Saturday, 16 May 2020

সি ভি রামন - পর্ব ৭



বিয়ে

মাদ্রাজে রামন ও সুব্রাহ্মণ্যর সাথে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল রামস্বামী শিবান নামে এক ভদ্রলোকের। শিবান ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে দীক্ষিত এবং নারী-স্বাধীনতার সমর্থক। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের সংগঠিত করে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করতেন তিনি। অনেকদিন আগে রামনের বাবা চন্দ্রশেখরনের সাথে পরিচয় হয়েছিল শিবানের। চন্দ্রশেখরনের দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেমকে খুব শ্রদ্ধা করেন শিবান। চন্দ্রশেখরনের দুই ছেলে মাদ্রাজে আছে জেনে শিবানই তাদের খুঁজে বের করে পরিচিত হন।
            রামস্বামীর স্ত্রী লক্ষ্মীর ছোটবোন লোকসুন্দরী তিন বছর বয়স থেকেই আছে তাদের সাথে। লোকসুন্দরীর ডাকনাম লোকম, বয়স বারো। মাদ্রাজের মত বড় শহরে লক্ষ্মী যেন নিঃসঙ্গবোধ না করে সেজন্য ছোট বোন লোকমকে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাদের বাবা।
            লোকমকে যথাসম্ভব ইংরেজি শিক্ষা, সংগীত শিক্ষা আর আদব-কায়দার শিক্ষা দিয়েছিলেন রামস্বামী শিবান। তখনকার সমাজে মেয়েদের বিয়ের পক্ষে বারো বছর বয়সকে অনেক বেশি বয়স বলে মনে করা হতো। কিন্তু শিবান আধুনিক মানুষ। তাই বারো বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। এবার লোকমের জন্য উপযুক্ত পাত্র দেখতে শুরু করেছেন। অনেকে দেখতেও এসেছে এর মধ্যে। তখনকার দিনে পাত্রী দেখার যে নিয়ম ছিল আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় এখনো উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সেই নিয়ম বলবৎ আছে। পাত্রপক্ষ দলবল নিয়ে মেয়ে দেখতে আসবে। মেয়ে সেজেগুঁজে জুবুথুবু হয়ে পাত্রপক্ষের সামনে বসবে। পাত্রপক্ষ গান গাইতে বললে দু-এক লাইন গান গাইবে।  প্রশ্ন করলে প্রশ্নের উত্তর দেবে। তারপর পেটপূর্তি করে ভালো ভালো খাবার খেয়ে পরে জানাবে বলে চলে যাবে পাত্রপক্ষ। পরে আরো অনেক মেয়ে এভাবে দেখার পর বিচারবিবেচনা করে পাত্রীদেখার ফলাফল ঘোষণা করা হবে। সেখানে একজন পাস করবে, বাকিরা ফেল করবে। অনেক সময় সব পাত্রীই ফেল করতে পারে। সেক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়া আবার প্রথম থেকে শুরু হবে। লোকমের ক্ষেত্রেও সেরকমই হচ্ছিল।
            দক্ষিণ ভারতে বীণা বাজানোর প্রচলন ছিল। মেয়েদের বীণা বাজাতে জানাটাও বিয়ের পরীক্ষায় আবশ্যিক বিষয় বলে ধরা হতো। লোকমকে বীণা বাজাতে শেখানো হয়েছে। লোকম প্রতিদিন গভীর মনযোগে বীণা বাজায় যেন কোথাও কোন ভুল না থাকে। একদিন ঘরে বসে বীণা বাজাচ্ছিল লোকম। সেই সময় শিবানের সাথে দেখা করতে আসেন রামন ও তার এক বন্ধু। ঘরে ঢুকার আগে লোকমের বীণার তান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন রামন।
            শিবান রামনকে বলেছিলেন লোকমের কথা। ইচ্ছে হলে লোকমকে দেখতে আসার কথা বলেছিলেন। কিন্তু রামন যে কোন রকম ফর্মালিটি ছাড়া নিজেই চলে আসবে তা ভাবতে পারেননি। রামনের সাথে লোকমের দেখা হয়নি সেদিন। শিবান আরেকদিন ফর্মাল পাত্রীদেখার ব্যবস্থা করলেন। রামন তাঁর বড়ভাই সুব্রাহ্মণ্য ও এক বন্ধুকে নিয়ে উপস্থিত হলেন লোকমকে দেখতে। সেদিন আবার লোকমের বীণা-বাদন শুনলেন। আর কিছু কথাবার্তা বলে খেয়েদেয়ে চলে এলেন। বাসায় এসে রামন সুব্রাহ্মণ্যকে বললেন, "লোকমকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাকেই আমি বিয়ে করবো।"
            "বাবাকে কোন কিছু না জানিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া মনে হয় ঠিক হবে না। বাবা শুনলে ভীষণ রাগ করবেন।"
            "তাতে কী এসে যায়? বাবার কথা মতো আমাকে বিয়ে করতে হবে নাকি? তুমি যেরকম করেছো সেরকম? বাবা বললো তার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে, আর তুমি একেবারে চোখ বন্ধ করে বিয়ে করে ফেললে। আমার পক্ষে সেরকম সম্ভব নয়। আমি এই মেয়েকে দেখেছি। ভালো বাজায়। কথাবার্তা শুনে মনে হলো বুদ্ধি আছে, আবার কিছুটা লজ্জাও আছে। সব মিলিয়ে ভালো বলেই মনে হচ্ছে আমার। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।"
            সুব্রাহ্মণ্য জানেন রামনকে আর বোঝানো যাবে না। রামন ভীষণ স্বাধীনচেতা। কারো আদেশ উপদেশ অনুরোধ মানার মানুষ সে নয়। সুতরাং তার কাজে বাধা দেয়ার কোন মানে হয় না।
            রামনের হাতে সময় নেই একটুও। মে মাসের অর্ধেক চলে গেছে। তাঁকে সহসাই কলকাতায় চলে যেতে হবে কাজে যোগ দেয়ার জন্য। রামনের ইচ্ছে যাবার সময় স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে যাবেন। বিয়ের পর তাঁর স্ত্রী কিছুদিন বাপের বাড়িতে থাকবে এরকম প্রচলিত নিয়ম তিনি মানেন না। তিনি শিবানকে তাড়া দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের আয়োজন করার জন্য।
            মে মাসের আটাশ তারিখ বিয়ের দিন ঠিক করা হলো। পাত্র-পাত্রীর বাবাকে খবর দেয়া হলো। রামনের বাবা রওনা দিলেন বিশাখাপট্টম থেকে মাদ্রাজের দিকে। আর লোকমের বাবা রওনা দিলেন মাদুরাই থেকে।
            লোকমের বাবা কৃষ্ণস্বামী আয়ার কাস্টমস অফিসার ছিলেন। এখন অবসর নিয়ে মাদুরাইতে নিজেদের বাড়িতে থাকেন। তাঁর বড় ছেলে কল্যাণশংকরন কিছুদিন আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। তাঁর মন খুবই খারাপ। ভেবেছিলেন ছেলে কল্যাণশংকরন আর মেয়ে লোকসুন্দরীর বিয়ে একই সঙ্গে দিয়ে দেবেন। কিন্তু তা আর হলো না।
            চন্দ্রশেখরন আর কৃষ্ণস্বামী মাদ্রাজে এসে যখন পরস্পর কথা বললেন একটা বিরাট সমস্যা ধরা পড়লো। দেখা গেলো রামন ও লোকমের জাত ভিন্ন। দুজনের পরিবারই ব্রাহ্মণ। কিন্তু ব্রাহ্মণের মধ্যেও আছে অনেক জাতিভেদ। প্রধান দুটো জাত ছিল ব্রাহচারণম ও বেদাম। রামনরা ব্রাহচারণম জাতি, আর লোকসুন্দরীরা বেদাম জাতির ব্রাহ্মণ। সেই সময় ভিন্ন জাতির মধ্যে বিয়ে হতো না। রামন নিজের বিয়ের পাত্রী নিজে ঠিক করে সামাজিক নিয়ম ভেঙেছে। তার ওপর এখন দেখা যাচ্ছে মেয়েটি ভিন্ন জাতির। কিন্তু রামনের বাবা সময়ের তুলনায় এসব ব্যাপারে অনেক আধুনিক ছিলেন। তিনি ভিন্ন জাতির মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে মেনে নিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন লোকমের বাবা। তিনি কিছুতেই ভিন্ন জাতির ছেলের হাতে কন্যা সম্প্রদান করতে রাজি নন। ছেলে এফ-সি-এস অফিসার হলেও তাঁর কিছু যায় আসে না।
            শ্বশুরের এরকম গোঁড়ামিতে রেগে গেলেন শিবান। তিনি বললেন লোকমকে তিনি ছোটবেলা থেকে শিক্ষাদীক্ষায় মানুষ করেছেন। সুতরাং সম্প্রদান তিনি করবেন। কিন্তু রামন রাজি নন তাতে। কন্যা সম্প্রদান করতে হলে কন্যার বাপকেই তা করতে হবে।
            বিয়ের সব আয়োজন পন্ড হয়ে গেলো। বিয়ের প্যান্ডেল খুলে ফেলা হলো। আমন্ত্রিত অতিথিদের সবাইকে খবর দেয়া হলো যে বিয়ে হচ্ছে না। রামন কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন এসব দেখে।
            এদিকে শিবান বসে রইলেন না। তিনি মাদ্রাজের সব বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ নেতাদের ডেকে নিয়ে এলেন তাঁর শ্বশুরকে বোঝানোর জন্য। নেতারা সবাই এসে কৃষ্ণস্বামীকে বোঝালেন যে এসব জাত-পাতের হিসেব করা এখন উচিত হবে না। তাঁরা কথা দিলেন যে এই বিয়েতে সবাই এসে বর-কনেকে আশীর্বাদ করে যাবেন। এরকম একটা বিয়ের আয়োজন করা সামাজিক উন্নতির লক্ষণ। এসব শুনে কৃষ্ণস্বামী রাজী হলেন।
            অবশেষে ১৯০৭ সালের ২রা জুন আঠারো বছরের রামন ও তেরো বছরের লোকসুন্দরীর বিয়ে হয়ে গেলো। মাদ্রাজের ইতিহাসে একটি সামাজিক বিপ্লবের মাইলফলক হয়ে থাকলো এই বিয়ে।
            ছয়ই জুন দি হিন্দু পত্রিকায় বেশ বড় এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো:
Madras 3 June, 1907. An inter-sectal marriage was celebrated yesterday at the Maharajah of Vizianagaram Girl's School premises, Triplicane. The bridegroom, Mr. C. Venkataraman, M.A., recently appointed on the enrolled list in the Finance Department of the Govt. of India, is the son of Mr. R. Chandrasekhara Aiyar, B.A., Vice Principal, A. V. N. Cpllege, Vizagapatam, and is of the Brahacharanam sect. The bride is the daughter of Mr. S. Krishnaswamy Aiyar, late of the Customs Dept. Pamban,and the sister-in-law of Mr. M. R. Ramaswamy Sivan B.A., of the Agricultural College, Saidapet. The bride belongs to the Vadama sect. This Marriage is of great importance from the Social Reformer's point of view, as being the first of this kind. Though according to the Shastras such inter-sectal alliances are not prohibited, yet no families till now initiated them. Great credit is due to Mr. Krishnaswamy Aiyar especially, who, in spite of his old age had the courage to help forward the cause of reform in this most desirable and practical manner. A large number of guests of different sects attended the wedding and thus evinced their sympathy for the cause.[1]



[1] Uma Parameswaran, C. V. Raman, Penguin Books, India, 2011,  p39

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts