Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ৫



মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ

১৯০৩ সালের শুরুতে চৌদ্দ বছর বয়সে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হলো রামন। তার বড়ভাই সুব্রাহ্মণ্য এক বছর আগে থেকেই এই কলেজে পড়ছে। থাকে হোস্টেলে। রামন এসে যোগ দিলো সেখানে।
            ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর জন্য ইংরেজরা প্রথম প্রেসিডেন্সি কলেজ স্থাপন করে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর কলকাতায়। তার বেশ কয়েক বছর পর দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় মাদ্রাজে (বর্তমান নাম চেন্নাই)। শুরু থেকেই এই কলেজে সব অধ্যাপক ও প্রশাসনিক অফিসারের পদগুলো ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ভারতীয়দের নিয়োগ করা হতো শুধুমাত্র তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে। উচ্চশ্রেণির পদে কোন ভারতীয়কে নিয়োগ করলেও তাদের বেতন দেয়া হতো একই পদে কর্মরত ইংরেজদের বেতনের অর্ধেক বা তার চেয়েও কম।
            ১৯০৩ সালে রামন যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে তখন সেখানে সব শিক্ষকই ছিলেন ইংরেজ। পুরো কলেজে রামন ছিল বয়সে সবার চেয়ে ছোট। চৌদ্দ বছরের বালক রামনের শরীর ছিল বয়সের তুলনায় আরো ছোট। লিকলিকে হাত-পা আর শরীরের তুলনায় বড় একটা মাথা - পাগড়ি অথবা টুপিতে ঢাকা।
            প্রথমদিন ইংরেজি ক্লাসে প্রফেসর ই এইচ এলিয়ট চোঙার মত করে পরা ধুতি, মাথায় ছোট্ট একটা টুপি, খালি-পা রোগা-পটকা কুচকুচে কালো চৌদ্দ বছরের এই বালককে বি-এ ক্লাসে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, খোকা, তুমি কি বিএ ক্লাসের ছাত্র?
            "ইয়েস স্যার।"
            "তোমার বয়স কত?"[1]
            "চৌদ্দ"
            অধ্যাপকদের সময় লাগলো না রামনের মেধার পরিচয় পেতে। কিছুদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকরা বুঝতে পারলেন এমন মেধাবী ছাত্র তাঁরা তাঁদের শিক্ষকতা জীবনে আগে দেখেননি কখনো।[2] পদার্থবিজ্ঞানের অনেক অধ্যাপক বুঝতে পারলেন রামনকে নতুন কিছু শেখানোর মত যথেষ্ট বিদ্যা তাঁদের ঘটে নেই।


প্রেসিডেন্সি কলেজে সহপাঠীদের সাথে রামন (পেছনের সারিতে সবার ডানে)


গ্রীষ্মের ছুটিতে রামন যখন বাড়িতে এলো, তার বাবা খেয়াল করে দেখলেন যে রামন আরো অনেক শুকিয়ে গেছে। নিজের শরীরের যত্ন সে তখনো নিতে শিখেনি। পড়াশোনা আর বিজ্ঞানের প্রতি তার ভালোবাসা এত বেশি যে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করার কথাও তার মনে থাকে না।
            রামনের মা বেশিরভাগ সময়েই কোলের শিশু সামলাতে ব্যস্ত থাকতেন। তারপর সেই শিশুর বয়স দু'বছর হতে না হতেই আবার গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। তাই রামনের দেখাশোনা করতেন তার দাদী। রামনের বাবা ঠিক করলেন রামন ও সুব্রাহ্মণ্যকে আর হোস্টেলে রাখবেন না। তিনি মাদ্রাজে একটি বাসা ভাড়া করলেন তাদের জন্য।
            প্রেসিডেন্সি কলেজের কাছে ঈশ্বরদাস লালা স্ট্রিটে এই নতুন বাসায় রামন ও সুব্রাহ্মণ্যকে দেখাশোনা করার জন্য তাদের দাদা-দাদী এবং বিধবা ফুফু জ্ঞানম চলে এসেছেন ত্রিচিনোপলি থেকে। রামন ও সুব্রাহ্মণ্য এখন বাসা থেকে কলেজে যায়। ক্লাসের পর রামন কলেজের সায়েন্স লাইব্রেরির সব বই দ্রুত পড়ে ফেলতে শুরু করেছে। শুধু বই নয়, ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান-সাময়িকীগুলো থেকে নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের তথ্য ও তত্ত্ব পেতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিতে সেসময় বিজ্ঞান-সাময়িকী খুব বেশি ছিল না।
            অচিরেই রামন আবিষ্কার করে ফেললো যে মাদ্রাজ শহরে আরো একটি চমৎকার লাইব্রেরি আছে; কনিমারা (Connemara) লাইব্রেরি। ব্রিটিশরা এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৬ সালে। রামন যখন মাদ্রাজে আসে তখনো এই লাইব্রেরিটি নতুন। পরিকল্পনা ছিলো সেই সময় সমগ্র ব্রিটেনে যত বই প্রকাশিত হবে তার সবগুলোর কপি এই লাইব্রেরিতে থাকবে। ১৮৯৬ সালের আগে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর কপিও আস্তে আস্তে সংগ্রহ করা হবে। ইংল্যান্ডের হেইলিবারি (Haileybury) কলেজের লাইব্রেরি থেকেও অনেক বই পাওয়া গেলো কনিমারা লাইব্রেরির জন্য। হেইলিবারি কলেজে উপমহাদেশের ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের জন্য। রামন এই লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠলো।
            লাইব্রেরি ছাড়াও রামন ঘুরে বেড়াতো পুরনো বইয়ের দোকানে। মাদ্রাজের মুর মার্কেট ছিল পুরনো জিনিসপত্রে ঠাঁসা। সেখানে টুলের উপর স্তূপ করে সাজিয়ে রাখা হতো পুরনো বই। ব্রিটিশ সৈন্য ও অফিসাররা ইন্ডিয়ায় পোস্টিং শেষে ব্রিটেনে চলে যাবার সময় তাদের সব বই ম্যাগাজিন ফেলে চলে যেতেন। সেগুলো সব বিক্রি হতো এখানে। রামন এখানে প্রচুর বৈজ্ঞানিক সাময়িকী পেয়ে গেলো যেগুলো প্রায় নতুনই বলা চলে।
            তখনকার যুগে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে নামী গবেষণা-সাময়িকী ছিল ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন (Philosophical Magazine)। প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিতে তখনো ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন পাওয়া যেতো না। রামন ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনের অনেকগুলো পুরনো সংখ্যা পেয়ে গেলো মুর মার্কেটে। আর নতুন সংখ্যাগুলো পেলো কনিমারা লাইব্রেরিতে। পনেরো বছরের বালক রামন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা-প্রবন্ধ পড়তে শুরু করলো গভীর আনন্দে। শুধু তাই নয়, পড়তে পড়তে নিজের গবেষণার অসংখ্য ধারণা এসে ভীড় করতে লাগলো তার মাথায়। নোটবইতে টুকে রাখতে শুরু করলো সে। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে তার প্রথম গবেষণার ফলাফল সে প্রকাশ করবে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে। কিন্তু তার আগে তাকে বিএ পাস করতে হবে।
            ইতোমধ্যে রামনের বড় ভাই সুব্রাহ্মণ্য বিএ পাস করে মাদ্রাজ থেকে বিশাখাপট্টমে চলে গেছেন। সেখানে বাড়িতে বসে নিজে নিজে পড়াশোনা করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
            ১৯০৪ সালে ষোল বছর বয়সে বিএ পাস করলেন রামন। পরীক্ষায় প্রথম হলেন তো বটেই, স্বর্ণপদক পেলেন পদার্থবিজ্ঞান ও ইংরেজিতে। রামনের কৃতিত্বের জন্য দেয়া হলো এলফিনস্টোন মেডেল ও জাগিরদার মেমোরিয়েল গোল্ড মেডেল। অধ্যাপকরা রামনের ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। কেউ বলেন, "আমার ত্রিশ বছরের অধ্যাপনাজীবনে এত ভালো ছাত্র আগে দেখিনি", কেউ বলেন, "ইংরেজি সাহিত্যে বিস্ময়কর দখল আছে রামনের।"
            সেই সময় স্নাতক পাস করার পর সব মেধাবী ছাত্রদের লক্ষ্য থাকতো ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের দিকে। ইংরেজরা উপমহাদেশে তাদের রাজত্ব কায়েম রাখার জন্য ভারতীয় অফিসার নিয়োগ করতেন এবং সেই অফিসারদের মনে ব্রিটিশ মনোভাব রোপণ করার লক্ষ্যে এই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার আগে লম্বা ট্রেনিং দেয়া হতো ইংল্যান্ডে। তারপর পরীক্ষা হতো সেখানে। পাস করতে পারলে প্রচুর বেতন ও সুযোগ-সুবিধা সহ উঁচুপদে প্রশাসনিক চাকরি।
            রামনেরও এই সময় টাকার খুব দরকার। তার নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য। তার দাদা এক বছর ধরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হবার জন্য পড়াশোনা করার পর সেই সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে আবার মাদ্রাজে ফিরে এসেছেন। মাদ্রাজের আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে আরেকটা বাসা নেয়া হয়েছে কিছুটা কম ভাড়ায়। তাদের এখন খরচ কমানো দরকার। কারণ বছরখানেক বাড়িতে থেকে সুব্রাহ্মণ্য দেখেছেন তার বাবার কত কষ্ট হচ্ছে সংসার চালাতে। সেই সময় তাদের বাবার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৮৫ রুপি। বছর কয়েক পর কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল হয়ে বেতন পান মাসে ১২৫ থেকে ১৭৫ রুপির স্কেলে। অথচ ততদিনে তাঁর সাতজন ছেলেমেয়ে। সাথে আছেন নিজের মা-বাবা এবং বিধবা পিসি। রামনের স্কলারশিপের টাকায় পড়ার খরচ মিটে গেলেও বাসা ভাড়া সব মিলিয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। পূর্বপুরুষের একশ একর জমির অবশিষ্ট আছে মাত্র সাড়ে ছয় একর। বাকি সব ঋণের দায়ে বন্ধক রাখা হয়ে গেছে। রামনের বাবা বাড়িতে ভালো ভালো যেই বইগুলো ছিল সেগুলোও বিক্রি করে দিতে শুরু করেছেন। কলেজের দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি দিনে তিন-চারটা টিউশনি করছেন।
            রামন সংসারের কোন খবরই রাখেন না। বড়ভাইয়ের কাছে এসব শুনে তার যে খুব কষ্ট হয়েছে তাও বলা যাবে না। কারণ সংসারে কিছুদিন পরপরই তার ভাই-বোন জন্মাচ্ছে এই ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগছে না। তবুও তার মনে হলো সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলা যায়। তার প্রফেসররাও পরামর্শ দিচ্ছেন বিলেতে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে। তাঁরা নিশ্চিত রামন আই-সি-এস হবেই। রামনও নিশ্চিন্ত সে ব্যাপারে। রামন সবকিছুতে ভালো করছেন, তাই তার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি।



প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র রামন


   
উপমহাদেশ তখনো ইংল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। ১৯২০ সালের আগে কোন পাসপোর্ট সিস্টেমও ছিল না। প্রাথমিক কিছু কাগজপত্র সাথে থাকলেই হতো। কাগজপত্রের মধ্যে সবচেয়ে দরকারি ছিল সিভিল সার্জনের ছাড়পত্র। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলে ব্রিটেনে যেতে দেয়া হতো না ভারতীয়দের। রামন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গেলেন মাদ্রাজের সিভিল সার্জনের অফিসে। সিভিল সার্জন রামনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সরাসরি বলে দিলেন, এই শরীর নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলে আর ফিরে আসতে হবে না। ওদেশের আবহাওয়া গায়ে লাগলেই মরে যাবে রামন। রামনের ইংল্যান্ড যাওয়া হলো না। ইংল্যান্ড যেতে না পারার জন্য অনেক বছর পর রামন এই সিভিল সার্জনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন আই-সি-এস হলে বিজ্ঞানের এত রহস্য আবিষ্কার করার আনন্দ থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন।
            আই-সি-এস পরীক্ষা দেয়া যাচ্ছে না যখন তখন পড়াশোনাই করা যাক। প্রেসিডেন্সি কলেজেই পদার্থবিজ্ঞানে এমএ-তে ভর্তি হলেন রামন। প্রথমদিন একটা লেকচার ক্লাস করলেন। তারপর পরবর্তী দুই বছরে এম-এ কোর্সের আর কোন তত্ত্বীয় ক্লাসে তিনি ঢোকেননি। প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক প্রফেসর জোন্‌স রামনকে বলে দিয়েছিলেন যে তাঁর ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেও চলবে। কারণ পদার্থবিজ্ঞানের এম-এ ক্লাসে যা পড়ানো হয় তার সবকিছুই রামনের জানা। সুতরাং ক্লাসে বসে সময় নষ্ট করার বদলে রামনের সময় কাটতে লাগলো কলেজের ফিজিক্স ল্যাবোরেটরিতে।
            প্রফেসর জোন্‌স প্রসঙ্গে রামন বলেছেন,[3] "Professor Jones believed in letting those who were capable of themselves to do so, with the result that during the four years I was at the Presidency College, I enjoyed a measure of academic freedom which seems almost incredible. To mention only one detail, during the whole of my two years' work for the MA degree, I remember attending only one lecture, and that was on the Fabry-Perot by Professor Jones himself."
            ফিজিক্স ল্যাবে কলেজ চলাকালীন যতক্ষণ খুশি কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে রামনকে। তিনি আলো নিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন। স্পেক্ট্রোমিটারের সাহায্যে প্রিজমের কোণের পরিমাপ করতে গিয়ে রামন আলোকের কিছু ব্যতিক্রমী বর্ণালী লক্ষ্য করেন। এ বর্ণালীগুলো সম্পর্কে কোন রকম ধারণা তিনি কোন বইতে পেলেন না। আলোক তত্ত্বের ওপর দুটো বই পড়েছেন রামন: থমাস প্রেসটনের 'থিওরি অব লাইট' এবং এডউইন এডসারের 'লাইট'। বইদুটো প্রকাশিত হয়েছে মাত্র চার-পাঁচ বছর আগে। কিন্তু এর মধ্যেই সেখানে বর্ণিত নিউটনের সমবর্তিত আলোর তত্ত্ব ভুল বলে মনে হচ্ছে কিংবা বইতে যেভাবে দেয়া আছে সেভাবে হবে না বলে মনে হচ্ছে। তার দরকার কিছু অপ্টিক্যাল লেন্স যেগুলো দিয়ে নিউটনের পোলারাইজড রিং পরীক্ষা করে দেখা যাবে।
            ১৯০৬ সালের জানুয়ারি মাসে রামনের দাদার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেলো। তারপর দাদা-দাদী গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। মাদ্রাজের বাসা আবার বদল করা হলো। রামনের মা বাসায় এলেন ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে। ইতোমধ্যে রামনের ছোটবোন মঙ্গলমের বিয়ে হয়ে গেছে। বড়ভাই সুব্রাহ্মণ্যেরও বিয়ে হয়ে গেছে দুবছর আগে, কিন্তু 'শান্তি কল্যাণম' অনুষ্ঠান হয়নি বলে বৌ এখনো বাপের বাড়িতে। বাসায় ছোট ভাইবোনরা রামনকে খুব ভালোবাসলেও বাসায় ছোট বাচ্চার চিৎকার-চেঁচামেচি ভালো লাগে না রামনের। তিনি যতক্ষণ পারেন কলেজের ল্যাবেই কাটান। নিজে নিজে আলোকের অনেক বিষয় পরীক্ষা করতে থাকেন।


প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান ল্যাবোরেটরি



অনেক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল একটা গবেষণাপত্র আকারে লিখে রামন পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনের ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে।  পাঁচ পৃষ্ঠার এই পেপারে নিজের পরিচয় দিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্সের ডেমোনেস্ট্রেটর হিসেবে। এম-এ পাশ করার আগেই ১৯০৬ সালের নভেম্বরে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো সি ভি রামনের প্রথম গবেষণাপত্র আনসিমেট্রিক্যাল ডিফ্রাক্‌শান-ব্যান্ডস ডিউ টু এ রেক্ট্যাঙ্গুলার অ্যাপার্চার।[4]         রামনের বয়স তখন মাত্র আঠারো। প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন সুযোগ তখন ছিল না। প্রেসিডেন্সি কলেজের কোন ছাত্র তো দূরের কথা কোন প্রফেসরেরও কোন গবেষণাপত্র এর আগে কোন বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি।

 
কলেজে সহপাঠী ও অধ্যাপকদের সাথে রামন (পেছনের সারির মাঝখানে)

১৯০৬ সালে এম-এ পরীক্ষা হয়ে গেলো। ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেলো প্রত্যাশিত ভাবেই রামন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম-এ পাশ করেছেন।
            মাত্র আঠারো বছর বয়সে রামনের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু এই আঠারো বছরের মধ্যেই তিনি পড়ে ফেলেছেন নানা বিষয়ে অসংখ্য বই যেগুলো তাঁর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হবার পথ তৈরি করতে সাহায্য করেছে। অনেক বছর পরে যেসব বই তাঁর জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে সেগুলো সম্পর্কে তিনি লিখেছেন:[5]
            "আঠারো বছর বয়সের মধ্যেই আমি আমার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছি। জীবনের এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমি চারটি ভাষা শিখেছি এবং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেক বই পড়েছি। অনেক ক্ষেত্রেই এই বইগুলি ছিল সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ মানের বই। সব বইয়ের নাম লিখতে গেলে ভীষণ লম্বা একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। এই সবগুলো বই কি আমাকে প্রভাবান্বিত করেছিল? এক অর্থে বলা চলে - করেছিল প্রভাব বিস্তার। এগুলো পড়েই আমার বিভিন্ন বিষয়ে সামান্য কিছু হলেও ধারণা জন্মেছিল। যেমন প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ইতিহাস, আধুনিক ভারত ও ইওরোপের ইতিহাস, যুক্তিবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আর্থিক তত্ত্ব এবং পাবলিক ফিন্যান্স, প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য। আর রসায়ন, প্রায় দশ বারো শাখার গণিত এবং তত্ত্বীয় ও পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের কথা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু এতসব বইয়ের মধ্য থেকে আমি কি বাছাই করে বলতে পারি ঠিক কোন বইগুলো আমার মানসিক গঠনে ভূমিকা রেখেছে এবং আমি আমার জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পেরেছি? আমি বলবো, হ্যাঁ, আমি তিনটি বইয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি।"
            রামন যে তিনটি বইয়ের কথা বলেছেন সেগুলো হলো: এডউইন আর্নল্ড এর 'দি লাইট অব এশিয়া' (The Light of Asia), ইউক্লিডের 'দি ইলেমেন্টস' (The Elements), এবং হারম্যান ভন হেল্‌মহল্টজ-এর 'দি সেন্সেশান অব টোন' (The Sensation of Tone)।
            লাইট অব এশিয়া বই পড়ে তিনি গৌতম বুদ্ধের আত্মত্যাগে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হন। মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের স্ত্রী, পুত্র, রাজত্ব সব ছেড়ে পরম সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন সিদ্ধার্থ। রামন নিজের জীবনে এই গৌতম বুদ্ধের প্রভাব দেখতে পান। বিজ্ঞান যে মানুষের পরম কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে এবং সেই বিজ্ঞানকে যে কোন রকম ধ্বংসাত্মক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয় তা বারে বারে বলেছেন রামন সারাজীবন ধরে।
            ইউক্লিডের 'দি ইলেমেন্টস' রামনদের পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জ্যামিতি যে আমাদের জীবনে কত প্রয়োজন এবং আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে তা রামন বুঝতে পেরেছিলেন এই বই থেকে। রামন ইউক্লিডের এই বইটার প্রতিটি পৃষ্ঠাকে তুলনা করেছেন প্রকৃতির গ্রান্ড অপেরার সঙ্গীতের সাথে: "The pages of Euclid are like the opening bars of the music of the grand opera of Nature's great drama."
            রামনের ক্রিস্টাল ও হীরার গবেষণায় জ্যামিতির ভূমিকা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। তিনি যে পদার্থের গঠনের জ্যামিতিক সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছিলেন তার গোড়াপত্তন হয়েছিল ইউক্লিডের বই থেকে।
            রামনের ষাট বছরেরও বেশি গবেষণা-জীবনের অনেক বছর কেটেছে শব্দ তরঙ্গ ও বাদ্যযন্ত্রের সুর নিয়ে গবেষণায়। রামনের বাবা সঙ্গীত ভালোবাসতেন, ভালো বেহালা বাজাতেন। বড় ভাইও বেহালা বাজাতেন। তাঁরা সঙ্গীত ভালোবাসতেন, কিন্তু সুরযন্ত্রে পদার্থবিজ্ঞান খুঁজতে যাননি। আইনস্টাইনও চমৎকার বেহালা বাজাতেন। কিন্তু আইনস্টাইনের মনে বেহালার সুর কীভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন জাগেনি। তবে রামন কেন সুরযন্ত্রের শব্দ-তরঙ্গের বিজ্ঞান নিয়ে এত গভীর গবেষণা করলেন?
            এই গবেষণার মূলে ছিল হেল্‌মহল্টজ এর বই 'দি সেন্সেশান অব টোন'। মূল জার্মান ভাষায় লিখিত বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ হাতে পেয়েছিলেন রামন। তখন তিনি মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছেন। বইটি সম্পর্কে রামন বলেছেন যে এই বইতে সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে গভীর আলোচনা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভাষার চমৎকার বিন্যাস এবং প্রাঞ্জলতাও তাঁকে মুগ্ধ করেছে। এই বই থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা আসলে কীরকম এবং কীভাবে তা করতে হয়। এই বই পড়তে পড়তে তিনি নিজের অনেক গবেষণার উপাদান পেয়ে যান। পরবর্তীতে সেই গবেষণাগুলো তিনি অনেক বছর ধরে করেছেন।
            হেল্‌মহল্টজের আরো একটি ক্লাসিক বইয়ের কথা রামন জানতেন সেই সময়। কিন্তু সেই 'দি ফিজিওলজি অব ভিশান' (The Physiology of Vision) বইটির ইংরেজি অনুবাদ তখন তিনি হাতে পাননি। রামন তাঁর জীবনের শেষের বছরগুলোতে দৃষ্টির শারীরতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং একই নামে একটা গবেষণাগ্রন্থও রচনা করেছেন।
            লর্ড র‍্যালের ফিজিক্স বইও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল রামনের গবেষণায়। তাঁর নোবেলবিজয়ী আবিষ্কার রামন-ইফেক্টের সূচনা হয়েছিল সমুদ্রের পানি নীল হওয়ার কারণ হিসেবে লর্ড র‍্যালে যে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তা খন্ডনের মাধ্যমে।
            রামনের বিজ্ঞান গবেষণার প্রতি প্রবল অনুরাগ থাকলেও শুধুমাত্র নিরলস বিজ্ঞান-সাধনা করে যাবার মতো পরিবেশ বা পারিবারিক সম্পদ রামনদের ছিল না। তাই এম-এ পাস করে একটা চাকরির চেষ্টা করতে হলো।



[1] P. R. Pisharoty, C. V. Raman (Publications Division, Govt. of India, New Delhi, 1982)
[2] S. Ramaseshan, C. Ramachandra. C. V. Raman A Pictorial Biography. Bangalore: The Indian Academy of Sciences, 1988.
[3] G. Venkataraman, Journey into Light Life and Science of C. V. Raman,. New Delhi: Penguin Books, 1994. page 14.
[4] C. V. Raman. Unsymmetrical diffraction-bands due to a rectangular aperture. Philosophical Magazine 1906;12:494.
[5] C. V. Raman, Books that have influenced me, G. A. Natesan & Co. Madras, 1947. p21

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts