Showing posts with label চিকিৎসাবিজ্ঞান. Show all posts
Showing posts with label চিকিৎসাবিজ্ঞান. Show all posts

Tuesday, 9 September 2025

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

 



যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীর প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন।

পৃথিবীর সব দেশে ক্যান্সার রোগীর বিস্তারিত পরিসংখ্যান রাখার ব্যবস্থা আছে। তবুও অনেক দেশে অনেক মানুষ ক্যান্সার রোগে মারা যায় – রোগ শনাক্ত হবার আগেই। তাদের সংখ্যা পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। ক্যান্সার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা – ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। শুধুমাত্র এই এক বছরেই সাতানব্বই লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে ক্যান্সারে [১]।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যায়। দেখা যাচ্ছে মানুষ যত দীর্ঘজীবী হচ্ছে, বয়স্কদের মধ্যে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছরই ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বর্তমান পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বছরে দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ হারে বাড়বে, আর ক্যান্সারে মৃত্যু হবে প্রায় এক কোটি বিশ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর। ২০৪০ সালের মধ্যে এই হার আরো বেড়ে যাবে। তখন বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে, আর দেড় কোটিরও বেশি ক্যান্সার রোগি মারা যাবে। ২০৫০ সালে এই হার আরো বাড়বে। বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হবে – আর মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে শতকরা পঞ্চাশেরও বেশি। তার মানে প্রতি দুই জন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে একজন মারা যাবে। এই সংখ্যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মুখে চড় মারার মতোই অপমানজনক।

এক সময় মনে করা হতো ক্যান্সার ধনীদের রোগ। গত শতাব্দীর পরিসংখ্যান থেকেও এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। আফ্রিকা মহাদেশের দরিদ্র কোন দেশের ক্যান্সার রোগীর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যান্সার রোগীর শতকরা হার অনেক বেশি। তার একটি প্রধান কারণ ছিল – আফ্রিকার জনগণের গড় আয়ু ছিল অস্ট্রেলিয়ার জনগণের গড় আয়ুর চেয়ে অনেক কম। ফলে ক্যান্সার হবার গড় বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই আফ্রিকার মানুষ অন্য কোন নিরাময়যোগ্য রোগে মারা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বৈশ্বিক উন্নয়নের সুফল এবং পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। এখন ক্যান্সার আর শুধুমাত্র বড়লোকের রোগ নয়।

কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। ক্যান্সার রোগের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা ভীষণ প্রযুক্তিনির্ভর এবং ব্যয়বহুল বলে ক্যান্সার চিকিৎসা এখনো সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে ধনীদেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার দরিদ্রদেশের ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক কম।

২০২২ সালে বাংলাদেশে নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার। আর একই বছর ক্যান্সারে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় এক লক্ষ সতের হাজার মানুষ। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করার ব্যাপারে নানারকম অসুবিধা আছে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বিভিন্ন কারণে খুবই নাজুক। অনেক রোগীই ক্যান্সারে মারা যান ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার আগেই, অথবা একেবারে শেষ পর্যায়ে শনাক্ত হওয়ার পর। তাই বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর বার্ষিক মৃত্যুর হার সত্তর শতাংশেরও বেশি।

ক্যান্সার রোগের যে কোনো চিকিৎসা নেই – তা নয়। এই রোগের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা আছে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী সুস্থও হচ্ছে। কিন্তু এই রোগের প্রধান সমস্যা হচ্ছে – এই রোগ হবার মূল কারণ এখনো অজানা। সেজন্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করারও সুনির্দিষ্ট কোনো উপায় এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে পারেননি। মূল কারণ অজানা বলেই – ক্যান্সারের প্রতি মানুষের প্রচন্ড ভীতি যেমন রয়েছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে নিত্যই প্রচারিত হচ্ছে নানারকম মতামত। যে মতামতের বেশিরভাগই এখনো অমীমাংসিত।

ক্যান্সার রোগের মূল কারণ শনাক্ত করা না গেলেও ক্যান্সার রোগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে যেটুকু বলা যায় – সেটুকু হলো – ক্যান্সার কোনো জীবাণুবাহিত রোগ নয়। ক্যান্সার হলো কোষঘটিত রোগ। স্বাভাবিক কোষ শরীরের ভেতর ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেও কোনো স্বাভাবিক কোষ কখন ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হবে তা বলা যায় না। ক্যান্সার কোষের রূপান্তর বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমান করা গেলেও – কেন এই রূপান্তর ঘটে তা এখনো অজানা।

কোষের কর্মপদ্ধতি লেখা থাকে তার ডিএনএ-তে। দেখা যায় স্বাভাবিক কোষ এবং ক্যান্সার কোষের ডিএনএ-তে পার্থক্য থাকে। কোষের ডিএনএ-র অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক কোষের কাজকর্ম অস্বাভাবিক হয়ে ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। ক্যান্সার কোষ তখন দেহের স্বাভাবিক জৈবনির্দেশ মেনে চলে না। একটি স্বাভাবিক কোষ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজনের পর স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ স্বাভাবিক মৃত্যুনির্দেশিকা মেনে চলে না। তাই ক্যান্সার কোষকে যেকোনো উপায়ে মেরে ফেলাই হলো ক্যান্সার চিকিৎসার মূল ভিত্তি।

ক্যান্সার চিকিৎসার প্রচলিত পদ্ধতিগুলির মধ্যে প্রধান পদ্ধতি হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিয়েশান প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা। কীভাবে এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ক্যান্সার কোষযুক্ত টিউমারে পাঠানো হবে – তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে ক্যান্সার চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি। 

বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগীকে ক্যামোথেরাপি দেয়া হয়। ক্যামোথেরাপিতে রাসায়নিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে ক্যান্সার কোষে পাঠানো হয়। যদি সার্জারি করে ক্যান্সার টিউমার অপসারণ করা সম্ভব হয় – তাহলে সার্জারি করা হয়। অর্ধেকের কাছাকাছি রোগীকে শরীরের বাইরে থেকে রেডিয়েশান দেয়া হয় – যাকে রেডিওথেরাপি বলা হয়। রেডিওথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসার দীর্ঘদিনের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে ক্যান্সার নির্মূল করার ব্যাপারটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যান্সার কোষগুলির স্বাভাবিক কোষের সাথে মিলেমিশে থাকার কারণে। সবগুলি ক্যান্সার কোষকে একসাথে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না – কারণ তাতে ক্যান্সার কোষের আশেপাশে থাকা স্বাভাবিক কোষগুলিও ধ্বংস হয়ে যাবে। শরীরের স্বাভাবিক কোষ যদি অতিমাত্রায় ধ্বংস হয়ে যায় – তাহলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়ে রোগীর হিতে বিপরীত হবে। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে রেডিওথেরাপি এমনভাবে দেয়া হয় – যেন ক্যান্সার কোষগুলি ধ্বংস হয়, কিন্তু স্বাভাবিক কোষগুলির কার্যক্রম অটুট থাকে [২]।

রেডিয়েশানের ক্ষতিকর দিক থেকে স্বাভাবিক কোষগুলিকে রক্ষা করার জন্য প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে ক্যান্সার কোষ ও স্বাভাবিক কোষের কিছু জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যকে কাজে লাগানো হয়। যেমন স্বাভাবিক কোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-কে সারিয়ে তুলতে পারে যদি তাদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়। প্রচলিত রেডিওথেরাপি পদ্ধতিতে তাই একসাথে অধিক মাত্রায় রেডিয়েশান প্রয়োগ করার পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময় পরপর কম মাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগ করা হয়। একবার রেডিয়েশান দেয়ার পর থেকে আরেকবার রেডিয়েশান দেয়ার আগ পর্যন্ত যে সময় (সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা) – সেই সময়ে ক্যান্সার কোষের সাথে যেসব স্বাভাবিক কোষ রেডিয়েশানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – তারা নিজেদের সুস্থ করে নিতে পারে (ডিএনএ সংশোধন)। ক্যান্সার কোষগুলির সাধারণত সেই ক্ষমতা থাকে না।

ক্যান্সার কোষগুলিতে সাধারণত অক্সিজেন প্রবাহের পরিমাণ থাকে স্বাভাবিক কোষগুলির চেয়ে কম। অক্সিজেন প্রবাহ কম থাকলে রেডিয়েশানের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে হাইপোক্সিক বা কম অক্সিজেনযুক্ত ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে গেলে যে মাত্রার রেডিয়েশান দিতে হবে – সেই মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষগুলি অনেক বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে বলে রেডিয়েশানের মাত্রা কম রাখতে হয়। ফলে রোগীর চিকিৎসা করতে হয় দীর্ঘদিন এবং খরচ ও ভোগান্তিও বেড়ে যায়।

রেডিওথেরাপিকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। কিছুটা সুফল পাওয়া গেলেও তেমন কোন যুগান্তকারী পরিবর্তন সেখানে ঘটেনি। কিন্তু সম্প্রতি ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি নামে এক নতুন ধরনের অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে ক্যান্সার চিকিৎসায় অস্বাভাবিক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা [৩,৪]।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি এমন একটি প্রযুক্তি যা অতিস্বল্প সময়ে (মিলিসেকেন্ডের মধ্যে) অতি উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন (সেকেন্ডে চল্লিশ গ্রের অধিক) শরীরে প্রয়োগ করে। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে মাত্র কয়েক গ্রে রেডিয়েশান দিতে যেখানে কয়েক মিনিট সময় লাগে,  সেখানে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি মাত্র এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে নির্ধারিত ডোজ প্রয়োগ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই দ্রুতগতির অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশন স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি কমিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রশ্ন হলো -  কীভাবে? যেখানে খুব কম মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেখানে অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান স্বাভাবিক কোষ কীভাবে সহ্য করবে?

ইঁদুর ও শূকরের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে এটি কার্যকরভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং স্বাভাবিক কোষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো একজন মানুষের উপর পরীক্ষামূলকভাবে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিত কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতবাদ পরীক্ষা করে দেখছেন ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে।

অতি অল্প সময়ে অতিমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন সেটা হলো অক্সিজেন হ্রাস তত্ত্ব বা অক্সিজেন ডিপ্লেশান হাইপোথিসিস। 

প্রচলিত কম মাত্রার রেডিওথেরাপিতে রেডিয়েশান জৈবকোষে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে। কোষে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এই ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ক্ষতিকর পার-অক্সাইডে পরিণত হয় যা ডিএনএর ক্ষতি করে। কোষে উপস্থিত অক্সিজেন ডিএনএর এই ক্ষতিকে স্থায়ী ক্ষতে পরিণত করে – ফলে কোষ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু কোষে যদি অক্সিজেন কম থাকে বা না থাকে, এই ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালগুলি ডিএনএর স্থায়ী কোন ক্ষতি করতে পারে না। ফলে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই অস্থায়ী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, ডিএনএ নিজে নিজে সংশোধিত হয়ে যায়।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অনেক বেশি মাত্রার রেডিয়েশন দেয়া হয়। এই উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বিপুল পরিমাণে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে, যা মুহূর্তেই চারপাশের অক্সিজেন খরচ করে ফেলে। অক্সিজেন এত দ্রুত শেষ হয়ে যায় যে কোষগুলিতে সাময়িকভাবে অক্সিজেনস্বল্পতা বা হাইপোক্সিয়া তৈরি হয়। এতে স্বাভাবিক কোষে পারঅক্সাইড কম তৈরি হয় এবং ডিএনএ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু টিউমার কোষ সাধারণত আগে থেকেই কিছুটা হাইপোক্সিক থাকে, তাই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির এই অক্সিজেন কমিয়ে ফেলার প্রভাবে তারা খুব একটা প্রভাবিত হয় না।

ইঁদুরসহ অন্যান্য কিছু প্রাণির উপর পরীক্ষা করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি নতুন বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেদিনে পথ এখনো অনেক বাকি। কারণ বিভিন্ন কোষে অক্সিজেনের শোষণ করার ক্ষমতা এবং পদ্ধতি ভিন্ন। মানুষের কোষের সাথে রেডিয়েশান যেভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে, অন্যান্য প্রাণির কোষের সাথে সেই মিথষ্ক্রিয়া হুবহু এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন কোষের রেডিয়েশান সংবেদনশীলতাও ভিন্ন। তাই অক্সিজেন হ্রাসের এই তত্ত্ব এখনো সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

তাছাড়া এই তত্ত্ব প্রমাণিত হলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে এই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করতে গেলে এখনো বেশি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এত উচ্চ হারে রেডিয়েশান প্রয়োগ করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে যে লিনিয়ার এক্সিলারেটর ব্যবহার করা হয় – তা দিয়ে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি অসম্ভব। দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা হলো – এত উচ্চ হারের রেডিয়েশান মাপার মতো বিশ্বাসযোগ্য ডোসিমিটার এখনো তৈরি হয়নি। ডোসিমিটার ছাড়া কোনো রোগীকেই সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিয়েশান দেয়া সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত খরচ হিসেবে ধরলে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির চিকিৎসায় খরচ পড়বে প্রচলিত রেডিওথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসা আবারো ধনীদের হাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে।

এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি ভবিষ্যতের ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যেসব ক্যান্সার শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গে হয় (যেমন: মস্তিষ্ক, ফুসফুস)। গবেষণা সফল হলে এটি দ্রুত সময়ে, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, কার্যকর চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

 

তথ্যসূত্র

১। গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি, ক্যান্সার টু ডে, ২০২৪।

২। প্রদীপ দেব, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ঢাকা ২০২৩।

৩। ফ্রনটিয়ার্স ইন অনকোলজি, ভল্যুম ৯, আর্টিক্যাল ১৫৬৩, জানুয়ারি ২০২০।

৪। অনকোলজি লেটারস, ভল্যুম ২৮, সংখ্যা ৬০২, ২০২৪।

________________

বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত







Sunday, 4 September 2022

রোজালিন ইয়ালো: নোবেলজয়ী চিকিৎসা-পদার্থবিজ্ঞানী

 




আমাদের শরীরের মতো এত জটিল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র আর একটিও নেই। শরীরের ছোটখাট সমস্যাগুলির সমাধান শরীর নিজে নিজেই করে ফেলে। অনেক সময় আমরা জানতেও পারি না শরীরের স্বাভাবিক রাসায়নিক উপাদানের কী পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু যখনই শরীরের কোন সমস্যা শরীর নিজে নিজে ঠিক করে ফেলতে পারে না, তখন বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে শরীর সংকেত দিতে থাকে যে কোথাও কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে। তখন দরকার হয় চিকিৎসার। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়। রোগনির্ণয়ের জন্য বর্তমানে যেসব উন্নত বৈজ্ঞানিক রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার একটি হলো রেডিওইমিউনোএসে (radioimmunoassay) বা আর-আই-এ (RIA)। এই পদ্ধতির মাধ্যমে আমাদের শরীরের রক্ত এবং অন্যান্য তরল পদার্থের মধ্য অন্য কোন পদার্থ ঢুকে গেলে – তা যত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাণেই হোক না কেন – তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে, খাবারের সাথে, এবং আরো বিভিন্নভাবে আমাদের শরীরে অনবরত ঢুকছে রোগজীবাণু, ভাইরাসছাড়াও আরো অসংখ্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। রক্ত এবং অন্যান্য তরলের সাথে মিশে গিয়ে এগুলি সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। আর-আই-এ পদ্ধতিতে এই উপাদানগুলির উপস্থিতি এবং পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। আর-আই-এ পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি নতুন দিগন্ত খুলে যায়। সম্ভব হয় শরীরের বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা মেপে দেখার। কোন ওষুধ রোগীর শরীরে কাজ করছে কী না, ভিটামিন শরীরের উপাদানের সাথে মিশতে পারছে কি না, কিংবা ভাইরাস আক্রান্ত হলে তা কোন্‌ মাত্রায় কতটুকু ক্ষতি করছে এবং তার প্রতিষেধক দিলে তা কার্যকর হচ্ছে কি না সবকিছুই মেপে দেখা সম্ভব হয়েছে এই আর-আই-এ উদ্ভাবনের ফলে। ওষুধের সঠিক মাত্রা নির্ধারণে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে এই পদ্ধতি। ১৯৫৯ সালে এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন পদার্থবিজ্ঞানী রোজালিন ইয়ালো এবং ডাক্তার সোলোমন বারসন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য রোজালিন ইয়ালো পেয়েছেন ১৯৭৭ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার। অথচ কর্মজীবনের শুরুতে হতদরিদ্র মা-বাবার সন্তান রোজালিন একটি শিক্ষকতার চাকরি চেয়েও পাননি। কাজ শুরু করেছিলেন স্টেনোগ্রাফার হিসেবে। একাগ্রতা, অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে রোজালিন হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রথম সারির চিকিৎসা-পদার্থবিজ্ঞানী। 

ইহুদি মা-বাবার সন্তান রোজালিনের জন্ম নিউইয়র্ক শহরে ১৯২১ সালের ১৯ জুলাই। তাঁর মা-বাবা পূর্ব ইওরোপ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে কোনো রকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছিলেন রোজালিনের মা-বাবা। বড় কোন স্বপ্ন দেখার সাহসও তাঁরা দিতে পারেননি তাঁদের সন্তানদের। নিজেরা বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু বুঝতে পেরেছেন সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারলে জীবনসংগ্রামে তারা হেরে যাবে না। 

আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে পড়াশোনা করার অনেক স্কুল আছে। নিউইয়র্কের ব্রংকস-এর সাধারণ সরকারি স্কুলেই পড়াশোনা রোজালিনের। হাইস্কুলে রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হন রোজালিন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনার জন্যও তাঁকে খুঁজতে হয়েছিল বিনাবেতনে পড়াশোনা কোথায় করা যায়। নিউইয়র্কের হান্টার কলেজ ছিল নিউইয়র্ক সিটির মিউনিসিপালিটি পরিচালিত বিনাবেতনে পড়ার কলেজ, যেখানে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়া হতো। হান্টার কলেজে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা করতে এসে রোজালিনের ভালো লেগে যায় পদার্থবিজ্ঞান। মেরি কুরির সন্তান ইভ কুরির লেখা মেরি কুরির জীবনী তখন প্রকাশিত হয়েছে। সেই বই পড়ে রোজালিন নিজেকে মেরি কুরির আদর্শে তৈরি করার অনুপ্রেরণা পেলেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের রমরমা তখন শুরু হয়ে গেছে। সেই সময় নিউক্লিয়ার ফিশানের জনক এনরিকো ফার্মির লেকচার শোনার সুযোগ হলো রোজালিনের। পদার্থবিজ্ঞান,  বিশেষ করে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রতি গভীর ভালোবাসা তৈরি হলো রোজালিনের। মা-বাবা যতই বলুন যে একটা শিক্ষকতার চাকরি পেলেই চলবে, রোজালিন মনস্থির মনস্থির করে ফেলেছেন সুযোগ পেলে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাই করবেন জীবনে। ১৯৪১ সালে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান মেজর নিয়ে স্নাতক পাশ করলেন হান্টার কলেজ থেকে। 

কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা করতে গেলে তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাগবে, পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করতে হবে। পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য বৃত্তি লাগবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলেন রোজালিন। কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সরাসরি প্রত্যাখ্যানপত্র পেলেন তিনি। স্নাতকে এত ভালো রেজাল্ট করার পরও কোন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভর্তির সুযোগ দিচ্ছে না কেন জানতে গিয়ে উত্তর পেলেন – একে তো মেয়ে, তার উপর ইহুদি। শুধুমাত্র একারণেই তাঁর দরখাস্ত বাতিল করে দেয়া হচ্ছিল। 

তাঁর মা-বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে যদি কোনোভাবে লেখাপড়া শিখে কোনো একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পায় তাহলে কোনোরকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকতার জন্য দরখাস্ত করেও কোন ফল হলো না। অনেকে পরামর্শ দিলেন স্টেনোগ্রাফি শিখে নিলে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কেরানির চাকরি পাওয়া যেতে পারে। রোজালিন বাধ্য হয়ে তাই শুরু করলেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর রুডলফ শোয়েনহেইমারের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও সান্তনা এই যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের অফিসে বসে কাজ করছেন। 

অবশেষে একটা সুযোগ এলো রোজালিনের জন্য। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। আমেরিকার ছেলেদের অনেকেই যুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে অনেক সিট খালি থেকে যাচ্ছিল। তখন শূন্যতা পূরণ করার জন্য মেয়েদেরকে সুযোগ দেয়া হয়। সেই সুযোগে ইলিনয় ইউনিভার্সিটির আরবানা-শ্যামপেইন ক্যাম্পাসে গ্রাজুয়েট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান রোজালিন। ১৯১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে রোজালিনের আগে আর কোন মেয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়নি সেখানে। রোজালিন ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম মেয়ে শিক্ষার্থী। একটা অ্যাসিস্ট্যান্টশিপও পেয়েছিলেন তিনি। স্নাতক পর্যায়ের ফিজিক্সের ক্লাস নিতেন তিনি। তখন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির অধীনে। ফ্যাকাল্টির চারশ’র অধিক অধ্যাপক ও শিক্ষা-সহকারীর মধ্যে রোজালিনই ছিলেন একমাত্র মেয়ে। 

এখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় আরন ইয়ালোর সাথে। আরনও ছিলেন ইহুদি পরিবারের সন্তান। আরনের বাবা ছিলেন নিউইয়র্কের ইহুদি ধর্মযাজক। ১৯৪৩ সালে আরন ও রোজালিনের বিয়ে হয়। পরের চার বছরের মধ্যে তাঁদের দুই সন্তান – বেনজামিন ও ইলানার জন্ম হয়। অন্যান্য সব কাজের মতোই ঘরসংসারও খুব মনযোগ দিয়ে ভালোবেসে করতেন রোজালিন। 

১৯৪৫ সালে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পিএইচডি সম্পন্ন করেন রোজালিন। দুর্দান্ত ভালো রেজাল্ট করার পরও তিনি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোথাও কোন চাকরি পেলেন না। অনেক দরখাস্ত ব্যর্থ হবার পর প্রথম কাজ শুরু করলেন নিউইয়র্ক সিটির ফেডারেল টেলিকমিউনিকেশান কোম্পানিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে। তারপর হান্টার কলেজে যোগ দেন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে। এরপর ব্রোংক্‌স এর ভ্যাটেরান্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ভিএ) হাসপাতালের নিউক্লিয়ার মেডিসিনের গবেষক হিসেবে ১৯৪৭ সালে। এখানেই তিনি গবেষণা শুরু করলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে রেডিও-আইসোটোপের ব্যবহার সম্পর্কে। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে রেডিও-আইসোটোপের ব্যবহার তখন মাত্র শুরু হয়েছে। রোজালিন দেখতে পাচ্ছেন নিউক্লিয়ার মেডিসিনের বিপুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত। কিন্তু তাঁর একজন গবেষণা-সহযোগী দরকার যিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে জানেন। এই কাজের জন্য তিনি বেছে নেন ভিএ হাসপাতালে সদ্য যোগ দেয়া ইন্টার্নি ডাক্তার সোলোমন বারসনকে। ডাক্তার সোলোমন বারসনের সাথে রোজালিনের অচ্ছেদ্য গবেষণা-বন্ধন তৈরি হয়। পরবর্তী বিশ বছরেরও বেশি সময় তাঁরা একসাথে গবেষণা করেছেন। ১৯৭২ সালে ডাক্তার সোলোমন হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। 

১৯৫০ এর দশকের শুরুতে রোজালিন ও সোলোমন রক্তে আয়োডিন ও এলবুমিনের বিপাক প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। রোগীর শরীরে রেডিও-আইসোটোপ সংযুক্ত রাসায়নিক (রেডিওফার্মাসিউটিক্যাল) ইনজেকশানের মাধ্যমে প্রয়োগ করার পর রোগীর রক্তের তেজস্ক্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় সময়ের সাথে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা কীভাবে ক্রমশ কমে আসে। অতিদ্রুত কমে এলে বুঝতে হবে বিপাক প্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে, আর বিকিরণের হার যদি কম হয়, বুঝতে হবে বিপাক ধীরগতিতে হচ্ছে। 

ডায়াবেটিসের মূল কারণ যে ইনসুলিনের দ্রুত বিপাক – সেই ধারণা চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মনে এলেও তখনো তা প্রমাণ করার উপায় জানা ছিল না। রোজালিন ডায়াবেটিক রোগীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তিনি ডায়াবেটিক রোগীর শরীরে রেডিও-আইসোটোপের বিকিরণের হার পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে ইনসুলিনের বিপাকের হার অনেক বেশি। অর্থাৎ ডায়াবেটিক রোগীর শরীর থেকে ইনসুলিন দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি এবার রোগীদের দুভাগে ভাগ করলেন। একভাগকে ইনসুলিন ইনজেকশান দেয়া হলো। অন্যভাগকে ইনসুলিন দেয়া হলো না। দেখা গেলো যাদেরকে ইতোমধ্যে ইনসুলিন দেয়া হয়েছে তাদের রক্তের ইনসুলিন বিপাকের হার, যাদেরকে আগে ইনসুলিন দেয়া হয়নি তাদের রক্তের ইনসুলিন বিপাকের হারের চেয়ে অনেক কম। তার মানে দাঁড়ালো শরীরে ইনসুলিন দেয়া হলে সেই ইনসুলিন রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে যা ইনসুলিনের বিপাক-প্রক্রিয়ার হার কমিয়ে দিয়ে শরীর থেকে ইনসুলিন ক্ষয়ের অস্বাভাবিক মাত্রাকে স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই আবিষ্কার একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। কিন্তু রোজালিন ও সোলোমন যখন তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল দ্য জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশন-এ প্রকাশের জন্য পাঠালেন, জার্নালের রিভিউয়াররা তা সরাসরি বাতিল করে দেন। এই প্রত্যাখ্যানে একটুও দমে গেলেন না রোজালিন। বরং আরো উৎসাহ নিয়ে আরো অনেক বিস্তারিত গবেষণা তিনি করলেন। সেখান থেকেই আবিষ্কার করলেন আর-আই-এ পদ্ধতি। সেই প্রত্যাখ্যানের চিঠি তিনি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন সারাজীবন। বিশ বছর পর ১৯৭৭ সালে তিনি যখন তাঁর এই গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন, তাঁর নোবেল বক্তৃতায় তিনি সেই প্রত্যাখ্যানপত্র দেখিয়েছিলেন। 

রোজালিন শিক্ষাজীবনে রসায়ন পড়েছেন, নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে পিএইচডি করেছেন, কিন্তু  জীববিজ্ঞানের কোন কোর্স করেননি। অথচ তিনি নিজে নিজে পড়াশোনা করে এত বেশি ফিজিওলজি এবং মেডিসিনের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন যে তাঁর সমসাময়িককালের কোন ডাক্তারেরও এত জ্ঞান ছিল না। 

নোবেলজয়ী রোজালিনের গবেষণাগারটি ছিল অত্যন্ত সাধারণ। শুরু করেছিলেন হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঝাড়ু-বালতি ইত্যাদি পরিচ্ছন্নতা কাজের সরঞ্জাম রাখার একটা ছোট্ট ঘরকে গবেষণাগারে রূপান্তরের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তার কিছুটা উন্নতি হলেও খুব দরকারি যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কোন বাহুল্য সেখানে ছিল না। সেরকম রোজালিনও ছিলেন সারাজীবন সাদামাটা। নোবেল পুরষ্কার পাবার আগেও যা ছিলেন, পরেও তাঁর সহজ-সরল সাদামাটা জীবনযাপনের কোন পরিবর্তন হয়নি। সপ্তাহে সবাই যেখানে চল্লিশ ঘন্টার বেশি কাজ করেন না, রোজালিন সপ্তাহে আশি ঘন্টা কাজ করতেন। তাঁর ল্যাবের কাছেই ছোট্ট একটা বাড়িতে স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি থাকতেন। এত গবেষণার ফাঁকেও তিনি বাড়ির কাজ করতেন। প্রথম সন্তানের বয়স এক মাস হবার আগেই তিনি সন্তান কোলে নিয়ে ল্যাবের কাজে যোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয় সন্তানের বেলাতেও তাই করেছেন। দুপুরে ল্যাব থেকে বের হয়ে বাসায় গিয়ে শিশু সন্তানদের জন্য খাবার তৈরি করে খাইয়ে আবার ল্যাবে এসেছেন। তিনি নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলতেন, নারী ও পুরুষের মধ্যে শুধুমাত্র একটাই পার্থক্য আছে – সেটা হলো নারী সন্তান জন্ম দিতে পারে, পুরুষ পারে না। এছাড়া অধিকারের ক্ষেত্রে আর কোন পার্থক্য থাকা উচিত নয়। 

১৯৯১ সালে সত্তর বছর বয়সে হাসপাতালের গবেষকের চাকরি থেকে অবসর নিতে হয় তাঁকে। তারপর বেঁচে ছিলেন আরো বিশ বছর। তখনো তাঁর পড়াশোনা, গবেষণা থেমে থাকেনি। ২০১১ সালের ৩০ মে তাঁর জীবনাবসান হয়। 


তথ্যসূত্র – সিমন গ্লিক, ন্যাচার, সংখ্যা ৪৭৪, ২০১১; সিয়াং ইয়ং ট্যান, সিঙ্গাপুর মেডিক্যাল জার্নাল, সংখ্যা ৬০, ২০১৯; নোবেল পুরষ্কার ওয়েবসাইট। 

___________
বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত






Thursday, 30 September 2021

কীভাবে পাই এক্স-রে

 



১৮৯৬ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে আমেরিকার বিখ্যাত পিয়ারসন্স ম্যাগাজিনে বিজ্ঞানী বিলহেল্‌ম রন্টগেনের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটির কিছু অংশ এরকম: 
“কত তারিখের ঘটনা?”
“নভেম্বরের ৮ তারিখ”
“কী আবিষ্কার করেছেন?”
“আমি একটি ক্রুক্‌স টিউব নিয়ে গবেষণা করছিলাম। টিউবটিকে আমি কালো কার্ডবোর্ড দিয়ে চারদিক থেকে ঢেকে দিয়েছিলাম। একটি বেরিয়াম প্লাটিনো-সায়ানাইড পেপার রাখা ছিল বেঞ্চের উপর। ক্রুক্‌স টিউবের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালানোর সময় দেখলাম বেরিয়াম প্লাটিনো-সায়ানাইড পেপারে অদ্ভুত একটি কালো দাগ পড়েছে।“
“কিসের দাগ?”
“এরকম দাগ বেরিয়াম প্লাটিনো-সায়ানাইড পেপারে শুধুমাত্র  সরাসরি আলো প্রবেশ করলে পড়তে পারে। কিন্তু টিউব থেকে আলো আসার কোন উপায় ছিল না। কারণ আমি টিউবের চারদিক মোটা কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলাম। টিউবের ভেতর বিদ্যুৎ প্রবাহে স্ফূলিঙ্গ তৈরি হলেও তার কোন আলো বাইরে আসবে না।“
“তখন আপনি কী ভাবলেন?”
“আমি কিছু ভাবিনি। আমি অনুসন্ধান করেছি। আমি ধারণা করতে পেরেছিলাম যে টিউব থেকেই এটা এসেছে। আমি আরো পরীক্ষানিরীক্ষা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার আর কোন সন্দেহ রইলো না। টিউবের ভেতর থেকে কোন রশ্মি বের হয়ে এসে বেরিয়াম প্লেটিনো-সায়ানাইড পেপারে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কালো দাগ তৈরি করেছে। আমি টিউব থেকে পেপারের দূরত্ব অনেক বাড়ানোর পরেও, এমনকি দুই মিটার দূর থেকেও এই দাগ পাচ্ছিলাম। শুরুতে মনে হয়েছিল এটা একটি নতুন ধরনের অদৃশ্য আলো। এখন পরিষ্কার যে এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা কিছু যা আগে কখনো দেখা যায়নি।“
“এটা কি আলো?”
“না”
“এটা কি বিদ্যুৎ?”
“না, আমাদের চেনা বিদ্যুৎ নয়।“
“তবে এটা কী?”
“আমি জানি না।“
প্রফেসর রন্টগেন সেদিন জানতেন না তিনি কী আবিষ্কার করেছেন। জানতেন না বলেই এই অজানা রশ্মির নাম তিনি দিয়েছিলেন – এক্স-রে। কেউ কেউ তাঁর নামে  রন্টগেন-রে রাখতে চেয়েছিলেন এই রশ্মির নাম। কিন্তু তা টেকেনি। এক্স-রে নামই রয়ে গেছে। [জার্মান প্রফেসর বিলহেল্‌ম রন্টগেন ইংরেজি উচ্চারণে হয়ে যান উইলহেল্‌ম রন্টজেন। সেখান থেকে আমাদের বাংলা উচ্চারণে রন্টজেন কীভাবে যেন হয়ে গিয়েছে রঞ্জন। বাংলায় লেখা অনেক বইতে এক্স-রে’কে রঞ্জন রশ্মি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এক্স-রে’র প্রতিশব্দ হিসেবে রঞ্জন-রশ্মি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।]

এক্স-রে যখন আবিষ্কৃত হয় – ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে – তখনো কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের অনেক মৌলিক ব্যাপারই আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু এক্স-রে আবিষ্কারের পরপরই অনেক কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে – যার উপর দাঁড়িয়ে গেছে পুরো বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞান। ১৮৯৬ সালে ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী হেনরি বেকোয়ারেল আবিষ্কার করলেন রেডিও-অ্যাকটিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা। ১৮৯৭ সালে স্যার জোসেফ জন থমসন আবিষ্কার করলেন পদার্থের মৌলিক কণা ইলেকট্রন। পরীক্ষাগারে এক্স-রে আবিষ্কার করার কৌশল জানা হয়েছে ইলেকট্রন আবিষ্কারেরও আগে, অথচ পদার্থের পরমাণুর ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়ার ফলেই যে এক্স-রে উৎপন্ন হয় তা জানা গেছে আরো অনেক বছর পর – যখন কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব আস্তে আস্তে বিকাশ লাভ করতে শুরু করেছে। এক্স-রে আবিষ্কারের ১৬ বছর পর ১৯১১ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড প্রোটন আবিষ্কার করেন। তার দু’বছর পর নীল্‌স বোর পরমাণুর গ্রহণযোগ্য কোয়ান্টাম মডেল উপস্থাপন করেন। পরমাণুর গঠন এবং ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম ধর্ম থেকে আমরা এখন এক্স-রে কীভাবে উৎপন্ন হয় তা ব্যাখ্যা করতে পারি। 

এক্স-রে কী ধরনের রশ্মি তা সেদিন অজানা থাকলেও আজ আমরা এক্স-রে সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। এক্স-রে অতিউচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ। এর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য অত্যন্ত কম এবং শক্তি অত্যন্ত বেশি। এক্স-রে’র কম্পাঙ্ক ৩০০ কোটি কোটি হার্টজ থেকে ৩ লক্ষ কোটি কোটি হার্টজ পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ এই রশ্মিগুলি ১ সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কোটি কোটি তরঙ্গ তৈরি করতে পারে। এই তরঙ্গগুলির দৈর্ঘ্য অত্যন্ত কম – ১০ ন্যানোমিটারেরও কম (১ মিটারকে একশ কোটি ভাগ করলে এক ভাগের দৈর্ঘ্য হবে এক ন্যানোমিটার)। স্বাভাবিকভাবেই এত ছোট তরঙ্গ চোখে দেখা যায় না। এই এক্স-রে খুব সহজেই আমাদের শরীর ভেদ করে চলে যেতে পারে। যে কোন বস্তুর একদিকে ঢুকে অন্যদিকে বের হয়ে যেতে পারে। এক্স-রে কোন চার্জ বহন করে না। ফলে কোন ধরনের তড়িৎ-ক্ষেত্র বা চৌম্বক-ক্ষেত্রে বাধা পড়ে না। দৃশ্যমান আলো ও এক্স-রে একই তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ পরিবারের সদস্য হলেও এক্স-রে আলোর মতো প্রতিফলিত বা প্রতিসৃত হয় না।এক্স-রে’র কোন ভর নেই, তাই এক্স-রে পদার্থ নয়। এক্স-রে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কিংবা অনুভবও করা যায় না। এক্স-রে তৈরি করে কোথাও জমা করেও রাখা যায় না। এক্স-রে তৈরি করার সাথে সাথেই ব্যবহার করে ফেলতে হয়। 

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এক্স-রে’র ব্যবহার অনেক বাড়ছে। এখন এয়ারপোর্টের এক্স-রে চেকিং থেকে শুরু করে মহাশূন্যের এক্স-রে অবজারভেটরি পর্যন্ত এক্স-রে’র বহুবিধ ব্যবহারে আমরা অভ্যস্ত। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে এক্স-রের ব্যবহার যে কত প্রয়োজনীয় তা আমরা সবাই জানি। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে এক্স-রে’র সাহায্যে যে রেডিওগ্রাফ তৈরি করা হয়, সেটাকেই আমরা এক্স-রে বলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় চার-শ কোটি মেডিকেল এক্স-রে তৈরি করা হয় রোগ নির্ণয়ের জন্য। অর্থাৎ পৃথিবীতে গড়ে প্রতি দুইজন মানুষের মধ্যে একজনের শরীরে কমপক্ষে একবার মেডিকেল এক্স-রে প্রয়োগ করা হচ্ছে প্রতিবছর। [এক্স-রে’র ব্যবহার কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের ব্যবহারের চেয়েও অনেক বেশি। এই কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের আবিষ্কারকরা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষের তালিকায় একদম শুরুর দিকে থাকেন। কিন্তু এক্স-রে আবিষ্কারক বিজ্ঞানী রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কারের মেধাস্বত্ব বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর মানুষের জন্য। শেষ বয়সে ভীষণ অর্থকষ্টে ভুগে হতদরিদ্র অবস্থায় ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে এই বিজ্ঞানীর। সে যাই হোক, মহৎ হতে গেলে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়।]

একেক কাজের জন্য একেকভাবে এক্স-রে উৎপাদন করা হয়, যদিও এক্স-রে উৎপন্ন হওয়ার মূলনীতি সবক্ষেত্রে এক। দেখা যাক চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ-নির্ণয় করার জন্য ডায়াগনস্টিক এক্স-রে কীভাবে উৎপাদন করা হয়। এক্স-রে উৎপাদনের জন্য কোন ধরনের কাঁচামাল লাগে না। এক্স-রে মেশিনের যেখানে এক্স-রে উৎপন্ন হয় সেটা একটি বায়ুশূন্য টিউব। সেই ১৮৯৫ সালে রন্টগেন যেরকম বায়ুশূন্য ক্রুক্‌স টিউবে প্রথম এক্স-রে তৈরি করেছিলেন নিজের অজান্তে, এখন এই ১২৫ বছর পরেও একইভাবে এক্স-রে তৈরি করা হয়। কম্পিউটার এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে রেডিওগ্রাফ তৈরির পদ্ধতিটা বদলে গেছে। কিন্তু এক্স-রে উৎপাদনের পদ্ধতিতে কোন পরিবর্তন হয়নি। 





এক্স-রে টিউবের একদিকে থাকে ক্যাথোড বা ফিলামেন্ট। তার দুই সেন্টিমিটার দূরে থাকে অ্যানোড বা টার্গেট। ক্যাথোড় এবং অ্যানোডের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ-প্রবাহ চালনা করা হয়। এই ভোল্টেজ ৩০ হাজার ভোল্ট থেকে শুরু করে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে। এত উচ্চ ভোল্টেজ কোত্থেকে সাপ্লাই করা হয়? এক্স-রে মেশিনের সাথে হাই-ভোল্টেজ জেনারেটর থাকে। সেই জেনারেটর এই ভোল্টেজ সাপ্লাই দেয়। শুধুমাত্র এক্স-রে তৈরি হবার সময় জেনারেটর চালু হয়। এবং পুরো প্রক্রিয়ায় কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে না। ক্যাথোড ও অ্যানোডের মধ্যে তীব্র আকর্ষণের ফলে ক্যাথোডের ফিলামেন্ট থেকে কোটি কোটি ইলেকট্রন মুক্ত হয়ে অ্যানোডের দিকে ছুটে যায়। ভোল্টেজ যত বেশি হয়, ইলেকট্রনের গতিশক্তি তত বেশি হয়, ফলে তত বেশি জোরে গিয়ে অ্যানোডের গায়ে ধাক্কা দেয়। এই ইলেকট্রন এত জোরে এসে অ্যানোডের ইলেকট্রনের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে। অ্যানোডের পদার্থের পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস অনুযায়ী ইলেকট্রনগুলি বিভিন্ন শক্তিস্তরে থাকে। সবচেয়ে ভেতরের শক্তিস্তর – K কক্ষপথের ইলেকট্রনের সাথে যদি ফিলামেন্ট থেকে আগত ইলেকট্রনের সংঘাত হয় – তবে K কক্ষপথের ইলেকট্রন কক্ষচ্যুত হয়। তখন সেখানে একটা খালি জায়গা তৈরি হয়। এই জায়গা পূরণ করার জন্য K কক্ষপথের বাইরের কক্ষপথ L বা M বা N কক্ষপথের ইলেকট্রন হুড়োহুড়ি করে ভেতরের দিকে যায়। বাইরের কক্ষপথের ইলেকট্রনের শক্তি ভেতরের কক্ষপথের ইলেকট্রনের শক্তির চেয়ে বেশি। তাই বাইরে থেকে ভেতরের কক্ষপথে গিয়ে জায়গা দখল করলে সেই ইলেকট্রন তার অতিরিক্ত শক্তি ত্যাগ করে। যে শক্তিটা ত্যাগ করে – সেটাই হলো এক্স-রে। এই শক্তি বহন করে কোয়ান্টাম কণা ফোটন। যাকে বলা হয় এক্স-রে ফোটন। এভাবে কোটি কোটি ইলেকট্রন মিথস্ক্রিয়া ঘটায় সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে। এভাবে তৈরি হওয়া এক্স-রে কে বলা হয় ক্যারেক্টারিস্টিক এক্স-রে। এই ধরনের এক্স-রে’র শক্তি নির্দিষ্টমাত্রার থাকে। আরেক ধরনের এক্স-রেও তৈরি হয় একই সাথে – যার শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট নয়। সেটা কীভাবে হয়? এই যে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলেকট্রন ফিলামেন্ট থেকে বের হয়ে প্রচন্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে অ্যানোডের গায়ে, সেখানে পরমাণুর শক্তিস্তরের কোন ইলেকট্রনের সাথে যদি সংঘর্ষ না ঘটে তাহলে কী হয়? ইলেকট্রনগুলি তখন সব শক্তিস্তর অতিক্রম করে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের দিকে অগ্রসর হয়। নিউক্লিয়াস ধনাত্মক চার্জযুক্ত। ঋণাত্মক ইলেকট্রন স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে আকৃষ্ট হবে। কিন্তু নিউক্লিয়াস তো ইলেকট্রনকে কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দেয় না প্রয়োজনীয় শক্তি নেই বলে। তখন ইলেকট্রনের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর শক্তি বের হয়ে যায়। এই বের হয়ে যাওয়া শক্তিগুলিও এক্স-রে। এগুলিকে বলা হয় ব্রামস্টারলাং (জার্মান শব্দ – যার অর্থ ভেঙে যাওয়া বিকিরণ) এক্স-রে। এই ধরনের এক্স-রে’র পরিমাণই মূলত বেশি থাকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ইলেকট্রনের সাথে ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়াতেই এক্স-রে তৈরি হয়। যত বেশি ইলেকট্রন – যত বেশি জোরে গিয়ে ধাক্কা দিতে পারবে তত বেশি এক্স-রে তত বেশি শক্তি নিয়ে তৈরি হবে। 

ক্যাথোড থেকে বেশি ইলেকট্রন তৈরি করার জন্য সেখানে টাংস্টেন ফিলামেন্ট ব্যবহার করা হয়। কারণ এই ফিলামেন্ট প্রায় আড়াই হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও গলে না। আবার তার পারমাণবিক ভরও তুলনামূলক ভাবে বেশি (৭৪)। এক পরমাণু টাংস্টেনে ৭৪টি ইলেকট্রন থাকে। তাহলে এক ইঞ্চি ব্যাসের ফিলামেন্টে কোটি কোটি কোটি ইলেকট্রন থাকে। আবার অন্যদিকে অ্যানোডে টার্গেট হিসেবেও ব্যবহার করা হয় টাংস্টেন। এই অ্যানোড খুবই শক্ত এবং প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের ধাতব চাকতি যা মেশিন চালু অবস্থায় মিনিটে প্রায় কয়েক হাজারবার ঘুরতে পারে। এখানেও প্রচুর ইলেকট্রন। ফলে ফিলামেন্ট থেকে আসা ইলেকট্রনের সাথে অ্যানোডের ইলেকট্রনের ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এরকম প্রচন্ড সংঘর্ষের ফলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয় এখানে। টাংস্টেন সেই তাপ সহ্য করতে পারে। 

এক্স-রে থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটে। এই বিকিরণ যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এক্স-রে টিউব থেকে উৎপন্ন এক্স-রে রোগীর শরীরে একদিকে প্রবেশ করে অন্যদিকে বের হয়ে যায়। বের হয়ে যাবার সময় এক্স-রে গুলিকে ইলেকট্রনিক ডিটেক্টরে ধারণ করা হয়। সেখান থেকেই মূলত রেডিওগ্রাফ তৈরি করা হয়। এক্স-রে রোগীর শরীরের ভেতর দিয়ে আসার সময় কিছু অংশ শরীরের হাড় ও মাংসে শোষিত হয়। কী পরিমাণ শোষিত হয়েছে তার হিসেব থেকেই মানুষের ভেতরের চিত্র তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াগুলি এখন কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হয়ে যায়। 

Sunday, 19 September 2021

পাল্‌স অক্সিমিটারের পদার্থবিজ্ঞান

 



আমরা সবাই জানি – বেঁচে থাকার জন্য আমাদের অক্সিজেনের দরকার হয়। আমাদের সুস্থ শরীর বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে, এবং সেই অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে শরীরের প্রত্যেকটি কোষে পাঠায়। আমাদের শরীরে অক্সিজেন কেন দরকার হয়? অক্সিজেনের সরবরাহ না থাকলে, বা প্রয়োজনের চেয়ে কমে গেলে আমাদের কী অসুবিধা হয়? 

আমাদের শরীরের জীববিজ্ঞানিক মৌলিক উপাদান হলো – কোষ। আমাদের শরীরের সবকিছু এই কোষ দ্বারা গঠিত। আমাদের শরীরে গড়ে প্রায় ৭৫ ট্রিলিয়ন বা ৭৫ লক্ষ কোটি কোষ আছে। এক ফোঁটা রক্তেই আছে প্রায় ৫০ লক্ষ লাল রক্তকোষ। সামগ্রিকভাবে বলা চলে আমাদের শরীরের সমস্ত কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় এই কোষগুলির সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে। 

শরীরের প্রত্যেকটি কোষ সক্রিয় থাকার জন্য যে শক্তি লাগে তা নিজেরাই তৈরি করে। কোষ সক্রিয় থাকার অর্থ হলো শরীরে তার যে ভূমিকা তা সঠিকভাবে পালন করা এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর কোষ-বিভাজনের মাধ্যমে নতুন কোষ তৈরি করা। নতুন কোষ তৈরি হতে না পারলে আমরা দ্রুত মরে যাবো – কারণ স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন প্রায় ৭০ হাজার কোটি কোষের মৃত্যু হয় আমাদের শরীরে। নতুন কোষ এই মৃতকোষগুলির দায়িত্ব পালন করে। 

কোষের কাজ চলার জন্য যে শক্তি লাগে সেই শক্তি উৎপন্ন হবার জন্য দরকার হয় অক্সিজেনের। বেশ কয়েকটি ধাপে এই শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। আমরা যে খাবার খাই সেগুলোর রাসায়নিক উপাদানের সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। যেমন গ্লুকোজ অণুর সাথে অক্সিজেন অণুর বিক্রিয়ার ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় সেটাই কোষের কাজকর্ম করার শক্তি যোগায়। তার সাথে তৈরি হয় পানি এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এই পানিও শরীরের অনেক কাজে লাগে। আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমরা শরীর থেকে বের করে দিই।

কোষ তার দরকারি অক্সিজেন পায় রক্ত থেকে। আমাদের শরীরের রক্তসংবহনতন্ত্রে দুই ধরনের রক্তনালিকা আছে। এক ধরনের রক্তনালিকা অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে – তাদেরকে আমরা বলি ধমনী বা আর্টারি। আরেক ধরনের রক্তনালিকা কার্বন-ডাই-অক্সাইডযুক্ত রক্ত বহন করে – তাদেরকে আমরা বলি শিরা বা ভেইন। ধমনী কোষের মধ্যে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। আর কোষে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয় শিরা সেগুলো নিয়ে আসে ফুসফুসে। ফুসফুস রক্ত থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড আলাদা করে ফেলে। আমরা নিশ্বাসের মাধ্যমে সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড শরীর থেকে বের করে দিই।

সুস্থ থাকার জন্য আমাদের রক্তে প্রয়োজনীয় পরিমাণে অক্সিজেন থাকতে হয়। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপা হয় ধমনীর রক্ত পরীক্ষা করে। আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস বা এবিজি পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে মাপা যায় রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ। কিন্তু সেই পদ্ধতিটি খুব সহজ নয়। ধমনী থেকে রক্ত নিয়ে তা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করতে হয়। 

এর চেয়ে অনেক সহজ পদ্ধতি হলো খুবই ছোট্ট একটা যন্ত্র - পাল্‌স অক্সিমিটার - এর সাহায্যে রক্তের অক্সিজেনের পরিমাণ মেপে দেখা। এই যন্ত্রটি আঙুলে লাগিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ এবং হার্টবিট মাপা যায়। এর জন্য শরীর থেকে রক্ত নেয়ারও দরকার হয় না, কোন পরীক্ষাগারেরও দরকার হয় না। তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সাধারণ ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রক্তে অক্সিজেন সম্পৃক্তি বা ব্লাড অক্সিজেন স্যাচুরেশান পরিমাপ করা হয়।

রক্তের হিমোগ্লোবিন-ই মূলত অক্সিজেন বহন করে। তবে সব হিমোগ্লোবিন যৌগেই অক্সিজেন থাকবে এমন কোন কথা নেই। হিমোগ্লোবিনে যদি অক্সিজেন থাকে – তাদেরকে বলা হয় অক্সিজেনেটেড  বা অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিন। আর যেসব হিমোগ্লোবিনে অক্সিজেন থাকে না, তাদের বলা হয় ডি-অক্সিজেনেটেড বা অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিন। অক্সিজেন স্যাচুরেশান বা সম্পৃক্তি মূলত নির্দেশ করে রক্তের মোট হিমোগ্লোবিনে্র কতভাগ অক্সিজেন বহন করে।  একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্তে যত হিমোগ্লোবিন আছে তার সবগুলোতে যদি অক্সিজেন থাকে – তাহলে বলা যায় অক্সিজেন সম্পৃক্ততার পরিমাণ শতকরা ১০০ ভাগ, আর যদি মাত্র ৭০ ভাগ অক্সিজেনেটেড হিমোগ্লোবিন, আর ৩০ ভাগ ডি-অক্সিজেনেটেড হিমোগ্লোবিন থাকে, তাহলে অক্সিজেন সম্পৃক্ততা হবে ৭০%।

পাল্‌স অক্সিমিটার খুব সহজেই এই সম্পৃক্ততার পরিমাণ হিসেব করতে পারে। কীভাবে? পাল্‌স অক্সিমিটার একটি ছোট্ট ক্লিপের মতো আঙ্গুলের উপর আটকে দেয়া যায়। এর একদিকে থাকে পাশাপাশি  দুটো লাইট এমিটিং ডায়োড বা এল-ই-ডি লাইট সোর্স। এদের একটি লাল আলো দেয়- যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬০ ন্যানোমিটার। এই আলো আমরা খালি চোখেও দেখতে পাই। অন্য এল-ই-ডি থেকে ইনফ্রা-রেড বা অবলোহিত আলো নির্গত হয় – যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৪০ ন্যানোমিটার। অবলোহিত আলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। এই আলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের অংশ। ক্লিপের অন্যপ্রান্তে থাকে  আলোক-সংবেদী ডিটেক্টর যা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় (ইন্টারঅ্যাকশান) তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সমানুপাতিক হারে ইলেকট্রনিক সিগনাল উৎপন্ন করে।

আমাদের শরীরে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ প্রয়োগ করলে তার কিছুটা আমাদের শরীরে শোষিত হয়, আবার কিছুটা শরীর ভেদ করে অন্যদিকে বের হয়ে আসে। কতটুকু শোষিত হবে, কতটুকু নির্গত হবে তা নির্ভর করে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক এবং শক্তির উপর। দৃশ্যমান আলোর শক্তির চেয়ে এক্স-রে’র শক্তি বেশি। তাই এক্স-রে’র বেশিরভাগ শরীর ভেদ করে বের হয়ে আসে। কিন্তু দৃশ্যমান আলোর বেশিরভাগ শোষিত হয়। আবার একই শক্তি ও কম্পাঙ্কের তরঙ্গও শরীরের কোন্‌ কোষ কতটুকু শোষণ করবে তা নির্ভর করে কী পরিমাণ পদার্থ এবং কোন্‌ ধরনের পদার্থের ভেতর দিয়ে তা আসছে তার উপর। অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিনে  পদার্থের পরিমাণ অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের চেয়ে বেশি। তাই অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের চেয়ে অনেক বেশি আলো শোষণ করে। অক্সিজেনযুক্ত হিমোগ্লোবিন লাল আলো যতটুকু শোষণ করে তার চেয়ে  অনেক বেশি শোষণ করে অবলোহিত আলো। অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের শোষণ হয় উভয়ক্ষেত্রেই আনুপাতিকহারে কম।

অক্সিমিটারের ক্লিপ আঙুল চেপে ধরে। আঙ্গুলের মধ্যে শিরা এবং ধমনী দুটোই আছে। ধমনীর রক্তে অক্সিজেন থাকে। কিন্তু শিরার রক্তে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থাকে, সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডেও তো অক্সিজেন থাকে। তাহলে সেই অক্সিজেনও তো হিসেবে চলে আসার কথা। তাহলে শিরার রক্ত এবং ধমনীর রক্ত কীভাবে বুঝতে পারে অক্সিমিটার? শুধুমাত্র ধমনীর রক্তের অক্সিজেনই তো আমরা মাপতে চাই। এখানে ভূমিকা রাখে আমাদের হৃদপিন্ডের সংকোচন এবং প্রসারণ বা সিস্টোল এবং ডায়াস্টোল। হৃদপিন্ডের সংকোচনের সময় ধমনীর রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়, আবার প্রসারণের সময় ধমনীর রক্তের পরিমাণ কমে যায়। ফলে ধমনীতে রক্তের পরিমাণের উঠানামার তরঙ্গ তৈরি হয়। এই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ধমনীর পাল্‌স বা স্পন্দনের কম্পাঙ্কের সমান। এক মিনিটে কয়টা স্পন্দন হয় সেটাও হিসেব করা যায় ধমনীর রক্তের তরঙ্গের হিসাব থেকে। শিরার মধ্য দিয়ে রক্তপ্রবাহের পরিমাণের কোন তারতম্য ঘটে না। ফলে কোন তরঙ্গ সৃষ্টি হয় না। ধমনী ও শিরার রক্তপ্রবাহের মধ্যে যে তরঙ্গগত পরিবর্তন ঘটে তাকে প্লেথিস্মোগ্রাফিক ট্রেস বা সংক্ষেপে প্লেথ বলা হয়। পাল্‌স অক্সিমিটারের ফলাফল সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য এই প্লেথ খুব ভালো হতে হয়।

ধমনীর রক্তে অক্সিজেন সম্পৃক্ততার পরিমাপ করা হয় অক্সিজেনযুক্ত ও অক্সিজেনমুক্ত হিমোগ্লোবিনের অনুপাতের হিসেব করে। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি হলে লাল আলোর শোষণ বেশি হবে, নির্গমন কম হবে। ফলে ডিটেক্টর কম আলো শনাক্ত করবে। অবলোহিত আলোর শোষণ ঘটবে আরো বেশি। ডিটেক্টর অবলোহিত আলো শনাক্ত করবে আরো কম। তখন লাল আলো ও অবলোহিত আলোর অনুপাত হবে বেশ কম। একইভাবে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কম হলে শোষণ  কম হবে, নির্গমন বেশি হবে। ফলে ডিটেক্টরে শনাক্তকৃত লাল আলো ও অবলোহিত আলোর অনুপাত হবে বেশ বড়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ডিটেক্টরে শনাক্তকৃত লাল ও অবলোহিত আলোর অনুপাত অক্সিজেন সম্পৃক্ততার বিপরীত অনুপাতিক।

অক্সিমিটারের ক্লিপে লাল ও অবলোহিত আলোর এল-ই-ডি ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু ব্যবহারের সময় রুমে অন্য যেসব আলো থাকে – সেই আলোও আঙ্গুলে প্রবেশ করে। এখন সেই আলো কি অক্সিমিটারের রিডিং-এ সমস্যা করে? আসলে করে না। কীভাবে? অক্সিমিটারের ক্লিপে আঙুল রাখার পর প্রথম ধাপে লাল আলো জ্বলে। তখন রুমের আলো ও লাল আলো ডিটেক্ট করে ডিটেক্টর। তারপর দ্বিতীয় ধাপে অবলোহিত আলো জ্বলে। তখন ডিটেক্টর অবলোহিত আলো ও রুমের আলো ডিটেক্ট করে। তৃতীয় ধাপে লাল ও অবলোহিত আলো দুটোই বন্ধ থাকে। তখন শুধু রুমের আলো ডিটেক্ট করে ডিটেক্টর। অক্সিমিটারের ইলেকট্রনিক সার্কিট এই রুমের আলোর সিগনাল আনুপাতিক হিসাব থেকে বাদ দেয়। তাই রুমে কী আলো জ্বললো তাতে অক্সিমিটারের রিডিং-এ কোন সমস্যা হয় না। তবে আঙুলের নখে যদি গাঢ় রঙের নখপালিশ থাকে – অক্সিমিটারের রিডিং-এ সামান্য তারতম্য ঘটতে পারে। এই করোনাকালে অনেকেই শরীরে অক্সিজেন সম্পৃক্তির পরিমাণের দিকে নজর রাখছেন পাল্‌স অক্সিমিটারের সাহায্যে। সাধারণত সুস্থ শরীরে রক্তের অক্সিজেন সম্পৃক্ততা ৯৫%-এর বেশি থাকে।

ছবির উৎস: https://commons.wikimedia.org/wiki/File:OxyWatch_C20_Pulse_Oximeter.png

________________________

বিজ্ঞানচিন্তা অনলাইনে প্রকাশিত

Saturday, 28 August 2021

সি-টি স্ক্যানিং-এর উদ্ভাবক গডফ্রে হাউন্সফিল্ড

 



বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের যে উদ্ভাবনগুলি রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সি-টি (Computed Tomography) তাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ ইন্সটিটিউট অব রেডিওলজির বার্ষিক সম্মেলনে ব্রিটিশ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার গডফ্রে হাউন্সফিল্ড সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে ত্রিমাত্রিক এক্স-রে ইমেজ তৈরি করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতির নাম দিয়েছিলেন ‘কম্পিউটারাইজড অ্যাক্সিয়েল ট্রান্সভার্স স্ক্যানিং’ বা ক্যাট (CAT) স্ক্যানিং। সিটি স্ক্যানিং আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন গডফ্রে হাউন্সফিল্ড। আফ্রিকান আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান কোরম্যাকও এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন হাউন্সফিল্ডের সাথে।

ইংল্যান্ডের নটিংহামশায়ারের নিউআর্কে ১৯১৯ সালের ২৮ আগস্ট গডফ্রে হাউন্সফিল্ডের জন্ম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর বাবা একটি ফার্ম কেনেন যেখানে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট গডফ্রে’র শৈশব কাটে প্রাকৃতিক মুক্ত পরিবেশে। সবার ছোট হওয়াতে অনেকটাই স্বাধীনতা পেয়েছিলেন নিজের খেয়ালে যা খুশি করার। 

শৈশব থেকেই যন্ত্রপাতির প্রতি ভীষণ আগ্রহ জন্মে গডফ্রের। ফার্মে চাষবাসের জন্য অনেক রকমের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ছিল। একেবারে গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে শহুরে বিনোদনের ছিঁটেফোঁটাও সেখানে ছিল না। ফলে হাতে সময় ছিল প্রচুর। সেই সময়টা গডফ্রে কাজে লাগাতেন নানারকমের যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এজন্য একটা ল্যাবও তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা তাঁর। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে নিউআর্ক ম্যাগনাস গ্রামার স্কুলে পড়ার সময় তিনি  বৈদ্যুতিক রেকর্ড প্লেয়ার তৈরি করেন ফার্মে তার নিজের ল্যাবরেটরিতে বসে। 

স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে লন্ডনের গিল্ডস কলেজে ভর্তি হলেন রেডিও কমিউনিকেশান নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গডফ্রে রয়েল এয়ারফোর্সে যোগ দেন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত তিনি এয়ারফোর্সে কাজ করতে করতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেন। ক্রেনওয়েল রাডার স্কুলে রাডার মেকানিক্স শিখেন তিনি। এরপর সেই স্কুলেই পড়ান কিছুদিন। ১৯৪৫ সালে তাঁকে রয়েল এয়ারফোর্সের সার্টিফিকেট অব মেরিট দেয়া হয়। ১৯৪৬ সালে যুদ্ধশেষে তিনি এয়ারফোর্স ছেড়ে দেন। 

এরপর তিনি ভর্তি হন লন্ডনের ফ্যারাডে হাউজ ইলেকট্রক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ১৯৫১ সালে তিনি ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। 

পাস করার সাথে সাথেই হাউন্সফেল্ড ইংল্যান্ডের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড মিউজিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (ই-এম-আই গ্রুপ) গ্রুপে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই এক কোম্পানিতেই তিনি তাঁর কর্মজীবন শেষ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি কোম্পানির মেডিক্যাল সিস্টেম ডিভিশানের হেড হন, ১৯৭৬ সালে চিফ স্টাফ সায়েন্টিস্ট, ১৯৭৭ সালে কোম্পানির সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির সিনিয়র স্টাফ সায়েন্টিস্ট নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ থেকে ২০০৪-এ মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি কোম্পানির পরামর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 




ইএমআই ল্যাবে হাউন্সফিল্ড প্রথমে কাজ করেন রাডার সিস্টেম নিয়ে। এরপর কাজ শুরু করেন কম্পিউটার ডিজাইন নিয়ে। সেই ১৯৫০ এর দশকে কম্পিউটার প্রযুক্তি মাত্র শুরু হচ্ছিলো। হাউন্সফিল্ডের নেতৃত্বে সেই ১৯৫৮ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম ট্রানজিস্টর কম্পিউটার EMIDEC 1100 তৈরি হয়। কম্পিউটার ডাটা স্টোরেজ সিস্টেমের উপর প্রচুর গবেষণা করেন হাউন্সফিল্ড। 

১৯৬৭ সালে কম্পিউটারের অটোম্যাটিক প্যাটার্ন রিকগনিশান সংক্রান্ত গবেষণা করার সময় সর্বপ্রথম কম্পিউটেড টমোগ্রাফির প্রথম ধারণা আসে তাঁর মনে। কম্পিউটার আঁকা ছবির বিভিন্ন দিক যদি শনাক্ত করতে পারে, তাহলে এক্স-রের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের গতিপথও শনাক্ত করতে পারবে। সেই ধারণা থেকেই কাজ শুরু করেন তিনি। 

তাঁর আগেও অনেকে এরকম কিছু কাজ করেছিলেন। হাউন্সফিল্ডের উদ্ভাবনের পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে ১৯১৭ সালে অস্ট্রিয়ান গণিতবিদ ইয়োহান র‍্যাডন (Johann Radon) প্রমাণ করেন যে দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক কোন বস্তুর অসীম সংখ্যক প্রজেকশান (বা ফালি) থেকে গাণিতিকভাবে বস্তুটিকে পুনর্নির্মাণ (reconstruction) করা যায়। 

পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে এই পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী রোনাল্ড ব্রেসওয়েল বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ১৯৫৬ সালে একটি সৌরম্যাপ তৈরি করেছিলেন। আমেরিকান নিউরোলজিস্ট উইলিয়াম হেনরি ওলডেনডর্ফ ১৯৬১ সালে নরম টিস্যুর ত্রিমাত্রিক ইমেজিং-এর মডেল তৈরি করেছিলেন। 

১৯৬৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভুত আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান কোরম্যাক টমোগ্রাফির তত্ত্ব এবং ইমেজিইং-এর জন্য দরকারি গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। কোরম্যাকের এই তত্ত্ব এবং গাণিতিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে গডফ্রে হাউন্সফিল্ড উদ্ভাবন করেন কম্পিউটেড টমোগ্রাফি।

এক্স-রের মাধ্যমে মানুষের শরীরের ভেতরের যেসব ছবি তোলা হয়, সেগুলি সব দ্বিমাত্রিক। তাতে শরীরের ত্রিমাত্রিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা সামগ্রিক দ্বিমাত্রিক চিত্র পাওয়া যায়, তবে তা সম্পূর্ণ চিত্র নয়। যেমন একজন রোগীর ফুসফুসের এক্স-রে দেখে ডাক্তার বুঝতে পারেন সেখানে কোন অস্বাভাবিকতা রয়েছে কি না। কিন্তু ফুসফুসের ঠিক কোন্‌ গভীরতায় অস্বাভাবিকতা আছে, তা একটিমাত্র চিত্র থেকে বোঝা যায় না। যেমন একটা বইয়ের শুধুমাত্র প্রচ্ছদের ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই বইটি কত মোটা। 


সিটি স্ক্যানার


হাউন্সফিল্ড যে পদ্ধতিতে এক্স-রে চিত্র তৈরি করলেন তা প্রচলিত এক্স-রে চিত্রের চেয়ে ভিন্ন। প্রচলিত পদ্ধতিতে রোগীর একটি এক্স-রে তৈরির জন্য একদিক থেকে এক্স-রে প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সি-টিতে রোগীর চারদিক থেকে এক্স-রে প্রয়োগ করে অনেকগুলি ছবি একসাথে তুলে, সেই ছবিগুলি থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নতির সাথে এই প্রযুক্তি সরাসরি যুক্ত। তাই এই প্রযুক্তির নাম কম্পিউটেড টমোগ্রাফি। 

গ্রিক শব্দ ‘টমোস’ অর্থ স্লাইস বা ফালি। টমোগ্রাফি শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে সেই অর্থে – যেখানে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে এক্স-রে’র মাধ্যমে ফালি ফালি করে দেখা হয়। তারপর সবগুলি ফালির ছবি এক সাথে জোড়া দিয়ে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটিতে খুবই উচ্চমাত্রার জটিল গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটারের সফ্‌টওয়ার খুব সহজেই এই জটিল গণিতের সমাধান করতে পারে। কম্পিউটারের মাধ্যমে সবকিছু করা হয় বলে এই পদ্ধতির বেশ কয়েকটি নাম আছে। যেমন কম্পিউটারাইজড অ্যাক্সিয়েল টমোগ্রাফি বা ক্যাট, কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি, কিংবা কম্পিউটেড টমোগ্রাফি। বর্তমানে সার্বিকভাবে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা সি-টি নামটাই ব্যবহৃত হয়।

১৯৭২ সাল থেকে হাউন্সফিল্ডের নেতৃত্বে ই-এম-আই কোম্পানি সিটি মেশিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। সেই বছরই হাউন্সফিল্ডকে যুক্তরাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সর্বোচ্চ পুরষ্কার ম্যাকরবার্ট পুরষ্কার দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হন। ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর ১৯৮১ সালে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার নাইটহুড প্রদান করে। 

স্যার গডফ্রে কোনদিন বিয়ে করেননি। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। 

তথ্যসূত্র:
1. www.nobelprize.org
2. প্রদীপ দেব, চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা প্রকাশন (প্রকাশিতব্য)

Tuesday, 6 July 2021

স্টেথোস্কোপ

 

***


কোন মানুষের হাতে বা গলায় স্টেথোস্কোপ দেখলেই আমরা বুঝে নিই যে মানুষটি ডাক্তার। স্টেথোস্কোপ যন্ত্রটা যতটা ডাক্তার ও ডাক্তারির প্রতীক হয়ে উঠেছে, অন্যকোন চিকিৎসাযন্ত্র ততটা নয়। একেবারে সব রোগের চিকিৎসাতেই যে স্টেথোস্কোপ লাগে তা নয়, কিন্তু স্টেথোস্কোপ ছাড়া ডাক্তারকে কেমন যেন অসম্পূর্ণ মনে হয়। এই স্টেথোস্কোপ আসলে কী করে? এটা কানে লাগিয়ে ডাক্তাররা রোগীর শরীরের শব্দ শোনেন।  আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে বিভিন্ন ধরনের শব্দ বের হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস, হাঁচি, কাশি, নাক-ডাকা কিংবা সশব্দে গন্ধবোমা নির্গমনের কথা বাদ দিলেও আমাদের হৃৎপিন্ড যে শব্দ করে সেই শব্দ শুনে ডাক্তাররা বুঝতে পারেন সেখানে কোন সমস্যা আছে কি না। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে হৃৎপিন্ড এবং ফুসফুসের শব্দ পরিষ্কারভাবে শুনতে সাহায্য করে এই স্টেথোস্কোপ।

শরীরের শব্দ শুনে রোগ নির্ণয়ের ব্যাপারটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় অসকাল্টেশান (auscultation)। এই ব্যাপারটা হাজার বছরের পুরনো। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রিটাসের সময় থেকেই ডাক্তারটা রোগীর বুকে কান লাগিয়ে হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনে রোগ নির্ণয় করতেন। সতেরো শ পঞ্চাশ সালের দিকে ভিয়েনার এক ডাক্তার লিওপোল্ড অয়েনব্রুগার শুরু করলেন আরেকটি নতুন পদ্ধতি। তিনি রোগীর বুকের শব্দ শোনার পাশাপাশি বুকের বিভিন্ন জায়গায় টোকা মেরে সেই শব্দের প্রতিফলন শুনে শুনে হৃৎপিন্ডের সমস্যা কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে তা বুঝতে শুরু করলেন। লিওপোল্ডের বাবার একটা পানশালা ছিল যেখানে প্রচুর মদ বিক্রি হতো। লিওপোল্ড দেখেছেন তাঁর বাবা মদের পিঁপের গায়ে থাপ্পড় মেরে শব্দ শুনে বুঝে নিচ্ছেন পিঁপেয় কতটুকু মদ আছে। ভরা-পাত্র আর খালি-পাত্রের শব্দ যে এক হয় না তা আমরা সবাই জানি। এই ব্যাপারটা মানুষের শরীরের ব্যাপারেও খাটে। ভরা-পেটের শব্দ আর খালি-পেটের শব্দ এক হবে না। পেটে গ্যাস জমলে যে ধরনের শব্দ হবে, পানি জমলে শব্দ হবে তার চেয়ে ভিন্ন। ফুসফুস কিংবা হৃৎপিন্ডের স্বাভাবিক শব্দ ও অস্বাভাবিক শব্দ শুনে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি সেই তখন থেকেই ছিল। ডাক্তার রোগীর শরীরে কান লাগিয়ে সেই শব্দ শুনতেন।

১৮১৬ সালের একদিন প্যারিসের নেকার হাসপাতালের ডাক্তার রেনে লাইনেক বেশ বিপদে পড়ে গেলেন এক রোগীর হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনতে গিয়ে। তখন ইওরোপে যক্ষা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল অনেক বেশি। ডাক্তার রেনে লাইনেকের তরুণী রোগীর শারীরিক আয়তন বিশাল। তার বুকে কান লাগিয়ে যে শব্দ শোনা গেল তাতে রোগ-নির্ণয় করা গেলো না। ভালো করে কান লাগিয়ে শব্দ শোনারও কোন উপায় নেই। ফ্রান্সের মানুষ এমনিতেই নিয়মিত গোসল করে না। তার ওপর অসুস্থ হলে তো কথাই নেই। রোগীর গায়ের গন্ধে যেখানে কাছে যাওয়া যায় না, সেখানে বুকে কান লাগিয়ে ফুসফুসের শব্দ শোনা! কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না ডাক্তার লাইনেক।

পায়চারি করতে করতে হাসপাতালের বাগানের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন দুটো বাচ্চা ছেলে একটা লম্বা কাঠের দু'দিকে কান লাগিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। দু'জনের হাতে দুটো পিন। তারা পিন দিয়ে আঁচড় কাটছে কাঠের গায়ে আর সেই আঁচড়ের শব্দ শুনছে কাঠের অন্যপ্রান্তে কান লাগিয়ে। ডাক্তার লাইনেকের কাছে মুহূর্তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। বাতাসে শব্দের বেগ ঘন্টায় প্রায় ১,১৯৩ কিলোমিটার। পানিতে শব্দের বেগ ঘন্টায় প্রায় ৫,৩৮৫ কিলোমিটার। কিন্তু কাঠের ভেতর দিয়ে শব্দ অনেক বেশি বেগে যেতে পারে। কাঠের মধ্য দিয়ে শব্দের বেগ ঘন্টায় প্রায় ১৪,৪০০ কিলোমিটার। বাচ্চা ছেলেরা যেভাবে শব্দ শুনছে সেভাবেও তো রোগীর বুকের শব্দ শোনা যায়। ডাক্তার লাইনেক দ্রুত ওয়ার্ডে এলেন। তাঁর হাতে একটা মেডিকেল জার্নাল ছিল। সেটাকে গুটিয়ে একটা চোঙার মত করে একপ্রান্ত রোগীর বুকে ঠেকিয়ে অন্যপ্রান্তে নিজের কান লাগালেন। অনেক স্পষ্ট এবং জোরালো শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই মুহূর্তটি ছিল ডাক্তার রেনে লাইনেকের জন্য 'ইউরেকা' মুহূর্ত। জন্ম হলো স্টেথোস্কোপের।

ডাক্তার রেনে লাইনেক তাঁর আবিষ্কারের নাম স্টেথোস্কোপ রেখেছেন গ্রিক শব্দ স্টেথোস এবং স্কোপেইন এর সমন্বয় করে।  'স্টেথোস' শব্দের অর্থ বক্ষ বা বুক, আর 'স্কোপেইন' শব্দের অর্থ হলো খুঁজে দেখা। ডাক্তার লাইনেকের তৈরি প্রথম স্টেথোস্কোপটি ছিল ৩০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং দুই সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের একটি কাঠের সিলিন্ডার।

 

চিত্র: ডাক্তার রেনে লাইনেক রোগী দেখছেন তাঁর আবিষ্কৃত স্টেথোস্কোপ দিয়ে। (শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি)



এই সাধারণ একটি যন্ত্র দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি অসাধারণ কাজ করেছেন। পরবর্তী তিন বছর ধরে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে তিনি তাঁর স্টেথোস্কোপের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। বিভিন্ন ধরনের পদার্থ এবং বিভিন্ন দৈর্ঘ্য ও ব্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে দেখেছেন যে সবচেয়ে ভালো কাজ করে ২৫ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং সাড়ে তিন সেন্টিমিটার ব্যাসের ফাঁপা কাঠের সিলিন্ডার আকৃতির স্টেথোস্কোপ। পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এরকম কাঠের সিলিন্ডার আকৃতির স্টেথোস্কোপ চালু ছিল। ডাক্তার লাইনেক তাঁর স্টেথোস্কোপের সাহায্যে হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসের বিভিন্ন ধরনের রোগের শব্দ অনুসন্ধান করেন এবং তা বই আকারে প্রকাশ করেন ১৮১৯ সালে। ফুসফুস ও হৃৎপিন্ডের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় তাঁর এই বই ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের মাইলফলক।

এরপর মাত্র সাত বছর বেঁচে ছিলেন ডাক্তার লাইনেক। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যক্ষা রোগীর চিকিৎসা করতে করতে এবং যক্ষা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে করতে নিজেই যক্ষা রোগের শিকার হলেন তিনি। ১৮২৬ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

লাইনেকের মৃত্যুর পর তাঁর স্টেথোস্কোপের বিভিন্ন ধরনের বিবর্তন ঘটেছে। ১৮২৮ সালে সিলিন্ডারের একদিকে চোঙাকৃতি করা হলো যেন রোগীর শরীর থেকে বেশি মাত্রার শব্দ সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো যায়। আর অন্যদিকে কান পাতার জন্য সিলিন্ডারকে সরু করা হলো যেন শব্দ কানের বাইরে না যায়, বা বাইরের শব্দের সাথে মিশে না যায়। তখনো কিন্তু এক কানেই শব্দ শোনা যেতো। ১৮৪৩ সালে সিলিন্ডারের এক প্রান্তে সীসার নল লাগিয়ে একই সাথে দুই কানে শব্দ শোনার ব্যবস্থা করা হলো। ১৮৫৫ সালে রাবারের প্রচলন ঘটার পর স্টেথোস্কোপের গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৮৯৪ সালে স্টেথোস্কোপে যুক্ত হয় শক্ত ধাতব ডায়াফ্রাম - যার নাম দেয়া হয় ফোনেন্ডোস্কোপ। ১৯২৬ সালে বস্টনের বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ হাওয়ার্ড স্প্র্যাগ স্টেথোস্কোপে যুক্ত করেন বেল ও ডায়াফ্রাম যার মাধ্যমে ডাক্তার ইচ্ছে করলে কম কম্পাঙ্ক ও বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পারেন। তারপর প্রায় তিরিশ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের স্টেথোস্কোপের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।


চিত্রস্টেথোস্কোপের বিভিন্ন অংশ




শব্দের সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই চলে স্টেথোস্কোপের কাজকর্ম। স্টেথোস্কোপের চেস্ট-পিস বা বুকের অংশটিকে থাকে একটি বড় চাকতির আকৃতির ডায়াফ্রাম এবং তার সাথে লাগানো অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ফাঁপা বেল। ডায়াফ্রামটি বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ প্রেরণ করে, আর ফাঁপা বেলটি কম কম্পাঙ্কের শব্দ প্রেরণ করে। হৃৎপিন্ড বা ফুসফুসের শব্দ ডায়াফ্রাম ও বেলের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে তাদের সাথে লাগানো নলের মধ্য দিয়ে ডাক্তারের কানে পৌঁছায়। ডাক্তারের শ্রবণ শক্তির উপর নির্ভর করে রোগনির্ণয়। এটাই হলো প্রচলিত স্টেথোস্কোপের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। অনেক সময় খুব কম কম্পাঙ্কের শব্দ ডাক্তারের কানে নাও পৌঁছাতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগনির্ণয়ে সমস্যা হতে পারে।

ইতোমধ্যে আমাদের ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। সাউন্ড টেকনোলজি এখন পুরোটাই ডিজিটাল। সেক্ষেত্রে স্টেথোস্কোপ-ও আস্তে আস্তে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। হৃৎপিন্ড বা ফুসফুসের অতি কম মাত্রার শব্দও এখন যন্ত্রের মাধ্যমে শোনা সম্ভব। শুধু তাই নয়, সেই শব্দকে রেকর্ড করে রাখাও এখন সম্ভব হচ্ছে ডিজিটাল স্টেথোস্কোপের মাধ্যমে। এই ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ হৃদরোগে আক্রান্তদের রোগনির্ণয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। পৃথিবীর সব দেশেই হৃদরোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পৃথিবীতে প্রতি বছর যত রোগী মারা যায় তাদের শতকরা ৩১% হলো হৃদরোগী। হৃৎপিন্ডের সঠিক শব্দ শুনেই হৃদরোগের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ শব্দকে ইলেকট্রনিক সিগনালে রূপান্তর ঘটায়। তারপর সেই ইলেকট্রনিক সিগনালকে যেভাবে খুশি সেভাবে প্রসেস করা যায়। সেই সিগনাল কম্পিউটারে ট্রান্সফার করে রোগীর ফাইলে সংযুক্ত করা যায়। কোন ধরনের নয়েজ থাকলে তা ডিজিটাল সিগনাল প্রসেসিং-এর মাধ্যমে বাদ দেয়া যায়।


ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ

ডিজিটাল স্টেথোস্কোপের চেস্ট পিসে ডায়াফ্রাম ও বেলের সাথে সংযুক্ত থাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মডিউল: ডাটা একুইজিশান বা তথ্য সংগ্রহ, প্রি-প্রসেসিং এবং সিগনাল প্রসেসিং। ডাটা একুইজিশানের জন্য ছোট্ট মাইক্রোফোন এবং সেন্সর ব্যবহার করা হয়। এরা শব্দ সংগ্রহ করে তা ডিজিটাল সিগনালে পরিবর্তন করে প্রি-প্রসেসিং মডিউলে পাঠায়। প্রি-প্রসেসিং মডিউলে সিগনালে যদি কোন নয়েজ বা অবাঞ্ছিত অংশ থাকে তা বের করে নেয়। তারপর সেই বিশুদ্ধ সিগনালকে পাঠানো হয় প্রসেসিং মডিউলে। ব্লু-টুথ বা ওয়াই-ফাই এর মাধ্যমে এই সিগনাল পাঠানো যায়। সেখান থেকে সাউন্ড ফাইল আকারে তা রেকর্ড করা হয়। ডাক্তার সেই ফাইল শুনে রোগ-নির্ণয় করতে পারেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একই ফাইল বারবার শুনতে পারেন বা অনেকে মিলে শুনতে পারেন। ভবিষ্যতে রোগনির্ণয়ে ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ ব্যাপক ভূমিকা রাখবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

___________

বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত



*বিজ্ঞানচিন্তায় স্টেথোস্কোপকে কী কারণে 'স্টেথিস্কোপ' ছাপিয়েছে আমি জানি না। আমি যতদূর জানি গ্রিক শব্দ স্টেথোস্‌ যার অর্থ বক্ষ বা বুক। সেখান থেকেই স্টেথোস্কোপ। 

*** ডাক্তারের ছবিটি নেয়া হয়েছে https://www.publicdomainpictures.net/ থেকে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স এর আওতায় এই ছবি কপিরাইটমুক্ত। 

Saturday, 9 June 2018

পরীক্ষা ছাড়া মেডিকেল কলেজে ভর্তি - একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত


অতি সম্প্রতি (৮/৬/২০১৮) 'সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা' প্রবন্ধের শেষের দিকে প্রফেসর জাফর ইকবাল লিখেছেন, "এই বছর এইচএসসি পরীক্ষাটি ভালোভাবে শেষ হয়েছে। আমার ধারণা যদি আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে এই  এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলকে ব্যবহার করে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় সেটি গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে কোনো অংশেই খারাপ একটি প্রক্রিয়া হবে না। কলেজগুলোতে এই পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করা হয় এবং আমার ধারণা সেখানে চমৎকার একটি পদ্ধতি দাঁড়িয়ে গেছে। সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সহজ একটি সমাধান হতে পারে।"

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় প্রফেসর জাফর ইকবালের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। সরকার যদি তাঁর এই প্রস্তাব মেনে নেয়, তাহলে হিতে বিপরীত হবে বলে মনে হয়। ২০১২ সালে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য কোন পরীক্ষা নেয়া হবে না, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। সঙ্গত কারণেই সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা হয়েছিল এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এই লেখাটি সেই সময়ের।
  
পরীক্ষা ছাড়া মেডিকেল কলেজে ভর্তি - একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত

পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশে কোন একটা সিস্টেম ঠিকঠাক চললে তা বদলানোর কথা কেউ ভাবেও না। যে সব সিস্টেমে গলদ আছে - সেগুলোকেই খোলনলচে পাল্টে দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে হয় উল্টোটা। এখানে যেসব রাস্তা ভাঙাচোরা - সেগুলো সারাবছর ভাঙাচোরাই থাকে। সেসব রাস্তা মোটামুটি চলনসই - সেগুলোতে শুরু হয় খোঁড়াখুড়ি। এ অবস্থা যেমন আক্ষরিক অর্থে সত্যি - তেমনি প্রায়োগিক অর্থেও। যেমন - দেশের হাজারো সমস্যার সমাধান যেখানে জরুরিভিত্তিতে করা দরকার সেখানে সরকার উঠেপড়ে লেগেছে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে। যেন ওটাই প্রধান সমস্যা এবং তার সমাধান করতে পারলেই বাংলাদেশের আর কোথাও কোন সমস্যা থাকবে না।

এরকম কাজের সাম্প্রতিকতম সংযোজন - মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা না নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রী ও সচিব মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের সাথে একটা মিটিং করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন - এস-এস-সি ও এইচ-এস-সি'র রেজাল্টের ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। ঠিক কীভাবে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হবে যেখানে প্রায় লাখ খানেক ছাত্রছাত্রী সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েছে? বলা হচ্ছে এখনো সে ব্যাপারে কোন নীতিমালাই তৈরি করা হয়নি। তবে 'কারো প্রতি অবিচার করা হবে না' জাতীয় গালভরা বুলি আছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের নম্বর ও জি-পি-এ'র যে সমন্বয় নেই তার কী হবে? তার জন্য নাকি জেলা-কোটাই যথেষ্ট। সে যাই হোক - কেন হঠাৎ এরকম একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার দরকার হলো হাজার হাজার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উপর? এতদিন যে পদ্ধতিতে ভর্তি চলছিলো তাতে কি ত্রুটি ছিল?

অনেক বছর ধরে একটু একটু সংস্কার ও সমন্বয় করতে করতে মেডিকেল কলেজে ভর্তির যে ব্যবস্থাটা অর্জিত হয়েছিল তা সর্বজনগ্রাহ্য একটা কার্যকরী ব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছিল। অনেক আগে একেক মেডিকেল কলেজে একেক সময় ভর্তি পরীক্ষা হতো। তাতে যেসব সমস্যা ছিল সব কলেজে এক সাথে পরীক্ষা নিয়ে সে সব সমস্যার কিছুটা সমাধান করা হলো। তখন লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হতো। দেখা গেলো মৌখিক পরীক্ষায় কিছুটা দুনীর্তির সুযোগ রয়ে যায়। পরে মৌখিক পরীক্ষা উঠে গেল। তারপর লিখিত পরীক্ষা বদলে গিয়ে এম-সি-কিউ পদ্ধতি চালু হলো। সেখানেও যেন না জেনে আন্দাজে উত্তর দিয়ে 'ভাগ্যের জোরে' কেউ সুযোগ পেয়ে না যেতে পারে  - সেজন্য চালু হলো ভুল উত্তরের জন্য নেগেটিভ মার্কিং। ফলে পরীক্ষা পদ্ধতি হয়ে উঠলো আরো আধুনিক এবং যুক্তিপূর্ণ। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ চালু হবার পর থেকে সারাদেশের অর্ধ-শত বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির কোন সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি ছিল না। গতবছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকেও নিয়ে আসা হয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার অধীনে। ফলে সারাদেশে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে সমন্বিত মেডিকেল ভর্তি ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। তাহলে এ সুন্দর ব্যবস্থাকে একেবারে বন্ধ করে দেয়ার পেছনে যুক্তি কী?

যুক্তি যা দেখানো হচ্ছে তাতে পনের কোটি মানুষের একটা বিশাল দেশ যাঁরা চালান তাঁদের লজ্জা হওয়া উচিত। কিছু কোচিং সেন্টার নাকি ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এবং আরো বিভিন্ন উপায়ে নাকি ভর্তি-পদ্ধতিকে কলুষিত করেতাই ভর্তি-পরীক্ষা উঠিয়ে দিলে তাদের উচিত শাস্তি হবে। বাঃ কী সুন্দর সমাধান আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এবং জ্বি-হুজুর মার্কা মেডিকেল-অধ্যক্ষদের। পৃথিবীর সবদেশে যে IELTS, TOEFL, GRE, GMAT ইত্যাদি আন্তর্জাতিক পরীক্ষাগুলো হয় - তাতেও তো কিছু কিছু দেশের ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কথা ওঠে কৈ সে কারণে তো পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ার কথা তো কখনো শোনা যায় না বরং পরীক্ষা ব্যবস্থাটাকে কীভাবে আরো নিশ্ছিদ্র করা যায় তার ব্যবস্থা করা হয় ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ না করে যেসব কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া যায় না?

সারা পৃথিবীতে মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যাপারটাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় আমাদের দেশের কিছু কিছু 'উচ্চশিক্ষিত' আমলা বলেই ফেলেছেন যে পৃথিবীর কোন উন্নত দেশেই নাকি ভর্তি-পরীক্ষা নেয়া হয় না আমি জানি না তাঁদের কাছে উন্নত দেশের সংজ্ঞা কী আমেরিকা নিশ্চয় একটি উন্নত দেশ সেখানে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে গেলে MCAT - বা Medical College Admission Test স্কোর লাগে। এই টেস্ট পরিচালনা করে এসোসিয়েশান অব আমেরিকান মেডিকেল কলেজ বা AAMC MCAT স্কোর ছাড়া আমেরিকায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া যায় না। ইংল্যান্ডে UKCAT বা UK Clinical Aptitude Test দিতে হয়। অস্ট্রেলিয়ায় স্নাতক পর্যায়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য দিতে হয় UMAT বা Undergraduate Medical Admission Test, স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মেডিকেল কোর্সে ভর্তির জন্য দিতে হয় Graduate Medical School Admission Test (GMSAT). Australian Council for Educational Research (ACER)  এর তত্ত্বাবধানে এই টেস্ট এখন ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডেও প্রচলিত হয়েছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, বা অস্ট্রেলিয়ার স্কুল কলেজের নিয়মিত পরীক্ষাগুলোর ফলাফল তো প্রশ্নবিদ্ধ নয়। তবুও সেসব দেশে মেডিকেলে ভর্তির জন্য ভর্তি-পরীক্ষা দিতে হয়। আর আমাদের দেশে এক শ্রেণীর আমলা হঠাৎ বলতে শুরু করেছেন বোর্ডের পরীক্ষার চেয়ে 'এক ঘন্টার ভর্তি পরীক্ষা বেশি কার্যকরী নয়'। এমন তো নয় যে বোর্ডের পরীক্ষার কোন গুরুত্বই দেয়া হচ্ছে না। এস-এস-সি ও এইচ-এস-সি'র নম্বর থেকে একটা অংশ তো প্রচলিত ভর্তি পদ্ধতিতেই সংযুক্ত আছে। যদি বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে সরকারের সমস্যা হয়  বুয়েটের মত উচ্চ-মাধ্যমিকের গ্রেডের ভিত্তিতে মেধানুসারে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু ভর্তি-পরীক্ষাহীন ভর্তির সিদ্ধান্ত হবে ভীষণ গোলমেলে এবং  তৈরি হবে আরো অনেক নতুন দুর্নীতির সুযোগ, এবং ভর্তি-বাণিজ্য। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এখনি ত্যাগ করা দরকার।

14/08/2012
Melbourne, Australia

Monday, 4 June 2018

প্রসঙ্গ: আবুল বাজানদার


কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ব্যাপারে আমাদের মত কৃপণ আর কোন দেশে আছে কি না আমি জানি না। যদি কেউ আমাদের দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আমাদের উপকার করে্ন - আমরা শুরুতে কেঁদেকেটে চিৎকার করে তাঁর গুণগান করি। তারপর যখন তাঁর কাছ থেকে উপকার নেয়াটা আমাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় – তখন আমরা আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকি। কৃতজ্ঞতার ভার আমরা সইতে পারি না। এই ভার কমানোর জন্য আমরা গভীর মনোযোগে উপকারীর উপকারের পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে তা বের করার চেষ্টা করি। তেমন কোনকিছু খুঁজে না পেলে যে কোন ছুতোয় তাঁর বদনাম করতে শুরু করি।

বাংলাদেশের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আচরণের ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। ডাক্তাররা দিনরাত পরিশ্রম করে চিকিৎসা দিয়ে রোগীদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আর রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে ডাক্তারদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে শুরু করেন। রোগী যত বলেন, রোগীর আত্মীয়স্বজন বলেন তার দশগুণ। সুস্থ থাকার জন্য ডাক্তাররা রোগীকে যেভাবে জীবন-যাপন করতে বলেন, যেভাবে ওষুধ খেতে বলেন তা সেভাবে না মেনে – ডাক্তারের ওপর ডাক্তারি করতে করতে যখন অসুখের ডালপালা গজিয়ে ফেলেন – আবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেন। আর ‘কসাই’ ডাক্তাররা আবার সেই রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ভালো করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

ডাক্তারদের ব্যাপারে কতটুকু অকৃতজ্ঞ হওয়া যায় তার সাম্প্রতিক উদাহরণ আবুল বাজানদার – যাঁকে বৃক্ষমানব নামে চেনেন বাংলাদেশের মানুষ। আবুল বাজানদার Epidermodysplasia verruciformis (EV) বা Tree syndrome-এ আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। আবুল বাজানদারের দুই হাতের ত্বকে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়ে গাছের ঝোপের মতো হয়ে গিয়েছিল  সারা পৃথিবীতে বিরল এই রোগের এখনো কোন সুনির্দিষ্ট নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি।



চিকিৎসার আগে আবুল বাজানদার



ডাক্তার সামন্তলাল সেন এবং তাঁর ইউনিটের একদল বাংলাদেশি ডাক্তার গত আড়াই বছর ধরে অবিরাম চিকিৎসা দিয়েছেন আবুল বাজানদারকে। হাতে-পায়ে ২৪টি অস্ত্রোপচার করে তাঁকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছিলেন আমাদের ডাক্তাররা। এই রোগ জিনেটিক কিনা পরীক্ষা করার জন্য তার রক্ত ও অন্যান্য উপাদান দেশের বাইরে পাঠিয়ে পরীক্ষা করে আনিয়েছেন ডাক্তাররা। হাসপাতালে শুধুমাত্র আবুল বাজানদারের চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্য আলাদা যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করেছেন। আবুল বাজানদারের চিকিৎসার অগ্রগতি নিয়ে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রশংসা করা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন মেডিক্যাল নিউজে। 


অনেকগুলো অপারেশন ও সমন্বিত চিকিৎসার পর আবুল বাজানদার 


অথচ আমরা কী দেখলাম? আমরা দেখলাম আবুল বাজানদার হাসপাতাল থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন। অর্থাৎ পালিয়ে গেলেন। তাঁকে কেউ বেঁধে রাখেননি হাসপাতালে। কিন্তু তিনি চলে গিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের লোকদের বলতে শুরু করলেন – হাসপাতালে তাঁর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন ডাক্তাররা। বিবিসি বাংলায় আবুল বাজানদারের বলা কথা শুনলাম। সেখানে আবুল বাজানদার বললেন যে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে খাবার দেয়া হতো। আড়াই বছর ধরে চলেছে সেরকম। কিন্তু চারজনের খাবার নাকি আর দেয়া হবে না বলা হয়েছে তাকে। তাই তিনি চলে গেছেন।

হাসপাতালে রোগী ছাড়া আর কাউকে খাবার দেয়ার নিয়ম নেই। ডাক্তার সামন্তলাল সেন নিজের পকেট থেকে পয়সা দিয়ে গত আড়াই বছর ধরে আবুল বাজানদারের স্ত্রী ও সন্তানদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। হাসপাতালের মোটা চালের ভাত আবুল বাজানদার খেতে পারতেন না – তাই তাদের জন্য ডাক্তারদের ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে এনে দেয়া হতো। আবুল বাজানদার তাঁর থাকার ক্যাবিন নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন ক্যাবিনে এসি ছিল না – তাই তাঁর কষ্ট হয়েছে।

আমাদের ডাক্তাররা তাঁর জন্য যা যা করেছেন – আমি জানি না আর কোনদেশে কোন রোগীর জন্য ডাক্তাররা ব্যক্তিগতভাবে তেমন কিছু করেন কি না। উন্নত দেশে শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর দিতে হয় মোট আয়ের কমপক্ষে তিন থেকে চার পারসেন্ট। জনগণের দেয়া সেই টাকায় চিকিৎসার বাজেট হয়। একজন স্পেশালিস্টের প্রতি পনেরো মিনিটের ফি হলো কমপক্ষে আড়াইশ ডলার। আর আমাদের দেশের স্পেশালিস্টরা যে রোগীকে এবং রোগীর পরিবারকে নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে মুখে খাবার পর্যন্ত তুলে দেন – সেই রোগী হাসপাতাল ছেড়ে গিয়ে সেই ডাক্তারদের বদনাম করেন।

এতকিছুর পরেও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই – এই আবুল বাজানদার যখন আবার এসে হাসপাতালে ভর্তি হবেন – আমাদের ডাক্তাররা সবকিছু ভুলে গিয়ে চিকিৎসার হাত বাড়িয়ে দেবেন পরম মমতায় কসাই না হলে কি এমন করতেন!!


চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে  আবুল বাজানদারের অভিযোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের বক্তব্য পড়ুন এখানে:
http://www.banglatribune.com/others/news/330359/



Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts