Showing posts with label আফ্রিকা. Show all posts
Showing posts with label আফ্রিকা. Show all posts

Wednesday, 2 September 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ১৮

 



ঘরে ফেরা

 সকাল ১১টায় রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কাউন্টারে হিসেবপত্তর মিটিয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম আমার ট্যাক্সি এসেছে কিনা। পাশের রুম থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো জেনি। সকালে সে-ই আমার জন্য ট্যাক্সি বুক করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার এই হাসিখুশী তরুণীর নাম Xenowien। ইংরেজি উচ্চারণে জেনোওয়েইন বা জেনোবিন হবার কথা কিন্তু সে বললো তার নামের উচ্চারণ ওরকম নয় তারপর নিজে যা উচ্চারণ করলো তা অনেকটা গলার ভেতর থেকে কফ পরিষ্কার করতে গেলে যেরকম শব্দ হয় সেরকম একটা শব্দ দিয়ে শুধু করতে হবে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম। মুখে থুথু উঠে এলো, কিন্তু সঠিক শব্দ উচ্চারিত হলো না। তখন সে বললো, ইউ ক্যান কল মি জেনি।

     ইওর কার ইজ রেডি স্যার

          লিকলিকে এক কিশোর বেলবয় এগিয়ে এলো আমার ব্যাগ নেয়ার জন্য। বাধা দিলাম না। এদেশে শ্রমের দাম এখনো অনেক কম। তাই অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাদের। কিছু টিপস তাদের আকাঙ্খিত পাওনা।

          হোটেলের নিজস্ব পরিবহন লুপের ঝকঝকে গাড়ি। এয়ারপোর্টে ড্রপ করার জন্য চার্জ নেবে ৩৫০ র‍্যান্ড।

          কালো স্যুট-টাই পরা ড্রাইভারকে ভি-আই-পি-দের নিরাপত্তারক্ষীর মতো লাগছে।

          বিদায় কেইপ টাউন। শহরটার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিছু কিছু শহর থেকে চলে আসার সময় কেমন যেন হালকা লাগে। মনে হয় একটা কাজ শেষ হলো, আর আসতে হবে না এখানে। আবার কিছু জায়গা আছে যেখান থেকে চলে আসার সময় মনে হয় - আবার আসতে হবে এখানে। কেইপ টাউন তেমনি একটা শহর।





 * * *

সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের চেকইন কাউন্টারগুলোর সামনে লম্বা লাইন। অনেকক্ষণ লাগলো কাউন্টারে পৌঁছাতে।

          যে কাউন্টারে গেলাম- একজন মাঝবয়সী রাগী রাগী চেহারার আফ্রিকান মহিলা। হাত বাড়িয়ে আমার পাসপোর্ট নেবার সময় খেয়াল করলাম তাঁর দুটো আঙুলে সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো।

     মেলবোর্ন?

     ইয়েস

          আনুষঙ্গিক রুটিন প্রশ্নমালা শেষে তিনটি বোর্ডিং পাস বুঝিয়ে দিলেন কেইপ টাউন টু জোহানেসবার্গ, জোহানেসবার্গ টু পার্থ, অ্যান্ড পার্থ টু মেলবোর্ন।

          পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম, আপনার আঙুলে কী হয়েছে?

          দেখলাম তাঁর গম্ভীর মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো। বললেন, রান্না করতে গিয়ে পুড়ে গেছে। মনে হলো হাত পুড়ে যাওয়াতে তাঁর কষ্টের চেয়ে আনন্দই বেশি। প্রিয় মানুষের জন্য কিছু করতে গিয়েই হয়তো তাঁর এই কষ্টের আনন্দ।

 

* * *

 

জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে প্রচন্ড ভিড়। সিকিউরিটি চেকিং-এর দীর্ঘলাইন পেরিয়ে আসতে ঘন্টাখানেক লাগলো। ইমিগ্রেশান অফিসাররা প্রচন্ড ব্যস্ত। তাদের সবাইকে অতিরিক্ত সতর্ক বলে মনে হচ্ছে।

          দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাবার পরেও, সারা পৃথিবীর শ্বেতাঙ্গ জগৎ কৃষ্ণাঙ্গদের এখনো প্রায়ই কৃতদাস বলেই মনে করে। বর্নিল পৃথিবী বড়ই বর্ণবাদী। তাই ইউরোপ আমেরিকায় এখনো কেষ্টা ব্যাটাই চোর ভাবার লোকের অভাব নেই। সেজন্য আফ্রিকার যে কোন এয়ারপোর্ট থেকে ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাওয়ার ফ্লাইটগুলোতে অতিরিক্ত রকমের সতর্কতা।

          আমার ফ্লাইট গেট A16. গেটে এসে দেখি সেখানে আরেকটা নিরাপত্তাবেষ্টনী। অন্য গেটের ওয়েটিং এরিয়ায় অপেক্ষা করছে সবাই

     আপনার কি কয়েক মিনিট সময় হবে?

          চোখ তুলে তাকালাম লিকলিকে সুপারি গাছের মতো লম্বা এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ, কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট ব্যাগ আর হাতে আই-প্যাড

     কী ব্যাপার?

     বসি?

     বসেন

বসলো পাশের চেয়ারে। গলায় ঝুলানো আইডি দেখিয়ে বললো, আমার নাম বেদেল। আমি দক্ষিণ আফ্রিকার পর্যটন কর্তৃপক্ষের হয়ে জরিপ করছি।

          দক্ষিণ আফ্রিকার পর্যটনশিল্পকে আরো উন্নত করার জন্য পর্যটকদের মতামতের গুরুত্ব অনেক। তাই বেদেলদের কাজ হলো বিভিন্ন প্রশ্ন করে জেনে নেয়া - কেমন লাগলো দক্ষিণ আফ্রিকা।

          প্রশ্নমালা শেষে ব্যাগ থেকে একটা স্যুভেনির বের করে গিফট করলো বেদেল। জানতে চাইলাম, এটাই আপনার ফুল টাইম জব?

     না, এটা পার্ট টাইম। আমি ফুল টাইম স্টুডেন্ট।

          বেদেল ইন্টারন্যশনাল স্টুডেন্ট। এসেছে কঙ্গো থেকে। খন্ডকালীন কাজ করে থাকাখাওয়ার পয়সা জোগাড় করে। এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করি বেদেলের সাথে। বিভিন্ন রকমের খন্ডকালীন কাজ করে একসময় আমাকেও জোগাড় করতে হয়েছে পড়াশোনার খরচ।

          আমি বাংলাদেশি শুনে বেদেল খুব প্রশংসা করলো বাংলাদেশিদের। জাতিসংঘের হয়ে অনেক বাংলাদেশি সৈনিক কঙ্গোতে কাজ করছেন সুনামের সাথে। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের সুনাম শুনতে কী যে ভালো লাগে, গর্বে বুক ফুলে যায়।

          আমাদের গেটের চেকিং শুরু হবার আগে পরের গেটের কার্যক্রম শুরু হলো। নিউইয়র্কের ফ্লাইট। মনে হচ্ছে যুদ্ধকালীন অবস্থা সেখানে। সবাই যার যার জুতো খুলে হাতে নিয়ে যাচ্ছেন এক একটা টেবিলের কাছে যেখানে ব্যাগ খুলে তন্ন তন্ন করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা আর কোন কিছু অর্জন না করতে পারলেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াতে পারছে সারা দুনিয়াজুড়ে।

          একটু পরে আমাদের প্লেনের চেকিং শুরু হলো। আমাদের অবশ্য জুতা খুলতে হলো না। আমার সিট প্লেনের পেছনের দিকে জানালার পাশে।

          যথাসময়ে প্লেন উড়লো আকাশে। দশ ঘন্টা পরেই অস্ট্রেলিয়া।

__________

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ১৭

 



পৃথিবীর প্রথম মানবহৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন

স্টুডেন্ট বা স্টাফদের জন্য ক্যাম্পাস-বাস আইডি দেখানোর নিয়ম আছে। কিন্তু আমরা তো বহিরাগত। এলিজাবেথকে বললাম, ড্রাইভারকে তুমিই জ্ঞিজ্ঞেস করবে আমরা যেতে পারবো কিনা।

     আমি কেন?

     আ বিউটিফুল ফেস ইজ দ্যা বেস্ট রেকমেন্ডেশান।

     কিন্তু সে যদি শ্বেতাঙ্গ পছন্দ না করে?

          "তুমি যদি শ্বেতাঙ্গ পুরুষ হতে তাহলে হয়তো এ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ নারী সবাই পছন্দ করে।

          মেডিকেল ক্যাম্পাসে যাবার যাত্রী বেশি ছিল না। 9C বাসের ড্রাইভার বেশ হাসিমুখেই কথা বললেন এলিজাবেথের সাথেমনে হলো ক্যাম্পাস বাসে সবাই চড়তে পারে

          আপার ক্যাম্পাসের চারপাশে ঘুরে হাইওয়েতে কিছুদূর এসে চারটা স্টপ পর গ্রুট ইশকির হাসপাতালের সামনে নামলাম পৌনে তিনটা বাজেহাসপাতালের দুটো উইংপুরনো ভবনটাকে এখন জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে।

          দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান হাসপাতালগুলোর একটি হলো গ্রুট ইশকির হাসপাতালডাচ শব্দ গ্রুট ইশকির (GROOTE SCHUUR) এর অর্থ হলো মহান খামারডাচরা এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিলো গ্রুট ইশকির

          ১৯৩৮ সালে এই হাসপাতাল স্থাপিত হয় কেইপ টাউন ইউনিভার্সিটির মেডিসিন ফ্যাকাল্টির টিচিং হাসপাতাল এটা এই হাসপাতাল পৃথিবীবিখ্যাত - কারণ এখানেই পৃথিবীর প্রথম মানুষের-হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে।

 

গ্রুট ইশকির হাসপাতাল


১৯৮৪ সালে হাসপাতাল ক্যাম্পাসের মধ্যে আরেকটি নতুন বিল্ডিং-এ নিয়ে যাওয়া হয়। পুরনো ভবনকে রেখে দেয়া হয় আগের মতোই। ২০০৭ সালে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে পুরনো হাসপাতাল ভবনের যেখানে অপারেশন হয়েছিল সেই রুমগুলোকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় হার্ট অব কেইপটাউন মিউজিয়াম। আমরা এখন সেখানে।

          বিকেল তিনটায় গাইডেড ট্যুর শুরু হলো। আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো ইতিহাসের নায়ক ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের সাথে।

          বেশ বড় অফিসঘর তাঁর। ১৯৬৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর যেভাবে ছিল সেভাবেই রাখা আছে। হুবহু মূর্তি বানিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাঁর চেয়ারে। মনে হচ্ছে এখুনি জ্ঞিজ্ঞেস করবেন, কী সমস্যা হচ্ছে আপনার?

          ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের জন্ম ১৯২২ সালের ৮ নভেম্বর, কেইপ টাউনেই লেখাপড়া করেছন এই ইউনিভার্সিটি অব কেইপ টাউনেই এখান থেকেই ডাক্তারি পাস করে গ্রুট ইশকির হাসপাতালের সার্জন হয়েছেন ১৯৫৮ সালে তাঁর ছোটভাই মরিস বার্নার্ডও ডাক্তার জটিল সার্জারিতে ক্রিশ্চিয়ানকে অ্যাসিস্ট করেন মরিস শরীরের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে রোগীকে নবজীবন দান করার মহান প্রচেষ্টা ছিল ক্রিশ্চিয়ানের

          ১৯৫৩ সালে প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ হয় আমেরিকায়। তারপর বিভিন্ন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে সফলভাবে। ক্রিশ্চিয়ান কিডনি প্রতিস্থাপন করেন কেইপ টাউনে ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে। কিন্তু তখনো পৃথিবীর কোথাও একজন মানুষের হৃৎপিন্ড খুলে নিয়ে অন্য মানুষের হৃৎপিন্ডের জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা কেউই করেননি। অথচ গবেষণা চলছিলো বিশ্বব্যাপী বড় বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে। ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড ততদিনে ৫০টারও বেশি কুকুরের হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন করেছেন সাফল্যের সাথে। মানুষের হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপনের জন্য যা যা দক্ষতা, চিকিৎসাসরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি দরকার সবই ছিল তার অপারেশন থিয়েটারে। দক্ষ সহায়কদলও ছিল। কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।

 

 

ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড। (ডানে মিউজিয়ামে রাখা তাঁর মূর্তি)


১৯৬৭ সালে ডক্টর বার্নার্ডের একজন মরণাপন্ন রোগী ছিলেন লুইস ওয়াশক্যানস্কি। সিভিয়ার হার্ট ফেইলিওরের কারণে তাঁর হার্টসার্জারির দরকার ছিল। কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো। ডক্টর বার্নার্ড দেখলেন হৃৎপিন্ড দান করার মতো কাউকে পাওয়া গেলে ওয়াশক্যানস্কিকে তিনি বাঁচাতে পারেন। কিন্তু সেরকম দাতা কোথায় পাবেন? এমন হতে হবে যে দাতার শরীরের মৃত্যু হয়েছে অন্য কোন কারণে, কিন্তু হৃৎপিন্ড সুস্থ আছে। তখন সেই হৃৎপিন্ড খুলে নিয়ে - যার হৃৎপিন্ড খারাপ হয়ে গেছে অথচ প্রাণে বেঁচে আছে তাকে বাঁচানো যায় নতুন হৃৎপিন্ড বসিয়ে দিয়ে।

          সেই সময় অন্য একটি পরিবারে একটি দুর্ঘটনা ঘটলো ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। পঁচিশ বছর বয়সী উচ্ছল তরুণী ডেনিস ডারভ্যাল তাঁর বাবা-মার সাথে চায়ের নিমন্ত্রণে যাচ্ছিলো এক পারিবারিক বন্ধুর বাসায়। হাসপাতালের কাছের সাবার্বের একটি শপিং এরিয়ায় গাড়ি থামিয়ে কেক কেনার জন্য যাচ্ছিলো ডেনিস ও তার মা। গাড়ি থেকে নেমে দুজনে রাস্তা পার হচ্ছিলো। এমন সময় একটা দ্রুতগামী গাড়ী তাদের দুজনকে চাপা দিয়ে চলে গেলো। ডেনিসের মা মারা গেলেন তৎক্ষণাৎ রাস্তার ওপর। ডেনিস গাড়ির ধাক্কায় শূন্যে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়লেন নিজেদেরই গাড়ির চাকার ওপর। প্রচন্ড আঘাতে মাথার খুলি ফেটে গেলো। দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো গ্রুট ইশকির হাসপাতালে। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করা হলো। কিন্তু রাত নটার দিকে ডেনিস ব্রেনডেথ হয়ে গেলো।

          তখনকার মেডিকেল এথিক্স অনুযায়ী ডেনিস কিন্তু তখনো শারীরিকভাবে মৃত নয়। তার হৃৎপিন্ড তখনো সচল। কিন্তু মস্তিষ্ক যেহেতু মরে গেছে তাই শরীর অসাড়। এ অবস্থায় ডেনিসের বেঁচে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই।

          ডেনিসের বাবার সাথে কথা বললেন ডক্টর বার্নার্ড। ডেনিসের হৃৎপিন্ড দিয়ে লুইস ওয়াশক্যানস্কির জীবন বাঁচানো যায়। শুধু তাই নয়, ডেনিসের কিডনি দিয়েও বাঁচানো যায় আরো একটি জীবন।

          ডেনিসের বাবা বুঝলেন ব্যাপারটা। তিনি অনুমতি দিলেন। কিন্তু আইন অনুযায়ী ডেনিসের হৃৎপিন্ডের ধুকধুক যতক্ষণ সচল- ততক্ষণ সে মৃত নয়। ক্রিশ্চিয়ানের ভাই ডাক্তার মরিস বার্নার্ডকে পরামর্শ দিলেন। পরামর্শমতো ডেনিসের হৃৎপিন্ডে ইনজেকশানের সাহায্যে পটাশিয়াম ঢুকিয়ে দেয়া হলো। হৃৎপিন্ড অবসাদগ্রস্থ হলো।

          শুরু হলো পাশাপাশি দুটো থিয়েটারে প্রাণ দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর কর্মযজ্ঞ।

ডেনিসের সুস্থ হৃৎপিন্ড খুলে নেয়া হলো। অন্য রুমে ওয়াশক্যানস্কির হৃৎপিন্ডও খুলে নেয়া হলো। তারপর দীর্ঘ নয় ঘন্টাব্যাপি অপারেশন করে ডেনিসের হৃৎপিন্ড লুইসের বুকে বসিয়ে দেয়া হলো। পৃথিবীর প্রথম মানব-হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপনের ইতিহাস তৈরি করলেন ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড।

          শুধু তাই নয়, ডেনিসের কিডনি প্রতিস্থাপন করে বাঁচানো হলো ১০ বছরের বালক জনাথন ভ্যান ওয়েক-এর জীবন। সেদিনের ঘটনা মানবতার পক্ষে অনেকগুলো মাইলফলক হয়ে থাকলো।

          ডেনিস ছিল খ্রিষ্টান। তার হৃৎপিন্ড নিয়ে বেঁচে উঠলো ইহুদি পুরুষ লুইস ওয়াশক্যানস্কি। থাকলো না কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ, রইলো না নারী-পুরুষ বিভাজন। ডেনিস ছিল শ্বেতাঙ্গ। তার কিডনি পেয়ে বেঁচে উঠলো কৃষ্ণাঙ্গ বালক জনাথন। রইলো না কোন বর্ণভেদ।

          কিন্তু মানবই মানবতাবিরোধী কাজকর্ম করে থাকে। তখনকার অ্যাপারর্টেড বা বিচ্ছিন্নকরণ আইন অনুযায়ী কালো মানুষ সাদা মানুষের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে পারে না। তাই বলা হলো সাদা মানুষের কিডনি দিয়ে কালো মানুষ বাঁচিয়ে অপরাধ করেছেন ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের দল।

          কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার বার্নার্ড ছিলেন সত্যিকারের মানবতাবাদী। তাঁর কাছে সাদা-কালোর কোন পার্থক্য ছিল না। কেইপটাউনের ডিস্ট্রিক্ট সিক্স থেকে সাদা-কালো আলাদা করা হচ্ছিল যেসময়, সেই সময়েই সাদা-কালো এক করে দিলেন তিনি। ডেনিসের হৃৎপিন্ড আক্ষরিক অর্থে বুকে ধারণ করে ১৮ দিন বেঁচেছিলেন লুইস ওয়াশক্যানস্কি।

 

 

ডেনিস ডারভ্যালের হৃৎপিন্ড নিয়ে প্রাণ পেয়েছিলেন লুইস ওয়াশক্যানস্কি এবং কিডনি নিয়ে বেঁচেছিল জনাথন।


এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে অনেক উন্নত মানুষের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। যার ফলে অঙ্গ প্রতিস্থাপনেও সাফল্যের হার বেড়েছে।

          ১৯৬৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর ঠিক যেভাবে সেই অপারেশন থিয়েটারে হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপিত হয়েছিল সেখানে ঠিক সেইভাবেই সময়কে ধরে রাখা হয়েছে। সব ডাক্তার, অ্যাসিস্ট্যান্ট, নার্স সবার হুবহু চেহারা ও গেট-আপে মূর্তি বানিয়ে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামে। সভ্যতার এত বড় অর্জনের কথা সবার জানা উচিত।

          ফেরার পথে আর বাসে উঠতে ইচ্ছে করলো না। হাসপাতালের ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সিতে উঠে গেলাম। মিটারচালিত ট্যাক্সি - গন্তব্য বলতেই স্টার্ট। সিটে হেলান দিয়ে আই অ্যাম সো টায়ার্ড" বলেই চোখ বন্ধ করে ফেললো এলিজাবেথ। মনে হলো ঘুমিয়েই পড়লো।

 

হার্ট অব কেইপ টাউন মিউজিয়ামে হার্ট-ট্রান্সপ্লেন্টেশান মডেল


হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থামতেই ভাড়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে দরজা খুলে চুপচাপ নেমে গেলো এলিজাবেথ। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতে করতে দেখলাম সে হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।


         
মিনিট খানেক পরে লবিতে এসে দেখি লিফট এর কাছে দাঁড়িয়ে আছে এলিজাবেথ।

     ওয়েটিং ফর ইউ - ক্যাজুয়েলি বললো সে।

     থ্যাংক ইউ

          লিফটে ওঠার পর কয়েক সেকেন্ড নিরবতা।

          হোয়াট অ্যাবাউট ডিনার? সরাসরি প্রশ্ন তার।

     হোয়াট অ্যাবাউট ইট?

     লেটস গো আউট

আমি কোন জবাব দিলাম না। বুঝতে চেষ্টা করছি তার উদ্দেশ্য কী। ফোর্থ ফ্লোর এসে গেছে। লিফটের দরজা খুললো। আমি বের হলাম। সেও। করিডোরে দাঁড়ালাম।

     সেভেন ও ক্লক? আবার প্রশ্ন করলো সে।

     হোয়াট?

     ডিনার

          কিছু কিছু প্রস্তাব আছে না করতে নেই।

     কোথায় যেতে চাও?

     ওয়াটারফ্রন্ট। সাতটায় একটা বাস যায় হোটেল থেকে। ওটাতে যাবো।

     ওকে, সি ইউ দেন।"

          ওয়েট ফর মি হিয়ার। একসাথে যাবো।

     ঠিক আছে

     সি ইউ সুন

 


পর্ব ১৮


ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ১৬

 



ইউনিভার্সিটি অব কেইপ টাউন

ঘন সবুজ বনের ভেতর বিশাল ক্যাম্পাস ছবির মতো সুন্দর। হাইওয়ের কাছে কেইপ টাউন ইউনিভার্সিটির রাগবি মাঠ। মাঠের ওপারে অসংখ্য বহুতল অ্যাকাডেমিক ভবন। একটা বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং-এর মাঝখানে রাস্তা ছাড়া খালি জায়গা খুব একটা নেই। সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। শান্ত স্নিগ্ধ। বিশ্বমানের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যেরকম হওয়া উচিত। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় এটা।

          ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশের এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু বয়সে নয়, মানের দিক থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

          এপর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন প্রাক্তন ছাত্র নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ১৯৫০ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কারবিজয়ী রালফ বানচি, ১৯৫১ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেলবিজয়ী ম্যাক্স থেইলার, ১৯৭৯ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেলবিজয়ী অ্যালেন ম্যাকলয়েড, ১৯৮২ সালের রসায়নে নোবেলবিজয়ী অ্যারন ক্লুং, আর ২০০৩ সালে সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী জন কোয়েৎজি- সবাই জীবনের একটা পর্যায়ে পড়াশোনা করেছিলেন এই ক্যাম্পাসে।

          ক্যাম্পাসে প্রচুর শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় শিক্ষার্থী চোখে পড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে মোট শিক্ষার্থীর তিনভাগের একভাগ শ্বেতাঙ্গ। প্রায় ১৮% ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট। অধ্যাপকদের মধ্যে এখনো তিনভাগের দুই ভাগ ইউরোপিয়ান বংশদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ। দক্ষিণ আফ্রিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়োগ বাড়ানোর বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।

          আপার ক্যাম্পাসে সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, কমার্স সব ফ্যাকাল্টি। পুরো আপার ক্যাম্পাসের চারদিক ঘিরে যে রাস্তা - তার নাম মাদিবা সার্কেল। নেলসন ম্যান্ডেলার নাম মাদিবা। তার মানে এই রাস্তার নামকরণ হয়েছে বেশি বছর হয়নি।

 

ইউনিভার্সিটি অব কেইপ টাউনের জেইমসন হল


জেইমসন হল আপার ক্যাম্পাসের কেন্দ্রবিন্দু। দূর থেকে দেখতে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের মতো লাগছে। খুবই সুন্দর ভবন। এর প্রশস্ত উঁচু সিঁড়িতে শিক্ষার্থীদের আড্ডা চলছে এখানে ওখানে। সামনের সবুজ চত্বরে স্টুডেন্টদের মিলনমেলা। আনন্দে হাসিতে বিক্ষোভে ভরে ওঠে এই প্রাঙ্গন যখন দরকার হয়।

          কাছেই ফুডকোর্ট। লাঞ্চ করা যেতে পারে। একটা বেজে গেছে। এলিজাবেথের পছন্দ ইন্ডিয়ান ফুড। রাইস অ্যান্ড চিকেন কারি উইথ চিলি। আমি নিলাম মাটন।

     তোমার প্ল্যানটা বলবে? যেতে যেতে প্রশ্ন এলিজাবেথের।

 

লাঞ্চটাইম


     এখান থেকে রোডস মেমোরিয়েলে উঠবো। সেখান থেকে গ্রুট ইশকির মিউজিয়াম দেখতে যাবো।

     সেই মিউজিয়ামে কী আছে?

     মেডিকেল স্টাফ। পৃথিবীর প্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লেন্টেশান হয়েছিল সেখানে। সেটা কীভাবে করা হয়েছিল তা দেখায়।

     তুমি কি ডাক্তার?"

     না, আমি ফিজিসিস্ট। তুমি কী?

     আমি হেয়ার ডিজাইনার।"

          "সেলুনে কাজ করো?"

          "না না। আমি হেয়ার স্টাইলিস্ট নই, হেয়ার ডিজাইনার।"

     মানে?"

          চুলের ডিজাইন করি। পরচুলা বানানোর কারখানায় কাজ করি।

তার নিজের চুলের যে অবস্থা তাতে সে কীরকম ডিজাইনার কে জানে অবশ্য দর্জির নিজের জামাকাপড় দেখে তো আর বিচার করা যায় না সে কেমন সেলাই করে

     তোমার প্ল্যান কী?

     নিজে একটা দোকান দেবো চুলের দোকান।

     দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা জানতে চাচ্ছি না এখনকার প্ল্যান বলো আমার সঙ্গে যাবে, নাকি নিজের পথ দেখবে?

     রোডস মেমোরিয়েল দেখার প্ল্যান আছে। মিউজিয়ামেরটা জানি না এখনো।

     কখন জানবে?

     রোডস মেমোরিয়েলে যাবার পর।

     তাহলে চলো। পাহাড়ে উঠতে হবে।

          হাঁটতে হাঁটতে রাগবি মাঠের দিকে এলাম। সেখান থেকে সুড়ঙ্গ পথে মিডল ও লোয়ার ক্যাম্পাসে যাওয়া যায়। রোডস মেমোরিয়েল আপার ক্যাম্পাসেরও উপরে।

          রাগবি মাঠের একপাড়ে একটা উঁচু পাথরের বেদি। বেদিটা এখন খালি। এটাতে সিসিল রোডের বিশাল আকৃতির এক মূর্তি ছিল গতবছর পর্যন্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক জায়গায় সিসিল রোডের মূর্তি আছে। সিটিতে, পার্লামেন্টের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, পার্কে।


 

রোডসের মূর্তি সরানো হচ্ছে (ছবি: ইন্টারনেট)


হাইওয়ের নাম রোডস ড্রাইভ, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে তার নামে আফ্রিকায়- রোডস ইউনিভার্সিটি। তার স্মরণে বিশাল এক মেমোরিয়েল- যা আমরা দেখতে যাচ্ছি। কে ছিলেন এই সিসিল রোডস?

     হি ওয়াজ আ ফাউন্ডার অব সাউথ আফ্রিকা - এলিজাবেথ বললো।

          আসলেই কি? যতটুকু পড়েছি সিসিল রোড সম্পর্কে তাতে মানুষটাকে ভয় করা যায় - কিন্তু শ্রদ্ধা করা যায় না কিছুতেই।

          সিসিল জন রোডস-এর জন্ম ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারে ১৮৫৩ সালের ৫ জুলাই। তার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ পাদ্রী। সিসিল ছিলেন চিররুগ্ন। লেখাপড়াও তেমন করতে পারেননি স্বাস্থ্যগত কারণে। ১৭ বছর বয়সে তাঁর বাবা-মা তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়ে দেন। সিসিলের বড় ভাই হারবার্ট আগে থেকেই আফ্রিকায় থাকতেন।

          সিসিলের স্বাস্থ্য খারাপ, মেজাজ খিটখিটে হলেও ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল ভালো। ১৮ বছর বয়সে ভাইয়ের সাথে তুলার ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ২ বছরের মধ্যে ব্যবসা ফেল করে। ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে অক্সফোর্ডে পড়াশোনার চেষ্টা করেন সিসিল কিছুদিন। কিন্তু এক সেমিস্টার না যেতেই বুঝতে পারেন যে পড়াশোনা তার জন্য নয়।

          সিসিল ফিরে এলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। হীরার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে ততদিনে। অনেক ক্ষুদ্রব্যবসায়ীও তখন হীরার ব্যবসা করছেন। সিসিলও শুরু করলেন। ১৮৯০ সালের মধ্যে পৃথিবীর হীরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন সিসিল রোডস। তারপর শুরু করেন ফলের ব্যবসা। ১৮৯২ সালের মধ্যেই আফ্রিকার সব ফলের ব্যবসা চলে আসে তাঁর হাতে।

          আফ্রিকান কালো মানুষদের তিনি মানুষ বলে মনে করতেন না। তিনি প্রকাশ্যেই বলতেন কালোদের কাজ হলো কুলিগিরি করা বা বড়জোর ক্ষেতখামারে কাজ করা। অন্যকিছু করতে চাইলে তাদের বাধা দেয়া উচিত।

          ১৮৭৭ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে পার্লামেন্টের মেম্বার হন। ১৮৯০ সালে সিসিল রোড কেইপ কলোনির (দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়ার পুরোটা) প্রধানমন্ত্রী হন। আফ্রিকান অশ্বেতাঙ্গদের সম্পর্কে তাঁর নীতি ছিলো, তারা হলো বর্বর। তাদেরকে পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখতে হবে। তাদের হাতে কোন জমির মালিকানা দেয়া যাবে না।

          সিসিল রোডস বিশ্বাস করতেন যে ইংরেজরাই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জাতি (First nation in the World)

          ১৮৭৭ সালে তিনি একটা উইল করেছিলেন সেখানে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন একটা গোপন সংগঠন গড়ে তোলার যে সংগঠন পুরো পৃথিবীকে ব্রিটিশ রাজত্বে পরিণত করবে তাঁর শেষ উইলে অবশ্য তিনি টেবল মাউন্টেনের আশেপাশের বিশাল আয়তনের জমি দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের জন্য দিয়ে যান অবশ্য তিনি কখনো চিন্তাও করতে পারেননি যে তাঁর মৃত্যুর একশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ভূমির মালিক হবার অধিকার অর্জন করবে কালো মানুষেরা, সরকার পরিচালিত হবে কালো মানুষদের দ্বারা যাঁদের তিনি মানুষ বলে মনে করতেন না।

          সিসিল রোডস পরিকল্পনা করেছিলেন আফ্রিকা মহাদেশের সর্বদক্ষিণের কেইপ টাউন থেকে সর্বউত্তরের মিশর পর্যন্ত ট্রেন লাইন বসানোর। টেলিগ্রাফ লাইন বসানোর কাজ তিনি শুরু করেছিলেন।

          ১৯০২ সালে ৪৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর উইল অনুসারে তাঁর সম্পদের কিছু অংশ নিয়ে ট্রাস্ট গঠিত হয়। একটা অংশ থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি দেয়া হয় প্রতিবছর। রোডস স্কলারশিপ খুবই প্রেস্টিজিয়াস স্কলারশিপ পৃথিবীর স্কলারদের কাছে। কিন্তু সিসিল রোডস এর কথামতো এই স্কলারশিপ শুধুমাত্র ইংরেজিভাষী শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ১৯৭৭ পর্যন্ত কোন মেয়ে এই স্কলারশিপের জন্য মনোনীত হতো না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১২ পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কোন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান রোডস স্কলারশিপের জন্য বিবেচিত হতো না।

 

 

রোডস মেমোরিয়েল


আপার ক্যাম্পাস থেকে ছায়াঢাকা একটা রাস্তা ধরে উপরের দিকে ওঠার পর রোডস মেমোরিয়েল। ডেভিলস পিক-এর একটা অংশে এই স্মারক-স্থাপনা। বিখ্যাত স্থপতি হারবার্ট ব্যাকার গ্রিক স্থাপত্যের অনুসরণে ইউ আকৃতির এই স্থাপনা বানান গ্রানাইট পাথর দিয়ে। টেবিল মাউন্টেন থেকে আনা হয় এসব পাথর।

          মূল স্থাপনায় পৌঁছানোর জন্য ৪৯ ধাপের পাথরের সিঁড়ি। সিসিল রোডসের জীবনের একেকটা বছরের জন্য একেকটা সিঁড়ি। নিচের ধাপের সিঁড়িগুলোর মাঝখানে একটা বিশাল অশ্বারোহীর পিতলের মূর্তি। এই মূর্তি শারীরিক শক্তির (Physical Energy) প্রতীক

          উপরের সিঁড়ির প্রশস্ত রেলিং-এর ওপর একপাশে চারটি করে দুপাশে আটটি ব্রোঞ্জের সিংহমূর্তি সিঁড়িতে দাঁড়ালে কেইপ টাউনের অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায় ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, গ্রুট ইশকির হাসপাতাল সব দেখা যাচ্ছে।

     দেখেছো, একজন কত বড় মানুষ কত বড় বড় কাজ করে গেছেন? মনে হচ্ছে এলিজাবেথ সিসিলের প্রশংসা করছে।

          এলিজাবেথের সঙ্গে কোন ধরনের তর্কে যাওয়া বৃথা। তার গায়ের চামড়া, চুলের রঙ তাকে এখনো অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা দেয় এই পৃথিবীতে। সিসিল রোডসকে তার ভালো লাগতেই পারে।

          নিচের দিকে তাকালে রাগবি মাঠের পাড়ে সিসিলের মূর্তিশূন্য বেদি দেখা যাচ্ছে। অনেকদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীরা এই মূর্তি সরাতে বাধ্য করেছে।

          মেমোরিয়েলের উপরের ধাপে সিসিল রোডস-এর একটা আবক্ষ পিতলের মূর্তি। গায়ে হাত দিয়ে চিন্তা করছেন রোডস। পুরনো পিতলের মূর্তির মুখ থেকে নাকটা কেউ সুন্দর করে কেটে নিয়ে গেছে। সেই জায়গায় পিতলের রঙ উজ্জ্বল।

 

সিসিল রোডসের নাক কেটে নেয়া হয়েছে

 

সিসিল চেয়েছিলেন এই ভূখন্ডে রাজত্ব করবে শুধুই সাদারা। এমন একজন বর্বর, বর্ণবাদী, আধিপত্যবাদী মানুষের নাম এখনো দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে ছড়িয়ে আছে - অনেক বছর লাগবে তা সরাতে। সিসিল রোডস এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে তার নামে ব্রিটিশ কলোনির একটা দেশের নামই ছিল-রোডেশিয়া। যা এখন জিম্বাবুয়ে এবং জাম্বিয়া দুটো স্বাধীন দেশ।

     হি ওয়াজ নট ম্যারিড-এলিজাবেথের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে খুবই আফসোস করছে সে।

     স্বাধীনচেতা মানুষ বিয়ে করে না।

     ইউ আর রাইট।"

          "তুমি কি স্বাধীনচেতা?"

          "ইয়েস।"

          রহস্যময় হাসি এলিজাবেথের মুখে।

          সোয়া দুটা বেজে গেছে। যেতে হবে গ্রুট ইশকির হাসপাতালে। মিউজিয়ামের তিনটার গাইডেড ট্যুরটা ধরতে হবে।

     কী ঠিক করলে?

          জ্ঞিজ্ঞেস করলাম এলিজাবেথকে। সে মেমোরিয়েলের গায়ে সিসিল রোডসের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা দেয়াল লিখনের ছবি তুলছে।

     অ্যাবাউট হোয়াট?

     হার্ট মিউজিয়ামে যাবে?

     পয়সা লাগে?

     লাগে

     কত?

     তিনশ র‍্যান্ড

     এত বেশি?

     বেশি কোথায়? বিশ ইউরো। তোমাদের প্যারিসে ২০ ইউরোতে ঢুকা যায় কোথাও?

          ঠিক বলেছো। আমার তো ক্যাশ নেই।

     ওরা ক্রেডিট নেয়। যাবে কিনা বলো। না গেলে-বাই।

          আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। দেখলাম সেও আসছে পেছনে।

          ইউনিভার্সিটির এত বিশাল ক্যাম্পাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবার, এক ক্যাম্পাস থেকে অন্য ক্যাম্পাসে যাবার, বাস ও ট্রেন স্টেশন থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করার সুবন্দোবস্ত আছে। তাহলো জ্যামি শাটল -  ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ক্যাম্পাস পরিবহন। আকাশী রঙের ঝকঝকে নতুন অনেকগুলো বাস চলে ক্যাম্পাসে।

          রোডস মেমোরিয়েল থেকে আপার ক্যাম্পাসে ফিরে এসে জ্যামি শাটলের স্টপ খুঁজে পেতে দেরি হলো না। রুটম্যাপ দেখলাম। আমাদের উঠতে হবে 9C বাসে

Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts