’মিনিটের বেশি দীর্ঘ নয়।
নাম ঠিকানা সবার বুকে লেখা আছে। তা দেখে দেখে অনেকেই “হ্যালো প্রাডিব, হাই প্রাডিব” করতে লাগলো। আমিও কিছুক্ষণ হাই জন, হ্যালো লিজ, হ্যাল্লো সুশান, হাই টিম করতে করতে হাত মেলালাম আর ‘নাইস টু মিট ইউ, সি ইউ এরাউন্ড’ করতে লাগলাম। এসময় সামনে এসে দাঁড়ালো একটা চায়নিজ মেয়ে। উচ্চতায় আমার চেয়ে যথেষ্ট খাটো বলে আমার নামটা পড়ছিলো গলা উঁচু করে। তার নেমট্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখলাম জিন ওয়াং। এসেছে ইউনিভার্সিটি অব কুইনসল্যান্ড থেকে। আমিই হাত বাড়িয়ে কথা বললাম তার সাথে, "হ্যালো জিন, হাউ আর ইউ? [অস্ট্রেলীয় উচ্চারণে হাউয়াইয়া?]"
"হাই প্রাডিব"
এডেলেইডে বেশ গরম, কুইনসল্যান্ডে মোটামুটি। মেলবোর্ন তেমন গরম নয় ইত্যাদি অর্ধ-প্রয়োজনীয় ইতস্তত কথাবার্তা হলো কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে সে জানতে চাইলো, "মেলবোর্নে কতদিন ধরে আছো?"
"আড়াই বছর। তুমি কতদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায়?"
"সাড়ে তিন বছর।"
"তোমার পিএইচডি কি শেষ?"
"না, থিসিস লিখছি এখন। আশা করছি মার্চের মধ্যে শেষ হবে।"
জানা গেলো জিনের রিসার্চ অ্যারিয়া অপটিক্‌স।
"তোমার দেশ কোথায়?" এডেলেইডে আসার পর এই প্রথম কেউ জ্ঞিজ্ঞাসা করলো আমাকে।
"বাংলাদেশ। তোমার?"
"চীন। মেলবোর্নে কেমন চায়নিজ আছে?"
"অনেক।"
"তোমার দেশটি কি আফ্রিকায়?"

মোটামুটি একটা ধাক্কা খেলাম আমি। আমি কালো এটা জানি। কিন্তু আফ্রিকানদের মতো দেখতে তা এই প্রথম জানলাম। চীনালোক সহজে বাংলাদেশ চিনতে পারে না। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকেও তারা তাদের নিজের ভাষায় অনুবাদ করে ফেলে। গ্রিনল্যান্ডকে বাংলা অনুবাদ করে আমরা যদি সবুজ-ভূমি বলতে আরম্ভ করি তাহলে যেরকম সমস্যা হবে জিনেরও হয়তো সেরকম সমস্যা হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের চায়নিজ অনুবাদ না বললে সে চিনতে পারবে না।
বললাম, "না, আফ্রিকায় নয়। এশিয়ায়। তোমাদের প্রতিবেশী ইন্ডিয়া আমাদেরও প্রতিবেশী। ধরতে গেলে তোমরা আমাদের প্রতিবেশীর প্রতিবেশী। আমার দেশের নামের চায়নিজ অনুবাদ পরে জানাবো তোমাকে।"
"আসলে আমি ভূগোলে খুব কাঁচা তো।"
"ওটা একটা খোঁড়া অজুহাত। বাদ দাও।"
বাদ দিতে বললেও বাদ দেয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না জিনের মধ্যে। সে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চলেছে ।
"তুমি কোথায় উঠেছো এখানে?"
"রয়েল এডেলেইড হাসপাতালের হোস্টেলে।"
"কি মজা! আমিও তো ওখানে। কত তলায় তুমি?"
"দশ"
"আমি এগারো। আমি তোমার উপরে! হিঃ হিঃ হিঃ।"
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না এখানে হাসার মতো কী আছে। কিন্তু হাসি না পেলেও নাকি ভদ্রতার হাসি হাসতে হয়। হাসলাম। এমনিতেই এখানে সবাই কারণে অকারণে হাসছে। দেখতে পেলাম বিপিনরা এসে ঢুকছে। জিনকে 'এক্সকিউজ মি' বলে বিপিনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বিপিন মানে বিপিন ধল। ধর নয়- ধল। বিহারের মানুষ। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরেট ফেলো। পিএইচডি করেছেন কোলকাতা থেকে। সঙ্গে এসেছে তার বৌ রানু। সাথে আরো কয়েকজন মেলবোর্নের ফিজিসিস্ট; এরিক, জন লি, ট্যান ল্যাং, ডেভিড পেটারসন। তারা আটজন মিলে একটি গাড়ি ভাড়া করে মেলবোর্ন থেকে সোজা ড্রাইভ করে চলে এসেছে। সবে এসে পৌঁছালো, কোথায় থাকবে এখনো ঠিক করতে পারেনি। জন, ট্যান আর রানুর সাথে ‘হ্যালো, হাই’ করতে না করতেই জিন এসে হাজির। জিনকে পরিচয় করিয়ে দিলাম জন আর ট্যানের সাথে।
জন লী আর ট্যান ল্যাং দু'জনই চায়নিজ। চায়নিজ ভাষাতেই আলাপ শুরু করলো তারা। একটু পরেই জানা গেলো ড. ট্যান ল্যাং আর জিন ওয়াং দু’জনই চীনে একই ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স পাস করেছে এবং তাদের দু’জনেরই সুপারভাইজার ছিলেন একই ব্যক্তি। আমি তাদেরকে কথা বলতে দিয়ে এগিয়ে গেলাম ড. অঞ্জলি মুখার্জীর দিকে।
ড. মুখার্জীর সামনে যেতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, "আপনি মানে তুমিই প্রদীপ? ‘তুমি’ বলছি বলে কিছু মনে করো না। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আরো বড় সড় কেউ হবে।"
খুব সহজেই আলাপ জমে গেলো। কনফারেনস ডেলিগেটদের তালিকায় তাঁর আর ড. মহানন্দা দাশগুপ্তার নাম দেখে ঠিকই ভেবেছিলাম তাঁরা বাঙালি হবেন। ভারতীয় বাঙালি। অঞ্জলি মুখার্জী কোলকাতার মেয়ে। সাহা রিসার্চ ইনস্টিউট থেকে পিএইচডি করে গত দেড়বছর যাবত অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক্টরেট ফেলো। তাঁর হাজবেন্ড আছেন কোলকাতায়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় পদে আছেন। তাই তাঁর ছুটি নেই এখানে আসার। অঞ্জলি এর মধ্যেই দু’বার ঘুরে এসেছেন কোলকাতা থেকে। অস্ট্রেলিয়ায় মন টিকছে না তাঁর, তার ওপর ক্যানবেরার মতো সব অর্থেই ঠান্ডা একটা জায়গায়।
বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাকে নিয়ে গেলেন ড. মহানন্দা দাশগুপ্তার কাছে। শার্ট আর ঘাগড়া জাতীয় একটা পোশাক পরা থাকলেও চেহারা আর গায়ের রঙের কারণে মহানন্দাকে পুরোপুরি ভারতীয় মেয়েই মনে হচ্ছে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি হৈ হৈ করে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। তাঁকে খুব উচ্ছ্বসিত মনে হচ্ছে। আমার সাথে পরিচিত হচ্ছেন বলেই এ উচ্ছ্বাস নয়, তিনি এমনিতেই বেশ প্রাণবন্ত। আমার সাথে বাক্য যা বললেন সব ইংরেজিতে। ইংরেজি কায়দায় আমার হাতটা ঝাঁকিয়ে দিলেন কয়েকবার। আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম বাংলায় কথা বলার জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি বাঙালি নন। দাশগুপ্তা পদবীতো বাঙালিদের থাকে। আমি কোন কথা না বলে ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম আমার ডানহাতটা তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে। তিনি দু’মিনিট ঝড়ের বেগে কথা বলে, পরে আমার সাথে আরো অনেক কথা বলবেন ইত্যাদি বলে, তাঁকে এখুনি যেতে হবে বলে দুঃখ প্রকাশ করে, অনেকটা ঝড়ের বেগেই চলে গেলেন। তাঁর গতির সাথে আমি কিছুতেই গতি মেলাতে পারছিলাম না। বাঙালি মেয়ের অবয়বে তিনি একজন পুরোদস্তুর অস্ট্রেলিয়ান।
আমি অঞ্জলি মুখার্জীকে জিজ্ঞেস করলাম, "তিনি বাঙালি নন?"
"পুরোপুরি বাঙালি। এখানে আসলে আট নয় বছর ধরে আছে তো তাই।"
জানা গেলো মহানন্দা দাশগুপ্তা টাটা ইনস্টিউট থেকে পিএইচডি করে এদেশে পোষ্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে এসেছিলেন নয় বছর আগে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশলান ইউনিভার্সিটিতে। তারপর থেকেই আছেন ওখানে। এক্সপেরিমেন্টাল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের কুইন এলিজাবেথ ফেলো তিনি। কুইন এলিজাবেথ ফেলোশিপ পাওয়া সহজ কথা নয়। দারুণ প্রতিভার অধিকারী না হলে এরকম ফেলোশিপ পাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না কেউ।
একে একে লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। আজকের মতো আয়োজন শেষ। কাল সকাল থেকে শুরু হবে মূল কর্মযজ্ঞ। আমিও যাবার জন্য পা বাড়ালাম। এ সময় "তুমি কি হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছো?"
জিনের প্রশ্ন। সে কখন আমার পিছু নিয়েছে আমি খেয়াল করিনি।
"হ্যাঁ"
"আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি আসলে রাস্তা চিনি না তো।"
"কোন সমস্যা নেই। তুমি এসেছো কবে?"
"কাল বিকেলে। আজ সারাদিন বিচে ঘুরেছি। ভীষণ সুন্দর বিচ। তুমি জানো এখানের বিচ কোনদিকে?"
মেয়েটা প্রচুর কথা বলে। চায়নিজ উচ্চারণে ইংরেজি। বুঝতে হলে বেশ মনোযোগ দিতে হয়জ। আমি অর্ধ-মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম হোস্টেলের দিকে। ব্যাগ রেখে আবার বেরোবো এরকম প্ল্যান আমার।
"তুমি রাতে আর কিছু খাবে না?"
এরকম প্রশ্নের জন্য আমি তৈরি ছিলাম না মোটেও। আমি কিছু বলার আগেই জিন বললো, "আমি ভেবেছিলাম এখানে ডিনার করাবে। তা না, কেবল টুকটাক খাওয়া।"
এই টুকটাক খাওয়া কিন্তু পরিমাণে কম নয়। আমার পেট ভর্তি হয়ে গেছে। অথচ এই পুঁচকে মেয়েটার পেটে এখনো ক্ষুধা আছে! আশ্চর্য তো। বললাম, "এর চেয়ে ভালো ডিনার এখানে আর কি করাবে। ফুল কোর্স ডিনার তো আর সব দিন করানো যাবে না।"
"আমার পেট ভরেনি। তুমি খাবারের দোকান চেন এখানে?"
"চিনি, কিন্তু আমার মনে হয় এতক্ষণে সব বন্ধ হয়ে গেছে।"
"চল না, গিয়ে দেখি। আমি একাই যেতাম। কিন্তু পথ চিনি না তো। তোমার কোন কাজ নেই তো এখন?"
জিনের কথায় কোন ধরনের ফর্মালিটির বালাই নেই। এমনভাবে কথা বলছে যেন সে জানেই আমি তার সাথে যেতে আপত্তি করবো না। আর আমার কোন কাজ থাকলেও তা ড্রপ করবো এখন। আমার আসলেই কোন কাজ নেই এখন। তাই আপত্তি করলাম না। দেখা যাক মেয়েটার খাদ্য সমস্যার কোন সমাধান করা যায় কি না। হোস্টেলে না গিয়ে সিটির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
খাবারের দোকানসহ শহরের প্রায় সব দোকান বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। কিন্তু জিন সেখানে ঢুকতে রাজি নয়, কারণ ডিনারের জন্য এত বেশি খরচ সে করতে পারবে না। শেষে একটা খাবারের গাড়ি পাওয়া গেলো। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে স্যান্ডুইচ বিক্রি করছে। জিন খুশিমনে দুটো স্যান্ডুইচ কিনলো। আমিও ভদ্রতার খাতিরে একটা কিনলাম।
স্যান্ডুইচের বিশাল আকৃতি দেখে আমি ভেবেছিলাম জিন দুটো স্যান্ডুইচ শেষ করবে কীভাবে? কিন্তু আমাকে বেশিক্ষণ ভাবতে হলোনা। কিছুদূর হেঁটে পার্লামেন্ট হাউসের বারান্দায় এসে বসতে বসতেই তার একটা স্যান্ডুইচ শেষ। আমারটার মোড়কও খুলিনি তখনো।


নর্থ ট্যারেস আর কিং উইলিয়াম স্ট্রিটের কোণায় এই পার্লামেন্ট ভবন। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার স্টেট পার্লামেন্ট হাউজ। গ্রানাইট পাথরের বিরাট বিরাট দশটি পিলার শোভা পাচ্ছে বারান্দাজুড়ে। শক্ত কালো পাথরের সিঁড়িতে বসে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম এর কারুকাজ। সিঁড়ির পাশে দেয়ালে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে।
এই ভবনটার দুটো অংশ। পশ্চিম অংশ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিলো ১৮৮৩ সালে, শেষ হয়েছে ১৯৩৯ সালে। আর পূর্ব অংশের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৮৯ সালে। এতো দীর্ঘ সময় কেন লাগলো তা আমি জানি না। আর বিল্ডিংটাও এমন কিছু অসাধারণ নয় যে এতদিন লাগবে। পুরোনো পার্লামেন্ট হাউজটাও এখনো পাশেই আছে।
রাস্তার আলো জ্বলছে অনেক আগেই। এখনো দিনের আলো আছে। রাস্তাগুলো বিশাল চওড়া এখানে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলাম। হঠাৎ জিনের প্রশ্নে চমকে উঠলাম। এতক্ষণ জিনের অস্তিত্বও ভুলে গিয়েছিলাম আমি।
"তোমার টপিকটা কী?"
"পিএইডি টপিক নাকি এখানে কী নিয়ে বলবো সেটা?"
"দু’টোই"
এবার আমার গবেষণা সম্পর্কে কিছুক্ষণ কথা হলো। জানতে চাইলাম তার কাজ সম্পর্কে। বলতে বলতে সে জানালো অস্ট্রেলিয়াকে তার মোটেও পছন্দ নয়। কারণ তার মতে অস্ট্রেলিয়া খুব একটা গতিশীল নয়। সে গতি পছন্দ করে। যেমন রয়েছে আমেরিকার। চার সপ্তাহের জন্য সে গিয়েছিলো নিউইয়র্কে। গত বছর। পিএইচডি শেষ করে আবারো যাবার ইচ্ছা। এখন থেকেই চেষ্টা করছে। কারণ সেখানে টাকা উপার্জন করা কোন ব্যাপারই নয়। এবং আমি যদি টাকা উপার্জন করতে চাই তাহলে অবশ্যই তার কথা শোনা উচিত। অবশ্যই আমেরিকা যাওয়া উচিত।
আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি জিনের কথা। সে কথা বলতে ভালোবাসে, বলুক ।
"আমি ভাবছি আমার সাবজেক্ট চেঞ্জ করে ফেলবো। আইটি’র বাজার এখন খুব ভালো। তুমি কী বলো?"
এই প্রশ্ন আসলে কথা বলার একটা অংশ। আমার উত্তরে কিছু যায় আসে না। তাই চুপ করে থাকলাম। সে বলেই চলেছে, "একজন আইটি’র লোক এখন বছরে কমপক্ষে একশ' হাজার ডলার বেতন পায়। ইউএস ডলার। আর একজন ফিজিসিস্ট?"
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, "সব কিছুকে টাকার হিসেবে বিচার করা উচিত নয়। যারা গবেষণা করে তারা মূলত ভালো লাগে বলে করে, ভালোবাসে বলেই করে। সেখানে টাকাটা প্রয়োজনীয়, কিন্তু মুখ্য নয়।"
"ভালোবাসা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই বলেই তুমি এই কথা বলছো। ভালোবাসার মূল কথাই হচ্ছে গিভ এন্ড টেক পলিসি।"
ভালোবাসার এরকম জেনারালাইজেশান মেনে নেয়া যায় না। বললাম, "অবজেকশানস। সব ভালোবাসা গিভ এন্ড টেক পলিসি নয়। ভালোবাসার মূল কথা হচ্ছে স্যাক্রিফাইস এন্ড কমিটমেন্ট। এ দু’টো না থাকলে কোন ভালোবাসাই সম্পূর্ণ নয়।"
তর্ক লেগে যেতে দেরি হলো না। জিন মানতেই চায় না যে অনেক ভালোবাসায় রেসিপ্রোসিটির স্থান নেই। তার কথা হলো, "তুমি যা চাচ্ছো, তা যদি তোমার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে না পাও, তাকে বদলে ফেলো। অলস লোকেরাই শুধু স্যাক্রিফাইস করে।"
সে যুক্তির কোন ধার ধারছে না। তার ভাবখানা এই, বাবা মাও যদি তার আশা পূরণ করতে না পারে তবে তাদেরকেও সে চেঞ্জ করে ফেলবে। বললাম, "যে বিষয়ে তুমি পিএইচডি করছো সে বিষয়টার বাজার দরের ভিত্তিতে তুমি কাজ করবে আর বাজার দর কমে গেলে বিষয় বদলাবে তাতো সব সময় সত্যি নয়। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তো একই রকম ব্যাপার। যাকে সত্যিকার ভালোবাসো তার জন্য সামান্য স্যাক্রিফাইস তুমি যদি না-ই করো, তাহলে কিসের ভালোবাসার কথা বলো তুমি?"
"তোমার মতো এরকম ছেলেমানুষী ভাবনা তোমার বয়সে আমিও ভাবতাম। এখন আর ভাবি না। বয়স বাড়লে তুমিও তোমার ভাবনা বদলাতে বাধ্য হবে।"
আমার মুখে আর কথা জোগালো না। চায়নিজদের বয়স সহজে বোঝা যায় না। জিনের বয়স তেইশ থেকে তেতাল্লিশ যে কোনটাই হতে পারে। কিন্তু আমাকে একেবারে ছেলেমানুষ ভাবার তো কোন কারণ নেই। মানুষের বয়সটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে এ সম্পর্কে আর কিছু বললাম না।
জিন বলেই চলেছে, "আমি তোমার যুক্তিগুলোর বিপরীতে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু তোমার যুক্তি আমি মেনেও নিচ্ছি না। আদর্শ ভালো জিনিস। কিন্তু শুধু আদর্শ দিয়ে জীবন চলে না।"
আমার আর তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। বললাম, "এবার ফেরা যাক।"
"চলো।"
ফেরার পথেও সে সারাক্ষণ বক বক করলো। আমি শুধু হ্যাঁ হুঁ করে গেছি। সে হোস্টেলের রাস্তা চেনে না বলেছিলো। কিন্তু এখন রাতের বেলাতেও দেখি সে একবারও রাস্তা সম্পর্কে কিছুই না জ্ঞিজ্ঞেস করে যেখানে বাঁক নেবার ঠিক সেখানেই বাঁক নিয়ে, যেখানে রাস্তা পেরোবার সেখানেই রাস্তা পার হয়ে হোস্টেলে ফিরেছে। দশতলার লিফট থামলে সে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি তার হাতটা সামান্য ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললাম, "গুডনাইট" ।
________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Latest Post

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা - দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইল এলাকায় কিছু পুলিশ সদস্য ইয়াসমিন নামের এক ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এই ঘ...

Popular Posts