Showing posts with label ক্যানবেরা. Show all posts
Showing posts with label ক্যানবেরা. Show all posts

Tuesday, 30 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৭ম পর্ব



হোটেলের ভাড়ার সাথে কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম হোটেলের নিয়ম কানুন লেখা কাগজটা। ব্রেকফাস্ট খেতে চাইলে ন'টার ভিতর যেতে হবে ডাইনিং হলে। পোশাকের ব্যাপারে লেখা আছে অবশ্যই জুতো পরে যেতে হবে। আর কিছু লেখা নেই পোশাক সম্পর্কে। অস্ট্রেলিয়ানরা পোশাকের ব্যাপারে মোটেই খুঁতখুঁতে নয়। এখানে কেন যে জুতোর কথা লিখেছে জানি না। কোন জামাকাপড় ছাড়া শুধুমাত্র পায়ে জুতো গলিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে হাজির হলে কেমন হয়? আইনত কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু সভ্যতার সব নিয়ম তো আর লিখে দিতে হয় না। এখন বাজে সাড়ে আটটা। নটার ভিতরে ডাইনিং রুমে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ছুটির দিনে শুধুমাত্র ফ্রি ব্রেকফাস্ট করার জন্য কেউ এত তাড়াতাড়ি উঠবে না ঘুম থেকে। আসলে উইকডেতে এখানে যারা আসে বেশির ভাগই আসে প্রশাসনিক বা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। তাদের জন্য রেডি ব্রেকফাস্ট খুবই জরুরি।
হোটেল রুমটা বেশ সুন্দর করে সাজানো।  কাল রাতে এত সব চোখে পড়েনি। জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই দিনের আলোয় ভরে গেলো সারাঘর। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ক্যাপিটাল হিল। যেখানে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। বাংলাদেশের হাই কমিশনও সেখানে। অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পার্লামেন্ট দেখতে যেতে হবে সেখানে।
সিডনি ফিরে যাবার বাসের টিকেট করা আছে সাড়ে বারোটায়। হাতে কয়েক ঘন্টা সময় আছে ঘুরে বেড়ানোর। রেডি হয়ে হোটেলের চাবি জমা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। পা রাখলাম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানীতে। চোখের সামনে উড়ছে অস্ট্রেলিয়ান পতাকা। ক্যাপিটাল হিলে পার্লামেন্ট হাউজের উপর থেকে উড়ছে পতপত করে।
ছোট্ট শহর ক্যানবেরা। মাত্র তিন লাখ মানুষের বাস এখানে। দু'হাজার চারশ’ স্কয়ার কিলোমিটারের ছোট্ট টেরিটরি। এ-সি-টি বা অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরি। নিউ সাউথ ওয়েলস ষ্টেটের মাঝখানে এই টেরিটরিতে সম্পূর্ণ পরিকল্পিত এই রাজধানী শহর। ক্যানবেরা সিটির চারপাশে একটা কৃত্রিম হ্রদ, নাম লেক বার্লি গ্রিফিন।
অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রফলের সাথে তুলনা করলে ক্যাপিটাল টেরিটরিকে একটা বিন্দুর মতো মনে হবে। উত্তর দক্ষিণে মাত্র ৮৮ কিলোমিটার লম্বা আর পূর্ব পশ্চিমের দূরত্ব মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। এই শহরের প্রায় সবকিছুই পূর্ব পরিকল্পিত। এখানকার প্রত্যেকটি গাছও নাকি পরিকল্পনা মতো লাগানো। এ সিটির শতকরা চল্লিশ ভাগ জায়গা জুড়ে আছে ন্যাশনাল পার্ক। মুরামব্রিজ নদী বয়ে গেছে শহরের দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে। ক্যাপিটাল হিলকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল গড়ে উঠেছে অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে। এলাকার নামও তাই নানারকম ক্রিসেন্ট। ঝলমলে সূর্যের আলোয় এত সবুজ ভরা ক্যানবেরা দেখে বোঝাই যায় না যে এখানের সমস্ত প্রাকৃতিক দৃশ্যকেও মানুষের শাসনে বেড়ে উঠতে হয়েছে।
ক্যানবেরার বয়স এখনো একশ বছরও হয়নি। ১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশন গঠিত  হবার পরে একটা ন্যাশানাল ক্যাপিটাল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সমস্যা হলো কোথায় হবে তা নিয়ে। মেলবোর্ন চায় তাদের ওখানেই হোক, আর সিডনি চায় তাদের শহরেই  হোক ফেডারেল ক্যাপিটাল। শেষ পর্যন্ত ১৯০৮ সালে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মেলবোর্ন বা সিডনি কোথাও না হয়ে এই দুই শহরের মাঝামাঝি কোন জায়গায় হবে রাজধানী শহর।
শহরের ডিজাইন করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিযোগিতায় জিতলো একজন আমেরিকানের ডিজাইন। আমেরিকান স্থপতি ওয়ালটার বার্লি গ্রিফিনের ডিজাইন অনুসারে গড়ে তোলা হয়েছে এই ক্যানবেরা শহর। নতুন শহরের নাম কী হবে তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ১৯২৭ সালে নাম ঠিক করা হয় ‘ক্যানবেরা’। আদিবাসীদের শব্দ ক্যানবেরা যার অর্থ হলো মিটিং প্লেস বা সম্মিলন ক্ষেত্র। 
ক্যানবেরার বেশির ভাগ স্থাপনা তৈরি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৪৬ সালে গড়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি। সেই হিসেবে বেশ নতুন বলা চলে এই শহরটাকে।

পার্লামেন্ট হাউজের সামনে

পার্লামেন্ট হাউজের কাছে এসে অভিভূত হয়ে গেলাম। প্রথমেই চোখ যায় চার পায়ের উপর দাঁড়ানো বিরাট ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের ওপর। জাতীয় পতাকাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দেখানো হয় এখানে। তবে এই সম্মান একেক জনের কাছে একেক রকম। জাতীয় পতাকার রঙে এরা অন্তর্বাসও তৈরি করে।
অনেক ট্যুরিস্ট এসে গেছে এর মধ্যেই। দর্শকদের জন্য সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে এই পার্লামেন্ট হাউজ, সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। গেট দিয়ে ঢুকতেই বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি অফিসার দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে ভয় পাবার কথা হলেও তারা কেউ ভয়ানক দর্শক নয়। বেশ হাসি খুশি। সিকিউরিটি অফিসারদের হাসিখুশি দেখলে তাদের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা হয় না। কিন্তু আমার ধারণা নিয়ে তারা কেউ খুব একটা বিচলিত বলে মনে হলো না। হাসি মুখেই ওয়েলকাম জানালো আমাকে।
সিকিউরিটি ইউনিটে একটা মেটাল ডিটেক্টরের ভিতর দিয়ে যেতে হয় সবাইকে আর সাথের সব জিনিসপত্র চালান করে দিতে হয় স্ক্যানারের ভিতর দিয়ে। খুব সহজ যান্ত্রিক ব্যবস্থা। এটাই একমাত্র প্রবেশপথ সাধারণের জন্য। আর কোথাও কোন চেকিং এর ব্যবস্থা নেই। গাইড আছে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই। কিছু জানাতে চাইলে ঝটপট করে বলে দিচ্ছে। ভিতরের প্রত্যেকটা ঘরেই যাওয়া যায়। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো।
এই পার্লামেন্ট হাউজের বয়স মাত্র বারো বছর। ১৯৮৮ সালে তৈরি হয়েছে এই ভবন। ইতালিয়ান স্থপতি রোমালডো জিউরগোলা এই ভবনের ডিজাইন করেছেন। বার্লি গ্রিফিন লেকের ঠিক দক্ষিণ পাড়েই এই পার্লামেন্ট হাউজ। সবুজ পাহাড়ের চূড়োয় বসে আছে এক টুকরো ছবির মতো।
পার্লামেন্ট হাউজের ভিতর অসংখ্য পেইন্টিংস। সবগুলিই অস্ট্রেলিয়ান শিল্পীর আঁকা। সিনেট হল, পার্লামেন্ট হল সব ঘুরে ঘুরে দেখালাম। যখন পার্লামেন্ট অধিবেশন চলে তখনো নাকি দর্শক এসে দেখতে পারে। এদেশের এমপিরা সম্ভবত জনগণকে খুব একটা ভয় পায় না। অথবা জনগণকে খুব বেশি আলাদা মনে করে না। জনগণ যে এদেশের কাউকেই ছেড়ে কথা কয় না।

সিনেট হাউজ

অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের জন্য ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক আর এদেশের সরকারের মেয়াদ তিন বছর। পার্লামেন্ট হাউজের তিন তলায় বিরাট একটা আর্ট গ্যালারিও আছে আর আছে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস সম্বলিত ছবির প্রদর্শনী। ইতিহাসকে এরা আড়াল করে না। মনে হয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার মানসিকতাও আছে এই জাতির।
পার্লামেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যায় বার্লি গ্রিফিন লেকের পাড়ে। এই লেক কাটা হয়েছে ১৯৬৩ সালে। মুলুংগুলু নামে একটা নদী ছিলো আগে এখানে। নদীটি মরে যায় প্রবাহ না থাকায়। তখন নগর কর্তৃপক্ষ এই লেক কাটার ব্যবস্থা করে। শহরের স্থপতি বার্লি গ্রিফিনের নামে নামকরণ হলো এই হ্রদের। লেকের চারপাশে বাঁধানো পাড়ে সাইকেল চালানো যায়, স্কেটিং করা যায়। ইচ্ছে করলে হেঁটে পার হওয়া যায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পথ।
হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট নৌকা। ভাড়া করা যায় ঘন্টা হিসেবে। পানিতে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে হলে একটা নৌকায় চড়ে বসলেই হলো। হ্রদের মাঝখানে এক জায়গায় ক্যাপ্টেন কুক মেমোরিয়াল ওয়াটার জেট। এখান থেকে শূন্যে পানি উঠে যাচ্ছে প্রায় দেড়শো মিটার। সূয্যের আলোয় হীরক কুচির মতো ঝরে পড়ছে এই জেটের পানি।
হাতের সময় দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। চলে এলাম বাস টার্মিনালে। সাড়ে বারোটার বাস সাড়ে বারোটাতেই ছাড়লো। এই বাস আসছে মেলবোর্ন থেকে। এখানে যাত্রী নামিয়ে সিডনিগামী যাত্রীদের তুলছে। আমার সিট একদম পেছনের দিকে। আবার চলছি সিডনির দিকে। এবার সিডনি শহরকে দেখতে হবে নিজের মতো করে।
চার ঘন্টা লাগলো সিডনি পৌঁছাতে। পথে একবারও থামেনি বাস। সিডনি শহরে ঢোকার সময় একটু রোদ ছিলো আকাশে। কিন্তু বাস থামতে না থামতেই বৃষ্টি নেমে এলো। প্রথমে এক দুই ফোঁটা, একটু পরেই অঝোর ধারায়। আকাশ আলকাতরা হয়ে আছে। এই বৃষ্টি কখন থামবে জানি না। হোটেল খুঁজতে হবে রাতে থাকার জন্য।
সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে একটা ব্যাকপ্যাকার হোস্টেল আছে। কিন্তু কোন সিট খালি নেই। আরো কয়েকটা হোটেলে ফোন করে দেখলাম। ছোট বড় সব হোটেলেই ক্রেডিট কার্ড চায়। আমার কোন ক্রেডিট কার্ড নেই। সুতরাং আমার কোন আইডেন্টিটি নেই বড় হোটেলে থাকার জন্য। উঠতে হবে ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলে।
কিংস ক্রস অ্যারিয়া হলো ব্যাকপ্যাকারদের স্বর্গরাজ্য। অনেকগুলো ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেল আছে এখানে। বিছানা থেকে শুরু করে সব কিছু প্যাক করে পিঠে নিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের জন্য কম খরচে থাকার ব্যবস্থা থাকে বলেই তা ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেল। বৃষ্টি ধরে এসেছে একটু। কয়েক ফোঁটা যা ঝরছে এখনো, তাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না। রেইনকোটটা গায়ে চড়িয়ে পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটতে লাগলাম কিংস ক্রসের উদ্দেশ্যে।
সিডনি সিটি ম্যাপ ফলো করতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না।  আকাশ মেঘলা হলেও আলোর অভাব নেই কোথাও। রাস্তার আনাচে-কানাচে আলো। পার্কের মাঝখানে পায়ে চলার পথে আলো। আক্ষরিক অর্থেই আলোয় ভুবন ভরা। কিংস ক্রস এলাকায় এসেই বুঝতে পারলাম কত ব্যস্ত আর মনোহারি এলাকা এটা। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে আবার। কিন্তু ফুটপাতে শেড দেয়া আছে।
রাস্তার ধারেই একটা ব্যাকপ্যাকার্স চোখে পড়লো। দোতলায় রিসেপশান। ম্যানেজার ইন্ডিয়ান, নাম ভিক্টর। আমি জায়গা পেলাম ওয়ান সি রুমে। ছয়জনের একটা রুমে একটা সিট খালি আছে। চাবি নিয়ে রুমে ঢুকলাম। ছয়জনের জন্য তিনটা দোতলা বিছানা। চট্টগ্রামের স্টেশন রোডে কিছু ঢালাও বিছানার হোটেল আছে। সারি সারি বিছানা পাতা। ঘুমানোর জন্য বিছানা ভাড়া দেয়া হয়, রুম নয়। এখানেও সেরকম। ছয়জনের জন্য একটা বাথরুম, ঘরের ভিতরেই আছে। ফলে রুম থেকে বেরোবার দরকার নেই। টেলিভিশন ফ্রিজ সবকিছু আছে। এত কম ভাড়ায় এর চেয়ে বেশি আশা করা উচিত নয়। তাছাড়া বেড়ানো যেখানে মূল উদ্দেশ্য সেখানে হোটেলে বসে তো কেউ সময় কাটাবে না। সামর্থ্য না থাকলে কত ধরনের যুক্তিই দেখানো যায়। আমার বেশ থ্রিলিং লাগছে।
রুমের ভিতর এই বিকেলবেলায় চার বিছানায় চার জন ঘুমাচ্ছে। তিনটে দোতলা বিছানায় একটার উপরের একটা আর অন্যটার নিচের একটা বিছানা খালি আছে। কিন্তু নিচের খালি বিছানায় একটা জ্যাকেট মেলে দেয়া, আর ওপরেরটায় দুটো বই রাখা। এই দুটোর মধ্যে ঠিক কোন বিছানাটা খালি বুঝতে পারছি না। বামদিকের দেয়াল ঘেঁষে লম্বালম্বি লাগানো দুটো বিছানার একটার দোতলায় ঘুমাচ্ছে একটা মেয়ে। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি এ সময় মেয়েটি চোখ খুলে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো, "হাই"।

"হাই, ডু ইউ নো, হুইচ সিট ইজ ভ্যাকেন্ট হিয়ার?"
"দিস ওয়ান। প্লিস টেক দিস ওয়ান।" বলেই সে উঠে বসলো বিছানার ওপর। হাত বাড়িয়ে অন্য বিছানার উপর থেকে বই দুটো টেনে নিলো নিজের বিছানায়। মেয়েটার গলার স্বর অদ্ভুত মিষ্টি।

ছেলে আর মেয়ে একই রুমে থাকাটা এদেশে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমি ধীরে সুস্থে আমার লকার গুছালাম। লকারের লক ছিলো না, ম্যানেজারের কাছ থেকে তালা চেয়ে নিয়ে এলাম। তালার জন্য আলাদা দশ ডলার জমা দিতে হলো। যাবার সময় তালা ফেরত দিলে টাকা ফেরত দেবে।
লকারে ব্যাগটা রেখে সিডনি সিটির ম্যাপ নিয়ে উঠে এলাম আমার দোতলা বিছানায়। মেয়েটি দেয়ালের দিকে পা দিয়ে শুয়ে আছে। এখন আমি যদি অন্য দেয়ালের দিকে মাথা দিয়ে শুই তাহলে তার মাথায় আমার পা লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আপাতত তার মাথার দিকেই আমাকে মাথা দিতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ট্রেনের বাংকে শুয়ে আছি। কয়েক মিনিট পরেই মেয়েটি আলাপ শুরু করলো।

"হাই, আয়াম সেরাহ।"
সেরাহ নামটা খুব প্রচলিত একটা নাম এখানে। বোধহয় প্রতি দশ-বিশজন মেয়ের মধ্যে একজনের নাম সেরাহ। আমরা যাকে সারা বা সারাহ উচ্চারণ করি তাই হয়ে গেছে সেরাহ। আমি আমার নাম বললাম। সে তা উচ্চারণ করার চেষ্টা করলো। এরা ‘দ’ উচ্চারণ করতে পারে না। প্রদীপ হয়ে যায় প্রাডিব।
জানা গেলো সারাহ সিডনির মেয়ে। এখানেই থাকে, পড়ে কোন একটা কলেজে। যে ছেলেরা ঘুমাচ্ছে তারা সব তার বন্ধু। ব্রিসবেন থেকে এসেছে তারা। সারাহ তাদের সিডনি শহর দেখাচ্ছে।
আমি আর দেরি করলাম না। পরে দেখা হবে বলে ছাতা আর রেইনকোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঘরে বসে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
রাস্তায় বেরিয়ে বুঝতে পারলাম ক্ষুধা লেগেছে। ম্যাকডোনাল্ডস খাব কিনা ভাবছি - চোখে পড়লো ‘ইন্ডিয়ান ক্যারি পয়েন্ট’ ঠিক রাস্তার ওপারেই।
ইন্ডিয়ান টেকওয়ে প্লেস যেরকম হয়ে থাকে সেরকম। খুব ছোট ছোট দোকান। মাত্র তিনটা টেবিল আর গোটা দশেক চেয়ার পাতা আছে। টেবিলের ওপর ময়লার আস্তরণ। কাউন্টারে তরকারি যেগুলো রাখা আছে সব আমার পরিচিত। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ করতে করতে আমি মোটামুটি বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি এ ব্যাপারে।
ভাত আর একটা তরকারি নিয়ে খেতে বসলাম। প্লেটেও মনে হচ্ছে ময়লা লেগে আছে। মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করেছে। ভাবছি যাবার সময় এই বিষয়ে কথা বলবো। হঠাৎ কাউন্টারে ছেলেটাকে টেলিফোনে বাংলায় কথা বলতে শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কথায় ঢাকাইয়া আঞ্চলিক টান। বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে খারাপ হয়ে যাওয়া মেজাজ আবার ভালো হয়ে গেলো। টেবিলের ময়লাকেও আর অসহ্য মনে হচ্ছে না । খুব বাজে স্বাদের রোগেনজোশকেও খুব একটা খারাপ লাগছে না।
পয়সা দেবার সময় জানতে চাইলাম, "ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনি কি বাংলাদেশি?"
"হুঁ" - গলার ভেতর ছোট্ট একটা শব্দ করলো ছেলেটা। মনে হচ্ছে  আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় সে খুব একটা। আমার বাংলা কথা শুনেও তার মুখে হাসি ফুটলো না। আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার নাম বললাম। সে হ্যান্ডশেক করা বা তার নাম বলা - কোনটাই করলো না। তার চোখে-মুখে বিরক্তি।
আমি জানতে চাইলাম, "দোকানের মালিক কি ইন্ডিয়ান?"                                                               
        "না, বাংলাদেশি"
"তবে দোকানের নাম ইন্ডিয়ান কেন? বাংলাদেশি দোকান বললে বুঝি চলে না?"
আমার কথা শুনে ছেলেটা এত রেগে যাবে বুঝতে পারিনি। বেশ রাগী রাগী কন্ঠে বললো, "খাবারগুলো সব যে ইন্ডিয়ান তা চোখে দেখেন না?"
 
ইন্ডিয়ান তরকারি সম্পর্কে সে আমাকে যা বলতে চাচ্ছে তাতে আমার সন্দেহ হচ্ছে সে আদৌ কিছু জানে কিনা। তার কথা বলার ভঙ্গিতে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। আমার সঙ্গে বাংলাদেশি মানুষের এরকম বিতৃষ্ণ ব্যবহার এই বিদেশে আশা করিনি।
মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, কোন রকমে সামলে নিলাম। কী দরকার! ছেলেটা হয়তো বড় কষ্টে আছে এখানে। হয়তো অবৈধভাবে আছে। কাজ করে যা পায় সব যায় উকিলের পেটে। শুনেছি এই সিডনি শহরে অনেক ছেলে অবৈধভাবে এক রুমে দশ-বারোজন গাদাগাদি করে থাকে। ঘন্টায় দু’তিন ডলার মজুরিতে কাজ করতে হয় রেস্টুরেন্টের কিচেনে বা গ্রোসারির গুদামে। বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নেই বলে কম মজুরির জন্য কোথাও নালিশও করতে পারছে না। দেশেও চলে যেতে পারছে না। কী দরকার তার সাথে রাগারাগি করার। নিজের দেশের একজন মানুষ পেয়েও ভালভাবে কথা বলতে না পারাতে একটু কষ্ট লাগছে বৈকি।
___________________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Monday, 29 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৬ষ্ঠ পর্ব



নতুন বছরের প্রথম দিনের সূর্যালোক জানালায় আসার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙেছে। স্বপনদারা ফিরেছেন একটু আগে। গতকাল সারাদিন, সারারাতের ক্লান্তির পরে এখন তাঁদের দরকার একটা দীর্ঘ নিরুপদ্রব ঘুম। আমি যথাসম্ভব নীরবে সকালের কাজ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে বেরোবার জন্য তৈরি। আমাকে যেতে হবে। দাদা বৌদিকে কিছু না বলে বেরোই কীভাবে? আবার এসময়ে ঘুম থেকে তাঁদের জাগাতে ইচ্ছে করছে না একটুও। তাঁদের উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে ঘরের অটোম্যাটিক লক অন করে বেরিয়ে গেলাম। মিনিট খানেক পরেই চেপে বসেছি সিডিনিগামী ট্রেনে। পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে নামলাম সিডিনি সেন্ট্রাল স্টেশনে।

নিউ ইয়ার্স ডে উপলক্ষে শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ আজ। স্টেশনেও খুব একটা ভিড় নেই। আমার ক্যানবেরার বাস সোয়া দশটায়। হাতে এখনো ঘন্টাখানেক সময় আছে। এ শহরের রাস্তায় রাস্তায় নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে আছে। কাল ক্যানবেরা থেকে ফিরে এসে তা করা যাবে।

সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের বিল্ডি-এর মধ্যেই গ্রেহাউন্ড বাস কাউন্টার। চেক ইন করে বোর্ডিং পাস নেবার পরও দেখি হাতে আরো কিছু সময় আছে। স্টেশন চত্বরে হাঁটতে লাগলাম। রোদে ঝলমল করছে চারদিক। স্টেশনের যাত্রীদের বেশির ভাগই  ট্যুরিস্ট। 

এই সেন্ট্রাল স্টেশনের ২৬ আর ২৭ নম্বর প্লাটফরমকে বলা হয় ভুতুড়ে প্লাটফরম। তার কারণ হলো ১৯৭৯ সালে এই প্লাটফরম দুটো তৈরি হবার পর থেকে একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। এ দুটো প্লাটফরম থেকে কোন ট্রেন ছাড়ে না বা কোন ট্রেন থামেও না এ দুটো প্লাটফরমে।    একজন দু'জন করে যাত্রী এসে জমা হতে শুরু করেছে ক্যানবেরাগামী বাসের কাছে। সোয়া দশটার বাস ছাড়লো প্রায় দশ মিনিট দেরিতে। ছুটির দিন। কারো কোন তাড়া নেই। সবার মুখ হাসি হাসি। অস্ট্রেলিয়ার মানুষ গায়ে পড়ে আলাপ জমায় অনেক সময়। ভালোই লাগে তাদের দিলখোলা ভাব। অষ্টাদশী ক্যারেনের সাথে আলাপ হলো। সে ক্যানবেরার মেয়ে। সিডনিতে এসেছিল কোন কাজে, এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ক্যাবেরার ঠিক কোথায় বাড়ি তা তো আর সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না, আর সে বললেও আমি চিনবো না। ঊর্মিরা থাকে নারাবুন্ধায়। ক্যারেনের কাছে জানতে চাইলাম নারাবুন্ধা কীভাবে যেতে হয়। সে বললো ক্যানবেরা গিয়ে দেখিয়ে দেবে।

হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে আমাদের বাস। একটা সিনেমা দেখানো হচ্ছে বাসের টেলিভিশনে। রাস্তার দু’পাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে ঘন গাছপালা, বেশির ভাগই ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। অস্ট্রেলিয়ান গরু চরছে। এদিকে সম্ভবত প্রচুর ডেইরি ফার্ম আছে। সিডনি থেকে ক্যানবেরার সড়ক দূরত্ব সাড়ে তিনশ কিলোমিটারের মতো। বিরাট চওড়া হাইওয়ে। ওয়ান ওয়ে হওয়াতে অন্যদিক থেকে আসা গাড়ির সাথে তাদের দেখা হচ্ছে না। বাইরের ঝকঝকে নীল আকাশ আর দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর দেখতে দেখতে এক সময় ক্লান্তিই চলে আসে। সুন্দরের সরবরাহ বেশি হয়ে গেলে সুন্দরও মনোটোনাস হয়ে পড়ে।
ক্যারেনের দিকে চোখ গেলো। সে সিটে পা তুলে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। দিনের বেলায় ঘুমানোটা এদেশের সংস্কৃতির সাথে ঠিক মেলে না। কিন্তু বাসে ট্রেনেতো অনেককেই ঘুমাতে দেখি।

বাসের গতি ক্রমশ কমে আসছে। অনেক রকম বিল্ডিং আর সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে। মনে হচ্ছে ক্যানবেরা পৌঁছে গেছি। ক্যারেন চোখ খুলে বাইরে তাকিয়ে বললো, "আমরা এসে গেছি"।
সোয়া দুটোয় গাড়ি থামলো ক্যানবেরা সেন্ট্রাল স্টেশনে। এদেশের সব সিটিতে একটা করে সেন্ট্রাল স্টেশন থাকে মনে হয়। বেশ সুন্দর লাগল ক্যানবেরা সেন্ট্রাল। এখানে শুধু বাস থামে। ক্যানবেরায় ট্রেন আছে কিনা আমি জানি না। ক্যারেনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সেও জানে না। ট্যুরিস্টদের জন্য ইনফরমেশন সেন্টার আজ বন্ধ।  তবে বিভিন্ন হোটেলের টেলিফোন নম্বর আর ছবিসহ বিরাট বিলবোর্ড  দেখা যাচ্ছে। বিলবোর্ডে লাগানো নম্বরে ডায়াল করলে বিনামূল্যে হোটেলের রিসেপশনে কথা বলা যায়। বুকিং করার পর হোটেলের লোক এসে নিয়ে যাবে এখান থেকে। ব্যবস্থাটা খুব ভাল লাগলো।
আমি আপাতত হোটেলে যাচ্ছি না। আগে ঊর্মিদের ওখান থেকে ঘুরে আসি। রায়হানকে ফোন করলাম। তারা বসে আছে আমার জন্য। এখন হোটেলে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ক্যারেন অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমাকে সিটি বাসে তুলে দেবে। ক্যানবেরার সবাই এরকম পরোপকারী কিনা জানি না।

ক্যারেন একটা ম্যাপ নিয়ে এলো কোত্থেকে। বাসের রুট আর সময় দেয়া আছে সেখানে। মার্কেট টার্কেট সব বন্ধ আজ। ক্যারেন আমাকে নিয়ে কয়েকটি রাস্তায় হাঁটলো, যদি কোন দোকানপাট খোলা থাকে। আমি ঊর্মির জন্য কিছু কিনতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু একটা দোকানও খোলা পেলাম না। ক্যারেন খুঁজছে সিগারেট। আমি সিগারেট খাই না জেনে একটু লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গিতে হাসলো। কিন্তু তার নাকি সিগারেটের তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। দোকান খোলা না পাওয়াতে এবার সে একজন পথচারীকে থামিয়ে একটা সিগারেট চেয়ে নিলো। ভিক্ষা চাইতে লজ্জা লাগলেও সিগারেট চাইতে সম্ভবত লজ্জা লাগে না। নেশার কাছে মানুষের অনেক বোধেরই মৃত্যু ঘটে।
আমাকে ধরতে হবে ৩৫ নম্বর বাস। নারাবুন্ধায় যায় এই বাস। ঊর্মি আর রায়হান থাকে সেখানে। ক্যারেন যাবে ঠিক উল্টো দিকে। তার বাস আমার বাসের আগে। সে বারবার জিজ্ঞাসা করছে আমি যেতে পারবো কিনা। ভালো লাগলো তার আন্তরিকতায়। তার সাথে আমার হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না। কিন্তু হু কেয়ারস ফর দ্যাট? মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারটা হয়তো ক্যারনের সহজাত একটা গুণ। তার সাবলীলতায় আমি মুগ্ধ। হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল সে। আমি ৩৫ নাম্বার বাসে চড়ে বসলাম।
বাসে আমিসহ মাত্র চারজন যাত্রী। সবাই বৃদ্ধ। ড্রাইভারও বেশ বয়স্ক। ক্যানবেরাতে বৃদ্ধদের সংখ্যা বেশি বলে শুনেছি। তরুণরা এইরকম একটা ছোট চুপচাপ এলাকায় থাকতে চায় না হয়তো।
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী এই ক্যানবেরা। কিন্তু রাজধানী বলতে যেরকম একটা ব্যস্ত বাণিজ্যিক শহরের কথা মনে হয়, এটা সেরকম নয়। শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাজের জন্য প্ল্যান করে এই শহর গড়ে তোলা হয়েছে। ক্যানবেরাই নাকি পৃথিবীর একমাত্র সিটি যেটা আগে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তারপর নগরায়ন হয়েছে। সাধারণত হয়ে থাকে উল্টো। কোন ভাবে বসতি গড়ে ওঠে কোথাও তারপর পরিকল্পনা করা হয় কীভাবে তার উন্নয়ন করা যায়।
      
বাসের জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি আমি। কোথাও কোন জনমানুষ চোখে পড়ছে  না। মনে হচ্ছে রূপকথার কোন ঘুমন্ত শহরে এসে পৌঁছেছি। বিরাট বিরাট রাস্তা । সব গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এ যেন সেই ‘গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়’। বাসের ভিতরে যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখি চারজনেই তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই একজন বললেন "হ্যাপি নিউ ইয়ার মাইট"।
আজ নিউ ইয়ার্স ডে এটা এখানে কীভাবে সেলিব্রেট করেছে আমি জানি না।

"হোয়ার ইউ গোয়িং?"
আমি কোথায় যাবো? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন এরা। বাসের টিকেট করার সময় কোথায় যাবো একবার বলেছি। তখন হয়তো খেয়াল করেননি কেউ। কারণ এখানে সিটি বাসের ভাড়া যেখানেই যাও, সমান। দুই ডলার প্রতি ট্রিপ।
বাসের ড্রাইভার আর যাত্রীরা প্রতিযোগিতা করে সাহায্য করলেন আমাকে। ৪৭ নম্বর বাড়ির সামনে কোন স্টপেজ নেই। কিন্তু ড্রাইভার সেখানেই গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, আমি যে ঠিক জায়গায় নেমেছি তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন।  আমাকে দেখে রায়হান ছুটে আসার পরে বাস ড্রাইভার হাত নেড়ে চলে গেলেন তাঁর গন্তব্যে। ভালো লাগলো খুব। মনে হল নিয়ম যে মানুষের জন্য তৈরি তা এরা খুব ভালোভাবে জানেন। আসলে নিয়মের চেয়ে মানুষের সংখ্যা কম হলে এই রকম বদান্যতা দেখানো সব দেশে সম্ভব।
রায়হানকে আমি আগে কখনো দেখিনি। ঊর্মির যখন বিয়ে হয়, তখন আমি দেশের বাইরে। রায়হান আমাকে দেখে দৌঁড়ে রাস্তায় চলে এসেছে। লুঙ্গি আর টিশার্ট পরা মোটা পাওয়ারের চশমা চোখে রায়হানকে দেখেই ভালো লেগে গেলো আমার। কত দিন পরে ঊর্মিকে দেখলাম। ঊর্মি আমার দিদির ননদের মেয়ে। খুব শুকিয়ে গেছে মেয়েটা।
ছোট্ট ছিমছাম বাসা। ঢুকতেই রান্নাঘর, তারপর বসার ঘর আর শোবার ঘর। সবকিছু চমৎকারভাবে গোছানো। রান্না হিটিং সবকিছু ইলেকট্রিক এখানে। গ্যাস থাকলে ভালো হতো। এদেশে ইলেকট্রিসিটির দাম গ্যাসের চেয়ে বেশি।
ক্যানবেরার বড় সমস্যা হলো এখানে বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না সহজে। কারণ ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়ি এখানে খুব একটা বানায় না কেউ। বৃদ্ধ আর চাকরিজীবীরাই মূল বাসিন্দা ক্যানবেরার। এখন অবশ্য ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের জন্য কিছু ঘর তৈরি হচ্ছে। রায়হানের বাড়িওয়ালা নিজের থাকার ঘর থেকে একটা অংশ ভাড়া দিয়েছে এদের। এর চেয়ে বড় বাসা লাগে না আসলে এখানে। দু'জনের সংসার। রায়হান কাজ করে উলওয়ার্থে। ঊর্মি ভর্তি হয়েছে ক্যানবেরা ইউনিভার্সিটিতে। সুখে আছে তারা। দেখে খুব ভালো লাগলো আমার।
           
পোলাও, মাংস, মাছ ইত্যাদি হরেক রকম আয়োজন করে রেখেছে তারা। খেতে খেতে গল্প আর গল্প করতে করতে খাওয়া হলো। দেশের গল্প। দেশের মানুষের গল্প। এখানকার বাঙালিদের গল্প, রায়হানের বন্ধুদের গল্প, ক্যানবেরার চাকরির বাজার আর বাংলাদেশের রাজনীতি সবকিছু নিয়ে প্রাণ খুলে আড্ডা মারলাম অনেকক্ষণ। রায়হানের সাথে গল্প করে বেশ মজা পাওয়া যায়। ছেলেটা মামাশ্বশুর বলে আমার সাথে কোন সংকোচজনক দুরত্ব রাখছে না এজন্যই তাকে এত ভালো লাগছে।
            
সন্ধ্যার দিকে বেরোলাম একটু। ঘুরে বেড়ানোর জন্য। রায়হান সাথে আসতে চাইলো। কিন্তু ঊর্মিকে বাসায় একা রেখে বেরোতে মানা করলাম। এমনিতেই তো তাকে অনেকটা সময় একা কাটাতে হয়। আজ ছুটির দিনেও সেটা করা উচিত হবে না। তাছাড়া একটু একা ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করলো। নতুন জায়গা দেখার জন্য একা ঘুরে বেড়ানো খুব ভালো মনে হয় আমার।
              
ক্যানবেরার রাস্তাগুলো বিশাল। সে তুলনায় ফুটপাত খুব ছোট। রাস্তা আর ফুটপাতের মাঝে বেশ চওড়া, রাস্তার চেয়েও প্রশস্ত জায়গা। সেখানে গাছ আর ঘাসে ভর্তি। স্ট্রিট লাইট খুব কম। যে কয়টা লাইট আছে সেখান থেকে আলো যা আসে তাও খুব টিমটিমে। এখানে বোধ হয় সন্ধ্যার পরে কেউ হাঁটতে বেরোয় না। আমি ছাড়া আর কোন ব্যক্তির দেখা পেলাম না রাস্তায়। হেঁটে হেঁটে ক্লে ক্রিসেন্ট থেকে মানুকা সেন্টার পর্যন্ত আসার পথে আর একটা মানুষও দেখলাম না। ছুটির দিন বলেই হয়তো।
মানুকা সেন্টারে বেশ কিছু দোকানপাট, ব্যাংক আর সুপার মার্কেট আছে। এখান থেকে একটা ট্যাক্সি নিলাম। ট্যাক্সিওয়ালা ভিয়েতনামি। এগারো বছর ধরে নাকি আছে এই ক্যানবেরায়। কথা শুনে মনে হলো সে ক্যানবেরার প্রেমে পড়ে গেছে। ক্যানবেরার সব কিছুই ভালো তার কাছে। এখানে ট্যাক্সির সংখ্যা খুব বেশি না হওয়াতে খুব একটা প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে না তাকে। সে আমাকে নিয়ে চললো ম্যাককোয়ারি হোটেলে।
   
বেশ বড় হোটেল এই ম্যাককোয়ারি। রুম পেতে কোন অসুবিধা হলো না। চাবি নিয়ে একই ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম মানুকা সেন্টারে। আমি ট্যাক্সি ছাড়তে চাইলেও সে আমাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। সে বলছে ফেরার পথে আমি রাস্তা ভুল করতে পারি। সে তখন দেখা যাবে। একটু আগে আমি হেঁটে এসেছি এই পথে। ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় ট্রিপস দেওয়ার প্রথা চালু নেই। কিন্তু আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বেশ ভালোই ট্রিপস দিলাম।  উলওয়ার্থে ঢুকলাম। এই চেইন সুপার মার্কেটের নাম সব জায়গায় উলওয়ার্থ, কিন্তু মেলবোর্নে সেফওয়ে। আমি জানি না কেন।  উলওয়ার্থ সাহেবের এই ব্যবসা পৃথিবী বিখ্যাত। ভিতরে ঢুকে স্বাভাবিক ভাবেই  তুলনা এসে যাচ্ছে মেলবোর্নের সাথে। দেখলাম মেলবোর্নের তুলনায় এখানে জিনিস পত্রের দাম অনেক বেশি। একই কোম্পানির জিনিস একেক জায়গায় একেক দাম। দ্রব্যমূল্য কীভাবে নির্ধারিত হয় আমি জানি না।
সুপার মার্কেট থেকে বেরিয়ে দেখলাম রাস্তার রাউন্ড এবাউট থেকে দুই-তিনটি রাস্তা চলে গেছে ভিন্ন ভিন্ন দিকে। এর কোনটা ধরে এসেছিলাম আমার আর মনে নেই। ট্যাক্সিওয়ালার কথা মনে হলো। রাস্তা ভুল করতে পারি! পকেটে ম্যাপ আছে। খুলে বের দেখলাম আর খুব নিশ্চিত হয়ে পথ ঠিক করলাম। এবার মিনিট দশেক হাঁটলেই পৌছে যাব ঊর্মিদের বাসায়। কিন্তু না, পথ শেষ হচ্ছে না। আমি কি বাড়ির নম্বর ভুল করছি? সবগুলো বাড়িই একই রকম দেখতে। আসার সময় দিনের আলো কিছুটা অবশিষ্ট ছিলো। এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের আলোয় যেটুকু বৈষম্য দেখা যেতো বিভিন্ন বাড়ির মধ্যে এখন তা আর চোখে পড়ছে না। কোন রাস্তায় আছি তা বোঝার কোন উপায় নেই। রাস্তায় কোন লাইট নেই। লোক নেই। বাস বন্ধ হয়ে গেছে ছ’টার সময়। পকেটের ম্যাপতো নিজে নিজে কথা কইবে না। ম্যাপ খুলে যে দেখবো, আলো নেই কোথাও। মানুষের বাসার সামনে লাগানো বাতির আলোয় গিয়ে ম্যাপ দেখেও কিছু বোঝার উপায় নেই। রাস্তায় নির্দেশক সাইনগুলো এতো দূরে যে তা পড়া যায় না কোনটা কোন স্ট্রিট।
শহরটার পরিকল্পনাকারীদের কেউই আমার মতো ট্যুরিষ্টদের কথা ভাবেননি তাতে আমি নিঃসন্দেহ হলাম। মনে হচ্ছে আমি এক ভুতুড়ে শহরের গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছি। প্রায় দুঘন্টা হাঁটার পরে মনে হলো যথেষ্ট হয়েছে। এবার ট্যাক্সি ডাকা দরকার। ডাকবো যে টেলিফোন বুথ কোথায়? আশে পাশে থাকার কথা। প্রতি রাস্তাতেই থাকার কথা। কিন্তু সব কথা সম্ভবত ক্যানবেরার জন্য খাটে না। চোখেই পড়ছে না টেলিফোন বুথ। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর মেইন স্ট্রিটে এসে একটা মার্কেট টাইপের চোখে পড়লো। কিন্তু তা বন্ধ। একটা টেলেস্ট্রা ফোনবুথ চোখে পড়লো। ট্যক্সিকে ফোন করলাম। একটা কলের জন্য চল্লিশ সেন্ট লাগার কথা। আমি দুই ডলারের কয়েন দিয়েছি টেলিফোন কয়েন স্লটে। এক ডলার ষাট সেন্ট ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু কয়েন রিটার্ন স্লটে কোন শব্দ নেই। বার কয়েক ঝাঁকুনি খেয়েও নির্বিকার টেলিফোন বক্স। কোন কোন মেশিন পয়সা ফেরত দেয় না, সেটা কিন্তু লেখা থাকে। এখানে সেরকম কিছু লেখাও নেই। ব্যাথা লাগা আঙুলেই ব্যাথা লাগে বার বার। সেরকম হচ্ছে এখানে। অবশেষে ট্যাক্সি এলো। ঊর্মিদের বাসায় আসতে ট্যাক্সিতেই লাগলো পুরো বিশ মিনিট। আমি যে শহরের কোন প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। রায়হান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করছিলো আমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলাম! তাকে তো আর বলা যায় না যে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম!
রাতের খাবার খেলাম বারোটার দিকে। ঊর্মিদের দৈনন্দিন রুটিন অনেকটা এরকম। রায়হানের রাতের শিফটে কাজ থাকে বারোটা থেকে তিনটা। সে ফিরে এলে তাদের রাত হয়। সে হিসেবে সকাল হয় দশটা এগারোটার দিকে। এদেশে ভালোভাবে থাকার জন্য খুব কষ্ট করতে হয়। আগে অভ্যাস কারো থাকে না এরকম কষ্ট করার। কিন্তু আস্তে আস্তে সিস্টেমের সাথে এডজাস্ট হয়ে যায়।
আমি হোটেলে চলে যাবো শুনেই মন খারাপ করে ফেললো ঊর্মি আর রায়হান। বিদেশে এতোদিন থাকার পরেও এরা একটুও প্র্যাকটিক্যাল হয়নি এখনো। আমি কাল দুপুরে চলে যাবো। আজ তাদের দেখে গেলাম। কাল সকালে ক্যানবেরা ঘুরবো নিজের মতো করে। কিন্তু তারা কিছুই বুঝতে চাচ্ছে না। ঊর্মিটা বরাবরই খুব চাপা। নিজের কষ্টের কথা সে কাউকেই বলে না। এখন তার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি আমি তাদের বাসায় রাতে থাকছি না এটা সে মেনে নিতে পারছে না। তার মামা তার শহরে এসে হোটেলে থাকবে এটা তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তাকে বলি আমার নিজের অসুবিধার কথা, আবার এক সময় এসে বেড়িয়ে যাবার কথা।
রায়হান ফোন করে ট্যাক্সি ডেকে দেয়। আমার খুব কষ্ট হয় তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। কষ্ট তাড়াতে আলাপ জমাই ট্যাক্সিওয়ালার সাথে। দশ মিনিটেই আমাকে পৌঁছে দেয় লেবানিজ ট্যাক্সিওয়ালা।
           
হোটেলের বামদিকে ‘এ’ ব্লকে আমার ঘর। গেটের চাবি আর রুমের চাবি আলাদা। আমার রুম একদম ভিতরের দিকে। রুমে ঢুকে বিছানায় ছুঁড়ে দিলাম নিজেকে। মনে হচ্ছিলো শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়বো। কিন্তু হলো উল্টো। বিছানায় আরামে শুলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুম পালালো। দিনের বেলায় খুব গরম লাগলেও এখন বেশ ঠাণ্ডা। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড শীত পড়ছে। ক্যানবেরায় শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাসে চলে যায়। এখন প্রচণ্ড গ্রীষ্মকালেও দেখি শীতকালের ঠাণ্ডা। পাশের রুম থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। হাসির সাথে সাথে প্রচণ্ড দাপাদাপি। হয়তো নিউ ইয়ার্স সেলিব্রেশান চলছে। আমার মন ঘুরে ফিরে চলে যাচ্ছে আবারো বাংলাদেশে। মনের উপর জোর খাটানো যায়। কিন্তু কতক্ষণ? 
______________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts