Showing posts with label রবীন্দ্রনাথ. Show all posts
Showing posts with label রবীন্দ্রনাথ. Show all posts

Monday, 8 May 2023

গীতবিতান পাঠ - ১

 রবিঠাকুরের গীতবিতানের ভূমিকা।



Friday, 6 August 2021

রবীন্দ্রনাথের শেষ লেখা

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৪১)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শারীরিকভাবে বেঁচেছিলেন আশি বছর (১৮৬১ – ১৯৪১)। তাঁর মৃত্যুর বয়সও আশি হয়ে গেল। অথচ তিনি আমাদের জীবনের মননশীল সব কাজে চিন্তায় আনন্দে বিষাদে প্রেমে বিরহে হেলাফেলায় সারাবেলায় কী অপরূপভাবে জীবন্ত। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ লেখা’ প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর। ১৩৪৮ বাংলার ভাদ্র মাসে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটে তার কিছুদিন আগে – ১৩৪৮ বাংলার ২২শে শ্রাবণ।

‘শেষ লেখা’ গ্রন্থের নামকরণ রবিঠাকুর নিজে করে যেতে পারেননি। বইয়ের ভূমিকায় কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন এ কথা। এই বইতে ১৫টি কবিতা আছে – যার মধ্যে কয়েকটি কবিতা কবি নিজের হাতে লিখতে পেরেছিলেন। বাকিগুলি কবি রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে মুখে মুখে বলেছিলেন – অন্যরা লিখে নিয়েছিলেন। কবি পরে সেগুলি দেখে সংশোধন করেছিলেন। একেবারে শেষের কবিতা “তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’ সংশোধন করার সময় পাননি। 

এই কবিতাগুলির কোনটারই শিরোনাম নেই। কবিতার প্রথম লাইনকেই কবিতার শিরোনাম ধরা হয়েছে। এই ১৫টি কবিতার মধ্যে কয়েকটি কবিতা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। বহুল আলোচিত কবিতার একটি হলো – 


“প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে,

কে তুমি—

মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,

কে তুমি—

পেল না উত্তর।“

এই কবিতাটি কবি লিখেছিলেন ২৭ জুলাই ১৯৪১ সালে – তাঁর মৃত্যুর মাত্র ১২দিন আগে। এই কবিতার অনেক রকমের দার্শনিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে – এখনো হচ্ছে। কবিতাতে যে ব্যাপারটা স্পষ্ট – সেটা হলো জীবনের অস্পষ্টতা। যে আমিত্বের বড়াই মানুষ করে – তার স্বরূপ কী? কে আমি? – এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। 

রবিঠাকুরের জীবনের সর্বশেষ রচনা – 

“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি

বিচিত্র ছলনা-জালে,

হে ছলনাময়ী।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে

সরল জীবনে।

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;

তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।

তোমার জ্যোতিষ্ক তারে

যে পথ দেখায়

সে যে তার অন্তরের পথ,

সে যে চিরস্বচ্ছ,

সহজ বিশ্বাসে সে যে

করে তারে চিরসমুজ্জল।

বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,

এই নিয়ে তাহার গৌরব।

লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।

সত্যেরে সে পায়

আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।

কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,

শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে

আপন ভাণ্ডারে।

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার।“ 


মৃত্যুর আট দিন আগে রচিত (৩০ জুলাই ১৯৪১) এই কবিতায় কি কোনোভাবে কবির বিরক্তি প্রকাশিত হয়েছে ছলনা এবং মিথ্যার কারণে? 

‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে’ – এ যেন আমাদের প্রত্যেকের মনের কথা – যখন আমাদের বিশ্বাস ভেঙে যায় প্রতারণার ফাঁদে। 

কবির জীবনের শেষ পংক্তি – ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে, সে পায় তোমার হাতে – শান্তির অক্ষয় অধিকার।“ এ যেন নিজেকে সান্তনা দেয়া – ছলনা সয়ে যাবার পরেও মনে মনে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা। কষ্ট লাগে – যখন জীবনের সায়াহ্নে বসে বিশ্বকবিকেও ভাবতে হয় কী ছলনাময় এই জগতের চারপাশ। 


Tuesday, 11 May 2021

শিকড়ের সন্ধানে'র রবীন্দ্রজয়ন্তী


 'শিকড়ের সন্ধানে' ও 'নজরুল চর্চা কেন্দ্র' (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) আয়োজিত অনলাইন রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সংগঠনের সুপ্তা পাল ধর। তাঁর অনুরোধে অনুষ্ঠানের প্রথম দিকে মিনিট খানেক কথা বলতে হয়েছিল। 

অনলাইনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন অনেকে। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা ব্যাপী অনুষ্ঠান। 

এই করোনাকালে পৃথিবী একদিকে চরম অসহায় একটি অবস্থা পার করছে। আবার অন্যদিকে বিজ্ঞানের উৎকর্ষে অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে - রবীন্দ্রনাথের কথার রেশ ধরে বলা যায় - দূরকে করেছে নিকট, আর পরকে করেছে ভাই। 

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত মানুষের সামনে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। পদার্থবিজ্ঞানে যেমন আইনস্টাইনকে বাদ দিয়ে তেমন কিছুই করা সম্ভব নয়, তেমনি বাঙালি মনন ও দর্শনে রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া একটা দিনও আমাদের চলে না। তিনি মিশে আছেন আমাদের সত্ত্বায়। আমাদের প্রতিটি দিনই রবীন্দ্রময়। তবুও আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি। এই মহতী আয়োজনে আমাকে আমন্ত্রণ করার জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ। সবাইকে শুভেচ্ছা। 

ইউটিউব লিংক




Sunday, 9 May 2021

ঠাকুরনামা - ১

 


আমাদের ছোটো নদী

রবিঠাকুরকে আমি ঠিক কখন থেকে চিনি তা সঠিকভাবে বলতে পারবো না। এই মানুষটি যে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, মনন, সঙ্গীত, এমনকি দর্শনের জগতের প্রায় পুরোটাই দখল করে আছেন তা জানতে আমার সময় লেগেছে অনেকের চেয়ে বেশি। স্কুলের একেবারে নিচের ক্লাসে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়েছি –

 

“আমাদের ছোটো নদী

চলে বাঁকে বাঁকে

বৈশাখ মাসে তার

হাঁটু জল থাকে।

পার হয়ে যায় গোরু,

পার হয় গাড়ি,

দুই ধার উঁচু তার,

ঢালু তার পাড়ি।

 

চিক্ চিক্ করে বালি,

কোথা নাই কাদা,

একধারে কাশবন

ফুলে ফুলে সাদা।

কিচিমিচি করে সেথা

শালিকের ঝাঁক,

রাতে ওঠে থেকে থেকে

শেয়ালের হাঁক।“

 

এটুকুই ছিল আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইতে – যে বইয়ের নাম ছিল ‘আমার সাথী’। আমাদের ক্লাসে বাংলা পড়াতেন মৌলভী ফররুখ আহম্মদ – আমরা বলতাম ‘ফারুক মলই’। প্রায় এক ফুট লম্বা সাদা দাড়ি ছিল তাঁর। দাড়ির জন্য আমরা বুঝতে পারতাম না তিনি হাসছেন না রেগে আছেন। ক্লাসে কবিতা পড়ানোর নিয়ম ছিল এরকম – তিনি এক লাইন বলবেন, আমরা চিৎকার করে সেই লাইন আবার বলবো। তিনি বই হাতে নিয়ে বলেন – আমাদের ছোটো নদী -, আমরা ক্লাস ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠি – আমাদের ছোটো নদী – এভাবে চলতে থাকে। পরেরদিন এই কবিতা আমাদের মুখস্থ বলতে হতো। মুখস্থ বলতে না পারলে এলোপাথাড়ি মার চলতো। মুখস্থ করার ব্যাপারে আমার ক্ষমতা খুবই কম। স্যারের বেতের বাড়ি আমার হাতে-পিঠে প্রায়ই পড়তো। এই কবিতার লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে একটা শব্দও কোনদিন বলেননি আমাদের স্যার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন না জেনেই মুখস্থ করতে হয়েছিল – আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে।

 

আরো পরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেখলাম – মনে হলো তাঁর দাড়ির সাথে আমাদের ‘ফারুক মলই’র দাড়ির অনেক মিল আছে। আরো পরে পড়লাম পুরো কবিতাটি -

 

“আর-পারে আমবন তালবন চলে,

গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।

তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে

গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

 

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে

আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।

বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,

বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

 

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর

মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।

মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,

ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।

দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,

বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।“

 

মুখস্থ করার বাধ্যবাধকতা যখন চলে গেলো – ভয়টাও চলে গেলো। কবিতার কথাগুলি কত সুন্দর- আর কত পরিচিত তার দৃশ্যগুলি। এ যেন আমাদেরই গ্রামের ছবি,  কবি এঁকেছেন তাঁর কবিতার ছন্দে।

“আমাদের ছোটো নদী, চলে বাঁকে বাঁকে” – এ যেন আমাদেরই গ্রামের ছড়া – যেটা পুবের পাহাড় থেকে নেমে এসে আমাদের বাড়ির খুব কাছ দিয়ে চলে গেছে পশ্চিমে, কোথায় গিয়ে মিশেছে তখনো জানি না।

“বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে” – এই ছড়া পার হয়ে আমাকে স্কুলে যেতে হয়। ছড়ার উপর বাঁশের সাঁকো ধরে পার হবার সময় গা কাঁপে। হাতে ধরার জন্য একটা বাঁশ বাঁধা থাকতো – কিন্তু সেটার নাগাল পেতাম না। বর্ষাকালে ছড়ার পানিতে সাঁকো ডুবে যেতো অনেক সময়। তখন স্কুলে যাওয়া হতো না। কিন্তু শীতকালে ছড়ার পানি শুকিয়ে যেতো, কিছুদিন পরে বালিও শুকিয়ে যেতো। বৈশাখ মাসে হাঁটুজলও থাকতো না। তখন আমার কী মজা যে হতো। সেই বালির উপর দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। শুকনো বালিতে আমরা দলবেঁধে ফুটবল খেলতাম। আমাদের ফুটবল আমরা নিজেরাই তৈরি করে নিতাম কুড়নো প্লাস্টিক আর কাগজ জড়ো করে সুতা দিয়ে বেঁধে। তখন সেই বালির উপর দিয়ে “পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,// দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।“ অবশ্য গাড়ি বলতে তখনো আমরা রিকশা আর ঠেলাগাড়িই বুঝতাম। আমাদের গ্রামে এই দুই প্রকারের গাড়ি ছাড়া তখনো আর কোনো গাড়ি যেতো না।

 

“চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা// একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।// - আমাদের বাড়ির কাছে কাশবন ছিল না। কিন্তু এই নদীর পাড়ে ছিল। কাশবন দেখার জন্য শীতকালে ছড়া বালির উপর দিয়েই হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পূর্বদিকের পাহাড়ের দিকে। বাতাসে দুলতো সাদা কাশফুলের শত শত লম্বা হাত। সারা গায়ে মাথায় বালি মেখে আমি তাকিয়ে থাকতাম – আকাশের মেঘ আর নিচের কাশের বন যেন মিলেমিশে যেতো।

 

কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,/ রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।// - শালিক পাখিকে আমরা খুব একটা পাত্তা দিতাম না। চিকন সুতার ফাঁদ পেতে খুব সহজেই আমরা ধরে ফেলতাম এই পাখিগুলিকে। এদেরকে খুব লোভী পাখি বলে মনে হতো। এক দুই দানা চালের লোভেই এরা ধরা পড়ে যেতো আমাদের হাতে। পাখি ধরার আনন্দেই পাখি ধরতাম। ধরে আবার ছেড়েও দিতাম। কারণ পাখি পোষার আবদার করলে সেই আবদার রাখার বদলে পিঠে কয়েক ঘা পড়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকতো। আর শেয়ালের হাঁক? শেয়াল আমাদের গ্রামে প্রচুর ছিল। প্রায়ই তারা মুরগি চুরি করে নিয়ে যেতো বলে শুনেছি। কিন্তু শেয়ালের হাঁক কখনো শুনিনি।

 

গ্রামে আম গাছ, তাল গাছের কমতি ছিল না। ব্রাহ্মণদের বাড়ির সামনের রাস্তায় তালগাছ, আমগাছের সারি। মনে হচ্ছে রবিঠাকুর যেন আমাদের গ্রামের জন্যই লিখেছেন - “আর-পারে আমবন তালবন চলে, গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।//

 

প্রথম বর্ষার বৃষ্টি হবার পর আস্তে আস্তে বালি ভিজে যেতো, পানি বাড়তে শুরু করলে দুপাড়ের বাড়িগুলি থেকে আমার বয়সী ছেলে-মেয়েরা এখানে নেমে যেতো – পানিতে দাপাদাপি করতে করতে। “তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে,/ গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।// অবশ্য আমাদের নিজেদের গামছা খুব একটা ছিলো না। সুপারির খোল কেটে পানি তোলার মতো ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করে নিতাম।

“সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে/ আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।// ছোট ছোট মাছগুলি যে কোত্থেকে আসতো আমরা কেউই জানতাম না। গায়ের গেঞ্জি খুলে সেই মাছগুলি  ধরতে চেষ্টা করতাম। আমার বন্ধু স্বপন ছিল খুব নির্দয় স্বভাবের। সে ছড়ার দুই পাশের ঘন বাঁশ থেকে কঞ্চি ভেঙে নিয়ে পিটিয়ে মাছ মেরে ফেলতো মাঝে মাঝে। শিশুরা যে কত নির্মম হতে পারে তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি। কোন ব্যাঙ যদি চোখে পড়তো কারো, সেই ব্যাঙ আর আস্ত থাকতো না। মাঝে মাঝে দেখতাম  আমাদের খোঁড়া বালির গর্তে জমা পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে কালো কালো ব্যাঙাচি। পানিতে হাত ডুবিয়ে হাতের তালুতে তুলে নিয়ে আসতাম পানিসহ ব্যাঙাচি। একটু পরেই হাতের তালু থেকে লাফিয়ে পড়ে যেতো পানিতে। অথচ এটুকুতেই মনে হতো পৃথিবী উঠে এসেছিলো হাতের মুঠোয়।

বাড়ির বউ আর বড় মেয়েদের দায়িত্ব থাকতো ছড়া থেকে পরিষ্কার পানি নিয়ে যাবার। আমাদের গ্রামে তখন টিউবওয়েল ছিল না বললেই চলে। এই ছড়ার বালি খুঁড়ে আমরা তুলে আনতাম পরিষ্কার পানি। কত কাকি-জেঠি-দিদি-দাদুকে যে বালি-খুঁড়ে পরিষ্কার পানি তুলে দিতাম। ছড়ার পানিতেই “বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,// বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।“

 

বর্ষার ঢলে দুকুল প্লাবিত হয়ে ঘোলা পানি চলে আসে গ্রামের ভেতর। শুকনো ছড়ার তখন অন্য রূপ। “আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর/ মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।// মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,/ ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।// দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,/ বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।“ – অবশ্য বরষা আমাদের জন্য উৎসব ছিল না কখনোই। বর্ষায় আমাদের বাড়ির ফুঁটো চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকে যেতো। গ্রামে পানি নিষ্কাশনের কোন পরিকল্পিত ব্যবস্থা ছিল না। বৃষ্টি হলেই গ্রামের সব পথ হয়ে উঠতো থিকথিকে কাদাময়। ভরা বর্ষায় বইখাতা প্লাস্টিকে মুড়ে ভিজতে স্কুলে যেতাম। দিনের পর দিন এত বৃষ্টি হতো – মনে হতো আমাদের ছোট নদীর পানি আর কখনোই শুকাবে না।

এখন সবকিছু কত বদলে গেছে। আমাদের ছোটনদীর উপর পাকা ব্রিজ হয়েছে। আমাদের ছড়ার বালি – এখন বিরাট ব্যবসায়িক সামগ্রি। খুব পাওয়ারফুল মেশিন দিয়ে খুব পাওয়ারফুল মানুষেরা এই বালির ব্যবসা করে। আমাদের ছোটনদীর সবকিছুই এখন বড় হয়ে গেছে – কেবল মনে হয় আমাদের  ছোট নদীর যে একটা আবেদন ছিল – সেটা খুব ছোট হয়ে গেছে। এত ছোট যে এখন তা আর খুঁজেই পাওয়া যায় না।

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts