Thursday 30 August 2018

আইনস্টাইনের খাবারদাবার




কবি-সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত খাবার-দাবার সম্পর্কিত গবেষণা প্রায়ই হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের খাদ্যরুচি কেমন ছিল, কয়টি পদ দিয়ে তিনি রাতের ভোজন সারতেন, প্রাতঃরাশে রুটি খেতেন নাকি লুচি, ইত্যাদি প্রসঙ্গও খুবই গুরুত্ব পায় রবীন্দ্র-আলোচনায়। হুমায়ূন আহমেদ খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতে ভালোবাসতেন, রান্না ও খাবারের প্রতি তাঁর বিশাল আগ্রহের কথাও খুব জানা যায়। ড. আনিসুজ্জামান কিংবা আবু হেনা মোস্তফা কামালের কঠিন-পানীয়প্রীতির কথাও অজানা নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও খেতে পছন্দ করতেন, কঠিন-পানীয় পেলে তো কথাই ছিল না। নতুন নতুন খাবার সে কাঁচা ঝিনুকই হোক কিংবা ব্যাঙের স্যুপ, সুনীল খেতেন খুব আগ্রহ নিয়ে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যে খাদ্যের ব্যাপারে কট্টর রক্ষণশীল- অনুকূল ঠাকুরের বাণী সহযোগে সিদ্ধ চাল-ডাল ছাড়া আর কিছুই তেমন খান না, আমেরিকায় যাবার সময়েও গামছা বেঁধে নিজের চাল-ডাল সাথে নিয়ে যান, তাও আমরা জানি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন তাঁদের বৈজ্ঞানিক অবদান এতটাই প্রাধান্য পায় যে তাঁরা কী খান, কী পান করেন, কী কী খেতে ভালোবাসেন, কী কী খাবারের গন্ধও সহ্য করতে পারেন না এসব ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। তবে কোন বিজ্ঞানী যদি তাঁর বৈজ্ঞানিক সীমারেখা ছাপিয়ে ঢুকে পড়েন একেবারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তখন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে আমাদের কৌতূহল হয়। আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে তেমনটিই হয়েছে।

আইনস্টাইনের মতো এতটা প্রচার আর কোন বিজ্ঞানীই পাননি কখনো। আইনস্টাইনের আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ভাবনাকে বদলে দিয়েছে, মহাবিশ্বের অজানা রহস্য সন্ধানে তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে এড়িয়ে চলার কোন উপায় নেই। এটা তো বৈজ্ঞানিক সত্য। এর বাইরে বিশাল সংখ্যক মানুষ আছেন যাঁরা আইনস্টাইন ঠিক কী আবিষ্কার করেছেন তা হয়তো ঠিকমতো বলতে পারবেন না, কিন্তু আইনস্টাইনের বড় ফ্যান। আইনস্টাইন সম্পর্কে এত বেশি ঘটনা ও মিথ প্রচারিত হয়েছে প্রচারমাধ্যম এবং লোকের মুখে মুখে - যে আইনস্টাইন নিজেও এক এক সময় আশ্চর্য হয়ে গেছেন ওসব দেখে এবং শুনে। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ আইনস্টাইন তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে লেখা চিঠিতে এ প্রসঙ্গে বলেন, "আমার সম্পর্কে ইতোমধ্যে এত বেশি মিথ্যা আর বানানো কথা প্রচার করা হয়েছে যে আমি যদি ওসবের দিকে মনযোগ দিতাম তাহলে এতদিনে আমাকে কবরে ঢুকে যেতে হতো।"

এত প্রচারের মধ্যেও আইনস্টাইনের খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে কিন্তু তেমন কোন মিথ বা গুজব কিছুই নেই। কারণ খাবার-দাবারের ব্যাপারে আইনস্টাইন ছিলেন একেবারে যাচ্ছেতাই সাধারণ মানের। আইনস্টাইন পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য খেতেন, রসনার তৃপ্তির জন্য নয়। খাবার সময়েও তিনি এত অন্যমনস্ক থাকতেন যে কী খাচ্ছেন ঠিক খেয়ালও করতেন না।

ছোটবেলায় আইনস্টাইনের মা পলিন ভালোমন্দ রান্না করে ছেলেকে খাওয়াতেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই কোন খাবারের প্রতিই বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না আইনস্টাইনের। তারপর কিশোর বয়স থেকেই তো আইনস্টাইন বাড়ির বাইরে। স্কুলের দিনগুলি খুব একটা সুখের কাটেনি তাঁর। খাবার-দাবারের ব্যাপারটা তাই কোনদিনই সেরকম ভাবে উপভোগ করার অভ্যেস তৈরি হয়নি।

পলিটেকনিকে পড়ার সময় মিলেইভার প্রেমে পড়ার পর মাঝে মাঝে হোস্টেল রুমে আইনস্টাইনের জন্য রান্না করতেন মিলেইভা। কিন্তু আইনস্টাইন বৈজ্ঞানিক আলোচনা কিংবা প্রেমে এতটাই মশগুল থাকতেন যে মিলেইভা কী রান্না করেছেন তা খেয়ালও করতেন না। সেই সব দিনগুলিতে চুমু ছাড়া আর কোন কিছুই আগ্রহ নিয়ে খেতেন না আইনস্টাইন।


মিলেইভা ও আইনস্টাইন


১৯০০ সালে পড়ালেখা শেষ হবার পর থেকে প্রায় তিন বছর একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করেছেন আইনস্টাইন। সেই সময়টাতে কিছুই তেমন করতে না পেরে বিজ্ঞাপন দিয়ে টিউশনি খুঁজেছেন। যেকোন খন্ডকালিন চাকরির খবর পেলেও ছুটে গেছেন সেখানে। অনেক চেষ্টার পর এক বন্ধুর সুপারিশে ১৯০১ সালের মে জুন ও জুলাই - এই তিন মাসের জন্য একটা ছুটিজনিত পদে শিক্ষকতার চাকরি পান আইনস্টাইন। উইন্টারথুর টেকনিক্যাল স্কুলের কাছাকাছি একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করে আইনস্টাইন স্কুলে পড়াতে শুরু করলেন। সেই সময় তিনি যখন যা পেতেন তাই খেতেন।

দ্রুত শেষ হয়ে গেলো তিন মাসের চাকরি। আরেকটা চাকরির চেষ্টা শুরু করলেন উইন্টারথুরের বাসা থেকেই। ওখান থেকে পনেরো মাইল দূরে জার্মান সীমান্তঘেঁষা সুইজারল্যান্ডের শ্যাফুসেন নামক গ্রামে একটা চাকরির খবর পাওয়া গেলো। আইনস্টাইনের বন্ধু কনরাড হ্যাবিশ্‌ট চাকরিটার খবর দিয়েছেন। চাকরিটিও আহামরি কিছু নয়। স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ফেল করা একজন ছাত্রকে প্রাইভেট পড়িয়ে পাস করিয়ে দেয়া। উইন্টারথুরের পাট চুকিয়ে আইনস্টাইন চলে গেলেন শ্যাফুসেনে। গিয়ে দেখলেন ওটা একটা প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুল। ধনী লোকের গাধা টাইপ ছেলেদের স্কুল সার্টিফিকেট পাস করিয়ে দেয়ার একটা প্রাইভেট প্রকল্প। জ্যাকব নুয়েশ নামে মিলিটারি মেজাজের একজন লোক এই প্রকল্পের পরিচালক। মাসিক দেড়শো ফ্রাঙ্ক বেতন ঠিক হলো আইনস্টাইনের জন্য। আইনস্টাইন আরেকটু বেশি বেতনের আশা করেছিলেন। কিন্তু এই দেড়শো ফ্রাঙ্কের চাকরিও তিনি আর কোথায় পাবেন। তবে এখানে তিন বেলা খাওয়া-দাওয়া ফ্রি। খেতে হয় নুয়েশের বাড়িতে।

যে ছেলেকে পড়াতে হবে তার নাম লুইস ক্যাহেন। ধনী মায়ের সন্তান লুইস গণিতে মহাগর্দভ। আইনস্টাইন যত্ন করে নিজের সহজাত এলোমেলো ঢিমেতাল পদ্ধতিতে পড়ানো শুরু করলেন লুইসকে। লুইস এতদিন শুধু মিলিটারি মেজাজের শিক্ষকই দেখেছে। আইনস্টাইনের মতো ভোলাভালা শিক্ষক পেয়ে বেশ খুশি হয়ে গেলো সে। আইনস্টাইনের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তার। ক্রমে আইনস্টাইন জানতে পারলেন লুইসের পড়াশোনার জন্য তার মা বছরে চার হাজার ফ্রাঙ্ক দেন নুয়েশের হাতে। আর নুয়েশ আইনস্টাইনকে দিচ্ছেন মাসে দেড়শো করে! তার মানে বছরে ২২০০ ফ্রাঙ্ক মেরে দিচ্ছেন নুয়েশ? আইনস্টাইনের টাকার টানাটানি চলছে তখন ভীষণ। হঠাৎ রেগে গেলেন তিনি। নুয়েশকে গিয়ে বললেন, "লুইসের মায়ের কাছ থেকে চার হাজার নিয়ে আমাকে শুধু আঠারো শ' দিতে লজ্জা করে না আপনার?"

নুয়েশ বুঝতে পারলেন কী বলতে চাইছেন আইনস্টাইন। কিন্তু চোরদের গলা সব কালেই বড় হয়। নুয়েশ বাজখাঁই বলায় বললেন, "কী বললেন? আমি টাকা মেরে দিচ্ছি? আপনি যে তিন বেলা আমার বাড়িতে খাচ্ছেন তা কি আকাশ থেকে আসছে? সেজন্য খরচ হচ্ছে বছরে আড়াই হাজারেরও বেশি। লুইসের মা যা দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে আমার।"

আইনস্টাইন অবাক হয়ে গেলেন। নুয়েশের বাড়িতে তিন বেলায় তিনি যা খান তাতে মাসে বড় জোর বিশ-পঁচিশ ফ্রাঙ্ক লাগতে পারে। আইনস্টাইন পরিষ্কার বুঝতে পারলেন নুয়েশ একজন নির্লজ্জ মিথ্যাবাদীও বটে। 

আইনস্টাইন নুয়েশকে বললেন, "আপনি যে খাবার আমাকে দেন ওসব অখাদ্য। আমি আপনার বাড়িতে খাবো না। আপনি ওই বারো মাসের বাইশ শ' অর্থাৎ মাসে ১৮৩ ফ্রাঙ্ক করে আমাকে দিয়ে দেবেন।"
" না, তা হবে না। আপনাকে আমার বাড়িতেই খেতে হবে।"
"না, ওই অখাদ্য আমি খাই না।" - 

এই প্রথম আইনস্টাইন খাদ্যাখাদ্য বিচার করেছেন। তাও ঠিক খাদ্যের জন্য নয়, একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। আইনস্টাইন জোর দিয়ে বললেন, "তাহলে অন্য চাকরিতে যোগ দিতে হবে আমাকে। আপনার বাড়িতে খেয়ে আমার পোষাচ্ছে না।"

আইনস্টাইন জেদের বশে বলে ফেলেছেন বটে যে চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু মনে মনে জানেন যে চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি চলতে পারবেন না। এদিকে নুয়েশ ভয় পেয়ে গেছেন যে তাঁর কুকীর্তির কথা লুইসের মায়ের কানে গেলে অর্থ আর মান দুটোই যাবে। তাই আইনস্টাইনের সাথে একটা রফায় এলেন নুয়েশ। ঠিক হলো আইনস্টাইন হোটেলে খাবেন। তাতে যা বিল আসবে তা নুয়েশ মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু হোটেলে খেতে গিয়েও আইনস্টাইন প্রতিদিনই একটা স্যুপ কিংবা সাধারণ কিছু খাবার খেয়ে চলে আসেন।

নুয়েশ আইনস্টাইনকে কোনদিনই সহ্য করতে পারেননি। বার্নের প্যাটেন্ট অফিসে আইনস্টাইনের চাকরি হচ্ছে হবে করতে করতেও অনেকদিন চলে গেলো। নুয়েশ জানতে পারলেন যে চাকরির বাজারে আইনস্টাইনের দাম খুব একটা নেই। তাছাড়া এও জানতে পারলেন যে আইনস্টাইন লুইসকে বার্নে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করছেন। নুয়েশ তা হতে দিতে পারেন না। তিনি আইনস্টাইনকে বরখাস্ত করলেন।

প্যাটেন্ট অফিসে চাকরি হবার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিন্ত আইনস্টাইন। কিন্তু তার জন্য আরো কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা জানেন না তিনি। চাকরি হারিয়ে বার্নে চলে এলেন আইনস্টাইন। বার্নে একটা বাসা ভাড়া করে তাতে ছাত্র পড়াবার বিজ্ঞাপন দিলেন। আইনস্টাইনের 'পড়াইতে চাই' বিজ্ঞাপন দেখে একজন মাত্র ছাত্র এসেছিলেন - মরিস সলোভাইন। পরে মরিস আইনস্টাইনের বন্ধু হয়ে ওঠেন। আরেক বন্ধু হ্যাবিশ্‌ট বার্নেই থাকতেন। আইনস্টাইন হ্যাবিশ্‌ট আর সলোভাইনকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন অলিম্পিক একাডেমি। তিন সদস্যের এই একাডেমিতে দিন-রাত বিজ্ঞানচর্চা চলে।


কনরাড হ্যাবিশ্‌ট, মরিস সলোভাইন, ও আলবার্ট আইনস্টাইন


জ্ঞানচর্চা অব্যাহত গতিতে চললেও উপার্জনের কিন্তু কোন উপায় হয়নি তখনো। আইনস্টাইনের জমানো টাকা ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো খাবারই জোটে না - এমন অবস্থা। আইনস্টাইন বেশ কয়েকদিন ধরে শুধু রুটি খেয়ে থাকছেন দেখে বন্ধুদের খুব কষ্ট হলো। তাঁরা প্ল্যান করলেন আইনস্টাইনের জন্মদিনে তাঁকে ক্যাভিয়ার খাওয়াবেন।



১৯০২ সালের ১৪ মার্চ আইনস্টাইনের ২৩তম জন্মদিনে বার্নে আইনস্টাইনের বাসায় বসেছে অলিম্পিক একাডেমির আসর। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাভিয়ার এনে প্লেটে সাজিয়ে আইনস্টাইনের সামনে রেখেছেন সলোভাইন ও হ্যাবিশ্‌ট। তাঁদের দুজনের খুব ইচ্ছে - ক্যাভিয়ার খেয়ে আইনস্টাইনের কী প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার। এদিকে আইনস্টাইন বস্তুর জড়তার ধর্ম নিয়ে চিন্তা করছেন বেশ কয়েকদিন থেকে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন সেদিন সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন। 

সলোভাইন আর হ্যাবিশ্‌ট সামনে আসার সাথে সাথেই আইনস্টাইন শুরু করে দিয়েছেন তাঁর আলোচনা। খেতে খেতেই বলে চলেছেন প্রোপার্টি অব ইনারশিয়া প্রসঙ্গে। আলোচনা শেষ হবার আগেই প্লেটের খাবার শেষ হয়ে হেলো। 

হ্যাবিশ্‌ট জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি আজ কী খেয়েছো বুঝতে পেরেছো?"
"কী খেলাম আজ?"
"ক্যাভিয়ার"
"ক্যাভিয়ার! ওটা ক্যাভিয়ার ছিলো? আগে বললে না কেন? বস্তুটাকে একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখতাম। আহা হা, ক্যাভিয়ার। দেখলে তো কেমন চাষার মতো খেলাম! ক্যাভিয়ারের অপমান হলো আজ।"

সলোভাইন আর হ্যাবিশ্‌ট ভাবলেন ক্যাভিয়ারের কথা আগেই আইনস্টাইনকে জানিয়ে দেয়া উচিত ছিল। কিছুদিন পরে তারা আবার ক্যাভিয়ার নিয়ে এলেন আইনস্টাইনের জন্য। আইনস্টাইন খেতে শুরু করতেই তাঁরা চিৎকার করে স্লোগান দিতে শুরু করলেন, "কী খাচ্ছে আইনস্টাইন?" 
"ক্যাভিয়ার, ক্যাভিয়ার"।


জেনেশুনে ক্যাভিয়ার খাওয়ার পরেও আইনস্টাইনের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। বরং সলোভাইন আর হ্যাবিশ্‌টের ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাস দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, "ক্যাভিয়ার খেতে ভালো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা নিয়ে ওরকম লাফালাফি করার মতো কিছু নেই ক্যাভিয়ারের মধ্যে।" 
সলোভাইন ও হ্যাবিশ্‌ট বুঝলেন ভালো খাবার-দাবারের সমঝদার আর যেই হোন - আইনস্টাইন নন।

বিয়ের পর মিলেইভা খাবারদাবারের ব্যাপারে আইনস্টাইনকে কিছুটা ভদ্র বানানোর চেষ্টা যে করেননি তা নয়। নানা রকম রান্না করতেন মিলেইভা। কিন্তু আইনস্টাইনের অনাগ্রহ এতটাই বেশি যে তাঁকে খাইয়ে কোন আনন্দ পাওয়া যায় না। বিয়ের আগে চুমু খাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহ থাকলেও বিয়ের পর আইনস্টাইনের সেই উৎসাহেও ভাঁটা পড়েছে। 

আইনস্টাইন ইতোমধ্যে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর পাঁচটি গবেষণাপত্র বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। বার্লিন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়েছেন আইনস্টাইন। স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটির পর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে গবেষণা করছেন দিনরাত। মিলেইভার দিকে ফিরে তাকানোর আগ্রহও নেই আইনস্টাইনের। তবে তাঁর নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছে তাঁর চেয়ে চার বছরের বড় মাসতুতো বোন এলসার প্রতি। 

১৯১৩-১৪ সাল দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে মিলেইভা আলাদা হয়ে বার্লিন ছেড়ে চলে যান সুইজারল্যান্ডে। বার্লিনের বাসায় একা আইনস্টাইন কাজ করছেন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই তাঁর। যখন প্রচন্ড ক্ষুধা লাগে কিছু একটা রাঁধতে হয় তাঁকে। রান্নাঘরে যথাসম্ভব কম সময় কাটানোর জন্য কিছু সংক্ষিপ্ত রন্ধনপ্রণালী আবিষ্কার করলেন আইনস্টাইন। দোকান থেকে কেনা স্যুপের টিন খুলে তা একটা পাত্রে ঢেলে চুলায় বসিয়ে দেন। স্যুপের সাথে ডিমটাও সিদ্ধ হয়ে যায়। একদিন এলসার মেয়ে মার্গট গিয়ে দেখেন আইনস্টাইন স্যুপের মধ্যে ডিম ভেঙে খাচ্ছেন। স্যুপে দেয়ার আগে ডিমটা যে ধোয়া দরকার সেদিকে কোন খেয়াল নেই তাঁর। মার্গটের প্রায় বমি এসে গেলো আইনস্টাইনের খাওয়া দেখে।

এলসার সাথে বিয়ের পরেও আইনস্টাইনের খাওয়া-দাওয়ার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। তারপর অনেক বছর পরে আইনস্টাইন যখন প্রিন্সটনে চলে গেলেন তাঁর জার্মানির জীবন-যাপনের সাথে আমেরিকান জীবন-যাপনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলেও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা আগের মতোই এলোমেলো রয়ে যায়। আইনস্টাইনের সেক্রেটারি হেলেন ডুকাস আইনস্টাইনকে চোখে চোখে রাখেন, আড়াল করে রাখেন সব উটকো ঝামেলা থেকে। কিন্তু আইনস্টাইন নিজের পড়ার ঘরে এলোমেলো যাচ্ছেতাই রকমে থাকতে পছন্দ করেন। মার্সার স্ট্রিটের দোতলা বাড়ি থেকে নিচে নেমে এসে আশেপাশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে ভাব করেন আইনস্টাইন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জানেও না আইনস্টাইন কত বড় বিজ্ঞানী, কত বড় সেলিব্রেটি।

পাশের বাড়ির আট বছর বয়সী মেয়ের সাথে বেশ ভাব আইনস্টাইনের। বাড়ির দরজা খোলা পেলেই মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সোজা আইনস্টাইনের পড়ার ঘরে ঢুকে যায়। আইনস্টাইন মেয়েটিকে অংক শেখাতে শুরু করেন। একদিন মেয়েটির খোঁজে সেখানে হাজির হয় মেয়েটির চৌদ্দ বছর বয়সী বড় বোন জেন সুইং এবং তার বান্ধবী। নিচের তলার বসার ঘরে সবকিছু চমৎকার সাজানো গোছানো। কিন্তু দোতলায় আইনস্টাইনের পড়ার ঘরে ঢুকে জেন অবাক হয়ে গেলো। এত অগোছালো ঘর সে আগে কখনো দেখেনি। টেবিল চেয়ার ঘরের মেঝে সবখানেই এলোমেলো কাগজ, খাতা, বইপত্র ডাঁই করে রাখা। আইনস্টাইনের পোশাক পরিচ্ছদ, মাথার চুল সবই এলোমেলো। ঘরের মাঝামাঝি একটা লম্বা টেবিলে বই খাতা খোলা কলমের পাশে খাবারের ময়লা প্লেট। ঘরের এক কোণে একটা ময়লা স্টোভ। দেখে মনে আইনস্টাইন এই ঘরেই রান্নাবান্না করে খান।

কিশোরী জেন ও তার বান্ধবীকে দেখে আইনস্টাইন খুশি হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা কি আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাও?"
আইনস্টাইন কী খান এবং কী খাওয়ান দেখার ইচ্ছেয় জেন বললো, "অবশ্যই"।
"তবে বসে যাও।"

জেনকে বসতে বলেই আইনস্টাইন কোণার স্টোভটা টেনে নিয়ে এলেন ঘরের মাঝখানে। জেন কোথাও বসার জায়গা দেখলো না। কারণ ঘরের দুটো চেয়ারের উপরেই বইয়ের স্তূপ। আইনস্টাইন ক্যান ওপেনার দিয়ে একটা একটা করে তিনটা স্যুপের ক্যান খুললেন। তারপর একটা একটা করে ক্যান স্টোভের উপর রেখে গরম করলেন। বই খাতার স্তূপ থেকে হাতড়ে হাতড়ে কয়েকটি ময়লা চামচ বের করে ক্যানের ভেতর দিয়ে গরম ক্যানগুলো এগিয়ে দিলেন জেন ও তার বান্ধবীর দিকে - "খাও"। 

জেন ও তার বান্ধবীর বমি এসে যাবার অবস্থা। তারা মুখে হাত চাপা দিয়ে দেখে যে আইনস্টাইন আরাম করে ক্যান থেকে স্যুপ খাচ্ছেন। স্যুপ লেগে গেছে তাঁর গোঁফে, গোঁফ থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়ে সোয়েটার ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেদিকে কোন নজর নেই আইনস্টাইনের, তিনি অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন গণিতের নিয়মকানুন প্রসঙ্গে।

আইনস্টাইন মদ পান করতে পছন্দ করতেন না। অ্যালকোহলের প্রতি কোন আগ্রহই তাঁর ছিল না। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর তিনি যখন সেলিব্রেটিদেরও সেলিব্রেটি হয়ে গেছেন, তখন এক আমেরিকান সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আমেরিকায় মদের ওপর ট্যাক্স যে বাড়ছে তাতে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?"

আইনস্টাইন তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিলেন, "মদের ট্যাক্স বাড়ুক বা কমুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আমাকে মদ পান করতে হয় না।" 

পানি ছাড়া আর যে পানীয় আইনস্টাইন পান করতেন তা হলো কফি। কিন্তু কফির ব্যাপারেও তাঁর কোন বিশেষ পছন্দ অপছন্দ ছিল না। যে কোন কফি হলেই তাঁর চলতো।

একটা নেশাই আইনস্টাইনের ছিল - তা হলো পাইপ টানা। আইনস্টাইন পাইপ ধরেছিলেন ১৮৯৯ সালে বিশ বছর বয়সে। আর ছাড়তে পারেননি। বিজ্ঞানী হিসেবে যে আইনস্টাইন ছিলেন প্রচন্ড উত্তেজক, খাদ্যাভ্যাসে সেই আইনস্টাইনই ছিলেন ভীষণ একঘেঁয়ে। তাতে অবশ্য বিজ্ঞান-জগতের কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। 




Tuesday 28 August 2018

জসীমউদ্দীন মন্ডলের জীবনের রেলগাড়ি




কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডলের "সংগ্রামী স্মৃতিকথা" 'জীবনের রেলগাড়ি' প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে। একজন সংগ্রামী শ্রমিক নেতা যখন ৮৮ বছর বয়সে স্মৃতিকথা লেখেন, তখন পাঠক সাধারণত আশা করেন যে ইতিহাসের একটা সময় সেখানে ধরা থাকবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। সেই ইতিহাস যে লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হবে সেটাও পাঠক জানেন। তবুও পাঠক আগ্রহ নিয়ে সে লেখা পড়েন - লেখকের হাত ধরে সময়-ভ্রমণ করার জন্য।
            
একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আগ্রহ নিয়ে আমি বইটি পড়েছি কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল তাঁর সংগ্রামী স্মৃতিগুলোকে কীভাবে স্মরণ করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন এবং কী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি জীবনকে দেখেছেন তা জানার জন্য। ১৯২৪ থেকে ২০১২ - ৮৮ বছরের দীর্ঘ জীবনে তিনি সংগ্রাম করেছেন ব্রিটিশ সরকারের সময়, তারপর পাকিস্তান, তারপর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন একজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। তাই তাঁর স্মৃতিকথা - শুধু স্মৃতিকথা নয় কিছুতেই - এটা ইতিহাসের প্রতিফলক হবারও দাবিদার ছিল।
            
মাত্র ১৬ বছর বয়সে রেলগাড়িতে উঠেছেন জসীমউদ্দীন রেলইঞ্জিনে কয়লা ঢালার  শ্রমিক হিসেবে। সেই সময় - ১৯৪০ সালে মাইকিং করে রেলওয়ের শ্রমিক নিয়োগ করা হতো। কর্মসংস্থানের সুযোগ এখনকার তুলনায় অনেক সহজ ছিল বলা চলে। শিয়ালদহ স্টেশনে গোরা সাহেবের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়ে কাজ পেয়ে গেলেন তিনি। মাসিক বেতন ১৫ টাকা। আর বেতন পাবার দিন থেকেই 'লাল ঝান্ডা' পার্টি তাঁর কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে এক টাকা চাঁদা। হিসেব করে দেখুন বেতনের শতকরা প্রায় সাড়ে ছয় ভাগ পার্টির চাঁদা দিতে হয়েছে সেই ১৯৪০ সালে।
            
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেছিল জার্মানি আর জাপানকে। জাপান যখন এশিয়ায় আগ্রাসন চালাচ্ছিল - এমনকি বার্মা পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল তখনো পার্টি সমর্থন করছে জাপানকে, জার্মানির হিটলারকে। সেটা শুধুমাত্র তখনই বদলালো যখন হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলো।
            
তারপর ১৯৪৭। দেশ ভাগের পর জসীমউদ্দীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন রেলওয়ের চাকরির অপশন নিয়ে। ইংরেজ চলে গেলেও তখনো ইংরেজ কর্মকর্তা কাজ করছিলেন পাকিস্তানের অনেক জায়গায়। রেলের অনেক ড্রাইভারও ছিলেন ইংরেজ। এই ইংরেজ ড্রাইভারদের বেতন দেয়া হতো ইওরোপিয়ান গ্রেডে। সেই সময় ১৯৪৯ সালেই রেলওয়ে শ্রমিক থেকে শ্রমিকদের নেতা হয়ে ওঠেন জসীমউদ্দীন। শুরুটা খুবই ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেব থেকে। ১৯৪৯ সাল। দুর্ভিক্ষের আলামত দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান সরকার এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্য-চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে চালের অভাব। ট্রেন-ইঞ্জিনের শ্রমিক হিসেবে জসীমউদ্দীন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যান ট্রেন নিয়ে। আনমুরা থেকে তিনি চাল কিনে নিয়ে আসতেন ঈশ্বরদীতে। কাজটা ছিল বেআইনী। একদিন এরকম তিন মণ চাল রেলের ইঞ্জিনে করে নিয়ে আসার সময় সরকারের মিলিশিয়া বাহিনী সেই চাল জব্দ করে নিয়ে যায়। জসীমউদ্দীন মন্ডলের নেতৃত্বে রেলওয়ে শ্রমিকেরা ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। দাবি আদায় হয়। চাল ফেরত দেয়া হয়। শুধু তাই নয় - রেলওয়ে শ্রমিকেরা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চাল নিয়ে যেতে পারবে সেই অনুমতিও দেয়া হয়। জসীমউদ্দীন মন্ডল নেতা হয়ে যান।
            
তারপর এই কাজের জন্য তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু সমস্যা হয়নি। তাঁর যে চাল নিয়ে আসার পারমিট ছিল সেটা ব্যবহার করে তিনি চালের ব্যবসা শুরু করেন। ট্রেনে করে চাল নিয়ে আসেন বিভিন্ন জেলা থেকে  এবং তা বেশি দামে বিক্রি করেন দুর্ভিক্ষের বাজারে। এবং তখনো তিনি শ্রমিক নেতা।
            
১৯৪৯ সালে তিনি খুদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই খুদ আন্দোলন হয়েছিল রেলওয়ে শ্রমিকদের চালের বদলে খুদ দেয়াকে কেন্দ্র করে। রেলওয়ে শ্রমিকেরা মুরগি নয়, তারা খুদ খাবে না। তাদের চাল দিতে হবে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়। তিনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন অনেকদিন। তাঁকে সহায়তা করেছেন পার্টির কর্মীরা। একদিন ধরা পড়েন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত পাঁচ বছর জেলে ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। তারপর থেকে ধরতে গেলে তিনি পার্টির মাসোহারাতেই চলেছেন। তিনি শ্রমিক না হয়েও শ্রমিকনেতা ছিলেন এবং পার্টির নির্দেশে শ্রমিক সংগঠন করে গেছেন।
            
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। এত বড় শ্রমিক নেতা - দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে - সেখানে সম্পৃক্ত হননি সেভাবে এটা খুবই আশ্চর্যের। আসলে সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তা কোথাও তিনি পরিষ্কার করে লেখেননি। সেই ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে বর্ণনা কমরেড জসীমউদ্দীন দিয়েছেন তা এতটাই বিক্ষিপ্ত আর এতটাই পার্টি নির্দেশিত যে তা পড়ে খুবই হতাশ হতে হয়। জ্যোতিবসুর কথা তিনি লিখেছেন বার বার। মৌলানা ভাসানীর কথা লিখেছেন বার বার। আক্ষরিক অর্থেই তিনি মৌলানা ভাসানীর পা টিপেছেন তাও লিখেছেন, আইয়ুব খানের কথা লিখেছেন, ফাতেমা জিন্নাহ্‌র কথা লিখেছেন, অথচ একটি বারের জন্যও শেখ মুজিব বা বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করেননি। যেন সেই মানুষটি কখনোই ছিল না তাঁর "সংগ্রামী" সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুদের আতিথ্যে বেশ আরামেই ছিলেন। স্বাধীনতার পর যথাসময়ে ফিরেও এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু একটি বারও বঙ্গবন্ধুর নাম না নিয়ে, একটি বারের জন্যও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা উচ্চারণ না করে "সংগ্রামী স্মৃতিকথা" লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একবারের জন্যও মুক্তিযোদ্ধা না বলে বলেছেন "প্রতিরোধ বাহিনী"। এটাই যদি তাঁর পার্টির আদেশ হয়ে থাকে - তাহলে বইতে "মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো" অধ্যায়টি না থাকলেই মনে হয় ভালো হতো।

স্বাধীন বাংলাদেশে এসে তিনি একবার মস্কোও গিয়েছিলেন। সেই বর্ণনাও আছে। তাঁর নিজের ছেলে যে বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে চোরাচালানী হয়েছে এবং সে কারণে তিনি তার ছেলের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেননি তাও আছে। কমরেড জসীমউদ্দীন মন্ডল আজীবন পার্টির হুকুম তামিল করে গেছেন অন্ধ আনুগত্যে। বইয়ের শেষের দিকে তিনি ঠিকই লিখেছেন, "সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনের পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখি, পাওয়ার পাল্লাটি শূন্য। বঞ্চনার পাল্লাটি ভারি হয়ে আছে বেশি। তবুও হতাশ হতে মন চায় না। এ যেনো এক কঠিন নেশা, সুতীব্র আকর্ষণ, যা উপেক্ষা করে থাকা কখনো সম্ভব নয়।" - এখানেই সমস্যা আমার মতো সাধারণ পাঠকের। যারা মনে করে কঠিন নেশা মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তোলে, বিপজ্জনক করে তোলে।  সেটা যদি রাজনৈতিক নেশা হয় - তাহলে তো আরো বিপজ্জনক।

Monday 27 August 2018

সৃজনশীল বিজ্ঞান শিক্ষার একটি নমুনা




বর্তমানে বাংলাদেশের স্কুলশিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পেছনে সারা বছর যতক্ষণ সময় দেয়, পৃথিবীর আর কোন দেশের স্কুল শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পড়াশোনার পেছনে তত সময় দেয় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের স্কুলের পড়াশোনার এখন সবটুকুই পরীক্ষাকেন্দ্রিক। জ্ঞানার্জনের জন্য পড়াশোনা শুধু কথার কথা। বাস্তবে মূল উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষায় পাস করা। তাই শিশুশ্রেণিতে ভর্তির পূর্বেই শুরু হয় ভর্তি-পরীক্ষায় পাস করার কোচিং। তারপর স্কুল যত নামী সেই স্কুলের প্রতি শ্রেণিতে প্রতি ক্লাসে ক্লাস-টেস্ট, উইকলি টেস্ট, মান্থলি টেস্ট, অর্ধ-বার্ষিক, বার্ষিক সব মিলিয়ে প্রতি শ্রেণিতে গড়ে শ-খানেক পরীক্ষা দিতে হয় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে। সেসব পরীক্ষায় ভালো করার জন্য স্কুলের বাইরে কোচিং সেন্টারে দিতে হয় আরো কয়েকশ মডেল-টেস্ট। এত পরীক্ষাময় শিক্ষা-ব্যবস্থা আমি আর কোথাও দেখিনি।

স্কুলে যে পরীক্ষাগুলো নেয়া হয় পরীক্ষার সেই খাতাগুলো পরে কেজি দরে বিক্রি করা হয় - এবং সেগুলোর কোন কোনটা মুদির দোকানের ঠোঙা হয়ে মাঝে মাঝে ঘরে চলে আসে। সেরকম একটা ঠোঙা থেকে বিজ্ঞানের যে সব উত্তর দেখলাম সেগুলো থেকে শিক্ষার্থীর (আসলে পরীক্ষার্থীর) সৃজনশীলতার কিঞ্চিৎ পরিচয় পাওয়া যায়, এবং পরীক্ষকও সেখানে নম্বর বিতরণ করেছেন বেশ উদারভাবেই।





ছবি থেকে আপনি নিজেই পড়ে নিতে পারবেন কী লিখেছেন আমাদের নবম শ্রেণির পরীক্ষার্থী। আমি স্কুলের নাম, পরীক্ষার্থীর নাম, রোল নং এগুলো মুছে দিলাম। বাংলা বানানের যে ভয়াবহতা দেখছি - তা কি একার সমস্যা নাকি সমষ্টিগত সমস্যা তা শিক্ষকরাই ভালো বলতে পারবেন। অবশ্য ফেসবুকে ইদানীং যা খুশি লেখার স্বাধীনতার মতোই শব্দের বানানেও স্বেচ্ছাচারিতা প্রকট।

পরীক্ষার্থীর নিজস্ব বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রেখেই হুবহু তুলে দিলাম এখানে:

"১ প্রশ্ননের উত্তর পদার্থবিজ্ঞান

১।(ক) শব্দ কি? শব্দের উৎস বলতে কি বুঝ?

শব্দ: কোন শব্দ বোড়ে আওয়াজ করলে বা যে কোন বাইরে শব্দ করলে তাকে শব্দ বলে।

শব্দের উৎস বলতে আমরা অনেকই অনেক সময় জোড়ে আওয়াজ করি করে থাকি তা হল শব্দ, এবং আনাদের ঘর তেকে টেম, লেড়িৎর, টেলিবিশনের অনেক সময় আওয়াছ করে থাকে। তাকে শব্দ বলে। আবার অনেক সময় আমাদের বাসাতে কোন না কোন জিনিস পড়ে থাকে, এই কারণে খুব জোড়ে আওয়াছ হয়ে তাকে, তাকে শব্দের উৎস বলে। আমাদের দেশে অনেক মানুষে  আবার কেউ বাসি বাজায়, কেউ গান করে, থাকে তাকে ও শব্দের উৎস বলেআবার বেশী শব্দ শুনলে কানে জন্য ক্ষতি হতে পারে। এই জন্য মানুষের শব্দ কম শুনা ভাল।

আমরা শব্দ মাধ্যমে বাভে শুনব যাতে ক্ষতি না হয়, এই কারণে।




খ প্রশ্ননের উত্তর

উত্তর। যে বস্তু কম্পনের ফলের শব্দ সৃষ্টি হয়, কোন বস্তুর কম্পনের ফলেই শব্দের উৎপত্তি হয়। আর যে সব বস্তুর কম্পনের ফলেই শব্দের পরীক্ষার সাহায্যে লাগে। সাধারণত পরীক্ষার জন্য তিনটি জিনিস লাগে।

১। একটি সুরুলী কাঁটা ২। একটি আশের বল
৩। আর একটি আদল গাছের ডাল।

পরীক্ষা সাহায্যে: আমরা প্রথমে সুরুলী কাঁটাটা সহ নিতে হবে এবং আশের বলটাও নিতে হবে তারপর গাছের ডালে সুতা দিয়ে বানতে হবে। আর যকখ আস্তে আস্তে করে বলটা টান দাও। তাহলে কটা বড় আওয়াছ শব্দ করে উটবে। তার তখন থেকে শব্দ সৃষ্টি হবে। আর বলটি যখন নরবে তখন শব্দ বন্দ হয়ে যাবে। আমরা একটু শব্দ কম শুনার জন্য চেষ্টা করব। যাতে আমাদের আর অন্য কোন মানুষের ক্ষতি না হয়।






৪ প্রশ্ননের উত্তর

উঃ
নিরাপত্তা ফিউজঃ আমাদের সবার প্রয়োজন সব সময় নিরাপত্তা থাকা। আর আমাদের ঘরের যদি কোন তার ফিউজ হলে প্রথমে মেন সুয়েছটি করে দিতে হবে। R আমাদের বাড়ীতে নানা ধরনের দুরগঠনা গঠে থাকে এই কারণে বিদ্যুতিক থেকে সচেতনতা হওয়া দরকার।

এর গঠন ও কার্যাবলীঃ আমাদের সকলের দরকার নিরাপত্তা হওয়া। যদি কোন মানুষ কারণের কাজ করে তাকে অনেক নিরাপত্তা হওয়া দরকার। এবং কোন কাজে করার সময় যেন তারটা বন্ধ করে দিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের বাড়িতে বালি দিলে, পাকা ছাড়লে বা টেলিবিশন ছাড়ার আগে খুব হুশিয়ারে ছাড়তে হবে। যাতে কোন দুরগঠনা না হয়। এই কারণে আমাদের খুব সাবধান হতে হবে। এর গঠণ ও কার্যাবলী থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমাদের সকলে নিরাপত্তা দরকার এবং অন্য কেউ বুঝা দরকার।

রাসায়ন বিজ্ঞান





৫ প্রশ্ননের উত্তর

(ক) উঃ ত্বকের যত্নে প্রয়োজনীয়তা: আমাদের সৌন্দর্য্য হল ত্বক। আর খুব বেশি সুন্দর হওয়া প্রয়োজন দরকার নারীরা। অনেক নারীরা ত্বকের যত্নে নিয়ে তাকে। এবং আমাদের দেশের নারীরা ত্বকের যত্ন নিতে পারে। আমাদের প্রয়োজন সব সময় পরীস্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া আর শরীলের প্রতি যত্ব নিবো দরকার।

৭ প্রশ্ননের উত্তর

(ক) তন্তু কাকে বলে।

উত্তর। আমাদের যে কোন বস্তু দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় বা হয়ে তাকে তন্তু বলে। "


চাইলে এর সবটুকুই হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় - যেমন আমরা অন্যান্য সব বিষয়ের ব্যাপারে করে থাকি। এই পরীক্ষার্থী সবগুলো প্রশ্নের জায়গায় 'প্রশ্নন" লিখেছেন। প্রশ্নন বলে কি কোন শব্দ আছে?

Saturday 25 August 2018

একটুখানি আইনস্টাইন



আমাদের সংস্কৃতিতে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সুফল (কিংবা কুফল) ভোগ করতে জানি সবাই, কিন্তু বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয় সম্মান কিংবা ভালোবাসা দিতে আমরা জানি না। আমরা কেউ তেমনভাবে ভেবেও দেখি না যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে আমরা কী কী সুবিধা পাচ্ছি, লেজার রশ্মি আমাদের কোন্‌ কাজে লাগছে কিংবা E=mc2 প্রয়োগ করে কী বিপুল শক্তির অধিকারী আমরা হয়ে উঠছি। জাতি হিসেবে আমরা আবেগপ্রব। ধর্ম-কবিতা-গান-গল্প-নাটক-সিনেমা সর্বোপরি রাজনীতির যত চর্চা আমরা করি বা পিন্ডি চটকাই তার সহস্রাংশ সময়ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য রাখি না। বিজ্ঞানচর্চা নিজেরা করি না তো বটেই - অন্য কেউ করলেও আমরা সহ্য করি না। বিশেষ করে আধুনিক বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরাতন ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই তেড়ে মারতে আসার লোকের অভাব নেই আমাদের বাংলাদেশে। রাষ্ট্রযন্ত্র আধুনিকতার মুখোশ পরে থাকে - কিন্তু মুখশ্রী বদলাতে রাজি নয় কোনভাবেই। এর মধ্যেও শত প্রতিকূলতা দুহাতে ঠেলে বিজ্ঞানচর্চা করে যাচ্ছেন অনেকেই। আইনস্টাইন সারাজীবন উৎসাহ দিয়েছেন এসব লড়াকু বিজ্ঞান-সৈনিকদের। আমার বিশ্বাস আমাদের দেশেও বিজ্ঞান-সৈনিকের সংখ্যা বাড়বে দিনে দিনে, একদিন আমাদের দেশেও গড়ে উঠবে আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানী। আইনস্টাইনের জীবন থেকে নেয়া আজকের লেখাটি বাংলার বিজ্ঞান-সেনাদের জন্য


জীবনবৃত্তান্ত


আইনস্টাইনের জীবনবৃত্তান্ত বহুল প্রচারিত। আইনস্টাইনই একমাত্র বিজ্ঞানী যাঁর এক বা একাধিক জীবনী পৃথিবীর প্রায় সবগুলো ভাষাতেই প্রকাশিত হয়েছে। তবে তাঁর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক জীবনবৃত্তান্ত রচিত হয়েছিল  ১৮৯৬ সালে তাঁর সতের বছর বয়সে তাঁর নিজের হাতেই। আইনস্টাইন তখন সুইজারল্যান্ডের আরাউ অঞ্চলের আরগাউ স্কুল থেকে ফেডারেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে লেখা তার জীবনবৃত্তান্ত ছিল এরকম:

১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ উল্‌ম শহরে আমার জন্ম। এক বছর বয়সে আমি মিউনিখে আসি। ১৮৯৪-৯৫ সালের শীতকাল পর্যন্ত আমি মিউনিখেই ছিলাম। সেখানেই আমার ইলিমেন্টারি স্কুল, তারপর লুটপোল্ড সেকেন্ডারি স্কুলে ক্লাস সেভেনে উঠেছিলাম, কিন্তু শেষ করা হয়নি। তার আগেই আমি মিলানে চলে গিয়েছিলাম এবং সেখানেই ছিলাম গত বছরের শরৎকাল পর্যন্ত। নিজে নিজেই পড়াশোনা করেছি মিলানে। তারপর গত বছর শরৎকাল শেষে আমি আরাউ এর ক্যান্টোনাল স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেছি।  বর্তমানে আমি গ্রাজুয়েশান পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে ফেডারেল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করা।

অনেক বছর পর ১৯৩২ সালে আইনস্টাইন আরেকবার নিজের হাতে লিখেছিলেন নিজের জীবনবৃত্তান্ত। তখন তিনি অনেক খ্যাতিমান। দশ বছর হয়ে গেছে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান-জগতে তাঁর নামডাক। ১৮৫টি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এসময় গ্যোয়েটে'র মৃত্যু শতবার্ষিকী উপলক্ষে জার্মান একাডেমি অব সায়েন্টিস্ট আইনস্টাইনকে একাডেমির মেম্বারশিপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইনস্টাইনও সম্মত হয়েছেন। কিন্তু সম্মত হয়েই পড়লেন বিপদে। একাডেমির চেয়ারম্যান ইয়া লম্বা এক ফরম ধরিয়ে দিলেন আইনস্টাইনকে। প্রায় পুরো জীবনবৃত্তান্ত লিখতে হলো ওই ফরম পূরণ করতে গিয়ে। ধৈর্য সহকারে আইনস্টাইন লিখলেন সব - জন্ম, স্কুল, প্যাটেন্ট অফিসের টেকনিক্যাল কাজ, উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা, প্রফেশনাল সোসাইটির মেম্বারশিপ সব লিখলেন। কিন্তু নোবেল পুরষ্কার পাবার কথা উল্লেখ করেননি কোথাও। তবে কি নোবেল পুরষ্কারের গুরুত্ব তাঁর কাছে খুব একটা ছিল না? নাকি তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন নোবেল প্রাপ্তির কথা? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা যায়নি কখনো।


জীবনের লক্ষ্য


ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, জীবনের লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয়ে আমরা অনেকেই রচনা লিখেছি স্কুলে। আইনস্টাইনকেও লিখতে হয়েছিল। সেই ষোল বছর বয়সেই আইনস্টাইন জীবনের লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছিলেন এভাবে:

যদি স্কুল গ্রাজুয়েশান পরীক্ষা পাশ করতে পারি, জুরিখের ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হবো। সেখানে চার বছর পড়াশোনা করবো গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে। ভবিষ্যতে আমি নিজেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তত্ত্বীয় শাখার অধ্যাপক হিসেবে দেখতে চাই। তার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। প্রধান কারণ হলো তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও গাণিতিক ভাবনাগুলো অনেক বেশি স্বাধীনভাবে করা যায়। তার পরের কারণ হলো ব্যবহারিক বিজ্ঞানে আমার দক্ষতার অভাব। সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক পেশায় এক ধরণের স্বাধীনতা আছে যা আমাকে ভীষণভাবে আগ্রহী করে তুলেছে সে পেশার প্রতি।

কিন্তু অনেক বছর ধরে অনেক কষ্টের পরে আইনস্টাইন যখন প্রফেসর হলেন, দেখলেন যেরকম স্বাধীনতা তিনি আশা করেছিলেন সেরকম স্বাধীনতা নেই সেখানে। একাডেমিক জগতেও আছে পদোন্নতির ইঁদুর-দৌড়, 'পাবলিশ অর পেরিশ' এর খড়গ। ১৯২৭ সালে বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে ম্যাক্স প্ল্যাংকের প্রফেসর পদ খালি হলে সেই পদ লাভের জন্য প্রফেসরদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তখন আইনস্টাইন তাঁর বন্ধু পল ইরেনফেস্টকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন - আমি ভাই ওসবে নেই। বড় বড় মস্তিষ্কের প্রতিযোগিতায় যাবার আর কোন ইচ্ছেই আমার নেই। এরকম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আমার কাছে অর্থ বা ক্ষমতা লাভের জন্য যুদ্ধ করার মতই হীন মনে হয়।

প্যাটেন্ট অফিসে কাজ করার সময় পদোন্নতির জন্য দু'বার দরখাস্ত করেছিলেন আইনস্টাইন। একবারও সফল হননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর আর কখনো পদোন্নতির জন্য আবেদন করেননি কোথাও। গবেষণাপত্র প্রকাশের প্রচলিত পদ্ধতিও পছন্দ করেননি তিনি। আমেরিকায় যাবার পর ফিজিক্যাল রিভিউতে একটা পেপার পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন রিভিউয়াররা লেখককে পরামর্শ দিচ্ছেন কোন্‌ প্রসঙ্গ কীভাবে লেখা উচিত - আইনস্টাইন বিরক্ত হলেন। তিনি আর কখনো কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি ফিজিক্যাল রিভিউতে।


প্রথম সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি


১৯০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব জেনেভা'র ৩৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একশ জন উদীয়মান প্রতিভাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আইনস্টাইনের নামও সেই একশ' জনের তালিকায় ছিল। আইনস্টাইন এসবের কিছুই জানতেন না। তাঁর প্রধান আবিষ্কারের পেপারগুলো যদিও প্রকাশিত হয়েছে ১৯০৫ সালে কিন্তু তখনো ওগুলো তেমন আলোড়ন তৈরি করেনি। আইনস্টাইন তখনো প্যাটেন্ট অফিসেই কাজ করছেন। এসময় একটা বড় খামে অনেক কাগজপত্র এসে পৌঁছালো তাঁর অফিসে। আইনস্টাইন খাম খুলে দেখেন বেশ সুদৃশ্য টাইপে ছাপানো বেশ কিছু কাগজপত্র। তাঁর মনে হলো ল্যাটিন ভাষায় লেখা কোন বিজ্ঞাপন। অপ্রয়োজনীয় মনে করে তিনি না পড়েই কাগজপত্রসহ খামটি ফেলে দিলেন বাতিল কাগজের স্তুপে। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আইনস্টাইনের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে আইনস্টাইনের বন্ধু লুসিয়েন কাফানের সাথে যোগাযোগ করলো। লুসিয়েন জরুরি ভিত্তিতে আইনস্টাইনকে ডেকে নিয়ে গেলেন জেনেভায় নির্দিষ্ট দিনে, কিন্তু ইউনিভার্সিটির ডিগ্রির ব্যাপারে কিছুই জানাননি।

জেনেভায় গিয়ে আইনস্টাইন দেখলেন জুরিখ ইউনিভার্সিটির অনেক প্রফেসর সেখানে উপস্থিত। জানা গেলো জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের সম্মানসূচক ডিগ্রি দিচ্ছেন। আইনস্টাইনও যে ডিগ্রি পাচ্ছেন তা তাঁরা জানেন, কিন্তু আইনস্টাইন নিজে তা জানেন না। যখন জানলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারণ সমাবর্তনের একাডেমিক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক পোশাক তার নেই। তিনি ভাবলেন কেটে পড়বেন, ডিগ্রি নেবেন না। কিন্তু তাঁর বন্ধু ও প্রফেসররা তা হতে দিলেন না। আইনস্টাইন শোভাযাত্রায় অংশ নিলেন তাঁর আটপৌরে কুচকানো কোট আর খড়ের টুপি পরে। পুরো সমাবর্তনে আইনস্টাইনই ছিলেন একমাত্র অনানুষ্ঠানিক। আরো মজার বিষয় হলো - আইনস্টাইনের এই প্রথম সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রির সনদে তাঁর নামের বানান ছিল ভুল। প্যাঁচানো অক্ষরের ফরাসি ভাষায় তাঁর নাম লেখা ছিল 'আলবার্ট টাইনস্টাইন'

আইনস্টাইন জীবনে অসংখ্য সম্মাননা, পুরষ্কার, সনদপত্র পেয়েছেন। কিন্তু একটি মাত্র সনদ ছাড়া আর কোন সনদই তিনি বাঁধিয়ে রাখেননি বা প্রদর্শন করেননি। সবগুলো সম্মাননা সনদই তিনি ফেলে রাখতেন ঘরের এক কোণে, অনেকটা লুকিয়ে। নোবেল পুরষ্কারের সনদও লুকিয়ে ছিল সেই নিভৃত কোণে। যে সনদটি তিনি তাঁর অফিসের দেয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন তা ছিলো ১৯৩৬ সালে বার্ন সায়েন্টিফিক সোসাইটি যে ডিপ্লোমা সনদটি তাঁকে পাঠিয়েছিল। এই সনদটি পেয়ে তিনি এত খুশি হয়েছিলেন যে তাঁর উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল বার্ন সায়েন্টিফিক সোসাইটিকে লেখা তাঁর ধন্যবাদ পত্রে: বার্ন সায়েন্টিফিক সোসাইটি যে আমাকে মনে রেখেছে তার জন্য আমি যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছি তা বোঝানোর ভাষা আমার নেই। এই সনদটি মনে হচ্ছে আমার অনেক দিন আগে ফেলে আসা যৌবনের স্মৃতি। মনে হচ্ছে আমি যেন ফিরে যাচ্ছি আমার যৌবনের সেইসব বিকেলগুলোতে।

আইনস্টাইন তখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কিন্তু মন যে পড়ে আছে ইউরোপে যেখানে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, সংগ্রাম, সাফল্য।


বিজ্ঞান ঈশ্বরের দান!


যে কোন বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে ঈশ্বর-বিশ্বাসীরা শুরুতে 'ঈশ্বর-বিরোধী' কাজকর্ম বলে অপপ্রচার চালিয়ে বাধাগ্রস্ত করে তুলতে সচেষ্ট হয়। তাতে ব্যর্থ হবার পর উল্টোগীত গাইতে শুরু করে এই বলে যে এসব আবিষ্কারের কথা ধর্ম-গ্রন্থগুলোতে কত আগে থেকেই গ্রন্থিত হয়ে আছে। এসব আবিষ্কার তো ওখান থেকেই টুকলিফাই করা। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে এরকম কচলানো শুরু হয়েছিল আইনস্টাইনের জীবদ্দশাতেই।

আইনস্টাইন প্রিন্সটনের এডভান্সড রিসার্চ সেন্টারে অধিষ্ঠিত হবার পর মিডিয়ার কল্যাণে দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন সবার কাছে। প্রতিদিন শত শত চিঠি আসতে থাকে তাঁর কাছে। কত রকম আলোচনা, সমালোচনা, আবদার, প্রশ্ন, অনুরোধ, ভালোবাসা, ঘৃণা সেসব প্রশ্ন জুড়ে। আমেরিকান ইহুদিরা প্রচারে লেগে গেলেন যে আইনস্টাইন তাঁদেরই লোক। আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর যে তাঁদের ধর্মের বিরাট প্রভাব আছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য রাবাইরা উঠেপড়ে লাগলেন। শিকাগোর এক রাবাই "দি রিলিজিয়াস ইমপ্লিক্যাশান্‌স অব দি থিওরি অব রিলেটিভিটি" শিরোনামে এক লেকচার তৈরি করে ফেললেন। তাতে আইনস্টাইনের স্বীকৃতি লাভ করার জন্য এই রাবাই আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে জানালেন তাঁর লেকচারের বিষয়ে।

ধর্মের স্বার্থে বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যায় আইনস্টাইন ভীষণ বিরক্ত হতেন। ১৯৩৯ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি রাবাইকে চিঠি লিখে জানালেন: আমি বিশ্বাস করি না যে আমার আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল ধারণার কোন অংশই ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে দাবি করা যায়। কারণ ধর্মের ধারণা বিজ্ঞানের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যৌক্তিক পৃথিবীতে শুধুমাত্র সাধারণ যুক্তির ধাপগুলো সম্পন্ন করেই এক কাজের সাথে অন্য কাজের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, তাতে ধর্মকে টেনে আনার দরকার হয় না।


ভাগ্যবান আইনস্টাইন


আইনস্টাইনের ৫০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে কার্ড পাঠিয়েছেন সিগমন্ড ফ্রয়েড। কার্ডে ফ্রয়েড আইনস্টাইনকে সম্বোধন করেছেন 'ইউ লাকি ওয়ান' বলে। আইনস্টাইন বুঝতে পারছিলেন না ফ্রয়েডের মত খ্যাতিমান মানুষ কেন তাঁকে ভাগ্যবান বলে মনে করবেন?

ফ্রয়েডকে চিঠি লিখলেন আইনস্টাইন - মহোদয়, আমাকে মনে রাখার জন্য ধন্যবাদ। আপনি আমার ভাগ্যের উপর এত জোর দিচ্ছেন কেন? আপনি যেখান এত মানুষের মনের খবর জানতে পারেন, সমগ্র মানবজাতি যেখানে আপনাকে মনে রাখছে - সেখানে আপনার তুলনায় আমি কীভাবে ভাগ্যবান হই?

উত্তরে ফ্রয়েড লিখলেন - পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের গভীর ধারণা নেই তারা কখনো সাহস পাবে না তোমার কাজের সমালোচনা করার, অথচ আমাকে দেখো - মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে যারা কিছুই জানে না তারাও আমার কাজের বড় সমালোচক। এক্ষেত্রে তুমি ভাগ্যবান নও? 

Friday 24 August 2018

আইনস্টাইন ফ্যাক্টস




১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ সকাল সাড়ে এগারোটায় আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। জার্মান ভাষায় লেখা তাঁর জন্ম-সনদঃ


জার্মান ভাষায় লেখা আইনস্টাইনের জন্মসনদ


বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এরকমঃ

জন্মসনদ
সূত্রঃ ২২৪
উল্‌ম, ১৫ মার্চ ১৮৭৯

১৩৫ নং ব্যানহফস্ট্রাফ (বি), উল্‌ম নিবাসী ইহুদী ধর্মে বিশ্বাসী ব্যবসায়ী হেরমান আইনস্টাইন জানিয়েছেন যে তাঁর উল্‌ম এর বাসায় তাঁর সাথে বসবাসকারী ইহুদী ধর্মে বিশ্বাসী তাঁর স্ত্রী পলিন আইনস্টাইন (কোচ) ১৪ মার্চ ১৮৭৯ তারিখের সকাল এগারোটা ত্রিশ মিনিটে একটি পুং লিঙ্গের শিশু জন্ম দিয়েছেন। শিশুটির নাম রাখা হয়েছেন আলবার্ট।
- পঠিত, অনুমোদিত এবং স্বাক্ষরিত - হেরমান আইনস্টাইন
-নিবন্ধনকৃত - হার্‌টমান।



আলবার্ট আইনস্টাইন - বয়স ৩-৪। আলবার্টের যতগুলো ছবি পাওয়া যায় তাদের মধ্যে এ ছবিটিই তার সবচেয়ে ছোট বয়সের ছবি।  


বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছোটবেলা নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। মাঝে মাঝে তাদের সম্পর্কে এমন অনেক ঘটনা প্রচারিত হয় - যার কিছুটা হয়তো সত্যি, বেশির ভাগই অতিরঞ্জন। আলবার্ট আইনস্টাইন সম্পর্কেও সেরকম অনেক কথা প্রচলিত আছে। যেমন জন্মের সময় নাকি আইনস্টাইনের মাথা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বড়। জন্মের সময় শিশুর মাথার আকার ছোট-বড় হতেই পারে। আলবার্টের মাথার সাইজের মাথা নিয়ে অনেক শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন। তাদের সবাই যে আইনস্টাইন হচ্ছে তা নয়। আলবার্ট অনেক দেরিতে কথা বলতে শুরু করেছিল এ প্রসঙ্গেও নানারকম তথ্য পাওয়া যায়। অনেকেই বলে থাকেন আইনস্টাইন কথা বলতে শুরু করেছেন চার বছর বয়সে - তাও একেবারে পূর্ণ বাক্য দিয়ে। এটাও অতিরঞ্জন।


আলবার্ট আইনস্টাইন - বয়স ১৪


বিশিষ্ট ব্যক্তিরা লেখাপড়ায় সাধারণ মানের হলে আমরা অতি-সাধারণরা  তা খুব মনে রাখি। যেমন রবীন্দ্রনাথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করেও বিশ্বকবিসম্রাট হয়ে উঠেছেন তা আমরা খুব মনে রাখি। আলবার্ট আইনস্টাইনও যে স্কুল-কলেজের লেখাপড়ায় খুব একটা আহামরি কিছু ছিলেন না, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি-পরীক্ষায় একবার ফেল করেছিলেন - তাও খুব যত্ন করে প্রচার করি। দেখা যাক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কেমন করেছিলেন আইনস্টাইন।



  
আলবার্ট আইনস্টাইন ১৭ বছর বয়সে স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাস করেন ক্যান্টন আরগাউ স্কুল থেকে। তাঁর স্কুল পাসের সার্টিফিকেট দেখুন - 

আইনস্টাইনের স্কুল পাসের মার্কশিট


ক্যান্টন আরগাউ শিক্ষাবোর্ড এই মর্মে প্রত্যয়ন করছে যে, মিঃ আলবার্ট আইনস্টাইন, সাং - উল্‌ম, জন্মতারিখ- ১৪ মার্চ ১৮৭৯, আরগাউ ক্যান্টন স্কুলের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর টেকনিক্যাল কোর্সে অধ্যয়ন করেছে। ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮, ১৯, ২১ ও ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে তার প্রাপ্তনম্বর নিম্নরূপঃ

জার্মান - ৫
ফ্রেঞ্চ - ৩
ইংরেজি -
ইটালিয়ান - ৫
ইতিহাস - ৬
ভূগোল - ৪
এলজেব্রা - ৬
জ্যামিতি - ৬
বর্ণনামূলক জ্যামিতি - ৬
পদার্থবিজ্ঞান - ৬
রসায়ন - ৫
প্রাকৃতিক ইতিহাস - ৫
শৈল্পিক অংকন - ৪
কারিগরী অংকন - ৪

প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে এই সনদপত্র প্রদান করা হলো।
আরাউ, অক্টোবর ৩, ১৮৯৬।

তখনকার হিসেবমতে কোন বিষয়ে গ্রেড ৬ হলো সর্বোচ্চ গ্রেড। দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন গড়পড়তা ভালো ছাত্রদের দলেই ছিলেন। স্কুলে ইংরেজি ভাষা তিনি পড়েননি কখনো। বিদেশী ভাষা ফ্রেঞ্চ ও ইটালিয়ান পড়েছিলেন। ইটালিয়ানে ভালোই করেছিলেন। ফ্রেঞ্চ খুব একটা ভালো করেননি।

আলবার্ট আইনস্টাইন - বয়স ১৯


স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে আইনস্টাইন মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। স্কুলের শিক্ষকরা মিলিটারি কায়দায় জোর করে মাথার ভেতর পড়ালেখা ঢোকানোর চেষ্টা করবেন - আর শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এটা তাঁর কোনদিনই ভাল লাগেনি। নিজের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করতে গিয়ে স্কুলে আলবার্টকে অনেক অপমান সইতে হয়েছে। তাই স্কুলিং সিস্টেমের উপরই তাঁর আস্থা চলে গিয়েছিল। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ লাভের জন্য প্রচলিত পরীক্ষাপদ্ধতিরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। কীরকম হওয়া উচিত পরীক্ষাপদ্ধতি? এ প্রশ্নের উত্তরে আইনস্টাইন বলেছিলেন - সারা বছর পাঠদানের পর শিক্ষার্থীরা একটা থিসিস বা এরকম কিছু লিখবে। এবং তা দেখে ডিগ্রি দিয়ে দেয়া হবে। 

মজার ব্যাপার হলো আইনস্টাইনের এ পদ্ধতি আসলে কোন কার্যকরী পদ্ধতি ছিল না। তিনি সিস্টেমের বিরোধীতা করলেও নিজের পছন্দমত কোন সিস্টেম চালু করে যেতে পারেননি। প্রথম চাকরি হিসেবে তিনি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। সেই মিলিটারি কায়দায় শিক্ষাদান পদ্ধতির অংশ হয়েছিলেন। তখন হয়তো তাঁর সুযোগ ছিল না প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তন করার। কিন্তু পরে বার্লিন বা  প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় তিনি তাঁর পছন্দমত শিক্ষাপদ্ধতির প্রয়োগ করতে পারতেন - কিন্তু তা তিনি করেননি। শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব একটা সফল ছিলেন না। তাঁর অধীনে একজন শিক্ষার্থীও পি-এইচডি করেননি। খুব একটা ভালো পড়াতেও পারতেন না তিনি। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে তাঁর অধ্যাপক পদটি ছিল মূলত গবেষণার জন্য। তিনি কোন কোর্স পড়াতেন না সেখানে। ইংরেজি লিখতে পারলেও ভালো বলতে পারতেন না বলেই হয়তো আমেরিকায় বসে ক্লাস নেয়া হয়নি তাঁর তেমন একটা। 

আইনস্টাইন - বয়স ৩৭


আইনস্টাইন আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন ১৯৪০ সালে। তাঁর নাগরিকত্ব সনদ পত্র দেখুনঃ



 
আইনস্টাইনের আমেরিকান জাতীয়তা সনদপত্র



আইনস্টাইনের ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়েও নানারকম মতবাদ চালু আছে। ঈশ্বরবিশ্বাসীরা যখন ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বিরোধ নেই প্রমাণ করতে চান - কিংবা বলতে চান যে বিজ্ঞানে ধর্মের প্রয়োজন আছে - তখন আইনস্টাইনের একটা বাক্য খুব প্রচার করেন - তা হলো, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া, আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। খুবই দার্শনিক কথাবার্তা। কিন্তু তাতে আসলে তেমন কিছুই প্রমাণিত হয় না। অনেক কিছুর ব্যাপারে আইনস্টাইন খোলামেলা কথা বললেও ঈশ্বর বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি খোলাখুলি বলেননি যে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, নাকি করেন না। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করেন না বলেছেন ঠিকই - কিন্তু ইহুদি ধর্মের ব্যাপারে তিনি অনেক কিছু করেছেন। উচ্চমার্গের ঈশ্বর বিশ্বাস তাঁর ছিল সবসময়। আবার ঈশ্বরের নামে মিলিটারি কায়দায় ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। আমাদের পৃথিবীর বেশির ভাগ বুদ্ধিমান পাবলিক ফিগার আসলে এরকম। জনপ্রিয়তা হারানোর রিস্ক কেউই নিতে চান না। ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন নিজেদের জীবনে না থাকলেও অন্যের মনে আঘাত কীভাবে দেবেন - ইত্যাদি যুক্তি দেখিয়ে ঈশ্বরের প্রশ্নে হয় নীরব থাকেন - নয়তো বলে থাকেন যে সকল ঈশ্বরই মহান। আইনস্টাইনও খুব একটা ব্যতিক্রম ছিলেন না এ ব্যাপারে। রিচার্ড ফাইনম্যান বা রিচার্ড ডকিন্সদের মত সাহসী হতে পারেননি আইনস্টাইন। 


আইনস্টাইন - বয়স ৭৫

১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল মারা যান আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর মৃত্যু-সনদ দেখুনঃ


আইনস্টাইনের ডেথ সার্টিফিকেট


আইনস্টাইনের মৃত্যুর এত বছর পরও আইনস্টাইনের বিজ্ঞান এখনো আধুনিক।

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts