Monday 25 April 2022

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হরগোবিন্দ খোরানা



রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার বিজ্ঞান যে মূলত পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের সমন্বিত রূপ তা এখন আমরা সবাই জানি। আমাদের জীবনের মূলসুর ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ডিএনএ’র কার্যকলাপ বিষদভাবে গবেষণা করা হয় বিজ্ঞানের যে শাখায় – তার নাম মলিকিউলার বায়োলজি বা আণবিক জীববিজ্ঞান। এই আণবিক জীববিজ্ঞানের অগ্রদূত ছিলেন আমাদের উপমহাদেশের সন্তান হরগোবিন্দ খোরানা।

জীবকোষের রসায়ন খুবই জটিল। প্রাণ রসায়ন বা বায়োকেমিস্ট্রি বিজ্ঞানের আলাদা শাখা হিসেবে দ্রুত প্রসারিত হতে শুরু করেছে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে। কিন্তু তার মূলে যে রাসায়নিক জীববিজ্ঞান বা কেমিক্যাল বায়োলজি, সেই কেমিক্যাল বায়োলজির প্রধান স্থপতি ছিলেন হরগোবিন্দ খোরানা। তিনিই প্রথম ডিএনএর জিনেটিক কোড সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। এই আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছে। এই আবিষ্কারের হাত ধরেই পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয়েছে অসংখ্য জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসাপদ্ধতি, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার শনাক্তকরণ পদ্ধতি, বংশগতিবিদ্যা, জিনঘটিত রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা এবং এসংক্রান্ত অসংখ্য কারিগরি পদ্ধতি - বায়োটেকনোলজি। ডিএনএর কোড ব্যাখ্যা করার সঠিক পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ১৯৬৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানী হরগোবিন্দ খোরানা, যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রামে – যেখানে একটি প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত ছিল না, শৈশবে গাছতলায় বসে যাকে শিখতে হয়েছিল বর্ণমালা।

ব্রিটিশ ভারতের অধীনে পাঞ্জাবের ছোট্ট একটি গ্রাম রায়পুর। এই গ্রামটি এতই ছোট যে তখনকার ভারতীয় ম্যাপে এর কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেতো না। মাত্র শ খানেক মানুষের বাস ছিল এই গ্রামে। গ্রামের সবাই নিরক্ষর কৃষিজীবী। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি ছিলেন কিছুটা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, সাধারণ যোগ-বিয়োগের হিসাব যিনি জানতেন। ব্রিটিশ সরকার এই মানুষটিকে গ্রামের চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য জমি রেজিস্ট্রি করার কাজে নিয়োগ করেছিলেন। এই পেশাটার নাম ছিল পাটোয়ারি। খোরানা পদবির এই দরিদ্র পাটোয়ারির এক মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হরগোবিন্দ খোরানা। অক্ষরজ্ঞান ছিল বলে বলা চলে খোরানা পরিবারই ছিল সেই গ্রামের একমাত্র শিক্ষিত পরিবার।

গ্রামে কোন স্কুল ছিল না। তবুও হরগোবিন্দর বাবা চেয়েছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। লেখাপড়া না শিখে হালচাষ করে জীবননির্বাহ করা ভীষণ কষ্টের তা তিনি প্রতিদিনই দেখছেন চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে গিয়ে। ইংরেজের রাজত্বে লেখাপড়া জানলে কেরানির চাকরি হলেও জুটবে। এই বিশ্বাসে তিনি নিজেই ছেলেমেয়েদের হাতেখড়ি দিলেন, অক্ষরজ্ঞান দিলেন গ্রামের এক গাছতলায় বসে নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

সেই সময় জন্মনিবন্ধনের কোন ব্যবস্থা ছিল না। কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়নি বলে সঠিক জন্মতারিখের কোন হিসেব ছিল না হরগোবিন্দর। একটু বড় হতেই গ্রামের গাছতলার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল। সবচেয়ে কাছে যে হাইস্কুলটি আছে সেটা মুলতান শহরে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে সেই স্কুল। কয়েক ঘন্টার হাঁটা পথ, গরুর গাড়িতেও লাগে অনেকক্ষণ। দিনের মধ্যে কয়েকঘণ্টা যায় পথে পথে। তবুও লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণের কাছে পথের কষ্ট কিছুই না। মুলতান স্কুলে ভর্তি হবার সময় জন্মতারিখের দরকার পড়লো। অনেক হিসেব করে জন্মতারিখ দেয়া হলো ১৯২২ সালের ৯ জানুয়ারি। তখন থেকে এই তারিখটিই হরগোবিন্দ খোরানার জন্মতারিখ হিসেবে বিবেচিত হলো।

মুলতান স্কুলে কিছুটা হলেও শহুরে ভাব আছে। স্কুলের শিক্ষকরা ভালো ছাত্রদের পেছনে প্রচুর সময় দেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক রতনলালের উৎসাহে বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করলো বালক হরগোবিন্দ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও তার সমান আকর্ষণ। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে পড়ে ফেলেছে জর্জ বার্নাড শ’র রচনা। মনে মনে ইচ্ছে তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করার।

উচ্চমাধ্যমিকের সমতুল্য ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যেতে হলো পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তির জন্য দুইটি বিভাগে দরখাস্ত করেছিলেন হরগোবিন্দ খোরানা। তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল ইংরেজি সাহিত্য, দ্বিতীয় পছন্দ রসায়ন। কিন্তু ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে গেলে একটি ইন্টারভিউ দিতে হয়। শিক্ষকদের মুখোমুখি হয়ে মৌখিক পরীক্ষা দেবার ব্যাপারে ভীষণ সংকোচ লাগছিল হরগোবিন্দর। তিনি মৌখিক পরীক্ষা দিতে গেলেন না। রসায়নে ভর্তির জন্য কোন ভর্তিপরীক্ষা দরকার হয়নি বলে তিনি রসায়নেই ভর্তি হলেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করলেন ১৯৪৫ সালে।

পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে খুব অস্বাভাবিক ভালো কোন রেজাল্ট করেছিলেন তা নয়। অন্য দশজন স্বাভাবিক ভালো ছাত্রের মতোই ছিল তাঁর রেজাল্ট। তবে সেই সময় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে খুব একটা প্রতিযোগিতা ছিল না।  একটু ভালো রেজাল্ট করে আবেদন করলে ব্রিটিশ সরকারের বৃত্তি পাওয়া যেতো। ভারতে তখন স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে। ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য স্বদেশী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেই ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সম্মানজনকভাবে বিদায় নেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে। ইংরেজ বিদায় নেবার পর ভারতীয়রা যেন ঠিকমতো দেশ গঠন করতে পারে সেজন্য কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ভারতীয় ছাত্রদের জন্য বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের জন্য কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই বৃত্তিপ্রকল্পের আওতায় কৃষি মন্ত্রনালয়ের অধীনে প্রশিক্ষণলাভের বৃত্তির জন্য মনোনীত হলেন হরগোবিন্দ খোরানা। ঠিক হলো তাঁকে ইংল্যান্ডের ইন্সটিটিউট অব বার্কশায়ারে পাঠানো হবে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করে ভারতে ফিরে এসে কৃষিউন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য।

বৃত্তির চিঠি পেয়ে সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন হরগোবিন্দ খোরানা। চিঠি নিয়ে লন্ডনের ইন্ডিয়ান হাই কমিশনারের অফিসে যাবার পর জানতে পারলেন বার্কশায়ার ইন্সটিটিউটে তাঁর জন্য যে বৃত্তিটা ঠিক করা হয়েছিল তা বাতিল হয়ে গেছে। তার বদলে তাঁকে অন্য একটি বৃত্তি দেয়া হয়েছে – লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈবরসায়নে পিএইচডি করার জন্য। হরগোবিন্দ খোরানা জানতেনই না যে তিনি জৈবরসায়নে পিএইচডি করবেন। অথচ এখান থেকেই শুরু হলো হরগোবিন্দ খোরানার গবেষণাজীবন।

লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সদ্য যোগ দেয়া প্রফেসর রজার বিয়ারের অধীনে পিএইচডি গবেষণা শুরু করলেন খোরানা। ইংরেজরা হরগোবিন্দ উচ্চারণ করতে পারে না বলে হরগোবিন্দ হয়ে গেলেন – গোবিন্দ্‌। অ্যালকালয়েড সিন্থেসিস বা ক্ষারক সংশ্লেষণ এবং মেলানিন সম্পর্কিত গবেষণা করে ১৯৪৮ সালে পিএইচডি অর্জন করলেন খোরানা।

বৃত্তির শর্ত ছিল পিএইচডি শেষ করে তিনি নিজের দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু কোথায় নিজের দেশ? ১৯৪৫ সালে তাঁর গ্রাম রায়পুর থেকে তিনি এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সেই রায়পুর পড়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। খোরানার পরিবারের সবাই উদ্বাস্তু হয়ে দিল্লিতে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁর অনেক আত্মীয়স্বজন প্রাণ হারিয়েছে দাঙ্গায়। এই অবস্থায় খোরানা কোথায় ফিরবেন? ধর্মের ভিত্তিতে যখন দেশ ভাগ হয়েছে, ফিরতে হলে খোরানাকে ভারতেই ফিরতে হবে। তাঁর জন্মভূমিতে তিনি আর ফিরতে পারবেন না, অন্তত এখন নয়।

ভারতে এখনি ফিরে না গিয়ে ইওরোপের জার্মান ভাষাভাষী কোন দেশে পরবর্তী এক বছর পোস্ট ডক্টরেট করার ইচ্ছে প্রকাশ করে তিনি ভারত সরকারের কাছে চিঠি লিখলেন। ভারতে তখন দেশ গঠনের জন্য লোক দরকার। এই অবস্থায় পোস্টডক্টরেট করার জন্য খরচ দেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। খোরানার দরখাস্ত মঞ্জুর হলো না। কিন্তু তাতেও খোরানার সিদ্ধান্ত বদলালো না। তিনি সুইজারল্যান্ডের জুরিখে চলে গেলেন প্রফেসর ভ্লাদিমির প্রিলোগের অধীনে গবেষণা করার জন্য।

দেশভাগ ছাড়াও সেই সময় ভারতে ফিরে না আসার আরো একটি কারণ ছিল খোরানার। ১৯৪৭ সালে পিএইচডি ছাত্র হিসেবে খোরানা প্রাগে গিয়েছিলেন যুবছাত্রদের ওয়ার্লড কংগ্রেসে যোগ দেয়ার জন্য। সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় সুইশ তরুণী এস্থার সিলবারের সাথে। পরিচয় থেকে ভালো লাগা, ক্রমে ভালোবাসা। এস্থারের কাছাকাছি থাকাটাও তাঁর জুরিখে থাকার অন্যতম কারণ।

সেই সময়টা তাঁর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ কষ্টকর ছিল। কোন ধরনের স্কলারশিপ ছাড়া, ভাতা ছাড়া তিনি ভ্লাদিমির প্রিলোগের ল্যাবে কাজ শুরু করলেন। প্রিলোগ তখন প্রতিষ্ঠিত রসায়নবিদ হলেও তাঁর হাতে তেমন কোন ফান্ড ছিল না যেটা দিয়ে খোরানাকে আর্থিক সহায়তা দেয়া যায়। খোরানা এগারো মাস ধরে ল্যাবেই ঘুমাতেন, খাদ্য ছিল ভাত আর রেশনের ফ্রি দুধ। এস্থার মাঝে মাঝে কিছু খাবার দিয়ে যেতেন – এটুকুই।

এস্থারের সাথে দেখা হওয়ার সময়টুকু ছাড়া বাকি সবটুকু সময় খোরনার কাটতো  ল্যাব আর লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিতে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত গবেষণাপত্র পড়তে পড়তে অনেক পুরনো একটা পেপার থেকে প্রায়-অজানা একটি সিন্থেটিক রিএজেন্ট কার্বোডিমাইট সম্পর্কে জানতে পারেন। পরবর্তীতে এই কার্বোডিমাইট ব্যবহার করে তিনি প্রাণরসায়নে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন।

১৯৪৯ সালের শুরুতে বৃত্তির শর্ত পূরণ করার জন্য তিনি ভারতে ফিরে এলেন। শর্ত ছিল তিনি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ভারতে চাকরি করবেন। কিন্তু সদ্যস্বাধীন ভারতে সেরকম কোন চাকরি নেই। লাহোর  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর অমুসলিম শিক্ষকরা সবাই ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে এসে এখন বেকার। খোরানাও তখন কার্যত উদ্বাস্তু। মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে। লিভারপুলের পিএইচডি, জুরিখের পোস্টডক নিয়ে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতাও জোটাতে পারছেন না তিনি।

তাঁর হতাশার কথা তিনি চিঠিতে লিখছেন তাঁর ইউরোপের পরিচিত শিক্ষক ও সহবিজ্ঞানীদের কাছে। প্রেমিকা এস্থার দিন গুনছেন জুরিখে। জুরিখে খোরানার পরিচয় হয়েছিল কেমব্রিজের অধ্যাপক কেনারের সাথে। প্রফেসর কেনার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আলেকজান্ডার টডের ল্যাবে একটি ফেলোশিপের বন্দোবস্ত করে দিলেন খোরানাকে। ১৯৪৯ সালের শেষে আবার ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন খোরানা। যোগ দিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর টডের ল্যাবে। এই ল্যাবে শুরু হলো খোরানা, টড এবং কেনারের যৌথগবেষণা। প্রফেসর টড ১৯৫৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।

খোরানা যখন কেমব্রিজে গবেষণা করছেন তখন তাঁর ল্যাব পরিদর্শনে এসেছিলেন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রিসার্চ কাউন্সিলের হেড গর্ডন শ্রাম। তিনি একজন গবেষকের সন্ধান করছিলেন যিনি ভ্যানকুভারে গিয়ে একটি গবেষণাগারের দায়িত্ব নিতে পারবেন। প্রফেসর টড খোরানার নাম প্রস্তাব করলে গর্ডন শ্রাম খোরানাকে ভ্যানকুভারে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। ১৯৫২ সালে সেই গবেষণাগারের দায়িত্ব নিয়ে ভ্যানকুভার চলে গেলেন খোরানা। যাবার সময় এস্থারকে বিয়ে করে সাথে নিয়ে গেলেন।

নতুন দেশে নতুন ল্যাবে নতুন সংসারের পাশাপাশি নতুন জীবন শুরু হলো খোরানার। পরবর্তী আট বছরে তিনটি সন্তানের পিতামাতা হন হরগোবিন্দ ও এস্থার। ২০০১ সালে এস্থারের মৃত্যু পর্যন্ত সুখি দাম্পত্যজীবন যাপন করেছিলেন তাঁরা।

১৯৫৪ সালে খোরানা কার্বোডিমাইট বিক্রিয়া ব্যবহার করে এডিপি ও এটিপির রাসায়নিক সংশ্লেষণ প্রকাশ করেন। খোরানার গবেষণা দ্রুত খ্যাতিলাভ করতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক মহলে। ১৯৬০ সালে তিনি আমেরিকার উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট অব এনজাইম রিসার্চে যোগ দিলেন। এখানেই তিনি ডিএনএ সিকোয়েন্সিং-এর যথাযথ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তিনি নিউক্লিওটাইডের রাসায়নিক উপাদানগুলি কীভাবে কাজ করে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ডিএনএর গাঠনিক উপাদানগুলির মধ্যে ঠিক কোথায় প্রোটিন সংশ্লেষণ শুরু হয়, কোথায় গিয়ে শেষ হয় তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হন তিনি। তাঁর এই গবেষণার জন্য ১৯৬৮ সালে তিনি রবার্ট হলি ও মার্শাল নিরেনবার্গের সাথে যৌথভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন।

এর পরবর্তী ৪৩ বছর ধরে ২০১১ সালের ৯ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি গবেষণা করেছেন আরো বিভিন্ন বিষয়ে।

১৯৭২ সালে তিনি এমআইটিতে যোগ দেন। এরপত আজীবন তিনি সেখানেই ছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত পথ ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় কেমিক্যাল বায়োলজি বা রাসায়নিক জীববিজ্ঞান। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে জার্নাল অব মলিকিউলার বায়োলজি ৩১৩ পৃষ্ঠার পুরো সংখ্যাটির ১৫টি গবেষণাপত্রের সবগুলিই ছিল হরগোবিন্দ খোরানার। আর-এন-এ সংশ্লেষণের গবেষণাসংক্রান্ত এই পেপারগুলি থেকে পরবর্তীতে উদ্ভাবিত হয়েছে পিলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশান বা পিসিআর পদ্ধতি (করোনা ভাইরাস শনাক্ত করার নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি)। এর জন্য খোরানা আরেকটি নোবেল পুরষ্কারের দাবিদার ছিলেন।

দীর্ঘ গবেষণা-জীবনে আড়াই শ’র বেশি গবেষকের সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিজ্ঞানী খোরানা। গবেষণার চূড়ায় উঠার পরেও তিনি ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী। নিজেকে তিনি চিরদিনের গবেষণাছাত্র হিসেবেই পরিচয় দিতেন।

তথ্যসূত্র

টমাস সাকমার, প্রসিডিংস অব দ্য আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি (২০১৭), হরগোবিন্দ খোরানা, সায়েন্স (২০০০), nobelprize.org. 

______________

বিজ্ঞানচিন্তা ফেব্রুয়ারি ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত






Wednesday 13 April 2022

ডার্ক ম্যাটার রহস্য - গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে

 



গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে – একটি টানটান উত্তেজনাকর রহস্যোপন্যাসের নাম হতে পারে সহজেই। কিন্তু নামের দ্বিতীয় অংশটা পড়েই বোঝা যায় বইটি বিজ্ঞানের। মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির রহস্য রহস্যোপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর। তবে পার্থক্য হলো – রহস্যোপন্যাসের শেষে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়, কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের রহস্য এখনো অনেকটাই রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।

ডার্কম্যাটারের রহস্যময়তাকে কোন গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার না করে বাংলার সহজিয়া বিজ্ঞানের বইতে তুলে আনার ব্যাপারটা খুব কঠিন। এই কঠিন কাজটিই অবলীলায় করে ফেলেছেন লেখক আবদুল গাফফার। পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয়সমূহের সহজীকরণ করেন যাঁরা – তাঁরা বোঝেন কাজটা কতটা কঠিন। তারজন্য প্রচুর পড়তে হয়, খাটতে হয়। এই বইটি লিখতে গিয়ে লেখক যে প্রচুর খেটেছেন, পড়াশোনা করেছেন, সেই পাঠ থেকে সারবস্তু তুলে এনে তাঁর পাঠককে দিয়েছেন তা এই বইয়ের সাতাশটি পরিচ্ছেদের প্রত্যেকটিতেই স্পষ্ট।

বাংলায় লিখতে গেলে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটা হয় – সেটা হলো যথাশব্দ খুঁজে বের করা। ইংরেজিতে ডার্ক ম্যাটার বললে পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা সবার কাছে সমানভাবে বোধগম্য -  ‘কৃষ্ণবস্তু’ কিংবা আরো সহজ বাংলায় ‘কালো পদার্থ’ বললে তা সবার কাছে সমান অর্থবোধক হয় না। তাই শব্দ প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা একটা বড় সমস্যা বাংলায় বিজ্ঞান লেখার ক্ষেত্রে। গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে – বইতে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিকে বাংলা নামে না ডেকে লেখক সঠিক কাজই করেছেন।

মহাবিশ্ব খুবই রহস্যময় জায়গা। রহস্যময়তার কারণ এখানে যতটা না দুর্বোধ্যতা – তার চেয়েও বেশি অদৃশ্যতা। পুরো মহাবিশ্বের শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগই এখনো মানুষের চেনা-জানার বাইরে রয়ে গেছে যার একুশ ভাগ ডার্ক ম্যাটার আর পঁচাত্তর ভাগ ডার্ক এনার্জি।

মহাবিশ্বের উপাদানের শতকরা মাত্র চারভাগ দৃশ্যমান পদার্থ দ্বারা গঠিত। দৃশ্যমান কথাটা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করলে আমরা যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে – মহাবিশ্বের যেসব পদার্থের উপর থেকে আলোর প্রতিফলন ঘটে আমাদের চোখে আসে। যেমন খালি চোখে আমরা আকাশের লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের আলো দেখতে পাই। অথবা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের মিথষ্ক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যান্ত্রিক উপায়ে দূর মহাকাশ থেকে পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করি। যেমন এক্স-রে কিংবা গামা-রে’র উপস্থিতি শনাক্ত করে হাজার আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের অস্তিস্ত্ব খুঁজে বের করা হচ্ছে। এসব অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেও এখনো দেখা সম্ভব হয়নি শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগ পদার্থ। মহাবিশ্বের এই বিশাল ভর এখনো রয়ে গেছে গুপ্ত। এই গুপ্ত মহাবিশ্বেরই খোঁজখবর দেয়া হয়েছে এই বইতে।

 সাতাশটি অধ্যায়ে ডার্ক ম্যাটারের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা হয়েছে এই বইতে। অধ্যায়গুলি ছোট ছোট – পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে যায় না, তথ্যভারাক্রান্তও মনে হয় না। বিজ্ঞানের বই তর তর করে পড়ে ফেলার বই নয়। বিজ্ঞানের বই – সে যে ভাষাতেই লেখা হোক না কেন, সেখানে বিজ্ঞান থাকবে। আর বিজ্ঞান পড়তে হলে মগজে চাপ পড়তেই হবে। এই বইটা পড়তেও পাঠককে সময় নিয়ে পড়তে হবে – সেটাই স্বাভাবিক। আমি বেশ সময় নিয়ে বইটি পড়েছি এবং পড়ে আনন্দ পেয়েছি।

প্রাচীন মহাবিশ্বের ধারণা থেকে শুরু করে আধুনিক মহাবিশ্বের মানচিত্রে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির স্থান কোথায় হতে পারে – সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমরা পেয়েছি এই বইতে। লেখক এ ব্যাপারে একটা সমন্বিত চিত্র বেশ ভালোভাবেই দিতে পেরেছেন।

প্রথমা প্রকাশন-এর বইগুলির অঙ্গসৌষ্ঠব উন্নত। ব্যবহৃত ছবিগুলি চমৎকারভাবে পরিষ্ফুটিত। কিন্তু সম্পাদনায় কিছুটা ত্রুটি রয়ে গেছে। এটা আমাদের প্রকাশনা জগতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে মনে হয় আমার। বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। আমি বইটির প্রথম সংস্করণ পড়েছি। হয়তো পরবর্তী সংস্করণে এসব ত্রুটি সংশোধিত হয়ে গেছে। আরেকটি দুর্বলতা হলো ছবিগুলিতে কোন নম্বর দেয়া নেই, কিন্তু বর্ণনায় বলা হয়েছে “চিত্র-৩ এর মতো” বা ২ নম্বর ছবির মতো ইত্যাদি (পৃষ্ঠা ৬৫)। আবার অধ্যায়গুলির কোন গাণিতিক পরিচয় নেই – অথচ কোন কোন জায়গায় উল্লেখ আছে “চতুর্দশ অধ্যায়ে বলেছিলাম … (পৃষ্ঠা ১৩৯), ১১তম অধ্যায়ে দেখেছি… (পৃষ্ঠা ১০৬) ইত্যাদি। ছবিগুলির লেবেলিং বাংলায় করা হয়েছে – সেটা খুব ভালো হয়েছে। তবে ৯২ পৃষ্ঠার স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ছবিটি জার্মান ভাষায় রয়ে গেছে।

কিছু কিছু ইংরেজি শব্দের সঠিক পরিভাষা আমাদের নেই – যেমন নয়েজকে বাংলায় গোলমাল বললে যা বোঝা যায় – তার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের নয়েজের কোন মিল নেই। পদার্থবিজ্ঞানে আমরা নয়েজ বলতে বুঝি – আনওয়ান্টেড ইনফরমেশান; অর্থাৎ অনাকাঙ্খিত সিগনাল। সেখানে গোলমাল বললে অর্থটা গোলমেলে হয়ে যায়। একই ভাবে স্লিট (slit) শব্দের অর্থ ‘ছিদ্র’ বললেও অর্থ বদলে যায় (পৃষ্ঠা ৮৩)

আরো টুকটাক কিছু কিছু বিষয় আরেকটু বিস্তৃতভাবে এলে ভালো হতো – যেমন বলা হয়েছে “ফার্মি টেলিস্কোপে সংযুক্ত আছে বিশাল আকারের এক চুম্বক। এই চুম্বক গামা রশ্মিকে ভেঙে ইলেকট্রন আর পজিট্রন জোড়ায় পরিণত করে ফেলতে পারে।“ (পৃষ্ঠা ১৪৩)  কিন্তু এটুকু বললে একটা সমস্যা থেকে যায়। তা হলো গামা রশ্মির উপর চৌম্বকক্ষেত্রের কোন প্রভাব নেই। সেক্ষেত্রে ঘটনাটা কীভাবে ঘটে তা পুরোটা ব্যাখ্যা করা দরকার।

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির আদ্যোপান্ত বইটি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।


Tuesday 12 April 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৭ (শেষ পর্ব)

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৭ (শেষ পর্ব)

পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। কমনওয়েলথভুক্ত দেশে গিয়ে গবেষণা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের এই বৃত্তিগুলি থাকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে। কমিশনের অফিস থেকে নির্ধারিত ফরম সংগ্রহ করে দরখাস্ত করেছিলাম। ঢাকায় মঞ্জুরি কমিশনের অফিসে স্কলারশিপের ইন্টারভিউ হলো। অনার্স ও মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস থাকলেই দরখাস্ত করা যায় বলেই দরখাস্ত করেছিলাম। আগে যদি জানতাম যে এই বৃত্তিগুলি অলিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই সংরক্ষিত, তাহলে দরখাস্তই করতাম না। তবে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হলো। দেখতে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে কত ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষমতা থাকে। 

ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস – এই আপ্তবাক্য অনুসারে একের পর এক নতুন পিলার গজাচ্ছে আমার। বুদ্ধিমান মানুষ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বুঝে ফেলে কোন্‌ বিষয় কীভাবে কাজ করে। আমার সেই ক্ষমতা নেই। তাই আমি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে দেখে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেসব বিদেশী বৃত্তির জন্য দরখাস্ত চাওয়া হয় – সেগুলিতে দরখাস্ত করতে থাকি। কোনোটা থেকেই কোন সাড়া পাই না। কিন্তু একদিন হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম এলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। ভারত সরকারের বৃত্তির জন্য পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। মার্চের ১৮ তারিখের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মূল ফরম জমা দিতে হবে। কিন্তু টেলিগ্রাম আমি পেয়েছি মার্চের ২৪ তারিখ। খামের উপর সিল দেখে বোঝা যাচ্ছে পাঠানো হয়েছে ১৯ তারিখ। এরকম ঝামেলা কি শুধু আমার সাথে হয়, নাকি আরো অনেকের সাথে হয়? কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকায় গেলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মন্ত্রণালয়ে ঢুকে দেখতে পেলাম – শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়ালে দেয়ালে অনেক বিদেশী বৃত্তির নোটিশ ঝুলছে। এই সংরক্ষিত এলাকায় যেখানে প্রবেশ করার জন্য বিশেষ অনুমতি লাগে, সেখানে এই বিজ্ঞপ্তিগুলি ঝুলিয়ে রাখার কারণ কী? দেখলাম মন্ত্রণালয়ের পিয়ন, কেরানি সবাই হা করে আছে টাকার জন্য। দেরি করে এসেছি এই কারণ দেখিয়ে একটা ফরমের জন্য তিন শ টাকা নগদ নিলো। মাত্র তিনশ টাকার জন্য আমার পাওয়া বৃত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবে! তাই অন্যায় জেনেও আমি তিন শ টাকা দিয়ে ফরম নিলাম। রাত জেগে ফরম পূরণ করে, সমস্ত কাগজপত্র জোগাড় করে পরদিন ফরম জমা দিলাম। এরপর কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি – ফাইনাল রেজাল্ট আসবে। দুই সপ্তাহ পর ভারতীয় হাই কমিশন থেকে চিঠি এলো – মন্ত্রণালয় থেকে আমার নাম পাঠানো হয়েছে, কিন্তু নির্ধারিত ফরমে আমার দরখাস্ত পাঠানো হয়নি। অথচ এই দরখাস্ত আমি নিজে জমা দিয়ে এসেছি মন্ত্রণালয়ে।

চাইলেই চট্টগ্রাম থেকে যখন খুশি ঢাকায় চলে যাওয়া যায় না। কলেজ থেকে ছুটি পাওয়া সহজ নয়। একদিনের ছুটির জন্যও ‘আকুল আবেদন’ করতে হয়। আবার গেলাম মন্ত্রণালয়ে। তারা বললো – দরখাস্ত ভারতীয় হাই কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। গেলাম ভারতীয় হাই কমিশনে। তারা জানালো – আমার দরখাস্ত তারা পায়নি। এখন উপায়? হাই কমিশনের একজন ‘দাসবাবু’ উপায় বাতলে দিলেন। আবার সমস্ত কাগজপত্র নতুন করে জোগাড় করে দরখাস্ত জমা দিলাম। এবার নিশ্চয় হয়ে যাবে। কিন্তু দাসবাবুর মৎস্য শিকারের খুব শখ। তিনি জানতে চাইলেন তাঁকে চট্টগ্রামে এনে তাঁর মৎস্য শিকারের শখ মেটাতে আমি কোন ভূমিকা রাখতে পারি কি না। তাঁর শখ মেটানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমার সরকারি স্কলারশিপের ওখানেই ইতি।

চতুর্দশ বিসিএস ছিল শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস। ওই বিসিএস আমরা দিতে পারিনি, কারণ আমাদের মাস্টার্স পরীক্ষা হয়নি তখনো। এরপর আমাদের জন্য সুযোগ এলো ষোড়শ বিসিএস। ওটাও শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ বিসিএস। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে আমার ওই বিসিএস হয়ে যাবে। মৌখিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র পাসমার্ক পেলেও আমি মেধাতালিকায় চলে আসবো এরকম আস্থা ছিল নিজের উপর। কিন্তু আস্থা আর বাস্তব এক জিনিস নয়। আমি ষোড়শ বিসিএস ফেল করলাম। আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকলো। বছরখানেক পর সপ্তদশ বিসিএসও ফেল করলাম। আত্মবিশ্বাস অবশিষ্ট যা ছিল তাও বাষ্প হয়ে উড়ে গেল।

কলেজে কাজে ব্যস্ত থাকি। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সাথে যতক্ষণ থাকি – আনন্দেই থাকি। ক্লাসরুম আমার প্রিয় জায়গা, শিক্ষার্থীরা আমার প্রিয়জন। কিন্তু তারপরও মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে।

যতই অনুভূতি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি – কাছের মানুষগুলি ঠিকই বুঝতে পারে। ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হই। এই মানুষটির সাথে আমার এখন যতটা পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, তার চেয়েও বেশি বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাঁর বয়স এখন পঁচাত্তর। তাঁর নিজস্ব সংগ্রামের কথাগুলি এখন আমি বুঝতে পারি। তিনিও খুলে বসেন তাঁর অতীত দিনের কথার ঝাঁপি।

আমার বাবার জীবন অনেকটা সাপ-লুড়ুর মতো। কতোবার তাঁর জীবনের পাকা গুটি সাপে খেয়েছে। তিনি শীর্ষ থেকে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছেন, কিন্তু তিনি থেমে যাননি। একটা কথার ভগ্নাংশ তিনি প্রায়ই বলেন – “মা ফলেষু কদাচন – কর্ম করে যাও, ফলের আশা করিও না।” মূল কথাটি অবশ্য এরকম “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” – অর্থাৎ মানুষের অধিকার শুধু কর্মে, কর্মফলে নয়। তার মানে কী দাঁড়ালো?  ফল যাই হোক, আমার চেষ্টা আমাকে করেই যেতে হবে।

নতুন করে চেষ্টা শুরু হলো। লালদীঘির পাড়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি। সেখানে রেফারেন্স সেকশানে কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিগুলির বিস্তারিত পরিচিতিসহ রেফারেন্স বই আছে। সেখান থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ঠিকানা জোগাড় করে উচ্চতর ডিগ্রিতে ভর্তির তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠাতে শুরু করলাম। প্রতিদিন কলেজ থেকে আসার পর সারা বিকেল এখানেই কাটে। এরপর রাত জেগে চিঠি টাইপ করি। মুসলিম হলের পাশে বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরির চার তলায় রেফারেন্স রুমে আছে আমেরিকান ইউনিভার্সিটির লিস্ট। ওখান থেকেও ঠিকানা জোগাড় হয়। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে প্রায় কয়েক শ’ চিঠি পোস্ট করলাম আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ আরো কিছু দেশে – যেখানে ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা হয়।

মাসখানেক পরে চিঠি আসতে শুরু করলো। বড় বড় খামের ভেতর বড় বড় প্রস্পেক্টাস। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্পেক্টাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের নতুন চারা গজাতে শুরু করে। কিন্তু স্বপ্নের ডানা ছেটে দিতে হয়। কারণ ভর্তির দরখাস্ত করার জন্য ফি আছে – পঞ্চাশ ডলার থেকে এক শ ডলার পর্যন্ত। ছিয়ানব্বই সালে আমেরিকান ডলারের দাম ছিল প্রায় পঞ্চাশ টাকা। সেই হিসেবে আমার এক মাসের বেতন মাত্র এক শ ডলার। দুইটা ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত করতে গেলেই আমি ফতুর হয়ে যাবো। তাই কয়েক শ ইউনিভার্সিটিতে চিঠি পাঠিয়ে প্রসপেক্টাস আনা গেলেও – ভর্তির দরখাস্ত করার ব্যাপারে খুব হিসেবী হয়ে উঠতে হলো। প্রথমে দেখলাম ফি ছাড়া দরখাস্ত করা যায় কোন্‌ কোন্‌ ইউনিভার্সিটিতে। আমেরিকার হাতে গোনা কয়েকটি ইউনিভার্সিটিতে দরখাস্ত করতে ফি লাগে না, কিন্তু টোফে্‌ল, জিআরই লাগে।

নতুন যন্ত্রণার নাম টোফেল, জিআরই। বইপত্র কিনে উল্টেপাল্টে দেখে বুঝতে পারলাম – আমার ইংরেজির অবস্থা ভয়াবহ। অরিজিনাল বইপত্রের দামও অনেক। পরীক্ষার ফিও ষাট-সত্তর ডলার। এই ডলারের চেক জোগাড় করতেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। আগ্রাবাদে সোনালী ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা থেকে অনেক কাগজপত্র জমা দিয়ে ডলারের চেক জোগাড় করতে হয়।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের জন্য দরখাস্ত করলাম। দরখাস্ত করার জন্য কোন ফি লাগলো না বলে অনেক খুশি হয়েছি। তবে দরখাস্তে উল্লেখ করা আছে আমার ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠাতে হবে। এই অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট বস্তুটা যে কী জিনিস – কোন ধারণা নেই। আমাদেরকে মার্কশিট দেয়া হয়েছে, সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট নামে কিছুই তো দেয়া হয়নি। অথচ জানতে পেরেছি আন্তর্জাতিক সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট দেয়া হয় – যেখানে কী কী সাবজেক্টে পরীক্ষা দিয়ে কত নম্বরের মধ্যে কত পেয়েছি, কী গ্রেডের কী মান, গ্রেড কীভাবে দেয়া হয়, কত নম্বরের মধ্যে কত পেলে ফার্স্ট ক্লাস, ইত্যাদি সব তথ্য থাকে সেই ট্রান্সক্রিপ্টে। ইউনিভার্সিটিগুলি ইউনিভার্সাল হবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ আমাদের ইউনিভার্সে অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টই নেই!

ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। ডেপুটি রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর জানা গেল অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টের জন্য নির্ধারিত ফরমে দরখাস্ত করতে হবে। অনার্সের জন্য একটি দরখাস্ত, মাস্টার্সের জন্য আরেকটি দরখাস্ত। দরখাস্তে আমি কোন্‌ পরীক্ষায় কত পেয়েছি তা লিখে দিতে হবে। সাথে আমার মার্কশিটের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হবে। প্রতিটি দরখাস্তের ফি দুইশ টাকা। সেই টাকা আবার অগ্রণী ব্যাংকে জমা দিতে হবে। আমি কোন্‌ পরীক্ষায় কত পেয়েছি সেই রেকর্ড তো বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকার কথা। সেখান থেকে তথ্য নিয়েই তো ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করে দেয়ার কথা। কিন্তু না, আমাকেই সব সরবরাহ করতে হবে। অফিসাররা সেই তথ্য মিলিয়ে দেখবেন ঠিক আছে কী না।

পুরো দুই দিন লাগলো ট্রান্সক্রিপ্ট রেডি হতে। পাতলা ফিনফিনে কাগজে টাইপ করা হলো ট্রান্সক্রিপ্ট। টাইপ করার সময় বেশ কয়েকবার ভুল হলো। সাদা ফ্লুইড দিয়ে সেই ভুল মোছা হলো। তার উপর আবার টাইপ করা হলো। এরকম ছন্নছাড়া ট্রান্সক্রিপ্ট যাবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। বলা হয়েছে ইউনিভার্সিটি থেকে সরাসরি পাঠাতে। সেজন্য পোস্টাল স্টাম্পের খরচ নেয়া হয়েছে পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু আমাকে ট্রান্সক্রিপ্ট দুটো এবং একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ মারা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো – “আপনি পোস্ট করে দিয়েন কোথায় দিতে হয়।“

“তাহলে পোস্টেজ বাবদ যে পঞ্চাশ টাকা নিলেন?”

“হে হে হে।“ মনে হলো এরকম হাস্যকর প্রশ্ন তিনি আর কখনো শোনেননি।

যাই হোক, অক্সফোর্ডে দরখাস্ত পাঠালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খামে অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠালাম। প্রামাণিকস্যারকে অনুরোধ করেছিলাম একটি রেফারেন্স লেটারের জন্য। তিনি বলেছেন, নিয়ম মোতাবেক তিনি সরাসরি অক্সফোর্ডেই পাঠিয়ে দেবেন।

মাসখানেক পর অক্সফোর্ড থেকে চিঠি এলো। আই-ই-এল-টি-এস করতে হবে। ওভারঅল ব্যান্ড স্কোর কমপক্ষে সেভেন হতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম বা আই-ই-এল-টি-এস সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। ব্রিটিশ কাউন্সিলে খোঁজ নিলাম। চট্টগ্রামে তেমন কোন তথ্য নেই। ব্রিটিশ কাউন্সিল ঢাকায় এই পরীক্ষার আয়োজন করে এবং সেখানে তথ্যও পাওয়া যায়। তবে চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কাউন্সিলের তরুণ লাইব্রেরিয়ান আনঅফিশিয়ালি জানালেন – আমি আগ্রহী হলে মিসেস সুতপা বড়ুয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারি। মিসেস বড়ুয়া আগে ব্রিটিশ কাউন্সিলে কাজ করতেন। এখন নিজেই একটি ইংরেজি শেখানোর প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন রহমতগঞ্জে।

সুতপা ম্যাডামের সাথে দেখা করলাম। বেশ বড় প্রতিষ্ঠান তাঁর। অনেক ছাত্রছাত্রী ইংরেজিতে কথা বলা শিখছে। আই-ই-এল-টি-এস কোর্সে আপাতত কোন স্টুডেন্ট নেই। কারণ ওই পরীক্ষাটা এখনো খুব একটা পরিচিত হয়নি এখানে। এখনো সবাই টোফেলই করে। সুতপাম্যাডাম আমাকে একাই পড়াবেন। এক ঘন্টা করে মোট দশটি ক্লাস নেবেন, প্রতি ক্লাস ছয় শ টাকা। তবে ব্যান্ড স্কোরের কোন গ্যারান্টি তিনি দিতে পারবেন না। ভর্তি হয়ে গেলাম।

মাস খানেক পরে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এলাম। ওভারঅল ব্যান্ড স্কোর এলো সাড়ে ছয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রিজেকশান লেটার এলো কয়েক সপ্তাহ পর।

দেখলাম অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলিতে আই-ই-এল-টি-এস ব্যান্ড স্কোর ছয় হলেই হয়। তাহলে তো অস্ট্রেলিয়ায় দরখাস্ত করতে হয়। কিন্তু দরখাস্তের ফি আছে সেখানে। অস্ট্রেলিয়ান ডলারের দাম আমেরিকান ডলারের চেয়ে কম। সাতানব্বইতে বাংলাদেশী টাকায় অস্ট্রেলিয়ান ডলার ছিল সাতাশ টাকা। এএনজেড গ্রিনলেজ ব্যাংকে অস্ট্রেলিয়ান ডলার পাওয়া যায়। আমার কলেজজীবনের বন্ধু সুরজিত কাজ করে সেখানে। তার সাহায্যে অস্ট্রেলিয়ান ডলার জোগাড় হলো। দরখাস্ত করলাম কয়েকটি অস্ট্রেলিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। এখানে অ্যাকাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পাঠাতে হয় না, দরখাস্তের সাথে নিজেই পাঠানো যায়। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে আবার ফরম ও টাকা জমা দিয়ে আরেক সেট ট্রান্সক্রিপ্ট নিয়ে এলাম। এবার ওগুলির ফটোকপি দিয়ে কাজ চালালাম।

প্রথম অফারটা এলো ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটি থেকে। শুধু ভর্তির অফার, কোন স্কলারশিপ নেই। টিউশন ফি বছরে আঠারো হাজার ডলার। অত টাকা দিয়ে পড়াশোনা করার সামর্থ্য নেই। পরের অফার এলো ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড থেকে। ওখানেও কোন স্কলারশিপ নেই। তৃতীয় অফারটা এলো ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন থেকে। প্রথম চিঠিতে কোন স্কলারশিপ নেই, কিন্তু বলা হলো স্কলারশিপের সিদ্ধান্ত কিছুদিন পরে জানানো হবে। এক মাস পর জানানো হলো – আমাকে একটা রিসার্চ স্কলারশিপ দেয়া হচ্ছে।

তারপর অন্য দেশ, অন্য কাহিনি।

<<<<<<<<< আগের পর্ব

Saturday 2 April 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৬

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৬

ইন্টারভিউর চিঠি পাবার পর স্বপ্নটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন জেগে উঠলেই ভেঙে যায়। কিন্তু জেগে জেগে যে স্বপ্ন দেখছি তা পিছু ছাড়ছে না। প্রামাণিকস্যার বলেছিলেন ইন্টারভিউর চিঠি নাও পাঠাতে পারে। কিন্তু ইন্টারভিউর চিঠি তো পেলাম। নভেম্বরের আট তারিখ সকাল দশটায় ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে ইন্টারভিউ। স্বপ্নের ঠেলায় প্রামাণিকস্যারের উপর রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাস্তববাদীর আড়ালে তিনি একজন নৈরাশ্যবাদী মানুষ। সোবহানস্যার যখন বলেছেন আমার আর হারুনের সমান যোগ্যতা, তখন নিশ্চয়ই তিনি আমাদের দু’জনের জন্যই সমানভাবে ভাবছেন। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কথার একটা দাম থাকবে না তা কি হয়?

স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি নিজের যোগ্যতাও তো প্রমাণ করতে হবে। ইন্টারভিউতে নিশ্চয় পদার্থবিজ্ঞানের গভীর জ্ঞান যাচাই করা হবে। আমার থিসিসের বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক খুঁটিনাটি আলোচনা করা হবে। ইতোমধ্যে একটি বেসরকারি কলেজে লেকচারার হবার জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছি। সেখানেও লিখিত, মৌখিক, ডেমনস্ট্রেশন – মোট তিন ধাপের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হবার জন্য যে ইন্টারভিউ সেখানে নিশ্চয় আরো অনেক গভীর অর্থবহ ধাপ অতিক্রম করতে হবে। পুরো একটা সপ্তাহ ধরে নিজেকে তৈরি করলাম নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে কী কী যোগ্যতা থাকা চাই – সে ব্যাপারে নিজস্ব কিছু মতামতও তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের স্বরূপ কী হওয়া উচিত – তা আমাদের শিক্ষকরা হয়তো ভালো জানেন। কিন্তু তাঁদের আচরণে কিংবা পাঠদানে তার প্রতিফলন পাইনি তেমন একটা। শিক্ষার্থীর চোখ দিয়ে না দেখলে অনেক জিনিস বোঝা যায় না। আমাদের শিক্ষকরা শিক্ষক হয়েই ভুলে যান যে তাঁরাও একসময় শিক্ষার্থী ছিলেন। এই ভুলটা আমি কখনো করবো না। শিক্ষকের কাজ যে শুধু শেখানো নয়, আবার নতুন করে শেখাও – সেটা আমি বুঝতে পেরেছি।

জীবনে প্রথমবার ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে ঢুকার সুযোগ হলো। মূল অফিসে ঢুকার আগে একটা মাঝারি আকারের বসার ঘর। সেখানে চারপাশের দেয়াল ঘেঁষে বেশ কিছু চেয়ার আর ছোট ছোট সোফা রাখা আছে। ভেবেছিলাম আমিই সবার আগে এসে পড়েছি। কিন্তু না, অঞ্জন চৌধুরি মানে অঞ্জনদা আরো আগে এসেছেন। আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বললেন, “তুমিও এসে পড়েছো? ইউনিভার্সিটির ইন্টারভিউর হাতেখড়ি হবে আজ তোমার।“ 

মনে হচ্ছে অঞ্জনদা এর আগেও ইন্টারভিউ দিয়েছেন। জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের তত্ত্বাবধানে এমফিল করেছেন তিনি। পয়েন্টের দিক থেকে তিনি অনেক এগিয়ে। ইন্টারভিউতে তাঁর সাথেও আমার প্রতিযোগিতা করতে হবে ভেবে একটু অস্বস্তিও লাগছে। একটু পর আরো অনেকে আসতে শুরু করেছেন। অপরিচিত অনেকজন। পরিচিতদের মধ্যে রফিকভাইকে দেখলাম। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রভাই হিসেবে আমি তাঁকে চিনি, তিনি আমাকে চেনেন না। হারুন রুমে ঢুকে আমার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে বের হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরে ফিরে এলো নুরুল ইসলামস্যার আর সোবহানস্যারের সাথে। সোবহানস্যার আর নুরুল ইসলামস্যার রুমের ভেতর দিয়ে হেঁটে মূল অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

ভিসিস্যারের রুমে ঢোকার আরো অনেক পথ আছে সম্ভবত। কারণ এখানে আসার পর শুনেছিলাম ভিসিস্যার তখনো আসেননি। একটু আগেই বলতে শুনলাম ভিসিস্যার এসে গেছেন। কোন্‌ দিক দিয়ে এলেন দেখতে পাইনি।

ইন্টারভিউ শুরু হলো। শুরুতেই অঞ্জনদার ডাক পড়লো। তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

আমার ধারণা ছিল কমপক্ষে ঘণ্টাখানেক লাগবে একেকজনের ইন্টারভিউ শেষ হতে। কিন্তু পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যেই বের হয়ে এলেন অঞ্জনদা। ডাক পড়লো আমার।

ভিসিস্যারের অফিসরুমটা বিশাল। আমি রুমে ঢুকেই হাত তুলে সালাম দিয়ে মনে হলো স্যাররা এত দূরে বসে আছেন যে সালাম ঠিকমতো পৌঁছায়নি তাঁদের টেবিলে। চার জনের ইন্টারভিউ বোর্ড। ভিসি রফিকুল ইসলাম চৌধুরিস্যার, আমাদের নুরুল ইসলামস্যার এবং সোবহানস্যার। আর এক্সটার্নাল হিসেবে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শামসুল হক। বসার আদেশ পেয়ে বসলাম তাঁদের সামনে চেয়ারে। প্রত্যেকের হাতেই আমার দরখাস্তের ফাইল। ভিসিস্যার ফাইল দেখতে দেখতে বললেন, “এসএসসি ফার্স্ট ডিভিশন, এইচএসসি ফার্স্ট ডিভিশন, অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড – বাহ্‌ ভেরি গুড। তোমাকে তো আমার মনে আছে। তোমাদের ফেয়ারওয়েলে তোমার কথাগুলি আমার খুব ভালো লেগেছিল। তোমার চিন্তাভাবনা খুব পজিটিভ। তোমাকে তো আমাদের দরকার।“

ভিসিস্যারের কথা শুনে আমার মাথার ভেতর স্বপ্নের পায়রাগুলি ডানা মেলে উড়তে শুরু করলো। মনে হলো স্বপ্নলোকের চাবি আমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু সোবহানস্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে দমে গেলাম। সোবহানস্যার গম্ভীরমুখে বললেন, “আমাদের আরো ক্যান্ডিডেট আছে স্যার।“

সোবহানস্যারের কথা শেষ হবার আগেই প্রফেসর শামসুল হক বললেন, “আপনার পোস্ট তো আছে মাত্র দুইটা। দরকার বলে তো সবাইকে আপনি রাখতে পারবেন না।“

ভিসিস্যার আর কোন কথা বললেন না। শামসুল হকস্যার বললেন, “দ্যাখো, এমএসসিটা আসলে তেমন কোন ডিগ্রি নয়। এমফিল করো, পিএইচডি করো – তারপর ট্রাই করো।“

মাথার ভেতর স্বপ্নের পায়রাগুলি ততক্ষণে আর্তনাদ করতে শুরু করেছে। সোবহানস্যার প্রশ্ন করলেন, “এমএসসিতে তোমার কী কী সাবজেক্ট ছিল?” বুঝতে পারছিলাম না স্যার আমার সাথে মজা করছেন কি না। কী কী সাবজেক্ট ছিল তা আমার মার্কশিটে লেখা আছে। স্যার নিজে আমাদের পড়িয়েছেন। কিন্তু যেকোনো প্রশ্নই প্রশ্ন। উত্তর দিলাম। নুরুল ইসলামস্যার একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। সোবহানস্যার বললেন, “ঠিক আছে, যাও।“

পাঁচ মিনিটেই শেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হবার ইন্টারভিউ। আমি জানতাম চাকরিপ্রার্থীদের জন্য বিভীষিকার অন্য নাম নিয়োগ পরীক্ষা। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কত রকমের পরীক্ষা দেয়ার পর চাকরি জোটে। বিসিএস পরীক্ষার কথাই ধরা যাক – প্রিলিমিনারি, লিখিত, মনস্তাত্ত্বিক, মৌখিক, স্বাস্থ্য, পুলিশ-চেক ইত্যাদি অনেকগুলি ধাপ পার হতে হতে অনেক সময় বছর পেরিয়ে যায়। বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও কত রকমের ইন্টারভিউ দিতে হয়। শাহীন কলেজের মতো একটা উচ্চমাধ্যমিক কলেজের লেকচারার হবার জন্যও কত দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে। আর এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার জন্য ইন্টারভিউতে আমাকে একটি মাত্র প্রশ্ন করা হলো – “এমএসসিতে তোমার কী কী সাবজেক্ট ছিল?” এরকম চরম একটা প্রহসনের ভেতর দিয়ে নিজে না গেলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না যে এরকমই হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে স্বায়ত্ত্বশাসন দেয়া হয়েছিল নিশ্চয়ই কোন মহৎ উদ্দেশ্যে। জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরিতে যেন অহেতুক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সৃষ্টি না হয় – সেজন্য। কিন্তু তার সুযোগে যে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায় জানি না। স্বপ্নভঙ্গ হবার পরে মনে হচ্ছে প্রামাণিকস্যার ঠিক কথাই বলেছিলেন।

সময় থেমে থাকে না। নতুন দিন আসে। দু’দিন পর শাহীন কলেজ থেকে নিয়োগপত্র পেলাম। জীবনের প্রথম যে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি – সেই চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছি। শাহীন কলেজের নিয়োগকর্তারা আমাকে যোগ্য মনে করেছেন। এবার আমারই দায়িত্ব যোগ্য হয়ে ওঠা। নভেম্বরের চৌদ্দ তারিখ শাহীন কলেজে যোগ দিলাম। শিক্ষক পদে যোগ দিলেই সত্যিকারের শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের সাথে নতুন করে শিখতে শিখতেই শিক্ষক হয়ে ওঠার সাধনা করতে হয়। বছর শেষে পরীক্ষায় পাস করলেই শিক্ষার্থীদের কাজ শেষ। একই ক্লাসের পড়া তাদের আর পড়তে হয় না। কিন্তু শিক্ষকদের সেই সুযোগ নেই। তাঁদের প্রতি বছরই নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে নতুন করে পড়তে হয়। আমি আবার নতুন করে উচ্চমাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞান পড়তে শুরু করলাম। তারপর শিক্ষক হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে করতে সাড়ে চার বছর কেটে গেছে শাহীন কলেজে। সেই কাহিনি অন্য কোথাও বলা যাবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় ফিরে আসি। সেবার দুইটি পদে তিনজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি নিজেদের লোক থাকলে তাদের জন্য পদ তৈরি করা যায়। ইচ্ছে করলে একটি পদের বিপরীতে একাধিক লোক নিয়োগ দেয়া যায়। হারুনকে নেয়া হয়েছিল সেই সময়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান শামসুল হকের নিজের একজন প্রার্থী ছিলেন। সেই ওবায়েদ সাহেবকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। শুনেছি তিনি যোগ দিয়েই চলে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর নগরে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্ক কি একটা ইন্টারভিউতেই শেষ হয়ে যাবে? অরুনস্যার অবশ্য সেরকমই উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “মাথায় ঘিলু থাকলে আর এইমুখো হবি না। পারলে আমেরিকা চলে যা। ওখানে গিয়ে কুলিগিরি করাও ভালো।“

কিন্তু আমার মাথায় ‘ঘিলু’ খুব একটা নেই। আমি অরুনস্যারের পরামর্শ না মেনে দু’বছর পর  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হবার জন্য আবার দরখাস্ত করেছিলাম। তখন নুরুল মোস্তফাস্যার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। আবারো এক্সটার্নাল হয়ে এসেছিলেন প্রফেসর শামসুল হক। সেবার হারুন আর রফিকভাইয়ের সাথে আবার দেখা হয়েছিল। তাঁরা দু’জনই গিয়েছিলেন সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য। আমার ক্ষেত্রে আবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বিষয়ভিত্তিক কোন প্রশ্ন নেই। শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার খাতিরে সার্টিফিকেট মার্কশিটে চোখ বুলাতে বুলাতে উপদেশ দেয়া – ‘বিসিএস দাও, চেষ্টা করতে থাকো।‘

চেষ্টা করতেই থাকলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় এবং শেষবার ইন্টারভিউ দিলাম ১৯৯৬ সালে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে দীর্ঘ একুশ বছর পর। আশা করেছিলাম পুরনো অনিয়মগুলি দূর হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি। সেবার সিলেকশান কমিটিতে প্রামাণিকস্যার ছিলেন। আমি সত্যিই আশা করেছিলাম ভালো কিছু হবে। হয়নি। পরে প্রামাণিকস্যার বলেছিলেন, "সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তোমার ধর্ম তো পরিবর্তন হয়নি।“

দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি ইন্টারভিউ দিয়েছি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ক্লাসমেটদের কয়েকজনের সাথে দেখা হয়েছিল। আনন্দ আর দীলিপও ইন্টারভিউ দিয়েছিল। কারোরই হয়নি। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে এতদূর থেকে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি দেখে ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষক হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “সহজ ব্যাপারগুলি কেন যে আপনারা বোঝেন না! একটু ভেতরের খবর নেবেন না? এসব ইন্টারভিউ হচ্ছে চাকরি রেগুলারাইজ করার জন্য।“

ভেতরের খবর কীভাবে পাওয়া যায় আমি জানি না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেছিলাম। এটাই তো নিয়ম বলে জানতাম। এর ভেতর যে ভেতরের খবর নিতে হয় সেই খবর আমার জানা ছিল না।

আরেকজন তরুণ শিক্ষক আরো জোরে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “চিটাগং থেকে এসেছেন, ডক্টর ইউনুসের সুপারিশ নিয়ে আসেননি তো আবার? তাহলে তো আমাদের কপাল পুড়বে। হাহাহা।“ তখন সেখানে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপার্সন ছিলেন প্রফেসর আফরোজি ইউনুস। তিনি যে ডক্টর ইউনুসের স্ত্রী তা আমি জানতাম না। সেই শিক্ষকদের হাসিঠাট্টা আমার কাছে খুবই অপমানজনক মনে হয়েছিল। এই তরুণ লেকচারাররা কয়েক বছর পরেই প্রফেসর হয়ে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দন্ডমুন্ডের মালিক হবেন। এখনই তাঁরা যা করছেন, তখন যে কী করবেন ভাবতেই ভয় হচ্ছিল।  

দিন যায়, কিন্তু মাথার ভেতর থেকে প্রফেসর শামসুল হকের কথাগুলি যায় না। কথাগুলি মাথার মধ্যে পেরেকের মতো গেঁথে গেছে – ‘এমএসসিটা আসলে তেমন কোন ডিগ্রি নয়। এমফিল করো, পিএইচডি করো।‘ কিন্তু কীভাবে? দেশের বাইরে গিয়ে পিএইচডি করতে হলে স্কলারশিপ পেতে হবে। কীভাবে পাওয়া যায় স্কলারশিপ, কারা দেয় – কোনো ধারণা নেই। 

পরের পর্ব >>>>>>>>>>>

<<<<<< আগের পর্ব

ইউ-এফ-ও এবং পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম

 




আন-আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট বা ইউ-এফ-ও সম্পর্কে প্রচারণা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার নিউ মেক্সিকো রাজ্যের মরুভূমিতে  রজওয়েল (Roswell) নামক জায়গায় কিছু ধাতব ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। সেখান থেকেই শুরু। প্রচার করা হতে থাকে যে মহাকাশের অজানা কোন গ্রহ থেকে আগন্তুকরা আমাদের পৃথিবীতে এসেছে এধরনের উড়ন্ত যানবাহন নিয়ে, সেগুলিরই কোনটা এখানে বিধ্বস্ত হয়েছে। এরপর আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় অনেক অতিউৎসাহী মানুষ প্রচার করতে থাকে যে বিশাল চাকতির মতো বস্তু তারা আকাশে উড়তে দেখেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই চাকতিগুলি হঠাৎ দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এগুলির নাম হয়ে যায় উড়ন্ত চাকতি বা ‘ফ্লাইং সসার’। অনেকে এগুলির ছবিও তুলেছে, রাডারেও ধরা পড়েছে কয়েকটা চাকতিসদৃশ বস্তু। বিজ্ঞানীরা এসব পরীক্ষা করে দেখেছেন। সবক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে এগুলি হয় উড়ন্ত বেলুন, কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে সৃষ্ট আকাশ-চিত্র যা দূর থেকে উড়ন্ত-চাকির মতো মনে হয়। কিন্তু অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাসীরা বৈজ্ঞানিক যুক্তি মানতে নারাজ। তারা বিভিন্ন ধরনের মনগড়া খবর তৈরি করতে থাকে। কেউ কেউ ভুয়া ছবি এবং ভিডিও প্রচার করতে থাকে – যা অনেকেই বিশ্বাস করে। গত সত্তর বছর ধরে ইউ-এফ-ও নিয়ে চর্চা করছে কিছু মানুষ। তাদের বিশ্বাস – ইউ-এফ-ও হলো মহাকাশের অন্য কোন গ্রহ-নক্ষত্র থেকে আগত নভোযান, যেগুলি অতি দ্রুত যেমন আসতে পারে, তেমনি অতি-দ্রুত চলেও যেতে পারে।

ইউ-এফ-ও’র ইতিহাস, গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদির পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। ২০২১ সালের জুন মাসে আমেরিকার অফিস অব দ্য ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে যেখানে এধরনের অজানা উড়ন্ত বস্তুর ধারণা থেকে উদ্ভুত বিপদের সম্ভাবনা যাচাই ও প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা চালু রাখার কথা বলা হয়েছে। এটা আমেরিকার নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ। কারণ ইউ-এফ-ও’র ছদ্মবেশে আকাশপথে আক্রমণ যেন না ঘটতে পারে তার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমেরিকার দেখাদেখি এরকম ব্যবস্থা অন্যান্য দেশও নিতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইউ-এফ-ও’র অস্তিত্ব মেনে নেয়া হচ্ছে।

এই প্রবন্ধে আমরা ইউ-এফ-ও’র রাজনীতি বা অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা করবো না। আমরা শুধু দেখবো – আমাদের গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে মহাকাশের অন্য কোন গ্রহ-নক্ষত্র থেকে এসব মহাকাশযানের পৃথিবীতে আসা সম্ভব কি না।

যারা ইউ-এফ-ও’র পক্ষে প্রচারণা চালায় তারা দাবি করে যে মহাকাশের অন্য গ্রহ থেকে আগত এসব নভোযানের ব্যাস ১৫ মিটার থেকে শুরু করে ১০০ মিটার বা তার চেয়েও বেশি। সেখানে অন্য গ্রহের মানুষও থাকে – যারা আমাদের গ্রহের মানুষের চেয়ে উন্নত। এসব ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে এসব নভোযান পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই এখানে আসে।

মহাবিশ্বের সবকিছুই মহাকর্ষ বল দ্বারা পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট। গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি সবকিছুরই নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ বল আছে, তাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। নিউটনের মহাকর্ষ বলের সূত্র সব জায়গাতেই খাটে। পদার্থের ভর, বেগ, ত্বরণ, শক্তি ইত্যাদির যে নিয়ম পদার্থবিজ্ঞানে আছে কোনকিছুরই তার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। ইউ-এফ-ওকেও এসব নিয়ম মানতে হবে।

মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতির সবচেয়ে আধুনিক এবং গ্রহণযোগ্য যে পরীক্ষিত তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে আছে তা হলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব বা স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুযায়ী মহাবিশ্বের যে কোন কাঠামোতে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি সমানভাবে প্রযোজ্য। তাহলে মহাবিশ্বের যে প্রান্ত থেকেই আসুক না কেন, নভোযানগুলিকে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলতেই হবে।

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের দ্বিতীয় নীতি হলো – শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিই হচ্ছে পদার্থের সর্বোচ্চ গতি। অর্থাৎ সেকেন্ডে দুই লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বা তিন লক্ষ কিলোমিটারের বেশি গতিতে কোন কিছুই চলতে পারে না।

মানুষ মহাকাশে বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো শুরু করেছে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে। গত ষাট বছরে সৌরজগতের সবগুলি গ্রহ-উপগ্রহের প্রায় সব জায়গা জরিপ করা হয়ে গেছে। আমাদের সৌরজগতের বাইরেও হাজার হাজার গ্রহ আবিষ্কার করে ফেলেছে। মহাকাশের আরো দূরতম স্থানে দূরবীক্ষণ স্থাপন করে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করার জন্য অতিসম্প্রতি মহাকাশে পাঠানো হয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়া অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না তার অনুসন্ধান চলছে গত কয়েক দশক থেকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো কোথাও ভিন-গ্রহের প্রাণির সন্ধান পাননি। তবুও যদি কেউ বলে যে মহাবিশ্বের অজানা কোন গ্রহ থেকে ইউ-এফ-ও’র মাধ্যমে ভিন-গ্রহের প্রাণিরা আমাদের গ্রহে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছে, তাহলে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে আমরা হিসেব করে দেখতে পারি সেটা সম্ভব কি না।

পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে মহাকাশযান পাঠাতে হলে পদার্থবিজ্ঞানের যেসব নিয়মকানুন মেনে প্রস্তুতি নিতে হয় এবং মহাকাশযান পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয় তা আমরা এখন জানি। পৃথিবী থেকে এপর্যন্ত সর্বোচ্চ যে গতিতে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো সম্ভব হয়েছে সেটা হলো পার্কার সোলার প্রোব। সূর্যের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে পাঠানো হয়েছে এই স্যাটেলাইট। ঘন্টায় প্রায় সাত লক্ষ কিলোমিটার বেগে ছুটছে এই স্যাটেলাইট। ২০২৪ সালে এটা সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছাবে। এটা হলো বাস্তবতা – শুধুমাত্র আমাদের পৃথিবী থেকে সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছতেই ছোট্ট একটা স্যাটেলাইটের সময় লাগছে ছয় বছরের বেশি। সেখানে কথিত ইউ-এফ-ও আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে আসছে, আবার চলেও যাচ্ছে – এটা অবিশ্বাস্য।

আমাদের সৌরজগতের সবগুলি গ্রহ-উপগ্রহের পূর্ণাঙ্গ জরিপ আমাদের হাতে আছে। সেখানে কোন প্রাণির সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমাদের সৌরজগতের বাইরে সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেনটাউরির দূরত্ব প্রায় ৪.২৫ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ সেখান থেকেও কোন কিছু আলোর বেগেও যদি আসে – সময় লাগবে সোয়া চার বছর। কিন্তু আলোর বেগে যদি আসে – সেটা আলোই হবে – পদার্থ নয়।

বৈজ্ঞানিক যুক্তির খাতিরে ধরে নিই, কথিত ইউ-এফ-ও একটি মহাকাশযান যার নাম ‘কল্পনা’ - যা আমাদের কাছের নক্ষত্র-জগতের কোন গ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসছে। ধরে নিলাম সেই গ্রহের দূরত্ব পৃথিবী থেকে পাঁচ আলোকবর্ষ। ধরা যাক তিনজন নভোচারীসহ নভোযান ‘কল্পনা’ সেই গ্রহ থেকে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আমরা জানি গ্রহান্তরে রওনা দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। রকেটের সাহায্যে এই নভোযানকে সেই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে পাঁচ আলোকবর্ষ দূরত্ব পেরিয়ে সৌরজগত এবং তার অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলির মাধ্যাকর্ষণ অতিক্রম করে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে ঢুকতে হবে। ধরে নিলাম এসব হিসেব করেও মহাকাশযান ‘কল্পনা’র সর্বোচ্চ গতি ঠিক করা হলো আলোর বেগের অর্ধেক – অর্থাৎ সেকেন্ডে দেড় লক্ষ কিলোমিটার। সেই গতিতে এলেও পৃথিবীতে আসতে ‘কল্পনা’র সময় লাগবে দশ বছর। চলে যাওয়ার জন্য আরো দশ বছর। তিনজন নভোচারীর বিশ বছরের খাওয়া-দাওয়া এবং অন্যান্য রসদ থাকতে হবে নভোযানে। বিশ বছর ধরে নভোযান চলার যন্ত্রপাতি এবং জ্বালানি লাগবে। সৌরশক্তি ব্যবহার করলেও সেই শক্তি তৈরি করার যন্ত্রপাতি লাগবে।

আমাদের পৃথিবী থেকে যেসব মহাকাশযান পৃথিবীর বাইরে পাঠানো হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ধরে নেয়া যায় – যন্ত্রপাতি, রসদ, জ্বালানিসহ ‘কল্পনা’র মোট ভর ১০ কিলোগ্রাম (দশ হাজার টন)।

এই মহাকাশযান উৎক্ষেপণের পর যদি ৯.৮ মিটার/বর্গ সেকেন্ড হারে ত্বরণ হয়, তাহলে সর্বোচ্চ গতি সেকেন্ডে দেড় লক্ষ কিলোমিটারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১৭৭ দিন। [হিসাব: ত্বরণ = বেগ/সময়, সুতরাং সময় = বেগ/ত্বরণ = (১.৫  x ১০)/(৯.৮) = ১৫৩০৬১২২.৪৫ সেকেন্ড = ১৭৭.১৫ দিন।]

এখানে সেকেন্ডে যে গতি ধরা হয়েছে তা স্যাটেলাইটের পক্ষে অসম্ভব। সর্বোচ্চ গতির পার্কার সোলার প্রোব স্যাটেলাইটের গতি আলোর গতির এক হাজার ভাগের এক ভাগেরও কম। সেখানে আমরা ‘কল্পনা’র গতি ধরে নিচ্ছি আলোর গতির অর্ধেক। তারপরেও দেখা যাক – ‘কল্পনা’র পৃথিবীতে আসার সম্ভাবনা কতটুকু।

দশ হাজার টন ভরের ‘কল্পনা’র গতি লাভ করার জন্য তাকে যে পরিমাণ গতিশক্তি অনবরত সরবরাহ করতে হবে তার পরিমাণ আমরা গতিশক্তির সমীকরণ থেকে হিসেব করতে পারি। সেই গতিশক্তির পরিমাণ হবে  একশ কোটি কোটি কোটি জুলেরও বেশি (১.১২৫ x ১০২৩ জুল)। [হিসাব: E = ½ mv2 = ½ (107 kg) (1.5 x 108 m/s2) (1.5 x 108 m/s2) = 1.125 x 1023 Joules]

এই পরিমাণ শক্তি বিশ বছর ধরে ক্রমাগত সরবরাহ করার জন্য দরকার হবে থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশান পদ্ধতি। এক মেগাটন (এক মিলিয়ন টন) থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা থেকে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ ৪.২ x ১০১৫ জুল। তাহলে দেখা যাচ্ছে ‘কল্পনা’র শক্তি যোগানোর জন্য দরকার হবে দুই কোটি ৬৭ লক্ষ ৮৫ হাজার ৭১৪টি মেগাটন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা। এক একটি মেগাটন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমার শক্তি হিরোশিমায় যে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার একশ গুণ।

১৭৭ দিনের মধ্যে আকাঙ্খিত গতিতে পৌঁছানোর জন্য  ‘কল্পনা’য় শক্তি সরবরাহ করতে হবে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১.৮ মেগাটন। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের চেয়েও বেশি জটিল এই শক্তি সরবরাহ-প্রক্রিয়া। শতকরা একশ ভাগ নিশ্চয়তার সাথে এই শক্তি সরবরাহ করতে হবে ‘কল্পনা’য়। বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বল এড়াতে এই শক্তির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে অকল্পনীয় দক্ষতায়। ‘কল্পনা’র গতি নিয়ন্ত্রণে এই শক্তি-নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এত বেশি পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত শক্তি সরবরাহ করা অসম্ভব।

এই পরিমাণ শক্তি থেকে যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হবে তার সবটুকুই বিকির্ণ হয়ে যেতে হবে। এর সামান্য অংশও যদি ‘কল্পনা’য় রয়ে যায় – তাহলে মহাকাশযানের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে প্রায় কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্টিফেন বোল্টজম্যানের তাপ বিকিরণের সূত্র প্রয়োগ করলে দেখা যায় ‘কল্পনা’র একশ বর্গমিটার ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট উপরিতলের তাপমাত্রা হয় প্রায় ছয় লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রার এক শতাংশও যদি মহাকাশযানে শোষিত হয় মহাকাশযানের তাপমাত্রা হবে ছয় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই তাপে ‘কল্পনা’ বাষ্প হয়ে যাবে।

যদি ‘কল্পনা’র বেগ কমানো হয়, তাহলে শক্তির হার কম লাগবে। ধরা যাক, আলোর বেগের অর্ধেকের পরিবর্তে আলোর বেগের এক শতাংশ বেগে ‘কল্পনা’ পৃথিবীতে আসছে। সে হিসেবে পৃথিবীতে আসতে তার সময় লাগবে ৫০ বছর, যেতে সময় লাগবে আরো ৫০ বছর। তখন একশ বছরের রসদ লাগবে। ‘কল্পনা’ আরো ভারী হয়ে যাবে। কিন্তু একশ বছরের যাত্রাপথ কিছুতেই আলোর-গতিতে আসা-যাওয়া হতে পারে না।

আমরা দেখেছি প্রচন্ড গতিতে কোন কিছু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে থেকে পৃথিবীতে আসার সময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে প্রচন্ড তাপের সৃষ্টি হয়। আলোর গতির কাছাকাছি কোন গতিতে যে তাপ তৈরি হবে সেই তাপে মহাকাশযান অক্ষত থাকার কথা নয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞানের কোন নিয়মেই ইউ-এফ-ও পৃথিবীর বাইরের কোন অজানা গ্রহ থেকে আসতে পারে না। যদি বলা হয়ে থাকে – ওরা এই মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে চলে না, অন্য কোন নিয়মে চলে – তাহলে বলতে হবে ওটা নিছক কল্পনা, বাস্তবের সাথে তার কোন সম্পর্ক প্রমাণিত হয়নি। 

আরো তথ্য: ‘প্রিলিমিনারি অ্যাসেসমেন্ট: আন-আইডেন্টিফায়েড অ্যারিয়েল ফেনোমেনা’, অফিস অব দি ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, জুন ২০২১। মাইকেল গেইনার, দি ফিজিক্স অব ইউ-এফ-ওজ, স্কেপটিক ২০১২। উইলিয়াম মার্কোইজ, দি ফিজিক্স এন্ড মেটাফিজিক্স অব আন-আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্টস, সায়েন্স ১৯৬৭।

______________

বিজ্ঞানচিন্তা জানুয়ারি ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত










Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts