বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত হতে পারে। এবার প্রশ্নটিকে একটু পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করা যাক। অতীত কিংবা বর্তমান যে কোনো সময়ের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় প্রাণি কী ছিল বা আছে? এর উত্তরে আমাদের কারো কারো ডাইনোসরের কথা মনে হতে পারে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসররা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তখনো কিন্তু মানুষের উদ্ভব হয়নি। অর্থাৎ কোন মানুষই কোনোদিন কোনো জীবন্ত ডাইনোসর দেখেনি। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হবার পর থেকে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসর এবং সেই যুগের পৃথিবী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন। জীবাশ্মের হাড়ের গঠন বিশ্লেষণ করে, হাড়গুলি ঠিকমতো সন্নিবেশ করিয়ে পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসরের কাঠামোগত আকার ও আকৃতির পূননির্মাণ করে তাদের আনুমানিক দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও ভরের হিসেব বিজ্ঞানীরা করেছেন। এপর্যন্ত আবিষ্কৃত ডাইনোসরের সবচেয়ে বড় জীবাশ্ম পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়াতে। এই অঞ্চলের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে প্যাটাগোটাইটান মায়োরাম (Patagotitan mayorum)। বিজ্ঞানীরা প্রাপ্ত তথ্য এবং প্রমাণের ভিত্তিতে হিসেব করে দেখেছেন টাইটানোসরাস গোত্রের এই ডাইনোসর ছিল প্রায় ৩৭ মিটার লম্বা আর প্রায় ৭৬ টন ভারী। দেখা যাচ্ছে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে কিছু কিছু ডাইনোসর নীল তিমিকে ছাড়িয়ে গেলেও – ভরের দিক থেকে ওরা নীল তিমির চেয়ে বড় ছিল না।
সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণি ডাইনোসরদের সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। বিশেষ করে এদেরকে নিয়ে যখন জুরাসিক পার্ক জাতীয় কল্পবৈজ্ঞানিক সিনেমা তৈরি হতে থাকে – সবার ভেতর ডাইনোসর সম্পর্কিত এক ধরনের ভীতিমিশ্রিত কৌতূহল তৈরি হয়। কাল্পনিক অতিরঞ্জন বাদ দিয়ে বাস্তবিক ডাইনোসরদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা গত কয়েক শ বছর ধরে।
ডাইনোসরের জীবাশ্ম সর্বপ্রথম কখন এবং কোথায় পাওয়া গিয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হওয়ার পর থেকে মানুষ প্রকৃতির সাথে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রাম এবং অভিযোজন করতে করতে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। এর মধ্যেই নানা প্রয়োজনে নানা ভাবে তারা অর্জন করেছে বিশেষ জ্ঞান এবং দক্ষতা। জীবাশ্ম সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েক হাজার বছরের পুরনো চীনা লেখায়, যেখানে বিভিন্ন জায়গায় ড্রাগনের হাড় পাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। ড্রাগন একটি কাল্পনিক প্রাণি – যাদের বিশাল দেহ, উড়তে পারে, মুখ থেকে আগুনের হল্কা বের হয় ইত্যাদি আরো অনেক ভয়ানক শক্তির অধিকার দেয়া হয়েছে এদেরকে মানুষের কল্পনায়। সেখান থেকে ধারণা করা যায় ডাইনোসরের বিশালাকৃতির জীবাশ্ম পাওয়া যাচ্ছিলো হাজার বছর আগেও – যেখান থেকে মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে ড্রাগনের মতো ভয়ানক প্রাণির। কিন্তু সেই জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করার মতো জ্ঞান ও দক্ষতা ছিল না সেই যুগে। তাই সেগুলি সংরক্ষিতও হয়নি।
ডাইনোসরের জীবাশ্ম সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ শুরু হয় ১৬৭৬ সালে। যদিও বিজ্ঞানীরা তখনো জানতেন না ডাইনোসর কী, এমনকি ‘ডাইনোসর’ নামটিও তখনো দেয়া হয়নি। ইংল্যান্ডের এক জাদুঘরের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড রবার্ট প্লট ১৬৭৬ সালে ইংল্যান্ডের এক জায়গায় একটি প্রকান্ড হাড় আবিষ্কার করেন। পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনি ধারণা করলেন এটি একটি প্রাচীন বিশালাকৃতি মানুষের উরুর হাড়। তখনো জীবাশ্ম সংরক্ষণের প্রযুক্তি ততটা উন্নত হয়নি। এই হাড়টি পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু রবার্ট প্লটের আঁকা হাড়ের চিত্র থেকে বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে ধারণা করেন যে এই হাড়টি ছিল মেগালোসরাস (Megalosaurus) গোত্রের ডাইনোসরের। হাড় পাওয়ার কয়েক শ বছর পরে বিশ্লেষণ করা হলেও, হাড় পাওয়া যাবার সময়ের হিসেবে বলা চলে মেগালোসরাস ডাইনোসর হলো বৈজ্ঞানিকভাবে নিবন্ধিত প্রথম ডাইনোসর।
১৮১৯ সালে ব্রিটিশ জীবাশ্ম বিজ্ঞানী উইলিয়াম বাকল্যান্ড বেশ কিছু জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন এবং ১৮২৪ সাল পর্যন্ত তাদেরকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাদের বৈজ্ঞানিক নাম দেন এবং বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। তিনি ভেবেছিলেন এই জীবাশ্মগুলি কোন বড় প্রজাতির পূর্বপ্রজন্মের সরিসৃপের । তখনো বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেননি যে এই জীবাশ্মগুলির সাথে বর্তমান পৃথিবীর কোন প্রাণির হুবহু মিল নেই।
সেইসময় একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী উইলিয়াম ডেভনশায়ার শল (William Devonshire Saull) শখের বশে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র জমাতেন এবং সেগুলি রাখার জন্য বড় বড় জাদুঘর তৈরি করেছিলেন। প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটায় তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা আগ্রহীদের দেখার জন্য খুলে দিতেন। তাঁর সংগ্রহে অনেক রকমের প্রাচীন প্রাণির হাড় ও জীবাশ্ম ছিল। ১৮৪২ সালের শুরুতে ব্রিটিশ জীবাশ্মবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়েন (Richard Owen) উইলিয়াম শলের সংগ্রহশালায় গিয়ে সেখানকার কিছু জীবাশ্ম দেখে খুব অবাক হলেন। মেরুদন্ডের হাড় দেখে তাঁর মনে হলো এগুলি কোন প্রাচীন ইগুয়ানা গোত্রের গিরগিটির হাড় হতে পারে। কিন্তু তাঁর মনে খটকা রয়ে গেল। যেসব গিরগিটি পৃথিবীতে আছে, তাদের হাড়ের সাথে কিছুটা মিল থাকলেও পুরোপুরি মিল নেই এসব জীবাশ্মের হাড়ের। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনি বুঝতে পারলেন যে জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া প্রাণিগুলির প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেখতে গিরিগিটির মতো মনে হলেও এই বিলুপ্ত প্রজাতি আরো ভয়ঙ্কর ছিল এই ভাবনা থেকে তিনি তাদের নাম দিলেন – ডাইনোসর। গ্রিক শব্দ ডাইনোস অর্থ ভয়ঙ্কর, আর সরোস অর্থ সরিসৃপ। সে হিসেবে ডাইনোসরের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ভয়ঙ্কর সরিসৃপ। রিচার্ড ওয়েনের দেয়া নাম টিকে গেল।
১৮৪২ সাল থেকে ডাইনোসরের জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও ডাইনোসরের জীবাশ্ম খুঁজে বের করার অভিযান পুরোদমে শুরু হয়েছিল আঠারো শ সালের শেষের দিকে আমেরিকান বিজ্ঞানী ওথনিয়েল মার্শ (Othniel Charles Marsh) ও এডোয়ার্ড কোপের (Edward Drinker Cope) মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে। বলা যায়, ডাইনোসর সম্পর্কে আজ আমরা যতটুকু জানি, তার পেছনে এই দু’জন আমেরিকান বিজ্ঞানীর অবদান সবচেয়ে বেশি।
ওথনিয়েল চার্লস মার্শের জন্ম নিউইয়র্কের একটি খামারে ১৮৩১ সালের ২৯ অক্টোবর। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। তাঁর বাবার একমাত্র ইচ্ছে ছিল ছেলে বড় হয়ে খামারেই কাজ করবে, চাষীর ছেলে চাষীই হবে। কিন্তু বালক বয়সেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ওথনিয়েল মার্শ। তাঁর সেই আগ্রহে উৎসাহ এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দেন তাঁর মামা জর্জ পিবডি। ক্রমে তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর জার্মানির বার্লিন ইউনিভার্সিটি ও হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে এনাটমি ও প্যালিওনটোলজি (জীবাশ্মবিজ্ঞান) বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। জার্মানি থেকে ফেরার পর ১৮৬৬ সালে তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে জীবাশ্মবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম জীবাশ্মবিজ্ঞান বিষয়ের প্রফেসর। তিনি প্রফেসর হয়েই তাঁর মামার কাছ থেকে দেড় লক্ষ ডলারের অনুদান আদায় করে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে স্থাপন করলেন ‘পিবডি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’। তাঁর মামা তাঁকে আরো এক লক্ষ ডলার দেন গবেষণা কাজ করার জন্য। সেই টাকায় তিনি পুরোদমে ডাইনোসরের জীবাশ্ম সন্ধান করেন এবং অনেকগুলি নতুন প্রজাতির ডাইনোসর আবিষ্কার করেন।
এডোয়ার্ড ড্রিংকার কোপের জন্ম ১৮৪০ সালের ২৮ জুলাই পেনসিল্ভেনিয়ার একটি ধনবান পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের পরিমন্ডলে বড় হয়েছেন তিনি। আঠারো বছর বয়সে প্রকাশ করেছেন প্রথম গবেষণাপত্র। ১৮৬৩ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থেকে ছেলেকে দূরে রাখার জন্য এডোয়ার্ডের বাবা এডোয়ার্ডকে পাঠিয়ে দেন জার্মানিতে। জার্মানিতেই এডোয়ার্ডের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় ওথনিয়েল মার্শের।
আমেরিকায় ফিরে আসার পরেও ওথনিয়েল এবং এডোয়ার্ডের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল অনেক বছর। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ১৮৬৭ সালে এডোয়ার্ড তাঁর আবিষ্কৃত একটি উভয়চর প্রাণির জীবাশ্মের নাম দেন ওথনিয়েল মার্শের নামানুসারে টাইওনিয়াস মার্শি (Ptyonius marshii)। এর প্রত্যোত্তরে পরের বছর ওথনিয়েল মার্শ তাঁর আবিষ্কৃত একটি নতুন এবং বিশাল সরিসৃপের জীবাশ্মের নাম রাখেন এডোয়ার্ড কোপের নামানুসারে মোসাসরাস কোপিয়ানাস (Mosasaurus copeanus)।
কিন্তু এই সৌহার্দ্য বেশিদিন টেকেনি। জীবাশ্মবিজ্ঞানে দুজনই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াই শুরু করেছেন। তাতে নানারকম অনৈতিক কৌশলও অবলম্বন করছেন তাঁরা। ১৮৬৮ সালে এডোয়ার্ড কোপ ওথনিয়েল মার্শকে নিউজার্সির একটি জীবাশ্ম সংগ্রহশালা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন নতুন কোন প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া যায় কি না দেখতে। সেখানে গিয়ে ওথনিয়েল মার্শ এডোয়ার্ড কোপকে না জানিয়ে সংগ্রহশালার মালিকের সাথে চুক্তি করে ফেলেন যেন নতুন কোন জীবাশ্ম পেলে তা সরাসরি তাঁর কাছে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এটা জানার পর এডোয়ার্ড কোপ স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা খুশি হলেন না।
একই বছর এডোয়ার্ড কোপ একটি বিলুপ্ত প্রজাতির সামুদ্রিক সরিসৃপের জীবাশ্ম পেয়ে তার নামকরণ করেন ইলাসমোসরাস প্লাটিউরাস (Elasmosaurus platyurus) এবং সেটা সম্পর্কে দ্রুত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ফেলেন আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির জার্নালে। কিছুদিন পর ওথনিয়েল মার্শ এডোয়ার্ড কোপের জীবাশ্মটি দেখতে গিয়ে দেখেন যে হাড়ের পুনর্বিন্যাস করার সময় এডোয়ার্ড কোপ ভুল করে মেরুদন্ডের হাড় যেগুলি মাথার দিকে হওয়ার কথা সেগুলি লেজের দিকে স্থাপন করেছেন। ভুল ধরা পড়ার পর এডোয়ার্ড কোপের আত্মগরিমায় প্রচন্ড আঘাত লাগলো। তিনি দ্রুত ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করলেন। যে জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার অবিক্রিত সবগুলি কপি কিনে নিলেন। জার্নালের পরের সংখ্যায় একটি সংশোধনী ছাপানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তাতেও তাঁর মনের ক্ষোভ কমলো না। তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো ওথনিয়েল মার্শের ওপর।
শুরু হলো দুজনের মধ্যে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা – কে কার আগে কত বেশি জীবাশ্ম সংগ্রহ করতে পারবে – এবং প্রতিযোগিতা থেকে বন্ধুত্ব পরিণত হলো শত্রুতায়। ওথনিয়েল মার্শ গোয়েন্দা লাগালেন এডোয়ার্ড কোপের গতিবিধির উপর নজর রাখতে। শুরু হলো ডাইনোসরের হাড় খোঁজার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই।
ওথনিয়েল মার্শ যেখানে যত জীবাশ্ম পাওয়া যায় সব কিনে নিতে লাগলেন। আর ওদিকে এডোয়ার্ড কোপ অতি দ্রুততার সাথে একটার পর একটা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করলেন নতুন নতুন প্রজাতির ডাইনোসরের উপর। প্রকাশনায় নিজের স্বীকৃতি আদায় করার জন্য তিনি ১৮৭৭ সালে আমেরিকান ন্যাচারালিস্ট জার্নালটিই কিনে নিলেন এবং নিজের জার্নালে ইচ্ছেমতো গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে শুরু করলেন। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে তিনি ৭৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে তিনি চৌদ্দ শতাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
এদিকে ওথনিয়েল মার্শ প্রতিজ্ঞা করেছেন যেভাবেই হোক তিনি এডোয়ার্ড কোপকে ধ্বংস করে ফেলবেন। ১৮৮২ সালে তিনি তাঁর অর্থ, প্রতিপত্তি এবং রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি গঠিত আমেরিকান জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রধান জীবাশ্মবিজ্ঞানী নিযুক্ত হলেন। এই নিয়োগ লাভ করার ফলে তাঁর হাতে প্রচুর ক্ষমতা এলো। জীবাশ্ম গবেষণার সমস্ত রাষ্ট্রীয় ফান্ড এখন তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তিনি জীবাশ্মবিজ্ঞানের উন্নয়নের বদলে এডোয়ার্ড কোপকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হলেন। তাঁর আদেশে এডোয়ার্ড কোপের সমস্ত রিসার্চ ফান্ডিং বন্ধ হয়ে গেল।
জীবাশ্ম গবেষণায় প্রচুর খরচ। একেকটি জীবাশ্ম খুঁজে বের করতে শত শত মানুষ নিয়ে দিনের পর দিন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চালিয়ে যেতে হয়। সরকারি অনুদান ছাড়া ব্যক্তিগত খরচে এই গবেষণা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ফান্ড হারিয়ে এডোয়ার্ড কোপ চেষ্টা করলেন নিজের যা কিছু ছিল তাকে আরেকটু বাড়িয়ে গবেষণা কাজ চালিয়ে যাবার। দ্রুত অর্থনৈতিক লাভের আশায় তিনি তাঁর সমস্ত সঞ্চয় বিনিয়োগ করলেন নিউ মেক্সিকোর একটি রূপার খনিতে। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। টাকা-পয়সা ক্ষমতা ইত্যাদি হারানোর সাথে সাথে এডোয়ার্ড কোপ পারিবারিকভাবেও একা হয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ত্যাগ করে দূরে সরে গেলেন। ফিলাডেলফিয়ার ছোট্ট একটি বাসায় একাকী জীবন কাটছিল তাঁর। সম্পদ বলতে তখন শুধু অবশিষ্ট আছে এত বছরের জমানো জীবাশ্মগুলি।
এডোয়ার্ড কোপকে এই অবস্থায় নিয়ে আসার পরেও তৃপ্ত হলেন না ওথনিয়েল মার্শ। তিনি এডোয়ার্ডের জীবাশ্মগুলিও দখল করতে চাইলেন। তিনি হুকুম দিলেন জীবাশ্মগুলি বাজেয়াপ্ত করার। যুক্তি দিলেন – জীবাশ্মগুলি সরকারি অনুদানের টাকায় কেনা হয়েছে, সুতরাং তা সরকারি সম্পত্তি। কিন্তু আদালতে গেলেন এডোয়ার্ড। তিনি প্রমাণ দিলেন যে জীবাশ্মগুলির বেশিরভাগই তাঁর নিজের টাকায় কেনা। ওথনিয়েল মার্শ হেরে গেলেন।
এবার এডোয়ার্ড কোপ উঠেপড়ে লাগলেন ওথনিয়েল মার্শের বিরুদ্ধে। ওথনিয়েল মার্শ নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অনেক অনৈতিক কাজ করেছেন। কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক নীতিনিয়মের তোয়াক্কা না করে তিনি জীবাশ্ম সংগ্রহ করেছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রশাসনিক পদ দখল করেছেন। এডোয়ার্ড কোপ এসমস্ত কাজের প্রমাণ গোপনে সংগ্রহ করছিলেন অনেক বছর ধরে। এবার তিনি সেইসব প্রমাণ তুলে দিলেন নিউইয়র্ক হেরাল্ডের একজন ফ্রিল্যান্ড সাংবাদিকের হাতে।
পত্রিকায় হেডলাইন হবার পর দুই সপ্তাহ ধরে বাগবিতন্ডা চললো সংবাদপত্রের পাতায় পাতায়। জনগণ ধিক্কার দিতে শুরু করলো। ওথনিয়েল মার্শ এবং তাঁর জিওলজিক্যাল সার্ভের অদক্ষতা ও সরকারি ক্ষমতা ও তহবিল তছরুপের দায়ে আমেরিকান কংগ্রেস তদন্ত কমিটি গঠন করলো। তদন্তের ফল হলো মারাত্মক। ওথনিয়াল মার্শ তাঁর পদ, ক্ষমতা, সংযোগ সবকিছু হারিয়ে ফেললেন। তাঁর সংগৃহীত জীবাশ্মগুলিও বাজেয়াপ্ত করা হলো – কারণ ওগুলি সরকারি টাকায় সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এডোয়ার্ড কোপ তাঁর জীবাশ্মগুলি নিজের কাছে রাখার সুযোগ পেলেও সেগুলি সংরক্ষণ করার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি সেগুলি বিক্রি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউই কিনতে রাজি হলো না। তাঁর বিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্জিত জীবাশ্মগুলি মাত্র বত্রিশ হাজার ডলারে বিক্রি করতে বাধ্য হলেন তিনি। ১৮৯৭ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মৃত্য হয় এডোয়ার্ড কোপের।
ওথনিয়েল মার্শ বেঁচেছিলেন আরো দুই বছর। ১৮৯৯ সালে ৬৭ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওথনিয়েল মার্শ প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়। তাঁর জীবাশ্মগুলির মধ্য থেকে আশি টনের মতো জীবাশ্ম সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। বাকি সংগ্রহ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিবডি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে দিয়ে গিয়েছিলেন।
এডোয়ার্ড কোপ ও ওথনিয়েল মার্শ ব্যক্তিগত বিরোধে জড়িয়ে পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেললেও তাতে জীবাশ্ম বিজ্ঞানের লাভ হলো প্রচুর। প্রায় তেরো হাজারের বেশি জীবাশ্মের নমুনা তাঁরা রেখে গিয়েছেন। ১৯০০ সালের শুরু থেকেই সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়ে গেলো ডাইনোসরের জীবাশ্মের খোঁজ ও গবেষণার কাজ। সেই থেকে শুরু হয়ে বর্তমান পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সাত শতাধিক প্রজাতির ডাইনোসরের জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছেন। আধুনিক নিউক্লিয়ার তেজস্ক্রিয় ক্ষয় (decay) এবং নিউক্লিয়ার ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে হিসেব করে বের করেছেন ডাইনোসরগুলি কত বছর আগে বেঁচে ছিল এই পৃথিবীতে।
যে সময়ে পৃথিবীতে ডাইনোসর বাস করতো সেই সময়টাকে মেসোজয়িক (Mesozoic) যুগ বলা হয়। আজ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছর থেকে পঁচিশ কোটি বছর আগের সময় হলো মেসোজয়িক যুগ। প্রায় বিশ কোটি বছর পৃথিবীতে বাস করেছে ডাইনোসররা। পঁচিশ কোটি বছর আগের পৃথিবী বর্তমান পৃথিবী থেকে অনেক ভিন্ন ছিল। পৃথিবীর স্থলভাগের মহাদেশগুলি সব একটির সাথে অন্যটি যুক্ত ছিল। বাতাসের তাপমাত্রা ছিল বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাও ছিল বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি। প্রাচীন উদ্ভিদ আর শৈবালে ভর্তি ছিল পৃথিবীর ভূমি। বিশ কোটি বছর ব্যাপ্ত মেসোজয়িক যুগকে আবার তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয় – ট্রাইয়াসিক, জুরাসিক এবং ক্রেটাসিয়াস পর্যায়।
বিশ কোটি থেকে পঁচিশ কোটি বছর আগের সময়টাকে বলা হয় ট্রাইয়াসিক পর্যায়। এই সময়টাতে পুরো পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ একসাথে লাগানো ছিল। তখন একটাই মহাদেশ ছিল – যাকে বলা হচ্ছে প্যানজিয়া। পৃথিবী ছিল প্রচন্ড উত্তপ্ত। ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ ছিল মরুভূমি। পানির কাছে সামান্য আদ্রতা থাকলেও বাতাস ছিল শুষ্ক। এই পর্যায়েই উদ্ভব ঘটে প্রথম যুগের ডাইনোসরের। আকারে ছোট দুপেয়ে মাংসাশী ছিল এইসব ডাইনোসর।
সাড়ে চৌদ্দ থেকে বিশ কোটি বছর আগের সময়টাকে বলা হয় জুরাসিক পর্যায়। জুরাসিক পর্যায়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ দুটি বড় মহাদেশে ভাগ হয়ে যায়। পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। মরুভূমি বদলে গিয়ে গভীর ঘন জঙ্গল তৈরি হয়। এই সময়টা ছিল ডাইনোসরদের স্বর্ণযুগ। অনেক প্রজাতির বড় বড় ডাইনোসরের উদ্ভব ঘটে এই পর্যায়ে। বড় বড় গাছের ডাল-পাতা খাওয়ার জন্য বিশালাকৃতির লম্বা গলার উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরের উদ্ভব ঘটে এই সময়। পাখির মতো ডানাওয়ালা উড়ন্ত ডাইনোসরেরও উদ্ভব ঘটে এই পর্যায়ে।
সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে চৌদ্দ কোটি বছর আগের সময়টাকে বলা হয় ক্রেটাসিয়াস পর্যায়। এই সময়কালে পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের উৎপত্তি হয়। ডাইনোসরগুলি ছড়িয়ে পড়ে সাতটি মহাদেশেই। অনেক নতুন নতুন গাছপালা, ফলমূল ও শাকসবজির উদ্ভব ঘটে। নতুন ধরনের পাখির মতো ধারালো নখযুক্ত ডাইনোসর এবং পালকযুক্ত ডাইনোসরের উদ্ভব ঘটে এই যুগে।
পৃথিবীর সাতটি মহাদেশ থেকেই ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এপর্যন্ত প্রায় আট হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে পনের হাজারের বেশি ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। বেশিরভাগ জীবাশ্ম পাওয়া গেছে মরুভূমিতে – কারণ সেখানে পাথরগুলির স্তর সহজে দেখা যায় বলে জীবাশ্ম আবিষ্কার তুলনামূলকভাবে সহজ।
আধুনিক জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের হাড়, দাঁত, পদচিহ্ন, শরীরের যে কোনো অংশ, চামড়ার ভাঁজ ইত্যাদি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি অত্যাধুনিক এক্স-রে, কম্পিউটেড টমোগ্রাফি ইত্যাদিও ব্যবহার করছেন অভ্যন্তরীণ তথ্য আবিষ্কারের জন্য। বায়োমেকানিক্স, ফিজিক্স, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে ডাইনোসরের হাঁটাচলা, শরীরের গঠন, ক্ষীপ্রতা, ওজন, আকার ইত্যাদি সব সঠিকভাবে হিসেব করতে পারছেন।
গত এক শ বছরে ডাইনোসরের জীবাশ্ম থেকে যত তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের ভিত্তিতে ডাইনোসরগুলিকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়: গিরগিটি-কোমর (সরিসসিয়ান্স) ডাইনোসর এবং পাখি-কোমর (অরনিথিসসিয়ান্স) ডাইনোসর।
সরিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলির কোমরের গঠন গিরগিটির কোমরের মতো। আবার এদের হাঁটাচলা ও পায়ের গঠনের ভিত্তিতে সরিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলিকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায় – সরোপডোমরফ্স এবং থেরোপড়্স। সরোপড শব্দের অর্থ হলো গিরগিটির মতো পা বিশিষ্ট। সরোপডোমরফ্স ডাইনোসরগুলি বিশালাকৃতি লম্বা গলা বিশিষ্ট উদ্ভিদভোজী ডাইনোসর। এরা চার পায়ে চলাচল করে এবং এদের ঠোঁটের বদলে মুখ আছে। অন্যদিকে থেরোপড্স ডাইনোসরগুলি দুই পায়ে চলাচল করে। এদের সামনের দুটি পা খুবই ছোট। থেরোপড শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো যেই পায়ে তিনটি আঙুল। এই ডাইনোসরগুলির পায়ে ধারালো নখযুক্ত তিনটি করে আঙুল। এরা আকারে বিশাল হতে পারে, আবার পাখির মতো ছোটও হতে পারে। এরা প্রচন্ড শিকারি এবং মাংসভোজী।
অরনিথিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলির কোমরের গঠন পাখির কোমরের মতো। এই প্রজাতির ডাইনোসরগুলির বেশিরভাগ উদ্ভিদভোজী। এদের গলা অপেক্ষাকৃত বেঁটে এবং মুখের বদলে পাখির মতো ঠোঁট আছে এদের।
অরনিথিসসিয়ান্স ডাইনোসরগুলিকে আবার তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় – মারজিনোসেফালিয়ান্স, অরনিথোপোড্স, এবং থাইরিওফোরান্স।
মারজিনোসেফালিয়ান্স ডাইনোসরগুলির মাথার পেছনে শক্ত হাড়ের শিঙের মতো আছে। এদেরকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায় – সিরাটোপসিয়ান্স এবং প্যাকাইসেফ্যালোসর্স। সিরাটোপসিয়ান্স ডাইনোসরদের মাথায় শিং আছে। মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত অনেকগুলি শক্ত হাড়ের শিং-এর মতো গঠন আছে। টিয়াপাখির মতো বাঁকানো ঠোঁটে এরা উদ্ভিদভোজী। প্যাকাইসেফ্যালোসর্স ডাইনোসরদের মাথার খুলি অনেক বেশি পুরু হাড় দিয়ে গঠিত। এরা দুপায়ে চলে এবং প্রধানত উদ্ভিদভোজী।
অরনিথোপোড্স ডাইনোসরগুলি প্রধানত দুই পায়ে হাঁটে। এরা বিশালাকৃতির উদ্ভিদভোজী ডাইনোসর। আকারে অনেক বেশি বড় হয়ে গেলে তখন শুধুমাত্র দুই পায়ে নিজেদের ভর সামলাতে না পারলে সামনের দুই পাও কাজে লাগায়।
থাইরিওফোরান্স ডাইনোসরগুলির শরীরে শক্ত হাড়ের বর্ম আছে। থাইরিওফোরা শব্দের অর্থ হচ্ছে বর্ম বহনকারী। এরা চার পায়ে হাঁটে। থাইরিওফোরান্স ডাইনোসরগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায় – স্টেগোসর্স এবং অ্যাঙ্কাইলোসর্স। স্টেগোসর্স ডাইনোসরগুলির পিঠ থেকে লেজ পর্যন্ত লম্বা সুঁচালো কাঁটার সারি আছে। অন্য কোন মাংসাশী ডাইনোসরের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা জন্য করার এই ব্যবস্থা। অন্যদিকে অ্যানকাইলোসর্স ডাইনোসরগুলি প্রাকৃতিকভাবে সবচেয়ে সুরক্ষিত। তাদের পিঠজুড়ে অত্যন্ত শক্ত হাডের খোলসের কারণে তাদেরকে ট্যাংক ডাইনোসরও বলা হয়ে থাকে। মাংসাশী শিকারী ডাইনোসরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এরা শক্ত পিঠ পেতে দেয়।
সবগুলি ডাইনোসরকে এই দশটি শাখা এবং উপশাখায় ফেলা যায়। তবে আরো বিভিন্ন বৈশিষ্টের ভিত্তিতে ডাইনোসরগুলিকে আরো অনেক ধরনের প্রজাতি ও উপপ্রজাতিতে ভাগ করে বিভিন্ন নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন ভয়ঙ্কর আক্রমণকারী ডাইনোসরের নাম টাইরানোসরাস। টাইরানোসরাস রেক্স বা টি রেক্স অর্থ হলো আক্রমণকারীদের রাজা। আবার অনেক ডাইনোসরের নামকরণ করা হয়েছে যেখানে জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেখানকার নাম অনুসারে। যেমন, ২০১২ সালে আর্জেন্টিনার প্যাটাগোনিয়ায় পাওয়া গেছে সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের জীবাশ্ম – যার নাম দেয়া হয়েছে প্যাটাগোটাইটান মায়োরাম। আবার আর্জেন্টিনায় প্রাপ্ত আরেকটি মাংসভোজী ডাইনোসরের নাম দেয়া হয়েছে তার আবিষ্কারক ভিক্টোরিনো হেরেরার নামানুসারে হেরেরাসরাস।
ডাইনোসরের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের গঠন এবং কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেয়েছেন। সবচেয়ে ক্ষিপ্র গতির শিকারি ডাইনোসর টাইরানোসরাসের পায়ের পেশির আকার অনেক বড়। তাদের পায়ের পেশী দ্রুততম সময়ে প্রচুর তাপ উৎপন্ন করতে পারতো যা গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হতো। এরা ঘন্টায় প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারতো। ডাইনোসরের শক্ত কঙ্কাল বিশাল শরীরের ভর বহন করতে পারতো। বিশালাকৃতির অনেক হাড়ের ভেতরে মজ্জার পরিবর্তে বাতাস দ্বারা পূর্ণ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শরীরের ওজন কম রাখার জন্যই হয়তো এরকম ছিল। উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরদের অন্ত্রের দৈর্ঘ্য মাংসভোজী ডাইনোসরদের অন্ত্রের দৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি। কারণ উদ্ভিদ হজম করতে তুলনামূলকভাবে বেশি সময় লাগতো। অনেক ডাইনোসর উদ্ভিদ হজম করার জন্য পাথর খেতো – যাতে পাকস্থলিতে গিয়ে এই পাথর উদ্ভিদের টুকরার সাথে সংঘর্ষ করে হজমে সহায়তা করতে পারে। শরীরের তুলনায় ডাইনোসরদের মগজের আয়তন ছিল খুবই ছোট। সেখান থেকে ধরে নেয়া যায় ডাইনোসররা খুব একটা বুদ্ধিমান প্রাণি ছিল না। বিশাল শরীরে রক্তপ্রবাহ চালনা করার জন্য ডাইনোসরদের দরকার ছিল খুবই বড় এবং শক্তিশালী চার-প্রকোষ্ট বিশিষ্ট হৃৎপিন্ড। ডাইনোসরদের ফুসফুস ছিল আধুনিক পাখিদের ফুসফুসের মতো। উড়ার জন্য অনেক দম লাগে বলে পাখিদের ফুসফুস স্তন্যপায়ীদের ফুসফুসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ডাইনোসরের দৃষ্টি ছিল ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ। ডায়নোসরদের শরীরের চামড়া ছিল মানুষের নখের মতো শক্ত আঁশে আচ্ছাদিত।
ডাইনোসররা পাখিদের মতো ডিম পাড়তো এবং ডিম থেকে বাচ্চা হতো। ডাইনোসরের সবচেয়ে বড় ডিম পাওয়া গেছে চীনে। নয় মিটার লম্বা একটি ডাইনোসরের বাসায় আঠারো ইঞ্চি লম্বা এই ডিম পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ডাইনোসররা পাখিদের মতো ডিমে তা দিতো এবং কিছু কিছু ডাইনোসর কুমিরের মতো করে ডিম পাড়তো এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতো।
ডাইনোসরদেরকে সরিসৃপের মতো শীতল রক্তের প্রাণি বলে ধারণা করা হয়েছিল এক সময়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন ডাইনোসররা উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রাণি ছিল। তবে তাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কত ছিল এবং সেই সময়ের পরিবেশের তাপমাত্রা কত ছিল সে সম্পর্কে সঠিক হিসেব কষা খুব সহজ নয়।
কিছু কিছু ডাইনোসর পঞ্চাশ-ষাট বছর বাঁচলেও বেশিরভাগ ডাইনোসরের গড় আয়ু ছিল বিশ থেকে ত্রিশ বছর।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি সবচেয়ে বড় ডাইনোসর যেটা পাওয়া গেছে সেটা ছিল প্রায় ৩৭ মিটার লম্বা এবং ওজন ছিল প্রায় ৭৬ টন। কিন্তু সব ডাইনোসরই এত বড় ছিল না। সবচেয়ে ছোট আকারের ডাইনোসর পাওয়া গেছে চীনে। মাত্র পঞ্চাশ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এই ডাইনোসরের নামও সবচেয়ে ছোট – মেই (Mei)।
ডাইনোসরের জীবাশ্ম এখনো পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। বিজ্ঞানীরা এখন আর খুব বেশি আশ্চর্য হচ্ছেন না তাতে। কিন্তু এখনো যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি সেটা হলো প্রায় বিশ কোটি বছর ধরে পৃথিবী দাপিয়ে চলার পর হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে গেল কেন এত বড় একটি প্রজাতি?
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি ধারণা দিয়েছেন। একটি ধারণা হলো সেই সময়ের পৃথিবীতে এমন কোন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যার প্রভাবে ডাইনোসরসহ সব প্রাণির মৃত্যু হয়েছিল।
আরেকটি ধারণা হলো আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ ঘটেছিল কয়েক শ বছর ধরে। ফলে আগুন এবং ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়েছিল পৃথিবী। সূর্যের আলো আসতে পারেনি পৃথিবীতে। অক্সিজেনের অভাবে মরে গেছে সবগুলি প্রাণি।
বর্তমানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে ধারণাটি বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন সেটা হলো প্রায় দশ কিলোমিটার চওড়া বিশাল এক গ্রহাণু ছিটকে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে। তার প্রতিঘাতে পৃথিবীজুড়ে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ, সুনামিসহ নানারকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলেছে বছরের পর বছর। সূর্যের আলো আসতে পারেনি প্রচন্ড ধুলো এবং ধোঁয়া ভেদ করে। ফলে অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে সবগুলি প্রাণি এবং উদ্ভিদ। বিশাল গ্রহাণুর আঘাতের প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। মেক্সিকোর সৈকতের নিচে সমুদ্রের তলদেশে বিশাল এক খাদ আবিষ্কৃত হয়েছে – যা গ্রহাণুর আঘাতের ফলে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। যদি ডাইনোসরসহ সমস্ত প্রাণির মৃত্যু হয়ে থাকে সেই সময় তাহলে ডাইনোসরদের উত্তরপ্রজন্ম পাখিরা বেঁচে রইলো কীভাবে? কুমির, গিরগিটি, কচ্ছপ এরকম প্রাণিগুলির সাথে ডাইনোসরের মিল আছে – তারা বেঁচে গেল কীভাবে? জীব বিবর্তনের এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আগামীতে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।
তথ্যসূত্র:
১। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ডাইনোসরস অ্যান্ড প্রিহিস্টোরিক লাইফ, মাইলস কিলি, ইউ কে, ২০০৯।
২। মার্ক জাফি, দ্য গিল্ডেড ডাইনোসর, থ্রি রিভার্স প্রেস, নিউ ইয়র্ক,২০০০।
৩। লিসা র্যান্ডেল, ডার্ক ম্যাটার অ্যান্ড দ্য ডাইনোসরস, দ্য বডলি হেড, লন্ডন, ২০১৫।
৪। স্টিফেন এল ব্রুস্যাটি, ডাইনোসর প্যালিওবায়োলজি, উইলি-ব্ল্যাকওয়েল, ইউ কে, ২০১২।
৫। জন উডওয়ার্ড, দ্য ডাইনোসর, পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউজ, নিউ ইয়র্ক, ২০১৮।
___________
বিজ্ঞানচিন্তা জানুয়ারি ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত