যে রোগের কাছে
পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা
আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীর প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন
মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন।
পৃথিবীর সব
দেশে ক্যান্সার রোগীর বিস্তারিত পরিসংখ্যান রাখার ব্যবস্থা আছে। তবুও অনেক দেশে অনেক
মানুষ ক্যান্সার রোগে মারা যায় – রোগ শনাক্ত হবার আগেই। তাদের সংখ্যা পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত
হয় না। ক্যান্সার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা – ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ
অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র ২০২২
সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। শুধুমাত্র এই এক
বছরেই সাতানব্বই লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে ক্যান্সারে [১]।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি
এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে। তার সরাসরি
প্রভাব পড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যায়। দেখা যাচ্ছে মানুষ যত দীর্ঘজীবী হচ্ছে, বয়স্কদের
মধ্যে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছরই ক্যান্সার
রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বর্তমান পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ধারণা
করছেন ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বছরে দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ
হারে বাড়বে, আর ক্যান্সারে মৃত্যু হবে প্রায় এক কোটি বিশ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর। ২০৪০
সালের মধ্যে এই হার আরো বেড়ে যাবে। তখন বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত
হবে, আর দেড় কোটিরও বেশি ক্যান্সার রোগি মারা যাবে। ২০৫০ সালে এই হার আরো বাড়বে। বছরে
প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হবে – আর মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে শতকরা
পঞ্চাশেরও বেশি। তার মানে প্রতি দুই জন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে একজন মারা যাবে। এই সংখ্যা
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মুখে চড় মারার মতোই অপমানজনক।
এক সময় মনে
করা হতো ক্যান্সার ধনীদের রোগ। গত শতাব্দীর পরিসংখ্যান থেকেও এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া
যায়। আফ্রিকা মহাদেশের দরিদ্র কোন দেশের ক্যান্সার রোগীর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যান্সার
রোগীর শতকরা হার অনেক বেশি। তার একটি প্রধান কারণ ছিল – আফ্রিকার জনগণের গড় আয়ু ছিল
অস্ট্রেলিয়ার জনগণের গড় আয়ুর চেয়ে অনেক কম। ফলে ক্যান্সার হবার গড় বয়সে পৌঁছানোর অনেক
আগেই আফ্রিকার মানুষ অন্য কোন নিরাময়যোগ্য রোগে মারা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পৃথিবী অনেক
বদলে গেছে। বৈশ্বিক উন্নয়নের সুফল এবং পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ
দেশেই এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। এখন ক্যান্সার আর শুধুমাত্র বড়লোকের রোগ নয়।
কিন্তু সমস্যা
রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। ক্যান্সার রোগের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা ভীষণ প্রযুক্তিনির্ভর
এবং ব্যয়বহুল বলে ক্যান্সার চিকিৎসা এখনো সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে
ধনীদেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার দরিদ্রদেশের ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হারের চেয়ে
অনেক কম।
২০২২ সালে বাংলাদেশে
নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার। আর একই বছর ক্যান্সারে প্রাণ
হারিয়েছেন প্রায় এক লক্ষ সতের হাজার মানুষ। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করার ব্যাপারে
নানারকম অসুবিধা আছে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বিভিন্ন কারণে খুবই নাজুক। অনেক রোগীই
ক্যান্সারে মারা যান ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার আগেই, অথবা একেবারে শেষ পর্যায়ে শনাক্ত
হওয়ার পর। তাই বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর বার্ষিক মৃত্যুর হার সত্তর শতাংশেরও বেশি।
ক্যান্সার রোগের
যে কোনো চিকিৎসা নেই – তা নয়। এই রোগের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা আছে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য
সংখ্যক রোগী সুস্থও হচ্ছে। কিন্তু এই রোগের প্রধান সমস্যা হচ্ছে – এই রোগ হবার মূল
কারণ এখনো অজানা। সেজন্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করারও সুনির্দিষ্ট কোনো উপায় এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা
খুঁজে বের করতে পারেননি। মূল কারণ অজানা বলেই – ক্যান্সারের প্রতি মানুষের প্রচন্ড
ভীতি যেমন রয়েছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে নিত্যই প্রচারিত হচ্ছে নানারকম মতামত। যে মতামতের
বেশিরভাগই এখনো অমীমাংসিত।
ক্যান্সার রোগের
মূল কারণ শনাক্ত করা না গেলেও ক্যান্সার রোগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে যেটুকু বলা যায়
– সেটুকু হলো – ক্যান্সার কোনো জীবাণুবাহিত রোগ নয়। ক্যান্সার হলো কোষঘটিত রোগ। স্বাভাবিক
কোষ শরীরের ভেতর ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা
জানতে পারলেও কোনো স্বাভাবিক কোষ কখন ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হবে তা বলা যায় না।
ক্যান্সার কোষের রূপান্তর বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমান করা গেলেও – কেন এই রূপান্তর ঘটে তা
এখনো অজানা।
কোষের কর্মপদ্ধতি
লেখা থাকে তার ডিএনএ-তে। দেখা যায় স্বাভাবিক কোষ এবং ক্যান্সার কোষের ডিএনএ-তে পার্থক্য
থাকে। কোষের ডিএনএ-র অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক কোষের কাজকর্ম অস্বাভাবিক
হয়ে ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। ক্যান্সার কোষ তখন দেহের স্বাভাবিক জৈবনির্দেশ মেনে চলে
না। একটি স্বাভাবিক কোষ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজনের পর স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ
করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ স্বাভাবিক মৃত্যুনির্দেশিকা মেনে চলে না। তাই ক্যান্সার
কোষকে যেকোনো উপায়ে মেরে ফেলাই হলো ক্যান্সার চিকিৎসার মূল ভিত্তি।
ক্যান্সার চিকিৎসার
প্রচলিত পদ্ধতিগুলির মধ্যে প্রধান পদ্ধতি হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিয়েশান প্রয়োগ
করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা। কীভাবে এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ক্যান্সার কোষযুক্ত টিউমারে
পাঠানো হবে – তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে ক্যান্সার চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি।
বেশিরভাগ ক্যান্সার
রোগীকে ক্যামোথেরাপি দেয়া হয়। ক্যামোথেরাপিতে রাসায়নিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ শরীরে প্রবেশ
করিয়ে ক্যান্সার কোষে পাঠানো হয়। যদি সার্জারি করে ক্যান্সার টিউমার অপসারণ করা সম্ভব
হয় – তাহলে সার্জারি করা হয়। অর্ধেকের কাছাকাছি রোগীকে শরীরের বাইরে থেকে রেডিয়েশান
দেয়া হয় – যাকে রেডিওথেরাপি বলা হয়। রেডিওথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসার দীর্ঘদিনের নির্ভরযোগ্য
পদ্ধতি।
ক্যান্সার কোষকে
ধ্বংস করে ক্যান্সার নির্মূল করার ব্যাপারটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যান্সার কোষগুলির
স্বাভাবিক কোষের সাথে মিলেমিশে থাকার কারণে। সবগুলি ক্যান্সার কোষকে একসাথে ধ্বংস করে
ফেলা সম্ভব হচ্ছে না – কারণ তাতে ক্যান্সার কোষের আশেপাশে থাকা স্বাভাবিক কোষগুলিও
ধ্বংস হয়ে যাবে। শরীরের স্বাভাবিক কোষ যদি অতিমাত্রায় ধ্বংস হয়ে যায় – তাহলে শরীরের
স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়ে রোগীর হিতে বিপরীত হবে। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে রেডিওথেরাপি
এমনভাবে দেয়া হয় – যেন ক্যান্সার কোষগুলি ধ্বংস হয়, কিন্তু স্বাভাবিক কোষগুলির কার্যক্রম
অটুট থাকে [২]।
রেডিয়েশানের
ক্ষতিকর দিক থেকে স্বাভাবিক কোষগুলিকে রক্ষা করার জন্য প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে ক্যান্সার
কোষ ও স্বাভাবিক কোষের কিছু জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যকে কাজে লাগানো হয়। যেমন স্বাভাবিক
কোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-কে সারিয়ে তুলতে পারে যদি তাদের পর্যাপ্ত সময়
দেয়া হয়। প্রচলিত রেডিওথেরাপি পদ্ধতিতে তাই একসাথে অধিক মাত্রায় রেডিয়েশান প্রয়োগ করার
পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময় পরপর কম মাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগ করা হয়। একবার রেডিয়েশান
দেয়ার পর থেকে আরেকবার রেডিয়েশান দেয়ার আগ পর্যন্ত যে সময় (সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা)
– সেই সময়ে ক্যান্সার কোষের সাথে যেসব স্বাভাবিক কোষ রেডিয়েশানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে – তারা নিজেদের সুস্থ করে নিতে পারে (ডিএনএ সংশোধন)। ক্যান্সার কোষগুলির সাধারণত
সেই ক্ষমতা থাকে না।
ক্যান্সার কোষগুলিতে
সাধারণত অক্সিজেন প্রবাহের পরিমাণ থাকে স্বাভাবিক কোষগুলির চেয়ে কম। অক্সিজেন প্রবাহ
কম থাকলে রেডিয়েশানের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে হাইপোক্সিক বা কম অক্সিজেনযুক্ত ক্যান্সার
কোষ ধ্বংস করতে গেলে যে মাত্রার রেডিয়েশান দিতে হবে – সেই মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক
কোষগুলি অনেক বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে বলে রেডিয়েশানের মাত্রা কম রাখতে হয়। ফলে রোগীর
চিকিৎসা করতে হয় দীর্ঘদিন এবং খরচ ও ভোগান্তিও বেড়ে যায়।
রেডিওথেরাপিকে
আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। কিছুটা সুফল পাওয়া গেলেও তেমন কোন
যুগান্তকারী পরিবর্তন সেখানে ঘটেনি। কিন্তু সম্প্রতি ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি নামে এক নতুন
ধরনের অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে ক্যান্সার চিকিৎসায় অস্বাভাবিক সুফল পাওয়ার
সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা [৩,৪]।
ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি
এমন একটি প্রযুক্তি যা অতিস্বল্প সময়ে (মিলিসেকেন্ডের মধ্যে) অতি উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন
(সেকেন্ডে চল্লিশ গ্রের অধিক) শরীরে প্রয়োগ করে। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে মাত্র কয়েক
গ্রে রেডিয়েশান দিতে যেখানে কয়েক মিনিট সময় লাগে, সেখানে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি মাত্র এক সেকেন্ডেরও
কম সময়ে নির্ধারিত ডোজ প্রয়োগ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই দ্রুতগতির অতিউচ্চমাত্রার
রেডিয়েশন স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি কমিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে
পারে। প্রশ্ন হলো - কীভাবে? যেখানে খুব কম
মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেখানে অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান
স্বাভাবিক কোষ কীভাবে সহ্য করবে?
ইঁদুর ও শূকরের
উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে এটি কার্যকরভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং
স্বাভাবিক কোষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো একজন মানুষের
উপর পরীক্ষামূলকভাবে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র,
ফ্রান্স ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিত কার্যকারিতা
যাচাইয়ের জন্য। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতবাদ পরীক্ষা করে দেখছেন ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে
স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে।
অতি অল্প সময়ে
অতিমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য
যে তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন সেটা হলো অক্সিজেন হ্রাস তত্ত্ব বা অক্সিজেন ডিপ্লেশান
হাইপোথিসিস।
প্রচলিত কম
মাত্রার রেডিওথেরাপিতে রেডিয়েশান জৈবকোষে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফ্রি র্যাডিক্যাল
তৈরি করে। কোষে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এই ফ্রি র্যাডিক্যাল ক্ষতিকর পার-অক্সাইডে পরিণত
হয় যা ডিএনএর ক্ষতি করে। কোষে উপস্থিত অক্সিজেন ডিএনএর এই ক্ষতিকে স্থায়ী ক্ষতে পরিণত
করে – ফলে কোষ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু কোষে যদি
অক্সিজেন কম থাকে বা না থাকে, এই ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যালগুলি ডিএনএর স্থায়ী কোন
ক্ষতি করতে পারে না। ফলে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই অস্থায়ী
ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, ডিএনএ নিজে নিজে সংশোধিত হয়ে যায়।
ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে
মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অনেক বেশি মাত্রার রেডিয়েশন দেয়া হয়। এই উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন
বিপুল পরিমাণে ফ্রি র্যাডিক্যাল তৈরি করে, যা মুহূর্তেই চারপাশের অক্সিজেন খরচ করে
ফেলে। অক্সিজেন এত দ্রুত শেষ হয়ে যায় যে কোষগুলিতে সাময়িকভাবে অক্সিজেনস্বল্পতা
বা হাইপোক্সিয়া তৈরি হয়। এতে স্বাভাবিক কোষে পারঅক্সাইড কম তৈরি হয় এবং ডিএনএ কম
ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু টিউমার কোষ সাধারণত আগে থেকেই কিছুটা হাইপোক্সিক থাকে, তাই
ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির এই অক্সিজেন কমিয়ে ফেলার প্রভাবে তারা খুব একটা প্রভাবিত হয় না।
ইঁদুরসহ অন্যান্য
কিছু প্রাণির উপর পরীক্ষা করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি নতুন
বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেদিনে পথ এখনো অনেক বাকি। কারণ বিভিন্ন
কোষে অক্সিজেনের শোষণ করার ক্ষমতা এবং পদ্ধতি ভিন্ন। মানুষের কোষের সাথে রেডিয়েশান
যেভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে, অন্যান্য প্রাণির কোষের সাথে সেই মিথষ্ক্রিয়া হুবহু এক নয়।
ভিন্ন ভিন্ন কোষের রেডিয়েশান সংবেদনশীলতাও ভিন্ন। তাই অক্সিজেন হ্রাসের এই তত্ত্ব এখনো
সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
তাছাড়া এই তত্ত্ব
প্রমাণিত হলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে এই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করতে গেলে এখনো বেশি
কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এত উচ্চ হারে রেডিয়েশান প্রয়োগ করার ক্ষমতাসম্পন্ন
প্রযুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে যে লিনিয়ার এক্সিলারেটর ব্যবহার করা
হয় – তা দিয়ে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি অসম্ভব। দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা হলো – এত উচ্চ হারের
রেডিয়েশান মাপার মতো বিশ্বাসযোগ্য ডোসিমিটার এখনো তৈরি হয়নি। ডোসিমিটার ছাড়া কোনো রোগীকেই
সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিয়েশান দেয়া সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত খরচ হিসেবে ধরলে ফ্ল্যাশ
রেডিওথেরাপির চিকিৎসায় খরচ পড়বে প্রচলিত রেডিওথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ক্যান্সার
চিকিৎসা আবারো ধনীদের হাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে।
এই সীমাবদ্ধতাকে
স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি ভবিষ্যতের ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি
বিপ্লব ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যেসব ক্যান্সার শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গে হয় (যেমন: মস্তিষ্ক,
ফুসফুস)। গবেষণা সফল হলে এটি দ্রুত সময়ে, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, কার্যকর চিকিৎসার
সুযোগ সৃষ্টি করবে।
তথ্যসূত্র
১। গ্লোবাল
ক্যান্সার অবজারভেটরি, ক্যান্সার টু ডে, ২০২৪।
২। প্রদীপ দেব,
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ঢাকা ২০২৩।
৩। ফ্রনটিয়ার্স
ইন অনকোলজি, ভল্যুম ৯, আর্টিক্যাল ১৫৬৩, জানুয়ারি ২০২০।
৪। অনকোলজি
লেটারস, ভল্যুম ২৮, সংখ্যা ৬০২, ২০২৪।
বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত