Monday 21 February 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬০

 



#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬০

“তুই আগে কখনো রাঙ্গামাটি আসিসনি?!!!!”

মানসদার কপালে ভাঁজ, চাউনিতে অবিশ্বাস আর বিরক্তির মিশ্রণ।

“এত ঘরকুনো কেন তুই? সারা বাংলাদেশের মানুষ এসে রাঙ্গামাটি ঘুরে যায়, আর তুই সারাজীবন চট্টগ্রামে থেকেও রাঙ্গামাটি আসিসনি আগে কখনো!”

তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এখনি থাপ্পড় মেরে দেবে। আমি তার কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ালাম। মানসদা স্বল্পদৈর্ঘ্য। ব্রিজের উপর থেকে এক পা ডানে সরলেই আমি তার হাতের নাগালের বাইরে।

পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেলের কাছেই রাঙ্গামাটি হ্রদ। সুন্দর ঝকঝকে একটি ব্রিজ চলে গেছে স্বচ্ছ নীল পানির মাঝখানে – অনেক দূর। চারপাশে পাহাড়ঘেরা হ্রদের পানিতে ছোট ছোট ঢেউ। ছোট ছোট কয়েকটা নৌকা আছে ব্রিজের কাছে অস্থায়ী ঘাটে। রিনারা সাত-আটজন মিলে নৌকা ভাড়া করে হ্রদের পানিতে ঘুরছে। আমরা মানসদার নেতৃত্বে হ্রদের পাড়ে অনেকক্ষণ হাঁটার পর ব্রিজে উঠে দাঁড়িয়েছি রেলিং ধরে।

যীশু চোখে ক্যামেরা লাগিয়ে পানির দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ। কিসের ছবি তুলছে জানি না। রিল আছে মাত্র একটি। সব মিলিয়ে ছত্রিশটির বেশি ছবি তোলা যাবে না। একটু আগেই সে বলেছে পঁচিশটি হয়ে গেছে। পঁচিশটির মধ্যে আমাদের যদি দুটো ছবিও থাকে – খুশি হয়ে যেতে হবে। ফ্রেমে রাখী কিংবা লিপি না থাকলে সে ছবিই তুলতে চায় না। এখন সম্ভবত সে জুম করে রাখীদের নৌকার ছবি তুলছে।

চারপাশটা এত সুন্দর! হ্রদটাকে কানায় কানায় ভরা জোয়ারের নদী বলে মনে হচ্ছে। এতদিন কেন আসিনি এখানে? আগে কোনদিন আসিনি শুনেই মানসদা ক্ষেপে গেছে। মানস চক্রবর্তীর ছোটবেলা কেটেছে রাঙ্গামাটিতে। কখন কীভাবে তারা এখানে এসেছিল জানি না। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে এখন বাঙালি বসতি। অথচ এই অঞ্চলের পুরোটাই ছিল আদিবাসিদের আদিভূমি।

পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ রাঙ্গামাটি। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটির দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটার। অথচ আগে একবারও আসিনি এখানে! থিওরি পরীক্ষার পর হঠাৎ করে রাঙ্গামাটি আসার সিদ্ধান্ত না হলে কখন আসতাম বা আদৌ আসতাম কি না জানি না।

রাঙ্গামাটি যাবার সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করে হয়ে গিয়েছিল। থিওরি পরীক্ষা শেষ হবার পর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ডেট দিয়েছে জানুয়ারির ত্রিশ তারিখ থেকে। সহপাঠীদের মধ্যে হারুন, মইনুল, দিলীপ, রিনা, প্রেমাঙ্কর, যীশু, অঞ্জন, আনন্দ আর আমি – এই নয়জন থিসিস করছি। আকতার আর দেলোয়ার হোসেন দুলাল থিসিস শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করে প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপে চলে যায়। প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপের পরীক্ষাও আগে শেষ হয়, রেজাল্টও আগে হয়ে যায়। এমনিতেই আমাদের তিন বছরেরও বেশি সময় নষ্ট হয়ে গেছে সেশনজটে। এখন যত আগে পাস করে বের হওয়া যায় ততই ভালো। চাকরি খোঁজার সংগ্রামে যোগ দিতে হবে তো।

একদিনের রাঙ্গামাটি সফরের আইডিয়াটি কার মাথা থেকে বের হয়েছিল জানি না। কিন্তু আমাদের করিৎকর্মা সংগঠকরা দ্রুতই ব্যবস্থা করে ফেললো। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ফেলার পরেও স্যার-ম্যাডামদের খবরদারি সহ্য করার কোন মানে হয় না। তাই স্যার-ম্যাডামদের কিছু জানানো হলো না।

ক্যাম্পাস থেকে রওনা হতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাঙ্গামাটি এসে পৌঁছেছি সোয়া দুইটার দিকে। প্যাকেট বিরিয়ানি সাথে এসেছে। পর্যটনের মোটেলের সামনে বাস থেকে নেমেই প্রথম কাজ হলো খাওয়া।

পিকনিকের সিজন। এখানে ওখানে সবখানে বাস, মাইকে হিন্দি গান বাজছে উচ্চস্বরে। খাবারের ফেলে দেয়া প্যাকেটে রাস্তাঘাট ভরে উঠেছে। আমরা ঘাসের উপর যেখানে বসে খেলাম, সেই জায়গাটা মিনিট দশেকের মধ্যেই নোংরা করে ফেললাম। উচ্ছিষ্ট হাড়, বেচে যাওয়া ভাত, প্যাকেট, প্লাস্টিক সবকিছু যেখানে খুশি ছুঁড়ে ফেলতে আমাদের জুড়ি নেই।

তারপর যতটুকু পারা যায় আশেপাশে ঘুরে দেখা। হ্রদটাই সবচেয়ে সুন্দর। এখানে ব্রিজের উপর থেকে অনেকদূর দেখা যায়। জানুয়ারির আকাশ ঝকঝকে নীল। সেই নীলের প্রতিফলনে হ্রদের পানিও নীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই টলটলে পানিতে টলমল করে ভাসছে আমাদের কৃতকর্ম - প্লাস্টিকের ঠোঙা, খাবারের প্যাকেট, চিপ্‌সের আবরণ, সিগারেটের ফিল্টার, ছাইপাস আরো কত কী।

হ্রদের পাড়ে বেশিক্ষণ থাকার উপায় নেই। সূর্যাস্তের আগেই রাঙ্গামাটির মিলিটারির চেক-পয়েন্ট অতিক্রম করে যেতে হবে। শান্তিবাহিনীর আক্রমণ ঘটে মাঝে মাঝে। সশস্ত্র সামরিক বাহিনী মোতায়েন আছে এখানে অনেক বছর থেকে। শীতকালীন সূর্য বেশিক্ষণ থাকে না আকাশে। বাসে উঠে রাঙ্গামাটি শহরের কাছাকাছি আরেকটি পাহাড়ি নিসর্গে কিছুক্ষণ বসলাম। সহপাঠীদের সাথে এটাই আমাদের শেষ পিকনিক। এভাবে সবার সাথে একসাথে আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না। জীবন আমাদের কাকে কোথায় নিয়ে যাবে জানি না। কারো কারো সাথে হয়তো এটাই শেষ দেখা। ভাবলেই কেমন যেন হতাশ লাগে।

“গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে” গানে রবীন্দ্রনাথ যে রাঙা মাটির কথা লিখেছেন সেটা নিশ্চয় এই রাঙ্গামাটি নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাঙ্গামাটি এসেছিলেন কি না সে ব্যাপারে কোথাও কিছু লেখা নেই। তবে রাঙ্গামাটি আসার পথে বাসের মধ্যে, এখানে আসার পর সারাক্ষণ এই গানটিই কিলবিল করছে মাথার মধ্যে। মাথা থেকে নেমে উচ্চস্বরে মুখ দিয়ে বের হচ্ছে। “ওরে কার পানে মন হাত বাড়ি-এ-এ-এ-এ-এ-এ” করতে শুরু করার সাথে সাথে রাখীর রামধমক – “অ্যাই গাধা চুপ কর্‌।“

গাধা চুপ করলো। কিন্তু গাধার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কেউ একজন বললো, “ইউ সিং ওয়েল।” উত্তরে আমার কিছু একটা বলা উচিত বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু মুখ হা হয়ে ফ্রিজ হয়ে গেছে। পোশাকে স্বদেশী, বাক্যে বিদেশী এই অপরূপা বালিকাকে তো আমি আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। এই বালিকা কে, আমাদের দলে কীভাবে ঢুকে পড়লো তাও তো জানি না। সে আমাকে বলেছে “ইউ সিং ওয়েল।“ অর্থাৎ আমি ভালো গেয়েছি! ইচ্ছে করছে রাখীকে ডেকে বলি এই মেয়ে কী বলছে।

আমি হা করে আছি দেখে মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার অবস্থা। সে হড়বড় করে ইংরেজিতে আরো অনেককিছু বললো। সম্ভবত নামও বললো। কিন্তু আমি ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। প্রদীপ নাথ বললো মেয়েটি আমাদের সিলেটি বন্ধুদের কারো আত্মীয়। ইংল্যান্ডে থাকে। দেশে বেড়াতে এসে ইউনিভার্সিটিতে এসেছে। সেখান থেকে এখানে।

অনেক ভেবেচিন্তে মনে মনে বাক্য গঠন করে জিজ্ঞেস করলাম, “ডু ইউ নো এনিথিং অ্যাবাউট মিউজিক?”

“ইয়েস। দ্যাট ওয়াজ টেগোর্‌স।“

এরপর তার আশেপাশে আমরা যারা ছিলাম সবাই হঠাৎ ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করলাম। “আই নো সাম সাম ইংলিশ।“ – টাইপের ইংরেজি।

ফেরার পথে বাসের মধ্যে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েকবার তার দিকে তাকাতেই আমার ঠিক পেছনের সারিতে বসা রিনা বললো, “এত কষ্ট করছিস কেন? তার পাশে গিয়ে বসলেই তো পারিস।“

ইচ্ছে ছিল, কিন্তু চক্ষুলজ্জায় পারছিলাম না।

রাঙ্গামাটির বাস বেপরোয়া গতির জন্য বিখ্যাত। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথে এত বড় বাস যেভাবে গতি না কমিয়েই ছুটে যাচ্ছে, চিকন রাস্তায় অন্যদিক থেকে আসা বাসের সাথে এক সুতার ব্যবধান রেখে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াচ্ছে – তাতে পেছন ফিরে ইংরেজীভাষিনীকে দেখার কথা কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে যেতে হলো।

কিন্তু মিনিট দশেক পরে বাসের পেছন দিক থেকে উচ্চস্বরে “বাস থামাও, বাস থামাও” চিৎকার চেঁচামেচিতে পেছনে তাকাতে হলো। বিদেশিনী সমানে বমি করছে। বিরিয়ানি সহ্য করার মতো সহ্যশক্তি তার পাকস্থলীর নেই।

পাহাড়ি বাজারে বাস থামিয়ে ডাক্তারখানার খোঁজ করা হলো। এখানে কোন ডাক্তার নেই। ছোট্ট একটা ফার্মাসি পাওয়া গেল। ফার্মাসি ছোট হলেও ওষুধ পাওয়া  গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রোগী ঘুমিয়ে পড়লো। হাফিজ ফিসফিস করে বললো – “যেই স্লিপিং পিল দিছে, হলে গিয়ে ঘুম ভাঙলে হয়।“

হলে যাবার পরেও নাকি তার ঘুম ভাঙেনি, ভেঙেছে পরদিন দুপুরে। ক্যাম্পাসে এসেছিল এর পরের দিন। সেমিনার লাইব্রেরিতে বসেছিল। আমি গিয়ে পরিচিতের ভঙ্গিতে ‘হাই’ বলেছিলাম। আশা করেছিলাম চিনতে পারবে। পারেনি।

জানুয়ারির ত্রিশ তারিখ থেকে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আমাদের জেনারেল ভাইভাও সেদিন থেকে শুরু হবার কথা ছিল। কিন্তু এক্সটার্নাল আসেননি বলে ভাইভা পিছিয়ে ফেব্রুয়ারির দশ তারিখে চলে গেছে।

ইতোমধ্যে আরো একটা নতুন ব্যাচ ভর্তি হয়েছে। তাদের ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। আমাদের পরের ব্যাচ আমাদেরকে বিদায় দেয়ার আয়োজন করেছে। ফেব্রুয়ারির নয় তারিখে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দেয়া হলো। ভিসিস্যার প্রধান অতিথি হিসেবে এলেন। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রবীণ অধ্যাপক শামসুদ্দিনস্যার গত ৩৯ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তিনিও অতিথি হয়ে এসেছেন। বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আবুল কালাম আকন্দ, হারুন আর আমি বক্তৃতা দিলাম। আবুল কালাম আকন্দ শিবিরের নেতা। সে খুব গুছিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে পারে। হারুন বললো বিদায় কত কষ্টের ইত্যাদি। আমি বললাম সম্পূর্ণ উল্টো কথা। বললাম তিন বছর আগেই আমাদের এখান থেকে চলে যাবার কথা ছিল। পরিস্থিতির কারণে আমাদের তিনটা বছর নষ্ট হয়েছে। এর জন্য আমরাও দায়ী। আমরা অনেক সময় দাবি করি অনেককিছু না বুঝেই। যেমন আমাদের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যত বই আছে – তা আমরা ধরেও দেখি না। অথচ বলতে থাকি – আমাদের পর্যাপ্ত বই নেই। এরকম আরো কী কী বলেছিলাম তাৎক্ষণিকভাবে। ভিসিস্যারকে আরেকটি মিটিং-এ যেতে হবে বলে – আমার বক্তব্যের পর পরই তিনি বক্তৃতা দিতে এলেন। তিনি আমার বক্তব্যের এত প্রশংসা করলেন যে আমি ফুলে ফেঁপে প্রায় উড়ে যাচ্ছিলাম। ভিসিস্যার যেহেতু প্রশংসা করেছেন, সেহেতু বাকিরাও ভালো ভালো অনেককিছু বললেন। আমি মনে মনে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করলাম।

কিন্তু কয়েকদিন পর বুঝতে পারলাম আমি আসলে কী। আয়োজকরা অনুষ্ঠানের নির্বাচিত কিছু ছবি বাঁধাই করে সেমিনার লাইব্রেরিতে রেখেছে স্মারক হিসেবে। সেই স্মারকের কোথাও আমার ছবি কিংবা নাম কিছুই নেই। অথচ হারুন, আবুল কালাম আকন্দসহ অন্য সবার নামনিশানা ঠিকঠাকমতোই আছে। আমাকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে এখন থেকেই!

<<<<<< আগের পর্ব

Tuesday 15 February 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৫৯

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫৯

তিরানব্বই সাল শুরু হতে না হতেই দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু। বিরানব্বইয়ের শেষের দিনগুলি দেশজুড়ে কেমন যেন অস্থিরতা। ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অত্যাচার চলছে বিভিন্নভাবে। আমার শেষ থিওরি পরীক্ষা ছিল ডিসেম্বরের ১২ তারিখ। কিন্তু ছয় তারিখ রাত থেকে দেশজুড়ে যেসব তান্ডবের খবর পাচ্ছিলাম রেডিওর খবরে তাতে মনের ভেতর প্রচন্ড আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। খুব দরকার না হলে যীশু কিংবা আমি কেউই রুম থেকে বের হচ্ছি না। বাথরুমে যাবার সময় কিংবা খাবার-দাবার কিনতে দোকানে যাবার সময় করিডোরে কিংবা রাস্তায় পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে মনে হচ্ছে তারা এমনভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে যেন বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য আমরাও দায়ী। এটা আমার মনের ভুলও হতে পারে, কিংবা ভয়ের কারণেও হতে পারে।

ভয়ের পাশাপাশি এক ধরনের গ্লানিও লাগছে। যুক্তিহীন অনুশাসনে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু আমার অবিশ্বাস দিয়ে তো আমার জন্মগত ধর্মপরিচয় মুছে ফেলা যাবে না। মুষ্টিমেয় কিছু ধর্মান্ধ মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সারাপৃথিবীতেই ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ধর্মের নামে হানাহানি করে। এধরনের হানাহানি সরাসরি যারা করে তাদের সংখ্যা সংখ্যার বিচারে এত কম, অথচ তাদের জোর এত বেশি যে রাষ্ট্রও তাদের রুখতে পারে না? আসলে রাষ্ট্রের কর্ণধাররা আন্তরিকভাবে চান না এসব হানাহানি বন্ধ হোক। নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ধর্মীয় হানাহানি উস্কে দেয়ার মতো মোক্ষম অস্ত্র আর হয় না। এসব ব্যাপার সবাই জানে, জেনেও চুপ করে থাকে। কারণ চুপ করে থাকলে আরামে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কিছুটা বাড়ে এই দেশে।

আমরাও চুপচাপ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এলাম। পরীক্ষার আগেরদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি দোকানপাটে আক্রমণ করা হয়। সীতাকুন্ডে হিন্দুপাড়ায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় কয়েকশ ঘরবাড়ি। সরকার এসব এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছে নয় তারিখ থেকে। কিন্তু কোন ধারাতেই কোন কাজ হচ্ছে না। যীশু লেপের নিচে রেডিও নিয়ে বিবিসির খবর শুনে আর আতঙ্কে কাঁপতে থাকে। এধরনের আতঙ্ক সংক্রামক, আমার মধ্যেও সংক্রান্ত হয়। সলিড স্টেট ফিজিক্সের পড়া মাথায় ওঠে।

এতকিছুর পরেও পরীক্ষা দিতে পেরে অনেক হালকা লাগে নিজেকে। পরীক্ষা দিয়ে মেসে এসেই যীশু ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। এবার একেবারেই চলে যাচ্ছে বাসায়। আমার বাড়ি যাওয়া দরকার। আমি জানি না গ্রামের কী অবস্থা হয়েছে এই অস্থির সময়ে।

পরদিন সকালে রওনা দিয়ে দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছলাম। পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা যেতে প্রায় চার ঘন্টা লেগে যায়। পরীক্ষার জন্য অনেকদিন বাড়ি আসা হয়নি। আমার বাবা আবেগপ্রবণ মানুষ। কিন্তু এবারের আবেগ মনে হলো আগের চেয়ে বেশি। দুর্যোগের সময় সন্তান ঘরের বাইরে থাকলে মা-বাবার মনের অবস্থা যে কী হয় তা মা-বাবাই জানেন।

আমাদের গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আছে। হিন্দুপাড়া আর মুসলমানপাড়া পাশাপাশি শান্তিতে বাস করে আসছে দীর্ঘদিন। এখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই সবাইকে আত্মীয়ের সম্বোধনেই ডাকে। বাস থেকে নেমে মাত্র বিশ-ত্রিশ মিটার পথ হেঁটে বাড়িতে ঢোকার মধ্যেই অন্তত দশজন চাচা-জ্যাঠা জিজ্ঞেস করে, “ভাই-পুত ক্যান আছস? অ-বাজি এন্‌গরি ফুয়াই কেয়া গেইয়স?” তাদের কথায় যে আন্তরিক আদর প্রকাশ পায় তাতে মন ভরে যায়। দেশের এই অস্থির পরিস্থিতিতেও আমাদের গ্রামে কোন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প জমে উঠতে পারেনি – মানুষে মানুষে হৃদ্যতার কারণে। অবশ্য সবাই যে অসাম্প্রদায়িক তা বলা যাবে না। তা হলে তো মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে আমাদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হতো না, গ্রামে কোন রাজাকার থাকতো না।

বাবার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। পিতা-পুত্রের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটা সংস্কৃত শ্লোক তিনি প্রায়ই বলেন, “লালয়েৎ পঞ্চবর্ষানি, দশবর্ষানি তাড়য়েৎ। প্রাপ্তে তু ষোড়শবর্ষানি পুত্রং মিত্রবৎ-আচরয়েৎ।“ পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কোন ধরনের শাসন ছাড়া পিতা পুত্রকে লালন করবে। তারপর দশ বছর পর্যন্ত আদরে-শাসনে রাখবে। যেই ষোল বছর হবে পিতা-পুত্র বন্ধু হয়ে যাবে। বাবা এই নিয়ম শুধু উচ্চারণ করেন না, মেনেও চলেন। দুপুরে খাওয়ার পর পিতা-পুত্র পাশাপাশি শুয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলি। আমার দাদা-দিদির ক্ষেত্রে বাবা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত গিয়ে দেখে এসেছেন তারা কী করছে, কীভাবে করছে। আমার ক্ষেত্রে বাবা আমার উচ্চমাধ্যমিকের পর আর মাথা ঘামাননি। সেটা তিনি ইচ্ছে করে করেছেন, নাকি শরীরে কুলোচ্ছে না বলে করেছেন তা জিজ্ঞেস করিনি।

ব্যক্তিগত কথাবার্তা শেষ হবার পর দেশের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক আক্রমণের কথা উঠলো। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছে। তখন দলে দলে হিন্দুরা চলে গেছে ভারতে। আমার বাবা তখন ছাব্বিশ বছরের যুবক। কেন তিনি সেসময় ভারতে চলে যাননি? এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তখনো মাটি কামড়ে এখানেই পড়ে রইলেন। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতায়। এত বৈরিতার মধ্যেও একবারও দেশত্যাগের কথা কেন তাঁর মনে হয়নি – খুব জানতে ইচ্ছে করলো। এর আগেও হয়তো এ ব্যাপারে কথা হয়েছে, কিন্তু এভাবে সরাসরি হয়নি।

বাবা আমার সব কেনোর উত্তর দিলেন মাত্র দুই লাইনের দুটো প্রশ্নে। “এটা আমার জন্মভূমি। এর খারাপ অবস্থা হয়েছে দেখেই একে ত্যাগ করে চলে যাবো? আমার অবস্থা খারাপ হলে, তোদের ঠিকমতো দেখাশোনা না করতে পারলে তোরা কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবি? অন্য কাউকে বাবা বলে ডাকবি?”

আমার বাবার লেখাপড়া ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। দেশের রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি বাজেট – কোনকিছু নিয়েই তিনি ভাবেন বলে মনে হয়নি কখনো। জীবনযুদ্ধে যতবার পরাজিত হয়েছেন, ততোবারই উঠে দাঁড়িয়েছেন। একবারও তাঁর দুরাবস্থার জন্য দেশকে দায়ী করেননি। এই মানুষটা নিজের জন্মভূমিকে নিজের মা-বাবার মতোই ভালোবাসেন। আমার কেমন একটা গর্বের অনুভূতি হতে থাকে।

তিরানব্বই সাল শুরু হতেই বাড়ী থেকে চলে আসতে হলো। প্র্যাকটিক্যাল গ্রুপের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হবে। তাদের পরীক্ষার সময়েই আমাদের জেনারেল ভাইভা হয়ে যাবে। থিসিসের কাজও পুরোপুরি শুরু করতে হবে। কিন্তু শহরে এসেই খবর পেলাম শহরের এক প্রান্তে তুলকালাম ঘটনা ঘটছে। হালিশহরে নৌবাহিনীর সদস্যদের সাথে স্থানীয়দের ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটেছে। দশ জন মানুষ মারা গেছেন গুলিতে, পাঁচশ’র বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। নির্বিচারে আগুন লাগানো হয়েছে ঘরবাড়িতে। প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে মানুষ। নিজের দেশের মানুষের উপর নিজের দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা অত্যাচার করছে! পরপর তিন-চারদিন ধরে হামলা চলছে। কী হচ্ছে এখানে?

উচ্চপর্যায়ের সামরিক হস্তক্ষেপের পর পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া হলো নৌবাহিনীর চার জন অফিসার ও পনেরো জন নাবিককে বরখাস্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু এতো ভয়ানক ঘটনা কীভাবে ঘটাতে পারলো অস্ত্রধারী সৈনিকেরা?

এর মধ্যেই জানুয়ারির দশ তারিখে সিলেটে যা ঘটলো তার বিবরণ পত্রিকায় পড়ে বুঝতে পারছিলাম না আমরা বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আছি, নাকি হাজার বছর আগের কোন অন্ধযুগে আছি। ছাতকছরা গ্রামের বাইশ বছর বয়সী তরুণী গৃহবধু নুরজাহানকে গ্রাম্য মাতব্বরদের নির্দেশে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হয়েছে নিজের ঘর থেকে। বেশ কিছুদিন আগে নুরজাহানকে তার স্বামী তালাক দেয়। নুরজাহান সম্প্রতি আবার বিয়ে করেছে তাদেরই গ্রামের মোতালেবকে। এই বিয়ে ধর্মীয় মতে সাক্ষী রেখে কলমা পড়েই হয়েছে। কিন্তু এখন গ্রামের মৌলানা মান্নানের নেতৃত্বে মোল্লারা বলতে শুরু করেছে নুরজাহানের তালাক নাকি ঠিকমতো তালাক ছিল না। তাই তার বর্তমান বিয়ে অবৈধ। বিয়ে যেহেতু অবৈধ, সেহেতু মোতালেবের সাথে নুরজাহান ঘর করছে – এটাও অবৈধ। মৌলানা মান্নান ফতোয়া দিলেন – নুরজাহান ও মোতালেবকে গলাপর্যন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলে পাথর নিক্ষেপ করা হোক। আর নুরজাহানের আব্বা যেহেতু মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন – সেহেতু নুরজাহানের আব্বাকে পঞ্চাশ ঘা দোর্‌রা মারা হোক। এধরনের শাস্তি কার্যকর করতে উৎসাহী মানুষের অভাব হয় না। আর এরকম শাস্তির মজা দেখার জন্য রয়েছে পুরো গ্রাম। নুরজাহানকে টেনে-হেঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে শাস্তি কার্যকর করা হলো গ্রামের সব মানুষের সামনে। পাথর মারা হলো, দোর্‌রা মারা হলো। সবকিছু হলো ধর্মের নামে। কেউ কিছু বললো না। ধর্মের নামে মানুষ খুন করলে যেখানে কেউ কিছু বলে না, সেখানে এ-তো সামান্য পাথর আর দোর্‌রা। পাথরের আঘাতে নুরজাহানের মৃত্যু হয়নি। কিন্তু নুরজাহানের আত্মসম্মান অনেক বেশি। এর অপমান সইবার শক্তি তার ছিল না। সে ঘটনার পর অপমানে গলায় দড়ি দেয়।

ধর্মের নামে এসব যারা করে তাদের কি থামাবার মতো কেউ নেই কোথাও? নাকি সবাই – ধর্ম বড় স্পর্শকাতর বিষয় বলে এড়িয়ে যায়? আসলে ধর্ম কি এতই লজ্জাবতী লতা যে একটু যুক্তির স্পর্শেই কাতর হয়ে যাবে? জানি না। দোতলায় উঠে তৌহিদভাইয়ের খোঁজ করলাম। তিনি ফতেয়াবাদ গার্লস স্কুলের ধর্মশিক্ষক। তিনি যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন। তাঁকে পেয়ে গেলাম ছাদে। স্কুল থেকে এসে গোসল করে ছাদে কাপড় মেলছেন। নুরজাহানের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতেই দেখলাম তিনি হঠাৎ ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলেন। সেই মুহূর্তেই ভাত খেতে না পারলে তিনি মুর্ছা যাবেন এরকম ভাব করে দ্রুত নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে।

<<<<<<<< আগের পর্ব 

Saturday 5 February 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৫৮

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫৮

আপেক্ষিক তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে স্বয়ং আইনস্টাইন নাকি বলেছিলেন, সুন্দরী মেয়ের সান্নিধ্যে ঘন্টাকে যে মিনিট বলে মনে হয়, আবার ট্রেনের টিকেট কাটতে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মিনিটকে যে ঘন্টা বলে মনে হয় – সেটাই হলো আপেক্ষিকতার সূত্রের সারমর্ম। ট্রেনের টিকেটের লাইনের উদাহরণ আইনস্টাইন দিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয় না। অনেকে নিজেদের বানানো কথা বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে চালিয়ে দেন। এখানেও হয়তো সেরকম কিছু হয়েছে। সে যা-ই হোক, পরীক্ষার খাতায় এসব লিখলে আইনস্টাইন কয়েকটা নম্বর দিলেও দিতে পারতেন, কিন্তু আমাদের স্যাররা একাধিক শূন্য দেবেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। রিলেটিভিটি পড়েছিলাম অনার্সে। মাস্টার্সে সেই সাবজেক্ট নেই। অথচ এখন রিলেটিভিটির কথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সময় স্বাভাবিকের চেয়েও দ্রুত চলে যাচ্ছে। নভেম্বর মাসের তিরিশ দিন ঠিক ঠিক তিরিশ দিনেই গেছে, অথচ মনে হচ্ছে তিন দিনে শেষ হয়ে গেছে নভেম্বর মাস। মাস্টার্সের চারটি তত্ত্বীয় পরীক্ষার তিনটি শেষ হয়ে গেছে। আট, উনিশ, আর ত্রিশ তারিখে পরীক্ষা ছিল। মাঝখানের দিনগুলি কীভাবে যে চলে গেছে গোনারও সময় পাইনি। এর আগের কোন পরীক্ষার সময় এতটা নিবিষ্ট হইনি। এবার যে পরিবর্তনটা হয়েছে তার জন্য কতটা মানসিক চাপ, আর কতটা যীশুর চাপ ঠিক আলাদা করে বলতে পারবো না। তবে একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছে সময়। এই ঘোর তৈরির পেছনে যীশুর হাত আছে অনেকখানি।

র‍্যাগ-ডের পর তেমন কোন লেখাপড়া ছাড়াই অক্টোবর শেষ হয়ে গেছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাড়িতে গিয়ে কাটিয়ে এসেছি অনেকদিন। অক্টোবরের শেষে একদিন হঠাৎ ব্যাগভর্তি বই-খাতা নিয়ে যীশু হাজির। 

“কী রে, তুই হঠাৎ?” – আমি অবাক হয়ে, খুশি হয়ে প্রশ্ন করি।

“আমাদের বাসায় গেস্ট এসেছে। পড়া হচ্ছে না।“ – যীশু ব্যাগ থেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বই বের করে খাটের উপর রাখতে রাখতে সংক্ষেপে উত্তর দিলো।

বুঝতে পারলাম। তাদের বাসায় অনেক গেস্ট এসেছে। পরীক্ষার সময় তার যতটুকু মনযোগ দরকার তা বাসায় দিতে পারছে না। তাই আমার রুমে চলে এসেছে। যাক্‌ গল্পসল্প করতে করতে আরাম্‌সে পরীক্ষা দেয়া যাবে ভেবে নড়েচড়ে বসতেই যীশু তর্জনি উঁচিয়ে বললো, “খবরদার, কোন ধরনের গল্পগুজব চলবে না।“ 

বলেই অন্য দেয়ালে লাগানো দ্বিতীয় টেবিলটা টেনে খাটের কাছে নিয়ে এসে বই খুলে পড়তে লাগলো। আজব তো!  কোয়ান্টাম মেকানিক্স পরীক্ষার তখনো আটদিন বাকি। তার সাথে আমার লাস্ট দেখা হয়েছে সেই র‍্যাগ ডে-র দিন। এই এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জমে যাওয়া গল্পের ঝাঁপি একটুও না খুলে বই খুলে বসলো! 

এক সপ্তাহের ভেতর রুমের পরিবেশটাই বদলে গেল। এত বছর ধরে যতগুলি পরীক্ষা দিয়েছি, ধরতে গেলে কোন ধরনের অতিরিক্ত চাপ ছাড়াই পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু যীশুর মাত্রাতিরিক্ত সিরিয়াসনেস আমার উপরও এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করলো। আগে রাত সাড়ে আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত দোতলার কোন রুমে কিংবা ছাদে টিভির সামনে কাটতো। এখন টিভি দেখা বাদ, হঠাৎ শহরে চলে যাওয়া বাদ, চৌধুরিহাটে বিপ্লবদের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারা বাদ। সপ্তাহখানেক বাদে কেমন যেন নেশাগ্রস্তের মতো লাগতে শুরু করলো। চোখের সামনে বইখাতা না থাকলে কেমন যেন খালি খালি লাগে। 

যীশু সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষকের মতো সময়নিষ্ঠ। ঠিক দশটায় সে বিছানায় লম্বা হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে রেডিওতে লো ভলিউমে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান শোনে। তারপর সাড়ে দশটায় চ্যানেল চেঞ্জ করে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে এগারোটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ে। 

আমার এক ব্যান্ডের রেডিওতে ভয়েস অব আমেরিকা ধরে, কিন্তু বিবিসি ধরে না। যীশু যে ছোট্ট রেডিওটা নিয়ে এসেছে তার রেঞ্জ অনেক বেশি, সেখানে অসংখ্য ফ্রিকোয়েন্সির অসংখ্য চ্যানেল ধরে। বিবিসিতে সম্ভবত কয়েক মিনিট ইংরেজিও শেখায়। যীশুকে অনুরোধ করলে ভলিউম বাড়ায়। একদিন বিবিসির ইংরেজি শেখার আসরে শুনলাম – মাত্র দুইশ ইংরেজি শব্দ জানা থাকলেই নাকি ইংরেজিতে দরকারি সব কথাবার্তা বলা সম্ভব। অনেকগুলি ইংরেজি শব্দ নাকি না জানলেও চলে – যেমন চোখের পানির ইংরেজি টিয়ার্স – না জানলেও চলে। তার বদলে ওয়াটার অব দি আই বললেও হয়। বাংলার অশ্রু যদি আমরা চোখের পানি দিয়ে চালিয়ে নিতে পারি, ইংরেজিতেও নয় কেন? 

নভেম্বরের চার তারিখ আমেরিকার নির্বাচন হলো। পাঁচ তারিখ রাতের সব খবরেই বিল ক্লিনটনের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার খবর। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে এক মেয়াদেই বিদায় নিতে হচ্ছে। বিশ্ব-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যীশুর কৌতূহলের অন্ত নেই। বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াতে যীশুকে খুব উত্তেজিত মনে হলো সেদিন। 

এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে যীশু। কিন্তু আমার রাত জাগা অভ্যাস। আমি জেগে থাকি আরো অনেকক্ষণ। যীশু ভোর পাঁচটায় উঠে পড়ে। যথাসম্ভব নিশব্দে বাইরে গিয়ে বাথরুম ঘুরে এসে পড়তে বসে যায়। তার শব্দ ঢাকার চেষ্টার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমিও উঠে পড়ি। তাতে লাভ হয়। পরীক্ষার আগে কয়েকবার রিভিশান দেয়া হয়ে যায়। 

কোয়ান্টাম মেকানিক্স পরীক্ষার আগের রাতে বিশ্বপরিস্থিতি জেনে মানসিক চঞ্চলতা বাড়িয়ে লাভ নেই বলে যীশু এগারোটার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভয়েস অব আমেরিকা কিংবা বিবিসি কোনটাই শোনেনি। আমার ঘুম আসতে চাচ্ছিলো না। তবুও জোর করে ঘুমাতে গেলাম। 

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছে রুমের ভেতর কেউ যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এত বছরের একা থাকার অভ্যাস। যীশুর উপস্থিতি খেয়াল ছিল না। কেমন যেন ভয় লাগছিলো। হঠাৎ মনে পড়লো – রুমের দ্বিতীয় খাটে তো যীশু ঘুমাচ্ছে। কান্নার শব্দ সেদিক থেকেই আসছে। মাথা থেকে লেপ সরিয়ে চোখ খুলে দেখলাম অন্ধকারে মশারির ভেতর বসে আছে যীশু। 

“কী হয়েছে যীশু?”

যীশু নিরুত্তর।

“কাঁদছিস কেন?”

এবারেও কোন উত্তর নেই। কেবল কান্নার শব্দ বাড়ছে। 

হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের সুইচটা টিপলাম। আলোয় দেখলাম যীশু গলায় বাঁধা মাফলারের ডগা দিয়ে চোখ মুছছে। টেবিলঘড়িতে রাত আড়াইটা। এই গহীন রাত্রিতে যীশুর শোকের কারণ কী? 

সবার সামনে হাসা যায় সহজে, কিন্তু কাঁদা যায় না। কান্না ব্যাপারটা বেশি মাত্রায় ব্যক্তিগত। তাই তাকে যথাসম্ভব গোপন করার চেষ্টা করি আমরা। লাইট অফ করে দিলাম। কাঁদতে হলে অন্ধকারেই কাঁদুক। 

“আমি বাসায় যাবো। বাসার জন্য পেট পুড়ছে।“ 

বলে কী যীশু! শিশুর মতো বাসায় যাবার জন্য কাঁদছে! রাত আড়াইটায় বাসায় যাবে? এখন যেতে চাইলে হেঁটে যেতে হবে। সকালেই পরীক্ষা, আর সে এখন বাসায় যাবে! আমি কোন কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।

সকালে উঠে দেখলাম যীশু পড়তে বসে গেছে। রাতের কান্নাকাটির ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করলাম না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স পরীক্ষা হয়ে গেল যথাসময়ে। পরীক্ষা শেষে রুমে এসেই যীশু চলে গেল বাসায়। 

এক রাত বাসায় কাটিয়ে পরদিন আবার চলে এলো। এভাবেই দ্রুত চলে গেলো তিনটি পরীক্ষা এবং নভেম্বর। পরীক্ষার মাঝখানের দিনগুলি রুমে বসে দ্রুতই চলে যায়। প্রদীপ নাথ হলে থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে। কোন কিছু আলোচনার দরকার হলে হল থেকে রুমে আসে। কাজ শেষ হবার সাথে সাথেই যীশু তাকে রুম থেকে বের করে দেয়। আগের মতো ঘণ্টার পর ঘন্টা গল্প করার সুযোগ হয় না। বিপ্লব গল্প করতে আসে যেদিন পরীক্ষা থাকে সেদিন বিকেলে পরীক্ষার পর যীশু শহরে চলে গেলে। পরীক্ষার পর ঐ এক সন্ধ্যাই আমার গল্প করার স্বাধীনতা। যীশুর এরকম খবরদারির উপাকারিতা হাতে হাতে টের পাচ্ছি। পরীক্ষাগুলি ভালো হচ্ছে। জানা জিনিস পরীক্ষার খাতায় ভুল লিখে আসা আমার জন্য খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মাস্টার্সের পরীক্ষায় সেরকম কিছু ঘটছে না। 

মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে যীশু আরো অনেকবার বাসায় চলে যাবো বলতে বলতে কেঁদেছে। ওটাও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। 

শেষ তত্ত্বীয় পরীক্ষা সলিড স্টেট ফিজিক্স ডিসেম্বরের ১২ তারিখ। ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে ছয় তারিখ পর্যন্ত একটানা পড়ে একবার রিভাইস দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ছয় তারিখ রাতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। 

অন্যদিনের মতো রেডিও নিয়ে শুয়ে পড়েছিল যীশু। হঠাৎ বৈদ্যুতিক শক খাবার মতো করে ছিটকে উঠে গেল বিছানা থেকে। কী হয়েছে? রেডিওর ভলিউম না বাড়িয়ে রেডিওটা নিয়ে এলো আমার টেবিলের কাছে। ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হচ্ছে ভারতের অযোধ্যায় উগ্র মৌলবাদী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে। সাড়ে দশটায় বিবিসির খবরে আরো বিস্তারিত জানা গেল। 

বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা তুলে ষোড়শ শতাব্দীর এই মসজিদের জায়গায় রামের জন্মভূমি ছিল বলে মসজিদটি ভেঙে ফেলার হুমকি দিচ্ছিলো অনেক বছর থেকে। ১৯৯০ সালেও একবার চেষ্টা করেছিল ভেঙে ফেলার। সেই সময় তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু মসজিদ ভেঙে ফেলেছে বলে গুজব রটিয়ে বাংলাদেশে তখন হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরের উপর ব্যাপক হামলা চালানো হয়েছিল এরশাদের জাতীয় পার্টির উস্‌কানিতে। এরশাদ ক্ষমতায় থাকার জন্য এসব করিয়েছিলেন। এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে পারেননি এর পরেও। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সবখানে। 

এবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক, বিজেপির কর সেবক ইত্যাদি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রামের দোহাই দিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ উগ্রবাদীকে একত্র করে মসজিদটি ভেঙে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও কোন প্রতিরোধই করতে পারেননি। 

যীশুর চোখেমুখে উৎকন্ঠা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনো ঘটনাটি জানে না। কাল সকালে যখন সবগুলি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বিশাল হেডিং দিয়ে ছাপানো হবে – তখন জেনে যাবে। ভারতের যেসব উগ্র হিন্দুরা এসব কাজ করেছে – তাদের সাথে বাংলাদেশের হিন্দুদের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও ওদের কাজের ফল ভোগ করতে হবে এদেরকে। বাংলাদেশের হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হবে। এই সুযোগে চলবে জমিদখল, বাড়িদখল, লুটপাট আর মেয়েদের উপর অত্যাচার। বলা হয়ে থাকে ধর্ম মানুষকে উদার হতে শেখায়। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছে – এটাই আমরা দেখি। সমস্ত ধর্মের উর্ধ্বে যে মানবতা সে মানবতার বাণী যাদের বিবেককে নাড়া দেয়, তাদের শক্তি খুবই কম। 

সারারাত নির্ঘুম কাটলো। ঘুমের সাথে সাথে পড়ালেখাও শিকেয় উঠেছে। পরদিন সকাল আটটার মধ্যেই জেনে গেছে সবাই। বিল্ডিং-এর উপরে নিচে আমি আর যীশুছাড়া বাকি সবাই হিন্দুদের উপর আক্রোশে ফুঁসছে। আর আমরা দু’জন রুমের মধ্যে ভয়ে উৎকন্ঠায় কাঁপছি। কাল রাতেই দেশের বিভিন্ন মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারতীয় হাই কমিশনের অফিস, ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের অফিসে আক্রমণ করা হয়েছে। সার্ক ক্রিকেট চলছে। বাংলাদেশ বনাম ভারতের খেলা ছিল। মীরপুর স্টেডিয়ামে খেলা শুরু হবার সাথে সাথে কয়েক শ মানুষ ভারতীয় খেলোয়াড়দের মেরে ফেলার জন্য মাঠে নেমে পড়ে। বাংলাদেশের পুলিশ ভারতীয় খেলোয়াড়দের নিরাপদে সরিয়ে নিতে পেরেছে। খেলা পন্ড হয়ে গেছে। দু’দিন পরে সার্ক সম্মেলন হবার কথা ছিল। সেই সম্মেলনও বাঞ্চাল হয়ে গেছে। 

আমার রুমের দরজায় ধুমধাম লাথি পড়েছে বেশ কয়েকটি। দরজা ভেঙে যেকোনো সময়েই রুমে ঢুকে আমাদের দু’জনকেই জবাই করে দিতে পারতো চাইলে। কিন্তু করেনি। দুপুরে তৌহিদ এসেছিল মোটরসাইকেল নিয়ে – আমাদের খবর নিতে। সে বললো দরকার হলে সে থাকবে আমাদের সাথে আমাদের নিরাপত্তা দিতে। 

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক শ মানুষ মারা গেছে একদিনের মধ্যেই। ধর্মের নামে হানাহানি কি কখনো বন্ধ হবে না? 

বিকেলে সাহস করে রাস্তায় বের হয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে নন্দীর হাটের দিকে গিয়েছিলাম। রাস্তায় একটার পর একটা ভ্যানগাড়ি আসছে – শিশু আর নারীভর্তি সবগুলিতে। রাউজানের ওদিক থেকে পালিয়ে আসছে সবাই। শিশুরা কাঁদছে, নারীদের অসহায় শূন্য দৃষ্টি। পুরুষরা কোথায়? শোনা যাচ্ছে – রাউজানের ওদিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরির লোকরা  নাকি রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়েছে। পুরুষদের পরনের কাপড় খুলে পরীক্ষা করা হচ্ছে তারা কোন্‌ ধর্মের। এরা ১৯৭১ সালে যা করেছিল – ১৯৯২ সালেও তা করছে। খুব অসহায় লাগছে। 

Thursday 3 February 2022

দর্পণে মহাবিশ্ব: হাবল স্পেস টেলিস্কোপ

 


পৃথিবীর বাইরে গিয়ে পৃথিবীকে দেখার ধারণাটা প্রথম দিয়েছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস সেই ২৪০০ বছর আগে। তখনো খালিচোখে আকাশের চন্দ্র-সূর্য দেখে প্রকৃতিকে বুঝতে চেষ্টা করেছে মানুষ। তখনো মানুষের চিন্তাভাবনায় মহাবিশ্বের মূলকেন্দ্র ছিল পৃথিবী। পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে অনেক দার্শনিক-গবেষণা হয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে। কিন্তু সেইসব ধারণার সুনির্দিষ্ট প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরের পর বছর। 

পৃথিবী থেকে আকাশ দেখার দৃশ্যপট দ্রুত পালটে গেলো যখন গ্যালিলিও আকাশের দিকে তাক করলেন প্রথম টেলিস্কোপ। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণনরত চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করলেন। বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদগুলোর গতিপথ দেখার পর গ্যালিলিওর মনে হলো এই উপগ্রহগুলো যেন তাদের মনিব-গ্রহের আদেশে একটি কক্ষপথে থেকে চাকরের মতো ঘুরছে মনিবের চারপাশে। ল্যাটিন ভাষায় তিনি উপগ্রহগুলোর নাম দিলেন 'satelles' (স্যাটেলিস) - যার অর্থ হলো servant বা চাকর। satelles থেকে ইংরেজিতে স্যাটেলাইট (satellite) কথাটি এসেছে। মানুষ যে কৃত্রিমভাবে স্যাটেলাইট তৈরি করে আকাশে পাঠিয়ে দিতে পারে সেরকম কোন কল্পনাও তখন কেউ করেনি। কিন্তু গ্যালিলি-যুগের পরবর্তী তিন শ বছরের মধ্যেই মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত কৃত্রিম স্যাটেলাইট – মানুষেরই কাজে।

গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের পর আরো অনেক শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবী থেকেই সেসব টেলিস্কোপ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করছে দিনরাত। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কারণে মহাকাশ থেকে আলো আসার সময় অনেক ধরনের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অনেক আলো শোষিত হয়, ধুলাবালিতে আলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ফলে মহাকাশের মহাজাগতিক ঘটনাগুলি নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। শত শত আলোকবর্ষ দূরের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে আসার সময় উজ্জ্বলতা হারায়। বায়ুমন্ডলের কারণেই তারাগুলি মিটমিট করে। ফলে অনেক কিছুই ধরা পড়ে না শক্তিশালী টেলিস্কোপেও। পৃথিবীর টেলিস্কোপগুলিকে বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপন করেও অনেক সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়নি। তাই বিশাল আকৃতির এক টেলিস্কোপকে স্যাটেলাইট হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে পৃথিবীর বাইরে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মহাবিশ্বকে দেখার প্রথম শক্তিশালী এবং প্রচন্ড সফল এই টেলিস্কোপের নাম হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। 

মহাকাশে টেলিস্কোপ স্থাপনের ধারণা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে জার্মানির বিজ্ঞানী হারমান ওবের্থ-এর “দ্য রকেট ইনটু প্ল্যানেটারি স্পেস’ বইতে। তখনো কিন্তু কোন ধরনের মহাকাশযান তৈরি হয়নি। তাই ওবের্থ-এর ধারণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি কেউ সেই সময়। এরপর ১৯৪৬ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাইম্যান স্পিৎজার-এর “অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল আডভান্টেজেজ অব অ্যান এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল অবজারভেটরি” প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে ওবের্থ-এর ধারণা আবার সামনে চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে শীতল-যুদ্ধ শুরু হলে মহাকাশ গবেষণায় দ্রুত উন্নতি ঘটে। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক মহাকাশে পাঠালে আমেরিকা দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকান মহাকাশ প্রশাসন প্রতিষ্ঠান - নাসা। 

১৯৬০ সালে প্রফেসর স্পিৎজার এবং আমেরিকার আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী নাসা এবং আমেরিকান কংগ্রেসের কাছে আবেদন করেন মহাকাশে টেলিস্কোপ পাঠানোর  “লার্জ অরবিটাল টেলিস্কোপ” প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার জন্য। ১৯৬৯ সালে এই প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। তবে সেই সময় মানুষ প্রথমবার চাঁদে অবতরণ করার পর নাসার প্রকল্পে বাজেট ঘাটতি দেখা দেয়। অনেক বড় প্রকল্প বাজেটের অভাবে ছোট করতে হয়। লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের প্রাথমিক নকশায় মূল দর্পণের ব্যাস ছিল ১২০ ইঞ্চি। টাকার অভাবে পুরো নকশা বদলে আরো ছোট আকারের টেলিস্কোপের পরিকল্পনা করতে হয়। এবার মূল দর্পণের ব্যাস দাঁড়ালো ৯৪ ইঞ্চিতে। ১৯৭৭ সালে আমেরিকান কংগ্রেস লার্জ স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্প অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের বাজেট কিছু বাড়ানোর জন্য নাসা ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাথে একটি চুক্তি করে। লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের শতকরা ১৫ ভাগ খরচ ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি দেবে, কিন্তু তার বিনিময়ে টেলিস্কোপের শতকরা ১৫ ভাগ পর্যবেক্ষণ সময় তারা ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাড়ে তিন ঘন্টা সময় থাকবে ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির জন্য সংরক্ষিত। 

১৯৭৯ সালের মধ্যে স্পেস টেলিস্কোপের নকশা চূড়ান্ত হয় এবং নির্মাণ-কাজ শুরু হয়। বিশটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইওরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা এই নির্মাণ-কাজের সাথে যুক্ত। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ১৯৮৩ সালের মধ্যে টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানোর। কিন্তু কাজ শুরু করার পর দেখা গেলো খরচ আর সময় কোনটাতেই কুলোচ্ছে না। ১৯৮৩ সালের মধ্যে কিছুতেই এই টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো সম্ভব নয়। এসময় এই টেলিস্কোপের নাম লার্জ স্পেস টেলিস্কোপের বদলে রাখা হলো আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল-এর নামে ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’। ঠিক করা হয় ১৯৮৬ সালে মহাকাশে পাঠানো হবে এই টেলিস্কোপ। 

১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনায় সাতজন নভোচারীর সবাই মর্মান্তিকভাবে নিহত হলে নাসার সব মহাকাশ প্রকল্প কয়েক বছরের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।  সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও হাবল টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো যায়নি তখন। অবশেষে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল মহাকাশে পাঠানো হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। পরেরদিন ২৫ এপ্রিল তা কক্ষপথে পৌঁছে যায়।

স্পেস শাটল ডিসকভারি তার প্রকোষ্ঠে ভরে টেলিস্কোপটিকে পৃথিবী থেকে মহাকাশে নিয়ে গিয়ে লো-আর্থ অরবিটে রেখে আসে। পৃথিবীর ভূমি থেকে ১৫০ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ১২০০ কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চতায় লো-আর্থ অরবিট। হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৪৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ঘন্টায় প্রায় ২৭ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে তার সময় লাগে প্রায় ৯৫ মিনিট। 

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ একটি বিশাল আকৃতির স্যাটেলাইট। এর মূল দেহের আকৃতি ৪.৩ মিটার ব্যাসের ১৩ মিটার লম্বা একটি চোঙার মতো। মহাকাশে পাঠানোর সময় এর ভর ছিল ১০,৮০০ কিলোগ্রাম। শেষবার সার্ভিসের পর বর্তমানে এর বর্তমান ভর দাঁড়িয়েছে ১২,২০০ কিলোগ্রামে। এই টেলিস্কোপকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন যন্ত্রপাতিগুলিকে আলাদা আলাদাভাবে মেরামত করা যায় বা দরকার হলে বদলে দেয়া যায়। পৃথিবী থেকে মহাকাশচারী পাঠিয়ে এই টেলিস্কোপ মেরামত করা যায়। সেজন্য টেলিস্কোপের বাইরের খোলে বিভিন্ন জায়গায় হাতল দেয়া হয়েছে – যেন মহাকাশচারীরা সেই হাতল ধরে মহাকাশে ভাসতে ভাসতে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারেন।

এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে সোলার প্যানেলের সাহায্যে। ৭.১ মিটার দীর্ঘ এবং ২.৬ মিটার চওড়া দুটো সোলার প্যানেল আছে এই টেলিস্কোপের দুই পাশে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে পারে এই প্যানেলদুটি। ছয়টি নিকেল-হাইড্রোজেন ব্যাটারিতে এই শক্তি সংরক্ষণ করে। এই শক্তি প্রায় ২২টি গাড়ির ব্যাটারির সঞ্চিত শক্তির সমান। 

এই টেলিস্কোপটি একটি রিফ্লেকটিং টেলিস্কোপ বা প্রতিফলক দুরবিন। আলোর প্রতিফলনের জন্য দুটি আয়না আছে এই টেলিস্কোপে – প্রাইমারি মিরর বা মুখ্যদর্পণ এবং সেকেন্ডারি মিরর বা গৌণদর্পণ। মুখ্যদর্পণের ব্যাস ৯৪ ইঞ্চি বা  ২.৪ মিটার এবং ভর ৮২৮ কিলোগ্রাম। গৌণদর্পণের ব্যাস মাত্র ১২ ইঞ্চি, এবং ভর ১২.৪ কিলোগ্রাম। যে কাচ দিয়ে এই আয়নাদুটো বানানো হয়েছে, সেই কাচ প্রচন্ড বা গরমেও একটুও সংকুচিত বা প্রসারিত হয় না। কাচের উপর প্রতিফলক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাগনেসিয়াম ফ্লোরাইডের উপর অ্যালুমিনিয়ামের আস্তরণ। 

মহাকাশ থেকে আগত আলো টেলিস্কোপের চোঙার মধ্যে ঢুকে মুখ্যদর্পণে প্রতিফলিত হয়ে গৌণদর্পণে পড়ে। গৌণদর্পণ থেকে আবার প্রতিফলিত হয়ে মুখ্যদর্পণের মাঝামাঝি সূক্ষ্ণছিদ্রের ভেতর দিয়ে মূল টেলিস্কোপের নলে প্রবেশ করে। সেখানেই প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। টেলিস্কোপে সৃষ্ট ফোকাস পয়েন্ট – যেখানে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় – সেখান থেকে তা টেলিস্কোপে লাগানো বিভিন্ন ক্যামেরা এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ভেতর চলে যায়। 

হাবল টেলিস্কোপের প্রধান পাঁচটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি হলো – ওয়াইড-ফিল্ড অ্যান্ড প্ল্যানেটারি ক্যামেরা (WF/PC), ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা (FOC), হাইস্পিড ফটোমিটার (HSP), গডার্ড হাই-রেজ্যুলেশন স্পেকট্রোগ্রাফ (GHRS), এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোগ্রাফ (FOS)।  



১৯৯০ সালে যে যন্ত্রপাতিগুলি পাঠানো হয়েছিল পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে টেলিস্কোপ সার্ভিসিং-এর সময় সেই যন্ত্রপাতিগুলি বদলে আরো উন্নতমানের যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বিগত তিরিশ বছরে। এপর্যন্ত মোট পাঁচবার পৃথিবী থেকে নভোচারীরা হাবল টেলিস্কোপে গিয়ে যন্ত্রপাতি বদলে দিয়ে এসেছে। প্রথম সার্ভিস মিশন গিয়েছিল ডিসেম্বর ১৯৯৩, দ্বিতীয় সার্ভিস মিশন ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, তৃতীয় সার্ভিস মিশনের প্রথম ধাপ ডিসেম্বর ১৯৯৯, তৃতীয় সার্ভিস মিশনের দ্বিতীয় ধাপ ফেব্রুয়ারি ২০০২, চতুর্থ এবং শেষ সার্ভিস মিশন মে ২০০৯। 

হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় WF/PC। দুইটি ক্যামেরার সমন্বয়ে WF/PC। ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা বিস্তীর্ণ আকাশের বিশাল এলাকা ধারণ করে, আর প্ল্যানেটারি ক্যামেরা সেই ছবির রেজ্যুলেশন বাড়ায় এবং ছবিকে বিবর্ধিত করে। ১৯৯০ সালে টেলিস্কোপ কাজ শুরু করার পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে মুখ্যদর্পণে সামান্য ত্রুটি রয়ে গেছে, ফলে ছবি ঝাপসা আসছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম সার্ভিসের সময় WF/PC প্রতিস্থাপন করে এই ত্রুটি দূর করা হয়। ২০০৯ সালে শেষবার সার্ভিসিং এর সময় আরো উন্নত-প্রযুক্তির WF/PC প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। 

মহাকাশে অনুজ্জ্বল বস্তুর ছবি তোলে ফেইন্ট অবজেক্ট ক্যামেরা। এই কাজ করার জন্য ইমেজ ইন্টেন্সিফায়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ২০০২ সালে সার্ভিসিং-এর সময় আরো উন্নতমানের সার্ভে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে টেলিস্কোপের সাথে। 

হাইস্পিড ফটোমিটারের কাজ হলো উচ্চশক্তির উৎস থেকে উৎপন্ন আলোর পরিবর্তন শনাক্ত করা। শুরুতে এটা ঠিকমতো কাজ করছিলো না। ১৯৯৩ সালে প্রথমবার সার্ভিসিং-এর সময় এটা বদলে একটা নতুন প্রযুক্তির COSTAR (corrective optics space telescope axial replacement) স্থাপন করা হয়। 

মহাকাশ গবেষণায় আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণের গুরুত্ব অপরিসীম। লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে আগত আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে জানা যায় আলোর উৎসের গতিপথ। আলোর তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে আমাদের বর্ণালী ভাগ করা হয়েছে। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম। যদি আগত আলোর স্বাভাবিক বর্ণালীরেখা নীল রেখার দিকে সরতে থাকে (ব্লু-শিফ্‌ট) – তাহলে বুঝতে হবে বস্তুটি আমাদের দিকে আসছে, আর যদি লাল রেখার দিকে সরতে থাকে (রেড শিফ্‌ট) তাহলে বুঝতে হবে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাকাশের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করার জন্য হাবল টেলিস্কোপে আছে দুইটি স্পেকট্রোগ্রাফ - গডার্ড হাই-রেজ্যুলেশন স্পেকট্রোগ্রাফ (GHRS), এবং ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোগ্রাফ (FOS)। দুটোই চমৎকারভাবে কাজ করেছে ১৯৯৭ পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় সার্ভিসিং-এর সময় এগুলি বদলে স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজিং স্পেকট্রোগ্রাফ (STIS) হয়েছে। এই স্পেকট্রোগ্রাফ অতিবেগুনি থেকে অবলোহিত তরঙ্গ পর্যন্ত সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোই বিশ্লেষণ করতে পারে। 

লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে ছবি তোলার জন্য হাবলকে খুবই স্থির থাকতে হয়। অনেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বোঝাতে বলে থাকেন একচুলও না হেলার কথা। হাবল একটি চুলকে এক কিলোমিটার দূর থেকে দেখলে যত ছোট দেখা যাবে – সেটুকুও না হেলে ছবি তুলতে পারে। এই কাজটি করার জন্য হাবলে আছে অত্যন্ত সংবেদী সেন্সর – ফাইন গাইডেন্স সেন্সরস (FGS)। তিনটি সেন্সর হাবল টেলিস্কোপকে কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির রাখতে পারে দীর্ঘ সময়। 

টেলিস্কোপের যন্ত্রপাতির সাথে লাগানো আছে অনেকগুলি কম্পিউটার এবং মাইক্রোপ্রসেসর। দুটি প্রধান কম্পিউটারের একটি যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যটি পুরো স্যাটেলাইটকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

হাবল টেলিস্কোপের মূল নিয়ন্ত্রণ আছে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের হাতে। হাবল টেলিস্কোপের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে। আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট গডার্ডের নাম অনুসারে এই সেন্টার এবং হাবল টেলিস্কোপের স্পেকট্রোগ্রাফের নামকরণও করা হয়েছে। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় কমান্ড পাঠান। সেই কমান্ড যায় ট্রেকিং অ্যান্ড ডাটা রিলে স্যাটেলাইটে। সেখান থেকে কমান্ড যায় হাবল টেলিস্কোপে লাগানো হাই-গেইন অ্যান্টেনার সাহায্যে হাবলের কম্পিউটারে। এখন টেলিস্কোপ থেকে ছবি এবং তথ্য পৃথিবীতে পাঠানো হয় হাবলের অ্যান্টেনার সাহায্যে ট্রেকিং অ্যান্ড ডাটা রিলে স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট থেকে চলে আসে পৃথিবীতে। প্রতি সপ্তাহে হাবল প্রায় ১৫০ গিগাবিট ডাটা পৃথিবীতে পাঠায়। 

অন্যান্য স্যাটেলাইটের মতোই পনেরো বছর কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে পাঠানো হয়েছিল হাবল টেলিস্কোপ। কিন্তু এটা নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছে গত একত্রিশ বছর ধরে। সার্ভিসিং এবং যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের কারণে এই টেলিস্কোপ দিনের পর পর দিন আরো শক্তিশালী হয়েছে। 

হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যেই আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা প্রমাণ পেয়েছি মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে ১৩৮০ কোটি বছর আগে। হাবলের সাহায্যে প্রমাণ পেয়েছি ব্ল্যাকহোলের। হাবল আমাদের খুঁজে দিয়েছে অনেকগুলি নতুন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা। হাবল টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দিয়েছে আশ্চর্য গতি। এপর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে হাবলের সাহায্যে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে। 

মহাকাশে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পাঠানো হচ্ছে। এই নতুন টেলিস্কোপ হাবল টেলিস্কোপের বিকল্প নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীও নয়। হাবল টেলিস্কোপ যেভাবে কাজ করছে সেভাবেই কাজ করতে থাকবে আরো অনেক বছর। 


তথ্যসূত্র: 

রবিন কেরড ও ক্যারোল স্টট - ‘হাবল দি মিরর অন দি ইউনিভার্স’ (২০০৮), প্রদীপ দেব – ‘সবার জন্য স্যাটেলাইট’ (২০১৯), nasa.gov, ডেভিড সায়লার ও ডেভিড হারল্যান্ড – ‘দি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ফ্রম কনসেপ্ট টু সাকসেস’ (২০১৬)। 

______________
বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত








Latest Post

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা - দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের গান

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার দশমাইল এলাকায় কিছু পুলিশ সদস্য ইয়াসমিন নামের এক ষোল বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এই ঘ...

Popular Posts