Showing posts with label বই. Show all posts
Showing posts with label বই. Show all posts

Wednesday, 20 August 2025

মুহম্মদ নিজাম-এর 'বেগানা পুষ্প'

 




বেগানা পুষ্প পড়তে শুরু করার আগেই চোখে পড়ে “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ” – যেখানে লেখা আছে “অতীব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, মারাত্মকভাবে ১৮+, অনুগ্রহপূর্বক প্রাপ্ত বয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠকের স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থটি দূরে সরিয়ে রাখুন। অজাগর মন ও মগজের কুপ্রভাব থেকে বেগানা উপাখ্যানের স্বাস্থ্য রক্ষায় যত্নবান হোন। আদেশক্রমে, কর্তৃপক্ষ।“

ব্যাপারটি যে ভীষণ নতুন - তা নয়। শতাব্দী আগে আঠারো পেরিয়েছি। আমার নিজস্ব আঠারোর আগেই কত ধরনের ১৮+ মার্কা বই পড়ে ফেলেছিলাম – সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ১৮+ বিজ্ঞাপিত যেসব বই যেসব “নিষিদ্ধ” আশায় হস্তগত করে দ্রুত গিলে ফেলেছিলাম তাদের বেশিরভাগের বিজ্ঞাপনই সার, ভেতরে সারবস্তু কিছুই নেই। বেগানা পুষ্পের ক্ষেত্রে প্রশ্ন বয়সের নয়, প্রশ্ন অন্য জায়গায়। বলা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠক যেন বেগানা পুষ্পের স্পর্শ না পায়। প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠকের সংজ্ঞা কী? তাদের স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থ দূরে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব কার?

যাই হোক – এই লাইনগুলি বইয়ের শুরুতে ছাপিয়ে দেয়ার তাগিদ লেখকের না প্রকাশকের জানি না। সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তাঁর গল্প তিনি কীভাবে বলবেন, কতটুকু বলবেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি কী কী করবে – গল্পের কাঠামোর ভেতর থেকে কীভাবে বেড়ে উঠবে, কীভাবে প্রথা ভাঙবে – সবই লেখকের হাতে। সৃজনশীল লেখকদের ক্ষমতা তাঁর সৃজনশীলতার কারণেই ঈর্ষণীয়। মুহম্মদ নিজামের সৃজনক্ষমতা ঈর্ষণীয়।

“বেগানা পুষ্প”র নায়ক জীবন আহমেদ। জীবনের গল্প জীবনের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন লেখক মুহম্মদ নিজাম। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পের সুবিধে হলো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীতার পাশাপাশি মনে মগজে কী চলছে তার শৈল্পিক বর্ণনার সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধাটি অসুবিধাও বটে। কারণ উত্তম পুরুষে বলা গল্পের দৃষ্টি একমুখি হয়। সবার মনের কথা খুলে বলার স্বাধীনতা তখন লেখকের থাকে না। বেগানা পুষ্পও সে হিসেবে শুধুমাত্র জীবনের দৃষ্টিতে দেখা একপাক্ষিক বিবরণ। বিথীর অন্তর্দহন কিংবা আনুষঙ্গিক মিথষ্ক্রিয়ার বিবরণও জীবন যতটুকু দিয়েছে ততটুকুই।

বেগানা পুষ্প প্রেমের উপন্যাস। ম্যাটম্যাটে মধ্যবিত্ত সংস্কারে আবদ্ধ জলে-নামবো-চুল-ভেজাবো-না ধরনের প্রেম নয়। উদ্দাম শরীরী প্রেম। শরীর বিনিময়ের বিশদ বিবরণ আছে বলেই হয়তো গল্প শুরুর আগে সেই ১৮+ এর আদিখ্যেতা। যদিও লেখক এখানে প্রেমের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ব্যবধান বর্ণনা করেছেন এভাবে – “প্রেম হল মধ্যবিত্তের পূজার থালা কিংবা ছেলেবেলায় মেলায় হারিয়ে যাওয়া জমজ ভাই। সে যখন এই জিনিসের সাক্ষাৎ পায়, আবেগে আবেশে দিশেহারা হয়ে যায়। আর ভোগবাদী বড়লোকেরা কুরবানীর পশুর মতো যত্ন করে ঘরে তোলে, আয়োজন করে জবাই দেয়। এরপর তেলে হলুদে আদায় লবঙ্গে মরিচে মাখামাখি করে কষিয়ে জ্বালানি দেয়, রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করে।“ [পৃ ৩৯-৪০]।

ছোট ক্যানভাসে রঙের আধিক্য ঘটলে, কিংবা তুলির আঁচড় মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয়ে গেলে মাঝে মাঝে বাস্তব পরাবাস্তবের সীমানা ঘুচে যায়, বেগানা পুষ্পেও সেরকম ঘটেছে। ইতিহাস দর্শন সমাজ এবং সমাজের মানুষ সব যেভাবে তালগোল পাকিয়ে থাকে – তার সবকিছুই কিছু কিছু আঁকতে চেয়েছেন লেখক এখানে।

জীবন লেখক হবার স্বপ্ন দ্যাখে, আবার এক সময় লন্ডন যাবার চেষ্টাও করে। কিন্তু বিথীর শরীর বেয়ে প্রেমে পড়ে যাবার পর সবকিছু থমকে দাঁড়ায়। বিথী যখন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় – তখন বর্তমানকে অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার কৌশল চমৎকার।

জীবনের ভাবনার মধ্য দিয়ে লেখক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিয়েছেন। যেমন, “ভিড়ের ভেতর ভ্রান্তি থাকে, জ্ঞান থাকে যৎসামান্য। নীলক্ষেতের কোন একটা বইয়ের দোকানের কোণায় পড়ে থাকা “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী” কিংবা “তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা” বইয়ে যে পরিমাণ সত্যবদ্ধ ঘটনা রয়েছে, সমগ্র ঢাকা শহরের যাবতীয় জনমানুষের ভিড়ে একযুগ ঘুরেফিরেও এইটুকু সত্য কেউ আহরণ করতে পারবে না।“ [পৃ ৬২]

পুরুষের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জীবনের পর্যবেক্ষণ নির্মম: “একটা পুরুষ একটা পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট এবং বিকৃত আচরণ করার ক্ষমতা রাখে। এই পৃথিবীর মেয়েরাই শুধু সেই দৃশ্যগুলোর সাক্ষী থাকে। পুরুষ জাতির পরম সৌভাগ্য যে, প্রিয়তম নারী জাতি সীমাহীন গ্লানি কিংবা অতলান্ত ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ জাতির এই কদর্য দিকটা সভ্য মানুষের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখে।“ [পৃ ৬৭]

পুরুষ মানুষ প্রেমিকার জন্য কাউকে খুনও করতে পারে। এটা দেখা গেল জীবনের বেলায়। আজমল বিথীকে নিয়ে বাজে প্রস্তাব করায়, জীবন ও বিথীর গোপন মিলনের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টার কারণে ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে আজমলকে খুন করে জীবন। তবে এটা কি শুধুমাত্র বিথীর সম্মান বাঁচাতে, নাকি নিজেরও – এটা পরিষ্কার হয় না। তবে আজমলকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার পরও জীবন কীভাবে এতটা স্বাভাবিক থাকে – এটাই আশ্চর্যের। পাঠক হবার এখানেই আনন্দ যে –  একজন খুনি কিংবা ধর্ষকও যদি নিজে কথা বলে - পাঠকের কাছে সবকিছুই অবলীলায় বলে ফেলে – লজ্জা কিংবা ভয় না করেই। 

বইটির ছাপা এবং বাঁধাই বেশ উন্নত। বানান ভুল মাত্র কয়েকটি। নীলা হারুনের প্রচ্ছদ সুন্দর। তবে প্রকাশনীর নাম “নয়েস” – শুনতে কেমন যেন লাগে।

মুহম্মদ নিজাম একটি ভালো গল্প বলেছেন। ভালোভাবেই বলেছেন।


Sunday, 22 June 2025

মুহম্মদ নিজাম-এর “ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ”

 



মুহম্মদ নিজাম-এর চিন্তা-চেতনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, বলা যায় ঝটিকা পরিচয়, ঘটে ফেসবুকে তাঁর হ্রস্ব অথচ টাইফুনের শক্তিসম্পন্ন পোস্ট দেখে। ইতোমধ্যে অনেকগুলি গল্প, উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এই তরুণ লেখক। তাঁর বইগুলি পড়ার জন্য এক ধরনের অস্থির তাগিদ অনুভব করছিলাম অনেকদিন থেকে।

 প্রবাসের পাঠকদের এখন আর আগের মতো খরায় কাটাতে হয় না। অনলাইনে এখন হাজার হাজার বই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কপিরাইটের দফারফা করে ছেড়ে দেয়া জাতি আমরা। কিন্তু লেখকের প্রতি পাঠকের দায়বদ্ধতা থেকে যারা আমরা বই কিনে পড়তে চাই – তাদের জন্য আমাদের দেশে এখনো আন্তর্জাতিক ডেলিভারির ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের অপেক্ষা করতে হয় – কখন দেশ থেকে কেউ আসবে, যে নিজের ব্যাগের মূল্যবান আয়তন এবং ভর ধার দিয়ে কয়েকটা বই নিয়ে আসবে সাথে করে।




মুহম্মদ নিজামের সবগুলি বই না হলেও – বেশ কিছু বই সংগ্রহ করতে পেরেছি। তালিকা এবং প্রকাশকাল দেখে দেখে প্রথম বই দিয়েই তাঁর বই পড়তে শুরু করলাম।

“ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ” এর কাহিনি প্রচলিত উপন্যাসের কাহিনি থেকে বেশ ভিন্ন। এখানে মানবমনের চিন্তাজগতে হানা দেয়া হয়েছে, তবে শীর্ষেন্দুর মানবজমিনের মতো ঘটনার ঘনঘটা ঘটিয়ে কোনকিছুই জট পাকিয়ে দেননি লেখক। কেন্দ্রিয় চরিত্র মিথুন – নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করেছে এখানে বিভিন্নভাবে। মনের কথা পাঠকের সাথে শেয়ার করার যে কৌশল লেখক এখানে ব্যবহার করেছেন তা বেশ সংযমের সাথে করেছেন। সংযম আর পরিমিতিবোধের কারণেই – গভীর তত্ত্বগুলিও হয়ে উঠেছে উপভোগ্য।

এই বই আমার খুবই ভাল লেগেছে। গল্প-উপন্যাস পড়ে ভালো লাগার কিংবা না লাগার ব্যপারটি পাঠকের নিজস্ব। সেখানে পাঠকের আবেগ কাজ করতে পারে, কাজ করতে পারে ব্যক্তিগত অনুভূতি, কিংবা নীতিবোধ। পাঠকের চিন্তার সাথে লেখকের সৃষ্ট কোন চরিত্রের চিন্তা মিলে গেলেও পাঠক ভালোবেসে ফেলে সেই চরিত্রকে। আমার ভালো লাগার প্রধান কারণ এই উপন্যাসের মূল বিষয়।

বইয়ের কেন্দ্রে বসে আছে যে তরুণ – মিথুন – গভীর চিন্তক। তরুণ বয়সেই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছে। চিন্তার গভীরে প্রবেশ করে একই জিনিস বিভিন্ন জনের মনের প্রতিফলন থেকে দেখতে শিখেছে। মিথুনের ভেতর তারুণ্যের তীব্র অস্থিরতার বদলে চিন্তার স্থিতধি অবস্থান আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। তার দাদা জাবের আলি – ধর্মান্ধ দলের উগ্র নেতা। জাবের আলির সাথেও মিথুনের যে স্নেহ এবং বিশ্বাসের দ্বান্দ্বিক অবস্থান উঠে এসেছে উপন্যাসে তা অনবদ্য।

এই বইতে সঠিক বিজ্ঞান আছে। লেখক এই বই যখন লিখেছেন তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইতিহাসের ছাত্র হয়েও মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস যে তিনি খোলামনে পড়েছেন এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন – তার সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে।

ঘটনার ব্যাপ্তি, চরিত্রগুলির পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সংক্ষিপ্ত কথোপকথন আমাকে মুগ্ধ করেছে। ধর্ম নিয়ে যেসব প্রশ্ন ধর্মান্ধদের উগ্রতার ভয়ে আমরা করতে পারি না, লেখক সেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন সাহসের সাথে।

“পাঁচশ বছর আগেও হয়তো এই পৃথিবীর বড় হুজুরেরা দাজ্জালের জন্ম হয়ে গেছে এবং কেয়ামত আসন্ন বলে এইভাবেই মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এখনো ছড়াচ্ছে। পাঁচশ বছর পরেও ছড়াবে।“ [পৃ ৪১]

“একজন বিশুদ্ধ মানুষ নিজে যে দুঃখ সহ্য করতে পারে না, অন্যকে সেইরকম কোনো দুঃখে পতিত হতে দেখলে অন্তরে তীব্র ব্যথাবোধ করে। মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঞ্চারিত করে যেতে পারে। এই সবই হচ্ছে মানব ধর্মের বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো যাদের রয়েছে, বিশেষ করে এক মতানুসারে তারা সবাই সনাতন ধর্মের প্রাণ। অর্থাৎ জগতের সকল মানুষই সনাতন ধর্মের মানুষ। এই মতানুসারে বর্তমান পৃথিবীতে যে ছয় বা সাতশত কোটি মানুষ রয়েছে তাদের সবাইকে সনাতন ধর্মের মানুষ বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।“ [পৃ ৪৩-৪৪] – এরকম গভীর চিন্তা করতে যেমন খোলা মনের দরকার হয়, তেমনি এই চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে দরকার হয়ে মনের গভীর সাহস। মুহম্মদ নিজামের সেই সাহস আছে।

ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করা আমাদের বহু পুরনো অভ্যেস। প্রাণভয়ে সেই অভ্যেসের প্রতি জিজ্ঞাসার আঙুল তুলতে সাহস করে না অনেকেই। মুহম্মদ নিজাম সরাসরিই বলেছেন এই উপন্যাসে, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথাটাই একবার ভেবে দেখুন। সেই সময় পাক সেনারা আদর্শগত দিক থেকে নিজেদের পবিত্র ধর্মযোদ্ধা ভেবে মনে মনে খুব আহলাদিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছে হিন্দুস্থানের দালাল, ইসলামের শত্রু। অথচ যুদ্ধকালীন নয়টা মাসে যতগুলি নিরপরাধ মানুষ মারা গিয়েছেন, যত নারী ধর্ষিত হয়েছেন – প্রায় সবকিছুই সংঘটিত হয়েছে ওদের মত মহান মহান স্বর্গীয় সৈনিকদের দ্বারা। আদর্শ নিজেই এখানে বলাৎকারের শিকার।“ [পৃ ৮৯]

এই বইতে অনেকগুলি বিষয় এসেছে যা বেশিরভাগ উপন্যাসের চরিত্রগুলি এড়িয়ে চলে। যেমন বিবর্তনবাদ, ধর্মের অলৌকিক অন্ধ বিশ্বাস। কাহিনির মিথুন অনন্য সাহস দেখিয়ে সরাসরি বলেছেন তাঁর ধর্মান্ধ দাদাকে – “আমাদের মধ্যে একটা শ্রেণি আছে যারা জোর করে কোরআনকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান-গ্রন্থ বলে জাহির করতে চায়। এটা আমার ভালো লাগে না। আমি ভাবি, গড অলমাইটি তো সবই জানেন। তিনি চাইলে নবীদের মাধ্যমে ইয়া বড় বড় পদার্থবিজ্ঞানের বই, রসায়নের বই লিখে পাঠাতে পারতেন। তা তিনি করেননি। মানুষের জন্য রেখে দিয়েছেন এবং মানুষ সেইগুলি আবিষ্কারও করছে। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানেন?” “আবিষ্কারকগণ প্রায় সবাই ইহুদী এবং খ্রিস্টান এবং নিরীশ্বরবাদী। আমরা যে চৌদ্দশ বছর ধরে কোরআন পাঠ করছি, আজ পর্যন্ত একটা যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না। একটা ভাল প্রেডিকশন করতে পারলাম না। অথচ যখনই শুনি, কেউ একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে, জোর করে তার উপর কৃতিত্ব জাহির করার হীন চেষ্টা করি। এটা কি ঠিক বলুন?” [পৃ১০৬]

“যে ধর্ম এখন আমরা পালন করছি তাতে যতটা শ্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা আছে তার চেয়ে বেশি আছে পারস্পরিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অহেতুক নিজের ভেতর কটু গন্ধময় আবর্জনা পোষণ করা।“ [পৃ ১০৭] – এই নির্মম সত্যিকথা বলার জন্য যে নির্ভয় সাহস লাগে – সেটা আছে মুহম্মদ নিজামের।

লেখকের পরিমিতিবোধ আমাকে মুগ্ধ শুধু করেনি, কিছুটা ঈর্ষান্বিতও করে তুলেছে। উর্মির সাথে মিথুনের প্রেম ভালোবাসা ঘটিয়ে দেয়ার এত সুন্দর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লেখক শুধুমাত্র তুলির একটা দুটো মানসিক টান দিয়ে পুরো ক্যানভাস খালি রেখেই ছেড়ে দিয়েছেন। প্রথম উপন্যাসেই এরকম বুদ্ধত্ব অর্জন করা সত্যিই দুরুহ।

উপন্যাসের মিথুনের মতো আমারও জেগেছে সেই মোক্ষম প্রশ্ন, “চারদিকে খেয়াল করার মতো এত ইঙ্গিত, দেখার মতো এত বিষয়, তবুও কেন চোখ মেলে তাকায় না মানুষ? কেন ভাবে না?”

বইটির প্রকাশনার ব্যাপারে কিছু কথা না বললে প্রকাশকের প্রতি অবিচার করা হবে। আমাদের বইয়ের প্রকাশনার আঙ্গিক মান যে অনেক উন্নত হয়েছে তা বোঝা যায় বইটি হাতে নিলেই। বায়ান্ন প্রকাশনীর মোহাম্মদ আল আমিন সরকার বেশ যত্ন করেই বইটি প্রকাশ করেছেন। রঙিন ছাপানো, ঝকঝকে প্রিন্ট, বানানভুল অতি সামান্য, কাগজ আকর্ষণীয়। তৃত এর প্রচ্ছদ বইয়ের শিরোনামের মতোই চিন্তাশীল।

সবমিলিয়ে চমৎকার এক বইপড়ার অনুভূতি দিলো মুহম্মদ নিজামের ‘ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ’।


Thursday, 20 March 2025

মহিউদ্দিন মোহাম্মদের 'আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র'

 




বেশ কয়েকদিন ধরে একটানা পড়ে শেষ করলাম মহিউদ্দিন মোহাম্মদের পাঁচটি বই। কোনো একজন লেখকের প্রকাশিত ছয়টি বইয়ের মধ্যে পাঁচটি পড়ে ফেলা – কম কথা নয় আমার জন্য। বিশেষ করে যেখানে দীর্ঘদিন বাংলা পরিমন্ডলের বাইরে থাকলে – বাৎসরিক বইমেলা থেকে দূরে থাকতে হলে – বই তো দূরের কথা, বইয়ের খবরও যথাসময়ে এসে পৌঁছায় না। 

হিশেব করে দেখা যাচ্ছে এই লেখকের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে। কম সময়ের মধ্যেই তিনি বিপুলভাবে আলোচিত হয়েছেন। বাংলাদেশি পাঠকদের মধ্যে আলোচনায় কীভাবে থাকতে হয় তা তিনি ভালো করে জানেন বলেই মনে হলো তাঁর বইগুলি পড়ে। 

কোনো বই পড়ে আমার নিজের কেমন লাগলো তা লিখে রাখি আমার নিজের জন্যই। কারণ আমার স্মৃতি খুব বেশিদিন সবল থাকবে এমন বিশ্বাস আমার নেই। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইগুলি পড়েও কেমন লাগলো একে একে বলছি। 

লেখক কোন্‌ লেখা কখন লিখেছেন তা নিজে না বললে অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু পাঠক হিসেবে কোনো লেখকের যদি একাধিক বই হাতে আসে – আমি চেষ্টা করি প্রকাশকালের ক্রমানুসারে বইগুলি পড়তে। সেভাবেই শুরু করলাম ‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’ দিয়ে। 

বই হাতে নিয়েই বুঝলাম আক্ষরিক অর্থেই বেশ মজবুত বই। শক্ত মলাট, মজবুত বাঁধাই, ঝকঝকে কাগজ। জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর সব বইয়েরই অঙ্গসৌষ্টব এরকম জোরালো কিনা জানি না। তবে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের সব বই বেশ সযত্নে প্রকাশিত। ভালো লাগলো আমাদের দেশের প্রকাশনা শিল্পের এই দিকটির উন্নতি দেখে।

‘আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’র যে সংস্করণটি আমি পড়লাম তা ষষ্ঠ সংস্করণ। ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে ২০২৪ এর জুনে বইয়ের ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। এতগুলি সংস্করণে কী কী সংস্কার করা হয়েছে তা লেখা থাকে প্রতিটি সংস্করণের ভূমিকায়। কিন্তু এই বইতে একটিই ভূমিকা আছে এবং সেটার সময়কাল দেখে বুঝতে পারি তা প্রথম সংস্করণের। বোঝার উপায় নেই সংস্করণ আর পুনর্মূদ্রণের মধ্যে আসলেই কোন পার্থক্য ছিল কি না। 

উৎসর্গের পাতাতেই চমকে দিয়েছেন লেখক – বইটি আল্লাহকে উৎসর্গ করে। আল্লাহকে এর আগে আর কেউ কোন বই উৎসর্গ করেনি এমন নয়। তবে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ যে যুক্তি দেখিয়েছেন – ‘কারণ তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করা যায় না’ – তা অভিনব। কেন দ্বিমত করা যায় না – সে প্রশ্ন এখানে তোলা নিরর্থক, কারণ উৎসর্গের ব্যাপারটি লেখকের এতটাই নিজস্ব যে সেখানে পাঠকের কোন কিছু বলার থাকে না, বলা উচিতও নয়। 

প্রকাশক শাহীদ হাসান তরফদার একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন এই বইয়ের। অবশ্য তার বেশিরভাগ পাতা জুড়ে আছে লেখকেরই দীর্ঘ কবিতা ‘মাংস নয়, হাড়ের মুক্তি চাই’। কবিতাটিও এই বইয়ের অংশ হয়ে উঠেছে যদিও বইটি লেখকের আধুনিক গদ্যের সংকলন। 

প্রকাশক তাঁর কথার শুরুতেই লিখছেন, “মগজে গুঁতো খাওয়ার ভয়ে অনেকে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখা পড়তে চান না।“ খটকা লাগলো। এই বই যদি লেখকের প্রথম বই হয়, তাহলে পাঠকদের মগজে গুঁতো দেয়ার ব্যাপারটি লেখক কোথায় করলেন? হয়তো অনলাইনে কিংবা ফেসবুকে – যা সেইসময় আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। বইতে যেসব বিষয়ে লেখা সংকলিত হয়েছে তার সবগুলিই সমসাময়িক, এবং ধারণা করা যায় তার কিছু কিছু হয়তো বইতে সংকলিত হবার আগে অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। প্রকাশক লেখক সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কোনো বই সম্পর্কে সেই বইয়ে প্রকাশিত প্রকাশকের কিংবা আলোচকদের প্রশংসাবাণীতে খুব বেশি ভরসা রাখা যায় না। কারণ এই প্রশংসা মূলত ব্যবসায়িক। কোনো প্রকাশক নিশ্চয় তাঁর নিজস্ব প্রকাশনার কোন বই সম্পর্কে নিন্দা করবেন না। তবুও এটা ভালো লাগলো যে প্রকাশক তাঁর লেখকের বই প্রকাশ করার আগে পড়ে দেখেছেন। আমি বাংলাদেশের একাধিক প্রকাশককে গর্ব করে বলতে শুনেছি যে তাঁরা বই পড়তে পছন্দ করেন না। জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্রকাশক সেরকম নন জেনে খুশি হলাম। 

বইয়ের দুটি অংশ – সংজ্ঞাবলীর পদাবলী এবং সূর্যগ্রহণ। প্রথম একুশটি রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে সংজ্ঞাবলীর পদাবলীতে এবং দশটি রচনা সন্নিবেশিত হয়েছে সূর্যগ্রহণ অংশে।

প্রথম অংশের লেখাগুলি সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরালো বক্তব্যের বারুদে ঠাসা। প্রসঙ্গ পরিচিত – কিন্তু উপস্থাপনার ভাষা নতুন এবং নিপুণ। ‘ভুঁড়ি হলো একজনের শরীরে বেড়ে ওঠা আরেকজনের মাংস’, ‘বাঙালি শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে ব্যাঙ থেকে’, ‘মানুষ প্রভুভক্তিতে কুকুরদেরও ছাড়িয়ে গেছে’, ‘প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র গাধাই যুক্তিবাদী’, ‘শয়তান তার গাড়িতে বিশেষ স্টিকার লাগিয়ে রাখে। স্টিকারে লেখা থাকে – “শয়তান”, ‘সত্যকে ঢিল মারলে পাওয়া যায় লোভনীয় পুরষ্কার’, ‘সময়ই একমাত্র শিক্ষক, যিনি পাঠদান শেষে তার ছাত্রদের মেরে ফেলেন’, ‘কৃষক হলেন ধানক্ষেতের ক্রীতদাস’, ‘শিক্ষক হবো – এই স্বপ্ন এখন আর কেউ দেখে না’, - এসব বাক্য ঝকঝকে ছুটির ফলার মতো, যেমন চকচকে তেমনই ধারালো। 

মানুষের বোধ জাগ্রত করাই লেখকের দর্শন, কিন্তু গতানুগতিক একঘেঁয়ে দার্শনিক তত্ত্বের বদলে তাঁর উপস্থাপনা ব্যতিক্রমী এবং আকর্ষণীয়। “সমাজকে যেদিন আমি একটি লাথি কম দিই, সমাজ সেদিন আপনাদের ঘাড়ে একটি কামড় বেশি দেয়।“ 

“তারুণ্যের প্রধান কাজ – বুড়ো মানুষের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা।“ যে সময়ে এই বাক্য রচিত হয়েছিল – তার তিন বছরের মধ্যেই যে তরুণরা অশীতিপর বুড়োদের ডেকে নিয়ে আসবে কর্তৃত্ব করার জন্য – তা কি লেখক জানতেন?

আধুনিক গরু-রচনা সমগ্রে সত্যি সত্যিই ‘গরু’ শিরোনামের একটি অভিনব রচনা আছে যেখানে বর্ণিত হয়েছে কঠিন সত্য – ‘ক্ষমতাহীন সকল প্রাণীই গরু’। 

সবগুলি রচনাই সুখপাঠ্য, চিন্তা জাগানীয়া। লেখক এখানে সফল। যেসব কথা সরাসরি বলতে চাননি – রূপক ব্যবহার করে বলেছেন। “মুরগিদের নিয়ে অসুবিধা হলো – তারা তাদের জনসভায় সবসময় প্রধান অতিথি করে থাকে একজন শিয়ালকে।“ – পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না, মুরগি কারা, আর শেয়াল কোন্‌জন। 

“বাদুড়ের দাঁত” রচনায় একটি তথ্যগত ভুল আছে। লেখক প্রচলিত বিশ্বাসকে তদন্ত না করেই লিখে ফেলেছেন “বাদুড় যে-পথে মলত্যাগ করে সে-পথেই খাবার গ্রহণ করে”। বাদুড় মাথা নিচু করে ঝুলে থাকে বলে অনেকেই মনে করে এরকম। আসলে বাদুড় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সব রকম শারীরিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণি। তাদের মলদ্বার আছে এবং মলদ্বার দিয়েই মল ত্যাগ করে, মুখ দিয়ে নয়। 

সূর্যগ্রহণ পর্বের প্রবন্ধগুলি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। ‘মানুষ ও অন্ধকারের প্রশংসা’ নিজেই একটি স্বতন্ত্র বই হতে পারতো কয়েক ফর্মার। এই প্রবন্ধের মানুষগুলি মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ, যারা বিশ্বাস করে অলৌকিক ক্ষমতায়। বিভিন্ন ধরনের গোঁড়ামির গোলামি তারা করে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। “যে সমাকে গোঁড়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে সমাজ চিলের সমাজ। ওখানে বাঁচতে হয় মুরগির ছানার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে।“ কী চমৎকার সত্য বলেছেন আমাদের সমাজ সম্পর্কে আমাদেরই সমাজ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই লেখক।

মানুষ সম্পর্কে লেখকের পর্যবেক্ষণ অসাধারণ। “মানুষ যে সম্পদ অর্জন করে, তার নব্বই শতাংশই সে ভোগ করতে পারে না। কিন্তু এই অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে মূল্যবান স্বাস্থ্য ও সুখ। সে বাঁচে পঞ্চাশ বছর, কিন্তু টাকা উপার্জন করে এক হাজার বছরের।“ 

এই লেখায় লেখক মানুষ হিসেবে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নততর বলেও দাবি করেছেন। লেখক হিসেবেও নিজেকে অন্য লেখকদের চেয়ে ভালো দাবি করে লিখেছেন, “লেখক হিশেবে আমাকে যারা হিংসা করেন, তারা জানেন যে, তাদের চেয়ে আমার লেখার দীর্ঘায়ু হওয়ার সক্ষমতা বেশি।“ [পৃ ১২৪] এটিকে অহংকার বলবো কি না জানি না। কারণ এই দাবি বড়ই ব্যক্তি নির্ভর। তিনি কোন্‌ লেখকের সাথে নিজের তুলনা করছেন তা খোলাসা করেননি। প্রয়াত হুমায়ূন আজাদও যখন তখন নিজেকেই সেরা দাবি করতেন। 

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য খুবই বিরূপ এবং তীব্র। শিক্ষাকে তিনি রাজনীতির হাতিয়ার বলে মনে করেন। মনে করেন “জাতীয় সংগীত ধীরে ধীরে শিশুদের চিন্তা ও প্রতিবাদ করার শক্তি কেড়ে নেয়।“ কিন্তু তিনি যেভাবে বলেছেন জাতীয় সংগীতের কারণেই শিশুরা ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে , ভালো ও খারাপের মধ্যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে, ঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, তা কি পুরোপুরি ঠিক? জাতীয় সংগীতের ফলেই মানুষ হিসেবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে [পৃ ১৩৩] – তা কি অতিশয়োক্তি নয়? 

বাংলাদেশের সরকারি স্কুলের শিশুপাঠ্য বইগুলির তীব্র সমালোচনা করেছেন লেখক। তা করতেই পারেন। তবে ঠিক কোন্‌ দেশের বইকে তিনি আদর্শ বই বলে মনে করেন তা বোঝা গেল না।  বইগুলির লেখক সম্পাদকদের নাম সরাসরি উল্লেখ না করে বিভিন্ন অপমানজনক বিশেষণ প্রয়োগ করে কঠোর ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন (পৃ ১৪৯) যা সুরুচির পরিচয় বলে আমার মনে হয়নি। 

জিপিএ ফাইভ ও জুতোর ফ্যাক্টরি প্রবন্ধে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি এবং গ্রেডিং সিস্টেমকে তুলোধুনা করেছেন লেখক। লিখেছেন, “কিছু কাগজ ও চকের ধুলো ছাড়া এ পদ্ধতিতে শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে আর কিছুর বিনিময় ঘটে না।“ [পৃ ১৬৭]। কিন্তু আদর্শ পদ্ধতি বলে কি কিছু আছে? যদি না থাকে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে কোন পদ্ধতিকে ভালো কিংবা খারাপ বলা হবে – সে প্রশ্ন লেখক এড়িয়ে গেছেন। 

লেখক গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি – পিএইচডির উৎপত্তির ইতিহাস এবং পিএইচডি ডিগ্রি সম্পর্কে অত্যন্ত ঋণাত্মক মতবাদ দিয়েছেন “ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি” প্রবন্ধে। বাংলাদেশের অনেকে টাকা দিয়ে এই ডিগ্রি নিয়েছেন, অন্যের লেখা নকল করে থিসিস লিখেছেন এরকম কলংকের আলোকে এরকম সমালোচনা করার যুক্তি লেখকের আছে। কিন্তু ঢালাওভাবে ডিগ্রিটাকেই অদরকারি বলে ফেললে অতিরিক্ত বলা হয়ে যায়।

‘আমাদের ইশকুল, আমাদের গোরস্থান’ রচনায় লেখক কীরকম স্কুল চান, কেমন স্কুল আদর্শ স্কুল তার কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন বাংলাদেশে যে স্কুলিং প্রথা চালু আছে তা পুরোপুরি বদলে ফেলতে হবে। “বর্তমান ইশকুলগুলোকে বিক্রি করে, অথবা ভেঙে ফেলে, নতুন ইশকুল নির্মাণ করা”- যাতে শিশুরা স্কুলে যেতে আনন্দ পায়। ভালো স্কুল এবং স্কুলিং বোঝানোর জন্য লেখক অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের একটি স্কুল পরিদর্শন করার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে আমি অনেক বছর থেকে এই শহরটিতে থাকি এবং এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আমার কিছুটা পরিচয় আছে। সে সূত্রে আমি বলতে পারি লেখক মেলবোর্নের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তুলনায় এগিয়ে রাখতে গিয়ে একটু বেশি প্রশংসা করে ফেলেছেন। লেখক ঠিক কী হিসেবে মেলবোর্নের বিদ্যালয় পরিদর্শন করলেন এবং প্রিন্সিপাল তাঁকে এত দীর্ঘ সময় নিয়ে সবকিছু দেখালেন – তা পাঠকদের বললে বুঝতে সুবিধা হতো। বলাবাহুল্য মেলবোর্নের সরকারি স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরাও এখানে উদ্বিগ্ন। এখানকার স্কুলের শিক্ষকরা এত কম বেতন পান যে – সুযোগ পেলেই শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য কোন পেশায় চলে যান এখানকার শিক্ষকরা। 

বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ এখনও মনে করে নারীর পোশাকের কারণেই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে সেখানে। অথচ ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এর পক্ষে কোন সুযুক্তি পাওয়া যায় না। লেখক এসমস্ত ব্যাপারের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন “ধর্ষণের সাথে পোশাকের সম্পর্ক” প্রবন্ধে। “ধর্ষণ তখনই ঘটে, যখন ধর্ষক বুঝতে পারে যে ধর্ষণ করার পরও সে নিরাপদে থাকবে। এ জন্য সে প্রথমেই যাকে ধর্ষণ করবে তার ক্ষমতা মেপে নেয়“ [পৃ ২০৪]। “বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে ক্ষমতা কাঠামো আছে, তাতে একজন মন্ত্রীর মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা, একজন কৃষকের মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কম” [পৃ ২০৫]। খুবই নির্মম সত্য কথা। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রমও কেন ঘটে যায়, যেমন ১৯৯৮ সালে ঘটা শাজনীন হত্যার ঘটনা, তার ব্যাখ্যা মেলে না। 

“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরা” রচনায় যৌক্তিকভাবেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমালোচনা করেছেন লেখক। সংগতকারণেই জোরালো শ্লেষাত্মক প্রশ্ন করেছেন, “একটি সেতু নির্মাণ করতে রাষ্ট্র খরচ করেছে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য এক থালা ভালো ভাত ও একটি ভালো কক্ষের ব্যবস্থা রাষ্ট্র করতে পারেনি [পৃ ২২১]”। 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনা করার ক্ষেত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে লেখক তাইওয়ানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ঔদার্যপূর্ণ সুনাম করেছেন লেখক। বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে কিংবা হঠাৎ দেখতে গেলে সবকিছু সুন্দরই মনে হয়, ফাঁকফোকরগুলি চোখে পড়ে না। ওখানেও যে অনিয়ম – বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম মাত্রার হলেও – চলে তা হঠাৎ দেখায় দেখা যায় না। উন্নত দেশের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে পরিমাণ বেতন দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়, সেই তুলনায় আমাদের দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মোটামুটি অবৈতনিক – এটি অস্বীকার করলে অন্যায় করা হয়। 

সবশেষের অধ্যায় “আঠারোটি পাউরুটি” আসলে হুমায়ূন আজাদের প্রবচনগুচ্ছের অনুকরণে আঠারোটি প্রবচন। যার আঠারো নম্বর “আইন জিনিসটি বেশ অদ্ভুত। যেমন – রাস্তায় কুকুর হিস্যু করতে পারবে, কিন্তু মানুষ থুথু ফেলতে পারবে না।“ – ঠিক কী কারণে এটি বলা হলো বুঝতে পারলাম না। লেখক কি মানুষের রাস্তায় থুথু ফেলার অধিকার চাচ্ছেন? 

সব মিলিয়ে বলতে গেলে বলা যায় – বেশ ভালো লেগেছে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র। লেখকের ভাষা চমৎকার, বক্তব্য পরিচ্ছন্ন। বইয়ের সম্পাদনায় কিছু ত্রুটি আছে, মনে হয়েছে যা কিছু লেখা হয়েছে সবই বইতে ঠেসে দিয়ে দেয়া হয়েছে – তাই কিছু কিছু জায়গা খাপছাড়া লেগেছে। 

লেখক পরিচিতিতে এসে লেখক নিজের ছবির বদলে তাঁর মায়ের ছবি দিয়েছেন। আর বলেছেন লেখকের পরিচয় তাঁর লেখা থেকেই খুঁজে নেয়া উচিত। তিনি কী কী ডিগ্রি অর্জন করেছেন, কী করেন তাতে কিছুই যায় আসে না। এক্ষেত্রে লেখকের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করতে বাধ্য হচ্ছি। লেখক যদি সৃজনশীল কোন সাহিত্য রচনা করেন তাতে তাঁর ভাষা এবং শৈল্পিক নির্মাণদক্ষতাই তাঁর পরিচয়। সেখানে তাঁর নামও যদি না থাকে কোন সমস্যা হয় না। অনেকেই ছদ্মনামে লেখেন। জেন অস্টিনের সবগুলি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নাম ছাড়াই। তাতে কারো কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু লেখক যখন প্রবন্ধ লেখেন, বিজ্ঞান লেখেন, দর্শন লেখেন, এবং লেখায় নিজের সম্পর্কে কোনো কিছু দাবি করেন – পাঠকের অধিকার জন্মায় সেগুলির সত্যতা যাচাই করে দেখার। লেখক যদি জ্ঞান দেন, পাঠকের অধিকার আছে যাচাই করে দেখার যে লেখকের জ্ঞান দেয়ার যোগ্যতা কীভাবে অর্জিত হয়েছে। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় হিসেবে যেসব কথা লেখার মধ্যে লিখেছেন – যেমন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জন করা তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন [পৃ ৯০], লুঙ্গি পরে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, বিমানে উঠেছেন [পৃ ৯২], ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাল প্যান্ট পরে যেতেন [পৃ ৯৪], শৈশবে মাদ্রাসায় পড়েছেন [পৃ ৯৭] – এগুলির সত্য-মিথ্যা কীভাবে প্রমাণিত হবে যদি মূল পরিচয় গোপন করা হয়? 

Friday, 10 January 2025

বিশ্বজিত সাহার "হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো"

 



বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান সে নিয়ে কারোরই কোন দ্বিমত নেই। ২০১২ সালে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর আরো এক যুগ কেটে গেছে। এখনো হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। তাঁর বই এখনো পাওয়া যাচ্ছে, এখনো মানুষ তাঁর বই পড়ছে। অবশ্য তাঁর নতুন প্রজন্মের কোন পাঠক তৈরি হয়েছে কি না আমি জানি না। কারণ আমাদের দেশের পাঠকদের মন এবং পাঠাভ্যাস নিয়ে নির্ভরযোগ্য তেমন কোনো গবেষণা হয় না।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার শনাক্ত হবার পর যখন তিনি চিকিৎসার্থে আমেরিকায় গেলেন তখন থেকে প্রায় প্রতিদিনই তাঁর চিকিৎসার অগ্রগতি সম্পর্কে নানারকম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রায় সবগুলি সংবাদপত্রে। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও লিখেছেন তাঁর নিজের চিকিৎসা এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত কলাম “নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ”সহ আরো অনেক লেখা। তাঁর লেখা এবং তাঁর সম্পর্কে খবরগুলি নিয়মিত পড়েছি অনলাইনে পাওয়া বাংলাদেশের সংবাদপত্রে।

২০১২ সালের ১৯ জুলাই যখন তাঁর মৃত্যু হলো – দুঃখে বুক ভেঙে গেছে তাঁর লক্ষ লক্ষ পাঠকের। হুমায়ূন আহমেদের কট্টর সমালোচকরাও কেউ তাঁর এরকম মৃত্যুতে অবিচল থাকতে পারেননি। এটাই স্বাভাবিক।

তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বেশ কিছু অপ্রিয় বাদানুবাদ, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে যা কিছুতেই অভিপ্রেত ছিল না। তাঁকে কোথায় কবর দেয়া হবে – তা নিয়েও হূমায়ূন আহমেদের পরিবারের ভেতরই মতভিন্নতা দেখা দিয়েছিল – এবং প্রচারমাধ্যম তা খুবই বিস্তারিতভাবে, অনেকক্ষেত্রে ফুলিয়ে ফাঁপিয়েও প্রচার করেছে। সর্বযূগে সর্বদেশে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা এরকমই।

নিউইয়র্কের মুক্তধারার মালিক বিশ্বজিত সাহার সাথে লেখক হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক বছরের। হুমায়ূন আহমেদের বই, নাটক, চলচিত্রের উত্তর আমেরিকার পরিবেশক মুক্তধারা। বিশ্বজিত সাহা হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবসময়েই কাছে ছিলেন এবং আমেরিকায় হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে অনেক কিছু করেছেন। তাই ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ সম্পর্কে স্বয়ং বিশ্বজিত সাহাই যখন একটি বই লিখলেন – তখন সেই বই সম্পর্কে পাঠকের আগ্রহ জন্মাবে সেটাই খুব স্বাভাবিক।

২০১৩ সালের বইমেলায় এই বই প্রকাশিত হবার পর সেটা নিয়ে হৈচৈ যেমন হয়েছে – তেমনি মেহের আফরোজ শাওনের সাথে বিশ্বজিত সাহার মনোমালিন্যও প্রকাশ্যে এসেছে। শাওন তথা মিসেস হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে বইটির প্রকাশককে উকিল নোটিশ পাঠান যেন বইটি বইমেলা থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং প্রচার ও বিক্রয় করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু তাতেও কাজ না হলে পুলিশ পাঠিয়ে বইমেলা থেকে সেই বইয়ের অনেকগুলি কপি বাজেয়াপ্ত করান। তাতে বইয়ের কাটতি অনেক বেড়ে যায়। সেই সময় বিশ্বজিত সাহা ইত্তেফাক পত্রিকায় এবং আরো কয়েকটি পত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদের শেষের দিনগুলি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন। সেইসময় সেগুলিও পড়েছিলাম।

এতবছর পর ‘হূমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ পড়ে আবারো মনে হলো হুমায়ূন আহমেদের মতো মানুষের শেষ দিনগুলি বিশেষ করে শেষের এক মাস ভীষণ যন্ত্রণাময় ছিল। এই যন্ত্রণা তাঁর পাবার কথা ছিল না।

হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের জন্য পুত্রশোক সহ্য করা ভীষণ কঠিন ছিল। অসহনীয় শোকের মধ্যেও তিনি কয়েক লাইনের একটি মন্তব্য করেছেন এই বইটি সম্পর্কে যে তিনি এই বইটি পড়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, কারণ বিশ্বজিত সাহা হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের কাছে ছিলেন।

লেখক আয়েশা ফয়েজের এই কথাগুলি খুবই গুরুত্বের সাথে বইয়ে সংযুক্ত করেছেন ভূমিকারও আগে প্রাক-ভূমিকা হিসেবে। আমার মনে হয়েছে লেখক এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন এই বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। লেখক নিজের ভুমিকাতেও উল্লেখ করেছেন আরো অনেক লেখকের এই বিষয়ে অনেক লেখা এবং বই প্রকাশের কথা। সেসব লেখার চেয়েও তাঁর নিজের লেখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য এটা প্রমাণের জন্য লেখক পুরো বইতে ডিটেলস এর প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন – যেমন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ওষুধের নাম, সময়, হাসপাতালের ডিটেলস – যা বইটিকে করে তুলেছে অনেকটাই ফ্যাক্ট ফাইল এর সংকলন।

হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত অভ্যাস থেকে শুরু করে তাঁর পরিচিত, ভক্ত, বন্ধুবান্ধব, হিতৈষীদের অনেকের – বিশেষ করে যারা প্রবাসে সেই সময়ে হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছেন সবার কথা উঠে এসেছে।

লেখকের নিজের ভূমিকা এবং তাঁর স্ত্রী রুমা সাহার কথা স্বাভাবিকভাবেই এসেছে প্রতিটি অধ্যায়ে কারণ হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বিশ্বজিত সাহা যতটুকু ভূমিকা রেখেছেন, প্রতিদিন হাসপাতালে যাওয়া, হুমায়ূন আহমেদের শিশুপুত্রদের দেখাশোনা করা, মেহের আফরোজ শাওনকে সঙ্গ এবং সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া সবই করেছেন রুমা সাহা।

প্রবাসী লেখক এবং বিজ্ঞানী পূরবী বসুও অনেক কিছু করেছেন হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার ব্যাপারে।

আমেরিকায় ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ অনেক। মুক্তধারার মাধ্যমে চিকিৎসার বেশিরভাগ খরচ স্পন্সর করেছেন বিশ্বজিত সাহা। তিনি কম খরচে চিকিৎসা যেন হয় সেজন্য হুমায়ূন আহমেদকে একটি মেডিক-এইড কার্ডেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই কার্ড সাধারণত আমেরিকার স্বল্প-আয়ের মানুষদের জন্য ফেডারেল সরকারের স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের অধীনে আমেরিকানদের দেয়া হয়। যদিও কার্ডটি দেয়া হয়েছে চিকিৎসার মাঝামাঝি সময়ে – তারপরও অনেক হাজার ডলার খরচ হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের জন্য যা যা করা সম্ভব সব করেছে। হুমায়ূন আহমেদকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অবৈতনিক একটি পদ দেয়া হয়েছিল – যেন যতদিন দরকার হয় তিনি আমেরিকায় থাকতে পারেন, আমেরিকার বাংলাদেশ দূতাবাসের সুযোগ-সুবিধা দরকার হলে নিতে পারেন। অনেক সময় বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা নিয়েছেনও তিনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর নিউইয়র্কের বাসায়। অর্থ সহায়তাও দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ অর্থ সাহায্য নেননি।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের সাথে বাস্তববাদী হুমায়ূন আহমেদ ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি সেইসব দিনগুলি নিয়ে বই লিখেছেন। নিয়মিত রসিকতা করেছেন। ছবি এঁকেছেন। তাঁর আঁকা ছবির ফ্রেম করেছেন লেখকের স্ত্রী রুমা সাহা। নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনীও হয়েছে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল ছবি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ ওঠানো হবে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত বদলান। তিনি ছবির প্রদর্শনী করতে রাজি হলেও বিক্রি করতে রাজি হননি।

২০১২ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখ সকাল আটটায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হুমায়ূন আহমেদ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। পরবর্তী ফলো আপের তারিখ দেয়া হয়েছিল ১৫ আগস্ট। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই ঘটে যায় ভয়ংকর ঘটনা এবং ঘটনা কিছুটা রহস্যময়ও হয়ে ওঠে।

১৯ তারিখ রাতেই নাকি হুমায়ূন আহমেদের নিউইয়র্কের বাসায় পার্টি হয়, সেখানে ঠিক কী কী হয় জানা যায় না। হুমায়ূন আহমেদ নাকি চেয়ার থেকে পড়ে যান, যদিও সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে বলে লেখক দাবি করেছেন। গোপন করেছেন মিসেস হুমায়ূন আহমেদ এবং প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম।

বিশ্বজিত সাহাকে খবর দেয়া হয় দুদিন পর – যখন হুমায়ূন আহমেদকে জ্যামাইকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরপর অনেকগুলি অপারেশন করাতে হয়। ডাক্তাররা শনাক্ত করেছেন হয়তো পড়ে গিয়ে আগের অপারেশনের সেলাই ছিড়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে পুরো একদিন বাসায় রেখে দেয়াতে তাতে ইন্টারন্যাল হেমারেজ হয় এবং ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে।

জুনের ২০ তারিখ থেকে জুলাইর ১২তারিখ পর্যন্ত অনেকগুলি অপারেশন, লাইফ সাপোর্ট এবং আমেরিকার হাসপাতালের সর্বোচ্চ চেষ্টাতেও বাঁচানো যায়নি হুমায়ূন আহমেদকে।

লেখকের কাছে সেই সময়ে শাওন ও মাজহারুল ইসলামের ব্যবহার এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। অনেকগুলি প্রশ্নের উদয় হয়েছে সেখানে। সেই প্রশ্নগুলির কোন নৈব্যক্তিক উত্তর আজও পাওয়া যায়নি।

হুমায়ূন আহমেদের মরদেহও একদিন বেশি আমেরিকায় রেখে দিতে হয় – শুধুমাত্র শাওন প্রথম শ্রেনির বিমান টিকেট ছাড়া দেশে ফিরবেন না বলে জেদের কারণে। শাওনের মা সরকার দলীয় এমপি হওয়াতে বেশ প্রভাব খাটিয়েছেন সেটাও স্পষ্ট।

হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় দাফন করা হবে সেটা নিয়েও হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পক্ষের সন্তানসন্ততি এবং ভাইবোন বনাম শাওনের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত নুহাশ পল্লীতেই দাফন করা হয়।

এই বইটি শাওন কেন নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর এই বইয়ের পাঠক হিসেবে আমি যতটুকু বুঝেছি তা হলো – শাওন চাননি তাঁর ব্যবহারের অসংলগ্নতা কেউ জানুক, কিংবা কেউ তাঁকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান।

হুমায়ূন আহমেদের ছবিগুলি লেখক বইতে দাবি করেছেন হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ছবিগুলি নিয়ে পরে কোনো ঝামেলা হতে পারে এটা কি তিনি টের পেয়েছিলেন?

বই প্রকাশের অনেক বছর পর সম্ভবত ২০২১ সালে মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূন আহমেদের ছবি চুরির অভিযোগে মামলা করেছিলেন রুমা চৌধুরি ও মঞ্জুরুল আজিম পলাশের বিরুদ্ধে। এগুলি বইয়ের বাইরের ঘটনা। আমি বেশ হতবাক হয়েছি বিশ্বজিত সাহা ও  রুমা সাহার বিবাহবিচ্ছেদ এবং রুমা সাহার মঞ্জুরুল আজিম পলাশকে বিয়ে করে আমেরিকা ছেড়ে বাংলাদেশে এসে বাস করার সংবাদে। ২০১২ সালে নাকি চব্বিশটি ছবির মধ্যে বিশটি ফেরত দেয়া হলেও চারটি ছবি ফেরত দেয়া হয়নি। রুমা সাহা নাকি বলেছিলেন সেগুলি হারিয়ে গেছে। ২০২১ সালে কুমিল্লায় এক প্রদর্শনীতে হুমায়ুন আহমেদের সেই হারিয়ে যাওয়া ছবিগুলি দেখা যায় – যে প্রদর্শনী করছিলেন রুমা চৌধুরি ও পলাশ। শাওন মামলা করেছিলেন এদের বিরুদ্ধে। দুবছর পর ছবিগুলি উদ্ধার করে শাওনের হাতে তুলে দেয়া হয়।

বিশ্বজিত সাহার বইটি হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলোর ক্রমানুগতিক ঘটনাপঞ্জি তাতে সন্দেহ নেই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে লেখক যেন পাঠকের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছেন তিনি হুমায়ূন আহমেদের জন্য কী কী করেছেন এবং কতখানি করেছেন। ভবিষ্যতের হুমায়ূন গবেষকদের তো বটেই, হুমায়ূনের শিশুপুত্রদ্বয় নিষাদ ও নিনিতও যদি কোনোদিন কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় – এই বই থেকে জানতে পারবে অন্য একটা ভার্সন যেটা হয়তো তাদের মা তাদেরকে অন্যভাবে বলেছেন।

বইটি দুঃখদিনের ঘটনা, তাই সুখপাঠ্য হবার দাবি রাখে না। কিন্তু তবুও বেশ কিছু ঘটনা এবং বর্ণনার পুনরুক্তি আছে। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ইতিহাসের অংশ। সে হিসেবে এই বইও ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছে।

------------

হুমায়ূন আহমেদের ছবি আঁকার হাতও যে এত চমৎকার তা আমরা জানতে পেরেছি তাঁর জীবনের একেবারে শেষের দিকে। এখানে তাঁর আঁকা কিছু ছবি রেখে দিলাম। 





Sunday, 5 January 2025

হায় সজনি - প্রেম বিরহের উপাখ্যান

 


সমরেশ মজুমদারের জীবনের শেষের দিকের উপন্যাস ‘হায় সজনি’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ এর ডিসেম্বরে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে একটানা পড়ে ফেলার মতো ছোট্ট উপন্যাস। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিনী কিংবা সাতকাহনের সমরেশ মজুমদার – তাই প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিল। 

উপন্যাসের ঘটনার সময়কাল দীর্ঘ। শুরু হয়েছে সেই সময় থেকে যখন কলকাতার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও ছেলে-মেয়েতে মেলামেশা তো দূরের কথা – কথা বলাটাকেও দোষের বলে ধরা হতো। গল্পের নায়িকা মৃণালিনী বড়লোকের মেয়ে, গাড়িতে করে কলেজে যায়। সারাক্ষণ মা-মাসীর নজরদারিতে থাকে। এরমধ্যে হঠাৎ একদিন মৃণালিনীর ইচ্ছে হলো স্বাধীনভাবে বাসে চড়তে। বাসস্টপে ‘টু বি’ নম্বর বাসের জন্য দাঁড়ালে অমিত তাকে বাস স্টেশনে দেখেই নাটকীয় কায়দায় “টু বি অর নট টু বি” বলে একটা মনলোগ আউড়ে দেয়। 

সেই তিল থেকেই তাল। না, সরাসরি মৃণালিনী কিংবা অমিতের কথাও হয় না, মেলামেশার তো প্রশ্নই ওঠে না। মৃণালিনীর মাসী খোঁজখবর নিয়ে অমিতের হোস্টেলে হাজির হন গোয়েন্দার মতো। অমিতকেই ভার দেন মৃণালিনীর ওপর নজরদারি করার জন্য। 

সময় গড়ায়। মৃণালিনীর বিয়ে হয়ে যায়, আবার অকালে বিধবাও হয়ে যায় সে। অমিত গল্প লেখে। তার গল্প থেকে সিনেমা হয়। মৃণালিনী সিনেমায় অভিনয় করতে চায়, আবার একটি সিনেমায় অভিনয় করেই হারিয়ে যায়। 

বছরের পর বছর কেটে যায়। অমিত বিখ্যাত সাহিত্যিক হয়। কিন্তু তার মনের ভেতরে মৃণালিনীর জন্য একটা জায়গা রয়েই যায়। শেষ অধ্যায় শেষ হয় নাটকীয় বিরহের মধ্য দিয়ে। একটু বেশি নাটকীয়ই বলা যায়। 

উপন্যাসে সব উপাদানই আছে। সমরেশ মজুমদার অভিজ্ঞ বিখ্যাত লেখক। কোনো উপাদানের ঘাটতি রাখেননি। কিন্তু উপাদানগুলি কেমন যেন একটু ছাড়া ছাড়া খাপছাড়া রয়ে গেছে। হতে পারে প্রত্যাশার পরিমাণ বেশি ছিল বলেই কেমন যেন অতৃপ্তি রয়ে গেছে। 


Sunday, 17 March 2024

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী - ইতিহাস ও রাজনৈতিক দর্শনের অমূল্য দলিল

 



বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রথমবার যখন পড়েছিলাম তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সাবলীল ভাষার দক্ষতায়। কী অনায়াসে তিনি নির্মেদ বাক্যে তুলে এনেছেন তাঁর সমসাময়িক ইতিহাস। পড়ার পর প্রথম যে কথাটি মনে হয়েছিল সেটা হলো – এই বই সর্বজনপাঠ্য হওয়া উচিত। আশা করেছিলাম – বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা সহ্যও করতে পারেন না কোনো না কোনো কারণে – তাঁরাও যদি এই বইটি পড়েন – জানতে পারবেন রাজনীতির কত চড়াই-উৎরাই পার হয়ে, কত দীর্ঘ সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। 

তার এক দশক পর সম্প্রতি বইটি আবার পড়লাম। এবার ঘটনার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর নৈতিক আদর্শের ব্যাপারটা টানলো আরো বেশি। প্রশ্ন জাগে – একটানা পনেরো বছর বঙ্গবন্ধুর নাম জপ করার পরেও আমাদের নেতাদের ভেতর তাঁর আদর্শের কোন ছাপ দেখি না কেন?

 বইয়ে উল্লেখিত সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই বই থেকে তথ্য নিয়েই রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অসংখ্য বই। সেই বইগুলির কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রচিত। 

২০১২ সালে প্রকাশিত হবার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’  সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত বই বাংলাদেশে। পাঠকরা নিজেদের মধ্যে কতটুকু উপলব্ধিমূলক আলোচনা করেছেন জানি না, তবে রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে এবং আনুকুল্য লাভের আশায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বইয়ের সুখ্যাতি করেছেন অনেকেই । শুনেছি বিসিএস পরীক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য এই বই – কারণ এই বই থেকে এক বা একাধিক প্রশ্ন প্রতি বৎসরই আসে, কিংবা মৌখিক পরীক্ষায় জিজ্ঞাসা করা হয়। অনলাইনে খুঁজলেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র অসংখ্য প্রশ্নোত্তর পাওয়া যায়। নিসন্দেহে এতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তথ্য কে কতটুকু জানে তা প্রমাণিত হয়। কিন্তু তথ্য জানা আর আদর্শ ধারণ করা কি এক? 

গত এক দশকে বঙ্গবন্ধুর পোশাক পরে যতজন নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক কিংবা সন্তানের চেয়েও বেশি সন্তান বলে গলা ফাটিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছেন – আমার কেন যেন মনে হয় তাঁদের কেউই বঙ্গবন্ধুর এই বইটি সম্পূর্ণ পড়েননি। যদি পড়তেন, কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিফলন দেখা যেতো তাঁদের মধ্যে। 

অবশ্য এটাও ঠিক, ধর্মীয় গ্রন্থ তো অনেকেই দিনরাত পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেন। তাতে কি ধর্মের আদর্শগুলি তাঁরা ধারণ করেন? যাই হোক, এই বইয়ে বর্ণিত ইতিহাস নয়, আমার কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটা হলো সেই সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভেতর আদর্শ নেতৃত্ব আর সত্যিকারের দেশপ্রেমের দর্শন গড়ে ওঠাটা। তাঁর আদর্শের ছিটেফোঁটাও যদি বর্তমান নেতাদের সবার ভেতর থাকতো!

রাজনীতির  পিচ্ছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে পংকিল পথ ধরে, অনেক ক্ষেত্রে জঞ্জাল পরিষ্কার করতে করতে তিনি উঠে এসেছেন একেবারে কর্মীর কাতার থেকে নেতার সারিতে। 

নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ঘটনা লিখতে লিখতে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু কিছু দার্শনিক লাইন লিখেছেন, যেগুলি আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত মূল্যবান তাঁকে চেনার জন্য। 

টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া জনপ্রতিনিধি সেই সময়েও ছিল (এখনো আছে বলাই বাহুল্য)। তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন: “এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি। আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেবার, যাতে তারা দল র‍্যাগ করে অন্য দলে না যেতে পারে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হল। তিনি বার বার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, “আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।“ আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্যদলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের!” (পৃ ৩৪)। 

বই থেকে কিছু লাইন যেখান থেকে বোঝা যায় তাঁর নীতিবোধ কতটা প্রখর ছিল:

“উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।“ (পৃ ৪৭)

“আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে পরশ্রীকাতর বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতর সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জনি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।“ (পৃ – ৪৭-৪৮)

“কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও যে বাঙালির দুঃখকষ্টের কারণ তা তিনি বুঝেছিলেন খুব ভালো করে। তাই তিনি পরিষ্কার ভাষায় উদাহরণসহ লিখেছেন এভাবে: “অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।“ (পৃ ৪৮)

ষড়যন্ত্রের রাজনীতি যে তখনো ছিল, এবং যতই দিন গেছে তা বেড়ে চলেছে তা তিনি জানতেন। “পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরাপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।“ পৃ ৭৮। 

তিনি কর্মবীর ছিলেন। তাঁর কর্মদর্শনও ছিল পরিষ্কার। “আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।“ (পৃ ৮০)

“কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিতে বলার অধিকার জনগণের আছে।“ (পৃ ১০০)

ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নেই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই।“ (পৃ ১২৬) এখনকার বৃদ্ধ ছাত্রনেতারা এই বই পড়লে নিশ্চয় লজ্জা পেতেন। 

“জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসকরা যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।“ পৃ ২১০

চীনের শান্তি সম্মেলনে গিয়ে তিনি নিজের চোখে যে শিল্প বিপ্লবের সূচনা এবং চীনা নাগরিকদের মানসিকতার পরিবর্তন দেখেছিলেন তা অত্যন্ত শিক্ষণীয়। “চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না, তা লোকে ব্যবহার করবে না।“ “এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হল জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে!” “এদেশে একটা বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরি করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়।“ পৃ ২৩১। 

দেশ স্বাধীন হলেই যে আপনাআপনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায় না তা তিনি ভালো করেই বুঝেছিলেন। চীনের সাথে পাকিস্তানের তুলনা করেছিলেন তিনি – “আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।“ পৃ ২৩৪।

পুঁজিবাদের কুফল সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল স্পষ্ট। “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।“ পৃ ২৩৪।

যুক্তফ্রন্ট করে ক্ষমতায় যাবার প্রস্তাবের উত্তরে ১৯৫৩ সালে তিনি বলেছিলেন, “ক্ষমতায় যাওয়া যেতে পারে, তবে জনসাধারণের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না, আর এ ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না। যেখানে আদর্শের মিল নাই সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।“ পৃ ২৫০।

“নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।“ “অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।“ পৃ ২৭৩।

আমাদের নেতারা কি দয়া করে এই বইটি মনযোগ দিয়ে পড়বেন এবং আত্মসমালোচনা করে দেখবেন – বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কতটুকু তাঁরা ধারণ করেন? 


Tuesday, 9 January 2024

মহাজাগতিক মানসভ্রমণ

 


মহাজাগতিক প্রথম আলো’র পাঠ প্রতিক্রিয়া

____________________

মাত্র পঁচিশ বছর আগেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বয়স হিসেব করেছিলেন আনুমানিক সাত থেকে বিশ বিলিয়ন অর্থাৎ সাত শ থেকে দুই হাজার কোটি বছর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু স্যাটেলাইট আর টেলিস্কোপের আধুনিকায়ন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যান্ত্রিক পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিজ্ঞানের উন্নতির ফসল কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন প্রায় সুনির্দিষ্টভাবেই হিসেব করে দেখেছেন যে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১৩৭০ কোটি বছর, খুব বেশি হলে ২০ কোটি বছর এদিক ওদিক হতে পারে। মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের সৌরজগৎ তথা পৃথিবীর বয়স অনেক কম, মাত্র সাড়ে চারশ কোটি বছর। অর্থাৎ মহাবিশ্বের উৎপত্তি হবার প্রায় নয় শ কোটি বছর পর আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তি হয়েছে। এই সাড়ে চারশ কোটি বছর বয়সী পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র দুই লক্ষ বছর আগে। আর এতসব আমরা জানতে শুরু করেছি মাত্র কয়েক শ বছর আগে থেকে। 

এত অতীতের ঘটিনা – যখন মানুষ তো দূরের কথা, আমাদের সৌরজগতই ছিল না – সেই সুদূর অতীতের কথা আমরা কীভাবে জানলাম? এই জানার মূলে আছে আলো। মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম শক্তির বিকিরণ হয়েছিল যে আলোর আকারে – সেই মহাজাগতিক প্রথম আলোই আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে মহাবিশ্বের আদি অবস্থার, একেবারে গোড়ায় কী হয়েছিল সেসব ঘটনার। মহাবিশ্বের পটভূমিতে ছড়িয়ে থাকা সে আদি আলোর অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা খুঁড়ে আনছেন আমাদের মহাবিশ্বের অতীত ইতিহাস। আমাদের মাথার ওপর যে আকাশে জ্বলতে দেখছি লক্ষ কোটি তারার মেলা – তাদের অনেকেই হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক বছর আগে – কিন্তু যে আলো রওনা দিয়েছিল মিলিয়ন বছর আগে – সেই আলো এসে পৌঁছাচ্ছে এতদিন পরে – মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব পার হয়ে। 

থ্রিলারের চেয়েও রোমহর্ষক এসব মহাজাগতিক ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে একটার পর একটা ধারবাহিকভাবে চলে আসেনি। মহাবিশ্বের রহস্যের জটখোলা এত সহজ নয়। একেক সময় একেক ঘটনার ভেতর দিয়ে একেক রকমের আবিষ্কার ঘটে। সেসব আবিষ্কারের তথ্য থেকে মহাবিশ্বের রহস্যের ধারাবাহিকতা খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীদের বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করতে হয়। সেই গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে গবেষণাপত্র তৈরি হয়। নানাসময়ের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপন করতে হয় বিজ্ঞানের বইপত্রে। সেখান থেকে আমরা সাধারণ মানুষ জানতে পারি – মহাবিশ্বে কী ঘটলো কখন ঘটলো। সেরকম জুৎসই বই হলে বই পড়তে পড়তেই পাঠকের মানসভ্রমণ হয়ে যেতে পারে – মহাবিশ্বের একেবারে গোড়ার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। আবুল বাসারের “মহাজাগতিক প্রথম আলো বিগ ব্যাং ও পটভূমি বিকিরণের খোঁজে” তেমনই এক সুখপাঠ্য বিজ্ঞানবই যা পড়ার সময় মহাজাগতিক মানসভ্রমণের অনুভূতি হলো। 

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লেখা সহজ নয়। কারণ অনেক। প্রথমত বৈজ্ঞানিক শব্দগুলির যথাযথ বাংলা পরিভাষা আমাদের নেই। দ্বিতীয়ত আমরা বিজ্ঞানের বই হয়তো অনেক পড়ি, কিন্তু সেভাবে বিষয়ভিত্তিক বিজ্ঞানচর্চা আমাদের নেই। আমাদের বিজ্ঞানপাঠের প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষা পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়। ফলে বিজ্ঞান লেখকের জন্য পাঠকের কাছ থেকে যে চ্যালেঞ্জটা আসার কথা সেটা অনেকসময় আসে না। আরো একটা বড় কারণ হলো – বিজ্ঞানের জনপ্রিয় বই লিখতে গিয়ে আমরা ইংরেজিতে লেখা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইগুলির ভাষাশৈলিও অনুকরণ করি, অনেকসময় হয়ে ওঠে আক্ষরিক অনুবাদ। এটা দোষের কিছু নয়। একসময় জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হতো আমেরিকান বা ইংল্যান্ডের লেখকদের। 

বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন এখন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম লেখক আবুল বাসার। তিনি একাধারে জনপ্রিয় অনুবাদক, মাসিক বিজ্ঞানচর্চার নির্বাহী সম্পাদক। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই অনুবাদের পাশাপাশি তিনি ইতোমধ্যে নিজস্ব বই লিখেছেন বেশ কয়েকটি। প্রথমা থেকে প্রকাশিত মহাজাগতিক প্রথম আলো তাঁর অত্যন্ত দরকারি একটি বই। 

বিশটি অধ্যায় আছে এই বইতে। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম আকর্ষণীয় – যেমন ‘একঘেয়ে ভুতুড়ে হিসহিস’, ‘দুটি প্যারাডক্স ও আইনস্টাইনের মহা ভুল’, গ্যামো অ্যান্ড গং, একটি হরর মুভি ও থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, কফিনের শেষ পেরেক, নোবেল ও শোক সমাচার – ইত্যাদি। শিরোনাম পড়ে মনে হচ্ছিলো থ্রিলার কাহিনিতে ঢুকতে যাচ্ছি। বিজ্ঞানের ইতিহাসের কাহিনিগুলিও তিনি সাজিয়েছেন সেভাবে সমান আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। 

শুরুতেই তিনি চমকে দিয়েছেন ১৯৬৫ সালে নিউ জার্সিতে বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসনের হর্ন অ্যান্টেনায় ধরা পড়া ভুতুড়ে হিসহিস নয়েজের ঘটনার মাধ্যমে। সেখান থেকে তিনি অতীতে গিয়েছেন, গিয়েছেন বিজ্ঞানীদের পরবর্তী কর্মকান্ডে। 

বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ই স্বয়ং-সম্পূর্ণ আবার উপন্যাসের মতো ঘটনার প্রবাহে সচল। ঘটনাপ্রবাহে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাজকর্ম বর্ণিত হয়েছে, বিজ্ঞানীদের অতিসংক্ষিপ্ত জীবনীও আছে সাথে যেখানে যেটুকু দরকার। রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেকসান্দার ফ্রিডম্যান, বেলজিয়ামের জর্জ লেমিত্রি, আমেরিকার হেনরিয়েটা লিভেট, হার্লো শ্যাপলি, হেবার কার্টিস, এডুইন হাবল, জর্জ গ্যামো, র‍্যালফ আলফার, রবার্ট হারম্যান, ফ্রেড হয়েল, রবার্ট ডিকি – প্রায় প্রত্যেক মহারথির কথাই এসেছে যথাপ্রসঙ্গে। 

জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্য এই বইয়ের ভূমিকায় সঠিকভাবেই লিখেছেন – যে এই বই ধরতে গেলে জ্যোতির্বিদ্যার আধুনিকতার সূত্রপাতের কাহিনি। আমি তাঁর সাথে সম্পূর্ণ একমত। সাবলীল ভাষা এই বইয়ের প্রধান আকর্ষণ। ভাষার কারণে হোঁচট খেতে হয়নি তেমন কোথাও। 

তবে কয়েকটি জায়গায় আমার সামান্য একটু মন্তব্য আছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৬৯ পৃষ্ঠায় বুনসেন ও কার্শভের যন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে “যেখানে একটি সরু স্লিট বা নল বসানো ছিল” – স্লিট আর নল কিন্তু এক জিনিস নয়। একই অধ্যায়ে ৭২ পৃষ্ঠায় হাইড্রোজেন পরমাণুর শক্তিস্তর বোঝানোর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের ফোটন শুষে নেয়ার ঘটনাটি খুব একটা পরিষ্কার হয়নি। আগত ফোটনের শক্তি আর ইলেকট্রনের বাইন্ডিং এনার্জির উপর নির্ভর করে ফোটনটি শোষিত হবার পর ইলেকট্রন শক্তিস্তর অতিক্রম করতে পারবে কি না, নাকি উত্তেজিত হবার পর আবার ফোটন বের করে দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়বে। 

সপ্তম অধ্যায়ে ৮২ পৃষ্ঠায় কিছুটা রূপক অর্থে বলা হয়েছে রসায়নবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানীদের ভাগ্য কীভাবে জ্যোতির্বিদদের ভাগ্যের চেয়ে ভালো। এই ব্যাপারটিতে আমার মতো আরো অনেক পাঠকই হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানী কিংবা রসায়নবিদ কাউকেই বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। 

৮৭ পৃষ্ঠার গ্রাফে উলম্বিক অক্ষে মন্দন বেগ কেন হিসেব করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করলে ব্যাপারটি আরো বোধগম্য হতো।

নবম অধ্যায়ে ১০২ পৃষ্ঠায় কথার ছলে লেখা হয়েছে বর “শুভদিন দেখে” নিজের দেশ ডেনমার্ক ছেড়ে আশ্রয় নিলেন ব্রিটেনে। এখানে কথার কথা হলেও “শুভদিন” ব্যাপারটি নীলস বোরের ক্ষেত্রে খাটে না। একই অধ্যায়ের ১১৪ পৃষ্ঠায় বিটা ক্ষয় বা বিটা ডিকের ব্যাখ্যাটিতে নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয়ে একটি ইলেকট্রন বিটা পার্টিক্যাল আকারে বের হয়ে আসার ব্যাপারটা উল্লেখ করা হয়নি। 

একই অধ্যায়ে ১১৭ পৃষ্ঠায় যেখানে সূর্যের কেন্দ্রে শক্তির উৎপত্তি দেখানো হয়েছে – সেখানে আমাদের বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার আয়নাইজেশান সূত্রকে খুব বেশি মিস করেছি। এই বইতে মেঘনাদ সাহার কাজ খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল, অথচ মেঘনাদ সাহা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। 

১৫তম অধ্যায়ে ১৭৭ পৃষ্ঠায় ১৯৫৬ সালে ট্রানজিস্টার উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন বেল ল্যাবের দুজন বিজ্ঞানীর জায়গায় তিনজন বিজ্ঞানী হবে। 

এই বইয়ের শেষে তথ্যনির্দেশে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের টীকা দেয়া আছে – যা কোন পাঠককে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা দেবে। 

শুধু এই বইয়ের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো বিজ্ঞানের বইতেই আমি বইয়ের শেষে শব্দের নির্ঘন্টটা খুব মিস করি। প্রকাশকরা হয়তো বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা না বাড়ানোর জন্য, বইয়ের দাম কম রাখার জন্য নির্ঘন্ট দেন না, কিন্তু ইনডেক্স বা নির্ঘন্ট ছাড়া যে কোনো মননশীল বই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কারণ এসব বই তো শুধুমাত্র একবার পাঠের জন্য নয়। পরে যখন এই বই আমি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবো – তখন পুরো বই আমাকে তন্ন তন্ন করতে হবে কোন নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য। 

আরো একটি ব্যাপার আমি খুব মিস করি বাংলা বইয়ে – সেটা হচ্ছে ক্রস রেফারেন্স বা টীকা। যেমন এই বই থেকেই উদাহরণ দিই – পৃষ্ঠা ৪৭ – “তাঁর এই গবেষণার ফল অচিরেই জার্নালে প্রকাশিত হলো।“ পাঠক এখানে জানতে চাইতে পারেন সেই জার্নালের ফুল রেফারেন্স। সেটা টীকা আকারে দেয়া যেতো। পৃষ্ঠা ৫৭ – হাবল তাঁর বাবার মৃত্যুর পর কীভাবে মনের অবস্থা বর্ণনা করেছেন তার উদ্ধৃতি আছে। কিন্তু রেফারেন্স নেই। পাঠকের কৌতূহল এখানে মিটছে না। সেজন্য লেখক ও প্রকাশকদের কাছে আমার আবেদন – বইয়ের পৃষ্ঠা কমিয়ে দাম যতই কম রাখার চেষ্টা করুন – যিনি বই কিনবেন না তিনি কিছুতেই কিনবেন না। আর ভালো বই ভালোভাবে বের করেন, পাঠক কিনবে। কারণ বাংলাদেশের বইয়ের দাম এখনো ফাস্টফুডের দামের চেয়ে অনেক কম। 

মহাজাগতিক প্রথম আলোর পাঠক আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি থেকে বর্তমান অবস্থায় আসার বিভিন্ন ধাপগুলির প্রমাণ তো পাবেনই – সাথে পাবেন মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করার খোরাক। এধরনের বিজ্ঞানের বই চিন্তার খোরাক জন্মায় – এখানেই লেখকের সাফল্য। 


বই - মহাজাগতিক প্রথম আলো

লেখক – আবুল বাসার

প্রকাশক – প্রথমা প্রকাশন

প্রকাশকাল – ২০২২

পৃষ্ঠাসংখ্যা – ২৪০

মুদ্রিত মূল্য – ৫০০ টাকা

ISBN 978 984 96885 0 1


Sunday, 18 June 2023

বিমল কান্তি গুহ’র “তীর্থযাত্রার ত্রিশ দিন”

 


নাপোড়া-সেখেরখীল গ্রামের বিশিষ্টজন হিসেবে বাবু বিমল কান্তি গুহকে সবাই মান্য করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন তাও অনেকদিন হলো। আমি তাঁর স্কুলে পড়াশোনা করিনি বলে সরাসরি তাঁর ছাত্র নই। কিন্তু আমাদের যুগে শিক্ষক মাত্রেই সম্মানিত ছিলেন, সরাসরি ক্লাসে পড়ানোর দরকার হতো না। আমার ছোটবেলায় আমি সব শিক্ষককেই ভয় পেতাম, বিমলস্যারও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। প্রচন্ড রকমের গম্ভীর আর রাশভারি মনে হতো তাঁকে। আমার বাবার সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সে হিসেবেও আমি তাঁর স্নেহ পেয়েছি। তাঁর বড়ছেলে লিটন আমার পরের ক্লাসে পড়লেও আমরা বন্ধুর মতো এক সাথে খেলাধুলা, ক্লাব, নাটক আর বাঁদরামি করতে করতে বড় হয়েছি। সে হিসেবেও বিমলস্যারের স্নেহধন্য হয়েছি। ভৌগোলিক দূরত্ব আর নাগরিক সময়ের অপ্রতুলতার কারণে এখন আর সেভাবে দেখা হবার সুযোগ ঘটে না। তবে এবার ছুটিতে গিয়ে বিমলস্যারের “তীর্থযাত্রার ত্রিশ দিন” বইটি পেয়ে খুব খুশি লাগলো। 




বিমলস্যার ২০০০ সালে ভারতে গিয়েছিলেন তীর্থভ্রমণে। বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিয়ে তীর্থভ্রমণ করিয়ে আনার প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে এখন। এবং দলবদ্ধভাবে অনেকেই যাচ্ছেন তীর্থ করতে। পুণ্য আর ভ্রমণের আনন্দ দুটোই লাভ হয় মোটামুটি কম খরচে – এই বিশ্বাস যাদের আছে তাঁরা এই ভ্রমণে যান। অন্যান্য যাত্রীদের সাথে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, দিল্লি, আগ্রা ইত্যাদি অনেক জায়গাউ ঘুরেছেন তিনি ত্রিশ দিন ধরে। 


বর্ণনায় এক ধরনের সারল্য আছে, অকপটতা আছে। ভাষার গাঁথুনি সহজ। অনেকসময় নির্ভুলও নয়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর সহজ সরল বিবরণ বলেই বেশ ভালো লাগে পড়তে। পড়তে পড়তে মনে হয় লেখক সামনে বসেই বলছেন কথাগুলি। 


ভ্রমণ কাহিনির কিছু কিছু জায়গায় ধর্মীয় ব্যাখ্যাও আছে। তীর্থযাত্রার বর্ণনাতে ধর্মতীর্থের বর্ণনা তো থাকবেই। 


বাংলাদেশী তীর্থযাত্রীদের ভারতীয় পরিচয়ে কম টাকার টিকেটে তাজমহলে ঢুকিয়ে দেয়া, বিভিন্ন সেবায়তনে থাকা, তিন বেলা পথের ধারে বাস থামিয়ে রান্না করে খাওয়া, প্রকৃতিতে প্রকৃতি সারা কোনো কিছুই বাদ যায়নি বর্ণনা থেকে। এখানেই লেখকের সাধু সার্থকতা। 


লেখকের বড়ছেলে অ্যাডভোকেট লিটন কান্তি গুহর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটি সব জায়গায় হয়তো পাওয়াও যাবে না। আমাদের লাইব্রেরিতে এক কপি সংগ্রহ করা হয়েছে। পড়ে খুব ভালো লাগলো। 


Saturday, 17 June 2023

আনিসুল হকের 'গুড্ডুবুড়া কমিক্স ৩'

 



আনিসুল হক খুবই ব্যস্ত লেখক। ছোট বড় মাঝারি সবার জন্যই লেখেন তিনি। গুড্ডূবুড়া তাঁর কমিক। হাস্যরসাত্মক কাজকর্ম থাকার কথা সেখানে। আছে অনেক। অবশ্যই আছে। হাসি না এলে বুঝতে হবে পাঠকের মন ভালো নেই। 

মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'আমার ডেঞ্জারাস মামী'

 



মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই মানেই হলো ধরেই পড়ে ফেলা যায়। 
ছুটিতে গিয়ে হাতের কাছে পেলাম। পড়ে ফেললাম। 

ঘটনার ঘনঘটা আছে বইতে – যা জাফর ইকবালের অনেকটাই ট্রেন্ড মার্ক এখন। বিজ্ঞানের কিছু পূর্বঘটিত বিক্রিয়ার মতোই আগে থেকে বলে দেয়া যায় কী কী ঘটতে পারে। 

যাঁকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস – তিনি মামী। মামার সাথে তাঁর ডিভোর্স হয়ে গেছে। কিন্তু মামী খুবই ভালো। যে পরিবারে তিনি বৈবাহিক সূত্রে এসেছিলেন, বিবাহ ভেঙে যাওয়ার পরেও তিনি সেখানে ঘুরেফিরেই আসেন। পরিবারের সব বাচ্চাদের আদর করেন। বাচ্চারাও তাঁকে অসম্ভব ভালোবাসে। মামী বিজ্ঞানী। একটি গবেষণা-জাহাজ নিয়ে তিনি সমুদ্রে যান গবেষণা করতে। সেখানে মামীর সহকারী হিসেবে সাথে যায় টুলু। টুলুর জবানীতেই বইটি লেখা। 

জাহাজে টুলুর সমবয়সী মেয়ে মিতির সাথে দেখা হয়। মিতি কানে শুনতে পায় না। তাই কথাও বলতে পারে না। কিন্তু অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকে। জহির নামে আরেকজন ছেলেও থাকে জাহাজে। জহির খুব পাজি টাইপের ছেলে। সে নানারকম দুষ্টুমি করে। টুলু তাকে বিভিন্নভাবে নাস্তানাবুদ করে। বিভিন্ন অভিযানও হয়। মিতি আর টুলু ঘটনাচক্রে বিশাল কিছু আবিষ্কারও করে ফেলে যা বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকে খুঁজছিলেন। 

আমাদের বাড়ির শিশুরা এখন বড় হয়ে গেছে। এখন তাদের শিশুদের বড় হবার পালা চলছে। এই বইটি যে বয়সীদের জন্য লেখা সেরকম কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি কেমন লাগলো। তবে আমার মনে হয় ছোটদের জন্য লেখা বই বড়দের পড়া উচিত নয়। কারণ বুদ্ধি পেকে গেলে সেই বুদ্ধি আনন্দ পাবার চেয়ে খুঁত ধরার দিকে মন দেয় বেশি। অবশ্য কিছু কিছু বই আছে যা ছোটদের জন্য লেখা হলেও সব বয়সের পাঠকেরাই চিরদিন আনন্দ পায়। ‘আমার ডেঞ্জারাস মামী’ সেরকম বই নয়। 



Tuesday, 18 April 2023

মাসুদ রানা ০০৭ - শত্রু ভয়ঙ্কর

 




এই বইটি একটু একটু করে পড়তে দীর্ঘদিন লেগেছে। থ্রিলার একটানে পড়ে ফেলার কথা। টানটান উত্তেজনা থাকার কথা। ক্লাস নাইন-টেন-ইলেভেনে যেভাবে দস্যু বনহুর পড়তাম, এখনো সেভাবে পড়তে পারলে বেশ লাগতো। এখন যে ভেতরের পাঠক মরে গেছে তা নয়, কিন্তু এখন কেমন যেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে অনেক। কাজও বেড়েছে, একসাথে অনেক কাজ করার মাল্টি টাস্কিং নামে এক অভ্যাস তৈরি হয়েছে। তাতে যে খুব কাজ হয়ে যায় তা নয়। তবে অনেক কাজই শুরু হয়, কোনোটাই ঠিকমতো শেষ হয় না। পল ডিরাক যে একসাথে একটির বেশি কাজ কখনোই করতেন তা – তার সুফল তিনি হাতে হাতে পেয়েছিলেন। 

মাসুদ রানা সিরিজের সপ্তম বই ‘শত্রু ভয়ঙ্কর’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। হয়তো আমার জন্মেরও আগে। ক্লাস টেনে পড়ার সময় সুশান্ত যখন কাঞ্চন নগর থেকে পটিয়ায় এসে মাসুদ রানার বই কিনে নিয়ে যেতো, তখন আমি পটিয়াতে ছিলাম। ইচ্ছে করলে মাসুদ রানা পড়তে পারতাম। কিন্তু আমি সেসময় দস্যু বনহুরই শুধু পড়েছি। কেন যে মাসুদ রানা তখন পড়িনি জানি না। এখন এই বয়সে যখন মানুষ ভারী ভারী বই পড়ে বিজ্ঞজনোচিত আচরণ করে, আমি তখন কৈশোরের স্মৃতিকাতরতা নিয়ে মাসুদ রানা পড়ি। তাতে মাসুদ রানার আরোপিত বীরত্বে যতটা যা আমোদিত হই, তার চেয়েও বেশি ফিরে আসে আমার কৈশোরের স্মৃতি। 

শত্রু ভয়ংকর কবে পড়তে শুরু করেছিলাম মনে নেই। শেষ করলাম কুবার পিডিতে গিয়ে। মেলবোর্ন থেকে এডেলেইড যাবার পথে এয়ারপোর্ট আর প্লেনে বসেও পড়েছি। ফোনে গাদা গাদা বই থাকে, এটা যে কী পরিমাণ সুবিধা দেয়!

এবার আসি শত্রু ভয়ঙ্করের কথায়। পাকিস্তানের স্পাই মাসুদ রানাকে ইস্তাম্বুলে পাঠানো হয় মূলত রাশিয়ার আণবিক বোমা এম-৩১৫ – যা চুরি হয়ে গেছে তা খুঁজে বের করার জন্য। সেজন্য নানারকম নাটকীয় ঘটনা ঘটায়। ইস্তাম্বুলে খুনের অপরাধে বিচার হবার সময় যে সুন্দরী যোহরা হাসানকে সাথে নিয়ে পালায়। যেরকম ধারণা করা হয়, সেরকমই ঘটে – যোরা রানাকে ভালোবেসে ফেলে। স্বাভাবিক। এদিকে যোরার বাবাকে জিম্মি করে ফেলে ইস্তাম্বুলের মাফিয়া চিফ ইয়াকুব বে। 

মাসুদ রানা, জাহাজ, জাহাজের ভেতর যুদ্ধ যুদ্ধ, এবং সবশেষে মধুরেন সমাপয়েৎ। আলাদা করে কেমন লেগেছে বলার কোন মানে হয় না। 


Saturday, 11 February 2023

ফাল্গুনী অমনিবাস কিংবা কিছুই না

 



লেখক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়কে আমি এই সেদিনও লেখিকা মনে করতাম। এখন অবশ্য লেখক শিক্ষক পরিচালক এরকম সব পেশাগত পরিচয়ের আর লৈঙ্গিক বিভাজন হয় না। এখন তসলিমা রুদ্র দুজনই লেখক। লেখিকা, শিক্ষিকা, পরিচালিকা এরকম শব্দগুলির ব্যবহার এখন খুবই অনাধুনিক। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বই কখন পড়েছিলাম হুবহু দিন-তারিখ মনে নেই। তখন এমন একটা সময়, যখন পরীক্ষার জন্য ‘সময়ের মূল্য’ রচনা মুখস্থ করতে হতো, কিন্তু সময়ের আলাদা কোন মূল্যই সেই সময় ছিল না আমার কাছে। সুনীলের ‘সেই সময়’ তখনো প্রকাশিত হয়নি, পড়া তো আরো অনেক পরের ব্যাপার।

বাড়িতে একজন ইঁচড়ে পাকা খুড়তুতো বড়ভাই ছিলেন। তার অনেকগুলি শখের একটি ছিল বইপড়া। নানান জায়গা থেকে নানান রকমের বই জোগাড় করে আনতেন তিনি। তক্কে তক্কে থাকতাম কখন হাত ঘুরে আমার হাতে আসবে। ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বই যেটা আমার হাতে এসেছিল – মধুমিলন টাইপের কিছু একটা নাম ছিল তার। তখন সবে গোঁফ গজাতে শুরু করেছে, শরীরে গোলমেলে নতুন হরমোনের প্রভাব প্রকট। মাথার ভেতর যখন তখন উঁকি মারে নানান নিষিদ্ধ কৌতুহল। নামের কারণেই বইটির প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। পড়ার পর মনে হয়েছিল বইটির নামকরণের স্বার্থকতা নেই।

পরে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের আরো অনেক বই পড়া হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। তাঁর কাহিনি থেকে তৈরি ভারতীয় সিনেমা ‘শাপমোচন’ও দেখেছিলাম। তখন চট্টগ্রাম শহরে অনেকগুলি বইয়ের দোকান ছিল, বইয়ের ক্রেতাও ছিল অনেক। ফুটপাতেও বই বিক্রি হতো অনেক। বেশিরভাগই পাইরেটেড বই। তখন অবশ্য পাইরেসি সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। তিন-চার টাকা দিয়ে ফালগুনী, আশুতোষ, নীহাররঞ্জন, নিমাই ভট্টাচার্যের বই কিনতে পেরেই আমি খুশি ছিলাম। ফুটপাত থেকে কিনেই পড়েছিলাম ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নিমান’। বইটি পড়ে তখন কেমন লেগেছিল এখন আর মনে নেই। মানব-মানবীর মানসিক জটিলতার পুরোটা বোঝার মতো বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা কোনটাই ছিল না তখন। তাই সেই সময়ের অনুভূতির বিস্মরণ ঘটেছিল।

এতদিন পরে এই ফাল্গুনের প্রাক্কালে আবার নতুন করে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় পড়তে হলো। বাংলাদেশে হাতেগোনা যে ক’টা বইয়ের দোকান এখনো টিকে আছে, দেখলাম সেখানে ‘ফাল্গুনী অমনিবাস’ নামে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের তিনটি বইয়ের একটি সংকলন বেশ প্রকটভাবেই শোভিত হচ্ছে। আমার এক বন্ধু সেই বইটি আমাকে পাঠানো কর্তব্য মনে করে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে পেয়েই পড়তে বসে যেতো যে পাঠক – সেই পাঠক এখন আর নেই। আমার বন্ধুটিও তা জানে বলেই বারবার জিজ্ঞেস করে বইটি পড়েছি কি না।

‘অনেক আগে পড়েছি’ – বিরক্তি চেপে বলি।

‘অনেক আগে পড়েছিস সেটা তো জানি। এখন পড়ে বল – আগের মতো লেগেছে কি না।‘ কন্ঠ থেকে বিরক্তির ভাব চাপা দেয়ার ভদ্রতা আমি দেখালেও সে দেখায় না।

না পড়েই পড়েছি বলে ফেলতে পারতাম। শুনেছি অনেকে নাকি ফ্ল্যাপের দশ লাইন পড়েই বইয়ের রিভিউ করে ফেলে। কিন্তু প্যাথোলজিক্যাল লায়ারও কারো কারো কাছে মিথ্যা বলে না। বইটি – মানে ফাল্গুনীর তিনটি উপন্যাস আবার পড়তে হলো। চিতা বহ্নিমান, চরণ দিলাম রাঙায়ে, এবং স্বাক্ষর। এই বইগুলি প্রথম পড়ার কী অনুভূতি ছিল তা এখন মনে নেই। কিন্ত এখনকার পাঠে আগের যদি কোন ভালো লাগা থেকেও থাকে তা উধাও হয়ে গেছে। ঘটনা, বর্ণনা, পরিণতি – কোনটাই যুতসই মনে হলো না। তার চেয়েও বেশি যেটা খচখচ করছে সেটা হলো ঘটনা তৈরির পেছনের দর্শন। যুক্তিহীন দর্শন মেনে নিতে হলে মানসিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।

চিরায়ত সাহিত্য আমরা তাদেরকেই বলি – যারা বহুবার পাঠেও পুরনো হয়ে যায় না, ভালো লাগা একটুও কমে না। ফাল্গুনীর এই বইগুলি সেরকম নয়। তবে অনেক দিন আগের পড়া বই আবার পড়তে গেলে – ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়, সেটাই লাভ। ফাল্গুনী অমনিবাস উসকে দিয়েছে কিছু পুরনো দিনের স্মৃতি। এখন মনে পড়লো ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের দুইটি বই আমার বুকশেলফ থেকে কে নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেয়নি।


Wednesday, 10 August 2022

শারমিন আক্তার সাথীর 'কিছু সাদা টিউলিপ'

 



ইয়ামিন আর প্রকৃতির ভালোবাসার গল্প ‘কিছু সাদা টিউলিপ’। দু’জন দুই পথের, দুই ধর্মের, দুই প্রকৃতির মানুষ – কিন্তু ভালোবাসার টানে মিলে যায় এক পথের মোহনায়; ভালোবাসার পথ। দোর্দন্ডপ্রতাপ ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজ এমপি মজিবর শাহ – চোরাচালানসহ যাবতীয় দুষ্কর্ম করে থাকেন। এসব কাজে তার ভাগনে ইয়ামিন তার ডানহাত। ক্ষমতাশালী মামা থাকলে যা হয় – তা বুঝে নিতে আমাদের সমস্যা হয় না। এই ইয়ামিনের প্রেমে পড়ে যায় একটি বিউটি পার্লারের মালিক খ্রিস্টান তরুণী প্রকৃতি। শুরুতে এক তরফা। ইয়ামিন এসে প্রকৃতির বিউটি পার্লারে ভাঙচুর চালায়। পরে তার ক্ষতিপূরণ দেয়। এতেই হয়তো ইয়ামিনের একটা কোমল মনের পরিচয় পায় প্রকৃতি। তাতেই ভালো লাগা। কাহিনিতে এমপি সাহেবের জীবন আছে। এমপি সাহেব তার আপন শালীকে একা পেয়ে ধর্ষণ করে। সেই ঘটনা চাপা দিতে এমপির স্ত্রী তার বোনের সাথে স্বামীর বিয়ে পড়িয়ে দেয়। সে নিয়ে দুই বোনের টানাপোড়েন আছে। ওদিকে প্রকৃতির মা-বাবা, ভাই-বোনের কথা আছে। সব মিলিয়ে কাহিনি এগিয়ে চলে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। মিলনাত্মক পরিণতি আকাঙ্খিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিরহে পরিণত হয়।

বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালের বইমেলায়। অনেকে নতুন লেখক পুরনো লেখক এভাবে ভাগ করে ফেলেন। আমি মনে করি লেখকদের মধ্যে নতুন পুরনোতে ভাগ হয় না। যে কোনো লেখকই যখন নতুন কোন লেখা নিয়ে আসেন, তখন তো তিনি নতুনই। শারমিন আক্তার সাথীর আর কোনো লেখা আগে পড়িনি। 

শারমিন আক্তার সাথীর এই উপন্যাসের কাহিনি সোজাসাপ্টা। সংলাপগুলি মাঝে মাঝে অহেতুক দার্শনিকতায় আক্রান্ত হলেও খুব বেশি ঝামেলা করে না। কিছু কিছু দার্শনিক উক্তি বেশ জোরালো। যেমন, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় স্বার্থ হচ্ছে ভালোবাসা। আর আমরা আমাদের জীবনে বহু মানুষ, প্রাণী বা বস্তুকে ভালোবাসি, তারাও আমাদের ভালোবাসে। সে হিসেবে আমরা সবাই স্বার্থপর।‘

বইটি প্রকাশ করেছে তাম্রলিপি। কিন্তু বানান কেন নির্ভুল করা যাচ্ছে না, বুঝতে পারছি না। প্রুফ রিডার এবং সম্পাদকরা কেন এগুলি দেখেন না? একটা জায়গায় লেখক হয়তো পান্ডুলিপিতে নোট লিখে রেখেছিলেন, “এখানের একটা অংশ বাড়তি কাগজে লিখে দিলাম”। সেটাই ছাপানো হয়ে গেছে বইয়ের অংশ হিসেবে (পৃ ৭৫)!

প্রকৃতির স্বপ্ন ছিল নেদারল্যান্ডে গিয়ে সাদা টিউলিপের বাগান দেখে আসার। ইয়ামিন তার সেই স্বপ্নপূরণের স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলেই এই কাহিনির সমাপ্তি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। 


Tuesday, 17 May 2022

চেতন ভগতের 400 Days

 



ইংরেজি ভাষায় যে ক’জন ভারতীয় লেখক উপন্যাস লিখে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন – চেতন ভগত তাঁদের অন্যতম। শুধুমাত্র অন্যতম বললে কম বলা হবে, চেতন ভগতের লেখা সবগুলি উপন্যাস খুবই পাঠকপ্রিয় হয়েছে। কোন্‌ বই কতটা ভালো লেগেছে পাঠকের – তা বিচারের প্রধান মাপকাঠি হলো সেই বইয়ের কত কপি বিক্রি হয়েছে। চেতন ভগতের প্রতিটি বই বিক্রি হয় দশ লক্ষ কপিরও বেশি। সে তো গেলো মূল ইংরেজিতে। অন্যান্য ভাষাতেও তাঁর বইয়ের বৈধ-অবৈধ অনেক অনুবাদ হচ্ছে। বৈধ অনুবাদ হচ্ছে মূল লেখক এবং/অথবা মূল প্রকাশকের অনুমোদিত অনুবাদ, আর অবৈধ অনুবাদ হচ্ছে – যে অনুবাদের কথা লেখক/প্রকাশক জানেনও না।

চেতন ভগতের লেখা কেন এত মানুষের ভালো লাগছে? তাঁর লেখার সাহিত্যমূল্য কোন স্তরের? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ নয়। কারণ গল্প-উপন্যাসের মান বিচার করার ব্যাপারটা বস্তুনিষ্ঠ নয়। একেকজনের ভালো লাগার কারণ একেক রকম। নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিকের লেখাও যে সবার ভালো লাগবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

আর কে নারায়ণের প্রত্যেকটি উপন্যাস কালোত্তীর্ণ, কিন্তু সেভাবে জনপ্রিয় নয়। জনপ্রিয় হবার উপাদান চেতন ভগত খুব ভালো করেই জানেন কীভাবে পাঠকপ্রিয় হওয়া যায়। তাঁর লেখার ভাষা, ঘটনার বর্ণনা, সংলাপ পড়ার সময় মনে হয় বই নয়, সিনেমা পড়ছি। সিনেমার বিজ্ঞাপনের মতো করেই তিনি তাঁর বই প্রকাশের আগে বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করেন।

চেতন ভগতের সবগুলি বই থেকেই সিনেমা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি নিজেও সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেন। তাঁর প্রথম বই Five Point Someone অবলম্বনে আমির খানের বিখ্যাত সিনেমা Three Idiots তৈরি হলেও সেই সিনেমাতে চেতন ভগতকে সেভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তারপর থেকে তিনি অনেক বেশি সতর্ক। নিজে সরাসরি যুক্ত থাকেন চিত্রনাট্য তৈরিতে।

তার উপন্যাসগুলির লক্ষ্য থাকে ইংরেজিপড়ুয়া তরুণ উচ্চমধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পাঠকদের মন জয় করা। আধুনিক প্রেম, যৌনতা, এবং ভারতীয় তরুণরা যেসব  সমস্যার সামনে প্রায় প্রতিদিন পড়ে – সেগুলিকেই তুলে আনেন কাহিনি-বিন্যাসে, বর্ণনায় এবং সংলাপে।

তাঁর সাম্প্রতিক বইগুলি সরাসরি থ্রিলার। The girl in room 105, One arranged murder, এবং 400 days  - রোমাঞ্চকর থ্রিলার গোত্রের। কেশব আর সৌরভ – দুই বন্ধু – গোয়েন্দা। অপেশাদার গোয়েন্দা। এদেরকে দিয়েই জটিল রহস্যের সমাধান করিয়ে নিচ্ছেন চেতন ভগত। কেশবের জবানীতেই ঘটনা এগোয়।

400 days এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একটি বারো বছরের মেয়ের অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। দাদাবাড়ির নিরাপদ বাড়ি থেকে রাতের বেলা উধাও হয়ে যায় আলিয়া-মনীশ দম্পতির বারো বছর বয়সী কন্যা সিয়া। রাতের বেলা নিজের ছোট বোন সুহানা আর চাচাতো ভাইদের সাথে এক রুমে ঘুমিয়েছিল সিয়া। কিন্তু সকালে দেখা গেলো সিয়া উধাও। কেউ জানে না সে কোথায়। কেবল সুহানা বললো রাতে কেউ একজন এসে ছুরি দেখিয়ে সিয়াকে নিয়ে গেছে। সুহানার বয়স মাত্র পাঁচ। সে ঘুমের ঘোরে কী দেখেছে ঠিকমতো বলতেও পারে না। আলিয়া-মনীশ অত্যন্ত ধনী ব্যবসায়ী। টাকা-পয়সা প্রভাব-প্রতিপত্তির অভাব নেই। কিন্তু পুলিশ-গোয়েন্দা কেউই কিছু করতে পারলো না। ধরে নেয়া হয় যে সিয়াকে মেরে ফেলা হয়েছে। সবাই হাল ছেড়ে দিলেও সিয়ার মা আলিয়া হাল ছেড়ে দেয় না। আলিয়া মেয়ের খোঁজ করার জন্য কেশব আর সৌরভের সাহায্য চায়। মূলত কেশবেরই সাহায্য চায়। কেশব সৌরভকেও কাজে লাগায়।

প্রচলিত গোয়েন্দা-কাহিনীর চেয়ে চেতন ভগতের স্টাইল কিছুটা ভিন্ন। এখানে আলিয়া ও মনীশের প্রেম-কাহিনীর বিশদ বিবরণ আছে। আবার কেশব আর আলিয়াও পরস্পর প্রেমে পড়ে যায়। এই প্রেম ভারতীয় রক্ষণশীল টাইপের প্রেম নয়। উদ্দাম ইওরোপিয়ান স্টাইলের প্রেম – যেখানে মনের সাথে, অনেকটা মনের আগেও শরীর এগোয়। শরীরের ব্যাপারে কোন ধরনের জড়তা দেখা যায় না চেতন ভগতের নায়ক-নায়িকাদের। সে রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সতেরো বছরের মেয়ে আলিয়া হোক – কিংবা ত্রিশ বছরের গৃহবধূ আলিয়া হোক।

তবে এখানেও আছে প্রচলিত পদ্ধতি – কেউই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়, আবার শেষপর্যন্ত দেখা যায় – যার দিকে সন্দেহের তীর কম ছোড়া হয়েছে সে-ই দোষী। তবে ভারতীয় পুলিশকে যেরকম অদক্ষ প্রমাণ করা হয়েছে – জানি না এত বাস্তব সমস্যার সমাধান তারা কীভাবে করেন।

চেতন ভগতের লেখা পাঠককে টেনে রাখে এটাই সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর লেখার। আর কোন নতুন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। 400 Days স্বতন্ত্র কিছু নয়, রহস্যও আহামরি রকমের কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নয়। কিন্তু তাঁর ভাষা চমৎকার। অহেতুক বর্ণনার বাহুল্য নেই। সেন্স অব হিউমার অসাধারণ।

কিন্তু গল্পের বিচার করলে বলতে হয় - আজকাল ভালো গোয়েন্দা গল্পের অভাব দেখা দিয়েছে, নাকি গোয়েন্দাগল্প বেশি পড়ার কুফল বুঝতে পারছি না। 



Wednesday, 13 April 2022

ডার্ক ম্যাটার রহস্য - গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে

 



গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে – একটি টানটান উত্তেজনাকর রহস্যোপন্যাসের নাম হতে পারে সহজেই। কিন্তু নামের দ্বিতীয় অংশটা পড়েই বোঝা যায় বইটি বিজ্ঞানের। মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির রহস্য রহস্যোপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর। তবে পার্থক্য হলো – রহস্যোপন্যাসের শেষে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়, কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের রহস্য এখনো অনেকটাই রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।

ডার্কম্যাটারের রহস্যময়তাকে কোন গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার না করে বাংলার সহজিয়া বিজ্ঞানের বইতে তুলে আনার ব্যাপারটা খুব কঠিন। এই কঠিন কাজটিই অবলীলায় করে ফেলেছেন লেখক আবদুল গাফফার। পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয়সমূহের সহজীকরণ করেন যাঁরা – তাঁরা বোঝেন কাজটা কতটা কঠিন। তারজন্য প্রচুর পড়তে হয়, খাটতে হয়। এই বইটি লিখতে গিয়ে লেখক যে প্রচুর খেটেছেন, পড়াশোনা করেছেন, সেই পাঠ থেকে সারবস্তু তুলে এনে তাঁর পাঠককে দিয়েছেন তা এই বইয়ের সাতাশটি পরিচ্ছেদের প্রত্যেকটিতেই স্পষ্ট।

বাংলায় লিখতে গেলে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটা হয় – সেটা হলো যথাশব্দ খুঁজে বের করা। ইংরেজিতে ডার্ক ম্যাটার বললে পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা সবার কাছে সমানভাবে বোধগম্য -  ‘কৃষ্ণবস্তু’ কিংবা আরো সহজ বাংলায় ‘কালো পদার্থ’ বললে তা সবার কাছে সমান অর্থবোধক হয় না। তাই শব্দ প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা একটা বড় সমস্যা বাংলায় বিজ্ঞান লেখার ক্ষেত্রে। গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে – বইতে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিকে বাংলা নামে না ডেকে লেখক সঠিক কাজই করেছেন।

মহাবিশ্ব খুবই রহস্যময় জায়গা। রহস্যময়তার কারণ এখানে যতটা না দুর্বোধ্যতা – তার চেয়েও বেশি অদৃশ্যতা। পুরো মহাবিশ্বের শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগই এখনো মানুষের চেনা-জানার বাইরে রয়ে গেছে যার একুশ ভাগ ডার্ক ম্যাটার আর পঁচাত্তর ভাগ ডার্ক এনার্জি।

মহাবিশ্বের উপাদানের শতকরা মাত্র চারভাগ দৃশ্যমান পদার্থ দ্বারা গঠিত। দৃশ্যমান কথাটা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করলে আমরা যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে – মহাবিশ্বের যেসব পদার্থের উপর থেকে আলোর প্রতিফলন ঘটে আমাদের চোখে আসে। যেমন খালি চোখে আমরা আকাশের লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের আলো দেখতে পাই। অথবা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের মিথষ্ক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যান্ত্রিক উপায়ে দূর মহাকাশ থেকে পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করি। যেমন এক্স-রে কিংবা গামা-রে’র উপস্থিতি শনাক্ত করে হাজার আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের অস্তিস্ত্ব খুঁজে বের করা হচ্ছে। এসব অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেও এখনো দেখা সম্ভব হয়নি শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগ পদার্থ। মহাবিশ্বের এই বিশাল ভর এখনো রয়ে গেছে গুপ্ত। এই গুপ্ত মহাবিশ্বেরই খোঁজখবর দেয়া হয়েছে এই বইতে।

 সাতাশটি অধ্যায়ে ডার্ক ম্যাটারের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা হয়েছে এই বইতে। অধ্যায়গুলি ছোট ছোট – পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে যায় না, তথ্যভারাক্রান্তও মনে হয় না। বিজ্ঞানের বই তর তর করে পড়ে ফেলার বই নয়। বিজ্ঞানের বই – সে যে ভাষাতেই লেখা হোক না কেন, সেখানে বিজ্ঞান থাকবে। আর বিজ্ঞান পড়তে হলে মগজে চাপ পড়তেই হবে। এই বইটা পড়তেও পাঠককে সময় নিয়ে পড়তে হবে – সেটাই স্বাভাবিক। আমি বেশ সময় নিয়ে বইটি পড়েছি এবং পড়ে আনন্দ পেয়েছি।

প্রাচীন মহাবিশ্বের ধারণা থেকে শুরু করে আধুনিক মহাবিশ্বের মানচিত্রে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির স্থান কোথায় হতে পারে – সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমরা পেয়েছি এই বইতে। লেখক এ ব্যাপারে একটা সমন্বিত চিত্র বেশ ভালোভাবেই দিতে পেরেছেন।

প্রথমা প্রকাশন-এর বইগুলির অঙ্গসৌষ্ঠব উন্নত। ব্যবহৃত ছবিগুলি চমৎকারভাবে পরিষ্ফুটিত। কিন্তু সম্পাদনায় কিছুটা ত্রুটি রয়ে গেছে। এটা আমাদের প্রকাশনা জগতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে মনে হয় আমার। বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। আমি বইটির প্রথম সংস্করণ পড়েছি। হয়তো পরবর্তী সংস্করণে এসব ত্রুটি সংশোধিত হয়ে গেছে। আরেকটি দুর্বলতা হলো ছবিগুলিতে কোন নম্বর দেয়া নেই, কিন্তু বর্ণনায় বলা হয়েছে “চিত্র-৩ এর মতো” বা ২ নম্বর ছবির মতো ইত্যাদি (পৃষ্ঠা ৬৫)। আবার অধ্যায়গুলির কোন গাণিতিক পরিচয় নেই – অথচ কোন কোন জায়গায় উল্লেখ আছে “চতুর্দশ অধ্যায়ে বলেছিলাম … (পৃষ্ঠা ১৩৯), ১১তম অধ্যায়ে দেখেছি… (পৃষ্ঠা ১০৬) ইত্যাদি। ছবিগুলির লেবেলিং বাংলায় করা হয়েছে – সেটা খুব ভালো হয়েছে। তবে ৯২ পৃষ্ঠার স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ছবিটি জার্মান ভাষায় রয়ে গেছে।

কিছু কিছু ইংরেজি শব্দের সঠিক পরিভাষা আমাদের নেই – যেমন নয়েজকে বাংলায় গোলমাল বললে যা বোঝা যায় – তার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের নয়েজের কোন মিল নেই। পদার্থবিজ্ঞানে আমরা নয়েজ বলতে বুঝি – আনওয়ান্টেড ইনফরমেশান; অর্থাৎ অনাকাঙ্খিত সিগনাল। সেখানে গোলমাল বললে অর্থটা গোলমেলে হয়ে যায়। একই ভাবে স্লিট (slit) শব্দের অর্থ ‘ছিদ্র’ বললেও অর্থ বদলে যায় (পৃষ্ঠা ৮৩)

আরো টুকটাক কিছু কিছু বিষয় আরেকটু বিস্তৃতভাবে এলে ভালো হতো – যেমন বলা হয়েছে “ফার্মি টেলিস্কোপে সংযুক্ত আছে বিশাল আকারের এক চুম্বক। এই চুম্বক গামা রশ্মিকে ভেঙে ইলেকট্রন আর পজিট্রন জোড়ায় পরিণত করে ফেলতে পারে।“ (পৃষ্ঠা ১৪৩)  কিন্তু এটুকু বললে একটা সমস্যা থেকে যায়। তা হলো গামা রশ্মির উপর চৌম্বকক্ষেত্রের কোন প্রভাব নেই। সেক্ষেত্রে ঘটনাটা কীভাবে ঘটে তা পুরোটা ব্যাখ্যা করা দরকার।

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির আদ্যোপান্ত বইটি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।


Latest Post

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

  যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হ...

Popular Posts