Friday 12 April 2024

ডাইনোসরের কাহিনি

 



বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত হতে পারে। এবার প্রশ্নটিকে একটু পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করা যাক। অতীত কিংবা বর্তমান যে কোনো সময়ের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় প্রাণি কী ছিল বা আছে? এর উত্তরে আমাদের কারো কারো ডাইনোসরের কথা মনে হতে পারে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তখনো কিন্তু মানুষের উদ্ভব হয়নি। অর্থাৎ কোন মানুষই কোনোদিন কোনো জীবন্ত ডাইনোসর দেখেনি। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হবার পর থেকে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসর এবং সেই যুগের পৃথিবী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন। জীবাশ্মের হাড়ের গঠন বিশ্লেষণ করে, হাড়গুলি ঠিকমতো সন্নিবেশ করিয়ে পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসরের কাঠামোগত আকার ও আকৃতির পূননির্মাণ করে তাদের আনুমানিক দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ভরের হিসেব বিজ্ঞানীরা করেছেন। এপর্যন্ত আবিষ্কৃত ডাইনোসরের সবচেয়ে বড় জীবাশ্ম পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়াতে। এই অঞ্চলের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে প্যাটাগোটাইটান মায়োরাম (Patagotitan mayorum)। বিজ্ঞানীরা প্রাপ্ত তথ্য এবং প্রমাণের ভিত্তিতে হিসেব করে দেখেছেন টাইটানোসরাস গোত্রের এই ডাইনোসর ছিল প্রায় ৩৭ মিটার লম্বা আর প্রায় ৭৬ টন ভারী। দেখা যাচ্ছে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে কিছু কিছু ডাইনোসর নীল তিমিকে ছাড়িয়ে গেলেও – ভরের দিক থেকে ওরা নীল তিমির চেয়ে বড় ছিল না। 

সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণি ডাইনোসরদের সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। বিশেষ করে এদেরকে নিয়ে যখন জুরাসিক পার্ক জাতীয় কল্পবৈজ্ঞানিক সিনেমা তৈরি হতে থাকে – সবার ভেতর ডাইনোসর সম্পর্কিত এক ধরনের ভীতিমিশ্রিত কৌতূহল তৈরি হয়। কাল্পনিক অতিরঞ্জন বাদ দিয়ে বাস্তবিক ডাইনোসরদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা গত কয়েক শ বছর ধরে। 

ডাইনোসরের জীবাশ্ম সর্বপ্রথম কখন এবং কোথায় পাওয়া গিয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হওয়ার পর থেকে মানুষ প্রকৃতির সাথে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রাম এবং অভিযোজন করতে করতে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। এর মধ্যেই নানা প্রয়োজনে নানা ভাবে তারা অর্জন করেছে বিশেষ জ্ঞান এবং দক্ষতা। জীবাশ্ম সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েক হাজার বছরের পুরনো চীনা লেখায়, যেখানে বিভিন্ন জায়গায় ড্রাগনের হাড় পাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। ড্রাগন একটি কাল্পনিক প্রাণি – যাদের বিশাল দেহ, উড়তে পারে, মুখ থেকে আগুনের হল্কা বের হয় ইত্যাদি আরো অনেক ভয়ানক শক্তির অধিকার দেয়া হয়েছে এদেরকে মানুষের কল্পনায়। সেখান থেকে ধারণা করা যায় ডাইনোসরের বিশালাকৃতির জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছিলো হাজার বছর আগেও – যেখান থেকে মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে ড্রাগনের মতো ভয়ানক প্রাণির। কিন্তু সেই জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করার মতো জ্ঞান ও দক্ষতা ছিল না সেই যুগে। তাই সেগুলি সংরক্ষিতও হয়নি। 

ডাইনোসরের জীবাশ্ম সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ শুরু হয় ১৬৭৬ সালে। যদিও বিজ্ঞানীরা তখনো জানতেন না ডাইনোসর কী, এমনকি ‘ডাইনোসর’ নামটিও তখনো দেয়া হয়নি। ইংল্যান্ডের এক জাদুঘরের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড রবার্ট প্লট ১৬৭৬ সালে ইংল্যান্ডের এক জায়গায় একটি প্রকান্ড হাড় আবিষ্কার করেন। পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনি ধারণা করলেন এটি একটি প্রাচীন বিশালাকৃতি মানুষের উরুর হাড়। তখনো জীবাশ্ম সংরক্ষণের প্রযুক্তি ততটা উন্নত হয়নি। এই হাড়টি পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু রবার্ট প্লটের আঁকা হাড়ের চিত্র থেকে বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে ধারণা করেন যে এই হাড়টি ছিল মেগালোসরাস (Megalosaurus) গোত্রের ডাইনোসরের। হাড় পাওয়ার কয়েক শ বছর পরে বিশ্লেষণ করা হলেও, হাড় পাওয়া যাবার সময়ের হিসেবে বলা চলে মেগালোসরাস ডাইনোসর হলো বৈজ্ঞানিকভাবে নিবন্ধিত প্রথম ডাইনোসর। 

১৮১৯ সালে ব্রিটিশ জীবাশ্ম বিজ্ঞানী উইলিয়াম বাকল্যান্ড বেশ কিছু জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন এবং ১৮২৪ সাল পর্যন্ত তাদেরকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাদের বৈজ্ঞানিক নাম দেন এবং বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। তিনি ভেবেছিলেন এই জীবাশ্মগুলি কোন বড় প্রজাতির পূর্বপ্রজন্মের সরিসৃপের । তখনো বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেননি যে এই জীবাশ্মগুলির সাথে বর্তমান পৃথিবীর কোন প্রাণির হুবহু মিল নেই। 

সেইসময় একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী উইলিয়াম ডেভনশায়ার শল (William Devonshire Saull) শখের বশে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র জমাতেন এবং সেগুলি রাখার জন্য বড় বড় জাদুঘর তৈরি করেছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটায় তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা আগ্রহীদের দেখার জন্য খুলে দিতেন। তাঁর সংগ্রহে অনেক রকমের প্রাচীন প্রাণির হাড় ও জীবাশ্ম ছিল। ১৮৪২ সালের শুরুতে ব্রিটিশ জীবাশ্মবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়েন (Richard Owen) উইলিয়াম শলের সংগ্রহশালায় গিয়ে সেখানকার কিছু জীবাশ্ম দেখে খুব অবাক হলেন। মেরুদন্ডের হাড় দেখে তাঁর মনে হলো এগুলি কোন প্রাচীন ইগুয়ানা গোত্রের গিরগিটির হাড় হতে পারে। কিন্তু তাঁর মনে খটকা রয়ে গেল। যেসব গিরগিটি পৃথিবীতে আছে, তাদের হাড়ের সাথে কিছুটা মিল থাকলেও পুরোপুরি মিল নেই এসব জীবাশ্মের হাড়ের। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনি বুঝতে পারলেন যে জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া প্রাণিগুলির প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেখতে গিরিগিটির মতো মনে হলেও এই বিলুপ্ত প্রজাতি আরো ভয়ঙ্কর ছিল এই ভাবনা থেকে তিনি তাদের নাম দিলেন – ডাইনোসর। গ্রিক শব্দ ডাইনোস অর্থ ভয়ঙ্কর, আর সরোস অর্থ সরিসৃপ। সে হিসেবে ডাইনোসরের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ভয়ঙ্কর সরিসৃপ। রিচার্ড ওয়েনের দেয়া নাম টিকে গেল। 

১৮৪২ সাল থেকে ডাইনোসরের জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও ডাইনোসরের জীবাশ্ম খুঁজে বের করার অভিযান পুরোদমে শুরু হয়েছিল আঠারো শ সালের শেষের দিকে আমেরিকান বিজ্ঞানী ওথনিয়েল মার্শ (Othniel Charles Marsh) ও এডোয়ার্ড কোপের (Edward Drinker Cope) মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে। বলা যায়, ডাইনোসর সম্পর্কে আজ আমরা যতটুকু জানি, তার পেছনে এই দু’জন আমেরিকান বিজ্ঞানীর অবদান সবচেয়ে বেশি। 

ওথনিয়েল চার্লস মার্শের জন্ম নিউইয়র্কের একটি খামারে ১৮৩১ সালের ২৯ অক্টোবর। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। তাঁর বাবার একমাত্র ইচ্ছে ছিল ছেলে বড় হয়ে খামারেই কাজ করবে, চাষীর ছেলে চাষীই হবে। কিন্তু বালক বয়সেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ওথনিয়েল মার্শ। তাঁর সেই আগ্রহে উৎসাহ এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দেন তাঁর মামা জর্জ পিবডি। ক্রমে তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর জার্মানির বার্লিন ইউনিভার্সিটি ও হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে এনাটমি ও প্যালিওনটোলজি (জীবাশ্মবিজ্ঞান) বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। জার্মানি থেকে ফেরার পর ১৮৬৬ সালে তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে জীবাশ্মবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম জীবাশ্মবিজ্ঞান বিষয়ের প্রফেসর। তিনি প্রফেসর হয়েই তাঁর মামার কাছ থেকে দেড় লক্ষ ডলারের অনুদান আদায় করে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে স্থাপন করলেন ‘পিবডি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’। তাঁর মামা তাঁকে আরো এক লক্ষ ডলার দেন গবেষণা কাজ করার জন্য। সেই টাকায় তিনি পুরোদমে ডাইনোসরের জীবাশ্ম সন্ধান করেন এবং অনেকগুলি নতুন প্রজাতির ডাইনোসর আবিষ্কার করেন। 

 এডোয়ার্ড ড্রিংকার কোপের জন্ম ১৮৪০ সালের ২৮ জুলাই পেনসিল্ভেনিয়ার একটি ধনবান পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের পরিমন্ডলে বড় হয়েছেন তিনি। আঠারো বছর বয়সে প্রকাশ করেছেন প্রথম গবেষণাপত্র। ১৮৬৩ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থেকে ছেলেকে দূরে রাখার জন্য এডোয়ার্ডের বাবা এডোয়ার্ডকে পাঠিয়ে দেন জার্মানিতে। জার্মানিতেই এডোয়ার্ডের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় ওথনিয়েল মার্শের। 

আমেরিকায় ফিরে আসার পরেও ওথনিয়েল এবং এডোয়ার্ডের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল অনেক বছর। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ১৮৬৭ সালে এডোয়ার্ড তাঁর আবিষ্কৃত একটি উভয়চর প্রাণির জীবাশ্মের নাম দেন ওথনিয়েল মার্শের নামানুসারে টাইওনিয়াস মার্শি (Ptyonius marshii)। এর প্রত্যোত্তরে পরের বছর ওথনিয়েল মার্শ তাঁর আবিষ্কৃত একটি নতুন এবং বিশাল সরিসৃপের জীবাশ্মের নাম রাখেন এডোয়ার্ড কোপের নামানুসারে মোসাসরাস কোপিয়ানাস (Mosasaurus copeanus)। 

কিন্তু এই সৌহার্দ্য বেশিদিন টেকেনি। জীবাশ্মবিজ্ঞানে দুজনই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াই শুরু করেছেন। তাতে নানারকম অনৈতিক কৌশলও অবলম্বন করছেন তাঁরা। ১৮৬৮ সালে এডোয়ার্ড কোপ ওথনিয়েল মার্শকে নিউজার্সির একটি জীবাশ্ম সংগ্রহশালা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন নতুন কোন প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া যায় কি না দেখতে। সেখানে গিয়ে ওথনিয়েল মার্শ এডোয়ার্ড কোপকে না জানিয়ে সংগ্রহশালার মালিকের সাথে চুক্তি করে ফেলেন যেন নতুন কোন জীবাশ্ম পেলে তা সরাসরি তাঁর কাছে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এটা জানার পর এডোয়ার্ড কোপ স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা খুশি হলেন না। 

একই বছর এডোয়ার্ড কোপ একটি বিলুপ্ত প্রজাতির সামুদ্রিক সরিসৃপের জীবাশ্ম পেয়ে তার নামকরণ করেন ইলাসমোসরাস প্লাটিউরাস (Elasmosaurus platyurus) এবং সেটা সম্পর্কে দ্রুত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ফেলেন আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির জার্নালে। কিছুদিন পর ওথনিয়েল মার্শ এডোয়ার্ড কোপের জীবাশ্মটি দেখতে গিয়ে দেখেন যে হাড়ের পুনর্বিন্যাস করার সময় এডোয়ার্ড কোপ ভুল করে মেরুদন্ডের হাড় যেগুলি মাথার দিকে হওয়ার কথা সেগুলি লেজের দিকে স্থাপন করেছেন। ভুল ধরা পড়ার পর এডোয়ার্ড কোপের আত্মগরিমায় প্রচন্ড আঘাত লাগলো। তিনি দ্রুত ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করলেন। যে জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার অবিক্রিত সবগুলি কপি কিনে নিলেন। জার্নালের পরের সংখ্যায় একটি সংশোধনী ছাপানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তাতেও তাঁর মনের ক্ষোভ কমলো না। তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো ওথনিয়েল মার্শের ওপর।

শুরু হলো দুজনের মধ্যে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা – কে কার আগে কত বেশি জীবাশ্ম সংগ্রহ করতে পারবে – এবং প্রতিযোগিতা থেকে বন্ধুত্ব পরিণত হলো শত্রুতায়। ওথনিয়েল মার্শ গোয়েন্দা লাগালেন এডোয়ার্ড কোপের গতিবিধির উপর নজর রাখতে। শুরু হলো ডাইনোসরের হাড় খোঁজার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। 

ওথনিয়েল মার্শ যেখানে যত জীবাশ্ম পাওয়া যায় সব কিনে নিতে লাগলেন। আর ওদিকে এডোয়ার্ড কোপ অতি দ্রুততার সাথে একটার পর একটা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করলেন নতুন নতুন প্রজাতির ডাইনোসরের উপর। প্রকাশনায় নিজের স্বীকৃতি আদায় করার জন্য তিনি ১৮৭৭ সালে আমেরিকান ন্যাচারালিস্ট জার্নালটিই কিনে নিলেন এবং নিজের জার্নালে ইচ্ছেমতো গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে শুরু করলেন। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে তিনি ৭৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে তিনি চৌদ্দ শতাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। 

এদিকে ওথনিয়েল মার্শ প্রতিজ্ঞা করেছেন যেভাবেই হোক তিনি এডোয়ার্ড কোপকে ধ্বংস করে ফেলবেন। ১৮৮২ সালে তিনি তাঁর অর্থ, প্রতিপত্তি এবং রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি গঠিত আমেরিকান জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রধান জীবাশ্মবিজ্ঞানী নিযুক্ত হলেন। এই নিয়োগ লাভ করার ফলে তাঁর হাতে প্রচুর ক্ষমতা এলো। জীবাশ্ম গবেষণার সমস্ত রাষ্ট্রীয় ফান্ড এখন তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তিনি জীবাশ্মবিজ্ঞানের উন্নয়নের বদলে এডোয়ার্ড কোপকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হলেন। তাঁর আদেশে এডোয়ার্ড কোপের সমস্ত রিসার্চ ফান্ডিং বন্ধ হয়ে গেল। 

জীবাশ্ম গবেষণায় প্রচুর খরচ। একেকটি জীবাশ্ম খুঁজে বের করতে শত শত মানুষ নিয়ে দিনের পর দিন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালিয়ে যেতে হয়। সরকারি অনুদান ছাড়া ব্যক্তিগত খরচে এই গবেষণা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ফান্ড হারিয়ে এডোয়ার্ড কোপ চেষ্টা করলেন নিজের যা কিছু ছিল তাকে আরেকটু বাড়িয়ে গবেষণা কাজ চালিয়ে যাবার। দ্রুত অর্থনৈতিক লাভের আশায় তিনি তাঁর সমস্ত সঞ্চয় বিনিয়োগ করলেন নিউ মেক্সিকোর একটি রূপার খনিতে। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। টাকা-পয়সা ক্ষমতা ইত্যাদি হারানোর সাথে সাথে এডোয়ার্ড কোপ পারিবারিকভাবেও একা হয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ত্যাগ করে দূরে সরে গেলেন। ফিলাডেলফিয়ার ছোট্ট একটি বাসায় একাকী জীবন কাটছিল তাঁর। সম্পদ বলতে তখন শুধু অবশিষ্ট আছে এত বছরের জমানো জীবাশ্মগুলি। 

এডোয়ার্ড কোপকে এই অবস্থায় নিয়ে আসার পরেও তৃপ্ত হলেন না ওথনিয়েল মার্শ। তিনি এডোয়ার্ডের জীবাশ্মগুলিও দখল করতে চাইলেন। তিনি হুকুম দিলেন জীবাশ্মগুলি বাজেয়াপ্ত করার। যুক্তি দিলেন – জীবাশ্মগুলি সরকারি অনুদানের টাকায় কেনা হয়েছে, সুতরাং তা সরকারি সম্পত্তি। কিন্তু আদালতে গেলেন এডোয়ার্ড। তিনি প্রমাণ দিলেন যে জীবাশ্মগুলির বেশিরভাগই তাঁর নিজের টাকায় কেনা। ওথনিয়েল মার্শ হেরে গেলেন। 

এবার এডোয়ার্ড কোপ উঠেপড়ে লাগলেন ওথনিয়েল মার্শের বিরুদ্ধে। ওথনিয়েল মার্শ নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অনেক অনৈতিক কাজ করেছেন। কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক নীতিনিয়মের তোয়াক্কা না করে তিনি জীবাশ্ম সংগ্রহ করেছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রশাসনিক পদ দখল করেছেন। এডোয়ার্ড কোপ এসমস্ত কাজের প্রমাণ গোপনে সংগ্রহ করছিলেন অনেক বছর ধরে। এবার তিনি সেইসব প্রমাণ তুলে দিলেন নিউইয়র্ক হেরাল্ডের একজন ফ্রিল্যান্ড সাংবাদিকের হাতে। 

পত্রিকায় হেডলাইন হবার পর দুই সপ্তাহ ধরে বাগবিতন্ডা চললো সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। জনগণ ধিক্কার দিতে শুরু করলো। ওথনিয়েল মার্শ এবং তাঁর জিওলজিক্যাল সার্ভের অদক্ষতা ও সরকারি ক্ষমতা ও তহবিল তছরুপের দায়ে আমেরিকান কংগ্রেস তদন্ত কমিটি গঠন করলো। তদন্তের ফল হলো মারাত্মক। ওথনিয়াল মার্শ তাঁর পদ, ক্ষমতা, সংযোগ সবকিছু হারিয়ে ফেললেন। তাঁর সংগৃহীত জীবাশ্মগুলিও বাজেয়াপ্ত করা হলো – কারণ ওগুলি সরকারি টাকায় সংগ্রহ করা হয়েছিল। 

এডোয়ার্ড কোপ তাঁর জীবাশ্মগুলি নিজের কাছে রাখার সুযোগ পেলেও সেগুলি সংরক্ষণ করার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি সেগুলি বিক্রি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউই কিনতে রাজি হলো না। তাঁর বিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত জীবাশ্মগুলি মাত্র বত্রিশ হাজার ডলারে বিক্রি করতে বাধ্য হলেন তিনি। ১৮৯৭ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মৃত্য হয় এডোয়ার্ড কোপের। 

ওথনিয়েল মার্শ বেঁচেছিলেন আরো দুই বছর। ১৮৯৯ সালে ৬৭ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওথনিয়েল মার্শ প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়। তাঁর জীবাশ্মগুলির মধ্য থেকে আশি টনের মতো জীবাশ্ম সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। বাকি সংগ্রহ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিবডি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে দিয়ে গিয়েছিলেন। 

এডোয়ার্ড কোপ ও ওথনিয়েল মার্শ ব্যক্তিগত বিরোধে জড়িয়ে পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেললেও তাতে জীবাশ্ম বিজ্ঞানের লাভ হলো প্রচুর। প্রায় তেরো হাজারের বেশি জীবাশ্মের নমুনা তাঁরা রেখে গিয়েছেন। ১৯০০ সালের শুরু থেকেই সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়ে গেলো ডাইনোসরের জীবাশ্মের খোঁজ ও গবেষণার কাজ। সেই থেকে শুরু হয়ে বর্তমান পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সাত শতাধিক প্রজাতির ডাইনোসরের জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছেন। আধুনিক নিউক্লিয়ার তেজস্ক্রিয় ক্ষয় (decay) এবং নিউক্লিয়ার ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে হিসেব করে বের করেছেন ডাইনোসরগুলি কত বছর আগে বেঁচে ছিল এই পৃথিবীতে। 

যে সময়ে পৃথিবীতে ডাইনোসর বাস করতো সেই সময়টাকে মেসোজয়িক (Mesozoic) যুগ বলা হয়। আজ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছর থেকে পঁচিশ কোটি বছর আগের সময় হলো মেসোজয়িক যুগ। প্রায় বিশ কোটি বছর পৃথিবীতে বাস করেছে ডাইনোসররা। পঁচিশ কোটি বছর আগের পৃথিবী বর্তমান পৃথিবী থেকে অনেক ভিন্ন ছিল। পৃথিবীর স্থলভাগের মহাদেশগুলি সব একটির সাথে অন্যটি যুক্ত ছিল। বাতাসের তাপমাত্রা ছিল বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাও ছিল বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি। প্রাচীন উদ্ভিদ আর শৈবালে ভর্তি ছিল পৃথিবীর ভূমি। বিশ কোটি বছর ব্যাপ্ত মেসোজয়িক যুগকে আবার তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয় – ট্রাইয়াসিক, জুরাসিক এবং ক্রেটাসিয়াস পর্যায়। 

বিশ কোটি থেকে পঁচিশ কোটি বছর আগের সময়টাকে বলা হয় ট্রাইয়াসিক পর্যায়। এই সময়টাতে পুরো পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ একসাথে লাগানো ছিল। তখন একটাই মহাদেশ ছিল – যাকে বলা হচ্ছে প্যানজিয়া। পৃথিবী ছিল প্রচন্ড উত্তপ্ত। ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ ছিল মরুভূমি। পানির কাছে সামান্য আদ্রতা থাকলেও বাতাস ছিল শুষ্ক। এই পর্যায়েই উদ্ভব ঘটে প্রথম যুগের ডাইনোসরের। আকারে ছোট দুপেয়ে মাংসাশী ছিল এইসব ডাইনোসর। 

সাড়ে চৌদ্দ থেকে বিশ কোটি বছর আগের সময়টাকে বলা হয় জুরাসিক পর্যায়। জুরাসিক পর্যায়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ দুটি বড় মহাদেশে ভাগ হয়ে যায়। পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। মরুভূমি বদলে গিয়ে গভীর ঘন জঙ্গল তৈরি হয়। এই সময়টা ছিল ডাইনোসরদের স্বর্ণযুগ। অনেক প্রজাতির বড় বড় ডাইনোসরের উদ্ভব ঘটে এই পর্যায়ে। বড় বড় গাছের ডাল-পাতা খাওয়ার জন্য বিশালাকৃতির লম্বা গলার উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরের উদ্ভব ঘটে এই সময়। পাখির মতো ডানাওয়ালা উড়ন্ত ডাইনোসরেরও উদ্ভব ঘটে এই পর্যায়ে। 

সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে চৌদ্দ কোটি বছর আগের সময়টাকে বলা হয় ক্রেটাসিয়াস পর্যায়। এই সময়কালে পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের উৎপত্তি হয়। ডাইনোসরগুলি ছড়িয়ে পড়ে সাতটি মহাদেশেই। অনেক নতুন নতুন গাছপালা, ফলমূল ও শাকসবজির উদ্ভব ঘটে। নতুন ধরনের পাখির মতো ধারালো নখযুক্ত ডাইনোসর এবং পালকযুক্ত ডাইনোসরের উদ্ভব ঘটে এই যুগে। 

পৃথিবীর সাতটি মহাদেশ থেকেই ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এপর্যন্ত প্রায় আট হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে পনের হাজারের বেশি ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। বেশিরভাগ জীবাশ্ম পাওয়া গেছে মরুভূমিতে – কারণ সেখানে পাথরগুলির স্তর সহজে দেখা যায় বলে জীবাশ্ম আবিষ্কার তুলনামূলকভাবে সহজ। 

আধুনিক জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের হাড়, দাঁত, পদচিহ্ন, শরীরের যে কোনো অংশ, চামড়ার ভাঁজ ইত্যাদি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি অত্যাধুনিক এক্স-রে, কম্পিউটেড টমোগ্রাফি ইত্যাদিও ব্যবহার করছেন অভ্যন্তরীণ তথ্য আবিষ্কারের জন্য। বায়োমেকানিক্স, ফিজিক্স, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে ডাইনোসরের হাঁটাচলা, শরীরের গঠন, ক্ষীপ্রতা, ওজন, আকার ইত্যাদি সব সঠিকভাবে হিসেব করতে পারছেন। 

গত এক শ বছরে ডাইনোসরের জীবাশ্ম থেকে যত তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের ভিত্তিতে ডাইনোসরগুলিকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়: গিরগিটি-কোমর (সরিসসিয়ান্স) ডাইনোসর এবং পাখি-কোমর (অরনিথিসসিয়ান্স) ডাইনোসর। 

সরিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলির কোমরের গঠন গিরগিটির কোমরের মতো। আবার এদের হাঁটাচলা ও পায়ের গঠনের ভিত্তিতে সরিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলিকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায় – সরোপডোমরফ্‌স এবং থেরোপড়্‌স। সরোপড শব্দের অর্থ হলো গিরগিটির মতো পা বিশিষ্ট। সরোপডোমরফ্‌স ডাইনোসরগুলি বিশালাকৃতি লম্বা গলা বিশিষ্ট উদ্ভিদভোজী ডাইনোসর। এরা চার পায়ে চলাচল করে এবং এদের ঠোঁটের বদলে মুখ আছে। অন্যদিকে থেরোপড্‌স ডাইনোসরগুলি দুই পায়ে চলাচল করে। এদের সামনের দুটি পা খুবই ছোট। থেরোপড শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো যেই পায়ে তিনটি আঙুল। এই ডাইনোসরগুলির পায়ে ধারালো নখযুক্ত তিনটি করে আঙুল। এরা আকারে বিশাল হতে পারে, আবার পাখির মতো ছোটও হতে পারে। এরা প্রচন্ড শিকারি এবং মাংসভোজী। 
অরনিথিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলির কোমরের গঠন পাখির কোমরের মতো। এই প্রজাতির ডাইনোসরগুলির বেশিরভাগ উদ্ভিদভোজী। এদের গলা অপেক্ষাকৃত বেঁটে এবং মুখের বদলে পাখির মতো ঠোঁট আছে এদের। 

অরনিথিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলিকে আবার তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় – মারজিনোসেফালিয়ান্স, অরনিথোপোড্‌স, এবং থাইরিওফোরান্‌স। 

মারজিনোসেফালিয়ান্স ডাইনোসরগুলির মাথার পেছনে শক্ত হাড়ের শিঙের মতো আছে। এদেরকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায় – সিরাটোপসিয়ান্স এবং প্যাকাইসেফ্যালোসর্‌স। সিরাটোপসিয়ান্স ডাইনোসরদের মাথায় শিং আছে। মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত অনেকগুলি শক্ত হাড়ের শিং-এর মতো গঠন আছে। টিয়াপাখির মতো বাঁকানো ঠোঁটে এরা উদ্ভিদভোজী। প্যাকাইসেফ্যালোসর্‌স ডাইনোসরদের মাথার খুলি অনেক বেশি পুরু হাড় দিয়ে গঠিত। এরা দুপায়ে চলে এবং প্রধানত উদ্ভিদভোজী। 
অরনিথোপোড্‌স ডাইনোসরগুলি প্রধানত দুই পায়ে হাঁটে। এরা বিশালাকৃতির উদ্ভিদভোজী ডাইনোসর। আকারে অনেক বেশি বড় হয়ে গেলে তখন শুধুমাত্র দুই পায়ে নিজেদের ভর সামলাতে না পারলে সামনের দুই পাও কাজে লাগায়। 

থাইরিওফোরান্স ডাইনোসরগুলির শরীরে শক্ত হাড়ের বর্ম আছে। থাইরিওফোরা শব্দের অর্থ হচ্ছে বর্ম বহনকারী। এরা চার পায়ে হাঁটে। থাইরিওফোরান্স ডাইনোসরগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায় – স্টেগোসর্‌স এবং অ্যাঙ্কাইলোসর্‌স। স্টেগোসর্‌স ডাইনোসরগুলির পিঠ থেকে লেজ পর্যন্ত লম্বা সুঁচালো কাঁটার সারি আছে। অন্য কোন মাংসাশী ডাইনোসরের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা জন্য করার এই ব্যবস্থা। অন্যদিকে অ্যানকাইলোসর্‌স ডাইনোসরগুলি প্রাকৃতিকভাবে সবচেয়ে সুরক্ষিত। তাদের পিঠজুড়ে অত্যন্ত শক্ত হাডের খোলসের কারণে তাদেরকে ট্যাংক ডাইনোসরও বলা হয়ে থাকে। মাংসাশী শিকারী ডাইনোসরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এরা শক্ত পিঠ পেতে দেয়। 

সবগুলি ডাইনোসরকে এই দশটি শাখা এবং উপশাখায় ফেলা যায়। তবে আরো বিভিন্ন বৈশিষ্টের ভিত্তিতে ডাইনোসরগুলিকে আরো অনেক ধরনের প্রজাতি ও উপপ্রজাতিতে ভাগ করে বিভিন্ন নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন ভয়ঙ্কর আক্রমণকারী ডাইনোসরের নাম টাইরানোসরাস। টাইরানোসরাস রেক্স বা টি রেক্স অর্থ হলো আক্রমণকারীদের রাজা। আবার অনেক ডাইনোসরের নামকরণ করা হয়েছে যেখানে জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেখানকার নাম অনুসারে। যেমন, ২০১২ সালে আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়ায় পাওয়া গেছে সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের জীবাশ্ম – যার নাম দেয়া হয়েছে প্যাটাগোটাইটান মায়োরাম। আবার আর্জেন্টিনায় প্রাপ্ত আরেকটি মাংসভোজী  ডাইনোসরের নাম দেয়া হয়েছে তার আবিষ্কারক ভিক্টোরিনো হেরেরার নামানুসারে হেরেরাসরাস। 

ডাইনোসরের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের গঠন এবং কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেয়েছেন। সবচেয়ে ক্ষিপ্র গতির শিকারি ডাইনোসর টাইরানোসরাসের পায়ের পেশির আকার অনেক বড়। তাদের পায়ের পেশী দ্রুততম সময়ে প্রচুর তাপ উৎপন্ন করতে পারতো যা গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হতো। এরা ঘন্টায় প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারতো। ডাইনোসরের শক্ত কঙ্কাল বিশাল শরীরের ভর বহন করতে পারতো। বিশালাকৃতির অনেক হাড়ের ভেতরে মজ্জার পরিবর্তে বাতাস দ্বারা পূর্ণ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শরীরের ওজন কম রাখার জন্যই হয়তো এরকম ছিল। উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরদের অন্ত্রের দৈর্ঘ্য মাংসভোজী ডাইনোসরদের অন্ত্রের দৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি। কারণ উদ্ভিদ হজম করতে তুলনামূলকভাবে বেশি সময় লাগতো। অনেক ডাইনোসর উদ্ভিদ হজম করার জন্য পাথর খেতো – যাতে পাকস্থলিতে গিয়ে এই পাথর উদ্ভিদের টুকরার সাথে সংঘর্ষ করে হজমে সহায়তা করতে পারে। শরীরের তুলনায় ডাইনোসরদের মগজের আয়তন ছিল খুবই ছোট। সেখান থেকে ধরে নেয়া যায় ডাইনোসররা খুব একটা বুদ্ধিমান প্রাণি ছিল না। বিশাল শরীরে রক্তপ্রবাহ চালনা করার জন্য ডাইনোসরদের দরকার ছিল খুবই বড় এবং শক্তিশালী চার-প্রকোষ্ট বিশিষ্ট হৃৎপিন্ড। ডাইনোসরদের ফুসফুস ছিল আধুনিক পাখিদের ফুসফুসের মতো। উড়ার জন্য অনেক দম লাগে বলে পাখিদের ফুসফুস স্তন্যপায়ীদের ফুসফুসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ডাইনোসরের দৃষ্টি ছিল ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ। ডায়নোসরদের শরীরের চামড়া ছিল মানুষের নখের মতো শক্ত আঁশে আচ্ছাদিত। 

ডাইনোসররা পাখিদের মতো ডিম পাড়তো এবং ডিম থেকে বাচ্চা হতো। ডাইনোসরের সবচেয়ে বড় ডিম পাওয়া গেছে চীনে। নয় মিটার লম্বা একটি ডাইনোসরের বাসায় আঠারো ইঞ্চি লম্বা এই ডিম পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ডাইনোসররা পাখিদের মতো ডিমে তা দিতো এবং কিছু কিছু ডাইনোসর কুমিরের মতো করে ডিম পাড়তো এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতো। 

ডাইনোসরদেরকে সরিসৃপের মতো শীতল রক্তের প্রাণি বলে ধারণা করা হয়েছিল এক সময়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন ডাইনোসররা উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণি ছিল। তবে তাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কত ছিল এবং সেই সময়ের পরিবেশের তাপমাত্রা কত ছিল সে সম্পর্কে সঠিক হিসেব কষা খুব সহজ নয়। 

কিছু কিছু ডাইনোসর পঞ্চাশ-ষাট বছর বাঁচলেও বেশিরভাগ ডাইনোসরের গড় আয়ু ছিল বিশ থেকে ত্রিশ বছর। 

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি সবচেয়ে বড় ডাইনোসর যেটা পাওয়া গেছে সেটা ছিল প্রায় ৩৭ মিটার লম্বা এবং ওজন ছিল প্রায় ৭৬ টন। কিন্তু সব ডাইনোসরই এত বড় ছিল না। সবচেয়ে ছোট আকারের ডাইনোসর পাওয়া গেছে চীনে। মাত্র পঞ্চাশ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এই ডাইনোসরের নামও সবচেয়ে ছোট – মেই (Mei)। 

ডাইনোসরের জীবাশ্ম এখনো পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। বিজ্ঞানীরা এখন আর খুব বেশি আশ্চর্য হচ্ছেন না তাতে। কিন্তু এখনো যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি সেটা হলো প্রায় বিশ কোটি বছর ধরে পৃথিবী দাপিয়ে চলার পর হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে গেল কেন এত বড় একটি প্রজাতি? 

আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি ধারণা দিয়েছেন। একটি ধারণা হলো সেই সময়ের পৃথিবীতে এমন কোন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যার প্রভাবে ডাইনোসরসহ সব প্রাণির মৃত্যু হয়েছিল। 

আরেকটি ধারণা হলো আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ ঘটেছিল কয়েক শ বছর ধরে। ফলে আগুন এবং ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়েছিল পৃথিবী। সূর্যের আলো আসতে পারেনি পৃথিবীতে। অক্সিজেনের অভাবে মরে গেছে সবগুলি প্রাণি। 

বর্তমানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে ধারণাটি বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন সেটা হলো প্রায় দশ কিলোমিটার চওড়া বিশাল এক গ্রহাণু ছিটকে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে। তার প্রতিঘাতে পৃথিবীজুড়ে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির উদ্‌গীরণ, সুনামিসহ নানারকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলেছে বছরের পর বছর। সূর্যের আলো আসতে পারেনি প্রচন্ড ধুলো এবং ধোঁয়া ভেদ করে। ফলে অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে সবগুলি প্রাণি এবং উদ্ভিদ। বিশাল গ্রহাণুর আঘাতের প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। মেক্সিকোর সৈকতের নিচে সমুদ্রের তলদেশে বিশাল এক খাদ আবিষ্কৃত হয়েছে – যা গ্রহাণুর আঘাতের ফলে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। যদি ডাইনোসরসহ সমস্ত প্রাণির মৃত্যু হয়ে থাকে সেই সময় তাহলে ডাইনোসরদের উত্তরপ্রজন্ম পাখিরা বেঁচে রইলো কীভাবে? কুমির, গিরগিটি, কচ্ছপ এরকম প্রাণিগুলির সাথে ডাইনোসরের মিল আছে – তারা বেঁচে গেল কীভাবে? জীব বিবর্তনের এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আগামীতে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। 

তথ্যসূত্র:
১। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ডাইনোসরস অ্যান্ড প্রিহিস্টোরিক লাইফ, মাইলস কিলি, ইউ কে, ২০০৯।
২। মার্ক জাফি, দ্য গিল্ডেড ডাইনোসর, থ্রি রিভার্স প্রেস, নিউ ইয়র্ক,২০০০।
৩। লিসা র‍্যান্ডেল, ডার্ক ম্যাটার অ্যান্ড দ্য ডাইনোসরস, দ্য বডলি হেড, লন্ডন, ২০১৫।
৪। স্টিফেন এল ব্রুস্যাটি, ডাইনোসর প্যালিওবায়োলজি, উইলি-ব্ল্যাকওয়েল, ইউ কে, ২০১২।
৫। জন উডওয়ার্ড, দ্য ডাইনোসর, পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউজ, নিউ ইয়র্ক, ২০১৮। 

___________

বিজ্ঞানচিন্তা জানুয়ারি ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত











Sunday 17 March 2024

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী - ইতিহাস ও রাজনৈতিক দর্শনের অমূল্য দলিল

 



বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রথমবার যখন পড়েছিলাম তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সাবলীল ভাষার দক্ষতায়। কী অনায়াসে তিনি নির্মেদ বাক্যে তুলে এনেছেন তাঁর সমসাময়িক ইতিহাস। পড়ার পর প্রথম যে কথাটি মনে হয়েছিল সেটা হলো – এই বই সর্বজনপাঠ্য হওয়া উচিত। আশা করেছিলাম – বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা সহ্যও করতে পারেন না কোনো না কোনো কারণে – তাঁরাও যদি এই বইটি পড়েন – জানতে পারবেন রাজনীতির কত চড়াই-উৎরাই পার হয়ে, কত দীর্ঘ সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। 

তার এক দশক পর সম্প্রতি বইটি আবার পড়লাম। এবার ঘটনার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর নৈতিক আদর্শের ব্যাপারটা টানলো আরো বেশি। প্রশ্ন জাগে – একটানা পনেরো বছর বঙ্গবন্ধুর নাম জপ করার পরেও আমাদের নেতাদের ভেতর তাঁর আদর্শের কোন ছাপ দেখি না কেন?

 বইয়ে উল্লেখিত সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই বই থেকে তথ্য নিয়েই রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অসংখ্য বই। সেই বইগুলির কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রচিত। 

২০১২ সালে প্রকাশিত হবার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’  সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত বই বাংলাদেশে। পাঠকরা নিজেদের মধ্যে কতটুকু উপলব্ধিমূলক আলোচনা করেছেন জানি না, তবে রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে এবং আনুকুল্য লাভের আশায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বইয়ের সুখ্যাতি করেছেন অনেকেই । শুনেছি বিসিএস পরীক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য এই বই – কারণ এই বই থেকে এক বা একাধিক প্রশ্ন প্রতি বৎসরই আসে, কিংবা মৌখিক পরীক্ষায় জিজ্ঞাসা করা হয়। অনলাইনে খুঁজলেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র অসংখ্য প্রশ্নোত্তর পাওয়া যায়। নিসন্দেহে এতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তথ্য কে কতটুকু জানে তা প্রমাণিত হয়। কিন্তু তথ্য জানা আর আদর্শ ধারণ করা কি এক? 

গত এক দশকে বঙ্গবন্ধুর পোশাক পরে যতজন নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক কিংবা সন্তানের চেয়েও বেশি সন্তান বলে গলা ফাটিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছেন – আমার কেন যেন মনে হয় তাঁদের কেউই বঙ্গবন্ধুর এই বইটি সম্পূর্ণ পড়েননি। যদি পড়তেন, কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিফলন দেখা যেতো তাঁদের মধ্যে। 

অবশ্য এটাও ঠিক, ধর্মীয় গ্রন্থ তো অনেকেই দিনরাত পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেন। তাতে কি ধর্মের আদর্শগুলি তাঁরা ধারণ করেন? যাই হোক, এই বইয়ে বর্ণিত ইতিহাস নয়, আমার কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটা হলো সেই সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভেতর আদর্শ নেতৃত্ব আর সত্যিকারের দেশপ্রেমের দর্শন গড়ে ওঠাটা। তাঁর আদর্শের ছিটেফোঁটাও যদি বর্তমান নেতাদের সবার ভেতর থাকতো!

রাজনীতির  পিচ্ছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে পংকিল পথ ধরে, অনেক ক্ষেত্রে জঞ্জাল পরিষ্কার করতে করতে তিনি উঠে এসেছেন একেবারে কর্মীর কাতার থেকে নেতার সারিতে। 

নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ঘটনা লিখতে লিখতে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু কিছু দার্শনিক লাইন লিখেছেন, যেগুলি আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত মূল্যবান তাঁকে চেনার জন্য। 

টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া জনপ্রতিনিধি সেই সময়েও ছিল (এখনো আছে বলাই বাহুল্য)। তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন: “এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি। আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেবার, যাতে তারা দল র‍্যাগ করে অন্য দলে না যেতে পারে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হল। তিনি বার বার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, “আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।“ আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্যদলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের!” (পৃ ৩৪)। 

বই থেকে কিছু লাইন যেখান থেকে বোঝা যায় তাঁর নীতিবোধ কতটা প্রখর ছিল:

“উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।“ (পৃ ৪৭)

“আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে পরশ্রীকাতর বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতর সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জনি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।“ (পৃ – ৪৭-৪৮)

“কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও যে বাঙালির দুঃখকষ্টের কারণ তা তিনি বুঝেছিলেন খুব ভালো করে। তাই তিনি পরিষ্কার ভাষায় উদাহরণসহ লিখেছেন এভাবে: “অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।“ (পৃ ৪৮)

ষড়যন্ত্রের রাজনীতি যে তখনো ছিল, এবং যতই দিন গেছে তা বেড়ে চলেছে তা তিনি জানতেন। “পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরাপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।“ পৃ ৭৮। 

তিনি কর্মবীর ছিলেন। তাঁর কর্মদর্শনও ছিল পরিষ্কার। “আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।“ (পৃ ৮০)

“কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিতে বলার অধিকার জনগণের আছে।“ (পৃ ১০০)

ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নেই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই।“ (পৃ ১২৬) এখনকার বৃদ্ধ ছাত্রনেতারা এই বই পড়লে নিশ্চয় লজ্জা পেতেন। 

“জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসকরা যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।“ পৃ ২১০

চীনের শান্তি সম্মেলনে গিয়ে তিনি নিজের চোখে যে শিল্প বিপ্লবের সূচনা এবং চীনা নাগরিকদের মানসিকতার পরিবর্তন দেখেছিলেন তা অত্যন্ত শিক্ষণীয়। “চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না, তা লোকে ব্যবহার করবে না।“ “এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হল জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে!” “এদেশে একটা বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরি করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়।“ পৃ ২৩১। 

দেশ স্বাধীন হলেই যে আপনাআপনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায় না তা তিনি ভালো করেই বুঝেছিলেন। চীনের সাথে পাকিস্তানের তুলনা করেছিলেন তিনি – “আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।“ পৃ ২৩৪।

পুঁজিবাদের কুফল সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল স্পষ্ট। “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।“ পৃ ২৩৪।

যুক্তফ্রন্ট করে ক্ষমতায় যাবার প্রস্তাবের উত্তরে ১৯৫৩ সালে তিনি বলেছিলেন, “ক্ষমতায় যাওয়া যেতে পারে, তবে জনসাধারণের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না, আর এ ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না। যেখানে আদর্শের মিল নাই সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।“ পৃ ২৫০।

“নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।“ “অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।“ পৃ ২৭৩।

আমাদের নেতারা কি দয়া করে এই বইটি মনযোগ দিয়ে পড়বেন এবং আত্মসমালোচনা করে দেখবেন – বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কতটুকু তাঁরা ধারণ করেন? 


Saturday 9 March 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর - ৯

 



সবকিছু গোছগাছ করে রুম থেকে যখন বের হলাম, তখন মাত্র সোয়া পাঁচটা বাজে। রেলস্টেশনে যেতে আধঘন্টার বেশি লাগবে না। ট্রেনের অগ্রিম টিকেট পেলে আরো পরে গেলেও চলতো। টিকেটের অনিশ্চয়তার কারণেই এত ভোরে বের হতে হচ্ছে।

লিফ্‌টের জন্য দাঁড়াতে হলো বেশ কিছুক্ষণ। তিনটি লিফ্‌টের দুটো পুরোপুরি বন্ধ। অন্যটি সম্ভবত নিচের তলায় আটকে আছে। নইলে চব্বিশ তলা পর্যন্ত উঠে আসতে এত সময় নেয়ার কথা নয়। করিডোরে টিমটিমে লাল আলো জ্বলছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। দূরের জানালায় আছড়ে পড়ছে রাতের নিয়ন বাতির প্রতিফলন।

পরিবেশের মৌনতার কারণে লিফ্‌ট থামার টুং শব্দটাকেও হঠাৎ অনেক জোরালো মনে হলো। সাত তলায় লিফ্‌ট থেকে বের হয়ে রিসিপশানে কাউকে দেখতে পেলাম না। রিসিপশানে চব্বিশ ঘন্টা লোক থাকে। এখন কোথায় গেল সবাই? ট্রলিব্যাগটা টেনে নিয়ে রিসিপশানের কাছে এসে দেখলাম ডেস্কের পেছনে ফ্লোরের লাল কার্পেটে পাশাপাশি বসে মোবাইলে রিল দেখছে দুজন ছেলে।

“হ্যালো, এক্সকিউজ মি”

ধড়পড় করে উঠে দাঁড়ালো দুজনই। লিকলিকে লম্বাটা দ্রুত এগিয়ে এলো রিসিপশানের ডেস্কে। তার লাল টি-শার্টে লাগানো ট্যাগে লেখা “ট্রেইনি”।

“গুড মর্নিং স্যার। ওয়েলকাম টু চিনামন রেড।“

“আমি আসলে চেক আউট করছি।“

কি-কার্ডটা নিয়ে কম্পিউটার চেক করে “ওকে স্যার” বলার জন্য অনেকক্ষণ সময় নিলো ছেলেটি। মনে হচ্ছে সে খুবই স্লো লার্নার।

“এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য কি গাড়ি লাগবে স্যার?”

“না, এয়ারপোর্টে যাবার জন্য লাগবে না। তবে রেলস্টেশনে যাবার জন্য একটি ট্যাক্সি লাগবে।“

“নিচের গার্ডরা ট্যাক্সি ডেকে দেবে স্যার।“

নিচে নেমে এলাম। বাইরে এখনো অন্ধকার। একজন নাইটগার্ড দরজার সামনে টুলে বসে ছিল। আমাকে বের হতে দেখে ছুটে এলো। বললাম, “রেলস্টেশনে যাবার জন্য একটি মিটারড-ট্যাক্সি কোথায় পাবো?”

“এক মিনিট দাঁড়ান স্যার, আমি ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসছি।“ – ঝরঝরে ইংরেজিতে কথাগুলি বলেই অন্ধকার রাস্তার দিকে ছুটে চলে গেল তরুণ নাইটগার্ড। তার ইংরেজি উচ্চারণ রিসেপশানের ছেলেটির চেয়েও ভালো।

রাতে সম্ভবত বৃষ্টি হয়েছে। হোটেলের সামনের রাস্তা ভেজা। মিনিটখানেকও লাগলো না, একটা লাল ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হলো নাইটগার্ড। এখানে এই তিন চাকার ট্যাক্সিগুলি সম্ভবত সিএনজিতে চলে না। শ্রীলংকায় গ্যাসের সংকট আছে। গাড়িতে দেয়ার মতো গ্যাস তাদের আছে কি না জানি না। পেট্রোলের দাম বাড়ার কারণেই এখানে ট্যাক্সিভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি।

ট্যাক্সিওয়ালা ইংরেজি ভালো বোঝে না। ফোর্ট রেলস্টেশন – এই দুটো শব্দ ছাড়া আমার আর কোন কথা বুঝতে পারলো বলে মনে হলো না। তাতে আমার কোন অসুবিধা নেই।

যে পথে ট্যাক্সি চলছে সেই পথ আমার চেনা হয়ে গেছে মাত্র একদিনেই। গলির ভেতরের রাস্তায় গাড়ির ভীড় নেই। কিন্তু গার্লে রোডে ওঠার পর দেখা গেলো এই ভোরেও রাস্তায় অনেক গাড়ি।

কাল রাতে আমি যে পথে ফোর্ট স্টেশনে গিয়েছিলাম এখন বুঝতে পারছি ওটা অনেক ঘুরপথ ছিল। প্রেসিডেন্ট অফিসের সামনের গোলচত্বর থেকে লোটাস রোড ধরে একটু এসে বামে মোড নিলে অনেক কাছে হয় স্টেশন। মিনিট দশেক লাগলো স্টেশনে পৌঁছাতে।

কাল রাতে দেখে গিয়েছিলাম চার নম্বর কাউন্টার থেকে কাটতে হবে টিকেট। কাউন্টারে লাইনে আমার আগে মাত্র দু’জন মানুষ। তারা বের হয়ে যেতেই কাউন্টারে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ক্যান আই গেট অ্যা টিকেট ফর ক্যান্ডি প্লিজ!”

“গো টু কাউন্টার সেভেন্টিন। রিজার্ভ টিকেট পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।“

“কাল রাতে যে বলেছিল রিজার্ভ টিকেট নেই!”

“আজ স্পেশাল ট্রেন দেয়া হয়েছে। গো ফাস্ট।“

সতেরো নম্বর কাউন্টার আমি গতকাল চিনে গিয়েছিলাম। সেই রিজার্ভেশান রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখি লোকে গিজগিজ করছে সেখানে। ক্যান্ডির কাউন্টারের লাইন এঁকেবেঁকে কোথায় চলে গেছে তা খুঁজে বের করতে বেশ কিছুক্ষণ লাগলো। তবে ভীড় হলেও যেটা দেখে ভালো লাগলো – সেটা হলো মানুষের ভদ্র ব্যবহার। কোথাও কোন ধাক্কাধাক্কি নেই, লাইনের মাঝখানে ঢুকে যাওয়া নেই। চিৎকার-চেঁচামেচিও নেই। এখন মনে হচ্ছে আরো ভোরে আসা উচিত ছিল।

যাত্রীদের বেশিরভাগই শ্রীলংকান। আজ সম্ভবত কোন বিশেষ দিন। যাত্রীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। তাদের অনেকেরই পরনে সাদা পোশাক। মনে হচ্ছে কোন উৎসবে অংশ নিতে যাচ্ছে সবাই।

বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগলো কাউন্টারে পৌঁছাতে। কলম্বো থেকে ক্যান্ডির সেকেন্ড ক্লাস রিজার্ভ টিকেটের দাম এক হাজার রুপি। এই ট্রেনে কোন ফার্স্ট ক্লাস নেই। পাসপোর্ট দেখাতে হলো না, তবে পাসপোর্টের নম্বর বলতে হলো টিকেট এন্ট্রি করার জন্য। কম্পিউটার প্রিন্টেড টিকেটের সাইজটা বেশ বড়। যেসব তথ্য টিকেটে প্রিন্ট করা আছে সেগুলি এর চারভাগের এক ভাগ কাগজেই হয়ে যেতো। অনায়াসেই এই টিকেটের ক্ষেত্রফল শতকরা পচাত্তর ভাগ কমিয়ে ফেলা যেতো। তাতে লক্ষ লক্ষ রিম কাগজ বেচে যেতো, আর টিকেটও আধুনিক এবং দৃষ্টিনন্দন হতো।

পাঁচ নম্বর প্লাটফরম থেকে ট্রেন ছাড়বে সাতটায়। প্লাটফরমে ঢুকলাম। শ্রীলংকার ব্যস্ততম রেলস্টেশন এই ফোর্ট স্টেশন। এখনো সবকিছু সেই ব্রিটিশ আমলেই রয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে, কেবল আধুনিক ডিজিটাল ডিসপ্লেগুলি ছাড়া।

ট্রেন এখনো প্লাটফরমে আসেনি। সম্ভবত অন্য কোন স্টেশন থেকে এখানে আসবে। প্লাটফরমের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হাঁটতে হাঁটতে মানুষ দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভ্রমণ করলে।

প্লাটফরম ভরে উঠতে শুরু করেছে মানুষের আনাগোনায়। বেশ কিছু বিদেশী পর্যটক দেখা যাচ্ছে এখন। এদের হয়তো আগেই টিকেট করা ছিল, অথবা এদের স্থানীয় ট্যুর এজেন্টরা সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখেছে। তাদের কয়েকজনের সাথে স্থানীয় ট্যুর গাইড দেখা যাচ্ছে অনবরত কথা বলছে।


ফোর্ট স্টেশন থেকে কাছেই লোটাস টাওয়ার

প্লাটফরম থেকে পূর্বদিকে তাকালে সরাসরি চোখে পড়ে লোটাস টাওয়ার। তার কয়েকটা ছবি তোলার চেষ্টা করছি – এমন সময় একজন চাপদাড়িওয়ালা মোটাসোটা লোক কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইন্ডিয়ান?”

“নো। আই …”

“ডোন্ট টেল মি, লেট মি গেস…” – আমাকে বাধা দিয়ে লোকটি বেশ মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন। আমি লোকটির দিকে ভালো করে তাকালাম। ছোট ছোট চোখ বেশ লাল, মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাননি। ডান হাতের কবজিতে বেশ বড় একটা জটিল উল্কি – সিংহলি ভাষায় কিছু লেখা আছে সেখানে।

“ইউ আর বাংলাদেশি, রাইট?”

“রাইট।“

“হা হা” – খুশিতে জোরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি।

“ইউ লাইক ক্রিকেট?”

“ইয়েস।“

“সাকিব আল হাসানকে আমি খুব পছন্দ করি। শুনেছি সে নাকি এমপি হচ্ছে?”

লোকটি যে সাম্প্রতিক খবরাখবরও রাখেন তা বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না এত কথা তিনি বলছেন কেন।

“আমি খেলাধূলা গানবাজনা মৌজমস্তি খুব পছন্দ করি। আমার এক ভাই থাকে কানাডায়, আরেক ভাই থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। তারা আমাকে এত টাকা পাঠায় যে আমি খরচ করে শেষ করতে পারি না। কাল সারারাত আমি ক্যাসিনোতে ছিলাম। এখনো বাসায় যাইনি। বাসায় গিয়ে কী করবো? বাসায় তো কেউ নেই। আমার বউ চলে গেছে।“

এখন লোকটিকে মাতাল বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনো তার নেশা কাটেনি। কিন্তু নেশা করার কারণ কি বউ চলে যাওয়া? নাকি নেশা করে বলেই বউ চলে গেছে? তার কাহিনি আরো জানার ইচ্ছে হচ্ছে, আবার অস্বস্তিও হচ্ছে। মাতাল সামলানোর অভিজ্ঞতা আমার খুব কম।

“হাউ লং উইল ইউ বি ইন কলম্বো? তোমার যা কিছু লাগে আমাকে ফোন করবা, আমি ব্যবস্থা করবো।“

“আমি তো ক্যান্ডি চলে যাচ্ছি।“

“ক্যান্ডি থেকে ফোন করবা।“ বলে সামনের দিকে চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলেন।

“ডু ইউ নো, হাউ ওল্ড আই অ্যাম?”

“না, জানি না।“

“আন্দাজ করে বলো, কত বয়স আমার?”

বয়স্ক মানুষ নিজেকে নিজের বয়সের চেয়ে কম বয়সী লাগছে বললে খুশি হয়। এই মানুষটির কাচাপাঁকা দাড়িতে ভর্তি গোলাকার মুখ আর স্ফীত ভুঁড়ি দেখে মনে হচ্ছে বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। তবুও খুশি করার জন্য বললাম, চল্লিশ!

শুনে হঠাৎ প্রচন্ড রেগে গেলেন তিনি। ধমক দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “চল্লিশ! চল্লিশ মনে হচ্ছে আমাকে! চল্লিশ মনে হচ্ছে আমাকে!!”

তার চিৎকার শুনে আশেপাশে লোক জমে যাচ্ছে। প্লাটফরমের একেবারে অন্য মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে এতক্ষণ এদিকে তেমন কেউ আসেনি। আমার কৌতূহল ছাপিয়ে এবার অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে। অন্যদিকে চলে যাবার জন্য পা বাড়ানোর আগেই দেখলাম মানুষের ভিড় ঠেলে একজন সাদা ইউনিফর্ম পরা রেলকর্মী এসে সিংহলি ভাষায় কিছু বলতে বলতে লোকটির বাহু ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো আরো সামনের দিকে – যেদিকে রেলওয়ে কোয়ার্টার। লোকটি যেতে যেতেও পিছন ফিরে ইংরেজিতে চিৎকার করে বলছে, “আমি সাকিব আল হাসানের চেয়েও ছোট।“

লোকটি কি মাতাল, নাকি উন্মাদ ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে মনের কোথাও যে সমস্যা আছে তা নিশ্চিত।

“সরি, হি শাউটেড অ্যাট ইউ!” কাছে দাঁড়ানো এক তরুণ বললো। তার দিকে তাকালে সে আবার বললো, “ডোন্ট মাইন্ড, অ্যা? হি ইজ নট এ ব্যাড পারসন।“

“তুমি চেনো তাকে?”

“হ্যাঁ, সে রেলওয়েতে চাকরি করে। মাঝে মাঝে মাতাল হয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে।“

লোকটি মাতাল হয়ে বেশি কথা বলেছে সত্য, কিন্তু উল্টাপাল্টা কথা কিছুই বলেনি। আমি একটু হেসে প্রসঙ্গ পাল্টালাম, “সেকেন্ড ক্লাস রিজার্ভ বগি কোথায় থামবে বলতে পারো?”

“প্লাটফরমের মাঝামাঝি যেতে হবে।“

এবার একটু দ্রুত পা ফেলে চলে হাঁটতে শুরু করলাম অন্যদিকে – প্লাটফরমের মাঝামাঝি পৌঁছানোর জন্য।

সাতটা বাজার দশ মিনিট আগে ট্রেন প্লাটফরমে ঢুকতে শুরু করার সাথে সাথে প্রচন্ড ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। মাত্র চারটি বগি হলো রিজার্ভ। বাকি ছয় সাতটি বগি তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণির অসংরক্ষিত আসনের বগি। সেখানে ঠাসাঠাসি করে যে আগে উঠতে পারে সে সিট পেলেও পেতে পারে।

ট্রেন থামার পর কোন ধরনের তাড়াহুড়ো ছাড়াই উঠে গেলাম ডি বগিতে। ট্রেনের বগিগুলি বাংলাদেশের ট্রেনের বগির মতোই। সেকেন্ড ক্লাস বগিও মনে হলো আমাদের ফার্স্ট ক্লাস বগির মতো। পরিচ্ছন্ন, সিটগুলিও আরামদায়ক। দুপাশে দুটো করে সিট। আমার সিট জানালার পাশে নয়। পাশের জন এখনো আসেনি। আমি আমার সিটে বসে আশেপাশে তাকাচ্ছি।

আমাদের কম্পার্টমেন্টে এখনো অনেক সিট খালি। সম্ভবত সামনের স্টেশন থেকে উঠবে। স্পেশাল ট্রেন হওয়াতে এই রিজার্ভ টিকেটগুলি আগে ছাড়া হয়নি। হলে তো কাল রাতেই কিনতে পারতাম। আমার সারির প্রথম দিকে একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবার উঠেছে। মা-বাবা আর দুজন কিশোরী কন্যা তাদের। এধরনের ট্রেনে উঠতে পেরে তারা যে প্রচন্ড খুশি তা বোঝা যাচ্ছে তাদের ছটফটানি দেখে।

ট্রেন সাতটায় ছাড়ার কথা। আর দুমিনিট বাকি সাতটা বাজার। পাশের সিটে কেউ আসছে না দেখে ভালোই লাগছে। ট্রেনে জানালার পাশে বসে বাইরে দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে – সেটা অনেকদিন পর পেতে যাচ্ছি আজ।



ঠিক সাতটায় ট্রেন চলতে শুরু করলো। নিজের সিট থেকে সরে জানালার সিটে গিয়ে বসলাম। সামনের সিট এসে পড়েছে জানালার মাঝামাঝি। ফলে দৃশ্য পুরোপুরি উপভোগ করা যাচ্ছে না। প্লাটফরম পার হয়ে ট্রেন এখন শহর অতিক্রম করছে। সামনের দুটো সিটও খালি। সেখানে গিয়ে বসবো কি না ভাবছি, এমন সময় সামনের দিকের বগি থেকে বেশ কয়েকজন এই বগিতে এসে বসতে শুরু করলো।

“হিয়ার আর উই। দিস থ্রি”

চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম – নীল জিন্স আর সাদা টি-শার্ট পরা অনেক লম্বা চুলের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সিটের সামনে। তার সঙ্গী দুজন ছেলে হাতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ট্রেনের দুলুনি সামলে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। বড় দুটো সুটকেস লাগেজ র‍্যাকে তুলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে একজন এসে মেয়েটিকে বললো আমার সামনের সিটের জানালার দিকে বসতে। এবার মেয়েটির মুখ দেখা গেল। স্বাভাবিক শ্রীলংকান,  চেহারায় আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই। ছেলেটির মুখে সযত্নে রক্ষিত দাড়িগোঁফ – অনেকটা অ্যানিমেল-এর রনবীর কাপুরের মতো। তারা পাশাপাশি সিটে বসার পর তৃতীয় জনকে দেখে বেশ চমকে উঠলাম। গতকাল দুপুরে গার্লে ফেস গ্রিনের সামনের রাস্তার ফুটপাতে যে বড়লোক ছেলেটির সাথে কথা হয়েছিল। তার সাথে আবার দেখা হবে ভাবিনি।

আমাকে দেখে সে চিনতে পারবে না ভেবেছিলাম। কিন্তু চিনতে পারলো। বললো, “ইউ এগেইন? গোয়িং ক্যান্ডি? আমিও ক্যান্ডি যাচ্ছি আমার বন্ধুদের সাথে। দে আর ফ্রম অস্ট্রেলিয়া।“ 


Sunday 3 March 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর - ৮

 



কলম্বো শহরে কোন রিকশা নেই।  চীন জাপান হংকং-এও এখনো রিকশার চল রয়ে গেছে, অথচ বুঝতে পারছি না শ্রীলংকা রিকশামুক্ত হয়ে গেল কীভাবে? পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এখানে সত্যি সত্যিই পাবলিক। রাস্তার বাস সরকারি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে, বাসে-বাসে অহেতুক প্রাণনাশক প্রতিযোগিতা এখানে নেই। বাসগুলির রঙ আর কারুকাজে উন্নত রুচিবোধের কোন চিহ্ন চোখে পড়লো না। আমাদের বিআরটিসির বাসের মতো মাঝে মাঝে কয়েকটা টকটকে লাল রঙের বাস দেখা গেলেও বেশিরভাগ বাসে আকাশী রঙের উপর ছোপছোপ আঁকুবুকি। বাসস্টপে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাস এলে আর উঠতে পারলাম না। প্রচন্ড ভীড় তো আছেই, তাছাড়া বাসের রুটও ঠিকমতো জানা নেই। বাস কন্ডাক্টর সিংহলী ভাষায় যেসব গন্তব্যের নাম ধরে ডাকাডাকি করছিলো সেসবের কোনটাই বুঝতে পারছিলাম না।

রিকশা নেই। আমাদের সিএনজি ট্যাক্সির মতো ট্যাক্সি আছে অনেক। সবুজ, নীল, লাল – ভিন্ন ভিন্ন রঙের ট্যাক্সি দেখলাম। বেশিরভাগই মিটারে চলে না, দরাদরি করতে হয়। মাঝে মাঝে একটা দুটো মিটারের ট্যাক্সি চোখে পড়ে। গাইড বইতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে – মিটারের ট্যাক্সিতে উঠতে। ছুটির দিনের ব্যস্ততায় রাস্তায় খালি ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল। রাস্তা পার হয়ে প্রেসিডেন্টের দপ্তরের সামনে এলাম। এখানে কোন গাড়ি থামতে দিচ্ছে না রাস্তার পুলিশ। আরেকটু এগিয়ে খোলা মাঠের যেখানে বিশাল খ্রিস্টমাস ট্রি সাজানো হয়েছে – সেখানে রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি ট্যাক্সি দাঁড়ানো। মিটার-ট্যাক্সি দেখে উঠে গেলাম।

“ওয়াটা ইয়ান্না উনা কোহেডা?” – লিকলিকে মাঝবয়সী ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। একটি শব্দও বুঝতে পারলাম না। ইংরেজিতে বললাম, “বেইরা লেইক নিয়ে যেতে পারবেন আমাকে?”

“বেইরা লেইক?”

“ইয়েস”

তাঁর মাথা এক পাশ থেকে অন্য পাশে নাড়ানো দেখে হতাশ হতে গিয়েই মনে পড়লো – আমরা না-বোঝানোর জন্য যেভাবে মাথা নাড়ি, এরা তো হ্যাঁ বোঝানোর জন্যই সেভাবে মাথা নাড়ে।

“হোয়ার ইন বেইরা লেইক?”

“ওল্ড টাউনের যে কোনো জায়গায়।“

ট্যাক্সি ছুটতে শুরু করলো। মিটারের দিকে চোখ পড়তেই মনে হলো ওটা ট্যাক্সির চেয়েও জোরে চলছে। এক কিলোমিটার যাবার আগেই মিটারে আড়াই শ রুপি উঠে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমেরিকান এমব্যাসি পার হয়ে ট্যাক্সি বাম দিকে মোড় নিলো। বেশ কয়েকটি ছোটবড় রাস্তা পার হয়ে পুরনো জীর্নশীর্ণ দোকানপাটের অঞ্চলে প্রবেশ করতেই হ্রদের পানিতে চোখ গেল। বললাম, এখানেই থামেন।

মাত্র সাত-আট মিনিটের ভ্রমণ। দূরত্ব খুব বেশি হলে চার কিলোমিটার হবে। ট্যাক্সির মিটারে দেখাচ্ছে চারশ ত্রিশ রুপি। ট্যাক্সিভাড়া এখানে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি।


ওল্ড টাউন ক্যাফে


শহরের ভেতর বেইরা হ্রদের এপার আর ওপারের মধ্যবর্তী দূরত্ব এক কিলোমিটারও হবে না। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য সীমাহীন। এদিকের বাড়িঘর, দোকানপাট পুরনো জীর্ণ। ওদিকে গড়ে উঠেছে ঝা চকচকে বহুতল আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক ভবন। ট্যাক্সি থেকে যেখানে নেমেছি – সামনেই ওল্ড টাউন ক্যাফে। শনিবারের বিকেলে যেখানে শহুরে ক্যাফে জমজমাট থাকার কথা, সেখানে এই ক্যাফের দরজা-জানালা বন্ধ। সাময়িক বন্ধ, না চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে বোঝার উপায় নেই। আশেপাশের ঘরবাড়িগুলিরও দৈন্যদশা, দেখেই মনে হচ্ছে মন খারাপ করে কোনরকমে ইনিচ্ছাসত্ত্বেও দাঁড়িয়ে আছে লেকের দিকে মুখ করে।

মাঝ-লেকের পানি আকাশের প্রতিচ্ছবিতে টলটলে নীল দেখালেও পাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি – লেকের পানি প্রচন্ড ময়লা। এই লেকের গভীরতা শুরু থেকেই কম ছিল। শুরুটা তো আজকের নয়। কম করে হলেও এই হ্রদের বয়স পাঁচ শ বছর হয়েছে। পর্তুগিজরা তখনকার রাজাদের হাত থেকে নিজেদের দুর্গ রক্ষা করার জন্য দুর্গের চারপাশে যে পরিখা খনন করেছিল – সেটাই এই হ্রদ। পর্তুগিজ ইঞ্জিনিয়ার বেইরার নামে এই হ্রদ পরিচিত হয়ে ওঠে – বেইরা লেইক নামে। এই হ্রদের চারপাশে গত পাঁচ শ বছর ধরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। কয়েকটি ছোট ছোট খাল এই হ্রদকে যুক্ত করেছে সাগরের সাথে। একসময় কলম্বো বন্দর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হতো এই হ্রদের ভেতর দিয়ে নৌকা করে শহরের বিভিন্ন জায়গায়।

হ্রদের এপারের বাঁধানো রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রচন্ড ময়লা, পাখিদের মলে সাদা হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারোরই নজর নেই এদিকে। পর্যটকদের কেউ আসেও না এখানে। আমি এদিকে এসেছি বিশেষ এক কারণে। সাত-আট বছর আগে আমার এক শ্রীলংকান ছাত্রীর কাছে শুনেছিলাম এই হ্রদের পাড়ের ওল্ড টাউনের কথা। এখানের কোন এক বাড়িতে তারা থাকতো ছোটবেলায়।  দুই জমজ বোনের পর আরো একটা ছোট্ট বোন ছিল তাদের। একদিন তাদের বাবা সেই ছোট্ট এক বছরের মেয়েটিকে বস্তায় ভরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল এই হ্রদে। তাদের মা যখন টের পায় – ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারপর তাদের ব্যক্তিগত কাহিনি অনেক দুঃখের। তাদের মা তাদের দুইবোনকে নিয়ে বাবাকে ছেড়ে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল ইন্ডিয়াতে। সেখান থেকে মেলবোর্নে। কলম্বোতে আসার পর সেই কাহিনি আবার মনে পড়লো। তাই দেখতে আসা। গত পাঁচ শ বছর ধরে এরকম কত শত ঘটনার নিরব সাক্ষী এই হ্রদ।


বেইরা হ্রদের মন্দির

গাছে গাছে অসংখ্য পাখি। ওপারে লোটাস টাওয়ার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়া পড়েছে হ্রদের পানিতে। বেশ বড় একটি বৌদ্ধমন্দির গড়ে তোলা হয়েছে হ্রদের পানির উপরেই। সারি সারি সোনালী বৌদ্ধমূর্তি সূর্যের আলোয় দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এদিকে কোনো কোলাহল নেই। ছোট ছোট রাস্তা -গাড়িশূন্য। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিলো।

এখান থেকে আমার হোটেল বেশ কাছে। হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছে মনে পড়লো বইয়ের দোকানের কথা। হোটেলের পেছন দিকের রাস্তায় একটি বইয়ের দোকান দেখেছিলাম সকালে বের হবার সময়। তখন বন্ধ ছিল ওটা। দশটা থেকে খোলার কথা। হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে আবার গেলাম বইয়ের দোকানে। খোলা আছে।


বিজিতা ইয়াপা বুকশপের প্রবেশপথ

দেয়ালে লাগানো খুবই সাদামাটা একটি সাইনবোর্ড – বিজিতা ইয়াপা বুকশপ। অন্ধকার একটি একতলা বাড়ির ভেতর মোটামুটি আকারের একটি বইয়ের দোকান। কিন্তু এরা শ্রীলংকার একটি প্রথম সারির প্রকাশক। শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন শহরে এদের শাখা আছে। ভেতরে ইংরেজি বইয়ের বেশ ভালো সংগ্রহ আছে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ। এদের প্রকাশিত বই আলাদা তাকে রাখা আছে। আমি খুঁজছিলাম শ্রীলংকান লেখকদের ইংরেজি বই। শ্রীলংকান সাহিত্য আমি মোটেও পড়িনি। আগ্রহ আছে পড়ে দেখার। শ্রীলংকান লেখকদের লেখা বেশ কিছু উপন্যাস আর থ্রিলার কিনলাম। এদের বেশিরভাগ বই পেপারব্যাক, হার্ডবাইন্ডিং খুব একটা নেই। খরচ কমানোর জন্য হতে পারে এই ব্যবস্থা। তবে এদের বইয়ের দাম তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। প্রকাশকরা বলে থাকেন – বই বেশি বিক্রি হলে বইয়ের দাম কম রাখা যায়। কিন্তু এখানেও যে বই প্রচুর বিক্রি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এত বড় দোকানে আমি ছাড়া আর মাত্র দুজন লোক বই ঘাটাঘাটি করছে। দুজন বিক্রেতা আর একজন দারোয়ান ছাড়া আর কাউকেই তো দেখলাম না ঘন্টাখানেকের মধ্যে।


বিজিতা ইয়াপা বুকশপের ভেতরে

হোটেলে এসে অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নেওয়ার পর সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কিন্তু ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। হোটেলের নয় তলায় একটি রেস্টুরেন্ট আছে। এক্সপিডিয়ার কল্যাণে এই রেস্টুরেন্টে আমাকে শতকরা বিশ ভাগ মুল্যহ্রাসের একটি কুপন দেয়া হয়েছে। কিন্তু খাবার পছন্দ না হলে মূল্যহ্রাস দিয়ে আমি করবো কী! হোটেলের ডিজিটাল প্রযুক্তি বেশ ভালো। রুমের স্মার্ট টিভিতে রেস্টুরেন্টের মেন্যু দেখা যায়। সবকিছু বিদেশী আইটেম। শ্রীলংকান রাইস অ্যান্ড কারি – ভাত-তরকারি এই হোটেলে নেই। বাইরেই যেতে হবে আবার।

দিনের আলো কমতে শুরু করেছে। আনন্দ কুমারাস্বামী গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে লিবার্টি প্লাজায় এলাম। দিনের চেয়েও বেশি ব্যস্ততা এখন এখানে। লিবার্টি প্লাজা শপিং মলের সামনের রাস্তায় সিনেমাহলের সামনে বেশ ভীড়। ইংরেজি সিনেমার বেশ কদর এখানে। শাহরুখ খানের ‘ডাংকি’ সিনেমার পোস্টারও দেখা যাচ্ছে। এখনকার সব আধুনিক শপিং মলেই ফুডকোর্ট থাকে। লিবার্টি প্লাজার বেইজমেন্টেও বেশ বড় ফুডকোর্ট। অনেকগুলি দোকান। শ্রীলংকান খাবার খুঁজছিলাম। পেয়ে গেলাম একসাথে অনেকগুলি খাবারের দোকান। শ্রীলংকান খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এক প্লেট ভাত, চার ধরনের সব্জি, এক টুকরো মাছ, আর কোমল পানীয় – সব মিলিয়ে মাত্র পাঁচশ রুপি। এই চরম মুদ্রাস্ফীতির কালেও এত কম দামে খাবার বিক্রি করতে পারে কীভাবে? সরকার কি কোন ভর্তুকি দিচ্ছে? জানি না।


শ্রীলংকার ঐতিহ্য ভাত-তরকারি

আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল – করতে গিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম সমুদ্রের দিকে। রাস্তায় রাস্তায় আলোকসজ্জা। আমেরিকান দূতাবাসসহ শহরের বেশিরভাগ ভবন আলোয় ঝলমল করছে। ক্রিস্টমাস এখানে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে মনে হচ্ছে। গার্লে ফেইস গ্রিন এখন লোকে লোকারণ্য। অসংখ্য নারীপুরুষ নেমে পড়েছে সাগর পাড়ের এক চিলতে সৈকতে। হাঁটু পানিতে নেমেই কী আনন্দ তাদের। রাস্তায় উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে নৃত্য করছে একদল তরুণ-তরুণী। সবার একই রকম টী-শার্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন কোম্পানি স্পন্সর করেছে তাদের প্রোগ্রাম। প্রেসিডেন্ট অফিসের পাশ দিয়ে লোটাস রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তাভর্তি গাড়ি। মনে হচ্ছে ট্রাফিকজ্যামে আটকে পড়েছে এদিকের পুরোটা শহর। এদিকে রাস্তার পাশেই হিলটন হোটেল। আরেকটু সামনে এগিয়ে সেক্রেটারিয়েট রেলওয়ে স্টেশনের কাছে আরেকটি বৌদ্ধমন্দির। বিশালাকৃতির বুদ্ধমূর্তি রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে। 

হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে। ফুটপাতে প্রচুর মানুষ। ম্যাক্‌ক্যালাম রোড ধরে কিছুদূর গিয়েই এক্সিবিশন সেন্টার। বাণিজ্যমেলা হচ্ছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই প্রচন্ড ভীড় সেখানে। বাণিজ্য আমাকে টানে না। এসব মেলার ভেতর আমি পারতপক্ষে ঢুকি না। কিন্তু মাইকে যে শ্রীলংকান গান বাজছে তা খুবই শ্রুতিমধুর। সংগীতের এই এক অদ্ভুত ক্ষমতা। সুর যদি মন ভরায়, ভাষা না বুঝলেও কিছু যায় আসে না।

একটু সামনে গিয়েই ক্যাসিনো। এখানে বড়লোকদের ভীড়। রাস্তার ফুটপাত দখল হয়ে গেছে দামী দামী গাড়িতে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম নতুন নতুন গাড়ি করে আসা লোভী নারী-পুরুষদের যারা সাড়ম্বরে জুয়া খেলতে আসছে।

ফোর্ট রেলওয়ে স্টেশন এদিকে কোথাও হবে জানি। কিন্তু মনে হচ্ছে কোন একটা ভুল টার্ন নিয়ে অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। স্টেশন খুঁজে বের করা দরকার। ক্যাসিনোর এক গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম ট্রেন স্টেশন কোথায়। গার্ডটি সম্ভবত ইংরেজি বোঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না। ইশারা ইংগিতে যেটুকু দেখালেন তাতে বুঝলাম যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে ফিরে যেতে হবে কিছুদূর। তারপর রাস্তা পার হয়ে ডান দিকে চলে যেতে হবে।

মিনিট দশেক হাঁটার পর স্টেশনের আলো দেখতে পেলাম। যেদিক দিয়ে এসেছি সেটা ফোর্ট স্টেশনের পেছনের দিক। ছোট্ট একটা পথ দিয়ে ওভারব্রিজে ওঠার রাস্তা। ওভারব্রিজে উঠেই দেখতে পেলাম পাশাপাশি অনেকগুলি রেললাইন। প্লাটফরমের পর প্লাটফরম। ব্রিজ পার হয়ে নামলাম স্টেশনের সামনে।

এই সেই কলম্বোর বিখ্যাত ফোর্ট রেলওয়ে স্টেশন। ব্রিটিশদের হাতে তৈরি এই ট্রেন স্টেশন এখনো একইভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সাদা রঙের খুবই পুরনো বিল্ডিং। সারি সারি টিকেট কাউন্টার। আগামীকাল ক্যান্ডি যাবো, খোঁজ নেয়া যাক যদি কোন রিজার্ভ টিকেট পাওয়া যায়। সতের নম্বর কাউন্টার হলো রিজার্ভেশন কাউন্টার। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার পর দেখলাম বিভিন্ন গন্তব্যের অনেকগুলি কাউন্টার সেখানে। ক্যান্ডির কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ভেতরে সাদা প্যান্টশার্ট পরা রেলকর্মী জানালেন – কোনো রিজার্ভ টিকেট নেই। কাল সকালে ট্রেন ছাড়ার ঘন্টাখানেক আগে এসে টিকেট কাটলে হবে।

“ক্যান্ডির ট্রেন কখন ছাড়বে?”

“ফার্স্ট ট্রেন ছয়টা পঞ্চাশ, এরপর আটটা, দশটা …”

মনে হচ্ছে ক্যান্ডির ট্রেন অনেকগুলি আছে। দেখা যাক সকালে কী হয়।

রিজার্ভেশন রুম থেকে বের হবার সময় একজন মাঝবয়সী লোক ফিসফিস করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “ক্যান্ডি যাবার জন্য রিজার্ভ টিকেট আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।“

“কীভাবে?”

“আমার কাছে টিকেট আছে। আপনি আমেরিকান তো? মাত্র বিশ ডলার।“

লোকটি আমাকে আমেরিকান কী কারণে ভাবলেন জানি না। বললাম, “না ভাই, আমার দরকার নেই।“

আমি দ্রুত হেঁটে তাকে কাটানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনিও বেশ দ্রুতই হাঁটতে শুরু করলেন আমার পাশাপাশি। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন্‌ হোটেলে উঠেছেন?”

আমি কোন উত্তর না দিয়ে হাঁটার গতি আরেকটু বাড়ালাম। কাজ হলো না। সে প্রায় গা ঘেঁষে জিজ্ঞেস করল, “মেয়ে লাগবে? বিউটিফুল শ্রীলংকান গার্লস?”

এরকম নোংরা দালালি এখানেও আছে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার দিকে কীভাবে তাকিয়ে ছিলাম জানি না, সে অন্যদিকে চলে গেল। আমি ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো একটি মিটার-ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম।


Friday 1 March 2024

কিউবিটের কেরামতি

 


“01110111 01100101 01101100 01100011 01101111 01101101 01100101 00100000 01110100 01101111 00100000 01110001 01110101 01100001 01101110 01110100 01110101 01101101 00100000 01100011 01101111 01101101 01110000 01110101 01110100 01101001 01101110 01100111”

প্রিয় পাঠক, উপরের লাইনটি দেখে আপনি বুঝতে পারছেন শুধুমাত্র 0 এবং 1 ব্যবহার করে ডিজিটাল সংকেতে কোনোকিছু লেখা হয়েছে। ডিজিটাল জগতের সাথে সামান্য একটু পরিচয় থাকলেই আপনি পড়তে পারছেন লাইনটি – যেখানে লেখা আছে, “Welcome to quantum computing”। বুঝতেই পারছেন, আজ এই লেখায় আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু সেই আলোচনায় আসার আগে আমাদের পরিচিত পদ্ধতিতে কম্পিউটিং-এর মূল ব্যাপারগুলি একটু দেখে নেয়া যাক, তাতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর ধরন বুঝতে সুবিধা হবে।

“Welcome to quantum computing”-এ যে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করেছি সেটাও যদি ডিজিটালি লিখতে যাই - তাহলে 00100010 লিখতে হবে। আপনি যে কম্পিউটার বা ট্যাব বা স্মার্টফোন ব্যবহার করে কোনকিছু লেখেন বা ক্যালকুলেটরে হিসেব করেন – তার সবকিছুই হয় ডিজিটাল সংকেতের মাধ্যমে। আমাদের প্রচলিত ডিজিটাল সংকেতের সবকিছুই হলো 0 এবং 1 এর সমন্বয়। কম্পিউটারের আদিযুগ থেকে শুরু করে বর্তমানের সুপারকম্পিউটারের যুগেও ডিজিটাল সংকেতের কোন পরিবর্তন হয়নি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্যপ্রবাহের জন্য ASCII (American Standard Code for Information Interchange) কোডের পাশাপাশি ইউনিকোডসহ আরো অনেক কোড তৈরি হয়েছে ঠিকই – কিন্তু সবকিছুরই মূলে আছে সেই শূন্য এবং এক। ডিজিটাল প্রযুক্তির মূল কাজ করে যে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স- সেই ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সেরও মূল চাবিকাঠি হলো এই দুইটি অংক – 0 এবং 1। ইলেকট্রনিক সুইচ বন্ধ থাকার সংকেত যদি 0 হয়, সুইচ চালু থাকার সংকেত হবে 1; ‘হ্যাঁ’ যদি 1 হয়, তবে ‘না’ হবে 0; উত্তর দিক যদি 1 হয়, 0 হবে দক্ষিণ দিক ইত্যাদি।

কম্পিউটারের আদিযুগে (১৯৫০ – ১৯৭০) খুব কম শক্তির একটি কম্পিউটার রাখার জন্য যেখানে বিশাল আকৃতির গুদামের দরকার হতো, সেখানে এখন মানুষের হাতের মুঠোয় ঘুরে বেড়াচ্ছে তার চেয়ে  কয়েক লক্ষ গুণ শক্তিশালী কম্পিউটার। কম্পিউটারের  আকার এবং আকৃতি দিনে দিনে ছোট হচ্ছে, আর শক্তি ও কর্মক্ষমতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে মূলত ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের ক্রমাগত বিবর্তনের ফলে। শূন্য এবং এক -এর কেরামতিতে যে কম্পিউটিং প্রযুক্তির সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে এবং ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে আমরা তার নাম দিয়েছি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং। অবশ্য এই নামটি দেয়ার দরকার হয়েছে তখন – যখন অন্য আরেক ধরনের কম্পিউটিং (কোয়ান্টাম কম্পিউটিং)-এর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফিজিক্সের জগতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্মের পর যেমন নিউটনের সূত্র মেনে চলা কাজকর্মকে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স নাম দিতে হয়েছে, তেমনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধর্মকে কাজে লাগিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর সম্ভাবনার অঙ্কুরোদ্গম হবার পর প্রচলিত কম্পিউটিং নাম দিতে হয়েছে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং।

ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং এর মূল উপাদানের নাম বিট – যা এসেছে বাইনারি ডিজিট থেকে। বাইনারি ডিজিটের ভিত্তি হলো দুই – 0 এবং 1। প্রচলিত দশ ভিত্তিক সংখ্যা যেমন 10n পদ্ধতিতে চলে যেখানে n = 0, 1, 2, 3, 4…, (100 = 1, 102 = 100, 103 = 1000, 104 = 10000 ইত্যাদি), তেমনি বাইনারি ডিজিটের রূপ হলো 2n (20 = 1, 21 = 2, 22 = 4, 23 = 8, 24 = 16 ইত্যাদি)। যদি বলা হয় এক বিট তথ্য – তখন সর্বোচ্চ 0 এবং 1 এই দুইটি ইনপুট হতে পারে। দুই বিট হলে 00, 01, 10, 11 এই চারটি ইনপুট হতে পারে। তিন বিট হলে 000, 001, 010, 011, 100, 101, 110, 111 এই আটটি ইনপুট হতে পারে। এভাবে বিট সংখ্যা যত বাড়বে তত বেশি ইনপুট হবে। দশ বিট হলে 1024, ষোল বিট হলে 65536 ইনপুট। বর্তমানে ৬৪ বিট অপারেটিং সিস্টেমের পার্সোনাল কম্পিউটার এক সাথে 18446744073709551616 (কত কোটি কোটি হিসেব করে দেখুন) ইনপুট নিয়ে কাজ করতে পারে। ইনপুট থেকে প্রাপ্ত ডিজিটাল আউটপুট জমা রাখা হয় কম্পিউটারের ইন্টারনাল হার্ড-ড্রাইভ কিংবা এক্সটার্নাল ড্রাইভে।  জমা রাখার জন্য যে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করা হয় – তারও পরিমাপ করা হয় বিট এবং বাইটের এককে। আট বিটে এক বাইট হয়। 1024 বাইটে এক কিলোবাইট। 1024 কিলোবাইটে এক মেগাবাইট, 1024 মেগাবাইটে এক গিগাবাইট, 1024 গিগাবাইটে এক টেরাবাইট ইত্যাদি। ইলেকট্রনিক চিপ্‌সের আকার ছোট হতে হতে বর্তমানে এমন পর্যায়ে এসেছে যে এক বর্গ সেন্টিমিটার আকারের একটি ইলেকট্রনিক চিপ্‌সেই এখন শত শত গিগাবাইট তথ্য জমা রাখা যায়।

ট্রানজিস্টর উদ্ভাবিত হবার আগে বড় বড় ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হতো কম্পিউটারের প্রতিটি ইনপুট দেয়ার জন্য এবং সেগুলির ক্রিয়াকলাপ ঘটানোর জন্য। ছোট ছোট ট্রানজিস্টর যখন ভ্যাকুয়াম টিউবের জায়গা নিলো, কম্পিউটারের আকার ছোট হতে শুরু করলো। এখন ট্রানজিস্টরের কর্মক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি আকার এত ছোট হয়ে গেছে যে এখনকার ল্যাপটপ কম্পিউটারে ব্যবহৃত আমাদের হাতের আঙুলের নখের আকারের একটি মাইক্রোচিপ্‌স-এ পাঁচ কোটি ট্রানজিস্টরের জায়গা হয়। ট্রানজিস্টরের আকার আরো ছোট করার গবেষণা চলছে। কিন্তু এই ছোট হবার কি কোন সীমারেখা আছে? এই প্রশ্নের উত্তরেই আছে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের সীমাবদ্ধতার কথা।  

কীভাবে? বস্তুর পরমাণুর ব্যাসার্ধ আনুমানিক 10-10 মিটার বা এক ন্যানোমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ। সিলিকন ট্রানজিস্টরের আকার পাঁচ ন্যানোমিটারে এসে থেমেছে। এর চেয়ে ছোট হলে সিলিকন ট্রানজিস্টর আর ঠিকভাবে কাজ করে না। কারণ তখন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের নিশ্চয়তার বদলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তা এসে যায়। বিজ্ঞানীরা অবশ্য কার্বন ন্যানোটিউব আর মলিবডিনাম ডাই-সালফাইডের সমন্বয়ে এক ন্যানোমিটার আকারের ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করেছেন যা ঠিকভাবে কাজ করছে। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদ্ভাবনের জন্য ট্রানজিস্টরের আকার দায়ী নয়। ট্রানজিস্টরের আকার যেটাই হোক – ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের  সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের মূলনীতি কোয়ান্টাম ফিজিক্স নির্ভর, ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স নয়।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং আর  ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং – ধরতে গেলে সম্পূর্ণ আলাদা। অনেকেই এই পার্থক্যকে মোমবাতি আর ইলেকট্রিক লাইটবাল্বের সাথে তুলনা করেছেন। মোমবাতি আর লাইটবাল্ব দুটোই আলো দেয়, তবে তাদের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যদি মোমবাতি হয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটার হাজার ওয়াটের লাইটবাল্ব। অর্থাৎ ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যেসব কাজ করতে পারে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই কাজ করতে পারবে আরো অনেক অনেক গুণ বেশি দক্ষতায়। কিন্তু এক হাজার মোমবাতিকে একসাথে করলেও যেমন সেটা লাইটবাল্ব হয়ে উঠবে না , তেমনি  ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের কর্মক্ষমতা বাড়াতে বাড়াতে লক্ষ লক্ষ গুণ বাড়ালেও তা কিছুতেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়ে যাবে না।

চলুন এবার দেখা যাক – কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কীভাবে কাজ করে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হার্ডওয়ার আইবিএম, গুগল ইত্যাদি বড় বড় কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকলেও সর্বজনগ্রাহ্য রূপ পেতে আরো কত বছর অপেক্ষা করতে হবে আমরা এখনো জানি না। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মূলনীতি অর্থাৎ কীভাবে এই কম্পিউটারের মূল মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে সেব্যাপারে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূলনীতিই হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর মূলনীতি।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার কী তা এক লাইনে বলা যায় এভাবে – কোয়ান্টাম কম্পিউটার হলো কোয়ান্টাম ফিজিক্স ও কম্পিউটার সায়েন্সের সমন্বিত রূপ। কম্পিউটার সায়েন্সের কাজ হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তাত্ত্বিক ধর্মকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহারিক রূপ দেয়া।

১৯০০ সালে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যাত্রা শুরু হলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধজুড়ে তাকে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের বুঝতে শিখিয়েছে পদার্থের পারমাণবিক ধর্ম। সেমিকন্ডাক্টরের বিপ্লব ঘটতে অনুঘটকের কাজ করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। ১৯৪৭ সালে সেমিকন্ডাক্টর ট্রানজিস্টর উদ্ভাবিত হবার পর কম্পিউটারের জগত পুরোপুরি বদলে গেলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধর্ম সরাসরি প্রয়োগ করে কম্পিউটিং-এর ধারণা তখনো কারো মনে আসেনি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর প্রাথমিক ধারণা দেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৮২ সালে। তিনি দেখান যে কোয়ান্টাম স্টেটের সুপারপজিশনকে কম্পিউটারের ইনফরমেশান ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করলে অনেকগুলি ইনপুট এক সাথে দেয়া যায়। ফলে কম্পিউটিং-এর কর্মদক্ষতা অনেক অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে। তবে তার জন্য দরকার হবে নতুন ধরনের অ্যালগরিদম। তার তিন বছরের মধ্যেই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর ধারণা বিস্তৃত হতে শুরু করে। রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর ধারণার বাস্তব রূপ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ক্যান্সারে মারা যান।

১৯৮৫ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানী ডেভিড ডিউশ (David Deutsch) বাস্তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কীভাবে কাজ করতে পারে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তারপর কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর গবেষণা দ্রুত বাড়তে থাকে।

ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং-এর মতোই কোয়ান্টাম কম্পিউটিংও বাইনারি ডিজিট 0 এবং 1  ব্যবহার করে, তবে ভিন্নভাবে। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে 1 এবং 0 র স্টেট বা দশা সুনির্দিষ্ট; বিদ্যুৎপ্রবাহ আছে (1) অথবা নেই (0)। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ কোয়ান্টাম কণার (ইলেকট্রন কিংবা ফোটন) কোয়ান্টাম স্টেট ব্যবহার করা হয় – যাতে কোয়ান্টাম সুপারপজিশানের মাধ্যমে একটি কণা একই সাথে একাধিক স্টেটে থাকার সম্ভাবনার কারণে একাধিক মান নির্দেশ করতে পারে। সেজন্য ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের মূল চাবিকাঠি ‘বিট’ এর অনুকরণে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর মূল চাবিকাঠির নাম কোয়ান্টাম বিট বা সংক্ষেপে কিউবিট। বলা চলে কিউবিটের কেরামতিই হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটিং।

 

চিত্র-১ কিউবিটের কোয়ান্টাম স্টেট


চিত্র-১ থেকে কিউবিটের কোয়ান্টাম স্টেটের সুপারপজিশনের একটি ধারণা পাওয়া যায়। ধরা যাক ক্লাসিক্যাল বিট 0 হলো পৃথিবীর উত্তর মেরু, সেক্ষেত্রে 1 হবে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু। কিন্তু কোয়ান্টাম কণার সুপারপজিশানের কারণে কিউবিটের দশা বা স্টেট পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর যে কোনো জায়গায় হতে পারে। সেক্ষেত্রে কিউবিটকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ডিরাক নোটেশানের মাধ্যমে লেখা যায়: |Q> =  α|0> + β|1>

যেখানে α এবং β হলো জটিল রাশি, যেগুলি দিয়ে 0  এবং 1 এর আনুপাতিক হিসেব করে কিউবিটের সঠিক দশা নির্ণয় করা যায়। নিচের দুটো চিত্র (২ ও ৩) থেকে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা সম্ভব।

 

চিত্র-২ কোয়ান্টাম দশা 0 এবং 1 এর সুপারপজিশনের ফলে কিউবিটের অবস্থান হতে পারে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর ঠিক মাঝামাঝি বিষুবরেখা বরাবর পূর্বদিকে।

চিত্র-৩: কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি অনুসারে ইলেকট্রন তরঙ্গধর্ম প্রদর্শন করে একই সাথে একাধিক অবস্থানে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সেদিকের কোয়ান্টাম দশার সম্ভাবনা হবে ৫০% উত্তরমেরুর দিকে, ৫০% দক্ষিণমেরুর  দিকে।


কোয়ান্টাম সুপারপজিশানের ব্যাপারটিকে আরো সহজভাবে বোঝার জন্য যদি শুধু এটুকুই আমরা ধরে নিই যে একটি ইলেকট্রন বা ফোটন একই সাথে দুইটি অবস্থানে থাকতে পারে, (কিংবা ইলেকট্রনের স্পিন আপ ও স্পিন ডাউন), সেক্ষেত্রে ক্লাসিক্যাল বিটের যেখানে 0 এবং 1 এই দুটো বিট লাগে, সেখানে একটি কিউবিট দিয়েই তা হয়ে যায়। এখন ২টি কিউবিট ব্যবহার করে আমরা পেতে পারি 00, 01, 10, 11 এই চারটি দশা। আরেকটি কিউবিট বাড়ালে আমরা পাবো 000, 001, 010, 011, 100, 101, 110, 111  এই আটটি দশা। এভাবে একটি করে কিউবিট যোগ করলেই দ্বিগুণ দশা পাওয়া যাচ্ছে। আট কিউবিট বা এক কিউবাইটে পাওয়া যাবে ২৫৬টি দশা। অর্থাৎ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ আটটি ইনপুট দিয়ে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের ২৫৬টি ইনপুটের সমান কাজ করানো সম্ভব। বর্তমানের সুপারকম্পিউটারগুলিও যে হিসেব করতে দিনের পর দিন সময় নেয় (যেমন জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াগুলির সঠিকভাবে যান্ত্রিক বিশ্লেষণ ইত্যাদি), সেই কাজগুলি কয়েক সেকেন্ডেই সম্পন্ন করা সম্ভব হবে ৫০ কিউবিটের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে।

এ তো  গেলো সুপারপজিশনের কথা। কিউবিট যে শুধু সুপারপজিশনেই থেমে থাকে তা নয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দ্বিতীয় যে ধর্মটি এরা কাজে লাগাতে পারে – সেটা হলো কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টামের জটাজাল। কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট ব্যাপারটি খুবই অদ্ভুত। কোয়ান্টাম কণাগুলি এমন ব্যবহার করে যেন একটি কোয়ান্টাম কণা অন্য আরেকটি কণার সাথে অদৃশ্যভাবে যুগলবন্দী হয়ে থাকে – সেটা যত দূরেই থাকুক না কেন। ধরা যাক হাইড্রোজেন পরমাণুর কথা। এর একটিমাত্র ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রনের অন্তঃঘূর্ণন বা স্পিন হতে পারে +১/২ কিংবা -১/২। দেখার আগ পর্যন্ত কিছুতেই সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় যে কোন একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রনের স্পিন +১/২ হবে কি -১/২ হবে। হাইড্রোজেন পরমাণুর বদলে যদি হিলিয়াম পরমাণুর কথা বিবেচনা করি – দেখা যাবে ব্যাপারটা আরো রহস্যময়। হিলিয়াম পরমাণুতে দুটো ইলেকট্রন আছে। তারা একই কক্ষপথে থাকে। পাউলির বর্জননীতি মেনে চলতে হয় তাদের। সেই নীতি অনুযায়ী একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি +১/২ হয়, অন্য ইলেকট্রনের স্পিন অবশ্যই -১/২ হবে। কোন ইলেকট্রনের স্পিন কী হবে তা না দেখে সুনির্দিষ্টভাবে বলার উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে একটি ইলেকট্রনের স্পিন যদি জানতে পারি, অন্যটির স্পিন কী হবে তা না দেখেই বলে দেয়া যায়। কিন্তু একটাও না দেখা পর্যন্ত কোনটারই স্পিন কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে ফলাফল নির্ভর করছে দর্শকের উপর? কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে - ঠিক তাই । যতক্ষণ দেখা না হচ্ছে – ততক্ষণ সম্ভাবনার সুপারপজিশান স্টেটেই থাকছে ইলেকট্রনের স্পিন।

আইনস্টাইন এরকম অনিশ্চয়তা মেনে নিতে না পেরে এর নাম দিয়েছিলেন ভূতুড়ে ঘটনা। তিনি কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর দুই সহকর্মী বরিস পডোলস্কি ও নাথান রোজেনের সাথে যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩৫ সালে। এই গবেষণাপত্র ইপিআর পেপার নামে পরিচিত। এর সপক্ষে ১৯৬৪ সালে আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট বেল একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন যেটা বেল্‌স ইনইকুইলিটি বা বেলের অসমতার পেপার হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিল। তিনি আহ্বান করেছিলেন কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টের পক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণ থাকলে তা হাজির করার জন্য। বেলের অসমতা পরীক্ষাগারে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য ২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন আলান এস্পেক্ট, জন ক্লাউজার এবং আন্তন সাইলিঙ্গার। [বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন কোয়ান্টামের জটাজাল

একটি কিউবিটকে যদি অন্য একটি কিউবিটের সাথে এন্টেঙ্গেল করানো যায়, তবে একটি কিউবিটের ইনপুট দিয়েই অপর কিউবিটেরও আউটপুট পাওয়া যাবে। নিচের  চিত্র (চিত্র-৪) থেকে ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব।

 

চিত্র ৪: কিউবিট A যদি কিউবিট B এর সাথে এন্টেঙ্গেলমেন্টে থাকে, তবে Aর ইনপুট যদি 00 হয়, Bর ইনপুট যে 11 হবে তা  না দেখেই বলে দেয়া যায় । সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র A কিউবিট ইনপুট থেকে পাওয়া যাবে চারটি আউটপুট।


এভাবে শুধু দুটো কিউবিট নয়, অনেকগুলি কিউবিটকে জটাজালে আবদ্ধ করে কোয়ান্টাম লজিক গেটে পাঠানো যায়। এখানে ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং-এ ব্যবহৃত লজিক গেট সম্পর্কে একটু উল্লেখ করা যাক। কম্পিউটারের ইনপুটগুলিকে পাঠানো হয় প্রয়োজনীয় লজিক গেটের ভেতর দিয়ে। যেমন AND গেটের ভেতর দিয়ে যদি দুটো ইনপুট 0 এবং 1 পাঠানো হয়, তখন 0 AND 0 = 0, 0 AND 1 = 0, 1 AND 0 = 0, 1 AND 1 = 1 পাই। যখন OR গেটের ভেতর দিয়ে পাঠানো হয় তখন 0 OR 0 = 0, 0 OR 1 = 1, 1 OR 0 = 1, 1 OR 1 = 1 পাওয়া যায়। আবার NOT  গেটের ভেতর দিয়ে পাঠানো ইনপুট উল্টে যায়। যেমন  0 NOT = 1, 1 NOT = 0 ইত্যাদি।

কোয়ান্টাম লজিক গেটও অনেকটাই ক্লাসিক্যাল লজিগ গেটের মতো, তবে অনেক বেশি জটিল। কারণ কিউবিটের ইনপুটগুলি নির্ভর করে কোয়ান্টাম প্রোবেবিলিটি বা সম্ভাবনার উপর। তাই কোয়ান্টাম লজিক গেটগুলি সময় নির্ভর। সবচেয়ে বেশি পরিচিত কোয়ান্টাম গেট হলো হাডামার্ড গেট বা H গেট। ফরাসী গণিতবিদ জাঁক হাডামার্ডের নামে এই কোয়ান্টাম গেট। এই H গেট কিউবিট ইনপুটকে সুপারপজিশন ইনপুটে পরিবর্তন করে দেয়। অর্থাৎ কিউবিট 0 এবং 1 কে H কোয়ান্টাম গেটের ভেতর দিয়ে পাঠালে তা 0 এবং 1 এর সুপারপজিশন স্টেট তৈরি করে দেবে। (চিত্র-৫)

 

চিত্র-৫: হাডামার্ড গেট কিউবিট (0 এবং 1) কে সুপারপজিশন কিউবিট (+ এবং -) এ রূপান্তর করে দেয়।


আরেকটি দরকারি এবং বহুল ব্যবহৃত কোয়ান্টাম গেট হলো Controlled NOT gate বা CNOT গেট। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং এর Exclusive OR (XOR) গেটের মতোই কাজ করে CNOT কোয়ান্টাম গেট। এটা কন্ট্রোলড কিউবিট ইনপুটের কোন পরিবর্তন ঘটায় না। কিন্তু এন্টেঙ্গেলড কিউবিটের মান উল্টে দেয়।

এরকম আরো অনেক কোয়ান্টাম গেট আছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক গেট তৈরি হবে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ কোন সমস্যার সমাধানের শুরুতে দরকারি কিউবিটগুলিকে নির্বাচন করার পর তাদেরকে সঠিক কোয়ান্টাম লজিক গেটের মাধ্যমে অন্য কিউবিটগুলির সাথে এন্টেঙ্গেল করানো হয়। তারপর একে অপরের সাথে জটাজালে আবদ্ধ সবগুলি কিউবিটের ইনপুট একই সাথে প্রসেস (কোয়ান্টাম কম্পিউটিং) করা হয়। প্রসেসিং শেষ হবার পর কিউবিটগুলিকে জটাজাল থেকে ছাড়িয়ে স্বাভাবিক বিটে ফিরিয়ে আনা হয়, তখন তাদের আউটপুট বাইনারি ডিজিটে (0,1) পাওয়া যায়। বাইনারি কোড থেকে ডিকোড করে সেই  ফলাফল কম্পিউটারে স্বাভাবিক আউটপুট ফাইল হিসেবে পাওয়া যায়।

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর তত্ত্ব বোঝা গেলেও কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে বাস্তবে রূপ দেয়া খুব একটা সহজ নয়। কারণ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর সফ্‌টওয়ার কিংবা এলগরিদম ক্লাসিক্যাল কম্পিউটিং-এর এলগরিদম থেকে ভিন্ন। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য সর্বপ্রথম কোয়ান্টাম এলগরিদম লিখেছিলেন বেল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী পিটার শোর ১৯৯৪ সালে। তার দুবছর পর ১৯৯৬ সালে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনাময় এলগরিদম তৈরি করেন ভারতীয় আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী লব কুমার গ্রোভার। পিটার শোর আর লব গ্রোভারের দেখানো পথে এখন কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহার করার উপযোগী অনেক এলগরিদম লেখা হচ্ছে, হার্ডওয়ার ও সফ্‌টওয়ার তৈরির কাজ চলছে। সে সম্পর্কে এই সংখ্যার অন্যান্য প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার দেখতে পাবো এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।

 

তথ্যসূত্র

১। জন গ্রিবিন, কম্পিউটিং উইথ কোয়ান্টাম ক্যাটস, প্রমিথিউস বুক্‌স, নিউ ইয়র্ক, ২০১৪।

২। জিম আল-খলিলি, কোয়ান্টাম এ গাইড ফর দ্য পারপ্লেক্সড, ওয়েইডেনফিল্ড অ্যান্ড নিকলসন, লন্ডন, ২০১২।

৩। ক্রিস বার্নহার্ডট, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ফর এভরিওয়ান, র‍্যান্ডম হাউজ, আমেরিকা, ২০২০।

৪। কিয়ারান হিউজেস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ফর দ্য কোয়ান্টাম কিউরিয়াস, স্প্রিঙ্গার, সুইজারল্যান্ড, ২০২১।

৫। বিয়াট্রিস ম্যারি ইলেরফ, ক্যালকুলেটিং উইথ কোয়ান্টা, স্প্রিঙ্গার, জার্মানি, ২০২২।

_____________________

বিজ্ঞানচিন্তা নভেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত










Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts