Sunday, 22 June 2025

মুহম্মদ নিজাম-এর “ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ”

 



মুহম্মদ নিজাম-এর চিন্তা-চেতনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, বলা যায় ঝটিকা পরিচয়, ঘটে ফেসবুকে তাঁর হ্রস্ব অথচ টাইফুনের শক্তিসম্পন্ন পোস্ট দেখে। ইতোমধ্যে অনেকগুলি গল্প, উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এই তরুণ লেখক। তাঁর বইগুলি পড়ার জন্য এক ধরনের অস্থির তাগিদ অনুভব করছিলাম অনেকদিন থেকে।

 প্রবাসের পাঠকদের এখন আর আগের মতো খরায় কাটাতে হয় না। অনলাইনে এখন হাজার হাজার বই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কপিরাইটের দফারফা করে ছেড়ে দেয়া জাতি আমরা। কিন্তু লেখকের প্রতি পাঠকের দায়বদ্ধতা থেকে যারা আমরা বই কিনে পড়তে চাই – তাদের জন্য আমাদের দেশে এখনো আন্তর্জাতিক ডেলিভারির ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের অপেক্ষা করতে হয় – কখন দেশ থেকে কেউ আসবে, যে নিজের ব্যাগের মূল্যবান আয়তন এবং ভর ধার দিয়ে কয়েকটা বই নিয়ে আসবে সাথে করে।




মুহম্মদ নিজামের সবগুলি বই না হলেও – বেশ কিছু বই সংগ্রহ করতে পেরেছি। তালিকা এবং প্রকাশকাল দেখে দেখে প্রথম বই দিয়েই তাঁর বই পড়তে শুরু করলাম।

“ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ” এর কাহিনি প্রচলিত উপন্যাসের কাহিনি থেকে বেশ ভিন্ন। এখানে মানবমনের চিন্তাজগতে হানা দেয়া হয়েছে, তবে শীর্ষেন্দুর মানবজমিনের মতো ঘটনার ঘনঘটা ঘটিয়ে কোনকিছুই জট পাকিয়ে দেননি লেখক। কেন্দ্রিয় চরিত্র মিথুন – নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করেছে এখানে বিভিন্নভাবে। মনের কথা পাঠকের সাথে শেয়ার করার যে কৌশল লেখক এখানে ব্যবহার করেছেন তা বেশ সংযমের সাথে করেছেন। সংযম আর পরিমিতিবোধের কারণেই – গভীর তত্ত্বগুলিও হয়ে উঠেছে উপভোগ্য।

এই বই আমার খুবই ভাল লেগেছে। গল্প-উপন্যাস পড়ে ভালো লাগার কিংবা না লাগার ব্যপারটি পাঠকের নিজস্ব। সেখানে পাঠকের আবেগ কাজ করতে পারে, কাজ করতে পারে ব্যক্তিগত অনুভূতি, কিংবা নীতিবোধ। পাঠকের চিন্তার সাথে লেখকের সৃষ্ট কোন চরিত্রের চিন্তা মিলে গেলেও পাঠক ভালোবেসে ফেলে সেই চরিত্রকে। আমার ভালো লাগার প্রধান কারণ এই উপন্যাসের মূল বিষয়।

বইয়ের কেন্দ্রে বসে আছে যে তরুণ – মিথুন – গভীর চিন্তক। তরুণ বয়সেই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছে। চিন্তার গভীরে প্রবেশ করে একই জিনিস বিভিন্ন জনের মনের প্রতিফলন থেকে দেখতে শিখেছে। মিথুনের ভেতর তারুণ্যের তীব্র অস্থিরতার বদলে চিন্তার স্থিতধি অবস্থান আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। তার দাদা জাবের আলি – ধর্মান্ধ দলের উগ্র নেতা। জাবের আলির সাথেও মিথুনের যে স্নেহ এবং বিশ্বাসের দ্বান্দ্বিক অবস্থান উঠে এসেছে উপন্যাসে তা অনবদ্য।

এই বইতে সঠিক বিজ্ঞান আছে। লেখক এই বই যখন লিখেছেন তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইতিহাসের ছাত্র হয়েও মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস যে তিনি খোলামনে পড়েছেন এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন – তার সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে।

ঘটনার ব্যাপ্তি, চরিত্রগুলির পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সংক্ষিপ্ত কথোপকথন আমাকে মুগ্ধ করেছে। ধর্ম নিয়ে যেসব প্রশ্ন ধর্মান্ধদের উগ্রতার ভয়ে আমরা করতে পারি না, লেখক সেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন সাহসের সাথে।

“পাঁচশ বছর আগেও হয়তো এই পৃথিবীর বড় হুজুরেরা দাজ্জালের জন্ম হয়ে গেছে এবং কেয়ামত আসন্ন বলে এইভাবেই মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এখনো ছড়াচ্ছে। পাঁচশ বছর পরেও ছড়াবে।“ [পৃ ৪১]

“একজন বিশুদ্ধ মানুষ নিজে যে দুঃখ সহ্য করতে পারে না, অন্যকে সেইরকম কোনো দুঃখে পতিত হতে দেখলে অন্তরে তীব্র ব্যথাবোধ করে। মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঞ্চারিত করে যেতে পারে। এই সবই হচ্ছে মানব ধর্মের বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো যাদের রয়েছে, বিশেষ করে এক মতানুসারে তারা সবাই সনাতন ধর্মের প্রাণ। অর্থাৎ জগতের সকল মানুষই সনাতন ধর্মের মানুষ। এই মতানুসারে বর্তমান পৃথিবীতে যে ছয় বা সাতশত কোটি মানুষ রয়েছে তাদের সবাইকে সনাতন ধর্মের মানুষ বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।“ [পৃ ৪৩-৪৪] – এরকম গভীর চিন্তা করতে যেমন খোলা মনের দরকার হয়, তেমনি এই চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে দরকার হয়ে মনের গভীর সাহস। মুহম্মদ নিজামের সেই সাহস আছে।

ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করা আমাদের বহু পুরনো অভ্যেস। প্রাণভয়ে সেই অভ্যেসের প্রতি জিজ্ঞাসার আঙুল তুলতে সাহস করে না অনেকেই। মুহম্মদ নিজাম সরাসরিই বলেছেন এই উপন্যাসে, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথাটাই একবার ভেবে দেখুন। সেই সময় পাক সেনারা আদর্শগত দিক থেকে নিজেদের পবিত্র ধর্মযোদ্ধা ভেবে মনে মনে খুব আহলাদিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছে হিন্দুস্থানের দালাল, ইসলামের শত্রু। অথচ যুদ্ধকালীন নয়টা মাসে যতগুলি নিরপরাধ মানুষ মারা গিয়েছেন, যত নারী ধর্ষিত হয়েছেন – প্রায় সবকিছুই সংঘটিত হয়েছে ওদের মত মহান মহান স্বর্গীয় সৈনিকদের দ্বারা। আদর্শ নিজেই এখানে বলাৎকারের শিকার।“ [পৃ ৮৯]

এই বইতে অনেকগুলি বিষয় এসেছে যা বেশিরভাগ উপন্যাসের চরিত্রগুলি এড়িয়ে চলে। যেমন বিবর্তনবাদ, ধর্মের অলৌকিক অন্ধ বিশ্বাস। কাহিনির মিথুন অনন্য সাহস দেখিয়ে সরাসরি বলেছেন তাঁর ধর্মান্ধ দাদাকে – “আমাদের মধ্যে একটা শ্রেণি আছে যারা জোর করে কোরআনকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান-গ্রন্থ বলে জাহির করতে চায়। এটা আমার ভালো লাগে না। আমি ভাবি, গড অলমাইটি তো সবই জানেন। তিনি চাইলে নবীদের মাধ্যমে ইয়া বড় বড় পদার্থবিজ্ঞানের বই, রসায়নের বই লিখে পাঠাতে পারতেন। তা তিনি করেননি। মানুষের জন্য রেখে দিয়েছেন এবং মানুষ সেইগুলি আবিষ্কারও করছে। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানেন?” “আবিষ্কারকগণ প্রায় সবাই ইহুদী এবং খ্রিস্টান এবং নিরীশ্বরবাদী। আমরা যে চৌদ্দশ বছর ধরে কোরআন পাঠ করছি, আজ পর্যন্ত একটা যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না। একটা ভাল প্রেডিকশন করতে পারলাম না। অথচ যখনই শুনি, কেউ একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে, জোর করে তার উপর কৃতিত্ব জাহির করার হীন চেষ্টা করি। এটা কি ঠিক বলুন?” [পৃ১০৬]

“যে ধর্ম এখন আমরা পালন করছি তাতে যতটা শ্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা আছে তার চেয়ে বেশি আছে পারস্পরিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অহেতুক নিজের ভেতর কটু গন্ধময় আবর্জনা পোষণ করা।“ [পৃ ১০৭] – এই নির্মম সত্যিকথা বলার জন্য যে নির্ভয় সাহস লাগে – সেটা আছে মুহম্মদ নিজামের।

লেখকের পরিমিতিবোধ আমাকে মুগ্ধ শুধু করেনি, কিছুটা ঈর্ষান্বিতও করে তুলেছে। উর্মির সাথে মিথুনের প্রেম ভালোবাসা ঘটিয়ে দেয়ার এত সুন্দর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লেখক শুধুমাত্র তুলির একটা দুটো মানসিক টান দিয়ে পুরো ক্যানভাস খালি রেখেই ছেড়ে দিয়েছেন। প্রথম উপন্যাসেই এরকম বুদ্ধত্ব অর্জন করা সত্যিই দুরুহ।

উপন্যাসের মিথুনের মতো আমারও জেগেছে সেই মোক্ষম প্রশ্ন, “চারদিকে খেয়াল করার মতো এত ইঙ্গিত, দেখার মতো এত বিষয়, তবুও কেন চোখ মেলে তাকায় না মানুষ? কেন ভাবে না?”

বইটির প্রকাশনার ব্যাপারে কিছু কথা না বললে প্রকাশকের প্রতি অবিচার করা হবে। আমাদের বইয়ের প্রকাশনার আঙ্গিক মান যে অনেক উন্নত হয়েছে তা বোঝা যায় বইটি হাতে নিলেই। বায়ান্ন প্রকাশনীর মোহাম্মদ আল আমিন সরকার বেশ যত্ন করেই বইটি প্রকাশ করেছেন। রঙিন ছাপানো, ঝকঝকে প্রিন্ট, বানানভুল অতি সামান্য, কাগজ আকর্ষণীয়। তৃত এর প্রচ্ছদ বইয়ের শিরোনামের মতোই চিন্তাশীল।

সবমিলিয়ে চমৎকার এক বইপড়ার অনুভূতি দিলো মুহম্মদ নিজামের ‘ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ’।


Tuesday, 10 June 2025

চার প্রজন্মের বেকেরেল: প্রতিপ্রভা ও তেজস্ক্রিয়তা

 


 ১৮৯৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক বছরে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অনেকগুলি যুগান্তকারী মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে। জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী উইলহেল্‌ম রন্টজেন যখন এক্স-রে আবিষ্কার করলেন – তার সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেলেও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীরা বিপদে পড়ে গেলেন। কারণ তাঁরা তখনো জানেন না পদার্থবিজ্ঞানের কোন্‌ তত্ত্বের সাহায্যে এক্স-রে উৎপন্ন হবার কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে।

সেই সময় তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ধীর। ইলেকট্রনই আবিষ্কৃত হয়নি তখনো – ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তো দূরের কথা। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খবর তখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছানোর প্রধান উপায় ছিল ডাকবিভাগ। এক্স-রে আবিষ্কারক রন্টজেন তাঁর স্ত্রী আনার হাতের একটি এক্স-রে প্লেট তৈরি করলেন ১৮৯৫ সালের ২২ ডিসেম্বর। সেটাই ছিল কোন মানবশরীরের প্রথম এক্স-রে। এই এক্স-রে প্লেটের কপি রন্টজেন পাঠিয়েছিলেন বার্লিন, ভিয়েনা, প্যারিস, হামবুর্গ, ম্যানচেস্টার এবং স্ট্রাসবুর্গে তাঁর বিজ্ঞানী-বন্ধুদের কাছে। প্যারিসের পার্সেল এসেছিল ফরাসি গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি পয়েনকারের কাছে।  

 

A hand x-ray of a handAI-generated content may be incorrect.
প্রথম এক্স-রে

 

পয়েনকারে ছিলেন ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য। ১৮৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি বিজ্ঞান একাডেমির নিয়মিত সভায় উপস্থিত অন্যান্য ফরাসি বিজ্ঞানীদেরকে রন্টজেনের পাঠানো এক্স-রে প্লেট দেখতে দিলেন পয়েনকারে। বিজ্ঞান একাডেমির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন হেনরি বেকেরেল। তিনি এক্স-রে প্লেটটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন করলেন, “ডিসচার্জ টিউবের কোন্‌ পাশ থেকে এক্স-রে বের হয়েছে এখানে?” পয়েনকারে উত্তর দিলেন, “মনে হচ্ছে নেগেটিভ ইলেকট্রোডের বিপরীত দিকের কাচ যেখান থেকে প্রতিপ্রভা (ফসফরেসেন্স) উৎপন্ন হচ্ছে – সেখান থেকেই এক্স-রে বের হচ্ছে।“ [১]

প্রতিপ্রভা কীভাবে উৎপন্ন হয় তা ভালোভাবেই জানেন হেনরি বেকেরেল। তখনকার সময়ে প্রতিপ্রভ পদার্থ এবং প্রতিপ্রভা উৎপাদনের বিজ্ঞানে বংশানুক্রমিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন তিনি – যার শুরু হয়েছিল তাঁর পিতামহ এন্টনি-সিজার বেকেরেলের হাতে।

প্যারিসে রয়েল গার্ডেন অব মেডিসিনাল প্ল্যান্টস – ঔষধী গাছের বাগান তৈরি হয়েছিল ১৬৪০ সালে। পরবর্তী এক শ বছরের মধ্যে এই বাগানের আয়তন এবং গাছের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয় এবং সেটাকে কেন্দ্র করে একটি গবেষণা-জাদুঘর স্থাপিত হয়। ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সের এই গবেষণা-জাদুঘর ছিল বিশাল আয়োজনের একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্র। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বারোটি বৈজ্ঞানিক পদ ‘সায়েন্টিফিক চেয়ার’ তৈরি করে ফ্রান্সের প্রধান বিজ্ঞানীদের নিয়োগ করা হয় গবেষণার নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৮ সালে সৃষ্টি হয় ‘চেয়ার অব ফিজিক্স’। প্রধান পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ পান এন্টনি-সিজার বেকেরেল।

এন্টনি-সিজারের জন্ম ১৭৮৮ সালে প্যারিসের অভিজাত পরিবারে। এন্টনি-সিজারের পিতামহ ছিলেন ফ্রান্সের রাজার লেফটেন্যান্ট। বড় পদ পদবি মানুষকে ক্ষমতার পাশাপাশি আভিজাত্যও এনে দেয়। ১৮ বছর বয়সে এন্টনি-সিজারের সুযোগ হয় ‘ইকুল পলিটেকনিক’-এ ভর্তি হবার। রাষ্ট্রীয় কারিগরী বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যই এই পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট তৈরি করা হয়েছিল। লেফটেন্যান্টের নাতি হবার সুযোগে এন্টনি-সিজার সেই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে মিলিটারি-ইঞ্জিনিয়ার হবার সুযোগ পান। কিন্তু প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি তাঁর যতটা আকর্ষণ ছিল – সামরিকবিদ্যা্র প্রতি ততটা ছিল না। তাই প্রকৌশলবিদ্যা সম্পন্ন করার পর তিনি ভগ্নস্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে মিলিটারি সার্ভিস থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর শুরু হয় তাঁর স্বাধীন গবেষণা। ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত নিরলস গবেষণা করেছেন তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে। ১৮২৯ সালে তিনি ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলোশিপ পান। ১৮৩৭ সালে পেয়েছেন রয়েল সোসাইটির কোপলে মেডেল। ১৮৩৮ সালে তিনি একাডেমি অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি গবেষণা-জাদুঘরের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। প্রফেসরদের বাসা ছিল জাদুঘর কমপ্লেক্সের কাছে ঔষধী বাগানের ভেতরেই। নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য সেখানকার কিছু অব্যবহৃত ঘর এবং জায়গা নিয়ে একটি সাময়িক গবেষণাগার স্থাপন করেন। সেদিন তিনি ভাবতেই পারেননি যে এই সাময়িক গবেষণাগারেই গবেষণা করবেন তাঁর পরের আরো তিন প্রজন্ম পরবর্তী একশ বছর ধরে। অবসর গ্রহণের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় এন্টনি-সিজার নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত গবেষণায় সক্রিয় ছিলেন এবং পাঁচ শতাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। [২]

এন্টনি-সিজার বেকেরেলের পুত্র এডমন্ড বেকেরেলের জন্ম ১৮২০ সালে। তিনিও বাবার মতোই ইকুল পলিটেকনিক থেকে ইঞ্জিনিয়ার হন ১৮৩৮ সালে। মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হবার পর তিনি অনায়াসেই যেকোনো বড় সরকারি পদে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে তাঁর বাবার সহকারি হিসেবে যোগ দেন ১৮৩৯ সালে। সেই সময় প্রফেসররা তাঁদের সহকারি হিসেবে নিজেদের পছন্দের যে কাউকে নিয়োগ দিতে পারতেন। এন্টনি-সিজার তাঁর নিজের ছেলেকেই গবেষণা-সহকারির পদে নিয়োগ দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ খুলে দিয়েছিলেন। এডমন্ড বেকেরেল কঠোর পরিশ্রমী বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর বাবার সাথে যৌথভাবে তিনি অনেকগুলি বই এবং গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৮৫২ সালে এডমন্ড প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন ফ্রান্সের ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্‌ট ইন্সটিটিউটে। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছিল বিভিন্ন কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলির কলকব্জা এবং ব্যবহার-প্রণালী জনগনের কাছে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে। পরে সেটাকে একটি পূর্ণাঙ্গ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়। এখানে তাঁর সহকারি ছিলেন বিজ্ঞানী গ্যাস্টন প্লান্টে। গ্যাসটন পরবর্তীতে লেড ব্যাটারি উদ্ভাবন করেছিলেন।

১৮৬৩ সালে এডমন্ড বেকেরেল ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন এবং ক্রমে ১৮৮০ সালে একাডেমির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তখনো তাঁর বাবা বেঁচেছিলেন এবং বিজ্ঞান একাডেমিতে তাঁর প্রভাব ছিল সীমাহীন। ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত বাবা-ছেলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে একাডেমির ফিজিক্স সেকশান। ১৮৭৮ সালে এডমন্ডের বাবা এন্টনি-সিজারের মৃত্যু হলে জাদুঘর-গবেষণাগারের ফিজিক্স চেয়ারে দায়িত্ব এসে পড়ে ছেলে এডমন্ডের হাতে। এডমন্ড বেকেরেল গবেষণা করেছেন আলোর বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাব সম্পর্কে। আলোর বর্ণালীতত্ত্বের গবেষণার অগ্রদূত ছিলেন এডমন্ড বেকেরেল। সূর্যের আলোর অতিবেগুনি রশ্মি সম্পর্কে অনেক গবেষণা করেছেন তিনি। তাঁর ছেলে হেনরি বেকেরেলের মধ্যে প্রতিপ্রভা পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। [৩]

এডমন্ড বেকেরেলের ছেলে হেনরি বেকেরেলের জন্ম ১৮৫২ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাদুঘর-গবেষণাগারের প্রফেসরস কোয়ার্টারে। সেই কোয়ার্টারে তখন তাঁর পূর্ববর্তী দুই প্রজন্মের পদার্থবিজ্ঞানী পিতামহ এন্টনি-সিজার এবং পিতা এডমন্ড বাস করছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন হেনরি বেকেরেল। পড়াশোনাও করেছেন পিতা-পিতামহের পথে – ইকুল পলিটেকনিকে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর ১৮৭৭ সালে যোগ দিয়েছেন ফরাসি সরকারের গণপূর্ত বিভাগে। সেই বছর তিনি বিয়ে করেছিলেন একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর কন্যা লুসি জো মেরিকে। পিতা-পিতামহের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে স্বতন্ত্রভাবে সুখের সংসার পেতেছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিয়ের এক বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান জিন-কে জন্ম দেবার কিছুদিন পরই লুসির মৃত্যু হয়। শিশু সন্তানকে নিয়ে হেনরি ফিরে আসেন তাঁর মা-বাবার বাড়িতে – প্রফেসরস কোয়ার্টারে।

ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এডমন্ড বেকেরেল নিজের পদ ছেড়ে দিয়ে সেখানে তাঁর ছেলে হেনরি বেকেরেলকে নিয়োগ দেন। পরিপূর্ণ গবেষক হবার ইচ্ছেয় তিনি সরকারি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পদ ছেড়ে দিয়ে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে পিতা-পিতামহের পথ অনুসরণ করলেন হেনরি বেকেরেল। প্রতিপ্রভ ও অনুপ্রভ পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করতে খুবই আনন্দ পেতে শুরু করেছেন তিনি। তখনো সব গবেষণা পরীক্ষণলব্ধ ফলাফল নির্ভর। এই ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় ভিত্তির জন্য খুব বেশি নির্ভরযোগ্য সূত্র তখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

১৮৪৫ সালে মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করেছিলেন আলোর পোলারাইজেশান। হেনরি বেকেরেল আলোর এই ধর্ম নিয়ে খুঁটিনাটি গবেষণা করলেন ১৮৭৫ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত। পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে আলোর পোলারাইজেশান কীরকম হয় তা মাপার জন্য বিশাল এক যন্ত্র তৈরি করলেন হেনরি বেকেরেল। এ সংক্রান্ত পরীক্ষণগুলি থেকে তিনি দুই ধরনের গবেষণাক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করলেন – ভূতত্ত্ব এবং চৌম্বকতত্ত্ব। ১৮৮৩ সাল থেকে তাঁর গবেষণা কেন্দ্রীভূত হয় বিভিন্ন মাধ্যম এবং কেলাসে অবলোহিত রশ্মির শোষণ এবং নির্গমনের ফলে উদ্ভূত আলোর প্রভাব – প্রতিপ্রভা এবং অনুপ্রভা রহস্যে। আলোর শোষণের গবেষণার উপর তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন ১৮৮৮ সালে। ১৮৮৯ সালে তিনি ফ্রেন্স সায়েন্স একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৮৯০ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন। ১৮৯১ সালে তাঁর পিতা এডমন্ড বেকেরেলের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর পিতার পদ – ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ফিজিক্স চেয়ার পান। এই পদের পাশাপাশি ১৮৯৫ সালে তিনি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ফিজিক্সের প্রফেসর পদেও যোগ দেন। ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির খুবই প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন হেনরি বেকেরেল। এই একাডেমির নিয়মিত মিটিং-এই তিনি ১৮৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম দেখেন রন্টজেনের পাঠানো এক্স-রে প্লেট এবং প্রতিপ্রভা সংক্রান্ত গবেষণায় নিজের বিশ্বাসের কারণেই ধরে নিয়েছিলেন প্রতিপ্রভারই অন্যরকম একটি ঘটনা এক্স-রের উৎপত্তি। পয়েনকারের সাথে তাঁর কথোপকথন থেকে এটা বোঝা যায়।  

হেনরি পয়েনকারে এবং হেনরি বেকেরেল দুজনেরই ধারণা ছিল ক্যাথোড রশ্মি ক্যাথোড টিউবের কাচের গায়ে ধাক্কা দেয়ার ফলে লুমিনেসেন্স বা প্রতিপ্রভা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেখান থেকেই এক্স-রে উৎপন্ন হয়েছে। বেকেরেল ভাবলেন এক্স-রে আর প্রতিপ্রভার সাথে সরাসরি সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারণের জন্য পরদিনই গবেষণা শুরু করলেন হেনরি বেকেরেল। তাঁর পিতা, পিতামহ তাঁর জন্য রেখে গেছেন খুবই গোছানো এবং সেইসময়ের সব সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ গবেষণাগার। প্রতিপ্রভ পদার্থের অনেক রকমের কেলাস মজুদ ছিল তাঁর গবেষণাগারে। তিনি সেগুলি নিয়ে একের পর এক পরীক্ষণ শুরু করলেন।

তাঁর পরীক্ষণ পদ্ধতি ছিল খুবই সহজ। একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটকে মোটা কালো কাগজে ঢেকে তার উপর প্রতিপ্রভ পদার্থের লবণের কৃস্টাল রেখে তাতে সরাসরি সূর্যের আলো প্রবেশ করানো। মোটা কালো কাগজ সূর্যের আলো থেকে ফটোগ্রাফিক প্লেটকে রক্ষা করবে। কিন্তু যখন সূর্যের আলোর সাথে প্রতিপ্রভ কৃস্টালের মিথষ্ক্রিয়ায় প্রতিপ্রভা তৈরি হবে। সেই প্রতিপ্রভায় যদি এক্স-রে উৎপন্ন হয় – তা কালো কাগজ ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটের রাসায়নিকের সাথে বিক্রিয়া করবে। সেই বিক্রিয়ার ফলাফল ফটোগ্রাফিক প্লেট প্রসেস করার পর সরাসরি দেখা যাবে। জিংক সালফেড, ক্যালসিয়াম সালফেড ইত্যাদি সব ক্রিস্টালই এক্স-রে তৈরি করতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু হেনরি বেকেরেল আশা করছেন ইউরেনিয়াম সালফেটের লবণ থেকে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। পনের বছর আগে তিনি ইউরেনিয়াম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু সেগুলি তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়ে গেছেন তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী গাব্রিয়েল লিপম্যান, যিনি রঙিন ছবি উৎপাদন করার গবেষণা করছিলেন।

হেনরি বেকেরেল লিপম্যানের কাছ থেকে তাঁর ইউরেনিয়াম সল্ট ফেরত নিয়ে এসে পরীক্ষণের জন্য তৈরি হলেন। কালো কাগজে ঢাকা ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর ইউরেনিয়াম এবং পটাশিয়ামের ডাবল সালফেট কৃস্টাল রাখা হলো। একটি কৃস্টাল এবং কালো কাগজের মাঝখানে একটি ধাতব পয়সা রেখে সূর্যের আলোতে রেখে দেয়া হলো কয়েক ঘন্টার জন্য। এরপর তিনি ফটোগ্রাফিক প্লেট প্রসেস করে দেখলেন খুব সামান্য একটু আলোর রেখা দেখা গেছে ফটোগ্রাফিক প্লেটে – পয়সার ছায়ার চারপাশে এবং কৃস্টালের চারপাশে। এক্স-রে তৈরি হলে তো তা পয়সা ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটে পয়সার এক্স-রে তৈরি হতো। কৃস্টালের উপর সূর্যের আলো পড়ে তাপ উৎপন্ন হয়ে যদি কৃস্টালের কোন বাষ্প তৈরি হয় – তা ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রভাব ফেলতে পারে। সেটা কাটানোর জন্য পাতলা কাচ দিয়ে কৃস্টাল ঢেকে দেয়া হলো। এই ফলাফল  ১৮৯৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সায়েন্স একাডেমির মিটিং-এ উপস্থাপন করলেন হেনরি বেকেরেল। কিন্তু তাতে নিশ্চিত করে এক্স-রে উৎপন্ন হবার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না। আরো পরীক্ষণ দরকার। একাডেমির পরবর্তী মিটিং ২ মার্চ। তার আগেই তাঁকে ফলাফল পেতে হবে।

কিন্ত বাধ সাধলো প্যারিসের আকাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। কৃস্টালে ফেলার মতো যথেষ্ট সূর্যরশ্মি নেই কোথাও। ঝাপসা আলোয় কিছুক্ষণ ফেলে রাখার পর সবকিছু গুটিয়ে একটি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতে বাধ্য হলেন হেনরি বেকেরেল। ২৭-২৮ তারিখেও সূর্যের মুখ দেখা গেল না। ১৮৯৬ সাল ছিল লিপইয়ার। বেকেরেল আশা করছিলেন অন্তত ২৯ তারিখে হলেও কিছু রোদ পাওয়া যাবে। কিন্তু না – সেই আশার গুড়েও বালি। এদিকে ২ তারিখের মিটিং-এ কিছু ফলাফল তো দেখাতে হবে। তাই মার্চের এক তারিখ ড্রয়ার খুলে ফটোগ্রাফিক ফিল্মের প্লেট ডেভেলপ করলেন হেনরি বেকেরেল। কিন্তু অবাক হয়ে গেলেন ফলাফল দেখে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে ক্রিস্টালের দাগ স্পষ্ট। যেখানে প্রতিপ্রভাই তৈরি হয়নি, সেখানে এই দাগ এলো কীভাবে? ইউরেনিয়াম সল্ট থেকে কি নিজে নিজেই কোন অজানা রশ্মি বের হচ্ছে? পদার্থের অজানা এক নতুন ধর্ম আবিষ্কৃত হলো সেদিন – যার নাম দেয়া হয়েছিল বেকেরেল রশ্মি।

পরবর্তী কয়েক বছরে মেরি কুরি এবং পিয়ের কুরি এই অজানা ধর্মের গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম। মেরি কুরি পদার্থের এই নতুন ধর্মের নাম দিলেন রেডিও-অ্যাকটিভিটি। এরপর একে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানের জগতে ঘটে গেছে বিপুল বিপ্লব – যা বিংশ শতাব্দীকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সেটা আরেকদিনের গল্প।

নোবেল পুরষ্কারের জন্য হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করা শুরু হয়েছিল ১৯০১ থেকেই। ১৯০১ সালে তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত রসায়নবিদ মারসেলিন বারথেলো। ১৯০২ এবং ১৯০৩ সালেও মারসেলিন হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরষ্কারের জন্য। মারসেলিন ছাড়াও ১৯০২ সালে আরো দুজন বিজ্ঞানী - ফরাসি গণিতবিদ গ্যাসটন ডারবোক্স এবং জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী এমিল ওয়ারবুর্গ হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরষ্কারের জন্য। ১৯০৩ সালে মারসেলিন ও গ্যাসটন ছাড়াও আরো চারজন বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য। তাঁরা ছিলেন – রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য চার্লস বুকার্ড ও ইলিউটের মাসকার্ট, পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান ও হেনরি পয়েনকারে। ১৯০৩ সালে মেরি এবং পিয়ের কুরির সাথে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন হেনরি বেকেরেল। [৪]

 হেনরি বেকেরেল ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর শুধুমাত্র একজনের নামই নোবেল কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিলেন – তিনি ছিলেন গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান। ১৯০৮ সালে গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, কিন্তু হেনরি বেকেরেল তা দেখে যেতে পারেননি। পুরষ্কার ঘোষণার কয়েক মাস আগে, ১৯০৮ সালের ২৫ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।

হেনরি বেকেরেলের ছেলে জিন বেকেরেলের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৮ সালে। তিনিও তাঁর পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞানী হয়েছেন। ১৯০৩ সালে তিনি তাঁর বাবা হেনরি বেকেরেলের সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। ১৯৪২ সালে তিনি গবেষণাগারের প্রধান হয়েছিলেন যেখানে কাজ করেছেন তাঁর পূর্ববর্তী তিন প্রজন্ম। ১৯৪৬ সালে তিনি ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কোন সন্তান ছিল না। তাই তাঁর মৃত্যুর সাথে শেষ হয় চার প্রজন্মের পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা।


হেনরি, জিন ও এডমন্ড বেকেরেল

 

তথ্যসূত্র

১। রেডিওলজিক্যাল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ভল্যুম ৮, ২০১৫, পৃ ১-৩।

২। রেডিয়েশান প্রটেকশান ডোসিমেট্রি, ভল্যুম ৬৮, সংখ্যা ১/২, ১৯৯৬, পৃ ৩-১০।

৩। মেডিক্যাল ফিজিক্স, ভল্যুম ২২, সংখ্যা ১১, নভেম্বর ১৯৯৫, পৃ ১৮৬৯ – ১৮৭৫।

৪। Nobelprize.org

______________

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত










Latest Post

মুহম্মদ নিজাম-এর “ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ”

  মুহম্মদ নিজাম-এর চিন্তা-চেতনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, বলা যায় ঝটিকা পরিচয়, ঘটে ফেসবুকে তাঁর হ্রস্ব অথচ টাইফুনের শক্তিসম্পন্ন পোস্ট দেখে। ই...

Popular Posts