This is a personal blog of
Dr Pradip Deb.
Our everyday sciences,
hobbies,
literature,
travel
and
many other human issues
are discussed here.
প্রদীপ দেবের ব্লগ।।
Pages
Thursday 31 May 2018
Wednesday 30 May 2018
Tuesday 29 May 2018
বিসিএস-এর আরেকটি অধ্যায়
বাংলাদেশে ভালো
কোন সিস্টেম তৈরি হতে দীর্ঘ সময় লাগলেও ভালো সিস্টেম ধ্বংস করে দিতে খুব বেশি সময়
লাগে না। বিসিএস পরীক্ষার কথা বলছি। ‘ভালো সিস্টেম’ বলতে যা বোঝায়
- বিসিএস পরীক্ষা ঠিক সেরকম ‘ভালো’ না হলেও একটা
পর্যায় পর্যন্ত তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ২৭তম বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে
যা ঘটলো এবং এখনো ঘটে চলেছে তাতে বিসিএস পরীক্ষার প্রতি আর আস্থা রাখা সম্ভব নয়। ভালো
পরীক্ষা দিয়ে সম্পূর্ণ মেধার জোরে বিসিএস পাস করতে পারার নিশ্চয়তা এখন আর কেউ দিতে
পারছে না। পরীক্ষা পদ্ধতির পুরোটাই এখন হয়ে পড়েছে অস্বচ্ছ গোলমেলে। অবশ্য এটাও ঠিক
যে বাংলাদেশের সব সরকারী ব্যাপারের মত বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতিও কখনোই তেমন স্বচ্ছ
ছিল না।
২৭তম বিসিএস
পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার ব্যাপারটা জানাজানি
হয়। মৌখিক পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতির কথা জেনে যায় সবাই। সবকিছুর পরেও রেজাল্ট
প্রকাশিত হয়। কিন্তু দুর্নীতির মাত্রা এতটাই বেশি ছিল এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোড়
হঠাৎ এতটাই ঘুরে গেলো যে ২৭তম বিসিএস এর
রেজাল্ট হজম করা সম্ভব হলো না। কিন্তু তাতে কী? আমাদের সিস্টেমের ফাঁকগুলো তাঁরা
ভালো করেই জানেন - যারা ওগুলো তৈরি করেছেন। তাই যেখানে লিখিত পরীক্ষার খাতা
পরিবর্তন করার প্রমাণ পাওয়া গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে -
সেখানে পুরো পরীক্ষাটা বাতিল না করে শুধু মৌখিক পরীক্ষাটা বাতিল করা হলো। আবার মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হলো। এবং তার পরের
ইতিহাস সবাই জানেন।
এখন সারাদেশে
২৭তম বিসিএস সংশ্লিষ্টরা দু’ভাগে বিভক্ত। যারা শেষের বার পাশ করেছেন - তারা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে চাকরিতে
যোগ দিচ্ছেন। আর যারা প্রথম বার পাশ করেছিলেন - কিন্ত দ্বিতীয়বার পাশ করতে পারেন
নি তাঁরা দিশেহারা হয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বস্তুবাদীরাও ‘ভাগ্য’কে মেনে নেয়ার কথা ভাবছেন। তাঁরা তাঁদের নিয়োগের দাবী
আদায়ের জন্য আত্মঘাতী পর্যন্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিভিন্ন রকম আশ্বাস
দিয়ে শান্ত করা হয়। কিন্তু এখন পিএসসি’র চেয়ারম্যান সাফ জানিয়ে দিলেন যে তাঁদের ব্যাপারে পিএসসি’র করার কিছুই নেই। এর আগে উপদেষ্টা
পরিষদে আলোচিত হয়েছে যে দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষা নেয়াটাই ভুল হয়েছিল। কিন্তু সে ভুল করার অনুমোদন
এই উপদেষ্টা পরিষদই দিয়েছিল। এটা যেন চিরকালীন সত্য যে ক্ষমতাবানরা ভুল করবেন আর
নির্দোষ ক্ষমতাহীন তার মাশুল গুণবেন।
এপর্যন্ত পড়ার
পর মনে হতে পারে যে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় যারা প্রথমবার পাশ করেছিলেন, কিন্তু
দ্বিতীয়বার পাশ করতে পারেননি তাদের প্রতি আমার নীতিগত সমর্থন আছে। এখন অবস্থা এমন
দাঁড়িয়েছে যে আমাদের সমর্থন বা বিরোধীতা অনেকটাই ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে গেছে।
প্রথম আলো ২৭তম বিসিএস বিষয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপানো শুরু করলে - নিয়োগ
প্রাপ্তদের মধ্যে এ বিশ্বাস প্রবল হয় যে প্রথম আলোর কোন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার আপনজন
এবার পাস করতে পারেন নি। তথ্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সংস্কৃতি
আমাদের মধ্যে এখনো নেই। তাই অনেকের মনে হতে পারে যে আমার কোন আপনজন এবার পাস করতে
পারেনি বলেই আমার এ লেখা। আসলে তা নয়। ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার সাথে আমার ব্যক্তিগত
কোন সম্পর্ক নেই। আমার সমর্থন বা বিরোধিতা ব্যক্তিগত কারণে নয়, নীতিগত কারণে।
আমি যারা
দ্বিতীয়বার পাশ করতে না পেরে আন্দোলন করছেন তাদের সমর্থন করতে পারছি না কোন ভাবেই।
কারণ দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সময়েই তাদের বোঝা উচিত ছিল যে তাঁরা
হয় পাশ করবেন - নয় ফেল করবেন। রেজাল্ট যাই হোক মেনে নিতে হবে। এটাই নিয়ম। এবার যদি
তারা পাশ করতেন - তাহলে তারা আন্দোলন করতেন না। এখানে নীতি কাজ করছে না - কাজ করছে
নিজেদের ব্যক্তিগত পাশ বা ফেল। এখানে এখন যতই আদর্শের কথা বলা হোক না কেন - সেগুলো
কাজ করেনি কখনো। এটা অবশ্যই স্বীকার করছি যে সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের
করার কিছুই ছিল না কখনো। তারা সরকারী সিদ্ধান্তের পুতুল। এখনো তাই। একবার তাদের
সামনে আশ্বাসের মুলো ঝুলানো হয় - আবার তা সরিয়ে নেয়া হয়। কাজে যুক্তি-নির্ভরতা কম
বলেই আন্দোলন কারীরা একদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজনও
করেছে। দুর্বল মানুষ অসহায় মুহূর্তে যুক্তি হারিয়ে ফেলে - এটাই স্বাভাবিক। তারা
তাদের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন যতটুকু পারা যায়। কিন্তু তাদের এ পরিস্থিতির মুখে যারা
ঠেলে দিলেন - তাদের অবস্থান কোথায়? যারা দুর্নীতি করে এই সিস্টেমের বারোটা
বাজিয়েছেন সেই পিএসসি মেম্বারদের কারো শাস্তি হয়েছে বলে তো শুনিনি।
বলা হলো বিসিএস
মৌখিক পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে - তাই আবার পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। যারা
দুর্নীতি করেছেন - তারা তো কমিটি মেম্বার বা কোন না কোন ভাবে পরীক্ষার সাথে
সংশ্লিষ্ট। তারা কি কোন শাস্তি পেয়েছেন? তাদের নাম কি জনগণ জানে? যে মৌখিক
পরীক্ষায় প্রথমবার দুর্নীতি হয়েছিল - দ্বিতীয়বার যে হয়নি তার গ্যারান্টি কী? যারা
প্রথমবার দুর্নীতি করে মনোনীত হয়েছিল বলে শুনেছি - তারা কি দ্বিতীয়বারও মনোনীত হন
নি? আসলে আইনের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে - কথার ফানুস উড়িয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশন যা খুশি
তাই করেছেন ২৭তম বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে।
২৮তম বিসিএস এর
প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ২৮ নভেম্বর। বলা হচ্ছে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের সব
কার্যক্রম শেষ হবে। আমরাও আশা করছি সেরকম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে পরীক্ষাতেও যে দুর্নীতি
হবে না - কারচুপি হবে না তার গ্যারান্টি কী? দুর্নীতি করার সব সুযোগ বহাল রেখে
শুধু মাত্র আশা করলেই কি সব হয়ে গেলো? মৌখিক পরীক্ষা এখনো পাস-ফেল নির্ভর। লিখিত
পরীক্ষায় ১০০% নম্বর পাবার পরও কাউকে
মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো সম্ভব। এবং তার জন্য ফেল করা পরীক্ষার্থীর আইনগত ভাবে
কিছুই করার নেই। তিনি কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবেন না যে তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল
করানো হয়েছে।
বিসিএস
পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষা বিষয়ে আমি একাধিক বার লিখেছি মনের তাড়নায়। বলেছি মৌখিক
পরীক্ষার অংশটুকু রেকর্ড করে রাখা দরকার। তাতে পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষক উভয়ের
কথোপকথনেরই রেকর্ড থাকবে। সবচেয়ে ভালো হতো যদি মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেয়া
হতো। কারণ মৌখিক পরীক্ষায় প্রার্থীর সার্বিক যোগ্যতা যাচাই করা অসম্ভব। যদি
প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব বা সনদপত্র ইত্যাদি যাচাই করার জন্য সাক্ষাৎকার জরুরী হয়ে থাকে - তাহলে সেই সাক্ষাৎকারে কোন নম্বর থাকা উচিত নয়, পাস/ফেল থাকা উচিত নয়।
তারপরও পিএসসি যদি মনে করে যে মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতেই হবে - তাহলে অন্তঃত
মৌখিক পরীক্ষায় আলাদা ভাবে পাশ করার ব্যবস্থাটুকু যেন তুলে নেয়া হয়। নইলে মৌখিক
পরীক্ষার ফাঁদে ফেলে অপছন্দের কাউকে বাদ দেয়ার কাজ আগেও হয়েছে - ভবিষ্যতেও হবে।
বিসিএস মৌখিক পরীক্ষা
সম্পর্কে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা একটু বলতে হয় এখানে। ষোড়শ বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা
ছিল সরকারী কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগের পরীক্ষা। পাস করবোই এরকম আত্মবিশ্বাস আমার
ছিল। কারণ সে পরীক্ষায় প্রিলিমিনারী আর অনার্স ও মাস্টার্সে প্রাপ্ত নম্বর যোগ
করার পর মৌখিক পরীক্ষায় পাস-ফেলের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। অনার্স ও
মাস্টার্সে যে নম্বর পেয়েছিলাম এবং প্রিলিমিনারী পরীক্ষা যেমন দিয়েছিলাম - তাতে
মৌখিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র পাস মার্ক পেলেও আমার বিসিএস পাস করার কথা। কিন্তু সেরকম
হয়নি। মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে কী কী প্রশ্ন করা হয়েছে এবং কেমন হেনস্তা করা হয়েছে তা
নাইবা বললাম। আমার মত আরো অনেকের এই অভিজ্ঞতা আছে। একথা সবাই জানেন যে যখন যে
সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সে সরকারের লোক পি-এস-সির কমিটিগুলোতে থাকেন। যখনকার কথা
বলছি তখন বিএনপি’র হাত ধরে
জামায়াত ক্ষমতায়। মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে সাবজেক্ট ভিত্তিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার চেয়ে
প্রশ্নকর্তাদের বেশি উৎসাহ দেখা গেলো আমার
ধর্মীয় পরিচয় আর বিশ্বাস প্রসঙ্গে। আমার মা-বাবা হিন্দু এটা হয়তো গ্রহণযোগ্য ছিল
তাঁদের কাছে। কারণ আমি নিজের ইচ্ছায় জন্মাইনি। কিন্তু নিজের যুক্তিতেই আমি
নাস্তিক। উপাসনা ধর্মে আমার অবিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার ধারণা আমার কাছে অর্থহীন, অলৌকিক কোন কিছুর প্রতি
প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই - এসব তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। রেজাল্ট বেরোলে দেখা
গেল আমি ফেল। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করেও অনেকে বিসিএস
পাস করে ফেললো, আর আমি ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েও বিসিএস পাস
করতে পারলাম না! ইউনিভার্সিটি আমার মত একটা গাধাকে ফার্স্ট ক্লাস দিলো কীভাবে? এরকম
ব্যাপার অহরহ ঘটছে বাংলাদেশে। সুতরাং আবার চেষ্টা। ১৯৯৮ সালে ১৮তম বিসিএস-এর মৌখিক
পরীক্ষা দিলাম। তখন আওয়ামী সরকারের প্রথমার্ধ। শুয়েপড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে কিছুটা
হলেও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করার চেষ্টা করা হচ্ছিল তখন। মৌখিক পরীক্ষায় তখন
ব্যক্তিগত বিষয়ে কোন প্রশ্ন করা হয়নি দেখে খুব ভালো লেগেছিল। সে বিসিএস পরীক্ষায়
আমি বেশ ভালো ভাবেই পাস করেছিলাম। তবে সরকারী চাকরি আমার করা হয়নি - কারণ নিয়োগ
পাবার আগেই আমি মেলবোর্নে চলে এসেছিলাম উচ্চতর শিক্ষা নেয়ার জন্য। এই হলো বিসিএস
পরীক্ষার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
বিসিএস পরীক্ষা
আমাদের মত নিম্ন সামর্থ্যের মানুষের জন্যও মাঝে মাঝে আশার আলো দেখায়। সবাই না হলেও
একটা বৃহত্তর অংশ এখনো মেধাকে সম্বল করেই প্রতিযোগিতায় নামেন। তাই ব্যবস্থায়
কিছুটা গলদ থাকলেও পুরো ব্যবস্থার প্রতি এতটা অবিশ্বাস আগে কখনো ছিল না। কিন্তু
এখন বিসিএস পরীক্ষা হয়ে গেছে একটা লটারির মত। পরীক্ষাতো ভালো হতেই হবে - তারপরও
কখন কী হবে কেউ জানে না। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। শুধুমাত্র আই-ওয়াশ করা নয়।
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মত পরিবর্তন দরকার। সে ব্যাপারে আমার একান্ত
নিজস্ব কিছু প্রস্তাব আছে। প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় যে নেগেটিভ মার্কিং এর ব্যবস্থা
করা হয়েছে এবার থেকে - তাকে আমি স্বাগত জানাই। লিখিত পরীক্ষা যে রকম আছে সেভাবেই
থাকতে পারে। মৌখিক পরীক্ষায় আলাদা ভাবে পাস করার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হোক।
পরীক্ষা কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ করা হোক। পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক প্রাপ্ত
নম্বর প্রকাশ করা হোক। অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীরও জানার অধিকার আছে কোন বিষয়ে কত
পেলেন। কোটা-ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ নীতি-মালা প্রকাশ করা হোক যাতে নিয়োগ
প্রদানের বিষয়টি সবার কাছেই বোধগম্য হয়।
পুরো বিষয়টা
নিয়ে যত সহজে লেখা যায়, প্রস্তাব করা যায় - তত সহজে কিন্তু প্রয়োগ করা যায় না। আমি
আশা করি বিসিএস পরীক্ষায় আস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা দ্রুত করা হবে। ২৮তম বিসিএস
পরীক্ষা হবে আস্থা ফিরিয়ে আনার পরীক্ষা। তারপর থেকে ব্যবস্থাটি আরো উন্নত থেকে
উন্নততর হবে। কিন্তু কে জানে - হয়তো নতুন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার
পেছনে হাঁটা শুরু হবে।
২৭ নভেম্বর
২০০৮
মেলবোর্ন,
অস্ট্রেলিয়া
Labels:
বাংলাদেশ,
বিসিএস পরীক্ষা,
শিক্ষা
বিসিএস পরীক্ষা প্রসঙ্গে দুটো কথা
বিসিএস পরীক্ষা
নিয়ে যে জট লেগেছে তা যেন কিছুতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না। ২৭ তম বিসিএস পরীক্ষায় ব্যাপক
কারচুপি হয়েছে বলে প্রমাণিত হওয়ায় প্রকাশিত ফলাফল বাতিল করে আবার মৌখিক পরীক্ষা
নেয়া হয়েছে প্রায় বছর খানেক ধরে। এর মধ্যে ২৮তম বিসিএস পরীক্ষার আবেদন পত্র জমা
নেয়া শেষ হয়েছে - তাও চার মাস হয়ে গেছে। ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্টের ব্যাপারে
মামলা চলছিলো, তাই রেজাল্ট দেয়া যাচ্ছিলো না বলা হচ্ছিলো পাবলিক সার্ভিস কমিশনের
পক্ষ থেকে। সে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তাও প্রায় দু’মাস আগে। এখনো ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা
হচ্ছে না। ২৮তম বিসিএস পরীক্ষার কার্যক্রমও শুরু করা হচ্ছে না। দেশের লক্ষাধিক
উচ্চশিক্ষিত কর্মপ্রার্থী অপেক্ষা করে আছেন - কখন বিসিএস পরীক্ষা হবে - কখন
কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারবেন।
বিসিএস পরীক্ষা
পদ্ধতির সংস্কার করে কিছুটা আধুনিক করা হয়েছে বলা হচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যা রয়েই
যাচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষার প্রধান দুর্বলতা এর মৌখিক পরীক্ষা পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে মৌখিক
পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে অনেক দিন আগেই। ২৭তম বিসিএস
পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফল বাতিল করে নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। এই মৌখিক
পরীক্ষাও যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ফলাফল প্রকাশিত
হওয়ার পর। শুধুমাত্র ভাইভা-বোর্ডের সদস্য পরিবর্তন করলেই কি সব ঠিক হয়ে গেলো?
বিসিএস পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষা এখনো পাস-ফেল নির্ধারণী পরীক্ষা। মৌখিক পরীক্ষার
পাস-মার্ক না পেলে লিখিত পরীক্ষায় ফুল-মার্ক পেলেও প্রার্থী ফেল করবে। সে ক্ষেত্রে
মৌখিক পরীক্ষার মোট নাম্বার কত করা হলো তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। একজন
পরীক্ষার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো খুবই সহজ একটি কাজ, তেমনি সহজ পাস করানো।
লিখিত বা মনস্তাত্ত্বিক বা শারীরিক যোগ্যতা পরীক্ষার রেকর্ড থাকে। কিন্তু মৌখিক
পরীক্ষায় শুধু প্রার্থীর প্রাপ্ত নম্বর ছাড়া আর কোন রেকর্ড থাকে না। একজন
পরীক্ষার্থীকে কী কী প্রশ্ন করা হলো - পরীক্ষার্থী কী উত্তর দিলেন - কোন কিছুরই
কোন রেকর্ড থাকে না। সেক্ষেত্রে সকল পরীক্ষার্থীর প্রতি সমান আচরণ করার ব্যাপারটি
রক্ষিত হয় না। সহকারী সার্জন হবার জন্য যে ডাক্তার পরীক্ষা দিতে এসেছেন - তাঁকে ফরাসী
প্রেসিডেন্ট সারকোজির বান্ধবীর নাম না জানার অপরাধেও ফেল করানো সম্ভব। কারণ
অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর পক্ষে প্রমাণ করার কোন উপায় নেই যে তাঁকে অপ্রাসঙ্গিক
প্রশ্ন করা হয়েছে। আবার সব প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে দেয়ার পরও যদি অন্য কোন কারণে
(ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক আদর্শ ইত্যাদি) প্রার্থীকে ফেল করানো হয় -
তাহলেও কারো কিছু বলার থাকে না। কারণ পরীক্ষার্থীর প্রশ্নোত্তরের কোন রেকর্ড থাকে
না।
বিসিএস মৌখিক
পরীক্ষাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ব্যবস্থা না করে বার বার পরীক্ষা নিয়ে আসলে যা
করা হচ্ছে তা হলো বই-এর টেক্সট ঠিক রেখে কভার বদলানোর মত। বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার
প্রশ্নোত্তর রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা করা যায় খুব সহজেই। প্রতিজন পরীক্ষার্থীর জন্য
যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় বরাদ্ধ করা হয় এবং বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন-কাঠামো থাকে -
তাহলে পরীক্ষার্থীর সাথে পরীক্ষকদের কথোপকথন টেপ করে রাখলেই হলো। আই-ই-এল-টি-এস
পরীক্ষার স্পিকিং অংশ যেভাবে রেকর্ড করা হয় - সেভাবে রেকর্ড করার জন্য কোন উন্নত
প্রযুক্তিরও দরকার নেই। যে কোন টেপ-রেকর্ডার, অডিও টেপ আর ব্যাটারি হলেই চলে। ২৮তম
বিসিএস পরীক্ষার ফরম এর মূল্য বাবদ দুশ’ টাকা এবং ফরম জমা দেয়ার সময় পাঁচশ’ টাকা - মোট
সাতশ’টাকা করে নেয়া হয়েছে প্রতিজন
পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে। এর খুব সামান্য অংশ খরচ করলেই মৌখিক পরীক্ষার কথোপকথন
রেকর্ড করা সম্ভব।
২২/১/০৮ তারিখে
প্রকাশিত বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তির ১৯ নম্বর ধারায় প্রার্থীদের স্বাস্থ্যগত
যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে কোন পুরুষ প্রার্থীর উচ্চতা পাঁচ ফুটের কম এবং কোন
মহিলা প্রার্থীর উচ্চতা চার ফুট দশ ইঞ্চির কম হলে “তাঁরা কোন ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য শারীরিকভাবে যোগ্য
বলে বিবেচিত হবেন না”। এই ধারাটি
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। তাছাড়া
প্রযুক্তিগত উন্নতির এই যুগে শারীরিক উচ্চতা কোন কাজের জন্যই একটি পূর্বশর্ত হতে
পারে না। একজন ছেলে বা মেয়ে যে কোন উচ্চতা নিয়েই যদি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের
উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে আসতে পারে - তাহলে সরকারি কাজের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবার
তো কথা নয়। এখন অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার মত দেশে সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্যও
শারীরিক উচ্চতার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়েছে। বিসিএস পরীক্ষায় শারীরিক উচ্চতার
শর্তটি তুলে নেয়া উচিত।
2008
Melbourne
Labels:
বাংলাদেশ,
বিসিএস পরীক্ষা,
শিক্ষা
Saturday 26 May 2018
বিশ্বাস ও বিজ্ঞান
১
সেদিন
এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গিয়ে আলাপ হলো একজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের সাথে। আলাপ ঠিক নয়,
তিনিই বলছিলেন সবকিছু, আর আমরা শুনছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, "এই বিশ্বব্রহ্মান্ড গাছপালা মানুষ পশুপাখি নদীর
স্রোত গানের সুর সব সব কিছু সৃষ্টি করেছেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান ঈশ্বর।"
আজকাল এরকম কথার বিরোধিতা করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়।
কিন্তু ভদ্রলোক একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অধ্যাপক। বিশ্ববিখ্যাত
বৈজ্ঞানিক জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। কয়েকটা প্যাটেন্টও আছে তাঁর
নামে। তিনি কি সেগুলোও ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছেন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,"ঈশ্বরই যদি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে
ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলেন কে?"
তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, "ঈশ্বরই ঈশ্বরকে
সৃষ্টি করেছেন। আগে তিনি নিজেকে বানিয়েছেন, তারপর অন্যান্য সবকিছু। একটার পর একটা। ওয়ান বাই ওয়ান।"
আমি বললাম, "ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সৃষ্টি না
হয়ে সৃষ্টিকর্তা হলেন কীভাবে? তিনি কি সবসময়েই ছিলেন, মানে সবকিছু সৃষ্টির আগে
থেকেই?"
"ইয়েস, তাই তো বলছি।"
"বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আগে তিনি কোথায় থাকতেন?
কী করছিলেন?"
"তিনি নরক বানাচ্ছিলেন – তোদের মত নাস্তিকদের থাকার
ব্যবস্থা করতে। যত্তসব। দুপাতা বিজ্ঞান পড়েই মনে করছিস সবকিছু জেনে বসে আছিস! আমি তোদের মতো হাজার হাজার বিজ্ঞানের ছাত্রকে পড়াই। আরে
ব্যাটা – বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।"
এরপর আর কথা বাড়ানোর অর্থ হয় না। কারণ এরকম অন্তঃসার
শূন্য তর্কবিতর্কের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। উপাসনা-ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রশ্নে
অবিশ্বাসের ছায়া দেখলেই উপাসনা-ধর্মে বিশ্বাসীরা খুব রেগে যান। বিশ্বাসের মতো
তাঁদের রাগটাও অযৌক্তিক। বিশ্বাসের ভিত্তি শক্ত না হলে রাগ দেখানোই আত্মরক্ষার সহজ
উপায়। রাগ দেখানোর পদ্ধতিটি অবশ্য একেক জনের কাছে একেক রকম - ক্ষমতা ও সু্যোগ ভেদে তা সম্পর্কচ্ছেদ থেকে
শিরচ্ছেদ পর্যন্ত হতে পারে।
২
ধর্মবিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানবিশ্বাসের কোন মিল নেই। উপাসনা-ধর্মের
পুরোটাই বিশ্বাস নির্ভর। কোন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা বা কার্যকারণের সাথে তার
সম্পর্ক অতি সামান্য। ধর্মবিশ্বাসের বেশির ভাগই আরোপিত এবং জন্মসূত্রে পাওয়া। মানুষ
যে পরিবারে জন্মায় – ভালো লাগুক বা না লাগুক – পারিবারিক ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন
করার জন্য তাকে বাধ্য করা হয়। সেক্ষেত্রে যাচাই বাছাই করার কোন সুযোগই থাকে না।
পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর ভিন্নতার কারণে ধর্মবিশ্বাসেরও পার্থক্য
দেখা দেয়। সে কারণেই দেখা যায় রাজস্থানের হিন্দু আর বাংলাদেশের হিন্দুর
ধর্মবিশ্বাস হুবহু এক নয়। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেও ধর্মবিশ্বাসে
ভিন্নতা দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, সমস্ত পরিকাঠামো এক থাকার পরেও মানুষে মানুষে
ধর্মবিশ্বাসে ভিন্নতা দেখা দিতে পারে।
ধর্মবিশ্বাস পরীক্ষা করে দেখার কোন উপায় নেই। ধর্মগ্রন্থে
যা লেখা আছে, যেভাবে লেখা আছে তাকেই পরম সত্য বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়
ধর্মপালনকারীদের। যখন সাধারণ চোখেই দেখা যায় যে ধর্মগ্রন্থে যা লেখা আছে তার সাথে
বাস্তবের কোন মিল নেই – তখন নানারকম খোঁড়া যুক্তি ধার করে ধর্মগ্রন্থের লেখাগুলোর অন্যরকম একটা ব্যাখ্যা
দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তাইতো ধর্মবিশ্বাসীদের বিশ্বাস করতে হয় যে যীশুখ্রিস্টের কোন
বায়োলজিক্যাল ফাদার নেই। যীশুকে ঈশ্বরের সন্তান বলা হয়ে থাকে, কিন্তু যে জৈব
প্রক্রিয়ায় প্রাণীর জন্ম হয় – সেরকম কোন প্রক্রিয়া মাতা মেরি ও ঈশ্বরের মধ্যে ঘটেছে
বলে বাইবেলে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে নানারকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
ধর্মবিশ্বাস কথাটি যতটা প্রচলিত –
বিজ্ঞানবিশ্বাস সে তুলনায় কম। কারণ বিজ্ঞানে শুধুমাত্র বিশ্বাস দিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠা করা
সম্ভব নয়। বিজ্ঞান পরীক্ষামূলক প্রমাণ ও কার্যকারণের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানে একটা তত্ত্বের সাথে অন্য তত্ত্বের মিল থাকতে হয়।
বিজ্ঞান ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে ভিন্ন হয়
না। যদি হয় তারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ম্যাগনেটিক
প্রোপার্টিজ বদলে যেতে পারে। তা ধনী দরিদ্র সাদা কালো যে কোন মানুষের পক্ষেই
পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। কিন্তু একটি ইঁদুর যেমন মাধ্যাকর্ষণ এড়াতে পারে না – তেমনি
ভ্যাটিকানের পোপের পক্ষেও মাধ্যাকর্ষণ এড়ানো সম্ভব নয়। বিজ্ঞানে যাঁরা বিশ্বাস
করেন তাঁরা অবশ্যই জানেন যে মাধ্যাকর্ষণ বল সাধারণ অবস্থায় সব সময়েই কাজ করছে। ওটা নানাভাবে
প্রমাণিত হয়েছে বলেই তাতে বিশ্বাস রাখা যায়। কিন্তু যদি কেউ দাবি করেন যে তিনি কোন
প্রকার প্রতারণার সাহায্য না নিয়ে অলৌকিক উপায়ে মাধ্যাকর্ষণ এড়িয়ে শূন্যে ভেসে
থাকতে পারেন – তাতে বিশ্বাস রাখা যায় না। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসীদের সকলেই কোন না কোন
ক্ষেত্রে অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন। বিজ্ঞানে অলৌকিক বলে কিছু নেই।
বিজ্ঞানের যে সব তত্ত্ব এখনো প্রমাণিত হয়নি – সেখানে
ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ এবং অনুমান কাজ করতে পারে। যেমন স্ট্রিং থিওরি – এখনো প্রমাণিত
হয়নি। সেখানে তাই এখনো মতভিন্নতা কাজ করছে। নিউক্লিয়ার থিওরিতে বিভিন্ন মডেলে
মতভিন্নতা আছে। কিন্তু সেসব আছে মূল সত্য বের করে আনার উদ্দেশ্যেই। সত্য উদ্ঘাটনের
জন্য ভিন্ন মতাবলম্বীরাও একসাথে কাজ করে যায় বিজ্ঞানে। ভুল মতবাদ থেকে শিক্ষা নিয়ে
নিজেদের ভুল স্বীকার করে নেন। স্টিফেন হকিং আর রজার পেনরোজের মধ্যে অনেক বছর ধরে
বিতর্ক চলেছে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন নিয়ে। শেষপর্যন্ত দেখা গেছে হকিং এর একটি
ধারণা ভুল ছিলো। এ ভুল স্বীকার করে নিতে হকিং এর একটুও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু
ধর্মবিশ্বাসে এরকম হয় না। সেখানে অহংবোধ বড় বেশি। আর সে কারণেই ধর্মে ধর্মে বিভাজনও
এত বেশি। বিভাজনের কারণে হানাহানিও এত বেশি।
বিজ্ঞানবিশ্বাসের সাথে ধর্মবিশ্বাসের আরেকটি প্রধান
পার্থক্য হলো ধর্মবিশ্বাস একটা পর্যায়ে বড়বেশি হিংস্র। ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়তো
করুণা করা হয়, কিন্তু সম্মান করা হয় না ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে। পৃথিবীতে ধর্মীয়
হানাহানির কারণে যত মানুষ মারা গেছে – আর কোন কিছুতে সেরকম হয়নি। আর বিজ্ঞানবিশ্বাসীরা
বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে কখনো হিংস্র হয়ে ওঠেনি। অনেকে পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের
জন্য বিজ্ঞানকে দায়ী করতে পছন্দ করেন। কিন্তু যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে
বোমা তৈরি করা হচ্ছে – সে একই পারমাণবিক তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর মানুষের
দৈনন্দিন জ্বালানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে, ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানকে কাজে
লাগিয়ে বিজ্ঞানের দোষ প্রচার করা হয় রাজনৈতিক স্বার্থে।
রাজনীতি দিয়ে বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি চেষ্টা
পৃথিবীর সব দেশেই হয়। সেটা হয় ধর্মবিশ্বাসের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে। যেমন
স্টেমসেল রিসার্চের ক্ষেত্রে আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো দেশও অনেক ধরণের
বিধিনিষেধ আরোপ করে বসে আছে। ফলে যে গবেষণা থেমে আছে তা নয়। কিন্তু যে গতিতে চলতে পারতো
সে গতিতে তা চলছে পারছে না। বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে সবসময়েই পেছনে টেনে ধরে রেখেছে
রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এবং এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ হিসেবে সবসময়েই দেখা যায় এক ধরণের
ধর্মবিশ্বাস কাজ করেছে। একটু পেছনের দিকের ইতিহাস খুঁজে দেখলেই দেখা যাবে – বিজ্ঞানকে
কোন সময়েই সহজে মেনে নেয়নি ধর্মবিশ্বাসীরা।
৩
যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রতি ধর্মবিশ্বাসীদের
দৃষ্টিভংগিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক ভাবে কী আবিষ্কৃত হলো তা না
জেনেই বলে দেয়া হয় যে এটা ধর্মবিরুদ্ধ, শয়তানের কারসাজী, এই আবিষ্কার
ঈশ্বরবিরুদ্ধ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটি প্রতিষ্ঠিত
হয়ে যায় এবং সবাই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে থাকে তখন ধর্মবিশ্বাসীরা হঠাৎ আবিষ্কার
করে ফেলে যে এসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সবকিছুই ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে। ধর্মগ্রন্থের
পাতায় পাতায় বিজ্ঞান। হুঁ হুঁ বাবা, ঐশ্বরিক গ্রন্থ হলো সকল বিজ্ঞানের উৎস!!
আর তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ধর্ম-বিরুদ্ধ বিজ্ঞানকে
ধর্ম-প্রচারে কাজে লাগানো। একটা উদাহরণ দিই - মাইক্রোফোন আবিষ্কারের পর ওটা
ব্যবহার করে আজান দেয়াকে না-জায়েজ বলা হতো।
আর এখন? বাংলাদেশের প্রতিটি শহরের হাজারো মসজিদের মাইক
দৈনিক কী পরিমাণ শব্দ-শক্তি তৈরি করে তা যদি কেউ গবেষণা করে প্রকাশ করে – তার জীবন
সংশয় দেখা দিতে পারে।
আজকাল অনেক জ্যোতিষী কম্পিউটারে ভাগ্য গণনা করেন এবং
অনেকেই তাতে বিশ্বাস করে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় একদম
শুরুতে ধর্ম ও বিজ্ঞানে খুব একটা বিরোধ ছিলো না। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির
ব্যবহার শুরু হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। উপাসনা-ধর্ম
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে অনেক পরে। সৃষ্টিকর্তার ধারণাও তৈরি হয়েছে আরো অনেক পরে।
বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের বিরোধের স্বরূপটা এক পলক দেখার জন্য আমাদের একটু পেছন দিকে
যেতে হবে। ইতিহাসের দিকে। অবশ্য প্রচলিত ইতিহাস আর বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের মধ্যে কিছু
মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রচলিত ইতিহাস মূলত
রাজনৈতিক ইতিহাস। রাজা বা শাসনকর্তার ইচ্ছামতো এ ইতিহাস রচিত হয়, বিকৃত হয়, সত্যি
ঘটনা মুছে ফেলা হয় বা সাজানো ঘটনার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। তবে মিথ্যার একটি বড়
দুর্বলতা হলো এটা সবকিছুর সাথে সমন্বিত অবস্থায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।
সামান্য সমন্বয়হীনতার লেজ যখন বেরিয়ে পড়ে – সে লেজ ধরে টান দিলেই মিথ্যার
আবরণ খসে পড়ে একসময়। সত্য ইতিহাস সেভাবেই বেরিয়ে আসে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ইতিহাস
লেখা হয় প্রকৃতিতে। একটি ফসিল কত বছরের পুরনো, বা এক খন্ড মাটি কী কী সভ্যতা ছুঁয়ে
এসেছে তা বৈজ্ঞানিক উপায়েই নির্ণীত হয়। সেরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই আজ জানা যায় – পৃথিবী
কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে – কত বছর আগে।
৪
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় পাওয়া নানারকম তথ্যপ্রমাণ থেকে
দেখা যায় আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়ান্স এর আগের প্রজাতি হোমো ইরেক্টাসের সময়
থেকেই পৃথিবীতে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ লক্ষ বছর থেকে
দশ লক্ষ বছর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হোমো ইরেক্টাসের উদ্ভব হয়েছিলো। চীনের বেইজিং এর
কাছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গুহায় পাওয়া নিদর্শন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে – আজ থেকে
প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্টাসরা প্রাকৃতিক আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার প্রযুক্তি
অর্জন করেছিলো।
আগুন যে প্রযুক্তির একটি প্রধান উৎস তা পরবর্তীতে
প্রমাণিত হয়েছে। আগুন জ্বালানো, আগুনকে প্রয়োজন মত কাজে লাগানো এবং প্রয়োজন শেষে
আগুন নেভানোর পদ্ধতি মানুষের আয়ত্ত্বে আসার সাথে সাথে সভ্যতার বিরাট একটি ধাপ
অতিক্রান্ত হলো। আগুনের শক্তিকে আবিষ্কার করতে গিয়ে মানুষ দেখেছে আগুনের বিধ্বংসী ক্ষমতাও।
সেসব অভিজ্ঞতা থেকে আগুনের প্রতি ভয়ও তৈরি হয়েছে। ভয় থেকে মানুষ আগুনকে দেবতা
জ্ঞান করতে শুরু করেছে। সনাতন যুগের সব ধর্মেই আগুন এর ভূমিকা বিশাল।
প্রকৃতিতে বাতাসের শক্তি দেখেছে মানুষ, দেখেছে ঘূর্ণিঝড়।
তারপর মানুষ যখন কৃষিকাজ শুরু করেছে – আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে – দেখেছে মাটি
থেকে খাদ্য শস্য উৎপন্ন হচ্ছে, সব কিছু মাটিতে মিশে যাচ্ছে এক সময়। পরবর্তীতে গ্রিক দার্শনিকরা যখন পদার্থের মূল উপাদান নির্ধারণ করতে
চিন্তাভাবনা শুরু করেছে – তখন প্রাথমিক যুগ থেকে বয়ে আসা এ ধারণা কাজে লেগেছে।
তাদের মনে হয়েছে – আগুন, পানি, মাটি আর বাতাসই হলো মূল উপাদান। প্রাকৃতিক
দুর্যোগ দেখতে দেখতে মানুষ প্রকৃতিকে ভয় করতে শিখেছে – এবং সে ভয়কে জয় করার জন্য
সংগ্রাম করতে শিখেছে। দেখেছে প্রত্যেক কাজের পেছনে কারো না কারো হাত রয়েছে।
প্রকৃতির অদৃশ্য হাতকে ঈশ্বরজ্ঞান করতে শিখেছে।
ঈশ্বরের ধারণা তৈরি হবার পর মানুষের পর্যবেক্ষণে নতুন
একটি ধারা তৈরি হলো। সমাজবদ্ধ ভাবে বাস করার জন্য সামাজিক নিয়ম কানুন তৈরি হলো।
শুরু হলো সামাজিক শ্রেণীবিভাগ। নিজেদের মধ্যেই টিকে থাকার সংগ্রামে শারীরিক শক্তির
সাথে বুদ্ধিমত্তাও যুক্ত হলো। যাঁরা বুড়ো হয়ে শারীরিক শক্তিতে পিছিয়ে পড়লেন – তাঁরা সমাজে
নিজেদের আসন ঠিক রাখার জন্য শুরু করলেন ধর্মব্যাখ্যা। পরবর্তীতে এদের নিয়েই একটা
শ্রেণী তৈরি হলো। সামাজিক ধর্মগুরু বা পুরোহিত শ্রেণী। এ পেশায় টিকে থাকার জন্য
তাদের দরকার হলো গভীর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ। সূর্যোদয় সূর্যাস্ত জোয়ার ভাটা ঋতু
পরিবর্তন জলবায়ুর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এসবের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হলো। এদের
হাত ধরেই ক্যালেন্ডার তৈরি হলো আজ থেকে প্রায় ২৮০০ বছর আগে। প্রতিষ্ঠিত হলো সময়ের
হিসেব – বছর, মাস, দিন, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড। সংখ্যার ব্যবহার শুরু হলো। সংখ্যা
লেখার চিহ্নও তৈরি হলো। শুরু হলো পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা।
যেহেতু এদের ব্যাখ্যার ভুল ধরার কেউ নেই- কোথাও কোন
বিরোধ ঘটলো না। এদের এবং এদের উত্তরাধিকারীদের হাতেই রয়ে গেলো সামাজিক ক্ষমতা। আরো
পরে যখন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো – রাজত্ব পরিচালনার ব্যাপার এলো – তখনো এই পুরোহিত শ্রেণীর দাপট
ঠিকই থাকলো। কারণ রাজারা দেখলো পুরোহিতদের কাজে লাগাতে পারলে রাজত্ব করা সহজ হয়।
কারণ যে মানুষ রাজাকে ভয় পায় না সেও প্রকৃতির অজানা রহস্যকে ভয় পায়। ততোদিনে এ
প্রকৃতির নাম হয়ে গেছে ঈশ্বর। কিন্তু রাজাদের মন যুগিয়ে চলতে গিয়ে পুরোহিত শ্রেণীর
সততায় কিছুটা ভন্ডামীও ঢুকে পড়েছে। নিজেদের অজান্তেই তারা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে
গিয়ে ও তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে চাইলেন না। ফলে
স্বাধীন গবেষক ও রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি গবেষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু
করলো। আস্তে আস্তে আলাদা হতে শুরু করলো বিজ্ঞান ও ধর্মবিশ্বাস। পরবর্তীতে যখন
পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করলো পুরোহিতরা ভাবলো এতে
তাদের আসন টলে যাবে। তাই তারা সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণার বিরোধীতা করলো।
রাষ্ট্র পুরোহিতদের সমর্থন করলো। সে কথায়
আসছি আর একটু পরের দিকে।
৫
মানুষের শরীর সম্পর্কে প্রত্যেক ধর্মই খুব স্পর্শকাতর। সব
ধর্মই শরীরকে খুব গুরুত্ব দেয়। এতই গুরুত্ব দেয় যে ধর্মের এ বাড়াবাড়ির কারণে প্রথম
দিকে মানুষের শরীর নিয়ে কোন গবেষণা করাই সম্ভব ছিলো না। মৃত মানুষের শরীর
ব্যবচ্ছেদ করে দেখা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবে নিষেধ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের
দেহের প্রথম ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিলো আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে। গ্রিক ডাক্তার
আল্কমেইয়ন গোপনে মানুষের মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে শিরা ও ধমনীর পার্থক্য খুঁজে পান।
আর শরীরের বিভিন্ন অংগপ্রত্যংগের মধ্যে স্নায়বিক সংযোগের ধারণাও আল্কমেইয়নই দেন।
কিন্তু পরবর্তী ছয় শ বছর ধরে মানুষের এনাটমি নিয়ে আর কোন গবেষণা করা যায়নি
ধর্মগুরুদের বাধার কারণে।
খ্রিস্টান ধর্মের উত্থান ঘটার পর এ অবস্থার আরো অবনতি
ঘটলো। খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা প্রচার করতে লাগলো যে মানুষের শরীর ঈশ্বর প্রদত্ত আত্মা
রাখার একটি খাঁচা ছাড়া আর কিছু নয়। এবং সে খাঁচা খুলে দেখার অধিকার মানুষের নেই।
সে সময় ১২৯ সালে ক্লডিয়াস গ্যালেনের জন্ম। তুরস্কের একটি ধনী পরিবারে জন্ম নেয়ার
কারণে গ্যালেনের পক্ষে মানুষের শরীর পর্যবেক্ষণ করার কিছুটা সু্যোগ হয়েছিলো।
চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য গ্যালেন রোমে গিয়ে রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্তাক্ত দেহ
পর্যবেক্ষণ করলেন অনেকদিন ধরে। হৃদপিন্ডের কাজ, শিরা ও ধমনীর কাজ ইত্যাদি
পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। কিন্তু মানুষ তখনো বিশ্বাস করে যে আত্মা থাকে শরীরের ভেতর।
গ্ল্যাডিয়েটররা আহত হয়ে মারা যাবার সময় গ্যালেন দেখলেন যে তাজা টকটকে ঘন লাল রক্ত
বেরিয়ে আসছে শরীর থেকে। গ্যালেন ভাবলেন এর নাম জীবন। মারা যাবার সময় এভাবেই জীবন
বেরিয়ে যায়। আর বেঁচে থাকলে ধমনী ও শিরা দিয়ে রক্তের সাথে জীবন প্রবাহিত হয়।
গ্যালেনের অনেক ধারণা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হলেও তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে
আরো তের শ বছর। গ্যালেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। তাঁর এ বিশ্বাসের কারণে তাঁর পর্যবেক্ষণও
ছিলো কিছুটা ঈশ্বর-কেন্দ্রিক।
বিজ্ঞানের অন্যান্য কিছু শাখা যখন ডানা মেলতে শুরু করেছে
– তখনো মানুষের শরীরের রহস্য জানার জন্য কোন গবেষণাই করা যাচ্ছে না
ধর্মগুরুদের নিষেধের কারণে। ক্লসিয়াস গ্যালেনের পর্যবেক্ষণকেই সত্য হিসেবে ধরে
নিয়ে চললো ১৪৯০ সাল পর্যন্ত। ধর্মগুরুদের প্রবল আপত্তির মুখেও ইতালির পাদুয়াতে এনাটমিক্যাল
থিয়েটার তৈরি হলো। সেখানে এনাটমি নিয়ে কাজ করলেন লিওনার্দো দা ভিনচি, এন্ড্রিয়াস
ভেসিলাস।
মানুষের শরীরের ওপর ধর্মের বাধা নিষেধ কিছুটা কমে এলেও এখনো
একেবারে থেমে নেই। এখনো মানুষের শরীর নিয়ে নতুন গবেষণায় ধর্ম একটি প্রধান বাধা।
জন্মনিয়ন্ত্রণকে অনেক ধর্মেই ধর্মবিরুদ্ধ কাজ বলে ধরে
প্রচার করা হয়। গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা কোন ধরণের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী
ব্যবহার করাকে ধর্মবিরুদ্ধ মনে করে। ১৯৫৬ সালে জন্মবিরতিকরণ পিল উদ্ভাবনের পর
ধর্মগুরুরা ক্ষেপে গেলেন। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। মেয়েদের জীবন অনেকভাবেই
বদলে গেলো এরপর থেকে। সন্তানজন্মসংক্রান্ত নানারকম রোগের হাত থেকে বাঁচতে আরম্ভ
করলেন মেয়েরা। কিন্তু কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাস এখনো বিজ্ঞানের এ অবদানকে স্বীকার করে
না।
গর্ভপাতকে ধর্ম প্রবল ভাবে বাধা দিয়ে আসছে। খুব দরকার না
হলে শখের বশে কেউ গর্ভপাত করে না। কিন্তু কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাসী মনে করেন – এটা ঈশ্বরের
ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ। তাঁরা আবার এটাও বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে
কোন কিছু করার ক্ষমতা কারো নেই। তাহলে গর্ভপাত যেহেতু হচ্ছে তা ঈশ্বরের ইচ্ছার
বিরুদ্ধে হয় কীভাবে! কিন্তু যুক্তির কথা তো ধর্ম শোনে না।
টেস্টটিউব বেবিকেও ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মবিরুদ্ধ কাজ মনে
করেন। সে একই রকম অন্ধকারাচ্ছন্ন মানসিকতার কারণে স্টেমসেল রিসার্চ বাধাগ্রস্ত।
অথচ সে গবেষণা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে আল্ঝেইমারের মত মারাত্মক ডি-এন-এ ঘটিত
রোগ থেকে।
৬
বিবর্তনবাদকে কিছু কিছু ধর্মবিশ্বাসী মোটেই স্বীকার করেন
না। ১৮৫৯ সালে ডারউইনের ‘দি অরিজিন অব স্পেসিস’ প্রকাশিত হবার পর পৃথিবীর
ধর্মাকাশে একটি ঝড় বয়ে গেলো। সে ঝড় এখনো থামেনি। ধর্মবিশ্বাসীরা মানতেই চাচ্ছেন না
যে মানুষ সরাসরি ঈশ্বরের হাতে কাদামাটি থেকে তৈরি নয়। আদম বা হাওয়ার কোন
অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়নি বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। মানুষ এসেছে অনেক অনেক বছরের প্রাকৃতিক
পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
ধর্মবিশ্বাসীরা বিবর্তনবাদকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে না
পেরে – প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে এখন। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন নামে একধরণের ছদ্ম
বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ঈশ্বর ছাড়া এরকম অপূর্ব
বুদ্ধিবৃত্তিক নির্বাচন আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যোগ্যতমকে খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব
ঈশ্বর নিজের হাতেই রেখে দিয়েছেন।
ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন বা আইডি তত্ত্ব মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ ক্ষমতায় আসার পর। সহজেই বোঝা যায় যে এটা একটা
সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চাল। আমি বেশ কয়েকজন গোঁড়া খ্রিস্টান বাইবেলবোদ্ধাকে জিজ্ঞেস
করে দেখেছি – বাইবেলে আইডি সম্পর্কে কী লেখা আছে বা আদৌ কিছু আছে কিনা। ঈশ্বরই সব কিছু
ডিজাইন করেছেন জাতীয় এলোমেলো কিছু কথাবার্তা ছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু তাঁরা জানাতে
পারেননি। আসলে তত্ত্বটা খুব বৈজ্ঞানিক করতে গিয়ে সহজপাচ্য করতে পারেনি। এ প্রসংগে
একটি চমৎকার বই এর নাম এখানে করা যায়। তা হলো রবিন উইলিয়াম্স এর “আনইন্টেলিজেন্ট
ডিজাইন, হোয়াই গড ইজন্ট এজ স্মার্ট এজ শি থিঙ্কস শি ইজ”।
বিবর্তন প্রশ্নে ধর্মবিশ্বাসীদের সাথে অনেকদিন থেকেই
বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব চলছে পৃথিবীর সৃষ্টি ও বয়স নিয়ে। বাইবেলের পক্ষ নিয়ে একপক্ষ
বলছে পৃথিবীর বয়স মাত্র ছয় হাজার বছর। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ অনুসন্ধান,
গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে হিসেব করে দেখিয়েছেন যে পৃথিবী
সৃষ্টি হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে চার শ কোটি বছর আগে। বাইবেলে বলা আছে বিশ্বব্রহ্মান্ড
সৃষ্টি হয়েছে মাত্র ছয়দিনে। ১৬৪২ সালে ব্রিটিশ মন্ত্রী ও বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ
জন লাইটফুট “অবজারভেশন্স অন জেনেসিস” নামে ২০ পৃষ্ঠার একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি লেখেন যে
পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯২৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। আর মানুষ সৃষ্টি করা
হয়েছে এর পাঁচ দিন পর, ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকাল নয়টায়। ডক্টর লাইটফুট
উচচশিক্ষিত মানুষ, বই লেখার কিছুদিন পর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর
নিযুক্ত হয়েছিলেন।
এর পর ১৬৫০ সালে অ্যাংলিকান বিশপ জেম্স উশার ওল্ড টেস্টামেন্টে
বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা ও দেবতাদের বয়স হিসেব করে ঘোষণা করলেন, পৃথিবী সৃষ্টি করা
হয়েছে যীশুখ্রিস্টের জন্মের ৪০০৪ বছর আগে, অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ রবিবার সকাল
নয়টায়। সময়টি কোন্ দেশের স্থানীয় সময় তা জানা যায়নি।
এঁদের এসমস্ত দাবীর সাথে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের কোন
মিল নেই। বৈজ্ঞানিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে প্রায় সাড়ে চার শ কোটি
বছর আগে। যেহেতু ধর্মগ্রন্থগুলো এসব বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত
করেনি, ধর্মবিশ্বাসীরা এখনো বিশ্বাস করে পৃথিবীর বয়স মাত্র চার হাজার বছর। আর
বৈজ্ঞানিক প্রমাণগুলো ঈশ্বরই ওভাবে রেখে দিয়েছেন মানুষের জ্ঞানের সীমানা দেখার
জন্য। কারণ তিনি মানুষের জ্ঞান পরীক্ষা করে দেখতে খুব পছন্দ করেন। এ নিয়ে তর্ক
বিতর্ক চলছে এখনো, হয়তো চলবে অনেকদিন। তবে একসময় দেখা যাবে নতুন করে লেখা হচ্ছে বাইবেলের
জেনেসিস – সেখানে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রবেশ করানো হবে, এবং আবারো প্রচার করা হবে যা
সব লেখা আছে বাইবেলে!!
৭
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে – এ সত্য কখনোই মেনে নিতে চায়নি
ধর্মবিশ্বাসীরা। কারণ মানুষকে ক্ষমতার কেন্দ্রে দেখতে ভালোবাসে সবাই। আর মানুষের
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরবে আর সবকিছু – পৃথিবী স্থির থাকবে – এরকমই বিশ্বাস ছিলো তখন।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ সালে গ্রিক দার্শনিক হিপার্কাস ধারণা দেন যে বিশ্বব্রহ্মান্ডের
কেন্দ্রে আছে পৃথিবী। এর প্রায় আড়াই শ বছর পর টলেমি হিপার্কাসের তত্ত্ব সমর্থন
করে নানারকম যুক্তি দেন। তাঁর একটি যুক্তি ছিলো, যেহেতু পৃথিবীতে মানুষ বাস করে – সেহেতু
সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই ঘুরবে। চার্চের খুব ভালো লাগলো টলেমির কথা। ভালো
লাগাই কাল হলো – মহাকাশ গবেষণা ভুল পথে এগোতে থাকলো পরবর্তী প্রায় সাড়ে তের শ বছর ধরে।
১৫০৭ সালে পোলান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস
কোপার্নিকাস দেখলেন টলেমির গাণিতিক যুক্তিগুলো প্রচুর ভুলে ভরা। কোপার্নিকাস হিসেব
করে দেখালেন যে পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
চার্চের রোষানলে পড়ার ভয়ে তিনি অনেক বছর এসব গবেষণা
প্রকাশ করেননি। শেষে ১৫৪৩ সালে তিনি এ তথ্য প্রকাশ করেন “অন দি রিভিলিউশান অব দি
হেভেনলি বডিজ” বইতে। তিনি জানতেন যে বইটি প্রকাশিত হলে চার্চের নেতারা ক্ষেপে যাবেন।
বুদ্ধি করে কিছুটা ঘুষ দেয়ার মতোই তিনি বইটি উৎসর্গ করলেন পোপ তৃতীয় জন পল্কে।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। চার্চের নেতারা কোপার্নিকাসের বইগুলো পুড়িয়ে ফেলার
আদেশ দিলেন। তবুও ভালো যে কোপারনিকাস্কেই পুড়িয়ে মারার আদেশ দেয়া হয়নি।
পরে গ্যালিলিও যখন এ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন – ক্যাথলিক চার্চ
আদেশ দিলো কাজ বন্ধ করতে। গ্যালিলিওকে হুমকি দেয়া হলো যেন তিনি পৃথিবীর ঘূর্ণন
সম্পর্কে আর একটি কথাও না বলেন। কিন্তু সহজে থেমে থাকার পাত্র গ্যালিলিও নন। তিনি
একটি বই লিখলেন এবং তাতে পোপের বিরুদ্ধেও লিখলেন অনেক কিছু। এতে ক্ষেপে গেলেন পোপ।
গ্যালিলিওর সামাজিক প্রতিষ্ঠার কারণে তাঁকে হত্যা করলে
জনমত চার্চের বিরুদ্ধে যেতে পারে ভেবে গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করা হলো। দীর্ঘদিন
বন্দী অবস্থার মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গ্যালিলিও একসময় বাধ্য হয়ে ঘোষণা
করেন যে, তিনি ভুল বলেছেন। কিন্তু সংগে সংগে এটাও বলেন যে, পৃথিবীর ঘূর্ণন কিন্তু
পোপের কথামতো থেমে যাবে না।
থেমে যায়নি। এত বছর পরে ভ্যাটিকানের পোপ স্বীকার করতে
বাধ্য হয়েছেন যে গ্যালিলিওর প্রতি অবিচার করা হয়েছিলো সেদিন। ১৬০০ সালে নুহ্’র প্লাবন
কখনোই হয়নি বলার অপরাধে ব্রুনোকে রোমের রাস্তায় প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মেরেছে ইউনাইটেড
চার্চের যাজকেরা। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও মতামতের
কাছে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলো চার্চ। তখন চার্চের শক্তি সংহত করার উদ্দ্যেশ্যেই
ব্রুনোর মতো মানুষকে খুন করা হলো। ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে ধর্মবিশ্বাসীদের এ হলো
স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
৮
শুধুমাত্র ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করলেই যে চার্চ ক্ষেপে যেতো
তা নয়। মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমুলক আচরণ কোন ধরণের কারণ ছাড়াই ঘটেছে তখন। মিশরের
হাইপাশিয়া ছিলেন ৩৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৫ সাল পর্যন্ত একমাত্র মেয়ে যিনি সমতল
জ্যামিতিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি টলেমির পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের
ধারণাকেও স্বীকার করতেন। কিন্তু তারপরও তাঁকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। রাস্তা থেকে
টেনে চার্চের ভেতর নিয়ে গিয়ে হিংস্রভাবে
কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে তাকে। তারপর রাস্তার উপর পুড়িয়ে মেরেছে তথাকথিত প্রেমের
অবতার যীশুখ্রিস্টের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা। পরবর্তী এক হাজার বছরে আর একজন মহিলাও বিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে আসতে পারেননি।
৯
বিজ্ঞান ও ধর্মের ইতিহাস অনেক দ্বন্দ্বে ভরা। অনেক সময়
নিজেদের ব্যক্তিগত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশও ঘটায় অনেকে। যেমন প্রথম জীবনে আইনস্টাইনকেও
ইহুদি পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাঁর গবেষণাকে
জার্মানিতে ইহুদিদের বিজ্ঞান নামে প্রচার করা হয়েছে। এখনো অনেক দেশে শুধুমাত্র
ধর্মীয় সংখ্যালঘু শ্রেণীর প্রতিনিধি হবার কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হয়
বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানের কথা বললে তা যদি ধর্মের বিরুদ্ধে যায় – তা
ব্যক্তিগত মত বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু সুখের কথা হলো – বিজ্ঞানকে অস্বীকার করলেই তা
মিথ্যা হয়ে যায় না।
বর্তমানে সব ধর্মবিশ্বাসীরাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে তাদের
ধর্ম বিজ্ঞানসম্মত – তাতে বিজ্ঞানের শক্তিকেই স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে। কারণ
বিজ্ঞান চলবে বৈজ্ঞানিক ধর্মের ভিত্তিতে, কিন্তু বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অচিরেই অচল হয়ে
যাবে।
Tuesday 22 May 2018
অবিশ্বাসের দর্শন: নবযুগের যুক্তিবাদীর দৃপ্ত পদক্ষেপ
পাঠ প্রতিক্রিয়া
অবিশ্বাসের দর্শন
অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর
প্রথম প্রকাশ: ২০১১
প্রকাশক: শুদ্ধস্বর, ঢাকা, বাংলাদেশ
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩১১
মূল্য: ৫০০ টাকা
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ
প্রচলিত ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব সামান্য সংখ্যক
কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন যাঁরা পৃথিবীটাকেই বদলে ফেলার চেষ্টা করেন। দিনের পর দিন নিরলস সংগ্রাম
চেষ্টা পরিশ্রম অধ্যবসায় দিয়ে পৃথিবীটাকে একটু একটু করে ঠিকই বদলে ফেলেন এই
ব্যতিক্রমী মানুষেরা।
অথচ তার সুফল ভোগ করেন সবাই যাদের মধ্যে তাঁরাও আছেন যাঁরা ক’দিন আগেও এ
পরিবর্তনের ঘোর বিরোধীতা করেছিলেন।
ধর্মবাদীদের সাথে মুক্তমনাদের পার্থক্য এখানেই যে ধর্মবাদীরা বড় বেশি বিভাজনপটু। ধর্মবাদীরা তাঁদের নিজস্ব
ধর্মের অনুশাসনগুলোর প্রতি কেউ প্রশ্ন তুললেই সেটাকে ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে
নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেন না অনেক সময়।
বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক যুক্তিতে টিকে থাকতে না পারলে পেশীশক্তি ব্যবহার করেন
ধর্মবাদীরা। মধ্যযুগে ধর্মের প্রসার ঘটেছে তলোয়ারের আস্ফালনে,
বর্তমানেও ধর্মবাদীদের মূল অস্ত্র আর যাই হোক - যুক্তি নয়। অথচ সারা পৃথিবীতে একজনও যুক্তিবাদী মুক্তমনা পাওয়া
যাবে না যিনি যুক্তির বদলে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। যুক্তির শক্তি যে কত প্রবল তা আরো একবার বুঝতে পারলাম
অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীরের ‘অবিশ্বাসের
দর্শন’ পড়তে পড়তে।
অনেক বছর আগে প্রথমবার
প্রবীর ঘোষের 'অলৌকিক নয় লৌকিক' পড়ে মনে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে যুক্তিবাদী আন্দোলন
যেভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে - বাংলাদেশে হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না সেরকম কোন
আন্দোলন।
এরকম ঋণাত্মক চিন্তার পেছনে যেসব যুক্তি কাজ করেছিলো তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি
গুরুত্ব পেয়েছিল ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকার হওয়ার একাধিক ঘটনা। মার্ক্স লেনিন নিয়ে জমাট
যুক্তিতক্কে ঝড় তুলতে পারা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যেও দেখেছি ব্যক্তিগত ধর্মের গায়ে
সামান্য আঘাত লাগলেই কেমন যেন ফুঁসে উঠে। যুক্তির সোপানগুলো ধাপে ধাপে পার হতে গিয়ে যেই
সৃষ্টিকর্তার প্রসঙ্গ আসে তখনই যুক্তিগুলো হঠাৎ থেমে গিয়ে কতগুলো অন্ধবিশ্বাস এসে
বসে যায় যুক্তির জায়গায়।
ধর্মীয় ভিন্নমতের অসহিষ্ণুতা এত প্রকট যে দেশে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে সেখানে
ঈশ্বরবিহীন মৌলিক দর্শনের চর্চা সম্ভব।
আসলে বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখার জন্য যে সাহস লাগে তা আমার ছিল না। কিন্তু মুক্তমনার সাথে
পরিচয়ের পর আমার সে ঋণাত্মক ধারণা ক্রমশ বদলে যেতে শুরু করে। ঝকঝকে নতুন চিন্তার একদল
যুক্তিবাদী মানুষ একটা প্লাটফরমে এসে তর্ক করছেন, বিজ্ঞান চর্চা করছেন, রচনা করছেন
আগামী দিনের দর্শন যার ভিত্তি কোন অলৌকিক অন্ধ সংস্কার নয়, বরং আধুনিক বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তির সাম্প্রতিকতম তত্ত্ব ও তথ্য; এসব দেখে যে কোন যুক্তিবাদী মনই উজ্জীবিত
হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক।
মুক্তমনা ব্লগের সাথে যাঁদেরই পরিচয় হয়েছে তাঁরাই কোন না কোন ভাবে উজ্জ্বীবিত
হয়েছেন।
প্রগতিশীল মননতো বটেই - রক্ষণশীল গোঁড়া মননও বাধ্য হয়েছেন চিন্তার গোঁড়ায় নতুন করে
সার-জল দিতে।
বাংলাদেশে মুক্তমনা আন্দোলনে
তুমুল হাওয়া লেগেছে ধরতে গেলে যাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে তাঁদের অন্যতম ড. অভিজিৎ
রায়।
মুক্তমনায় তাঁর লেখা যাঁরা পড়েছেন তারাই মুগ্ধ হয়েছেন। কাঠমোল্লারাও স্বীকার করতে
বাধ্য হয়েছেন যে যুক্তি প্রয়োগে ও যুক্তি খন্ডনে অভিজিৎ রায়ের জুড়ি নেই। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনায়
অভিজিৎ রায় ইতোমধ্যেই তাঁর স্বকীয়তার উজ্জ্বল ছাপ রেখেছেন “আলো হাতে চলিয়াছে
আঁধারের যাত্রী”,
“মহাবিশ্বে
প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে”,
“সমকামিতা-
একটি বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ”, “ভালবাসা
কারে কয়”
প্রভৃতি বইতে।
এবার অভিজিৎ রায়ের সাথে যুক্ত হয়েছেন আরেকজন তরুণ মুক্তমনা রায়হান আবীর যিনি
ইতোমধ্যেই বাংলা ব্লগে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন যৌক্তিক প্রতিভার স্বকীয়তায়। এঁদের দুজনের যৌথ প্রয়াস “অবিশ্বাসের দর্শন”।
একদম একটানা একনিঃশ্বাসে পড়ে
ফেলার মত বই নয় ‘অবিশ্বাসের
দর্শন’। যদি তাই হতো তাহলে এর আবেদন
এতটা গভীর হতো না, এটা হয়ে পড়তো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের
উপন্যাসের মতো। ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ আধুনিক বৈজ্ঞানিক
দর্শনের বই যা পড়তে পড়তে থামতে হয়, ভাবতে হয়, উপলব্ধি করতে হয় এবং মাঝে মাঝে নিজের
সাথে কিছুটা বোঝাপড়াও করে নিতে হয়।
কারণ ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারলে এ বই
নাড়িয়ে দিতে সক্ষম আমাদের আজন্ম লালিত কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত। তাই যেমন এর নামকরণ হয়েছে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ তেমনি লেখকদের
কথামতো ‘অবিশ্বাসের
বিজ্ঞান’ বা
‘প্রান্তিক
বিজ্ঞান’ও
হতে পারতো (পৃঃ ৯, ভূমিকা)।
যে অবিশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে
তা প্রথাগত ঈশ্বরে অবিশ্বাস, অলৌকিকত্বে অবিশ্বাস, গোঁজামিলে ভর্তি ধর্মগ্রন্থে
অবিশ্বাস, কিন্তু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণে বিশ্বাস, কঠিন ও বাস্তব ইহলৌকিক
জীবনের ওপর সুদৃঢ় বিশ্বাস এবং একটা সুন্দর প্রগতিশীল সমাজ গঠনের গভীর আত্মবিশ্বাস।
নয়টি
অধ্যায়ে বিভক্ত তিন শতাধিক পৃষ্ঠার বই ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ এর প্রথম অধ্যায় ‘বিজ্ঞান এর গান’। ‘বিজ্ঞান
কি অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে অভিমত দিতে অক্ষম?’, ‘বিজ্ঞানও
কি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত?’, ‘আমরা কি আমাদের মনকে বিশ্বাস করতে পারি?’ ‘বিজ্ঞান
ও ধর্ম কি সাংঘর্ষিক নয়?’, ‘বিজ্ঞান কি ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণ করতে
সক্ষম?’ ইত্যাদি সর্বজনীন
মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে এ অধ্যায়ে।
লেখকদ্বয় আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শন প্রয়োগে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে থ্রি-ও
(অমনিসায়েন্ট, অমনিবেনেভোলেন্ট, অমনিপোটেন্ট) মার্কা গড বা সর্বজ্ঞ-পরম
করুণাময়-সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আসলে একটা অসম্ভব হাঁসজারু কিংবা বকচ্ছপ জাতীয় কল্পনা। ধর্মীয় সংগঠনগুলো শত শত কোটি ডলার খরচ করে ধর্মকে
বিজ্ঞানের মোড়কে পরিবেশনের যে চেষ্টা করছেন সে প্রসঙ্গও তথ্য-প্রমাণ সহ উঠে এসেছে
এ অধ্যায়ে।
ধর্মীয়
ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা যুক্তির সহজ পাঠ ঠিক ততদূর পর্যন্ত মেনে চলেন যতদূর পর্যন্ত
গেলে তাঁদের প্রচলিত ঈশ্বর নিরাপদ থাকেন।
উদাহরণ দেয়া যেতে পারে এভাবে- মাধ্যাকর্ষণ বল সম্পর্কে ধারণা আছে যাদের তাঁদের যদি
প্রশ্ন করা হয়- কোন কিছু উপরে ছুড়ে দিলে তা নিচে নেমে আসে কেন? তাঁরা ঠিকই উত্তর
দেবেন - মাধ্যাকর্ষণের কারণে।
তাঁরা কিন্তু কিছুতেই বলবেন না যে “আল্লাহ্র হুকুমে” বা “ঈশ্বরের
ইচ্ছায়”। ম্যালেরিয়া কেন হয়? তার উত্তরেও মানুষ ঈশ্বরকে টেনে
আনেন না। আসলে বিজ্ঞান বা ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কে অজ্ঞানতা
যেখান থেকে শুরু - ঐশ্বরিক দর্শনও খেলা দেখাতে শুরু করে সেখান থেকে। ৪১ পৃষ্ঠায় আঁকা কার্টুনটি মাত্র কয়েকটি রেখার টানেই
দেখাতে সক্ষম হয়েছে স্বাভাবিক যুক্তি আর ধর্মীয় যুক্তির মধ্যে পার্থক্য কোথায়। অজ্ঞানতার কারণে অলৌকিক অসারতায় বিশ্বাস ক্ষতিকর বটে,
তবে জ্ঞানের আলোয় সে ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া সম্ভব যদি জ্ঞানের ফলে অবসান ঘটে
অলৌকিকত্বের। কিন্তু প্রচন্ড ক্ষতি হয় তখন যখন মানুষ বিজ্ঞানের
জ্ঞানকে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চায়, ধর্মের নেশায় বুঁদ হয়ে অলৌকিক ঈশ্বরের
মহিমা প্রচার করতে গিয়ে বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রকেও মানতে চায় না।
নতুন দিনের নাস্তিক বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন বই ও গবেষণাপত্র থেকে উদ্ধ্বৃতি নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে এ অধ্যায়ের আলোচনা। তবে ২২ পৃষ্ঠায় ভিক্টর স্টেঙ্গরের যে কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে একই কথা আবার ২৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ইংরেজিতে। 'অক্কামের ক্ষুর' অনুসরণ করে এই দ্বিরুক্তি এড়ানো যেতো।
সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী মাত্রেই
সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী; বিবর্তনে তাঁদের কোন বিশ্বাস নেই।
বিবর্তন মিথ্যা প্রমাণ করতে না পেরে- ‘এটা নিছক তত্ত্ব’ জাতীয় কথার পালেও বাতাস লাগছে না দেখে ইন্টেলিজেন্ট
ডিজাইন আমদানি করতে সচেষ্ট হয়েছে সৃষ্টিবাদীরা।
তাঁদের যুক্তি হিসেবে বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে প্যালের ঘড়ি (কিংবা হুমায়ূন
আহমেদের নিকন ক্যামেরা), হয়েলের বোয়িং ৭৪৭, বিহের হ্রাস অযোগ্য জটিলতা ইত্যাদি। বিবর্তনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সহ ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন যে মোটেও
ইন্টেলিজেন্ট নয় তা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসেছে চোখের বিবর্তনের সচিত্র
বিবরণ। মাইকেল বিহে’র ইঁদুর মারা কল যাঁদের কাছে হ্রাস অযোগ্য জটিল বস্তু -
তাঁরা হতাশ হবেন এই দেখে যে ইঁদুর মারা কলের উদাহরণ যুক্তির বৈঠকে কল্কে পাওয়ার
যোগ্যতা হারিয়েছে।
মানুষের শরীরের মন্দ নকশা’র
চিত্র যা ২০০১ সালে সায়েন্টিফিক আমেরিকানে প্রকাশিত হয়েছিল তা এখানে যথোপযুক্তভাবে
ব্যবহৃত হয়েছে (পৃঃ৭২-৭৩)। মন্দ নকশা কীভাবে সংশোধন করা যায় তাও
দেয়া আছে। কিন্তু তথাকথিত ঈশ্বরের তো সাধ্য নেই তা প্রয়োগ করার!
প্রসঙ্গক্রমে এসেছে নুহের নৌকার কথা। এ সংক্রান্ত আজগুবি বন্যার কথা অনেকেই বিশ্বাস করেন - এটাই
আশ্চর্যের। নুহের নৌকা ও মহাপ্লাবন সংক্রান্ত মিথের জন্ম
খ্রিস্টের জন্মেরও ২৮০০ বছর আগের। সুমুরিয়ান পুরাণে এরকম ঘটনার উল্লেখ
আছে (পৃঃ৭৯)। পরে এটা বিবর্তিত হয়ে বাইবেলে স্থান পেয়েছে। সেখান থেকে আরেক বিবর্তনে কোরানে। এই
যে গল্প থেকে গল্পের বিবর্তন - সেখানেও নাকি ঈশ্বরের হাত আছে।
আচ্ছা কেউ কি জানে ঈশ্বরের জন্ম কখন?
দ্বিতীয় অধ্যায়ে সামান্য কিছু
দুর্বলতা চোখে পড়েছে আমার। এ অধ্যায়টা ব্লগ থেকে বইয়ের জন্য
সম্পাদনা করার সময় লেখক তাঁর সহ-লেখকের কথা ভুলে গিয়েছিলেন বলেই অধ্যায়ের বিভিন্ন
জায়গায় “আমার খুবই প্রিয়” (পৃঃ ৬০), “আমার এক বন্ধুকে” (পৃঃ ৬৬), “আমার তত্ত্বাবধায়ক স্যার”, “আমাকে
দায়িত্ব দিলেন”, “আমি মোটামুটি” (পৃঃ৬৮) ইত্যাদি এক বচন উত্তম পুরুষ ব্যবহৃত হয়েছে। লেখকের লেখার স্টাইলের সাথে যাঁরা পরিচিত তাঁরা হয়তো বুঝতে পারবেন
অধ্যায়টা কার রচনা - কিন্তু যৌথ লেখায় যেহেতু কোন্অধ্যায় কার রচনা তা উল্লেখ করা
হয়নি - ‘আমি’র বদলে ‘আমরা’ হলে বেশি গ্রহণযোগ্য হতো। ৬০
পৃষ্ঠায় ছক্কার উদাহরণ দেয়া হয়েছে - কিন্তু বলা হয়েছে কার্ডের উদাহরণ। ৮৪ পৃষ্ঠায় ইলেকট্রনের ডাবল স্পাইরাল প্যাটার্ন তৈরি করার জন্য যে
পরীক্ষার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা খুব একটা পরিষ্কার নয়।
বলা হচ্ছে “প্রথমে আমরা একটা ইলেকট্রন নেই (নিই)”। শুধুমাত্র একটা ইলেকট্রন আলাদা ভাবে
নেয়া খুব সহজ নয়। “এবার একে একটা টেবিলে স্থাপন করি” -
ইলেকট্রন! টেবিলে স্থাপন!! কীভাবে? তারপর বলা হচ্ছে ইলেকট্রনকে কেন্দ্র করে একটা
বৃত্ত আঁকতে। পরীক্ষাটাকে একটু সহজভাবে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন
করা জরুরি। নয়তো ধর্মবাদীরা এটাকে নিয়েই ফ্যানাবে।
হয়েলের
বোয়িং ৭৪৭ ফ্যালাসি ব্যাখ্যা করা হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে। প্রসঙ্গক্রমে সরল চোখ থেকে জটিল চোখের
বিবর্তনের বর্ণনা এসেছে। বর্ণিত হয়েছে অজৈব যৌগ থেকে জৈব যৌগের উৎপত্তির বিভিন্ন ধাপ। অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদের ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও
বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ বইতে আরো বিস্তারিত আছে এ প্রসঙ্গ। বিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিক্ষিপ্ত
মিউটেশনের বর্ণনায় বানরের শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট টাইপ করার উদাহরণটি খুবই চমকপ্রদ। অধ্যায়ের শুরুতে ফ্রেডরিক
হয়েলের এত বড় একটা ছবি ছাপিয়ে হয়েলকে কি একটু বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে গেলো না?
শুরুতে?
- এই সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়। খুব কম কথায় সহজ বৈজ্ঞানিক
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে মহাবিশ্বের উৎপত্তির কথা। অলৌকিকত্ব ছাড়াই কীভাবে
পদার্থের উৎপত্তি, ভরের উৎপত্তি, শক্তির উৎপত্তি। বিগব্যাং এর মাধ্যমে
মহাবিশ্বের সূচনার পর কীভাবে বেড়ে চলেছে এর এনট্রপির পরিমাণ- কীভাবে বেড়ে চলেছে
মহাবিশ্বের আয়তন প্রাকৃতিক পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মেই- খুবই টানটান প্রাঞ্জল বর্ণনা। মহাবিশ্বের উৎপত্তির জন্য যে
কোন অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার আদৌ প্রয়োজন নেই তা এ অধ্যায়টি পড়লেই প্রতীয়মান হবে।
ভাববাদী
দার্শনিকদের চিন্তার একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে ‘আত্মা’। কত রকমের ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা
যে আছে আত্মাকে ঘিরে। বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ ও শব্দাংশ প্রচলিত আছে ‘আত্মা’কে নিয়ে। মানুষ মরলেও আত্মা নাকি মরে
না। মৃত্যুর পর
আত্মার শান্তির জন্য কত রকমের অনুষ্ঠানের অনুশাসন প্রচলিত। অবিশ্বাসের দর্শনের পঞ্চম
অধ্যায় “আত্মা
নিয়ে ইতং বিতং” এক কথায় প্রচলিত আত্মার মৃত্যুবাণ। আত্মা সংক্রান্ত কোন মানসিক ঝামেলায় পড়লে “আত্মা নিয়ে ইতং বিতং” পড়ে নিন, ঝামেলা কেটে যাবে। (তবে ‘ইতং বিতং’ শব্দের অর্থ কী আমাকে জিজ্ঞেস
করবেন না, আমি বলতে পারবো না। ‘আত্মা’ শব্দটি যদি মেনে নিতে পারেন, ‘ইতং বিতং’ এ সমস্যা হবার কথা নয়।) মৃত্যু ও মৃত্যুর সংজ্ঞা
নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে এ অধ্যায়ে। আত্মার অসারতা, আত্মার নানারকম গল্প,
বিজ্ঞানের চোখে আত্মা ও অমরত্ব, আত্মা নিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সন্নিবেশে
প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে এ অধ্যায়। এ অধ্যায়ে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ বই থেকে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা (পৃঃ
১৪ - ২০) হুবহু উদ্ধৃত হয়েছে প্রাসঙ্গিক ভাবেই। এ অধ্যায়ের শেষাংশে মৃত্যুর
পর চোখ সহ দেহের অন্যান্য অংশ বা পুরো দেহটিই মেডিকেল কলেজে দান করার আহ্বানটি
খুবই দরকারি এবং মানবিক অর্থবহ। দেশের বাইরে (আমার জানামতে অস্ট্রেলিয়ায়) আত্মায় বিশ্বাসীরাও দেহ বা
প্রত্যঙ্গ দান করার অঙ্গীকার করেন। মেডিকেল কলেজে তিন বছর ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ব্যবচ্ছেদের পর দেহগুলো যার
যার পরিবারের কাছে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা থাকে যদি পরিবার চায়।
পৃথিবীর বেশিরভাগ আস্তিক
মানুষের ধর্ম উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত।
জন্মসূত্রে যে ধর্ম কাঁধের ওপর চেপে বসে তার ইমেজ রক্ষা করার দায়িত্বও নিজের কাঁধে
তুলে নেন ধর্মপরায়ণ মানুষ। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার
জন্য নানারকম ছলচাতুরি করতেও বাধে না তাদের। বিজ্ঞানের
ব্যাপক প্রসার ও প্রযুক্তির সহজ লভ্যতার কারণে ধর্মের ঐশ্বরিক আবেদন এখন ক্রমশ
ক্ষয়িষ্ণু। উন্নত বিশ্বে তো বটেই - উন্নয়নশীল দেশেও এখন মোবাইল
ফোন ফেসবুকের ব্যবহার মন্দির-মসজিদ-গির্জার ব্যবহারের চেয়ে অনেক বেশি। এ অবস্থায় ধর্মবাদীরা ঐশ্বরিক কিতাবে বিজ্ঞান খুঁজে পাবার দাবি
করছেন। ব্যাপারটা হাস্যকর, কিন্তু বিপজ্জনকও বটে। কারণ এদের দলে কিছু কিছু শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীও দেখা যায়
মাঝে মাঝে। পারলৌকিক প্রাপ্তির লোভ তো বটেই - ইহলৌকিক নগদ
প্রাপ্তিও তাদের কম নয়। তাই এখন নাকি কোরানে ‘বিগ-ব্যাং’ এর আয়াত পাওয়া যাচ্ছে। বেদও পিছিয়ে নেই - সেখানেও
বিগ-বিগব্যাং হাজির মৃণাল দাসগুপ্ত নামক বিজ্ঞানীদের কল্যাণে। যে
রামায়ণের হনুমান সূর্যকে বগলের নিচে রেখে দিতে পারে- সেখানেও হয়তো ক’দিন পরে বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়া যাবে।
কোরান টেম্পারিং করে নাইন্টিনের ‘মিরাকল’ ঘটিয়ে ফেলছেন রাশাদ খলিফা ও
তাঁর ধ্বজাধারীরা। এসব বিজ্ঞানময় কিতাবের মুখোশ খুলে দিয়েছেন অভিজিৎ
রায়হান অবিশ্বাসের দর্শনের ষষ্ঠ অধ্যায়ে।
দুর্নীতি,
সন্ত্রাস, অরাজকতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে নৈতিকতার সব রকমের অবক্ষয়
ঘটেছে যেসব দেশে - সেসব দেশে আশ্চর্যজনক ভাবে ধর্মের ব্যবহার অনেক বেশি। তার মানে কী দাঁড়ালো? ধর্মের
সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক যদি থাকে তা কীরকম? স্বাভাবিক সরল যুক্তিতে তো বলতে হয় ধর্ম
নৈতিকতার বিপ্রতীপ। কিন্তু আসলে তা নয়। নৈতিকতা আসলে ধর্ম নিরপেক্ষ- অর্থাৎ নৈতিকতার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। সপ্তম অধ্যায় “ধর্মীয় নৈতিকতা”য় লেখকদ্বয় বিভিন্ন ধর্ম ও
ধর্মগ্রন্থ এবং তাদের অনুসারীদের আচার-আচরণ ব্যাখ্যা করে বাস্তব উদাহরণ ও উপাত্তের
সাহায্যে দেখিয়েছেন কীভাবে ‘ধর্ম-মুক্ত’ দেশে নৈতিকতার উৎকর্ষ ঘটেছে। কীভাবে মানুষ ধর্মহীন হয়েও কতটা সুখে আছে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী
স্টিফেন ওয়াইনবার্গের উদ্ধৃতি এখানে সার্থকভাবে প্রযোজ্যঃ “ধর্ম মানবতার জন্য এক নির্মম পরিহাস। ধর্ম মানুক বা নাই মানুক, সবসময়ই এমন
অবস্থা থাকবে যে ভাল মানুষেরা ভাল কাজ করছে, আর খারাপ মানুষেরা খারাপ কাজ করছে। কিন্তু ভাল মানুষকে দিয়ে
খারাপ কাজ করানোর ক্ষেত্রে ধর্মের জুড়ি নেই” (পৃঃ ১৯৮)।
শারীরিক অসুখের ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীদের
নিরলস সংগ্রাম চলছে। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের যে ভাইরাস সমাজে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে আছে - এবং
পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত ছড়ানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে যে পরিমাণ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার
তা কি গড়ে উঠছে? ধর্মীয় বিশ্বাসের ভাইরাসে কত মানুষের প্রাণ গেছে তার একটা ক্ষুদ্র
তালিকা দেয়া হয়েছে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ অধ্যায়ে (পৃঃ ২৩৭-২৪৫)। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা, আফগানিস্তানে তালেবানি কাজ-কারবার, টুইন টাওয়ার
ধ্বংস করে এতগুলো মানুষ মেরে ফেলা, ইরাক যুদ্ধ - সবই ধর্মীয় ভাইরাসের পরোক্ষ
প্রভাব। সাথে অবশ্য
বাস্তব অর্থনৈতিক ব্যাপারও আছে। যে আত্মঘাতী বোমারুরা শরীরে বোমা বেঁধে আল্লাহ্র নামে শহীদ হবার জন্য
ঝাঁপিয়ে পড়ছেন - তাঁরা তার বিনিময়ে নিজের পরিবারের সারাজীবনের ভরণপোষণ ও
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন। তা না হলে শুধুমাত্র বিশ্বাসের ভাইরাসের শক্তি হয়তো ততটা হতো না। কিন্তু এই ভাইরাস যে ভীষণ
শক্তিশালী তা অনস্বীকার্য। ২৫৮ পৃষ্ঠার গ্রাফটা সরাসরি প্রমাণ করে দিচ্ছে যে ধর্মীয় প্রভাব-মুক্ত
দেশের বেশিরভাগেরই জিডিপি ধর্মীয় ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ, নাইজার, ইয়েমেনের
মত দেশে শতকরা ৯৯ জন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অথচ এসব দেশে দারিদ্র্য
মানুষের ধর্মের মতই নিত্যসঙ্গী (পৃঃ২৫৬)। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকেও উদারপন্থীরা
রক্ষণশীলদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। ২৫২ পৃষ্ঠার চিত্রদুটো তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তবে এটাও ঠিক যে ধর্মে
বিশ্বাসীরা বেশ অলসও বটে। একটা দুটো ধর্মীয় পুস্তক আঁকড়ে ধরে বিশ্বজয় করার স্বপ্ন দেখে তারা -
কুতর্ক করে একই যুক্তি বারবার দেয় একই বই থেকে। অথচ অবিশ্বাসীদের তিন শতাধিক
রেফারেন্স বই ও গবেষণাপত্র আত্মস্থ করে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ লিখতে হয়। সারা প্যালিন বা ক্রিস্টিন ওডেনেলের চেয়ে রিচার্ড ডকিন্স বা বিল মার যে
অনেক বেশি স্মার্ট তা তো সবাই স্বীকার করবেন। ২৫৪ পৃষ্ঠায় এই চারজনের ছবি
দেয়া হয়েছে।
নতুন
দিনের নাস্তিকতাই যে আগামীদিনের ভাইরাসমুক্ত সমাজ গঠন করবে তা দৃঢ় যুক্তিতে ব্যক্ত
করেছেন অভিজিৎ রায়হান তাঁদের বইয়ের শেষ অধ্যায়ে। বিশ্বাসের দীনতা, বিশ্বাসের
উদ্ভব, ধর্মের কুফল, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, ধর্মহীন সমাজ প্রসঙ্গে প্রাণবন্ত আলোচনা
করেছেন লেখকদ্বয়। ধর্মহীন সমাজের উদাহরণ হিসেবে ডেনমার্কের সামাজিক প্রসঙ্গ এসেছে। সমাজবিজ্ঞানী ফিল জাকারম্যান
ডেনমার্কে চৌদ্দমাস থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এদেশের মানুষের সামাজিক জীবনযাপন। ধর্মহীন এ সমাজ প্রায়
অপরাধহীন। ইউরোপের
পাশাপাশি দেশ জার্মানি, ইতালি বা ফ্রান্সের দিকে তাকালেও ব্যাপারটা চোখে পড়বে। আমি নিজে মিউনিখে দেখেছি
ট্রেন স্টেশনে কোন টিকেট-চেকার নেই, এমন কি কোন দরজাও নেই স্টেশনে ঢোকার মুখে। অথচ রোমে গিয়ে দেখলাম
ডাবল-গেট দিয়ে ঠেকাতে হচ্ছে বিনা-টিকেটের যাত্রীদের। ভ্যাটিকানের এত কাছেই
নৈতিকতার এত বড় বিপর্যয়!
বইয়ের ছাপা ও বাঁধাই চমৎকার। সামিয়া হোসেনের প্রচ্ছদ খুবই প্রাণবন্ত।
বইতে ব্যবহৃত চিত্রগুলোর পরিস্ফুটন খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু সারা বইতে একটা
চিত্রেরও নম্বর দেয়া হয়নি। ফলে মাঝে মাঝে বর্ণনার সাথে চিত্র মিলিয়ে নিতে কষ্ট হয়। যেমন চতুর্থ অধ্যায়ের পৃঃ১২০
ও পৃঃ১২১ এ চিত্র-২ ও চিত্র-১ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু চিত্রে নম্বর না
থাকাতে কোন্চিত্রের কথা বোঝানো হচ্ছে তা পরিষ্কার হয়নি। তাছাড়া ওই পৃষ্ঠাগুলোতে মাত্র
একটি চিত্রই আছে। এ বইয়ের যদি কোন বড় দুর্বলতা থাকে তা হলো বানান বিভ্রাট। অনেকগুলো ভুল বানান চোখে
পড়েছে। ৩৭১ পৃষ্ঠার অফসেট বোর্ড বাঁধাই বইয়ের দাম
পাঁচশ’ টাকা
রাখার যুক্তি হয়তো আছে, তবে দাম আর একটু কম রাখা গেলে ভালো হতো।
বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও মুক্তমনার
আত্মপ্রকাশ নিয়ে আলোচনা এই বই থেকে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বিশ্বাসের ভাইরাস আমাদের
যেভাবে আতঙ্কিত করে - আগামীদিনের বিশ্বাসমুক্তদের পদধ্বনি তেমনি আমাদের আশান্বিত
করে। মুক্তমনার
সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে, ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে আমাদের মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র,
সমৃদ্ধ ও শানিত হচ্ছে আমাদের যুক্তিবোধ। এই উত্তরণের পথে একটা বিরাট মাইলফলক হয়ে
থাকবে “অবিশ্বাসের দর্শন”। সেজন্য অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীরের প্রতি সকল মুক্তমনার পক্ষ থেকে
জানাচ্ছি কৃতজ্ঞতা।
Labels:
গ্রন্থ পর্যালোচনা,
দর্শন,
বই,
বিজ্ঞান,
সমাজ
Subscribe to:
Posts (Atom)
Latest Post
বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও
পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...
Popular Posts
-
প্রথম অধ্যায় স্যাটেলাইটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পৃথিবী এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে তা ইচ্ছে করলে আমরা সরাসরি দেখতে ...
-
পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...
-
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনা পৃথিবীর অনেক ভাষায় রূপান্তরিত হওয়া উচিত। বিশ্বজনীন ভাষায় যাঁদের দখল আছে, তাঁরা তা করছেন কিছু কিছু। বিশ্বজনীন ভ...