Showing posts with label Sri Lanka. Show all posts
Showing posts with label Sri Lanka. Show all posts

Saturday, 9 March 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর - ৯

 



সবকিছু গোছগাছ করে রুম থেকে যখন বের হলাম, তখন মাত্র সোয়া পাঁচটা বাজে। রেলস্টেশনে যেতে আধঘন্টার বেশি লাগবে না। ট্রেনের অগ্রিম টিকেট পেলে আরো পরে গেলেও চলতো। টিকেটের অনিশ্চয়তার কারণেই এত ভোরে বের হতে হচ্ছে।

লিফ্‌টের জন্য দাঁড়াতে হলো বেশ কিছুক্ষণ। তিনটি লিফ্‌টের দুটো পুরোপুরি বন্ধ। অন্যটি সম্ভবত নিচের তলায় আটকে আছে। নইলে চব্বিশ তলা পর্যন্ত উঠে আসতে এত সময় নেয়ার কথা নয়। করিডোরে টিমটিমে লাল আলো জ্বলছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। দূরের জানালায় আছড়ে পড়ছে রাতের নিয়ন বাতির প্রতিফলন।

পরিবেশের মৌনতার কারণে লিফ্‌ট থামার টুং শব্দটাকেও হঠাৎ অনেক জোরালো মনে হলো। সাত তলায় লিফ্‌ট থেকে বের হয়ে রিসিপশানে কাউকে দেখতে পেলাম না। রিসিপশানে চব্বিশ ঘন্টা লোক থাকে। এখন কোথায় গেল সবাই? ট্রলিব্যাগটা টেনে নিয়ে রিসিপশানের কাছে এসে দেখলাম ডেস্কের পেছনে ফ্লোরের লাল কার্পেটে পাশাপাশি বসে মোবাইলে রিল দেখছে দুজন ছেলে।

“হ্যালো, এক্সকিউজ মি”

ধড়পড় করে উঠে দাঁড়ালো দুজনই। লিকলিকে লম্বাটা দ্রুত এগিয়ে এলো রিসিপশানের ডেস্কে। তার লাল টি-শার্টে লাগানো ট্যাগে লেখা “ট্রেইনি”।

“গুড মর্নিং স্যার। ওয়েলকাম টু চিনামন রেড।“

“আমি আসলে চেক আউট করছি।“

কি-কার্ডটা নিয়ে কম্পিউটার চেক করে “ওকে স্যার” বলার জন্য অনেকক্ষণ সময় নিলো ছেলেটি। মনে হচ্ছে সে খুবই স্লো লার্নার।

“এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য কি গাড়ি লাগবে স্যার?”

“না, এয়ারপোর্টে যাবার জন্য লাগবে না। তবে রেলস্টেশনে যাবার জন্য একটি ট্যাক্সি লাগবে।“

“নিচের গার্ডরা ট্যাক্সি ডেকে দেবে স্যার।“

নিচে নেমে এলাম। বাইরে এখনো অন্ধকার। একজন নাইটগার্ড দরজার সামনে টুলে বসে ছিল। আমাকে বের হতে দেখে ছুটে এলো। বললাম, “রেলস্টেশনে যাবার জন্য একটি মিটারড-ট্যাক্সি কোথায় পাবো?”

“এক মিনিট দাঁড়ান স্যার, আমি ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসছি।“ – ঝরঝরে ইংরেজিতে কথাগুলি বলেই অন্ধকার রাস্তার দিকে ছুটে চলে গেল তরুণ নাইটগার্ড। তার ইংরেজি উচ্চারণ রিসেপশানের ছেলেটির চেয়েও ভালো।

রাতে সম্ভবত বৃষ্টি হয়েছে। হোটেলের সামনের রাস্তা ভেজা। মিনিটখানেকও লাগলো না, একটা লাল ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হলো নাইটগার্ড। এখানে এই তিন চাকার ট্যাক্সিগুলি সম্ভবত সিএনজিতে চলে না। শ্রীলংকায় গ্যাসের সংকট আছে। গাড়িতে দেয়ার মতো গ্যাস তাদের আছে কি না জানি না। পেট্রোলের দাম বাড়ার কারণেই এখানে ট্যাক্সিভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি।

ট্যাক্সিওয়ালা ইংরেজি ভালো বোঝে না। ফোর্ট রেলস্টেশন – এই দুটো শব্দ ছাড়া আমার আর কোন কথা বুঝতে পারলো বলে মনে হলো না। তাতে আমার কোন অসুবিধা নেই।

যে পথে ট্যাক্সি চলছে সেই পথ আমার চেনা হয়ে গেছে মাত্র একদিনেই। গলির ভেতরের রাস্তায় গাড়ির ভীড় নেই। কিন্তু গার্লে রোডে ওঠার পর দেখা গেলো এই ভোরেও রাস্তায় অনেক গাড়ি।

কাল রাতে আমি যে পথে ফোর্ট স্টেশনে গিয়েছিলাম এখন বুঝতে পারছি ওটা অনেক ঘুরপথ ছিল। প্রেসিডেন্ট অফিসের সামনের গোলচত্বর থেকে লোটাস রোড ধরে একটু এসে বামে মোড নিলে অনেক কাছে হয় স্টেশন। মিনিট দশেক লাগলো স্টেশনে পৌঁছাতে।

কাল রাতে দেখে গিয়েছিলাম চার নম্বর কাউন্টার থেকে কাটতে হবে টিকেট। কাউন্টারে লাইনে আমার আগে মাত্র দু’জন মানুষ। তারা বের হয়ে যেতেই কাউন্টারে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ক্যান আই গেট অ্যা টিকেট ফর ক্যান্ডি প্লিজ!”

“গো টু কাউন্টার সেভেন্টিন। রিজার্ভ টিকেট পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।“

“কাল রাতে যে বলেছিল রিজার্ভ টিকেট নেই!”

“আজ স্পেশাল ট্রেন দেয়া হয়েছে। গো ফাস্ট।“

সতেরো নম্বর কাউন্টার আমি গতকাল চিনে গিয়েছিলাম। সেই রিজার্ভেশান রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখি লোকে গিজগিজ করছে সেখানে। ক্যান্ডির কাউন্টারের লাইন এঁকেবেঁকে কোথায় চলে গেছে তা খুঁজে বের করতে বেশ কিছুক্ষণ লাগলো। তবে ভীড় হলেও যেটা দেখে ভালো লাগলো – সেটা হলো মানুষের ভদ্র ব্যবহার। কোথাও কোন ধাক্কাধাক্কি নেই, লাইনের মাঝখানে ঢুকে যাওয়া নেই। চিৎকার-চেঁচামেচিও নেই। এখন মনে হচ্ছে আরো ভোরে আসা উচিত ছিল।

যাত্রীদের বেশিরভাগই শ্রীলংকান। আজ সম্ভবত কোন বিশেষ দিন। যাত্রীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। তাদের অনেকেরই পরনে সাদা পোশাক। মনে হচ্ছে কোন উৎসবে অংশ নিতে যাচ্ছে সবাই।

বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগলো কাউন্টারে পৌঁছাতে। কলম্বো থেকে ক্যান্ডির সেকেন্ড ক্লাস রিজার্ভ টিকেটের দাম এক হাজার রুপি। এই ট্রেনে কোন ফার্স্ট ক্লাস নেই। পাসপোর্ট দেখাতে হলো না, তবে পাসপোর্টের নম্বর বলতে হলো টিকেট এন্ট্রি করার জন্য। কম্পিউটার প্রিন্টেড টিকেটের সাইজটা বেশ বড়। যেসব তথ্য টিকেটে প্রিন্ট করা আছে সেগুলি এর চারভাগের এক ভাগ কাগজেই হয়ে যেতো। অনায়াসেই এই টিকেটের ক্ষেত্রফল শতকরা পচাত্তর ভাগ কমিয়ে ফেলা যেতো। তাতে লক্ষ লক্ষ রিম কাগজ বেচে যেতো, আর টিকেটও আধুনিক এবং দৃষ্টিনন্দন হতো।

পাঁচ নম্বর প্লাটফরম থেকে ট্রেন ছাড়বে সাতটায়। প্লাটফরমে ঢুকলাম। শ্রীলংকার ব্যস্ততম রেলস্টেশন এই ফোর্ট স্টেশন। এখনো সবকিছু সেই ব্রিটিশ আমলেই রয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে, কেবল আধুনিক ডিজিটাল ডিসপ্লেগুলি ছাড়া।

ট্রেন এখনো প্লাটফরমে আসেনি। সম্ভবত অন্য কোন স্টেশন থেকে এখানে আসবে। প্লাটফরমের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হাঁটতে হাঁটতে মানুষ দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভ্রমণ করলে।

প্লাটফরম ভরে উঠতে শুরু করেছে মানুষের আনাগোনায়। বেশ কিছু বিদেশী পর্যটক দেখা যাচ্ছে এখন। এদের হয়তো আগেই টিকেট করা ছিল, অথবা এদের স্থানীয় ট্যুর এজেন্টরা সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখেছে। তাদের কয়েকজনের সাথে স্থানীয় ট্যুর গাইড দেখা যাচ্ছে অনবরত কথা বলছে।


ফোর্ট স্টেশন থেকে কাছেই লোটাস টাওয়ার

প্লাটফরম থেকে পূর্বদিকে তাকালে সরাসরি চোখে পড়ে লোটাস টাওয়ার। তার কয়েকটা ছবি তোলার চেষ্টা করছি – এমন সময় একজন চাপদাড়িওয়ালা মোটাসোটা লোক কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইন্ডিয়ান?”

“নো। আই …”

“ডোন্ট টেল মি, লেট মি গেস…” – আমাকে বাধা দিয়ে লোকটি বেশ মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন। আমি লোকটির দিকে ভালো করে তাকালাম। ছোট ছোট চোখ বেশ লাল, মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাননি। ডান হাতের কবজিতে বেশ বড় একটা জটিল উল্কি – সিংহলি ভাষায় কিছু লেখা আছে সেখানে।

“ইউ আর বাংলাদেশি, রাইট?”

“রাইট।“

“হা হা” – খুশিতে জোরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি।

“ইউ লাইক ক্রিকেট?”

“ইয়েস।“

“সাকিব আল হাসানকে আমি খুব পছন্দ করি। শুনেছি সে নাকি এমপি হচ্ছে?”

লোকটি যে সাম্প্রতিক খবরাখবরও রাখেন তা বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না এত কথা তিনি বলছেন কেন।

“আমি খেলাধূলা গানবাজনা মৌজমস্তি খুব পছন্দ করি। আমার এক ভাই থাকে কানাডায়, আরেক ভাই থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। তারা আমাকে এত টাকা পাঠায় যে আমি খরচ করে শেষ করতে পারি না। কাল সারারাত আমি ক্যাসিনোতে ছিলাম। এখনো বাসায় যাইনি। বাসায় গিয়ে কী করবো? বাসায় তো কেউ নেই। আমার বউ চলে গেছে।“

এখন লোকটিকে মাতাল বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনো তার নেশা কাটেনি। কিন্তু নেশা করার কারণ কি বউ চলে যাওয়া? নাকি নেশা করে বলেই বউ চলে গেছে? তার কাহিনি আরো জানার ইচ্ছে হচ্ছে, আবার অস্বস্তিও হচ্ছে। মাতাল সামলানোর অভিজ্ঞতা আমার খুব কম।

“হাউ লং উইল ইউ বি ইন কলম্বো? তোমার যা কিছু লাগে আমাকে ফোন করবা, আমি ব্যবস্থা করবো।“

“আমি তো ক্যান্ডি চলে যাচ্ছি।“

“ক্যান্ডি থেকে ফোন করবা।“ বলে সামনের দিকে চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলেন।

“ডু ইউ নো, হাউ ওল্ড আই অ্যাম?”

“না, জানি না।“

“আন্দাজ করে বলো, কত বয়স আমার?”

বয়স্ক মানুষ নিজেকে নিজের বয়সের চেয়ে কম বয়সী লাগছে বললে খুশি হয়। এই মানুষটির কাচাপাঁকা দাড়িতে ভর্তি গোলাকার মুখ আর স্ফীত ভুঁড়ি দেখে মনে হচ্ছে বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। তবুও খুশি করার জন্য বললাম, চল্লিশ!

শুনে হঠাৎ প্রচন্ড রেগে গেলেন তিনি। ধমক দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “চল্লিশ! চল্লিশ মনে হচ্ছে আমাকে! চল্লিশ মনে হচ্ছে আমাকে!!”

তার চিৎকার শুনে আশেপাশে লোক জমে যাচ্ছে। প্লাটফরমের একেবারে অন্য মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে এতক্ষণ এদিকে তেমন কেউ আসেনি। আমার কৌতূহল ছাপিয়ে এবার অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে। অন্যদিকে চলে যাবার জন্য পা বাড়ানোর আগেই দেখলাম মানুষের ভিড় ঠেলে একজন সাদা ইউনিফর্ম পরা রেলকর্মী এসে সিংহলি ভাষায় কিছু বলতে বলতে লোকটির বাহু ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো আরো সামনের দিকে – যেদিকে রেলওয়ে কোয়ার্টার। লোকটি যেতে যেতেও পিছন ফিরে ইংরেজিতে চিৎকার করে বলছে, “আমি সাকিব আল হাসানের চেয়েও ছোট।“

লোকটি কি মাতাল, নাকি উন্মাদ ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে মনের কোথাও যে সমস্যা আছে তা নিশ্চিত।

“সরি, হি শাউটেড অ্যাট ইউ!” কাছে দাঁড়ানো এক তরুণ বললো। তার দিকে তাকালে সে আবার বললো, “ডোন্ট মাইন্ড, অ্যা? হি ইজ নট এ ব্যাড পারসন।“

“তুমি চেনো তাকে?”

“হ্যাঁ, সে রেলওয়েতে চাকরি করে। মাঝে মাঝে মাতাল হয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে।“

লোকটি মাতাল হয়ে বেশি কথা বলেছে সত্য, কিন্তু উল্টাপাল্টা কথা কিছুই বলেনি। আমি একটু হেসে প্রসঙ্গ পাল্টালাম, “সেকেন্ড ক্লাস রিজার্ভ বগি কোথায় থামবে বলতে পারো?”

“প্লাটফরমের মাঝামাঝি যেতে হবে।“

এবার একটু দ্রুত পা ফেলে চলে হাঁটতে শুরু করলাম অন্যদিকে – প্লাটফরমের মাঝামাঝি পৌঁছানোর জন্য।

সাতটা বাজার দশ মিনিট আগে ট্রেন প্লাটফরমে ঢুকতে শুরু করার সাথে সাথে প্রচন্ড ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। মাত্র চারটি বগি হলো রিজার্ভ। বাকি ছয় সাতটি বগি তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণির অসংরক্ষিত আসনের বগি। সেখানে ঠাসাঠাসি করে যে আগে উঠতে পারে সে সিট পেলেও পেতে পারে।

ট্রেন থামার পর কোন ধরনের তাড়াহুড়ো ছাড়াই উঠে গেলাম ডি বগিতে। ট্রেনের বগিগুলি বাংলাদেশের ট্রেনের বগির মতোই। সেকেন্ড ক্লাস বগিও মনে হলো আমাদের ফার্স্ট ক্লাস বগির মতো। পরিচ্ছন্ন, সিটগুলিও আরামদায়ক। দুপাশে দুটো করে সিট। আমার সিট জানালার পাশে নয়। পাশের জন এখনো আসেনি। আমি আমার সিটে বসে আশেপাশে তাকাচ্ছি।

আমাদের কম্পার্টমেন্টে এখনো অনেক সিট খালি। সম্ভবত সামনের স্টেশন থেকে উঠবে। স্পেশাল ট্রেন হওয়াতে এই রিজার্ভ টিকেটগুলি আগে ছাড়া হয়নি। হলে তো কাল রাতেই কিনতে পারতাম। আমার সারির প্রথম দিকে একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবার উঠেছে। মা-বাবা আর দুজন কিশোরী কন্যা তাদের। এধরনের ট্রেনে উঠতে পেরে তারা যে প্রচন্ড খুশি তা বোঝা যাচ্ছে তাদের ছটফটানি দেখে।

ট্রেন সাতটায় ছাড়ার কথা। আর দুমিনিট বাকি সাতটা বাজার। পাশের সিটে কেউ আসছে না দেখে ভালোই লাগছে। ট্রেনে জানালার পাশে বসে বাইরে দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে – সেটা অনেকদিন পর পেতে যাচ্ছি আজ।



ঠিক সাতটায় ট্রেন চলতে শুরু করলো। নিজের সিট থেকে সরে জানালার সিটে গিয়ে বসলাম। সামনের সিট এসে পড়েছে জানালার মাঝামাঝি। ফলে দৃশ্য পুরোপুরি উপভোগ করা যাচ্ছে না। প্লাটফরম পার হয়ে ট্রেন এখন শহর অতিক্রম করছে। সামনের দুটো সিটও খালি। সেখানে গিয়ে বসবো কি না ভাবছি, এমন সময় সামনের দিকের বগি থেকে বেশ কয়েকজন এই বগিতে এসে বসতে শুরু করলো।

“হিয়ার আর উই। দিস থ্রি”

চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম – নীল জিন্স আর সাদা টি-শার্ট পরা অনেক লম্বা চুলের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সিটের সামনে। তার সঙ্গী দুজন ছেলে হাতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ট্রেনের দুলুনি সামলে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। বড় দুটো সুটকেস লাগেজ র‍্যাকে তুলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে একজন এসে মেয়েটিকে বললো আমার সামনের সিটের জানালার দিকে বসতে। এবার মেয়েটির মুখ দেখা গেল। স্বাভাবিক শ্রীলংকান,  চেহারায় আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই। ছেলেটির মুখে সযত্নে রক্ষিত দাড়িগোঁফ – অনেকটা অ্যানিমেল-এর রনবীর কাপুরের মতো। তারা পাশাপাশি সিটে বসার পর তৃতীয় জনকে দেখে বেশ চমকে উঠলাম। গতকাল দুপুরে গার্লে ফেস গ্রিনের সামনের রাস্তার ফুটপাতে যে বড়লোক ছেলেটির সাথে কথা হয়েছিল। তার সাথে আবার দেখা হবে ভাবিনি।

আমাকে দেখে সে চিনতে পারবে না ভেবেছিলাম। কিন্তু চিনতে পারলো। বললো, “ইউ এগেইন? গোয়িং ক্যান্ডি? আমিও ক্যান্ডি যাচ্ছি আমার বন্ধুদের সাথে। দে আর ফ্রম অস্ট্রেলিয়া।“ 


Sunday, 3 March 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর - ৮

 



কলম্বো শহরে কোন রিকশা নেই।  চীন জাপান হংকং-এও এখনো রিকশার চল রয়ে গেছে, অথচ বুঝতে পারছি না শ্রীলংকা রিকশামুক্ত হয়ে গেল কীভাবে? পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এখানে সত্যি সত্যিই পাবলিক। রাস্তার বাস সরকারি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে, বাসে-বাসে অহেতুক প্রাণনাশক প্রতিযোগিতা এখানে নেই। বাসগুলির রঙ আর কারুকাজে উন্নত রুচিবোধের কোন চিহ্ন চোখে পড়লো না। আমাদের বিআরটিসির বাসের মতো মাঝে মাঝে কয়েকটা টকটকে লাল রঙের বাস দেখা গেলেও বেশিরভাগ বাসে আকাশী রঙের উপর ছোপছোপ আঁকুবুকি। বাসস্টপে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাস এলে আর উঠতে পারলাম না। প্রচন্ড ভীড় তো আছেই, তাছাড়া বাসের রুটও ঠিকমতো জানা নেই। বাস কন্ডাক্টর সিংহলী ভাষায় যেসব গন্তব্যের নাম ধরে ডাকাডাকি করছিলো সেসবের কোনটাই বুঝতে পারছিলাম না।

রিকশা নেই। আমাদের সিএনজি ট্যাক্সির মতো ট্যাক্সি আছে অনেক। সবুজ, নীল, লাল – ভিন্ন ভিন্ন রঙের ট্যাক্সি দেখলাম। বেশিরভাগই মিটারে চলে না, দরাদরি করতে হয়। মাঝে মাঝে একটা দুটো মিটারের ট্যাক্সি চোখে পড়ে। গাইড বইতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে – মিটারের ট্যাক্সিতে উঠতে। ছুটির দিনের ব্যস্ততায় রাস্তায় খালি ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল। রাস্তা পার হয়ে প্রেসিডেন্টের দপ্তরের সামনে এলাম। এখানে কোন গাড়ি থামতে দিচ্ছে না রাস্তার পুলিশ। আরেকটু এগিয়ে খোলা মাঠের যেখানে বিশাল খ্রিস্টমাস ট্রি সাজানো হয়েছে – সেখানে রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি ট্যাক্সি দাঁড়ানো। মিটার-ট্যাক্সি দেখে উঠে গেলাম।

“ওয়াটা ইয়ান্না উনা কোহেডা?” – লিকলিকে মাঝবয়সী ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। একটি শব্দও বুঝতে পারলাম না। ইংরেজিতে বললাম, “বেইরা লেইক নিয়ে যেতে পারবেন আমাকে?”

“বেইরা লেইক?”

“ইয়েস”

তাঁর মাথা এক পাশ থেকে অন্য পাশে নাড়ানো দেখে হতাশ হতে গিয়েই মনে পড়লো – আমরা না-বোঝানোর জন্য যেভাবে মাথা নাড়ি, এরা তো হ্যাঁ বোঝানোর জন্যই সেভাবে মাথা নাড়ে।

“হোয়ার ইন বেইরা লেইক?”

“ওল্ড টাউনের যে কোনো জায়গায়।“

ট্যাক্সি ছুটতে শুরু করলো। মিটারের দিকে চোখ পড়তেই মনে হলো ওটা ট্যাক্সির চেয়েও জোরে চলছে। এক কিলোমিটার যাবার আগেই মিটারে আড়াই শ রুপি উঠে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমেরিকান এমব্যাসি পার হয়ে ট্যাক্সি বাম দিকে মোড় নিলো। বেশ কয়েকটি ছোটবড় রাস্তা পার হয়ে পুরনো জীর্নশীর্ণ দোকানপাটের অঞ্চলে প্রবেশ করতেই হ্রদের পানিতে চোখ গেল। বললাম, এখানেই থামেন।

মাত্র সাত-আট মিনিটের ভ্রমণ। দূরত্ব খুব বেশি হলে চার কিলোমিটার হবে। ট্যাক্সির মিটারে দেখাচ্ছে চারশ ত্রিশ রুপি। ট্যাক্সিভাড়া এখানে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি।


ওল্ড টাউন ক্যাফে


শহরের ভেতর বেইরা হ্রদের এপার আর ওপারের মধ্যবর্তী দূরত্ব এক কিলোমিটারও হবে না। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য সীমাহীন। এদিকের বাড়িঘর, দোকানপাট পুরনো জীর্ণ। ওদিকে গড়ে উঠেছে ঝা চকচকে বহুতল আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক ভবন। ট্যাক্সি থেকে যেখানে নেমেছি – সামনেই ওল্ড টাউন ক্যাফে। শনিবারের বিকেলে যেখানে শহুরে ক্যাফে জমজমাট থাকার কথা, সেখানে এই ক্যাফের দরজা-জানালা বন্ধ। সাময়িক বন্ধ, না চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে বোঝার উপায় নেই। আশেপাশের ঘরবাড়িগুলিরও দৈন্যদশা, দেখেই মনে হচ্ছে মন খারাপ করে কোনরকমে ইনিচ্ছাসত্ত্বেও দাঁড়িয়ে আছে লেকের দিকে মুখ করে।

মাঝ-লেকের পানি আকাশের প্রতিচ্ছবিতে টলটলে নীল দেখালেও পাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি – লেকের পানি প্রচন্ড ময়লা। এই লেকের গভীরতা শুরু থেকেই কম ছিল। শুরুটা তো আজকের নয়। কম করে হলেও এই হ্রদের বয়স পাঁচ শ বছর হয়েছে। পর্তুগিজরা তখনকার রাজাদের হাত থেকে নিজেদের দুর্গ রক্ষা করার জন্য দুর্গের চারপাশে যে পরিখা খনন করেছিল – সেটাই এই হ্রদ। পর্তুগিজ ইঞ্জিনিয়ার বেইরার নামে এই হ্রদ পরিচিত হয়ে ওঠে – বেইরা লেইক নামে। এই হ্রদের চারপাশে গত পাঁচ শ বছর ধরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। কয়েকটি ছোট ছোট খাল এই হ্রদকে যুক্ত করেছে সাগরের সাথে। একসময় কলম্বো বন্দর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হতো এই হ্রদের ভেতর দিয়ে নৌকা করে শহরের বিভিন্ন জায়গায়।

হ্রদের এপারের বাঁধানো রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। প্রচন্ড ময়লা, পাখিদের মলে সাদা হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারোরই নজর নেই এদিকে। পর্যটকদের কেউ আসেও না এখানে। আমি এদিকে এসেছি বিশেষ এক কারণে। সাত-আট বছর আগে আমার এক শ্রীলংকান ছাত্রীর কাছে শুনেছিলাম এই হ্রদের পাড়ের ওল্ড টাউনের কথা। এখানের কোন এক বাড়িতে তারা থাকতো ছোটবেলায়।  দুই জমজ বোনের পর আরো একটা ছোট্ট বোন ছিল তাদের। একদিন তাদের বাবা সেই ছোট্ট এক বছরের মেয়েটিকে বস্তায় ভরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল এই হ্রদে। তাদের মা যখন টের পায় – ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারপর তাদের ব্যক্তিগত কাহিনি অনেক দুঃখের। তাদের মা তাদের দুইবোনকে নিয়ে বাবাকে ছেড়ে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল ইন্ডিয়াতে। সেখান থেকে মেলবোর্নে। কলম্বোতে আসার পর সেই কাহিনি আবার মনে পড়লো। তাই দেখতে আসা। গত পাঁচ শ বছর ধরে এরকম কত শত ঘটনার নিরব সাক্ষী এই হ্রদ।


বেইরা হ্রদের মন্দির

গাছে গাছে অসংখ্য পাখি। ওপারে লোটাস টাওয়ার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়া পড়েছে হ্রদের পানিতে। বেশ বড় একটি বৌদ্ধমন্দির গড়ে তোলা হয়েছে হ্রদের পানির উপরেই। সারি সারি সোনালী বৌদ্ধমূর্তি সূর্যের আলোয় দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এদিকে কোনো কোলাহল নেই। ছোট ছোট রাস্তা -গাড়িশূন্য। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিলো।

এখান থেকে আমার হোটেল বেশ কাছে। হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছে মনে পড়লো বইয়ের দোকানের কথা। হোটেলের পেছন দিকের রাস্তায় একটি বইয়ের দোকান দেখেছিলাম সকালে বের হবার সময়। তখন বন্ধ ছিল ওটা। দশটা থেকে খোলার কথা। হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে আবার গেলাম বইয়ের দোকানে। খোলা আছে।


বিজিতা ইয়াপা বুকশপের প্রবেশপথ

দেয়ালে লাগানো খুবই সাদামাটা একটি সাইনবোর্ড – বিজিতা ইয়াপা বুকশপ। অন্ধকার একটি একতলা বাড়ির ভেতর মোটামুটি আকারের একটি বইয়ের দোকান। কিন্তু এরা শ্রীলংকার একটি প্রথম সারির প্রকাশক। শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন শহরে এদের শাখা আছে। ভেতরে ইংরেজি বইয়ের বেশ ভালো সংগ্রহ আছে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ। এদের প্রকাশিত বই আলাদা তাকে রাখা আছে। আমি খুঁজছিলাম শ্রীলংকান লেখকদের ইংরেজি বই। শ্রীলংকান সাহিত্য আমি মোটেও পড়িনি। আগ্রহ আছে পড়ে দেখার। শ্রীলংকান লেখকদের লেখা বেশ কিছু উপন্যাস আর থ্রিলার কিনলাম। এদের বেশিরভাগ বই পেপারব্যাক, হার্ডবাইন্ডিং খুব একটা নেই। খরচ কমানোর জন্য হতে পারে এই ব্যবস্থা। তবে এদের বইয়ের দাম তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। প্রকাশকরা বলে থাকেন – বই বেশি বিক্রি হলে বইয়ের দাম কম রাখা যায়। কিন্তু এখানেও যে বই প্রচুর বিক্রি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এত বড় দোকানে আমি ছাড়া আর মাত্র দুজন লোক বই ঘাটাঘাটি করছে। দুজন বিক্রেতা আর একজন দারোয়ান ছাড়া আর কাউকেই তো দেখলাম না ঘন্টাখানেকের মধ্যে।


বিজিতা ইয়াপা বুকশপের ভেতরে

হোটেলে এসে অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নেওয়ার পর সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কিন্তু ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। হোটেলের নয় তলায় একটি রেস্টুরেন্ট আছে। এক্সপিডিয়ার কল্যাণে এই রেস্টুরেন্টে আমাকে শতকরা বিশ ভাগ মুল্যহ্রাসের একটি কুপন দেয়া হয়েছে। কিন্তু খাবার পছন্দ না হলে মূল্যহ্রাস দিয়ে আমি করবো কী! হোটেলের ডিজিটাল প্রযুক্তি বেশ ভালো। রুমের স্মার্ট টিভিতে রেস্টুরেন্টের মেন্যু দেখা যায়। সবকিছু বিদেশী আইটেম। শ্রীলংকান রাইস অ্যান্ড কারি – ভাত-তরকারি এই হোটেলে নেই। বাইরেই যেতে হবে আবার।

দিনের আলো কমতে শুরু করেছে। আনন্দ কুমারাস্বামী গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে লিবার্টি প্লাজায় এলাম। দিনের চেয়েও বেশি ব্যস্ততা এখন এখানে। লিবার্টি প্লাজা শপিং মলের সামনের রাস্তায় সিনেমাহলের সামনে বেশ ভীড়। ইংরেজি সিনেমার বেশ কদর এখানে। শাহরুখ খানের ‘ডাংকি’ সিনেমার পোস্টারও দেখা যাচ্ছে। এখনকার সব আধুনিক শপিং মলেই ফুডকোর্ট থাকে। লিবার্টি প্লাজার বেইজমেন্টেও বেশ বড় ফুডকোর্ট। অনেকগুলি দোকান। শ্রীলংকান খাবার খুঁজছিলাম। পেয়ে গেলাম একসাথে অনেকগুলি খাবারের দোকান। শ্রীলংকান খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এক প্লেট ভাত, চার ধরনের সব্জি, এক টুকরো মাছ, আর কোমল পানীয় – সব মিলিয়ে মাত্র পাঁচশ রুপি। এই চরম মুদ্রাস্ফীতির কালেও এত কম দামে খাবার বিক্রি করতে পারে কীভাবে? সরকার কি কোন ভর্তুকি দিচ্ছে? জানি না।


শ্রীলংকার ঐতিহ্য ভাত-তরকারি

আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল – করতে গিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম সমুদ্রের দিকে। রাস্তায় রাস্তায় আলোকসজ্জা। আমেরিকান দূতাবাসসহ শহরের বেশিরভাগ ভবন আলোয় ঝলমল করছে। ক্রিস্টমাস এখানে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে মনে হচ্ছে। গার্লে ফেইস গ্রিন এখন লোকে লোকারণ্য। অসংখ্য নারীপুরুষ নেমে পড়েছে সাগর পাড়ের এক চিলতে সৈকতে। হাঁটু পানিতে নেমেই কী আনন্দ তাদের। রাস্তায় উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে নৃত্য করছে একদল তরুণ-তরুণী। সবার একই রকম টী-শার্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন কোম্পানি স্পন্সর করেছে তাদের প্রোগ্রাম। প্রেসিডেন্ট অফিসের পাশ দিয়ে লোটাস রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তাভর্তি গাড়ি। মনে হচ্ছে ট্রাফিকজ্যামে আটকে পড়েছে এদিকের পুরোটা শহর। এদিকে রাস্তার পাশেই হিলটন হোটেল। আরেকটু সামনে এগিয়ে সেক্রেটারিয়েট রেলওয়ে স্টেশনের কাছে আরেকটি বৌদ্ধমন্দির। বিশালাকৃতির বুদ্ধমূর্তি রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে। 

হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে। ফুটপাতে প্রচুর মানুষ। ম্যাক্‌ক্যালাম রোড ধরে কিছুদূর গিয়েই এক্সিবিশন সেন্টার। বাণিজ্যমেলা হচ্ছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই প্রচন্ড ভীড় সেখানে। বাণিজ্য আমাকে টানে না। এসব মেলার ভেতর আমি পারতপক্ষে ঢুকি না। কিন্তু মাইকে যে শ্রীলংকান গান বাজছে তা খুবই শ্রুতিমধুর। সংগীতের এই এক অদ্ভুত ক্ষমতা। সুর যদি মন ভরায়, ভাষা না বুঝলেও কিছু যায় আসে না।

একটু সামনে গিয়েই ক্যাসিনো। এখানে বড়লোকদের ভীড়। রাস্তার ফুটপাত দখল হয়ে গেছে দামী দামী গাড়িতে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম নতুন নতুন গাড়ি করে আসা লোভী নারী-পুরুষদের যারা সাড়ম্বরে জুয়া খেলতে আসছে।

ফোর্ট রেলওয়ে স্টেশন এদিকে কোথাও হবে জানি। কিন্তু মনে হচ্ছে কোন একটা ভুল টার্ন নিয়ে অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। স্টেশন খুঁজে বের করা দরকার। ক্যাসিনোর এক গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম ট্রেন স্টেশন কোথায়। গার্ডটি সম্ভবত ইংরেজি বোঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না। ইশারা ইংগিতে যেটুকু দেখালেন তাতে বুঝলাম যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে ফিরে যেতে হবে কিছুদূর। তারপর রাস্তা পার হয়ে ডান দিকে চলে যেতে হবে।

মিনিট দশেক হাঁটার পর স্টেশনের আলো দেখতে পেলাম। যেদিক দিয়ে এসেছি সেটা ফোর্ট স্টেশনের পেছনের দিক। ছোট্ট একটা পথ দিয়ে ওভারব্রিজে ওঠার রাস্তা। ওভারব্রিজে উঠেই দেখতে পেলাম পাশাপাশি অনেকগুলি রেললাইন। প্লাটফরমের পর প্লাটফরম। ব্রিজ পার হয়ে নামলাম স্টেশনের সামনে।

এই সেই কলম্বোর বিখ্যাত ফোর্ট রেলওয়ে স্টেশন। ব্রিটিশদের হাতে তৈরি এই ট্রেন স্টেশন এখনো একইভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সাদা রঙের খুবই পুরনো বিল্ডিং। সারি সারি টিকেট কাউন্টার। আগামীকাল ক্যান্ডি যাবো, খোঁজ নেয়া যাক যদি কোন রিজার্ভ টিকেট পাওয়া যায়। সতের নম্বর কাউন্টার হলো রিজার্ভেশন কাউন্টার। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার পর দেখলাম বিভিন্ন গন্তব্যের অনেকগুলি কাউন্টার সেখানে। ক্যান্ডির কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ভেতরে সাদা প্যান্টশার্ট পরা রেলকর্মী জানালেন – কোনো রিজার্ভ টিকেট নেই। কাল সকালে ট্রেন ছাড়ার ঘন্টাখানেক আগে এসে টিকেট কাটলে হবে।

“ক্যান্ডির ট্রেন কখন ছাড়বে?”

“ফার্স্ট ট্রেন ছয়টা পঞ্চাশ, এরপর আটটা, দশটা …”

মনে হচ্ছে ক্যান্ডির ট্রেন অনেকগুলি আছে। দেখা যাক সকালে কী হয়।

রিজার্ভেশন রুম থেকে বের হবার সময় একজন মাঝবয়সী লোক ফিসফিস করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “ক্যান্ডি যাবার জন্য রিজার্ভ টিকেট আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।“

“কীভাবে?”

“আমার কাছে টিকেট আছে। আপনি আমেরিকান তো? মাত্র বিশ ডলার।“

লোকটি আমাকে আমেরিকান কী কারণে ভাবলেন জানি না। বললাম, “না ভাই, আমার দরকার নেই।“

আমি দ্রুত হেঁটে তাকে কাটানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনিও বেশ দ্রুতই হাঁটতে শুরু করলেন আমার পাশাপাশি। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন্‌ হোটেলে উঠেছেন?”

আমি কোন উত্তর না দিয়ে হাঁটার গতি আরেকটু বাড়ালাম। কাজ হলো না। সে প্রায় গা ঘেঁষে জিজ্ঞেস করল, “মেয়ে লাগবে? বিউটিফুল শ্রীলংকান গার্লস?”

এরকম নোংরা দালালি এখানেও আছে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার দিকে কীভাবে তাকিয়ে ছিলাম জানি না, সে অন্যদিকে চলে গেল। আমি ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো একটি মিটার-ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম।


Wednesday, 28 February 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর - ০৭

 


অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলিকে এখন আর তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলা হয় না। ধনীদেশগুলি আদর করে এখন তাদের উন্নয়নশীল বলে ডাকে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে সেসব দেশে চোখ কপালে ওঠার মতো উন্নয়ন ঘটে চলেছে। ঋণ করে ঘি খাবার মানসিকতা থাকুক বা না থাকুক, এখন বিশ্বমোড়লরা জোর করে ঋণ দিয়ে ঘি খেতে বাধ্য করে। অনভ্যাসের ঐ ঘি সাধারণ জনগণের পেটে সহ্য না হলেও  সেসব দেশের ক্ষমতাশালী কিছু মানুষ রাতারাতি ধনী হয়ে যায়। আদর্শ রাষ্ট্র যেখানে দেশের সকল নাগরিকের জীবন-যাপনের সার্বিক মানোন্নয়নকেই প্রাধান্য দেয়, সেখানে উন্নয়নশীল দেশে ঘটে বাহ্যিক জৌলুস বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় বাহবা দিয়ে চড়া সুদে বৈদেশিক ঋণের ইন্ধন জোগায় মোড়লরা। মোড়লদের কথায় লোভী অসৎ শাসকরা উঠবস করে – কারণ তাতে দেশের বারোটা বাজলেও শাসকদের ব্যক্তিগত তহবিল ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। তার অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ – চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।


প্রেসিডেন্টের দপ্তর

কলম্বো মেইন রোডের ওপারে পাকা ইটের রঙের বিশাল ভবনটি দেখেই চিনতে পারলাম ওটা প্রেসিডেন্টের কার্যালয়। গতবছর ২০২২ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শ্রীলংকার বিক্ষুব্ধ জনগণ সরকারের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে। সেই সময় টেলিভিশনে এই ভবন দেখেছি অনেকবার। বিক্ষুব্ধ জনগণ গত বছরের এপ্রিলে এই ভবন দখল করে নিয়েছিল। আজও এখানে অসংখ্য সশস্ত্র প্রহরী পাহারায় নিযুক্ত। ক্রিস্টমাস উপলক্ষে পুরো ভবন আলোকসজ্জিত করা হয়ে গেছে। এখন ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন বড় ধরনের উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। 

শ্রীলংকার সরকারি অবকাঠামোর বেশিরভাগই ব্রিটিশদের তৈরি। এই ভবনটিও ব্রিটিশরাই তৈরি করেছিল ১৯৩০ সালে। সেই সময় মাত্র সাড়ে চার লাখ রুপি খরচ হয়েছিল এই বিশাল রাষ্ট্রীয় ভবন তৈরি করতে। প্রায় এক শ বছর বয়সেও এই ভবন ঝকঝকে নতুনের মতো। ব্রিটিশরা ১৯৪৭ পর্যন্ত এটাকে স্টেট কাউন্সিল অব সিলনের অফিস হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হবার পর থেকে এটাই ছিল শ্রীলংকার পার্লামেন্ট হাউজ। ১৯৮৩ সালে দশ কিলোমিটার দক্ষিণে কুট্টিতে নতুন পার্লামেন্ট ভবন তৈরি হবার পর এই ভবন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

ভবনের সামনে শ্রীলংকার প্রথম তিন প্রধানমন্ত্রীর ধাতব মূর্তি রোদে জ্বলজ্বল করছে। এঁরা সবাই জনগণের ভালোবাসা পেয়েছিলেন নিশ্চয়। নইলে বিক্ষোভের সময় এসব মূর্তি অক্ষত থাকতো না। 

পাশেই লোটাস রোড চলে গেছে লোটাস টাওয়ারের দিকে। ওদিকে যাওয়ার আগে এদিকটা দেখে যাওয়া যাক। রাউন্ড অ্যাবাউট-এর সামনে রাস্তা পার হওয়ার সময় বুঝতে পারলাম ট্রাফিক লাইট না থাকলে রাউন্ড অ্যাবাউটে গাড়ি চালানোর যে স্বাভাবিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয় – গতি কমাতে হয়, পথচারীকে রাস্তা পার হতে দিতে হয় – এসবের কোন বালাই নেই এখানে। 

সমুদ্রের পাশে পুরনো বাঁধানো রাস্তার পর আরো অনেক খালি জায়গা পড়ে আছে। একটু দূরে সম্পূর্ণ নতুন একটি আবাসিক শহর ‘পোর্ট সিটি’ গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল। সরকারি দুর্নীতির স্বাক্ষী হয়ে এই নগরীর কাজ জনবিক্ষোভের মুখে আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ যেতে চাইলে ওখানে গিয়ে ঘুরে আসতে পারে। 

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সামনের রাস্তায় ছোট্ট একটা গেট আছে পোর্ট সিটিতে ঢোকার। গেটে লেখা আছে হেঁটে যেতে আসতে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। কেউ যদি গাড়িতে করে যেতে চায় তবে টাকা দিয়ে স্পেশাল পারমিট কিনে যেতে পারবে অন্য গেট দিয়ে। 


পোর্ট সিটির প্রবেশ পথ


গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম এক সময় সাইট অফিস এবং ফ্ল্যাট বুকিং অফিস ছিল এদিকে। এখন আর নেই, কিন্তু বিশাল বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড দাঁড়িয়ে আছে এখনো। বহুতল ভবনে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক হবার প্রলোভন দেখানো মনোলোভা বিজ্ঞাপন। লাস্যময়ী যে তরুণীর ছবি বিজ্ঞাপনে – হয়তো শ্রীলংকান কোন অভিনেত্রী  – যাকে দেখে ফ্ল্যাট কিনতে উদ্বুদ্ধ হবেন অনেকে। প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যাবার জন্য নিশ্চয় সেই অভিনেত্রী দায়ী নন। বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠানের এরকম একটি বিজ্ঞাপন করেছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরি বন্যা। রবীন্দ্রপ্রেমী অনেকেই ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম বুকিং দিয়ে প্রতারিত হয়েছিলেন।  

ছোট্ট একটি গার্ডরুম। তার পাশে মেটাল ডিকেক্টর। ওটার ভেতর দিয়ে যাবার সময় কোন ধরনের শব্দ হলো না। সম্ভবত ডিটেক্টরও কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। গার্ডরুমের গার্ডের দিকে তাকালাম। তিনি ছোট্ট টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চোখাচোখি হতেই একটু হাসলেন। মনে হলো বসে থাকা ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই এখানে। 

ইট বিছানো ছোট্ট একটি রাস্তা ধরে হাঁটছি। বাম পাশে সামুদ্রিক ঝোপ, মেছো গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। ডানে বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে ভেতরের জঙ্গল। একের পর এক বিজ্ঞাপনে পৃথিবীর বড় বড় শহরের ছবির পাশাপাশি কলম্বোর পোর্ট সিটির তুলনা করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের দাবি সত্যি হলে কলম্বোর পোর্ট সিটি হার মানাবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিকে, আমেরিকার নিউইয়র্ককে, জাপানের টোকিওকে, কানাডার টরন্টোকে। সামনে সমুদ্রের বাম পাশে কলম্বোকে খুবই সুন্দর লাগছে এখান থেকে। ঝকঝকে নীল আকাশ দেখে বোঝা যাচ্ছে কলম্বোর বাতাস অনেক বিশুদ্ধ।

মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরই একটি বেশ বড় গোলচত্বর। তার সামনে বেশ বড় বড় ধাতব অক্ষরে লেখা হয়েছে পোর্ট সিটির নাম। সমুদ্রের পাড় সুন্দর করে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করে বেশ কয়েকটি সিড়ি তৈরি করে দেয়া হয়েছে। বাঁধানো রাস্তার একপাশে সাগর, সেদিকে রেলিং দেয়া আছে। কয়েকটি বড় বড় নারকেল গাছ, সম্ভবত আগেই ছিল অধিকৃত জমিতে। কিছু নতুন গাছ লাগানো হয়েছে। পানির উপর দিয়ে হাঁটার জন্য একটি সুদৃশ্য টানা ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। ঘরবাড়ির কোন চিহ্ন কোথাও নেই।


পোর্ট সিটির ভেতরে সুদৃশ্য ব্রিজ


কিছু উঠতি প্রেমিক-প্রেমিকা ছাতা খুলে বসে আছে এখানে ওখানে। আর মাত্র গুটিকতক আমার মতো কৌতূহলী পর্যটক ছাড়া তেমন আর কেউ নেই। দুর্নীতির থলের বেড়াল বের হয়ে আসার কারণেই কি আকর্ষণ হারিয়েছে প্রস্তাবিত পোর্ট সিটি? তবে আমার মনে হচ্ছে এটা সাময়িক। কিছুদিনের মধ্যেই এটি আবার প্রচন্ড বিক্রমে শুরু হয়ে যাবে। কারণ এই প্রকল্প ছিল শ্রীলংকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের নিজের প্রকল্প, আর অর্থদাতা স্বয়ং চীন। 

এখান থেকে কলম্বো শহরের বড় বড় বিল্ডিংগুলি যেরকম উজ্জ্বল দেখাচ্ছে – সেরকম অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী দুর্নীতির বড় বড় চিহ্নও চোখে পড়ছে। মেলবোর্নে আমার শ্রীলংকান প্রতিবেশীর সাথে অনেকদিন কথা হয়েছে শ্রীলংকায় বিক্ষোভের সময়। তখনকার প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্টের পরিবারের দুর্নীতির যে কাহিনি তার কাছে শুনেছি এবং প্রিন্ট মিডিয়া থেকেও যতটুকু জেনেছি তাতে শ্রীলংকার জনগণের জন্য কষ্ট লাগে। অনেকে বলে থাকেন, যেমন নাগরিক তেমন সরকার। তাই যদি হবে, তাহলে শ্রীলংকানরা এত সুনাগরিক হওয়া সত্ত্বেও এরকম প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী কীভাবে পায় বছরের পর বছর!

আমাদের মতো স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হয়নি শ্রীলংকানদের। তবে দীর্ঘদিন ধরে তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ সামলাতে হয়েছে তাদের। ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে শ্রীলংকায় সরাসরি গৃহযুদ্ধ চলেছে। এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ, সাতাশ হাজার তামিল টাইগার বাহিনির সদস্য এবং আটাশ হাজারেরও বেশি শ্রীলংকান সেনাবাহিনীর সদস্য। ২০০৯ সালে ফিল্ড মার্শাল সারদ ফনসেকার নেতৃত্বে শ্রীলংকান সেনাবাহিনি তামিল টাইগারদের পরাস্ত করে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটায়। এর কৃতিত্ব অনেকটাই এসে পড়ে তখনকার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের হাতে। 

শ্রীলংকার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবার ভীষণ প্রভাবশালী। ১৯৩৬ সালে ম্যাথিউ রাজাপাকসের ব্রিটিশ সরকারের অধীনে স্টেট কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে তাঁদের রাজনীতির উত্থান শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই আলভিন সেই পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ম্যাথিউ রাজাপাকসের ছেলে লক্সমন এবং আলভিন দুজনই নির্বাচিত হন দুই এলাকা থেকে। ১৯৭৭ পর্যন্ত অবিরামভাবে রাজাপাকসে পরিবারের একাধিক সদস্য শ্রীলংকার পার্লামেন্ট মেম্বার ছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সাময়িক বিরতির পর ১৯৮৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত রাজাপাকসে পরিবারের একাধিক সদস্য শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকগুলি পদ ধরে রেখেছিলেন। 

আলভিন রাজাপাকসের নয়জন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড়ছেলে চামাল রাজাপাকসে ১৯৮৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন, ২০০০ সালে ডেপুটি মিনিস্টার, ২০০৭ সালে সেচমন্ত্রী, এবং ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন। তাঁর ছেলে শশীন্দ্র উভা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ২০১৫ পর্যন্ত। 

আলভিনের দ্বিতীয় ছেলে মাহিন্দা রাজাপাকসে। তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত এমপি ছিলেন। এরপর ১৯৮৯ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত আবার এমপি। ১৯৯৪ সালে শ্রমমন্ত্রী, ১৯৯৭ সালে মৎস্যমন্ত্রী, ২০০০ সালে বন্দরমন্ত্রী, ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী, ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে শ্রীলংকার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মূল ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।

শ্রীলংকার শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি পার্লামেন্টারিয়ানও নয়, আবার পুরোপুরি প্রেসিডেন্সিয়ালও নয়। শুরুতে ব্রিটিশ পদ্ধতির পার্লামেন্টারিয়ান শাসনব্যবস্থা চালু থাকলেও পরে সরাসরি জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার বিধান রাখা হয়। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মতোই কোন প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্বে থাকতে পারবেন না – এই বিধান রাখা হয়। আর প্রেসিডেন্ট পদে ভোট দেয়ার পদ্ধতিও খুব সুন্দর। অনেকটাই অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনের মতো – পছন্দের ক্রমানুসারে ভোট। তবে অস্ট্রেলিয়ায় যেরকম সব প্রার্থীকেই পছন্দের ক্রমানুসারে ভোট দিতে হয়, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রথম এবং দ্বিতীয় পছন্দকে ভোট দিলেই চলে। ধরা যাক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক, খ, গ, ঘ, ঙ – এই পাঁচজন প্রার্থী। এখন ভোটারকে এই পাঁচ জনের মধ্যে দু’জনকে প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে ভোট দিতে হবে। প্রথম পছন্দ হিসেবে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন। 

এভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দুই মেয়াদ সম্পন্ন করার পরেও তাঁর প্রেসিডেন্ট পদের মোহ কাটেনি। আবারো প্রেসিডেন্ট হবার জন্য তিনি সংবিধান সংশোধন করে ফেললেন। আবার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ালেন। ২০০৯ সালে তামিল টাইগারদের দমন করে তিনি যতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, সংবিধান সংশোধন করে একনায়কতন্ত্রের দিকে প্রকাশ্যে অগ্রসর হবার পর তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না। নতুন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দার আনা সংবিধানের সংশোধনী বাতিল করে দিলেন। তাতে দমবার পাত্র নন রাজাপাকসে। দুবছরের মধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। ২০১৮ সালে তিনি পার্লামেন্টে ফিরে এলেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে। সেবার মাত্র তিন মাস প্রধানমন্ত্রী থাকলেও ২০১৯ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। সেই সময় প্রেসিডেন্ট হলেন তাঁর ছোটভাই গোটাবায়া রাজাপাকসে। 

রাজতন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্রে এরকম পরিবারতন্ত্র খুবই বিরল। জনগণের ভোটেই তো এরা নির্বাচিত হয় বার বার। জনগণ তো সবাই শিক্ষিত, সুনাগরিক। তাহলে কেন তারা বার বার এদেরকেই নির্বাচিত করে এদের এতসব দুর্নীতি জানা সত্ত্বেও! এই পরিবারের হাতেই শ্রীলংকার সমস্ত বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। 

এই পোর্ট সিটি করার প্ল্যান পুরোটাই চীনের। ৬৬০ একর জায়গার প্রায় অর্ধেকটা চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়ে দেয়ার প্ল্যান। ৫০ একর জায়গা চীনের সরাসরি মালিকানায় দিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও পাস হয়েছে। চীনের কাছ থেকেই ফ্ল্যাট কিনতে হবে শ্রীলংকান নাগরিকদের। এই পুরো প্রকল্প পাস হয়েছে মাহিন্দা রাজাপাকসের প্রেসিডেন্ট থাকার সময়। পরে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন এবং তাঁর ছোটভাই যখন প্রেসিডেন্ট হন, তখন কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালে বিল পাস হয় যে এখানকার চায়নিজ ডেভেলপারদের আগামী চল্লিশ বছর পর্যন্ত কোন ট্যাক্সই দিতে হবে না। 

কোভিডের কারণে এমনিতেই শ্রীলংকার অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। তাছাড়া ২০১৯ সালে কলম্বোতে ঘটে গেছে জঙ্গি আক্রমণ। পর্যটন শিল্প একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে তখন। বৈদেশিক ঋণের বোঝা টানতে টানতে সরকারি কোষাগার খালি হয়ে গেছে। জনগণ বুঝে ফেলেছে রাজাপাকসে পরিবার তাদের পথে বসিয়েছে। বিক্ষোভ শুরু হয়। এখানেই প্রেসিডেন্ট অফিসের সামনে, গার্লে ফেইস গ্রিন – খালি মাঠ ভরে উঠে বিক্ষুদ্ধ জনগণের বিক্ষোভে। এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাত মাস ধরে একটানা বিক্ষোভের পর রাজাপাকসে পরিবার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং দেশ থেকে পালিয়ে যায়। নিজের দেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা চুরি করে তারা বিদেশে কী আরাম আয়েশে জীবন কাটায়। যেসব দেশ তাদের আশ্রয় দেয় – তারা তো খুব সভ্য দেশ। তাদের একবারও মনে হয় না এটা অন্যায়? নাকি ন্যায়-অন্যায় সবকিছু শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় – যাদের টাকার জোর কম, ক্ষমতার জোর আরো কম! 

শ্রীলংকার জনগণও কিছুদিনের মধ্যেই ভুলে যাবে তাদের নেতাদের দুর্নীতির কথা। আবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে তাদেরই কোন সঙ্গীসাথীদের কিংবা তাদেরই পরিবারের কাউকে।


কাঠগোলাপের বাগান


পোর্ট সিটিতে সারিবদ্ধভাবে অনেক কাঠগোলাপের চারা লাগানো হয়েছিল। গুচ্ছ গুচ্ছ হলদে-সাদা ফুল ফুটে আছে। বড় বড় কিছু মাছি উড়ছে সেখানে। ছোট্ট একটা বিলাসী রেস্টুরেন্টও খোলা হয়েছিল একসময়। এখন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। তার পেছন দিকে সবুজ ঘাসে মোড়া লন, নারকেল গাছের ঘন ছায়া, ফিরে আসার রাস্তা। এদিক দিয়ে  ফিরে  আসার সময় দেখলাম বন্ধ দোকানের পেছনে দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে একজোড়া কিশোর-কিশোরী। সম্ভবত নতুন প্রেম – পায়ের শব্দে চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো দুজনেই, তারপর আবার ডুবে গেল নিবিড় ভালোবাসায়। পোর্ট সিটির ইতিহাস এদেরকে স্পর্শ করে না মোটেও। 


Sunday, 18 February 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর - ৬

 


বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভিড়ও বাড়তে শুরু করেছে ভারত মহাসাগরের তীরে ছোট্ট এই সবুজ চত্বরে – ইংরেজিতে ‘গার্লে ফেইস গ্রিন’ যার নাম। Galle-র উচ্চারণ এরা করে গার্লে। প্রচন্ড রোদ। তলোয়ার হাতে সিংহমূর্তির পাশে দন্ডায়মান ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের মাথায় দড়িছেঁড়া তাবুর মতো ঝুলে আছে বিশাল পতাকা। উড়বার মতো বাতাস নেই। তার দুপাশে বিশাল দুটো ওলন্দাজ কামান রোদে চকচক করছে। পৌনে চারশ বছর আগে ওলন্দাজরা যখন সিলনের দখল নিয়েছিল পর্তুগিজদের হটিয়ে তখন ওরাই এই জায়গাটি বেছে নিয়েছিল বাইরের শত্রুদের ওপর নজর রাখার জন্য। সমুদ্রের পাড়ে কোন গাছপালা লাগায়নি যেন অতিদূরের কোনো সমুদ্রযানও নজর এড়িয়ে যেতে না পারে। কামান বসিয়ে রেখেছিল শত্রুদের উপর দাগার জন্য। কিন্তু ব্রিটিশরা ডাচদের পরাজিত করেছিল অতি সহজেই। সেই কামানগুলি এখন নিস্তেজ, ইতিহাসের পুরনো সাক্ষী, পর্যটকদের ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড। 


এক চিলতে সৈকত


মাঠের বিভিন্ন জায়গায় বসে গেছে শিশুদের খেলনার দোকান। চোখে পড়ার মতো কোনো ভিড় নেই সেখানে। নিতান্তই সস্তা দামের চায়নিজ খেলনা, কিন্তু সেগুলি কেনার মতোও সামর্থ্য হয়তো নেই অনেকের। যেকোনো দেশেই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় শিকার হয় মধ্যবিত্তরা। মান বাঁচাতে গেলে তাঁদের পেটে টান পড়ে। এখানেও বোঝা যাচ্ছে সেরকমই ঘটেছে। মধ্যবিত্তের শিশুরা এখন একটি রঙিন বেলুনেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছে, খেলনা রোবট কিনে দেয়ার সামর্থ্য তাদের মা-বাবার নেই আর। 

গাড়ি চলার রাস্তা সমুদ্র থেকে অনেক উঁচুতে। মাঠ পেরিয়ে ইটের তৈরি অনেক ধাপের সিঁড়ি। রাস্তার উপর কিছু নারকেল গাছ দেখা যাচ্ছে। ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেয়ার আশায় সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। পাশ দিয়ে ভীড় করে নেমে গেল হাফপ্যান্ট টি-শার্ট পরা একদল তরুণ। বোঝাই যাচ্ছে পানিতে নামবে। 

হঠাৎ আমার সামনে উপর থেকে ছিটকে পড়লো আধলিটারের একটি পানির বোতল। উপরের দিকে তাকাতেই ছুটে এলো আরো দুই তিন বোতল। দেখলাম কয়েক সিঁড়ি সামনে ছোট্ট এক মেয়ে ব্যস্ত হয়ে বোতল ধরার চেষ্টা করছে। কুড়িয়ে নিলাম আমার হাতের নাগালে যে ক’টা ছিল। তার হাতে দিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম – প্লাস্টিকের ঠোঙায় করে নিয়ে যাচ্ছিল সে অনেকগুলি পানির বোতল। পানির ভারে ছিঁড়ে গেছে ঠোঙা। এখন কী করবে বুঝতে না পেরে বোতলগুলি সিঁড়ির ধাপে রেখে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। 

কালো হাড্ডিসার বাচ্চাটিকে দেখে কেমন যেন মায়া হলো। হয়তো পানি বিক্রি করে সে। সম্ভবত নিচের দোকান থেকে পানি নিয়ে আসছিলো উপরে এসে বিক্রি করার জন্য। তার সাথে কি আর কেউ আছে? তার সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমার কী করা উচিত বুঝে উঠার আগেই সে বিড়বিড় করে সিংহলি ভাষায় কিছু একটা বললো। পাশ দিয়ে যারা নামছিলেন, তাদের ভেতর দুজন থেমে গেলেন। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, অন্যজন তরুণ। বৃদ্ধ নিজের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন একটা পাতলা প্লাস্টিকের ঠোঙা। মেয়েটির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে হাত বাড়িয়ে ঠোঙাটি নিয়ে উবু হয়ে পায়ের কাছে রাখা পানির বোতলগুলি ঠোঙায় ভরতে শুরু করলো। আমি সিঁড়ির কয়েকধাপ উপরে উঠে তাকিয়ে দেখলাম বৃদ্ধ ভদ্রলোক ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছেন অনেক দূর। আর তরুণটি নিজের হাতে যে প্লাস্টিকের ঠোঙাটি ছিল তার ভেতর থেকে একটা পুঁটলি বের করে ঠোঙাটি মেয়েটির হাতে দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছেন। খুবই ছোট্ট একটি ঘটনা। অথচ এই সাধারণ ঘটনাটিকেই আমার কাছে অসাধারণ মনে হচ্ছে। 

রাস্তায় উঠে এলাম। বেশ বড় ফুটপাত। ফুটপাতের পাশে বেশ দূরে দূরে কয়েকটি বড় বড় নারকেল গাছ। গাছের গোড়ার চারদিকে সিমেন্ট দিয়ে বাধানো। অনেকেই বসে আছে সেখানে। আবছা ছায়ায় একটুখানি খালি জায়গায় আমিও বসলাম। 

প্রচন্ড ভীড় সামনে। রাস্তার একটা অংশ ছেড়ে দেয়া হয়েছে মোটরসাইকেল পার্ক করার জন্য। বোঝা যাচ্ছে মোটরসাইকেল এখানে খুবই জনপ্রিয় বাহন। রাস্তার এই পাশে বেশ কিছু খাবারের আউটলেট। আইসক্রিম, পিৎজা, আর নুড়ুল্‌স-এর  আলাদা-আলাদা ট্রাক। জাঁকজমকপূর্ণ পোস্টার-প্লাকার্ডে মোড়া এসব  খাদ্য-গাড়ির সামনে প্রচন্ড ভীড়। নিচে সমুদ্রের ধারের সাদামাটা দোকানের খদ্দের আর এখানকার জৌলুসপূর্ণ খাবারের ট্রাকের সামনের খদ্দেরের মধ্যে পার্থক্য সামর্থ্যের। 

গাছের ছায়ায় আরাম লাগছে। মনে হচ্ছে ছায়ার সাথে কিছুটা বাতাসও পাচ্ছি। দূরে সমুদ্রের পানিতে রোদের ঝিকিমিকি। আকাশ ঝকঝকে নীল, এখানে ওখানে ভেসে বেড়াচ্ছে কয়েক টুকরো সাদা মেঘ। বাতাস পেয়ে পুরোটাই খুলেছে পতাকার জমিন। 


শ্রীলংকার পতাকা


আমাদের পতাকার মতো সহজ-সরল নয় শ্রীলংকার পতাকা। পৃথিবীর সহজতম পতাকাগুলির মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশের পতাকা। সবচেয়ে সহজ জাপানের পতাকা, তারপরই সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্তের বাংলাদেশ। সে হিসেবে শ্রীলংকার পতাকা খুবই জটিল পতাকা। হাতে তলোয়ার নিয়ে যে হলুদ সিংহটি আছে পতাকায় তা আঁকতে বা সেলাই করতে অনেক সময় লাগবে। সাথে আরো অনেক রঙ আর ফিচার আছে পতাকায়। শ্রীলংকার পতাকায় সিংহের অবস্থান প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের অনুধারাপুরার রাজত্বকাল থেকে। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফিচারের পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সিংহ রয়ে গেছে পতাকাজুড়ে; যদিও শ্রীলংকার কোন জঙ্গলেই কোন সিংহ নেই। পতাকার সিংহ মূলত সিংহলি জনগোষ্ঠীর প্রতীক। সিংহের হাতে যে তলোয়ার – তা স্বাধীনতার প্রতীক। সিংহের লেজে আটটি চুল স্পষ্ট দেখা যায় – যা বৌদ্ধধর্মের অষ্টশীলের প্রতীক। হলুদ সিং হের ব্যাকগ্রাউন্ডের মেরুন রঙ সিংহলি জাতির রঙ। এর চারপাশে হলুদ রঙের বর্ডার বৌদ্ধধর্মের প্রতীক। বর্ডারের ভেতর চার কোণায় চারটি মন্দিরের চূড়ার প্রতীক সন্নিবিষ্ট। ১৭৯৮ থেকে ১৮১৫ পর্যন্ত এরকম পতাকা চালু ছিল। ১৮১৫ থেকে ১৮৭৫ পর্যন্ত ছিল সরাসরি ব্রিটিশ পতাকা। ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ পতাকার নীল ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর হলুদ বৃত্তের মাঝখানে একটি মন্দির ও হাতির মনোগ্রাম লাগিয়ে ব্রিটিশরা সিলন জাতির মন জয় করার চেষ্টা চালায়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা সিলন থেকে চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত এই পরিবর্তিত ব্রিটিশ পতাকাই চালু ছিল। ১৯৪৮ সালে আবার ফিরে আসে সেই ১৮১৫ সালের সিংহ-পতাকা। কিন্তু স্বাধীন সিলনে বৌদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য জাতিসত্ত্বা অধিকারসচেতন হতে শুরু করেছে। শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মের হলুদ রঙ দেশের সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই ১৯৫১ সালে পতাকার সাথে আরো দুটো রঙ যুক্ত হয়। হলুদ বর্ডারের ভেতর সবুজ রঙ যুক্ত হয় মুসলমান নাগরিকদের জন্য এবং গোলাপী রঙের আয়তক্ষেত্র যুক্ত হয় তামিল হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য। ১৯৭২ সালে সিলন ডোমিনিয়ন থেকে যখন দেশটি পুরোপুরি স্বাধীন শ্রীলংকা হয় – তখন পতাকার হ্লুদ বর্ডারের ভেতর চার কোণায় মন্দিরের চুড়ার মতো ফিচার বদলে দিয়ে তার বদলে চার কোণায় চারটি হলুদ রঙের অশ্বত্থ পাতা যোগ করে দেয়া হয় – যা বৌদ্ধধর্মের প্রতীক। দেখা যাচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও শ্রীলংকার পতাকায় বৌদ্ধধর্মীয় প্রতীক অনেক বেশি। 

রাস্তার ওপারে বিখ্যাত সাংগ্রিলা হোটেল। তার পাশে গড়ে উঠেছে বিশাল অভিজাত সুপারমার্কেট ওয়ান গার্লে ফেইস মল। ক্রিস্টমাস উপলক্ষে বিরাট মূল্যহ্রাসের ঢেউয়ে নাচছে উচ্চবিত্তরা। রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়। অনেক নতুন নতুন গাড়ি দেখা যাচ্ছে। বিএমডাব্লিউ, মার্সিডিজও আছে। এই এলাকাটি যে উচ্চবিত্তের এলাকা তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না। অবশ্য পুরো এলাকা নয় - রাস্তার ওপারের হোটেল, মার্কেট, জৌলুশ বড়লোকদের, এপারে্র সাগর সৈকত ফুটপাত – সবার। 

করোনার সময়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ। ফলে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে আশংকাজনক হারে। জিনিসপত্রের দাম গেছে বেড়ে, মুদ্রার মান গেছে কমে। শ্রীলংকা মূল্যস্ফীতি কীভাবে সামলাচ্ছে জানি না। আমি চোখের সামনে যেসব জিনিস দেখছি সেগুলির দাম ডলারে কনভার্ট করলে তো বটেই, বাংলাদেশি টাকায় রূপান্তর করলেও মনে হচ্ছে বাংলাদেশের চেয়ে সস্তা। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটলে তৃতীয় বিশ্বে ভিক্ষাবৃত্তি বেড়ে যায়। বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষাবৃত্তিকে ধর্ম পালনের অংশ বলে মনে করা হলেও এখানে কোন ভিক্ষুকের দেখা আমি এখনো পাইনি। অন্যের কাছে হাত পাতার মতো আত্মগ্লানিকর কাজ কেউ করছেন না দেখে ভালো লাগছে। 

নারকেল পাতার ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ছে জোরালো রোদ। গাছের ছায়া সরে গেছে কয়েক ফুট। আমিও সরলাম ছায়ার দিকে। সরতেই পাশে এসে বসলেন একজন। হাতে গাড়ির চাবি, মুখে নাতিদীর্ঘ দাড়ি, কানে কানের দুলের মতো লেগে আছে সাদা ইয়ার বাড। সিংহলি ভাষায় গো গো করে কথা বলছেন। আমি সব কথাই শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু একটা শব্দও বুঝতে পারছি না। 

“ইন্ডিয়ান?” 

এই শব্দটি বুঝতে পারলাম। কিন্তু বুঝতে না দেয়ার জন্য বক্তার দিকে একটুও তাকাচ্ছি না।

“হ্যালো, আর ইউ ইন্ডিয়ান?”

ফিরে তাকালাম। হাতে ফোন ছাড়া ফোনে কথা বললে ঠিক বোঝা যায় না কার সাথে কথা বলছে, সামনে যে আছে তার সাথে, নাকি ফোনের ওপ্রান্তে যে আছে তার সাথে। 

“তামিল?”

মনে হচ্ছে আমাকেই জিজ্ঞেস করছে।

“আর ইউ টকিং টু মি?” রবার্ট ডি নিরোর টোনে বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বিদেশ বিঁভুই-এ রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না ভেবে বাঙালি টোনেই জিজ্ঞেস করলাম। 

“ইয়েস। আর ইউ ইন্ডিয়ান?”

“সরি নো। ইফ ইউ আর লুকিং ফর অ্যান ইন্ডিয়ান, আই অ্যাম নট দ্যাট পার্সন।“ 

“হোয়ার ইউ ফ্রম?”

ছেলেটির ইংরেজি বেশ ভালো। বেশভুষায় বড়লোকি উপচে পড়ছে। অ্যাডিডাসের টি-শার্ট, নাইকির জুতা। হাফপ্যান্টের ব্রান্ড দেখা যাচ্ছে না। তার তো রাস্তার ওপারে থাকার কথা। এখানে ফুটপাতের গাছতলায় এসে কেন বসেছে কে জানে। চুপ করে থাকতে পারে না বলেই হয়তো কথা বলতে চাচ্ছে। বললাম, “বাংলাদেশ। কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

“এমনিই। আমি ভেবেছিলাম আপনি শ্রীলংকান। তাই তো সিংহলি বলছিলাম।“

“আপনি কি শুরু থেকেই আমার সাথে কথা বলছিলেন?”

“হ্যাঁ”

“কী জিজ্ঞেস করছিলেন?”

“এখানে আমার এক ফ্রেন্ডের আসার কথা। তাকে দেখেছেন কিনা জানতে চাইছিলাম।“

“ফ্রেন্ডের ফোন নেই?”

“ফোন আছে। চার্জ নেই।“

ছেলেটি অস্থির। একবার বসছে, একবার উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে জিমে যাবার বদলে এখানে চলে আসতে হয়েছে বলে রুটিন উঠবস এখানেই করে নিচ্ছে। 

“এখানে বেড়াতে, নাকি কাজে?” সময় কাটানোর জন্য প্রশ্ন করছে ছেলেটি। উত্তর না দিলেও চলে। 

সামনেই ফুটপাতের এক ধারে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের টুলে বসে ডাব বিক্রি করছেন একজন বৃদ্ধ। মুখে খোচা খোচা সাদা দাড়ি। মাথাভর্তি টাক। তামিল সুপারস্টার রজনীকান্তের আসল চেহারার মতো চেহারা। একটু পর পর অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে বলছেন, “থাম্বুলি, থাম্বুলি।”

“হোয়াট ইজ থাম্বুলি?” আমিও স্বগতোক্তির মতোই মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলাম। কানে ইয়ার বাড থাকা সত্ত্বেও শুনতে পেলো যুবক। উত্তর দিলো, “কোকোনাট। গুড ফর হেল্‌থ। বেটার দ্যান ওয়াটার। পিওর। বেস্ট কোকোনাট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।“

ওয়ার্ল্ডের বেস্ট কোকোনাট একটু আগে একটা খেয়েছি, আরেকটি খাবো কি না ভাবছি। আধলিটার পানির একটি বোতলের দাম আর একটি ডাবের দাম সমান। পানির দামে বিকোচ্ছে বলে কি পানির বদলে ডাব খেলে চলবে? দিনে কয়টা ডাব খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত? বেশি খেলে আবার পটাশিয়াম বেড়ে গিয়ে ঝামেলা বাড়াবে না তো? 

অস্থির যুবক হঠাৎ হাত তুলে চিৎকার করে লাফাতে শুরু করলো। তার চার্জ-চলে-যাওয়া ফ্রেন্ডকে দেখতে পেয়েছে হয়তো। আমিও উঠে হাঁটতে শুরু করলাম প্রেসিডেন্টের অফিসের দিকে। 


দারুচিনি দ্বীপের ভিতর - ৫

 


ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কয়ারের আর্কেড শপিংমলে ঢুকে মনেই হলো না যে অর্থনৈতিক একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে শ্রীলংকায় মাত্র কিছুদিন আগে। দোকানে জিনিসপত্র কিংবা ক্রেতা – কোনটিরই কোন অভাব দেখা যাচ্ছে না। অনেক জায়গা নিয়ে ব্রিটিশদের তৈরি করা উঁচু দোতলা দালানগুলি দেখলেই বোঝা যায় এখানে সরকারি কোন দপ্তর ছিল আগে। সেই দপ্তর অন্য কোথাও সরে গিয়ে এখন সেগুলি রূপান্তরিত হয়েছে আধুনিক বিপনিবিতানে। দোকানপাট দেখে মনে হচ্ছে বড়লোকদের পাড়া। বার্গার কিং, ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি এসব আমেরিকান চেইন এখানেও রাজত্ব করছে বিশাল প্রতিপত্তি নিয়ে। রাষ্ট্রের নামের ভেতর যে সমাজতান্ত্রিক শব্দটি আছে তা ধনতন্ত্রের চাপে পড়ে শব্দেই বন্দী হয়ে আছে। বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের এখন যে হাল, শ্রীলংকার আর দোষ কী।

আর্কেড থেকে বের হয়েই রাস্তা। নামফলকের ইংরেজি থেকে সরাসরি উচ্চারণে রাস্তার নাম দাঁড়ায় বৌদ্ধলোক মাওয়াথা কিংবা মাওয়াধা। সরু সংক্ষিপ্ত রাস্তাকে এরা মাওয়াথা বলে। রোড, এভিনিউ, স্ট্রিট ইত্যাদির পাশাপাশি এখানে অনেক রাস্তার নামের শেষে মাওয়াথা আছে। সে হিসেবে বৌদ্ধলোক রাস্তাটি সরু এবং সংক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এটা বিশাল বড় রাস্তা। এটা ধরে কিছুদূর হেঁটেই পৌঁছে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। 


ইউনিভার্সিটি অব কলম্বো


কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ম্যানেজমেন্ট আর ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন এর সাইনবোর্ড প্রায় পাশাপাশি। তাদের সামনে রাস্তার অন্যদিকে আরেকটি ছোট্ট বিশ্ববিদ্যালয় – বুড্ডিস্ট অ্যান্ড পালি ইউনিভার্সিটি অব শ্রীলংকা। 

সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে। অস্ট্রেলিয়ায় যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ পেলাম না। ছুটির দিন বলে সবগুলি গেটই বন্ধ। রাস্তা থেকে বিভিন্ন ভবনের কিছু অংশ আর গেটে গেটে বিভিন্ন অনুষদের সাইনবোর্ড দেখা ছাড়া ভেতরে ঢোকার কোন সুযোগ নেই আজ। ক্যাম্পাসের চারপাশের রাস্তায় হেঁটে দেখলাম যতটুকু দেখা যায়। 


শতবর্ষ উদ্‌যাপনের বিজ্ঞাপন


কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি গেটে এখনো বড় বড় সাইনবোর্ডে শতবর্ষ উদ্‌যাপনের চিহ্ন। ১৯২১ থেকে ২০২১। এখানে সব সাইনবোর্ডেই সিংহলি, তামিল আর ইংরেজিতে লেখা থাকে। কিন্তু কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল মনোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ লেখা আছে সংস্কৃতে। হাইস্কুলের ক্লাস সেভেন-এইটে যে সংস্কৃত পড়েছিলাম – তাতে লেখাটা যে সংস্কৃত তা চিনতে পারছি, কিন্তু পড়তে পারছি না। গুগলের কৃপায় জানা গেল – সেখানে লেখা আছে “বুদ্ধি সর্বত্র ভ্রজতে”। জ্ঞানের কদর সব জায়গায় – এরকম কিছু একটা অর্থ হবে। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগোতে এরকম ভালো ভালো কথা লিখে রাখতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কথাগুলি শুধু লোগোতেই লেগে থাকে। 

জাতিগঠনে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব যে জাতি যত ভালোভাবে বুঝেছে তারা তত উন্নতি করেছে। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে অনেকগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। ইউনিভার্সিটি অব কলম্বো ছিল তাদেরই একটি। ১৯২১ সালে এই ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু। কিন্তু তারও অনেক বছর আগে ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিলন মেডিক্যাল স্কুল। ধরতে গেলে তাকে কেন্দ্র করে পরে গড়ে উঠেছে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু গত একশ বছরে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রসারিত হয়েছে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞাপনে এরা উপমহাদেশের প্রথম দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বলে দাবি করছে নিজেদের। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে করছে জানি না। ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং-এ শ্রীলংকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের প্রথম এক হাজারের মধ্যে নেই। 

একটি গেটে লেখা আছে পলিথিনমুক্ত এলাকা। কিন্তু তার সামনেই ফুটপাতে পলিথিনের ঠোঙায় বিক্রি হচ্ছে পিঠাজাতীয় নানারকমের খাবার। তবে খেয়াল করে দেখলাম – লোকজন খাবার খেয়ে ময়লা পলিথিন নির্দিষ্ট বিনেই ফেলছে। এদিক থেকে এরা নিসন্দেহে ভারত কিংবা বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে এগিয়ে। এই শিক্ষাটা এরা জাতিকে কীভাবে দিয়েছে তা ভাবার বিষয়। 

ব্রিটিশরা চলে যাবার পর কিছু কিছু রাস্তা বা জায়গার নাম এরা পরিবর্তন করলেও এখনো শহরের অনেক রাস্তার আগের নামই রয়ে গেছে – আলফ্রেড হাউজ এভিনিউ, এডোয়ার্ড লেন, কুইনস রোড, আলফ্রেড প্লেস - এসব রাস্তা পার হয়ে এলাম গালে রোডে। কলম্বো শহরের প্রধান সড়কগুলির একটি। আধুনিক ব্যস্ত শহরগুলির মতোই আধুনিক ট্রাফিক সিস্টেম। সড়কবাতির নির্দেশ মেনে চলছে সবাই। পথচারি পারাপারে তেমন কোন সমস্যা দেখলাম না। 

একটু পর পর যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে সেটা হলো বিদেশে পড়তে যাবার এজেন্টের বিজ্ঞাপন। কত কম খরচে কত সহজে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এরা। এদের পাল্লায় পড়ে কতজন যে কতভাবে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তার খবর কে রাখে। সরকারি হিসেবে বেকারত্বের হার পাঁচ শতাংশের নিচে। তবুও শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কেন দেশ ছাড়তে চায়? অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য বেশিক্ষণ ভাবতে হয় না। পঁচিশ বছর আগে আমি কী কারণে দেশ ছেড়েছিলাম? এই পঁচিশ বছরে সেই কারণটা নিশ্চয় আরো অনেকগুণে বেড়েছে। এখানে যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, ঢাকা শহরে ঘুরলে হয়তো এর দশগুণ বেশি দেখতে পাবো।  

তৃতীয় বিশ্বের রাজধানী শহরে আমেরিকান দূতাবাসের চেহারা সবসময়েই চকচক করে। এখানে গালে রোডের সাথে লাগানো বিশাল এলাকা জুড়ে আমেরিকান দূতাবাস। দূতাবাস না বলে দুর্গ বললেই বেশি অর্থবোধক হবে। সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনির যতজন সদস্য এখানে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টের বাসভবনেও ততজন পাহারাদার নেই। দেয়ালে খুঁটিতে যেদিকেই তাকাই সিসি ক্যামেরা চোখে পড়ছে। এখানকার রাস্তা দিয়ে যারাই হেঁটে যায়, সবাইকেই সম্ভবত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারা। আমেরিকা এক আশ্চর্য দেশ। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সবাই তাদের গালি দেয়। যারা বেশি গালি দেয়, তারাই আবার বেশি পাগল তাদের দেশে যাবার জন্য। 

অনেকগুলি বড় বড় হোটেল এই রাস্তার আশেপাশে। ট্যুরিজম অথরিটির বিশাল ভবনের সামনে রাস্তার ওপাড়ে সিনামন গ্রান্ড হোটেল। বেশ কয়েকটি সিনামন হোটেল আছে কলম্বোতে। আমি যেটাতে উঠেছি – সেটা সিনামন রেড। সেটার তুলনায় সিনামন গ্রান্ডের তারকা সংখ্যা বেশি, কিন্তু উচ্চতা কম। সিনামন গ্রান্ডে ঢোকার মুখে নিরাপত্তা তল্লাশীর বাহুল্য দেখে বোঝা যায় চার বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ আক্রমণের পর থেকেই এ অবস্থা হয়েছে। 

২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের দিন সিনামন গ্রান্ডসহ কলম্বোর তিনটি হোটেল আর তিনটি গীর্জায় হামলা চালিয়েছিল আইসিস সমর্থক জঙ্গিরা। মূল উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব বিদেশী পর্যটককে হত্যা করা। মোট ২৬৯ জন নিরস্ত্র পর্যটককে খুন করেছিল তারা বোমা হামলা করে। মানুষ খুন করা কীভাবে ধর্ম পালনের অংশ হয় আমি জানি না। এই ঘটনার এক বছর পরেই কোভিড এসে আরো লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল শ্রীলংকার পর্যটন শিল্প। গত বছর থেকে তারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বড় বড় হোটেলগুলি এখন খ্রিস্টমাসের জন্য সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেছে। 

ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট অথরিটির বহুতল ভবনের পর একতলা একটি নতুন ভবনে পর্যটকদের জন্য তথ্যকেন্দ্র। রাস্তার পাশের বড় কাচের দরজা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করলাম। দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবার কথা। কিন্তু ধাক্কাধাক্কি করেও খোলা গেল না। ভেতরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শনিবার তো দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা। এখনো দুটোও বাজেনি। অন্য কোন দরজা কি আছে? দেখলাম রাস্তা থেকে ভেতরের দিকে আরেকটি দরজা আছে। ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। খোলার কোন লক্ষণ নেই। সরকারি অফিস বলেই কি এ অবস্থা? চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াবার পর মনে হলো দরজা খুলছে। দেখলাম ছোট্ট একটা মেয়ে ভেতর থেকে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে দিল। চায়নিজদের মতো শ্রীলংকান মেয়েদেরও বয়স বোঝা যায় না। এখানে যখন চাকরি করছে বয়স নিশ্চয় আঠারোর উপরে। ভেতরে কনকনে ঠান্ডা। এই গরমে অনেক মানুষই এখানে এসে বসে আরাম করতে পারতো। কিন্তু কেউ নেই। সবাই সম্ভবত দরজা বন্ধ দেখে চলে গেছে। আমি আসাতে মেয়েটি বিরক্ত হয়েছে কি না বুঝতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার মুখে ভাবলেশ নেই। সে দুই হাতে তার শরীরের তুলনায় দীর্ঘ চুল সামলাতে ব্যস্ত। 

ভেতরের দেয়ালজুড়ে শ্রীলংকার ট্যুরিস্ট ম্যাপ, আর বিভিন্ন এলাকার সুন্দর সব ছবি। কলম্বোর একটি ম্যাপ চেয়ে নিলাম। বিভিন্ন স্পটের বুকলেট আশা করেছিলাম। নেই। আমি এটা ওটা জিজ্ঞেস করেও তেমন কোন উত্তর পেলাম না। এমন নিরুৎসাহী মানুষ কীভাবে এরকম একটা পর্যটন তথ্যকেন্দ্রে চাকরি পেলো জানি না। অবশ্য আজকাল পর্যটকরা এসব তথ্যকেন্দ্রের চেয়ে ইন্টারনেটের উপরই বেশি ভরসা করে। 

“সরি ফর ডিস্টার্বিং ইউ” – বলে বের হয়ে আসার সময়ও আশা করেছিলাম মেয়েটি অন্তত বলবে যে সে ডিস্টার্বড হয়নি, ওটাই তার কাজ। কিন্তু সে কিছু না বলে দরজায় আবার তালা লাগিয়ে দিল। আরো দুঘন্টা ভেতরে বসে থেকে তারপর বাড়ি চলে যাবে। খুবই মজার চাকরি। 

এক ব্লক পরেই ছোট্ট একটা ব্রিজ। নিচ দিয়ে ঝমঝম করে একটি লোকাল ট্রেন চলে গেল। মাত্র তিনটি বগির ছোট্ট ট্রেন। ব্রিজ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রেললাইনের অবস্থা দেখে ভীষণ হতাশ হলাম। শ্রীলংকার ট্যুরিস্টদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ থাকে এখানকার ট্রেনে চড়া। এই বিখ্যাত ট্রেন-সাম্রাজ্যের লাইনগুলির সংস্কার হয় না কত বছর জানি না। এরা যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থসংকটে ভুগছে তা দৈনন্দিন বেচাকেনায় বোঝা না গেলেও রাষ্ট্রের বড় বড় অবকাঠামোগুলি দেখলে বোঝা যায়। 

ব্রিজ পার হয়েই ভারতীয় হাইকমিশন। আমেরিকানদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয় এরা এখানে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতকে একটু তোয়াজ করেই চলে শ্রীলংকা। শ্রীলংকায় ভারতের ইনভেস্টমেন্ট অনেক। তাছাড়াও শ্রীলংকায় সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে ভারত থেকে। শ্রীলংকার মোট পর্যটকের শতকরা প্রায় আঠারো ভাগ ভারতীয় পর্যটক। শ্রীলংকান তামিলদের নিয়ে ভারতের সাথে টানাপোড়েনও ছিল অনেক, এখন হয়তো কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। 

ভারতীয় হাই কমিশনের সামনের ফুটপাত আমেরিকান দূতাবাসের সামনের ফুটপাতের মতো অতটা চওড়া নয়। প্রহরীদের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের কাঁধে ঝোলানো অস্ত্র গায়ে লেগে যাবার সম্ভাবনা বাঁচিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত হাঁটছি। এমন সময় “ডু ইউ স্পিক ইংলিশ?” শুনে থমকে দাঁড়ালাম। নির্ভেজাল ব্রিটিশ উচ্চারণ, হাতে ঢাউস ট্রলিব্যাগ, পিঠে তার চেয়েও বড় ব্যাকপ্যাক। এত জিনিসপত্রের ভীড়ে চিকন গৌর মুখখানি চোখে পড়তে কয়েক সেকেন্ড লাগলো। 

বললাম, “ইয়েস, আই ডু”

“এদিকে ব্যাগেজ রাখার লকার কোথায় আছে বলতে পারো?”

লকারে লাগেজ রেখে হালকা ভাবে শহর ঘুরে বেড়ানো যায়। ট্যুরিস্টবান্ধব এই শহরে লকারের ব্যবস্থা নিশ্চয় কোথাও আছে। কিন্তু আমার এখনো চোখে পড়েনি। বললাম, “সরি ম্যাম, আমি ঠিক জানি না। রেলস্টেশনে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তো বেশ দূরে এখান থেকে। আপনি সামনের এই হোটেলে দেখতে পারেন, যদি তাদের থাকে।“ সামনের ঐতিহাসিক গালে ফেস হোটেলের দিকে আঙুল তুলে দেখালাম। 

ভদ্রমহিলা শুকনো একটা থ্যাংক ইউ বললেন, কিন্তু মনে হলো খুব একটা খুশি হলেন না। হোটেলেও উঠছেন না, কিন্তু একা এতগুলি ব্যাগ তিনি কেন এনেছেন কে জানে। ট্রাভেল লাইট ট্রাভেল মোর কথাটি কি তিনি শোনেননি? 

যাই হোক, হাই কমিশনের সামনে এভাবে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে দুজন নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে এলো তার দিকে। আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। 


গার্লে ফেইস হোটেল


 গালে ফেস হোটেলটি একেবারে সমুদ্রের সাথে লাগানো। অনেক পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী এই হোটেল। মহাত্মা গান্ধী কলম্বোতে এসেছিলেন যখন, এই হোটেলেই ছিলেন। লাল টেরাকোটার ছাউনি হলুদ রঙের চারতলা দালান। মূল সড়ক থেকে অনেকটাই ভেতরে এবং নিচে সাগরের দিকে। সামনে বেশ বড় পার্কিং লট। এবং তারও সামনে সাগর ঘেঁষে বিশাল সবুজ চত্বর। কলম্বো শহরের প্রাণকেন্দ্রের সাগর আর শহর মিশেছে এখানে। 

ঝকঝকে গা ঝলসানো গরম রোদ। সাগরের কিনার ঘেঁষে বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার এক পাশে সারি সারি অস্থায়ী দোকান, বেশিরভাগই খাবারের। চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছসহ নানারকম তেলেভাজার দোকান। আইসক্রিম, সফ্‌ট ড্রিংকসের দোকানও আছে। এই গরমেও লোকে গমগম করছে। ডাব বিক্রি করছে অনেকে। সবুজের বদলে বেশিরভাগ ডাবই কেমন যেন হলুদ রঙের। এক বৃদ্ধার কাছ থেকে একটা ডাব কিনে খেলাম। দেড় শ রুপি। অনেক পানি। কিন্তু কেমন যেন নিস্তেজ স্বাদ। 


গার্লে ফেইস গ্রিন


এত বড় সাগর সামনে, অথচ সৈকত নেই এখানে। খুব সামান্য এক চিলতে বালির রেখা আছে – সেখানেই দাপাদাপি করছে অনেকে। একটা পাকা ব্রিজ আছে, পাড় থেকে চলে গেছে পানির উপর কিছুদূর। সেখানে অস্বাভাবিক ভীড়। যতটা নিজের চোখে দেখছে, তার চেয়ে বেশি দেখছে ক্যামেরার চোখে। ছবি তুলে পোস্ট করার উদ্দেশ্যেই এখন ঘুরে বেড়ায় অনেকে। অনেকে নাকি ভ্রমণের খরচ তুলে ফেলে ছবি আর ভিডিও পোস্ট করতে করতে।


প্রেমের ছত্রতল


অস্থায়ী দোকানগুলির সাথে বেশ কিছু স্থায়ী দোকানও আছে। সেগুলি অনেকটা গুহার ভেতর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। সেখানে গুহার ভিতর তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীর ভিড়। তাদের আচরণে পারস্পরিক ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে। ছাতার আড়ালে প্রেম এখানে খুবই সাধারণ একটি দৃশ্য। কেউই তাদেরকে বাধা দিচ্ছে না। শ্রীলংকা শুনেছি আমাদের মতোই রক্ষণশীল জাতি। কিন্তু এখন ক্রমশ উদার হচ্ছে মনে হচ্ছে। অথবা হতে পারে এটি শুধুমাত্র শহুরে উদারতা। 


দারুচিনি দ্বীপের ভিতর ৪

 


এখনো দুপুর হয়নি, অথচ মাথার উপর সূর্য গনগন করছে। প্রচন্ড রোদে ধাতব বৌদ্ধমূর্তি থেকে গরম বের হচ্ছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে এলাম গাছের নিচে। এখানে ছায়া আছে, কিন্তু বাতাসে আরামের পরশ নেই। গাছের ছায়ায় মানুষের ভীড়। ছুটির দিন, অনেকেই ফ্যামিলি আউটিং-এ বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে পার্কে। বত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে তারা পাত্তাই দিচ্ছে না। 

অসংখ্য বিদেশী ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। সার্কভুক্ত দেশগুলির নাগরিকদের আলাদা করে চেনা না গেলেও শ্বেতাঙ্গদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শ্রীলংকান ট্যুরিজম গত এক বছরে তুঙ্গে উঠে গেছে। কোভিডের সময় প্রায় দুবছর পর্যটকশূন্য হয়ে তাদের অর্থনীতির অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন দ্রুত চাঙ্গা হয়ে গেছে সব। এই ২০২৩ সালেই শ্রীলংকার পর্যটন খাতে আয় বেড়ে গেছে শতকরা প্রায় আশি ভাগ। এক বছরে একশ আশি কোটি ডলার আয় হয়েছে তাদের শুধুমাত্র পর্যটন খাতে। তার প্রমাণ চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। 

এদিকে ইট বিছানো পথে গাছের ছায়া পড়েছে। সামনেই রানি বিহারা মহাদেবীর মূর্তি। কী পাথর দিয়ে বানানো জানি না, কেমন যেন গোলাপী দেখাচ্ছে। তার সামনে দুজন স্বল্পবসনা অল্পবয়সী শ্বেতাঙ্গিনী দাঁড়িয়ে একজন স্থূলবপু মধ্যবয়সী শ্রীলংকান ট্যুর গাইডের ধারাবিবরণী শুনছে। আশেপাশে লোকের অভাব নেই। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেকেই। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমিও শুনলাম গাইডের বর্ণনা। তার ইংরেজি উচ্চারণ চমৎকার। শ্রীলংকানদের ইংরেজির একটা আলাদা টান আছে যা ভারতীয়দের ইংরেজি উচ্চারণ থেকে আলাদা।

স্থানীয় শ্রীলংকানদের যে ব্যাপারটা ভালো লাগছে খুব – সেটা হলো পর্যটকদের সাথে তারা কোন ধরনের হ্যাংলামি করছে না। এই গরমে বিদেশী মেয়েদের পোশাক যতই শিথিল আর সংক্ষিপ্ত হোক না কেন, তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে কেউ তাকিয়ে থাকছে না। পার্কে হকার আছে অনেক, কিন্তু কেউই কোন জিনিস কেনার জন্য বিরক্ত করছে না কাউকে। 

বিহারা মহাদেবীর মূর্তি দেখে মনেই হয় না যে প্রাচীন শ্রীলংকার একজন রানি ছিলেন তিনি। অতিসাধারণ শাড়ি, খালি পা, বিষন্নমুখে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চেহারার সাথে প্রচলিত বুদ্ধমূর্তির চেহারার ভীষণ মিল। যে বেদির উপর তিনি দাঁড়িয়ে আছেন – সেই বেদির পাথরে কয়েকটি ঢেউ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। হয়তো এভাবেই তিনি সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলেন এই দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব সৈকতে খ্রিস্টের জন্মের একশ ষাট বছর আগে। গাইড বলছিলেন - তাঁকে ঘিরে খুব চমকপ্রদ কাহিনি প্রচলিত আছে শ্রীলংকায়। কাহিনির শুরু কেলানিয়া রাজ্য থেকে। 

কেলানিয়া রাজ্যের রাজা ছিলেন কেলানি টিসা। ধর্মপ্রাণ প্রজাবৎসল রাজা স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে সুখে রাজকার্য সম্পাদন করছিলেন। রাজার ছোটভাই উত্তিয়াও রাজপ্রাসাদে থাকতেন। উত্তিয়ার সাথে রানির একটি গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন রাজা জেনে যান এই সম্পর্কের কথা। রানি রাজাকে বলেন উত্তিয়াই জোর করেছেন। রাজা উত্তিয়াকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেন। আদেশ দেন রাজ্য ছেড়ে চলে যাবার। উত্তিয়া তাই করেন। কিন্তু গোপনে রানির সাথে দেখা করার প্ল্যান করেন। কিন্তু প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করা অসম্ভব। 

রাজাকে ধর্মতত্ত্ব শেখানোর জন্য রাজপ্রাসাদেই থাকতেন একজন জ্ঞানী ভিক্ষু। ভিক্ষুর সাথে থাকতেন আরো কয়েকজন শ্রমণ। প্রতিদিন সকালে তাঁরা রাজার ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট করতেন। রাজা-রানি-রাজকন্যা নিজেদের হাতে তাঁদের পাতে খাবার তুলে দিতেন। প্রাসাদে থাকার সময় উত্তিয়াও এই ভিক্ষুর কাছে জ্ঞানলাভ করেছেন। ভিক্ষুর হাতের লেখা তিনি নকল করতে পারতেন। উত্তিয়া রাজার চোখ এড়িয়ে রানিকে একটি চিঠি দেয়ার পরিকল্পনা করলেন। তিনি ভিক্ষুর হাতের লেখা নকল করে রানিকে একটি চিঠি লিখলেন। নিজের একজন লোককে শ্রমণের পোশাক পরিয়ে তার হাতে চিঠিটি দিয়ে ভিক্ষুর দলে ভিড়িয়ে দিলেন সকালে রাজার ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে যেন রানির হাতে চিঠিটি দিতে পারে। 

পরিকল্পনা মতো শ্রমণবেশী লোকটি চিঠিটি রানির হাতে দিতে গিয়ে রাজার হাতে ধরা পড়ে। রাজা চিঠি খুলে দেখে ওটা ভিক্ষুর হাতের লেখা। বৌদ্ধসন্নাসী ভিক্ষু কি না রানিকে গোপনে দেখা করার জন্য লিখছে! এরপর যা হবার তাই হলো। ভিক্ষু যতই বলেন এই কাজ তার নয়, রাজা ততই রেগে যান। রাজরোষে পড়লে রক্ষা নেই কারো – সে এখনই হোক কিংবা খ্রিস্টের জন্মের শত বছর আগেই হোক। রাজা আদেশ দিলেন শ্রমণকে ফাঁসিতে চড়ানো হোক।  যে রাজা এত বছর ধরে বৌদ্ধধর্মের অহিংসার শিক্ষা নিয়েছিলেন, তিনি আদেশ দিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু ভিক্ষুকে একটা বড় পাত্রে ভরে গরম তেলে ভাজা হোক। তাই হলো। রাজপ্রাসাদের বাইরে অসংখ্য মানুষের সামনে বিশাল কড়াইতে তেল গরম করে সেই তেলে জীবন্ত ভিক্ষুকে ভাজা হলো। আর মানুষ – যুগে যুগে যা করে থাকেন – দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিংস্রতা উপভোগ করেন। 

এরপর অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। সমুদ্র ফুঁসে উঠলো। প্রচন্ড প্লাবনে ডুবে যেতে লাগলো নগর, রাজ্য, রাজপ্রাসাদ। সবাই বলতে লাগলো রাজা দুজন নিরপরাধকে শাস্তি দিয়েছেন – তাই সমুদ্র ক্ষেপে উঠেছে। এখন সমুদ্রকে শান্ত করতে হলে রাজাকে তার কোন আপনজনকে সমুদ্রে বিসর্জন দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাসের অবস্থা। নিজে বাঁচলে বাপের নাম হিসেব করে রাজা তাঁর মেয়েকে একটি বড় ড্রামে ভরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলেন। সমুদ্র শান্ত হলো।

এদিকে সেই ড্রামটি ভাসতে ভাসতে শ্রীলংকার দক্ষিণ দিকে রাজা কাবান টিসার রাজ্যে গিয়ে ভিড়লো। পাত্র থেকে অপরূপা মেয়েকে বের হতে দেখে তাকে রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সব কথা শোনার পর সেই মেয়েটিকে রাজা বিয়ে করলেন। লংকা বিহারের কাছের সমুদ্রে পাওয়া গিয়েছিল বলে তাঁর নাম হলো রানি বিহারা মহাদেবী। এখন পার্কের এক কোণায় মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। 

সামনে ঘাসের লন পেরিয়ে পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় খোলা মঞ্চ। রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় এখানে। তার ঠিক অন্যদিকে পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় কলম্বো পাবলিক লাইব্রেরি। তিন তলা পুরনো বিল্ডিং। শনিবার দুপুর একটা পর্যন্ত খোলা থাকলেও কার্ড ছাড়া ঢুকতে দেয় না লাইব্রেরিতে। 

পাবলিক লাইব্রেরির সামনের রাস্তা গ্রিন পাথ পেরিয়ে শ্রীলংকা টেনিস এসোসিয়েশানের বিল্ডিং বামে রেখে একটু হাঁটলেই কলম্বো ন্যাশনাল মিউজিয়াম। বিশাল দোতলা ধবধবে সাদা বিল্ডিং দেখেই বোঝা যায় এটা ব্রিটিশ আমলের তৈরি বিল্ডিং। নিতান্ত বাধ্য না হলে গতানুগতিক মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকে পুরনো যুগের জিনিসপত্র দেখতে খুব একটা ভালো লাগে না আমার। এখানেও ঢুকলাম না। 

মিউজিয়ামের কাছেই ইউনিভার্সিটি অব ভিজুয়াল অ্যান্ড পারফর্মিং আর্টস। তার সামনে ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি। পাথরের দুটো সাদা সিংহ আর্ট গ্যালারির গেট পাহারা দিচ্ছে। ধরতে গেলে মানুষ-জন নেই এদিকে। আর্ট গ্যালারির কাছের রাস্তাটির নাম নিলুম পোকুনা ড্রাইভ। এখানেই তৈরি হয়েছে কলম্বোর সবচেয়ে আধুনিক থিয়েটার নিলুম পোকুনা থিয়েটার। নিলুম পোকুনা আক্ষরিক অনুবাদ হবে পদ্মপুকুর। পদ্মের পাপড়ির আকারে তৈরি হয়েছে এই থিয়েটারের বাইরের ধাতব কাঠামো। মহিন্দ রাজাপাকসে এই থিয়েটার তৈরি করান যখন তিনি শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন (২০০৫ থেকে ২০১৫)। শ্রীলংকার পারফর্মিং আর্ট অনেক সমৃদ্ধ। তাদের লোকসংস্কৃতির সাথে দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির কিছুটা মিল আছে বলে মনে হয়। 

নিলুম পোকুনা ড্রাইভ মিশেছে যে বাঁকা চাঁদের মতো রাস্তায় – তার নাম অ্যালবার্ট ক্রিসেন্ট। বেশ চওড়া ব্যস্ত রাস্তা। এখান থেকে সোজা রাস্তা ইন্ডিপেন্ডেন্স এভেনিউ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বাম পাশে বিশাল ক্রিকেট গ্রাউন্ড। উঠতি ক্রিকেটাররা প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলছে সেখানে। কোন দর্শক নেই। এদিকে দোকানপাট নেই বললেই চলে। মাঠ পেরোতেই ক্রিড়া কমপ্লেক্স। শ্রীলংকা বাংলাদেশের মতোই ক্রিকেটপ্রিয় জাতি। ক্রিকেট ছাড়া অন্যান্য অন্যান্য খেলার ফেডারেশানের অফিসগুলিও এখানে। ক্যারম ফেডারেশান দেখলাম। ক্যারম খেলার কি কোন টুর্নামেন্ট হয়? 

ইন্ডিপেন্ডেন্স এভিনিউ আমাকে নিয়ে এলো ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কোয়ারে – শ্রীলংকার স্বাধীনতা চত্বর। স্বাধীনতার স্মারকস্তম্ভ সমৃদ্ধ একটি বড় ছাউনি আর তার সামনে ডি এস সেনানায়কের বিশাল মূর্তি। ডন স্টিফেন সেনানায়ক ছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রীলংকার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে শ্রীলংকার জাতির জনকও বলা হয়। 

স্বাধীনতা চত্বরে দুজন নিরস্ত্র বৃদ্ধ প্রহরী ছাড়া আর কেউ নেই। বাইরে প্রখর রোদ হলেও এই চত্বরের মসৃণ পাথরের মেঝেতে আরামদায়ক ঠান্ডা। কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নিলাম। এই চত্বরের নিচের তলায় অনেকটা ভূগর্ভে স্বাধীনতা জাদুঘর। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতে যেভাবে স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, আন্দোলন হয়েছে কখনো সশস্ত্র, কখনো অহিংস – সেরকম কিছু সেই সময়ের সিলনে হয়েছে বলে শুনিনি কোনদিন। কেমন ছিল শ্রীলংকার স্বাধীনতার আন্দোলন জানার কৌতূহলে ঢুকলাম জাদুঘরের ভেতর। 


জাদুঘরের প্রবেশপথ


ছোট্ট একটা প্যাসেজ। দেয়ালের পাশে লাগানো একটি ছোট্ট টেবিল-চেয়ার। চেয়ারে কেউ নেই। টেবিলের সাথে একটি বড় পোস্টারে লেখা আছে স্বাধীনতা জাদুঘরে প্রবেশমূল্য। স্বদেশীদের জন্য দশ রুপি, আর বিদেশীদের জন্য পাঁচ শ রুপি। কিন্তু কাউকেই তো দেখছি না। 

“হ্যালো, এনিবডি হিয়ার?” 

কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। প্রচন্ড গরম। মিউজিয়ামের ভেতর – তা যদি হয় মাটির নিচে যেখানে বাতাস ঢোকে না – সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে তাপ নিয়ন্ত্রণের যে কোনো ব্যবস্থাই নেই তা স্পষ্ট। হয়তো সেকারণেই কেউ নেই। কিন্তু একজন গার্ড তো অন্তত থাকবে। 

করিডোর ধরে আরেকটু ভেতরে ঢুকলাম। বাম পাশে একটি ছোট্ট রুমের জানালা দিয়ে দেখলাম টিকেট কাউন্টার লেখা কাউন্টারের টেবিলে পলিথিনের ব্যাগ থেকে ভাত খাচ্ছেন একজন লোক। লাঞ্চ টাইমে এসে বিরক্ত করছি ভেবে একটু সংকোচ হচ্ছে। 

“জাদুঘর কি খোলা?”

তিনি মুখভর্তি ভাত নিয়ে গা-গোঁ করতে করতে কিছু একটা বললেন। 

“একটু কি স্পষ্ট করে বলা যাবে যা বললেন?”

হাতের আঙুলে লেগে থাকা ঝোল্ভাত চাটতে চাটতে তিনি যা বললেন তার একটা শব্দও আমি বুঝতে পারলাম না। 

“সরি, আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইউ সেইং”

লোকটি চেয়ার থেকে উঠে রুমের ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। প্রচন্ড গরমে আমি দরদর করে ঘামছি। কাউন্টারের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম রুমের ভেতরে আরেকটি রুম আছে। একটু পর সেখান থেকে বের হয়ে এলো একটি কম বয়সী ছেলে। 

“ফাইভ হান্ড্রেড রুপিজ” – গলার স্বর রুক্ষ।

আমি এক হাজার রুপির একটি নোট তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে নোটটি হাতে নিয়ে “ওকে, গো দিস ওয়ে” বলে করিডোরের অন্যদিকে হাত দেখালো। টিকেট আর পাঁচ শ টাকা ফেরত কোনটাই দেবার ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ বা ইচ্ছে নেই। 

“আর পাঁচ শ রুপি ফেরত দেবেন না?”

মনে হলো নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে পকেটে হাত দিয়ে এক তাড়া নোট বের করে একটা পাঁচ শ রুপির নোট ফেরত দিলো আমাকে।

“টিকেট?”

“লাগবে না।“

টাকা নিয়ে টিকেট না দেয়ার অর্থ হলো সেই টাকা সরকারের তহবিলে জমা না দিয়ে নিজের পকেটে ঢোকানো। এরকম ব্যাপারে তো সহায়তা করা যায় না। 

“টিকেট ছাড়া আমি ঢুকবো না। আমি টিকেটের টাকা দিয়েছি, আমাকে টিকেট দিন।“

প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে কাউন্টারের জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে অন্যজনের উচ্ছিষ্ট পলিথিনের নিচ থেকে একটা কুঁচকে যাওয়া টিকেট আমার হাতে দিলো। টিকেটের গায়ে একটা থ্যাবড়ানো সিলমোহর দিয়ে লেখা ৫০০ রুপি। এগুলির কোন ধরনের অডিট কিংবা হিসেব হবার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। 

ভেতরে ঢুকে মনে হলো ইন্ডিয়ান রেস্তোরার গরম তন্দুরের ভেতর ঢুকলাম। টিমটিমে আলো জ্বলছে। কিন্তু বাম পাশের পুরো একটা হলঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেদিকে পাওয়ারকাট হয়ে আছে কতদিন হলো কে জানে। পাশের হলঘরে বেশ কিছু মানুষের আবক্ষ মূর্তি আর দেয়ালের খোপে খোপে কিছু সচিত্র তথ্যবিবরণী অত্যন্ত অনাকর্ষণীয় ভাবে রাখা। মাঝে মাঝে কয়েকটা স্ট্যান্ড ফ্যান আছে। কিন্তু একটাও চলছে না। একটির সুইচ অন করার সাথে সাথে এমন বিদঘুটে শব্দ শুরু করলো যে কয়েক সেকেন্ড পরেই তা বন্ধ করে দিতে হলো। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা জাদুঘরের ব্যবস্থাপনা এত খারাপ কীভাবে হতে পারে! 


জাদুঘরে ছবি তোলা অনুমোদিত


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের পক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজত্ব চালানো আর সম্ভব হচ্ছিলো না। ইন্ডিয়া স্বাধীনতার জন্য অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করলেও – তারা স্বাধীনতা পেয়েছে মূলত ইংল্যান্ডের সাথে দর কষাকষি করে। তাও পাকিস্তান ও ভারত দুটো আলাদা দেশ করে দিয়ে গেছে ইংরেজরা। সে তুলনায় অনেক শান্তিপূর্ণভাবেই স্বায়ত্বশাসন লাভ করে তখনকার সিলন ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ডমিনিয়ন অব সিলন হিসেবে ছিল এই দেশ ১৯৭২ সালের ২২মে পর্যন্ত। ১৯৭২ সালে এই দেশ ডেমোক্রেটিক সোশালিস্ট রিপাবলিক অব শ্রীলংকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 

এটুকু ইতিহাস জেনেই বের হয়ে আসতে হলো। ভেতরের গরম আর সহ্য হচ্ছিল না। বাইরে বের হয়ে বত্রিশ ডিগ্রির রোদেও মনে হলো – কী আরাম!


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts