Showing posts with label আইনস্টাইন. Show all posts
Showing posts with label আইনস্টাইন. Show all posts

Friday, 7 June 2024

হেনড্রিক লরেন্টজ: আইনস্টাইনের গুরু




প্রফেসর হেনড্রিক লরেন্টজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আইনস্টাইন দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন, “He meant more to me personally than anybody else I have met in my lifetime” – “ব্যক্তিগতভাবে আমি জীবনে যত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তিনি।“ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে লরেন্টজ-এর গবেষণার ফসল থেকে। পদার্থের পারমাণবিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত ছিলেন হেনড্রিক অ্যান্টুন লরেন্টজ। ১৯০২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর ছাত্র পিটার জিম্যান। 

১৮৫৩ সালের ১৮ জুলাই নেদারল্যান্ডের আর্নহেমে জন্ম হয় হেনড্রিক লরেন্টজের। তাঁর বাবা ছিলেন গেরিট ফ্রেদেরিক, মা গিরট্রুইডা। চার বছর বয়সে লরেন্টজ মাতৃহারা হন। তাঁর বাবা আবার বিয়ে করেন লুবার্টা হুপকিসকে। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত লরেন্টজ একেবারে শৈশব থেকেই লেখাপড়ার মধ্যে বড় হন।

লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস ছিলেন লরেন্টজের বাবা। ছোটবেলাতেই একটি কঠোর নিয়মকানুনসমৃদ্ধ স্কুলে ভর্তি করে দেন তাকে। ওখান থেকে ১৮৬৬ সালে হাইস্কুলের বেশ এডভান্সড কোর্সে ভর্তি হয়ে যান অনায়াসে। ১৮৭০ সালে লিডেন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং দুবছরের মধ্যে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৭২ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর আর্নহেমের একটি নৈশবিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ সম্পর্কিত পিএইচডি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। 

১৮৭৫ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন হেনড্রিক লরেন্টজ। এরপর যোগ দেন লিডেন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। কয়েক বছরের মধ্যেই তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান-এর প্রধান অধ্যাপকে উন্নীত হন। নেদারল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এর আগে কোন তত্ত্বীয় অধ্যাপকের পদ ছিলো না। পদার্থবিজ্ঞানের আলাদা শাখা হিসেবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান তখন সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে। সে হিসেবে বলা যায় হেনড্রিক লরেন্টজ ছিলেন নেদারল্যান্ডের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যাপক। পরবর্তীতে ইওরোপের অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনার লোভনীয় প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও তিনি অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেননি। সারাজীবন লিডেন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করার পরেও তিনি তাঁর সোমবার সকালের লেকচার চালিয়ে গিয়েছেন। এই লেকচার ক্লাসে অংশ নিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। 

লিডেন ইউনিভার্সিটিতে আইনস্টাইন তাঁর বন্ধু পল ইরেনফেস্টের কাছে যেতেন। তখন প্রতি সোমবার প্রফেসর লরেন্টজ যে পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার ও গবেষণার অগ্রগতি সম্পর্কে যে লেকচার দিতেন – আইনস্টাইন সেখানে যোগ দিতেন। সেখান থেকে আইনস্টাইন তাঁর নিজের গবেষণার অনেক খোরাক পেয়েছেন। 

শুরুতে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের উপর কাজ করছিলেন লরেন্টজ। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও আলোর সম্পর্কের নীতিগুলি নিয়ে। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিসে আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিফলনের নীতিগুলির নতুন ব্যাখ্যা দেন। আলোর বেগ এবং যে মাধ্যমে আলো চলাচল করে সেই মাধ্যমের ঘনত্ব ও উপাদানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন লরেন্টজ। 

প্রায় একই সময়ে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী লুডভিগ লরেঞ্জও আলোর বেগের সাথে আলোর মাধ্যমের প্রতিসরণাঙ্কের একই ধরনের গাণিতিক সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। হেনড্রিক লরেন্টজ আর লুডভিগ লরেঞ্জের নাম অনুসারে এই সমীকরণের নাম হয় লরেন্টজ-লরেঞ্জ সমীকরণ। এই সমীকরণ অনুসারে আলোক মাধ্যম বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত অসংখ্য কণার সমষ্টি – যে কণাগুলি সবসময় ঢেউয়ের মতো দুলছে। মাধ্যমের ভেতর দিয়ে আলোর চলাচলের সময় এই কণাগুলির সাথে আলোর তরঙ্গের মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। এখন আমরা সবাই আলোর কণাতত্ত্ব সম্পর্কে জানি। কিন্তু সেই ১৮৭৯-৮০ সালে পরমাণু এবং তার উপাদান – ইলেকট্রন, প্রোটন-নিউট্রন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন ধারণাই ছিল না বিজ্ঞানীদের। 

১৮৮১ সালে লরেন্টজ একাডেমি অব ফাইন আর্টস এর প্রফেসর ইওহান কাইজারের মেয়ে আলেত্তাকে বিয়ে করেন। হেনড্রিক ও আলেত্তা লরেন্টজ-এর দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে হয়। তাঁদের বড় মেয়ে গিরট্রুইডা পরবর্তীতে বাবার মতোই পদার্থবিজ্ঞানী হন। 

ম্যাক্সওয়েলের সূত্র থেকে লরেন্টজের যে সমীকরণের সূত্রপাত হয়েছে, সেখান থেকেই দানা বেঁধেছে ইলেকট্রনের তত্ত্ব। ১৮৯২ সালে লরেন্টজ তাঁর তাত্ত্বিক গবেষণা থেকে উদ্ভূত প্রস্তাব করেন যেকোনো পদার্থের মধ্যেই ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আছে। লরেন্টজ তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন যে এসব চার্জিত কণার কম্পনের ফলে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের উৎপত্তি হয়। ম্যাক্সওয়েল তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সূত্র দিয়েছিলেন ১৮৫০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে। লরেন্টজ যেসময় তাঁর ইলেকট্রনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করছিলেন, সেই সময়েই ১৮৮৮ সালে হেনরিখ হার্টজ পরীক্ষাগারে তড়িতচুম্বক তরঙ্গ উৎপন্ন করতে সক্ষম হন। 

লরেন্টজ-এর সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে বাতাসে ইথার নামে এক ধরনের স্বচ্ছ পাতলা অদৃশ্য বস্তু আছে। অনেক বিজ্ঞানী বাতাসে ইথারের বেগ নির্ণয় করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে অনেকে বিশ্বাস করতেন যে ইথার স্থির – বাতাসে তাদের বেগ শূন্য। লরেন্টজও শুরুতে বিশ্বাস করতেন যে বাতাসে ইথার আছে এবং তার ভেতর দিয়ে আলো, শব্দ ইত্যাদি চলাচল করে। কিন্তু ১৮৮৭ সালে মাইকেলসন ও মর্লির পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় যে ইথারের কোন অস্তিত্ব নেই। 

কিন্তু ইথারের অস্তিত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় ব্যাপারটি পুরোপুরি মেনে নেননি লরেন্টজ। তিনি ইথার খুঁজে না পাবার ব্যাপারটিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করলেন তাঁর ইলেকট্রন তত্ত্বের গবেষণায়।  গতির ফলে বস্তুর আকারের কী পরিবর্তন ঘটে তার তত্ত্ব আবিষ্কার করেন তিনি – যা পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছে লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান নামে। লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান কাজে লাগিয়েই আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছেন তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব।

লরেন্টজের পরমাণু তত্ত্ব অনুসারে বস্তু যখন যেদিকে চলতে থাকে সেদিকে তার দৈর্ঘ্য কিছুটা কমে যায়। যদিও এই পরিবর্তন খুবই নগণ্য, বস্তুর গতিবেগ অত্যন্ত বেশি হলে এই পরিবর্তন মাপা সম্ভব। লরেন্টজ ধারণা দেন যে বস্তুর গতি বস্তুর ভেতরের চার্জিত বস্তুর মধ্যবর্তী বলের পরিবর্তন ঘটায়। 

লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান প্রকাশিত হবার আগেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়ে গেছেন হেনড্রিক লরেন্টজ তাঁর আলোর উপর চুম্বকত্বের প্রভাবের তত্ত্বের জন্য। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী পরীক্ষাগারে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ উৎপাদনের প্রমাণ পান জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হেনরিক হার্টজ। পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণে কিছুটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গিয়েছিল – সেখানে পরমাণু তত্ত্বের কোন স্থান না থাকাতে। 

লরেন্টজ তাঁর পরমাণুর তত্ত্বে চার্জিত ইলেকট্রনের ধারণা দেন – যার প্রবাহের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে পরিবাহী ও অপরিবাহী বস্তুর ধর্ম নির্ধারণ করা যায়। লরেন্টজ-এর তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেন তাঁর ছাত্র পিটার জিম্যান। এই আবিষ্কারের জন্য তাঁরা দুজন ১৯০২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পান। 

লরেন্টজের নোবেল পুরষ্কার-পরবর্তী গবেষণা আরো অনেক বেশি যুগান্তকারী। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান তত্ত্ব অনুসারে গতির ফলে গতিশীল বস্তুর ভেতরের কণার চার্জের মধ্যবর্তী তড়িৎচুম্বক বলের তারতম্য ঘটে। ফলে গতিশীল বস্তু আকারে কিছুটা সংকুচিত হয়ে যায়। এখান থেকেই পরের বছর ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কার করেন স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি। 

লরেন্টজের গবেষণা থেকে পদার্থবিজ্ঞানের এত বেশি নতুন গবেষণার পথ খুলে গিয়েছিল যে তাঁকে সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ১৯০৫ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পান। ১৯০৮ সালে পান রয়েল সোসাইটির রামফোর্ড মেডেল এবং ১৯১৮ সালে পান কোপলে মেডেল। ১৯১১ সালে তাঁর সভাপতিত্বে ব্রাসেলস-এ অনুষ্ঠিত হয় প্রথম সলভে কংগ্রেস। 

১৯১৯ সালে নেদারল্যান্ড সরকার সমুদ্র নিয়ন্ত্রণের উচ্চ-পর্যায়ের কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে প্রফেসর লরেন্টজকে। তাঁর নেতৃত্বে হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যাপক উন্নতি ঘটে নেদারল্যান্ডে। 


আইনস্টাইন ও লরেন্টজ (১৯২১)


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লরেন্টজ ইওরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা-সহযোগিতা পুনপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম সারির সাত জন বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে ‘কমিটি অন ইন্টেলেকচুয়াল কো-অপারেশন অদ দ্য লিগ অব নেশনস’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন লরেন্টজ। ১৯২৫ সালে তিনি সেই কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিলেন। 

১৯২৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি লরেন্টজ মৃত্যুবরণ করেন। নেদারল্যান্ডে তিনি এতটাই সম্মানিত ছিলেন যে তাঁর মৃত্যুতে দেশের সবগুলি টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন সার্ভিস তিন মিনিটের জন্য বন্ধ রেখে তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করা হয়। 

১৯৫৩ সালে লরেন্টজ-এর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আলবার্ট আইনস্টাইন লিডেন ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে যে লেখাটি পাঠান সেখানে তিনি লিখেছেন, “সবাই অনুভব করতো তাঁর শ্রেষ্ঠতা, তাঁর প্রাধান্য। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠতা কারো উপরই কোন চাপ সৃষ্টি করতো না।“ 

লরেন্টজ ছিলেন অত্যন্ত মানবিক, যুদ্ধবিরোধী একজন মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর এক জার্মান প্রফেসর বন্ধু তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে – পৃথিবীতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হবে শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগে। লরেন্টজ তার উত্তরে বলেছিলেন, “সেরকম পৃথিবীতে আর যেই থাকুক, আমি থাকতে চাই না।“ 

তথ্যসূত্র

১।  https://www.nobelprize.org/prizes/physics/1902/ceremony-speech/

২। https://www.britannica.com/biography/Hendrik-Antoon-Lorentz

৩। আলবার্ট আইনস্টাইন, আইডিয়াজ অ্যান্ড ওপিনিয়ন্স, রূপা অ্যান্ড কোং, দিল্লী, ২০০৯।

৪। বায়োগ্রাফিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্টিস্টস, ওয়ার্ল্ড বুক, শিকাগো, ২০০৩।

৫। https://en.wikipedia.org/wiki/Hendrik_Lorentz

 ______________

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত






Thursday, 2 September 2021

আইনস্টাইন: চিরকালের সেরা বিজ্ঞানী

 



পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম কী? এ প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ মানুষই যে বিজ্ঞানীর নাম নেন তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন। বিজ্ঞানের মানুষ তো বটেই - যে মানুষ বিজ্ঞানের ধারেকাছেও কোনদিন থাকতে চান না, তিনিও আইনস্টাইনের নাম জানেন। আর জানবেন না-ই বা কেন? আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ এবং সার্বিক তত্ত্ব প্রমাণিত হবার পর সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমে আইনস্টাইনের নাম এত বেশি প্রচারিত হয়েছে যে তিনি সিনেমার সুপারস্টারদের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। 

১৯৩১ সালে হলিউড সিনেমার সুপারস্টার চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা 'সিটি লাইটস'-এর উদ্বোধনী শো-তে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন। তখন দর্শকরা চার্লি চ্যাপলিনকে দেখে যতটা আপ্লুত হয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি আপ্লুত হয়েছিলেন আইনস্টাইনকে দেখে। আইনস্টাইন চার্লি চ্যাপলিনের প্রশংসা করে বলেছিলেন, "আপনি এত বড় শিল্পী যে আপনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না, অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ সবকিছু বুঝে যায়।" 

উত্তরে চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, "কিন্তু আপনার ক্ষমতা তো আমার চেয়েও বেশি। আপনার বিজ্ঞান কেউ বুঝতে পারে না, অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ আপনাকে পছন্দ করে।" 

ব্যাপারটা অনেকটাই সত্যি। আইনস্টাইনের সূত্রগুলি খুবই জনপ্রিয়, কিন্তু ভীষণ দুর্বোধ্য। আইনস্টাইন একাই আমূল বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর মূল বিজ্ঞানের ধারা। বিংশ শতাব্দীর সেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। অথচ ছোটবেলায় এই মানুষটি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাথামোটা। 

আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম জার্মানিতে। দানিউব নদীর তীরে ছোট্ট ছিমছাম শহর উল্‌ম। রেলওয়ে স্টেশন রোড - বানহফস্ট্রাসে'র ২০নং বাড়ির তৃতীয় তলার ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ শুক্রবার পলিন ও হেরমান আইনস্টাইনের প্রথম সন্তান আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। জন্মের সময় থেকেই আলবার্টের মাথাটা অস্বাভাবিক বড়। মাথার পেছন দিকে কেমন যেন উঁচু হয়ে আছে। আক্ষরিক অর্থে মাথামোটা ছেলেটার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হবে কি না তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন তার মা পলিন। মায়ের চিন্তা আরো বাড়লো যখন দেখলেন যে আলবার্ট আড়াই বছর বয়সেও কথা বলতে শিখলো না। 

আলবার্ট আইনস্টাইনের স্কুলজীবন শুরু হলো ১৮৮৫ সালের ১ অক্টোবর মিউনিখে বাড়ির কাছের ক্যাথলিক স্কুলে। সত্তর জনের ক্লাসে আলবার্ট  ছিল একমাত্র ইহুদি। স্কুলে তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে প্রতিদিনই তাকে সহপাঠীদের কাছে অপমানিত হতে হতো। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সহপাঠীরা তাকে মারধরও করতো। স্কুলে কোন বন্ধু ছিল না তার। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে না সে ঠিকমত। 

স্কুলের পড়াশোনার পদ্ধতি ভালো লাগে না আলবার্টের। কিন্তু বাড়িতে কাকা জ্যাকবের কাছে অংক কষতে দারুণ লাগে। কাকার কাছে বীজগণিতের চর্চা শুরু হয়েছে স্কুলে ভর্তি হবার আগে থেকেই। ১৮৮৮ সালের অক্টোবরের এক তারিখ থেকে শুরু হলো লুটপোল্ড জিমনেশিয়ামের ক্লাস। এটি হাইস্কুলের সমতুল্য। এখানেও ভালো লাগেনি তার। বিশেষ করে শিক্ষকরা যখন মিলিটারি স্টাইলে পড়ানো শুরু করেন এবং যুক্তিহীন মুখস্ত করার ওপর গুরুত্ব দেন- ভালো লাগে না তার। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের তার মনে হয়েছিল ড্রিল সার্জেন্ট, এখন হাইস্কুলের শিক্ষকদের মনে হচ্ছে ল্যাফটেন্যান্ট। 

স্কুলের পড়াশোনা প্রতি তেমন কোন আগ্রহ সৃষ্টি না হলেও বাড়িতে লেখাপড়ার একটি নতুন পথ খুলে যায় আলবার্টের। মিউনিখ ইউনিভার্সিটির মেডিকেলের ছাত্র একুশ বছর বয়সী ম্যাক্স ট্যালমুডের সাথে দশ বছর বয়সী আলবার্ট আইনস্টাইনের জ্ঞানবিজ্ঞানের যোগসূত্র তৈরি হয়। গরমের ছুটিতে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির একটি বই হাতে পেয়ে ভীষণ ভালো লেগে গেলো আলবার্টের। জ্যামিতিক সমস্যাগুলোর ভিন্নরকম সমাধান করা যায় কিনা চেষ্টা করতে লাগলো সে। গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হবার আগেই দেখা গেলো অনেকগুলো সমস্যার সমাধান সে নিজে নিজে করে ফেলেছে। পরবর্তীতে আইনস্টাইন এই জ্যামিতি বইটার নাম দিয়েছিলেন, ‘পবিত্র জ্যামিতি বই ’। 

১৮৯৪ সালে আইনস্টাইনের বাবার ব্যবসা লাটে ওঠে। দেউলিয়া হয়ে তাঁকে মিউনিখের পাট গুটিয়ে চলে যেতে হয় ইতালির মিলানে। মা-বাবা আর বোন ইতালিতে চলে গেলেও আলবার্টকে থেকে যেতে হয় মিউনিখের স্কুলে। কিন্তু সেখানে মোটেও ভালো লাগে না তার। একদিন স্কুল থেকে পালিয়ে মিলানে চলে যায় সে। তার মা-বাবা খুব রেগে যায় তাতে। তার বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। কিন্তু আলবার্টের ইচ্ছা দর্শনের শিক্ষক হবার। 

মা-বাবা অনেক বুঝিয়ে জুরিখের সুইস পলিটেকনিক্যালে পড়ার ব্যাপারে রাজি করান তাকে। কিন্তু পলিটেকনিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় ১৮৯৫ সালে পাস করতে পারলো না আলবার্ট। পরের বছর ১৮৯৬ সালে আবার পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে সুইস পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হলো আলবার্ট। পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি তার ভালোবাসার শুরু এখানেই। 

১৮৯৬ থেকে ১৯০০ - এই চার বছরের কোর্স পাস করে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হবার যোগ্যতা অর্জন করলেন আইনস্টাইন। কিন্তু পলিটেকনিক্যালের অধ্যাপকদের পড়ানোর পদ্ধতি খুব একটা ভালো লাগেনি তাঁর। তিনি নিয়মিত ক্লাসেও যেতেন না। তবে সেখানে দু'জন অন্তরঙ্গ বন্ধু পেয়েছেন আইনস্টাইন - মার্সেল গ্রোসম্যান ও অ্যাঞ্জেলো বেসো। এই দু'জনের সাথে তাঁর সারাজীবন বন্ধুত্ব ছিল। গ্রোসম্যান প্রত্যেকটি ক্লাসে যেতেন, আর আইনস্টাইন গ্রোসম্যানের ক্লাসনোট পড়ে পরীক্ষা দিতেন। 

পাস করার পর দীর্ঘদিন বেকার ছিলেন আইনস্টাইন। বিজ্ঞাপন দিয়ে টিউশনি জোগাড় করার চেষ্টাও করেছেন সেই সময়। আইনস্টাইনের বাবাও অনেক চেষ্টা করেছেন ছেলের জন্য একটা চাকরি জোগাড় করার। অনেক অধ্যাপকের কাছে তিনি নিজে চিঠি লিখেছেন চাকরিভিক্ষা করে। কিছুদিন অস্থায়ীভাবে একটি স্কুলেও শিক্ষকতা করেছিলেন আইনস্টাইন। 

১৯০২ সালে বন্ধু মার্সেল গ্রোসম্যানের বাবার সুপারিশে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন শহরের প্যাটেন্ট অফিসে তৃতীয় শ্রেণির টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসেবে চাকরি পান আলবার্ট আইনস্টাইন। বারো জনের টিমে একজন নিচুপদের কেরানি ছিলেন তিনি। 

অফিসের কাজ শেষ করার পরেও হাতে সময় থাকতো তাঁর। সেই সময়টাতে তিনি নিজস্ব গবেষণা করতেন। অফিসে একটু অবসর পেলেই তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসেন। অবশ্য সেখানে একেবারে ধ্যানমগ্ন হতে পারেন না। বসের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। ডিরেক্টর আসার আগেই নিজের গবেষণা লুকিয়ে ফেলতে হয়। অফিসে বসে নিজের গবেষণা করতে দেখলে বস নিশ্চয় খুশি হবেন না। তবে প্যাটেন্ট অফিসের কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন আইনস্টাইন। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্যাটেন্ট পরীক্ষা করতে করতে নানারকম নতুন নতুন যন্ত্র দেখতে দেখতে বেশ অভিজ্ঞ পরীক্ষক হিসেবে নাম করেছেন আইনস্টাইন। 

১৯০৩ সালে তিনি বিয়ে করলেন তাঁর সহপাঠী বান্ধবী মিলেইভা মেরিককে। ১৯০৪ সালে তাদের প্রথম পুত্র হ্যান্সের জন্ম হয়। অফিস থেকে ফিরে হ্যান্সকে কোলে নিয়ে বসেন আইনস্টাইন। বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে কাগজ পেন্সিল নিয়ে লিখতে শুরু করেন আইনস্টাইন। প্রচন্ড হট্টগোলের মধ্যেও গভীর মনযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন তিনি। অনেক সময় দেখা যায়, কোলের ওপর বাচ্চা কাঁদছে অথচ তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। 

পরের বছর ১৯০৫ সাল ছিল আইনস্টাইনের জীবনের একটি বিস্ময়কর বছর। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় এবছর তিনি যে অবদান রাখেন তাতেই তিনি হয়ে ওঠেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন। এবছর তিনি চারটি মৌলিক গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশ করেন যার জন্য পরে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। শুধু তাই নয় এবছর সংবাদপত্রের জন্য তেইশটি সমালোচনা প্রবন্ধ লেখেন, এবং এবছর তিনি তাঁর পিএইচডির থিসিস লিখে জমা দেন। এর সবগুলোই তিনি করেছেন অফিসের কাজের পরে তাঁর নিজস্ব সময়ে। 

১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের প্রথম গবেষণাপত্রটি ছিল: On a Heuristic Point of View Concerning the Production and Transformation of Light. Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭(১৯০৫), পৃষ্ঠা ১৩২-১৪৮। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন আলোর কণা ফোটনের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। আলো তরঙ্গের আকারে যেমন থাকতে পারে, তেমনি থাকতে পারে গুচ্ছ গুচ্ছ কণার শক্তির আকারে। এই ধারণা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন ম্যাক্স প্ল্যাংক।  আলোর এরকম গুচ্ছাকার শক্তিকে আলোর কোয়ান্টা বলা হয়। আলোর কোয়ান্টা বা ফোটনের ধারণার ওপর ভিত্তি করে আইনস্টাইন দেখান যে, কোন বস্তুর ওপর আলো প্রতিফলিত হবার পর সে বস্তু থেকে কিছু ইলেকট্রন নির্গত নয়। অবশ্য এ ইলেকট্রন বেরিয়ে আসার জন্য কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির দরকার হয়। আলো যেহেতু তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, বস্তুর ওপর আলোকপাতের ফলে বস্তু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হবার ঘটনাকে বলা যায় একধরনের তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ। এই বিশেষ ধরনের বিকিরণের নাম ফটো-ইলেক্ট্রিক ইফেক্ট। ম্যাক্স প্ল্যাংকের শক্তির বিকিরণের সূত্র অনুযায়ী পদার্থের ভেতর ইলেকট্রনগুলোকে পদার্থ একধরনের আকর্ষণ বল দ্বারা ধরে রাখে। পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের করতে আনতে হলে এই আকর্ষণ বলের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। আইনস্টাইন হিসেব করে দেখান যে এই শক্তির পরিমাণ আলোর কম্পাঙ্কের সমাণুপাতিক। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলা যায়, শক্তি = প্ল্যাংকের ধ্রুবক x কম্পাঙ্ক। এই আবিষ্কারের জন্য আইনস্টাইনকে ১৯২১ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়। অবশ্য এই পুরষ্কার ঘোষিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। 

আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনেক উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। বিশেষ করে বোরের পরমাণু তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয় আইনস্টাইনের ফোটন তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে আইনস্টাইন ও বোরের মধ্যে অনেক তর্কবির্তক হয়েছে, আইনস্টাইন কখনোই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র মেনে নেননি। আইনস্টাইন বিশ্বাস করেছেন বিশ্বের সব ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতি থাকে। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে- পৃথিবীর সব ঘটনাই সম্ভাবনার সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

১৯০৫ সালের মার্চ মাসে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের পেপারটি পাঠানোর পরেই পিএইচডির থিসিস নিয়ে আবার চিন্তা শুরু করেছেন আইনস্টাইন। আরেকটি থিসিস লিখতেই হবে তাঁকে। কিন্তু কোন্‌ বিষয়ে? এ'নিয়ে দুবার থিসিস লিখেছেন তিনি। দুবারই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁর সুপারভাইজার প্রফেসর ক্লেইনার। 

একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে কফি খাচ্ছেন আইনস্টাইন ও বেসো। কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে বেসোর সাথে কথা বলছেন আইনস্টাইন, “কফিতে চিনি মেশানোর পর কফির ভিসকোসিটি (সান্দ্রতা) বদলে যাচ্ছে। আরো কিছু চিনি মেশালে আরো বদলে যাবে। তার মানে চিনির কণার আয়তনের সাথে ভিসকোসিটির সম্পর্ক আছে। এখন যদি ভিসকোসিটি জানা থাকে, তাহলে আমরা চিনির অণুর আয়তন পরিমাপ করতে পারবো।” 

আণুবীক্ষণিক কণার আয়তন বের করার পদ্ধতি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করলেন আইনস্টাইন। কয়েকদিন একটানা কাজ করে তিনি ডিফিউশান কনস্ট্যান্ট ও ভিসকোসিটির সম্পর্ক ব্যবহার করে কণার আয়তন নির্ণয়ের সমীকরণ বের করে ফেললেন। কয়েকদিনের মধ্যেই আরেকটি থিসিস লিখে এপ্রিলের শুরুতে পাঠিয়ে দিলেন প্রফেসর ক্লেইনারের কাছে। 

আইনস্টাইন জানেন ক্লেইনার অনেক সময় নিয়ে থিসিসটি পড়বেন। তারপর ধীরে সুস্থে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু আইনস্টাইনকে অবাক করে দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই ক্লেইনার তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। ক্লেইনার থিসিসটি প্রত্যাখ্যান করছেন, কারণ থিসিসটি পিএইচডি থিসিস হিসেবে খুবই সংক্ষিপ্ত। থিসিসটি ছিলো মাত্র সতেরো পৃষ্ঠা। 

আইনস্টাইন আবারো রেগে গেলেন। থিসিসের দৈর্ঘ্যের ওপর কিছুই নির্ভর করে না। তিনি আবার থিসিসটি পড়ে দেখলেন। কোথাও কোন ভুল পেলেন না। থিসিসের শেষে আর একটি মাত্র লাইন যোগ করে থিসিসটি আবার পাঠিয়ে দিলেন ক্লেইনারের কাছে। 

এবার অবাক হবার পালা ক্লেইনারের। তিনি দেখলেন আইনস্টাইন কিছুই পরিবর্তন করেননি থিসিসের, দৈর্ঘ্য বেড়েছে মাত্র একলাইন। এত আত্মবিশ্বাসের কারণ কী? তিনি এবার আরো মনযোগ দিয়ে পড়ে দেখলেন থিসিসটি। থিসিসের বিষয়বস্তু চমৎকার, তবে জটিল গাণিতিক সমীকরণগুলো তিনি বুঝতে পারছেন না। ক্লেইনার থিসিসটি পাঠিয়ে দিলেন গণিত বিভাগের হেড হেনরিখ বার্কহার্ডকে। বেশ কয়েকদিন পরে বার্কহার্ড তাঁর মন্তব্যসহ থিসিসটি ফেরত পাঠালেন ক্লেইনারের কাছে। বার্কহার্ড লিখেছেন, “থিসিসে যে পদ্ধতিতে গাণিতিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা নির্ভুল, এবং অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা ছাড়া এরকম কারো পক্ষে সম্ভব নয়।” 

ক্লেইনার থিসিসটি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গ্রহণ করে আইনস্টাইনকে অফিসিয়াল চিঠি দিলেন। আইনস্টাইন এখন ডক্টর আইনস্টাইন। আনন্দ ও উৎসাহে কয়েকদিনের মধ্যেই থিসিসটিকে গবেষণাপত্রের আকারে লিখে পাঠিয়ে দিলেন অ্যানালেন ডার ফিজিকে। এটি ছিল তাঁর ১৯০৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় গবেষণাপত্র: On the Motion of small Particles Suspended in Liquids at Rest Required by the Molecular-Kinetic Theory of Heat, Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭(১৯০৫), পৃষ্ঠা ৫৪৯-৫৬০। 

এই প্রথমবারের মত আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতি সম্পর্কে আলোচনা করলেন। কোন তরল পদার্থের ওপর খালি চোখে দেখা যায় না এরকম ছোট ছোট পদার্থের কণা ভাসতে থাকলে কণাগুলোর গতি কোন নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের গতি হয় অত্যন্ত অনিয়মিত। আঠারো শতকে স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ব্রাউন এ গতি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এ গতির নাম দেয়া হয়েছে ব্রাউনিয়ান গতি। আইনস্টাইন এই গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেন যে এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের একভাগের সমান বা তার চেয়েও ছোট কণাগুলো তরল পদার্থে ওরকম বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করার কারণ হলো তাদের থার্মাল ডায়নামিক্স। বোল্টজম্যানের সূত্র ব্যবহার করে আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন এবং গ্যাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুগুলোর গতির গাণিতিক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আইনস্টাইনের এ পেপার থেকে পরবর্তীতে তাপের আণবিক-গতিতত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। আইনস্টাইনের পেপারগুলোর মধ্যে এই পেপারটিই এপর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার উল্লেখিত হয়েছে গবেষকদের গবেষণাপত্রে।

ব্রাউনিয়ান গতি সম্পর্কিত পেপারটি জার্নালে পাঠিয়ে দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই অন্য একটি সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন আইনস্টাইন। আসলে এই সমস্যাটি নিয়ে আইনস্টাইন ভাবছেন অনেকদিন থেকে। ষোলবছর বয়সে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিলো আলোক রশ্মির সাথে সমবেগে ছুটতে পারলে কেমন হতো। স্থান ও সময়ের মধ্যে সম্পর্কের কথা মাথায় আসে তাঁর। 

প্রায় দুশ বছর আগে আইজাক নিউটন ধারণা দিয়ে গেছেন যে স্থান ও কাল পরম। অর্থাৎ মহাবিশ্বের যে কোন জায়গাতেই স্থান ও কালের পরিমাপ একই হবে। কিন্তু আইনস্টাইনের কাছে ব্যাপারটি সন্দেহযুক্ত। আর্নস্ট মাখ ও হেনরি পয়েনকেয়ারও একই সন্দেহ পোষণ করেছেন। আইনস্টাইন ভাবছেন সময়ের কথা। দুটো ঘড়ি যদি একই স্থানে সমান সময় দেয়, তবে একটি ঘড়িকে অন্য একটি গ্রহে নিয়ে গেলেও কি সমান সময় দেবে? 

আইনস্টাইন দেখলেন যদি গ্যালিলিয়ান ট্রান্সফরমেশান বিবেচনা করা হয়, তবে দুটো ঘড়ি সবসময়েই সমান সময় দেবে। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হলো সব ট্রান্সফরমেশান কিন্তু গ্যালিলিয়ান নয়। সেক্ষেত্রে সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য নতুন ধরনের ট্রান্সফরমেশানের ধারণা দরকার। 

আইনস্টাইন লরেঞ্জের জ্যামিতি ব্যবহার করে সৃষ্টি করলেন লরেঞ্জ-আইনস্টাইন ট্রান্সফরমেশান সূত্র। নতুন এই সূত্রের সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। তিনি দেখালেন গতি হিসেব করার সময় ডপলারের ইফেক্ট হিসেব করতে হবে। নিঊটনের পরম গতির সমীকরণ এখানে খাটবে না। কারণ পরম গতি বলে কিছু নেই। সকল গতিই আপেক্ষিক। পৃথিবীর ভেতরে আমরা তা বুঝতে পারি না, কারণ এখানে গতি হিসেব করার সময় আমরা আসলে কোন বস্তুর সাপেক্ষেই গতি হিসেব করি। পৃথিবীর নিজের গতির কথা বিবেচনায় না রেখে আমরা পৃথিবীকে স্থির ধরেই অন্যবস্তুর গতি হিসেব করি। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে গেলে রেফারেন্স হিসেবে একটা ফ্রেম রাখতেই হবে গতি হিসেব করার জন্য, এবং সে গতি হবে আপেক্ষিক গতি। এখানে থেকেই আপেক্ষিকতার সৃষ্টি হচ্ছে, রূপ নিচ্ছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। 

আইনস্টাইন হিসেব করে দেখলেন আলোর গতির চেয়ে বেশি কোন গতি হতে পারে না। তিনি আরো দেখলেন আলোর প্রবাহের জন্য ইথারের কোন প্রয়োজন নেই। পয়েনকেয়ারও একই কথা বলেছেন ইথার সম্পর্কে। আলো বা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ প্রবাহের জন্য কোন ধরনের মাধ্যমের দরকার নেই। 

আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে করতে দেখলেন গতিশীল বস্তুর ভরও স্থির নয়। গতির সাথে বস্তুর ভর বেড়ে যায়। আইনস্টাইনের সূত্র মতে কোন বস্তু যদি আলোর বেগে চলে, তবে তার ভর অসীম হয়ে যায়। আইনস্টাইন ধারণা দিলেন আলো ছাড়া আর কোন কিছুই আলোর বেগে চলতে পারে না। এখান থেকেই তৈরি হলো তাঁর ১৯০৫ সালের তৃতীয় গবেষণাপত্র: On the Electrodynamics of Moving Bodies. Annalen der Physik, সংখ্যা ১৭(১৯০৫), পৃষ্ঠা ৮০১-৯২১। '

১২১ পৃষ্ঠার বিশাল এই গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিশেষ সূত্র ব্যাখ্যা করেন। একই বেগে চলমান সকল পর্যবেক্ষকের কাছে আলোর বেগ স্থির ধরে নিয়ে আইনস্টাইন প্রমাণ করে দেন যে স্থান (space) এবং কাল (time) পরস্পর স্বাধীন নয়, বরং স্থান ও কাল একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এখান থেকেই জন্ম হলো স্পেস-টাইম বা স্থান কালের ধারণার। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতাকে x, y, z ধরে ত্রিমাত্রিক জগতের প্রচলিত ধারণা ভেঙে শুরু হলো চতুর্মাত্রিক জগৎ। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার সাথে যোগ হলো চতুর্থমাত্রা - সময়। 

আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের গবেষণাপত্র জার্নালে পাঠিয়ে দিলেন জুনের ৩০ তারিখে। সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে পেপারটি প্রকাশিত হয়। পেপারটি জার্নালে পাঠিয়েই আইনস্টাইন সেটার একটি সম্পূরক পেপার লিখে ফেললেন। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সম্পূরক চার পৃষ্ঠার এই ছোট পেপারে আইনস্টাইন দেখিয়েছেন বস্তুর ভরের সাথে শক্তির সম্পর্ক। সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সমীকরণ E = mc2. এটাই ছিল ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের চতুর্থ গবেষণাপত্র: Does the Inertia of a Body Depend on Its Energy Content? Annalen der Physik, সংখ্যা ১৮(১৯০৫), পৃষ্ঠা ৬৩৯-৬৪১। 

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ধারণাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আইনস্টাইন দেখালেন, বস্তু থেকে যে শক্তি নির্গত হয় তা বস্তুর ভরের পরিবর্তনের সমানুপাতিক। প্রাথমিকভাবে সূত্রটি ছিলো: m = E/c2. প্রথমবারের মত পদার্থের ভরের সংজ্ঞা দিলেন তিনি, “বস্তুর ভর হলো তার ভেতরের শক্তির পরিমাণ (The mass of a body is a measure of its energy content)”। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এতদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিলো। এখন থেকে যে কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে  স্থান ও কালের ধারণা অপরিহার্য হয়ে উঠলো। 

ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক জগতে আইনস্টাইন উল্লেখযোগ্য স্থান পেতে শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ আসতে লাগলো। ১৯০৯ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন তিনি। ১৯১০ সালে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান এডোয়ার্ডের জন্ম হয়। ১৯১১ সালে তিনি যোগ দেন প্রাগ ইউনিভার্সিটিতে। ১৯১২ সালে যোগ দেন সুইস পলিটেকনিক্যালে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে। ১৯১৪ সালে যোগ দেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে করতে আইনস্টাইন নিজেকে প্রশ্ন করছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সব তত্ত্বই প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে আপেক্ষিক। সেক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণও কেন আপেক্ষিক হবে না? কাজের ফাঁকে হঠাৎ তাঁর মনে হলো কেউ যদি মুক্তভাবে উপর থেকে নিচের দিকে পড়তে থাকে, তাহলে সে কোন ধরনের ওজন অনুভব করবে না। কারণ লোকটির সাথে সাথে তার চারপাশের সবকিছুও তো পড়ে যাচ্ছে মনে হবে, সেক্ষেত্রে সে কীভাবে বুঝবে যে সে মাধ্যাকর্ষণ বলের ভেতরে আছে কি নেই। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের রেফারেন্স পয়েন্ট নেই। এক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে সে স্থির আছে, কিন্তু বাকি সবকিছু চলে যাচ্ছে উপরের দিকে। তারমানে মাধ্যাকর্ষণও আপেক্ষিক। 

পরবর্তীতে তাঁর এ ধারণা থেকেই জন্ম নেয় আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব (General Theory Of Relativity)। আইনস্টাইন তাঁর এ ধারণাকে বর্ণনা করেছেন জীবনের আনন্দময় ধারণা হিসেবে। জেনারেল থিওরিতে আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যার সমস্ত নিয়মকে গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যার প্রস্তাব করেন। 

১৯১৫-১৬ সালে প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব নিয়ে। এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তবে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে নক্ষত্রের আলোও বেঁকে যাবে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া এই তত্ত্ব তো কেউ মেনে নেবেন না। 

১৯১৯ সালের জুন মাসে আইনস্টাইনের সার্বিক তত্ত্ব প্রমাণিত হয়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি অবজারভেটরির পরিচালক, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন সূর্যের অভিকর্ষ ক্ষেত্রের টানে তারার আলো যে বেঁকে যায় তা পর্যবেক্ষণ করেন। সূর্যের পূর্ণগ্রহণের ছবি থেকে প্রমাণিত হয় যে অভিকর্ষ ক্ষেত্রের টানে আলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। নভেম্বর মাসে রয়েল সোসাইটি এডিংটনের পরীক্ষালব্ধ ফল প্রকাশ করলে আইনস্টাইন রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যান। কারণ আইনস্টাইনের তত্ত্বটি সাধারণ মানুষের কাছে এতই দুর্বোধ্য যে সাধারণের কাছে মনে হচ্ছে একমাত্র আইনস্টাইনই অন্যরকম একটি পৃথিবীকে দেখার ক্ষমতা রাখেন, একমাত্র আইনস্টাইনই পারেন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বুঝতে। আইনস্টাইনকে নিয়ে অনেক মিথের জন্ম হতে লাগলো, এবং তা লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হতে লাগলো। 

এর কয়েক বছর পর ১৯২৪ সালে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্যেন বসুর কাজের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স। আইনস্টাইন সত্যেন বসুর সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে কাজ করলেন। সত্যেন বসু একধরনের নতুন কণার ধারণা দিয়েছেন- যা ভরহীন হওয়াতে যে কোন স্বাধীন সংখ্যায় হতে পারে এবং সবগুলো কণাই একই রকম ধর্ম প্রদর্শন করবে। সত্যেন বসুর নাম অনুসারে এই কণাগুলোর নাম দেয়া হলো বোসন। আইনস্টাইন বোসন নিয়ে গবেষণা করে দেখলেন যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে সবগুলো বোসন একই শক্তিস্তরে থাকবে এবং সে শক্তিস্তর হলো সর্বনিম্ম শক্তিস্তর (Ground-state energy level)। পরে এই অবস্থার নাম হয়েছে বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট (Bose-Einstein Condensate) বা বি-ই-সি। ২০০১ সালে পরীক্ষাগারে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট সৃষ্টি করে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন উলফগ্যাং কেটেরেল (Wolfgang Ketterle), এরিক কর্নেল (Eric Cornell) ও কার্ল উইম্যান (Carl Wieman)।

এরপর আইনস্টাইন গ্রান্ড ইউনিফিকেশান থিওরি বা একটি সমন্বিত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। কিন্তু তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। ইতোমধ্যে ইওরোপে নাৎসিদের উত্থান ঘটায় আইনস্টাইনকে জার্মানি ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয় আমেরিকায়। সেখানে তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট ফর এডভান্সড স্টাডিজে অধ্যাপক হিসেবে কাটিয়ে দেন বাকি জীবন। 

১৯৫২ সালে আইনস্টাইনকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হবার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। আইনস্টাইন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। 

১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল আইনস্টাইনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরেও আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে আরো অনেক নতুন বিজ্ঞানের শাখাপ্রশাখা বিকশিত হচ্ছে। আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা 'বিয়ন্ড আইনস্টাইন' প্রকল্পের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্মরহস্য, ব্ল্যাক হোল, ডার্ক এনার্জি ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাচ্ছে। আইনস্টাইন কোন ধরনের পরীক্ষাগার ছাড়াই যে গবেষণা-তত্ত্ব দিয়ে গেছেন সেগুলি এখনো কাজ করছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পথ-প্রদর্শক হিসেবে। 

তথ্যসূত্র:
প্রদীপ দেব, সবার জন্য আইনস্টাইন, তাম্রলিপি, ঢাকা, ২০২০। এবং সেখানে উল্লেখিত অন্যান্য বই এবং গবেষণাপত্র। 
______________

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত। 










Sunday, 18 April 2021

আইনস্টাইন স্মরণে

 


আজ ১৮ এপ্রিল ২০২১, আইনস্টাইনের ৬৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।

 

আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবন ও কর্ম নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। আইনস্টাইনের জীবদ্দশায় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে আইনস্টাইন-জীবনী প্রকাশিত হয়েছিল সেই Einstein: His Life and Times  লিখেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ ফ্রাংক। ফিলিপ ফ্রাংক ছিলেন আইনস্টাইনের চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ছোট। তাঁর জন্ম হাঙ্গেরিতে, ১৮৮৪ সালের ২০ মার্চ। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী লুডভিগ বোল্টজম্যানের তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচডি করেছিলেন। ১৯১২ সালে আইনস্টাইন যখন জার্মান ইউনিভার্সিটি অব প্রাগের অধ্যাপক পদ ছেড়ে জুরিখ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিলেন, তাঁর ছেড়ে আসা পদের জন্য তিনি যাঁর নাম সুপারিশ করেছিলেন তিনি হলেন ফিলিপ ফ্রাংক। ফিলিপ ফ্রাংক ১৯১২ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জার্মান ইউনিভার্সিটি অব প্রাগে অধ্যাপনা করেছিলেন। আইনস্টাইনের সাথে ছিল তাঁর বৈজ্ঞানিক-বন্ধুত্ব। কিন্তু ১৯৩৮ সালে হিটলারের বাহিনী প্রাগ দখল করে নেয়। অন্যান্য সব ইহুদীদের মতোই ফিলিপ ফ্রাংককেও ইওরোপ ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। ফিলিপ ফ্রাংক যোগ দেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আইনস্টাইন-জীবনী। এই বই লেখার জন্য সেই সময় আইনস্টাইনের সাথে দিনের পর দিন অনেক কথাবার্তা বলেছেন তিনি। বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে আইনস্টাইনের দর্শন ছিলো অনেকটাই আলাদা। ফিলিপ ফ্রাঙ্ক ১৯৪৯ সালে Review of Modern Physics-এ Einstein’s philosophy of science প্রবন্ধে দুটো উদাহরণের মাধ্যমে সেটা প্রকাশ করেছেন এভাবে:

 

“প্রায় দশ বছর আগে আমি আইনস্টাইনের সাথে আলোচনা করছিলাম যে চার্চের অনেক উঁচু পর্যায়ের পাদ্রীরাও তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। আইনস্টাইন বলেন – তাঁর নিজের অনুমানে তিনি মনে করেন আপেক্ষিকতা সম্পর্কে যতজন পদার্থবিজ্ঞানী আগ্রহী, তারচেয়ে বেশি আগ্রহী হলেন চার্চের যাজকরা। আইনস্টাইনের কথায় আমি একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা তো আশ্চর্যের বিষয়। এই বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা কী? মৃদু হেসে তিনি উত্তর দিলেন, “যাজকরা প্রকৃতির সার্বিক নিয়মের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীরা প্রায়ই সার্বিক ব্যাপারে আগ্রহী নন।“

 

আরেকদিন  আলোচনা করছিলাম একজন বিজ্ঞানীর কাজ সম্পর্কে – যিনি তাঁর গবেষণায় খুব একটা নাম করতে পারেননি। এই বিজ্ঞানী যে বিষয়ে গবেষণা করেন – সেই বিষয়টা ভীষণ জটিল, এবং সেখানে সাফল্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রায়ই দেখা যায় – সেই বিষয়ে নতুন কিছু জানার পরে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যায়। তাই তিনি গবেষণার ফল নিয়ে খুব একটা হৈ চৈ করতে পারেন না। ফলে তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে অবমূল্যায়ন করেন। আইনস্টাইন সব শুনে এই বিজ্ঞানী সম্পর্কে বললেন, “আমি এই ধরনের মানুষদের খুব শ্রদ্ধা করি। যেসব বিজ্ঞানী এক টুকরা কাঠ নিয়ে সেই কাঠের সবচেয়ে নরম ও পাতলা অংশটা খুঁজে বের করে সেখানে একটার পর একটা ছিদ্র করতে থাকেন, কারণ সেখানে ছিদ্র করাটা সহজ, এবং সেটা নিয়ে সারাক্ষণ হৈ চৈ করতে থাকেন – সেসব বিজ্ঞানীদের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই।“ 


Wednesday, 17 July 2019

আইনস্টাইনের কাল - পর্ব-২৪ (শেষ পর্ব)


১৯৫১
অনেকদিন শয্যাশায়ী থাকার পর জুনের পঁচিশ তারিখে আইনস্টাইনের বোন মায়া মারা গেছেন। বোনকে হারিয়ে আরো একা হয়ে গেলেন আইনস্টাইন। বাড়িতে এখন তিনজন মাত্র মানুষ- হেলেন ডুকাস, মার্গট ও আইনস্টাইন।

আইনস্টাইন এখনো কাজ করছেন ইউনিফায়েড ফিলড থিওরির ওপর। অভিকর্ষজ বল ও তড়িৎচুম্বকীয় বলকে একই ফ্রেমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের বিশ্বাস- প্রকৃতিতে দুটো আলাদা আলাদা বল থাকতে পারেনা, সব প্রাকৃতিক বলই কোন না কোন ভাবে একই ফ্রেমে আবদ্ধ। তখনো স্ট্রং ও উইক নিউক্লিয়ার ফোর্সের আলাদা অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়নি। এখন অবশ্য বিজ্ঞানীরা থিওরি অব এভরিথিং(Theory Of Everything)- এর সন্ধানে গবেষণা করছেন।

প্রকাশনা
পেপারঃ২৭৪ Foreward.In Spinaoza:Dictionary. সম্পাদনাঃ ড্যাগোবার্ট রুনিস(Dagobert D.Runes), প্রকাশকঃফিলোসফিক্যাল লাইব্রেরি, নিউইয়র্ক (১৯৫১)। ড্যাগোবার্ট রুনিস সম্পাদিত স্পিনোজার অভিধানের ভূমিকা লিখে দেন আইনস্টাইন। বারুস স্পিনোজা (Baruch Spinoza)ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর ইহুদি ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক। আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত ধর্মচিন্তায় হল্যান্ডের এই দার্শনিকের অনেক প্রভাব সুস্পষ্ট। স্পিনোজা উগ্র-ইহুদিবাদের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন টোরাহ(Torah) শাস্ত্রের নিয়ম-কানুন এ যুগে অচল। রক্ষণশীল ইহুদিরা স্পিনোজাকে পছন্দ করেন না। স্পিনোজার দার্শনিক রচনাবলীর সংকলন স্পিনোজা-অভিধান। আইনস্টাইন এর ভূমিকায় বইটির প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে বইটির প্রশংসা করেন।  

পেপারঃ২৭৫ The Advent of the Quantum Theory. Science, সংখ্যা ১১৩ (১৯৫১), পৃষ্ঠাঃ৮২-৮৪। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্বের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করেন।

পেপারঃ২৭৬ Introduction.In Johannes Kepler:Life and Letters. সম্পাদনাঃক্যারোলা ব্যুমগার্ড, প্রকাশকঃফিলোসফিক্যাল লাইব্রেরি, নিউইয়র্ক (১৯৫১)। জোহানেস কেপলারের চিঠিপত্রের সংকলন ও সম্পাদনা করেন ক্যারোলা ব্যুমগার্ড(Carola Baumgardt)। আইনস্টাইন এ সংকলনে ভূমিকায় কেপলারের যুগান্তকারী গবেষণা ও আবিষ্কারের কথা স্মরণ করেন। পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের গতিপথ আবিষ্কার করেছেন কেপলার। গ্যালিলিও থেকে শুরু করে আরো অনেকের কাছে লেখা কেপলারের চিঠি থেকে জানা যায় প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করে গবেষণা করতে হয়েছে কেপলারকে।

১৯৫২
ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট চেইম ওয়েইজম্যান মারা গেছেন। ইসরায়েলি নেতারা আইনস্টাইনকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন। সিনিয়র নেতাদের এ সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড-বেন-গুরিয়ন সহ ইসরায়েল সরকারের অনেকেই গভীর উৎকন্ঠায় পড়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বেন-গুরিয়ন ইৎজাক ন্যাভনকে প্রশ্ন করলেন, আইনস্টাইন যদি রাজী হয়ে যান তখন কী হবে? তাঁকে তো প্রেসিডেন্ট বানাতেই হবে। কারণ তখন তো আর অনুরোধ ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট হলে আমাদের যে কীরকম সমস্যা হবে বুঝতে পারছেন?

আইনস্টাইন ইসরায়েলের নেতাদের সবিনয়ে জানিয়ে দিলেন, আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি এরকম একটি প্রস্তাব পেয়ে। তবে আমি প্রেসিডেন্ট পদের উপযুক্ত নই। ইসরায়েলের নেতারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজী হয়েছে জার্মানি। জার্মানি আইনস্টাইনকে আবারো সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দিতে চাচ্ছে। আইনস্টাইন এবারো দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন সে প্রস্তাব।

১৯১৯ সালের মত এবছর ফেব্রুয়ারিতে আবার সূর্যের পূর্ণগ্রহণ দেখা গেছে ইউরোপ থেকে। জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা এবছর আবার প্রমাণ পেয়েছেন আলোর ওপরও অভিকর্ষণের প্রভাব আছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবারো সঠিক প্রমাণিত হলো। নভেম্বরের ১৮ তারিখে আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল আইল্যান্ডে প্রথম হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

প্রকাশনা
এ বছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের তিনটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ

পেপারঃ২৭৭ Foreword হোমার স্মিথের Man and His Gods বইয়ের ভূমিকা। প্রকাশকঃলিটল ব্রাউন, বোস্টন (১৯৫২)। খ্যাতিমান জীববিজ্ঞানী হোমার স্মিথের ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাসভিত্তিক বই ম্যান এন্ড হিজ গডস- এর ভূমিকা লিখে দেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইন স্মিথের বস্তুনিষ্ঠতার প্রশংসা করেন।

পেপারঃ২৭৮ Those Who Read Only Newspapers See Things Like a Nearsighted Person without Glasses.Der Jungkaufmann (Zurich),বর্ষ ২৭, সংখ্যা ৪(১৯৫২), পৃষ্ঠাঃ৭৩। সুইজারল্যান্ডের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে আইনস্টাইন তরুণতরুণীদের প্রতি ক্লাসিক বই পড়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যারা সংবাদপত্র ছাড়া আর কিছুই পড়েনা, তাদের চিন্তাভাবনা চশমা ছাড়া স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের দৃষ্টির মতই সীমাবদ্ধ। শিল্পসাহিত্য বা দর্শনের খুব সামান্য অংশই কালোত্তীর্ণ হয়, আর ওই কালোত্তীর্ণ রচনাই মানব-সভ্যতার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, বিশ্বমানবতার দলিল।

পেপারঃ২৭৯ Symptoms of Cultural Decay. Bulletin of Atomic Scientists, বর্ষ ৮, সংখ্যা ৭ (অক্টোবর ১৯৫২)। বুলেটিন অব এটমিক সায়েন্টিস্টস-এ প্রকাশিত এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিকদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত নয় এবং অন্যদেশের সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণা-বিনিময়েও বাধা দেয়া উচিত নয়। আইনস্টাইন বলেন, বর্তমান রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করা যায় না। তাঁরা এমন কর্তৃত্বপরায়ণ যে শান্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও তাঁরা সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে চান, মানুষকে সংগঠিত করতে চান যেন আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।

১৯৫৩
আইনস্টাইনের শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। প্রিন্সটনের রাস্তায় হাঁটা, আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়া, প্রতিবেশীর সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করা- সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর। পৃথিবী থেকে মিলিটারি সিস্টেম উঠে গেলেই খুশি হন আইনস্টাইন। মিলিটারি সার্ভিসের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় কথা বলেছেন। গঠিত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশান অব অপোনেন্টস অব মিলিটারি সার্ভিস (International Organization of Opponents of Military Service). এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আইনস্টাইনকে অনুরোধ করা হলো সংগঠনের জার্মান শাখার সভাপতির পদ গ্রহণ করার জন্য। আইনস্টাইন জার্মানির জন্য কিছুই করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।

প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের ছয়টি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ

পেপারঃ২৮০ To the Jewish Peace Fellowship. Tidings, বর্ষ ৮, সংখ্যা ১ (১৯৫৩), পৃষ্ঠাঃ৩। ইহুদিদের একটি শান্তিবাদী সংগঠনে আইনস্টাইনের এ ভাষণটি পাঠ করা হয়।

পেপারঃ২৮১ A Comment on a Criticism  of a Recent Unified Field Theory. Physical Review, সংখ্যা ৮৯ (১৯৫৩), সংখ্যা ৩২১। ইউনিফায়েড ফিলড থিওরির ওপর এটাই আইনস্টাইনের শেষ গবেষণাপত্র। সমন্বিত তত্ত্বের গাণিতিক বিশ্লেষণের ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলেও ঠিক কীভাবে তত্ত্বটি কাজ করে সে ব্যাপারে তিনি এখনো নিশ্চিন্ত নন। থিওরির ফিজিক্স সম্পর্কেও নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি এখনো।

পেপারঃ২৮২ Elementary Reflections on the Interpretation of the Foundations of Quantum Mechanics. In Scientific Papers Presented to Max Born. প্রকাশকঃ অলিভার এন্ড বয়েড,এডিনবরা (১৯৫৩)। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম থিওরি থেকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উত্তরণের পথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু টার্ম ব্যাখ্যা করেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাফল্যের প্রায় বিশ বছর পরেও আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারছেন না।

পেপারঃ২৮৩ Preface.In Galileo Galilei,Dialouge Concerning the Two Chief World Systems: Ptolemaic and Copernican.অনুবাদঃ স্টিলম্যান ড্র্যাক। প্রকাশকঃ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, বার্কলি ও লস এঞ্জেলেস (১৯৫৩)। টলেমি ও কোপারনিকাস তত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা ভিত্তিক গ্যালিলিওর এই বইটি পুনঃপ্রকাশের সময় আইনস্টাইনের এই ভূমিকাটি প্রকাশিত হয়।

পেপারঃ২৮৪ Letter in Reply to Willium  Frauenglass. Bulletin of the Atomic Scientists, সংখ্যা ৯ (১৯৫৩), পৃষ্ঠাঃ২৩০। ব্রুকলিনের স্কুলশিক্ষক উইলিয়াম ফ্রয়েনগ্লাসকে কমিউনিস্ট সন্দেহে সিনেটর ম্যাককারথির অফিস থেকে চিঠি পাঠানো হয়। আমেরিকান সিনেটর ইন্টারনাল সিকিউরিটি সাবকমিটির সামনে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে তাঁকে। তিনি আইনস্টাইনের কাছে পরামর্শ চাইলেন। আইনস্টাইন মে মাসের ১৬ তারিখে উইলিয়াম ফ্রয়েনগ্লাসকে এই চিঠিটি লেখেন। আইনস্টাইন ফ্রয়েনগ্লাসকে পরামর্শ দেন সিনেট কমিটির কাছে না যাবার জন্য। আইনস্টাইন বলেন, প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীরই উচিত এধরণের ব্যবস্থার প্রতিবাদ করা। কারণ এই ব্যবস্থা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অনুসারে মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ শুধুই নয়, এই ব্যবস্থা সংবিধান লঙ্ঘন করে নিরপরাধ নাগরিকের ওপর রাষ্ট্রের অত্যাচার।

পেপারঃ২৮৫ Message to the 24th Annual Conference of the War Resisters League. ১০ আগস্ট ১৯৫৩, নিউইয়র্ক। ওয়ার রেজিস্ট্রারস লিগের ২৪ তম বার্ষিক অধিবেশনে আইনস্টাইনের এই বাণী পঠিত হয়। আইনস্টাইন যুদ্ধবিরোধী এই সংগঠনের কার্যকলাপের প্রশংসা করেন এবং তাদের সাফল্য কামনা করেন।

১৯৫৪
রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন আইনস্টাইন। অসুস্থ শরীরেও কাজ করে যাচ্ছেন তিনি যতটুকু পারছেন। সহযোগী গবেষক ব্রুরিয়া কফম্যানের সাথে কাজ করে আইনস্টাইন জীবনের শেষ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রটি শেষ করেন এবছর। পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তী বছর (পেপার-২৯৪)।

আমেরিকান সিনেটর ম্যাককারথির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট শিকার জোরেশোরেই চলছে। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণারত অধ্যাপক ও বিজ্ঞানীরা সবাই তটস্থ হয়ে আছেন, কখন ডাক আসে হাউজ আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিজ কমিটি থেকে। কমিটি এখন লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবোরেটরির ডাইরেক্টর, আমেরিকার প্রথম পারমাণবিক বোমার জনক রবার্ট ওপেনহেইমারকে জেরা করছে। কমিটির ধারণা, কমিউনিস্টদের প্রতি সমর্থন আছে ওপেনহেইমারের। ওপেনহেইমারের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেনস বাতিল করে দেয়া হলো, সব ধরণের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো তাঁকে। যে মানুষটি পারমাণবিক বোমার বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়ে আমেরিকাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী (বা ভয়ঙ্কর) দেশে পরিণত করেছেন সেই ওপেনহেইমারকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো আমেরিকা।
আইনস্টাইন প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত ওপেনহেইমারকে সমর্থন করেছেন। তিনি প্রকাশ্যে কঠোর ভাষায় কমিটির সমালোচনা করেছেন। আইনস্টাইন দেশের সব বিজ্ঞানীদের আহ্বান জানিয়ে চলেছেন যেন কমিটির সামনে কেউ না যায়। আমেরিকান বামপন্থী ও উদারপন্থীরা আইনস্টাইনের সাহসের প্রশংসা করলেন। তাঁদের কাছে আইনস্টাইন এখন হিরো। অন্যদিকে রক্ষণশীল ডানপন্থী ও উগ্রপন্থী আমেরিকানদের চোখে আইনস্টাইন একজন দেশদ্রোহী। তাঁরা এখন আইনস্টাইনের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাঁকে আমেরিকা থেকে বের করে দেবার দাবী তুলছেন। দেশদ্রোহী আইনস্টাইনের বিচার চেয়ে মিছিল মিটিং হচ্ছে। আইনস্টাইন জ্ঞানবিজ্ঞান ও নাগরিক অধিকারের এরকম অপমান জার্মানিতে দেখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে। এখন আমেরিকায় আবার একই রকম অপমান দেখে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লেন।

সিনেটর ম্যাককারথি এবার নজর দিলেন আমেরিকান মিলিটারি ডিপার্টমেন্টের দিকে। তিনি প্রমাণ করতে চান যে মিলিটারিতেও কমিউনিস্ট-দূষণ ঘটেছে। এতদিন শিল্পী, বিজ্ঞানী আর বুদ্ধিজীবীদের অপমান উপভোগ করেছেন মিলিটারিরা। এবার তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করতেই তাঁরা ক্ষেপে গেলেন। আর্মিদের এটর্নি সিনেটে ম্যাককারথিকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, আপনার কি লজ্জা-শরম নেই? কয়েকদিনের মধ্যেই ম্যাককারথির দিন শেষ হয়ে গেলো। তাঁর সব ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হলো। সিনেটে ম্যাককারথির কাজের সমালোচনা করে বলা হলো যে, তিনি আমেরিকান সিনেটের অপমান করেছেন। ম্যাককারথির রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলেও বিশ্বরাজনীতিতে ম্যাককারথিজম নামক নতুন শব্দ চালু হয়ে গেলো। কোনরকম প্রমাণছাড়া শুধুমাত্র সন্দেহবশত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাউকে হেনস্থা করার নাম দেয়া হলো ম্যাককারথিজম

আমেরিকা এবছর আরেকটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে। বিস্ফোরণের ফলে তিনটি দ্বীপ বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। ওপেনহেইমার এখন শান্তিবাদী। আইনস্টাইনের সাথে গলা মিলিয়ে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানালেন হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্পের। আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার পারমাণবিক বিস্ফোরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো।

প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের ছয়টি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ

পেপারঃ২৮৬ Ideas and Opinions.অনুবাদঃসোনিয়া বার্গম্যান(Sonja Bargmann)। প্রকাশকঃ ক্রাউন, নিউইয়র্ক (১৯৫৪)। বিভিন্ন বিষয়ে আইনস্টাইনের প্রবন্ধের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংকলন এই বই। জার্মান ভাষায় লিখিত প্রবন্ধগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আইনস্টাইনের সহকারী ভ্যালেন্টাইন বার্গম্যানের স্ত্রী সোনিয়া বার্গম্যান। বইটির বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলোর একটি ভূমিকা লিখেছেন ভ্যালেন্টাইন বার্গম্যান।

পেপারঃ২৮৭ Algebric Properties of the Field in the Relativistic Theory of the Asymmetric Field. Annals of Mathematics, সংখ্যা ৫৯ (১৯৫৪), পৃষ্ঠাঃ২৩০-২৪৪। সহলেখকঃ ব্রুরিয়া কফম্যান। এটি আইনস্টাইনের জীবনের শেষ গবেষণাপত্র। সহযোগী গবেষক ব্রুরিয়া কফম্যানের সাথে লিখিত এই গবেষণাপত্রে রিলেটিভিস্টিক ফিল্ড থিওরির বীজগাণিতিক ধর্ম বিশ্লেষণ করেছেন।

পেপারঃ২৮৮ Foreword.ম্যাক্স জ্যামারের Concepts of Space বইয়ের মুখবন্ধ। প্রকাশকঃ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ (১৯৫৪)।

পেপারঃ২৮৯ The Meaning of Relativity.পঞ্চম সংস্করণ, প্রকাশকঃ প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, প্রিন্সটন, নিউজার্সি (১৯৫৪)। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি থেকে শুরু করে সমন্বিত তত্ত্ব পর্যন্ত আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত গবেষণার সংকলন এই বই। আইনস্টাইন পঞ্চম সংস্করণে বেশ কিছু নতুন বিষয় যোগ করেন এবং আগের সংকলনের অনেক কিছু পরিবর্তন করেন। চতুর্থ সংস্করণের অ্যাপেন্ডিক্স-২ এর জেনারালাইজেশান অব গ্র্যাভিটেশান থিওরির পুরোটাই বদলে ফেলে পঞ্চম সংস্করণে রিলেটিভিস্টিক থিওরি অব দি নন-সিমেট্রিক ফিলড শিরোনামে সংযোজন করেন। এটাই ছিলো আইনস্টাইনের অভিকর্ষজ ক্ষেত্র ও তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের সমন্বয় সাধনের সর্বশেষ চেষ্টা।

পেপারঃ২৯০ If Einstein Were Young Again,He Says Hed Become a Plumber. নিউইয়র্ক টাইমস, ১০ নভেম্বর ১৯৫৪। অক্টোবরের ১৩ তারিখে দি রিপোর্টার-এর সম্পাদকের কাছে লেখা একটি চিঠির ওপর ভিত্তি করে নিউইয়র্ক টাইমস নভেম্বরের ১০ তারিখে এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করে। আবার যদি জন্ম হয়- আইনস্টাইন কী হতে চান সেজন্মে? আইনস্টাইন লিখেছেন, পরবর্তী জন্মে তিনি আর বৈজ্ঞানিক হতে চান না। তিনি হতে চান মিস্ত্রী বা ফেরিওয়ালা। তিনি দেখতে চান মিস্ত্রী বা ফেরিওয়ালার কাজে বর্তমানে যে স্বাধীনতা আছে, তখনো সে স্বাধীনতা থাকে কিনা। যদি থাকে, তখন হয়তো পূর্ণ-স্বাধীনতায় পদার্থবিজ্ঞানচর্চা করা যাবে। কারণ আইনস্টাইন বিশ্বাস করেন, চাকরি করে গবেষণা করতে হলে সে গবেষণা স্বাধীন নয়।

পেপারঃ২৯১ Tribute to Joseph Scharl. নিউইয়র্ক টাইমস, ৯ ডিসেম্বর ১৯৫৪। শিল্পী জোসেফ শার্ল আইনস্টাইনের ছবি এঁকেছিলেন। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন শিল্পী শার্লের প্রশংসা করেন।

১৯৫৫
মার্চের ১৪ তারিখে আইনস্টাইন ছিয়াত্তরতম জন্মদিন পালন করলেন। তাঁর বন্ধুরা চেয়েছিলেন বেশ জাঁকজমক করে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু আইনস্টাইন রাজী হননি। কয়েকজন ঘনিষ্ঠবন্ধুদের সাথে ঘরোয়াভাবে সাদামাটা একটি অনুষ্ঠান হলো। এক সপ্তাহ পরে তিনি খবর পেলেন, তাঁর প্রিয় বন্ধু মাইকেল বেসো মারা গেছেন।

 আইনস্টাইনের সুখে দুঃখে সবসময় পাশে থাকতেন মাইকেল বেসো। স্পেশাল রিলেটিভিটির সময় থেকে শুরু করে মিলেইভার সাথে বিচ্ছেদের সময়ও মাইকেল বেসোই ছিলেন আইনস্টাইনের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু। ভীষণ মুষড়ে পড়লেন আইনস্টাইন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে। আমেরিকা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণ করে শক্তির আস্ফালন করেছে। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল আইনস্টাইনের কাছে অনুরোধ করেছেন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য বিশ্বনেতাদের কাছে আবেদন করার জন্য। বার্ট্রান্ড রাসেল আবেদনের খসড়া তৈরি করেছেন। এগারোই এপ্রিল আইনস্টাইন আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলের কাছে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইসরায়েল সরকার আইনস্টাইনকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যেতে চাচ্ছে ইসরায়েলে। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আইনস্টাইনের পক্ষে ইসরায়েল ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। ঠিক হলো আইনস্টাইনের বক্তৃতা রেকর্ড করে নিয়ে যাওয়া হবে ইসরায়েলের রেডিওতে প্রচার করার জন্য। আইনস্টাইন বক্তৃতার খসড়া তৈরি করতে শুরু করলেন।

এপ্রিলের ১৩ তারিখে পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলেন আইনস্টাইন। এরকম ব্যথা তাঁর আগেও হয়েছে। বেশ কয়েকবছর আগে তাঁর পেটের একটি ধমনীর দেয়ালে টিউমার (aneurysm)হয়েছে এবং তা দিনে দিনে বড় হচ্ছে। যে কোনদিন সেটি ফেটে যেতে পারে। ব্যথা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরকম তীব্র ব্যথা আগে কোনদিন লাগেনি। হেলেন ডুকাস ডাক্তারকে ফোন করলেন। আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত ডাক্তার পরামর্শ দিলেন হাসপাতালে ভর্তি হতে। কিন্তু আইনস্টাইন কিছুতেই হাসপাতালে যেতে রাজী নন। কিন্তু ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে দেখে ১৫ তারিখে একপ্রকার জোর করেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তাররা বললেন, অপারেশান করাতে হবে। আইনস্টাইন কিছুতেই রাজী নন। তিনি বলেন, মৃত্যু যত সংক্ষেপে হয় ততোই ভালো, অপারেশান ইত্যাদি করে আড়ম্বর সহকারে মরার কোন অর্থ হয়না। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বড়ছেলে হ্যান্স এলেন, নিউইয়র্ক থেকে ওয়ালটার বাকি, অটো নাথান সহ আরো অনেক ডাক্তার বন্ধু এলেন। সবাই চেষ্টা করলেন আইনস্টাইনকে অপারেশানে রাজী করাতে। কিন্তু আইনস্টাইন কিছুতেই অপারেশান করাবেন না। ব্যথা কিছুটা কমে গেলো কয়েকদিনের মধ্যে।

এপ্রিলের ১৭ তারিখ রাতে কিছুটা সুস্থ বোধ করার পর ইসরায়েলের বক্তৃতার খসড়া নিয়ে কিছুক্ষণ কাজ করে ঘুমিয়ে পড়লেন আইনস্টাইন। কিন্তু কয়েকঘন্টা পরেই ১৮ তারিখ ভোর একটার দিকে প্রচন্ড ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেলো তাঁর। পেটের ফোঁড়া ফেটে গেছে। কর্তব্যরত নার্স অ্যালবার্টা রোজেল (Alberta Rozsel)ছুটে এলেন। আইনস্টাইন তখন বিড়বিড় করে জার্মান ভাষায় কিছু বললেন। নার্স তার কিছুই বুঝতে পারলেন না। কয়েকমিনিটের মধ্যেই মারা গেলেন আইনস্টাইন।

খবর পেয়ে ডাক্তার নার্স বন্ধুরা সবাই ছুটে এলেন হাসপাতালে। হাসপাতালের প্যাথোলজিস্ট ডাক্তার টমাস হার্ভি(Thomas Harvey) । আইনস্টাইনের মরদেহের অটোপসি(autopsy) করার সময় কারো কোন অনুমতি ছাড়াই ব্রেনটি খুলে রেখে দিলেন। আরেকজন প্যাথোলজিস্ট ডাক্তার হেনরি অ্যাব্রামস(Henry Abrams) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে আইনস্টাইনের চোখ দুটো তুলে নিলেন। অনেকদিন আগেই আইনস্টাইন বলেছিলেন, মৃত্যুর পরে যেন তাঁর শরীর পুড়িয়ে ফেলা হয়। কোন ধরণের শোকসভা, শোকমিছিল, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে নিষেধ করেছিলেন তিনি। এমনকি তাঁর সমাধির চিহ্নও না রাখার জন্য বলেছেন আইনস্টাইন। ১৮ এপ্রিল,১৯৫৫, সোমবার বিকেলে কোনধরণের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ছাড়াই আইনস্টাইনের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হলো। কিছু পোড়াছাই ভাসিয়ে দেয়া হলো ডেলাওয়ার(Delaware) নদীতে। পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো আইনস্টাইনের মৃত্যুসংবাদ।

প্রকাশনা
এপ্রিলে আইনস্টাইনের মৃত্যুর পরেও সারাবছর ধরে আইনস্টাইনের বেশ কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছে এবছর। এবছর প্রকাশিত নয়টি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ

পেপারঃ২৯২ Forewordলুই ডি ব্রগলির Physics and Microphysics বই এর মুখবন্ধ। প্রকাশকঃপ্যান্থিয়ন, নিউইয়র্ক (১৯৫৫)।

পেপারঃ২৯৩ Preface.জুলস মকের(Jules Moch)Human Folly:To Disarm or Perish বইয়ের ভূমিকা। প্রকাশকঃ গোল্যানস(Gollancz), লন্ডন(১৯৫৫)।

পেপারঃ২৯৪ A New Form of the General Relativistic Field Equations. Annals of Mathematics, সংখ্যা ৬২(১৯৫৫), পৃষ্ঠাঃ১২৮-১৩৮। সহলেখকঃ ব্রুরিয়া কফম্যান। আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিস্টিক ফিল্ড ইকোয়েশানের একটি নতুন রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এ গবেষণাপত্রে। এ পেপারটি আইনস্টাইনের সহযোগী ব্রুরিয়া কফম্যানের প্রত্যক্ষ রচনা। আইনস্টাইনের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে এ পেপারটি রচিত হয়েছে।

পেপারঃ২৯৫ The Einstein-Russell Manifesto. ৯ জুলাই ১৯৫৫। লন্ডন থেকে প্রচারিত। বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের লক্ষ্যে আইনস্টাইন বার্ট্রান্ড রাসেলের সাথে এই যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। বিবৃতিতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন ম্যাক্স বোর্ন, লিওপোল্ড ইনফেলড, ফ্রেডেরিক জুলিয়েট-কুরি, লাইনাস পাউলিং প্রমুখ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরা।

পেপারঃ২৯৬ Remembrances. Schweizerische Hochschulzeitung, সংখ্যা ২৮ (বিশেষ সংখ্যা, ১৯৫৫), পৃষ্ঠাঃ১৪৩-১৫৩। এই প্রবন্ধে আইনস্টাইন তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোর কিছু স্মৃতিচারণ করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, ছাত্রাবস্থাতেই তিনি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের বিখ্যাত গবেষকদের ব্যক্তিগত জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পড়তে শুরু করেছিলেন।

পেপারঃ২৯৭ Albert Schweitzer at Eighty. Christian Century, বর্ষ ৭২, সংখ্যা ২ (১৯৫৫), পৃষ্ঠাঃ৪২।  আলবার্ট সোয়েটজারের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে আইনস্টাইনের শুভেচ্ছাবাণী। ডাক্তার, দার্শনিক ও মানবতাবাদী  আলবার্ট সোয়েটজার ১৯৫২ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছেন।

পেপারঃ২৯৮ Introduction.হেনরি ওয়াসেলের (Henry I.Wachtel) Security for All and Free Enterprise বইয়ের ভূমিকা। প্রকাশকঃ ফিলোসফিক্যাল লাইব্রেরি, নিউইয়র্ক (১৯৫৫)।

পেপারঃ২৯৯ Foreword উইলিয়াম এসলিঙ্গারের (William  Esslinger)Politics and Science বইয়ের মুখবন্ধ। প্রকাশকঃ ফিলোসফিক্যাল লাইব্রেরি, নিউইয়র্ক (১৯৫৫)।

পেপারঃ৩০০ What Is the Task of an International Journal? Common Cause, বর্ষ ১, সংখ্যা ১(১৯৫৫, ফ্লোরেনস,ইটালি), পৃষ্ঠাঃ৩। ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে প্রকাশিত কমন কজ জার্নালের প্রথম সংখ্যার জন্য আইনস্টাইন এ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল জার্নালের নীতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এ প্রবন্ধে।

আইনস্টাইনের কাল - পর্ব-২৩


১৯৪৭
বিশ্বব্যাপী মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিশ্ব-সরকার গঠনের পক্ষে সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করে চলেছেন আইনস্টাইন তাঁর বড়ছেলে হ্যান্স এলবার্ট ইউনভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছেন এবছর এর আগে তিনি ক্যালটেকে কাজ করেছেন কয়েকবছর

প্যালেস্টাইনকে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার ব্রিটিশ প্রস্তাব আরব ও ইহুদি উভয় সম্প্রদায়ই প্রত্যাখ্যান করেছে প্যালেস্টাইন সমস্যার সমাধানের ভার নিয়েছে জাতিসংঘ ভারতে বিট্রিশ শাসনের অবসান হয়েছে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে গেছে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠদের নতুন দেশ পাকিস্তান স্বাধীনতা দিবস ধার্য করেছে ১৪ আগস্ট পরদিন ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিন্দু,মুসলমান ও শিখদের মধ্যে প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গা থামাবার লক্ষ্যে অনশন পালন করেছেন

প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের পাঁচটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ

পেপারঃ২৫০ The Military Mentality. American Scholar, সংখ্যা ১৬ (১৯৪৭), পৃষ্ঠাঃ৩৫৩-৩৫৪ এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক নেতাদের মিলিটারি মানসিকতার কড়া সমালোচনা করেন পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে বেশি ক্ষমতা অর্জন করাকে আমেরিকা অন্যসবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিয়েছে বলে তিনি আমেরিকাকে দোষারোপ করেন তিনি মনে করেন, ক্ষমতা অর্জনের মানসিকতা থেকে মিলিটারি মানসিকতার সৃষ্টি হয় যে কোন উপায়ে ক্ষমতা অর্জনই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে আইনস্টাইন জার্মানির ব্যাপার থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানান জার্মানি পৃথিবী শাসন করার ক্ষমতা অর্জন করতে চেয়েছিলো বলেই দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেলো এখন পারমাণবিক যুগে ক্ষমতার লোভ তো আরো সাংঘাতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে শক্তিলাভের মানসিকতা থেকে আরো বেশি শক্তিশালী, আরো বেশি বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে  

পেপারঃ২৫১ Atomic War or Peace. As told to Raymond Swing. Atlantic Monthly, সংখ্যা ১৮০(নভেম্বর ১৯৪৭) আটলান্টিক মান্থলির সাংবাদিক রেমন্ড সুইং এর কাছে দেয়া আইনস্টাইনের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এই প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে আইনস্টাইন পারমাণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের পক্ষে তাঁর মত ব্যক্ত করেন এজন্য বিশ্ব-সরকার ব্যবস্থার যে কোন বিকল্প নেই তা তিনি আবারো ব্যাখ্যা করেন

পেপারঃ২৫২ [Response to the Editor on Walter Whites article, Why I Remain a Negro.] Saturday Review of Literature, সংখ্যা ৩০ (১ নভেম্বর ১৯৪৭), পৃষ্ঠাঃ২১ আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আইনস্টাইন সবসময় সোচ্চার সংবাদপত্রে বর্ণসমস্যা সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধের প্রতিক্রিয়া জানাতে আইনস্টাইন এ প্রবন্ধটি লেখেন

পেপারঃ২৫৩ [Open letter to the United Nations General Assembly on how to break the vicious circle.] United Nations World, সংখ্যা ১ (অক্টোবর ১৯৪৭), পৃষ্ঠাঃ১৩-১৪ সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আইনস্টাইনের এই খোলাচিঠিটি পড়ে শোনানো হয় আইনস্টাইন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিশ্ব-সরকার গঠনের আহ্বান জানান তিনি বলেন, একমাত্র বিশ্ব-সরকার ব্যবস্থাই পারে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতার অশুভ চক্র ভাঙতে

পেপারঃ২৫৪ The Problem of Space, Ether and the Field in Physics. The Great Thinkers series এর চতুর্থ খন্ডে Man and the Universe অধ্যায়ে প্রকাশিত সম্পাদনাঃ এস কমিনস ও আর এন লিনস্কট প্রকাশকঃ র্যানডম হাউজ, নিউইয়র্ক (১৯৪৭) এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন বৈজ্ঞানিক ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করেন আমাদের বৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে স্থানকালক্ষেত্রইথার ইত্যাদি একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত

১৯৪৮
আইনস্টাইনের ছোটছেলে এডোয়ার্ড মানসিক হাসপাতালে পড়ে আছে। মিলেইভা অসুস্থ শরীরে তার দেখাশোনা করেন। আইনস্টাইন এডোয়ার্ডের চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠান। কিন্তু সে টাকায় কুলোয় না। আইনস্টাইনের নোবেল পুরষ্কারের টাকা দিয়ে তিনটি বাড়ি কিনেছিলেন মিলেইভা। তার একটিতে তিনি থাকেন, অন্যদুটো ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকা যা পান তা দিয়ে নিজের খরচই চলে না, এডোয়ার্ডের চিকিৎসার খরচ চলবে কী করে। মিলেইভা বাড়ি দুটো বিক্রি করে দিলেন। সে টাকাগুলোও দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা মিলেইভা শংকিত হয়ে পড়লেন অবশিষ্ট বাড়িটাও না বিক্রি করতে হয়। তিনি বাড়িটা আইনস্টাইনের নামে লিখে দিলেন। ভাবলেন এতে অন্তত তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই বাড়িটা থাকবে।

এরমধ্যে একদিন বরফের ওপর আছাড় খেয়ে পা ভেঙে ফেললেন মিলেইভা। শয্যাশায়ী মিলেইভার স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়লো। আইনস্টাইন খবর পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন-মিলেইভা মারা গেলে এডোয়ার্ডকে দেখবে কে? এডোয়ার্ডের চিকিৎসা ও দেখাশোনা করার জন্য আইনস্টাইন একটি ট্রাস্ট গঠনের পরিকল্পনা করলেন। তিনি তাঁর নামে লিখে দেয়া বাড়িটি বিক্রি করে টাকাটা মিলেইভার কাছে পাঠিয়ে দিলেন ট্রাস্টে জমা দেয়ার জন্য। বাড়ি বিক্রি করার সময় আইনস্টাইন পরিষ্কার শর্ত দিয়েছেন যে, মিলেইভা যতদিন বেঁচে থাকবেন, ঐ বাড়িতেই বিনা ভাড়ায় থাকবেন। কিন্তু মিলেইভা বাড়ি বিক্রি করে দেয়াতে খুব কষ্ট পেলেন। আইনস্টাইনকে তিনি আর কোন খবরই দিলেন না। আইনস্টাইন অনেকদিন মিলেইভার কোন খবর না পেয়ে জুরিখে লোক পাঠিয়ে খবর নিয়ে জানতে পারলেন, একটি বড় ধরণের স্ট্রোকে মিলেইভার শরীরের একদিক অবশ হয়ে গেছে। এবছর আগস্টের চার তারিখে মৃত্যু হলো মিলেইভার। মৃত্যুর পর তাঁর বিছানার নিচ থেকে পাওয়া যায় বাড়ি বিক্রিত পঁচাশি হাজার ফ্রাংক।

আইনস্টাইনের শরীর ভেঙে পড়ছে। পাকস্থলিতে মারাত্মক ব্যথা হচ্ছে তাঁর। বছরের শেষের দিকে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার পরে ডাক্তাররা আইনস্টাইনের পেটের ধমনীর দেয়ালে বড়ধরণের ক্ষত দেখতে পান, তবে তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়নি।

জানুয়ারির ৩০ তারিখে ভারতে উগ্র হিন্দুবাদীরা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে। শান্তিবাদী মহাত্মার বয়স হয়েছিলো উনাশি বছর। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন আইনস্টাইনের শান্তির নায়ক। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মহাত্মা গান্ধী, আর সেকারণেই তাঁকে প্রাণ দিতে হলো। এদিকে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। কাইম ওয়েইজম্যান হলেন ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, আর ডেভিড বেন-গুরিয়ন হলেন প্রিমিয়ার।

প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের সাতটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ

পেপারঃ২৫৫ [Letter on universal military training addressed to the chairman of the senate committee.] U.S Congress,Senate,Committee on Armed Services,Hearings on Universal Military Training, পৃষ্ঠা ২৫৭। বিশ্বব্যাপী সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে আইনস্টাইন আমেরিকান কংগ্রেসে এই চিঠিটি লেখেন। সিনেট কমিটিতে চিঠিটি পড়া হয় এবছর (১৯৪৮) ২৪ মার্চ তারিখে। আইনস্টাইনের ওপর কয়েকজন সিনেটর বিরক্তও হয়েছেন এতে।

পেপারঃ২৫৬ Religion and Science: Irreconcilable? Christian Register, সংখ্যা ১২৭ (জুন ১৯৪৮), পৃষ্ঠাঃ১৯-২০। নিউইয়র্ক সিটির লিবারেল মিনিস্টারস ক্লাব আইনস্টাইনকে শুভেচ্ছাকার্ড পাঠায়। সেখানে আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়,ধর্ম ও বিজ্ঞানের সহাবস্থান কি অসম্ভব? উত্তরে আইনস্টাইন জানান, এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ নয়। কারণ বিজ্ঞান বিষয়ে সব মানুষ একমত হতে পারলেও ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষের মধ্যে মতের ভিন্নতা আছে। ধর্মে যে সমস্ত অলৌকিক কাহিনী চালু আছে, তা একেক ধর্মে একেক রকমের হওয়াতে এবং বাস্তবের সাথে সে সমস্ত ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকাতে মানুষের মধ্যে মতের ভিন্নতা দেখা দেয়। মত পার্থক্য থেকে তৈরি হয় অসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক বিরোধিতা। কিন্তু ধর্মের প্রকৃত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অলৌকিক অবাস্তব কাহিনীর কোন প্রয়োজন নেই।

পেপারঃ২৫৭ On Receiving the One World Award. ২৭ এপ্রিল ১৯৪৮ তারিখে কানের্গি হলে প্রদত্ত ভাষণ। বিশ্ব-সরকারের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে আইনস্টাইনকে ওয়ান ওয়ার্লড পুরষ্কারে সম্মানিত করা হয়। আইনস্টাইন পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আবারো বিশ্ব-সরকারের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও অস্ত্র-প্রতিযোগিতা কমছে না দেখে আইনস্টাইন কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছেন বিশ্বশান্তির ব্যাপারে। রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের কার্যকলাপে কিছুটা বিরক্ত হয়েই তিনি মন্তব্য করেন, এরকম চলতে থাকলে পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবে একমাত্র অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী কোন সংগঠন।

পেপারঃ২৫৮ Looking Ahead.Rotarian, জুন ১৯৪৮, পৃষ্টাঃ৮-১০। আইনস্টাইন এ প্রবন্ধে বিশ্ব-সরকার ব্যবস্থার সপক্ষে আবারো মত প্রকাশ করেছেন। এ প্রবন্ধের সাথে বুলেটিন অব এটমিক সায়েন্টিস্টসে প্রকাশিত আইনস্টাইনের দুটো পেপার আবার প্রকাশ করা হয়। ওদুটো প্রবন্ধের একটিতে আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন [চতুর্থ সংখ্যা,পৃষ্ঠাঃ১ (১৯৪৮)]। অন্যটিতে সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন আইনস্টাইন [চতুর্থ সংখ্যা, পৃষ্ঠাঃ৩৫-৩৭ (১৯৪৮)]। এর আগে আইনস্টাইনের বিশ্ব-সরকারের ধারণার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা।

পেপারঃ২৫৯ Quantum  Mechanics and Reality.Dialectica, সংখ্যা ২ (১৯৪৮), পৃষ্ঠাঃ৩২০-৩২৪। কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে পারেননি আইনস্টাইন। এ প্রবন্ধে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অসম্পূর্ণতা আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে বাস্তবের বিরোধ থেকেই যাচ্ছে।

পেপারঃ২৬০ General Theory of Gravitation. Reviews of Modern Physics, সংখ্যা ২০ (১৯৪৮), পৃষ্ঠাঃ৩৫-৩৯। এ গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন জেনারেল থিওরি অব গ্র্যাভিটেশান তথ্য জেনারেল রিলেটিভিটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

পেপারঃ২৬১ Atomic Science Reading List. In 1948;Magazine of the Year(জানুয়ারি), পৃষ্ঠাঃ৬০-৬১। পারমাণবিক শক্তি ও তার ক্ষমতা সম্পর্কে জানার জন্য শুধুমাত্র আইসোটোপ,পিচব্লেন্ড ও প্লুটোনিয়াম সম্পর্কে জানাটাই যথেষ্ট নয়। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন ছয়টি ম্যাগাজিন ও বইয়ের কথা উল্লেখ করেন-যা থেকে পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ একটি ধারণা পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন। আইনস্টাইনের মতে পারমাণবিক শক্তি ও তার প্রয়োগের সাথে শান্তি, নিরাপত্তা ও মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ব্যাপারটি এখন গভীরভাবে জড়িত।আইনস্টাইন যে বইগুলোর কথা উল্লেখ করেন, তা হলোঃ ১।মাসিক বুলেটিন অব দি এটমিক সায়েন্টিস্টস। আইনস্টাইনের মতে এই মাসিক পত্রিকা পারমাণবিক শক্তির উন্নয়ন ও তথ্যের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র। ২।সেলিগ হেচের(Selig Hecht) বই এক্সপ্লেইনিং দি এটম। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে নিউক্লিয়ার ফিশানের বৈজ্ঞানিক ধাপগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ৩। জন হারসির(John Hersey) উপন্যাস হিরোশিমা। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপর পারমাণবিক বোমার প্রভাব বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ৪। কর্ড মেয়ারের(Cord Meyer Jr.) পিস ফর এনার্কি (Peace or Anarchy)। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত এই বইতে পারমাণবিক বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জটিল ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ৫। এমেরি রেভিসের (Emery Reves)দি এনাটমি অব পিস। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত এই বইতে আইনস্টাইনের বিশ্ব-সরকারের ধারণাকে সমর্থন করা হয়েছে। ৬। র‍্যামন্ড সুইং (Raymond Swing)এর ইন দি নেম অব স্যানিটি (In the Name of Sanity). পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কার ও তার ব্যবহার সংক্রান্ত ঘটনা ও খবরের ধারাবাহিক সংকলন এই বই।

১৯৪৯
বছরের শুরুতে অসুস্থ হয়ে মাসখানেক হাসপাতালে কাটাতে হলো আইনস্টাইনকে। কিছুটা সুস্থ হবার পর কয়েক সপ্তাহের বিশ্রামের জন্য ফ্লোরিডায় চলে গেলেন। সাথে গেলেন তাঁর পুরনো ডাক্তার বন্ধু ওয়ালটার বাকি। ডাক্তার বাকি থাকেন নিউইয়র্কের সেভেন্টি সিক্সথ স্ট্রিটে। আইনস্টাইন নিউইয়র্কে গেলে ডাক্তার বাকির বাড়িতেই ওঠেন। এবছর আইনস্টাইন তাঁর সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী অটোবায়োগ্রাফিক্যাল নোটস শেষ করেন।

মার্চের চৌদ্দ তারিখ আইনস্টাইনের সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে আইনস্টাইনকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। প্রায় তিনশ বিজ্ঞানী এখানে জড়ো হন আইনস্টাইনকে শ্রদ্ধা জানাতে। এ উপলক্ষে একটি সিম্পোজিয়ামেরও আয়োজন করা হয়। আইনস্টাইন যখন হলে ঢুকছিলেন-সারা হলে পিনপতন নীরবতা, সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আইনস্টাইনকে সম্মান জানালেন।

জার্মানির সাথে কোন ধরণের সম্পর্ক রাখতেই রাজী নন আইনস্টাইন। জার্মানি চাচ্ছে আইনস্টাইনকে আবার জার্মান নাগরিকত্ব দিতে। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের বৈদেশিক সদস্য হবার আমন্ত্রণ জানানো হলো তাঁকে। জন্মস্থান উলম শহর নাগরিকত্ব দিতে চাইলো। কিন্তু সব আহ্বানই প্রত্যাখ্যান করলেন আইনস্টাইন।

এবছর ইসরায়েল স্বাধীনরাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছে। তেল-আবিব থেকে তাদের রাজধানী জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হয়েছে। আইনস্টাইন ইসরায়েলকে সমর্থন করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। শুরু হয়ে গেছে আমেরিকার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ।

প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য পাঁচটি পেপারঃ

পেপারঃ২৬২ Why Socialism ? Monthly Review: An Independent Socialist Magazine, বর্ষ ১, সংখ্যা ১ (মে ১৯৪৯), পৃষ্ঠাঃ৯-১৫। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন পুঁজিবাদের কড়া সমালোচনা করেন। পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ফলে সমাজে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়, সমাজে দুর্নীতির জন্ম হয়। পুঁজিবাদের দাপটে গরীব মানুষ পঙ্গু হয়ে যায়, তাদের কোন অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা থাকেনা। আইনস্টাইনের মতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারে।

পেপারঃ২৬৩ In the Shadow of the Atomic Bomb. Solution Patriot, বর্ষ ৭, সংখ্যা ৩ (মে ১৯৪৯)। আইনস্টাইন আমেরিকাকে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে পরোক্ষভাবে উদ্বুদ্ধ করলেও পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন পারমাণবিক বোমার কুফল ব্যাখ্যা করেছেন।

পেপারঃ২৬৪ Autobiographical Notes and Remarks to the Essays Appearing in the Volume. In Albert Einstein; Philosopher-Scientist, সম্পাদনাঃপল শিলপ (Paul A.schilpp)। লাইব্রেরি অব লিভিং ফিলোসফারস, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩-৯৪। প্রকাশকঃ ওপেন কোর্ট, লা সালি (১৯৪৯)। আইনস্টাইন তাঁর সংক্ষিপ্ত বৈজ্ঞানিক আত্মজীবনী অটোবায়োগ্রাফিক্যাল নোটস লিখেছেন পল শিলপের অনুরোধে।

পেপারঃ২৬৫ Foreword. In the Hebrew University of Jerusalem, 1925-1950. প্রকাশকঃগোল্ডবার্গ প্রেস, জেরুজালেম (১৯৪৯)। জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত সংকলনের ভূমিকায় আইনস্টাইন ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও লক্ষ্য সম্পর্কে আলোকপাত করেন।

পেপারঃ২৬৬ On the Motion of Particles in General Relativity Theory. সহলেখকঃলিওপোল্ড ইনফেল্ড। Canadian Journal of Mathematics, সংখ্যা ৩ (১৯৪৯), পৃষ্ঠাঃ২০৯-২১৪। আইনস্টাইন ও ইনফেলড এই গবেষণাপত্রে দেখান যে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির জন্য শুধুমাত্র ফিলড ইকুয়েশানই যথেষ্ট।

১৯৫০
আইনস্টাইনের শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর সময় প্রায় শেষ। মৃত্যুর পরে তাঁর গবেষণাপত্র ও অন্যান্য সম্পদের বিলিবন্টনের জন্য উইল করলেন তিনি। তাঁর বন্ধু অটো ন্যাথানকে দায়িত্ব দিলেন উইল বাস্তবায়নের। আর সেক্রেটারি হেলেন ডূকাসকে দায়িত্ব দিলেন তাঁর গবেষণাসহ সবধরণের কাগজপত্রের দেখাশোনার। সব গবেষণাপত্র ও গবেষণাসংক্রান্ত দলিল দান করলেন জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে। অটো ন্যাথান ও হেলেন ডুকাসের মৃত্যুর পরে সব দলিলপত্র হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে দেয়া হবে- এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আইনস্টাইন তাঁর বেহালাটি দান করে দিলেন তাঁর নাতি বার্নহার্ডকে। আর টাকাপয়সা যা থাকবে তা পাবেন হেলেন ডুকাস, ছেলে হ্যান্স এলবার্ট ও এডোয়ার্ড এবং সৎকন্যা মার্গট।

ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ঘোষণা করলেন যে, আমেরিকা হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করেছে। এ বোমা পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী। ধারণা করা হচ্ছে হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী এডোয়ার্ড টেলার এই বোমার জনক। আইনস্টাইন খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন এ ঘটনায়। তিনি টেলিভিশন মাধ্যমে এ বোমার ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করে দিতে চাইলেন। টেলিভিশনে প্রচারিত বিবৃতিতে তিনি বললেন, হাইড্রোজেন বোমা যদি কখনো ব্যবহার করা হয়, পৃথিবী তেজস্ক্রিয়তায় ভরে যাবে, কোন প্রাণীই আর বেঁচে থাকবে না।

আমেরিকান সিনেটর জোসেফ ম্যাককারথি কমিউনিস্ট অনুসন্ধান শুরু করলেন। তাঁর ধারণা কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট সমর্থকে ভরে গেছে আমেরিকান স্বরাষ্ট্র দপ্তর। কমিউনিস্ট শিকারের উদ্দেশ্যে পরবর্তী চারবছর ধরে ম্যাককারথি শতশত মানুষকে সন্দেহবশত হয়রানি করেছেন। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী ও শিল্পীদের পেছনে গোয়েন্দা লেলিয়ে দিয়েছেন তিনি। কংগ্রেসে হাউজ আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিজ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কাউকে কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ হলেই তাঁকে এই কমিটির সামনে নিয়ে আসা হয়। আর কমিটির নানারকম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, উত্তরের সপক্ষে প্রমাণ দাখিল করে সেই ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হয় যে তিনি কমিউনিস্ট নন। অনেককে আবার চিঠি দিয়ে কমিটির সামনে হাজির হবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। আইনস্টাইন তীব্র নিন্দা করলেন এ ব্যবস্থার। কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে নিজেকে কমিউনিস্ট নন প্রমাণ করার জন্য চিঠি পেয়েছেন এরকম অনেককেই আইনস্টাইন পরামর্শ দিয়েছেন কমিটিকে সহযোগিতা না করার জন্য। কারণা তিনি মনে করেন, এ ব্যবস্থা মানুষের নাগরিক স্বাধীনতার পরিপন্থী।

প্রকাশনা
এবছর প্রকাশিত আইনস্টাইনের সাতটি উল্লেখযোগ্য রচনাঃ

পেপারঃ২৬৭ On the Moral Obligation of the Scientist. Impact, বর্ষ ১(১৯৫০), পৃষ্ঠাঃ১০৪-১০৫। এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন বিজ্ঞানীদের নৈতিক দায়িত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

পেপারঃ২৬৮ Physics,Philosophy, and Scientific Progress.Journal of the International College of Surgeons, সংখ্যা ১৪ (১৯৫০), পৃষ্ঠাঃ৭৫৫-৭৫৮। ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব সার্জনস এর সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য আইনস্টাইনের এই ভাষণটি রেকর্ড করা হয় এবং অনুষ্ঠানে তা বাজিয়ে শোনানো হয়। আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞান ও তার দর্শন প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। পরে ভাষণটি কলেজের জার্নালে প্রকাশিত হয়।

পেপারঃ২৬৯ An Open Letter to the Society for Social Responsibility in Science. Science, সংখ্যা ১১২(১৯৫০), পৃষ্ঠাঃ৭৬০-৭৬১। বিজ্ঞানীদের সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সোসাইটি ফর সোশাল রেসপনসিবিলিটি ইন সায়েন্স। ডিসেম্বরের ২২ তারিখে সায়েন্স ম্যাগাজিনের চিঠিপত্র কলামে প্রকাশিত এই চিঠিতে আইনস্টাইন বিজ্ঞানীদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য সোসাইটি গঠনের প্রশংসা করে মনে করিয়ে দেন যে, সমাজের মানুষের চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হলে এধরণের প্রতিষ্ঠান সমাজের কোন উপকারেই আসবে না। তিনি ন্যুরেমবার্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, আত্ম-দায়িত্ববোধ থেকে রেহাই পেতে পারেন না কেউ।

পেপারঃ২৭০ On the Generalized Theory of Gravitation. Scientific American, বর্ষ ১৮২, সংখ্যা ৪ (এপ্রিল ১৯৫০), পৃষ্ঠাঃ১৩-১৭। সায়েন্টিফিক আমেরিকানদের সম্পাদকের অনুরোধে লিখিত এ প্রবন্ধে আইনস্টাইন ক্ষেত্র পদার্থবিজ্ঞান বা ফিলড ফিজিক্সের ভিত্তি স্থাপন করার জন্য তাঁর গাণিতিক অনুসন্ধানের বিবরণ দেন।

পেপারঃ২৭১ The Bianchi Identities in the Generalized Theory of Gravitation. Canadian Journal of Mathematics, বর্ষ ৪ (১৯৫০), পৃষ্ঠাঃ১২০-১২৮। ইউনিফায়েড থিওরি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছাড়েন নি আইনস্টাইন। এ গবেষণাপত্রে তিনি আবারো গ্র্যাভিটেশানের একটি সাধারণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।

পেপারঃ২৭২ Foreword ফিলিপ ফ্রাঙ্কের Relativity:A Richer Truth বইতে মুখবন্ধ হিসেবে আইনস্টাইনের এ লেখাটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশকঃ জোনাথন কেইপ, লন্ডন (১৯৫১)।ফিলিপ ফ্রাঙ্ক এই বইতে সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে আপেক্ষিকতার প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আইনস্টাইন এই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, মাঝে মাঝে যুক্তির সাথে নীতির মিল নাও থাকতে পারে। কিন্তু সামাজিক বা ব্যক্তিগত নীতিগুলো-যৌক্তিক চিন্তা ও ব্যবহারিক জ্ঞানের মাধ্যমে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। বিজ্ঞানে যেমন কোন ধারণা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ বা বর্জন করা হয়, সেরকম সামাজিক নীতিগুলোও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে। সমাজ ও ব্যক্তির উপকারে আসে এরকম নীতি গ্রহণযোগ্য হবে, আর ক্ষতিকারক হলে সেরকম নীতি বাদ দেয়া যেতে পারে।

পেপারঃ২৭৩ Message to the Italian Society for the Advancement of Science. ইটালিয়ান সোসাইটি ফর দি এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স এর বেয়াল্লিশতম সভা উপলক্ষে আইনস্টাইন এই লেখাটি পাঠিয়েছিলেন। পরে তা প্রকাশিত হয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক প্রকাশিত জার্নাল ইমপ্যাক্ট এর হেমন্তকালীন সংখ্যায়। আইনস্টাইন বলেন, মানুষ যে কোন ব্যাপারেই সত্যকে খুঁজে বের করতে চায়, সত্যকে বুঝতে চায়। সেটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জটিল সামাজিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে সহজ সত্যকে খুঁজে বের করা সহজ নয়। বৈজ্ঞানিকরা সহজ সত্য খুঁজতে গিয়ে জটিল জটিল সমস্যায় পড়ে যান। মানুষের মুক্তির জন্য গবেষণা করতে গিয়ে দেখা যায় তাঁরা এমনকিছু তৈরি করে ফেলেন যা দিয়ে মানুষকে সহজেই শৃঙ্খলিত করা যায়।




Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts